ক্ষেত্র ব্রতকথা
এক ব্রাহ্মণের ছেলে পাঁচ বছরের হতেই তার বাপ মারা যায়। তার মা ছেলেটি নিয়ে ভাই-ভাজের ঘরে এসে রইলেন। ননদ আসতেই ভাজ দাসী ছাড়িয়ে দিলেন, রাখাল ছাড়িয়ে দিলেন। ছেলেটি ছাগল, গোরু চরায়। তার মা গোয়াল কাড়ে, সমস্ত পাট-ঝাঁট করে, রেঁধে রাখে; ভাজ সকলকে ভাত দেন। ছেলেটি একটু বড়ো হতেই তার মামা ডেকে বললেন, ‘ওরে বিশে! চাষ করতে পারবি? না বসে বসে অন্ন ধ্বংসাবি?’ বিশু বললে ‘পারব মামা।’ তখন মামা হাল-হেলে কিনে দিলেন, বিশু চাষ করতে লাগল। বিশু সারাদিন চাষে খাটে, কোদাল পাড়ে, কাঠ কাটে, কিন্তু খেটেখুটেও পেটভরে খেতে পায় না। ভাতের ওপর একটু তরকারিও পায় না। মায়ের প্রাণে কত সয়! কেবল চোখের জল মোছেন, আর ভগবানকে ডাকেন। ছেলেটি সকাল হলে গোরু, ছাগল, ভেড়া নিয়ে, লাঙল ঘাড়ে করে মাঠে চলে যায়। কে জানে শীত, কে জানে বর্ষা, কে জানে রোদ, ছেলের বিশ্রাম নেই। একটু বেলা হলেই মায়ের প্রাণ ছটফট করতে থাকে। তার মা মুড়ি, চালভাজা, চিঁড়ে, মুড়কি, মূলা, কাঁকুড়, শশা যে দিন যা হয়, তাই নিয়ে এক ঘটি জল নিয়ে সেই মাঠে গিয়ে দিয়ে আসেন। বিশু ক্ষেত্রদেবীকে নিবেদন না-করে খায় না। মা ছেলের গায়ের ঘাম মুছিয়ে, মুখে লক্ষ লক্ষ চুমু খেয়ে, গলায় কাপড় দিয়ে মা ক্ষেত্রদেবীকে সঁপে দিয়ে বাড়ি আসেন। বলেন, ‘হে মা ক্ষেত্রদেবী! দুখিনীর ধন আমার বিশুকে তুমি রক্ষা কর।’ মা বাড়ি চলে আসেন, বিশু বেলা আড়াই প্রহরের সময় আসে, দুটি পাতের-নাতের যে যা না খেতে পারে, তাই খেয়ে বিশু আবার মাঠে যায়। ব্রাহ্মণের ছেলে লাঙল করে বলে, সকলে তাকে ‘লাঙলে বিশে’ বলে ডাকে।
একদিন লাঙলে বিশু ভাত খেতে পারছে না দেখে তার মা দুধ থেকে সর তুলে দিয়েছিলেন। বিশুর মামি চটে লাল, মুখে যা এল তাই বললেন। ভালো জ্বালা হয়েছে, ভালো আপদ হয়েছে, ঘরে কিছু থাকবার যো নেই। দুধের সরটুকু পর্যন্ত আহ্লাদে ছেলেকে খাইয়ে রেখেছেন। স্বামীকে সব কথা চৌগুণ মাত্রায় বাড়িয়ে বলা হল। আর বলেন, ‘দেখো! ওদের পেছনে মাসে কত বেশি খরচ পড়ে, তার চাইতে চাষি, চাকর রাখলে কত কাজ পাওয়া যায়।’ এই কথা শুনে বিশুর মামার মাথা ঘুরে গেল। তার পরদিন বিশুকে আর কাজে যেতে দিলেন না, বিশুর মাকেও কোনো কাজে হাত দিতে দিলেন না।
সে দিন অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষের শনিবার; বিশু ও বিশুর মা দুজনে কিছুই খেতে পায়নি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে মাঠে বসে কাঁদছে। এমন সময় ক্ষেত্রদেবী বৃদ্ধ ব্রাহ্মণীর বেশে লাঙলা বিশুকে দেখা দিয়ে বললেন, ‘বিশু, তোমার শাপে বর হয়েছে বাছা! তুমি কেঁদো না। এই ধান কয়টি নিয়ে মুদির দোকানে যাও; চিঁড়ে মুড়কি এনে খেয়ে ওই যে জলার ধারে কুঁড়েঘরটি দেখা যাচ্ছে, ওই ঘরে দুই মায়ে বেটায় আজ শুয়ে থাকোগে। আর এই বীজধানগুলি নিয়ে যাও। কাল সকালে উঠে ওই মাঠে ঘাটে সব ছড়িয়ে দিও, তাহলে আর তোমাদের কষ্ট থাকবে না।’ তখন বিশু বীজধানগুলি মায়ের আঁচলে ফেলে দিয়ে, অপর ধানগুলি নিয়ে দোকানে গেল। দোকানি মুড়ি, চিঁড়ে, মুড়কি, ছাতু, নাড়ু, দই, দুধ সব দিলে। সেইগুলি নিয়ে মাকে সঙ্গে করে কুঁড়েঘরে গেল। স্থানটি পরিষ্কার করে সেইগুলি সব ক্ষেত্রদেবীকে নিবেদন করে, মায়ে বেটায় অর্ধেক খেয়ে, অর্ধেক পরদিন খাবার জন্য রেখে দিলে। তার পরদিন স্নান করে শুদ্ধাচারে বীজধানগুলি ঘাটে মাঠে ছড়িয়ে দিলে। তারপর বাসি চিঁড়ে, মুড়কি যা ছিল, দুজনে খেয়ে শুয়ে রইল।
তার পরদিন সকালে মায়ে পোয়ে উঠে দেখে যে, এক দিনেই ধানের গাছ হয়েছে। কাছে গিয়ে দেখে ধানগাছে সোনার ধান ফলেছে। কতকগুলো লোক গিয়ে সেই দেশের জমিদারকে খবর দিলে। জমিদার সেখানে এসে, স্বচক্ষে দেখে বিশুর আদ্যোপান্ত বৃত্তান্ত সমস্ত শুনে আশ্চর্য হলেন। আর বিশুকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বিশুর পৈতা দিয়ে, তাঁর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে, সেইজমি বিশুকে যৌতুক দিলেন। বিশু সোনার ধান কেটে মরাই বাঁধলে; কতক হাটে বেচলে, কতক কুঁড়েঘরে তুলে রাখলে। বিশুর সুখ আর ধরে না। ক্রমে বিশুর খুব বড়ো বাড়ি আরম্ভ হল। দেশ-দেশান্তর থেকে রাজমজুর এসে খাটতে লাগল। ওখানে বিশু বাড়ি থেকে চলে আসায়, তার মামা-মামির লক্ষ্মী ছেড়েছে, ক্ষেত্রদেবী বিরূপ হয়েছেন। মামা মামি খেতে না-পেয়ে খাটতে বেরিয়েছেন। অপর গ্রামে এক নূতন জমিদার বাড়ি করছে শুনে সেখানে গেলেন। তাঁরা সেখানে খোয়া ভাঙছেন, তাগাড় মাখছেন, ইট বইছেন, এমন সময় বিশু দেখতে পেয়ে, মাকে বললে, ‘ওমা! সর্বনাশ হয়েছে, মামা-মামি খাটতে এসেছে। যাও, শীঘ্র ওঁদের আদর করে নিয়ে এস, ওঁরাই আমার ঐশ্বর্যের মূল।’
তখন বিশুর মা, দাসী পাঠিয়ে তাঁদের দুজনকে বাড়ির ভিতর আনালেন। বিশু ও বিশুর মাকে দেখে মামা-মামি কেঁদে ফেললেন। বিশু মামা-মামিকে প্রণাম করে সকল কথা জিজ্ঞাসা করলে। তারপর তাঁদের তেল মাখিয়ে, স্নান করিয়ে, গরদের কাপড় পরিয়ে, পঞ্চাশ ব্যঞ্জন ভাত খাইয়ে, কিছুদিন বাড়িতে রেখে আদর যত্ন করলে। আবার অগ্রহায়ণ মাস এল, শুক্লপক্ষ শনিবারে মামা-মামিকে দিয়ে ক্ষেত্রব্রত করালে। তারপর মামা-মামিকে ধনদৌলত দিয়ে, দাসদাসী সঙ্গে দিয়ে পালকি করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলে। ক্ষেত্রদেবীর কৃপায় মামা-মামির ক্ষেত্রভরা ধান হল, গোয়ালভরা গোরু হল, দাসদাসী, হাতি, ঘোড়া হল। কিছুদিন পরে মামা-মামি, বিশু আর বিশুর মাকে নিমন্ত্রণ করে বাড়িতে আনালেন, পঞ্চাশ ব্যঞ্জন ভাত, পিঠে পায়েস করে খাওয়ালেন। মামির সেদিন আর বিশুকে খাইয়ে আশ মেটে না। খাওয়ার কিছুক্ষণ পরে আবার মামি এক বাটি দুধ সর এনে বিশুর মুখে ধরে বললেন, ‘খাও বাবা! ওবেলা ভাত খেতে পারোনি, এইটুকু খাও।’ বিশু তখন হাসতে হাসতে বললে:
মামা মামির লাঙলা বিশু
জলার ধারে ঘর।
এখন কেন বিশুর মুখে
বাটি ভরা সর?
মামি তখন লজ্জায় মুখ তুলতে পারলেন না। এখন লাঙলা বিশুর হাতি, ঘোড়া, দাসদাসী, ধনদৌলত কিছুরই অভাব নেই। বিশু এখন বিশ্বনাথ। সেই থেকে বিশ্বনাথ আর তার মামা-মামি খুব ঘটা করে প্রতি বৎসর ক্ষেত্রব্রত করতে লাগলেন। সেই অবধি পৃথিবীতে ক্ষেত্রব্রত প্রচার হল।
ক্ষেত্রব্রত কথা সমাপ্ত।