ক্ষেত্রভূমি

ক্ষেত্রভূমি

ছেলেগুলো চলে যাওয়ার পর হাসপাতালটা ফের নিরিবিলি হয়ে গেল। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল একটা কাক বুঝি কারেন্ট খেয়ে পড়ে গেছে, তাকে ঘিরে চিৎকার করছে একশো কাক। এই গ্রামীণ হাসপাতালের চরিত্রটা এরকমই, হঠাৎ হঠাৎ হইচই শুরু হয়। বাকি সময়টা বেশ শান্ত। জানালা দিয়ে দেখা যায় গাছপালা। হাওয়া ঢেউ তোলে ধানখেতে৷ বড় রাস্তা অনেকটাই দূরে, বাস, অটোর আওয়াজ পর্যন্ত আসে না। নিরিবিলিতে অভ্যস্ত সৃজাদের তাই হইহট্টগোল হলে ভীষণ কানে লাগে।

একটু আগে যে দলটা এসেছিল, তাদের একজনের কাঁধে ছুরির আঘাত। ছ’টা স্টিচ করল সৃজা। কেসটা পুলিশকে জানানো উচিত ছিল। সেটাই আইন। এই প্রত্যন্ত গ্রামে এসব আইন মানতে গেলে, সুস্থ স্বাভাবিক শরীরে বাড়ি ফেরা যাবে না।

ছেলেগুলো ছিল বিলের ধারে মাস্তান-গুন্ডার দল। এদের মধ্যে হামেশাই মারপিট হয়। কেউ মাথা ফাটিয়ে এল, পা ভেঙে এল, বুলেট ইনজুরিও আসে। সৃজার সঙ্গে মৈনাকও থাকে অনডিউটিতে, এইসব কেস হ্যান্ডেল করতে চায় না। সৃজাকে বলে, বস্, তুমি যাও। লেডি ডাক্তার দেখলে ওরা খুব একটা তড়পায় না। ছেলে ডাক্তার হলে হাঙ্গামা করে বেশি।

কথাটা খানিকটা সত্যি, পুরোটা নয়। মৈনাক একটু নার্ভাস টাইপেরও আছে। ঝামেলাগুলো সামলায় বলে সৃজা মৈনাকের থেকে কিছু সুবিধেও পায়। প্রয়োজন পড়লে ডিউটি আওয়ার্স শেষ হওয়ার দু’-তিন ঘণ্টা আগে সৃজা বেরিয়ে আসতে পারে। মৈনাক একা আউটডোরের চাপটা নেয়। বছর দেড়েক হল সৃজাকে সপ্তাহে অন্তত দু’-দিন তিন-চার ঘণ্টা আগে ছুটি নিয়ে চলে যেতে হচ্ছে। বাবা খুবই অসুস্থ। বাবাকে দেখে ফিরতে হয় নিজের বাড়ি। হাসপাতাল, বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি সব মিলিয়ে অনেকটা রাস্তা। পুরো ডিউটি করতে হলে কিছুতেই সবদিক ম্যানেজ করা যেত না। সৃজা যেহেতু একমাত্র সন্তান, বাবা-মায়ের দিকটা তাকে ভালমতোই খেয়াল রাখতে হয়। ঠান্ডা মাথায় নিপুণ হাতে গুন্ডা বদমাশদের সেলাই ফোঁড়াই করতে পারলে, ছাড়পত্র পাওয়া যায় বাবাকে দেখতে যাওয়ার।

এরকম নিরুপায় পরিস্থিতিতে বাবার একটা কথা প্রায়ই মনে পড়ে। ডাক্তারি পাশ করার পর সৃজা এরকমই একটা প্রত্যন্ত গ্রামে পোস্টিং পেয়েছিল এবং বুঝেছিল গ্রাম থেকে সহজে তার রেহাই নেই। কলেজে ইউনিয়নে সক্রিয়ভাবে যোগ দেয়নি, লবিও করেনি, ভেবেছিল মহিলা বলে খুব একটা বাজে জায়গায় পোস্টিং দেবে না। ভুল প্রমাণিত হয়েছিল আন্দাজ। মন খারাপ হয়েছিল খুব। বাবা সান্ত্বনা দিয়েছিল এই বলে, এত ভেঙে পড়ছিস

কেন! তোর শিক্ষার সদব্যবহার গ্রামে গেলেই হবে। সব ডাক্তার যদি শহরে প্র্যাকটিস করতে চায় গ্রামের লোকগুলোকে কে দেখবে? ওখানে মন দিয়ে ডাক্তারিটা কর, দেখবি ওরা তোকে মাথায় তুলে রাখবে। শহরে এই সম্মানটা তুই পাবি না।

সৃজার এখন হাসি পায়, সম্মান না ঘেঁচু। গুন্ডাগুলো হুমকি দিয়ে চিকিৎসা করিয়ে নেয়। চার কিলোমিটার দূরে মফস্সল, নার্সিংহোম। সেখানে যাবে না। ওরা পুলিশ ডাকবেই। মস্তান-গুন্ডা বাদে এখানে যারা চিকিৎসা করাতে আসে, তারা হতদরিদ্র, সংখ্যাতে নগণ্য। একটু যাদের পয়সা আছে, গ্রামীণ হাসপাতালের ওষুধ, চিকিৎসক কোনওটার উপরই ভরসা করে না। গ্রাম পাত্তা দেয় না বলেই সৃজা আগেভাগে ছুটি পেয়ে বাবাকে দেখতে যেতে পারে। বাবার এসব আর জানা হল না। গত দু’-বছর ধরে ধীরে ধীরে ভুলে গেল সব। এখন অ্যালঝাইমারে অ্যাকিউট স্টেজ। নিজেকেও ভুলে গেছে। রোগটা ধরা পড়তে ছ’মাস লেগে গিয়েছিল।

ওয়াশরুম থেকে ফিরে আউটডোরে এসে বসল সৃজা। মৈনাক পেশেন্ট দেখছে। দুটি গ্রামের বউ। মৈনাক বলল, কোয়ার্টারে গিয়ে রেস্ট নিতে পারতে সৃজাদি। আমি তো এদিকটা দেখছি। সৃজা চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে আরাম করে বসে। বলে, নাহ ঠিক আছে। ঘরে ঢোকে হিতেনদা। বলে, চা আনি ডাক্তার দিদি?

ঘাড় হেলিয়ে অনুমতি দেয় সৃজা। একটা কোয়ার্টার সৃজার নামে এখানে অ্যালট করা আছে। রেস্ট নেওয়ার মতো খাট-বিছানাও রেখেছে সৃজা। নাইট ডিউটি থাকলেও বিশ্রাম নিতে যায় না বড় একটা। ভীষণ একা একা লাগে। আউটডোরের টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে নেয় একটু। মৈনাককে নিজের কোয়ার্টারেই থাকতে হয়। ওর আসল বাড়ি মালদা। সৃজার অবস্থা যদি মৈনাকের মতো হত চাকরিটা করা যেত না। তখন চেম্বার খুলে বসো। এত পাশটাশ করেও সেই দোকানদার। চিকিৎসার দোকান। কবে জমবে কোনও ঠিক নেই। ছেলেকে কার্শিয়াং-এর স্কুলে পড়ানো যেত না। সৃজা চাকরিটা করে বলেই বছরে দেড়লাখের ধাক্কাটা নিতে পারবে। টুপাইয়ের অ্যাডমিশন হয়ে গেছে। ওখানে ক্লাস ফাইভে ভরতি হল। এখন অবশ্য বাড়িতেই আছে, সামনের মাসে চলে যেতে হবে।

মৈনাক, সৃজাকে চা দিয়ে গেল হিতেনদা। মৈনাকের পেশেন্ট দেখা আপাতত শেষ। আউটডোর খালি। সৃজা আশা করছে মৈনাক তাকে বলবে, বাড়ি চলে যাও সৃজাদি, আর বসে থেকে কী করবে।

কোনও কোনও দিন বলে। তবে খুবই কম। সৃজাকেই বলতে হয়, মৈনাক রে, আজ একটু তাড়াতাড়ি যাব। বাবাকে দেখতে যেতে হবে— বলা তো নয় অনুরোধ করা। বারংবার অনুগ্রহ চাইতে ভাল লাগে না সৃজার। উপায় নেই। মৈনাক খুব প্রয়োজন ছাড়া আপত্তি করে না।

সৃজা অবশ্য আজ বাপের বাড়ি যাবে না। সোজা বাড়িতেই যাবে। আর কদিন বাদেই কার্শিয়াং চলে যাবে ছেলেটা, যতটুকু চোখভরে দেখে নেওয়া যায়। প্রণবের বাহ্যত ছেলেকে নিয়ে কোনও আদিখ্যেতা নেই। ও রোজ যেমন অফিস থেকে ন’টা, সাড়ে ন’টায় ফেরে, তেমনই ফিরবে। ততক্ষণ ইছাপুরের বাড়িতে টুপাই আর শাশুড়িমা। সৃজা যদি এখন

হাসপাতাল থেকে বেরোয়, বাড়ি ঢুকতে দু’ঘণ্টার উপর। এখান থেকে অটো করে স্টেশন, ট্রেনে ব্যান্ডেল হয়ে নৈহাটি, ফের ট্রেন। চা খাওয়ার পর উসখুস করছে সৃজা। মৈনাক মন দিয়ে পত্রিকার পাতা ওলটাচ্ছে। এখনও বলছে না যেতে। সম্ভবত অনুরোধ করাটাকে উপভোগ করে। ঠিক আছে, সৃজাও এবার থেকে গুন্ডা-মস্তানদের দলকে সামলাতে যাবে না।

মোবাইলটা টেবিলে রেখেছিল সৃজা। কাঁপছে, আলো জ্বলছে। অপারেশনে যখন যায় ভাইব্রেট মোডে করে রাখে। মোবাইল কাঁপলে ইদানীং বুকও ধড়ফড় করে সৃজার, নির্ঘাত মায়ের ফোন। বাবা কিছু একটা ঘটিয়েছে।

কী হল, ধরো। বলল, মৈনাক। ভাইব্রেশনের চাপা গোঁ গোঁ আওয়াজ ওর কানেও পৌঁছেছে। ফোনসেট তোলে সৃজা। যা ভেবেছিল, স্ক্রিনে ‘মা’ লেখা। কানে দেয় ফোন। বলে, কী হল।

ও প্রান্তে মা বলে, তোর বাবা আজ মারাত্মক কাণ্ড শুরু করেছে, ঘর ভাসিয়েছে পেচ্ছাপ করে। পা দাপাচ্ছে সেই জলের উপর।

শেফালি কী করছে? বাথরুমে নিয়ে যেতে পারেনি কেন? ওকে রাখা হয়েছে কী জন্য? ঝাঁজিয়ে উঠে প্রশ্নগুলো করে সৃজা। বেলুড়ে বাবার ঘরটা এখন যেন সে দেখতে পাচ্ছে।

সৃজার বিরক্তি প্রকাশে মা আজকাল তেমন গা করে না। বলে যাচ্ছে, চারটে শেফালি এলেও তোর বাবাকে এখন সামলাতে পারবে না। ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে শেফালিকে। গায়ে অসুরের শক্তি। আমি চেপে শোওয়াতে গেলাম, হাত চালিয়ে দিল মুখে। পেচ্ছাপ মাখা হাত।

গা ঘিনঘিন করে ওঠে সৃজার। নিজেকে ধাতস্থ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে, যাকে নিয়ে কথা সে তার বাবা, জন্মদাতা, গলা স্বাভাবিক পরদায় রেখে মাকে বলে, এরকম তো আগেও করেছে। এত অধৈর্য হয়ে পড়ছ কেন?

তোর চোখের সামনে এসব ঘটলে, কত ধৈর্য থাকে দেখতাম। মায়ের গলায় রাগ। সৃজার মাথা গরম হতে থাকে। বলে তুমি তা হলে কী করতে বলো? চাকরি, সংসার ছেড়ে বাবার কাছে গিয়ে বসে থাকি?

আমিই বা কী করব বলো? সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। দু’-দিন ধরে চান করানো যায়নি। শেফালি জোর করে চান করাতে গেলে মরা কান্না জুড়ে দিচ্ছে। আশপাশের বাড়ির কাছে মাথা কাটা যাচ্ছে আমার।

মা, এটুকু কষ্ট তো তোমাকে সহ্য করতেই হবে। আফটার অল তোমার সঙ্গে বাবার সম্পর্কটা সবচেয়ে কাছের।

তোর সঙ্গে বুঝি খুব দূরের? লোকটা যখন সুস্থ ছিল, বাবা বলতে অজ্ঞান ছিলিস তুই। এখন নিজের সুবিধে মতো দূরের হয়ে যাচ্ছিস। বাহ!

মায়ের ভর্ৎসনা শুনে গলা চড়ে সৃজার, কী যা তা বলছ! বাবার জন্য কী করিনি আমি। কলকাতায় স্যারেদের কাছে গিয়ে দেখাইনি? শেফালির মতো কস্টলি আয়া রেখেছি। তারপর ওষুধপত্র, টেস্ট… কোনটা বাদ রেখেছি শুনি?

ওতেই সন্তানের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। রুটিন করে সপ্তাহে দু’-দিন দেখতে আসিস। আমি কী নরক-যন্ত্রণার মধ্যে কাটাচ্ছি, সে একমাত্র আমিই জানি। এসময় তো আমার পাশে একটু বেশি বেশি থাকা উচিত ছিল তোর।

একটা মেয়ের পক্ষে এর চেয়ে বেশি সম্ভব নয়। শ্বশুরবাড়ি, চাকরি সামলে রোজ রোজ বাবাকে দেখতে যাওয়া…

কথা শেষ হওয়ার আগেই মা বলে ওঠে, কন্যা সন্তান কিন্তু আমরা চেয়ে আনিনি। এসে যখন পড়েছে, তাকে ভালভাবে মানুষ করার জন্য ভাবিনি দ্বিতীয় সন্তানের কথা। সেটাই তা হলে আমাদের ভুল। সে যাই হোক পারিস যদি আজ একবার আয়। ওষুধটষুধ কিছু পালটাবি কিনা দ্যাখ। ধৈর্যের এখন শেষ পরীক্ষা দিচ্ছি আমি। খুব তাড়াতাড়ি বাঁধে ফাটল ধরবে, সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে চলে যাব।

ফোন ছেড়ে দিল মা। সেট হাতে নিয়ে গুম মেরে বসে থাকে সৃজা। মৈনাক একপ্রান্তের কথা শুনে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝেছে। জানতে চায়, কন্ডিশন কি খুবই ডেটোরিয়েট করেছে?

ধীরে মাথা নাড়ে সৃজা। বড় একটা শ্বাস সহ বলে, এরকম তো হবেই এ রোগের ক্ষেত্রে। মা আসলে চাপটা নিতে পারছে না। মায়েরও তো বয়স হয়েছে।

একটু সময় নিয়ে মৈনাক বলে, তুমি আর বসে থেকে কী করবে। যাও একবার কাকাবাবুকে দেখে এসো।

সৃজা ঠিক করে উঠতে পারে না আজ বাবাকে দেখতে যাবে কি না। আপাতত হাসপাতাল থেকে বেরোনোর উদ্যোগ নেয়।

অটো চেপে, স্টেশনে এসে সৃজা সিদ্ধান্ত নেয়, বাবাকে দেখতে যাওয়া উচিত। ফোনে বলা মায়ের একটা কথা ওকে প্রায় ধাক্কা মেরে ডাউন প্ল্যাটফর্মে এনে ফেলল। সৃজার বয়ঃসন্ধির পর থেকেই মা রাখঢাক করে কথাটা প্রায়ই বলত, এখন বলে সরাসরি। তাকে ভালভাবে মানুষ করার জন্য বাবা-মা আর কোনও সন্তান আনেনি। কথাটা মিথ্যেও নয়, সামান্য কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের কর্মচারী হয়ে বাবা নিরন্তর পয়সা জুগিয়ে গেছে সৃজার পড়াশোনার জন্য। জয়েন্ট এনট্রান্সের প্রিপারেশনের সময় সৃজার পিছনে যা খরচা হত, গোটা সংসার চালাতে তার চেয়ে টাকা লাগত কম। বাবা কখনও ভাবেনি মেয়ে ডাক্তার হলেও আলটিমেটলি পরের বাড়িতে যাবে। সৃজাকে ডাক্তার করাটাই ছিল বাবার কাছে গর্বের বিষয়। বাবা গর্বিত হয়েছে। কিন্তু একটা না-ডাক্তার পুত্র সন্তানের কাছে যে সেবাটা পেতে পারত, সৃজার কাছে সেটা পাচ্ছে না। এক্ষেত্রে সৃজারই বা কী করার আছে? নারীজন্মটা তো তার হাতেও নেই। মা যে এসব বোঝে না তা নয়, বাবার রোগের প্রকোপে তিতিবিরক্ত হয়ে পড়ছে। না হওয়াটাই হত আশ্চর্যের। একটা চেনা মানুষ ব্যবহার করছে

অচেনার মতো। যে বাবা পাড়ায়, অফিসে, এমনকী বাড়িতেও কম কথা বলা শান্তশিষ্ট মানুষ ছিল, এখন অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে, আবোলতাবোল সে সব কথার কোনও যোগসূত্র নেই। রেগে গেলে রীতিমতো খিস্তি খেউড় করছে। গালাগালগুলো যে বাবার মুখ থেকে বেরোবে, দুঃস্বপ্নেও ভাবা যায় না। তারপর আছে গায়ে হাত তোলা। টয়লেটিং-এর সেন্স নেই। শেফালি আছে বলে রক্ষে। একটু অন্যমনস্ক হলেই ঘর-বিছানা নোংরা করে ফেলছে। এর মধ্যেও যে মায়ের মাথাটা ঠিকঠাক কাজ করছে, সেটাই বিরাট ব্যাপার। সৃজা যদি টানা এই পরিস্থিতির মাঝে কাটাত, পাগল হয়ে যেত নির্ঘাত।

মায়ের কথা ভেবে হাসপাতাল থেকে সোজা বেলুড়ের বাড়িতে চলে এসেছে সৃজা। জোর করে ভুলে থেকেছে ছেলেকে। বাপের বাড়িতে এসে ইদানীং সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটা হয়, আজও হয়েছে। বাড়ি জুড়ে ঝাঁজালো পেচ্ছাপের গন্ধ। সৃজা অনেকবার শেফালিকে বলেছে ভাল করে ফিনাইল দিস না কেন? বিচ্ছিরি গন্ধ হয়ে আছে। রুম ফ্রেশনারও দিবি। শেফালি বলে, দিই তো। ভাল করেই দিই ডাক্তারদিদি। শেফালি সৃজাদের হাসপাতালের টেম্পোরারি আয়া। যেমন আরও ছ’জন আছে। শেফালি বেস্ট। সৃজা বুঝে শুনে বাবাকে দেখাশোনার ভার দিয়েছে। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে শেফালি ও বাড়িতে ফাঁকি দেবে না। আসলে মা, শেফালি অভ্যস্ত হয়ে গেছে এসব গন্ধে। সৃজার সবচেয়ে অসুবিধে হয় মা কিছু খেতে দিলে। যেমন এখন দিয়েছে। সৃজার প্রিয় জিনিস, মায়ের হাতের সুজির হালুয়া। গলা দিয়ে নামতে চাইছে না। আজন্ম যে বাড়িতে খেয়েদেয়ে বড় হয়েছে, সে বাড়ির খাবার আজ গলা দিয়ে নামছে না, এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে। মনের অস্বস্তি মুখে যেন এসে না পড়ে, যথাসাধ্য চেষ্টা করে চামচ দিয়ে একটু একটু করে খেয়ে যাচ্ছে সৃজা। ডাইনিং টেবিলের উলটো দিকের চেয়ারে বসে আছে মা। চোখ না তুলেই সৃজা বুঝতে পারছে, বড় মমতার সঙ্গে মা সৃজার খাওয়া লক্ষ করে যাচ্ছে। সারাদিনের নানান যন্ত্রণার মাঝে মায়ের কাছে এটা একটা দুর্লভ মুহূর্ত। ফোনে যে মা কথা বলেছিল, এখনকার মায়ের সঙ্গে তার কোনও মিলই নেই। ডোরবেল শুনে দরজা খোলার পর সৃজাকে দেখে মায়ের মুখে পরম স্বস্তি নেমে এল। বলেছিল, আয়।

বাবার ঘরের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল মা। একটু কোলকুঁজো হয়ে গেছে, দিনে দিনে বয়সটাও ডবল বাড়ছে। ঘরে ঢুকে সৃজা দেখেছিল, বাবার একটা হাত দড়ি দিয়ে জানলার সঙ্গে বাঁধা। এ দৃশ্য আগেও দেখেছে সৃজা। ভায়োলেন্ট হয়ে উঠলে, এ ছাড়া আর কোনও রাস্তা থাকে না। দৃশ্যটা সহ্য করতে বেশ কষ্টই হয়। ঘরে ছিল শেফালি, বাবার হাতের দড়ি খুলতে খুলতে সৃজা জিজ্ঞেস করেছিল, মাঝে কোনও ওষুধটষুধ দিতে ভুলে যাসনি তো? অবস্থা হঠাৎ এত খারাপ হয়ে গেল কেন?

শেফালি বলেছিল, না দিদি, কোনও ওষুধ বাদ যায়নি। হিসেব দেখে নিন আপনি।

দড়ির একটা ফাঁস এমন করে বেঁধেছে, কিছুতেই খুলছিল না। শেফালি এসে খুলে দিল। সৃজা জানে, ওষুধ বাদ যাওয়ার কারণে বাবা ভায়োলেন্ট হয়নি। এ রোগের ধরনটাই এরকম, পেশেন্ট কখন কী আচরণ করবে কোনও ঠিক নেই। শেফালিকে একটু সতর্ক করার জন্যই কথাটা তুলেছিল সৃজা। বাবার ব্লাডপ্রেশার এবং অন্যান্য প্রাইমারি ব্যাপারগুলো সৃজা যখন

চেক করছিল, সামান্য একটু তেল মেরে বেশ কিছুক্ষণের জন্য ছুটি চেয়ে নিল শেফালি। বলল, দেখুন দিদি, আপনি আসাতে কেমন হাতখোলা অবস্থায় চুপটি করে শুয়ে আছে। ভিতর ভিতর জ্ঞান টনটনে। আপনি না থাকলেই আমাদের জ্বালায়।

একথার খানিক পরেই শেফালি বলেছিল, আপনি তো আছেন। আমি একটু বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।

শেফালির বাড়ি কাছেই। সৃজা না করেনি, বেচারি দিনরাত ডিউটি দিয়ে যাচ্ছে। দুপুরে ঘণ্টা দুয়েকের ছুটি পায়। শেফালি যে বলল, সৃজাকে দেখলে বাবা শান্ত থাকে, তা মোটেই নয়। মেয়ে যে এসেছে, বাবা জানেই না। সৃজা বাবার গাল থুতনি নেড়ে কতবার বলল, বাবা দেখো, আমি এসেছি। ও বাবা! বাবা, কেন তুমি ওরকম করছিলে? কেন জ্বালাচ্ছিলে মাকে। তুমি তো এরকম ছিলে না। আমরা তোমার প্রতি কী অন্যায় করেছি…

গলা ধরে আসছিল সৃজার, চোখে জল। মা পিঠে হাত রেখে তুলে নিয়ে এল তাকে। সৃজার কথাগুলো বাবার মস্তিষ্কের অজ্ঞাত কোনও স্নায়ুতে সামান্য অনুরণন তোলেনি। কথার তালে পড়েনি চোখের পাতা। বাবা কোনওভাবেই সৃজাকে চিনতে পারেনি। চেনার আগ্রহটাও অবশিষ্ট নেই। সৃজাকে দেখে তাই শান্ত হয়ে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। সৃজা যখন রাত জেগে পরীক্ষার প্রিপারেশন করত, সঙ্গে জাগত বাবা। ঘুমোতে যেতে বললে, বলত, আমি ঠিক আছি। তুই পড় না। সেই বাবা আজ চিনতে পারছে না। বাবাকে গন্ডগোল পাকাতে, চেঁচামেচি করতে সৃজা সত্যিই কম দেখেছে। কারণ, সে এ বাড়িতে সপ্তাহে মাত্র দু’দিন আসে। পুরো ঝড়টা যায় মা, শেফালির উপর দিয়ে।

খাওয়া হয়ে গেছে। টেবিলে প্লেট নামিয়ে জলের গ্লাসের দিকে হাত বাড়ায় সৃজা। মা বলে ওঠে, এবার কিছু একটা কর।

আবার সেই এক কথা। তবে এবারের আর্তিতে শ্রান্তিটাই বেশি করে ধরা দিল।

জল খেয়ে সৃজা বলল, আর কী করতে পারি বলো! কলকাতার দু’জন নামী নিউরোলজিস্টকে দেখালাম। দু’জনেই মেডিকেলে আমায় পড়িয়েছেন। যত্ন করে দেখেছেন বাবাকে। দুই স্যারের একই কথা প্রথমদিকে ধরা না পড়লে এ রোগের ইমপ্রুভমেন্ট সম্ভব নয়। ক্রমশ খারাপ হবে অবস্থা। সাপোর্টিং মেডিসিন দিয়ে যতটুকু যা সামলে রাখা যায়। এমনিতেই কিয়োরেবল নয় ডিজিজটা।

মা বলে, কিন্তু আমি যে আর পারছি না। তুই বাবাকে কতটুকু সময় আর দেখিস। যা তাণ্ডব শুরু করে আমাদের তো পাগল করে দেয়, পিছনের বাড়ির লাল্টুর মা না কোনওদিন তোর বাবার চেঁচানিতে হার্টফেল করে। হার্টের অসুখ ওর মায়ের। ওরা ভাল লোক বলে কিছু বলে না। লাল্টু তোর বাবার খোঁজ নেওয়ার ছল করে দু’-চারবার বলেছে, কাকাবাবুকে অ্যাসাইলামে রাখা যায় না? আমি বলেছি, না রে এ ধরনের রোগীর জন্য অ্যাসাইলাম নেই। বড়জোর নার্সিংহোমে রাখা যেতে পারে। সেখানে খরচও প্রচুর, বাড়ির মতো সেবাযত্নও পাবে না। ইদানীং বারান্দায় দাঁড়াতে অস্বস্তি হয় আমার, পাছে আশপাশের বাড়ির লোকের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়। তোর বাবার চিৎকারে তাদেরও তো কম অসুবিধে হচ্ছে না। আমি রোজ ভগবানকে ডাকি ওকে যেন তুলে নেয়। নয়তো আমাকেই নিক। সিঁদুর মাথায়

নিয়ে চলে যেতে রাজি আমি। তারপর ওর যা হয় হোক।

মায়ের কথাগুলো অস্বাভাবিক ঠেকছে না সৃজার কাছে। সৃজাও কি মনে মনে বাবার মৃত্যু কামনা করে না? মুখ ফুটে মায়ের মতো বলে ফেলে না, এটাই যা তফাত। আর মা তো বলবেই, বাবার সমস্ত ঝামেলা মাকেই সামলাতে হচ্ছে। শরীরও আর সঙ্গ দিচ্ছে না। সৃজা মাকে বাস্তব পরিস্থিতিটা বোঝায়, দেখো মা, বাবার এখন যা স্টেজ, স্ট্রং সিডেটিভ দিলে অনেকটাই ঝিমিয়ে যাবে। তখন দিনরাত বিছানায়। ওখানেই পেচ্ছাপ, পায়খানা। সেই অবস্থাটা তো আরও ভয়াবহ। পারবে সহ্য করতে?

ওই ওষুধটা আরও একটু বেশি করে দেওয়া যায় না? তাতে ওই লোকটার শান্তি, আমাদেরও রেহাই।

মা কী বলতে চাইছে, বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না সৃজার। অথচ বিশ্বাস হচ্ছে না। বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে, মা এতটাই ফেডআপ হয়ে গেছে!

অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় মা বলে, অত অবাক হয়ে তাকানোর কিছু নেই। আমি, অনেক ভাবনাচিন্তা করেই কথাটা বলেছি। তুই যদি টানা এ বাড়িতে সাতদিন থাকতিস, ডিসিশনটা নিজেই নিতিস।

সৃজা অনুভব করে তার শরীরের বেশ কিছু অনৈচ্ছিক পেশি নিজের মতো কাঁপতে শুরু করেছে। ভিতর ভিতর উত্তেজনা হচ্ছে ভীষণ। মায়ের প্রস্তাব উড়িয়ে দিতে পারছে না। তবু বলে, এটা হয় না।

কেন হয় না শুনি? যে লোকটাকে চিরনিদ্রায় পাঠিয়ে দেওয়ার কথা হচ্ছে, সে তোর বাবা নয়। সে অনেক দিন আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। ভুলে গেছে ইহজগতের সব কিছু। শুধু তার শরীরটা আছে বলেই তাকে সেবাযত্ন করে যেতে হবে? আমাদের অপরাধ তা

হলে ওটাই, আমরা তাকে ভুলতে পারিনি। তাই যদি হয়, সে আমাদের স্মৃতিতে থাক।

কপালের রগ দুটো দপদপ করছে সৃজার। টেবিলে রাখা গ্লাসে তলানি জল পড়ে আছে। তুলে নিয়ে গলায় ঢালে সৃজা। বলে, এসব করলে ধরা পড়ে যাব। ডেথ সার্টিফিকেট দেবে না ডাক্তার।

সার্টিফিকেট অন্য ডাক্তার দেবে কেন! তুই দিবি।

না মা, ডাক্তারি এথিক্সে এটা আমরা করতে পারি না।

কেন পারিস না। কোথায় আটকায়?

মা, বাবা এবং নিয়ারেস্ট কারও ডেথ সার্টিফিকেট আমরা লিখি না। ক্ষমতার সুযোগটা নিয়ে ডাক্তাররা সম্পত্তির কারণে নিকটজনকে মারতে পারে। এক্ষেত্রে ইনশিয়োরেন্স ক্লেম পেতেও অসুবিধে হয়। তারপর ব্যাপারটা নিয়ে কেউ যদি কোর্টে চ্যালেঞ্জ করে, মামলা অনেক দূর গড়াবে।

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে কী যেন ভেবে নিল মা, বলল, কে মামলা করবে, কেনই বা করবে? বাবার সমস্ত সম্পত্তি আমার পর তোর। আর কোনও ওয়ারিশ নেই। কে সার্টিফিকেট দিল, কেউ জানতেও আসবে না। তুই পাঁচ-সাতদিন ছুটি নিয়ে এখানে থাক, চোখের সামনে দেখ লোকটার কাণ্ড। ঘনঘন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে, এ বাড়িটা যেন ওর নয়।

প্রচণ্ড রাগ থেকেই যেন নোংরা করে দিচ্ছে বাড়িটা। তোর তখন নিজের থেকেই মনে হবে লোকটাকে ছুটি করে দিই। তাতেই সবচেয়ে শান্তি পাবে মানুষটা। দুপুরবেলা ওষুধটা দিবি, যখন শেফালি থাকে না। ও মারা গেলে পাড়ার লোককেও জানানোর দরকার নেই। পিছনের বাড়ির লাল্টুকে ডেকে বলব, শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। ও তো অপেক্ষা করে বসে আছে, কবে কাকাবাবু মারা যায়।

বার্নিংঘাটে গিয়ে আটকে যাব আমরা।

কী করে? জানতে চায় মা।

সৃজা বলে, মেয়ের সই করা সার্টিফিকেট দেখে গাঁইগুই করতে পারে। পুলিশ ডাকাও অসম্ভব কিছু না।

কীভাবে বুঝছে, তুই ওর মেয়ে? টাইটেল তো পালটে গেছে তোর। কেউ বলে না দিলে, ওরা কিছুতেই বুঝবে না। বলার মতো লোক আমরা সঙ্গে নিয়ে যাব কেন? এই একই কারণে ইনশিয়োরেন্সের টাকা পেতে অসুবিধে হবে না আমাদের।

অনেক বছর পর আজ আবার নতুন করে সৃজা বুঝতে পারল, সে এ বাড়ির নয়। পর হয়ে গেছে।

দিদি, আমি তা হলে এখন আসি।

পুরুষ কণ্ঠ। চমকে ঘাড় ফেরায় সৃজা। বাবা কখন জানি চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছে। আলুথালু পোশাক, মুখে অমায়িক হাসি। যেন বাইরের কোনও অতিথি। কণ্ঠস্বরও পালটে গেছে বাবার। মা চেয়ার ছেড়ে ওঠে।

বাবাকে ধরে ঘরে নিয়ে যেতে যেতে বলে, হ্যাঁ, আপনি তো এবার আসবেনই। রাস্তাঘাটে পড়ে গিয়ে হাত-পা না ভাঙলে আপনার শান্তি হবে কোথা থেকে?

নিত্যদিনের বকুনির সুরে কথা বলছে মা, কে বলবে একটু আগে বাবার মৃত্যুর নিখুঁত পরিকল্পনা সাজিয়ে গেছে। এই মা আজ হাসপাতালে ফোন করে খেয়াল করিয়ে ছিল, বাবার সঙ্গে সৃজার সম্পর্কটা মায়ের মতোই কাছের। একটু আগে বোঝাল, বিয়ে হয়ে পর হয়ে গেছে সৃজা। ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে কোনও অসুবিধে নেই। মাকেই এখন সবচেয়ে বেশি অচেনা লাগছে সৃজার। নিজের সুবিধেমতো নিরুত্তাপভাবে মত বদলে ফেলেছে। কষ্ট সয়ে সয়ে এতটাই নির্বিকার হয়ে যায় মানুষ! মুখে হাতচাপা দিয়ে কাঁদার চেষ্টা করে সৃজা, মনে হয় মাথার উপর বাবা, মা কেউ নেই। কিছুতেই কান্না আসে না।

এক সপ্তাহ পর সৃজা বাপের বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াল। এখন দুপুর। ডোরবেল টিপল সৃজা। এই কদিনে মা অনেকবার ফোন করেছে। আরও রেস্টলেসনেস বেড়েছে বাবার। এবারের ফোনগুলোয় মা কিন্তু একবারও আসতে বলেনি। বলেছে, আমি তোকে যেটা বলেছিলাম, সেটাই কর। তাতে মানুষটা বরং শান্তি পাবে। উপকারই করা হবে তার।

দরজা খুলল মা। সৃজার থমথমে মুখ দেখে যা বোঝার বুঝে গেল। বলল, শেফালি এইমাত্র বাড়ি গেল। তুই আসবি জানলে, এটা ওটা কিনতে পাঠিয়ে ওর ফেরাটা দেরি করাতে পারতাম।

শেফালিকে নিয়ে ভাবার কিছু নেই। ডাক্তারের এথিক্স ও বোঝে না। এখানকার বাঁধা চাকরিটা চলে যাবে, এটাই ওর কাছে সমস্যার। সৃজা না হয় হাসপাতালে শেফালির ডিউটি একটু বেশি করে অ্যালট করে দেবে, তাতেই ও খুশি। ডাইনিং-এর টেবিলে কাঁধব্যাগটা রাখে সৃজা। আজ আর বাথরুমে গিয়ে হাত-পা ধোয়ার দরকার নেই। ব্যাগ থেকে ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ আর সিডেটিভের অ্যাম্পুল বার করে। সিরিঞ্জে ওষুধ ভরতে ভরতে মাকে বলে, তুমি আমার সঙ্গে থাকবে।

আমার থাকার দরকারটা কী?

দরকার আছে, তোমাকে চোখের সামনে দেখতে হবে ঘটনাটা। আমি একা কেন পুরোটার দায় নেব।

ঠিক আছে। বলে চট করে কেমন রাজি হয়ে গেল মা! মানুষকে বাঁচানোর যে ম্যাক্সিমাম দাগটা আছে সিরিঞ্জে তার চেয়ে অনেক বেশি ভরে নিল সৃজা। বাবার ঘরের দিকে পা বাড়ায়। নিজেকে মনে হচ্ছে মানুষকে মৃত্যুদানের প্রথম প্রতিনিধি। লোকে এতদিন ভেবেছে, করে উঠতে পারেনি। আবার এমনও হতে পারে, এ ঘটনা অনেকবার ঘটেছে, কেউ জানতে পারেনি। যেমন জানতে পারবে না সৃজাদের ব্যাপারটা। কন্ডিশন ফুলপ্রুফ।

শোয়া অবস্থায় বাবা দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল, যেন অপেক্ষায় ছিল কারুর। সৃজা ঘরে পা দিতেই ধড়মড় করে উঠে বসার চেষ্টা করল। পারল না। কনুইয়ের ভরে আধশোয়া হয়ে বলে উঠল, আপনি এসে গেছেন, আসুন!

মেঝেতে পা গেঁথে যাচ্ছে সৃজার। কী করুণ, নিঃসহায়ের হাসি হাসছে বাবা। সৃজার হাত থেকে পড়ে যায় ওষুধ ভরা সিরিঞ্জ। ভাগ্যিস কাচের নয় বিচ্ছিরি শব্দ হত। সৃজা ছুটে গিয়ে বাবার বুকের উপর পড়ে। অঝোরে কাঁদতে থাকে। কান্না জড়ানো গলায়

মাকে বলে, বাবা আমাকে চিনতে পেরে গেল মা।

কোথায় চিনল! তোকে তো আপনি আজ্ঞে করছে। বিস্ময়ের গলায় বলল মা। বুঝতে পারল এ কাজ মেয়ের দ্বারা হবে না। চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। বোধহয় সৃজার জন্য চায়ের জল বসাতে।

সৃজা নিশ্চিত বাবা তাকে চিনতে ভুল করেনি। কত কষ্ট করে মেয়েকে ডাক্তার করেছিল, সেই এখন ফিরে এসেছে মৃত্যুদূত হয়ে। বাবার বুকে মুখ ঘষতে থাকে সৃজা। যেমন পরিণত ধানগাছ ঝড়ে লুটোপুটি খায় মাটিতে। বাবাকে আবার করে ফিরে পাচ্ছে সৃজা। বাবা বাবা গন্ধটা এখনও যায়নি। মাটি থেকে কি মাটির গন্ধ কখনও যায়?

শারদীয়া মাতৃশক্তি, ২০০৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *