ক্ষুদে গানরাজ

ক্ষুদে গানরাজ

স্যার, আপনি কি গান গাইতে জানেন?

না।

গান বোঝেন?

না।

রাগ বিষয়ে জ্ঞান আছে?

না।

মীড়, গমক, মূৰ্ছনা–এইসব কী?

জানি না কী।

তাহলে ক্ষুদে গানরাজের প্রথম বিচারক হলেন কী জন্যে?

এই প্রশ্নের একটাই উত্তর, ‘ভুল হয়ে গেছে। মানুষ হিসেবে ভুল করার অধিকার আমার আছে।’

মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন একবার শিশুদের কবিতা আবৃত্তির বিচারক হয়েছিলেন। ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স কুস্তি প্রযোগিতার বিচারক হয়েছিলেন।

ক্ষুদে গানরাজের আরেকজন বিচারকের নাম মেহের আফরোজ শাওন। সে আমার পরিচিত। সে গান জানে, গান বোঝে, রাগ জানে, মীড় গমক-মূর্ছনা জানে। এরকম একজন বিচারক পাশে থাকলে নির্ভয়ে থাকা যায়। তার আবার আমার প্রতি উচ্চ ধারণা। সে মনে করে আমার কান অত্যন্ত পরিষ্কার। গান ভালো হচ্ছে নাকি হচ্ছে না–এটা আমি অতিদ্রুত ধরতে পারি।

শাওন অন্য স্ত্রীদের চেয়ে আলাদা না। স্ত্রীরা নির্গুণ স্বামীর ভেতরও গুণ আবিষ্কার করে ফেলে।

বিচারকের দায়িত্ব পালন শুরু হলো। আমি কঠিন ভাইবা পরীক্ষা নিচ্ছি এরকম মুখ করে বসে থাকি। শাওন চাপা গলায় বলে, ভুরু কুঁচকে আছ কেন? বাচ্চাদের দিকে রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে আছ কেন? ওরা ভয় পাচ্ছে। আমার নিজেরই তোমার দিকে তাকাতে ভয় লাগছে, ওর ভয় পাবে না কেন!

আমি চাপা গলায় বললাম, ওরা আমাকে মোটেই ভয় পাচ্ছে না। তোমাকে ভয় পাচ্ছে। তুমি গানে ভুল ধরছ, আমি ধরছি না।

তুমি একজন বিচারক। ওরা ভুল করলে তুমি ধরবে না!

 আমি বললাম, ভুল ধরার যে ছাকনি আমার কানে আছে সেটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমি ভুল ধরতে পারছি না। যা শুনছি তা-ই মনে হচ্ছে শুদ্ধ।

পাঠকরা বলুন, যে বাচ্চাটি ক্লাস ওয়ানে উঠে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে তাল লয়-সুর ঠিক রেখে গান করছে আমি তার কী ভুল ধরব? ভুল ধরায় আমার কোনো আনন্দ নেই, আমার গান শোনাতেই আনন্দ।

মৃত্তিকা নামের যে মেয়েটি ক্ষুদে গানরাজের প্রধান সমন্বয়কারী তাকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি, আমার শহীদুল্লাহ হলের বাসায় সে তার বাবার হাত ধরে প্রায়ই আসত। এসেই দৌড়ে টয়লেটে ঢুকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ত বাথটাবে। তখন তাকে হাতি দিয়ে টেনে তোলাও ছিল অসম্ভব। এই মেয়েটি ছিল ক্ষুদে দস্যি। তানিশা নামের আরেকটি মেয়ে যে উপস্থাপনার কঠিন এবং বিরক্তিকর কাজটি হাসিমুখে করে তাকেও অতি শৈশব থেকে চিনি। সে আরেক দস্যি। তার প্রধান কাজ ছিল, বাইরে থেকে বাথরুমের ফুটো দিয়ে তাকিয়ে থাকা এবং কিছুক্ষণ পর পর বলা–দেখে ফেলেছি, দেখে ফেলেছি।

আসলে ক্ষুদে গানরাজে ঢুকে আমি ক্ষুদেদের জগতে ঢুকে পড়েছি। এতগুলি গানের পাখি আর দুজন একসময়কার ক্ষুদে দস্যিকে নিয়ে আমার যাত্রা। Alice in wonderland এর আশ্চর্য জগতে আমার বিচরণ।

জীবন শুকায়ে গেলে করুণাধারায় আশ্রয় নিতে হয়। রবীন্দ্রনাথ এই পরামর্শ দিয়েছেন। আমার জীবন শুকিয়ে যায় নি। সেই সম্ভাবনা একেবারেই নেই, তারপরেও আমি সুরের করুণাধারায় অবগাহন করতে পারছি এ আমার পরম সৌভাগ্য।

একটাই কষ্টকর ব্যাপার–বাচ্চারা যখন বাদ পড়ে যায়। কী অবাক দৃষ্টিতেই না তারা তাকায়। তাদের চোখের দৃষ্টি বলে দেয়-আমি এত সুন্দর করে গাইলাম আর তোমরা আমাকে বাদ দিয়ে দিলে! বড়দের জগতের নিষ্ঠুরতার পরিচয়ে তাদের ক্ষুদ্র ভুবন হয়ে যায় এলোমেলো। বাদ পড়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের প্রতি কিছু বাবা-মা অত্যন্ত হৃদয়হীন আচরণ করেন। একটি মেয়ে দর্শকদের ভোটের কারণে বাদ পড়ল। সে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। এর মধ্যে মঞ্চে উপস্থিত হলেন মেয়েটির মা। শুরু করলেন মার। কী আশ্চর্য কাণ্ড। তাঁর মেয়ে ক্ষুদে গানরাজ হবে এই স্বপ্নে মহিলার মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে। তিনি তা জানেন না।

আমাদের ষোল কোটি মানুষের দেশে যোজন ক্রিকেট প্লেয়ার নেই, ষোলজন ফুটবল প্লেয়ার নেই, আর এতগুলি গানের পাখি? আমি খুবই অবাক হই। অনুষ্ঠান শেষে বিস্ময়বোধ নিয়ে বাড়ি ফিরি, আবারও বিস্ময় নিয়ে পরের অনুষ্ঠানে যাই। কেউ কেউ বাদ পড়ে, ইয়েলো জোন বা ডেনজার জোনে চলে যায়। তারা গলা ফাটিয়ে কাঁদতে শুরু করে। তাদের কান্না দেখে প্রধান বিচারক মেহের আফরোজ কাঁদেন। একটা ইন্টারেস্টিং দৃশ্য হিসেবে ক্যামেরা তা রেকর্ড এবং প্রচার করে। আমি ক্যামেরার ব্যাপারটা জানি বলে নিজের চোখ আড়াল করি। শিশুরা কাঁদছে, তানিশা কাঁদছে। দুই বিচারক কাঁদছে। কোনো মানে হয়?

গানের পাখিদের একটির নাম রানা। সে অবশ্যি সারাক্ষণই হাসে। বাদ পড়ে গেলেও দাঁত বের করে হাসে। উচ্চারণ ভয়াবহ খারাপ। আমাকে ডাকে ছার, স্যার না। ছেলেটি খুলনা শহরে রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে ভিক্ষা করে বাবা-মার সংসার চালাতো। এখন ক্ষুদে গানরাজ হওয়ার সম্ভাবনা তার প্রবল। প্রথম দশজনের ভেতর সে চলে এসেছে ইউরোপ, আমেরিকায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতের হাতছানি এখনই তার জন্যে শুরু হয়েছে। তার জন্যে অপেক্ষা করছে অন্য এক জগত। যে জগত ভিক্ষাবৃত্তির জগত না।

আরেকটি ছেলের কথা বলি–নাম শান্ত মিয়া। বাড়ি পাবনা। তার মা বিড়ি বেঁধে দৈনিক নয় টাকা পায়। এতে মাতা-পুত্রের সংসার চলে। ছেলেটি প্রথম বারোজনের ভেতর চলে এসে বাদ পড়ল। আমাকে এবং শাওনকে কাঁদতে কাঁদতে বলল, এখন আমি কই যাব? মানুষের বাসাবাড়িতে কাজের ছেলের চাকরি নেওয়া ছাড়া আমার আর কোনো পথ নাই। আগেও কাজ করি খেতাম, এখনো খাব।

আমি তাকে বললাম, তোমার মাকে আমি নুহাশপল্লীতে একটা চাকরি দিতে পারি। তুমি থাকবে তোমার মা’র সঙ্গে। তোমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হবে। তুমি পড়াশোনা করবে। আগে পড়াশোনা তারপর গান। রাজি আছ?

শান্ত মিয়া বলল, স্যার আমি রাজি।

মাতা-পুত্র এখন নুহাশপল্লীতে আছে। শান্ত মিয়া ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়েছে। শান্ত মিয়া অবসর সময়ে একটা কঞ্চি হাতে নুহাশপল্লীতে একা একা ঘুরে বেড়ায়। নিজের মনের আনন্দে গান করে—আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানিরে…

উকিল মুন্সির বিখ্যাত বিচ্ছেদি গান। তাঁর গান নুহাশপল্লীর বৃক্ষদের স্পর্শ করে। মানুষের কষ্ট সবার আগে টের পায় বৃক্ষরাজি। এই তথ্য আমরা জানি না।

পাদটিকা

Failure is very difficult for anyone to bear, but very few can manage the shock of early success.
—Maurice Valency (পরাজয় সহ্য করা সবার জন্যেই কঠিন, আবার শুরুতেই সাফল্যের ধাক্কাও অনেকেই হজম করতে পারে না।)

কুইজ

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে নালিশ গেছে। ভুল-ভাল উচ্চারণে জনৈক উর্দুভাষী (হিন্দিও হতে পারে) গায়ক তার দু’টা বিখ্যাত গান রেকর্ড করে ফেলেছে। রেকর্ড দুটি এই মুহূর্তে প্রত্যাহার করা উচিত।

রবীন্দ্রনাথ মন দিয়ে রেকর্ড শুনে বললেন, গায়কের কণ্ঠের মাধুর্যে উচ্চারণের ক্রটি ঢাকা পড়ে গেছে। রেকর্ড দু’টা থাকবে।

গায়কের নাম কী?

উত্তর : কে. এল. সায়গল (গায়ক এবং অভিনেতা)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *