ক্ষাত্র উপবীত – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
অবাক চোখে চারপাশে তাকিয়ে দেখছিল ছেলেটা৷ কী বিশাল বিশাল সব প্রাসাদ! মন্দির! আর ওই যে সোনালি রঙের স্তম্ভটা দাঁড়িয়ে আছে, সেটা যেন আকাশ ছুঁতে চায়! এই প্রাসাদ মন্দির, মিনারের মাঝে মাঝে রয়েছে ছোটো ছোটো সরোবর৷ এই পাহাড়ের মাথায় জল কোথা থেকে আসে কে জানে! এমনিতেই এ দেশের সমতলে জলের দেখা তেমন মেলে না, চারপাশে শুধু ধু-ধু বালিয়াড়ি৷ আর গাছ বলতে কাঁটা ঝোপ৷ কিন্তু এখানে সরোবরও আছে আবার গাছও আছে৷ বিশেষত কুল, আম আর অশ্বত্থ গাছ৷ আর এখানের লোকজনের সাজপোশাকের কী জেল্লা! মাথায় সোনার তবক লাগানো পাগড়ি, পরনে জরির কাজ করা কুর্তা, তলোয়ারের খাপের গায়ে রূপোর কারুকাজ৷ এমনকী দুর্গ প্রাকারের গায়ে পায়ে চলা পথে যে সব সৈনিকরা বর্শা হাতে টহল দিচ্ছে তাদের পোশাকের জেল্লা দেখলেও অবাক হয়ে যেতে হয়৷ এর আগে একবার বেদনার প্রাসাদ দেখেছিল বাচ্চা ছেলেটা৷ কিন্তু কোথায় সেই বেদনার প্রাসাদ আর কোথায় এই চিতোর! এখানকার প্রাসাদগুলোর এক-একটা মহলই এত বড়ো যে তার মধ্যে বেদনার প্রাসাদ ঢুকে যায়৷ আর শরহটাও তেমনই বড়ো৷ চারপাশে দেখতে দেখতে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছেলেটা৷ কিন্তু কিছুতেই যেন শেষ হচ্ছে না নগরীটা৷ রাজপথেও বহু মানুষের ভিড়৷ কেউ ঘোড়ার পিঠে, কেউ ঝালর দেওয়া শিবিকায়, কেউ-বা উটের পিঠে বা পদব্রজে এদিক-ওদিক যাচ্ছে৷ ঘুরতে ঘুরতে একসময় বেশ খিদে পেয়ে গেল ছেলেটার৷ যে ভারবাহী খচ্চরের দলের সঙ্গে সে এই দুর্গনগরীতে এসেছে তাদের সঙ্গে থাকলে নিশ্চয়ই খাবার মিলত৷ কিন্তু এ নগরীর একটার পর একটা তোরণ অতিক্রম করতে করতে তারা যে কখন কোথায় হারিয়ে গেছে খেয়াল নেই ছেলেটার৷ তাতে অবশ্য খুব বেশি ক্ষতি নেই ছেলেটা বা ভারবাহী পশুগুলোর মালিক-এ দুই পক্ষের কারোরই৷ বেদনারের রাস্তায় কিছু দিন আগে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ছেলেটা৷ ভারবাহী পশুদের তাড়িয়ে নিয়ে চলার একজনের প্রয়োজন ছিল৷ তাই এই অনাথ ছেলেটাকে পশু তাড়ানোর কাজে খাদ্যের বিনিময়ে নিয়োগ করেছিল লোকটা৷ দু-তরফের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাস এইটুকুই৷
কিন্তু এখন কী করবে সে? বেশ খিদে পাচ্ছে যে তার? রাস্তার পাশে তাঁবুর নীচে বসে ছিল এক বৃদ্ধ দোকানি৷ অনেকটা বাধ্য হয়েই জিজ্ঞেস করল তাকে, ‘এখানে বিনে পয়সায় খাবার কোথায় পাওয়া যাবে?’
বিত্তশালী চিতোর নগরীতে কোনো ভিখারি নেই৷ লোকটা তাই একটু বিস্মিত হল ছেলেটার কথা শুনে৷ কিন্তু তার পোশাক, বিশেষত মাথার ছোট্টো পাগড়ির ধরনটা দেখে সে অনুমান করল ছেলেটা ভিনদেশি৷ কারণ চিতোরে ওভাবে কেউ পাগড়ি বাঁধে না৷ চিতোরে ভিখারি না থাকলেও একটা লঙ্গরখানা আছে৷ কারণ বিশাল মেবার প্রদেশের রাজধানী পর্বত নগরী চিতোরে বহু দূর দূর থেকে রোজ বহু মানুষ আসে নানা কাজে৷ তাদের খাবারের ব্যবস্থার জন্য বিনা পয়সার এই লঙ্গরখানা৷ লোকটা ছেলেটাকে বাতলে দিল তার রাস্তা৷ বিশাল আয়োজন সেখানে৷ গনগনে বিরাট চুল্লিতে বিশাল বিশাল হাড়ি বসানো৷ চাটুতে রুটি সেঁকা হচ্ছে৷ যারা সেখানে দাঁড়িয়ে তারা অবশ্য একটু অন্তজ শ্রেণির ভিনদেশি৷ ঘোড়ার সহিস, মুটে, উট চালক এসব লোকেরাই৷ খাবারের পাত্র রাখা ছিল তা নিয়ে লোকগুলোর সঙ্গেই দাঁড়িয়ে পড়ল ছেলেটা৷ দু-তিন রকম পদে বেশ পেটপুরে খাওয়া৷ অনেকদিন পরে পেটপুরে খেল ছেলেটা৷ এক ফাঁকে সে এ কথাটাও একজনের থেকে জেনে গেল যে এ লঙ্গরখানা প্রতিদিনই চলে৷ যত ইচ্ছা খাও কোনো পয়সা লাগবে না৷ বাঃ বেশ ভালো ব্যাপার তো৷ মনে মনে বেশ উৎফুল্ল হল ছেলেটা৷ ‘এত সুন্দর নগরী, তার ওপর খাওয়ার আয়োজন৷ বেদনারের রাস্তায় তো তাকে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হয় খাবারের জন্য৷ এক-একসময় এক-দু-দিন কোনো খাবারই মেলে না৷ এখানে রয়ে গেলেই তো হয়৷-ভাবল ছেলেটা৷
লঙ্গরখানা থেকে বেরিয়ে একটা সরোবরের সোপানে বসে জল খেয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিল সে৷ তারপর আবার বেরোল নগর পরিক্রমায়৷ বিকাল বেলা সে উপস্থিত হল নগরীর সেই মাঠে৷ যেখানে আকাশ ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল স্তম্ভটা৷ সেটার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে ভাবার চেষ্টা করছিল স্তম্ভটা কী করে বানানো হয়েছে! কিন্তু তার চিন্তাজাল ছিন্ন হল একটা কলরবে৷ সে তাকিয়ে দেখল তারই বয়সি দশ-বারো বছরের ছেলের দল তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে৷ তাদের হাতে কাঠের তলোয়ার৷ এই অপরিচিত জায়গায় রাজপুত বালকরা তাকে ঘিরে ধরায় প্রথমে বেশ ভয় পেয়ে গেল ছেলেটা৷ কিন্তু একজন তাকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘আমরা যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলব৷ দলে একজন কম পড়েছে৷ তুই খেলবি আমার সঙ্গে?’
সঙ্গেসঙ্গে যে হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, খেলব৷ আমার নাম চন্দ্র৷’
তার পোশাক দেখে কেমন সন্দেহ হওয়ায় একজন তাকে প্রশ্ন করল, ‘তুই কি ক্ষত্রিয়? শাক্তবৎক্ষত্রিয় নাকি চন্দ্রাবৎ?’ এসব কিছুই চন্দ্রর জানা নেই৷ তাই সে একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘তা তো জানি না৷ আমি এসেছি বেদনার প্রদেশ থেকে৷’
অপর একজন বলল, ‘জানিস না৷ আচ্ছা তোর গলায় কি আমাদের মতো উপবীত আছে? রাজপুত ক্ষত্রিয়দের উপবীত থাকে৷’
চন্দ্র জবাব দিল, ‘না, নাই৷’
ছেলেরা সবাই বলল, ‘তাহলে তুই ক্ষত্রিয় নস৷ আমরা ক্ষত্রিয় ছাড়া কারও সঙ্গে খেলি না৷ তোকে খেলায় নেব না৷’-এ কথা বলে প্রথমে তফাতে চলে গেল তারা৷ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্য একটা ক্ষত্রিয় ছেলেকে জুটিয়ে নিয়ে বিজয়স্তম্ভর নীচে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলতে শুরু করল৷ একটু দূরে দাঁড়িয়ে বিমর্ষ হয়ে তাদের খেলা দেখতে লাগল চন্দ্র৷ আর মনে মনে ভাবতে লাগল, ‘ইস, আমার যদি ওদের মতো একটা উপবীত থাকত . . .’
চিতোরেই রয়ে গেল চন্দ্র৷ হাতিশালে হাতির খাবার দেবার কাজ পেয়ে গেল, সেখানে মাথা গোঁজার স্থানও পেয়ে গেল সে৷ তবে রোজ বিকালে বিজয়স্তম্ভর চত্বরে যাওয়া একটা নেশার মতো পেয়ে বসল তাকে৷ আসলে সেটা যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলাতে যোগ দেবার টান৷ রোজ সেখানে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলে ছেলেরা৷ আর সূর্যাস্ত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে সে খেলা দেখে চন্দ্র৷ সে ভাবে হয়তো আজ তাকে খেলার জন্য ডাকবে ছেলেরা৷ চন্দ্র নিজের জন্য একটা কাঠের তরবারি বানিয়ে নিয়েছে, সেটা নিয়েই সে আসে৷ কিন্তু খেলার ডাক আর তার আসে না৷ তার যে ক্ষত্রিয় উপবীত নেই৷
এভাবেই দিন চলছিল৷ কিন্তু হঠাৎ দ্রুত পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করল৷ সারা নগরীতে হঠাৎ কেমন যেন চাপা উত্তেজনার সৃষ্টি হল৷ একদিন চন্দ্র কার কাছে যেন শুনল যে মহারানা উদয় সিংহ নগরী ছেড়ে পালিয়েছেন! তবু মাঠে আসছিল ছেলেরা৷ চন্দ্রও যাচ্ছিল খেলায় যোগ দেবার আশায়৷ কিন্তু একদিন রাতে হঠাৎ কামানের গর্জনে ঘুম ভেঙে গেল চন্দ্রর৷ সে শুনতে পেল কেল্লার বুরুজ থেকে মন্ত্রীরা চিৎকার করছে, ‘তুর্কি এসেছে!’ তুর্কি এসেছে! তারপর থেকেই মুহুর্মুহু কামানের গর্জনে কেঁপে উঠতে লাগল শান্তির চিতোরগড়৷
চন্দ্র মাঠে গিয়ে দেখল ছেলেদের আসা বন্ধ হয়েছে সেখানে৷ পথে সেই ছেলেদের দলের একজনের সঙ্গে দেখা হল তার৷ সে চন্দ্রকে জানাল, ‘যবন আকবর হানা দিয়েছে৷ খেলা নয়, আমরা এবার সত্যি যুদ্ধ করব৷’ চন্দ্র তাকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল-‘আচ্ছা, সত্যি যুদ্ধ করতেও কি উপবীত লাগে? নইলে আমিও যুদ্ধে যাব৷’ কিন্তু তার আগেই সে চলে গেল৷
সত্যিই ক-দিনের মধ্যে শুরু হল ভয়ংকর যুদ্ধ৷ যে মাঠে ছেলের দল যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলত সেখানে সাজানো হতে লাগল সার সার চিতা৷ যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা নয় সত্যি যুদ্ধ শুরু হয়েছে যে!
২
কেল্লা নগরীর ভিতর অন্ধকার নেমেছে অনেক আগেই৷ কিন্তু এ জায়গাটা আলোকিত৷ বিজয় স্তম্ভর সামনের চত্বরে সার সার অগুনতি চিতা জ্বলছে৷ রাজপুত কুলের শৌর্যবীর্যের প্রতীক মহারানা কুম্ভর তৈরি এই প্রাচীন বিজয়স্তম্ভ৷ যে বিজয়স্তম্ভর মাথায় দুধ ঢালা হত তা এখন শকুনের আবাসস্থল৷ আর তার সামনে যে চত্বরে যুদ্ধ জয়ের পর উৎসব হত সেখানে তখন ফুলের বদলে সাজানো হয়েছে গণচিতা৷ চিতা অবশ্য আরও একটা জায়গাতে অবিরাম ভাবে সবার অলক্ষে জ্বলছে৷ ওই যে কিছুটা দূরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে মহারানা কুম্ভ নির্মিত বিশাল প্রাসাদ, ওরই একজায়গা থেকে সিঁড়ি নেমে গেছে মাটির গভীরে, সেই ভূগর্ভস্থ প্রকোষ্ঠে জ্বলছে এক অনির্বাণ চিতা৷ জহরব্রত পালন করে সেই অগ্নিকুম্ভে ঝাঁপ দিচ্ছে রাজপুত রমণীরা৷ মাটির ওপর-নীচে সর্বত্রই শুধু জ্বলছে চিতার আগুন৷ মহারানা বাপ্পার চিতোরগড়, মহারানা কুম্ভর চিতোরগড়, মহারানা সংগ্রাম সিংহর চিতোরগড়৷ সেই চিতোরগড় আজ শ্মশানে পরিণত৷ তুর্কি আকবর তাকে শ্মশানে পরিণত করে দিয়েছেন৷ অন্ধকার শ্মশানভূমিতে বসে ভালো করে কান পাতলে মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে বাদ্যযন্ত্রর শব্দ! আসলে ও শব্দ ভেসে আসছে পাহাড়ের নীচে মোগল তাঁবু থেকে৷ ইতিমধ্যে বিজয় উৎসবের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে সম্রাট সেনারা৷ আর তো মাত্র দু-তিন দিনের অপেক্ষা৷ আর তারপরই তো কেল্লা নগরীর দখল নেবে তারা৷ এমনও হতে পারে হয়তো-বা কালই কেল্লার বুরুজগুলো থেকে নেমে যাবে শীশদীয় রাজপুতদের জ্বলন্ত সূর্য চিহ্ন আঁকা রাজপতাকা৷ সেখানে উড়বে মোগল সম্রাটের বিজয় কেতন৷ সব শেষ, সব শেষ!
মহারানা উদয়সিংহ তো কবেই পালিয়েছেন কেল্লা ছেড়ে৷ বলদর্পী তুর্কি সম্রাটের মুখোমুখী লড়াই করার সাহস কাপুরুষ উদয় সিংহর ছিল না৷ তবু রাজপুতরা লড়াইটা চালিয়ে গেছে দীর্ঘ দিন ধরে৷ না, তারা লড়াইটা উদয় সিংহর হয়ে লড়ছে না, লড়ছে মাতৃভূমির সম্মান রক্ষার জন্য৷ রাজপুত কুলের শৌর্যবীর্যের প্রতীক এই চিতোরগড়৷ এ মাটিতেই একদিন জন্মেছিলেন মহারানা কুম্ভ, মহারানা সংগ্রামসিংহর মতো যোদ্ধারা৷ যাঁদের পুজো করে রাজপুতকুল৷ আর সে জন্যই তো আমন্ত্রণ না জানালেও এই দারুণ দুর্যোগের দিনে এই মরুপ্রদেশের রাজারা নিজের থেকেই এসে উপস্থিত হয়েছিলেন চিতোর রক্ষা করার জন্য৷ এসেছিলেন চন্দ্রাবৎ রানা শহিদাস ও তাঁর সেনারা৷ যতক্ষণ তিনি জীবিত ছিলেন ততদিন একজন মোগল সেনাও সূর্যতোরণ অতিক্রম করতে পারেনি৷ শহিদাসের মৃত্যুর পর তোরণ রক্ষা করতে এগিয়ে এলেন সংগ্রামের বংশধর নাদোরিয়ার রাবৎদুদা, তারপর দুই সামন্তরাজা বিজলিরাজ মাদ্রি ও প্রসাররাজ ঝালাপতি, তারপর বেদনার প্রদেশের রাজা জয়মল্ল ও কৈলবারের বালক শাসনকর্তা ষোলো বছরের পুত্র৷ একে একে তাঁরা সবাই শহিদ হলেন৷ ফাঁকা হয়ে গেছে কেল্লা৷ একত্রিশ হাজার রাজপুতবীরের মৃত্যু হয়েছে এই যুদ্ধে৷ চিতার আগুনের আলো মাঝে মাঝে গিয়ে পড়ছে বিজয়স্তম্ভের কিছুটা পিছনে৷ একটা স্তূপ চোখে পড়ছে আগুনের আলোতে৷ সাদা রঙের স্তূপ৷ কোনো বৌদ্ধ স্তূপ নয় ওটা৷ রাজপুত ক্ষত্রিয়রা উপবীত ধারণ করে৷ উপবীত পোড়ানো যায় না৷ তাই চিতাতে ওঠাবার আগে মৃতদেহের গা থেকে উপবীত খুলে নেওয়া হয়৷ সেইগুলো জমতে জমতেই ওরকম স্তূপের আকার নিয়েছে৷
বিজয়স্তম্ভর ভিত্তি-বেদিটা বেশ উঁচু৷ তারই গায়ে আধো-আলোছায়াতে বসেছিলেন বৃদ্ধ মৈঁদাস ও তাঁকে ঘিরে জনা পঞ্চাশেক লোক৷ আধো-অন্ধকারে মৈঁদাসের হাত দুটো বুকের কাছে গোটানো মনে হলেও তাঁর হাত দুটো কাটা গেছে যুদ্ধে৷ বিষণ্ণ ভাবে জ্বলন্ত চিতাগুলোর দিকে চেয়েছিলেন তিনি৷ অন্যরা চুপচাপ মাথা নীচু করে বসে ভাবছিল চিতোরের ভবিতব্যের কথা৷ একসময় মৌনতা ভঙ্গ করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বৃদ্ধ মৈঁদাস বললেন, ‘কাল কী হবে? সূর্যোদয়ের সঙ্গেসঙ্গেই নিশ্চই আকবর তার হস্তী বাহিনী নিয়ে হানা দেবেন তোরণ ভাঙার জন্য৷ আমরা মাত্র কয়েকজন লোক৷ শিশু আর যে ক-জন নারী বেঁচে আছে তাদের আরাবল্লির পার্বত্য অঞ্চলে পৌঁছে দেবার জন্য রাতের অন্ধকারেই কিছু লোককে কেল্লা ত্যাগ করতে হবে৷’
তার কথা শুনে মাধবরাও নামে একজন সৈনিক বলে উঠল, ‘তবে কোনো আশাই কি আর নেই?’
একটু চুপ করে থেকে বৃদ্ধ বললেন, ‘আশা একটা আছে৷ কল্পি গ্রামের ইসমাইল তার তিরন্দাজ বাহিনী নিয়ে দেশ রক্ষার জন্য আসছে৷ তবে তাদের আসতে সম্ভবত আগামীকাল সন্ধ্যা নেমে যাবে৷ যুদ্ধ যতক্ষণ শেষ না হচ্ছে, যতক্ষণ পর্যন্ত একজন রাজপুতও জীবিত আছে ততক্ষণ বলা যাবে না সব শেষ৷ সামান্য একটা তিরও অনেক সময় যুদ্ধের ফলাফল বদলে দেয়৷ যেমন আফগান মুলুকে বন্দি অন্ধ রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহানের একটা তির ফুঁড়ে দিয়েছিল সমুদ্রসমান সেনার ঘেরাটোপে দাঁড়িয়ে থাকা মহম্মদ ঘোরির বুক৷ কে বলতে পারে ইসমাইলের একটা তির তুর্কি সম্রাটকে ছিটকে ফেলবে না সাকিরার পিঠ থেকে৷’
এ কথা বলার পর সৈনিকদের দিকে তাকিয়ে মৈঁদাস বললেন, ‘যেভাবেই হোক কাল সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তোরণ রক্ষা করতে হবে আমাদের৷ কাল কে তোরণ রক্ষার দায়িত্ব নেবেন বলুন? কে নেবেন কাল সেনাপতির দায়িত্ব?’
প্রশ্নটা তিনি করলেন, কিন্তু সমবেত জনতা মাথা নীচু করে রইল৷ কোনো জবাব মিলল না৷
মৈঁদাস আবারও প্রশ্ন করলেন, ‘কাল সূর্যতোরণ রক্ষা করার কে সেনাপতি হবেন বলুন? তখন তাকে সেনাপতি পদে অভিষিক্ত করব আমরা৷’ এবারও নিশ্চুপ রইল জনতা৷ যুদ্ধে একটা তিরই ভাগ্য বদলে দিতে পারে ঠিকই, কিন্তু তা অনেকটা দৈব ঘটনার মতো৷ কাল সামান্য ক-জন সেনা নিয়ে আকবরের হস্তী বাহিনী আর সমুদ্র সমান সেনার মুখোমুখি হয়ে তোরণ রক্ষার দায়িত্ব নেওয়া মানে নির্ঘাত মৃত্যু৷’
সৈনিকদের থেকে আবারও সাড়া না পেয়ে মৈঁদাস উঠে দাঁড়িয়ে তার কনুই থেকে কাটা বাহু দুটো ওপরে তুলে বললেন, ‘আমার যদি দুটো হাত থাকত তবে আমি সেনাপতির দায়িত্ব নিতাম৷ কিন্তু হাত ছাড়া তো তলোয়ার ধরা যায় না, তির ছোড়াও যায় না৷ বলুন এই শেষ লড়াইতে কে সূর্যতোরণ রক্ষা করবেন? মাতৃভূমির সম্মান রক্ষার জন্য আত্মবিসর্জন দিতে প্রস্তুত হবেন?’
তৃতীয় বারের প্রশ্ন শুনেও নিশ্চুপ রইল জনতা৷
বৃদ্ধ মৈঁদাস এবার সেনাদের উজ্জীবিত করার জন্য বললেন, ‘আপনারা কি ভুলে গেলেন সেনাপতি রাঠোর জয়মলের কথা, যাঁর এক-পা কামানের গোলায় উড়ে গেলেও তিনি দুর্গপ্রাকারে দাঁড়িয়ে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করে গেলেন যতক্ষণ না রক্ত ক্ষরণে মৃত্যু নেমে এল তাঁর? ভুলে গেলেন নাদোরিয়ার বীর রাববদুদার কথা? তলোয়ারের কোপে তাঁর মাথা নেমে গেলেও তার কবন্ধ দেহ ছুটে গিয়ে একসঙ্গে তিনজন মোগলকে বর্শা বিদ্ধ করেছিল৷ ভুলে গেলেন বালকবীর পুত্তর সে দিনের লড়াইয়ের কথা? ষোলো বছরের বালকবীর পুত্তর সঙ্গে লড়াইয়ে সেদিন পিছু হটতে হয়েছিল বহু যুদ্ধের নায়ক স্বয়ং আকবরকে৷ অথবা পাদন তোরণ রক্ষা করতে গিয়ে শহিদ হওয়া দুই ভাই গোরা-বাদলের কথা?’ নিশ্চুপ রইল সৈনিকরা৷
মৈঁদাস বলে যেতে লাগলেন, ‘শুধু কি পুরুষেরা? পুত্তর মৃত্যুর পর তলোয়ার হাতে তার বারো বছরের বালিকা বধূ আর পুত্ত-জননী যে ভাবে এ যুদ্ধে তলোয়ার হাতে লড়াই করে শহিদ হলেন তার কি কোনো তুলনা আছে ইতিহাসের পাতায়? অথবা তাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে যে ছ-হাজার রাজপুত বীরাঙ্গনা মোগলদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জীবন উৎসর্গ করলেন ভাবুন তাদের কথা৷ কত নামী-অনামী রাজপুত নর-নারী মাতৃভূমির সম্মান রক্ষার জন্য প্রাণ দিলেন এ যুদ্ধে৷ কত মানুষের ত্যাগ, কত আত্মবলিদান . . .৷’
মৈঁদাসের কথা শুনে শুনে অনেক সৈনিকের চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল ঠিকই, কিন্তু কেউ সাহস করে উঠে দাঁড়িয়ে বলতে পারল না, ‘আমি কাল যুদ্ধে নেতৃত্ব দেব৷ তোরণ সামলাব৷’
দীর্ঘক্ষণ ধরে সৈনিকদের উজ্জীবিত করার চেষ্টায় যখন কোনো ফল হল না তখন বৃদ্ধ মৈঁদাস বলে উঠলেন, ‘ছিঃ ছিঃ, আপনারা এত কাপুরুষ! এত হীনবীর্য ভাবতে আমার লজ্জা হচ্ছে৷ ওই যারা চিতার আগুনে পুড়ে স্বর্গে যাচ্ছেন তাঁরা ওপর থেকে আমাদের অভিশাপ দেবেন আমাদের এই ভীরুতার জন্য৷ না, না, এ কলঙ্কের বোঝা কিছুতেই বহন করতে পারব না আমি৷ আপনারা যখন কেউ তোরণ রক্ষার দায়িত্ব নিতে চাইছেন না তখন এ দায়িত্ব আমিই নেব৷ তোরণের মাথায় আমি উঠে দাঁড়াব৷ ওপর থেকে পা দিয়ে নুড়ি-পাথর ফেলব মোগলদের ওপর৷ জানি এটা হাস্যকর চেষ্টা মোগলদের রোখার জন্য৷ ওদের একটা তিরই আমাকে ছিটকে ফেলবে নীচে৷ কিন্তু মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমি জেনে যাব যে রাজপুত ভীরু কাপুরুষ নয়৷’-প্রচণ্ড উত্তেজিত ভাবে কথাগুলো বলে তিনি শেষ বারের জন্য বললেন, ‘এখনও জানতে চাইছি যে তোরণ রক্ষার দায়িত্ব কেউ নেবেন?’
তাঁর শেষ প্রশ্নেরও কোনো জবাব মিলল না৷
লজ্জায়, ক্ষোভে, কাঁপতে কাঁপতে মৈঁদাস একবার ঘৃণায় মাটিতে থুতু ফেললেন৷ তারপর তিনি এগোতে যাচ্ছিলেন লোকগুলোর সঙ্গ ত্যাগ করার জন্য৷ ঠিক এমন সময় কে যেন বলে উঠল, ‘আমি তোরণ রক্ষা করতে রাজি৷ সেনাপতি হতে রাজি৷’
কথাটা কানে যেতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন মৈঁদাস৷ কে বললেন কথাটা? তিনি তাকালেন সৈনিকদের দিকে৷ না তারা কেউ কথাটা বলেনি৷ যেদিক থেকে কথাটা ভেসে এসেছে তারা বিস্মিত ভাবে তাকিয়ে আছে সে দিকে৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখান থেকে বেরিয়ে এল একজন৷ স্তম্ভ বেদির আড়ালে দাঁড়িয়ে সে এতক্ষণ সৈনিকদের কথোপকথন শুনছিল৷ তবে তাকে দেখে বিস্মিত হয়ে গেল সবাই৷ লোক নয়, একটা বারো-তেরো বছরের বাচ্চা ছেলে৷ মৈঁদাসের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বেশ বলিষ্ঠ ভাবে সে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি যুদ্ধ করতে রাজি৷’
মৈঁদাস বেশ অবাক হয়ে তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কে? কোথায় থাক? এই শ্মশান ভূমির অন্ধকারে কী করছ?’
ছেলেটা জবাব দিল, ‘আমার নাম চন্দ্র৷ বেদনার থেকে এখানে যুদ্ধের আগে এসেছিলাম ভারবাহী খচ্চরের সঙ্গে৷ আমার কেউ নেই৷ এখানকার লঙ্গরখানায় খাবারের ব্যবস্থা দেখে এখানেই রয়ে গেছি৷ আর ফিরিনি৷’
ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলেন মৈঁদাস৷ ছেলেটার ছিপছিপে কালো চেহারা৷ পাগড়ির আড়াল থেকে চুল নেমে এসেছে কাঁধ পর্যন্ত৷ চিতোরের অনেক বালকই যুদ্ধে অংশ নিয়ে শহিদ হয়েছে৷ বালকবীর পুত্ত তো যুদ্ধে একদিন আকবরকেও পিছু হটতে বাধ্য করেছিল৷ কিন্তু এ বালক তো তাদের চেয়েও অনেক ছোটো, নেহাতই শিশু বলা যায় একে৷ কিন্তু এ বালক কোনো দৈব বালক না তো? চিতোরের রক্ষাকর্তা একলিঙ্গজি এই বালকের রূপ ধরে তাদের সামনে আবির্ভূত হননি তো?-এ কথা ভেবে নিয়ে মৈঁদাস বললেন, ‘সত্যি তুমি কালকের যুদ্ধে সেনাপতি হতে রাজি? জানো তো যে, সেনাপতি হলে যে পরিস্থিতিই হোক না কেন সূর্যাস্তের আগে তোরণ ত্যাগ করা যাবে না৷’ চন্দ্র জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, রাজি৷ তবে আমার একটা শর্ত আছে৷’
শর্ত! কী শর্ত ছেলেটার? চিতোরের সিংহাসন দাবি করে বসবে নাতো? সে শর্তেও অবশ্য আপত্তি নেই এখন আর কারও৷ এ ছেলেটা যদি কাল তোরণ রক্ষা করতে পারে, ইসমাইল আসার পর যুদ্ধর গতি প্রকৃতি ঘুরে যায়, চিতোর আবার তার ক্ষমতা ফিরে পায় তখন ও ছেলেটার সিংহাসনের ওপর দাবি পলায়মান হীনবীর্য রানা উদয় সিংহর চেয়ে কোনো অংশে কম হবে না৷ তাই মৈঁদাস হেসে বললেন, ‘কী শর্ত? চিতোরের সিংহাসন?’ ছেলেটা হেসে জবাব দিল, ‘না, আমি রানা হতে চাই না, ক্ষত্রিয় হতে চাই৷ ক্ষাত্র উপবীত ধারণ করতে চাই৷’
শর্তটা শুনে বিস্মিতভাবে মৈঁদাস বললেন, ‘তুমি ক্ষত্রিয় নও? যুদ্ধে অবশ্য ক্ষত্রিয় না হলেও কিছু এসে যায় না৷ ভীলেরা এ যুদ্ধে লড়েছে৷ তারা ক্ষত্রিয় নয়৷ কাল তিরন্দাজ বাহিনি নিয়ে ইসমাইল আসবে৷ সে তো ক্ষত্রিয় কেন, হিন্দুও নয়৷ মাতৃভূমি রক্ষার জন্য ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র, হিন্দু-মুসলিম আমরা সামিল হয়েছি আকবরের বিরুদ্ধে৷’
ছেলেটা এবার একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আমার বংশ পরিচয় আমি জানি না৷ তবে আমার গলায় ক্ষাত্র উপবীত না থাকার কারণে ছেলেরা আমাকে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলতে নেয় না৷ ওটা আমার চাই৷ তবে আমি কাল সেনাপতি হব৷’
অন্য সময় হলে মৈঁদাস হয়তো ছেলেটার কথা শুনে হেসে ফেলতেন, কিন্তু পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে তিনি হাসলেন না৷ কাল ইসমাইল আসার আগে পর্যন্ত চেষ্টা করতে হবে তোরণ আগলাবার৷ তা সে যত ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাই হোক৷ তবে তিনি শেষ বারের জন্য চন্দ্রকে সতর্ক করে বললেন, ‘যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা আর সত্যি যুদ্ধ এক নয়৷ কাল তোরণ রক্ষা করতে গিয়ে তোমার মৃত্যুও হতে পারে৷ তুমি ভেবে বলছ তো?’
চন্দ্র জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, ভেবে বলছি৷ শুধু ক্ষাত্র উপবীত আমার চাই৷’
মৈঁদাস বললেন, ‘তবে তাই হোক৷ যুদ্ধে আমার পাঁচ পুত্ররই মৃত্যু হয়েছে৷ আমার উত্তরাধিকারী কেউ নেই৷ উপস্থিত এই নগরবাসীকে সাক্ষী রেখে, চিতার আগুনে ওই যে যারা স্বর্গে যাচ্ছেন তাদের আশীর্বাদ নিয়ে ঘোষণা করলাম আমি তোমাকে আমার পুত্র হিসাবে গ্রহণ করলাম৷ আমার পদবি, উত্তরাধিকার তোমার ওপর বর্তাল৷’ এ কথা বলার পর মৈঁদাস একজন সৈনিককে কাছে ডেকে মৈঁদাসের উপবীতটা খুলিয়ে পরিয়ে দিলেন চন্দ্রর গলায়৷ অজ্ঞাত পরিচয় চন্দ্র হল, ‘চন্দ্র মৈঁদাস৷’
খুশিতে চন্দ্রর চোখ-মুখ আধো অন্ধকারেও ঝলমল করে উঠল৷ যুদ্ধ তো একদিন শেষ হবেই৷ আবার খেলতে আসবে ছেলেরা৷ তখন আর কেউ ফেরাতে পারবে না আমাকে৷-মনে মনে এ কথা ভেবে উৎফুল্ল হল চন্দ্র৷
কিছুক্ষণের মধ্যেই চন্দ্রর হাতে কুশ বেঁধে, হাতে তলোয়ার ধরিয়ে মৈঁদাসের নেতৃত্বে চিতোরের সেনাপতি হিসাবে বরণ করে নিল সবাই৷
মৈঁদাস সহ সবাই একসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘জয় একলিঙ্গজির জয়! জয় চিতোর সেনাপতি চন্দ্র মৈঁদাসের জয়?’
চন্দ্রকে নিয়ে মৈঁদাস এবার রওনা হলেন নিজের বাসস্থানের দিকে৷ আর সৈনিকদের একটা অংশ চলে গেল নারী-শিশুদের নিয়ে পালাবার জন্য৷ আলো আঁধারি পথ চলতে চলতে মৈঁদাস তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘যুদ্ধ শুরুর পর তো লঙ্গরখানা বন্ধ হয়ে গেছে৷ এতদিন কী খেয়ে বেঁচে আছে?’
চন্দ্র জবাব দিল৷ ‘পদ্মিনী প্রাসাদের পিছনে যে বুনো কুলের বন আছে৷ সেই কুল খেয়ে৷’-এ কথা বলে সে জানতে চাইল, ‘কাল যুদ্ধ কেমন হবে?’ ‘মৈঁদাস বললেন, ‘হাতি নিয়ে তোরণ ভাঙতে আসবে মোগলরা৷ হয়তো-বা স্বয়ং সম্রাটই থাকবেন? তুমি কি থামাতে পারবে তাঁকে?’
‘হাতি!’ কী যেন একটু ভেবে নিয়ে চন্দ্র বলল, ‘আচ্ছা, দেখা যাক৷’
এইটুকু ছেলের পক্ষে আকবরের হস্তী বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানে নির্ঘাত মৃত্যু৷ তবু নিরুপায় মৈঁদাস তাকে ঠেলে দিচ্ছেন মৃত্যুর মুখে৷ অপরিচিত চন্দ্রর প্রতি মনটা ভিজে গেল মৈঁদাসের৷ তিনি পরম মমতায় চন্দ্রকে বললেন, ‘আজ তোমাকে আহার করাব আমি৷’ মনে মনে বললেন, ‘হয়তো-বা শেষ আহার৷’
৩
চিতোরের আকাশে তখন সবে শুকতারা ফুটে উঠেছে, চন্দ্রকে নিয়ে গৃহ ছেড়ে গোমুখ কুণ্ড বা সরোবরের দিকে রওনা হলেন মৈঁদাস৷ সঙ্গে নতুন পোশাক, অস্ত্র৷ আগের দিন মৈঁদাসের আস্তানাতেই আহার সেরে সেখানেই রাত্রিবাস করেছিল চন্দ্র৷ মনে মনে সে বেশ উৎফুল্ল৷ সে এখন উপবীতধারী ক্ষত্রিয় রাজপুত৷ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে স্বপ্ন দেখেছে বিজয়স্তম্ভর মাঠে সে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলছে ক্ষত্রিয় ছেলেদের সঙ্গে৷ বেশ মজার স্বপ্ন৷ ঘুম ভাঙার পরও তার রেশ কাটেনি তার মন থেকে৷ আনন্দে লাফাতে লাফাতেই সে এগোল মৈঁদাসের সঙ্গে৷ তা দেখে মৈঁদাস বিস্মিত ভাবে বললেন, ‘তোমার ভয় করছে না চন্দ্র?’
চন্দ্র প্রশ্নটা শুনে খেলার ছলে পথের সামনে পড়ে থাকা একটু নুড়ি লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘না, ভয় করবে কেন?’ বাচ্চা ছেলেটা সম্ভবত ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারছে না৷ বুঝতে পারছে না যে, সামান্য ক্ষাত্র উপবীতের বিনিময়ে সে জীবন উৎসর্গ করতে চলেছে সূর্যতোরণ রক্ষা করতে গিয়ে৷ একা তোরণ রক্ষা করতে হবে এই বাচ্চা ছেলেটাকে! মৈঁদাস বললেন, ‘মোগলরা হাতি নিয়ে তোরণের কপাট ভাঙতে আসবে আজ৷ হাওয়াই, কৈরা দানবের মতো সব যুদ্ধহস্তী৷ সম্রাট নিজে বসে থাকেন জাকিয়া নামের এক বিশাল হাতির শিবিকায়৷ হাতিগুলো কপাটে ধাক্কা দেবে৷ কপাট ভেঙে গেলে বন্যার বাঁধ ভাঙা জলের মতো নগরীতে প্রবেশ করবে মোগল সেনারা৷ এতদিন তোরণের ওপর থেকে তির ছুড়ে হাতিগুলোকে তোরণের কাছ থেকে দূরে রাখা হত৷ কিন্তু তিরন্দাজরাও আজ আর নেই৷ তুমি একা কীভাবে রক্ষা করবে তোরণ?’ এ কথা শুনেও ছেলেটার কোনো হেলদোল দেখা গেল না৷ সে বলল, ‘হাতিগুলোর ব্যবস্থা আমি করব৷ আচ্ছা যুদ্ধ কবে শেষ হবে বলতে পারো? যুদ্ধ শেষ না হলে তো ছেলেরা মাঠে আসবে না খেলতে৷’
বৃদ্ধ মৈঁদাস একথা শুনে কী বলবেন? ছেলেটার ভবিতব্যের কথা চিন্তা করে তাঁর চোখ দিয়ে শুধু দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল৷ মৈঁদাসের পাঁচ যুবক পুত্রর মৃত্যু হয়েছে যুদ্ধে৷ কিন্তু তারা জেনে বুঝে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে৷ এক রাতের মধ্যেই যেন এই দত্তক পুত্রের প্রতি বড়ো বেশি মায়া জন্মে গেছে মৈঁদাসের৷ হয়তো-বা সে অবোধ বালক বলেই৷ তার অন্য পুত্ররা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর দিকে ছুটেছিল তখন গর্বে বুক ফুলে উঠেছিল মৈঁদাসের৷ দেশের জন্য জীবন দেওয়া তো সৌভাগ্যের ব্যাপার৷ কিন্তু আজ দু-ফোঁটা হলেও জল গড়িয়ে পড়ল তার চোখ বেয়ে৷’
পবিত্র গোমুখ কুণ্ড৷ গো-মাতার মুখের মতো দেখতে একটা পাথরের ভিতর থেকে অবিরল শীতল জলধারা নির্গত হয়ে একটা কুণ্ড সৃষ্টি করেছে৷ রুক্ষ পার্বত্য নগরীর বুকে এ জল কীভাবে আসে তা কারও জানা নেই৷ এ কুণ্ডুর জল চিতোরবাসীর কাছে গঙ্গার জলের মতোই পবিত্র৷ মৈঁদাসের নির্দেশে কুণ্ডর জলে প্রথমে স্নান সেরে তার জীর্ণ পোশাক পরিত্যাগ করে সেনাপতির ঝলমলে পোশাক পরল৷ কোমরে তলোয়ারই ভালো৷ তবে সে তার উপবীতটা বার করে বেশ কয়েকবার মহানন্দে দেখল৷
নতুন পোশাক পরার পর মৈঁদাস তাকে নিয়ে গেলেন কাছেই চিতোরের কুলদেবী চিতোরেশ্বরীর মন্দিরে৷ দেবী মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে মৈঁদাসের কথামতো চিতোরের রীতি মেনে চন্দ্র শপথ করল, ‘আমি মেবারের সেনাপতি চন্দ্র মৈঁদাস দেবী চিতোরেশ্বরীকে সাক্ষী রেখে শপথ করছি যে আমি চিতোরের প্রধান তোরণ রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করলাম৷ আমি সূর্যাস্তের আগে তোরণ ত্যাগ করব না৷ যতক্ষণ আমি জীবিত থাকব ততক্ষণ একজন শত্রু সেনাকেও তোরণ অতিক্রম করতে দেব না৷’
এ সব কাজ মেটার পর চন্দ্ররা যখন বাইরে এসে দাঁড়াল তখন শুকতারা মুছে গিয়ে পুবের আকাশ লাল হতে শুরু করেছে৷ সেদিকে তাকিয়ে মৈঁদাস বললেন, ‘সূর্যোদয় হতে চলেছে৷ এবার তোমাকে তোরণ রক্ষার জন্য যেতে হবে৷ যে শপথ নিলে তা মনে আছে নিশ্চই৷ চিতোরেশ্বরী তোমার সহায় হন৷’ চন্দ্র বলল, ‘হ্যাঁ, যাচ্ছি৷ তবে যাবার আগে আমি একবার শূন্য হাতিশালাটা ঘুরে যাব৷ ওখানে আমার কিছু জিনিস আছে৷’
বৃদ্ধ মৈঁদাস তাকালেন চন্দ্রর দিকে৷ তার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল চন্দ্র৷ নিজের চোখের জল গোপন করার জন্য এবার তাড়াতাড়ি অন্যদিকে এগোলেন মৈঁদাস৷ আর চন্দ্র এগোল হাতিশালের দিকে৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই দূর থেকে মৈঁদাস দেখলেন পরিত্যক্ত হাতিশাল থেকে একটা বিরাট থলে কাঁধে নিয়ে চন্দ্র রওনা হল সূর্যতোরণের দিকে৷ ঠিক সেই সময় পাহাড়ের নীচে আকবরের শিবির থেকে ভেসে আসতে লাগল রণহস্তীদের বৃহংতি৷ ভোরের আলো ফোটার সঙ্গেসঙ্গেই সওয়ারি পিঠে নিয়ে প্রতিদিনের মতো ওপরে উঠে আসার জন্য৷ চন্দ্র গিয়ে উপস্থিত হল নগরীর প্রধান তোরণ রক্ষার জন্য৷ বিশাল সূর্যতোরণ৷ হাতি যাওয়া-আসা করে এই তোরণ দিয়ে৷ বিশাল তার কপাট৷ তার নীচে দু-আঙুল মতো ফাঁক আছে৷ চন্দ্র মাটিতে শুয়ে একবার বাইরে তাকাল৷ সামনের পাথর বিছান পথ ঢালু হয়ে নেমে গেছে নীচের দিকে৷ ও পথে বেয়েই হস্তীবাহিনী নিয়ে ওপরে উঠে আসবেন আকবর৷
এ দিন বেশ ধীরে-সুস্থেই তার বাহিনী নিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলেন সম্রাট৷ যুদ্ধ তো বলতে গেলে শেষ৷ তাঁর অনুমান আর মাত্র জনা পঞ্চাশেক সেনা আছে দুর্গের ভিতর৷ কতক্ষণ আর তারা ঠেকিয়ে রাখবে তার এই হস্তীবাহিনী আর এই সমুদ্র সমান মোগল সেনাদের৷ এমনও হতে পারে আজ কোনো রক্তপাতই হল না৷ রাজপুতরা আত্মসমর্পণ করল তাঁর কাছে৷ আর তা যদি না হয়ও তাহলেও দ্বিপ্রহরের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে৷ হাতি দিয়ে তোরণ ভেঙে নগরীতে প্রবেশ করবেন তিনি৷ তাঁবুতে উৎসবের আয়োজন শুরু করার নির্দেশ দিয়ে পাকদণ্ডী বেয়ে একটার পর একটা তোরণ, গণেশ পোল, হনুমান পোল, পাদন পোল অতিক্রম করে ওপরে উঠে আসতে লাগলেন সম্রাট৷ সে সব তোরণের কপাট আজ উন্মুক্ত৷ এইসব তোরণগুলো রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ গেছে হাজার হাজার রাজপুতের৷ সম্রাটের সেনা দলের ক্ষতিও কিছু কম হয়নি৷ এখন বাকি আছে শুধু সূর্যতোরণের পতন৷ বাহিনীর প্রথম ভাগে পাহাড়ের মতো বিশাল যুদ্ধ হস্তীর পিঠে লোহার জালের তৈরি শিবিকায় বসে স্বয়ং মোগল সম্রাট আকবর৷ এই হাতির নাম জাকিরা৷ আর তাকে ঘিরে কৈরা, হাওয়াই ইত্যাদি বিশাল হস্তীযূথ৷ আর তাদের পিছনে সম্রাটের পদাতিক বাহিনী৷ মোগল সম্রাটদের মধ্যে আকবরই কেবলমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রে একেবারে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেন৷ এ ব্যাপারটা তিনি অবশ্য শিখেছেন রাজপুত রাজাদের থেকেই৷ নিরাপত্তার কিছু অভাব থাকলেও এতে সৈনিকদের মনোবল বাড়ে৷ যুদ্ধ জয় সহজ হয়৷
একসময় ওপরে উঠে এলেন সম্রাট৷ সূর্য তখন বেশ খানিকটা ওপরে ওঠে গেছে৷ সূর্যতোরণের কিছুটা তফাতে এসে তাঁর হস্তীযূথকে দাঁড় করালেন সম্রাট৷ বিশাল তোরণটা ভিতর থেকে বন্ধ ঠিকই, কিন্তু কোনো শব্দ আসছে না তোরণের ভিতর থেকে৷ অন্য দিন এখানে এসে সম্রাট বাহিনী দাঁড়ালেই ঝাঁকে ঝাঁকে তির ছুটে আসত তোরণ সংলগ্ন দুর্গ প্রাকারের আড়াল থেকে৷ কিন্তু আজ চারপাশ সব কিছু কেমন যেন নিঝুম-নিস্তব্ধ৷ রাজপুত সেনাদের যুদ্ধে আহ্বান জানাবার জন্য রণবাদ্যকারদের বাজনা বাজাবার জন্য ইঙ্গিত করলেন সম্রাট৷ বীভৎস শব্দে বেজে উঠল রণভেরি কাড়া-নাকাড়া৷ তার সঙ্গে মোগল সেনাদের কান ফাটানো চিৎকার৷ দীর্ঘক্ষণ ধরে সেই ভয়ংকর শব্দেও একটা তিরও ছুটে এল না তোরণ প্রাকারের আড়াল থেকে৷
সম্রাট আকবর বাদ্যকারদের থামিয়ে দিয়ে তাঁর সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘সম্ভবত কেল্লায় যে কয়জন লোক ছিল তারা প্রাণ ভয়ে রাতের অন্ধকারে পাহাড়ের পিছনের ঢাল বেয়ে জঙ্গলে পালিয়েছে৷ তোরণটা বন্ধ আছে ঠিকই৷ হাতি দিয়ে লাথি মেরে তোরণ ভাঙতে হবে৷ চিতোর জয় কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্পন্ন হবে৷ শিশোদীয় রাজপুতদের দম্ভ কুলগৌরব আজ ধুলোয় মিশিয়ে দিলাম আমি৷ তোরণ ভাঙো৷’
সম্রাটের নামে জয়ধ্বনি করে উঠল মোগল সেনারা৷
তোরণ ভাঙার জন্য প্রথম প্রস্তুত হল কৈরা নামের দানব হাতিটা৷ তার মাহুত তাকে কয়েক পা পিছনে আনল৷ তারপর সম্রাটের নির্দেশ পেয়ে তাকে ছোটাতে শুরু করল তোরণের দিকে৷ এবার আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে কপাট৷ পিলপিল করে দুর্গে প্রবেশ করবে মোগল সেনারা৷ তার জন্য তোরণের দিকে তাকিয়ে প্রস্তুত হল সবাই৷ একটা বিশাল পর্বত যেন ছুটে যাচ্ছে তোরণের দিকে!
মাহুত সমেত কৈরা ছুটে গেল তোরণের কাছে৷ আর মাত্র হাত দশেকের ব্যবধান৷ কিন্তু হঠাৎই থমকে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল হাতিটা৷ মাহুত তাকে চেষ্টা করেও আর সামনে আনতে পারল না৷ মাহুতের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে যন্ত্রণায়, আতঙ্কে চিৎকার করতে করতে পিছিয়ে আসতে লাগল কৈরা৷
কী হল ব্যাপারটা? কোনো গুপ্ত জায়গা থেকে অস্ত্র ছুটে এসে লাগল নাকি কৈরার গায়ে? রণহস্তীগুলোর সারা শরীর বেতের বর্মে মোড়া৷ সে বর্মে তির, বর্শা বা তলোয়ারের কোপ বসতে পারে না৷ তবে? আর তার গায়েও তো কোনো অস্ত্র লেগে আছে দেখা যাচ্ছে না৷ কেউই বুঝতে পারল না ব্যাপারটা৷
পিছু হটে আসা কৈরাকে যখন আর কিছুতেই সামনে এগিয়ে নেওয়া গেল না তখন তোরণ ভাঙার জন্য জাকিরাকে নিয়ে নিজেই প্রস্তুত হলেন সম্রাট৷ জাকিরার দু-পাশে আরও দুটো হস্তীযূথ নৌরজা আর সম্রাটের আদরের হাওয়াই৷ সার বেঁধে কিছুটা পিছনে প্রথমে সরে এল তিনটে হাতিই৷ তারপর একই সঙ্গে ছুটতে শুরু করল পদাঘাতে তোরণ গুঁড়িয়ে দেবার জন্য৷
কিন্তু তোরণের প্রায় কাছে পৌঁছেই একসঙ্গে হঠাৎ লাফিয়ে উঠল তিনটে হাতিই৷ আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে আর্তনাদ করে পিছু হঠতে শুরু করল তারা৷ কিছুতেই তাদের সামনে এগোনো যাচ্ছে না৷ হতভম্ব সম্রাট ও হাতির মাহুতরা৷ বহু যুদ্ধের প্রশিক্ষিত হস্তীযূথ এমনভাবে হঠাৎ ভয় পেয়ে যাচ্ছে কেন সামনে এগোতে? জাকিরা কোনোদিন সম্রাটের নির্দেশ অমান্য করেনি৷ কামানের গোলার সামনে ছুটে গেছে সে৷ বহু চেষ্টাতেও তাকে আর এক-পাও সামনে আগাতে পারছেন না সম্রাট৷ হাতিগুলো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রবল যন্ত্রণায় বাতাসে কান আর শুঁড় ঝাপটিয়ে গগনভেদী আর্তনাদ করছে৷
আর এরপরই একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটল৷ নৌরজার মাহুত হাতি এগোচ্ছে না দেখে অঙ্কুশ দিয়ে প্রচণ্ড ঘা দিল তার মাথায়৷ মুহূর্তের মধ্যে খেপে গেল হাতিটা৷ শুড় দিয়ে মাহুতকে টেনে নামিয়ে সে তাকে আছাড় মারল পাথুরে মাটিতে৷ চুরমার হয়ে গেল মাহুতের দেহ৷ এ কাজ করার পর সে পিছনে ছুটতে শুরু করল৷ তার ধাক্কায় জাকিরার পিঠ থেকেও ছিটকে পড়ে যাচ্ছিলেন সম্রাট৷ কোনোরকমে শিবিকা আঁকড়ে ধরে বেঁচে গেলেন তিনি৷ নইলে নৌরজার পায়ের নীচে পড়ে শেষ হয়ে যেতেন৷ যেমন ঘটল পশ্চাৎবর্তী সৈনিকদের ভাগ্যে৷ সে সামনে যাকে পেল তাকে পায়ে দলে, শুঁড়ে করে আছাড় মেরে ছুটল ঢাল বেয়ে নীচের দিকে৷ আর নৌরজার এই আচরণ সংক্রমিত হল জাকিরা সহ অন্য হাতিগুলোর মধ্যেও৷ তাদের ওপর আর নিয়ন্ত্রণ থাকল না সওয়ারিদের৷ সম্রাটকে পিঠে নিয়ে জাকিরা সহ অন্য হাতিগুলোও ছুটল নীচের দিকে৷ হাহাকার উঠল মোগল শিবিরে৷ দলবদ্ধ হস্তীযূথের পায়ের তলায় লুটোতে লাগল মোগল সেনাদের দেহ৷ বাঁচার জন্য যে যেদিকে পারল পালাতে লাগল তারা৷ হাতিদের দৌড় থামল গিয়ে মোগল শিবিরে পৌঁছে৷ সেখানে পৌঁছেও আর্তনাদ করতে লাগল তারা৷ আকবর কোনোক্রমে জাকিরার পিঠ থেকে নেমে নিজের তাঁবুতে প্রবেশ করলেন৷ এদিন আর সম্রাটের চিতোরজয় করা হল না৷ এদিনের মতো যুদ্ধ সমাপ্তির কথা ঘোষণা করে সৈনিকদের মৃতদেহগুলো নীচে নামানোর জন্য আর হাতিগুলোকে শান্ত করার নির্দেশ দিলেন সম্রাট৷ তিনি তাঁবুতে বসে ভাবতে লাগলেন কী হতে পারে ঘটনাটা?
নীচ থেকে ভেসে আসছে সম্রাটের রণহস্তীর আর্তনাদ৷ এদিকে তখন বন্ধ সূর্যতোরণের আড়ালে তালি দিয়ে ছোটো সেনাপতি চন্দ্র নাচছে আর বলছে-‘হাতি তোর পায়ের নীচে কুলের বিচি! কুলের বিচি!’
হাতিশালে কিছুদিন কাজ করেছিল চন্দ্র৷ সে খেয়াল করে দেখেছিল যে হাতি যত বড়ো প্রাণীই হোক না কেন তার নরম পায়ের নীচে খাঁজাকাটা অংশে ছোটো কুলের বিচি পড়লে সে ব্যথায় কাতর হয়৷ তাই বুনো কুল খেয়ে বিচিগুলো যাতে হাতির পায়ের নীচে না পড়ে সেজন্য সে সেগুলি একটা থলের মধ্যে জমিয়ে রাখত৷ হাতিগুলো মারা যাবার পর হাতিশাল শূণ্য হলেও চন্দ্রর সে অভ্যাস যায়নি৷ লঙ্গরখানা বন্ধ হবার পর তো সে বেশ কিছুদিন কুল খেয়েই কাটিয়েছে৷ আর বিচিগুলোকে সে জমিয়ে রেখেছিল থলের মধ্যে৷ সম্রাট যখন তাঁর হস্তীবাহিনী নিয়ে তোরণ ভাঙার জন্য এগোচ্ছিলেন তখন বুদ্ধিমান চন্দ্র মুঠোমুঠো কুলের বিচি ছুড়ে দিচ্ছিল তোরণের নীচের ফাঁকা জায়গা দিয়ে৷ তোরণের ছিদ্র দিয়ে সে দেখছিল হাতিগুলোর গতিবিধি৷ ঢালু পথ বেয়ে সেগুলো গড়িয়ে যাচ্ছিল হাতিগুলোর পায়ের নীচে৷ আর তাতেই কুপোকাত রণহস্তীরা৷ সামান্য বাচ্চা ছেলের বুদ্ধিমত্তার কাছে পরাজিত হয়েছেন বহুদর্শী মোগল সম্রাট আকবর আর তার বিশাল বাহিনী৷
তোরণের ফাঁক দিয়ে স্বয়ং সম্রাটকে পালাতে দেখেছে চন্দ্র৷ হয়তো এবার তবে যুদ্ধ থেমে যাবে৷ আবার নিশ্চয়ই ছেলের দল মাঠে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলতে আসবে এই ভেবে আনন্দে বেশ কিছুক্ষণ নেচে নিল সে৷ একসময় কোলাহল থেমে গেল বাইরে৷ নীচ থেকে মাঝে মাঝে শুধু ভেসে আসতে লাগল হাতির অস্পষ্ট আর্তনাদ৷ তবে এখন তোরণ ছাড়া যাবে না৷ কারণ সূর্যাস্তের আগে তোরণ ছাড়বে না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে চন্দ্র৷ তোরণের আড়ালে বসে থাকতে থাকতে একসময় ঝিমুনি এসে গেল তার৷ বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়ল৷ সে দেখতে লাগল যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার স্বপ্ন৷
একটা কোলাহলের শব্দে যখন চন্দ্রের ঘুম ভাঙল তখন দিন শেষ হয়েছে৷ সূর্যদেব অস্ত যেতে বসেছেন পাটে৷ বিজয়স্তম্ভর দিক থেকে কোলাহলটা আসছে! কীসের কোলাহল! হঠাৎ চন্দ্রর মনে হল যে যুদ্ধ থেমে গেছে বলে ছেলের দল আবার মাঠে ফিরে আসেনি তো? বিজয়স্তম্ভ জায়গাটা সূর্যতোরণ থেকে বেশ কিছুটা দূরে৷ তবে তোরণের মাথায় ওঠার জন্য একটা সিঁড়ি আছে৷ সেখানে উঠলে ও চত্বরটা দেখা যায়৷ এই ভেবে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে তোরণের মাথায় উঠে চন্দ্র তাকাল স্তম্ভ চত্বরের দিকে৷ সেখানে জড়ো হয়েছে একদল মানুষ৷ পিঠে তাদের ধনুক৷ ইসমাইল তার দলবল নিয়ে সূর্যাস্তের প্রাক মুহূর্তেই পিছনের পাহাড় বেয়ে দুর্গ রক্ষার জন্য ওপরে ওঠে এসেছে৷ তাদেরই ওই কোলাহল৷ এরপর চন্দ্র দেখল ধনুর্ধরদের একটা অন্য দল মৈঁদাসকে সঙ্গে করে তোরণের কাছাকাছি চলে এসেছে৷ তাদের দেখে চন্দ্র তোরণের মাথা থেকে নামতে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে কোথা থেকে একটা তির এসে বিধঁল চন্দ্রর ছোট্ট বুকে৷ আকবরের সেনাদল নীচে নেমে গেলেও সেখানে গিরিবর্তে আড়ালে দাঁড়িয়ে প্রতিদিনের মতো তোরণের ওপর নজরদারি করছিল একজন সৈন্য৷ সেই চালিয়েছিল তিরটা৷ ছোট্ট চন্দ্রর চোখে ঝাপসা হয়ে গেল বিজয়স্তম্ভর চত্বর৷ সারা দিন সূর্যতোরণ রক্ষা করে দিন শেষে চন্দ্রর দেহটা ছিটকে পড়ল কেল্লার ভিতর৷ ঠিক সেই সময় ঝুপ করে সূর্য ডুবে গেল৷ আঁধার নেমে এল চিতোরগড়ে৷
বিজয়স্তম্ভর সামনে যে মাঠে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার জন্য স্বপ্ন দেখত চন্দ্র সেখানেই তার চিতা সাজানো হল৷ চন্দ্রর ছোট্ট দেহটা চিতায় তোলার আগে খুলে নেওয়া হল তার উপবীতটা৷ জ্বলে উঠল চিতা৷
চোখ দিয়ে জল ঝরছিল বৃদ্ধ মৈঁদাসের৷ কে একজন চন্দ্রর উপবীতটা রেখে আসতে যাচ্ছিল উপবীতের গাদায়৷ তা দেখে মৈঁদাস কাতর স্বরে বললেন, ‘শেষ ক্ষত্রিয়ও আজ নিহত হল৷ উপবীতগুলো কেউ ওজন করে দেখো তো, চিতোরেশ্বরী কত রাজপুতের রক্ত পান করলেন তাঁর তৃষ্ণা নিবারণের জন্য?’
চন্দ্রর চিতার আগুনের আলোয় উপবীতগুলো দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা হল৷ তার ওজন দাঁড়াল সাড়ে চুয়াত্তর মন!
পুনশ্চ: এরপর ইসমাইলের নেতৃত্বে তাঁর তিরন্দাজ বাহিনী অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করে আরও ক-দিন আকবর বাহিনীকে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন ঠিকই কিন্তু শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করতে হয় ইসমাইল ও তার সঙ্গীদের৷ ১৬২৪ সংবতে (১৫৬৮ খ্রি.), ১২ চৈত্র সূর্যতোরণ অতিক্রম করে আকবর পা রাখেন চিতোর কেল্লায়৷ তখন আর সেখানে একজন মানুষও জীবিত নেই৷ চিতোরের যা কিছু সুন্দর ছিল-প্রাসাদ দেবালয় সব টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলে চিতোরকে সত্যিই শ্মশান ভূমিতে পরিণত করে দিল্লি ফিরে যান বলদর্পী মহামতি সম্রাট৷ কিন্তু রাজপুতনার চারণ ভট্ট কবিদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে ছোট্ট চন্দ্রর অমর গাথা৷ রাজপুতনার ছোটো ছোটো ছেলেরা হাতি দেখলে, বিশেষত মোগলদের হাতি দেখলেই চন্দ্রর ঘটনার কথা স্মরণ করে বলে উঠত ‘হাতি তোর পায়ের নীচে কুলের বিচি৷’ আর রাজপুতরা এরপর থেকে মুখবন্ধ চিঠির খামের ওপর ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ কথাটা লিখতে শুরু করে৷ যার অর্থ প্রাপক ভিন্ন অন্য কেউ সে চিঠি খুললে যেন তার ওপর চিতোরের রাজপুত ক্ষত্রিয় হত্যার পাপ বর্ষায়৷ জাহাঙ্গিরের আমলে একদল রাজপুত দোয়াব অঞ্চলে জরিপের কাজে এসেছিল৷ তারা পরে রয়েগেছিল এ বাংলাতেই৷ তাদের মুখে মুখে এ কথা দুটো বা প্রবাদ দুটো বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল৷ ছোটো ছেলেরা হাতি দেখলে বলত-‘হাতি তোর পায়ের নীচে কুলের বিচি৷’ আর বড়োরা চিঠির খামের ওপর লিখে দিতেন ‘সাড়ে চুয়াত্তর’৷