নয়
ঐদিন শাহিন শিউলিদের বাসা থেকে চলে আসার পর শিউলির নানা খলিল সাহেব ও নানি নাসিমা বানু অফিস থেকে বাসায় ফিরলেন। তারপর যখন চা পান করছিলেন তখন শিউলি ওঁদের কাছে এসে সালাম দিল।
খলিল সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, মনে হচ্ছে আজকের মিশন। সাকশেসফুল।
শিউলি বলল, কী করে বুঝলেন?
তোমার চোখ মুখ বলে দিচ্ছে।
কিন্তু আপনাদের অনুপস্থিতির কারণে অর্ধেক সাকশেসফুল।
ঠিক আছে, সামনের শুক্রবার নিয়ে আসিস। সেদিন বাকি অর্ধেক পুষিয়ে দেব। তবে ভদ্রলোককে আমার কাছে পরীক্ষা দিতে হবে। পাস করলে কোনো বাধা দেব না। বরং সর্বান্তকরণে তোকে সমর্থন করব; কিন্তু যদি ফেল করে, তা হলে ক্যান্সেল করে দেব। কি রাজি তো?
শিউলি বলল, আমার একশ পার্সেন্ট বিশ্বাস পাস করবেই।
তা হলে তো কোনো কথাই নেই; কিন্তু ফেল করলে কোনো কনসিডার করব না।
নাসিমা বানু এতক্ষণ নানা-নাতনির কথা চুপ করে শুনছিলেন। এবার স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি যে ওকে অত আস্কারা দিচ্ছ, তা কি ঠিক হচ্ছে?
খলিল সাহেব চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা টেবিলের উপর রেখে বললেন, আস্কারা দিলেও এটা নিশ্চয় জান, আমার কথার কোনোদিন নড়চড় হয়নি? তাছাড়া এত বছর আমার সঙ্গে ঘর-সংসার করছ অন্যায়ের প্রতি কখনও আমাকে নতি স্বীকার করতে দেখেছ?
নাসিমা বানু নাতনির দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে বললেন, না দেখিনি। তবে আমি হলাম তোমার স্ত্রী আর শিউলি হল নাতনি। স্ত্রীর প্রতি কঠোর হতে পারলেও নাতনির প্রতি হতে পারবে কি?
পারব কিনা ঐ দিন দেখে নিও বলে খলিল সাহেব উঠে বাগানের দিকে চলে গেলেন ইভিনিং ওয়াক করার জন্য।
নানার কঠোরতার কথা শুনে শিউলি ঘাবড়ে গেল। ভাবল, সত্যি সত্যি শাহিন যদি নানার পরীক্ষায় পাস করতে না পারে, তাহলে কী হবে? নানা চলে যাবার পর নানিকে জিজ্ঞেস করল, নানা কঠোর হবার কথা কী বললেন, বুঝতে পারলাম না। চার পাঁচ বছর আপনাদের কাছে রয়েছি, কই, একদিনের জন্যেও তো নানাকে আপনার প্রতি কঠোর হতে দেখিনি?
নাসিমা বানু বললেন, তোর নানা কখনও অন্যায়ের কাছে আপস করেনি। যদি কোনো সময় একটু আধটু অন্যায় আবদার করতাম, তা হলে রাগ করে কয়েকদিন কথা বলত না। মনে হয় নানার কথায় তুই ভয় পেয়েছিস। চিন্তা করিস না, আমি থাকতে তোর কোনো ভয় নেই। ছেলেটা পরীক্ষায় ফেল করলেও আমি গ্রেস মার্ক দিয়ে পাস করিয়ে দেব।
মাই ডিয়ার সুইট নানি বলে শিউলি নাসিমা বানুকে জড়িয়ে ধরল।
নাসিমা বানু বললেন, তুই তোর মায়ের মতো হয়েছিস। সেও তোর বাবাকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল। তোর নানা তো কিছুতেই বিয়েটা মেনে নিতে পারেনি। যত ঝড়ঝাঁপটা আমাকেই সহ্য করতে হয়েছিল। তারপর চোখ মুছে বললেন, মনে হচ্ছে তোর বেলাতেও অনেক ঝড়ঝাঁপটা সহ্য করতে হবে। এবার আমাকে ছাড়, কিচেনে বুয়া কী করছে দেখি।
ঐদিন রাতে শিউলি শাহিনকে ফোন করে বলল, তুমি চলে যাবার পর পর নানা-নানি অফিস থেকে ফিরেছেন। তারপর নানার পরীক্ষা করার কথা জানিয়ে বলল, ফেল করলে তোমাকে ক্যান্সেল করে দেবেন বলেছেন।
শাহিন বলল, তাহলে তো খুব চিন্তার কথা? যদি ফেল করি, তুমিও যেমন আমাকে পাবে না, তেমনি আমিও তোমাকে পাব না।
হ্যাঁ, কথাটা শুনে আমি খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। নানা কথাটা বলার পর বাগানে চলে যেতে নানি আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে অভয় দিয়ে বললেন, “আমি থাকতে তুই ঘাবড়াচ্ছিস কেন? আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। তিনি যদি তোদের জোড়া করে পয়দা করে থাকেন, তাহলে পরীক্ষায় ফেল করলেও তোদের বিয়ে হবে।”
শাহিন জিজ্ঞেস করল, পরীক্ষার ডেটের কথা বলেছেন?
হ্যাঁ, বলেছেন। সামনের শুক্রবার দিন তোমাকে আমি নিয়ে আসবে। শোন, পরীক্ষার ব্যাপারে তুমি কোনো দুশ্চিন্তা করবে না। ফেল করলেও আমি তোমাকে যেমন করে হোক বিয়ে করবই।
আমাকে বিয়ে করলে তোমার নানা তো তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন। আমার চাল-ছুলো নেই, তোমাকে রাখব কোথায়?
তুমি না একটা বোকার ডিম।
মানুষ বুঝি ডিম পাড়ে? ডিম তো পাড়ে পাখিরা।
তোমার মতো মানুষও পড়ে।
ঠিক আছে, আমি না হয় ডিম পাড়ি; কিন্তু কথাটা কেন বললে বলবে তো।
আমরা গোপনে কাজি অফিসে বিয়ে করে পড়াশোনা চালিয়ে যাব। পড়াশোনা শেষ করার পর তুমি চাকরি করে স্বাবলম্বি হবার পর নানাকে বিয়ে করার কথা বলব। তখন বাড়ি থেকে বের করে দিলে তোমার কাছে চলে আসব। তোমাকে বোকার ডিম কেন বললাম এবার নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ?
তুমি কথাটা বলামাত্র বুঝেছি। তোমাকে বোকার ডিম বানাবার জন্য না বোঝার ভান করে কথাটার অর্থ জিজ্ঞেস করেছি।
শিউলি হেসে উঠে বলল, তা হলে আমরা দুজনেই কি বোকার ডিম?
শাহিনও হেসে উঠে বলল, তুমি যখন বলছ তখন তাই।
শিউলি বলল, ওসব কথা বাদ দিয়ে যা বলছি শোন, শুক্রবার সকাল আটটার সময় তুমি গাজিপুর গোলচাক্তির কাছে থাকবে, আমি তোমাকে নিতে আসব।
তুমি আবার কষ্ট করে আসবে কেন? আমি তো তোমাদের বাসা চিনি, যেতে পারব।
তা পারবে, তবে আমি তা মেনে নিতে পারছি না। তাই আমিই তোমাকে নিয়ে আসার জন্য আসব।
ঠিক আছে, তাই এস; কিন্তু শুক্রবার আসতে এখনও সাতদিন বাকি, যদি মনে না থাকে?
বৃহস্পতিবার দিনগত রাতে আমি ফোন করে মনে করিয়ে দেব। এবার রাখি নানি ডাকছেন বলে শিউলি সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।
শুক্রবার সকালে শাহিনের খালা আয়েশা শাহিনকে বললেন, তোর খালুর শরীর ভালো নয়। আজ তুই, বাজারটা করে এনে দে। তারপর তার হাতে বাজারের ব্যাগ, ফর্দ ও টাকা দিলেন।
ফর্দ দেখে শাহিন চিন্তা করল, এতকিছু কেনাকাটা করতে কমপক্ষে একঘন্টা লাগবে। ওদিকে শিউলি গাড়ি নিয়ে এসে অপেক্ষা করবে।
তাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আয়েশা বললেন, কীরে, চুপ করে কী ভাবছিস?
খালার কথায় শাহিনের চিন্তা ছিন্ন হয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, কিছু না। তারপর বাজার করে যখন ফিরল তখন সাড়ে আটটা। তাড়াতাড়ি করে যা পরেছিল সেই পোশাকেই বেরিয়ে পড়ল। ভালো পোশাক পরার কথা ভুলে গেল।
আয়েশা খাতুন দেখতে পেয়ে বললেন, কীরে, নাস্তা না খেয়ে কোথায় যাচ্ছিস?
শাহিন বলল, একটা জরুরি কাজে যাচ্ছি, ওখানে নাস্তা খেয়ে নেব। তারপর শিউলির গাড়ির কাছে যখন এল তখন নটা বেজে গেছে।
শিউলি গাড়ি নিয়ে ঠিক আটটার সময় এসেছে। শাহিনের আসতে দেরি হচ্ছে দেখে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছিল। মোবাইল নিয়ে আসতে ভুলে গেছে বলে তাকে ফোনও করতে পারছিল না।
শাহিন কাছে এসে সালাম দিলে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠ, ওদিকে নাস্তার টেবিলে নানা নানি অপেক্ষা করছেন।
শিউলি ড্রাইভার না নিয়ে নিজে ড্রাইভ করে এসেছে। সামনের গেট খুলে দিয়ে শাহিনকে উঠতে বলে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসল। শাহিন উঠে গেট লাগাবার পর গাড়ি ছেড়ে দিয়ে তার পোশাক দেখে মৃদু হেসে বলল, মনে হচ্ছে কোনো কারণে দেরি হবার ফলে পোশাক পাল্টাতে সময় পাওনি?
শাহিন নিজের পোশাকের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে জিব কেটে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। খালা আম্মা কোনোদিন আমাকে বাজার করতে বলেন নি। খালুর শরীর খারাপ বলে আজ বললেন। তারপর আর কিছু না বলে চুপ করে রাস্তার দিকে চেয়ে রইল।
শিউলি তার মুখের দিকে একবার চেয়ে নিয়ে বলল, এতে লজ্জা পাবার কী আছে? পোশাকের ব্যাপারে আমি তেমন ইন্টারেস্টেড নই। আমারও মাঝে মাঝে এরকম হয়।
খলিল সাহেব প্রতিদিন ন’টার সময় নাতনি ও স্ত্রীর সঙ্গে নাস্তা খান। আজ শিউলিকে দেখতে না পেয়ে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, নায়িকা এ্যাবসেন্ট কেন?
নাসিমা বানু বললেন, নায়ককে নিয়ে আসতে গেছে।
খলিল সাহেব বড় বড় চোখ বের করে স্ত্রীর দিকে তাকালেন।
নাসিমা বানু বললেন, ওভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছ কেন? কাল রাতে তুমিই তো তাকে নায়ককে নিয়ে আসতে বললে পরীক্ষা নেয়ার জন্য।
খলিল সাহেব ঐভাবে তাকিয়ে স্ত্রীকে রাগিয়ে মজা পান। এখনও তাই করেছেন। স্ত্রীর কথায় দৃষ্টি সংযত করে বললেন, সরি, ভুলে গিয়েছিলাম। তারপর বললেন, ওদের আসতে হয়তো দেরি হবে, এস আমরা নাস্তা খেয়ে নিই।
নাস্তা খেয়ে সেখানেই দুজনে কথা বলছিলেন। প্রায় আধ ঘণ্টা পর শিউলি শাহিনকে নিয়ে ওদের কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, সরি নানাজি, ফিরেত দেরি হয়ে গেল।
খলিল সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে শাহিনের আপাদমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তাদেরকে বসতে বললেন।
খলিল সাহেব সুন্দর সুপুরুষ, মুখে চাপ দাড়ি, বয়স ষাটের মতো হলেও স্বাস্থ্য ভালো, চুল-দাড়ি এখনও পাকেনি, মাথায় চুপি। ওনাকে দেখে শাহিনের মনে হল, খুব ধার্মিক লোক। বসতে বলতে শাহিন সালাম দিল।
সালামের উত্তর দিয়ে খলিল সাহেব বললেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন বস। বসার পর আবার বললেন, মনে হচ্ছে, তোমরা এখনও নাস্তা খাওনি। তারপর আয়াকে ডেকে ওদের জন্য নাস্তা নিয়ে আসতে বলে উঠে চলে গেলেন।
নানাজি চলে যাবার পর শিউলি নানিকে জিজ্ঞেস করল, এনিথিং হ্যাঁপন্ড?
নাসিমা বানু বললেন, এখনও ঘটেনি, তবে এবার ঘটবে? মেহমানকে নিয়ে তাড়াতাড়ি নাস্তা খেয়ে নে। তারপর ওরা নাস্তা খেতে শুরু করলে শাহিনের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন, ছেলেটা মনে হয় খুব সরল সোজা। তা না হলে এই পোশাকে কেউ প্রেমিকার বাড়িতে আসে? এরকম ছেলেকে কি শিউলির নানা পছন্দ করবে?
ওদের নাস্তা খাওয়া শেষ হয়েছে, এমন সময় খলিল সাহেব এসে তাদেরকে নিয়ে ড্রইং রুমে বসলেন। উনি আগেই নাতনির কাছে শাহিনের পুরো বায়োডাটা জেনেছেন। তাই ওসব কিছু জিজ্ঞেস না করে জিজ্ঞেস করলেন, ইসলাম শব্দের অর্থ কী?
শাহিন বলল, শান্তি।
মুসলমান কারা?
যারা ইসলাম কবুল করার পর নিজের কামনা বাসনা বিসর্জন দিয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (স)-এর বিধি নিষেধ মেনে চলে তারাই মুসলমান।
তোমার পরিচয় কী?
আমি একজন মুসলমান।
তুমি তা হলে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (স) এর বিধি নিষেধ মেনে চল?
জ্বী, যথাসাধ্য মেনে চলার চেষ্টা করি।
ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রেম-ভালবাসা ইসলামে যে নিষেধ, তা কি জান?
জ্বী, জানি।
তবু কেন আমার নাতনির সঙ্গে প্রেম করেছ?
আমি আপনার নাতনির সঙ্গে প্রেম করিনি। তবে তাকে ভীষণ পছন্দ করি এবং আল্লাহ রাজি থাকলে সময় মতো বিয়ে করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর পছন্দ করে বিয়ে করা ছেলে মেয়ে উভয়ের জন্য ইসলামে নিষিদ্ধ নয়, বরং সিদ্ধ। যেমন আমাদের নবী করিম (স) বলেছেন, “পরস্পর দুইজন প্রেমিকের পক্ষে বিবাহের ন্যায় উত্তম আর কিছুই নাই।” [বর্ণনায় হযরত ইবনে আরাম (রাঃ)-ইবনে মাযাহ]
একটা কথা না বলে পারছি না, বর্তমানে প্রেম-ভালবাসার নামে ছেলে মেয়েদের মধ্যে মেলামেশা ও বেহায়াপনা যারা করে বেড়াচ্ছে, তাদের দলে আমি নই। আর এগুলো ইসলামে নিষেধ।
তোমার পোশাক দেখে মনে হচ্ছে, তুমি মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। শিউলি বড়লোকের মেয়ে ও ধনী ব্যবসায়ী নানার একমাত্র নাতনি জেনেও তুমি তাকে বিয়ে করতে চাও কোন সাহসে? ওর মাসিক হাত খরচই দশ হাজার টাকা। তুমি এখন ছাত্র, লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করলে কত টাকা আর বেতন পাবে, দশ, পনের না হয় বিশ পঁচিশ হাজার টাকা? আজকালের বাজারে বিশ পঁচিশ হাজার টাকা আবার টাকা না কি? তা ছাড়া বর্তমানে ভালো জব পাওয়া সোনার হরিণ পাওয়ার মতো। কত হাজার হাজার ছেলে মাস্টার্স পাস করে বেকার রয়েছে। আর ভাগ্যগুণে চাকরি পেলেও ঐ টাকায় কী হবে? তুমি মনে হয় জানো, সংসারে অভাব ঢুকলে প্রেম ভালবাসা জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়।
যদি মনে করে থাক, শিউলি তার নানার একমাত্র ওয়ারিশ হিসেবে সবকিছু পাবে, তা হলে ভুল করবে। আর যদি ওকে বিয়ে করে এখানে থাকবে অর্থাৎ ঘরজামাই হয়ে থাকবে, তাহলেও ভুল করবে। একটা কথার উত্তর দাও তো, বিয়ে করে শিউলিকে কোথায় তুলবে? খালা খালুর বাড়িতে, না নিজেদের বাড়িতে? তোমার মা বাবা থেকেও না থাকার মতো। তারা তো তোমাকে চিরকালের জন্য তোমার খালা খালুকে দিয়ে দিয়েছেন। তারপর চুপ করে শাহিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
খলিল সাহেবের কথা শুনতে শুনতে শাহিন যতটা না রেগে গেল, তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি অপমান বোধ করল। কিন্তু কিছু বলার মতো কথা না পেয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
খলিল সাহেব তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আবার বলতে শুরু করলেন, জানি, এসব প্রশ্নের উত্তর তুমি দিতে পারবে না। তাই বলব, কুঁড়ে ঘরে শুয়ে রাজা হবার স্বপ্ন দেখ না। মনে রেখ, সমানে সমান না হলে জীবনের। সর্বক্ষেত্রে অশান্তি ভোগ করতে হয়। আমি তোমার ও শিউলির ভালো চাই। তাই ভবিষ্যৎ জীবনে তোমরা যেন অশান্তির আগুনে না জ্বল, সেজন্য এসব কথা বললাম। তোমাকে শিউলি নিয়ে এসেছে। তুমি এখন আমাদের মেহমান, নচেৎ চাবকে তোমার পিঠের ছাল তুলে নিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিতাম। তারপর নাতনিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, প্রেম করা ইসলামে নিষেধ জেনেও প্রেমের পথে পা বাড়ালি কেন। তুই নাতনি না হয়ে যদি নাতি হতিস, তাহলে চাবকে তোরও পিঠের ছাল তুলে নিতাম। তোর রুচিকে বলিহারি, এমন একজন হাভাতের ছেলের সঙ্গে প্রেম করবি ভাবতেই পারছি না। মনে হয় তোর বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে।
নানার কথা শুনতে শুনতে প্রথম থেকেই শিউলি নিরবে চোখের পানি ফেলছিল। নানা থেমে যেতে চোখ মুছে বলল, আমার বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পায়নি, পেয়েছে আপনার। তা না হলে ওকে পরীক্ষা করার কথা বলে ডেকে নিয়ে এসে যা-তা বলে অপমান করছেন। তারপর শাহিনের কাছে এসে ভিজে গলায় বলল, তোমাকে নিয়ে এসে মারাত্মক ভুল করেছি। নানাজি অপমান করবেন জানলে কিছুতেই নিয়ে আসতাম না। তারপর তার একটা হাত ধরে বেরিয়ে এসে গাড়িতে তুলে নিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল।
গাড়ি চালাতে চালাতে বারবার তাকে চোখ মুছতে দেখে শাহিন বলল, তোমার মানসিক অবস্থা ভালো নয়, গাড়ি এক সাইডে পার্ক কর। নচেৎ যে কোনো সময়ে এ্যাকসিডেন্ট করে বসবে।
শিউলি গাড়ি পার্ক করে শাহিনের দুটো হাত ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, বিশ্বাস কর, নানাজী এভাবে তোমাকে অপমান করবেন কল্পনাও করিনি। তারপর ধরা হাত দু’টোতে অনেক চুমো খেয়ে বলল, বল, আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ?
শাহিন নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তার দুটো হাত ধরে কয়েকটা চুমো খেয়ে বলল, তোমার নানাজি যা-তা বলে আমাকে অপমান করলেও কথাগুলো ঠিকই বলেছেন। কারণ শুধু উনিই নয়, এরকম ক্ষেত্রে যে কোনো গার্জেনই তাই বলতেন। অতএব তোমার ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। আর যতবার উঠবে, ততবারই তুমি ক্ষমা পাবে। যাই হোক, এখন কোথায় যেতে চাও বল, আমি ড্রাইভ করে নিয়ে যাব।
শাহিন ড্রাইভিং জানে শুনে শিউলি খুশি হয়ে বলল, কাজি অফিসে গিয়ে এক্ষুনি আমরা বিয়ে করব।
বিয়ের কথা শুনে শাহিন অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
কী হল, বিয়ের কথা শুনে কিছু বলছ না কেন?
এক্ষুনি বিয়ে করাটা কি উচিত হবে? ঝোঁকের মাথায় হঠাৎ করে কিছু করা ঠিক নয়। হাদিসে আছে, আমাদের নবী করিম (স) বলেছেন, “তাড়াহুড়ো । করে কোনো কাজ করতে নেই। তাড়াহুড়ো করে কোনো কিছু করা শয়তানের কাজ।” তাছাড়া মনীষীরা বলেছেন, “ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।” তাই বলছিলাম…
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে শিউলি বলল, এসব কথা জানি। আজ দু’বছর ধরে চিন্তা ভাবনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অতএব আর কোনো চিন্তা ভাবনা করা লাগবে না। অবশ্য তোমার ব্যাপারটা তুমি ভালো বুঝে। তবে আমি যতটুকু জানি, তোমাকে যতটা বিশ্বাস করি ও ভালবাসি, তার থেকে অনেক বেশি আমাকে বিশ্বাস কর ও ভালবাস। কি, ঠিক বলিনি?
হ্যাঁ ঠিক বলেছ।
তাহলে চল, কাজটা সেরে ফেলি বলে শিউলি গাড়ি ছেড়ে দিয়ে মৃদু হেসে বলল, ভয় নেই, এখন আর ইনশাআল্লাহ একসিডেন্ট করব না।
.
শাহিনকে নিয়ে শিউলি বেরিয়ে যাবার পর নাসিমা বানু স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন, এখন কী হবে?
খলিল সাহেব মৃদু হেসে বললেন, কী হবে দু’তিন ঘণ্টা পরে জানতে পারবে।
কাজটা কিন্তু তুমি ঠিক করনি। ঠিক করেছি, না বেঠিক করেছি, ওরা ফিরলেই জানতে পারবে।
নাসিমা বানু ভ্রু কুঁচকে বললেন, ওরা মানে, ঐ ছেলেটাও শিউলির সঙ্গে ফিরে আসবে নাকি? আমার তো মনে হয় ছেলেটা জীবনেও এখানে আসবে না।
খলিল সাহেব ঠোঁটে হাসি ধরে রেখে বললেন, আমার যতদূর ধারণা, ইনশাআল্লাহ ছেলেটা নিশ্চয় শিউলির সঙ্গেই ফিরে আসবে।
এটা তো তোমার অনুমান। অনুমান করে কিছু বলতে নবী করিম (স) নিষেধ করেছেন।
তা আমিও জানি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে জ্ঞানের অনুভূতিতে অনুমান করে কিছু বলা নিষেধ নয়। যাই হোক, এব্যাপারে আর কিছু বলতে চাই না। দেখ না, ছেলেটা শিউলির সঙ্গে ফিরে আসে কিনা।
শোন, কিচেনে গিয়ে বুয়াদের বলে দাও, একজন নতুন মেহমান দুপুরে খাবে। ভালো কিছু যেন রান্না করে।
স্বামী অনেক সময় অনুমান করে যা বলে, তা বেশিরভাগ ঠিক হয়, সে কথা নাসিমা বানু জানেন। তাই এখন তার কথা শুনে বেশ অবাক হলেও আর কিছু না বলে কিচেনে গেলেন।
.
কাজি অফিসের কাজ সেরে শিউলি যখন শাহিনকে গাড়িতে উঠতে বলল তখন শাহিন বলল, তুমি বাসায় যাও, আমি বাসে করে চলে যাব।
শিউলি কপট রাগ দেখিয়ে বলল গাড়িতে উঠ বলছি। শাহিন গাড়িতে উঠার পর গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলল, তুমি এখন আমাদের বাসায় যাবে।
শাহিন তার মুখের দিকে চেয়ে বলল, কী পাগলের মতো কথা বলছ? এখন গেলে তোমার নানা যদি দারোয়ান দিয়ে আমাকে বের করে দেন।
শিউলি বলল, মনে হয় তা করবেন না। যদি করেন, তাহলে আমিও তোমার সঙ্গে চলে আসব।
শাহিন বলল, চলে তো আসবে বললে, কিন্তু আমি তোমাকে নিয়ে কোথায় উঠব।
শিউলি হেসে উঠে বলল, কেন, হোটেলে উঠবে। তারপর গম্ভীর হয়ে বলল, এখন আর কোনো কথা বলবে না, শুধু দেখে যাও আমি কী করি। তারপর তাকে কী কী করতে হবে বলে দিল।
ফেরার পথে মসজিদ দেখতে পেয়ে শিউলি অল্পদূরে গাড়ি পার্ক করে বলল, ইমাম সাহেব খুৎবা পড়ছেন। তুমি জুম্মার নামায পড়ে এস, আমি এখানে অপেক্ষা করছি।
.
খলিল সাহেব জুম্মার নামায পড়ে আসার পর নাসিমা বানু জিজ্ঞেস করলেন, ভাত দিতে বলব। উনি প্রতিদিন জোহরের নামায পড়ে ভাত খান।
খলিল সাহেব বললেন, ওরা আসুক একসঙ্গে খাব।
প্রায় আধ ঘণ্টার মধ্যে গেটের কাছে এসে শিউলি হর্ন বাজাল।
দারোয়ান গেট খুলে দিতে গাড়ি ভেতরে নিয়ে এসে পার্ক করল। নামবার আগে শাহিনকে বলল, যা যা বলেছি মনে আছে তো?
শাহিন বলল, আছে; কিন্তু বেশ ভয় ভয় করছে।
শিউলি হেসে উঠে বলল, আমি মেয়ে, ভয় ভয় আমার করবে। তুমি ছেলে, তোমার করবে কেন? মনকে শক্ত কর, হয়তো ইনশাআল্লাহ কোনো কিছুই ঘটবে না।
হর্ন শুনে খলিল সাহেব স্ত্রীকে বললেন, নায়ক-নায়িকা এসে গেছে।
গাড়ি থেকে নেমে শিউলি শাহিনের হাত ধরে নানা নানির কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, আমি এই হাভাতেকে কাজি অফিসে বিয়ে করে এলাম। কথা শেষ করে প্রথমে নানাকে ও পরে নানিকে কদমবুসি করে বলল, আমাদের দোয়া করুন।
শাহিনও শিউলির কথামতো ওঁদেরকে সালাম দিয়ে কদমবুসি করে বলল, আমরা গুরুতর অন্যায় করেছি। আপনারা মহৎ, আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন।
খলিল সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কি, আমার কথা ঠিক হল? ওরা ফিরে আসবে বলিনি?
নাসিমা বানু বললেন, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। এখন ওদেরকে ক্ষমা করে দোয়া করবে না?
খলিল সাহেব বললেন, তা তো করতেই হবে। তবে শর্ত আছে।
শিউলি বলার আগে শাহিন বলল, বলুন মাথা পেতে নেব।
খলিল সাহেব গম্ভীরস্বরে বললেন, শিউলির নানা নানির মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে এখানে থাকতে হবে। তবে যতদিন না তোমাদের লেখাপড়া শেষ হচ্ছে, ততদিন তুমি নিচ তলায় গেস্টরুমে থাকবে আর শিউলি দোতলায় যেমন আছে তেমনি থাকবে। শেষ শর্তটা হল, এখন থেকে তোমার সব খরচ আমরা বহন করব।
শর্তের কথা শুনে শাহিন খুব অপমান বোধ করল। কিছুক্ষণ মুখ নিচু করে থেকে বলল, আপনার মতো মহৎ লোকের কাছে এরকম শর্ত আশা করিনি। আপনি পুরুষ হয়ে অন্য একজন পুরুষকে পুরুষতু বিসর্জন দিয়ে কাপুষের মতো ঘরজামাই করে রাখতে চাচ্ছেন। বলুন তো আমার জায়গায় আপনি হলে কী করতেন?
অনেক আগে যখন শিউলি নানাকে জানায়, শাহিনকে ভালবাসে এবং ভবিষ্যতে তাকে বিয়েও করবে তখন শুধু তার পরিচয় জেনে ছিলেন। পরে খুব বিশ্বস্ত লোকের দ্বারা শাহিনের সবকিছুর খবর নেন এবং শাহিন যে খুব সাধাসিধে সরল-সোজা, সৎচরিত্র ও ধার্মিক ছেলে জানতে পারেন। তাই তার আর্থিক অবস্থার কথা জেনেও ভেবেছিলেন এই ছেলের হাতেই নাতনিকে দেবেন। তবু তাকে পরীক্ষা করার জন্য নাতনিকে আজ নিয়ে আসতে বলেন এবং ঐসব কথা বলে অপমান করেন। শেষে ক্ষমা করার শর্ত দেন।
শাহিনের শেষের দিকের কথা শুনে খলিল সাহেব প্রথমে গম্ভীরতা বজায় রেখে বললেন, তোমার জায়গায় আমি হলে যা করতাম, তা তুমি কল্পনাও করতে পারতে না। তারপর হো হো করে হেসে উঠে নাতনির দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার নায়ক একশর মধ্যে এক’শ নাম্বার পেয়ে পাস করেছে।
কথাটা শুনে শাহিন ভেবাচেখা খেয়ে গেলেও শিউলি দ্রুত এগিয়ে এসে নানাজিকে আর একবার কদমবুসি করে বলল, কংগ্রাচুলেশন মাই সুইট নানাজি। তারপর শাহিনকেও করার জন্য ইশারা করে নানাজিকে বলল, এবার নিশ্চয় আমাদেরকে দোয়া করবেন?
শাহীন কদমবুসি করতে এলে তার হাত ধরে খলিল সাহেব বললেন, থাক ভাই কদমবুসি করতে হবে না। কদমবুসি করা ঠিক নয় জেনেও তোমরা করছ কেন? এমনিই দোয়া করছি; তোমাদের দাম্পত্য জীবন আল্লাহ সুখের ও শান্তি র করুক। পরকালের অনন্ত জীবনেও তোমাদেরকে জান্নাত নসিব করুক। তোমাদের অন্তরে আজীবন চিরবসন্তের বাতাস বইতে থাকুক। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিয়ে হায়াতে তৈয়েবা দিক। নবী করিম (স) এর উপর শতকোটি দরুদ ও সালাম পেশ করে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছি, তিনি যেন তার প্রিয় রাসুল (স) অসিলায় এই দোয়া কবুল করেন।
সবাই একসঙ্গে বলে উঠল আমিন। তারপর নাসিমা বানু আয়াদের ডেকে খাবার দিতে বললেন।