চার
পরের দিন রোজ ভার্সিটিতে গেলে এক সময় শিউলি জিজ্ঞেস করল, কীরে, তোর প্রেমিকবরের খবর কী?
রোজ কপট রাগ দেখিয়ে বলল, প্রেমিকবর কাকে বলে জানিস?
শিউলি হেসে উঠে বলল, জানি। একটু জোক করলাম আর কী।
রোজ বলল, এরকম জোক আর করবি না। তারপর বলল, সে অনেক কথা। চল, কোথাও বসি।
একটা নিরিবিলি জায়গায় বসে শিউলি বলল, নে, এবার শুরু কর।
রোজ নাদিমের বায়োডাটা বলে গত রাতে ফোনে যেসব কথা হয়েছে, তা থেকে যতটুকু বলার বলে বলল, সে আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
তুই কী বললি?
বললাম, আপনার বায়োডাটা ইনকোয়ারি করার পর সত্য হলে দেখা সাক্ষাতের ব্যবস্থা হবে।
তুই খুব ভালো কথা বলেছিস। বায়োডাটা ভালো; কিন্তু কী করে ইনকোয়ারি করবি কিছু ভেবেছিস?
তোকে একদিন বলেছিলাম আমার এক খালাত ভাই আমাদের বাড়িতে থেকে এখানেই মাস্টার্স করছে। তার বাড়ি কুমিল্লা। তাকে দিয়েই করাব ভেবেছি।
তুই তো বলেছিলি, সে তোর থেকে বড়। বড় ভাইকে দিয়ে ইনকোয়ারি করাবি, ব্যাপারটা ঠিক মেনে নিতে পারছি না।
রোজ হেসে উঠে বলল, সে আমার থেকে দেড় বছরের বড়। তাকে বড় বলে আমি মানিই না। আমরা বন্ধুর মতো তুই তোকারি করে কথা বলি।
শিউলি বলল, তাই-ই বল, আমার কাছে যেন কেমন কেমন মনে হচ্ছিল। যাক, ইনকোয়ারি করার পর রেজাল্ট জানাবি তো?
রোজ বলল, অফকোর্স। তোকে জানাব না তো কাকে জানাব? চল, এবার ক্লাসে যাই।
একদিন রোজ শাহিনকে বলল, আমার একটা কাজ করে দিবি?
শাহিন বলল, সাধ্যের মধ্যে হলে করে দেব।
রোজ তাকে নাদিমের ঠিকানা দিয়ে বলল, এই ছেলেটার সম্পর্কে সবকিছু জেনে আমাকে জানাবি।
শাহিন কাগজটার উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই ছেলেকে তুই চিনিস?
সে কথা পরে শুনিস, যা বললাম করতে পারবি কিনা বল।
পারব না কেন? সামনের সপ্তাহে কয়েকদিনের জন্য ভার্সিটি বন্ধ থাকবে। সে সময় বাড়িতে যাব ভেবেছি। তখন একদিন ছেলেটার বাড়িতে গিয়ে সবকিছু জেনে আসব।
তুই না একটা গাধা।
আমি আবার গাধার মতো কি বললাম?
গাধা নয়তো কী? ভার্সিটিতে পড়ছিস আর একথা জানিস না, কারও সম্পর্কে কিছু জানতে হলে অন্যের কাছ থেকে জানতে হয়। সব থেকে ভালো জানা যায় তার শত্রুর কাছ থেকে। এক বিখ্যাত কবি, ঔনার নাম আমার মনে নেই। তিনি একটা কবিতায় লিখেছেন,
“দোষ যদি আপনার চাহ জানিবার,
অরাতির কাছে পাবে সন্ধান তাহার।”
সরি, কথাটা আমিও জানতাম। তবে ভুলে গিয়েছিলাম।
তোরা, ছেলেরা কি সবাই একই রকম? জানা থাকলেও কাজের সময় মনে থাকে না?
শাহিন বলল, একথা বলছিস কেন? আর কেউ বুঝি আমার মতো তোকে বলেছে?
নাদিমের কথাটা মনে পড়তে হঠাৎ করে রোজের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। শাহিনের কথা শুনে তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, না মানে একদিন একটা ছেলে বলেছিল।
কে রে ছেলেটা?
বলা যাবে না।
শাহিন কাগজটা দেখিয়ে বলল, আমার তো মনে হচ্ছে এই ছেলেটা।
রোজ বলল, তুই না দিন দিন খুব ভেঁপো হয়ে যাচ্ছিস। ছোট বোনের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় সেকথাও জানিস না।
তুই আমাকে বড় বলে মানিস? মানলে প্রেমিকের বায়োডাটা ইনকোয়ারি করার কথা বলতিস না।
তুই কিন্তু এবার ছোট বোনের সঙ্গে ফাজলামি করছিস।
ঠিক আছে, আর কোনো কিছু করব না তোর সঙ্গে।
কথাটা মনে রাখবি। আর শোন, কাজটা যদি ঠিকমতো করতে পারিস, তা হলে তোকে এমন একটা সারপ্রাইজ দেব, যা তুই সারাজীবনেও ভুলতে পারবি না।
সারপ্রাইজ না দিলেও তোকে সুখী করার জন্য কাজটা করে দেব।
আমিও তোকে কথা দিলাম, আমি সুখী হই, বা না হই তবু তোকে সারপ্রাইজটা দেব। আর কাজটা না করে দিলেও দেব।
শাহিন বলল, একটা কথা না বলে পারছি না, বিয়ের আগে প্রেম-ভালবাসা অথবা মন দেয়া-নেয়া ইসলামে নিষেধ। তুই একজন ধার্মিক মেয়ে হয়ে এ পথে পা বাড়ানো কি উচিত হয়েছে?
রোজ বলল, তুই অবশ্য ঠিক কথা বলেছিস, আর আমিও সেকথা জানি। তবে কী জানিস, ছেলেটার সঙ্গে পরিচয় বা মেলামেশা তো দূরের কথা, একবারও দেখা সাক্ষাৎ পর্যন্ত হয়নি।
তাই নাকি? তা হলে তার বায়োডাটা পেলি কী করে? আর তার সবকিছুর খোঁজ-খবর নিতেই বা চাচ্ছিস কেন?
সেসব আর একদিন শুনিস। তুই এখান যা। আর শোন, এই ব্যাপারটা অন্য কেউ যেন না জানে।
.
রোজের বায়োডাটা নেয়ার পর নাহিদ চিন্তা করল, রোজকে বিয়ে করার কথা বাবা বা ভাইয়াদের তো বলা যাবে না, মাকে দিয়ে বলাতে হবে। মা রোজদের সম্পর্কে সবকিছু জানতে চাইলে বায়োডাটা দিয়ে খোঁজ-খবর নিতে বললে হবে; কিন্তু সেখানে গিয়ে তাদের খারাপ কিছু দেখে যদি কুটুম্বিতা করতে রাজি নাহয়? তার চেয়ে মাকে জানাবার আগে তারই উচিত রোজদের গ্রামে গিয়ে তাদের সবার খোঁজ-খবর নেয়া। এইসব চিন্তা করে নাদিম এক শুক্রবারে গাজীপুর টাউনে গিয়ে প্রথমে জুম্মার নামায পড়ল। তারপর হোটেলে খাওয়া দাওয়া করে মসজিদে ফিরে এসে খাদেমকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ইমাম সাহেব কোথায় থাকেন?
খাদেম মসজিদের পাশে দুটো রুম দেখিয়ে বললেন, উত্তর দিকের রুমটায় ইমাম সাহেব থাকেন।
নাদিম ইমাম সাহেবের রুমের দরজার কাছে এসে পর্দার বাইরে থেকে সালাম দিল।
ইমাম সাহেব সবে মাত্র খেয়ে উঠে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। কাউকে সালাম দিতে শুনে সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, ভেতরে আসুন।
নাদিম পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।
ইমাম সাহেব একটা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন।
ইমাম সাহেব বেশ বয়স্ক লোক। চুল দাড়ি পেকে সব সাদা শনের মতো হয়ে গেছে। তাই দেখে নাদিম বসে বলল, দেখুন, আমি আপনার নাতির বয়সি, আমাকে তুমি করে বললে খুশি হব।
ইমাম সাহেব বললেন, শুনে আমিও খুশি হলাম। তোমার মতো আমার একটা নাতি ছিল। সৌদিতে চাকরি করতে গিয়ে রোড এ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে। তা ভাই, তোমাকে তো চিনতে পারছি না।
নাদিম বলল, আমি ঢাকা থেকে এসেছি।
আমার কাছে কেন এসেছ বল।
কিছু মনে করবেন না, আমি একজনের সম্পর্কে কিছু জানতে এসেছি।
ওনার নাম বল।
জামাল উদ্দিন।
ইমাম সাহেব মৃদু হেসে বললেন, আরে ভাই শুধু নাম বললে হবে? ঠিকানাও তো বলতে হবে। ঐ নামে তো অনেককে চিনি।
নাদিম ঠিকানা বলল।
ইমাম সাহেব বললেন, হ্যাঁ, ওনাকে খুব ভালোভাবেই চিনি। ওনার আর আমার বাড়ি একই গ্রামে। কী জানতে চাও বল?
নাদিম বলল, ওনার আর্থিক অবস্থা কেমন? উনি কী করেন? ধর্মের বিধি নিষেধ মেনে চলেন কি না, স্বভাব-চরিত্র কেমন? ছেলেমেয়ে কয়জন? তাদেরও স্বভাব চরিত্র কেমন? তারা কে কী করে?
ইমাম সাহেব জ্ঞানী ও বিচক্ষণ লোক। নাদিমের কথা শুনে যা বোঝার বুঝে গেলেন। তবু জিজ্ঞেস করলেন, ওনার সম্পর্কে এত কিছু জানতে চাচ্ছ কেন?
নাদিম বলল, আমার তো মনে হচ্ছে আপনি বুঝতে পেরেও জিজ্ঞেস করেছেন?
হ্যাঁ ভাই, তোমার কথা ঠিক। তা তুমি ছেলের না মেয়ের পক্ষের হয়ে এসেছ?
বেয়াদবি মাফ করবেন, আগে আমার কথার উত্তর দিন। তারপর আপনার কথার উত্তর দেব।
ইমাম সাহেব অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, জামাল উদ্দিন সরকারি চাকরি করেন। ওনার কোনো ছেলে সন্তান নেই। একটা মাত্র মেয়ে। বিয়ের পর অনেক বছর কোনো সন্তান হয়নি। তাই ওনার স্ত্রী বড়বোনের একটা ছেলেকে নিয়ে আসেন মানুষ করার জন্য। আল্লাহর কী শান, বোনের ছেলেকে নিয়ে আসার এক দেড় বছর পর একটা মেয়ে সন্তান হয়। তারপর আর কোনো সন্তান হয়নি। মেয়েটি জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে।
নাদিম জিজ্ঞেস করল, ওনারা ধর্ম-কর্ম মেনে চলেন কিনা বললেন না, আর্থিক অবস্থা কেমন তাও বললেন না।
ইমাম সাহেব বললেন, আগে ধর্ম-কর্ম তেমন একটা মেনে চলতে দেখিনি। মেয়েটি ভার্সিটিতে ভর্তি হবার কিছুদিন পর থেকে সবাইকে নিয়মিত নামায রোযা করতে দেখি। মেয়েটা বোরখা পরে ভার্সিটি যায়। আর আর্থিক অবস্থা খুব ভালো। এবার আমার কথার উত্তর দাও।
নাদিম বলল, আমি ছেলের পক্ষ থেকে জামাল উদ্দিনের মেয়ের জন্য এসেছি। তবে এখন বিয়ের প্রস্তাব দেব না। একই গ্রামে বাড়ি যখন, তখন। ওনাদের বংশ কেমন, উনি বা ওনার পূর্ব পুরুষরা কেউ মদ তাড়ি খেতেন কিনা, সুদের ব্যবসা করতেন কিনা নিশ্চয় জানেন?
ইমাম সাহেব বললেন, না ভাই, আমার জ্ঞান হবার পর থেকে আজ পর্যন্ত ওসব কিছু শুনিনি। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি করে বলতো ভাই, পাত্র তোমার কে হয়?
বলাটা ঠিক হবে কী না নাদিম চুপ করে চিন্তা করতে লাগল।
কী হল ভাই, চুপ করে আছ কেন? বলতে না চাইলে জোর করব না। তবে আমার বিশ্বাস, পাত্র তুমি নিজেই।
নাদিম মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ, আপনার অনুমান ঠিক। মেহেরবানী করে কথা দিন, আমার ব্যাপারে মেয়ের মা-বাবা বা ওনাদের আত্মীয়দের কাউকে কিছু বলবেন না।
ইমাম সাহেব বললেন, বললেও কারও কোনো ক্ষতি হবে না। তবু তুমি যখন নিষেধ করছ তখন কথা দিলাম, এসব কথা এখানকার দ্বিতীয় কেউ জানবে না।
নাদিম শোকর আলহামদুলিল্লাহ বলে বলল, আপনাকে অনেক অনেক মোবারকবাদ জানাচ্ছি। দোয়া করুন, আল্লাহ যেন আপনাকে দাদুর মতো জীবনভর মনে রাখতে পারি। চলুন মিষ্টিমুখ করাব।
না ভাই, আজ নয়। কিছুক্ষণ আগে ভাত খেয়েছি। আল্লাহ যেদিন তোমার মনস্কামনা পূরণ করবেন, সেদিন খাব।
দাদু ভাই, আর একটা কথা, ঐ মেয়েটার স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন?
একই গ্রামে বাড়ি হলেও আমাদের বাড়ি অন্য পাড়ায়। তবু যতটুকু জানি, ওর মতো মেয়ে সচারাচর দেখা যায় না।
নাদিম বলল, দাদু, আল্লাহ রাজি থাকলে আপনাকে দিয়ে প্রস্তাব দেওয়াব।
ইমাম সাহেব বললেন, তুমি যে আমাকে দিয়ে প্রস্তাব দেয়াবে বলছ, তা কী করে হয়? আমি তো তোমাদের সম্পর্কে কিছুই জানি না।
নাদিম বলল, ভুল করে ফেলেছি। তারপর একটা কাগজে নাম ঠিকানা লিখে দেয়ার সময় বলল, একদিন এসে আপনাকে আমাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাব। স্বচক্ষে সরজেমিন করবেন।
ইমাম সাহেব বললেন, আল্লাহ রাজি থাকলে তা না হয় করব। এখন বলত, এই মেয়ের খোঁজ তুমি পেলে কী করে?
মাফ করবেন দাদু, এখন সেকথা বলতে পারব না। তবে ইনশাআল্লাহ বিয়ের পর বলব। তারপর জিজ্ঞেস করল, নিশ্চয় আপনার মোবাইল আছে?
আজকাল রিকশাওয়ালা, কুলি ও ভিখেরীদের যখন মোবাইল আছে তখন। আমার কী আর না থেকে পারে।
মোবাইলটা দিন, আমার নাম্বার ও নাম সেভ করে দিই। সেভ করার পর মোবাইল ফেরত দেয়ার সময় বলল, আপনার নাম্বার বলুন, আমার মোবাইলে সেভ করে নিই।
সেভ করার পর নাদিম বলল, কবে আমাদের বাড়ি যেতে পারবেন ফোন করে জানাবেন, আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাব। ভাববেন না আপনাকে ফাঁকি দেব। বিয়ে হোক বা না হোক, ঘটকালি করার জন্য উপযুক্ত সালামি পাবেন।
ইমাম সাহেব হেসে উঠে বললেন, নাতির জন্য ঘটকালি করে কোনো দাদু কি সালামি নেয়, না নিতে পারে?
আপনি অবশ্য ঠিক কথা বলেছেন? তবে নাতি যদি খুশি হয়ে দাদুকে কিছু দেয়, তাতে তো কোনো দাদুর মনে করার কিছু নেই। তা হলে এবার আসি দাদু আপনার ফোনের প্রতীক্ষায় থাকব। তারপর নাদিম সালাম বিনিময় করে বিদায় নিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওয়ানা দিল।
.
রোজের খালাত ভাই শাহিন বাড়িতে আসার দুদিন পর বাড়াইল গ্রামে গিয়ে বিভিন্ন লোকজনের কাছে নাদিম ও তার পরিবারবর্গের খোঁজ-খবর নিয়ে ফিরে এল। তারপর ভার্সিটি খোলর আগের দিন গাজীপুর এল।
সুযোগমতো একসময় রোজ শাহিনকে বলল, কী খবর বল।
শাহিন নাদিমের সবকিছু ভালো জেনেছে। রোজ কী করে তার বায়োডাটা পেল এবং কেনই বা তার খোঁজ-খবর নিতে বলেছে, তা জানার জন্য দুষ্টমী করে বলল, খবর খুব খারাপ। নাদিম তোকে যে বায়োডাটা দিয়েছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। তেড়েল মাতাল বংশের ছেলে। আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। ছেলেমেয়ে পড়িয়ে লেখাপড়া করেছে। কথা শেষ করে রোজের মুখের দিকে চেয়ে রইল কোনো পরিবর্তন হয় কিনা দেখার জন্য।
রোজ বুঝতে পারল, শাহিন কোনো কারণে নাদিমের সম্পর্কে মিথ্যে বলছে। তাই খুব রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, সত্যি বললি, না ফাজলামি করছিস?
তার ওপর রোজ যে খুব রেগে গেছে তা বুঝতে পেরে শাহিন ঘাবড়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, তুই অত রেগে গেছিস কেন?
রোজ রাগ সামলে নিয়ে সংযত কণ্ঠে বলল, কই রেগে গেছি? যা জিজ্ঞেস করলাম বলবি তো?
শাহিন বলল, বলতে যে ভয় করছে।
সত্যি বলতে কাপুরুষরা ভয় পায়। তা ছাড়া কোনো মুসলমানের মিথ্যা বলা উচিত নয়। কারণ মিথ্যা বলা হারাম। এটা হাদিসের কথা।
সত্য বলব, তবে তোকে ওয়াদা করতে হবে, নাদিমের বায়োডাটা পেলি কী করে এবং তার সবকিছু জানতে চাচ্ছিস কেন বলতে হবে।
রোজ বলল, ঠিক আছে, ওয়াদা করলাম।
শাহিন বলল, ওদের গ্রামে গিয়ে যাকেই নাদিমের ও তার পরিবারবর্গের কথা জিজ্ঞেস করেছি, তারা সবাই ভালো বলেছে। শুধু তাই নয়, ওর মতো ছেলে নাকি লাখে একটা। আর ও যে বায়োডাটা দিয়েছে, তা সব সত্যি। তবে ফেরার পথে ওদের গ্রামের শেষ প্রান্তে এসে একটা সুন্দর ও হ্যান্ডসাম ছেলের সঙ্গে দেখা হতে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার বাড়ি কোন গ্রামে?
সালামের উত্তর দিয়ে বললাম, আপনার সঙ্গে পরিচয় নেই, অথচ আমার বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করছেন কেন?
ছেলেটা মৃদু হেসে বলল, এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। তাই এদিকে আপনাকে নতুন দেখে জিজ্ঞেস করলাম। মনে হচ্ছে বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করতে অসন্তুষ্ট হয়েছেন।
বললাম, আমার বাড়ি কুমিল্লা।
ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, এখানে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে এসেছিলেন বুঝি?
বললাম, না, একটা ছেলের সম্পর্কে খোঁজ নিতে এসেছিলাম।
ছেলেটি আবার জিজ্ঞেস করল, খোঁজ পেয়েছেন, না পেলে বলুন। আমার বাড়ি এই গ্রামে, আমি হয়তো আপনাকে সহযোগিতা করতে পারব।
ছেলেটাকে দেখে ও তার কথাবার্তা শুনে মনে হল, ভদ্র ঘরের শিক্ষিত ছেলে। নাদিমের সম্পর্কে এই গ্রামের সবাই ভালো বললেও এই ছেলে কী বলে জানা যাবে ভেবে বললাম, আপনাদের গ্রামের নাদিম নামে একটা ছেলের সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে এসেছিলাম।
ভার্সিটি বন্ধ থাকায় আজ নাদিম বাড়ি আসছিল। শাহিনের কথা শুনে মনে মনে চমকে উঠে ভাবল, তা হলে কি রোজ এই ছেলেকে আমার খোঁজ নিতে পাঠিয়েছে? কিন্তু ছেলেটাতো বলল, তার বাড়ি কুমিল্লা?
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে বললাম, কী ভাই, নাদিমকে চেনেন নাকি?
ছেলেটা বলল, হ্যাঁ, চিনি।
বললাম, তা হলে বলুন ছেলেটার স্বভাব-চরিত্র কেমন?
ছেলেটা রাস্তার পাশে একটা চা-দোকান দেখিয়ে বলল, খুব ক্লান্তি লাগছে। চলুন, ঐ চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে বলব।
চায়ে চুমুক দিয়ে ছেলেটা বলল, আগে আপনি বলুন, নাদিমের সম্পর্কে কেন জানতে এসেছেন? সে কি আপনাদের গ্রামে কোনো অপকর্ম করেছে?
বললাম, না-না, ওসব কিছু নয়। আমার এক আত্মীয়ের সঙ্গে নাদিমের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। তাই একটু খোঁজ খবর নিতে এসেছিলাম।
ছেলেটা বলল, তা নাদিমের সম্পর্কে কী খবর জানলেন? ভালোনা মন্দ?
বললাম, “গ্রামের অনেককে জিজ্ঞেস করেছি, সবাই বলল, খুব ভালো ছেলে। এরকম ছেলে আজকাল দেখাই যায় না। তা আপনি কী বলেন?”
ছেলেটা বলল, আপনাকে যারা বলেছে, তারা তার বাইরের দিকটা দেখেছে। তা ছাড়া ভিন গাঁয়ের কেউ কারও সম্পর্কে জানতে চাইলে সবাই তো ভালো বলবেই। কারণ কেউ নিজের গ্রামের ছেলের দুর্নাম করে না।
বললাম, সে যাই হোক, আপনিও কি তাই বলবেন?
ছেলেটা বলল, না। নাদিমদের সঙ্গে আমাদের অনেক দিনের শক্রতা। তাই সত্য কথাই বলব। সে তেড়েল মাতাল বংশের ছেলে। তার বাপ-চাচারা এখনও তাড়ি খায়। ধর্ম-কর্ম কেউ মানে না। নাদিমের চরিত্রও ভালো না। কলেজে পড়ার সময় একটা মেয়ের সঙ্গে ফষ্টি-নষ্টি করে ধরা পড়ে। সেজন্যে গ্রামে থাকতে না পেরে ঢাকায় গিয়ে একজনের বাড়িতে লজিং থেকে তাদের ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে নিজে লেখাপড়া করছে।
বললাম, কিন্তু গ্রামের লোকজন তো কেউ তার সম্পর্কে এতটুকু খারাপ কিছু বলল না। মনে হচ্ছে আপনি শত্রু বলে তার দুর্নাম করছেন।
ছেলেটা বলল, আপনি বোধ হয় জানেন না, কারও সম্পর্কে কিছু জানতে হলে তার শত্রুকে জিজ্ঞেস করতে হয়। আপনজনেরা ও বন্ধুর দোষ চেপে গিয়ে তার শুধু গুণগুলো বলবে। যাই হোক, আমার কথা বিশ্বাস করুন বা না করুন, যা সত্যি তাই বললাম।
ছেলেটার কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বললাম, কথাগুলো জানিয়ে অনেক উপকার করলেন। তারপর তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে আসার সময় তোর কথা মনে পড়ল। তুইও একদিন আমাকে ঐ কথা বলেছিলি। এখন কী করবি বল।
শাহিনের প্রথম দিকের কথা শুনে রোজ আনন্দিত হলেও শেষের কথাগুলো শুনে খুব চিন্তায় পড়ে গেল। ভাবল, নাদিম কি সত্যিই খারাপ ছেলে?
তাকে চুপ করে ভাবতে দেখে শাহিন বলল, যা কিছু সিদ্ধান্ত নিবি খুব ভেবে চিন্তে নিবি। আর আমাকে অবশ্যই জানাবি।
রোজ জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, ছেলেটা দেখতে কেমন বলতো?
শাহিন বলল, একটু আগে বললাম না, সুন্দর হ্যান্ডসাম ছেলে?
তাতো বলেছিস, আমার জিজ্ঞেস করার উদ্দেশ্য হল, তাকে ভালো ভাবে লক্ষ্য করে বুঝতে পারিস নি, সত্য বলল, না মিথ্যে বলল?
সেরকম কিছু বুঝতে পারিনি; তবে লম্বা-চওড়া পেটাই শরীর। মনে হয় নিয়মিত ব্যায়াম করে অথবা কংফু ক্যারাটে পারদর্শী।
রোজ বলল, নাদিম ও তার বাপ-চাচাঁদের সম্পর্কে যেসব কথা বললি, সেসব যে সত্য প্রমাণ দিতে পারবি?
শাহিন বলল, প্রমাণ দেব কী করে? তবে আল্লাহ পাকের নামে কসম খেয়ে বলতে পারি, যা কিছু বলেছি সত্য বলেছি। আর একথা নিশ্চয় জানিস, কোনো মুসলমানই আল্লাহ পাকের নামে মিথ্যে কসম খেতে পারে না। কারণ আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বলেছেন, “আল্লাহ পাকের নামে মিথ্যা কসম খাওয়া বড় গুনাহ।”
এবার যে কথা বলবি বলে ওয়াদা করেছিস বল।
রোজ বলল, তুই ভার্সিটিতে পড়ছিস, এই সামান্য ব্যাপারটা বুঝতে পারছিস না?
শাহিন বলল, তা আর পারিনি; কিন্তু তুই তো বলেছিলি, নাদিমের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎও হয়নি।
রোজ বলল, যা সত্যি তাই বলেছি। তারপর কীভাবে তাদের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বলল।
শাহিন বলল, তোর মতো ধার্মিক মেয়ে মোবাইলে প্রেম করবি ভাবতেই পারছি না। তার সম্পর্কে গ্রামের লোকেরা ভালো বললেও ফেরার সময় অন্য ছেলেটা যেসব কথা বলল, সেসব যদি সত্যি হয়, তা হলে কী হবে?
রোজ বলল, তুই ভালো কথা বলেছিস। কি জানিস, প্রেম ভালবাসা এমন এক জিনিস, যা নাকি ভালোমন্দ বিচার করে না, যাকে বলে অন্ধ।
তাকে থামিয়ে দিয়ে শাহিন বলল, তাই যদি হয়, তা হলে সে কথা জেনেও তুই ঐ পথে পা বাড়ালি কেন?
তুই তো আমাকে কথাটা শেষ করতে দিলি না। বলছি শোন, প্রেম ভালবাসা অন্ধ হলেও আমি তা বিশ্বাস করি না। তাই তো তোকে নাদিমের সবকিছু সত্য মিথ্যা যাচাই করার জন্য তাদের গ্রামে পাঠিয়েছিলাম।
ভবিষ্যতে তুই কি নাদিমকে বিয়ে করতে চাস?
হ্যাঁ, চাই।
তার সম্পর্কের এত খারাপ খবর শোনার পরও একথা বলতে পারলি?
পারব না কেন? গ্রামের সবলোক যাকে ভালো বলেছে, সে ভালো না হয়ে পারে না। আর যে ছেলেটা তোকে তার সম্পর্কে খারাপ বলেছে, আমার মন বলছে সেই-ই নাদিম।
শাহিন অবাক হয়ে বলল, হঠাৎ তোর মন একথা বলছে কেন?
কেনর উত্তর দিতে পারব না। তবে আমি হান্ড্রেড না হলেও এইট্টি পার্সেন্টে সিওর, ঐ ছেলেটাই নাদিম।
তোর তো সবেমাত্র অনার্স থার্ড ইয়ার। নাদিম যদি এরমধ্যে তোকে বিয়ে করতে চায়, তা হলে কি পড়াশোনা বন্ধ করে দিবি?
পড়াশোনা, বন্ধ করব না। এর মধ্যে বিয়ে করতে চাইলে বলব, মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর আমরা বিয়ে করব।
সেশন জটে পড়লে তো তিন চার বছর কিংবা আরও এক বছর নাদিমকে অপেক্ষা করতে হবে। অতদিন নাদিম যদি অপেক্ষা করতে না চায়?
তাহলে বলব, বিয়ের পরও পড়াশোনার সুযোগ দিতে হবে। আশা করি, আমার কথা নিশ্চয় নাদিম রাখবে।
ধর, খালা খালু যদি নাদিমের সঙ্গে বিয়ে দিতে না চান, তখন কী করবি?
যা করব তখন তুই দেখতে পাবি। আর বেশি বকবক না করে এখন তুই যাতো।
শাহিন কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, কী যেন আমাকে একটা সারপ্রাইজ দিবি বলেছিলি?
রোজ বলল, হ্যাঁ, দেব। তবে এখন নয়, যখন দেব তখন জানতে পারবি।
শাহিন আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গেল।