দুই
মেয়েটির নাম রোজিনা আখতার। ডাক নাম রোজ। দেখতে অপরূপা না হলেও রূপসী। বাবা জামাল উদ্দিন সরকারি বড় অফিসার। মা তাহেরা বেগম শিক্ষিতা গৃহিণী।
বিয়ের পর পাঁচ-ছয় বছর তাহেরা বেগমের পেটে সন্তান না হওয়ায় স্বামী স্ত্রী দু’জনেরই মনে শান্তি নেই। জামাল উদ্দিন নিজের ও স্ত্রীর সবকিছু ডাক্তারি পরীক্ষা করিয়েছেন। ডাক্তাররা বলেছেন, কারও কোনো দোষ নেই। অনেকের দেরিতে সন্তান হয়। আপনাদেরও সেরকম হতে পারে।
এরপর আরও দু’বছর তাহেরা বেগমের পেটে সন্তান না আসায় একদিন তিনি স্বামীকে বললেন, আমার বড় বোনের দুটো ছেলে ও একটা মেয়ে। এ বছর আরও একটা ছেলে হয়েছে। ছেলেটা পেটে থাকতে বুবু খুব অসুস্থ ছিল। ছেলে হবার পর আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বুবুর শাশুড়ি তাকে উঠানো দুধ খাইয়ে মানুষ করছেন। তুমি রাজি থাকলে ঐ ছোট ছেলেটাকে আমি মানুষ করতে চাই। মুরুব্বিদের মুখে শুনেছি, “যে মেয়ের বাচ্চা হয় না, সে যদি অন্য কোনো মেয়ের বাচ্চাকে মানুষ করে, তা হলে তারও বাচ্চা হয়।”
জামাল উদ্দিন অনেক সময় গভীর রাতে স্ত্রীকে কাঁদতে দেখেছেন। প্রথম প্রথম দেখে ভাবতেন, হয়তো কোনো দুঃস্বপ্ন দেখে কাঁদছে। তারপর আরও কয়েক রাতে কাঁদতে দেখে একদিন কাঁদার কারণ জিজ্ঞেস করেন।
তাহেরা বেগম স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে বলেন, আমাদের যদি একটা সন্তানও থাকত, তা হলে, কথাটা শেষ করতে না পেরে ফুঁপিয়ে উঠেন।
জামাল উদ্দিনও সন্তানের জন্য বেদনা অনুভব করেন; কিন্তু সে কথা স্ত্রীকে বুঝতে দেননি। স্ত্রীকে ফুঁপিয়ে উঠতে দেখে নানান কথা বলে প্রবোধ দিয়েছেন। আজ স্ত্রীর কথা শুনে মনের মধ্যে আবার নিঃসন্তানের বেদনা অনুভব করলেন। তাই না করতে পারলেন না। বললেন, ঠিক আছে, অনুমতি দিলাম; কিন্তু তোমার বড় আপা ও দুলাভাই কি রাজি হবেন?
তাহেরা বেগম বললেন, তাদের মতামত নিয়েই তোমাকে কথাটা বলেছি।
জামাল উদ্দিন বললেন, তাদেরকে বলল, “সারাজীবনের জন্য ঐ ছেলেকে আমাদের কাছে দিয়ে দিতে হবে। আমরা ওকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করব। তারপর রুজী-রোজগারের ব্যবস্থা করে বিয়ে দেব। তারা যেন কখনও ছেলের দাবি না করেন।
তাহেরা বেগম বললেন, ওসব নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তুমি বলার আগেই আমি বড় আপা ও দুলাভাইয়ের সঙ্গে পাকা কথা বলে নিয়েছি।
জামাল উদ্দিন বললেন, তা হলে তো আপত্তি করার কোনো কারণই নেই।
তাহেরা বেগমের বড় আপা নাসরীনের বিয়ে হয়েছে কুমিল্লা টাউনে। তিনি ছোট ছেলের নাম রেখেছেন শাহিন।
তাহেরা বেগম শাহিনকে নিয়ে আসার দেড় বছর পর একটা কন্যা সন্তান প্রসব করেন। সেই মেয়েই রোজিনা ওরফে রোজ। রোজের পর ওনার আর কোনো সন্তান হয়নি।
রোজ এখন জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটিতে ইসলামিক হিস্ট্রিতে অনার্স। করছে। এটা তার দ্বিতীয় বর্ষ। আর শাহিন একই ভার্সিটিতে জিওগ্রাফীতে অনার্স করছে। এখন তার তৃতীয় বর্ষ চলছে। ওরা দেড় দু’বছরের ছোট বড় হলেও তুই তোকারী করে কথা বলে।
রোজদের বাড়ির কেউ ধর্মের বিধি বিধান মেনে চলত না। রোজ ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর শিউলি নামে একটা ধার্মিক মেয়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। শিউলিই তাকে কুরআন হাদিসের বাণী শুনিয়ে ধর্মের পথে এনেছে। রোজ আবার প্রথমে শাহিনকে ও পরে মা-বাবাকে কুরআন হাদিসের বাণী শুনিয়ে ধর্মের পথে এনেছে।
আজ প্রায় একমাস হয়ে গেল ছেলেটা ফোন না করায় রোজ ভাবল, ছেলেটা ঠিকই বখাটে। তাই আমার কাছে সুবিধে করতে না পেরে হয়তো অন্য কোনো মেয়ের পিছনে লেগেছে। এমন সময় মোবাইলে রিং হচ্ছে শুনে ছেলেটার নাম্বার উঠেছে দেখে চমকে উঠে ফোন রিসিভ করবে কিনা চিন্তা করতে লাগল।
আট দশবার রিং হয়ে লাইন কেটে যাওয়ার পর আবার রিং বাজতে শুরু করলে রিসিভ করে রাগের সঙ্গে কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই ছেলেটাকে সালাম দিতে শুনে থেমে গেল। তারপর গম্ভীরস্বরে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আমার পড়াতে আপনি খুব ডিস্টার্ব করছেন, এটা কি ঠিক হচ্ছে? আমার পিছনে লেগেছেন কেন বলুন তো? আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করিনি; তবু আপনি আমার ক্ষতি করছেন, কেন? রাত বারটা পর্যন্ত আমি পড়াশোনা করি। আপনি যদি সত্যিই ভালো ছেলে হন, তা হলে আর কোনোদিন আমাকে ফোন করবেন না।
নাহিদ দুঃখিত গলায় বলল, সরি, এক্সট্রিমলি সরি। আপনি এসময় পড়াশোনা করেন জানলে ফোন করতাম না। এবার বলুন, কখন ফোন করলে আপনার ডিস্টার্ব হবে না?
রোজ বলল, কিন্তু কেন আপনি আমার পেছনে লেগেছেন?
তার কথাগুলো নাদিমের কানে কান্নার মতো শোনাল। বলল, প্লিজ, ক্ষমা করে দিন। আসল কথা কী জানেন, প্রথম দিন রং নাম্বারে আপনার কণ্ঠস্বর শুনে এত মুগ্ধ হয়েছি যে, তারপর থেকে বারবার শুনতে ইচ্ছা করে। আপনি আমাকে খারাপ ছেলে ভাবতে পারেন ভেবে আপনার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য প্রতিদিন ফোন করার ইচ্ছে হলেও করিনি। প্লিজ, আপনার নামটা বলবেন?
কেন? নাম জেনে কী হবে?
মনে হচ্ছে কণ্ঠস্বরের মতো আপনার নামটাও সুন্দর হবে।
তাতে আপনার কী?
স্মৃতিতে গেঁথে রাখব আর ভাববো, সুন্দর কণ্ঠের মেয়েটির নামও সুন্দর।
নাদিমের কথা শুনে রোজের রাগ পড়ে গেল। ভাবল, ছেলেটা ভদ্র ঘরের, বখাটে হতে পারে না। বলল, আপনি কী করেন?
চাকরি করি।
কতদূর লেখাপড়া করেছেন।
বাংলায় অনার্স নিয়ে মাস্টার্স করেছি।
তা হলে বখাটের মতো আচরণ করছেন কেন?
ভুল করছেন, কোনো মুসলমান বখাটে হতে পারে না।
কিন্তু আপনি তোতা…
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে নাদিম বলল, আমি মোটেই বখাটে নই। আপনার সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর আমার মনকে পাগল করে তুলেছে। তাই মাঝে মাঝে ফোন করি।
রোজ হেসে উঠে বলল, শুনেছি ছেলেমেয়েরা একে অন্যের রূপ দেখে মুগ্ধ হয়। আবার অনেকে ছেলে বা মেয়ের বাবার ঐশ্বর্য দেখে প্রেমে পড়ে। আমি তো এ দুটোর কোনোটার মধ্যে পড়িনি। তবু কেন আমার পিছনে লেগেছেন? মনে হয় ভেতরে ভেতরে আমার বাবার ঐশ্বর্যের খবর নিয়ে সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরের দোহায় দেখিয়ে আমাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলতে চান?
নাদিম বলল, আপনি যা কিছু ভাবছেন তা ভুল। প্লিজ, নামটা বললে খুব খুশি হতাম।
সরি, আপনাকে খুশি করতে পারছি না বলে দুঃখিত। তারপর লাইন কেটে দিয়ে রোজ মোবাইল অফ করে দিল।
নাদিম কয়েকবার ফোন করে বুঝতে পারল, মেয়েটা মোবাইল অফ করে রেখেছে।
নাদিম সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকলেও যখন মেয়েটির কথা মনে পড়ে তখন খুব বিচলিত হয়ে চিন্তা করে কীভাবে তার সঙ্গে পরিচয় করা যায়। একদিন রাতে ঘুমোতে যাবার সময় সেকথা ভেবে ঘুম আসছিল না। তখন হঠাৎ তার মন বলে উঠল, যাকে কখনও দেখিসনি, তার সঙ্গে শুধু ফোনের মাধ্যমে প্রেম করা এবং তাকে নিয়ে কোনো কিছু চিন্তা করা তোর মোটেই উচিত নয়। তা ছাড়া ধার্মিক ছেলে হিসেবে তুই জানিস, বিয়ের আগে প্রেম ভালবাসা ইসলামে নিষেধ। এই যে একটা বেগানা মেয়ের সঙ্গে ফোনে আলাপ করছিস, এটাও তো ইসলামে নিষেধ।
মনের কথা শুনে নাদিমের বুক চিরে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। ভাবল, তাই তো এটা করা ঠিক হচ্ছে না। তারপর আল্লাহর নাম স্মরণ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল। এই সব চিন্তা করে নাদিম প্রায় দু’মাস মেয়েটাকে ভুলে যাবার জন্য কোনো ফোন করল না।
.
আজ কয়েকদিন থেকে নাদিমের খুব জ্বর। সাধারণত মেসে যারা থাকে তাদের রান্না করে দেয়ার জন্য ও থালা বাসন ধুয়ে দেয়ার জন্য কাজের মেয়ে থাকে। নাদিম কাজের মেয়ে না রেখে প্রথম দিকে নিজেই কাজের মেয়ের কাজগুলো করত। তারপর একটা চৌদ্দ পনের বছরের ছেলে রেখেছে। ছেলেটার নাম বসির। বসির নিউমার্কেট ও ভার্সিটি এলাকায় কাগজ টোকাত। একদিন তাকে দেখে নাদিমের কেমন যেন মায়া হল। ভাবল, এত সুন্দর ছেলেটা লেখাপড়া না করে টোকাইয়ের কাজ করছে। তার সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারল, তার বাড়ি সিরাজগঞ্জে। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছে। তাদের অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল ছিল। নদীতে তাদের জায়গা জমি ও বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে যাবার পর তাদের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। ওরা চার ভাইবোন। তার বাবা কামলা খেটে কোনো রকমে সংসার চালালেও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাবার মতো ক্ষমতা নেই। তাই বসির লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে কাজের চেষ্টায় ঢাকায় আসে। প্রথমে পুরানো ঢাকায় একটা হোটেলে মেসিয়ারের কাজ করত। হোটেলের মালিক তাকে প্রচুর খাটাত। মেসিয়ারের কাজ ছাড়া তাকে বাবুর্চির সঙ্গে কাজও করাত। এত খাটুনি তার সহ্য হত না। তা ছাড়া ঠিকমতো বেতনও দিত না। তাই সেই কাজ ছেড়ে দিয়ে টোকাইয়ের কাজ করছে। রান্নার কাজ জানে জেনে নাদিম তাকে নিজের কাছে মেসে রেখেছে। সেই-ই এখন নাদিমের বাজার ও রান্নার কাজ করে। তার কাছে থাকে, খায়। মাসে মাসে কিছু টাকা তার দেশে মা বাবার কাছে মানিঅর্ডার করে নাদিম পাঠিয়ে দেয়। বসির অবসর সময়ে পান সিগারেটের ডালা নিয়ে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে। অবশ্য নাদিমই এই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। নাদিম তাকে কুরআন শরীফ পড়া শিখিয়েছে। নামায পড়তে জানে জেনে নিয়মিত নামায পড়াচ্ছে।
নাদিমের যে কয়েকদিন জ্বর বেশি ছিল, বসির ডাক্তার ডেকে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। ডাক্তারের কথামতো তার মাথায় পানি দিয়েছে, নিয়ম মাফিক ওষুধ খাইয়েছে।
আট দশ দিন জ্বরে ভোগার পর আজ নাদিম কিছুটা সুস্থ। রাত বারটা বেজে গেলেও তার ঘুম আসছে না। কেবলই মেয়েটাকে ফোন করতে ইচ্ছে। করছে। চেষ্টা করেও ইচ্ছেটাকে দমন করতে পারছে না। প্রথম দিকে বসির ঘরের মেঝেয় ঘুমাত। কিছুদিন আগে একজন শোবার মতো একটা ছোট রেডিমেট তক্তপোষ নাদিম কিনে দিয়েছে। এখন বসির সেই তক্তপোষে শোয় । রাত দশটার দিকে বসির ঘুমিয়ে পড়ে। নাদিম তার দিকে একবার চেয়ে মেয়েটাকে ফোন করল।
রোজ ঘুমাবে বলে বালিশে মাথা রেখেছে, এমন সময় মোবাইল বেজে উঠতে ভাবল, এত রাতে কে আবার ফোন করল, সেই ছেলেটা নয়তো? তারপর নাম্বার দেখে সিওর হল। প্রায় দু’মাস ফোন করেনি দেখে ভেবেছিল, ছেলেটা হয়তো সত্যিই বখাটে নয়। তা না হলে এতদিনে কয়েকবার ফোন করত। ততক্ষণে ছয় সাতটা রিং বেজে গেছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিসিভ করে মনের অজান্তে সালাম দিয়ে বলল, এত রাতে কেউ কাউকে ফোন করে?
নাদিম ভেবেছিল, এত রাতে ফোন করেছি জেনে হয়তো রেগে গিয়ে যা তা করে বলবে অথবা লাইন কেটে দিয়ে মোবাইল বন্ধ করে দেবে। তার বদলে প্রথমেই সালাম দিতে শুনে ও তার কথা শুনে আনন্দে নাদিমের হার্ট বিট বেড়ে গেল। কিছু বলতে না পেরে চুপ করে রইল।
কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে রোজ বলল, জানেন না, সালামের উত্তর না। দিলে গুনাহ হয়?
নাদিম সালামের উত্তর দিয়ে আবার চুপ করে রইল।
রোজ তার চুপ করে থাকার কারণ জানে। তাই আবার বলল, আমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিলেন না যে?
নাদিম বলল, এগারটার সময় ফোন করলে আপনার পড়ার ডিস্টার্ব হবে, তাই বলে থেমে গেল।
রোজ হেসে উঠে বলল, এখন তো ঘুমের ডিস্টার্ব হচ্ছে।
তা হলে বলুন, কখন ফোন করলে কোনো কিছুতেই ডিস্টার্ব হবে না।
সে কথা পরে, তার আগে বলুন, বেগানা ছেলেমেয়েদের মধ্যে ফোনে আলাপ করা ইসলামে নিষেধ জেনেও কেন ফোন করেন?
এ প্রশ্ন আগেও একদিন করেছিলেন। যে কারণে সেদিন উত্তর দিইনি, সেই একই কারণে আজও দেয়া যাবে না।
কেন দেয়া যাবে না?
বললে আপনি যেমন খুব রেগে যাবেন, তেমনি আমাকে খুব খারাপ ছেলে ভাববেন।
তাই যদি হয়, তা হলে বলার দরকার নেই। এবার তাহলে লাইন কেটে দিচ্ছি।
প্লিজ, লাইন কাটবেন না, দু’একটা কথা বলব।
বলুন।
আমার নাম নাদিম। বাংলায় মাস্টার্স করে চাকরি করছি, সেকথা আগে একদিন বলেছি। আপনারটা বলবেন?
যদি না বলি?
বললে তো জোর করতে পারব না, তবে মনে খুব কষ্ট পাব।
মনে কষ্ট পাবেন কেন?
মনে হচ্ছে, বুঝেও না বোঝার ভান করছেন।
ভালো নাম রোজিনা আখতার। ডাক নাম রোজ। জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটিতে ইসলামিক হিস্ট্রীতে অনার্স করছি। এটা থার্ড ইয়ার।
নাদিম তার নাম শুনে খুশি হয়ে ভাবল, নিশ্চয় নামের মতো মেয়েটি দেখতেও সুন্দর।
রোজ বলল, আমার পরিচয় শুনে মনে হচ্ছে কিছু ভাবছেন?
কী করে বুঝলেন?
কিছু না ভাবলে চুপ করে ছিলেন কেন?
ঠিক বলেছেন বলে নাদিম ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, কি ভাবছিলাম বলতে পারেন?
না, পারব না। কারণ মানুষের মনের খবর আল্লাহ ছাড়া কেউ বলতে পারে না। তবে অনুমান করে বলতে পারি। সেটা ঠিকও হতে পারে আবার বেঠিকও হতে পারে।
ঠিক বেঠিক যাই হোক না কেন আপনি বলুন।
রোজ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, প্রথম দিন আমার কণ্ঠস্বর শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন, আর আজ আমার নাম শুনে আরও বেশি মুগ্ধ হয়ে ভাবছেন, নামের মতো হয়তো আমি সুন্দর। এবার বলুন, আমার অনুমান ঠিক না বৈঠিক?
নাদিম অবাক কণ্ঠে বলল, একশ’ পার্সেন্ট ঠিক!
রোজ বলল, এবার একটা ঘটনা বলব শুনবেন? ঘটনাটা কয়েকটা দৈনিক কাগজে ছাপা হয়েছিল।
বলুন, শুনব।
একটা মেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস পাস করে যখন ইন্টারনিসিপ করছিল তখন একটা ছেলে আপনার মতো মোবাইল টিপতে টিপতে ঐ মেয়েটির নাম্বারে রিং হতে থাকে। মেয়েটি ফোন রিসিভ করে জিজ্ঞেস করে কাকে চান? ছেলেটা মেয়েটির কণ্ঠস্বর শুনে মুগ্ধ হয়। তারপর দিনের পর দিন মেয়েটিকে ফোন করে আলাপ করতে থাকে। প্রথম দিকে মেয়েটি ছেলেটাকে বখাটে ভেবে রাগারাগি করে ফোন করতে নিষেধ করে; কিন্তু ছেলেটি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ফোন করে প্রেম নিবেদন করতে থাকে। মেয়েটিও হয়তো ছেলেটার কণ্ঠস্বর শুনে ও কথাবার্তা শুনে মুগ্ধ হয়ে তাকে ভালবেসে ফেলে। তারপর তাদের দেখা সাক্ষাৎ না হলেও ফোনের মাধ্যমে তাদের সেই ভালবাসা গভীর থেকে গম্ভীর হয়। ছেলেটি তখন জুওলজিতে মাস্টার্স করছিল।
মেয়েটি ইন্টারনিশীপ শেষ করে একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে জয়েন করে। তখনও তাদের ফোনে প্রেমালাপ চলতে থাকে। প্রায় দু’আড়াই বছর তাদের ফোনে সম্পর্ক থাকলেও দেখা সাক্ষাৎ হয়নি।
ছেলেটা মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর হঠাৎ একদিন ঐ প্রাইভেট ক্লিনিকে এসে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করে নিজের পরিচয় দেয়।
ছেলেটা খুব রোগা আর কালো কুৎসিত। তাই তাকে দেখেও তার পরিচয় পেয়ে মেয়েটি চমকে উঠে ও তার মন ঘেন্নায় ভরে উঠে। কারণ মেয়েটি খুব সুন্দরী। দুধে আলতা মেশান গায়ের রঙ, চোখ দুটো পটলচেরা। গোলগাল চেহারা। সে ভাবতেই পারেনি, প্রায় দু’আড়াই বছর যার সঙ্গে ফোনে প্রেম করেছে, সে এত রোগা ও কালো কুৎসিত। তাকে দেখে মেয়েটির মন বেসামাল হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে সামলে নিয়ে বলল, ফোনে যার সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়েছে, সে আপনি নন।
ছেলেটা মেয়েটিকে দেখে তখন আনন্দ সাগরে ভাসছিল। তার কথা শুনে বলল, এ তুমি কী বলছ? আমার কণ্ঠস্বর ও কথাবার্তা শুনেও এরকম কথা বলতে পারলে?
আসলে মেয়েটি তাকে ঠিকই চিনেছে। তার কুৎসিত চেহারা দেখে তার মন বিষিয়ে গেছে। সে ভেবেছিল, যার কণ্ঠস্বর এত সুন্দর, সে দেখতেও নিশ্চয় খুব সুন্দর হবে। তাই রেগে উঠে বলল, আপনার কথা আমি বিশ্বাস করি না। আপনি এখান থেকে চলে যান। নচেৎ লোকজন ডাকতে বাধ্য হব।
ছেলেটা প্রথমে মনে করেছিল, মেয়েটি তার সঙ্গে জোক করছে। পরে তার কথা শুনে বুঝতে পারল, তার কুৎসিত চেহারা দেখে তাকে ডিনাই করছে। তাই রেগে গেলেও ফোনে যে সমস্ত কথা হত, সেসব বলে বোঝাবার চেষ্টা করল।
মেয়েটি ছিল এ্যাসিস্টেন্ট সার্জেন। তার রুমে কিছু সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি ছিল। মেয়েটি যখন মোটেই পাত্তা দিল না এবং পুলিশে ফোন করার কথা বলল তখন ছেলেটি রাগ সামলাতে পারল না। সার্জিক্যাল ছুরি দিয়ে মেয়েটির গলা কেটে খুন করল।
একজন নার্স মেয়েটির রুমে আসছিল। রুমের ভেতর ধস্তাধস্তি হচ্ছে শুনে তাড়াতাড়ি এসে ঘটনা দেখে ভয় পেয়ে ছুটে ফিরে গিয়ে অন্যান্য ডাক্তারকে ঘটনাটা জানাল। মুহূর্তের মধ্যে ক্লিনিকের সবাই জেনে গিয়ে ছেলেটিকে ধরে বেঁধে ফেলে থানায় ফোন করে জানাল।
থানা থেকে পুলিশ এসে ছেলেটিকে এ্যারেস্ট করে নিয়ে গেল। পুলিশের জেরার মুখে ছেলেটা তাদের দীর্ঘ দিনের সম্পর্কের কথা বলে কেন খুন করল সেকথাও জানাল।
মেয়েটির বাবা খুনের মামলা করল। কোটে জজ সাহেবের কাছেও ছেলেটা একই জবানবন্দী দিয়ে খুন করার কথা অকপটে স্বীকার করল। কিছু দিন মামলা চলার পর মামলার রায় অনুযায়ী তার ফাঁসি হয়ে গেল।
ঘটনাটা শেষ করে রোজ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আসলে কী জানেন, মোবাইল ফোন দেশে চালু হয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপকার হলেও টিনএজার বলুন আর বয়স্ক ছেলেমেয়ে বলুন, সবাই-এর অনেক ক্ষতি হয়েছে। সমাজের নৈতিক অবক্ষয় দ্রুত গতিতে বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে মা-বাবারা, কিশোর কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের হাতে মোবাইল দিয়ে তাদের ভীষণ ক্ষতি করছে। এই বয়সেই তারা সহপাঠিদের সঙ্গে মোবাইলে চুটিয়ে প্রেম প্রেম খেলছে। আর একটা ঘটনা বলছি শুনুন–
আমাদের পাশের বাড়ির সপ্তম শ্রেণির একটা মেয়ে মোবাইলে দুতিনটে ছেলের সঙ্গে প্রেম করে।
নাদিম বলল, আপনি খুব দামি কথা বলেছেন। এই বয়সের ছেলেমেয়েদের হাতে মোবাইল দেয়া মোটেই উচিত নয়। এবার আমি একটা কথা বলি?
রোজ বলল, কি বলবেন আমি বুঝতে পারছি। পরে সে ব্যাপারে আলাপ করা যাবে। এখন ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখুন কটা বেজেছে। তারপর নাদিমকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আল্লাহ হাফেজ বলে লাইন কেটে দিয়ে মোবাইল অফ করে ঘুমিয়ে পড়ল।
নাদিমও ক্লিনিকের ঘটনাটা একটা দৈনিক পেপারে পড়েছিল। রোজ লাইন কেটে দেয়ার পর সারারাত ঘুমোতে পারল না। চিন্তা করতে লাগল, রোজের। ধারণা, আমি যদি দেখতে কুৎসিত হই, তা হলে কী ঘটনা ঘটতে পারে? তার। ধারণা ভাঙ্গাবার জন্য তাদের দেখা সাক্ষাৎ হওয়া একান্ত দরকার। তাছাড়া। তাকে দেখার জন্য তার মনও খুব উতলা হয়ে উঠেছে। তাই কয়েকদিনের মধ্যে দেখা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে হবে। কোথায় কিভাবে দেখা করবে ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।