এক
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা। এখানে যেমন বাখরাবাদ গ্যাস ফিল্ড ও আশুগঞ্জ সার-কারখানা, তেমনি বহু কৃতি সন্ত নি জন্মেছেন এই জেলায়। তাঁদের মধ্যে পৃথিবী বিখ্যাত সঙ্গীত সাধক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আলি আকবর খাঁ, কবি আল মাহমুদ, কবি আব্দুল কাদির, সৈয়দ আব্দুল হাদি, চিত্রনায়ক আলমগীর, আলি ইমাম, আব্দুল কুদুস মাখন ও আরও অনেকে।
এই জেলার নবীনগর থানার বাড়াইল একটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম। ইউনুস হাওলাদার এই গ্রামের একজন গণ্যমান্য লোক। ওনার শুধু চার ছেলে। সবার ছোট নাদিম। নাদিম খুব মেধাবী। স্কুল জীবনে কোনোদিন সেকেন্ড হয় নি। ছোটবেলা থেকে ক্রিকেট খেলতে খুব ভালবাসে। একই গ্রামের মাসুদ, কায়ুম, মামুন ও উজ্জল নাদিমের বন্ধু। ওর বন্ধুরাও ক্রিকেট খেলতে ভালবাসে। পাঁচ বন্ধুর মধ্যে নাদিম সবার থেকে ভালো খেলে। সবাই বাড়াইল প্রাইমারী স্কুলের পাঠ শেষে সেলিমগঞ্জ এ.আর. এম.হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেছে। তারপর নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে একই কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স নিয়ে মাস্টার্স করেছে। তারপর চাকরি নিয়ে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও ঈদ ও বকরী ঈদে এবং বিভিন্ন সরকারি ছুটিতে বাড়িতে গেলে সবাই একসঙ্গে মিলিত হয়ে গল্প করে, আড্ডা দেয়। কালের বিধানে দু’তিন বছরের মধ্যে মাসুদ ও উজ্জ্বল মারা যায়।
নাদিম মাস্টার্স পরীক্ষা দেয়ার পর পেপারে বিজ্ঞপ্তি দেখে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি অফিসে চাকরির জন্য দরখাস্ত দিতে থাকে এবং কয়েক জায়গায় ইন্টারভিউও দেয়। যেদিন মাস্টার্সের রেজাল্ট বেরল, সেদিন ঢাকার এক বেসরকারি কোম্পানি থেকে এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেল। মাস্টার্সে ফাস্ট ক্লাস পেয়েছে, তার উপর চাকরি পেয়েছে। দু’দুটো শুভ সংবাদ পেয়ে নাদিম দু’রাকাত শোকরানার নামায পড়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। আর বাড়ির সবাই খুব খুশি হল। ভাবিরা খুশি হয়ে মোরগ পোলাও রান্না করে নিজেরাও খেল এবং গ্রামের গরিবদেরকেও খাওয়াল।
নাদিমের বড় ভাই ইবরাহিম গ্রামের স্কুলে মাস্টারি করে। মেজ ভাই ঈদীশ চট্টগ্রাম ক্যান্টমেন্টে চাকরি করে। সে ফ্যামিলি নিয়ে সেখানেই থাকে। কয়েকদিন ছুটি থাকায় বৌ-ছেলেমেয়ে নিয়ে দু’দিন আগে বাড়িতে এসেছে। সেজ ভাই ইলিয়াস দুবাইয়ে চাকরি করে। তার বৌ বাড়িতে থাকে। ইলিয়াস দু’বছর অন্তর বাড়ি আসে। দিন পনের আগে সেও দুবাই থেকে বাড়িতে এসেছে। তাদের একান্নবর্তী পরিবার।
দুপুরে যখন বাবার সঙ্গে চার ভাই খাচ্ছিল তখন বড় ভাই ইবরাহিম নাদিমকে জিজ্ঞেস করল, তোর জয়েনিং ডেট কবে?
নাদিম বলল, সামনের মঙ্গলবার।
মেজ ভাই ঈদরীশ বলল, আজ তো শুক্রবার। মাঝখানে তিন দিন সময় আছে। কালই ঢাকায় চলে যা, থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে তো।
কেউ কিছু বলার আগে সেজ ভাই ইলিয়াস বলল, মেজ ভাই ঠিক কথা বলেছে। কাল ওর সঙ্গে আমিও যাব। আমার কিছু কেনাকাটা করতে হবে। দুজনে মিলে কোনো ভালো মেসের খোঁজ করব।
এতক্ষণ তাদের বাবা ইউনুস হাওলাদার চুপচাপ খাচ্ছিলেন। ইলিয়াসের কথা শুনে বললেন, তুমি ভালো কথা বলেছ। ঢাকায় অনেকবার গেছ, সেখানকার অনেক জায়গা চেনো।
ইলিয়াসের বৌ হুমাইরার এক খালার বিয়ে হয়েছে ঢাকায়। তাদের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো। গাড়ি-বাড়ি আছে। তার খালু একজন বিজনেসম্যান। হুমাইরা ঐ খালার বাড়িতে থেকে ইডেন কলেজ হতে ডিগ্রী নিয়েছে।
শ্বশুর থেমে যেতে হুমাইরা বলল, বাবা, কিছু মনে করবেন না, ছোট ভাই এর ঢাকায় থাকার ব্যাপারে কথা বলতে চাই।
ইউনুস হাওলাদার সেজ বৌমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বেশ তো মা, কী বলতে চাও বল।
হুমাইরা বলল, ঢাকার সোবহানবাগে আমার বড় খালার বাড়ি। মেসে থাকার ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত ছোট ভাই ওনাদের বাড়িতে থাকতে পারবে। আপনি অনুমতি দিলে আমি ফোনে খালা-খালুর সঙ্গে এব্যাপারে আলাপ করব। আমি ওনাদের বাসায় প্রায় চার বছর থেকে পড়াশোনা করেছি। আপনার ছেলে আমার সঙ্গে দু’তিনবার গেছেন। ওনারা কেমন মানুষ উনি জানেন।
ইউনুস হাওলাদার ইলিয়াসকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি কী বল?
ইলিয়াস বলল, হুমাইরা ভালো কথাই বলেছে। সত্যিই ওনারা খুব ভালো মানুষ। ও ফোন করে বলে দিলে খুব খুশি হবেন।
ইবরাহিম বলল, আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে দু’চার দিন থাকা গেলেও চাকরি করতে গিয়ে স্থায়ীভাবে থাকা ঠিক নয়।
ইলিয়াস বলল, তুমি অবশ্য ঠিক কথা বলেছ। তবে নাদিম তো বেশি দিন থাকবে না। যে ক’দিন মেসে থাকার ব্যবস্থা না হচ্ছে, সেই ক’দিনই থাকবে।
ইউনুস হাওলাদার বললেন, এত কথার দরকার কী? ঢাকায় মেসের অভাব নেই। দু’চার দিনের মধ্যে ইনশাআল্লাহ পেয়ে যাবে।
বাবার কথা শুনে আর কেউ কোনো কথা বলল না।
পরের দিন ইলিয়াস ছোট ভাই নাদিমকে নিয়ে ঢাকায় গিয়ে খালু শ্বশুরের বাসায় উঠল।
.
আগের দিন হুমাইরা ফোন করে খালা-খালুকে যা বলার বলে দিয়েছে। তাই তারা আগে থেকে একটা গেস্টরুম ঠিক করে রেখেছেন। ওরা আসার পর হুমাইরার খালা নাজমা বেগম ভাগ্নী জামাই ও তার ছোট ভাইকে আদর আপ্যায়ন করলেন। তারপর নাদিমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হুমাইরা তোমার থাকার ব্যাপারে আমার সঙ্গে কথা বলেছে। তুমি সম্পর্কে আমার পুত্রা। পুত্ৰা আর ছেলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মেসে থাকতে যাবে কেন? আমাদের কয়েকটা রুম ফাঁকা পড়ে আছে। এখানে থাকতে তোমার কোনো অসুবিধে হবে না। আর যদি মনে কর আমাদের অসুবিধে হবে, তাও ঠিক নয়। বরং আমরা খুশিই হব।
ইলিয়াস বলল, খালা আম্মা, আসার পথে আমি ওকে সেকথা বলেছিলাম, রাজি না হয়ে বলল, যে কয়েকদিন মেসের ব্যবস্থা না হয়, সেই কয়েকদিন থাকব। মেসের ব্যবস্থা হয়ে গেলে চলে যাব। আপনি কিছু মনে করবেন না, ও ভীষণ লাজুক।
নাজমা বেগম বললেন, ঠিক আছে বাবা, ওর ইচ্ছার ওপর জোর খাটাব না।
.
মনের মতো মেসে সিট না পেয়ে নাদিম সপ্তাহ খানের মধ্যে একটা মেসের একরুম পুরো ভাড়া নিল। তারপর সেজ ভাবির খালার বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে চলে এল। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর ফোন করে বাড়িতে সেকথা
জানিয়ে ঘুমোতে গেল; কিন্তু ঘুম আসছিল না বলে অন্যমনস্কতায় মোবাইল টিপতে টিপতে হঠাৎ রিং হচ্ছে শুনে কানের কাছে নিতে একটি মেয়ের সুমধুর কণ্ঠ শুনতে পেল, “হালো, কে বলছেন?”
মেয়েটির কণ্ঠস্বর শুনে নাদিমের মনে হল, এত মিষ্টি গলার স্বর জীবনে আর কোনোদিন শুনেনি। তাই আবার শোনার জন্য কিছু না বলে চুপ করে রইল।
মেয়েটি আবার বলল, কথা বলছেন না কেন? কাকে চান?
নাদিম বলল, এটা কোন জায়গা বলুন তো?
জায়গার নাম জেনে কী হবে? কাকে চান বলবেন তো?
প্লিজ, দয়া করে জায়গাটার নাম বলুন!
গাজীপুর।
সরি, রং নাম্বার–বলে লাইন কেটে দিয়ে নাদিম নাম্বারটা মোবাইলে সেভ করে রাখল। তারপর ভাবল, মেয়েটির কণ্ঠস্বর যখন এত মিষ্টি তখন দেখতে নিশ্চয় সুন্দর হবে। হঠাৎ তার মন বলে উঠল, মেয়েটি দেখতে সুন্দর হোক অথবা অসুন্দর হোক, তাতে তোর কী? কোনো মুসলমান ছেলেরই কোনো অপরিচিত মেয়েকে নিয়ে এরকম চিন্তা করা উচিত নয়।
তওবা এসতাগফার পড়ে নাদিম ঘুমিয়ে পড়ল।
.
এরপর প্রায় প্রতিদিন রাত এগারটার সময় ঐ নাম্বারে ফোন করে মেয়েটির কণ্ঠস্বর শোনার জন্য মন উতলা হলেও অনুচিত হবে ভেবে ফোন করে না। এভাবে প্রায় বিশ পঁচিশ দিন ধৈর্য ধরতে পারলেও আজ পারল না। আসলে শয়তান মানুষের মনে অনুচিত কাজ করার জন্য ওয়াসওয়াসা দেয়। অনেকে তা বুঝতে পেরে শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে তা থেকে বিরত থাকে। আবার অনেকে অনুচিত কাজ করার সময় শয়তান আল্লাহর কথা ভুলিয়ে দেয়। নাদিমেরও তাই হল। মোবাইলে রিং করে সেটা কানের কাছে ধরল।
দু’বার রিং হবার পর মেয়েটি ফোন রিসিভ করে বলল, হ্যালো কে বলছেন?
নাদিম তার কণ্ঠস্বর শুনে তৃপ্ত হল। আবার শোনার জন্য চুপ করে রইল।
মেয়েটি অন্তুষ্ট গলায় বলল, কী হল, চুপ করে আছেন কেন? কে বলছেন? কাকে চান বলবেন তো?
আরও অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে নাদিম বলল, যাকে চাই তিনিই ফোন ধরেছেন।
এবার মেয়েটি বেশ রাগের সঙ্গে বলল, মানে …?
মানে, আপনার কণ্ঠস্বর খুব মিষ্টি। সেটা শোনার জন্য ফোন করেছি।
রাগের সঙ্গেই মেয়েটি বলল, আমাকে আপনি চেনেন?
না।
তাহলে ঐ কথা বলছেন কেন? জানেন না, একজন অপরিচিত ও অনাত্মীয় মেয়ের কাছে এভাবে ফোন করা উচিত নয়? বিশেষ করে মুসলমান বালেগ ছেলে-মেয়ের জন্য এটা ভীষণ অন্যায়।
মুসলমান ছেলে হিসেবে তা আমিও জানি।
তাহলে জেনেও এরকম অন্যায় কাজ করছেন কেন?
কারণটা বললে আমাকে খুব খারাপ ছেলে ভেবে রেগে যাবেন।
কারণটা আমার জানার দরকার নেই। শুনুন, আর কোনো দিন বিরক্ত করবেন না। এই কথা বলে মেয়েটি লাইন কেটে দিলেও নাম্বারটা মোবাইলে সেভ করে চিন্তা করল, মনে হচ্ছে কিছুদিন আগে এই ছেলেটাই ফোন করেছিল। আরও চিন্তা করল, ছেলেটা মনে হয় বখাটে। আবার যদি ফোন করে, কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দেবে।