ক্ষমা নেই
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে। নাম, কাল ও ঘটনাপঞ্জী গল্পের প্রয়োজনে কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত।)
নভেম্বর ২৪, ১৯৪৬
বার্লিংটন, ভারমন্ট, আমেরিকা
নিউহোপ হোম ফর আনওয়েড মাদারস
ইলানর একজন মাত্র ২২ বছর বয়সী অবিবাহিতা মেয়ে, যে আজই তার শিশুপুত্রের জন্ম দিয়েছে এখানে। বার্লিংটনের এই হোমে তার সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য তাকে নিয়ে এসেছেন তার বাবা-মা। যদিও তার কৃতকর্মে তাঁরা যারপরনাই ক্ষুব্ধ, তবু কেবলমাত্র সন্তানস্নেহের খাতিরেই তাঁরা নিজেদের বংশগরিমা ও নাকউঁচু মনোভাবকে কিছুদিনের জন্য দূরে সরিয়ে রেখেছেন। গ্রামে তাঁরা অত্যন্ত ধার্মিক ও সৎ বলে পরিচিত। তাঁদের মতো উচ্চনীতিবোধসম্পন্ন ঘরে ইলানরের মতো অশৈলী কীর্তি কেউ করতে পারে, তা মিসেস কোওয়েল কল্পনা করতে পারতেন না, যদি না তাঁর কন্যা হয়ে ইলানর এ কাজ করে ফেলত। মিস্টার কোওয়েল, ইলানরের পিতা, ঘটনাটা শুনে অবধি যে মৌনতা নিয়েছেন, খুব প্রয়োজন না হলে কথা বলছেন না। ইলানর জানে সে অন্যায় করেছে। কিন্তু প্রেমের কি কোনও সীমানা হয়? কাউবয় হেনরির সঙ্গে তার দেখা হওয়াটাই যেন কাল ছিল। হেনরি একটা চালচুলোহীন ছেলে। পাশের গ্রামের মিঃ মার্কসের ভেড়াগুলোকে নিয়ে মাঠে আসত। ইলানর জানত, হেনরি তার যোগ্য নয়। সেই বা কেন বিয়ে করতে চেয়েছিল হেনরিকে? কী করে সে যৌবনের টান অগ্রাহ্য করে? মাঠের এক ঝোপের আড়ালে দিনের পর দিন চলল তাদের অভিসার। মাসতিনেক পর ইলানর টের পেল শরীরের পরিবর্তন। সে কথা জানার কয়েকদিনের মধ্যেই হেনরি পালাল। বাধ্য হয়ে সে তার মা-কে জানাল সব। মায়ের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, টেনে তার মুখে এক চড়, তারপর প্যারানয়েডের মতো থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে হাউমাউ কান্না। এগুলো সবই ইলানর জানত। অবশেষে বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন যে এই গর্ভ রাখা যাবে না। ততদিনে তার গর্ভাবস্থার পাঁচমাস অতিক্রান্ত। বাবার চেনাশোনা ডঃ ম্যাক্সওয়েল দেখে বললেন, এখন গর্ভপাত করালে ইলানরের জীবনসংশয় হতে পারে। এরপরই নিউহোপে আসার সিদ্ধান্ত।
বাবা চেয়েছিলেন, বাচ্চাটার একটা ব্যবস্থা নিউহোপের কর্ণধার সিস্টার এলিজাবেথই করে দিন। কোনও অরফ্যানেজ কিংবা কোনও ফসটার হোমে বাচ্চাটার গতি করে দিয়ে ঝামেলা ঝেড়ে ফেলতে পারলে শান্তি পেত পুরো পরিবার। কিন্তু তা হল না। সিস্টার এলিজাবেথ বরং মিঃ কোওয়েল কেই বুঝিয়ে দিলেন, কেন ঈশ্বরের দান শিশুটির দায়িত্ব তাঁদেরই নেওয়া উচিৎ। মায়ের থেকে সন্তানকে পৃথক করার পাপ করতে অস্বীকার করলেন সিস্টার। অগত্যা ইলানরের বাবা-মা ঠিক করলেন তাঁরাই শিশুটিকে দত্তক নেবেন এবং পৃথিবীর কাছে শিশুটির পরিচিতি হবে তাঁদের দত্তক সন্তান হিসেবে। তাঁদের আর পাঁচটা সমাজকল্যাণমূলক কাজের একটা হয়েই থেকে যাবে সে। শিশুটি তাঁদের চিনবে পিতা মাতা হিসেবে আর ইলানর সহ তাঁদের অন্যান্য সন্তানেরা তার কাছে পরিচিত হবে দাদা-দিদি বলে। সিস্টার এলিজাবেথ ছাড়া এ জগতের আর কেউ এ শিশুর আসল পরিচয় জানবে না। এই শর্ত পূরণ করার মাশুল হিসেবে সিস্টার এলিজাবেথের নিউহোপ হোম মিঃ কোওয়েলের দরাজ মনের নিদর্শন হিসেবে তখনকার দিনের হিসেবে বিরাট অঙ্কের ডোনেশন লাভ করল।
১৯৫১ সাল, টাকোমা, ওয়াশিংটন
টেডির জন্মের কয়েকবছরের মধ্যেই ইলানর ওয়াশিংটনে চলে আসে। ওর জন্মটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি মিঃ কোওয়েল। চোখের সামনে সেই অনাকাঙ্খিত শিশুর বেড়ে ওঠা তাঁর মনে এক অদম্য বিতৃষ্ণার বীজ বপন করছিল। তাঁদের পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েনে একসময় মনে হচ্ছিল, পরিবারটাই হয়তো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। এরপরই ইলানর সিদ্ধান্ত নেয় টেডিকে নিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার। ওয়াশিংটনে এসে নিজের ও টেডির জীবন চালানো খুব সহজ ছিল না, যদি না সামান্য বারের ওয়েট্রেসের চাকরিটা জোটাতে পারত ইলানর। একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই আর দুমুঠো খাবার— এই জোটাতে হিমশিম খেয়ে যাওয়া ইলানর খুব তাড়াতাড়ি লেগে পড়ল একজন স্বামী জোগাড়ের চেষ্টায়। খুব সময় লাগল না। জনাথন ব্রড ছিল তাদের বারের সিঙ্গার। একজন মহিলা সিঙ্গারের সঙ্গে প্রতি সন্ধেয় মাখোমাখো প্রেমের গান করতে বাধ্য হত জনাথন। অতিথিদের পানীয় সরবরাহের পাশাপাশি তাদের নানাবিধ বায়নাক্কা সামলাতে সামলাতে ইলানর আর জনাথন দু’জনেই অনুভব করত একে অপরের সঙ্গলাভের আকাঙ্খা। সামান্য চাকরি, সামান্য মাইনে দু’জনেরই। কিন্তু ইলানরের তখন বেশি প্রয়োজন একজন মনের মতো সঙ্গীর। জনাথন সেই জায়গাটা ভালোভাবেই পূরণ করতে পেরেছিল। কিন্তু মাত্রই কিছুদিনের জন্য। জনাথনের অতিরিক্ত পানদোষ ও ইলানরের গায়ে হাত তোলার প্রবণতা তাকে শীঘ্রই স্বামী হিসেবে অতি নিম্নমানের বলে প্রমাণ করল। যাই হোক না কেন, যেহেতু এ গল্প ইলানরের নয়, জনাথনের নয়, এ গল্প টেডির, থিওডর ব্রড এর, তাই তার বাবা মাকে তাদের নিয়তির হাতে ছেড়ে দিয়ে আমাদের এগোতে হবে।
১৯৫৩ সাল, ওয়াশিংটন
অনেক ছোটবেলা থেকেই টেডির মধ্যে কিছু অচিরাচরিত কৌতূহল দেখা গিয়েছিল। এমন কিছু, যা সাধারণভাবে মানুষ ঘৃণা বা ভয় করে। আট বছর বয়সে টেডিকে একটি সুন্দর পাখি কিনে দিয়েছিল ইলানর। সে ভেবেছিল, দিনের অনেকটা সময় একা থাকে টেডি, এই পাখিটা ওর একাকীত্বের সঙ্গী হবে। টেডি পাখিটা পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল। সারাদিন পাখির সঙ্গে খেলা করত। একদিন কাজ থেকে বাড়ি ফিরে ইলানর খেয়াল করে পাখিটি খাঁচাতে নেই। টেডিকে প্রশ্ন করে যথাযথ উত্তর পায় না ইলানর। কিন্তু ঘরের কাজ করতে করতে নজরে পড়ে খুব সূক্ষ্ম রক্তের ছোপ লেগে রয়েছে ঘরের কোথাও কোথাও। ছাপ অনুসরণ করে কয়েক পা এগিয়ে স্টোররুমের দিকে যেতেই গা শিউরে ওঠে টেডির মায়ের। পাখিটির প্রাণহীন দেহ পড়ে রয়েছে স্টোররুমের নর্দমার গর্তে অর্ধেক গোঁজা অবস্থায়। সেখান থেকে টেনে বের করে বোঝা গেল, জ্যান্ত অবস্থায় কেউ পাখিটির ঘাড় মুচড়ে দিয়েছে উলটোদিকে। পাখির দুটি পা কাটা, সেগুলির কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না। চোখদুটি কোটর থেকে বেরিয়ে ঝুলছে। ইলানর জানে না, চোখদুটোকে টেনে তাদের স্বস্থান থেকে বের করে আনা হয়েছিল, না কি ঘাড়ে আচমকা মোচড়ের অভিঘাতে সেগুলো প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ঠিকরে বেরিয়ে এসেছিল। শুধু তার মায়ের মন কেন যেন বড্ড কু গাইতে শুরু করল। পাখিটার দেহের সৎকার্য করে ফিরে এতক্ষণ একা একা থাকা মাত্র আট বছরের টেডির ধারে কাছেও ফিরল না ইলানর। পিছন ফিরে খেলায় মগ্ন ছেলের পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়ল বেডরুমে। সেই সময় সে যদি ভালো করে লক্ষ্য করত, তবে দেখতে পেত টেডির হাতে আবছা হয়ে আসা রক্তের চিহ্ন ও মুখে ফুটে ওঠা পৈশাচিক হাসি, যা আর যাই হোক, আট বছরের ছেলের উপযুক্ত নয়।
সেদিনই বোধহয় টেডির ভবিষ্যৎ স্থির হয়ে গিয়েছিল। এই দিন থেকে মাত্র ছত্রিশ বছরের মাথায় ফ্লোরিডার স্টেট প্রিজনে ইলেকট্রিক চেয়ারে যে তাকে অনিচ্ছাপূর্ণ মৃত্যুবরণ করতে হবে, তা কি ইলানর কল্পনাও করতে পেরেছিল? তবে ইলানর চেয়েছিল তার ছেলে আর পাঁচটা শিশুর মতোই সুস্থ স্বাভাবিক হোক। জনাথনের মতের বিরুদ্ধে নিজের সামান্য পুঁজি দিয়ে সে টেডিকে ভর্তি করেছিল নামী স্কুলে। কিন্তু খুঁত বোধহয় টেডির রক্তেই ছিল। কমবয়সের একটা ভুলের মাশুল যে ইলানরকে সারাজীবন ধরে দিতে হবে, এ কথা সে কল্পনাও করেনি। ইলানরের প্রথম যৌবনের প্রেমিক হেনরির বংশপরিচয় জানার কোনও চেষ্টা তখন সে করেনি। যদি সম্ভব হত, তবে আজ ইলানর জানতে চাইত। সে কার সন্তান ছিল, কোন পরিবেশে তার বেড়ে ওঠা, এসব জানতে পারলে হয়তো টেডির অস্বাভাবিকতার হদিশ পাওয়া যেত। কিন্তু আজ আর তা সম্ভব নয়। জনাথন যতই অমানুষ হোক, সে টেডির দায়িত্ব নিয়েছে, নিজের নাম দিয়েছে। স্কুলে টেডি ব্ৰড নামেই পরিচিত; থিওডর ব্রড, বাবার নাম জনাথন ব্রড। এর জন্যই ইলানর পড়ে পড়ে ওর মার খেত।
১৯৬০ সাল, ওয়াশিংটন
টেডি বড় হতে হতে আরও বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেল। ইলানরের বাড়ির পিছনের বাগানে মাঝে মাঝেই প্রথম প্রথম ছোটখাটো প্রাণী যেমন, খরগোশ, গিনিপিগ, ইঁদুর, বেড়ালের এবং পরে বড় প্রাণী, যেমন কুকুর, ভেড়া বা গরুর ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যেতে লাগল। ইলানরের কাজই ছিল অন্ধকার থাকতে উঠে পিছনের বাগান পরিষ্কার করা। রাতে শুয়ে অনিদ্র ইলানর শুনতে পেত লেপার্ডের মতো হালকা অথচ ক্ষিপ্ৰ পদক্ষেপে চলাফেরার শব্দ। বাগানের শুকনো পাতার ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া, অসহায় জীবগুলোর যন্ত্রণাময় মরণচিৎকার ও শেষপর্যন্ত বাগান থেকে পায়ের আওয়াজের গৃহে প্রত্যাবর্তন। ইলানর এরপর সামান্য দু-একঘণ্টার জন্য হয়তো চোখ বুজত। ঘুমের মধ্যে কোনও মনুষ্যবেশী দানব হানা দিত কিনা জানি না, কিন্তু প্রবল ঠান্ডার দিনেও ঘামে ভিজে তার দু’ঘণ্টার ঘুমের অবসান হত। বাগান থেকে জীবজন্তুগুলোর শেষ চিহ্নগুলো দূর করতে করতে সে হয়তো মনে করত তার কতদিন আগে ছেড়ে আসা বাবা মায়ের কথা, একসময়ের প্রেমের মানুষ হেনরির কথা, আস্তে আস্তে দানবে রূপান্তরিত হতে-থাকা পুত্রের কথা, হয়তো বা নিজের ‘হয়তো-হতে-পারত’ জীবনের কথাও।
অন্যদিকে টেডি তার মায়ের প্রশ্রয়ে এগিয়ে চলছিল তার অনিশ্চিত ও সম্পূর্ণ অন্ধকার এক ভবিষ্যতের দিকে। ঠিক এই সময়েই যদি ইলানর তাকে তুলে দিত কোনও মানসিক চিকিৎসকের হাতে, তাহলে হয়তো টেডির পরিণতি এত মর্মান্তিক হত না। ইলেকট্রিক চেয়ারে তার মৃত্যুর পর জেলের বাইরে জনসাধারণ আনন্দ উৎসবে মেতে উঠত না, বাজি ফাটিয়ে মাতোয়ারা হয়ে উঠত না।
টেডি পড়াশোনায় ভালো ছিল, শান্ত ও বিবেচক স্বভাবের হওয়ায় স্কুলে সে শিক্ষক ও সহপাঠীদের প্রিয় পাত্র ছিল। স্কুল পেরিয়ে কলেজে ওঠার আগেই একদিন রাতে ইলানরের আধো ঘুমের মধ্যে অভ্যস্ত শব্দগুলোর কিছু ব্যত্যয় ঘটেছে বলে মনে হল। একজনের বদলে দুজনের পায়ের শব্দ ও পিছনের বাগানের জন্তুটা যেন একটু বেশিই বড়মাপের বলে মনে হয়েছিল তার। পরদিন ভোরে অবশ্য কোনও জন্তুর দেহ সে পায়নি। পেয়েছিল বাগানের গাছে জল দেওয়ার জন্য কাটা অগভীর পরিখার জলে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা জনাথনের আধডোবা দেহটা। এই দেহটা সরিয়ে ফেলার ঝুঁকি অবশ্য নেয়নি ইলানর। মদ্যপ জনাথনকে আশেপাশের সবাই চিনত। তাই
নেশাড়ু অবস্থায় জলে পড়ে সে মারা গেছে, এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে বিশেষ বেগ পেতে হল না। কিন্তু নিজের মনেই এতদিনে একটু চিন্তা হতে শুরু করল ইলানরের। তবে কি যে ছেলে এতকাল পশুর রক্তে হাত রাঙিয়ে তৃপ্ত ছিল, এবার কি তার নররক্তের তৃষ্ণা শুরু হল? এভাবে কি আর বেশিদিন ছেলেটাকে বাঁচাতে পারবে সে?
১৯৬৬ সাল, ওয়াশিংটন
ইলানরকে এরপর খুব বেশিদিন এসব সইতে হয়নি। টেডি কলেজে পড়তে পড়তেই মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে ইলানর মারা যায়। মাকে বোধহয় ভালোই বাসত টেডি। পরম যত্নে তার মৃতদেহ সমাধিস্থ করেছিল সে। এইসময়েই টেডির জীবনে আসে স্তেফানি। উচ্চবিত্ত পিতার একমাত্র সন্তান, লম্বা কালো চুলের অধিকারিণী স্তেফানির মধ্যে সেই সবই ছিল, যা যা টেডি কামনা করত। ব্যাগ-ভরতি টাকা, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, সৌন্দর্য— টেডি নিজেকে হারিয়ে ফেলল। জানি না স্তেফানির সঙ্গ টেডিকে তার জন্মসূত্রে প্রাপ্ত দানবীয় প্রবৃত্তি সাময়িক ভুলিয়ে দিতে পেরেছিল কিনা! তবে স্তেফানির কাছে টেডি তার বহু চাটুকারদের একজন হয়েই থেকে গিয়েছিল। তাই টেডির কাছে তাদের সম্পর্কের মূল্য থাকলেও স্তেফানির কাছে সবটাই ছিল দু’দিনের ফুর্তি।
কিছুদিনের মধ্যেই টেডিকে ছুঁড়ে ফেলে সে অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ল। এই সময়ের আশেপাশেই কলেজের পাঠ চুকিয়ে বৃহত্তর জীবনের জন্য তৈরি হচ্ছিল টেডির অধিকাংশ সহপাঠী। কিন্তু স্তেফানির অবহেলা, তাচ্ছিল্য টেডির মধ্যে জন্ম দিচ্ছিল এক বিজাতীয় প্রবণতা। জন্মগতভাবে অমানুষোচিত প্রবণতাবিশিষ্ট টেডির জীবনের পরবর্তী কিছু বছর কেটে যাবে সিরিয়াল কিলিং, রেপ ও নেক্রোফিলিয়ার মতো ঘৃণ্য অপরাধের পুনরাবৃত্তিতে। অফিসিয়ালি ৩৬টি ও আনঅফিসিয়ালি প্রায় ১০০টি মেয়েকে অপহরণ, নৃশংসভাবে হত্যা এবং মৃত্যুর আগে বা পরে কয়েকজনের সঙ্গে শারীরিকভাবে ঘনিষ্ঠ হওয়ার দায় বর্তেছিল টেডির কাঁধে। জানা যায়, এই হতভাগ্য মেয়েদের প্রত্যেকেই ছিল স্তেফানির মতো লম্বা কালো চুলের অধিকারিণী! জন্মগত মেন্টাল ডিসঅর্ডার নিয়ে বড় হলেও টেডির প্রেমিক-সত্তাকে কিন্তু মোটেই অস্বীকার করা যায় না। সারা জীবন ধরে শিকারের মধ্যে বিশ্বাসঘাতিনী প্রেমিকাকে খুঁজেছে টেডি। তাকে ভালোবেসেছে, শাস্তি দিয়েছে, নিজের মেল ইগো চরিতার্থ করেছে।
প্রকৃতির মধ্যে যেসব ঘটনাবলী মানুষকে সবচেয়ে বেশি অবাক করে, তা হল প্রকৃতির নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রবণতা, নিজের গড়ে তোলা নিয়ম ভেঙে, আবার নতুন নিয়ম গড়ে তোলা। এইজন্যেই মানুষ একদিকে পশুকে পোষ মানায়, ভালোবাসে, অন্যদিকে পশুমাংসে উদরপূর্তি করে। যে উদ্ভিদ দিনের আলোয় অক্সিজেনের উৎস, প্রাণের রক্ষক, সেই রাতের বেলা বিষবাষ্পের সরবরাহকারী। নিয়মকে ব্যতিক্রম প্রমাণিত করে ব্যতিক্রমকে নিয়ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে প্রকৃতি। তা না হলে, যোগ্যতমের উদ্বর্তনের পৃথিবীতে কীভাবে জন্ম হল টেডির মতো অ-মানুষ, যে কিনা শিকার করত প্রয়োজনে নয়, কেবল সহজাত প্রবৃত্তির তাড়নায়। কেবল শিকার করাই নয়, জীবন্ত অবস্থায় শিকারকে প্রবল কষ্ট দিয়ে, অত্যাচার করে যেন যৌনতৃপ্তি অনুভব করত সে। টেডির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার প্রায় ত্রিশ বছর পরে আজও সে অপরাধবিজ্ঞানের গবেষণার বস্তু।
অনেকে বলেন, ইলানরের পিতা স্যামুয়েল কোওয়েল ধার্মিকতার মুখোশের আড়ালে ছিলেন যৌনতার পূজারী। তাঁর কাছে ছিল পর্ণগ্রাফির এক বিরাট সম্ভার। এমনকি কেউ কেউ তাঁর বিরুদ্ধে শিশুদের প্রতি শারীরিক আকর্ষণ বা পিডোফিলিয়ার অভিযোগও করে থাকেন। তাঁর লালসার শিকারদের মধ্যে একজন হয়তো টেডিও। ইলানরের তার পিতা-মাতাকে ছেড়ে যাওয়ার কারণও হতে পারে এটাই। আরও এক পা এগিয়ে কেউ কেউ ইলানরের সন্তানের পিতৃত্বের দায়ও তাঁর উপরেই ন্যস্ত করতে চান। যদিও এইসব কিছু কেবল অভিযোগ হয়েই থেকে গেছে। কোনও প্রমাণ এর স্বপক্ষে মেলেনি। তবে যা রটে, তার কিছুটা বটে, এই তত্ত্বে বিশ্বাসী হলে মাতামহের চারিত্রিক আখ্যান থেকে টেডির আচরণগত ত্রুটির কিছু হদিশ পাওয়া যায় বৈকি। আপাতত সত্যি মিথ্যের দ্বন্দ্বকে সরিয়ে রেখে আমরা গল্পে ফিরি।
১৯৭০ সাল, সিয়াটেল
একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আত্মহত্যা-নিবারণ সংক্রান্ত কাজে যোগ দিল থিওডর ওরফে টেডি ব্রড। তার কাজ ছিল হটলাইনে আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষের দুঃখের কথা শুনে তাদের আত্মহত্যার পথ থেকে সরিয়ে আলোর দিশা দেখানো। অল্প কিছুদিনের মধ্যে টেলিকলার ও কাউন্সেলার হিসেবে টেডি অত্যন্ত সাফল্যলাভ করল। তার মিষ্ট কণ্ঠস্বর ও যুক্তিপূর্ণ বাক্য বহু মানুষকে নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে ফিরিয়ে এনেছিল। অনুমান করা যায়, এই সময়ে হয়তো টেডি তার জীবনের অভিশাপ থেকে মুক্তির পথ খুঁজছিল। তা নাহলে যে টেডি ভবিষ্যতে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতে পরিণত হবে, সে কীভাবে কিছু মানুষের কাছে দেবদূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হল? তবে টেডির জীবনে এই উত্তরণের সময়কাল বড়ই স্বল্প। খুব তাড়াতাড়িই সে নিজের স্যাডিস্ট পারসন্যালিটির কাছে পরাজয় স্বীকার করে।
১৯৭৩ সাল, আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্য
এরপরে যে টেডিকে দুনিয়া দেখল, সে একটা পচে গলে যাওয়া মানসিকতার মানুষ। সে তার অন্তত বারোজন ভিকটিমের ক্ষেত্রে অমানুষিক অত্যাচারের পর হত্যা করে তাদের দেহ পচন ধরার অপেক্ষায় নিজের ঘরে লুকিয়ে রাখে এবং পচন ধরার পর দেহগুলির সঙ্গে বিকৃত যৌনক্রীড়ায় মেতে ওঠে। পরে দেহগুলিকে শহরের বিভিন্ন স্থানে ফেলে দিলেও তাদের কর্তিত মুণ্ডগুলিকে নিজের কৃতকর্মের নিদর্শন অর্থাৎ ট্রফি হিসেবে নিজের ঘরের ফ্রিজারে রেখে দেয় বহুদিন।
১৯৭৭ সাল, ফোরিডা
পরবর্তীকালে টেডি যখন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়, তখন পুলিশের তাবড় অফিসারেরা তার কীর্তি দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। যদিও টেডি তার বিরুদ্ধে ট্রায়াল চলার প্রথম কিছু বছর নিজের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগই স্বীকার করেনি। একাধিকবার কোর্টরুম থেকে ও পুলিশি হেপাজত থেকে সে পালিয়েছে। বাইরে এসেই পুনরায় সে কোনও না কোনও অসহায় মেয়েকে খুন করেছে। সাধারণত অসুস্থতার ভান করে ও নিজের সুদর্শন চেহারার সুযোগ নিয়ে সে মেয়েদের নিজের দিকে আকৃষ্ট করত। মেয়েরা তাকে সাহায্য করার জন্য তার গাড়িতে উঠলেই পরিস্থিতির রাশ নিয়ে নিত সে নিজের হাতে। পুলিশ তাকে বারবার পাগলা কুকুরের মতো খুঁজে বের করত। কিন্তু দোষ স্বীকার না-করায় এবং তার বিরুদ্ধে পুলিশের প্রমাণ যথেষ্ট বলে প্রতিপন্ন না-হওয়ায় পুলিশ একটু সমস্যায় পড়েছিল।
১৯৮০ সাল, ফোরিডা
এইসময় টেডির নিস্পাপ চেহারা ও প্রেমিকসুলভ আবেদনের মায়ায় ভুলে আমেরিকা জুড়ে তার বেশ কিছু মহিলা অনুরাগী তৈরি হল, যারা বিশ্বাস করত টেডি নির্দোষ। এমনকি তারা টেডিকে বিয়ে করে সংসার পাততেও রাজী ছিল। এদের মধ্যেই একজন, ক্যারলের সঙ্গে টেডির পরিচয় ও প্রেম এইসময়ই। ক্যারল বিশ্বাস করত টেডি নির্দোষ। পূর্বে একবার বিবাহিত ও দুই সন্তানের মা ক্যারলকে বিয়ে করে টেডি। ১৯৮২তে এই যুগলের একটি কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। স্তেফানির সঙ্গে প্রেম ভেঙে যাওয়ার পর থেকে যে টেডির সঙ্গে মেয়েদের সম্পর্কের ভিত্তি ছিল কেবলই বিকৃতি, সেই টেডি তার খুনি সত্তার চরম দিনগুলিতে কীকরে একটি মেয়ের সঙ্গে স্বাভাবিক দাম্পত্য যাপন করল, তা বোধহয় জটিল থেকে জটিলতম মনস্তত্ত্বের বিষয় বলে বিবেচিত হতে পারে।
১৯৮৫ সাল, ফোরিডা
টেডির বিরুদ্ধে ক্যারল নামের একটি মেয়ের (টেডির স্ত্রী নয়) আনা অভিযোগ ফ্লোরিডা পুলিশের হাতে টেডির বিরুদ্ধে শক্তপোক্ত প্রমাণ হিসেবে সঞ্চিত হয়। ক্যারল ছিল সেই কয়েকজনের একজন, যারা টেডির শিকার হয়েও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিল। ক্যারলের সাক্ষ্য টেডির কাছে চরম বলে প্রমাণিত হয়েছিল। টেডির অপরাধী প্রমাণের পর পরই তার স্ত্রী ক্যারল তাকে ত্যাগ করে। ইউনাইটেড স্টেটস সুপ্রিম কোর্ট চারটি আলাদা আলাদা কেসে টেডিকে তিনটি পৃথক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। অবশেষে ১৯৮৯ সালের ২৪ শে জানুয়ারী ফ্লোরিডা স্টেট প্রিজনে তাকে সরকারিভাবে হত্যা করা হয়। এই সময় টেডির হাতে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হয়েছিল যে হতভাগ্য মেয়েরা, তাদের আত্মীয় পরিজন ও বন্ধুবান্ধবরা বাজি ফাটিয়ে আনন্দে মেতে উঠেছিল জেলের বাইরে।
টেডির মতো সিরিয়াল কিলার মানুষের ইতিহাসে আরও অনেক এসেছে। তাদের সবারই মানসিক বৈকল্যের বীজ লুকিয়ে ছিল হয় রক্তে, নয়ত বেড়ে ওঠার পরিবেশে। বলা হয়, প্রকৃতি তথা ঈশ্বর নিজের কোনও ত্রুটিপূর্ণ সৃষ্টি পছন্দ করেন না। এই কারণে অধিকাংশ ত্রুটিপূর্ণ ভ্রূণ মাতৃগর্ভেই নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু টেডির মতো অমানুষ সৃষ্টি করেও তার মনে বিশেষ কারও প্রতি স্বাভাবিক মানুষের মতো ভালোবাসা ভরে দেন কোন উদ্দেশ্যে? হয়তো নিজের সৃষ্টিকেই কখনো কখনো যাচাই করে দেখতে সাধ হয় সৃষ্টিকর্তার। তাই টেডির মতো সৃষ্টিছাড়াদের জন্ম হয়। কিন্তু তাদের পাপের বোঝা বইতে রাজি নন ঈশ্বরও। সেইজন্যই বোধহয় মৃত্যুর পরও টেডির নাম সাধারণ মানুষের শিরদাঁড়া কাঁপিয়ে দেয়, অপরাধবিজ্ঞান ও মনস্তত্ত্বের বিষয়বস্তু হয়ে আজও ঘৃণা কুড়োতে হয়, তার নিজের কন্যাও পরিচয় লুকোতে নাম পদবী বদলে আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়। সময় ও প্রকৃতির দরবারে কোনও অপরাধেরই ক্ষমা নেই।