ক্ষমতা ও শাসন পদ্ধতি
কোনো সংগঠনের উদ্দেশ্যের কথা বাদ দিলেও গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে– (১) আকার, (২) সদস্যদের উপর ক্ষমতা (৩) সদস্য নয় এমন মানুষের উপর ক্ষমতা এবং (৪) সরকারের ধরন। পরবর্তী পরিচ্ছেদে আমি আকার সম্বন্ধে আলোচনা করব। বাকিগুলো বর্তমান পরিচ্ছেদের আলোচ্য বিষয়।
রাষ্ট্র ছাড়া আইনানুগ স্বীকৃত সংগঠনগুলো সদস্যদের উপর সীমাবদ্ধ ক্ষমতা প্রয়োগ করে আইনের মাধ্যমে। যদি আপনি একজন ব্যারিস্টার, সলিসিটর, চিকিৎসক বা ঘোড়দৌড়ের ঘোড়ার মালিক হন, আপনার সম্প্রদায় থেকে আপনি বিতাড়িত হতে পারেন, হতে পারেন আপনি তালিকাচ্যুত, অযোগ্য ঘোষিত হতে পারেন ঘোড়দৌড় ব্যবসায়, অথবা আপনাকে সতর্ক করা যেতে পারে ঘোড় দৌড় মাঠ থেকে সরে পড়ার জন্য। এসব শাস্তি অপমানজনক এবং প্রথম তিনটি অর্থনৈতিকভাবে চরম কষ্টকর। কিন্তু আপনি যতই আপনার পেশায় অপ্রিয় হোন না কেন আইনগতভাবে আপনার সহকর্মীরা আপনার পেশাগত অনুশীলনে বাধা প্রদান ছাড়া কিছুই করতে পারবে না। আপনি যদি রাজনীতিবিদ হন তবে আপনি অবশ্যই কোনো দলের অন্তর্ভুক্ত হবেন; কিন্তু আপনাকে অন্য দলে যোগদানে অথবা সংসদীয় প্রতিযোগিতা থেকে দূরে শান্তিপূর্ণ বসবাসে বাধা দেয়া যাবে না। রাষ্ট্র ছাড়া অন্যান্য সংগঠনগুলোকে সদস্যদের উপর ক্ষমতা নির্ভর করে এর বিতাড়ন করার অধিকারের উপর এবং তা কমবেশি মারাত্মক বিতাড়নের সঙ্গে জড়িত অপমান ও অর্থনৈতিক কষ্ট অনুসারে।
অপরপক্ষে নাগরিকদের উপর রাষ্ট্রের ক্ষমতা সীমাহীনভাবে বেড়ে যায় অবাধ গ্রেফতার সম্পর্কে সাংবিধানিক বিধি-নিষেধ না থাকলে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনগত পদ্ধতি ছাড়া কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না জীবন, স্বাধীনতা বা সম্পত্তি থেকে। বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের কাছে প্রদর্শন করতে হবে যে পূর্ব ঘোষিত আইন অনুসারে তিনি দোষী সাব্যস্ত এবং এ ধরনের শাস্তির যোগ্য। একইভাবে ইংল্যান্ডে নির্বাহীদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হলেও আইন পরিষদ সর্বশক্তিমান। পরিষদ এ রকম আইন পাস করতে পারে যে মি. জন স্মিথ মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হতে পারেন বা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন নেই তাকে পদ্ধতিগতভাবে অপরাধী সাব্যস্ত করার। যেসব পন্থায় পার্লামেন্ট সরকারি নিয়ন্ত্রণ লাভ করে সর্বগ্রাসী ক্ষমতার মতোই এ ক্ষমতা ছিল অনুরূপ একটি পন্থা। এই ক্ষমতা ভারত এবং একদল শাসিত দেশগুলোতে নির্বাহীদের হাতে এবং তা অবাধে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এটা ঐতিহ্য অনুসারে ঘটে থাকে এবং যেখানে রাষ্ট্র এই শক্তিমত্ততা হারিয়েছে সেখানে তারা তা করে থাকে মানবাধিকার মতবাদের ফলস্বরূপ।
সংগঠনের সংজ্ঞা সদস্য নয় এমন লোকের উপর দেয়া অপেক্ষাকৃত কঠিন। বিদেশিদের সাপেক্ষে যুদ্ধ অথবা যুদ্ধরীতির উপর নির্ভরশীল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। তা প্রযোজ্য শুল্ক এবং অভিবাসন নিয়ম-কানুনের বেলায়ও। চীন দেশে সামরিক পরাজয়ের ফলস্বরূপ গৃহীত চুক্তির দ্বারা এ দুটো পরিচালিত হতো। শুধু যথেষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব থাকলে, সব লোকের ধ্বংস অথবা বিতাড়নের হুকুম জারি করা যেতে পারে। এসব প্রায়ই করা হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বিবেচনা করা যায় যশোয়ার বই, ব্যাবিলনীয় বন্দিত্ব এবং উত্তর আমেরিকায় ইন্ডিয়ানদের নির্মূলের পরিবর্তে কারাবাসের কথা।
রাষ্ট্র কর্তৃক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বাহ্যিক ক্ষমতা ঈর্ষার চোখে দেখাই স্বাভাবিক। তাই এগুলো বহুলাংশে অবৈধ এগুলো নির্ভর করে প্রধানত বয়কট ও চরম ভীতি প্রদর্শনের উপর। সাধারণত এ ধরনের সন্ত্রাসী প্রভাব বিপ্লব বা অজরাকতার ভূমিকাস্বরূপ। রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞ আয়ারল্যান্ডে প্রথমত জমিদার ও পরে ব্রিটিশ আধিপত্যের পতন ঘটায়। জারতন্ত্রের রাশিয়ায় বিপ্লবীরা প্রধানত সন্ত্রাসী তৎপরতার উপর নির্ভর করে। নাজিরা হিংস্রতাপূর্ণ অবৈধ কাজের মাধ্যমে তাদের পথ বেছে নেয়। বর্তমানে চেকোস্লোভাকিয়ায় জার্মান জনগণের ভেতর যারা হেনলিন দলে যোগদান করা থেকে বিরত তারা এমন নোটিশ পাচ্ছে, আপনি একজন চিহ্নিত ব্যক্তি অথবা আপনার পালা আসবে। জার্মানিরা অস্ট্রিয়া দখল করে নিলে বিরোধীদের ভাগ্যে যা ঘটে সে দৃষ্টিকোণ থেকে এ ধরনের ভীতি প্রদর্শন অত্যন্ত কার্যকারী। যে রাষ্ট্র এ ধরনের কার্যকলাপের সাথে পেরে ওঠে না তারা শীঘ্রই পতিত হয় দুঃখে। এই অবৈধ কার্যকলাপ কোনো একক সংগঠনের রাজনৈতিক কর্মসূচি হলে তার পরিণাম হয় বিপ্লব। কিন্তু তা দস্যুদল বা বিদ্রোহী সিপাহিদের কার্যকলাপ হলে পর্যবসিত হতে পারে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলতায়।
গুরুত্বপূর্ণ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। এগুলো গোপন সংস্থাগুলোর অনুরূপ নয় এমন অবৈধতা ছাড়াই সন্ত্রাসী কার্যকলাপে সমর্থ। কারণ, তারা শত্রুকে হত্যার হুমকি দেয় না, তবে ঠেলে দেয় ক্ষুধার দিকে। কোনো স্পষ্ট ঘোষণার প্রয়োজন হয় না এ ধরনের ভীতি প্রদর্শনের জন্য। তারা প্রায়ই এর দ্বারা সরকারকে পরাজিত করেছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করা যায় ফ্রান্সের অধুনা ঘটনা প্রবাহ। যতদিন পর্যন্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রাখে যে, রাষ্ট্রের ভেতরে এগুলোর সঙ্গে সম্পর্কহীন লোকজন যথেষ্ট খেতে পাবে অথবা পাবে না তত দিন পর্যন্ত মারাত্মক সীমাবদ্ধতার অধীন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বলা যায় যে, রাশিয়ার মতো ইতালি ও জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্যক্তি মালিকানার উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানার শ্রেষ্ঠত্ব।
আমি এখন প্রশ্নে আসছি সরকারের প্রকারভেদের। ইতিহাসে জ্ঞাত প্রাচীনতম, সরলতম এবং সবচেয়ে বিস্তৃত সংবিধান হিসেবে পরম রাজতন্ত্র দিয়ে আরম্ভ করা স্বাভাবিক। আমি নিরূপণ করছি না রাজা ও অত্যাচারীর ভেতর পার্থক্য, আমি শুধু এক ব্যক্তির শাসন আলোচনা করছি-হতে পারে সে শাসনক্ষমতা উত্তরাধিকারী সূত্রেপ্রাপ্ত অথবা জোরপূর্বক লব্ধ। ব্যাবিলনীয় সভ্যতা থেকে শুরু করে মেসিডোনীয়, রোমান প্রভূত্ব এবং খেলাফত পার হয়ে মহান মোগল পর্যন্ত এ ধরনের শাসন সবসময়ই প্রভাব বিস্তার করছে এশিয়ায়। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে সি. হুয়াং সি যিনি বই পুড়িয়েছিলেন, তার শাসনকাল ছাড়া অন্য কোনো সময়েই চীনের সম্রাটরা পরম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না। অন্য সময় পন্ডিত ব্যক্তিরা তাকে পরাস্ত করতে পারতেন। কিন্তু চীন সবসময়ই সব শাসনের ব্যতিক্রম। আজ যদিও পরম রাজতন্ত্র পতনোন্মুখ বলে অনুমিত হচ্ছে তারপরও এর সমান্তরালে থেকে অনুরূপ কিছু বিস্তার লাভ করছে জার্মানি, ইতালি, রাশিয়া, তুরস্ক ও জাপানে। এটা স্পষ্ট যে মানুষের কাছে স্বাভাবিক ও ধরনের সরকারই।
এর গুণাগুণ পরিষ্কার মনোবিজ্ঞান সম্মতভাবে। সাধারণত নেতা কোনো গোত্র বা সম্প্রদায়কে বিজয়লাভে পরিচালিত করেন এবং তার অনুসারীরা নিজেদের তার গৌরবের অংশীদার বলে মনে করেন। সাইরাস মিডসদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে পারসিকদের নেতৃত্ব দেন; আলেকজান্ডার মেসিডোনিয়াবাসীদের ক্ষমতা সম্পদ দান করেন; নেপোলিয়ান বিপ্লবী সৈন্যদের বিজয় এনে দেন। তা-ই ছিল লেনিন ও হিটলারের সঙ্গে নিজ নিজ দলের সম্পর্ক। যে দল বা সম্প্রদায়ের প্রধান হচ্ছেন একজন বিজয়ী ব্যক্তি সে দল বা সম্প্রদায় স্বেচ্ছায় তাকে অনুসরণ করে এবং তার সফলতার প্রশান্তি অনুভব করে। শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভীতি বিরাজমান যাদের তিনি পরাস্ত করেন তাদের ভেতর। কোনো রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ বা আপসভ্যাসের প্রয়োজন নেই; একমাত্র সহজাত সামাজিক বন্ধন অন্তর্হিত ছোট দলের ভেতর বিরাজমান বন্ধনের মতোই এবং তা এই সত্যের জন্য সহজ হয়ে যায় যে, সবকিছুই নির্ভর করে বীরের কৃতিত্বের উপর। তিনি যখন মারা যান তখন তার কাজ হয়ে যেতে পারে টুকরো টুকরো। কিন্তু ভাগ্যক্রমে কোনো সক্ষম উত্তরাধিকারী নতুন ক্ষমতা চালিয়ে যেতে পারে প্রথাগত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত।
নেতা ও অনুসারীদের সম্পর্ক ভিন্ন অন্য যে সম্পর্ক একই সম্প্রদায়ের লোককে একত্রিত করে রেখেছে তার অসুবিধা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের সাপেক্ষে। বিজয়ের মাধ্যমে ছোট দৃষ্টান্ত খুবই কম। কারণ, ফিলিপের সময় গ্রিস ও রেনেসাঁ ইতালির বিভিন্ন সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভেতর সামান্যতম সহযোগিতা ও জীবন-মৃত্যুর ব্যাপার ছিল। এ সত্ত্বেও তা ঘটেনি। আজকাল একই জিনিস সত্য ইউরোপের বেলায়। আদেশদানে অথবা স্বাধীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত ব্যক্তিকে প্রভাবিত করা সহজ নয় যে তিনি স্বেচ্ছায় বাইরের শক্তির কাছে মাথা নত করবেন। কিন্তু সাধারণত তা দস্যুদলের অনুরূপ এবং তাদের হাতে নেতৃত্বদানের ক্ষমতা অর্পণের ব্যাপারে নেতার অভিপ্রায়ে বিশ্বাস রাখে। এই ক্ষেত্রে চুক্তিটি রুশোর নয় বরং হবসের। এটি এমন এক চুক্তি যার মাধ্যমে নাগরিকরা পরস্পরের সঙ্গে অভিনয় করে থাকে–এটা নেতা ও অনুসারীদের মধ্যকার চুক্তি নয়। মনোবিজ্ঞানসম্মত গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হচ্ছে যে, মানুষ এ ধরনের চুক্তি শুধু তখনই মেনে নিতে রাজি হয় যখন দেখা দেয় লুণ্ঠন ও বিজয়ের সমূহ সম্ভাবনা। স্বাভাবিকভাবে নগ্ন আকারের না হলেও এটাই মনোবিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়া, যার ফলে স্বৈরাচারী নয় এমন রাজারা সফল যুদ্ধের মাধ্যমে হতে পেরেছে এর আরও অধিক কাছাকাছি।
এই আলোচনা থেকে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় যে, রাজার স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতার প্রতি যখন সিংহাসনের কাছাকাছি একদল লোকের স্বেচ্ছামূলক সম্মতির প্রয়োজন হয়ে পড়ে তখন স্বভাবতই অধিকাংশ প্রজা প্রথমে ভয়ে ও পরে মেনে নেয় ঐতিহ্যগতভাবে অধীনতা। যে অর্থে সামাজিক চুক্তি পুরোপুরিভাবে অবাস্তব নয় শুধু সে অর্থে তা বিজয়ীদের চুক্তি। এ চুক্তি আসল উদ্দেশ্য হারিয়ে বসে বিজয়ের ফলোভে বঞ্চিত হলে। একাধিক সম্প্রদায়ে বিস্তৃত ক্ষমতার অধিকারী রাজার প্রতি অধিকাংশ প্রজার বশ্যতার মূল কারণ স্বেচ্ছামূলক সম্মতি নয়, ভয়।
দলের অভ্যন্তরে আনুগত্যের উদ্দেশ্য এবং সাধারণ জনগণের ভেতর ভয় এত সহজ ও সরল যে সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর বিস্তৃতি শুধুই বিজয়ের মাধ্যমে হয়েছে স্বেচ্ছামূলক ফেডারেশন দ্বারা নয়। একই কারণে রাজতন্ত্র এত গুরুত্ব বহন করছে ইতিহাসে।
যা হোক রাজতন্ত্রের রয়েছে অনেক বড় অসুবিধা। তা উত্তরাধিকারমূলক হলে শাসকদের টিকে থাকা সন্দেহজনক। সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে গৃহযুদ্ধ হতে পারে উত্তরাধিকার আইনে কোনোরূপ অনিশ্চয়তা থাকলে। প্রাচ্যে একজন শাসক তার ভাইদের হত্যার মাধ্যমে শুরু করেন; কিন্তু একজন পালিয়ে যেতে পারলে তিনি দাবি উত্থাপন করতেন সিংহাসনের। পড়া যেতে পারে MAINUC CIS STORIA DO MOGOR নামক বইটি। বইটিতে মহান মোগলদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এটা স্পষ্ট যে, উত্তরাধিকারমূলক যুদ্ধ অন্য যে কোনো কারণের চেয়ে তাদের সাম্রাজ্যকে অধিকতর দুর্বল করে দেয়। একই শিক্ষা গোলাপ যুদ্ধ দিয়ে থাকে আমাদের দেশে।
অপরপক্ষে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা এর চেয়ে বেশি রাজতন্ত্র উত্তরাধিকারমূলক না হলে। এ ধরনের বিপদের উদাহরণ হচ্ছে কমোডসের মৃত্যুর পর ক্রিস্টেন্টাইনের সিংহাসন আরোহণ পর্যন্ত রোমান সাম্রাজ্য। এ সমস্যার একমাত্র সমাধান পরিকল্পিত হয়েছে; এটা এমন পদ্ধতি যার মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে থাকেন পোপ। কিন্তু তা হচ্ছে গণতন্ত্র থেকে শুরু করে উন্নয়নের সর্বশেষ পরিভাষা। এক্ষেত্রেও বিরাট অনৈক্য থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে, এ পদ্ধতিও অভ্রান্ত নয়।
রাজতন্ত্রে আরও মারাত্মক অসুবিধা এই যে, রাজার স্বার্থের অনুকূল প্রজাদের স্বার্থ না হলে সাধারণত তা প্রজাদের স্বার্থের প্রতি উদাসীন হয়। বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত থাকা সম্ভব স্বার্থের অভিন্নতা। রাজার আগ্রহ অভ্যন্তরীণ অরাজকতা দমনে বিদ্যমান। সুতরাং অরাজকতার বিপদ দেখা দিলে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সম্প্রদায় অরাজকতা দমনে রাজাকে সমর্থন করেন। প্রজাদের সম্পর্কে তার আগ্রহ রয়েছে কারণ তাতে কর অধিক পরিমাণে বেড়ে যায়। রাজা ও প্রজাদের স্বার্থ অভিন্নরূপে দেখা দেয় বৈদেশিক যুদ্ধে বিজয়ী হলে। তাই রাজ্য বিস্তারে সমর্থ হলে তার নেতৃত্বাধীন দলটি তার কাজকে লাভজনক মনে করে। কিন্তু রাজারা দুটো কারণে বিপথগামী হন : গর্ব এবং নিষ্প্রভ অভ্যন্তরীণ দলের উপর নির্ভরতা। গর্ব সম্পর্কে : মিসরীয়রা পিরামিড তৈরির ব্যাপারে কষ্ট করলেও ফরাসিরা পরিশেষে প্রতিবাদ করেছে ভার্সাই এবং লভার সম্পর্কে। নীতিবাদীরা কঠোর ভাষা প্রয়োগ করেছে কোর্টের বিলাসিতার উপর। বাইবেলের অপ্রামাণিক অংশে মদ খারাপ, নারী খারাপ, রাজা খারাপ বলে বর্ণিত আছে।
আরও গুরুত্বপূর্ণ রাজতন্ত্র পতনের অন্য কারণটি। রাজারা সমাজের নির্ভরশীল হয়ে পড়েন বিশেষ অংশের উপর : অভিজাত শ্রেণি, চার্চ, উচ্চ বুর্জোয়া অথবা সম্ভবত কোনো ভৌগোলিক দল যেমন, কোজাক। ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায় অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ফলে সুবিধাভোগী বলের ক্ষমতা এবং তাদের সঙ্গে রাজাও হয়ে ওঠেন অপ্রিয়। নিকোলাস-২ এর মতো তিনি নিজ দলের পূর্ণ সমর্থন লাভের পরিবর্তে তা হারানোর মতো নির্বোধ হতে পারেন; কিন্তু এটা ব্যতিক্রমধর্মী। চার্লস-১ ও লুইস-১৬ অভিজাতদের সমর্থন পেয়েছিলেন, কিন্তু তাদের পতন ঘটে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিরোধী হওয়ার ফলে।
একজন রাজা বা স্বৈরচারী শাসক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারেন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ধূর্ত হলে এবং বাহ্যিকভাবে সফল হলে। তার রাজবংশ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে তিনি আপাত ঐশ্বরিক হলে। কিন্তু সভ্যতার বিকাশ তার স্বর্গীয় দাবির প্রতি বিশ্বাসের পরিসমাপ্তি ঘটায়। যুদ্ধের পরাজয় সবসময় সংঘটিত হলে কোনো এক সময় বিপ্লব হতে পারে এবং নিশ্চিত হয়ে যেতে পারে রাজতন্ত্র।
রাজতন্ত্রের স্বাভাবিক উত্তরাধিকার হচ্ছে অলিগার্কি। অলিগার্কি অনেক ধরনের হতে পারে : তা হতে পারে বংশপরম্পরায় অভিজাতদের, ধনীদের, চার্চের অথবা রাজনৈতিক দলের। বিভিন্ন ফল পাওয়া যায় এগুলো থেকে। উত্তরাধিকারমূলক জমিদারি আভিজাত্য, রক্ষণশীল, গর্বিত, মূর্খ এবং এমনকি নিষ্ঠুরও হতে পারে। এসব কারণে তা সবসময়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয় উচ্চ বুর্জোয়াদের সঙ্গে সংগ্রামে। মধ্যযুগে সব স্বাধীন শহরগুলোতে ধনীদের শাসন জয়ী হয় এবং তা ভেনিসে টিকে থাকে নেপোলিয়ান কর্তৃক বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত। মোটের উপর ইতিহাসে জ্ঞাত অন্যান্য শাসনের চেয়ে এ ধরনের শাসন অধিকতর জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত ও ধূর্ততাপূর্ণ ছিল। বিশেষ করে জটিল ষড়যন্ত্রে নিমজ্জিত ভেনিস শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিচক্ষণতার দিকনির্দেশনা দেয় এবং অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি দক্ষতাপূর্ণ কূটনৈতিক বিভাগ চালু করে। বাণিজ্যলব্ধ অর্থ চাতুর্যজাত ছিল, কিন্তু স্বেচ্ছাচারজাত নয়। বণিকদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারের ভেতর এই বৈশিষ্ট্যগুলো পরিলক্ষিত হয়। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি আধুনিক শিল্পে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। এর আংশিক কারণ এই যে, তারা কাঁচামাল ব্যবহার করে থাকেন কৌশলগতভাবে নিপুণতার সঙ্গে। এর আংশিক কারণ এও হতে পারে যে, জনসাধারণের সঙ্গে তাদের আচরণ সমপর্যায়ভুক্ত লোকের সঙ্গে নয় বরং সৈনিক কর্মচারীদের সঙ্গে আচরণের মতো, যারা অবশ্যই প্রত্যায়াপন্ন হবেন, কিন্তু হবেন না দমিত।
চার্চ বা রাজনৈতিক দলের সমর্থনপুষ্ট সরকার (যাকে দিব্যতন্ত্র ও সেন্ট পিটারের পিতৃত্বে এবং জেসুটের রাজত্বকালে) পেরাগুয়েতে বিরাজ করে। কিন্তু এর আধুনিক রূপটি কেলভিনের শাসনের মাধ্যমে জেনেভাতে শুরু হয়। ব্যতিক্রম শুধু মুনস্টারে এনাবেপ্টিস্টদের স্বল্পকালীন আন্দোলন। এর চেয়েও আধুনিক রূপটি দরবেশদের শাসন যা পুনর্জাগরণের সময় ইংল্যান্ডে সমাপ্ত হয়। তবে তা কিছুকালের জন্য টিকে ছিল নতুন ইংল্যান্ডে। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে এ ধরনের সরকারের স্থায়ী বিলুপ্তি ঘটেছে বলে মনে হয়। কিন্তু পুনরুজ্জীবিত হয় লেলিন কর্তৃক। ইতালি ও জার্মানিতে তা গৃহীত হয় এবং এর জন্য জোর প্রচেষ্টা চলে চীনে।
রাশিয়া ও চীনের মতো যেসব দেশে জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই অশিক্ষিত ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাশূন্য সেখানে বিপ্লবীরা সম্মুখীন হয় কঠিন পরিস্থিতির। সম্ভবত সফল হতো না পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র। এর জন্য চেষ্টা করা হয়েছে চীনে, কিন্তু প্রথম থেকেই পরিণত ছিল কলঙ্কজনক। অপরপক্ষে রাশিয়ায় অঞ্চলভিত্তিক আভিজাত্য ও মধ্যবিত্ত বনিক শ্রেণির প্রতি বিপ্লবী দলগুলোর ছিল শুধু ঘৃণাই। এসব শ্রেণির মানুষের সমন্বয়ে গঠিত অলিগার্ক দ্বারা কোনো লক্ষ্যই অর্জন করার ছিল না। তাই তারা বলেছিলেন, বিপ্লবী দল হিসেবে আমরা দেশে গণতন্ত্রের ক্ষেত্র সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখব এবং এর ভেতর আমাদের নীতি অনুযায়ী আমরা দেশবাসীকে শিক্ষিত করে তুলব।
যা হোক আশানুরূপ ফল লাভ হয়নি পুরনো বলশেভিকদের। ক্রমাগতভাবে মারাত্মক রূপ ধারণ করে গৃহযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ এবং কৃষক অসন্তোষের মুখে একনায়কতন্ত্র। পাশাপাশি লেলিনের মৃত্যুর পর কমিউনিস্টদের দলীয় কোন্দলের ফলে একদলীয় শাসন কঠিন ছিল না। আমি ১৯২০ সালে লিখেছিলাম : বর্তমানে রাশিয়া যে অবস্থার সম্মুখীন বলশেভিক তত্ত্ব অনুসারে আজ হোক কাল হোক প্রতিটি দেশ একই অবস্থার সম্মুখীন হবে এবং এমন অবস্থায় প্রতিটি দেশ নির্মম লোকের হাতে পড়বে যারা স্বাধীনপ্রিয় নয় স্বভাবগতভাবে। একনায়কতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের গুরুত্ব কমই দেবে তারা। এটি অনিবার্য যে রাশিয়ায় বলশেভিকদের মতো অন্যান্য দেশে যেসব ব্যক্তি অনুরূপ অবস্থানে রয়েছে তারা ছেড়ে দেবে তাদের ক্ষমতার একচেটিয়া অধিকার এবং নতুন বিপ্লবের মাধ্যমে বিতাড়নের পূর্ব পর্যন্ত টিকে থাকার জন্য চেষ্টা করবে যুক্তি খুঁজে বের করার। অন্যান্য ক্ষেত্রে গুণাগুণ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও এসব কারণে দিব্যতন্ত্রকে গণতন্ত্রের দিকে গণ্য করা কঠিন একটি পদক্ষেপ হিসেবে।
কোনো নতুন ধর্মের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে দিব্যতন্ত্রের গুণাগুণ কখনও খুব মহান এবং কখনও হয়ে পড়ে প্রায় অস্তিত্বহীন। প্রথমত বিপ্লবের পর বিশ্বাসীরা সামাজিক বন্ধনের নাভী গঠন করে এবং মৌলিক বিষয়ে একমত হওয়ার ফলে সহজে সহযোগিতা করতে পারে। সুতরাং তাদের পক্ষে সম্ভব সম্পূর্ণ সচেতন একটি শক্তিশালী সরকার গঠন করা। দ্বিতীয়ত ইতিমধ্যে খেয়াল করা গেছে যে, কোনো কারণে গণতন্ত্র নিশ্চিতভাবে ব্যর্থ হলে সেখানে সংখ্যালঘিষ্ঠ (জন্ম বা সম্পদের দিক দিয়ে নয়) দল বা চার্চের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা সম্ভব। তৃতীয়ত, এটা নিশ্চিত যে বিশ্বাসীরা সাধারণ মানুষের চেয়ে অধিক শক্তিসম্পন্ন ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন এবং অনেকাংশেই তারা অর্জন করেছে বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেষ্ঠত্ব। যা হোক কিছু ক্ষমতাসম্পন্ন কিছু ধর্মমতসহ বিশেষ বিশেষ ধর্মমত চাকরি সন্ধানী দুঃসাহসিক লোকসহ শুধু মূর্খ লোককেই আকর্ষণ করে থাকে। তাই দিব্যতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত কতগুলো বৈশিষ্ট্য হলো বুদ্ধিবৃত্তি।
একটি সম্প্রদায়ের সদস্যদের ভেতর ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লে সেখানে অনিবার্যভাবে কঠোর বাছাই সম্পন্ন হয়। খাঁটি বিশ্বাসীরা সত্য বিশ্বাসের প্রচারের উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে; অন্যান্য ব্যক্তিগত বাহ্যিক সাদৃশ্য সন্তুষ্ট থাকে। প্রথমোক্ত মনোভাব মুক্তবুদ্ধিচর্চা নষ্ট করে দেয়। শেষোক্তটি জন্ম দেয় কপটতার। শিক্ষা ও সাহিত্য অবশ্যই ধরাবাঁধা ছকের ভেতর থাকবে এবং উদ্যম ও সমালোচনার পরিবর্তে শুধু বিশ্বাস সৃষ্টির লক্ষ্যে পরিকল্পিত হবে। নেতারা নিজস্ব মতবাদে আগ্রহী হলে ভিন্ন মতের আবির্ভাব ঘটবে এবং গোঁড়া মতবাদ ক্রমান্বয়ে সঞ্চার করবে অধিকতর শক্তি। যারা ধর্মমতের দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত তারা সাধারণ মানুষের অনুরূপ নয়, দৈনন্দিন জীবন থেকে এ ধরনের ভিন্ন কিছু দ্বারা পরিচালিত হন। এ ধরনের মানুষ কোনো অপ্রিয় সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করলে সমাজের অধিকাংশ মানুষ। স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে অধিকতর হঠকারী ও মূর্খ হয়। এটি এমন একটি ফল বা সব চিন্তাই কার্যত ভিন্নমত এবং তাই বিপজ্জনক-এ ধরনের জ্ঞানের দ্বারা উন্নীত হয়। দিব্যতন্ত্রের অনুসারী শাসক অন্ধ অনুরাগের বশবর্তী হবেন; অন্ধ অনুরাগের ফলে তিনি মারাত্মক হবেন; মারাত্মক হলে তিনি বিরোধিতার সম্মুখীন হবেন; বিরোধিতার সম্মুখীন হলে তিনি আরও মারাত্মক হবেন। তার ক্ষমতা তাড়না ধর্মীয় উন্মাদনার ছদ্মাবরণে আবৃত থাকবে। ফলে তা পর্যবসিত হবে নিয়ন্ত্রণহীনতায়। ধ্বংস ও বিপন্ন অবস্থা এবং নাজি পুলিশ ও চেক এর জন্যেই।
আমরা দেখেছি যে, দোষ-গুণ-ই আছে রাজতন্ত্র ও অলিগৰ্কীর। উভয়টির প্রধান ত্রুটি হচ্ছে, যে সরকার এক সময় সাধারণ মানুষের স্বার্থের প্রতি এতই উদাসীন হয়ে পড়ে যে বিপ্লব সংগঠিত হয়। গণতন্ত্র দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে তা এ ধরনের অস্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়ায়। যেহেতু গৃহযুদ্ধ গুরুতর অমঙ্গলজনক সুতরাং যে সরকার ব্যবস্থা গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা দূর করে দেয় তা প্রশংসার দাবি রাখে। এখন গৃহযুদ্ধ অসম্ভব, কিন্তু সংঘটিত হলে তা আগের ক্ষমতাসীনদের জন্য নিয়ে আসবে বিজয়। অন্যান্য কিছু অপরিবর্তিত থাকলে গৃহযুদ্ধে সংখ্যালঘু সরকারের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের বিজয়ের সম্ভাবনা বেশি। এগুলো গণতন্ত্রের পক্ষের যুক্তি; অধুনা বিভিন্ন উদাহরণ থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে তা অনেক সীমাবদ্ধতার অধীন।
একটি সরকার গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করে রাজনৈতিক ক্ষমতায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অংশগ্রহণের ফলে। চরম গ্রিসীয় গণতন্ত্রে মহিলা ও দাসের স্থান ছিল না। মহিলাদের ভোটাধিকার প্রদানের আগেই আমেরিকানরা নিজেদের গণতান্ত্রিক ভাবত। স্পষ্টতই রাজনৈতিক ক্ষমতায় অংশগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে গণতন্ত্রের কাছাকাছি এসে যায় একটি অলিগার্কি ব্যবস্থা। কিন্তু অংশগ্রহণকারী লোকের সংখ্যা হ্রাস পেলে দেখা দেয় অলিগার্কির বৈশিষ্ট্য।
সব সংগঠনের বিশেষত রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সরকারের সমস্যা দুধরনের। সরকারের দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যাটি হচ্ছে শাসিতের কাছ থেকে সম্মতি আদায় করা। শাসিতের দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যাটি হচ্ছে শাসিতের স্বার্থের ক্ষতিয়ান নিতে সরকারকে উদ্বুদ্ধ করা। সমস্যা দুটির যে কোনো একটি সমাধান হয়ে গেলে দেখা দেয় না অন্যটি। কিন্তু উভয়টির সমাধানের অভাবে দেখা দেয় বিপ্লব। সাধারণ একটি সমঝোতামূলক সমাধানে পৌঁছা সম্ভব। পেশিশক্তির কথা বাদ দিলে সরকার পক্ষের প্রধান উৎপাদকগুলোর পেশি হচ্ছে ঐতিহ্য, ধর্ম, বৈদেশিক শত্রুর ভয় এবং নেতাকে অনুসরণ করার স্বাভাবকি ইচ্ছা। শাসিতের স্বার্থ রক্ষার জন্য কোন মাত্রা কার্যকর–এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত পদ্ধতিই হচ্ছে গণতন্ত্র।
শাসন পদ্ধতি হিসেবে কিছু অপরিহার্য সীমাবদ্ধতা রয়েছে গণতন্ত্রের। অন্যান্য ক্ষেত্রে এগুলো নীতিগতভাবে পরিহারযোগ্য। এ সীমাবদ্ধতার উদ্ভব হয় প্রধানত দুটো উৎস থেকে। কিছু ক্ষেত্রে ত্বরিত সিদ্ধান্তের প্রয়োজন। অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় বিশেষজ্ঞ পরামর্শ। ১৯৩১ সালে ব্রিটেন যখন স্বর্নমান পরিত্যাগ করে তখন উভয় উৎপাদকই জড়িত ছিল। সমস্যাগুলো এমন ছিল যে, তা বুঝত না অধিকাংশ মানুষই। গণতন্ত্র তাই অতীত দৃশ্যাদি অবলোকনপূর্বক এর মতামত প্রকাশ করতে পারত। যুদ্ধ মুদ্রার চেয়ে কম কৌশলসম্পন্ন, কিন্তু তুরিতাবস্থাজনিত।
এসব অপরিহার্য সীমাবদ্ধতার জন্য ভোটাররা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নির্ভর করে সরকারের উপর। সরকার জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেই গণতন্ত্র সফল হয়। দীর্ঘ সংসদ রায় ঘোষণা করে যে, এর সম্মতি ছাড়া সংসদ ভেঙে দেয়া যাবে না। কোন জিনিসটি পরবর্তী সংসদকে এ ধরনের কাজে বাধা দেয়? উত্তরটি যেমন সাধারণ নয় তেমনি নিশ্চিতও নয়। প্রথমে অবস্থায় বিপ্লবাত্মক পরিস্থিতি বিরাজ না করলে বহির্গামী সংসদ সদস্যদের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা বিধিত করে। তাদের অনেকেই আবার নির্বাচিত হতে পারেন। শাসন করার আনন্দ হতে বঞ্চিত হলেও প্রতিযোগীর ভুলের প্রকাশ্য সমালোচনা করে প্রায় সমান আনন্দ পেতে পারেন। যথাসময়ে তারা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেন। কিন্তু শাসনতান্ত্রিক উপায়ে তাদের কবল থেকে ভোটারদের মুক্তি অসম্ভব হলেও বিপ্লবাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। এতে তাদের সম্পত্তি এমনকি জীবনও হতে পারে বিপন্ন। এ ধরনের হঠকারিতায় সম্পৃক্ত ছিল স্টামফোর্ড ও প্রথম চার্লসের অদৃষ্ট।
ইতিমধ্যে বিপ্লবাত্মক পরিস্থিতি বিরাজ করলে সব কিছু ভিন্ন রূপ ধারণ করত। ধরা যাক একটি রক্ষণশীল দলের এ ধরনের ভয় করার কারণ ছিল যে, পরবর্তী নির্বাচনে কমিউনিস্টরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে এবং ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটাবে কোনোরূপ ক্ষতিপূরণ ছাড়াই। এ ধলনের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল দীঘ সংসদের পক্ষে রায় দিতে পারে। তা প্রতিহত করা যেতে পারে শুধু সেনাবাহিনীর আনুগত্যের ব্যাপারে সন্দেহ দ্বারাই।
গণতন্ত্রের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বাধ্যতামূলক হলেও তা এ ধরনের নিরাপত্তাবোধে ব্যর্থ হবে যে বিপ্লবাত্মক পরিবেশে প্রতিনিধিদের পরিস্থিতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সঙ্গে সংসদের মনোভাব বিরোধিতাপূর্ণ হতে পারে। এ ধরনের পরিবেশে সংসদ শক্তিমত্ততার উপর নির্ভর করে কোনোরূপ ঝুঁকি ছাড়াই ব্যর্থ করতে দিতে পারে অধিকাংশ জনগণের উদ্দেশ্য।
এটা বলা যাবে না যে, গণতন্ত্রের চেয়ে ভালো শাসন পদ্ধতি রয়েছে। শুধু বলা যাবে যে, অনেক বিষয় রয়েছে যার জন্য মানুষ সংগ্রাম করবে এবং এগুলোর উদ্ভব হলে কোনো শাসনই ঠেকাতে পারবে না গৃহযুদ্ধ। গৃহযুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে এমন কোনো বিষয়ের জটিলতা রোধ করা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর অন্যতম। যে সমাজে মানুষ গণতন্ত্র চর্চায় অভ্যস্ত সেখানে এই দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী গণতন্ত্র অন্য যে কোনো শাসন পদ্ধতির চেয়ে অগ্রাধিকার পাবার যোগ্য।
শাসন পদ্ধতি হিসেবে গণতন্ত্রের সমস্যা এই যে, তা সব সময় গুরুত্ব আরোপ করে আপসমূলক মনোভাবের উপর। কিন্তু সঠিক মনোভাব এই হওয়া উচিত যে, পরাজিত দল বশ্যতা স্বীকারের উপযোগী কোনো নীতি গ্রহণ করবে। অপরদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সুবিধাবাদী কার্যকলাপ এমন হওয়া উচিত নয় যা জন্ম দিতে পারে বিদ্রোহের। এর জন্য প্রয়োজন অনুশীলন, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও পারস্পরিক সহিষ্ণু মনোভাব। এর চেয়েও বেশি প্রয়োজন ভীতশূন্য রাষ্ট্রের। কারণ ভীতিপ্রদ রাষ্ট্রের জনগণ বাধ্য হয় নেতাকে অনুসরণ করতে। এমন ক্ষেত্রে উড়িয়ে দেয়া যায় না নেতার একনায়ক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। এই অবস্থায় একমাত্র গণতন্ত্রই স্থিতিশীল সরকার গঠনে সর্মথ। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ডমিনিয়ন স্ক্যানডিনেভিয়া এবং সুইজারল্যান্ড বাহ্যিক প্রভাব ছাড়া খুব কমই বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। স্থিতিশীলতা ছাড়াও গণতন্ত্রের গুণাগুণ এই যে, তা সমাজের মঙ্গলজনক কাজে সরকারকে বাধ্য করে। এগুলো আশানুরূপ না হলেও পরম রাজতন্ত্র, অলিগার্ক অথবা স্বৈরাচারের চেয়ে গণতন্ত্র অনেক বেশি কার্যকরি।
গণতন্ত্রের কিছু সমস্যা রয়েছে আধুনিক বৃহৎ রাষ্ট্রে। সমস্যাগুলো অন্যান্য শাসন পদ্ধতির সঙ্গে তুলনামূলক নয়, বরং তা অপরিহার্য রূপে বিপুল সংখ্যাপ্রসূত। প্রাচীনকালে প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি অজ্ঞাত থাকায় নাগরিকরা বাজার এলাকায় জমায়েত হয়ে নিজেদের মতামত দিতে পারত প্রতিটি বিষয়ের উপর। রাষ্ট্রের পরিধি যখন একক নগরভিত্তিক ছিল তখন তা প্রতিটি নাগরিককে ক্ষমতা ও দায়িত্ববোধ দান করে। অধিকাংশ বিষয় এমন ছিল যে, প্রত্যেকেই তার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দ্বারা এগুলো বুঝতে পারত। কিন্তু নির্বাচিত আইন পরিষদের অভাবে গণতান্ত্রিক এলাকা বেশি বিস্তার লাভ করেনি। ইতালির বিশাল এলাকায় জনগণকে রোমান নাগরিকত্ব প্রদান করলে রাজনৈতিক নতুন এলাকার নাগরিকরা রাজনৈতিক ক্ষমতায় বাস্তব অংশগ্রহণে সক্ষম হয়নি। কারণ, তা অনুশীলন করতে পারত শুধু রোমে বসবাসকারী জনসাধারণই। আধুনিক বিশ্বে প্রতিনিধি র্নিাচনের মাধ্যমে ভৌগোলিক অসুবিধাগুলো দূর করা হয়। অল্পদিন আগেও প্রতিনিধিরা একবার নির্বাচিত হলে যথেষ্ট ক্ষমতা রাখতেন। কারণ রাজধানী থেকে দূরবর্তী এলাকায় বসবাসকারী জনগণ কার্যকরি মতামত রাখার জন্য ঘটনাবলি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য শীঘ্র বিস্তারিতভাবে জানতে পারত না। অধুনা সম্প্রচার মাধ্যম দ্রুত যাতায়াত ব্যবস্থা, সংবাদপত্র ইত্যাদির বদৌলতে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোও ক্রমাগতভাবে প্রাচীন নগর রাষ্ট্রের অনুরূপ হতে চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে দূরবর্তী ভোটারদের। অনুসারীরা নেতার উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে, নেতাও প্রভাব বিস্তার করতে পারেন অনুসারীদের উপর। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে তা অসম্ভব ছিল। ফলস্বরূপ প্রতিনিধিত্বের গুরুত্ব কমেছে এবং নেতার গুরুত্ব বেড়েছে। সংসদ এখন আর ভোটার ও শাসকদের ভেতর কার্যকরি মাধ্যম নয়। আগের দিনে শুধু নির্বাচনকালে ব্যবহৃত হতো এমন সব প্রচার মাধ্যম আজকাল সব সময়ই প্রচারণা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। জননেতা, অত্যাচারী শাসক, দেহরক্ষী ও নির্বাসিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রাচীন নগর রাষ্ট্রের অনুরূপ রাষ্ট্র আবার জাগরিত হয়েছে। কারণ আবারও দেখা দিয়েছে এর প্রচারণা পদ্ধতি।
নেতার প্রতি আগ্রহ না থাকলে বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভোটাররা প্রায়ই ভোটাধিকার প্রয়োগ মনে করেন অর্থহীন। কোনো একটি দলের শক্তিশালী প্রচারক না হলে শাসক নির্বাচনের সিদ্ধান্তকারী বিশাল জনশক্তির তুলনায় তার ভূমিকা পুরোপুরিভাবে অবহেলিত মনে করেন। বাস্তবে তিনি শুধু দুই ব্যক্তির ভেতর যে কোনো একজনের পক্ষে সংশ্লিষ্ট মনস্তত্ত্ব রাজতন্ত্রের বেলা আরোচিত মনস্তত্ত্বের অনুরূপ হয়ে থাকে। রাজাও তার সক্রিয় সমর্থকদের সম্পর্ক গোত্র বা সম্প্রদায়ের সদস্যদের ভেতর বন্ধনের অনুরূপ প্রত্যক্ষ দক্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তি বিশেষের ভেতর উৎসর্গের মনোবৃত্তি উজ্জীবিত করার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করে থাকেন। ওই ব্যক্তি বড় নেতা হলে এক ব্যক্তির শাসন হয় প্রতিষ্ঠিত। তা না হলে কার্যকরি কমিটিই প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকে তার নির্বাচনী বিজয়ের পশ্চাতে।
প্রকৃত গণতন্ত্র এটা নয়। সরকারের পরিধি বড় হলে গণতন্ত্র সংরক্ষণ সম্পর্কীয় প্রশ্ন কঠিন হয়ে পড়ে। পরবর্তী অধ্যায়ে আমি এই আলোচনায় প্রত্যাবর্তন করব।
এ পর্যন্ত আমরা আলোচনা করলাম রাজনীতিতে বিভিন্ন প্রকার শাসন পদ্ধতি। কিন্তু অর্থনৈতিক সংগঠনগুলোতে আবির্ভূত পদ্ধতি এত গুরুত্বপূর্ণ ও অদ্ভুত যে তা দাবি রাখে পৃথক আলোচনার।
কোনো শিল্প উদ্যোগের ক্ষেত্রে প্রারম্ভেই রয়েছে একটি পার্থক্য যা প্রাচীন সমাজে নাগরিক ও দাসের মধ্যকার পার্থক্যর অনুরূপ। মূলধন দাতা একজন নাগরিক, কিন্তু চাকরিজীবী হচ্ছেন একজন দাস। এ ধরনের পার্থক্যে আমি খুব জোর দিতে চাই না। চাকরিজীবী দাসের অনুরূপ নন। কারণ, তিনি চাকরি পরিবর্তন করতে পারেন অথবা ইচ্ছা করলে কাটাতে পারেন অবসর সময়। সরকারের সাপেক্ষে আমি সাদৃশ্য বের করতে চাই। স্বাধীন মানুষের সাপেক্ষে সম্পর্কের ভিত্তিতে স্বৈরাচার, অলিগার্ক ও গণতন্ত্র ভিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়েছে। দাসের সঙ্গে সম্পর্ক অনুযায়ী এগুলো একই ধরনের। অনুরূপভাবে একটি পুঁজিবাদী শিল্প প্রতিষ্ঠানে রাজতান্ত্রিক, অলিগার্ক ও গণতান্ত্রিক পন্থায় বিনিয়োগকারীদের ভেতর ক্ষমতা বন্টন করা হয়। কিন্তু চাকরিজীবীরা বিনিয়োগ না করলে কোনো শেয়ার পায় না এবং তাদের দাবি অবহেলিত থেকে যায় প্রাচীন দাসের মতোই।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বহুরূপতা দেখা যায় অলিগার্কিক সংবিধানের মতো। আমি এ মুহূর্তে ভাবছি না এই সত্য সম্পর্কে যে, চাকরিজীবীরা রয়েছে ব্যবস্থাপনার বাইরে। আমি ভাবছি শুধু শেয়ার মালিকদের কথাই। এ সম্পর্কে ভালো বর্ণনা যে বইতে পাওয়া যায় ইতিমধ্যে আমি এর বর্ণনা দিয়েছি : The Modern Corporation and Private Property by Berley and Means. নিয়ন্ত্রণের ক্রমবিকাশ শিরোনামে এক অধ্যায়ে গ্রন্থকারদ্বয় দেখিয়েছেন যে কিভাবে অলিগার্করা স্বল্প বিনিয়োগের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করে নিয়ন্ত্রণ লাভ করেছে বিশাল সঞ্চিত মূলধনের। Proxy Committee র কলা- কৌশল ব্যবহার করে পরিচালকরা তাদের উত্তরসূরিদের নির্দেশ দিতে পারেন। মালিকানা অসংখ্য ভাগে ভাগ হয়ে পড়লে ব্যবস্থাপনা চিরস্থায়ী হয়ে যেতে পারে। এ শর্তের সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থা বর্তমান লেখক অন্যত্র যে সংগঠনে বের করতে পেরেছেন তা হচ্ছে ক্যাথলিক চার্চের উপর প্রভাবশালী সংগঠন। পোপ কার্ডিনালদের নিযুক্ত করেন, আবার কার্ডিনাল পরিষদ পোপ নির্বাচন করেন। এ ধরনের ব্যবস্থা কোনো কোনো বিশাল কর্পোরেশনে বিদ্যমান। আমেরিকায় টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ কোম্পানি এবং আমেরিকার ইস্পাত কর্পোরেশনের বিনিয়োগ যথাক্রমে চার ও দুই বিলিয়ন ডলার। শেষোক্তটিতে পরিচালকমণ্ডলী মাত্র ১.৪ শতাংশের মালিক অথচ তাদের হাতে সম্পূর্ণরূপে অর্থনৈতিক ক্ষমতা।
ব্যবসা কর্পোরেশনগুলো অধিকতর জটিল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে। ভিন্ন ভিন্ন করণীয় কাজ রয়েছে পরিচালকদের, শেয়ার মালিকদের, ডিবেঞ্চার মালিকদের, নির্বাহী কর্মকর্তা ও সাধারণ কর্মচারীদের। নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সাধারণ অলিগার্ক ব্যবস্থার অনুরূপ। এর ইউনিট হচ্ছে শেয়ার-শেয়ার মালিক নয়। পরিচালকরা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি। বাস্তবে সাধারণ শেয়ার মালিকদের তুলনায় পরিচালকদের যে ক্ষমতা রয়েছে তা ব্যক্তি অলিগার্কের তুলনায় রাজনৈতিক অলিগার্কের ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। অপরপক্ষে যেখানে ট্রেড ইউনিয়ন সুসংগঠিত সেখানে চাকরির শর্তের ব্যাপারে কর্মচারীদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত রাখার ক্ষমতা রয়েছে। উদ্দেশ্যের অদ্ভূত দ্বৈততা পরিলক্ষিত হয় পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানে : একদিকে জনসাধারণের জন্য দ্রব্য অথবা সেবার যোগান দেয়ার উদ্দেশ্যে এগুলো সৃষ্টি করা হয়ে থাকে; অপরদিকে শেয়ার মালিকদের লাভের অংশ দেয়াও এগুলোর উদ্দেশ্য। রাজনৈতিক সংগঠনগুলোতে রাজনীতিবিদরা শুধুই বেতন বৃদ্ধির চিন্তা করেন না, বরং জনকল্যাণমূলক কর্মেও ব্রত হন। স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষ থেকেও এ ধরনের দাবি উচ্চারিত হয় বলে ব্যবসার চেয়ে রাজনীতিতে অধিক কপটতা বিদ্যমান। কিন্তু গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক প্রচারণার যৌথ প্রভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিল্পপতি রাজনৈতিক প্রতারণার কলা-কৌশল আয়ত্ত করেছেন এবং ভান করতে শিখেছেন যে জনকল্যাণই তাদের ধন উপার্জনের উদ্দেশ্য। রাজনীতি ও অর্থনীতি একীভূত হওয়ার আরেকটি দৃষ্টান্ত তা।
নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কিভাবে পরিবর্তিত হয় বিশেষ প্রতিষ্ঠানে–এ সম্পর্কে প্রয়োজন কিছু বলা। এটা এমন যে এ ব্যাপারে ইতিহাস থেকে কোনো নিশ্চিত নির্দেশনা পাওয়া যায় না। আমরা দেখেছি যে ইতিহাস যুগের সূচনালগ্নেই মিসর ও ব্যাবিলনে পরম রাজতন্ত্র পুরোপুরিভঅবে উন্নতি লাভ করে; নৃবিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে ধারণা করা হয় যে, মূলত বয়স্ক পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত সীমিত কর্তৃত্ব থেকে তা উন্নীত হয়েছে। ইউরোপীয় প্রভাবের অধীনতা ছাড়া এশিয়াব্যাপী (চীন ছাড়া) কোথাও পরম রাজতন্ত্র অন্য কোনো শাসন ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হতে দেখা যায়নি। অপরপক্ষে ইতিহাস যুগে তা কখনও ইউরোপে দীর্ঘস্থায়ী হতে দেখা যায়নি। অপরপক্ষে ইতিহাস যুগে তা কখনও ইউরোপে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মধ্যযুগে সামন্ত অভিজাত শ্রেণি ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক শহরগুলোর মিউনিসিপ্যাল স্বায়ত্তশাসনের জন্য রাজার ক্ষমতা সীমিত ছিল। রেনেসাঁর পর সর্বত্র রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু মধ্যবিত্তের আবির্ভাবের ফলে এর পরিসমাপ্তি ঘটে প্রথম ইংল্যান্ডে, পরে ফ্রান্সে ও এর পরে পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ জায়গায়। ১৯১৮ সালে বলশেভিকদের সাংবিধানিক পরিষদ বাতিল করা অবধি অনুমান করা হতো যে, সভ্য জগতের সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করবে সংসদীয় গণতন্ত্র।
যা হোক, নতুন কিছু নয় গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন। এগুলো ঘটে থাকে গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলোতে, সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হলে রোমে এবং মধ্যযুগীয় ইতালির বাণিজ্যিক প্রজাতন্ত্রগুলোতে। কোনো সাধারণ নীতি প্রণয়ন করা কি সম্ভব গণতন্ত্রমুখী ও গণতন্ত্রবিমুখী বিভিন্ন পরির্তন নিধারণে?
অতীতে গণতন্ত্রবিরোধী দুটি শক্তি ছিল-সম্পদ ও যুদ্ধ। এ দুটোর ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য আমরা মেডিসি ও নেপোলিয়ানকের দৃষ্টান্ত হিসেবে নিতে পারি। বাণিজ্যলব্ধ সম্পদের অধিকারী ব্যক্তিদের রূঢ়তা জমিদারদের চেয়ে কম। তাই তা ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করতেও পরবর্তী সময়ে হিংসার উদ্রেক না করে শাসন কাজ চালিয়ে যেতে উত্তরাধিকারী শাসকদের তুলনায় অনেক দক্ষ। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় ভেনিসে অথবা হেনসিটিক লীগের শহরগুলোতে বিদেশি লোকের মাধ্যমে মুনাফা সৃষ্টি করা হতো। ফলে স্বদেশে তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়নি। নগরবাসী অভিজাতদের অলিগার্ক তাই বাণিজ্য প্রধান সমাজে অন্য স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল পদ্ধতি। একটি পরিবার অনেকগুলো পরিবারের তুলনায় প্রভূত সম্পদের অধিকারী হলে তা সহজেই উন্নীত হয় রাজতন্ত্রে।
যুদ্ধ পরিচালিত হয় একটি ভিন্ন ও হিংস্রতাপূর্ণ মানসিকতা দ্বারা। ভয় মানুষের মনে জন্ম দেয় নেতার প্রয়োজনবোধের। একজন সফল জেনারেল ভয়ের বিপরীতধর্মী আবেগপূর্ণ প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম। যেহেতু বিজয় এ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার তাই একজন সফল জেনারেল দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতা তার হাতে ন্যস্ত করার প্রয়োজনীয়তা সহজেই বুঝতে সক্ষম। তিনি অপরিহার্য বিবেচিত হন সংকটকালীন। কিন্তু সংকট কেটে গেলে তাকে অপসারণ করা হয়ে পড়ে কঠিন।
যুদ্ধংদেহী মানসিকতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও গণতন্ত্রবিরোধী আধুনিক আন্দোলন সম্পূর্ণরূপে নেপোলিয়নের অনুরূপ নয়। এটা অদ্ভুত মনে হতে পারে যে, সেনাপতির চেয়ে শক্তিশালী হবে বেসামরিক সরকার। তথাপি যেখানে গণতন্ত্র জাতীয় প্রোথিতমূল অভ্যাসে পরিণত হয়েছে সেখানকার অবস্থা তাই। লিংকন সেনাপতি নিয়োগকালে লিখেন, তারা আমাকে বলছে যে তোমার লক্ষ্য হচ্ছে একনায়কতন্ত্র। তা অর্জন করতে হলে প্রয়োজন বিজয় লাভ করা। বিজয়ের জন্য আমি তোমার দিকে চেয়ে আছি এবং আমি ঝুঁকি নেব একনায়কত্বের। তিনি নিরাপদে তা লিখতে পেরেছিলেন, কারণ, তিনি জানতেন যে বেসামরিক সরকারের উপর আক্রমণ হলে আমেরিকার সৈন্য জেনারেলকে অনুসরণ করে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ওয়েলিংটনের অধিনায়ক এ ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করলে কোনো মানুষ পেতেন না তাকে অনুসরণ করার জন্য।
গণতন্ত্র নতুন অবস্থায় প্রাক্তন ক্ষমতাসীনদের প্রতি বিরক্তি থেকেই জন্ম লাভ করে; কিন্তু নতুন অবস্থায় স্থিতিশীল নয় তা। যারা নিজেদের পুরনো রাজা বা অলিগার্কদের বিরোধী মনে করেন তারা রাজতান্ত্রিক বা অলিগার্কিক পদ্ধতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারেন। নেপোলিয়ান ও হিটলার জনসমর্থন লাভ করেছিলেন, কিন্তু পারেননি বারবোনস এবং হোহেন জোলার্ন। যেখানে গণতন্ত্র দীর্ঘ স্থায়ীত্বের ফলে ঐতিহ্যগত হয়ে পড়েছে শুধু সেখানেই তা স্থিতিশীল হয়। ক্রমওয়েল, নেপোলিয়ান ও হিটলার নিজ নিজ দেশে গণতন্ত্রের প্রাথমিক যুগে আর্বিভূত হন। প্রথম দুইজনের তুলনায় তৃতীয় ব্যক্তি কখনোই আশ্চর্যজনক হতে পারেন না। পূর্বসূরিদের চেয়ে তার দীর্ঘস্থায়ীত্বের কল্পনা করার কারণ ছিল না।
এ ব্যাপারে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, অদূর ভবিষ্যতে গণতন্ত্র এর ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে পারবে কি না। আমরা বলছি যে গণতন্ত্র এর স্থিতিশীলতার জন্য অবশ্যই ঐতিহ্যগত হবে। পূর্ব ইউরোপ ও এশিয়ায় কতটুকু সম্ভাবনা রয়েছে এর ঐতিহ্যগত প্রতিষ্ঠা লাভের?
সামরিক কৌশলের দ্বারা সব সময় সরকার প্রভাবিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক দিনগুলোতে রোমান নাগরিকদের সমন্বয়ে গঠিত ছিল রোমান সেনাবাহিনী। কিন্তু পেশাদার সৈন্য স্থলাভিষিক্ত হলে সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়। সামন্ত অভিজাত শ্রেণির শক্তি নির্ভর করত দৃঢ়তার উপর, কিন্তু নিঃশেষ হয়ে যায় আর্টিলারির সূচনা হলে। প্রথম প্রশিক্ষণবিহীন বিশাল ফরাসি বিপ্লবী সেনাবাহিনী তাদের বিরোধী পেশাদার ছোট সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে বিশেষ আদর্শের প্রতি জনপ্রিয় উৎসাহের গুরুত্ব প্রদর্শন করে। এর মাধ্যমে প্রতিফলিত হয় গণতন্ত্রের সামরিক সুবিধাগুলো। উড়োজাহাজ ব্যবহারের মাধ্যমে মনে হয় আমরা স্বল্পসংখ্যক দক্ষ লোকের সমন্বয়ে গঠিত সেনাশক্তির উপর নির্ভরশীলতার যুগে ফিরে যাচ্ছি। মারাত্মক যুদ্ধে জড়িত প্রতিটি দেশের সরকার বৈমানিকদের ইচ্ছার অনুরূপ হবে, যা গণতান্ত্রিক নয়।
কিন্তু এগুলোর বিপক্ষে প্রয়োজন কিছু আলোচনার। মনে করা যেতে পারে যে, মহাযুদ্ধে শুধু যুক্তরাষ্ট্রই জয়লাভ করবে। কিন্তু তাই বলে যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র অচল হয়ে যাবে–এটা মনে করা অসম্ভব। যুদ্ধ কল্পিত সুবিধাগুলো থেকে ফ্যাসিবাদী শক্তির অনেকটাই অস্তিত্ব লাভ করবে। ফলশ্রুতিতে কোনো জাতিকে শিক্ষা ও দেশপ্রেমের বিস্তৃতি ছাড়া অন্য কিছুই যোগাতে পারবে না এত শক্তি।