ক্ষমতা ও নৈতিক বিধি
যে কোনোভাবে নৈতিকতার দুটো দিক বিদ্যমান ইহুদি নবীদের সময় থেকেই : একটি আইনের অনুরূপ; অপরটি ব্যক্তিবিশেষের বিবেক। পূর্বোক্তটি ক্ষমতার অংশবিশেষ, শেষোক্তটি প্রায়ই বিপ্লবধর্মী। আইনের অনুরূপ দিকটি ইতিবাচক নৈতিকতা, অন্যটি ব্যক্তিগত নৈতিকতা। আমি এই পরিচ্ছেদে আলোচনা করার ইচ্ছা রাখি দুই ধরনের নৈতিকতার পরস্পরের মধ্যকার এবং এগুলোর সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক।
ব্যক্তিগত নৈতিকতার চেয়ে ইতিবাচক নৈতিকতা পুরনো এবং সম্ভবত পুরনো আইন ও সরকারের চেয়েও। মূলত তা ছিল উপজাতীয় প্রথা এবং ক্রমে তা থেকে গঠিত হয়েছে আইন। অতি প্রাচীন সমাজে দৃষ্ট বিবাহ সম্পর্কে অসাধারণ বিস্তৃত নিয়ম-কানুন আলোচনা করা যাক। আমাদের কাছে মনে হয়েছে এগুলো নিয়ম মাত্রই; কিন্তু তাদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র যারা এগুলো গ্রহণ করে। এগুলোর নৈতিক শক্তি বিদ্যমান অজাচারী যৌনমিলনের ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধের মতোই। এগুলোর উৎস অস্পষ্ট, কিন্তু এক অর্থে সন্দেহাতীতভাবে ধর্মীয়। ইতিবাচক নৈতিকতার এই অংশটুকু সামাজিক অসমতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয় বলে মনে হয়। এটা ব্যতিক্রমধর্মী ক্ষমতা অর্পণ করে না বা এর মেনে নেয় না অস্তিত্ব। আজও সভ্য সমাজে রয়েছে এ ধরনের নৈতিক বিধি। গ্রিক চার্চ একই সন্তানের দেব পিতাদের ভেতর বিবাহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে–এ ধলনের বিধি-নিষেধ কোনোরূপ সামাজিক উদ্দেশ্যই পূর্ণ করছে না। এর উৎস একমাত্র ধর্মতত্ত্বেই রয়েছে। মূলত কুসংস্কার ছিল এখনকার অনেক যুক্তিনির্ভর বিধি-নিষেধই। প্রেতাত্মার শত্রুতার জন্য হত্যা আপত্তিজনক-এ ধরনের আপত্তি শুধু হত্যাকারীরই নয় বরং প্রদর্শিত হতো হত্যাকারীর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেও। তাই এ বিষয়ে সমাজের স্বার্থ জড়িত ছিল শাস্তিও শুদ্ধিকরণ আধ্যাত্মিক গুরুত্ব লাভ করে এবং দেখা দেয় অনুশোচনা ও মুক্তিদানের রূপলাভের সম্ভাবনা। কিন্তু এর মূল আনুষ্ঠানিক বৈশিষ্ট্য এখন এভাবে স্মরণ করা হয়, মেষশাবকের রক্তে বিধৌত।
আমি আলোচনা করতে চাই না ইতিবাচক নৈতিকতার এ ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও। আমি ক্ষমতার সহায়ক গৃহীত নৈতিক বিধির ওই দিকগুলো আলোচনা করতে চাই। সাধারণত প্রথাগত নৈতিকতার (বহুলাংশে অচেতন) অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থা সক্রিয় করে তোলা। সফল হলে এ উদ্দেশ্য অর্জিত হয় পুলিশ বাহিনীর চেয়ে সহজে ও অধিকতর কার্যকরি পন্থায়। কিন্তু তা ক্ষমতা পুনর্বণ্টনের প্রত্যাশায় সিক্ত বিপ্লবী ক্ষমতার মুখোমুখি হতে বাধ্য। এই পরিচ্ছেদে আমি প্রথমত আলোচনা করব নৈতিক আচরণবিধির উপর ক্ষমতার প্রভাব নিয়ে এবং পরে দেখাব যে খুঁজে পাওয়া যায় কি-না নৈতিকতার অন্য কোনো ভিত্তি।
নৈতিক ক্ষমতার স্পষ্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছে পৌনঃপুনিক অভ্যাসের মাধ্যমে বাধ্য থাকার মনোভাব সৃষ্টি। পিতামাতার প্রতি সন্তান, স্বামীর প্রতি স্ত্রী, প্রভুর প্রতি ভৃত্য, রাজার প্রতি প্রজা এবং (ধর্মীয় ক্ষেত্রে) যাজকের প্রতি অজ্ঞের বাধ্য থাকা কর্তব্য। ধর্মীয় আদর্শ এবং সেনাবাহিনীতে আরও বিশেষ কর্তব্যপরায়ণতা। বিদ্যমান ছিল। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমান্তরালে প্রবহমান এগুলোর প্রতিটির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
আলোচনা করা যাক পিতামাতার প্রতি সন্তানোচিত আচরণ দিয়েই। বর্তমান যুগে এমন অসভ্য রয়েছে যে যখন তাদের পিতামাতা বৃদ্ধাবস্থায় কাজের অনুপযোগী হয়ে পড়ে তখন খাদ্য হিসেবে তাদের বিক্রি করে দেয়া হয়। সভ্যতার অগ্রগতির কোনো এক পর্যায়ে স্বাভাবিক অগ্রিম চিন্তাশীল কোনো ব্যক্তির মাথায় অবশ্যই এমন চিন্তা আসে যে শৈশব অবস্থায় তাদের সন্তানদের ভেতর এ ধরনের মানসিক অবস্থা সৃষ্টি করা যেতে পারে যা বৃদ্ধাবস্থায় তাকে জীবিত রাখতে সাহায্য করবে; নিঃসন্দেহে তিনি ওই ব্যক্তি যার পিতামাতা ইতিমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছেন। তিনি তার বিরোধী মতবাদ সমর্থন করার জন্য দল গঠনের উদ্দেশ্যে দূরদর্শিতামূলক চেতনায় আবেদন রেখেছিলেন কি-না আমার সন্দেহ। আমার সন্দেহ হয় যে, তিনি মনোযোগ আকর্ষণ করেন মানবাধিকারের প্রতি প্রধানত ফলমূল জাতীয় খাদ্যের সুবিধাদির প্রতি, ছেলেমেয়েদের মঙ্গলার্থে শ্রমের ফলে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছেন এমন বৃদ্ধ লোকের দোষহীনতার দিকে। সম্ভবত ওই সময় কৃশ বয়োজ্যেষ্ঠ ও অস্বাভাবিক বুদ্ধিমান কোনো ব্যক্তি ছিলেন যার পরামর্শ তার মাংসের চেয়েও মূল্যবান অনুভূত হলো। যা হোক এমন হতে পারে যে, কারও পিতামাতাকে খাওয়ার চেয়ে সম্মান প্রদর্শন করা উচিত বলে অনুভূত হলো। আমাদের কাছে অতিরঞ্জিত বলে মনে হয় প্রাচীন সভ্যতায় পিতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই লাভজনক প্রথার অবসানের লক্ষ্যে অতি শক্তিশালী বাধা সৃষ্টির প্রয়োজন ছিল। সুতরাং আমরা দেখতে পাই যে, TEN COMMANDMENT-এর পরামর্শ হচ্ছে যদি তুমি তোমার পিতামাতাকে শ্রদ্ধা করতে ব্যর্থ হও তবে অল্প বয়সেই তুমি মারা যাবে। রোমানরা পিতৃহত্যাকে সবচেয়ে নৃশংস অপরাধ মনে করত এবং কনফিউসীয়রা মনে করত যে, পিতামাতার প্রতি সন্তানোচিত ব্যবহার করাই নৈতিকতার বুনিয়াদ। ছেলেমেয়েদের অসহায় শৈশবাবস্থার পরও তাদের উপর পৈতৃক কর্তৃত্ব স্থায়ী করার জন্য এগুলোই সহজাত ও অচেতন ব্যবস্থা। সম্পত্তির স্বত্বাধিকারের দ্বারা পিতামাতার কর্তৃত্ব অবশ্যই বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু পিতামাতার প্রতি সন্তানোচিত আচরণের অস্তিত্ব না থাকলে যুবকরা তাদের পিতামাতা দুর্বল হয়ে যাওয়ার পর তাদের দল বা গোষ্ঠীর উপর পিতামাতার নিয়ন্ত্রণ রাখতে দিত না।
একই জিনিস ঘটত মহিলাদের অধীনতার ব্যাপারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরুষ প্রাণীদের শ্রেষ্ঠশক্তি স্ত্রী প্রাণীদের ক্রমাগতভাবে অধীন করে নিতে পারে না। কারণ, উদ্দেশ্যের দিক থেকে পুরুষদের যথেষ্ট দৃঢ়তার অভাব রয়েছে। মানবজাতির ভেতর সভ্যতার কোনো এক স্তরে স্ত্রীলোকের অধীনতা বর্বর সমাজের চেয়ে অনেক বেশি পূর্ণাঙ্গ ছিল এবং সবসময়ই এই অধীনতা নৈতিকতার সাহায্যে শক্তি লাভ করে। সেন্ট পল বলেছেন, পুরুষ ঈশ্বরের প্রতিবিম্ব ও গৌরব কিন্তু মহিলারা পুরুষের গৌরব। কারণ পুরুষ স্ত্রীলোকের নয় বরং স্ত্রীলোক পুরুষের। কোনো পুরুষই স্ত্রীলোকের জন্য সৃষ্টি হয়নি বরং স্ত্রীলোক পুরুষের জন্য সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং স্ত্রী তার স্বামীকে মেনে চলবে। স্বামীর চেয়ে স্ত্রীর ভেতর অবিশ্বস্ততা নিকৃষ্ট পাপ। এটা সত্য যে, তত্ত্বগতভাবে খ্রিস্টধর্মে পুরুষ ও স্ত্রী উভয়ের বেলা ব্যভিচার সমান পাপ। এই পাপটি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে। কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবে সম্ভব হয়নি। এমনকি খ্রিস্টপূর্ব যুগেও তা তত্ত্বগতভাবে ছিল না। বিবাহিত মহিলার সঙ্গে ব্যভিচার দুষ্কর্মের ছিল। কারণ অপরাধটি ছিল তার স্বামীর বিরুদ্ধে। কিন্তু মহিলারা ও যুদ্ধবন্দিরা ছিল তাদের প্রভুর বৈধ সম্পদ। তাই তাদের সাথে যৌনমিলন দুষ্কর্মের ছিল না। এই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না খ্রিস্টান ধার্মিক দাস মালিকদের। তা ছিল না ঊনবিংশ শতাব্দীর আমেরিকাতেও।
পুরুষ ও মহিলাদের নৈতিকতার পার্থক্যের ভিত্তি ছিল ক্ষমতার দিক থেকে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব। মূলত শ্রেষ্ঠত্ব শুধু কায়িক দিক থেকেই ছিল। কিন্তু এই ভিত্তি থেকে তা ক্রমে অর্থনীতি, রাজনীতি ও ধর্মনীতিতে সম্প্রসারিত হয়। পুরুষের উপর নৈতিকতার বড় ধরনের সুবিধা এক্ষেত্রে অত্যন্ত স্পষ্ট বলে মনে হয়। কারণ, অতি আধুনিককালেও মহিলারা বিশ্বাস করতেন পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব বাস্তবায়নকারী নৈতিক শিক্ষায়। ফলে প্রয়োজন পড়ত অপেক্ষাকৃত কম বাধ্যবাধকতার।
আইনপ্রণেতার দৃষ্টিতে মহিলাদের গুরুত্বহীনতার একটি আকর্ষণীয় ব্যাখ্যা পাওয়া যায় হামুরাব্বি বিধিতে। কোনো ভদ্রলোকের সন্তানসম্ভবা মেয়েকে আঘাত করার ফলে মেয়েটি মারা গেলে আঘাতকারীর মেয়ের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় প্রদান করা হয়। ভদ্রলোক ও আঘাতকারীর পক্ষে এটাই ন্যায়। যে মেয়েটি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে সে শুধু শেষোক্ত ব্যক্তির অধিকারভুক্ত এবং তার নিজের বাঁচার অধিকার নেই। ভদ্রলোকের মেয়েকে খুন করায় আঘাতকারী ভদ্রলোকের কাছে অপরাধী-মেয়েটির কাছে নয়। মেয়েদের অধিকার ছিল না, কারণ তারা ছিল ক্ষমতাহীন। ১ম জর্জ পর্যন্ত রাজারা শ্রদ্ধেয় ছিল ধর্মীয় দিক দিয়ে।
Theres such divinity doth hedge a king that treason can but peep thing it would. Acts little of it will.
এমনকি বিশ্বাসঘাতকতা শব্দের ভেতর অধার্মিকতার গন্ধ রয়েছে REPUB LIC বইয়েও। ইংল্যান্ডে রাজকীয় ঐতিহ্যের দ্বারা সরকার লাভবান হন। ভিক্টোরীয় যুগে রাজনীতিবিদরা, এমনকি গ্লেডস্টোনও ভাবতেন যে এটা দেখা তাদের কর্তব্য যে রানী কখনও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া থাকবেন না। আজকাল অনেকেই ভাবেন যে কর্তৃপক্ষের প্রতি বশ্যতা সার্বভৌমত্বের প্রতি বশ্যতার শামিল। এটা একটি ক্রমহাসমান অনুরাগ। কিন্তু এই অনুরাগ হ্রাস পেলে সরকারের স্থিতিশীলতা হ্রাস পায় এবং বেড়ে যায় ডান অথবা বামের একনায়কত্বের সম্ভাবনা।
এখনও বেইজহাটের ইংলিশ সংবিধান বইটি পড়াশোনার জন্য একটি মুল্যবান বই। তাতে এভাবে শুরু হয়েছে রাজতন্ত্রের আলোচনা
রানীর উপকারিতা মর্যাদাপূর্ণ ক্ষমতার দিকদিয়ে বর্ণনাতীত। তাকে ছাড়া ইংল্যান্ডের বর্তমান ইংলিশ সরকার ব্যর্থ হবে। রানী উইন্ডসরের স্লোপে ভ্রমণ করেছেন, ওয়েলসের রাজকুমার ডারভিতে গিয়েছিলেন-এগুলো পড়ে অনেকেই কল্পনা করে যে, অনেক ছোট জিনিসের বেলাও অনেক চিন্তা এবং খ্যাতির গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা রয়েছেন ভুলের মধ্যেই। এটা খুঁজে বের করা ভালো যে কিভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ হলো একজন বিধবা এবং বেকার যুবকের কার্যকলাপ।
রাজতন্ত্র ভালো সরকার হওয়ার পেছনে সবচেয়ে জোরালো কারণটি হচ্ছে যে, এটা একটি বোধগম্য সরকার। একে বুঝতে পেরেছে মানবজাতি। কিন্তু বিশ্বে এরা খুব কমই অন্যদের বুঝতে পেরেছে। প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে, কল্পনাশক্তির দ্বারাই মানুষ শাসিত হচ্ছে; কিন্তু এর চেয়েও সত্য যে, মানুষ শাসিত হচ্ছে কল্পনার দুর্বলতার দ্বারাই।
এটি সত্য ও গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক বন্ধন সহজ করে তোলে রাজতন্ত্র। কারণ, ব্যক্তিবিশেষের প্রতি আনুগত্য তত কঠিন নয়। দ্বিতীয়ত রাজতন্ত্র এর দীর্ঘ ইতিহাসে যে শ্রদ্ধা মিশ্রিত অনুরাগ পুঞ্জীভূত করেছে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এর সঞ্চার অসম্ভব। কোথাও বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র অবলুপ্ত হলে স্বভাবত এর স্থলে শিগগির অথবা বিলম্বে এক ব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় : গ্রিসে স্বেচ্ছাচারী, রোমে সম্রাট, ইংল্যান্ডে ক্রমওয়েল, ফ্রান্সে নেপোলিয়ন ও এবং আমাদের সময়ে স্ট্যালিন ও হিটলার। এ ধরনের মানুষ অর্জন করেন আগের রাজতন্ত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনুভূতির অংশবিশেষ। প্রাচীন ও ঐতিহ্যগত পরম রাজতন্ত্রে যথোচিত আনুগত্যের অনুরূপ রাশিয়ার বিচারলয়ে অভিযুক্তের স্বীকারোক্তির ভেতর শাসকের প্রতি আনুগত্য গ্রহণ এক মজাদার ব্যাপার। নতুন একনায়ক অসাধারণ ব্যক্তিত্বশীল না হলে খুব কমই সফল হবেন অতীতে বংশানুক্রমিক রাজপুরুষদের উপভোগকৃত ধর্মীয় শ্রদ্ধাবোধ সঞ্চারে।
আমরা দেখেছি যে, এ পর্যন্ত প্রায়ই ধর্মীয় উপাদান আনা হয়েছে রাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে ক্ষমতার মোকাবেলায়। যে সমাজ ব্যবস্থায় রাজা প্রতীকস্বরূপ বিদ্যমান তিনি সেই সমাজ ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করে তুলেছেন। জাপান ও ইংল্যান্ডের মতো অনেক অর্ধসভ্য দেশে তা ঘটেছে। রাজা কোনো অন্যায় করতে পারেন না-ইংল্যান্ডে এই মতবাদটি রাজাকে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু রাজার অস্তিত্ব না থাকলে মন্ত্রীদের যে ক্ষমতা থাকত এর অধীনে তার চেয়ে বেশি ক্ষমতা অর্জিত হয়েছে। যেখানে রাজতন্ত্র প্রথাগত সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহই হচ্ছে রাজার প্রতি অপরাধ এবং গোড়া ব্যক্তিদের কাছে এগুলো পাপ ও অধর্ম। সাধারণতভাবে বলতে গেলে রাজতন্ত্র অবস্থা পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কাজ করার মতো একটি শক্তি। এর চেয়ে উপযোগী কাজ হচ্ছে সামাজিক সংহতির অনুকূলে ব্যাপক অনুভূতি সৃষ্টি করা। মানুষ প্রকৃতিগতভাবে এত কম সামাজিক যে অরাজকতা হচ্ছে একটি নিয়মিত বিপদ যার প্রতিরোধকল্পে রাজতন্ত্র অনেক কিছু করেছে। যা হোক, এই গুণের বিপরীতে তা প্রাচীন পাপ বাঁচিয়ে রাখা এবং ঈপ্সিত পরিবর্তন প্রতিরোধকল্পে শক্তিবৃদ্ধির দোষে দুষ্ট। অধুনা পৃথিবী পৃষ্ঠের অধিকাংশ স্থানে রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটিয়েছে এই ত্রুটি।
অন্যান্য ক্ষমতার চেয়ে নৈতিকতার সঙ্গে যাজকয়ি ক্ষমতার সম্পর্ক অধিকতর স্পষ্ট। খ্রিস্টান দেশে ঈশ্বরের আরাধনার ভেতর সদ্গুণ নিহিত। কোন আদেশটি ঈশ্বরের তা একমাত্র যাজকই জানেন। আমরা দেখেছি যে মানুষের চেয়ে ঈশ্বরের আরাধনাই শ্রেয়-নীতিবাক্যটি বিপ্লবধর্মী। দুটো পরিস্থিতিতে তা সম্ভব–একটি হচ্ছে যখন রাষ্ট্র চার্চের বিরোধী; অন্যটি হচ্ছে, যখন ধরে নেয়া হয় যে ঈশ্বর সরাসরি মানুষের বিবেকের সাথে কথা বলেন। পূর্বোক্ত অবস্থা কনস্টেন্টাইনের আগে বিদ্যমান ছিল এবং শেষোক্ত অবস্থা এনাবেপ্টিস্ট এবং স্বাধীনচেতাদের ভেতর বিরাজমান ছিল। স্বাধীন অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত প্রথাগত চার্চ বিদ্যমান থাকাকালে ইতিবাচক নৈতিকতা ব্যক্তিবিশেষের বিবেক ও ঈশ্বরের মাধ্যম হিসেবে গৃহীত হয়। এর গ্রহণযোগ্যতা চলাকালে এর ক্ষমতা অনেক বেশি এবং চার্চের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে বেশি দোষণীয় মনে করা হয়। তা সত্ত্বেও চার্চের অসুবিধা রয়েছে, কারণ যদি চার্চ নিদারুণভাবে ক্ষমতা ব্যবহার করে তবে মানুষ সন্দেহ পোষণ করতে শুরু করবে যে তা কি সঠিকভাবে ঈশ্বরের ইচ্ছায় বিশ্লেষণ করতে পারছে। যখন এই সন্দেহ সাধারণভাবে বিস্তার লাভ করে তখন চার্চ সংক্রান্ত সব প্রাসাদ চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে যায়। এমনটি ঘটেছিল সংস্কার আন্দোলনের সময় টটনিক দেশগুলোতে।
চার্চের ক্ষেত্রে ক্ষমতা ও নৈতিকতার সম্পর্ক বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত আলোচিত ক্ষমতা ও নৈতিকতার সম্পর্কের কিছুটা বিপরীত। পিতামাতা, স্বামী ও রাজার প্রতি বাধ্য থাকার জন্য ইতিবাচক নৈতিকতার নির্দেশ, কারণ, তারা শক্তিশালী; কিন্তু নৈতিক কর্তৃত্বের জন্য চার্চ শক্তিশালী। যা হোক তা শুধু একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত সত্য। চার্চ নিরাপদ হলে পিতামাতা, স্বামী বা রাজার প্রতি আনুগত্যের নৈতিকতার মতো চার্চের প্রতি আনুগত্যের নৈতিকতা বেড়ে যায়। অনুরূপভাবে অধীনতামূলক নৈতিকতা প্রত্যাখ্যান করা হয়। বিরুদ্ধ মতবাদ এবং অনৈক্য চার্চের কাছে বিশেষভাবে ঘৃণ্য। তাই এগুলো বিপ্লবী কার্যক্রমের অপরিহার্য উপাদান। যাজকীয় ক্ষমতার বিরোধিতার ফলাফল আরও জটিল। চার্চ নৈতিক বিধিগুলোর অফিসিয়াল অভিভাবক। ফলে এর বিরোধীরা নৈতিক মতবাদ এবং পরিচালনার দিক থেকে এর বিরোধিতা করবেন। তারা পিউরিটানদের মতো আরও কঠোরতার সঙ্গে এবং ফরাসি বিপ্লবীদের মতো আরও শৈথিল্যের সঙ্গে বিদ্রোহ করতে পারে। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই নৈতিকতা একটি ব্যক্তিগত বিষয়-আগের মতো একটি অফিসিয়াল সিদ্ধান্তের বিষয় নয়।
এটা অবশ্যই করা উচিত নয় যে, অপেক্ষাকৃত কম কঠোর হলেও অফিসিয়াল যাজকীয় নৈতিকতার চেয়ে ব্যক্তিগত নৈতিকতা নিকৃষ্ট। খ্রিস্টপূর্ব যষ্ঠ ডেলপিতে দৈববানী এই জনহিতকর সংস্কার কাজ স্তিমিত করে দেয় এবং পুরনো ব্যক্তির মৃত স্ত্রীর বোনকে বিবাহ করা অনুমোদনযোগ্য মনে করে তখন চার্চ তার ক্ষমতা সাপেক্ষে পুরনো বিধি-নিষেধ বলবৎ করে।
চার্চ যেখানে ক্ষমতা হারিয়েছে সেখানে কিছু ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে নৈতিকতা প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিগত হতে পারেনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা জনমত অর্থাৎ সাধারণ প্রতিবেশি এবং চাকরিদাতাদের মতো প্রদর্শিত হচ্ছে ক্ষমতাবানদের মতামতের মাধ্যমে।
এ পরিবর্তন পাপীদের দৃষ্টিকোণ থেকে তুচ্ছ ও অধিকতর খারাপ হতে পারে। যেখানে ব্যক্তিগত প্রাপ্তি পাপীর নয় বরং বিচারকের মতো, তিনি সেখানে আনুষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক আদালতের অংশবিশেষ। তিনি কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মেনে নিতে বাধ্য চার্চ শক্তিশালী হলে। দৃঢ় নৈতিক অনুভূতিসম্পন্ন প্রটেস্ট্যান্টরা যাজকীয় নৈতিক ক্রিয়াকলাপ অন্যায়ভাবে আত্মস্থ করেছে এবং অন্যান্য মানুষের দোষ-গুণ বিশেষত দোষের প্রতি প্রায় পোষণ করে সরকারি মনোভাব।
Ye naught to do mark and tell.
Your neighbours fault and folly.
(এটা বলা যথোচিত নয় যে
তোমার প্রতিবেশির ত্রুটি রয়েছে)
ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে নৈতিক আচরণবিধি তত্ত্বটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। বর্বর সমাজের অসবর্ণ বিবাহমূলক অনুশাসন থেকে শুরু করে সভ্যতার সর্বস্তরে ক্ষমতার সঙ্গে নৈতিক বিধিগুলো বাহ্যত কোনো পার্থক্য নেই। আমাদের ভেতর শুধু সমকামের নিন্দাবাদই দৃষ্টান্তস্বরূপ উপস্থাপিত হতে পারে। নৈতিক আচরণবিধি অর্থনৈতিক ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ মার্কসীয় তত্ত্বটি সাধারণভাবে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ তত্ত্বটির চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম সমৃদ্ধ। তা সত্ত্বেও মার্কসীয় তত্ত্বটি অনেক ক্ষেত্রেই সত্য। দৃষ্টান্তস্বরূপ মধ্যযুগে যখন জনসাধারণের ভেতর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষ জমির মালিক ছিল, যখন ইহুদিরাই (একমাত্র) অর্থ বিনিয়োগকারী ছিল, তখন চার্চ কোনোরূপ ইতস্তত না করেই কুদিস প্রথা বাতিল করে দেয়। এটা ছিল ঋণগৃহীতার নৈতিকতা। বিত্তবান মালিক সম্প্রদায়ের অভ্যুদয়ের সঙ্গে পুরনো নিষেধাজ্ঞা টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ল। এর শৈথিল্য প্রথম এনেছিলেন কেলভিন, যার মক্কেলরা ছিল শহুরে ও সম্পদশালী পরে অন্য প্রটেস্ট্যান্টরা এবং পরিশেষে ক্যাথলিক চার্চ। ঋণদাতাদের নৈতিকতা সামাজিক রূপ লাভ করে এবং ঋণ পরিশোধহীনতা ঘৃণ্য পাপ বলে বিবেচিত হয়। বাস্তবে অতি অধুনা পর্যন্ত দেউলিয়াদের বহিষ্কার করে রাখে বন্ধু সমাজ।
বিভিন্ন যুগের শত্রু সম্পর্কিত নৈতিক বিধির পার্থক্য অনেক। এর কারণ পার্থক্য ছিল ক্ষমতা লাভ জনক ব্যবহারে। এই বিষয়ের উপর শোনা যাক পুরনো টেস্টামেন্ট থেকে :
When the lord thy God shall bring thee into the land wither throw goest to possess it, and hath cost out many nations before thee, the Hittites, and the Girgashites, and the Amorifes, and the companies, and the Perizzites, and the Hivites and the Jebusites. Seven nations greater and mightier than thou;
And when the lord thy God shall deliver them before thee; Thou shalt smite them, and utterly destroy they; thou shalt make no covenant with them. no show mercy unto them :
Neither shalt thou make marriage with them; they daughter shalt thou not give unto his sow. nor his daughter shalt thou take untro thy son.
For they will turn away thy son from following me, that they may serve other gods : so the anger of the lord be kindled against you, and destroy thee suddenly.
If they do all this, There shall not be male or female barren among you, or among your cattle.
পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে এই সাত জাতি সম্পর্কে আরও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে :
thou shalf save alive nothing that breathe th… that they teach you not to do after all their abominations.
But towards cities which are very for off from thee, and which are not of these nations it is permissible to be more merciful
Thou shall smite every male there of with the edge of the sword : but the women, and the little ones, and the cattle, and all that is in the city even all the spoil thereof, shalt thou take unto thyself.
স্মরণ করা যেতে পারে যে বিষয়টি সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান না থাকায় সোল (saul) এমালেকাইটকে আঘাত করলে সমস্যায় পড়েন:
And he took agag the king of the Amolekites alive and utterly destroyed all the people with the edge of the sword.
But saul and the people spared Agag, and the best of the sheep, and of the oxen, and of the fettings. and the lambs, and all that was good. and would not utterly destroy them : but everything that was vile and refuse, that they destroyed utterly.
Then come the word of the lord unto samnel saying.
It repenteth me that I have set up saul to the king : for he is turned back from following me. and hath not performed my commandments.
The moral code towards enemies is a matter as to which different ages have differed greatly, largely because the profitable uses of power have differed. On this subject, let us first hear the Old Testament.
When the Lord thy God shall bring thee into the land wither thou gust to possess it, and hath cast out many nations before thee, the Hittities. and Girgashites, and the Amorites, and the Canaanites, and the Perizzites, and the Hivites and the Jebusites, seven nations greater and mightier than thou :
And when the Lord thy God shall deliver them before thee : thou shalt smite them, and utterly destroy them : thou shall make no covenant with them. nor show mercy unto them :
Neither shalt thou make marriages with them : thy daughter shalt thou not give unto his son. nor his daughter shall thou take unto thv son.
For thev will turn away the son from following me. that they may serve other gods : so will the anger of the Lord be kindled against you. and destroy thee suddenly.
If they do all this, there shall not be make or female barren among you. or among your cattle.
As regards these seven nations, we are told in a later chapter even more explicity :
Thou shalt save alive nothing that breatheth … that they teach you not to do after all their abominations.
But towards cities which are very far off from thee, and which are not of these nations it is permissible to be more merciful:
Thou shall smite every male thereof with the edge of the sword : but the women, and the little ones, and the cattle, and all that is in the city. even all the spoil thereof, shalt thou take unto thyself.
It will be remembered that when Saul smote the Amalekites he got into trouble for being insufficiently thorough :
And be took Agag the king of the Amalekites alive and utterly destroyed all the people with the edge of the sword.
But Saul and the people with the edge of the sword.
But Saul and the people spared Agag. and the best of the sheep, and of the oxen, and of the fatlings, arid the lambs and all that was good. and would not utterly destroy them : but everything that was vile and refuse, that they destroyed utterly.
Then came the word of the Lord unto Samuel, saying,
It repenteth me that I have set up Saul to be king : for he is turned back from following me, and hath not performed my commandments.
রচনার এই অংশগুলোতে এ কথা স্পষ্ট যে পরিপূর্ণ বিজয় লাভই ছিল জেন্টাইল ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সংঘর্ষে ইসরাইলি ছেলেমেয়েদের আগ্রহের কারণ। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ধর্মীয় তথা যাজকদের স্বার্থ ছিল জনসাধারণের উপর অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার করা। প্রভুর কথা সামুয়েল পর্যন্ত এসেছিল। কিন্তু Saul-এর কাছে যা আসল তা ছিল সামুয়েলের এবং কথাটি ছিল : আমার কানে ভেড়ার ডাক ও ষড়গুলোর হাম্বা ধ্বনির অর্থ কি ছিল? Saul এগুলোর উত্তর দিতে পারতেন নিজের পাপ স্বীকারের মাধ্যমেই।
পৌত্তলিকতার প্রতি ঘৃণার বশবর্তী হয়ে ইহুদিরা পরাজিতদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য ব্যতিক্রমধর্মী ব্যাপকতায় ধাবিত হয়। কিন্তু প্রাচীন কোনো জাতিই পরাজিত জনগণের সঙ্গে আচরণের কোনো নৈতিক বা আচরণগত সীমারেখা চিহ্নিত করেনি। একটিই রীতি ছিল যে, পরাজিত পক্ষের কিছু লোককে নিশ্চিহ্ন করা হতো এবং অবশিষ্ট মানুষকে দাস হিসেবে বিক্রি করা হতো। কিছু গ্রিক (যেমন Euripides in the trojen women) এই রীতির বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির জন্য চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তারা বিফল হয়। শক্তিহীন বলেই পরাজিত দল ক্ষমতা লাভের দাবি করতে পারেনি। এমনকি তত্ত্বগতভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যক্ত হয়নি খ্রিস্টবাদের পূর্ব পর্যন্ত।
শত্রুর প্রতি কর্তব্য একটি কঠিন ধারণা। প্রাচীনকালে ক্ষমাশীলতা একটি গুণ হিসেবে স্বীকৃত হতো। কিন্তু এই স্বীকৃতি শুধু সফল ক্ষেত্রেগুলোতেই প্রযোজ্য হতো। অন্য ক্ষেত্রে তা দুর্বল হিসেবে নিন্দিত হতো। ভয়ের উদ্রেক হলে কেউ উদারতা আশা করত না। রোমানরা হেনিবল বা স্পার্টাকাসের অনুসারীদের কাউকে ক্ষমা প্রদর্শন করেনি। মধ্যযুগে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত সৈনিকদের মধ্যকার সংঘাত খুব মারাত্মক ছিল না; আলবেজিনেসের প্রতি সামান্যতম ক্ষমা দেখানো হয়নি। আমাদের যুগে ফিনল্যান্ড, হাঙ্গেরি, জার্মানি ও স্পেনে শ্বেত সন্ত্রাসীদের শিকারে পরিণত মানুষের প্রতি প্রায় একই ধরনের হিংস্র আচরণ প্রদর্শিত হয়েছে। এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়া অন্যদের মধ্যে থেকে খুবই কমই অভিযোগ উঠেছে। অনুরূপভাবে রাশিয়াতে অধিকাংশ বামপন্থিরা সন্ত্রাস অনুমোদন করে। পুরনো টেস্টামেন্টের দিনগুলোর মতো বাস্তবে শক্রর প্রতি কোনো কর্তব্যই স্বীকৃত হচ্ছে না, যখন এগুলো ভীত সঞ্চারে শক্তিশালী। ইতিবাচক নৈতিকতা শুধু সমাজের সংশ্লিষ্ট অংশের ভেতর ক্রিয়াশীল এবং কার্যত এটি সরকারের একটি বিভাগ। এখন একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ব সরকার ছাড়া অন্য অবাস্তব পরামর্শ ব্যতিরেকে কলহপ্রিয় জনগণকে স্বীকার করতে পারবে না যে নৈতিক বিধিগুলো মানবজাতির একটি সম্প্রদায়ের ভেতর সীমাবদ্ধ নয়।
এই পরিচ্ছেদে আমি আলোচনা করছি ইতিবাচক নৈতিকতার, কিন্তু স্পষ্টই প্রতীয়মান হচ্ছে যে তা যথেষ্ট নয়। ইতিবাচক নৈতিকতার, কিন্তু ক্ষমতার পক্ষে এবং তা বিপ্লব অনুমোদন করে না। তা বিবদমান পক্ষগুলোর হিংস্রতা প্রশমনে কিছুই করে না এবং নৈতিক অন্তর্দৃষ্টি সম্পর্কিত নতুন কিছুর ঘোষকের জন্য অবস্থান খুঁজে বের করতে পারে না। এখানে তত্ত্বীয় কঠিন প্রশ্ন জড়িত রয়েছে। কিন্তু এগুলো আলোচনার আগে আসুন আমরা কতগুলো প্রশ্ন স্মরণ করি, যা শুধু বিরোধিতাই করতে পারে ইতিবাচক নৈতিকতার।
কম হলেও পৃথিবী গসপেলের কাছে ঋণী। তা কিছুটা দাসত্ব ও মহিলাদের অধীনতা প্রত্যাখ্যানকারীদের কাছে ঋণী। আমরা আশা করতে পারি যে ভবিষ্যতে যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক বৈষম্য বর্জনকারীদের কাছে তা ঋণী হবে। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে সহিষ্ণু প্রচারকদের কাছে তা ঋণী হবে। মধ্যযুগীয় চার্চের বিরুদ্ধে বিপ্লব, পুনর্জাগরিত রাজতন্ত্রে এবং বর্তমান প্রটোক্র্যাসি ক্ষমতার অচলাবস্থা নিরসনের জন্য প্রয়োজনীয়। এ কথা স্বীকার করে পৃথিবীকে অরাজতার দিকে ঠেলে না দিয়ে প্রয়োজন এগুলোর স্থান খুঁজে বের করা।
এখানে বিবেচনাধীন রয়েছে দুটো প্রশ্ন : প্রথমত ইতিবাচক নৈতিকতা ব্যক্তিগত নৈতিকতায় পরিণত করার জন্য কি হতে পারে এর দৃষ্টিকোণ থেকে বিজ্ঞতাপূর্ণ মনোভাব? কোন মাত্রার শ্রদ্ধার জন্য ব্যক্তিগত নৈতিকতা ইতিবাচক নৈতিকতার কাছে দায়ী? কিন্তু এর যে কোনো একটি আলোচনার আগে প্রয়োজন ব্যক্তিগত নৈতিকতা বলতে কি বোঝায় তা আলোকপাত করা।
ব্যক্তিগত নৈতিকতা আলোচনা করা যেতে পারে ঐতিহাসিক ঘটনাবলি থেকে অথবা দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে। আলোচনা শুরু করি পূর্বোক্তটি দিয়েই।
ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান অনুযায়ী বলা যায়, প্রায় প্রতিটি ব্যক্তিই ঘৃণার চোখে দেখতেন বিশেষ বিশেষ কাজ। সাধারণ এসব কার্যকলাপ শুধু ব্যক্তিবিশেষের দ্বারাই নয় বরং ঘৃণিত হতো সম্পূর্ণ গোষ্ঠী, জাতি বা সম্প্রদায় কর্তৃক। কোনো কোনো ঘৃণার উৎস মানুষের জানা নেই আবার কোনো কোনো ঘৃণার উৎস ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের ভেতর খুঁজে পাওয়া যেত। আমরা জানি কেন মোহাম্মদ (সাঃ)-এর অনুসারীরা কোনো প্রাণী বা মানুষের ছবি অংকন করে না। এর কারণ মোহাম্মদ (সাঃ) এমন করতে নিষেধ করেছেন তাদের। আমরা জানি কেন ইহুদিরা খরগোস খায় না। এর কারণ মুসা (আঃ)-এর আইন ঘোষণা করছে যে খরগোস অপবিত্র প্রাণী। এ ধরণের নিষেধাজ্ঞাগুলো গৃহীত হলে ওইগুলো ইতিবাচক নৈতিকতার আওতাভুক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু যে কোনোভাবে এগুলো জানা হয়ে গেলে তা পড়ে ব্যক্তিগত নৈতিকতার পর্যায়ে।
যা হোক, ইতিবাচক নৈতিকতা বলতে আমাদের কাছে ধর্মীয় অনুশাসনের চেয়ে বেশি কিছু মনে হয়। যেভাবে তা আমাদের কাছে পরিচিত তা সেকেলে নয়, কিন্তু এর কতগুলো উৎস রয়েছে বলে মনে হয়- চৈনিক বিজ্ঞ ব্যক্তি, ইহুদি নবী এবং গ্রিক দার্শনিক। কঠিন ব্যাপার ইতিহাসে তাদের গুরুত্ব নির্ণয় করা। সবাই কয়েক শতাব্দীর ভেতর বসবাস করে গেছেন। তাদের সবাই বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলোর অংশীদার যা তাদের পূর্বসূরিদের থেকে স্পষ্টভাবে পৃথক করেছে। প্রথা অথবা অন্য কারও পূর্বসূরিদের থেকে স্পষ্টভাবে পৃথক করেছে। প্রথা অথবা অন্য কারও জ্ঞানের মাধ্যমে নয় বরং নিজের জ্ঞানানুযায়ী লাওসি ও চুনসি চাও তাদের মতবাদ প্রচার করেন। তাদের মতবাদ বিশেষ কর্তব্য সংবলিত নয়, বরং বিশেষ চিন্তা ও অনুভূতি সংবলিত জীবন পদ্ধতি যা স্বাভাবিক হয়ে যায় কোনোরূপ নীতির প্রয়োজন ব্যতিরেকে। একই কথা বলা যেতে পারে প্রাচীন বৌদ্ধদের সম্বন্ধে। ইহুদি নবীরা আইন অতিক্রম করেন এবং নতুন ও অধিকতর অন্তর্মুখী গুণাবলি সমর্থন করেন। এই সমর্থনের ভিত্তি প্রথা নয়, বরং প্রভু এমন বলেছেন শব্দাবলির মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ। সক্রেটিস আত্মার আদেশ অনুযায়ী কাজ করেন-আইনানুগ কর্তৃপক্ষের আদেশ অনুযায়ী নয়। অন্তরের সুরের প্রতি মিথ্যা হওয়ার চেয়ে শহীদের মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করতে তিনি প্রস্তুত। তাদের সময়ে এইসব মানুষ বিদ্রোহী ছিলেন এবং সবাই সম্মানিত হয়েছেন। এগুলোর ভেতর অবশ্যই বিবেচনাধীন রয়েছে নতুন কিছু। কিন্তু এই জিনিসটি কি তা সার্বিকভাবে সহজ নয় বলা।
এটা মনে হয় যে, নৈতিক প্রশ্নে মানবজাতির ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে নিজেকে উপস্থাপিত করা সবসময় অন্যায় হতে পারে না। আজকাল প্রত্যেকেই বিজ্ঞানে অনুরূপ মতবাদ গ্রহণ করেন। কিন্তু বিজ্ঞানে নতুন মতবাদ পরীক্ষা করার পদ্ধতি জ্ঞাত এবং শিগগিরই তা সাধারণভাবে গৃহীত হয়ে থাকে অথবা প্রথা ছাড়া অন্য কোনো কারণে প্রত্যাখ্যাত হয়। নীতিশাস্ত্রের নতুন মতবাদ পরীক্ষা করার অনুরূপ কোনো পদ্ধতির অস্তিত্ব নেই। নবী তার উপদেশের প্রাথমিক উপস্থাপনায় প্রভু এমন বলেছেন কথাটি যথেষ্ট মনে করেন। কিন্তু অন্যান্য মানুষ কি করে বুঝবে যে তিনি দিব্যজ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছেন? বিজ্ঞানে প্রায়ই চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচিত পরীক্ষার অনুরূপ পরীক্ষা ডিউটারনমি আশ্চর্যজনকভাবে প্রস্তাব করেন যে পূর্ব ধারণাতেই সফলতা রয়েছে। তিনি যদি অন্তরে অন্তরে তাকে বলে দেন তবে আমরা কি করে জানব প্রভু কোন কথাটি বলেননি। নবী যখন কিছু বলেন এবং কথা অনুযায়ী কাজ হয় না তখন বলা হয় যে প্রভু এ রকম বলেননি, বরং নবী তা অনুমান করেই বলেছিলেন। কিন্তু আধুনিক মানুষ খুব কমই এ ধরনের নীতিশাস্ত্রীয় পরীক্ষা গ্রহণ করে থাকে।
প্রশ্নের মোকাবেলা অবশ্যই করতে হবে আমাদের। নীতিশাস্ত্রীয় মতবাদ বলতে কি বোঝায় এবং কিভাবে তা পরীক্ষা করা যেতে পারে।
ঐতিহাসিকভাবে নীতিশাস্ত্র ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অধিকাংশ লোকের জন্য কর্তৃত্বই যথেষ্ট-চার্চ অথবা বাইবেলে বর্ণিত সত্য-মিথ্যাই তাদের কাছে আসল সত্য-মিথ্যা। কিন্তু সময় সময় বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিত্ব স্বর্গীয় প্রেরণা লাভ করেছেন–তারা জেনেছেন কোন জিনিস সত্য অথবা মিথ্যা। কারণ, প্রভু সরাসরি তাদের সাথে কথা বলেছেন। গোঁড়া মতবাদ অনুসারে এসব মানুষ অনেক আগেই চলে গেছেন এবং আধুনিক কোনো ব্যক্তি নিজেকে ওইরকম একজন বলে পরিচয় দিলে তাকে আশ্রয়দানে রাখাই শ্রেয় হবে যদি চর্চা তার ঘোষণা অনুমোদন না করে। যা হোক, এটাই হচ্ছে বিদ্রোহীদের স্বেচ্ছাচারী হওয়ার স্বাভাবিক অবস্থা এবং তা আমাদের সাহায্য করে না বিদ্রোহীদের বৈধ কার্যকলাপ নিরূপণে।
আমরা কি ভাষান্তর করতে পারি ধর্মীয় পরিভাষার বাইরে নীতিশাস্ত্রের? এর সম্ভাব্যতা সম্পর্কে ভিক্টোরীয় স্বাধীন চিন্তাবিদদের কোনো সন্দেহ ছিল না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, উপযোগবাদীরা ছিল উচ্চ নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ এবং তারা প্রত্যয় পোষণ করত তাদের নৈতিকতা একটি যুক্তিসঙ্গত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত বলে। যা হোক, বিষয়টি তাদের কল্পিত অবস্থার চেয়ে কঠিন। আলোচনা করা যাক উপযোগবাদীদের প্রস্তাবিত প্রশ্নের। কখনও কি আচারণবিধির নীতিশাস্ত্রীয় প্রতিজ্ঞা হতে পারে অথবা সর্বদাই কি আচরণের ভালো অথবা খারাপ ফলাফল থেকে তা পেতে হবে? ফলাফল নিরপেক্ষ প্রথাগত সৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে যে বিশেষ শ্রেণির কার্যকলাপ নীতিশাস্ত্রীয়ভাবে নিরপেক্ষ এবং এগুলো বিচার্য ফলাফল সাপেক্ষে। মৃত স্ত্রীর বোনের সঙ্গে বিবাহ একটি নীতিশাস্ত্রীয় প্রশ্ন; কিন্তু স্বর্নমান সম্পর্কীয় প্রশ্ন নীতিশাস্ত্রের আওতাভুক্ত নয়। দুটো সংজ্ঞা রয়েছে নীতিশাস্ত্রীয় প্রশ্নে, এর যে কোনো একটি এই বিশেষণ প্রযুক্ত ক্ষেত্রের জন্য প্রযুক্ত হবে। একটি প্রশ্ন নীতিশাস্ত্র সম্পর্কীয় (১) যদি তা প্রাচীন ইহুদিদের আগ্রহ সৃষ্টি করত। (২) যদি তা এ রকম হয় যে ক্যান্টারবারির আর্কবিশপ এর অফিসিয়াল দক্ষ। এটা স্পষ্ট যে, সম্পূর্ণ অরক্ষণযোগ্য নীতিশাস্ত্র শব্দটির ব্যবহার।
তা সত্ত্বেও ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে আমি দেখতে পাই যে, বিভিন্ন ধরনের আচরণ রয়েছে, যেগুলোর ক্ষেত্রে আমি প্রতিকূলতা অনুভব করছি এবং যেগুলো আমার কাছে মনে হয় নৈতিকতা সম্পন্ন বলে।
কিন্তু স্পষ্টই তা প্রাক্কলিত পরিণাম নির্ভর নয়। অনেকের কাছ থেকেই আমি জানতে পেরেছি যে অসংখ্য ছেলেমেয়েকে বিষবাষ্প প্রয়োগে হত্যা করেও অন্যসব ভয়ানক কার্যকলাপের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ গণতন্ত্র সংরক্ষণ করা যায়। এ মুহূর্তে আমি এমন উপায় অবলম্বন নীরবে মেনে নিতে পারি না। আমি বলছি যে, তা সফল হবে না অথবা যদি সফল হয়েই যায় তবে এর পরিণাম এত খারাপ হবে যে তা গণতন্ত্রের যে কোনো সুফলকে অনেক পেছনে ফেলে দেবে। এ ব্যাপারে যুক্তিটি কতটুকু পক্ষপাতহীন আমি নিশ্চিত নই। আমি বলছি এ ধরনের উপায় অবলম্বন করা উচিত, যদি আমার কাছে প্রতীয়মান হয় যে এগুলোই সফল হবে। মনোগত কল্পনা থেকে আমি নিশ্চিত যে আমার কল্পিত ভালো কিছু এ ধরনের উপায় অর্জিত হতে পারে না। সর্বোপরি আমি মনে করি যে, দর্শনগতভাবে সব কাজই বিচার্য ফলাফল দ্বারা। কিন্তু যেহেতু তা কঠিন, অনিশ্চিত ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, বাস্তবে তাই আশা করা যেতে পারে যে, কিছু কিছু কাজ বাতিল করে দিতে হবে এবং পরিণতির পরীক্ষা ব্যতিরেকে কিছু কিছু কাজের প্রশংসাসূচক মূল্যায়ন করতে হবে। সুতরাং উপযোগবাদীদের মতো আমাকে বলতে হয় যে, যে কোনো সঠিক অবস্থায় সঠিক কাজ হচ্ছে তা-ই যা সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে সম্ভাব্য কাজগুলোর ভেতর মন্দের চেয়ে সর্বাধিক ভালো কিছু অর্জন করতে পারে। নৈতিক আচরণবিধির দ্বারাই এর কাজ সম্পাদন সম্ভব। এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে নিলে নীতিশাস্ত্র ভালো ও মন্দের উদ্দেশ্যমূলক সংজ্ঞায়নে পর্যবসিত হয়। উপযোগবাদীরা বলেন, ভালো হচ্ছে আনন্দ এবং মন্দ হচ্ছে বেদনা। কিন্তু কেউ যদি তার সঙ্গে একমত না হন তবে কি যুক্তি উপস্থাপন করবেন তিনি?
বিবেচনা করা যাক জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। একজন বলেছেন, ভালো হচ্ছে আনন্দ; অন্যজন বলেছেন, ভালো হচ্ছে আল্লাহর প্রশংসা এবং চিরকাল তাকে গৌরবান্বিত করা। এই তিন ব্যক্তি কিসের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং কি পদ্ধতির মাধ্যমে একে-অন্যের প্রত্যয় সৃষ্টি করেছেন? বিজ্ঞানীদের মতে তাদের পদ্ধতি প্রকৃত সত্যের ব্যাপারে সংবেদনশীল নয়, অর্থাৎ কোনো সত্যই এই বিতর্কের অনুকূল নয়। তাদের পার্থক্য আকাক্ষার মধ্যে-সত্য সম্পর্কিত বিতর্কের ভেতর নয়। আমি বলছি না যে আমি যখন বলি এটা ভালো তখন আমি বোঝাতে চাই আমি তা আশা করি; এটা শুধু একটি বিশেষ আকাক্ষা যা আমাকে কোনো জিনিস ভালো বলতে উদ্বুদ্ধ করছে। এই আশা বিশেষ মাত্রা পর্যন্ত নৈব্যক্তিক; এটা এমন একটি বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কিত হবে যা শুধু আমার পরিবেশেই আমাকে আনন্দ দেবে না। কোনো একজন রাজা। এই বর্ণনার প্রথম অংশ নিঃসন্দেহে নীতিগত। কিন্তু রাজা হওয়ায় তার আনন্দ শুধু নীতিগত হতে পারে, যদি কোনো জরিপ থেকে বোঝা যায় যে, অন্য কিছুই পারে না এ ধরনের ভালো রাজা বানাতে।
আগে এক উপলক্ষে আমি প্রস্তাব করেছি যে, স্বকীয়মান ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন-তবে এ ব্যাখ্যা স্বপ্রমাণের ভিত্তিতে নয়, বরং মানবজাতির আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কিত প্রকাশের ভিত্তিতে। আমি যখন বলি ঘৃণা খারাপ তখন প্রকৃতপক্ষে আমি বলি যে, কেউ ঘৃণাবোধ করেনি। আমি কোনোরূপ গুরুত্ব আরোপ করছি, আমি শুধু বিশেষ ধরনের আকাক্ষা প্রকাশ করছি। শ্রোতা বুঝতে পারেন যে, আমি এই আকাক্ষা অনুভব করি। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন যে সত্য শুধু এটি ই। এই সত্য মনোবিজ্ঞানসম্মত সত্য-নীতিশাস্ত্রীয় সত্য নয়।
নীতিশাস্ত্রের মহাপ্রবর্তকরা অন্য মানুষের চেয়ে বেশি জানতেন না। তবে বেশি আশা করতেন। আরও যথাযথভাবে বলতে গেলে সাধারণ মানুষের চেয়ে তাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল অধিকতর নৈর্ব্যক্তিক এবং তাদের লক্ষ্যস্থল ছিল অধিকতর ব্যাপক। অধিকাংশ লোকই নিজের সুখের চিন্তা করে; বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ তাদের ছেলেমেয়ের সুখের চিন্তা করে; অল্প লোকও জাতীয় সুখের চিন্তা করে না; মানবজাতির জন্য সুখের চিন্তা কোনো কোনো মানুষের ভেতর খাঁটি ও প্রবল। অনেকের মধ্যেই এ ধরনের অনুভূতি নেই এবং একে সার্বজনীন সুখের পথে বাধাস্বরূপ দেখে এসব মানুষ মনে করে যে অন্যরা যেমন কাজ করে তেমন অভুব করে; সুখই ভালো এভাবে এই আশাবাদ ব্যক্ত করা যায়।
বুদ্ধ ও স্টয়েকের সময় থেকে আজ পর্যন্ত নৈতিকতাবাদী সবাই ভালো বলতে এমন কিছু বিবেচনা করেছেন যা সব মানুষ সমভাবে উপভোগ করতে পারে। তারা নিজেদের রাজপুত্র বা গ্রিক বা ইহুদি মনে করেননি বরং মানুষই ভেবেছেন। সব সময়ই তাদের নীতির দ্বিত্ব উৎস ছিল : একদিকে তারা নিজেদের জীবনে বিশেষ বিশেষ জিনিসের মূল্য দিতেন। অপরদিকে সহানুভূতিমূলক গুণ থাকার ফলে নিজেদের মতোই তারা অন্যদের জন্যও আশা করতেন। নীতিশাস্ত্রে সহানুভূতি একটি বিশ্বজনীন শক্তি; আমি মনে করি সহানুভূতি একটি আবেগ তত্ত্বীয় নীতি নয়। সহানুভূতি সহজাত একটি বিশেষ শিশু অন্য একটি শিশুর কান্নার দুঃখ পেতে পারে। কিন্তু সহানুভূতির সীমাবদ্ধতা প্রাকৃতিকও বটে। ইঁদুরের প্রতি বিড়ালের সহানুভূতি নেই। হাতি ছাড়া অন্য প্রাণীর প্রতি রোমানদের সহানুভূতি ছিল না। ইহুদিদের প্রতি জেন্টাইলদের এবং কুলকদের প্রতি স্ট্যালিনের কোনো সহানুভূতি ছিল না। সহানুভূতির সীমাবদ্ধতা থাকলে অনুরূপভাবে ভালোর ধারণা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ভালো এমন যা শুধু মহানুভব ব্যক্তিরা অথবা শুধু অতিমানব অথবা আর্য অথবা প্রলেতারীয় অথবা ক্রিস্টাডেলপীয়রা ভোগ করে থাকেন। এসব ইঁদুর-বিড়াল সম্পর্কজাত নীতিশাস্ত্রের কথা।
ইঁদুর-বিড়াল সম্পর্কজাত নীতিশাস্ত্রীয় কথার খণ্ডন বাস্তব, তাত্ত্বিক নয়। দুটোই এ ধরনের নীতিশাস্ত্রের উপযোগী হয়ে থাকে। ঝগড়াটে ছোট ছোট ছেলেদের মতো অনেকেই বলতে থাকে, চলো খেলা শুরু করি; আমি বিড়াল তুমি ইঁদুর। না না প্রত্যেকেই উত্তর দেয় তুমি না আমি বিড়াল হব। এভাবে ওরা সবাই পরিণত হয় ঝগড়াটে বিড়ালে। কিন্তু এর একজন পূর্ণ সফলতা অর্জন করতে পারলে সে তার নীতিকথা প্রতিষ্ঠা করতে পারে; আমরা তখন বাড়ি ভাড়া, সাদা মানুষের বোঝা অথবা নরভিক প্রতিযোগিতা অথবা এ ধরনের কিছু মতামত পেয়ে থাকি। এ ধরনের মতামতগুলো অপরিহার্যরূপে আকর্ষণ করে থাকে বিড়ালকেই, ইঁদুরকে নয়। এগুলো ইঁদুরের উপর আরোপিত নগ্ন ক্ষমতা।
নীতিশাস্ত্রীয় বিতর্ক প্রায়ই উপায় সম্পর্কিত-উদ্দেশ্য সম্পর্কিত নয়। দাস প্রথাকে এজন্য আক্রমণ করা যেতে পারে যে তা অ-অর্থনৈতিক নয়। স্বাধীন ছেলেমেয়েদের আলাপ-আলোচনা আগ্রহ উদ্দীপক-এ সত্যের উপর জোর দিয়ে মহিলাদের অধীনতার সমালোচনা করা হয়। নির্যাতনের জন্য দুঃখ করা হয় এজন্য যে, এর ফলে উদ্ভূত ধর্মীয় বিশ্বাস বৈধ নয়। যা হোক, এসব যুক্তির পেছনে সাধারণত উদ্দেশ্য সম্পর্কিত পার্থক্য বিদ্যমান। নিয়েজেকের যুদ্ধবাদ সম্পর্কিত সমালোচনার মতো উদ্দেশ্যের পার্থক্য নগ্নভাবে প্রতীয়মান হয়। খ্রিস্টীয় নীতিশাস্ত্রে সব মানুষ একই রকম। নিয়েজের বেলায় অধিকাংশই বীরের পাথেয়। প্রকৃত সত্যের প্রতি আবেদন সৃষ্টির মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক বিতর্কের মতো উদ্দেশ্য সম্পর্কিত বিতর্ক চালানো যায় না। মানুষের অনুভূতির পরিবর্তনের প্রচেষ্টার মাধ্যমে অবশ্যই এগুলো চালাতে হবে। খ্রিস্টানরা অনুভূতি সৃষ্টির চেষ্টা চালাতে পারে। অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা প্রচারণা বৃদ্ধি করতে পারে। সংক্ষেপে এই প্রতিযোগিতা হচ্ছে ক্ষমতালাভের সাধারণ প্রতিযোগিতা। সার্বজনীন ক্ষমতায় শিক্ষাদানকারী কোনো ধর্মমত ও একটি সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী হয়ে ওঠার উপায়ে পরিণত হতে পারে। তখনই তা ঘটে থাকে যখন ফরাসি বিপ্লব অস্ত্রের বলে বিস্তার লাভ করার কাজ শুরু করে।
রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মতো নীতিশাস্ত্রীয় উদ্দেশ্য ক্ষমতা নয়। মানুষ যদিও একে-অপরকে ঘৃণা করেছে, শোষণ করেছে এবং অত্যাচার করেছে তারপরও নতুন জীবন পদ্ধতির প্রবর্তকদের প্রতি তারা তাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছে। প্রাচীনকালের জাতীয় এবং উপজাতীয় বিশ্বাসগুলোর স্থলে বিশ্বজনীনতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিবেদিত মহান ধর্মগুলো মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখেছে ইহুদি বা জেন্টাইল, অধীন বা স্বাধীন হিসেবে নয়। এগুলোর প্রবর্তকদের সহানুভূতি ছিল বিশ্বজনীন এবং মনে করা হতো যে এ মর্মে তাদের প্রজ্ঞা অস্থায়ী ও আবেগপ্রবণ স্বেচ্ছাচারী প্রজ্ঞা অতিক্রম করেছে। ফলাফল সম্পূর্ণরূপে প্রবর্তকদের আশানুরূপ হয়নি। পুলিশ উত্তেজিত জনতাকে অসহায় মানুষের উপর আক্রমণ থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারত। উত্তেজিত জনতা অসহায়দের জীবন্ত দগ্ধ দেখতে চাইলে যদি তাদের কেউ ধীর পরিত্যাগের মাধ্যমে প্রথমে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করার পর অগ্নিদগ্ধ হতো, তবে উন্মত্ততা প্রচণ্ড রূপ ধারণ করত। তা সত্ত্বেও বিশ্বজনীন সহানুভূতিমূলক নীতিমালা একের পর এক রাজ্য জয় করে নিত। অনুভূতির জগতে তা বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের নৈর্ব্যক্তিক ঔৎসুক্যের অনুরূপ, দুটোই মানসিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য। আমার মনে হয় না যে উপজাতীয় বা অভিজাত নীতিশাস্ত্রীয় তত্ত্বে প্রত্যাবর্তন দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। বুদ্ধের সময় থেকে মানবজাতির ইতিহাস বিপরীতমুখী প্রবণতা দেখিয়েছে। ধ্যানমগ্ন মুহূর্তে যা কিছু ভালো মনে হয় তা ক্ষমতা নয়। তা প্রমাণিত মানুষ যাকে স্বর্গীয় আত্মা মনে করেছে তার বৈশিষ্ট্য থেকেই।
এ অধ্যায়ের শুরুতে আলোচিত পিতামাতার প্রতি সন্তানোচিত আচরণ, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর বশ্যতা, রাজার প্রতি আনুগত্য ইত্যাদির মতো প্রথাগত নৈতিক বিধি আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে গিয়েছে। নৈতিক নিয়ন্ত্রণের অভাব হলে অধিকতর কঠোর নতুন আচরণবিধি এগুলোর স্থান দখল করে নেয়। আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে আমাদের এ যুগে ইতিবাচক নৈতিকতার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের ক্ষমতা অনেক বেশি। অবশ্যই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বৃদ্ধির পরিণতিস্বরূপ তা ঘটেছে। চার্চ ও পরিবারের নিয়ন্ত্রণ অনেকটা কমে গেছে। কিন্তু আমি এর কোনো লক্ষণই দেখছি না যে অষ্টাদশ শতাব্দী অথবা মধ্যযুগের চেয়ে আমাদের এ যুগে নৈতিকতার প্রভাব রয়ে গেছে মানবীয় কার্যকলাপে।
এবার আসুন একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা এই পরিচ্ছেদের আলোচনা সমাপ্ত করি। প্রাচীন সমাজে এমন বিশ্বাস করা হতো যে আচরণ বিধিগুলোর উৎস অতীন্দ্রিয়লোক। আমি এর কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে বলে মনে করি না। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে, এর ফলে সমাজে শক্তির ভারসাম্য বিরাজ করে। দেবতারা মনে করেন যে ক্ষমতাবানদের কাছে আত্মসমর্পণ করা কর্তব্য; কিন্তু ক্ষমতাবানরা এত নিষ্ঠুর হবে না যে তা বিদ্রোহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নবী ও জ্ঞানী মানুষের প্রভাবে নতুন নৈতিক বিধি দেখা দেয়। কখনও নৈতিক বিধিগুলো পুরাতনের পাশাপাশি চলে আবার কখনও তা পুরাতনের স্থান দখল করে নেয়। নবী ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা ক্ষমতার ঊর্ধ্বে জ্ঞান, ন্যায়বিচার ও বিশ্বজনীন প্রেমের স্থান দিয়েছেন। এইভাবে তারা দেখিয়েছেন যে, ব্যক্তিগত সফলতার চেয়ে এই লক্ষ্যগুলো অধিক মুল্যবান। সমাজ পদ্ধতির যে অংশ বিশেষের জন্য মানুষ দুঃখভোগ করে থাকে নবী ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা ব্যক্তিগত কারণেই এর পরিবর্তনের প্রত্যাশা করে থাকেন। বিপ্লবী আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত কারণের সঙ্গে নৈর্ব্যক্তিক তত্ত্বের সমন্বিত রূপদানের ফলেই।
আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি সমাজ জীবনে বিপ্লবের স্থান চিহ্নিতকরণে। বিপ্লব দুধরনের : তা শুধু ব্যক্তিগত হতে পারে অথবা হতে পারে ভিন্ন সমাজ প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তার আশা-আকাঙ্ক্ষায় অন্যের অংশ থাকতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই কিছু সংখ্যক ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ ছাড়া সবাই অংশগ্রহণ করে থাকে। (যারা প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় নিজের স্বার্থসিদ্ধি লাভ করে তারাই এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমধর্মী লোক)। এ ধরনের বিপ্লব গঠনমূলক, ধ্বংসাত্মক নয়। এমনকি প্রথম দিকে ধ্বংসাত্মক দেখা গেলেও পরিণামে তা স্থিতিশীল নতুন সমাজের জন্ম দেয়। এর নৈর্ব্যক্তিক উদ্দেশ্যই একে নৈরাজ্যিক বিপ্লব থেকে আলাদা করে দেখায়। শুধু ঘটনা প্রবাহ থেকে এর বৈধতা যাচাই করা সম্ভব। কর্তৃপক্ষের বোষধাদয় হলে একে প্রতিরোধ না করেই প্রজ্ঞার পরিচয় দেবেন। ব্যক্তিবিশেষ মানুষের জন্য উপকারী জীবন পদ্ধতি উপলব্ধি করতে পারেন। যে জীবন পদ্ধতি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা অধিক পরিমাণে চরিতার্থ করতে সমর্থ। তিনি কে তা অন্য লোকের কাছে বোধগম্য করে তুলতে পারেন। বিপ্লব ছাড়া মানবজাতি পশ্চাৎপদ থেকে যাবে এবং অন্যায় দূর হবে না সমাজ থেকে।