ক্ষমতার শাসন
মানুষ ও পশুর মাঝে নানা রকম পার্থক্য। আর এই পার্থক্যগুলোর কতগুলো বৃত্তিবৃত্তিক, কতগুলো আবার আবেগপ্রসূত। মানবীয় আকাঙ্ক্ষা যে পশুর আকাক্ষার মতো না তা আবেগপ্রসূত একটি প্রধান পার্থক্য থেকে বোঝা যায়। আকাঙ্ক্ষাগুলো মুখ্যত সীমাহীন ও পূর্ণ তৃপ্তিলাভে ব্যর্থ। খাদ্য গ্রহণের পর অজগর যেমন পুনরায় ক্ষুধা না লাগা পর্যন্ত সুখে নিদ্রা যায় তেমনি অন্য কোনো পশুর ভেতর এর ব্যতিক্রম ঘটলে ধরে নিতে হবে যে প্রয়োজনের তুলনায় তাদের খাদ্য প্রাপ্তি কম কিংবা তারা শত্রুর ভয়ে ভীত। পশুপাখির সার্বিক কার্যকলাপ গুটি কয়েক ব্যতিক্রম থাকা সত্ত্বেও বংশবৃদ্ধি ও বেঁচে থাকার মৌলিক প্রয়োজনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় এবং এগুলোর কার্যকলাপ ওইসব মৌলিক প্রয়োজনের দ্বারা চিহ্নিত সীমা অতিক্রম করে না।
তবে মানুষের বেলায় বিষয়টি ভিন্নধর্মী। এ কথা সত্য যে, মানবকুলের বৃহৎ অংশ জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য বস্তু অর্জনের লক্ষ্যে এতটাই কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য হয় যে অন্যান্য উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে খুব কম কর্মশক্তিই তাদের মাঝে বিদ্যমান থাকে। তাই বলে জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় বস্তুর প্রাপ্তি সুনিশ্চিত হওয়ায় তারা কর্মতৎপরতা বন্ধ করে দেয় না। এথেন্স অভিডানে যখন জেরক্স অবতীর্ণ হন তখন তার খাদ্য, পোশাক ও স্ত্রীর অভাব ছিল না। নিউটন ট্রিনিটিতে ফেলোশিপ লাভের পর ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশের নিশ্চয়তা পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে প্রিন্সিপিয়া লিখেছিলেন নিউটন। ইগনেসিয়ায় লায়লার অভাব থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় খুঁজে বের করার প্রয়োজনও ছিল না সেন্ট ফ্রান্সিসের। আলস্যপরায়ণ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ছাড়া অন্য সব লোকের ভেতর কিন্তু এ ধরনের বৈশিষ্ট্য বা গুণ কমবেশি অস্বাভাবিকভাবে দেখতে পাওয়া যায়। মিসেস এ-যিনি তার স্বামীর ব্যবসায়িক সফলতায় সন্দেহাতীতভাবে প্রত্যয় পোষণ করতেন এবং যার কাজের ঘর সম্পর্কে কোনো ভয় ছিল না, তিনি মিসেস বি-এর চেয়ে ভালো পোশাক পরতে পছন্দ করতেন। যদিও তিনি অপেক্ষাকৃত কম খরচে নিউমোনিয়াজতিন বিপদ এড়াতে পারতেন। যদি মি. একে উপাধিতে ভূষিত করা হতো বা সংসদে সদস্য নির্বাচিত করা হতো তাহলে তিনি এবং মিসেস এ উভয়েই খুশি হতেন। সাফল্যের কোনো শেষ নেই, হোক না তা অলীক কল্পনাপ্রসূত, সম্ভব মনে হলে তা অর্জনের চেষ্টা করা হয়।
কল্পনা হলো এক ধরনের আঁকশির মতো; এজন্য সব মৌলিক চাহিদা মিটে গেলেও এটি মানুষকে বিরতিহীন প্রচেষ্টায় উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের ভেতর অধিকাংশ মানুষ খুব অল্প সময়কেই জেনেছেন যখন আমরা বলতে পারতাম
If it were now to die,
There now to be most happy, for I fear
My soul hath her content as absolute
That not another comfort like to this
Succeeds in unknown fate.
আমরা জানি যে সুখ দীর্ঘস্থায়ী নয় তাই আমাদের পূর্ণাঙ্গ সুখের ক্ষণে অথেলোর মতো মৃত্যু কামনা করাই স্বাভাবিক। মানুষের পক্ষে পরম সুখের জন্য যা প্রয়োজন তা অর্জন করা অসম্ভব। স্বর্গসুখ শুধু ঈশ্বরই পেতে পারেন, যেহেতু সাম্রাজ্য এবং ক্ষমতা ও গৌরব একমাত্র তাঁরই। মৃত্যুর ফলে পার্থিব ক্ষমতা সংক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে, এ কারণে পার্থিব রাজ্য অন্যান্য রাজ্য দ্বারা সীমিত হয়ে যায় এবং পার্থিব গৌরব শতাব্দীর প্রবাহে বিলীন হয়ে যায়। তারপরও আমরা তৈরি করি পিরামিড এবং অবতারণা করি সুন্দর অমর গাথার। খুব সামান্য ক্ষমতা ও গৌরব যাদের আছে তারা মনে করে আরেকটু পেলেই তারা পরিতৃপ্তি পাবে, তাদের এ ধারণা ভুল। সীমাহীন এসব আকাক্ষা এবং এতে কেউ কিছুই পরিপূর্ণ তৃপ্তি পেতে পারে না। খোদার আনন্দ বিস্তৃতির মধ্যেই তারা শুধু সুখের সন্ধান পেতে পারে।
জীবজন্তু যখন তাদের অস্তিত্ব ও বংশবিস্তার নিয়েই সন্তুষ্ট, মানুষ তখন তাদের পরিবৃত্তির জন্য মশগুল। এ অবস্থায় কল্পনায় রায়ে তাদের আকাঙ্ক্ষা অঙ্কিত সীমারেখা অতিক্রম করতে পারে না। সব মানুষই সম্ভব হলে ঈশ্বর হতে চাইত। এর অবাস্তবতাকে গুটিকয়েক মানুষ স্বীকার করে নিতে পারে না। মিলটনের শয়তানের ছাঁচে গড়া এসব মানুষ। মহত্ত্ব ও অধার্মিকতার মিশ্রণ দেখা যায় তাদের মাঝে। মানবীয় ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল নয়–আমি অধার্মিকতা বলতে এমন কিছু বোঝাতে চাই। বড় বড় বিজয়ী নেতার ভেতর মহত্ত্ব ও অধার্মিকতার অদ্ভুত মিশ্রণ সুস্পষ্ট। অবশ্য মানুষের ভেতর এর কিছু কিছু উপাদান দেখতে পাওয়া যায়। সামাজিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এগুলো সংকট সৃষ্টি করে। প্রত্যেকেই আমরা নিজেকে ঈশ্বরের সমতুল্য মনে করি এবং তা খোদা ও উপাস্যের মধ্যকার সহযোগিতার স্বরূপ অনুসারে বুঝতে চাই। এজন্যই সরকার ও আপোষ মীমাংসার প্রয়োজন স্বরূপ প্রতিযোগিতা, অস্থিতিশীলতা ও পর্যায়বৃত্ত হিংস্রতার সঙ্গে বিদ্রোহের তাড়না। এ কারণে নৈতিকতার প্রয়োজন অরাজকতাপূর্ণ স্বাধিকার আদায়ের প্রচেষ্টা রহিতকরণে।
ক্ষমতা ও গৌরব হলো মানুষের সীমাহীন আকাঙ্ক্ষার ভেতর প্রধান। যদিও এগুলো ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত কিন্তু অভিন্ন নয়। মর্যাদার চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বেশি। অন্যদিকে ক্ষমতার চেয়ে রাজার মর্যাদা বেশি। সে যাই হোক গৌরব অর্জনের সহজতম পথ হচ্ছে আগে ক্ষমতা লাভ করা। এটা তাদের ক্ষেত্রেই বিশেষভাবে প্রযোজ্য যারা জাতীয় ঘটনা নিয়ে কাজ করেন। সুতরাং গৌরব ও ক্ষমতালাভের আকাঙ্ক্ষা মানুষকে একই কাজ সমাধান উদ্বুদ্ধ করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাস্তবে এটা দুটো উদ্দেশ্য বিবেচিত হয় অভিন্ন বলে।
গোঁড়া অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে মার্কস এ বিষয়ে একমত যে, তিনি এবং গোড়া অর্থনীতিবিদরা ভুল করেছেন অর্থ-সম্পর্কীয় স্বার্থকে সমাজবিজ্ঞানের মূল ও চালিকাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে। ক্ষমতা ও মর্যাদা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে সীমাহীন নয় সম্পদ লাভের আকাঙ্ক্ষা, বরং তা পরিপূর্ণ তৃপ্তি লাভ করতে পারে সীমিত সরবরাহ দ্বারা। বস্তুগত উপভোগের সাপেক্ষে বোঝা যায় না প্রকৃত ব্যয়বহুল আকাঙ্ক্ষা। এইসব সম্পদ অন্যায়ভাবে অধীনস্ত হয়ে পড়ে আইন পরিষদ কর্তৃক প্রণীত আইন বলে এবং সিনেমা গ্যালারিগুলো দক্ষ কুশলীদের দ্বারা একান্ত পুরনো প্রভুদের জন্য নির্ধারিত হয়। ক্ষমতা ও গৌরব বাড়ানোর জন্যই এ সব কিছুই করা হয়–আয়েশে বসার জন্য নয়। ক্ষমতা অনুসরণ করা হয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠী উভয় পর্যায়েই পরিমিত উপভোগের নিশ্চয়তা পেলে, সম্পদ নয়। তারা সম্পদের পরিবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে ক্ষমতার জন্যই সম্পদের সন্ধান করে অথবা ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু পূর্বোক্ত বিষয়টিতে শেষোক্ত বিষয়টির মতো মূল চালিকা শক্তি অর্থনীতি হয়।
এই ভুলটি গোঁড়া অর্থনীতিবিদ ও মার্কসীয় অর্থনীতিবিদদের শুধু তত্ত্বীয় দিক থেকে নয় বরং তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারিক দিক থেকেও এবং আধুনিক ঘটনাপ্রবাহকে ভ্রান্তির বেড়াজালে–ই প্রবিষ্ট করেছে। যদি মনে করা হয়, ক্ষমতার মোহই সামাজিক বিষয়গুলোর দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করে, একমাত্র তাহলেই সম্ভব সঠিকভাবে আধুনিক অথবা প্রাচীন ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ।
সমাজবিজ্ঞানের মূল ধারণা ক্ষমতা-আমি এই বইয়ের পরবর্তী পর্যায়ে এই সত্যটি প্রমাণ করার চেষ্টা করব। শক্তি যেমন পদার্থবিজ্ঞানের মূল ধারণা তেমনি ক্ষমতা সমাজবিজ্ঞানের মূল ধারণা। ক্ষমতাও শক্তির মতো প্রকারভেদ আছে। যেমন সম্পদ, যুদ্ধাস্ত্র, বেসামরিক কর্তৃত্ব এবং মতামতের উপর প্রভাব। তবে এমন ভাবা যাবে না যে এগুলো একটা আরেকটার অধীন। এর কোনোটি অন্যটি থেকে উদ্ভূতও নয়। অবশ্য এ কথা সত্য যে, আংশিক সফলতা আনবে পৃথকভাবে যে কোনো এক প্রকার ক্ষমতার আলোচনা। ক্ষমতার একটি বিশেষ রূপের আলোচনা ত্রুটিপূর্ণ হয়ে থাকে অন্যগুলো আলোচনার বাইরে রাখলে। সম্পদ লাভ করা যেতে পারে মিলিটারি ক্ষমতা ও মতামতের উপর প্রভাব থেকে। ঠিক একইভাবে এগুলোর যে কোনো একটি সৃষ্টি করা যায় সম্পদ থেকে। শুধু ক্ষমতার সাপেক্ষে সমাজ গতিবিজ্ঞানের সূত্রগুলো বর্ণনা করা যায় ক্ষমতার বিশেষ রূপের সাপেক্ষে নয়। মিলিটারি ক্ষমতা আগের দিনগুলোতে বিচ্ছিন্নভাবে ছিল এবং পরিচালকের আকস্মিক দক্ষতার উপর নির্ভর করতে যুদ্ধের জয় পরাজয়। আমরা এ যুগে মনে করি অন্যসব ক্ষমতা বেরিয়ে আসবে অর্থনৈতিক ক্ষমতা থেকে। আমি বলতে চাই, মিলিটারি ইতিহাসবিদদের অনেকের এটিও একটি বড় ধরনের ভুল যে, এটি তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে অচল ভাবতে। আবার অনেকেই প্রচালনাই ক্ষমতার মৌলিক রূপ বলে মনে করেন। অবশ্য কোনো নতুন ধারণা নয় এটি। এটি শহীদের রক্তই চার্চের ভিত্তি এই প্রচলিত ধারণাই ভেতর জীবন্ত হয়ে ওঠে। এতে মিলিটারি এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণের মতোও প্রায় সমপরিমাণ সত্য ও মিথ্যার আশ্রয় রয়েছে। প্রচারণা সমাজে অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা গড়ে তুলতে পারে যদি তা ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়। কিন্তু প্রচারণার উদ্দেশ্যে ইচ্ছা করলে তারা এটি ব্যবহার করতে পারেন যাদের হাতে মিলিটারি বা অর্থনৈতিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। অবশ্য পদার্থবিজ্ঞানের অনুরূপ আলোচনায় যদি ফিরে যাই তাহলে দেখব, ক্ষমতাও শক্তির মতো বারবার রূপান্তর ঘটায় এবং এই সব পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যে নিয়ম বিদ্যমান তার অনুসন্ধান করা সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হওয়া উচিত। আমাদের এ যুগে ক্ষমতার যে কোনো রূপকে আলাদা করে দেখা, বিশেষত অর্থনৈতিক ক্ষমতা আলাদাভাবে দেখার ফলে ভুলের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে বাস্তব গুরুত্বের অধিকারী।
ক্ষমতার সাপেক্ষে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে বিভিন্ন সমাজের পার্থক্য। তাদের পার্থক্য হয়ে থাকে ব্যক্তি ও সংগঠন কর্তৃক অর্জিত ক্ষমতার পরিমাণের ভিন্নতার জন্যে। এ কথা সত্য যে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে সংগঠনের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যেই বর্তমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অনেক বেশি। আবার এগুলোর পার্থক্য সৃষ্টি হয় সর্বাদিক প্রভাবশালী সংগঠনগুলোর ভিন্নতা সাপেক্ষে। যেমন মিলিটারি, স্বৈরতন্ত্র, ধনতন্ত্র, দিব্যতন্ত্র ভিন্ন ভিন্ন ধরনের। তাদের পার্থক্য সৃষ্টি হয় ক্ষমতা অর্জনের পদ্ধতিগত ভিন্নতার জন্যে। এক ধরনের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের জন্ম দেয় উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া রাজতন্ত্র; অন্য এক প্রকার ব্যক্তিত্বের জন্ম দেয় রাজকীয় ব্যবস্থা; গণতন্ত্র তৃতীয় এবং যুদ্ধ চতুর্থ প্রকারের ব্যক্তিত্বের জন্ম দেয়।
ক্ষমতা অর্জনে সক্ষম ব্যক্তিদের সংখ্যা সীমিত রাখার জন্য যেখানে অভিজাততন্ত্র বা রাজতন্ত্রের মতো কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠান নেই সেখানে তাদের জন্য ক্ষমতা অর্জন খুব সহজ যাদের ক্ষমতা অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। রয়েছে। মূলত ক্ষমতা যে সমাজ ব্যবস্থায় সবার জন্য উন্মুক্ত সে সমাজে ক্ষমতাকেন্দ্রিক পদগুলো অসাধারণ ক্ষমতালিম্পু ব্যক্তিদের হাতে চলে যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানব স্পৃহাগুলোর ভেতর ক্ষমতালিপ্সা অন্যতম হলেও তা সামঞ্জস্যহীনভাবে সমাজে বন্টিত হয়ে আছে এবং তা সীমিত হয়ে পড়ে ভিন্ন। ধরনের অন্যান্য স্পৃহা, যেমন আনন্দপ্রিয়তা, আরামপ্রিয়তা ও অনুমোদনপ্রিয়তা দ্বারা। এটি সুযোগ বাড়িয়ে দেয় আনুগত্যের ছদ্মাবরণে বিরাজ করা ভীরুলোকদের ভেতর সাহসি ব্যক্তিদের ক্ষমতা বিস্তারে। ক্ষমতালিপ্সা যাদের প্রবল নয় তাদের প্রভাব ঘটনাপ্রবাহের উপর খুবই কম। সাধারণত তারাই সমাজে পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম যারা সমাজ পরিবর্তনের তীব্র আশা পোষণ করে। সুতরাং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একটি বৈশিষ্ট্য হলো ক্ষমতালিপ্সা। একে আমরা একমাত্র মানবশৃহা বলে গণ্য করলে অবশ্যই ভুল হবে। অবশ্য সমাজবিজ্ঞানের কার্যকারণ সূত্রগুলো অন্বেষণের ফলে যা ঘটে থাকে এ ভুল হয় এক্ষেত্রে আমাদের এমন বিপথগামী করবে না। ক্ষমতালিপ্সাই হলো প্রধান স্পৃহা যার ফলে পরিবর্তন সাধিত হয়। তাই তার আলোচনা করা সমাজবিজ্ঞানে একান্ত প্রয়োজন।
বিভিন্ন প্রকার ক্ষমতার সাপেক্ষে শুধু সমাজ গতিবিজ্ঞানের সূত্রগুলো বর্ণনা করা সম্ভব। এই সূত্রগুলো আবিষ্কারের জন্য প্রথমত ক্ষমতার শ্রেণিবিভাগ এবং পরে ব্যক্তি বা সংগঠন দ্বারা মানবজীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অর্জনের পন্থা সংবলিত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তে পর্যালোচনা প্রয়োজন।
এ পুরো বইয়ে আমার দ্বিবিধ উদ্দেশ্য থাকবে পরামর্শদানে। আমি বিশ্বাস করি যে সামাজিক পরিবর্তনের সাধারণ বিশ্লেষণ অধিকতর সমৃদ্ধ অর্থনীতিবিদদের প্রদত্ত শিক্ষা অপেক্ষা। বর্তমান ও নিকট-ভবিষ্যৎকে অধিকতর বোধগম্য করে তোলা প্রয়োজন অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী ব্যক্তিদের চেয়ে। বিভিন্নভাবে ব্যতিক্রমধর্মী ছিল ওই শতাব্দীগুলো। অনেকভাবে আমরা বিগত যুগের জীবনধারা ও চিন্তাধারায় প্রত্যাবর্তন করছি বলে মনে হয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাস আলোচনা এ যুগ ও এর প্রয়োজন বুঝতে হলে অপরিহার্য। আমরা সম্ভাব্য অগ্রগতি শুধু তখনই অর্জন করতে পারব যখন তা ঊনবিংশ শতাব্দীর স্বতঃসিদ্ধতার অযৌক্তিক প্রভাবে প্রভাবিত হবে না।