ক্ষমতার রকমভেদ
ক্ষমতার সংজ্ঞা দেয়া যেতে পারে অভিপ্রেত ফলাফল সৃষ্টি সাপেক্ষে। সুতরাং ধারণাটি পরিমাণগত; একই রকম আকাক্ষা পোষণ করেন এ ধরনের দুই ব্যক্তির ভেতর তিনিই অধিকতর ক্ষমতার অধিকারী যিনি অধিকতর আকাঙ্ক্ষা পূরণে সক্ষম। কিন্তু তাদের ক্ষমতা তুলনা করার কোনো উপায় থাকে না যখন ওই দুই ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন আকাঙ্ক্ষা পূরণে সক্ষম হন। মনে করা যাক ভালো ছবি আঁকা ও ধনী হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন দুজন শিল্পী। যদি তাদের একজন ভালো ছবি অংকনে সমর্থ হন এবং অপরজন ধনী হতে সক্ষম হন তবে কার ক্ষমতা বেশি নিরূপণ করা অসম্ভব। আমরা শুধু বলতে পারি A-এর অভিপ্রেত কাজের ফলাফল B-এর চেয়ে বেশি হলে A-এর ক্ষমতা বেশি B-এর চেয়ে।
ক্ষমতার শ্রেণিবিভাগ করা যায় বিভিন্নভাবে : মানুষের উপর ক্ষমতা এবং জড়বস্তুর বা প্রাণীর উপর ক্ষমতা। আমি প্রধানত আলোচনা করব মানুষের উপর ক্ষমতা নিয়ে, কিন্তু আধুনিক বিশ্বে পরিবর্তনের প্রধান কারণ হচ্ছে জড়বস্তুর উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ–এ কথা মনে রাখা দরকার। বিজ্ঞানের কাছে এ সত্য আমরা ঋণী।
মানুষের উপর ক্ষমতার শ্রেণিবিভাগ করা যেতে পারে জনসাধারণকে প্রভাবিত করার রীতি অথবা সংশ্লিষ্ট সংগঠনের নমুনা সাপেক্ষে।
প্রভাবিত হতে পারে ব্যক্তি বিশেষ : A. সরাসরি ক্ষমতা আরোপ করে শরীরের উপর। যেমন, কাউকে কারারুদ্ধ করে বা হত্যা করে। B. উদ্দীপকস্বরূপ পুরস্কার অথবা শাস্তির দ্বারা। যেমন, কাউকে উৎসাহ প্রদান করে চাকরিতে নিযুক্তির মাধ্যমে। C. প্রভাব ফেলে মতামতের উপর। যেমন, এই সর্বশেষ শিরোনামে আমি অন্যের ভেতর অভিপ্রেত অভ্যাস সৃষ্টির সুযোগ অন্তর্ভুক্ত করব এক ব্যাপক অর্থে প্রচারণা দ্বারা। যেমন, অভিপ্রেত অভ্যাস সৃষ্টি করা হয় সামরিক অনুশীলনের মাধ্যমে। পার্থক্য শুধু এই যে, এ ক্ষেত্রে প্রক্রিয়া চলতে পারে কোনোরকম মধ্যবর্তী মতামত ছাড়াই।
আমাদের আচরণে অত্যন্ত নগ্নভাবে এ ধরনের ক্ষমতা প্রকাশ পাচ্ছে সরাসরি পশুর প্রতি। এখানে অনুভূত হচ্ছে না ছলনা বা গোপনীয়তার প্রয়োজন। যখন শূকরের শরীরে রশি বেঁধে জাহাজে ওঠানো হয় এবং যখন সে আর্তনাদ করতে থাকে তখন সে সততই শারীরিক ক্ষমতার অধীন। আমাদের ইচ্ছানুসারে গাধা যখন গাজরকে অনুসরণ করে তখন এই যুক্তিদিয়েই তাকে আমরা কাজে উদ্বুদ্ধ করি যে, এমন করাই তার স্বার্থের অনুকূল। ক্রীড়া প্রদর্শনকারী পশুর আচরণ হচ্ছে এ দুয়ের মধ্যবর্তী, যার ভেতর অভ্যাস সৃষ্টি করা হয়েছে পুরস্কার ও শাস্তির মাধ্যমে। ভেড়ার জাহাজ আরোহণ আবার ভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধ; এক্ষেত্রে জাহাজের খোলা জায়গায় নেতাকে টেনে বার করা হয়, তখন বাকিগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুসরণ করে তাকে।
উদাহরণসহ এরকম ক্ষমতাই মানব সমাজে ব্যাখ্যা করা যায়। মিলিটারি ও পুলিশি ক্ষমতার ব্যাখ্যাস্বরূপ, শূকরের দৃষ্টান্তটির বর্ণনা।
প্রচারণা ক্ষমতার স্বরূপ বর্ণনা করে গাধা ও গাজরের দৃষ্টান্ত।
শিক্ষার ক্ষমতা প্রদর্শিত হয় ক্রীড়া প্রদর্শনকারী পশুর উদাহরণে।
ভেড়াগুলো কর্তৃক তাদের অনিচ্ছুক নেতার অনুসরণ–দলীয় রাজনীতির দৃষ্টান্ত; যখন দলীয় কোন্দলের শিকার অথবা দলীয় নেতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ সাধারণ সম্মানিত নেতা।
আমরা এখন এই উপমাগুলো প্রয়োগ করি হিটলারের অভ্যুদয়ের ক্ষেত্রে। গাজর চিল নাজি কর্মসূচি (সুদ উচ্চেদ সংবলিত), গাধা ছিল নিম্নবিত্ত শ্রেণির লোক, ভেড়া ও তাদের দলপতি ছিল সামাজিক গণতন্ত্র এবং হিন্দেনবার্গ। শূকরগুলো ছিল (শুধু তাদের ভাগ্য বিবেচিত হলো) বন্দিশিবিরে আটকেপড়া হতভাগ্যরা, ক্রীড়া প্রদর্শনকারী পশুগুলো হলো লাখ লাখ জনতা, যার বাধ্য নাজিকে সালাম দিতে।
বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন ক্ষমতা আরোপ করে থাকে। সংগঠনগুলোকে চিহ্নিত করা যায় এই আরোপিত ক্ষমতার রূপ অনুয়ায়ী। দৈহিক দমনমূলক ক্ষমতা অনুশীলন করে সেনাবাহিনী ও পুলিশ। পুরস্কার অথবা শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে অর্থনৈতিক সংগঠনগুলোতে। এর ফলে কাজের প্রতি উৎসাহ বা ভয় সৃষ্টি হয়। মতামত প্রভাবিত করার লক্ষ্য স্থির করে রাজনৈতিক দল। কিন্তু খুব স্পষ্ট নয় এই পার্থক্যগুলো, কারণ বৈশিষ্ট্যসূচক ক্ষমতার বাইরে প্রতিটি সংগঠনে ব্যবহার করা থাকে ভিন্ন ধরনের ক্ষমতাও।
এসব জটিলতার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় আইনের ক্ষমতায়। আইনের ক্ষমতা রাষ্ট্রীয় দমননীতি কার্যকর করে এর চূড়ান্ত রূপ। সভ্য সমাজে রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার হচ্ছে সীমাবদ্ধতা সাপেক্ষে দৈহিক দমন এবং কতগুলো নীতির সমাহার হচ্ছে আইন, যা অনুসরণ করে রাষ্ট্র এই বিশেষ অধিকার প্রযোগ করে নাগরিকদের সঙ্গে আচরণের মাধ্যমে। আইনে উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্য রয়েছে শাস্তির বিধান। শুধু অনভিপ্রেত কার্যকলাপ বাস্তবে অসম্ভব করে তোলা এই শাস্তি বিধানের উদ্দেশ্য নয়, বরং তা অনাকর্ষণীয় করে তোলা। আইন প্রায় নিষ্ক্রিয়, যদি জনসমর্থন না থাকে। আমেরিকাতে নিষিদ্ধকালীন সময়ে অথবা আশির দশকে আয়ারল্যান্ডে তা দেখা যায় যখন অধিকাংশ জনগণের সহানুভূতি অর্জন করে Moonlighter রা। সুতরাং কার্যকরি শক্তি হিসেবে পুলিশি ক্ষমতার চেয়ে জনগণের মতামত ও আবেগের উপর আইন অধিকতর নির্ভরশীল। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের অন্যতম হলো আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ।
আমাদের অতিপ্রয়োজনীয় ঐতিহ্যগত ও নবঅর্জিত ক্ষমতার মধ্যবর্তী পার্থক্যের কাছাকাছি নিয়ে আসে এই হৃদয়ানুভূতি। অভ্যাসজনিত শক্তি বিদ্যমান ঐতিহ্যগত ক্ষমতার মধ্যে। প্রয়োজন নেই সবসময় এর সত্যতা বিচারের। বারবার প্রমাণেরও প্রয়োজন নেই যে একে উৎখাত করার মতো যথাযথ ক্ষমতার অধিকারী নয় কোনো প্রতিযোগীই। যদি তা জড়িত ধর্মবিশ্বাস ও প্রায় ধর্মবিশ্বাসের সাথে। ফলে খারাপ বলে বিবেচিত হয় প্রতিবন্ধকতা এবং বিপ্লবী ক্ষমতা বা জোরপূর্বক অর্জনের ক্ষমতার চেয়ে জনগণের মতামতের উপর অধিক নির্ভরশীল। এর পরস্পর বিপরীত দুটো পরিণতি বিদ্যমান। ঐতিহ্যগত ক্ষমতা একদিকে নিরাপত্তাবোধের জন্য বিশ্বাসঘাতক দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভরশীল নয়, সম্ভবত অত্যধিক রাজনৈতিক নিষ্ঠুরতা এড়াতে পারে ঐতিহ্যিক ক্ষমতা; অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের আসক্তির অনুকূলে স্মরণাতীত প্রথার যুক্তি রয়েছে সে সমাজে যেখানে প্রাচীন প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যমান। আর এ জন্যই তা অধিকতর স্পষ্ট থাকে জনপ্রিয় সমর্থন লাভে আশাবাদী নতুন ধরনের সরকারের অধীন সম্ভাব্য অন্যায়গুলোর চেয়ে। ফ্রান্সের সন্ত্রাসী শাসন বিপ্লবী ধরনের কিন্তু সেটি করভি প্রথাজাতীয় অত্যাচারী শাসনের দৃষ্টান্ত।
আমার মতে যে ক্ষমতা ঐতিহ্য বা অনুমোদন নির্ভর নয় তা-ই নগ্ন ক্ষমতা। ঐতিহ্যগত ক্ষমতা ও নগ্ন ক্ষমতার ভেতর বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে পার্থক্য অনেক। ঐতিহ্যগত ক্ষমতা বিদ্যমান যে সমাজে, সেখানকার শাসন বৈশিষ্ট্য নির্ভর করে প্রায় সীমাহীন নিরাপত্তা অথবা নিরাপত্তাহীন অনুভূতির উপর।
নগ্ন ক্ষমতা স্বভাবতই সামরিক এবং তা দেখা দিতে পারে অভ্যন্তরীণ নিষ্ঠুরতা অথবা ভিন্ন দেশ বিজয়ের মধ্যে। প্রকৃতপক্ষে নগ্ন ক্ষমতার গুরুত্ব বিদেশ জয়ে অনেক বেশি এবং আমি মনে করি তা অনেক বৈজ্ঞানিক ইতিহাসবিদের স্বীকৃত গুরুত্বের চেয়েও অনেক বেশি। মহান আলেকজান্ডার ও জুলিয়াস সিজার ইতিহাসের গতিধারার আমুল পরিবর্তন করেন যুদ্ধের মাধ্যমে। কিন্তু পূর্বোক্ত ব্যক্তির জন্য গ্রিক ভাষায় লেখা হয়নি গসপেল এবং রোমান সাম্রাজ্যব্যাপী প্রচার করা যায়নি খ্রিস্টবাদ। শেষোক্ত ব্যক্তির জন্য ফরাসিরা ল্যাটিন থেকে উদ্ভূত ভাষায় কথা বলত না এবং ক্যাথলিক চার্চ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছে সামান্যই। তলোয়ারের ক্ষমতার আরেকটি বড় দৃষ্টান্ত রেড ইন্ডিয়ানদের উপর শ্বেতকায় মানুষদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব। সভ্যতার যে প্রসার ঘটে অস্ত্রবলের বিজয়ের মাধ্যমে, তা সম্ভব নয় কোনো একক কর্তৃত্বের পক্ষে। তা সত্ত্বেও অন্যান্য ক্ষমতার উপর সামরিক ক্ষমতা নির্ভরশীল, যেমন-স্বাস্থ্য, কৌশলগত জ্ঞান। সব সময় যে তা-ই ঘটেছে আমি তা বলছি না উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, উত্তরাধিকার সংক্রান্ত স্পেনের যুদ্ধে ফলাফলের জন্য অপরিহার্য ছিল মার্লবরাফের প্রতিভা। কিন্তু একে বিবেচনা করতে হয় সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম বলে।
বিশাল সংখ্যালঘিষ্ট জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সর্মথন লাভের ঐতিহ্যগত ক্ষমতা বিলুপ্ত হলে এর পরিবর্তে বিপ্লবী কর্তৃত্ব স্থলাভিষিক্ত হতে পারে। এমন হয়েছিল আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামে। নগ্ন ক্ষমতার কোনো বৈশিষ্ট্য ছিল না ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে। একইভাবে ক্যাথলিক চার্চের পরিবর্তে নতুন চার্চ প্রতিষ্ঠা করা হয় সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে। বলের চেয়ে সম্মতির উপর অধিক নির্ভরশীল ছিল তাদের সফলতা। নগ্ন ক্ষমতার ব্যাপক ব্যবহার ছাড়া সফল প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লবী কর্তৃত্ব তার ঐতিহ্যগত কর্তৃত্বের তুলনায় বীর্যবান হবে আরও অনেক বেশি এবং লাভ করবে সক্রিয় জনসমর্থন। ১৯১১ সালে যখন ঘোষণা করা হয় চীন প্রজাতন্ত্র তখন বিদেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষিত ব্যক্তিরা রায় দেয় সংসদীয় সংবিধানের পক্ষে। কিন্তু জনগণ ছিল উদাসীন এবং সরকার শিগগিরই পর্যবসিত হয় যুদ্ধবাজ টিউকানস (সামরিক সরকার)-এর অধীন নগ্ন ক্ষমতায়। পরবর্তী সময়ে কমিনটার্ন কর্তৃক অর্জিত এ ধরনের একতা নির্ভরশীল ছিল জাতীয়তাবোধের উপর, সংসদীয় ব্যবস্থার উপর নয়। একই ধরনের বিষয় প্রায়ই ল্যাটিন আমেরিকাতে ঘটেছে। এসব ক্ষেত্রে জনপ্রিয় সমর্থন পেলে সংসদীয় কর্তৃত্ব যথেষ্ট বিপ্লবী হয়ে যেত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে খাঁটি সামরিক ক্ষমতা ছিল বিজয়ী এবং তা ছিল নগ্ন।
ঐতিহ্যগত, বিপ্লবী এবং নগ্ন ক্ষমতার ভেতর পার্থক্য মনস্তাত্ত্বিক শুধু প্রাচীনত্ব থাকলেই কোনো ক্ষমতা ঐতিহ্যগত হবে আমি এমন মনে করি না; এর প্রতি জনগণের শ্রদ্ধাবোধ অবশ্যই থাকতে হবে। আংশিকভাবে প্রথার জন্য এই শ্রদ্ধাবোদ হয়ে থাকে। ঐতিহ্যগত ক্ষমতা নগ্ন ক্ষমতায় রূপান্ততির হয় এই শ্রদ্ধাবোধ হ্রাস পেলে। ১৯১৭ সালের বিজয় মুহূর্ত পর্যন্ত রাশিয়াতে এই রূপান্তর পদ্ধতি দেখা দেয় ক্রমবর্ধমান বিপ্লবী আন্দোলনের মাধ্যমে।
আমি বিপ্লবী ক্ষমতা বলি নতুন ধর্মমত, কর্মসূচি, ভাবাবেগ এবং জাতীয় স্বাধীনতার আশাবাদকে কেন্দ্র করে একতাবদ্ধ বিশাল জনগোষ্ঠীর উপর নির্ভরশীল ক্ষমতাকে। আমি নগ্ন ক্ষমতা তাকে বলি যে ক্ষমতা ব্যক্তি বিশেষের ক্ষমতালিপ্সা থেকে উদ্ভুত সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া শুধু ভয়ের মাধ্যমে প্রজাসাধারণের বশ্যতা অর্জন করে। নগ্ন ক্ষমতা মাত্রাগত ব্যাপার। গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাপেক্ষে সরকারের ক্ষমতা নগ্ন নয়। কিন্তু তা নগ্ন নৈরাজ্যবাদীদের সাপেক্ষে। একইভাবে যেখানে চার্চের ক্ষমতা বিরুদ্ধবাদীদের সাপেক্ষে নগ্ন সেখানে নিষ্ঠুরতা বিদ্যমান-গোঁড়া পাপীদের সাপেক্ষে নয়।
আমাদের আলোচ্য বিষয়ের অন্য দিক হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা ও ব্যক্তিবিশেষের ক্ষমতার ভেতর বিভক্তি। কোনো প্রতিষ্ঠান যে পন্থায় ক্ষমতা দখল করে তা কিন্তু এক, অন্যদিকে কোনো ব্যক্তি যে পন্থায় সংগঠনের ভেতর ক্ষমতা দখল করে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অবশ্য এ দুটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে আপনাকে অবশ্যই দলের ভেতর ক্ষমতা অর্জন করতে হবে এবং দেশের ভেতর আপনার দল ক্ষমতা অর্জন করবে। কিন্তু কোনো জাতীয় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের জন্য উত্তরাধিকার নীতি প্রচলিত থাকলে আপনাকে রাজার উত্তরাধিকারী হতে হবে। আপনি অন্য দেশ জয় করতে সমর্থন হবেন না এই উত্তরাধিকার লাভ করে। আপনাকে বিভিন্ন গুণে গুণান্বিত হতে হবে ভিন্ন দেশ জয়ের জন্য। অবশ্যই প্রায়ই এ গুণগুলোর অভাব দেখা যেত রাজপুত্রদের মধ্যে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এ জাতীয় অবস্থা বর্তমান যুগে বিরাজ করছে যেখানে ধনতন্ত্র প্রধানত উত্তরাধিকার সংক্রান্ত ধরা যাক ফ্রান্সে দুইশ ধনী পরিবার রয়েছে যাদের টী ব্যবস্থাপনায় আগের মতো নেই; কারণ তারা ব্যর্থ হয়েছে ব্যাপকভাবে স্বর্গীয় অধিকারের মতবাদ গ্রহণ করতে। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ছাড়া উঠতি ধনী ব্যক্তি তার ভাইকে দরিদ্রে পরিণত করলে কেউ তা অধর্ম মনে করে না।
নানা ধরনের সংগঠন নানা রকম ব্যক্তিকে শীর্ষে উঠিয়ে দেয়। অনুরূপভাবে বিভিন্ন ব্যক্তির উন্নতির সহায়ক সমাজের বিভিন্ন রকম অবস্থাও। ইতিহাসে এক একটি যুগের সূচনা করে বিখ্যাত ব্যক্তির কার্যকলাপ এবং এর আপাত বৈশিষ্ট্য উদ্ভূত হয় এসব ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য থেকেই। পরিবর্তিত হয় খ্যাতিলাভের জন্য প্রয়োজনীয় গুণাগুণ। অনুরুপভাবে পরিবর্তন ঘটে খ্যাতিমান ব্যক্তিদেরও। অনুমান করা যায়, লেলিনের মতো ব্যক্তিত্ব ছিল দ্বাদশ শতাব্দীতে এবং বর্তমান সমাজে রয়েছে রিচার্ড কয়ার ডি লায়নের মতো ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তারা অজ্ঞাত ইতিহাসে। এক মুহূর্তের জন্য আসুন আমরা ভাবি কোন ধরনের মানুষ কোন ধরনের ক্ষমতার ফসল।
ভদ্রলোক সম্বন্ধে আমাদের ধারণার জন্ম দিয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ক্ষমতা। এটি আমাদের ধারণার কিছু অধঃপতিত রূপ। এর রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস-গোত্রপতিদের ঐন্দ্রজালিক বৈশিষ্ট্য থেকে শুরু করে রাজার দেবত্ব, পীরের পীরত্ব, বিজয় ও আভিজাত্য পর্যন্ত। উত্তরাধিকার আইন যে দেশে ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে বলবৎ রয়েছে সেখানে প্রশংসতি বৈশিষ্ট্যগুলোর উৎস অবসর ও প্রশ্নাতীত শ্রেষ্ঠত্ব। নিম্নশ্রেণিভুক্ত সমাজে ক্ষমতা রাজতান্ত্রিক না হয়ে অভিজাততান্ত্রিক হলে সবিনয় আত্মপ্রকাশসহ সমপর্যায়ভুক্ত লোকের সঙ্গে ভদ্রতা অন্তর্ভুক্ত হয় সর্বোৎকৃষ্ট আচরণে। আচরণের ব্যাপক ধারণা থাকা সত্ত্বেও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ক্ষমতার অধীন এলাকার মানুষের গুণাগুণ তার আচরণ দ্বারা বিচার্য। সামাজিক সক্ষমতা অনুশীলনের চেয়ে ভালো কিছু সম্পাদনে অনভ্যস্ত নারী-পুরুষ সমন্বয়ে গঠিত বুর্জোয়া জেন্টিলহোম অনুপ্রবেশ করলে হাস্যাস্পদ হয়ে থাকে। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সমাজের উপর নির্ভরশীল ভদ্রলোকের প্রশংসায় বিদ্যমান বিষয়গুলো এবং তা দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যায় পিতা থেকে পুত্রের হাতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরিত না হলে।
ভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয় প্রকৃত অথবা অনুমতি শিক্ষার মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জিত হলে। প্রথাগত চীন ও ক্যাথলিক চার্চ হচ্ছে এর রকম ক্ষমতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটো দৃষ্টান্ত। আধুনিক বিশ্বে অতীতের অধিকাংশ সময়ের চেয়ে তা কমই রয়েছে; চার্চ ছাড়া এ ধরনের ক্ষমতা ইংল্যান্ডে খুব কমই রয়েছে। অধিকাংশ বর্বর সমাজে শিক্ষার মাধ্যমে সঞ্চারিত ক্ষমতার প্রভাব সর্বাধিক। কিন্তু তা নিয়মিতভাবে হ্রাস পায় সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে। আমি শিক্ষা বলতে অন্তর্ভুক্ত করছি মেজিসিয়ান বা মেডিসিনম্যানদের শিক্ষার মতো খ্যাতিমান শিক্ষাকে। লাসা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি পেতে হলে বিশ বছরের প্রয়োজন। এই ডিগ্রি প্রয়োজন হয় দালাইলামার পদ ছাড়া অন্যসব পদের জন্যে। ইউরোপে এক হাজার সালের বিরাজমান অবস্থাই যথেষ্ট যখন পোপ সিলভিস্টার ২ ছিলেন একজন খ্যাতিমান মেজিসিয়ান। তিনি বই পড়তেন এবং সমর্থ হতেন মেটাফিজিক্যাল ভীতি সঞ্চারের মাধ্যমে চার্চের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে।
আমরা জানি ধর্মযাজকের আধ্যাত্মিক উত্তরসূরি হরো বুদ্ধিজীবীরাই; কিন্তু তাদের ক্ষমতা হরণ করে নিয়েছে শিক্ষার বিস্তৃতি। বুদ্ধিজীবীদের ক্ষমতা র্নিভর করে কুসংস্কারের উপর; প্রথাগত যাদুমন্ত্র অথবা পবিত্র গ্রন্থের প্রতি শ্রদ্ধা। এগুলোর কিছুটা টিকে আছে ইংলিশ দেশগুলোতে, যা দেখতে পাওয়া যায় রাজ্যাভিষেক ও সংবিধানের প্রতি ইংরেজদের মনোভাবের ভেতর। এখনও প্রথাগত পান্ডিত্য ক্ষমতা আছে কেন্টারবারির আর্কবিশপ ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের। কিন্তু তা শুধু মিসরীয় যাজক ও চৈনিক কনফিউসীয় পন্ডিতদের ক্ষমতার প্রেতাত্মা।
সম্মান যদি ভদ্রলোকের বৈশিষ্ট্যমূলক গুণাগুণ হয় তবে জ্ঞান হবে শিক্ষার মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জনকারী ব্যক্তির গুণাগুণ। ব্যক্তি বিশেষের পান্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞানভান্ডার, আবেগ-অনুভূতির উপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ও মানবজীবন সম্পর্কে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা প্রয়োজন জ্ঞানের জন্য খ্যাতি অর্জন করতে। মনে হয় এসব গুণাগুণের কিছু কিছু অর্জন করা সম্ভব শুধু বয়সের কারণেই। এজন্যই সম্মানসূচক পরিভাষা হচ্ছে প্রেসভাইটার, সিগনিয়ার, এলডারম্যান ও এলডার। মুরব্বি মহান ব্যক্তি বলে একজন চৈনিক ভিক্ষুক পথিককে সম্বোধন করে। কিন্তু জ্ঞানসমৃদ্ধ যাজক ও সাহিত্যিকদের যৌথ সংস্থা গঠিত হয় জ্ঞানী ব্যক্তিদের ক্ষমতা সংগঠিত হলে। সব জ্ঞান যাদের ভেতর পুঞ্জীভূত আছে বলে মনে হয়। একজন উপাধিপ্রাপ্ত যোদ্ধা থেকে ভিন্ন ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন মহাজ্ঞানী বা পরমজ্ঞানী ব্যক্তি। ভিন্ন ধরনের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয় তার শাসনের জন্য। এর বিপরীত দৃষ্টান্ত হলো চীন ও জাপান।
যদিও জ্ঞান সভ্যতার ক্ষেত্রে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিকতর ভূমিকা রাখে তারপরও ইতিমধ্যে আমরা এমন অদ্ভুত জ্ঞানের উল্লেখ করেছি যে নতুন জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিদের ক্ষমতা অনুরূপভাবে বৃদ্ধি পায়নি। বিদ্যুৎ ও টেলিফোন কর্মীরা আমাদের সহায়ক অদ্ভুত কর্ম সম্পাদন করে থাকলেও আমরা কিন্তু তাদেরকে মেডিসিনম্যানের মতো মনে করি না। তাদের বিরক্ত করলে তারা বিপর্যয় ঘটিয়ে দিতে পারে, এ কথা আমরা চিন্তা করি না। এর কারণ কঠিন হলেও বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় জ্ঞান দুর্বোধ্য নয়। এ জ্ঞান তাদের জন্য উন্মুক্ত যারা প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারে। সুতরাং আধুনিক বুদ্ধিজীবীরা কোনোরূপ ভীতির সঞ্চার করেন না, শুধু চাকরিজীবী হিসেবেই থাকেন। তবে ব্যতিক্রম দেখা যায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে। ক্যান্টারবারির আর্কবিশপ ব্যর্থ হন তার পূর্বসূরিদের ক্ষমতা অর্জনে সহায়ক মহিনীমায়া অর্জনে।
জ্ঞানী ব্যক্তিদের সম্মান প্রদর্শন করা হয় স্বাভাবিক জ্ঞানের জন্য নয় বরং অনুমিত ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতার জন্যে। বিজ্ঞান বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বিনষ্ট করে দিয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিতি ঘটিয়ে ঐন্দ্রজালিক বিশ্বাসের মূলে আঘাত হেনে। বিজ্ঞানীরা আমাদের এ যুগের সঙ্গে আগের যুগের পার্থক্য সৃষ্টিকারী বৈশিষ্ট্যগুলোর জনক এবং তারা অপরিমেয় প্রভাব রাখেন আবিষ্কার ও উদ্ভাবনীর মাধ্যমে ঘটনাপ্রবাহের উপর। তা সত্ত্বেও ভারতীয় উলঙ্গ ফকির ও ম্যালেনেশিয়ার মেডিসিনম্যানের মতো তারা জ্ঞানের জন্য এত খ্যাতি অর্জন করতে পারেন না। নিজেদের কার্যকলাপের দরুন বুদ্ধিজীবীরা আধুনিক বিশ্বের প্রতি বিরাগভাজন হন তাদের মর্যাদা ফসকে যেতে দেখে। কমিউনিজমে বিশ্বাসী হন ন্যূনতম বিরাগভাজন ব্যক্তি; এই অনুভূতি যাদের ভেতর অনেক গভীরে নির্জন আবাসে তারা একান্তে চুপ করে থাকেন।
নতুন এক ধরনের ক্ষমতাশালী ব্যক্তিত্বের জন্ম দিয়েছে বড় বড় অর্থনৈতিক সংগঠনের পরিবৃদ্ধি। তাকে আমেরিকায় বলা হয় নির্বাহী। তিনি অন্য মানুষের প্রভাবিত করেন ত্বরিত উপলব্ধি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম লৌহরূপ ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে। তার থাকতে হবে সুদৃঢ় চোয়াল, শক্তভাবে বদ্ধ ঠোঁট এবং সংক্ষিপ্ত ও ধারালো কথা বলার অভ্যাস। তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগাতে হবে সমকক্ষ ব্যক্তিদের মনে এবং বিশ্বাসম্প্রবণ করে তুলতে হবে অধীনস্তদের। তাকে অর্জন করতে হবে একজন মহান জেনারেল বা একজন কূটনীতিকের গুণাবলি। তিনি হবেন দ্বন্দ্বে নিষ্ঠুর কিন্তু আলোচনার টেবিলে তিনি হবেন দক্ষ সম্মতি প্রদানকারী। মানুষ গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সংগঠনগুলোর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অর্জন করতে পারে এসব গুণাবলি দ্বারা।
গণতন্ত্রে এক ধরনের মানুষের হস্তগত রাজনৈতিক ক্ষমতা, যারা এ পর্যন্ত আলোচিত তিন ধরনের মানুষ থেকেও ভিন্ন প্রকৃতির। একজন রাজনীতিককে সফলকাম হতে হলে অবশ্যই তার সংগঠনের আস্থা অর্জন করতে হবে এবং সফল হতে হবে অধিকাংশ ভোটারের ভেতর উৎসাহ সৃষ্টিতে। ক্ষমতা অর্জনের জন্য এই দুই স্তরের প্রয়োজনীয় গুণাবলি এক প্রকার নয়। এর যে কোনো একটির অধিকারী হয় বেশিরভাগ মানুষই। এ রকম বিরল ব্যক্তিত্ব নন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা। যদিও তারা সাধারণ মানুষের ভেতর ভাবাবেগ সৃষ্টি করতে পারেন না, তারপরও তারা দক্ষ পার্টির ব্যবস্থাপকদের অনুগ্রহ অর্জনে। এসব মানুষ সাধারণভাবে পরাজিত হন, কিন্তু তাদের পরাজয়ের পূর্বাভাস বোঝাতে পারেন না দলীয় ব্যবস্থাপকরা। কখনও নির্বাচনে সংগঠন বিজয়লাভ করতে পারে প্রার্থীর ব্যক্তিগত গুণাগুণ ছাড়াই। এ ধরনের ক্ষেত্রে পার্টি তার উপর প্রভাব বিস্তার করে নির্বাচনোত্তর সময়ে। যার ফলে প্রকৃত ক্ষমতা অর্জন করতে তিনি কখনও সক্ষম হন না। পক্ষান্তরে নিজের সংগঠন সৃষ্টি করা যে কারও পক্ষে সম্ভব। এর দৃষ্টান্ত নেপোলিয়ন-৩, মুসোলিনি এবং হিটলার। প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ব্যবহার করে রাজনীতিবিদ সফলতা অর্জন করলেও পরিণামে তিনি একে তার ইচ্ছার অধীনস্ত করে তোলেন এর উপর প্রভাব বিস্তার করে।
একজন রাজনীতিককে যেসব গুণাবলি গণতন্ত্রে সফল করে তোলে তা পরিবর্তিত হয় সময়ের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী। এগুলো শাস্তিকালীন এবং বিপ্লব বা। যুদ্ধকালীন সময়ে একরকম নয়। একজন মানুষ সফল হতে পারেন শাস্তি কালীন সময়ে কাঠিন্য ও সুবিচার দ্বারা। কিন্তু এর অধিক গুণাবলি প্রয়োজন হয় শান্তি বিঘ্নিত হলে। এমন সময় প্রয়োজন একজন আকর্ষণীয় বক্তা হওয়ার প্রয়োজন নেই প্রচলিত অর্থে অনিবার্য বাগ্মী হওয়ার। বাগ্মী ছিলেন না রবসপিয়ার এবং লেলিন; কিন্তু তারা ছিলেন স্থিরচিত্ত, আবেগপ্রবণ এবং সাহসী। স্বাভাবিক ও নিয়ন্ত্রিত হতে পারে এই আবেগ, কিন্তু অনুভূত হতে হবে এর অস্তিত্ব। একজন রাজনীতিবিদ সক্ষম হবেন উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে যুক্তিনির্ভর বা নৈর্ব্যক্তিক সত্য উপলব্ধি করতে। তিনি অবশ্যই জনগণকে বোঝানোর ক্ষমতা রাখবেন যে তাদের আবেগপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা সম্ভব এবং তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি তা অর্জন করতে পারেন দৃঢ় সংকল্পের মাধ্যমে।
গণতন্ত্রকে মুছে ফেলে দিয়ে যিনি ডিক্টেটর হয়েছেন তিনিই সবচেয়ে সফল রাজনীতিবিদ। অবশ্য বিশেষ ক্ষেত্রে তা সম্ভব; ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে কেউই তা করতে পারেননি। কিন্তু যখন তা সম্ভব তখন উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে গণতন্ত্রী রাজনীতিবিদদের একমাত্র উচ্চমাত্রায় ওইসব গুণ প্রয়োজন হয়। লেলিন, মুসোলিনি, হিটলার গণতন্ত্রের কাছে ঋণী তাদের উত্থানের জন্য।
একবার যখন ডিক্টেটরি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তা ডিক্টেটরের গুণাবলি ভিন্ন হয়ে থাকে প্রতিষ্ঠাকালে ব্যবহৃত গুণাবলি থেকে। যখন উত্তরাধিকার প্রত্যাখ্যাত হয় তখন গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হলো নিজে অন্তরালে থেকে অপরের মাধ্যমে ক্ষমতাসাধন, ষড়যন্ত্র এবং কোর্টের পক্ষপাতিত্ব অর্জন করা। এ জন্য প্রতিষ্ঠাকারীর মৃত্যুর পর নিশ্চিতভাবে পরিবর্তিত হয় ডিক্টেটরি ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলো। যেহেতু প্রতিষ্ঠাকারীর গুণাগুণের চেয়ে উত্তরাধিকারী ডিক্টেটরের গুণগুলো সাধারণভাবে কম আকর্ষণীয় সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই সম্ভাবনা থেকে যায় অস্থিতিশীলতা ও প্রাসাদ বিপ্লবের এবং পরিণামে তা মোড় নেয় অন্য পদ্ধতিতে। যা হোক আশা করা যায়, এই প্রবণতা রোধ করা সম্ভব রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে কোনোরূপ জনপ্রিয় গুণাগুণ প্রর্দশন ছাড়া শুধু আধুনিক প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে তার জনপ্রিয়তা সৃষ্টি করে। কিন্তু এখনও বলা সম্ভব নয় এ ধরনের পদ্ধতি কতটুকু সফল হবে।
আমরা এ পর্যন্ত আমাদের বিবেচনার বাইরে রেখেছি ব্যক্তিবিশেষের এক ধরনের ক্ষমতার আলোচনা। নেপথ্যে একে ক্ষমতা বলা হয়। এর অন্তর্ভুক্ত হলো সভাসদ, ষড়যন্ত্রকারী, গুপ্তচর এবং ঘটনার অন্তরালে থেকে অন্যের দ্বারা নিজ উদ্দেশ্য পূরণে সক্ষম ব্যক্তির ক্ষমতা। প্রতিটি বড় সংগঠন, যেখানে নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তিদের যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে সেখানে অপেক্ষাকৃত কম খ্যাতিসম্পন্ন মানুষ থাকে যারা নিজস্ব পদ্ধতিতে প্রভাব প্রতিষ্ঠা করে নেতাদের উপর। এই একই পর্যায়ভুক্ত হলো ওয়ারপুলার এবং পার্টি কর্তারা, যদিও ভিন্ন ধরনের কৌশল তাদের। আস্থাভাজন বন্ধুদের তারা বসিয়ে দেন লোকচক্ষুর অন্তরালে কৌশলগত স্থানগুলোতে। সুতরাং সময় মতো তারা সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। স্বৈরাচার উত্তরাধিকারমূলক না হলেও স্বৈরাচারীর মৃত্যুর পর এ ধরনের ব্যক্তিরা তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার আশা পূরণ করতে পারেন। কিন্তু তারা পছন্দ করেন লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকাটাই। তাদের মোহ গৌরবের চেয়ে ক্ষমতার প্রতি বেশি। এ ধরনের ব্যক্তিরা প্রায়ই ভীরু হয়ে থাকেন। কখনও তারা যে কোনো কারণে বঞ্চিত হয় প্রাচ্য রাজতন্ত্রের খোঁজা ব্যক্তি অথবা অন্য জায়গায় রাজার মহীয়সীর মতো নামসর্বস্ব নেতৃত্ব থেকে। তাদের প্রভাব সর্বাদিক উত্তরাধিকারমূলক নামমাত্র ক্ষমতার ক্ষেত্রে। কিন্তু ক্ষমতা থাকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতার অস্তিত্ব আধুনিক সরকার ব্যবস্থাপনার যেসব বিভাগে রয়েছে বলে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে, ঐগুলোতে অনিবার্য হয়ে পড়ে তাদের প্রভাব। মুদ্রা ও বিদেশি নীতি হচ্ছে এগুলোর ভেতর এ যুগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বেরন হেলেটাইনের প্রভূত ক্ষমতা চিল কায়সার উইলিয়াম-২ এর শাসনকালে। কিন্তু তিনি কখনও আবির্ভূত হননি জনসমক্ষে আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয় ব্রিটেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী অফিসারদের ক্ষমতা কতটুকু। তবে ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় দলিল থেকে তা জানাতে পারবে আমাদের সন্তানরা। অন্যসব ক্ষমতা থেকে এমন নেপথ্য ক্ষমতা অনেক ভিন্ন। এগুলো সাধারণত অনাকাঙ্ক্ষিত গুণাবলি। এ ধরনের নেপথ্যে ক্ষমতা বিদ্যমান যে শাসন পদ্ধতিতে তা কোনোরূপ অবদান রাখতে পারে না সর্বসাধারণের মঙ্গলার্থে।