ক্ষমতার দর্শন
এই অধ্যায়ে আমি আলোচনা করতে চাই ক্ষমতাপ্রীতির দ্বারা অনুপ্রাণিত দর্শন সম্বন্ধে। আমি বলছি না যে ক্ষমতাই এর বিষয়বস্তু। তবে অধিবিদ্যা ও নৈতিক বিচার-বিবেচনায় এটিই দার্শনিকদের সচেতন বা অবচেতন ইচ্ছা।
আমাদের বিশ্বাস জন্ম নেয় বিভিন্ন মাত্রায় ইচ্ছার সঙ্গে দর্শনের মিলনের ফলেই। কোনো ক্ষেত্রে একটি উৎপাদকের কার্যকরী অংশ খুবই কম থাকে এবং অন্য ক্ষেত্রে অন্য উৎপাদকের। অভিজ্ঞতার সাহায্যে সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে এমন কিছু যৎসামান্যই হয়ে থাকে। যখন আমাদের বিশ্বাস তা অতিক্রম করে যায় তখন ইচ্ছাই এগুলোর সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করে। অপরপক্ষে অল্প বিশ্বাসই চূড়ান্তভাবে মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পরও দীর্ঘদিন টিকে থাকে। তাছাড়া পক্ষে বা বিপক্ষে তা যুগ যুগ ধরে টিকে থাকতে পারে প্রমাণের অভাব হলেও।
দর্শন জীবনের চেয়ে অধিকতর সমন্বিত। অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকে আমাদের জীবনে। কিন্তু একটি দর্শন সাধারণত কোনো প্রভাবশালী ইচ্ছার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকে।
বিভিন্ন রকম আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রভাবিত করেছে দার্শনিকের কাজকে। জানার আকাক্ষা রয়েছে। কিন্তু বিশ্বকে যে জানা সম্ভব এটা প্রমাণের আকাক্ষার মতো তা এক হতে পারে না। সুখের আকাক্ষা রয়েছে, সদগুণের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে এবং এ দুয়ের মিলনে সৃষ্ট মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও রয়েছে। সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে মিলনের আকাক্ষা রয়েছে, সৌন্দর্যের আকাক্ষা রয়েছে এবং সর্বোপরি রয়েছে ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা।
সদগুণের লক্ষ্য স্থির করে বড় বড় ধর্মগুলো। খ্রিস্ট ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্ম মুক্তির পথ অন্বেষণ করে। অধিকতর রহস্যরূপে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে মিলনের পথ অন্বেষণ করে। অভিজ্ঞতাবাদী দর্শন সত্য অন্বেষণ করে। আবার আদর্শবাদী দর্শন (ডেকার্তে থেকে কান্ট পর্যন্ত) নিশ্চয়তার অন্বেষণ করে। বাস্তবে কান্ট পর্যন্ত বড় বড় দার্শনিক মানব স্বভাবের জ্ঞাত অংশের সঙ্গে সম্পর্কিত আকাক্ষার সঙ্গে তাদের চর্চা সীমাবদ্ধ রাখেন। বেনথাম ও মানচেষ্টার স্কুলের দর্শন সম্পদকে প্রধান। উপায় ও আনন্দকে উদ্দেশ্য হিসেবে স্থির করে। আধুনিককালের ক্ষমতা দর্শন প্রধান মানচেস্টরিসমাস-এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ আবির্ভূত হয়। জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ধারাবাহিক আনন্দলাভ–এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে তা প্রতিক্রিয়াস্বরূপ।
ইচ্ছাশক্তি ও অনিয়ন্ত্রিত বাস্তবতার ভেতর দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক হচ্ছে মানবজীবন। যে দার্শনিক ক্ষমতা তাড়না দ্বারা পরিচালিত হন তিনি বাস্তবতার ভূমিকাকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করেন। আমি এ মুহূর্তে শুধু মেকিয়াভেলি ও রিপাবলিক গ্রন্থে বর্ণিত নগ্ন ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন ব্যক্তিদের কথাই চিন্তা করছি; আমি ভাবছি ওইসব মানুষের কথা যারা অধিবিদ্যা ও নীতিবিজ্ঞানের আচ্ছাদনের নিচে তাদের ক্ষমতাপ্রীতি লুকিয়ে রাখার তত্ত্ব উঘাটন করেন। ফিকট হলেন আধুনিককালের এমন দার্শনিকের ভেতর প্রথম ব্যক্তি।
ফিকটের দর্শন শুরু হয় পৃথিবীতে একক অস্তিত্বশীল সত্তার অহংবোধ থেকে। শুধু নিজেকে সত্য বলে মনে নেয় বলেই এই অহংবোধ রয়েছে। যদিও অন্য কিছুই বিরাজ করে না তারপরও এই অহংবোধ একদিন ধাক্কা খায় এবং এর ফলে অহংবোধহীনতা সত্যে পরিণত হয়। তা তখন ধাবিত হয় বিভিন্ন উদ্ভবের দিকে। সংশয়বাদিতা উদ্ভবের কারণ হিসেবে ঈশ্বরের দিকে ইঙ্গিত করে। ফিকট মনে করেন যে, ঈশ্বর ও অহংবোধের ভেতর পার্থক্য অপ্রয়োজনীয়। অহংবোধ ও অধিবিদ্যার ভেতর সমন্বয় হলে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, জার্মানরা ভালো এবং ফরাসিরা খারাপ। তাই নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জার্মানদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। জার্মান ও ফরাসিরা শুধু ফিকটেরই আবিষ্কার। কিন্তু জার্মানরা উন্নততর এবং তারা চূড়ান্ত বাস্তবতার অধিকতর নিকটবর্তী বা ফিকটের অহং। আলেকজান্ডার ও অগাস্টাস নিজেদের দেবতা বলে দাবি করেছেন এবং অন্যদের চুক্তিবদ্ধ হওয়ার ভান ধরতে বাধ্য করেছেন। ফিকট সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিলেন না। তাই তাকে চাকরি হারাতে হয় নাস্তিকতার দায়ে। কারণ তিনি ঘোষণা দিতে পারেননি কোনো স্বর্গীয় সত্তার।
সামাজিক কর্তব্যের কোনো স্থান নেই ফিকটের অধিবিদ্যায়। কারণ বহির্বিশ্ব শুধু আমারই স্বপ্ন। এই দর্শনের সঙ্গে মানানসই কাল্পনিক নীতিশাস্ত্র হচ্ছে আপন উন্নয়নের। অযৌক্তিকভাবে একজন মানুষ ভাবতে পারেন যে তার পরিবার বা জাতি তার অহংয়ের অংশবিশেষ। তাই তার অধিকতর মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। এভাবেই স্বাভাবিক সৃষ্টি জাতি ও জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস সলিপসিস্টিক দর্শনের। সর্বোপরি যেহেতু ক্ষমতাপ্রীতি তত্ত্বকে অনুপ্রাণিত করে, তাই ক্ষমতা শুধু অর্জন করা যেতে পারে অন্যান্য বিষয়ের সাহায্যে।
এ সবই আদর্শবাদ হিসেবে পরিচিত এবং বহির্বিশ্বের বাস্তবতা স্বীকৃতিদানকারী দর্শনের চেয়ে তা নৈতিক দিক থেকে বিবেচিত মহত্তর বলে।
আমার ইচ্ছা থেকে সত্যের ধারণায় মূর্ত হয়ে ওঠে স্বাধীন বিষয়ের বাস্তবতা। আমার বিশ্বাসের সত্য উপাদানটি এমন কিছুর উপর নির্ভর করে না যা আমি করতে পারি। আমি আগামীকাল আমার প্রাতঃভোজন সম্পন্ন করব-এই বিশ্বাস আংশিকভাবে নির্ভর করে আমার ইচ্ছাশক্তির উপর। কিন্তু মার্চের ১৫ তারিখ সিজারকে হত্যা করা হয়–এ ধরনের বিশ্বাস ইচ্ছাশক্তির উপর নির্ভর করে না। ক্ষমতাপ্রীতির দ্বারা অনুপ্রাণিত দর্শনে এ ধরনের অবস্থা নিরানন্দের এবং তাই তা সত্য ও মিথ্যার উৎস হিসেবে সত্য ঘটনার সাধারণ ধারণাকে ধ্বংস করতে শুরু করে। হেগেলের অনুসারীরা বলেন যে, সত্য ঘটনার সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল হলেই সত্য বিরাজ করে না। বরং আমাদের বিশ্বাসের পুরো পদ্ধতির পারস্পরিক সমন্বয়ের উপর তা নির্ভর করে। আপনার সব বিশ্বাসই সত্য হবে যদি এগুলোর সবই মানানসই হয়। প্রকৃতপক্ষে কোনো পার্থক্য নেই ঔপন্যাসিকের সত্য ও ঐতিহাসিকের সত্যের ভেতর। এভাবে সৃজনশীলতা মুক্তি লাভ করে বাস্তব বিশ্বের শিকল থেকে।
বাস্তববাদ হচ্ছে এর বিশেষরূপে ক্ষমতা দর্শন। বাস্তবাদ অনুসারে কোনো বিশ্বাসের ফলাফল আনন্দদায়ক হলে তাই সত্য। এখন মানুষই পারে একটি বিশ্বাসের পরিণতিকে আনন্দ বা নিরানন্দের ব্যাপারে পরিণত করতে। একনায়কের সদগুণে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের চেয়ে অধিকতর আনন্দদায়ক পরিণতি বয়ে আনে যদি আপনি এর সরকারের অধীনে বসবাস করেন। যেখানেই কার্যকরি নির্যাতন বিরাজমান সেখানে বাস্তবতাবোধে অফিসিয়াল বিশ্বাসই সত্য। তাই বাস্তববাদী দর্শন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদেরকে অধিবিদ্যাগত Omnipotence দান করে, যা একটি অধিকতর পেডিস্ট্রিয়ান দর্শন অগ্রাহ্য করে। আমি বলছি না যে, সবচেয়ে বেশি বাস্তববাদীরা এই পরিণতিগুলোকে তাদের নিজেদের দর্শন বলে গ্রহণ করেন। আমি শুধু বলছি যে, সত্য সম্বন্ধে সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির উপর বাস্তববাদীদের আক্রমণ ক্ষমতাপ্রীতি থেকে উদ্ভূত। অবশ্য প্রাণহীন প্রকৃতির উপর এর ক্ষমতা মানুষের উপর ক্ষমতার চেয়ে বেশি।
বার্গসঁর সৃষ্টিশীল বিবর্তন হচ্ছে একটি ক্ষমতা দর্শন যা বার্নার্ডশর Back to Methusaleh নাটকের শেষ দৃশ্যে অতি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। বার্গ বলেছেন যে, বুদ্ধিবৃত্তি নিন্দিত, কারণ তা অবৈধভাবে নিষ্ক্রিয় এবং শুধুই চিন্তার ভেতর সীমাবদ্ধ। তিনি বিশ্বাস করেন যে, প্রাণীগুলো চক্ষু অর্জন করেছে কারণ তারা অনুভব করে যে কোনো কিছু দেখতে সমর্থ হওয়া তাদের জন্য আনন্দদায়ক হবে। তাদের বুদ্ধিবৃত্তি দৃষ্টি সম্পর্কীয় চিন্তাভাবনায় সমর্থ হয়ে ওঠেনি। কারণ তারা ছিল অন্ধ। কিন্তু intuition ই এর অদ্ভুত কাজ সম্পাদনে সমর্থ হয়। তার মতে সর্বপ্রকার বিবর্তনের মূলে রয়েছে আকাঙ্ক্ষা। আকাক্ষা যথেষ্ট আবেগপূর্ণ হলে অর্জন সীমাহীন হয়ে পড়ে। জীবন গঠন (যান্ত্রিক) বোঝার ক্ষেত্রে জীব রসায়নবিদদের প্রচেষ্টা তুচ্ছ বলে মনে হয়, কারণ জীবন গঠন যান্ত্রিক নয়, এর পরিবর্ধন এমনই যে মানুষের পক্ষে বুদ্ধিমত্তার দ্বারা এর সম্বন্ধে অগ্রিম কল্পনা করা অসম্ভব। কাজের দ্বারাই শুধু জীবনকে বোঝা যায়। ফলাফল দাঁড়াচ্ছে যে, মানুষ আবেগপ্রবণ হবে। সৌভাগ্যজনকভাবে বার্গসঁর সুখের জন্য ওইগুলো স্বাভাবিকভাবে তাই।
কোনো কোনো দার্শনিক তাদের ক্ষমতা-তাড়না অধিবিদ্যাগত সত্তাকে প্রভাবিত করুক এটা চান না। তবে তারা অনুমোদন করেন নীতিবিদ্যার উপর মুক্ত শাসন। তাদের ভেতর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছেন নিয়েজেক। নিয়েজেক খ্রিস্টীয় নৈতিকতাকে দাস নৈতিকতার মতোই অগ্রাহ্য করেন এবং এর পরিবর্তে বীর শাসকদের উপযোগী নৈতিকতার যোগান দিয়ে থাকেন। অবশ্য তা নতুন নয়। এর কিছু কিছু হেরাক্লিয়াস ও প্লেটোর ভেতর এবং অনেকগুলোই রেনেসাঁর ভেতর পাওয়া যায়। নিয়েজেকের ভেতর এর সমাধান করা হয়েছে এবং নিউ টেস্টামেন্টের শিক্ষার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তার দৃষ্টিতে সংঘবদ্ধ মানুষের নিজেদের স্বার্থের দিক থেকে কোনো মূল্য নেই; কিন্তু বীরের মহত্ত্ব অর্জনের উপায় হিসেবে এর মূল্য রয়েছে। বীর নিজের উন্নতি বিধানের জন্য তাদের আহত করার অধিকার রাখেন। বাস্তবে অভিজাতরা সর্বদাই তাদের কর্মপন্থা এমনভাবে স্থির করেছে যে এ ধরনের নীতিশাস্ত্র দ্বারা তা প্রমাণিত। কিন্তু খ্রিস্টীয় তত্ত্ব বলছে যে ঈশ্বরের দৃষ্টিতে সব মানুষই সমান। গণতন্ত্র খ্রিস্টীয় শিক্ষার কাছে সমর্থন লাভের জন্য এ আবেদন রাখে। কিন্তু অভিজাতদের কাছে নিয়েজেকের নীতিবিদ্যাই শ্রেষ্ঠ। দেব-দেবি থাকলে আমি কিভাবে দেবতা না হয়ে থাকতে পারতাম? সুতরাং কোনো দেবতা নেই বলেছেন নিয়েজেকের জরাথুস্ত্র। ঈশ্বরকে সিংহাসনচ্যুত করা প্রয়োজন যাতে পৃথিবীতে সন্ত্রাসীদের জায়গা করে দেয়া যায়।
ক্ষমতাপ্রীতি মানব প্রকৃতির স্বাভাবিক অংশবিশেষ। কিন্তু ক্ষমতা দর্শন একটি বিশেষ অর্থে অস্বাভাবিক। বস্তু ও অন্যান্য মানুষের সমন্বয়ে গঠিত বহির্বিশ্বের অস্তিত্ব তথ্যস্বরূপ এবং তা বিশেষ ধরনের অহংকারকে ধ্বংস করে দেয়। ক্ষমতাপ্রীতির দ্বারা গঠিত বিশ্ব সম্পর্কে বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী মানুষ প্রতি জনপদেই দেখতে পাওয়া যায়। কোনো মানুষ ভাবতেন যে তিনি ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর, অন্য মানুষ ভাববেন যে তিনি রাজা। আবার অন্য কেউ ভাববেন যে তিনি ঈশ্বর। অনুরূপ বিপথগামিতা যদি শিক্ষিত মানুষের দ্বারা অস্পষ্ট ভাষায় প্রকাশিত হয় তবে তা দর্শনের অধ্যাপক হওয়ার পথ সুগম করে দেয়। কিন্তু যদি তা আবেগপ্রবণ মানুষের বাগিতায় প্রকাশিত হয় তবে তা দর্শনের অধ্যাপক হওয়ার পথ সুগম করে দেয়। সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত উন্মাদের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়, কারণ তার কার্যকলাপ প্রশ্নবিদ্ধ হলে সে সহিংসপ্রবণ হয়ে পড়ে। সার্টিফিকেটধারী নয় এমন বিভিন্ন ধরনের মানুষ ক্ষমতাবান সেনাদলের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে এবং তাদের ক্ষমতাধীন সব সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের উপর ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। সাহিত্য, দর্শন ও রাজনীতি উন্মাদের সফলতা এ যুগের এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য। উন্মাদের সফলতার ধরন প্রায় পুরোপুরিভাবে তাড়না থেকে ক্ষমতার দিকে ধাবিত হয়।
এই অবস্থা বোঝার জন্য সমাজ জীবনের সঙ্গে ক্ষমতা দর্শনের সম্পর্ক আলোচনা করা প্রয়োজন। আমাদের ধারণার চেয়েও জটিল হতে পারে এই সম্পর্কটি।
আমরা সলিপজিসম দিয়ে শুরু করতে পারি। যখন ফিকট মনে করেন যে, সব কিছুই অহং থেকে শুরু হয়, তখন পাঠকরা মনে করেন না যে সবকিছু জোহান গটলিয়ের ফিকট থেকে শুরু হয়। কেমন অদ্ভূত? কিছুদিন আগে পর্যন্ত কেন আমি তাকে শুনতে পাইনি? তিনি কি প্রকৃতই মনে করেন যে তিনি তাদের আবিষ্কার করেছেন? কি হাস্যকর অহংবোধ? আমি পুনর্বার বলি যে পাঠক তা বলছেন না। তিনি ফিকটের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন এবং যুক্তিগুলোকে অকাট্য দেখছেন না। তিনি চিন্তা করেন, মোটের উপর অতীত সম্বন্ধে আমি কি জানি? আমার কিছু অভিজ্ঞতা রয়েছে যেগুলো আমি বাছাই করেছিলাম আমার জন্মের আগের সময় সম্বন্ধে ব্যাখ্যাস্বরূপ। যেসব জায়গা আমি দেখিনি এগুলো সম্পর্কে আমি কি বলতে শুনেছি। আমি যদি ঈশ্বরের জায়গায় নিজেকে মনে করি এবং বলি যে বিশ্ব আমারই সৃষ্টি তবে কোনো কিছু দিয়েই প্রমাণ করা যাবে না যে আমি ভুল করছি। ফিকট মনে করছেন যে শুধু ফিকটই আছেন এবং জন স্মিথ যুক্তিগুলো পড়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন যে শুধু জন স্মিথই আছেন। কিন্তু জন স্মিথ কখনও খেয়াল করেননি যে ফিকটের কথা তা নয়।
এভাবে সলিপসিজমের বিশেষ ধরন সমাজজীবনের ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। কিছু সংখ্যক পাগল, যারা প্রত্যেকেই নিজেকে ঈশ্বর মনে করে, একে-অন্যের সঙ্গে বিনয়ের সঙ্গে আচরণের শিক্ষা নিতে পারে। কিন্তু যে পর্যন্ত প্রতিটি ঈশ্বরই নিজেকে Omnipotence হিসেব দেখতে পায় ততক্ষণই তাদের এই বিনয়ভাব বজায় থাকে। যদি মি. A নিজেকে ঈশ্বর ভাবেন তাহলে তিনি অন্যদের কার্যকলাপ ততক্ষণ মেনে নেবেন যতক্ষণ তাদের কার্যকলাপ তার উদ্দেশ্য সাধনে সহায়ক হবে। কিন্তু যদি মি. B তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করেন এবং বুঝতে চান যে তিনি Omnipotence নন তাহলে মি. Aর আবেগ জাগ্রত হবে এবং তিনি বুঝে নেবেন যে মি. B হচ্ছে শয়তান অথবা তার সমর্থক। মি. B ও A সম্পর্কে অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করবেন। প্রত্যেকেই দল গঠন করবেন। ফলে যুদ্ধ বাধবে। এটা হবে ধর্মযুদ্ধ, যা হবে তীব্রতর; নিষ্ঠুরতর এবং অধিকতর উন্মাদনাযুক্ত। ধরা যাক মি. A হচ্ছেন হিটলার এবং মি. B হচ্ছেন স্ট্যালিন। তাদের দুজনের মাধ্যমে বর্তমান বিশ্বের একটি চিত্র পেতে পারেন। হিটলার বলবেন, আমি মুক্তিদাতা। স্ট্যালিন বলবেন, আমি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ। কিন্তু যেহেতু তাদের দাবি বিশাল সেনাবাহিনী, উড়োজাহাজ, বিষাক্ত গ্যাস ও নির্দোষ ব্যক্তিদের সমর্থপুষ্ট তাই উভয়ের উন্মাদনা থেকে যাবে মানুষের অলক্ষ্যেই।
পরবর্তী পর্যায়ে ধরা যাক নিয়েজেকের বীরের আচরণ। প্রশংসাকারী পাঠককে অবশ্যই বোঝানো হবে যে তিনি নিজে একজন বীর এবং তিনি দুই প্রকৃতির। অসহৎ ও অপরিণামদর্শী ষড়যন্ত্র দ্বারা তাকে পেছনে ফেলে রাখা হয়েছে। এ থেকে মনে হয় যে নিয়েজেকের দর্শন খুবই চমৎকার। কিন্তু এভাবে পাঠ করা হলে ও প্রশংসা করা হলে কিভাবে স্থির করা যাবে যে তিনিই বীর হবেন? স্পষ্টতই যুদ্ধ দ্বারা। এ দুয়ের কোনো একজন বিজয় অর্জন করলে তিনি শুধু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেই তার বীর উপাধি বজায় রাখতে সমর্থ হবেন। এর জন্য তাকে ক্ষমতাধর বিশাল গোপন পুলিশ বাহিনী গঠন করতে হবে। তিনি হত্যার ভয়ের মধ্যেই বসবাস করবেন। অন্য সবাই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ভয়ে ভীত থাকবেন এবং এভাবে বীরত্বের সংস্কৃতি নিঃশেষ হবে একটি ভীতিপূর্ণ জাতি গঠনের মধ্য দিয়ে।
একটি বিশ্বাসের পরিণতি আনন্দদায়ক হলে তা সত্য হয়-এ ধরনের বাস্তববাদী তত্ত্বের সঙ্গে একই ধরনের বেদনাদায়ক পরিস্থিতি জন্ম নেয়। কার জন্য আনন্দদায়ক? স্ট্যালিনের প্রতি বিশ্বাস তার জন্য আনন্দদায়ক; কিন্তু ট্রটস্কির জন্য বেদনাদায়ক। হিটলারের প্রতি বিশ্বাস নাজিদের জন্য আনন্দদায়ক; কিন্তু ক্যাম্পে যাদের জড়ো করে রাখা হয়েছিল তাদের জন্য বেদনাদায়ক। নগ্ন শক্তিই শুধু এই প্রশ্নের সমাধান দিতে পারে। কে এই আনন্দদায়ক পরিণতি উপভোগ করবেন? এর উত্তরই প্রমাণ করে যে একটি বিশ্বাস সত্য।
ক্ষমতা দর্শন আপনা থেকেই ভুল প্রমাণিত হয় সামাজিক পরিণতির হিসাব নেয়া হলে। আমি ঈশ্বর-এই বিশ্বাসে অন্য কেউ অংশীদার না হলে তা অচল হয়ে পড়ে। অন্য কেউ অংশীদার হলে তা আমাকে বিধ্বংসী যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। বীরের সংস্কৃতি একটি কাপুরুষ জাতির জন্ম দেয়। বাস্তববাদের বিশ্বাস ব্যাপকতা পেলে নগ্ন ক্ষমতার শাসনের দিকে ধাবিত করে, যা নিরানন্দের। সুতরাং এর নিজস্ব মাপকাঠি থেকেই বলা যায় যে, বাস্তববাদে বিশ্বাস মিথ্যা। সমাজজীবনে সামাজিক আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য ক্ষমতাপ্রীতি ছাড়া প্রয়োজন অন্য কোনো দর্শনের উপর নির্ভর করা।