ক্ষমতার উৎস : ধর্মমত
লোকসংখ্যা, অর্থনৈতিক উৎসগুলো এবং কৌশলগত যোগ্যতার উপরই শুধু নির্ভর করে না একটি সম্প্রদায়ের ক্ষমতা, নির্ভর করে সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরে বিরাজমান বিশ্বাসের উপরও। কখনও জনগণের অন্ধ বিশ্বাস সম্প্রদায়ের ক্ষমতা প্রভূত বৃদ্ধি করে আবার কখনও তা হ্রাস করে দেয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর চেয়ে বর্তমান সমাজে ধর্মোন্মাদনা ব্যাপকতা লাভ করেছে, তাই ক্ষমতার যুক্তি হচ্ছে, ঐক্যবদ্ধ উন্মাদ জাতির চেয়ে যুদ্ধ জয়ের সম্ভাবনা বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠ সুস্থ। জনগোষ্ঠী নিয়ে গঠিত জাতির। এ যুক্তির বিচার করা যাক ইতিহাসের আলোকে।
শুরুতে এটা লক্ষণীয়, ব্যর্থতার ক্ষেত্রগুলো উন্মাদনার সফল ক্ষেত্রগুলোর চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম জ্ঞাত। কারণ ব্যর্থতার ক্ষেত্রগুলো অপেক্ষাকৃত অস্পষ্ট রয়েছে। সুতরাং ভুল হতে বাধ্য ত্বরিত পরীক্ষণ। কিন্তু তা এড়ানো কঠিন নয় যদি আমরা সম্ভাব্য ভুলের উৎস সম্বন্ধে অবহিত হই।
ইসলামের অভ্যুদয় হচ্ছে ধর্মোন্মাদনার মাধ্যমে ক্ষমতালাভের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। আরবদের সম্পদ ও জ্ঞানে নতুন কিছুই যোগ করেননি মোহাম্মদ (সঃ)। তারপরও তার মৃত্যুর কিছুদিনের ভেতর তার অনুসারীরা শক্তিশালী প্রতিবেশিদের পরাজিত করে প্রতিষ্ঠা করে বিশাল সাম্রাজ্য। নিঃসন্দেহে নবী (সাঃ) কর্তৃক প্রবর্তিত ধর্মই তার জাতির বিজয়ের অপরিহার্য উপাদান। জীবনের শেষদিকে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেন বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। মুসলমানরা নিরুৎসাহিত ছিল : তারা ইঙ্গিত করল অর্থ, ঘোড়া ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাবের দিকে। তারা আরও বলল যে, এটা ফসল কাটার সময় এবং গ্রীষ্মের অসহনীয় গরম। নবী ঘৃণাভরে উচ্চারণ করলেন, নরকের আগুন এর চেয়েও গরম। তিনি ঘৃণার চোখে দেখতেন বাধ্যতামূলক সেবা গ্রহণ। কিন্তু ফিরে এসে পঞ্চাশ দিনের জন্য সম্প্রদায় থেকে বহিষ্কার করে চরম অপরাধীদের শাস্তি দেন। মোহাম্মদ (সঃ)-এর জীবিতাবস্থায় এবং তার মৃত্যুর পর কয়েক বছর পর্যন্ত ধর্মোন্মদনার মাধ্যমে আরব জাতির ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং যুদ্ধে আত্মবিশ্বাস জন্মে। অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে বেহেস্ত পাওয়া যাবে-সাহস সঞ্চার করা হয় এ ধরনের বিশ্বাস জন্মানোর মাধ্যমে।
কিন্তু উন্মাদনা যদিও প্রাথমিক পদক্ষেপগুলোতে আরবদের প্রেরণা দান করে, তারপরও অন্যান্য বিষয়ের ভূমিকা রয়েছে তাদের দীর্ঘ বিজয়ের ইতিহাসে। বাইজেনটাইন ও পারস্য দুটোই দুর্বল হয়ে পড়েছিল সিদ্ধান্তহীন দীর্ঘ যুদ্ধের কারণে। রোমান সৈন্যরা সব সময়ই দুর্বল ছিল এবং অশ্বারোহণে তাদের অনীহা ছিল। আরব অশ্বারোহীরা অবিশ্বাস্যরকম দ্রুতগতিসম্পন্ন ছিল এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কষ্টসহিষ্ণু হয়ে উঠত, যা অসহনীয় ছিল তাদের বিলাস প্রিয় প্রতিবেশিদের কাছে। এসব অবস্থা অপরিহার্য ছিল মুসলমানদের প্রাথমিক সাফল্যের জন্য।
খুব শিগগিরই উন্মাদনামুক্ত করা হলো সরকার। নবী (সঃ)-এর জামাতা হযরত আলী (রাঃ) বিশ্বাসীদের একটি সম্প্রদায়ের ভেতর মূল উন্মাদনা জিইয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু তিনি গৃহযুদ্ধে পরাজিত হন এবং শেষ পর্যন্ত শহীদ হন। তারপর খেলাফতে অধিষ্ঠিত হলো নবী (সঃ)-এর ঘোর বিরোধী উমাইয়া পরিবার। কিন্তু ধর্মে তাদের রাজনৈতিক সম্মতি ছাড়া বেশি কিছু ছিল না। মোহাম্মদ (সঃ)-এর নির্যাতনকারীরা জোরপূর্বক দখল করল তার সন্তানদের উত্তরাধিকার এবং তার ধর্ম ও রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তা হয়ে বসল প্রতিমা পূজারিরা। বিরোধিতায় আবু সুফিয়ান দুর্দান্ত ও অনড় ছিলেন। তার ধর্ম গ্রহণ ধীরগতিসম্পন্ন ও অনিচ্ছাকৃত ছিল। প্রয়োজন ও স্বার্থ দ্বারা সমর্থিত ছিল তার নতুন বিশ্বাস। তিনি যুদ্ধ করেন এবং সেবা দান করেন এবং সম্ভবত তিনি বিশ্বাসও করতেন। উমাইয়া পরিবারের যোগ্যতার দ্বারা অন্ধকার যুগের পাপের প্রায়শ্চিত্ত হলো। এ মুহূর্ত থেকে অনেক দিন পর্যন্ত খেলাফত মুক্ত চিন্তার জন্য চিহ্নিত হয়ে রইল। কিন্তু খ্রিস্টানরা উন্মাদ রয়ে গেল। প্রথম থেকেই মোহাম্মদ (সঃ)-এর অনুসারীরা বিজিত খ্রিস্টানদের সঙ্গে তাদের আচরণে সংযমের পরিচয় দেন। এই সংযম খ্রিস্টানদের নির্যাতনস্পৃহার প্রবল বিরোধী। তাদের বিজয় ও সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রধান কারণ ছিল এই সংযম।
ক্রমওয়েলের নেতৃত্বে স্বাধীনতাবাদীদের বিজয় হচ্ছে উন্মাদনার এই আপাত সাফল্যের অন্য একটি উদাহরণ। কিন্তু প্রশ্ন জাগে যে, উন্মাদনার কতটুকু ভূমিকা ছিল ক্রমওয়েলের সাফল্যে? বাজার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পার্লামেন্ট এজন্য বিজয়ী হয় যে লন্ডন ও পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলো এর পক্ষে ছিল; জনশক্তি ও অর্থ সম্পদের দিক দিয়ে তা রাজাকে অনেক দূর অতিক্রম করে গিয়েছিল। মধ্যপন্থিদের মতো প্রেসবাইটেরিওয়অরা বিপ্লবের ফলে ক্রমাগতভাবে একদিকে চলে যায়, কারণ, তারা সর্বান্তকরণে বিজয়ের প্রত্যাশা করছিল না। ক্রমওয়েল একজন বাস্তব রাজনীতিবিদ হয়ে পড়েন ক্ষমতা অর্জনের পর এবং উদ্বিগ্ন ছিলেন সংকটাবস্থাকে সর্বোত্তম পন্থায় কাজে লাগানোর ব্যাপারে। কিন্তু তিনি তার অনুসারীদের উন্মাদনা উপেক্ষা করতে পারেননি, যা এতই অপ্রিয় ছিল যে পরিণামে এর জন্যেই তার দলের পতন হয়। এ কথা বলা যাবে না যে, উন্মাদনা ইংলিশ স্বাধীনতাবাদীদের চেয়ে তাদের পূর্বসূরিদের সাফল্যে বেশি কিছু করেছে।
ব্যাপক ভিত্তিতে ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস ইংল্যান্ডের অনুরূপ : উন্মাদনা, বিজয়, পতন ও প্রতিক্রিয়া। এমনকি অনুকূল এই দুই দৃষ্টান্তে ক্ষণস্থায়ী ছিল উন্মাদনার দৃষ্টান্ত।
সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতা অনেক বেশি উন্মাদদের। এটি টিটাসের সময় জেরুজালেম ধ্বংস করে এবং ১৪৫৩ সালে ধ্বংস করে কনস্টান্টিনোপল। প্রাচ্য ও প্রতিচ্যের চার্চগুলোর ভেতর তুচ্ছ পার্থক্য থাকায় প্রতিচ্যকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। প্রথমত স্পেনের পতন ঘটায় ইহুদি ও মুরদেরকে বিতাড়নের মাধ্যমে এবং পরে নেদারল্যান্ডে বিদ্রোহ ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের মাধ্যমে। অপরদিকে বর্তমান যুগব্যাপী ওইসব জাতিই সফল হচ্ছে যারা ভিন্ন মতাবলম্বীদের নির্যাতনে সবচেয়ে কম আসক্ত।
তা সত্ত্বেও আজকাল ব্যাপকতা লাভ করেছে একটি কথা, সুষম মতবাদ অপরিহার্য জাতীয় সংহতির জন্য। এই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা হয় জার্মানি ও রাশিয়ায় কঠোরতার সঙ্গে এবং ইতালি ও জাপানের কিছুটা শৈথিল্যের সঙ্গে। গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্সে অনেক ফ্যাসিবাদ বিরোধীরাই এই মতবাদ পোষণ করেন যে মুক্তিচিন্তাই হচ্ছে সামরিক দুর্বলতার উৎস। আরও একবার এই প্রশ্নের পর্যালোচনা করা যাক অধিক তত্ত্বগতভাবে এবং বিশ্লেষণাত্মক ঢঙে।
আমি যে প্রশ্ন সম্পর্কে বলছি তা ব্যাপক কিছু নয়। মুক্তচিন্তাকে উৎসাহিত। করা উচিত কি-না অথবা কমপক্ষে তা কি সহ্য করতে হবে? আমি একটি ছোট প্রশ্ন করছি : ক্ষমতার উৎস হিসেবে (স্বতঃস্ফূর্ত বা আরোপিত) সুষম ধর্মমতের ব্যাপ্তি কতটুকু? অপরপক্ষে এর ব্যাপ্তি কতটুকু ক্ষমতার উৎস হিসেবে?
১৯০৫ সালে যখন ব্রিটিশরা তিব্বতে সামরিক অভিযান চালায় তখন প্রথমে সাহসের সঙ্গে অগ্রসর হয় তিব্বতীয়রা, কারণ লাগামবাদীরা বুলেটের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ দান করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা হতাহত হলে লাগামবাদীরা দেখল যে বুলেটের অগ্রভাগ নিকেলের তৈরি। তখন ব্যাখ্যা দেয়া হলো যে শুধু সিসার ক্ষেত্রে রক্ষাকবচ প্রযোজ্য। এরপর খুব কম সাহস প্রদর্শন করে তিব্বতীয়রা। বেলাকুন এবং পিজনার যখন কমিউনিস্ট বিপ্লব করেন তখন তারা আশ্বস্ত ছিলেন যে, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে দ্বান্দ্বিক মতবাদ। আমি ভুলে গিয়েছি যে লাগামবাদীরা কমিনটার্নের ব্যর্থতার কি ব্যাখ্যা দিয়েছিল? এ দুটো দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যায় যে বিজয় লাভে ব্যর্থ সুষম বিশ্বাস।
এ ব্যাপারে সত্যে পৌঁছাতে হলে দুই বিপরীত উক্তির ভেতর আপস মীমাংসা করা প্রয়োজন। এর প্রথমটি হচ্ছে, বিশ্বাসের অনুবর্তী মানুষ ভিন্ন মতাবলম্বীদের চেয়ে অধিক আগ্রহের সঙ্গে সহযোগিতা করবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ভ্রান্ত বিশ্বাসের চেয়ে সত্য বিশ্বাসের অনুসারীদের সাফল্যলাভের সম্ভাবনা বেশি। এই দুই উক্তি পরীক্ষা করব আমরা।
এটা স্পষ্ট যে, সহযোগিতার সহায়ক হলো ঐকমত্য। স্পেনের গৃহযুদ্ধে এনার্কিস্ট, কমিউনিস্ট ও বাস্ক জাতীয়তাবাদীদের ভেতর সহযোগিতা কঠিন ছিল, যদিও তারা সবাই কামনা করে ফ্রাঙ্কোর পরাজয়। একটু কম হলেও অনুরূপভাবে কার্লিস্ট ও আধুনিক ফ্যাসিবাদীদের ভেতর সহযোগিতা কঠিন হয়ে পড়ে। অব্যবহিত লক্ষ্য সম্পর্কে ঐকমত্য ও মেজাজগত সাদৃশ্য থাকলে অন্যান্য বিষয়ে মতপার্থক্য ক্ষতিকর নয়। পেনিনসুলার যুদ্ধের ঐতিহাসিক স্যার উইলিয়াম নেফিয়ার নেপোলিয়নের প্রশংসা করেছেন এবং ওয়েলিংটনের নিন্দা করেছেন। তার লিখিত বই থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেন নেপোলিয়নের পরাজয়কে। কিন্তু তার সাম্প্রদায়িক চেতনা ও সামরিক কর্তব্যানুভূতি বাতিল করে দেয় এ ধরনের বুদ্ধিবৃত্তি। তিনি উচ্চ রক্ষণশীল রাজনীতিকদের মতো দক্ষতার সঙ্গে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। সুযোগ এলে আজকাল হিটলারের বিরুদ্ধে তেজোবীর্যের সাথে যুদ্ধ করবে ব্রিটিশ টরিরা।
একটি জাতি, ধর্ম বা দলের ক্ষমতালাভের জন্য জরুরি মেজাজ ও অভ্যাসের উপর নির্ভরশীল সমতা। যেখানে এর অস্তিত্ব রয়েছে সেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্বাসের প্রয়োজন নেই। গ্রেট ব্রিটেনে এর অস্তিত্ব বিদ্যমান কিন্তু সেখানে তা ছিল না ১৭৪৫ সাল পর্যন্ত। ১৯৭২ সালে ফ্রান্সে অথবা বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে এবং পরবর্তী গৃহযুদ্ধের সময় রাশিয়ায় এর অস্তিত্ব ছিল না। এ মুহূর্তে এর অস্তিত্ব নেই স্পেনে। কার্যক্ষেত্রে আনুগত্যের উপর নির্ভর করতে পারলে একটি সরকারের পক্ষে মুক্ত চিন্তার অনুকূলে সম্মতি প্রদান করা কঠিন নয়। কিন্তু বিষয়টি জটিল হয়ে যেতে পারে সম্মতি প্রদানে অনিচ্ছার দরুন। এটা স্পষ্ট যে, গৃহযুদ্ধের সময় স্বাধীন প্রচারণা অসম্ভব, কিন্তু আসন্ন গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে প্রচারণা নিষিদ্ধকরণের যুক্তিগুলো কম আকর্ষণীয়। জোরালো যুক্তি বিদ্যমান মারাত্মক পরিবেশে আরোপিত সমস্যার পক্ষে।
এখন ধরা যাক দ্বিতীয় উক্তিটি। সত্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিশ্বাসগুলো নেয়াই সুবিধাজনক। সরাসরি সুবিধা সম্ভব শুধু সীমিত শ্রেণির বিশ্বাসের বেলায়। প্রথমত উচ্চ বিস্ফোরক দ্রব্য ও বিষাক্ত গ্যাসের মতো বিষয়গুলো এবং পরে ধরা যেতে পারে বিরোধী শক্তিগুলোর আপেক্ষিক ক্ষমতা-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো। এসব বিষয় সম্পর্কেও বলা যেতে পারে যে, শুধু নীতি ও সামরিক ক্রিয়াকলাপ নির্ধারণে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা প্রয়োজন : আশা করা যায় যে জনগণ বিজয়ের নিশ্চয়তা অনুভব করবে এবং বিমান ও আক্রমণপ্রসূত বিপদের গুরুত্ব কমই দেবে। সত্য সম্পর্কে অবহিত হবেন শুধু সরকার, সামরিক কর্তাব্যক্তি ও তাদের কুশলীরাই। অন্যান্য মানুষের ভেতর সর্বাধিক কাম্যআত্মবিশ্বাস ও অন্ধভাবে বাধ্য থাকা।
যদি দাবার মতো হিসাব করা যেত মানবীয় কার্যকলাপ এবং যদি রাজনীতিবিদ ও যুদ্ধবিশারদরা দাবা খেলোয়াড়দের মতো চতুর হতেন তাহলে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছুটা সত্য থাকত। সফল যুদ্ধের সুবিধাগুলো সন্দেহজনক, কিন্তু ব্যর্থ যুদ্ধের অসুবিধাগুলো নিশ্চিত। সুতরাং যদি অসাধারণ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি আগেভাগেই বুঝতে পারতেন যে অমুক যুদ্ধে জয়লাভ করতে যাচ্ছেন তাহলে কোনো যুদ্ধই হতো না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং প্রতিটি যুদ্ধেই সম্ভাব্যতার ভুল হিসাবটি করে থাকেন উভয় পক্ষের সরকার না হলেও এক পক্ষের সরকার। এর অনেক কারণ রয়েছে–গর্ব, অহংকার ও ছোঁয়াচে উত্তেজনা। যখন জনমনে অন্ধ বিশ্বাস জিইয়ে রাখা হয় তখন জনগণের এই বিশ্বাস ও মারমুখো ভাব সম্বন্ধে শাসকদের সহজেই অবহিত করা যেতে পারে। খুব কমই এইসব অপ্রিয় সত্যের মূল্যদিয়ে থাকেন শাসক শ্রেণি, তা তারা জানেন অথচ গোপন রাখেন। তবে সংবাদপ্রিয় অথবা কতোপকথনে ঘোষিত প্রিয় সত্য বিষয়ের যথার্থ মূল্যায়ন করে থাকেন। সৃষ্টি হচ্ছে বায়ুরোগ ও অহংভাবের বাতিক; রেহাই নেই সরকারের।
গোপনীয়তার জন্য সৃষ্ট ফলাফল আকাঙ্ক্ষিত ফলাফলের ঠিক বিপরীত হয় যুদ্ধ সংঘঠিত হলে। মানুষের কাছ থেকে গোপন করে রাখা অপ্রীতিকর সত্যের কিছু কিছু সর্বসাধারণের কাছে স্পষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং মানুষকে যতই সুখের স্বর্গে বসবাসের প্রতিশ্রুতি দেয়া হোক না কেন, তারা ততই আতঙ্কিত ও নিরুৎসাহিত হয় বাস্তব সত্যের দ্বারা। এইভাবে বেড়ে যায় বিপ্লব এবং আকস্মিক পদচ্যুতির সম্ভাবনা।
বুদ্ধিবৃত্তির জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায় অধীনস্তদের জোরপূর্বক বিশেষভাবে আচরণ দেখাতে বাধ্য করা হলে। বাহ্যিকভাবে হলেও অযৌক্তিক মতবাদ গ্রহণ যে সমাজে স্বাভাবিক সে সমাজে সর্বোৎকৃষ্ট ব্যক্তিকে বিরাগভাজন হতে হয়। ফলে ওই সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক মান কমে এবং তা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় কৌশলগত অগ্রগতির পথে। এর সত্যতা বিশেষভাবে প্রমাণিত হয় যখন অফিসিয়াল ধর্মমত এমন হয় যে, তা গ্রহণ করতে পারে খুব কম সংখ্যক মানুষই। নাজিরা অনেক যোগ্য জার্মান নাগরিককে নির্বাসিত করেছে। আজ হোক কাল হোক এর প্রভাব পড়বেই সামরিক কৌশলের উপর। বিজ্ঞান ছাড়া অসম্ভব দীর্ঘ অগ্রগতি। আবার চিন্তার ক্ষেত্রে স্বাধীনতার অভাব হলে অগ্রগতি অসম্ভব। ফলে এই বিজ্ঞানের যুগে যুদ্ধ ভিন্ন অন্য সব ক্ষেত্রে মতামত সংক্রান্ত সমতার প্রচেষ্টা পরিশেষে সামরিক দক্ষতার সর্বনাশ সাধন করে।
আমরা এখন আসতে পারি এ দুটো গতানুগতিক উক্তির বাস্তব সংশ্লেষণে। সামাজিক বন্ধনের জন্য প্রয়োজন একটি ধর্মমত অথবা আচার-আচরণের একটি প্রচলিত রীতি অথবা প্রভাবশালী ভাবপ্রবণতা অথবা এ তিনের সংমিশ্রণ। একটি সম্প্রদায় ভেঙে পড়তে পারে এর কোনো একটি না থাকলে। ফলে কোনো অত্যাচারী বা বিদেশি শক্তির অধীন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এ ধরনের বন্ধন কার্যকরি হলে একে গভীরভাবে অনুভব করে নেয়া প্রয়োজন, তা বলপূর্বক আরোপিত হতে পারে সংখ্যালঘুর উপর, যদি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ব্যতিক্রমী বুদ্ধিবৃত্তি বা নৈতিকতার দিক দিয়ে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ না হয়। তবে তা অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠের ভেতর খুঁটি ও স্বতঃস্ফূর্ত হবে। ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত সামাজিক সংহতির উপায় হচ্ছে নেতার প্রতি আনুগত্য, জাতীয় গৌরব এবং ধর্মীয় উৎসাহ। কিন্তু নেতার প্রতি আনুগত্য আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন অপেক্ষাকৃত কম স্থায়ীভাবে কার্যকর। তার কারণ বর্তমানে সার্বভৌমত্বের উত্তরাধিকার হ্রাস পেয়েছে এবং মুক্তচিন্তার প্রসারের ফলে ধর্মীয় উৎসাহে ভাটা পড়েছে। সুতরাং একমাত্র জাতীয় গৌরব রয়ে গেল এবং তা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। খ্রিস্টবাদের মতো এত অধিক না হলেও এই অনুভূতির পক্ষে ক্ষতিকর অফিসিয়াল ধর্মমত থাকা সত্ত্বেও সোভিয়েত রাশিয়ায় লক্ষণীয়ভাবে আগ্রহের সৃষ্টি করেছে এর পুনরাবির্ভাব।
স্বাধীনতার উপর কতটুকু হস্তক্ষেপ প্রয়োজন জাতীয় গৌরব রক্ষার জন্য? মুলত হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্য তা-ই। রাশিয়ায় মনে করা হয় যে, যারা অফিসিয়াল মতামতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন রাষ্ট্রদ্রোহিতার আচরণ দেখানোই স্বাভাবিক তাদের পক্ষে। ইতালি ও জার্মানিতে সরকারের শক্তি নির্ভর করে সরকারের জাতীয়তাবাদী আচরণের উপর এবং যে কোনো বিরোধিতাই মস্কোর স্বার্থে হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। ফ্রান্সে স্বাধীনতাহানি ঘটলে বুঝতে হবে যে তা সম্ভবত জার্মানপন্থিদের বিশ্বাসঘাতকতা রোধের লক্ষ্যে করা হয়েছে। এসব দেশে শ্রেণি সংঘাতগুলোকে অতিক্রম করে যায়। ফলে গণতান্ত্রিক দেশে পুঁজিপতি এবং ফ্যাসিবাদী দেশে সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী দল জাতীয় স্বার্থ ভিন্ন অন্য স্বার্থের চেতনায় পরিচালিত হয়। এই সমস্যা কঠিন সরকারের জন্য। কারণ, জাতীয়তাবাদ একটি মূর্খতাপূর্ণ আদর্শ ও বুদ্ধিজীবীরা অনুধাবন করেন যে তা ধ্বংস এনেছে ইউরোপে। সবচেয়ে ভালো সমাধান হচ্ছে যে গণতন্ত্র কমিউনিজম বা সমষ্টিগত নিরাপত্তার মতো আন্তর্জাতিক স্লোগানের ছদ্মাবরণে নিয়ে আসে। জার্মানি ও ইতালির মতো যেসব দেশে তা করা যায় না, বাহ্যিক সমতা সেখানে অত্যাচারের জন্ম দেয়, কিন্তু জন্ম দেয় না বৈধ অন্তর্মুখী চেতনার। সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছে সামাজিক সংহতির জন্য অপরিহার্য কোনো একটি ধর্মমত। কিন্তু শক্তির উৎস হতে হলে অধিকাংশ জনগোষ্ঠী এবং কিছু সংখ্যক কুশলীদের দ্বারা তা অনুভূত হতে হবে একান্ত গভীরভাবে। যেখানে এ ধরনের অবস্থা নেই সরকার সেখানে বিপচন ও নির্যাতনের মাধ্যমে তা সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু বিপচন ও নির্যাতন কঠোর হলে তা বাস্তবতার বাইরে চলে যেতে পারে এবং বাধ্য করে গুরুত্বপূর্ণ সত্য সম্পর্কে অজ্ঞ থাকতে অথবা তা ভুলে যেতে। যেহেতু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা ক্ষমতার তাড়না দ্বারা প্রভাবিত সেহেতু স্বাধীনতার উপর যে পরিমাণ হস্তক্ষেপ জাতীয় শক্তির জন্য সবচেয়ে সহায়ক-তা সবসময়ই সরকারগুলোর বিশ্বাসের তুলনায় কম। তাই অরাজকতায় পর্যবসিত না হলে জাতীয় সংহতি বৃদ্ধি করতে পারে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে বিকীর্ণ অনুভূতি। কিন্তু বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া এসব চলে যেতে পারে সার্বজনীনতার বাইরে।