ক্ষত ও নিরাময় – তৃণাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়
এভাবে প্রশ্রয় দিচ্ছে কেন প্রবীরকে! তার মুখে মাসে দু-একবার মদের গন্ধ পেলে লিপিকা দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শোয়। কলকাতার যাবতীয় আবর্জনা নিয়ে বয়ে যাওয়া বাগজোলা ক্যানেল তাদের এই ভাড়াবাড়ি থেকে ইটছেঁড়া দূরত্বে। তাই সভনে মশায় এবাড়ি সারাক্ষণ ভরে থাকে। স্কুল থেকে ফিরেই লিপিকা জানালাগুলো দিয়ে দেয় পটাপট। তাই প্রথম বিকেল থেকেই ঘরে হাওয়া বাতাস ঢোকা বন্ধ। কিরকম যেন এক ভ্যাপসা গরমে এই ঘরে দুই বাসিন্দা লিপিকা আর রুদ্র ঘামতে থাকে। তার ওপরে দেয়ালের দিকে মুখ করে বিছানায় মশারির কোণে সরে গেলে তো আরও গরম লাগবে। লিপিকার আবার সামান্য গরমও সহ্য হয় না। মাঝে মাঝে মধ্যরাতে বিছানা থেকে নেমে ফ্রিজের কনকনে জল কচক করে গলায় ঢালে। সেই লিপিকাও মাসে দু-একদিন যেদিন রুদ্র মদ খেয়ে ফেরে, সেদিন দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে মশারির কোণে চলে যাবে। আর সেই লিপিকাই প্রবীরের এই মুহূর্তে এ বাড়িতে বসে মদ খাওয়াটাকে মেনে নিচ্ছে।
শুধু মেনে নিচ্ছে নয়, রুদ্র স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে, দু-চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছে, রীতিমত প্রশ্রয় দিচ্ছে প্রবীরকে লিপিকা। লিপিকা রান্নাঘরে গিয়েছিল। ছোট কাঁচের প্লেট হাতে ফিরে এসে লজ্জিত চাহনিতে বলল, টোম্যাটো সস আর পেঁয়াজ ছাড়া কিছু নেই এমুহূর্তে..
কাফি, কাফি, বলে দাড়ি চুলকে গোঁফের নিচে হাসি ভাসিয়ে তুলল প্রবীর। হাত বাড়িয়ে প্লেটটা নিয়ে নিল। সামনের ছোট বেতের টেবিলের ওপরে নামিয়ে রেখে বলল, একটু জল লাগবে….
হ্যাঁ, হ্যাঁ, দিচ্ছি…..। লিপিকা অত্যন্ত সহজভাবে ঘাড় নাড়ে এবং চলে যায়।
ঐ সহজতা রুদ্রর মাথার ভিতরে ঠোকর মারে। প্রবীরের মদ্যপানের বিরুদ্ধে কোন ধরনের প্রতিবাদ তো নেই-ই উল্টে পূর্ণ সহযোগিতা। এর রহস্য? চোয়াল মৃদু শক্ত হয়ে ওঠে রুদ্রর। জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়। অলস রোদের ভিতর দিয়ে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ছেলেমেয়েরা ভ্যানরিক্সায় বাড়ি ফিরছে। তার মানে বারোটা। তার মানে একতলায় গিয়ে রিজার্ভারের চাবিটা বন্ধ করে দিতে হবে। না হলে ওপরে জল আসবে না। লিপিকা স্কুলে চাকরি করে। রুদ্রকে তাই সামলাতে হয় ঘর সংসার। এতে অবশ্য কোন সমস্যা নেই রুদ্রর। উল্টে কিছুটা সুবিধা।
ঘরের কাজ করেও সময় পাওয়া যায় অনেকটা। দশটা পাঁচটার অফিস করলে কি এতটা সময় পাওয়া যেত। তখন কোথায় থাকত তার স্বপ্ন, তার স্বপ্নের কন, এই পৃথিবীতে তার অবস্থান হলেও, আসলে সেই যোজন যোজন দূরে, সেই ছবি আঁকা তখন কোথায় থাকত! এই বেশ ভালো আছে।
রুদ্র খদ্দরের পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে বেতের চেয়ার ছেড়ে একটু তাড়ার ভাব এনে উঠে দাঁড়াল। বলল, তুই বোস, আমি নিচে গিয়ে রিজার্ভারের চাবিটা বন্ধ করে দিয়ে আসি, না হলে সারাদিন আবার জল পাওয়া হবে না……।
বীর বলে উঠল, বোস কি রে! তুই খাবি না! ও চাবিটাবি পরে বন্ধ করলেও চলবে তুই বোস তো…..লিপিকার দিকে তাকিয়ে বলল, ঐ তো, ও বন্ধ করে দিয়ে আসবে। তুই বোস…..
রুদ্র এক মুহূর্ত হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইল। লিপিকা তার না প্রবীরের বৌ, বুঝতে পারল না। আরও অবাক হল এমন একটা কথার পরে লিপিকা নীরব! সে কথাগুলো বললে তো এ-মুহূর্তে বাতাসে আগুন ধরে যেত।
একদিন সবে রঙে তুলি ডুবিয়েছে রুদ্র। লিপিকা সেদিন বাড়িতে। মাধ্যমিকের মেয়েদের টেস্টের খাতা দেখছে। বিছানা থেকে দেয়ালঘড়ির ওপরে চোখ পড়ে যাওয়ায় লিপিকা বলেছিল, কি গো, নিচে গিয়ে রিজার্ভারের চাবিটা বন্ধ করে দিয়ে এসো না……
রুদ্র বিরক্ত হয়েছিল। রেগে গিয়েছিল। উঁচু স্বরে বারান্দা থেকে বলেছিল, আমি ক্যানভাসে রঙ চাপিয়েছি…..
আমি খাতা দেখছি….। উঁচু স্বরেই ফিরেছিল উত্তর।
তোমার খাতা দেখা আর আমার ছবি আঁকা এক হল!
সব মানুষের কাজই কাজ, এই যে শ্রদ্ধাপূর্ণ ভাবনাটা তোমার কথা থেকে মাঝে মধ্যেই বেরিয়ে আসে সেটা আসলে মুখোশ বলো…..
এই এক সমস্যা লিপিকার। সব সময় একটা উত্তর যেন ঠোঁট খুলে বেরিয়ে আসার জন্যে অপেক্ষা করছে জিবের ডগায়।
রুদ্র রীতিমত ক্ষেপে উঠেছিল। প্রায় চেঁচিয়ে বলেছিল, ছাত্রী পড়াতে পড়াতে তুমি সকলকেই তোমার ছাত্রী মনে করতে শুরু করেছ, ঘ সময় অমন দিদিমণিমার্কা কথা বলো না তো….
দিনিমণিমার্কা কথা! তার একটা মার্কা দিয়ে ফেলেছে এই কটা দিনে রুদ্র। ভাবতে ভাবতে অবাক হচ্ছিল লিপিকা। ও ক্ষেপে গেল। বলল, কেন এই দিনিমণির কথাই তো মাত্র কয়েকটা বছর আগেই তোমার ভালায় সূরণ ঘটাত, তখনও তো আমি দিদিমণি-ই ছিলাম….
তারপরে আর কোন শব্দ ছিল না। অসহ্য নীরবতা। লিপিকা বিরক্ত হচ্ছিল কালক্ষেরে জন্যে। তারপরে ত্রস্ত হয়ে সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে গিয়েছিল রিজার্ভারের চাবিটাকে বন্ধ করে দেবে বলে।
ঐ ঘটনার পরে রুদ্র অবশ্য নিজের সঙ্গে নিজেই একটা সমঝোতা করে নিয়েছিল। এ বাড়িতে, এ-সংসারে থেকে ছবি আঁকতে গেলে কিছু কিছু কাজ তাকে করতে হবে। যদি কাজের লোকও রাখে লিপিকা, সুও তাকে কিছু কাজ করতে হবে। তাই ও নিয়ে রাগ করলে চলবে না। মানে সে রাগ করবে না। ছবিকেই ভালোবেসেছে ধ্ব থেকে। তাই আর কিছুই ভাবেনি। স্কুলের গণ্ডিও পেরনো হয়নি। একটা নির্ভরতার তো প্রয়োজন। লিপিকা তো সেটা তাকে দিচ্ছে। তারও কিছু ক্য আছে। ব্যাপারটা রুদ্রর কাছে কর্তব্যে এসে ঠেকেছে। যেনবা এক সাংসারিক বিনিময় প্রথা। ছবি আঁকাকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে রক্ত-মাংসের যেটুকুকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। তার রসদ লিপিকার কাছ থেকে গ্রহণ, আর তার প্রত্যর্পণ হল সাংসারিক কাজকর্ম, দায়-দায়িত্ব। ব্যস এই, আর কি, এর বাইরে তো আর কিছু নেই। এমনই জানে রুদ্র। তাই একটা মাপজোক গুণভাগ করে একটা সম্পর্ক আজকাল সে বজায় রেখে চলে লিপিকার সঙ্গে।
আর আজ হঠাৎ অনেকদিন পরে এবাড়িতে হঠাৎ করে ঢুকে পড়ে এই সাংসারিক আবহাওয়া, একটা নিয়মের পরিবেশ। লিপিকার পছন্দ-অপছন্দের যে সীমারেখা তা যেন অতি সহজেই ভেঙে দিচ্ছে প্রবীর। কি করে হচ্ছে এটা। প্রবীর পেরে উঠছে? নাকি লিপিকাই ওকে পেরে উঠতে সাহায্য করছে।
প্রবীরের কোকড়ান দাক্সি ওপরে চোখ রাখতে রুদ্র কফিহাউসের দিনগুলোকে দেখতে পেল মুহূর্তের জন্যে। যোল-সতেরোজনের জমায়েত, মানে অতটুকু টেবিলে অতজন ধরে না, প্রথমে জনা-পাঁচেকের একটা বৃত্ত, তাকে ঘিরে আরেকটা বৃত্ত, তাকে ঘিরে ফের একটা, যেন গ্রহ-উপগ্রহের কক্ষপথ, সে পথে কফি জল নিয়ে চলাফেরা করা বেয়ারারা আটকে যায়, ধমক দেয়, কিন্তু সে শোনে ধমক, গ্রহ-উপগ্রহেরা তো তখন তুমুল আলোচনায় ব্যস্ত, ছবি আঁকিয়ে রুদ্র, কবিতা ও লিটিল ম্যাগাজিন নিয়ে থাকা প্রবীর, এম টেকের শ্যামল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়তে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়তে আসা সায়নী আর নম্রতা, দুপুরে অফিসেঅফিসে স্টেশনারি সাপ্লাই দেওয়া আর সন্ধ্যেবেলায় গ্রুপ থিয়েটারের রিহার্সাল করা অৰ্বিাণ—কে না থাকত আড্ডায়! লিপিকা বি.এড পড়তে এসে জুটে গেল।
পুরোদস্তুর ঝালমুড়ি-আড্ডা। আচ্ছা চলাকালীন কে যেন একবার হো-হো করে হেসে উঠে কথাটা বলেছিল। তারপরে সকলে। প্রবীর শুধু হাসেনি। সিরিয়াস স্বরে বলেছিল, ব্যাপারটাকে এরকম চিপ করে দাম না, ঝালমুড়ি-আড্ডা না বলে বল এই সময়ের আড্ডা। প্রবীর কবিতা লিখত। কথা বলত কবিতার মত। সমস্ত জীবনটাকে কবিতা করে নিতে চেয়েছিল। এমন এমন কথা বলে উঠত, আর গতি থেমে যেত। সকলেই চিন্তাশীল হয়ে উঠত। রুদ্র লক্ষ করেছে কয়েক মুহূর্তের জন্যে আড্ডা থামিয়ে সকলেই প্রবীরের কথাগুলো নিয়ে ভাবলেও শেষ পর্যন্ত প্রবীরের কথা বা প্রবীরের ব্যাপারে কেউই উৎসাহী হতো না। কাউকেই প্রবীর উৎসাহী করতে পারেনি কখনও তার প্রতি। মেয়েদের মধ্যে কোন আবেদনই তৈরি করতে সক্ষম হয়নি প্রবীর।
কিন্তু আজ রুদ্রের মনে হচ্ছে প্রবীর সম্পর্কে যা ভেবেছে, যা জেনেছে তা হয়ত সবই ভুল। লিপিকার হৃদয়ের গভীর আড়ালে প্রবীরের প্রতি ক্ষীণ একটা দুর্বলতা হয়ত আছে। রয়ে গেছে এখনও। হয়ত ভেবেছিল কবিতা-লিটিল ম্যাগাজিন গায় বাড়ি—কিছুই না করার ইচ্ছে-এমনকি একটা ছোট সম্পর্ক, একটু প্রেম প্রেম খেলা—সেই সরে ইচ্ছে নেই—ছন্দ মাত্রা শব্দ শরীর আর অপার ভাবাবেগের কথা শুধু মাঝেমাঝে কথা থামিয়ে ড্যান্ড্যা করে তাকাত লিপিকার দিকে। প্রবীরের। অনুপস্থিতিতে ওর কথা উঠলেই লিপিকা হাসতে হাসতে বলত, কিরকম ছাগলের মত চোখ দুটো না! কথাটা শেষ হলেও লিপিকার হাসি যেন শেষ হতে চাইত না।
কিন্তু আজ রুদ্রর মনে হচ্ছে ঐ হাসিটা নিখুঁত অভিনয় ছিল লিপিকার। মনের নিভৃত কোণে প্রবীরের ব্যাপারে রয়ে গিয়েছিল অন্য কোন ছোঁয়া। না হলে এমনভাবে। প্রশ্রয়টাকে বাড়িয়ে তুলছে কেন লিপিকা। প্রবীর দীর্ঘদিন পরে ওদের সঙ্গে দেখা করবে বলে হঠাৎ করে এবাড়িতে ঢুকে পড়ার পর থেকেই লিপিকার মধ্যে রুদ্রর প্রতি একটা প্রবল রাগ একটু একটু করে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। এটা জানে রুদ্র। বুঝেছে রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। মেটাক না, যত খুশি রাগ মেটাক লিপিকা। কিন্তু অত তাড়ার কি আছে। আগে প্রবীর বাড়ি থেকে চলে যাক। একটা ছোট মিথ্যে গল্প, একটা কিছু সাজিয়ে আগে প্রবীরকে বাসে তুলে দিয়ে আসুক, তারপরে নয় হবে। অথচ তা না করে এ-মুহূর্তে প্রবীরকেই যেন একটা অস্ত্র করে নিয়ে তুলে ধরেছে তার বিরুদ্ধে সেই রাগটাকে মিটিয়ে নেওয়ার জন্যে। এটা কি শুধু রাগ মেটানো, নাকি
একভাবে পুরনো বন্ধুর প্রতি ঘুমিয়ে থাকা পুরনো রোমাঞ্চকে জাগিয়ে তোলা?
নিচে রিজার্ভারের চাবি বন্ধ করার জন্যে এ-ঘর থেকে যাওয়ার সময় দেখেছিল দুটি গ্লাসে দুটি পেগ বানিয়ে ফেলেছে প্রবীর। নিচে চাবিটা বন্ধ করে ওপরে ফিরে আসতে একটা বেশিই সময় নিয়েছিল রুদ্র। ওপরে ফিরে মদ ঢালা গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তো খাবো না…..
প্রবীর অবাক হয়ে বলল, খাবি না মানে।
খাবো না মানে এ-সময় আমি খাই না—
এ সময় তুই খাস্ না। কথাটা বলে প্রবীর হো হো করে হেসে উঠেছিল। লিপিকার চোখে তাকিয়ে নিয়ে বলল, বিয়ের পরে খুব উন্নতি হয়েছে রে, তোর….
রুদ্র চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, উন্নতির কি হল এতে, সাতসকালে তুই ছাড়া দেশে মদ্যপান করেটা কে!
রুদ্র লক্ষ করল একথায় প্রবীরের মধ্যে সামান্য ভাবান্তও ভেসে উঠল না। নিজের গ্লাসে জল ঢেলে বলল, দেখ তোর গ্লাসে কতোটা জল ঢালব….
আমি খাবো না প্রবীর…। রুদ্রর স্বর এখন বেশ গম্ভীর। আড়চোখে তাকাল লিপিকার দিকে। আশা করেছিল লিপিকার দিক থেকেই সকালবেলাতেই মদ্যপানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আসবে। অথচ রুদ্র দেখল লিপিকার দু-চোখে নীরতার ভিতরে শুধু প্রশ্রয়। খুব কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিতে প্রবীরের গ্লাসের মদে জল মেশানো দেখছে।
একটা গ্লাস উঁচু করে রুদ্রর দিকে তুলে ধরল প্রবীর। বলল, কফিহাউসের দিনগুলো মনে পড়ে, তখন তো কোন কোনদিন তুই আর আমি মদ দিয়ে মুখ ধুয়েছি…..
রুদ্র বলল, তাই বলে আজীবন সেগুলোকে রক্ষা করতে হবে নাকি, আর রক্ষা করতে না পারলেই কি সেটার নাম দিবি পালিয়ে আসা। বোগাস…যতসব….
প্রবীর গ্লাসটাকে রুদ্রর আরও কাছে এগিয়ে দেয়। বলে, ঝগড়া করছিস কেন! আমি কি তোর কাছে ঝগড়া করতে এসেছি!
ঝগড়া নয়, ঝগড়া নয়। কথা দুটো বলে প্রবীরের হাত থেকে ঝপ করে গ্লাসটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ঠক্ শব্দে নামিয়ে রাখল টেবিলের ওপরে। প্রবীরের মনে হল আজ রুদ্র তার সঙ্গে বসে মদ্যপানই করছে না, ডাক্তারের নির্দেশে কোন তেতো ওষুধ যেন গিলছে।
লিপিকা ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা বোসো তাহলে, দেখি পাশের পাড়া থেকে কিছু আনা যায় কিনা….
প্ৰবীর বলল, পাশের পাড়া কেন।
এ-পাড়ায় তো আজ সব দোকান বন্ধ। আজ সোমবার না, এ-পাড়ায় সব দোকান বন্ধ থাকে….
লিপিকা পায়ে স্লিপার দিয়ে বেরিয়ে গেল। আর রাগে গা রি-রি করে উঠল রুদ্রর। প্রবীরের প্রতি লিপিকার এতোটা আতিথ্যের হেতু! মাসের মধ্যে একদিন-দুদিন তার মুখ থেকে মদের গন্ধ যার কাছে অসহ্য, সে-ই এখন মদের চাটের জন্যে পাশের পাড়ার দোকানে ছুটছে!
সকালে হঠাৎ করে প্রবীর যখন ঢুকে পড়েছিল এ বাড়িতে, চমকে ওঠে রুদ্র। শেষ পর্যন্ত চলে আসবে কল্পনাতেও আনতে পারেনি। আজকাল তেলরঙের কাজ আর করে না রুদ্র। করে না বললে ভুল। আসলে ক্যানভাসের ওপরে তেলরঙের কাজে যে ছবি, স্রষ্টার এক একটি অনিন্দ্য সুন্দর ভাবনা ফুটে ওঠে, তা আর আজকাল রুদ্রর কল্পনার জগতে স্থান করে নিতে পারে না। আজকাল আর ভাবনার জন্ম হয় না তার মস্তিষ্কে। আর হয়েই বা কি লাভ! ছবিগুলো তৈরি হওয়ার পরে একজিবিসান করো। এখানে পাঠাও, ওখানে পাঠাও। সে অনেক পরিশ্রমের ব্যাপার। তার থেকে কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় বড়ো প্রকাশকের ঘরে বই-এর প্রচ্ছদ, লে-আউট করলে পয়সা খারাপ পাওয়া যায় না, পরিশ্রমও কম।
কিন্তু লিপিকা বলে, তোমাকে অত পয়সার চিন্তা কে করতে বলেছে! সে তো আমার দায়িত্ব, তুমি শুধু মন দিয়ে ছবি এঁকে যাও।
উত্তরে রুদ্র ঠোঁট ফাঁক করে সিগারেটের ধোঁয়া সরু করে ছেড়ে দিয়েছিল ঘরের সিলিঙের দিকে। বলেছিল, ধুস, যা বোঝে না তা নিয়ে অতো কথা বললো কেন—
এক বাকরুদ্ধ ব্যথায় কঁকিয়ে উটেছিল লিপিকার ভিতরটা। সে বলতে পারেনি তুমি ঠিকই বলেছো, আমি ছবির কিছু বুঝি না। কিন্তু আমি তো কোনদিন ছবি বুঝতে চাইনি, বুঝতে চেয়েছি শুধু আঁকিয়ে মানুষটাকে, সেই যে কফিহাউসের দিনগুলোতে তোমার ক্ষয়াটে গাল, সামান কোটর গর্ত চোখ, চোখের নিচে কালি, দীর্ঘ নাকের নিচে শুয়োপোকার রোমের মত গুঁড়োগুড়ো গোঁফ, অধজ্বলন্ত বিড়ি আর অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত ভাবনা কথা, আমি যে সেই রুদ্রকেই ভালোবেসেছি। সেই রুদ্রকেই চেয়ে এসেছি বরাবর। এই যে এখন তুমি পরিণত, দাবানলের মত আবেগ আর কণ্ঠ বেয়ে ঝরে পড়ে না, কখন কাকে কি কথা বললে সন্তুষ্ট করা যাবে জেনে গেছ, এখন তোমার গাল আর ক্ষয়টে নয়, হাসলে মেদ ঢেউ তোলে থুতনির নিচে, বিড়ি নয়, কিংসাইজ এখন তোমার ঠোঁটে, এই উজ্জ্বল রুদ্রকে যে আমি কোনদিনও চাইনি, এই উজ্জ্বল রুদ্র তো আসলে রুদ্রর মৃতদেহ….। লিপিকা বুঝেছিল এইকথাগুলো তার পক্ষে রুদ্রকে বলা সম্ভব হয়নি। কারণ ঐ শেষের ভয়ঙ্কর শব্দটা তার পক্ষে উচ্চারণ করা কঠিন ছিল।
কলেজ স্ট্রিট পাড়ার প্রকাশকের ঘর থেকে ফেরার পথে কফিহাউসের দরজায় দেখা হয়ে গিয়েছিল প্রবীরের সঙ্গে। চমকে উঠেছিল রুদ্র, এ কি চেহারা করেছিস। রুদ্র দেখেছিল চুল উঠে মাথার ওপরে জায়গায় জায়গায় টাক পড়ে গেছে প্রবীরের। গাল আরও ঢুকে গেছে। দুচোখে অদ্ভুত এক হলুদ ছোঁয়া। যেন অনন্ত জন্ডিস ওর সঙ্গী। কি করছিস? রুদ্রের প্রশ্নের উত্তরে প্রবীর ওর সম্পাদনায় সাত বছর ধরে চরম নিয়মিত ভাবে প্রকাশপাওয়া লিটিল ম্যাগাজিনের নবতম সংখ্যাটি ধরিয়ে দিয়েছিল প্রশ্নকর্তার হাতে। আর ফিসফিস করে বসেছিল, কোন জায়গা থেকে ধরে কিছু টাকার। ব্যবস্থা করে দে না, আগামী ইস্যুটা না হলে বেরবে না, দরকার হলে সুদ দেবো…।
রুদ্র প্রায় হেসে ফেলেছিল। শীর্ণ প্রবীর আরও শীর্ণ হয়েছে। লাঠির মত সরলরেখা হয়ে গেছে। মানুষটাই নেই। আসলই নেই, সেখানে সুদ আসবে কোথা থেকে। তাই বলেছিল, এভাবে নিজেকে ক্ষয় করে কি লাভ—
প্রবীর যেন চমকে উঠেছিল ওর কথায়, এটাকে তুই ক্ষয় বলছিস। এটা যে কি…..
তারপর নিজের থেকেই কথার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল প্রবীর। বলেছিল, ঠিকানাটা দে, একদিন যাবো….।
ঠিকানা দিয়েছিল রুদ্র। তারপর লিপিকার কথা জিজ্ঞেস করায় রুদ্র বুঝেছিল তাদের বিয়ের কথাটা প্রবীর জানে না। মজা করার একটা ইচ্ছে ভিতরে প্রবল হয়ে উঠেছিল রুদ্রর। বলেছিল, আমার সঙ্গে আর দেখা হয় না রে, তোর সঙ্গে হয়?
লিপিকার সঙ্গে রুদ্রর আর দেখা হয় না শুনে প্রবীর অবাক হয়েছিল। কফিহাউসের সেই আড্ডার সকলেই তো জানতো মাটির বুক থেকে হিমালয়কে সরিয়ে দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু লিপিকার জীবন থেকে রুদ্রকে বা রুদ্রর জীবন থেকে লিপিকাকে আলাদা করা যাবে না কোনদিন। সেই লিপিকার সঙ্গে রুদ্রর এখন আর দেখা হয় না। আবেগে প্রবীর মনের রুদ্ধ গোপন দ্বার খুলে ধরেছিল রুদ্রর সামনে। বলেছিল, আমি জানতাম ও কোথাও নোঙর করবে না, শুধু এ-ঘাট থেকে ও-ঘাট, ও-ঘাট থেকে সে-ঘাটে ঘুরে বেড়াবে…..। এক কপট সিরিয়াস ভাব মুখে চোখে আটকে সেই মুহূর্তে প্রবীরের কথাগুলো শুনছিল রুদ্র। আর সেটাই যেন প্রবীরের কথা বলার উৎসাহকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। আর রুদ্র তখন ভিতরে ভিতরে হোহো করে হাসছিল।
আজ সকালে এবাড়িতে ঢুকে সিঁথিতে সিঁদুর টানা, হাতে শাঁখা-পলা পরা লিপিকাকে দেখে চমকে ওঠে প্রবীর। সেই মুহূর্তে যে কি চরম অস্বস্তিতে কেটেছে তা একমাত্র রুদ্রই জানে। আসলে সে তো কল্পনাও করতে পারেনি, প্রবীর শেষ পর্যন্ত চলে আসবে। আর সকালের সেই পর্বের রুদ্র আর প্রবীরের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে লিপিকাও জেনছে রুদ্র তাদের বিয়ের কথাটা প্রবীরকে জানায়নি। প্রবীরের দুটি বিহ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝেছে জানায় তো নি, উল্টে প্রবীরকে নিয়ে এক নিষ্ঠুর কৌতুক করেছে রুদ্র। কেন? কেন? কেন এরকম হয়ে উঠেছে রুদ্র। এখন তো রুদ্রর জীবনে ব্যথা অনিশ্চয়তা ব্যাপারগুলো কতো কমে গেছে। তাহলে রুদ্র এমন নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে কেন। আচ্ছা, ব্যথা মরে গেলেই কি মানুষ এমন নিষ্ঠুর কৌতুকপ্রিয় হয়ে ওঠে! না, না, ব্যথা নয়, অন্য কোন কিছু মরে গেলেই বোধহয় মানুষ এমনই কৌতুকে মেতে ওঠে। কিন্তু সেটা কি? ঠিক বুঝে উঠতে পারে না লিপিকা।
দু পেগ মদ সাত-সকালে শরীরে যাওয়ায় স্নায়ুগুলো সব ধনুকের মত টানটান ছিলা হয়ে উঠেছে রুদ্রর। রান্নাঘরে আসতে দেখল ডিমের ঝুরি ভাজছে লিপিকা। ওর ঠিক মনে আছে, প্রবীরের প্রিয় চাট কি। এ-পাড়ায় দোকান বন্ধু বলে পাশের পাড়ার দোকান থেকে ডিম-পেঁয়াজ নিয়ে এসে ঝুরি ভাজছে লিপিকা। রান্নাঘরের চৌকাঠের কাছে এসে রুদ্র দাতের সঙ্গে দাঁত ঘষে বলে, এটা কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না!
কিসের বাড়াবাড়ি?
ওকে তুমি মদ খেতে অ্যালাও করলে কেন?
অ্যালাও করার কি আছে। তোমার পুরনো বন্ধু, একসঙ্গে অনেক মদ খেয়েছ, তাছাড়া আড্ডার মাঝখানে ও যেভাবে বোতলটা বের করে ফেলল, তাতে না বলার সুযোগটা পেলাম কই……
সুযোগ পেলাম কই, রাগে রুদ্র ভেংচে উঠল। কেন, আমার মুখ থেকে তো মাঝেমধ্যে গন্ধ পেলে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শোও, তাও তো আগের মত রেগুলার খাই না….
তুমি তো নিজের জন্যে খাও না, তুমি তো এখন মদ খাও তোমার প্রয়োজনের লোকদের খুশি করার জন্যে, আর আজ যা বুঝলাম তা হল প্রবীর খায় শুধু নিজের জন্যে….
তাতে হয়েছেটা কি! এবার শুধু দাঁত্রে সঙ্গে দাঁত নয়, রুদ্রর শরীরে হাড়ের সঙ্গে হাড় ঢুকে যায়।
লিপিকার ভিতরে এসব কিছু তেমন কোন রেখাপাত ঘটাতে পারে না। নির্লিপ্ত স্বরে বলে, হবে আবার কি, বলছিলাম শুধু তফাতটার কথা। ও আর তোমার তফাৎ, তুমি অনেক দূর এগিয়েছ, অনেক সুন্দর হয়েছ, কিন্তু তুমি আর তুমি থাকতে পারোনি, ও ক্ষয়েছে, ক্ষয়ে ক্ষয়ে আর শীর্ণ হয়েছে, কিন্তু ও প্রবীরই রয়ে গেছে। এখনও সেই আগের মতই ব্যথা পেতে জানে। সকালে ও যখন সবে এবাড়িতে ঢুকেছে, দেখলে না আমার সিঁথিতে সিঁদুর দেখে কিরকম বিহ্বল হয়ে পড়ল। কেন তুমি জানাওনি ওকে আমাদের বিয়ের কথাটা…
রুদ্র মেঝের ওপরে দৃষ্টি নামিয়ে আনে। বলে, বিশ্বাস করো, অতো ভেবেচিন্তে ব্যাপারটা আমি করিনি। সেদিন ওর সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে হঠাৎ করে ওকে নিয়ে একটু মজা করতে ইচ্ছে হয়েছিল…
মজা! হাঁ করে রুদ্র দিকে তাকাল লিপিকা। বলল, তুমি না শিল্পী, ছবি আঁকো!
আঁকি তো। এবার রুদ্রও অবাক।
প্রবীর, তো কবিতা লেখে, লিটিল ম্যাগাজিন করে, ও তো তোমারই মতো শিল্পী, একজন শিল্পী আরেকজন শিল্পীকে নিয়ে এভাবে মজা করতে পারে। কৌতুকপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে। তুমি না আমায় ভালোবেসে বিয়ে করেছিলে। লিপিকা কিরকম যেন কঁকিয়ে ওঠে। বলে, তোমার ভিতরে শিল্পী-মানুষটা মরে গেলে আমি কাকে ভালোবাসবো বলল তো….
এখন রাত্রি-সমুদ্রের নীরবতা এই জনবসতিপূর্ণ লোকালয়ের ঘরটিতে।
রুদ্র ধীর পায়ে রান্নাঘরের সামনে থেকে সদরের দিকে চলে আসে। প্রবীর বলেছিল সিগারেট ফুরিয়ে গেছে। সিগারেট আনতে হবে এখন। সিগারেট আনা নয়, রুদ্র আসলে পালাল। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বুঝতে পারছিল, কেন সকাল থেকে লিপিকা প্রবীরের মদ খাওয়াটাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। প্রবীর তো আসলে মদ্যপান করছে না। প্রবীর তো আসলে তার শরীরে সৃষ্ট ক্ষতের নিরাময় করছে। যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে। রুদ্রের কৌতুক।