ক্ষতিপূরণ
আমি দাঁড়িয়েছিলাম অ্যারিজোনার টুসন বিমান- বন্দরে৷ যাব শিকাগো শহরে৷ আটটা বাজতে দশ মিনিট বাকি৷ ওদেশে সন্ধে হয় খুব দেরিতে, তখনও আকাশে আলো আছে৷ আমি লাউঞ্জের বাইরে এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম৷ প্লেনটা আসতে দেরি করছে, আর সেই জন্য ছটফটানি শুরু হয়েছে আমার মনে৷ শিকাগো পৌঁছতে খুব বেশি রাত হলেই মুশকিল৷ কারণ শিকাগো এয়ারপোর্টে আমার এক বন্ধু গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবে, তার গাড়িতে আমি যাব সিডার র্যাপিড নামে একটা ছোট্ট শহরে৷ সেটা আরও প্রায় দুশো মাইল দূরে৷ গাড়িতে যেতে ঘণ্টা তিনেক লেগে যাবে৷
আটটা বেজে পাঁচ মিনিট প্লেনটাকে দেখা গেল আকাশে একটা গোল চক্কর দিয়ে নামছে৷ এই প্লেনটা আসছে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে, ওখানে বিকেলবেলা খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল খবর পাওয়া গেছে৷
প্লেনটাকে দেখেই আমি কাউন্টারের দিকে ছুটলাম৷ টিকিট ‘ওকে’ করে নিতে হবে৷ প্লেন এসে না পৌঁছলে ওরা টিকিটের এই ছাড়পত্র দেয় না৷ কাউন্টারে আমার সামনে মাত্র আর একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে, অর্থাৎ আমি দ্বিতীয়! আমার টিকিট ‘ওকে’ হবেই, কোনো চিন্তা নেই৷
আমার সামনের লোকটি ছোটোখাটো দৈত্যের মতন৷ লম্বায় সাড়ে ছ-ফুট তো হবেই, তেমনি চওড়া৷ গায়ে একটা জারকিন৷ লোকটি পেছন ফিরে একবার আমার দিকে তাকাল৷ লোকটি মুলাটো, অর্থাৎ পুরোপুরি শ্বেতাঙ্গও নয়, কালোও নয়৷ মাথার চুল কোঁকড়া, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা৷
ওদের নিয়ম অনুযায়ী আমার চোখাচোখি হতেই লোকটি বলল, হাই! আমি বললুম হাই! লোকটি তারপর বলল, গোয়িং টু শিকাগো? আমি বললুম ইয়া!
লোকটির কী গুরুগম্ভীর গলা!
লোকটির কাঁধে ঝোলানো শুধু চামড়ার ব্যাগ৷ আর কোনো মালপত্র নেই৷ কাউন্টারের লোকটি এসে দাঁড়াতেই আমার সামনের লোকটি ব্যাগ খুলতে গেল৷ আমি বোধহয় অতি উৎসাহের চোটে একটু সামনে ঝুঁকেছিলাম, তারপরেই একটা কাণ্ড হয়ে গেল!
লোকটির হাত যে অত লম্বা তা আমি বুঝতে পারিনি, ব্যাগ খুলতে গিয়ে লোকটির একটা কনুই পিছিয়ে এসে সোজা ধাক্কা মারল আমার বাঁ চোখে৷ আমি বাংলায় ‘বাপরে’ বলে চিৎকার করে বসে পড়লুম!
তারপর কী হল আমি চোখে দেখতে পাইনি৷ আমার চোখ দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে৷ নানান লোকের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, দু-এক মিনিটের মধ্যেই কারা যেন আমায় সাবধানে তুলে শুইয়ে দিল স্ট্রেচারে৷ তারপরই অ্যাম্বুলেন্সের প্যাঁ পোঁ শব্দ৷ আমি অজ্ঞান হইনি, অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যেও আমার মনে পড়ছে, আমার ওই প্লেনটা আর ধরা হল না৷ শিকাগো এয়ারপোর্টে আমার বন্ধু গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে৷
এক ঘণ্টার মধ্যে ডাক্তাররা আমার চোখ পরীক্ষা করে ওষুধ লাগিয়ে, মস্ত বড়ো একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে দেবার পর আমি জিজ্ঞেস করলুম, আমি কি এরপর পৌনে দশটার প্লেন ধরতে পারব?
বড়ো ডাক্তার জানালেন তার কোনো প্রশ্নই ওঠে না৷ আমাকে এখানে অন্তত তিনদিন শুয়ে থাকতে হবে৷ তাঁদের কথা যদি আমি না শুনি তাহলে আমার বাঁ চোখটা চিরকালের মতো নষ্ট হয়ে যেতে পারে৷
কী আর করি, আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললুম! একটা চোখ কে আর নষ্ট করতে চায়৷ বিদেশ-বিভুঁইয়ে একটা হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে থাকতে হল আমায়৷ এর আগে দেশে বা বিদেশে কক্ষনো আমি হাসপাতালে থাকিনি৷
এই হাসপাতালের প্রত্যেক কেবিনে একটা করে টেলিভিশন সেট৷ নার্স সেটা চালিয়ে দিয়ে গেছে৷ এক চোখে ব্যান্ডেজ বাঁধা বলে অন্য চোখটাও খুলতে কষ্ট হচ্ছে আমার৷ তা ছাড়া এখন টেলিভিশনের প্রোগ্রাম দেখার মেজাজও নেই৷ কথা আর গানবাজনাগুলো শুনতে পাচ্ছি৷ দশটার সময় শুরু হল খবর৷ টেলিভিশনে খবর পড়াটা এরা খুব আকর্ষণীয় করে তোলে৷ প্রথমে একজন খবর বলে নিউ ইয়র্ক থেকে, তারপর সেই লোকটি হঠাৎ কথা থামিয়ে বলে, হ্যালো জ্যাক, হোয়াটস আপ দেয়ার? অমনি দেখা যায় তিন হাজার মাইল দূরে ক্যালিফোর্নিয়ায় বসে আছে আর একজন, সে তখন ওদিককার খবর বলে৷ এমনিভাবে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে আর একজন৷ কখনো কখনো জাপান, ভিয়েতনাম, ফ্রান্স বা আফ্রিকা থেকেও ওদের প্রতিনিধিকে সরাসরি খবর বলতে দেখা ও শোনা যায়৷ এনবিসি নিউজের জ্যাক রবসনের খবর পড়া আমার বেশ ভালো লাগে৷ সে শুরু করতেই আমি কান খাড়া করলুম৷ জ্যাক প্রথমেই বলল, আজ সন্ধেবেলা ফ্লাইট নম্বর পাঁচশো বাহাত্তর হাইজ্যাকড হয়েছে!
উত্তেজনায় সঙ্গে সঙ্গে আমি উঠে বসলুম৷ অতি কষ্টে ডান চোখটা মেলে তাকালুম টেলিভিশন সেটের দিকে৷ ফ্লাইট নম্বর পাঁচশো বাহাত্তর? ওই প্লেনটাতেই তো আমার যাওয়ার কথা ছিল!
এই প্রথম সেই দৈত্যের মতো চেহারার মুলাটো লোকটির উপর আমার খুব রাগ হল৷ ওই লোকটা তার লম্বা ধেরেঙ্গা হাতের কনুই দিয়ে আমায় খোঁচা মারল বলেই তো আমি এমন একটা দারুণ সুযোগ হারালুম; হাইজ্যাকিংয়ের সময় সেই বিমানে থাকার ইচ্ছে আমার অনেক দিনের! যারা হাইজ্যাকিং করে তারা তো যাত্রীদের মারে না, সব ব্যাপারটা বেশ দেখা যায়৷
জ্যাক রবসন আরও জানাল যে হাইজ্যাকড প্লেনটা প্রথমে যাচ্ছিল কিউবার দিকে, কিন্তু সেখানে খোঁজ নিয়ে শোনা গেছে, কিউবায় সেটা নামেনি, সেটা উড়ে গেছে ‘আননোন ডেস্টিনেশনের’ দিকে৷ আননোন ডেস্টিনেশন, সে যে আরও রোমাঞ্চকর ব্যাপার৷ আমি নিরাশ হয়ে পড়লুম৷
বেল বাজিয়ে নার্সকে ডাকলুম একবার৷
ছোট্টখাট্ট চেহারার ফুটফুটে নার্স এসে দরজার কাছে দাঁড়াতেই আমি জিজ্ঞেস করলুম, সিস্টার, আমাকে এখানে কে ভরতি করে দিল?
নার্স বললে, তোমাকে তো নিয়ে এসেছে এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি স্টাফ৷
যে লোকটা আমায় কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরেছে সে আসেনি?
তোমায় কে ধাক্কা মেরেছে? সে কথা তো কেউ বলেনি!
হ্যাঁ, আমার সামনের লোকটির কনুইয়ের ধাক্কাতেই তো…
সে কথা তাহলে তুমি পুলিশকে জানাতে পারো৷ লোকটির নাম জানো তুমি?
নাম জানি না! তবে চেহারাটা স্পষ্ট মনে আছে৷
সেই কথাই পুলিশকে জানিয়ো, পুলিশ ঠিক নাম বার করে ফেলবে৷ তারপর ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারো তার কাছ থেকে৷
আচ্ছা থাক, পরে ভেবে দেখব৷ টিভি বন্ধ করে বাতি নিবিয়ে দিয়ে যাও৷
এদেশে সব ব্যাপারেই ক্ষতিপূরণ৷ সামান্য সামান্য ব্যাপারে মামলা করেই অনেকে টাকা পেয়ে যায়৷ মামলা না করলেও ইনসিওরেন্স কোম্পানি দেয়৷ আমার এক বন্ধু হিচ হাইকিং করার সময় একটা গাড়িতে বিশ পয়সার রাইড নিয়েছিল, সেই গাড়িটা অ্যাকসিডেন্ট করল ব্লুমিংটন শহরের কাছে, আমার বন্ধুটির একটা পা মুচকে গিয়েছিল শুধু৷ খুবই সামান্য ব্যাপার, একটু চুন-হলুদ লাগালেই সেরে যাবার মতন৷ তাতেই ক্ষতিপূরণ পেয়ে গেছে দু-হাজার ডলার৷
বিদেশে বেড়াতে এসে ওসব ঝঞ্ঝাটের মধ্যে যাবার ইচ্ছে আমার নেই৷ পুলিশের সঙ্গে কে নিজেকে জড়াতে চায়! তবু আমি মনে মনে বললুম লোকটা খুব অভদ্র তো! হয়তো সে ইচ্ছে করে আমায় ধাক্কা দেয়নি; তবু আমার কাছে এসে একবার অন্তত দুঃখ প্রকাশ করা উচিত ছিল তার!
চোখের যন্ত্রণায় ঘুম আসছে না৷ শুয়ে শুয়ে আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে লাগলুম! কমিকসের গল্পের ছবির মতন যেন দেখতে পেলুম, সমুদ্রের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে ফ্লাইট নম্বর পাঁচশো বাহাত্তর; ওর ভেতরে ককপিটের সামনে পাইলটের কপালের কাছে পিস্তল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিমান-দস্যু..সবাই ভয়ে মুখ ফ্যাকাশে করে আছে৷ …হঠাৎ আমার মনে হল, ওই দৈত্যের মতন চেহারার লোকটাই বিমানদস্যু নয় তো? ওর চেহারা তো ঠিক ডাকাতেরই মতন! হয়তো ওর আরও সঙ্গী ছিল? বিমানটা ছিনতাই করে বোধহয় চলে যাচ্ছে আফ্রিকার কোনো দেশে…৷ বেশ একখানা গল্প ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে পড়লুম একসময়ে৷
পরদিন সকালেই কাগজে বড়ো বড়ো করে খবর বেরুল, ওই হাইজ্যাক করা বিমানটা আকাশেই ধ্বংস হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে পড়েছে গালফ অফ মেক্সিকোতে৷ ছাপান্নজন যাত্রীর মধ্যে একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি; সবাইকে মৃত বলে ধরে নেওয়া যায় নিশ্চিতভাবে৷ দুর্ঘটনা হয় রাত সাড়ে দশটায়, তারপর শেষ রাত পর্যন্ত সার্চ পার্টি সেখানকার সমুদ্র এলাকা খোঁজাখুঁজি করেও কাউকে উদ্ধার করতে পারেনি৷ পৃথিবীর সব কাগজেই বেরিয়েছিল এই খবর৷ খবরটা পড়ে যে আমার কী মনে হল কী বলব! ওই শীতের দেশেও সারা গায়ে ঘাম এসে গেল, ঝিম ঝিম করতে লাগল মাথাটা৷ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলুম৷ ওই প্লেনে আমার থাকার কথা ছিল৷ চোখে এই ধাক্কাটা না লাগলে, এতক্ষণে আমার দেহটা টুকরো টুকরো হয়ে গালফ অফ মেক্সিকোতে ভাসছে আর হাঙরে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে৷
খবরের কাগজটা তন্ন তন্ন করে পড়লুম৷ প্লেনটা কেন ভেঙে পড়ল তার কারণটা ঠিক জানা যাচ্ছে না৷ পাইলট প্রথমে খবরটা জানাবার পর আর কিছু বলতে পারেনি৷ খুব সম্ভবত প্লেনের মধ্যে গুলি চলেছে৷ পুলিশের লোক বলেছে যাত্রীদের মধ্যে একজন নাকি নেভাডার লাস ভেগাস শহরে জুয়া খেলে সর্বস্বান্ত হয়েছিল, তারপর পাওনাদারদের তাড়া খেয়ে পালিয়ে এসেছিল টুসন-এ, সেখান থেকে প্লেন হাইজ্যাক করে অন্য দেশে আশ্রয় নেবার মতলবে ছিল৷ তারপর কী হয়েছে কেউ জানে না৷
আমার কেন যেন দৃঢ় ধারণা হয়ে গেল, সেই দৈত্যের মতন মুলাটো লোকটাই এসব কাণ্ড করেছে৷ লাইনের একেবারে প্রথমে এসে দাঁড়িয়ে ছিল৷ এরকম কাণ্ড হবার পরও একটুও অপেক্ষা করেনি৷ এত ব্যস্ত ছিল প্লেনটা ধরবার জন্য৷
দুপুরের দিকে আমার মনে হল, ওই লোকটা ইচ্ছে করেই আমায় ধাক্কা দেয়নি তো? লোকটা জানত, ওই প্লেনে নানারকম বিপদ হবে, তাই ও আমায় বাঁচাতে চেয়েছিল? কিন্তু আমায় ও চেনে না শোনে না৷ ও আমায় বাঁচাবার চেষ্টা করবে কেন? এখন যেন স্পষ্ট মনে পড়ছে, আমি এগিয়ে যাইনি, লোকটা ইচ্ছে করেই কনুইটা পিছিয়ে এনে খুব জোরে মেরেছিল আমায়৷
লোকটা কি জানত, ও নিজেও মরে যাবে? সারাদিন আমি ওই লোকটির কথা ভাবতে লাগলুম৷ লোকটির মুখ আমার মনের মধ্যে গেঁথে গেল একেবারে৷
তিনদিন পরে ছাড়া পেলুম হাসপাতাল থেকে৷ চোখের ব্যান্ডেজ খুলে আমায় একটা এক চোখ ঢাকা চশমা পরিয়ে দেওয়া হয়েছে! ডাক্তার জানালেন যে, আর ভয় নেই; চোখটা বেঁচে যাবে৷
আমার একশো পঁচাত্তর ডলার চার্জ দিতে হল৷ হাসপাতালেও এদেশে পয়সা লাগে৷ হেলথ ইনসিওরেন্স থাকলে অবশ্য বিনি পয়সায় হয়ে যায়৷ আমার এখনও করা হয়নি৷ বিদেশি বলে আমায় সস্তা করে দেওয়া হয়েছে অবশ্য, নইলে অনেক বেশি টাকা লাগত৷ এই একশো পঁচাত্তর ডলার দিতেই আমার গা কচকচ করতে লাগল৷ বিদেশে এসে সবসময় হিসেব করে চলতে হয় টাকাপয়সা৷ আমার কোনো দোষ নেই, তবু শুধু খরচ হয়ে গেল এতগুলো টাকা৷
প্লেনের টিকিটটা অবশ্য বাতিল হয়নি৷ সেই টিকিটেই ফিরে এলুম শিকাগোতে৷
এরপর দেড় মাস কেটে গেছে৷
ইতিমধ্যে বন্ধুবান্ধব যাদেরই বলেছি যে অভিশপ্ত ফ্লাইট নাম্বার পাঁচশো বাহাত্তর বিমানটায় আমার আসবার কথা ছিল, কেউ বিশ্বাস করে না৷ একটা লোক আমার চোখে ধাক্কা দিয়েছিল বলে আমি হাসপাতালে ছিলাম শুনেও ওরা হাসে৷ এমনকী যে বন্ধুটির কথা ছিল শিকাগো এয়ারপোর্টে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করার, সেও বলল, ‘তুই যে ওই প্লেনে আসবি না, সেই খবরটা আমায় ঠিক সময় জানাসনি তো, তাই এসব গল্প বানাচ্ছিস৷ ওটা মোটেই ফ্লাইট নাম্বার পাঁচশো বাহাত্তর ছিল না৷’
এরপর কানাডার তিনশো দু-জন যাত্রী সমেত আর একটা প্লেন হাইজ্যাকড হতেই আগেরটার কথা সবাই ভুলে গেল৷ এই প্লেনটা নেমেছে সাহারা মরুভূমির কাছে একটা ছোট্ট শহরে, দারুণ রোমহর্ষক ব্যাপার!
আমি থাকি আরওয়া সিটি নামে একটা ছোটো শহরে! একটা তিন তলা কাঠের বাড়ির দোতলায় আমার ফ্ল্যাট৷ সকাল নটা থেকে একটা পর্যন্ত এক জায়গায় কাজে যাই, তারপর সারাদিন আমার ছুটি৷ আমার ঘরের জানলা দিয়ে একটা নদী দেখা যায়৷ ক’দিন ধরে বরফ পড়তে শুরু করেছে৷ জানলা দিয়ে আমি মাঝে মাঝে চেয়ে দেখি৷ সেই নদীটার জল আস্তে আস্তে জমে যাচ্ছে৷ ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা নদীর মাঝখানে গিয়ে খেলে৷ নদীর ধারে সারি সারি উইলো গাছ, সেগুলোর গায়ে ঝুরো ঝুরো বরফ জমে আছে৷ দূর থেকে মনে হয় থোকা থোকা সাদা ফুল৷
একদিন দুপুরে আমার ফ্ল্যাটের দরজায় দুমদুম করে ঘা পড়ল৷ কলিং বেল আছে, সেটা না টিপে কে এমন ধাক্কা মারছে?
আমি বিরক্তভাবে জিজ্ঞেস করলুম, কে?
ভারিক্কি গলায় উত্তর এল, মেইলম্যান৷
এদেশে মেইলম্যানদের চেহারা আর সাজপোশাক দেখলে মনে হয় মিলিটারি৷ এরা পায়ে হেঁটে চিঠি বিলি করে না, প্রত্যেকের নিজস্ব গাড়ি আছে৷ সাধারণত নীচের ডাক বাক্সতেই এরা চিঠি দিয়ে চলে যায়৷ রেজিস্ট্রি কিংবা মানি অর্ডার থাকলে ওপরে আসে৷
দরজা খুলে মেইলম্যানটিকে দেখে আমি এতটাই অবাক হয়ে গেলুম যে আমার মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরুল না৷ আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলুম তার দিকে!
লোকটি আমার অবস্থা দেখে হেসে বললেন, ‘হেই ম্যান, হোয়াজ্জা ম্যাটার? হ্যাভ ইউ সিন আ গোস্ট অর সামথিং?
আমার তখন সত্যিই ভূত দেখার অবস্থা৷
ঠিক সেইরকম গলার আওয়াজ, অবিকল সেই চেহারা৷ সেই সাড়ে ছ-ফুট লম্বা, তেমনি চওড়া, কালোও না ফরসাও নয়, মুলাটো, মাথার চুল কোঁকড়া, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা৷
লোকটা একটা ফর্ম আর একটা কলম এগিয়ে দিয়ে আমায় বললেন, সই করো৷
কথা তো নয়, যেন হুকুম৷ যন্ত্রের মতন আমি সই করলুম৷ তারপর লোকটা আমার হাতে একটা খাম দিল৷
তারপর সে চলে যাবার জন্য পেছন ফিরতেই আমি বললুম, পর্ডন মি৷ আমি কি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
লোকটি আবার ঘুরে তাকিয়ে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী? আমি বললুম, তোমায় আমি আগে দেখেছি মনে হচ্ছে৷
লোকটি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, তা দেখে থাকতে পারো, আমি তো এদিকে প্রায়ই আসি৷
আমি বললুম, তা নয়, তোমাকে আমি দেখেছি একটা বিশাল জায়গায়…‘তুমি কখনো টুসনে গেছো!
লোকটি কর্কশ গলায় বললে, টুসন? সেটা আবার কোথায়? হোয়ার দ্য হেল ইজ দ্যাট ডামনড প্লেস?
আমি এবার বানান করে বললুম, টি ই সি এস ও এন৷ অনেকে বলে টাকসন, আসলে ওটা টুসন উচ্চারণ হবে৷ আরিজোনা স্টেটে৷
লোকটি বলল, আমেরিকার পশ্চিম অঞ্চলেই কখনো যায়নি৷
আমি দ্রুত চিন্তা করতে লাগলুম৷ দুজন মানুষের চেহারার এমন মিল হতে পারে? পাঁচশো বাহাত্তর বিমান দুর্ঘটনায় একজনও বাঁচেনি! এই লোকটাই বা বাঁচবে কি করে? এক যদি যমজ হয়—
আবার জিজ্ঞেস করলুম, তোমার কোনও যমজ ভাই আছে?
লোকটি এবার হাসল বেশ জোরে, তারপর বলল, টুইন ব্রাদার? সিয়ামিজ টুইন, হা-হা-হা! তুমি দেখছি খুব মজার লোক! আমি আজ পর্যন্ত কোনো যমজ দেখিনি! আমার এমনি একটা ভাই ছিল বটে, নিউ ইয়র্কের হার্লেমে এক দাঙ্গায় সে মারা গেছে পাঁচ বছর আগে, কেন, তোমার এত কৌতূহল কেন?
এবার আমি লজ্জিতভাবে বললুম, না, না, কিছু না এমনিই৷ কিছু মনে করো না, ক্ষমা চাইছি, যদি তোমায় বিরক্ত করে থাকি–
লোকটি আমার কাঁধ চাপড়ে বলল, ঠিক আছে ঠিক আছে৷ ইউ আর ওয়েলকাম! দিস ইজ আ ফ্রি কানট্রি৷
কাঠের সিঁড়ি দুপদুপিয়ে লোকটি নেমে চলে গেল৷ এবার আমি হাতের খামটি ছিঁড়লাম৷ তাতে একটা চেক৷ আবার আমি অবাক৷ আমায় কে টাকা পাঠাবে?
চিঠিটা পড়ে দেখলুম, কোন একটা ক্রস ওয়ার্ড পাজল প্রতিযোগিতায় আমি একটা পুরস্কার পেয়েছি৷ আমার তখন রীতিমতো ভ্যাবাচাকা খাওয়ার মতন অবস্থা৷ সময় কাটাবার জন্য আমি মাঝে মাঝে খবরের কাগজের ক্রস ওয়ার্ড পাজল সমাধান করার চেষ্টা করি বটে৷ কিন্তু কোনোটাই শেষ পর্যন্ত সবগুলি পারি না৷ কোনোদিন তো আমি প্রতিযোগিতার ফর্ম ফিলাপ করে পাঠাইনি৷ তাহলে পুরস্কার পাব কী করে? নাকি কোন একসময় একটা পাঠিয়েছিলুম৷ এখন ভুলে গেছি!
আরও চমক লাগল, যখন দেখলুম, চেকটা একশো পঁচাত্তর ডলারের!
সেই মেইলম্যানকে আমাদের রাস্তায় আর কোনোদিন দেখিনি আমি৷ এ নিয়ে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করাও যায় না৷ ব্যাপারটা নিশ্চয় অলৌকিক কিছু! আজও সব জিনিসটা আমার কাছে একটা ধাঁধার মতন মনে হয়৷
—