ক্ষতিপূরণ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
আমি দাঁড়িয়েছিলাম অ্যারিজোনার টুসন বিমানবন্দরে। যাব শিকাগো শহরে। আটটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। ওদেশে সন্ধে হয় খুব দেরিতে, তখনও আকাশে আলো আছে। আমি লাউঞ্জের বাইরে এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। প্লেনটা আসতে দেরি করছে, আর সেই জন্য ছটফটানি শুরু হয়েছে আমার মনে। শিকাগো পৌঁছতে খুব বেশি রাত হলেই মুশকিল। কারণ শিকাগো এয়ারপোর্টে আমার এক বন্ধু গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবে, তার গাড়িতে আমি যাব সীডার র্যাপিডস নামে একটা ছোট্ট শহরে। সেটা আরও প্রায় দুশো মাইল দূরে। গাড়িতে যেতে ঘণ্টা তিনেক লেগে যাবে।
আটটা বেজে পাঁচ মিনিটে প্লেনটাকে দেখা দেখা গেল আকাশে একটা গোল চক্কর দিয়ে নামছে। এই প্লেনটা আসছে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে, ওখানে বিকেলবেলা খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল খবর পাওয়া গেছে।
প্লেনটাকে দেখেই আমি কাউন্টারের দিকে ছুটলাম। টিকিট ‘ওকে’ করে নিতে হবে। প্লেন এসে না পৌঁছলে ওরা টিকিটের এই ছাড়পত্র দেয় না। কাউন্টারে আমার সামনে মাত্র আর একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে, অর্থাৎ আমি দ্বিতীয়! আমার টিকিট ‘ওকে’ হবেই, কোনো চিন্তা নেই।
আমার সামনের লোকটি ছোটোখাটো দৈত্যের মতন। লম্বায় সাড়ে ছ—ফুট তো হবেই, তেমনি চওড়া। গায়ে একটা জারকিন। লোকটি পেছন ফিরে একবার আমার দিকে তাকাল। লোকটি মুলাটো, অর্থাৎ পুরোপুরি শ্বেতাঙ্গও নয়, কালোও নয়। মাথার চুল কোঁকড়া, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা।
ওদের নিয়ম অনুযায়ী আমার চোখাচোখি হতেই লোকটি বলল, হাই! আমি বললুম হাই! লোকটি তারপর বলল, গোয়িং টু শিকাগো? আমি বললুম ইয়া!
লোকটির কি গুরুগম্ভীর গলা!
লোকটির কাঁধে ঝোলানো শুধু চামড়ার ব্যাগ। আর কোনো মালপত্র নেই। কাউন্টারের লোকটি এসে দাঁড়াতেই আমার সামনের লোকটি ব্যাগ খুলতে গেল। আমি বোধহয় অতি উৎসাহের চোটে একটু সামনে ঝুঁকেছিলাম, তারপরেই একটা কাণ্ড হয়ে গেল!
লোকটির হাত যে অত লম্বা তা আমি বুঝতে পারিনি, ব্যাগ খুলতে গিয়ে লোকটির একটা কনুই পিছিয়ে এসে সোজা ধাক্কা মারল আমার বাঁ চোখে। আমি বাংলায় ‘বাপরে’ বলে চিৎকার করে বসে পড়লুম!
তারপর কী হল আমি চোখে দেখতে পাইনি। আমার চোখ দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। নানান লোকের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, দু—এক মিনিটের মধ্যেই কারা যেন আমায় সাবধানে তুলে শুউয়ে দিল স্ট্রেচারে। তারপরই অ্যাম্বুলেন্সের প্যাঁ পোঁ শব্দ। আমি অজ্ঞান হইনি, অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যেও আমার মনে পড়ছে, আমার ওই প্লেনটা আর ধরা হল না। শিকাগো এয়ারপোর্টে আমার বন্ধু গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।
এক ঘণ্টার মধ্যে ডাক্তাররা আমার চোখ পরীক্ষা করে ওষুধ লাগিয়ে, মস্ত বড়ো একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে দেবার পর আমি জিজ্ঞেস করলুম, আমি কি এরপর পৌনে দশটার প্লেন ধরতে পারব?
বড়ো ডাক্তার জানালেন তার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমাকে এখানে অন্তত তিনদিন শুয়ে থাকতে হবে। তাঁদের কথা যদি আমি না শুনি তাহলে আমার বাঁ চোখটা চিরকালের মতো নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
কী আর করি, আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললুম! একটা চোখ কে আর নষ্ট করতে চায়। বিদেশ—বিভুঁয়ে একটা হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে থাকতে হল আমায়। এর আগে দেশে বা বিদেশে কক্ষনো আমি হাসপাতালে থাকিনি।
এই হাসপাতালের প্রত্যেক কেবিনে একটা করে টেলিভিশন সেট। নার্স সেটা চালিয়ে দিয়ে গেছে। এক চোখে ব্যান্ডেজ বাঁধা বলে অন্য চোখটাও খুলতে কষ্ট হচ্ছে আমার। তা ছাড়া এখন টেলিভিশনের প্রোগ্রাম দেখার মেজাজও নেই। কথা আর গানবাজনাগুলো শুনতে পাচ্ছি। দশটার সময় শুরু হল খবর। টেলিভিশনে খবর পড়াটা এরা খুব আকর্ষণীয় করে তোলে। প্রথমে একজন খবর বলে নিউ ইয়র্ক থেকে, তারপর সেই লোকটি হঠাৎ কথা থামিয়ে বলে, হ্যালো জ্যাক, হোয়াটস আপ দেয়ার? অমনি দেখা যায় তিন হাজার মাইল দূরে ক্যালিফোর্নিয়ায় বসে আছে আর একজন, সে তখন ওদিককার খবর বলে। এমনিভাবে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে আর একজন। কখনো কখনো জাপান, ভিয়েতনাম, ফ্রান্স বা আফ্রিকা থেকেও ওদের প্রতিনিধিকে সরাসরি খবর বলতে দেখা ও শোনা যায়। এনবিসি নিউজের জ্যাক রবসনের খবর পড়া আমার বেশ ভালো লাগে। সে শুরু করতেই আমি কান খাড়া করলুম। জ্যাক প্রথমেই বলল, আজ সন্ধেবেলা ফ্লাইট নম্বর পাঁচশো বাহাত্তর হাইজ্যাকড হয়েছে!
উত্তেজনায় সঙ্গে সঙ্গে আমি উঠে বসলুম। অতি কষ্টে ডান চোখটা মেলে তাকালুম টেলিভিশন সেটের দিকে। ফ্লাইট নম্বর পাঁচ শো বাহাত্তর? ওই প্লেনটাতেই তো আমার যাওয়ার কথা ছিল!
এই প্রথম সেই দৈত্যের মতো চেহারার মুলাটো লোকটির উপর আমার খুব রাগ হল। ওই লোকটা তার লম্বা ধেরেঙ্গা হাতের কনুই দিয়ে আমায় খোঁচা মারল বলেই তো আমি এখন একটা দারুণ সুযোগ হারালুম; হাইজ্যাকিংয়ের সময় সেই বিমানে থাকার ইচ্ছে আমার অনেক দিনের! যারা হাইজ্যাকিং করে তারা তো যাত্রীদের মারে না, সব ব্যাপারটা বেশ দেখা যায়।
জ্যাক রবসন আরও জানালো যে হাইজ্যাকড প্লেনটা প্রথমে যাচ্ছিল কিউবার দিকে, কিন্তু সেখানে খোঁজ নিয়ে শোনা গেছে, কিউবায় সেটা নামেনি, সেটা উড়ে গেছে ‘আননোন ডেস্টিনেশনের’ দিকে। আননোন ডেস্টিনেশন, সে যে আরও রোমাঞ্চকর ব্যাপার। আমি নিরাশ হয়ে পড়লুম।
বেল বাজিয়ে নার্সকে ডাকলুম একবার।
ছোট্টখাট্ট চেহারার ফুটফুটে নার্স এসে দরজার কাছে দাঁড়াতেই আমি জিজ্ঞেস করলুম, সিস্টার, আমাকে এখানে কে ভরতি করে দিল?
নার্স বললে, তোমাকে তো নিয়ে এসেছে এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি স্টাফ।
যে লোকটা আমায় কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরেছে সে আসেনি?
তোমায় কে ধাক্কা মেরেছে? সে কথা তো কেউ বলেনি!
হ্যাঁ, আমার সামনের লোকটির কনুইয়ের ধাক্কাতেই তো…
—সে কথা তাহলে তুমি পুলিশকে জানাতে পারো। লোকটির নাম জানো তুমি?
—নাম জানিনা! তবে চেহারাটা স্পষ্ট মনে আছে।
—সেই কথাই পুলিশকে জানিয়ো, পুলিশ ঠিক নাম বার করে ফেলবে। তারপর ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারো তার কাছ থেকে।
—আচ্ছা থাক, পরে ভেবে দেখব। টিভি বন্ধ করে বাতি নিবিয়ে দিয়ে যাও।
এদেশে সব ব্যাপারেই ক্ষতিপূরণ। সামান্য সামান্য ব্যাপারে মামলা করেই অনেকে টাকা পেয়ে যায়। মামলা না করলেও ইনসিওরেন্স কোম্পানি দেয়। আমার এক বন্ধু হিচ হাইকিং করার সময় একটা গাড়িতে বিশ পয়সার রাইড নিয়েছিল, সেই গাড়িটা অ্যাকসিডেন্ট করল ব্লুমিংটন শহরের কাছে, আমার বন্ধুটির একটা পা মুচকে গিয়েছিল শুধু। খুবই সামান্য ব্যাপার, একটু চুন—হলুদ লাগালেই সেরে যাবার মতন। তাতেই ক্ষতিপূরণ পেয়ে গেছে দু—হাজার ডলার।
বিদেশে বেড়াতে এসে ওসব ঝঞ্ঝাটের মধ্যে যাবার ইচ্ছে আমার নেই। পুলিশের সঙ্গে কে নিজেকে জড়াতে চায়! তবু আমি মনে মনে বললুম লোকটা খুব অভদ্র তো! হয়তো সে ইচ্ছে করে আমায় ধাক্কা দেয়নি; তবু আমার কাছে এসে একবার অন্তত দুঃখ প্রকাশ করা উচিত ছিল তার!
চোখের যন্ত্রণায় ঘুম আসছে না। শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল চিন্তা করতে লাগলুম! কমিকসের গল্পের ছবির মতন যেন দেখতে পেলুম, সমুদ্রের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে ফ্লাইট নম্বর পাঁচশো বাহাত্তর; ওর ভেতরে ককপিটের সামনে পাইলটের কপালের কাছে পিস্তল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিমান—দস্যু… সবাই ভয়ে মুখ ফ্যাকাসে করে আছে। …হঠাৎ আমার মনে হল, ওই দৈত্যের মতন চেহারার লোকটাই বিমানদস্যু নয় তো? ওর চেহারা তো ঠিক ডাকাতেরই মতন! হয়তো ওর আরও সঙ্গী ছিল? বিমানটা ছিনতাই করে বোধহয় চলে যাচ্ছে আফ্রিকার কোনো দেশে…। বেশ একখানা গল্প ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে পড়লুম একসময়ে।
পরদিন সকালেই কাগজে বড়ো বড়ো করে খবর বেরুলো, ওই হাইজ্যাক করা বিমানটা আকাশেই ধ্বংস হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে পড়েছে গালফ অফ মেক্সিকোতে। ছাপান্ন জন যাত্রীর মধ্যে একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি; সবাইকে মৃত বলে ধরে নেওয়া যায় নিশ্চিতভাবে। দুর্ঘটনা হয় রাত সাড়ে দশটায়, তারপর শেষ রাত পর্যন্ত সার্চ পার্টি সেখানকার সমুদ্র এলাকা খোঁজাখুঁজি করেও কাউকে উদ্ধার করতে পারেনি। পৃথিবীর সব কাগজেই বেরিয়েছিল এই খবর। খবরটা পড়ে যে আমার কী মনে হল কী বলব! ওই শীতের দেশেও সারা গায়ে ঘাম এসে গেল, ঝিম ঝিম করতে লাগল মাথাটা। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলুম। ওই প্লেনে আমার থাকার কথা ছিল। চোখে এই ধাক্কাটা না লাগলে, এতক্ষণে আমার দেহটা টুকরো টুকরো হয়ে গালফ অফ মেক্সিকোতে ভাসছে আর হাঙরে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে।
খবরের কাগজটা তন্ন তন্ন করে পড়লুম। প্লেনটা কেন ভেঙে পড়ল তার কারণটা ঠিক জানা যাচ্ছে না। পাইলট প্রথমে খবরটা জানাবার পর আর কিছু বলতে পারেনি। খুব সম্ভবত প্লেনের মধ্যে গুলি চলেছে। পুলিশের লোক বলেছে যাত্রীদের মধ্যে একজন নাকি নেভাডার লাস ভেগাস শহরে জুয়া খেলে সর্বস্বান্ত হয়েছিল, তারপর পাওনাদারদের তাড়া খেয়ে পালিয়ে এসেছিল টুসন—এ, সেখান থেকে প্লেন হাইজ্যাক করে অন্য দেশে আশ্রয় নেবার মতলবে ছিল। তারপর কী হয়েছে, কেউ জানে না।
আমার কেন যেন দৃঢ় ধারণা হয়ে গেল, সেই দৈত্যের মতন মুলাটো লোকটাই এসব কাণ্ড করেছে। লাইনের একেবারে প্রথমে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। এরকম কাণ্ড হবার পরও একটুও অপেক্ষা করেনি। এত ব্যস্ত ছিল প্লেনটা ধরবার জন্য।
দুপুরের দিকে আমার মনে হল, ওই লোকটা ইচ্ছে করেই আমায় ধাক্কা দেয়নি তো? লোকটা জানতো, ওই প্লেনে নানারকম বিপদ হবে, তাই ও আমায় বাঁচাতে চেয়েছিল? কিন্তু আমায় ও চেনে না শোনে না। ও আমায় বাঁচাবার চেষ্টা করবে কেন? এখন যেন স্পষ্ট মনে পড়ছে, আমি এগিয়ে যাইনি, লোকটা ইচ্ছে করেই কনুইটা পিছিয়ে এনে খুব জোরে মেরেছিল আমায়।
লোকটা কি জানতো, ও নিজেও মরে যাবে? সারাদিন আমি ওই লোকটির কথা ভাবতে লাগলুম। লোকটির মুখ আমার মনের মধ্যে গেঁথে গেল একেবারে।
তিনদিন পরে ছাড়া পেলুম হাসপাতাল থেকে। চোখের ব্যান্ডেজ খুলে আমায় একটা এক চোখ ঢাকা চশমা পরিয়ে দেওয়া হয়েছে! ডাক্তার জানালেন যে, আর ভয় নেই, চোখটা বেঁচে যাবে।
আমায় একশো পাঁচাত্তর ডলার চার্জ দিতে হল। হাসপাতালেও এদেশে পয়সা লাগে। হেলথ ইনসিওরেন্স থাকলে অবশ্য বিনি পয়সায় হয়ে যায়। আমার এখনও করা হয়নি। বিদেশি বলে আমায় সস্তা করে দেওয়া হয়েছে অবশ্য, নইলে অনেক বেশি টাকা লাগত। এই একশো পঁচাত্তর ডলার দিতেই আমার গা কচকচ করতে লাগল। বিদেশে এসে সবসময় হিসেব করে চলতে হয় টাকাপয়সা। আমার কোনো দোষ নেই, তবু শুধু শুধু খরচ হয়ে গেল এতগুলো টাকা।
প্লেনের টিকিটটা অবশ্য বাতিল হয়নি। সেই টিকিটেই ফিরে এলুম শিকাগোতে।
এরপর দেড় মাস কেটে গেছে।
ইতিমধ্যে বন্ধুবান্ধব যাদেরই বলেছি যে অভিশপ্ত ফ্লাইট নাম্বার পাঁচশো বাহাত্তর বিমানটায় আমার আসবার কথা ছিল, কেউ বিশ্বাস করে না। একটা লোক আমার চোখে ধাক্কা দিয়েছিল বলে আমি হাসপাতালে ছিলাম শুনেও ওরা হাসে। এমনকী যে বন্ধুটির কথা ছিল শিকাগো এয়ারপোর্টে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করার, সেও বলল, ‘তুই যে ওই প্লেনে আসবি না, সেই খবরটা আমায় ঠিক সময় জানাসনি তো, তাই এসব গল্প বানাচ্ছিস। ওটা মোটেই ফ্লাইট নাম্বার পাঁচশো বাহাত্তর ছিল না।’
এরপর কানাডার তিনশো দু—জন যাত্রী সমেত আর একটা প্লেন হাইজ্যাকড হতেই আগেরটার কথা সবাই ভুলে গেল। এই প্লেনটা নেমেছে সাহারা মরুভূমির কাছে একটা ছোট্ট শহরে, দারুণ রোমহর্ষক ব্যাপার!
আমি থাকি আরওয়া সিটি নামে একটা ছোটো শহরে! একটা তিন তলা কাঠের বাড়ির দোতলায় আমার ফ্ল্যাট। সকাল নটা থেকে একটা পর্যন্ত এক জায়গায় কাজে যাই, তারপর সারাদিন আমার ছুটি। আমার ঘরের জানলা দিয়ে একটা নদী দেখা যায়। কদিন ধরে বরফ পড়তে শুরু করেছে। জানলা দিয়ে আমি মাঝে মাঝে চেয়ে দেখি। সেই নদীটার জল আস্তে আস্তে জমে যাচ্ছে। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা নদীর মাঝখানে গিয়ে খেলে। নদীর ধারে সারি সারি উইলো গাছ, সেগুলোর গায়ে ঝুরো ঝুরো বরফ জমে আছে। দূর থেকে মনে হয় থোকা থোকা সাদা ফুল।
একদিন দুপুরে আমার ফ্ল্যাটের দরজায় দুমদুম করে ঘা পড়ল। কলিং বেল আছে, সেটা না টিপে কে এমন ধাক্কা মারছে?
আমি বিরক্তভাবে জিজ্ঞেস করলুম, কে?
ভারিক্কি গলায় উত্তর এল মেইলম্যান।
এদেশের মেইলম্যানদের চেহারা আর সাজপোশাক দেখলে মনে হয় মিলিটারি। এরা পায়ে হেঁটে চিঠি বিলি করে না, প্রত্যেকের নিজস্ব গাড়ি আছে। সাধারণত নীচের ডাক বাক্সতেই এরা চিঠি দিয়ে চলে যায়। রেজিস্ট্রি কিংবা মানি অর্ডার থাকলে ওপরে আসে।
দরজা খুলে মেইলম্যানটিকে দেখে আমি এতটাই অবাক হয়ে গেলুম যে আমার মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরুলো না। আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলুম তার দিকে!
লোকটি আমার অবস্থা দেখে হেসে বললেন, ‘হেই ম্যান, হোয়াজ্জা ম্যাটার? হ্যাভ ইউ সিন আ গোস্ট অর সামথিং?
আমার তখন সত্যিই ভূত দেখার অবস্থা।
ঠিক সেইরকম গলার আওয়াজ, অবিকল সেই চেহারা। সেই সাড়ে ছ—ফুট লম্বা, তেমনি চওড়া, কালোও না ফরসাও নয়, মূলাটো, মাথার চুল কোঁকড়া, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা।
লোকটা একটা ফর্ম আর একটা কলম এগিয়ে দিয়ে আমায় বললেন, সই করো।
কথা তো নয়, যেন হুকুম। যন্ত্রের মতন আমি সই করলুম। তারপর লোকটা আমার হাতে একটা খাম দিল।
তারপর সে চলে যাবার জন্য পেছন ফিরতেই আমি বললুম, পর্ডন মি। আমি কি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
লোকটি আবার ঘুরে তাকিয়ে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী? আমি বললুম, তোমায় আমি আগে দেখেছি মনে হচ্ছে।
লোকটি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, তা দেখে থাকতে পারো, আমি তো এদিকে প্রায়ই আসি।
আমি বললুম তা নয়, তোমাকে আমি দেখেছি একটা বিশাল জায়গায়…’তুমি কখনো টুসনে গেছো!
লোকটি কর্কশ গলায় বললে, টুসন? সেটা আবার কোথায়? হোয়ার দ্য হেল ইজ দ্যাট ডামনড প্লেস?
আমি এবার বানান করে বললুম, টি ই সি এস ও এন। অনেকে বলে টাকসন, আসলে ওটা টুসন উচ্চারণ হবে। আরিজোনা স্টেটে।
লোকটি বলল, আমেরিকার পশ্চিম অঞ্চলেই কখনো যায়নি।
আমি দ্রুত চিন্তা করতে লাগলুম। দুজন মানুষের চেহারার এমন মিল হতে পারে? পাঁচশো বাহাত্তর বিমান দুর্ঘটনায় একজনও বাঁচেনি! এই লোকটাই বা বাঁচবে কি করে? এক যদি যমজ হয়—
আবার জিজ্ঞেস করলুম, তোমার কোনও যমজ ভাই আছে?
লোকটা এবার হাসল বেশ জোরে, তারপর বললো, টুইন ব্রাদার? সিয়ামিজ টুইন, হা—হা—হা! তুমি দেখছি খুব মজার লোক! আমি আজ পর্যন্ত কোনো যমজ দেখিনি! আমার এমনি একটা ভাই ছিল বটে, নিউ ইয়র্কের হার্লেমে এক দাঙ্গায় সে মারা গেছে পাঁচ বছর আগে, কেন, তোমার এত কৌতূহল কেন?
এবার আমি লজ্জিতভাবে বললুম, না, না, কিছু না এমনিই। কিছু মনে করো না, ক্ষমা চাইছি, যদি তোমায় বিরক্ত করে থাকি—
লোকটি আমার কাঁধ চাপড়ে বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে। ইউ আর ওয়েলকাম! দিস ইজ আ ফ্রি কানট্রি।
কাঠের সিঁড়ি দুপ দুপিয়ে লোকটি নেমে চলে গেল। এবার আমি হাতের খামটি ছিঁড়লাম। তাতে একটা চেক। আবার আমি অবাক। আমায় কে টাকা পাঠাবে?
চিঠিটা পড়ে দেখলুম, কোন একটা ক্রস ওয়ার্ড পাজল প্রতিযোগিতায় আমি একটা পুরস্কার পেয়েছি। আমার তখন রীতিমতো ভ্যাবাচাকা খাওয়ার মতন অবস্থা। সময় কাটাবার জন্যে আমি মাঝে মাঝে খবরের কাগজের ক্রস ওয়ার্ড পাজল সমাধান করার চেষ্টা করি বটে। কিন্তু কোনোটাই শেষপর্যন্ত সবগুলি পারি না। কোনোদিন তো আমি প্রতিযোগিতার ফর্ম ফিলাপ করে পাঠাইনি। তাহলে পুরস্কার পাব কী করে? নাকি কোন এক সময় একটা পাঠিয়েছিলুম। এখন ভুলে গেছি!
আরও চমক লাগল, যখন দেখলুম, চেকটা একশো পঁচাত্তর ডলারের!
সেই মেইলম্যানকে আমাদের রাস্তায় আর কোনোদিন দেখিনি আমি। এ নিয়ে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করাও যায় না। ব্যাপারটা নিশ্চয় অলৌকিক কিছু! আজও সব জিনিসটা আমার কাছে একটা ধাঁধার মতন মনে হয়।