ক্ষণজন্মা শিল্পী তুলসী চক্রবর্তী
তুলসী চক্রবর্তীর মতো অভিনেতা বাংলা সিনেমায় কমই হয়েছে। মোট কতগুলো ছবিতে অভিনয় করেছেন বলতে পারব না। কিন্তু আমি চল্লিশ দশক থেকে বাংলা ছবি দেখছি, তখন থেকে তুলসী চক্রবর্তীকে বহু ছবিতে বহু বিচিত্র ধরনের অভিনয় করতে দেখেছি। পরে জেনেছি তাঁর সিনেমায় অভিনয় শুরু ১৯৩২ সালে নিউ থিয়েটার্সের ‘পুনর্জন্ম’ ছবিতে। থিয়েটারে অবশ্য তার আগেই তাঁর অভিনয় শুরু হয়েছিল, ১৯২০ সালে, স্টার থিয়েটারে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ নাটকে। ১৯৬১-তে তাঁর মৃত্যু হয়।
সুতরাং সিনেমায় মোটামুটি তিরিশ বছর এবং তার আগে বছর বারো থিয়েটারে, অর্থাৎ বিয়াল্লিশ বছর তাঁর পেশাদার অভিনেতার জীবন। আমার তো মনে হয় না এই দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছরে তাঁর অভিনয়ে এমন একটিও নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যাবে, যেখানে তিনি সুঅভিনয় করেননি। ক’জন এরকম অভিনেতা পাওয়া যাবে যাঁর সম্বন্ধে এমন কথা বলা যায়?
এই বিয়াল্লিশ বছরের অভিনয়-কর্মের মধ্যে দিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তের, বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্তের এমন একটা পরিচয় তিনি ক্রমে ক্রমে মূর্ত করেছেন যা খুব কম অভিনেতাই পেরেছেন। এই প্রসঙ্গে শুধু দুজন কৌতুকাভিনেতার কথা মনে পড়ে— ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ও জহর রায়, যাঁদের অভিনয়ের মধ্যে মধ্যবিত্ত বাঙালির স্বরূপ বহুলভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ভানু ও জহর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যাপারে তুলসীবাবুর থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন এবং দুজনেই পঠনপাঠনে সমৃদ্ধ করেছিলেন নিজেদের। এ বিষয়ে তুলসী চক্রবর্তী অত সৌভাগ্যবান ছিলেন না। তাঁর বাবা আশুতোষ চক্রবর্তী রেলে চাকরি করতেন, ঘোরাঘুরির চাকরি। তাই বাল্যকালে তিনি জোড়াসাঁকোয় জ্যাঠামশাই-এর বাড়িতে থাকতেন। অতি অল্পবয়সেই তুলসী চক্রবর্তীর পিতৃবিয়োগ হওয়াতে যেটুকু ইস্কুলের পড়াশুনো শুরু হয়েছিল তাও বন্ধ হয়ে যায়।
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জহর রায় চ্যাপলিন, বাস্টার কিটন, হ্যারি ল্যাংডেন প্রমুখ হলিউডের মহান ক্লাউনদের কাজের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তাই এঁদের কিছু প্রভাব ভানু-জহরের অভিনয়-কলার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয়ে কোথাও বিদেশের অভিনেতাদের কোনও প্রভাব লক্ষ করা যায় না। সে অভিনয় নিতান্তই দেশজ। দেশের মানুষের চরিত্রলক্ষণের মধ্যেই তার শেকড় খুঁজতে হয়।
এমন একজন অভিনেতা, যিনি বেশিদূর লেখাপড়া করেননি, পৃথিবীর সিনেমা বা থিয়েটারের এমন কিছু খবর যিনি রাখতেন না, তিনি কী করে এমন ক্ষণজন্মা শিল্পী হয়ে উঠলেন, এটা ভাবলে বিস্ময়ের সীমা থাকে না। তবু যেটুকু তাঁর সম্বন্ধে জানতে পাই, তার থেকে খানিকটা আঁচ করা যায় তাঁর শিল্পী হয়ে ওঠার অন্তর-ইতিহাসটাকে।
ছেলেবেলায় প্রথমটায় বাবার ঘোরাঘুরির চাকরির জন্যে এবং তারপর জ্ঞানোদয়ের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাবা মারা যাওয়ায় তুলসী চক্রবর্তী মানুষ হয়েছিলেন যে মানুষটির কাছে, তিনি ছিলেন তাঁর জ্যাঠামশাই প্রসাদ চক্রবর্তী। এই প্রসাদ চক্রবর্তী খুব ভাল হারমোনিয়াম বাজাতেন, গান গাইতেন, অভিনয়ও করতেন। তাঁর অ্যামেচার থিয়েটার ও অর্কেস্ট্রার একটা দল ছিল। প্রসাদবাবু কলকাতার স্টার থিয়েটারের অর্কেস্ট্রাতেও চাকরি করেছেন বেশ কিছুকাল। তখনকার কলকাতায় বহু বড়লোকের বাড়িতে পূজাআচ্চায় দোল উৎসবে ঝুলনের সময় নাটক ও গানবাজনা হত। প্রসাদবাবুর দল সেইরকম সব জায়গায় নাটক ও গান করতে যেত। এমনকি শহরের বাইরেও বায়না নিয়ে অনুষ্ঠান করে আসত। তুলসী চক্রবর্তীর নিজের মুখেই শুনেছি, অল্পবয়সে পিতৃহারা হওয়ার পরে জ্যাঠামশাইয়ের অভিভাবকত্বে থাকলেও প্রসাদবাবু তাঁর পড়াশুনো ইত্যাদির দিকে তেমন মনোযোগ দিতে পারতেন না, তিনি তাঁর অর্কেস্ট্রা ও নাটকের দল নিয়েই মেতে থাকতেন। জ্যাঠামশাইয়ের নজরদারির অভাবে লেখাপড়াটা না হলেও জ্যাঠামশাইয়ের ওই অর্কেস্ট্রার দলে থাকতে থাকতে গান আর অভিনয়ের নেশাটা বালক তুলসী চক্রবর্তীর হৃদয়মন দখল করে নিয়েছিল।
জ্যাঠামশাইয়ের ওই ‘কেলাব’ অর্থাৎ দলের সঙ্গে তিনি সেই শৈশবেই নানান আসরে গান গাইতে যেতেন। অভিনয়ও করতেন, তবে তখন গানই গাইতেন বেশি। নানা ধরনের গান— কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, কবিগান ইত্যাদি। মাঝে মাঝে মূল গায়েনের দোয়ারকি হয়ে তরজার আসরেও নামতে হত।
চমৎকার গান গাইতেন তুলসী চক্রবর্তী। জ্যাঠামশাইয়ের দল ছাড়াও পরবর্তীকালে অন্যান্য দলেও এসব করেছেন। খানিকটা নাচও শিখতে হয়েছে তাঁকে। সেখানে শিক্ষার সময় তালে ভুল হলে অধিকারী খেজুর ডালের ছড়ি দিয়ে পায়ে মারতেন। তাঁর গান, নাচ শেখার পরিচয় ছায়াছবিতে বাঙালি দর্শক অনেকবারই পেয়েছেন। ‘কবি’ ছবিতে কবির লড়াইয়ের দৃশ্যে তুলসীবাবুর অভিনয় দেখলেই বোঝা যায় এর উৎসে সত্য অভিজ্ঞতা আছে।
আমি একবার পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে স্টার থিয়েটারের একটি নাটকে মঞ্চে তাঁকে গান গাইতে শুনেছিলাম। খানিকটা নেচে নেচেই গেয়েছিলেন। বাড়ির চাকরের পার্ট করছিলেন। বাড়ির শিশুপুত্রকে প্যারামবুলেটরে করে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছেন, সেই সময় গান করছেন—
‘ওই গড়গড় গড়গড় গড়গড় রাজার গাড়ি যায়
গড়গড়িয়ে যায় রে যায়।’
সেই অসামান্য গায়ন আজও আমি ভুলতে পারি না।
গানবাজনা, অভিনয়ের হাতেখড়িটা তাঁর হয়েছিল জ্যাঠামশাইয়ের কাছে। পরে স্টার থিয়েটারে অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছেও পৌঁছোন জ্যাঠামশাইয়ের দৌলতেই। থিয়েটারে এসে একজন অসামান্য গুরু পেলেন তিনি। অবশ্য অপরেশচন্দ্রের কাছে শিক্ষালাভের অনেক আগেই থিয়েটারের উইংসের ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অভিনয় দেখার নেশা ধরে গিয়েছিল তাঁর। জ্যাঠামশাই যখন স্টার থিয়েটারে হারমোনিয়াম বাজাতেন তখন তরুণ তুলসী চক্রবর্তী বাড়ি থেকে তাঁর খাবার নিয়ে আসতেন। জ্যাঠামশাইয়ের জন্যে থিয়েটারে ঢোকা ও উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে অভিনয় দেখার অনুমতি তাঁর ছিল। এরপর যখন থিয়েটারে যোগ দিলেন, তখন দীর্ঘদিন ধরে অপরেশচন্দ্রের শিক্ষা তাঁকে পুরোদস্তুর পেশাদার অভিনয়ের দক্ষতা এনে দিল।
কিন্তু শুধুমাত্র অভিনয়-কলার কুশলতা থেকেই তো অতবড় শিল্পী হওয়া যায় না। কুশলী অভিনেতার থেকে মহৎ শিল্পীতে উত্তরণের পথে সব থেকে বড় প্রয়োজন শিল্পীর জীবনবোধের। এই জীবনবোধ একান্তভাবেই তাঁর নিজস্ব। তা কেউ তাঁকে শেখাতে পারে না। মানুষকে শিল্পী যতভাবে জেনেছে, মানবজীবনের সুখ-দুঃখ-সঙ্কট-সংগ্রামের সে যতভাবে অংশীদার হয়েছে তার থেকেই গড়ে ওঠে তার জীবনবোধ। তুলসী চক্রবর্তীর ক্ষেত্রে এই বোধ পঠনপাঠন বা গ্রন্থ থেকে আহরিত জ্ঞানসঞ্চয়ের মধ্যে দিয়ে বিকাশলাভ করেনি। অল্পবয়স থেকে দুঃখ-দারিদ্র্য ও জীবনসংগ্রামের অভিজ্ঞতা এবং মানুষ সম্পর্কে তাঁর সহজাত আগ্রহ ও ঔৎসুক্য তাঁর জীবনবোধকে সমৃদ্ধ করেছিল।
বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জ্যাঠামশাইয়ের অন্নধ্বংস না করে স্বাবলম্বী হবেন এমন একটা অভিপ্রায়ে তুলসী চক্রবর্তী বেশ কয়েকবার নানা রকমের চাকরি করেছেন। তার মধ্যে প্রথমটা ছিল চিৎপুরে একটা চাটের দোকানে প্লেট ধোয়ার কাজ। সন্ধেবেলায় মৌতাত করার সময় বাবুরা কষা মাংস ইত্যাদির চাট খেয়ে গেলে সেই মাতালবাবুদের এঁটো বাসন তাঁকে ধুতে হত। এই চাকরিতে ইতি হল যখন জ্যাঠামশাই জানতে পেরে দোকানে এসে চুলের মুঠি ধরে, ‘বামুনের ছেলে, আর কাজ পেলে না? মোদো-মাতালদের এঁটো ধুয়ে স্বাবলম্বী হতে চাইছ?’— এই বলে সেখান থেকে তাঁকে ছাড়িয়ে আনলেন।
ব্রাহ্মণের সংস্কারে খোঁচা লাগল তাঁর। সে কাজ আর করতে যাননি তুলসীবাবু, কিন্তু তারপরেই তিনি বাড়ি থেকে পালালেন। এক সার্কাস পার্টিতে ঢুকে পড়ে চলে গেলেন বর্মা মুল্লুকে। সেখানে বাঘ-সিংহের খেলা ছাড়া আর সবরকম খেলাই সকলকে করতে হত। তুলসীবাবু বেশিরভাগ সময় জোকার সাজতেন। এই সার্কাস করতে গিয়ে একটা বাড়তি লাভ হয়েছিল। সার্কাসটিতে উত্তর ভারতের হিন্দু-মুসলমান সব জাতের লোক থাকাতে হিন্দি ও উর্দুতে অনর্গল কথা বলতে শিখেছিলেন তিনি, যেটা পরে নিউ থিয়েটার্সের হিন্দি ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে তাঁর কাজে লেগেছিল। সার্কাস কেন ছেড়েছিলেন তার কারণটা নিজের স্বভাবসিদ্ধ সরস ভাষায় তিনি বলেছিলেন, ‘—যেদিন দেখলাম আমার নিজের শরীর থেকে জন্তুজানোয়ারের গন্ধ বেরোচ্ছে, সেদিনই কাউকে কিছু না বলে চম্পট দিলাম।’
বর্মা থেকে ফেরার পর তাঁর জ্যাঠামশাই তুলসীবাবুকে চিৎপুরের একটা ছাপাখানায় নিয়ে গিয়ে কাজে ঢুকিয়ে দিলেন। কম্পোজিটরের কাজ করবেন বলে টাইপের খুঁটিনাটি শিখতে লাগলেন। আর এই ছাপাখানায় কাজ করতে গিয়েই অভিনেতা হওয়ার বাসনাটা উদগ্র হয়ে উঠল তাঁর মনে। ওই প্রেসে থিয়েটারপাড়ার বড় বড় পোস্টার আর হ্যান্ডবিল ছাপা হত। পোস্টারে নামকরা শিল্পীদের নামগুলি দেখতে দেখতে, আর হ্যান্ডবিলের রকমারি মনোহারী ভাষার বিজ্ঞাপনগুলি পড়তে পড়তে তাঁর মনে হত অভিনেতা হতে পারলে তাঁরও তো ওইরকম পোস্টারে নাম ছাপা হবে! জ্যাঠামশাইয়ের কাছে গিয়ে বায়না ধরলেন থিয়েটারে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্যে। জ্যাঠামশাই বললেন— ‘সেই ভাল, তোর তো দেখছি অ্যাক্টিংটা ভালই আসে। তাছাড়া সব সময় আমার চোখের সামনে থাকতে পারবি।’ অপরেশচন্দ্রর কাছে কাকুতিমিনতি করে তিনি তুলসীবাবুকে স্টার থিয়েটারে ঢুকিয়ে দিলেন।
ওইসব নানারকম পেশার মধ্যে দিয়ে যেমন তিনি মানুষের বিচিত্র পরিচয়কে জেনেছেন, তেমনি তাঁর স্বভাবের মধ্যেই এমন একটা জিনিস ছিল যা তাঁকে সারাজীবন সাধারণ মানুষের জীবনপ্রবাহের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছে। আচার-ব্যবহারে, এমনকি সম্ভবত মনের দিক থেকেও তিনি ছিলেন একজন ঘরোয়া সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি। এই সাধারণত্বের মধ্যে যা ছিল অসাধারণ তা হল তাঁর মানুষকে দেখার আগ্রহ ও মানুষকে দেখার চোখ।
স্কুলে পড়ার সময় বেশ কয়েক বছর আমি হাওড়ায় থেকেছি। সেই সময় কালীবাবুর বাজারে বাজার করতে গেলেই দেখতে পেতাম তুলসীবাবু থলে হাতে বাজার করছেন। পরনে অত্যন্ত সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্তের মতো আধময়লা ধুতি, গায়ে একটা ব্যবহারে জীর্ণ ফতুয়া কী গেঞ্জি। চল্লিশের দশকের শেষে তখনই কিন্তু তুলসী চক্রবর্তী সিনেমার একজন অতিপরিচিত নামকরা শিল্পী। কিন্তু গ্ল্যামারে আগ্রহী বহু অভিনেতার মতো তিনি ছিলেন না। প্রায়শই দেখতাম পরিচিত লোকদের সঙ্গে নিতান্ত সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে আলাপ করছেন, এমনকি সবজিওয়ালা, মাছওয়ালা, ফড়ে, নিকিরি, মুদি কী দোকানিদের সঙ্গেও বন্ধুর মতো গল্প করছেন। আমি সিনেমায় আসার পরে যখন তাঁর সঙ্গে কাজ করার ও ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ হয়, তখন বুঝতে পেরেছি উনি সত্যি সত্যিই ওই রকম নিরহংকারী ঘরোয়া মানুষ। দেখেছি সব রকমের মানুষের সঙ্গেই সহজে এবং আনন্দের সঙ্গে মিশতে জানতেন। সেই জন্যেই বোধহয় সাধারণ বাঙালির জীবনকে আঁতিপাঁতি করে জানতেন, অভিনয়ের মধ্যে তাই ফুটিয়ে তুলতেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন করে শিকড় নামানো ছিল বলেই হয়ত তিনি অসামান্য শিল্পী হয়েছিলেন।
নটশ্রেষ্ঠ অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফী বলেছিলেন— ‘আমি দেখি, তোমরা দেখিতে জানো না। তাই তোমাদের শিখিতে এত কষ্ট হয়। অভিনয় শিক্ষা কোনও ব্যক্তি বিশেষের নিকট হয় না— প্রকৃত অভিনয় সমাজের কাছে শিখতে হয়। দেখিতে শিখিতে হয়— দেখিয়া বিচার করিতে হয়।… এবং উপযুক্ত অবসরে তা আরোপ করিতে চেষ্টা করিতে হয়।’
‘ভাবীকাল’ ছবিতে তুলসী চক্রবর্তী একটি জটিল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। চরিত্রটি আগে আদর্শবাদী ছিল, পরে আস্তে আস্তে ক্ষমতার মোহ, অর্থলালসা তাকে পাল্টে দিচ্ছে। এই ছবিতে ভাল অভিনয় করেছিলেন বলে সাংবাদিক রবি বসু যখন তাঁকে প্রশংসা করেন তখন তুলসী চক্রবর্তী তাঁকে বলেছিলেন— ‘ওই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করার জন্যে তো ভাল অভিনেতা হওয়ার দরকার হয় না। তুমি যে সমাজে বসবাস করো, একটু চোখ-কান খোলা রেখে যদি সেই সমাজের মানুষগুলোকে দেখো, তাহলে তুমিও ওইরকম অভিনয় করতে পারবে। চোখের সামনেই তো দেখলাম কত মানুষের আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেল। যত ছিল বেনাবুনে সব হয়ে গেল কীত্তুনে। এককালে বড় বড় আদর্শের কথা বলত, পরে ক্ষমতা পেয়ে তারা আর মানুষকে মানুষ বলে জ্ঞান করছে না এ তো অহরহ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি ভাই। তাদেরই একজনের ধাঁচে ভাবীকাল ছবির ওই চরিত্রটা করেছিলাম।’
তুলসী চক্রবর্তীর এই বক্তব্যের মধ্যে অর্ধেন্দুশেখরের ওপরে উদ্ধৃত কথাগুলির প্রতিধ্বনি শোনা যায়। আর বোঝা যায় তাঁর সাধারণ মানুষসুলভ বিনয়ী, নম্র অন্তঃকরণের অন্তঃস্থলে এক গভীর সচেতনতা ও জীবনবোধ জাগ্রত ছিল। এই সচেতনতা ও জীবনবোধই সাদাসিধে মাটির মানুষটিকে ক্ষণজন্মা শিল্পীর মহত্ত্বে উত্তীর্ণ করেছিল।