ক্লোনবাবাজি ও কালকেতু

ক্লোনবাবাজি ও কালকেতু

অফিসে ঢুকেই কৌশিক বলল, ”কালকেতুদা, আজ একটা ফ্যান্টাসটিক রেকর্ড হয়েছে মুচিশা—র স্টেডিয়ামে।”

কম্পিউটারের সামনে বসে ইস্টবেঙ্গল—ভ্রাতৃসঙ্ঘ ম্যাচ সম্পর্কে একটা রিপোর্ট লিখছিলাম। তাকিয়ে দেখলাম, কৌশিকের মুখটা উত্তেজনায় ঝকমক করছে। আজ সকালেই ওকে পাঠিয়েছিলাম মুচিশায়। সাতগাছিয়ার ওদিকে একটা জায়গায়। অ্যাথলেটিকসের কোচ স্বপন রাহা এসে খুব করে ধরেছিল একজন রিপোর্টার পাঠানোর জন্য। ওরা, কোচেরা মিলে অ্যাথলিটদের জন্য একটা লিগ চালু করেছে। তারই প্রথম মিট ছিল অখ্যাত ওই মুচিশায়।

আমার যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। রিপোর্টারদের মধ্যে অ্যাথলেটিকসে খুব আগ্রহ সন্দীপের। ও খুব খোঁজখবর রাখে। কিন্তু দু’দিনের ছুটি নিয়ে ও বর্ধমান গেছে। সামনে কৌশিককে দেখে ওকেই বলেছিলাম স্বপনের সঙ্গে চলে যেতে। মুচিশা নামটা শুনে কৌশিক প্রথমে হেসে ফেলেছিল। ক্রিকেট রিপোর্টিং করার জন্য ও হিল্লি—দিল্লি ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফোন তুলে সৌরভ—শচীনদের সঙ্গে যখন—তখন কথা বলে। মুচিশার মতো এত ছোট একটা জায়গায়, সামান্য একটা অ্যাথলেটিকস মিটে যেতে ওর মন চাইবে কেন? তবুও গিয়েছিল।

ফিরে আসার পর এখন দেখছি, বেশ উত্তেজিত! জিজ্ঞেস করলাম, ”কী এমন রেকর্ড হল?”

আমার উলটো দিকের চেয়ারে বসেই কৌশিক বলল, ”কালকেতুদা, আজ একটা লাইফটাইম এক্সপিরিয়েন্স হল। এই প্রথম আমাদের একটা মেয়ে হান্ড্রেড মিটার রেস ১১ সেকেন্ডের কম সময়ে দৌড়ল। উফ, আমি ভাবতেও পারছি না।”

ভ্রাতৃসঙ্ঘের বিরুদ্ধে দীপেন্দু বিশ্বাস খেলতে পারবে কি না, আগে সেটা চেক করা দরকার। কৌশিকের গাঁজাখুরি শুনে কোনও লাভ নেই। চট করে ভেবে নিয়ে আমি টেলিফোনের রিসিভারটা তুললাম। ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে মনোরঞ্জনকে এখনও পাওয়া যাবে। আগে ওর সঙ্গে কথা বলে নেওয়া দরকার। ১১ সেকেন্ডের কমে একশো মিটার! তাও আবার আমাদের একটা মেয়ে? গুল মারার জায়গা পায়নি। হাসব, না রেগে উঠব, ঠিক বুঝতে পারলাম না।

মনোরঞ্জনের সঙ্গে কথা বলে আবার নিজের লেখায় মন দিয়েছি। কৌশিক ফের জিজ্ঞেস করল, ”কতটা লিখব কালকেতুদা?”

বললাম, ”অন্য কোনও কাগজের কোনও রিপোর্টার মুচিশায় গিয়েছিল?”

”না। একমাত্র আমিই ওখানে ছিলাম। খবরটা আমাদের এক্সক্লুসিভ হয়ে যাবে। কাল দেখবেন, ব্যাপারটা নিয়ে খুব হইচই হবে।”

কথাটা শুনে মনে মনে হাসলাম। রিপোর্টারদের এই এক দোষ। তার আনা খবর বড় করে ছাপানোর জন্য ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে বলা। কৌশিকের মধ্যে অবশ্য এই দোষটা এতদিন লক্ষ করিনি। আজ দেখছি, বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছে। সামান্য একটা মিট। অ্যাথলেটিকস কোচদের আয়োজন করা। আমাদের মতো বড় কাগজে এই খবর ১০—১২ লাইনের বেশি ছাপা হওয়া উচিত না। অন্য কেউ হলে লোকই পাঠাতাম না। নেহাত স্বপন রাহা আমার বন্ধুর মতো। তাই কৌশিককে পাঠিয়েছি। বললাম, ”বেশি লিখতে হবে না। তুমি পাঁচ—সাত সেন্টিমিটারের মতো লিখে দাও।”

মুখ দেখেই বুঝলাম, কথাটা কৌশিকের পছন্দ হল না। আমি স্পোর্টস এডিটর। মুখের ওপর কথা বলা ওর পক্ষে সম্ভব না। তাই একটু ঘুরিয়ে ও বলল, ”কালকেতুদা, আমার মনে হয়, আপনি একবার স্বপনদার সঙ্গে কথা বলে নিন। ওঁরা কিন্তু আমাকে বললেন, ইন্ডিয়ান অ্যাথলেটিকসে এটা একটা মাইলস্টোন।”

খবরটা বড় করে ছাপানোর জন্য স্বপন তো বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলবেই। তাই কৌশিকের কথায় পাত্তা না দিয়ে বললাম, ”কাগজে আজ খুব বেশি জায়গা নেই। জিম্বাবোয়ে থেকে সৌরভ আজ ফিরে আসছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে কেন বিশ্রী হারল, সে ব্যাপারে ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য সুমিতকে ওর কাছে পাঠিয়েছি। রূপায়ণ গেছে পৌলমী ঘটকের কাছে। মেয়েটা ব্রাজিল থেকে ফিরেছে। এত খবরের মধ্যে আমাকে মুচিশা ঢোকাতে হবে। তুমি বেশি লিখো না।”

আর কোনও কথা না বলে কৌশিক কম্পিউটারের সামনে বসে গেল। ওর চোখ দেখে মনে হল, মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে। বেচারি সাত সকালে সেই বিরাটি থেকে গেছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায়। এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। বিরাটিতে থাকে বলে ডিপার্টমেন্টের অন্যরা মাঝে—মধ্যে ওকে খ্যাপায়। রতন একবার ওদের বাড়িতে গিয়েছিল। ওখানে একটা দোকানে সাইনবোর্ড দেখে এসেছিল, ‘এখানে কলিকাতার দরে কয়লা পাওয়া যায়।’ ফিরে এসে ও অফিসসুদ্ধু কথাটা রাষ্ট্র করে দেয়। আমাদের সুপ্রিয় থাকে দেশপ্রিয় পার্কের কাছে। ওর ১০ বছরের মেয়ে আজ পর্যন্ত কয়লা জিনিসটা চোখে দেখেনি। ও প্রায়ই কৌশিকের কাছে ঠাট্টা করে জানতে চায়, মেয়েকে কয়লা দেখানোর জন্য কবে বিরাটিতে নিয়ে যাবে।

সারাদিন বসে কৌশিক অত ইভেন্ট দেখেছে। তারপর যদি ফিরে এসে শোনে পাঁচ—সাত লাইনের বেশি লিখতে হবে না, তা হলে মনখারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ও এসে যা বলছে, বিশ্বাস করা যায় না। ১১ সেকেন্ডের কম সময়ে একশো মিটার দৌড়! পি টি ঊষার মতো অ্যাথলিটও পারেনি। ওর সেরা সময় ছিল, ১১.৩৯ সেকেন্ড। ফ্লোরেন্স গ্রিফিথ জয়নারকে অবশ্য সাব—ইলেভেন দৌড়তে দেখেছিলাম বার্সেলোনা ওলিম্পিকসে। সম্ভবত ১০.৪৯ সেকেন্ডে। ওরা পারে। তাই বলে আমাদের কোনও মেয়ে? অসম্ভব। আসলে কৌশিক অ্যাথলেটিকস রিপোর্ট কখনও করে না। পাবলিসিটি পাওয়ার জন্য স্বপনরা কী বলতে কী বলেছে সেটাই বিশ্বাস করে নিয়েছে।

ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের প্রিভিউ শেষ করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বাথরুমে গিয়ে চোখমুখে জল দিয়ে ফিরে আসছি, এমন সময় করিডোরে দেখা নিউজ এডিটরের সঙ্গে। আমাকে দেখেই উনি বললেন, ”এই যে কালকেতুবাবু, আপনাকেই খুঁজছিলাম। সৌরভের খবরটা কিন্তু আজ আমরা পেজ ওয়ানে নেব।”

বড় কাগজে খেলার পাতায় রোজ জায়গা কম। খেলার একটা খবর প্রথম পাতায় চালান করে দিতে পারলে আমারই সুবিধে। অন্য একটা খবর তা হলে খেলার পাতায় ঢোকানো যায়। ক্রিকেটের খবর হলে নিউজ এডিটররা চোখ বুজে নিয়ে নেন। তাই বললাম, ”ঠিক আছে। সুমিত ফিরুক। তারপর পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওই একই ফ্লাইটে কিন্তু পৌলমীও ফিরেছে।”

”সে আবার কে?”

”টেবল টেনিসে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ান। ব্রাজিলে খুব ভাল খেলেছে।”

”না, না। পৌলমী—ফৌলমীর খবর আমরা নিতে পারব না। সৌরভের খবর বেশি করে দিন। কাগজটা বেশি বিক্রি হয় তা হলে।” বলেই নিউজ এডিটর হনহন করে চলে গেলেন ফোটোগ্রাফারদের ঘরের দিকে।

আজকাল অফিসের ভেতর সিগারেট খাওয়া বারণ। সিগারেট টানার ইচ্ছে হলে নীচে নেমে অফিস চৌহদ্দির বাইরে যেতে হয়। অনেকক্ষণ ধূমপান করা হয়নি। সিগারেট খাওয়ার জন্য নীচে নেমে এলাম। রিসেপশনেই দেখা হয়ে গেল তথাগতর সঙ্গে। বৃষ্টিতে ভিজতে—ভিজতে কোথাও থেকে ফিরেছে। পাখার হাওয়ায় গায়ের জামা শুকিয়ে নিচ্ছে। ও আগে আমাদের ডিপার্টমেন্টে ছিল। ক্রীড়া সাংবাদিকতা করা ছাড়াও আমার একটু—আধটু গোয়েন্দাগিরির শখ আছে। এই ছেলেটা রহস্যভেদের কয়েকটা ঘটনায় তখন আমাকে সাহায্য করেছে। মাসদুয়েক আগে ট্রান্সফার নিয়ে ও চলে গেছে জেনারেল রিপোর্টিংয়ে। কিন্তু খেলা নিয়ে উৎসাহ হারায়নি। আমাকে দেখেই তথাগত বলল, ”কালকেতুদা দেখলেন, জিম্বাবোয়ে নিয়ে যা বলেছিলাম তা হল কি না?”

জিম্বাবোয়েতে ত্রিদেশীয় ক্রিকেট শুরু হওয়ার আগে তথাগত আমাকে বলেছিল, ”দেখবেন, এবার ঠিক ওয়েস্ট ইন্ডিজকে চ্যাম্পিয়ান করানো হবে।” শুনে হেসেছিলাম। ওয়েস্ট ইন্ডিজ কী করে চ্যাম্পিয়ান হবে? ওদের টিমটা এখন এত খারাপ অবস্থায় যে, ভারতকে হারানো সম্ভবই না। কিন্তু তথাগত দমে যাওয়ার ছেলে না। আমাকে একটা অদ্ভুত কথা বলেছিল, ”ওয়েস্ট ইন্ডিজে ক্রিকেটের হাল খুব খারাপ বলেই দেখবেন, ওদের জিতিয়ে দেওয়া হবে। যাতে ওদের দেশের লোকেরা আবার ক্রিকেটমুখী হয়ে ওঠে। এটা একটা ইন্টারন্যাশনাল ছক।”

সেদিন বলেছিলাম, ”তা হয় নাকি?”

”আমার কথা মিলিয়ে নেবেন আপনি। এই যে অস্ট্রেলিয়া এসে ভারতকে ফলো অন করিয়েও ইডেনে ম্যাচটা হেরে গেল, এটাও ওই ছক। ম্যাচ গট আপ, বেটিং এসব নিয়ে ভারতে ক্রিকেটের যথেষ্ট বদনাম হয়ে গেছিল তখন। আবার লোককে ক্রিকেটে টেনে আনার জন্য একটা অবিশ্বাস্য জয় দরকার ছিল। সেটাই করা হল। এখন দেখুন, লোকে সব ভুলে গেছে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের কথা।”

তথাগতটা এমন ক্রিকেট—বিরোধী ছিল না। একবার প্রেস কনফারেন্সে কপিলদেবের সঙ্গে ওর প্রচণ্ড তর্কাতর্কি হয়। তারপর থেকেই ও ক্রিকেটারদের ওপর হাড়ে হাড়ে চটা। এ ঘটনাগুলো আমি জানি। রিসেপশনে দাঁড়িয়ে তাই হাসতে হাসতে বললাম, ”তোর মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। এবার ডাক্তার দেখা।”

তথাগত বলল ”কালকেতুদা, বিশ্বাস করলেন না তো? দেখবেন একদিন—না— একদিন এসব জোচ্চুরি ধরা পড়ে যাবে।”

ক্রিকেট বেটিং নিয়ে আনন্দমেলায় আমি একটা গল্প লিখেছিলাম ছ’—সাত বছর আগে। তখন কেউ বিশ্বাসই করতে চাননি। হ্যান্সি ক্রোনিয়ে ধরা পড়ার পর এখন অনেকের মাথায় ঢুকেছে। যাকগে, ওসব ফালতু ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনও লাভ নেই। অফিসের বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরালাম। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তায় কাদা। মোটর ভেহিকেলসের বারান্দায় উঠে আমি মনে মনে ঠিক করতে লাগলাম, খবরের জন্য আর কোথাও ফোন করার দরকার আছে কি না। ফট করে মনে হল, আজ একবারও ইন্টারনেটে বসিনি। ফুটবলের ওয়েবসাইটগুলো দেখা হয়নি। ভাইচুং ভুটিয়া বেরি ক্লাবের ট্রেনিংয়ে যোগ দিতে গেছে। ওখানে খবর হতেও পারে।

সিগারেটে মৌজ করে টান দিচ্ছি। এমন সময় মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। ও—প্রান্তে সুদীশ। আমার পুলিশ—বন্ধু সুদীশ নাগ। আমার গলা শুনেই ও বলল, ”তুই এখন কোথায়? ভবানী ভবনে একবার আসতে পারবি? তোর সঙ্গে প্রচণ্ড একটা দরকার আছে।”

এই ক’দিন আগেও সুদীশ কলকাতা পুলিশে ছিল। মাস ছয়েক আগে ও জেলা—পুলিশে বদলি হয়ে গেছে। এখন বসে আলিপুরে ভবানী ভবনে। রহস্যভেদে মাঝে—মাঝে সুদীশ আমাকে সাহায্য করে। কোনও—কোনও সময় কোনও কেস—এ ও ঠেকে গেলে আমারও সাহায্য নেয়। সেরকমই কিছু হবে বুঝি! কিন্তু এখন আমার পক্ষে আলিপুরে যাওয়া সম্ভব না। পেজ রিলিজ করার ব্যাপার আছে। একটু দেরি হলে প্রেসের লোকেরা এসে ঝামেলা করবে। তাই বললাম, ”ফোনে বলা সম্ভব না?”

সুদীশ বলল, ”না রে! সমস্যাটা জটিল। আমার মাথায় বিশেষ কিছু ঢোকেনি। আই জি এইমাত্র আমাকে ডেকে প্রবলেমটা বললেন। তাই তোর সাহায্য চাই।”

”ইন নাট সেল, আমায় ফোনে বলতে পারবি না?”

”না রে, তোকে কিছু কাগজপত্তর দেখাতে হবে। দাঁড়া, তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। তোর ঝামেলা কখন চুকবে, বল তো? আমি না হয় বাড়ি যাওয়ার সময় তোর অফিসে ঢুঁ মেরে যাব।”

সুদীশ থাকে বিডন স্ট্রিটের দিকে। বাড়ি ফেরার সময় এদিক দিয়েই যাবে। তাই বললাম, ”ঠিক আছে। চলে আয়। আটটার পর।”

মোবাইল অফ করে ফের ওপরে উঠে এলাম। রূপায়ণ ফিরে এসেছে। রিপোর্ট লিখতে বসে গেছে। ব্রাজিলে পৌলমী কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল। আমাদের কাগজে তবুও এদের কথা বের হয়। অন্য কাগজগুলো সৌরভ—শচীন ছাড়া অন্য কাউকে তো প্লেয়ার বলেই মনে করে না। কৌশিক রিপোর্ট লিখে প্রিন্ট বের করে আমার টেবলে রেখে বোধ হয় খেতে গেছে। ওর রিপোর্টটা পড়তে শুরু করলাম।

‘শুক্রবার ভারতীয় অ্যাথলেটিকস ইতিহাসে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে গেল। ১০০ মিটার দৌড়ে এই প্রথম ১১ সেকেন্ডের বাধা টপকালেন একজন ভারতীয় মেয়ে। মুচিশার স্টেডিয়ামে ওই অসাধারণ রেকর্ডটি করেন রুডি। ১০.৯৬ সেঃ সময় করে তিনি ভেঙে দিলেন পি টি ঊষার রেকর্ড। সপ্তদশী এই মেয়েটি এবারই অ্যাথলেটিকস মিটে প্রথম অংশ নিচ্ছেন। প্রতিভাবান অ্যাথলিট খুঁজে বের করার জন্য বাংলার কয়েকজন অ্যাথলেটিকস কোচ এই মিটের আয়োজন করেছেন। প্রথম মিট হল মুচিশা গ্রামে। এর পরে এক সপ্তাহ অন্তর আরও চারটি মিট হবে যথাক্রমে ডায়মন্ডহারবার, বহরমপুর, কোচবিহার ও মীন দ্বীপে।’

রিপোর্টটা পড়ে মনে মনে হাসলাম। কৌশিক খুব রেগে রয়েছে মনে হচ্ছে। চ্যাম্পিয়ান মেয়েটার নাম লিখেছে, কিন্তু পদবি লেখেনি। তা ছাড়া অন্য কোনও ইভেন্টের ফলও দেয়নি। মিটে একটাই মাত্র ইভেন্ট, হতে পারে না। কৌশিক ফিরে এলে আরও কয়েকটা লাইন জুড়ে দিতে বলব। মনে খটকা। ১০.৯৬ সময় কেউ করতে পারে বলে আমার অন্তত বিশ্বাস হচ্ছে না। খবরটা ছাপালে কাল লোকে হাসবে না তো?

উঠে ইন্টারনেটের ঘরে গিয়ে বসব কি না ভাবছি, এমন সময় মনে হল, কৌশিকের রিপোর্ট সম্পর্কে এমন অবিশ্বাসই বা করছি কেন আমি? রুডি বলে মেয়েটা তো রেকর্ড করতেও পারে। একেক সময় একেক জন অসাধারণ প্রতিভা উঠে আসে একেকটা দেশে। ঊষাকে যখন প্রথম পাতিয়ালার ক্যাম্পে দেখি, তখন কি ভাবতে পেরেছিলাম, ও এত পদক নিয়ে আসবে দেশের জন্য? কে ভেবেছিল গোপীচন্দ্রের মতো একটা ছেলে অল ইংল্যান্ড ব্যাডমিন্টনে চ্যাম্পিয়ান হবে? না, কৌশিকের কাছে আগে সব ভাল করে জেনে নেওয়া যাক।

কথাটা ভাবার মাঝে ঘরে এসে ঢুকল কৌশিক। ওকে দেখেই জিজ্ঞেস করলাম, ”এই রুডি মেয়েটার পুরো নাম কী?”

”তা তো কিছু বলল না। শুধু বলল রুডি। মেয়েটাকে দেখলে আপনার ইন্ডিয়ান বলেই মনে হবে না কালকেতুদা। মনে হবে কোনও আমেরিকান মেয়ে। যেমন হাইট, তেমনই মাসল কো—অর্ডিনেশন। দেখলেই আপনার মনে হবে মারিয়ন জোন্সের কোনও আত্মীয়—টাত্মীয় হবে। ওর রেসটা হয়ে যাওয়ার পর আজ একটা ঝামেলা হয়েছিল। কাগজে জায়গা নেই আপনি বললেন। তাই লিখতে পারলাম না।”

”কী ঝামেলা হয়েছিল?”

”আসলে এই মিটটা অর্গানাইজ করছে বাংলার অ্যাথলেটিকস কোচেরা। সারা বাংলা জুড়ে এঁদের কোচিং ক্যাম্প আছে। সেইসব ক্যাম্পের ছেলেমেয়ে কেমন প্রোগ্রেস করল, তা দেখার জন্য এই মিট। ট্যালেন্ট সার্চ আর কী। একটাই মাত্র ইভেন্ট। ১০০ মিটার দৌড়। শ’খানেক ছেলেমেয়ে এসেছিল। তা, প্রথম হিটে রুডি বলে মেয়েটা যখন ১১.২০ সময় করে ঊষা আর রচিতা পাণ্ডার জয়েন্ট রেকর্ডটা ভেঙে দিল, তখন অন্য ১০—১২ জন কোচ গিয়ে হামলা করেছিল টাইম কিপারদের ওপর। ওঁদের বক্তব্য, ঘড়িতে নিশ্চয়ই কোনও গণ্ডগোল আছে। না হলে এত কম সময় হতেই পারে না। ফের হিটের ব্যবস্থা করতে হবে।”

”তারপর কী হল?”

”স্বপন রাহারা সবাইকে বোঝাল, এখনও চারটে রাউন্ড আছে। মেয়েটাকে দৌড়তে হবে। আপনারা এত অবিশ্বাস করছেন কেন? কোয়ার্টার ফাইনাল রাউন্ডে আপনারাই টাইম নিন। আমাদের কেউ ফিনিশিং পয়েন্টের ধারেকাছে থাকব না।”

”পরের রাউন্ডে ওরা সবাই টাইম নিল?”

”হ্যাঁ কালকেতুদা। তখন রুডি টাইম করল, ১১.১০। টাইম দেখে সব কোচ তখন চুপ করে গেল। প্রতি রাউন্ডে টাইম কমাতে কমাতে তারপর ফাইনালে গিয়ে সাব—ইলেভেন টাইম করল মেয়েটা। তারপর সব কোচদের কী নাচানাচি!”

এত কথা শোনার পরও আমার ধন্ধ যায় না। জিজ্ঞেস করলাম, ”মেয়েটার কোচ কে? তাঁর সঙ্গে কথা বলেছ?”

”ভাল করে কথা বলার আগেই কোচ ভদ্রলোক একটা মারুতি ভ্যানে ওঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলে গেলেন। বললেন, অনেকদূর যেতে হবে। সেই মীন দ্বীপ না যেন কোথায়? হলদিয়া পেরিয়ে যেতে হয়। আপনি এত ইন্টারেস্ট নেবেন জানলে আমি মেয়েটারও ইন্টারভিউ নিয়ে আসতাম।”

”কোচের নামটা কী, বলতে পারবে?’

”লুকে পেলজার…। বেশ বয়স্ক। সবাই ওঁকে সার সার বলে ডাকছিলেন। আপনি স্বপন রাহাকে ফোন করলে সব জানতে পারবেন। কেননা দেখলাম, স্বপন রাহার সঙ্গে বেশ চেনা।”

”ওহ, তা হলে ইন্ডিয়ান না, পেলজার যখন…তার মানে জার্মান। ভদ্রলোক কী ভাষায় কথা বলছিলেন?”

”কেন, বাংলায়। ইস, এখন আফসোস হচ্ছে কেন লোকটার সঙ্গে ভাল করে কথা বলে রাখলাম না? রিপোর্টটা আপনি দেখেছেন কালকেতুদা? কয়েকটা লাইন কি বাড়িয়ে দেব?”

”দাও।” বলেই আমি স্বপন রাহাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করতে লাগলাম। আফসোস এখন আমারই হচ্ছে। আরও আগে কেন কৌশিককে এসব কথা জিজ্ঞেস করলাম না? তা হলে রুডি মেয়েটাকে নিয়ে অন্যরকমভাবে স্টোরিটা করা যেত। হঠাৎ মনে হল, ছয়ের দশকে ডঃ অটো পেলজার বলে একজন জার্মান কোচ দিল্লিতে এসেছিলেন। ভারতে ম্যারাথন দৌড় জনপ্রিয় করার জন্য তিনি অনেক চেষ্টা করেছিলেন সেই সময়। পেলজার ভারতের এমন প্রেমে পড়ে যান যে, আর দেশেই ফিরে যাননি। এই লুকে পেলজার কি তাঁরই কেউ হন নাকি? কৌশিক বলল, ভদ্রলোক মীন দ্বীপে থাকেন। জায়গাটার নাম আমি শুনেছি হলদিয়া কাউন্টি স্পোর্টস ফেডারেশনের সেক্রেটারি সঞ্জয় ব্যানার্জির মুখে। কী একটা নদী পেরিয়ে যেতে হয়, জানি। একবার আমাকে ও ওখানে নিয়ে যেতেও চেয়েছিল।

স্বপনকে ফোনে পাওয়া গেল না। রাত দশটার আগে নাকি বাড়ি ফিরবে না। অত রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে না। তাই কৌশিককে বললাম, ”যতটা পারো এই রিপোর্টটা বাড়াও। আমি একটা ঝুঁকি নেব। বড় করে ছাপব।”

…সব কাজ আটটার মধ্যে শেষ করে আমি ইন্টারনেটের ঘরের দিকে গেলাম। কোপা আমেরিকার খেলা চলছে কলম্বিয়ায়। ব্রাজিল—পেরু ম্যাচের রেজাল্ট কী হল, জানা দরকার। ব্রাজিলের দলটা ভাল খেলছে না। মন এমনিতেই খারাপ। ঘরে গিয়ে দেখি কম্পিউটারের সামনে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন দেখছে পথিক। আমাদের কাগজে প্রতি সোমবার বিজ্ঞান বিষয়ক একটা পাতা বের হয়। সেই পাতাটির দায়িত্ব এই পথিক গুহের ওপর। ছেলেটার প্রচুর পড়াশোনা। কঠিন বিষয়গুলো খুব সহজভাবে লেখে। সাধারণ পাঠক, যাদের বিজ্ঞান নিয়ে অতটা আগ্রহ নেই, তাদেরও বুঝতে অসুবিধে হয় না। পথিককে আমার আরও ভাল লাগে এই কারণে যে, ও পাঁড় ফুটবল সমর্থক। আর মোহনবাগান অন্ত প্রাণ।

আমাকে দেখেই পথিক বলল, ”কালকেতুদা, আপনি কি নেটে বসবেন? তা হলে আমাকে পাঁচটা মিনিট সময় দিন।”

বললাম, ”ঠিক আছে। আমার তাড়াতাড়ি নেই। কী নিয়ে লিখছ এবার?”

”হিউম্যান ক্লোনিং। খুব ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট। নেটে চমৎকার কিছু মালমশলা পেয়ে গেলাম। সোমবার ক্লোনিং নিয়েই লিখব।”

বছরখানেক আগে ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে একটা লেখা পড়েছিলাম ক্লোনিং নিয়ে।

খুব অবাক হয়েছিলাম। একটা মানুষের মতো একাধিক মানুষ তৈরি করা নাকি সম্ভব। বিজ্ঞান কোথায় চলে গেছে আজকাল। পথিকের পেছনে দাঁড়িয়ে আমি ওয়েবসাইটটা দেখে রাখলাম। হিউম্যান ক্লোনিং ও আর জি ডট কম। পরে কোনও ফাঁকা সময়ে বসে লেখাগুলো দেখে নেব। আজকাল ইন্টারনেটে বসে নানা বিষয় নিয়ে পড়তে আমার খুব ভালো লাগে।

পথিক উঠে যাওয়ার পর নেটে বসতে যাব, এমন সময় মোবাইলে ফোন, ”কালকেতু, আমি চাঁদনি চক মেট্রো স্টেশনের কাছে এসে গেছি। তুই নেমে আয়।”

অগত্যা উঠে পড়তে হল। সুদীশ এসে গেছে। কৌশিকের রিপোর্টে একটা হেডিং করে দিয়ে আমি নীচে নেমে এলাম।

সুদীশের সঙ্গে দেখা হলেই প্রথমে ও যে অভিযোগটা করে, সেটা আজও করল, ”তোরা সবাই মিলে কি ইস্টবেঙ্গল ক্লাবটা তুলে দিবি?”

ভীষণ হাসি পেল কথাটা শুনে। মাঝে সুদীশ ইস্টবেঙ্গল ক্লাব নিয়ে কোনও কথাই বলত না। এ বছর টিমটা জাতীয় লিগ চ্যাম্পিয়ান হওয়ার পর থেকে দেখছি, ওর পুরনো আবেগ আবার ফিরে এসেছে। ওর প্রশ্নটা শুনে বললাম, ”কেন, আমরা কী অপরাধ করলাম?”

”তোরাই তো আসল কালপ্রিট। এই যে বিজয়নের ট্রান্সফারটা অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন আর মোহনবাগান মিলে ষড়যন্ত্র করে আটকে দিল, তোরা তো একটা লাইনও তার বিরুদ্ধে লিখলি না?”

কেউ ষড়যন্ত্র করেনি। দোষ আসলে বিজয়নেরই। কিন্তু সুদীশকে বোঝাতে গেলে রাত্তির বারোটার আগে বাড়ি ফিরতে পারব না। ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টাররা সবাই একেবারে আর্জেন্টিনার ফুটবলপ্রেমীদের মতো। সবকিছুতেই ষড়যন্ত্রের গন্ধ পায়। তাই বললাম, ”লিখে কোনও লাভ নেই। বিজয়ন তোদের ক্লাবে খেলবে। তুই নিশ্চিন্ত থাক। যাকগে, তুই কী বলতে এসেছিস, বল।”

”এখানে বসে বলা যাবে না। চল, কোথাও বসি।” বলেই সুদীশ আমাকে গাড়িতে তুলে নিল। তারপর ড্রাইভারকে বলল, ”চল, লেক ক্লাবে চল।”

গাড়ি এসপ্ল্যানেডে আসার পর বললাম, ”লালবাজার থেকে জেলা পুলিশে গিয়ে তোর কেমন লাগছে রে?”

”খুব বাজে। এতদিন টুক করে ইস্টবেঙ্গলের ম্যাচ দেখতে চলে যেতাম। আর এখানে আজ বজবজ, কাল সুন্দরবন করতে হচ্ছে। ভাল লাগে, বল?”

”সুন্দরবনে গিয়েছিলি?”

”হ্যাঁ, এই তো কয়েকদিন আগে গেলাম। কলস দ্বীপের কাছে একটা চর—এ কয়েকজন জলদস্যু খুব বাড়াবাড়ি শুরু করেছিল। ইলিশ মাছের ট্রলার আটকে রেখে ওরা মুক্তিপণ আদায় করছিল। দিনতিনেক লাগল ওদের ঠান্ডা করতে। কখনও গেছিস ওদিকটায়? সুন্দরবন জায়গাটা কিন্তু দারুণ।”

একবারে ঝড়খালি পর্যন্ত গেছিলাম। মাতলা নদীর ভয়ঙ্কর রূপ দেখে আর দক্ষিণে যেতে সাহস পাইনি। বললাম, ”না রে, ওদিকটায় যাওয়া হয়নি। তুই যে গেলি, বাঘ দেখতে পেয়েছিস?”

”হ্যাঁ। পিরখালিতে। নদীর ধারে জল খেতে এসেছিল। সুন্দরবনের মানুষগুলোকে দেখে সত্যিই আমি অবাক হয়ে গেছি। জানিস, কীভাবে লড়াই করে ওদের বাঁচতে হয়? জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। ওখানকার ছেলেমেয়েদের যদি তোদের খেলার জগতে আনা যায়, তা হলে একেক জন সব দারুণ স্পোর্টসম্যান হবে।”

কথাটা মন্দ বলেনি সুদীশ। আমারও তাই মনে হয়। আরাম—বিলাসের মধ্যে থাকা শহুরে ছেলেমেয়েদের দিয়ে কিছু হবে না। লড়াকু ছেলেমেয়ে চাই। এ নিয়ে গ্যারি স্মিথের একটা লেখা পড়েছিলাম ‘ইলাসট্রেটেড উইকলি’তে। প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশে যারা বসবাস করে, তাদের শিখিয়ে—পড়িয়ে ভাল ক্রীড়াবিদ করা সম্ভব। আমেরিকায় এসব নিয়ে রিসার্চ হয়। আমাদের দেশে কেউ এত খুঁটিনাটি ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাই বিরাট জনগোষ্ঠীর একটা অংশ খেলার আঙিনার বাইরেই থেকে যায়।

সুদীশের মুখে সুন্দরবনের গল্প শুনতে—শুনতে লেক ক্লাবে এসে পৌঁছলাম। তখনও ভাবিনি, একটু পরে লেক ক্লাবে বসে ও আমাকে সুন্দরবন নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বসবে। বাইরে লনে বসে খাবারের অর্ডার দিয়ে সুদীশ বলল, ”যা বলতে যাচ্ছি, শুনলে তোর আজগুবি বলে মনে হবে। কিন্তু এটাই সত্যি। আচ্ছা, একস্ট্রা টেরেস্ট্রিয়াল এলিমেন্টস নিয়ে তোর কি কোনও ধারণা আছে?”

বললাম, ”বেশি কিছু জানি না। সিনেমায় দেখেছি। টিভি—তে কখনও দেখি। মনে হয়, বানানো গপ্প।”

”না, বানানো গপ্প নয়। ডি আই বি রিসেন্টলি একটা রিপোর্ট পাঠিয়েছে, সুন্দরবনের একেবারে রিমোট একটা দ্বীপে মাঝে—মধ্যে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখা যাচ্ছে। ওই দ্বীপটা পরিত্যক্ত। কেউ বসবাস করে না। ট্রলারে করে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার সময় সেই জিনিসটা জেলেদের চোখে পড়েছে।”

”জিনিসটা কী?”

”ফ্লাইং সসার টাইপের কিছু। মানে, উড়ন্ত যান গোছের। রাতের বেলায় আসে, ভোর হতে—না—হতে আবার চলে যায়।”

”রেডারে ধরা পড়েনি?”

”ওই অঞ্চলে রেডার অ্যাকটিভেট করে না। আমাদের ডি আই বি—র লোকেরা ভটভটি করে ওই দ্বীপটায় গিয়েছিল। দেখে এসেছে, কিছু ছোট ছোট কটেজ আছে। একটা ল্যাবরেটরি গোছের কিছু করা হচ্ছে। চারদিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ওরা খবর দিয়েছে, সরকারের কাছ থেকে ওই দ্বীপটা প্রায় কুড়ি বছর আগে মাছের ভেড়ি করার অন্য লিজ নিয়েছিলেন এক ভদ্রলোক। তারপর থেকে ওখানে কী হয়েছে কারও মাথাব্যথা নেই। সুন্দরবন অঞ্চলে এখনও কিছু কিছু দুর্গম জায়গা আছে, যেখানে মানুষ বাঘের ভয়ে যায় না। ইদানীং কিছু কিছু অদ্ভুত ব্যাপার আশপাশের লোকেরা লক্ষ করেছেন বলে পুলিশের নজর রাখতে হচ্ছে।”

”কিন্তু সমস্যাটা কী?”

”আরে, সেটাই তো ভাল করে জানি না। ডি আই বি—র যে লোকগুলো ওখানে গিয়েছিল, ওরা এসে বলেছে, ওই দ্বীপে নাকি একই রকম দেখতে বেশ কিছু লোককে ওরা দেখেছে। সেই লোকগুলো বাঘ পোষে। মানে আমরা যেমন কুকুর পুষি আর কী। এ সব অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার। আমরা চব্বিশ পরগনার ডি এম—কে একটা নোট পাঠিয়েছি আরও ইনফরমেশন এনে দেওয়ার জন্য। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে কী জানিস, বাবা দক্ষিণ রায়ের ভয়ে আমাদের কোনও লোক ওই দ্বীপে আর যেতে চাইছে না।”

হাসতে হাসতে বললাম, ”কেন? গেলে বাঘে খেয়ে ফেলবে?”

”তুই হাসছিস? এখানে বসে ঠিক বুঝতে পারবি না, ওখানে কী অবস্থা। আমি একবার গিয়েই বুঝতে পেরেছি। যাকগে, তোকে যে কারণে ডাকলাম, ক্লোনিং সম্পর্কে তোর কোনও আইডিয়া আছে?”

মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে পথিকের সঙ্গে ক্লোনিং নিয়ে কথা হচ্ছিল। আচমকা সুদীশের মুখে একই প্রসঙ্গ শুনে জিজ্ঞেস করলাম, ”কেন বল তো?”

”আমার কী মনে হয় জানিস, সুন্দরবনের ওই দ্বীপে ক্লোনিং নিয়ে কেউ গবেষণা করছে। এই ডি আই বি—র লোকগুলো এসে বলছে, ওখানে একই রকম দেখতে কিছু লোককে ওরা দেখে এসেছে, ক্লোন করা ছাড়া কিছুতেই সেটা সম্ভব না। তারপর ওই বাঘ পোষা…রহস্যজনক। তার মানে, কেউ বাঘের ক্লোন তৈরি করেছে। এবং এমনভাবে তাদের ট্রেনিং দিয়েছে, যাতে তারা পোষ মানে।”

খাওয়া বন্ধ করে আমি সুদীশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও যা বলছে, তা হওয়া অসম্ভব কিছু না। টাইম ম্যাগাজিনে পড়েছিলাম, ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা অনেকদিন চেষ্টা করার পর ভেড়ার ক্লোন করতে সক্ষম হয়েছেন। স্কটল্যান্ড থেকে বছর পাঁচেক আগে ওই খবরটা ছড়ানোর পর সারা বিশ্বে হইচই শুরু হয়ে গেছিল। আমেরিকার কিছু বিজ্ঞানী তখনই বলে দেন, মানুষেরও ক্লোন করা সম্ভব। তার মানে, একটা মানুষের মতো দেখতে হুবহু আরেকটা মানুষ তৈরি করার দিন এসে গেছে। কিন্তু সেই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা—নিরীক্ষার জন্য সময় লাগবে। এখন পর্যন্ত বিশ্বের কোথাও কোনও বিজ্ঞানী দাবি করেননি, তিনি মানুষের ক্লোন করেছেন। সুন্দরবনে যে বা যিনি এসব নিয়ে গবেষণা করছেন বলে সুদীশের ধারণা, তিনি কী করে একই রকম দেখতে একাধিক মানুষ তৈরি করে ফেলবেন?

সুদীশকে বললাম, ”ওই দ্বীপে তুই নিজে গিয়ে একবার খোঁজ—খবর নে না।”

”আমিও সে—কথাই ভাবছি। সমস্যাটা অন্য জায়গায়। তুই ‘ঈস’ বলে কোনও সংস্থার নাম শুনেছিস?”

”’ঈস’? না, কী ধরনের সংস্থা?”

”আমারও বিশেষ কোনও ধারণা নেই। এই অর্গানাইজেশনটা কিছু বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ মিলে তৈরি করেছেন। নিজেদের ওঁরা ‘ঈশ্বরের সন্তান’ বলে পরিচয় দেন। সেই থেকে ঈস। শুনলাম, ওঁদেরই একজন সুন্দরবনের দ্বীপটা লিজে নিয়েছিলেন। কোটি কোটি টাকার মালিক। এই অর্গানাইজেশনটার মেম্বার কম নয়। পঞ্চাশ হাজারের মতো। ভারতে তো বটেই, এঁরা ছড়িয়ে—ছিটিয়ে আছেন বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা পর্যন্ত। এঁদের কর্মকাণ্ড অদ্ভুত।”

”তুই এত খবর পেলি কোত্থেকে?”

”এঁদের একটা ওয়েবসাইট আছে। ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ ঈস ডট কম। সেখান থেকে জেনেছি। এঁরা ডারউইনের তত্ত্ব বিশ্বাস করেন না। এঁরা মনে করেন, ঈশ্বর ক্লোন তৈরি করে পৃথিবীতে ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা তাদেরই বংশধর। এবং আমাদেরও উচিত কিছু ক্লোন তৈরি করে অন্য গ্রহ বা উপগ্রহে ছেড়ে আসা। একটা সময় আসবে, তখন পৃথিবীতে থাকার জায়গা থাকবে না। খাদ্যশস্য যথেষ্ট পাওয়া যাবে না। তাই এখনই মহাবিশ্বে আমাদের একটা উপনিবেশ গড়ে রাখতে হবে।”

এই পর্যন্ত শুনে আমি বললাম, ”তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে, কোনও আমেরিকান লেখকের সায়েন্স ফিকশন পড়ছি। তা, এই অর্গ্যনাইজেশনের চিফ লোকটা থাকে কোথায়?”

”আমার ধারণা, সুন্দরবনের ওই দ্বীপে। ওইখান থেকেই অর্গানাইজেশনটা চালায়। লোকটার নিজস্ব প্লেন আছে। তবে আমরা যে অর্থে প্লেন বুঝি, সেরকম না। অনেকটা ফ্লাইং সসারের মতো কিছু। এ—খবরটা পেলাম, কোস্টাল গার্ডদের কাছ থেকে। তোর মনে আছে, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে কিছুদিন আগে একটা ট্রলার আটকা পড়ে গিয়েছিল? একটা হেলিকপ্টার ওই ট্রলারের জেলেদের উদ্ধার করতে গিয়েছিল তখন। কপ্টার থেকে হঠাৎ গার্ডরা ওই দ্বীপে গোল চাকতির মতো কয়েকটা জিনিস দেখতে পায়। হেড কোয়ার্টারে এসে ওরা খবরটা দেওয়ার পর আরেকবার কপ্টার পাঠানো হয়েছিল চক্কর মেরে আসার জন্য। তখন কিন্তু ওপর থেকে আর কিছু দেখা যায়নি। তার মানে, ঈসের লোকেরা সাবধান হয়ে গিয়েছিল।”

সুদীশের কথা শুনে আমার অনেক কিছু আজগুবি মনে হচ্ছে। কিন্তু লেক ক্লাবের মতো অভিজাত ক্লাবে বসে ডিনার সারতে সারতে আন্দাজ করা সম্ভব নয়, সুন্দরবনের মতো জায়গায় রহস্যজনক কী ঘটে যাচ্ছে। একটা কথা অবশ্য আমার মাথায় ঢুকছে না, সুদীশের কথামতো ঈস বলে যদি কোনও অর্গানাইজেশন থেকেও থাকে, তা হলে পুলিশের মাথাব্যথার কারণটা কী? একদল বিজ্ঞানমনস্ক লোক ওখানে বসে গবেষণা করছেন! লোকচক্ষুর অন্তরালে বসে ওঁরা কি কোনও অপরাধমূলক কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন? সুদীশ তো সেরকম কিছু বলল না? তাই জিজ্ঞেস করলাম, ”ঈস নিয়ে তোরা এত মাথা ঘামাচ্ছিস কেন?”

”তোরা নয়, বল তুই। একটাই কারণ। ক্লোন নিয়ে গবেষণা ভবিষ্যতের পক্ষে খুব খারাপ হয়ে দাঁড়াবে। এ সম্পর্কে গত তিন—চার দিনে একটু—আধটু পড়াশোনা করেছি। ইউরোপের উনিশটা দেশ অলরেডি ব্যান করে দিয়েছে ক্লোন নিয়ে রিসার্চ। ওরা বলছে, সভ্যতার অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। এবার তোকে বলি, কেন এত মাথা ঘামাচ্ছি। আই জি আমাকে বলেছেন, ওই দ্বীপে গিয়ে ওদের রিসার্চ নিয়ে একটা রিপোর্ট তৈরি করে দিতে। তুই কি আমার সঙ্গে যেতে পারবি?”

”আমি? না রে, এখন আমার পক্ষে কোথাও বেরোনো সম্ভব না। লিগের খেলা শুরু হয়ে গেছে। অফিস ছেড়ে যেতে পারব না। তুই কবে যাবি?”

”যত শিগগির সম্ভব। তোর সঙ্গে কনট্যাক্ট রাখতে হবে। আই জি বললেন, মিঃ নাগ পারলে আপনিই পারবেন। কপালে কী আছে কে জানে?”

এর পর খাওয়ার দিকে আমরা দু’জনেই মন দিলাম। রাত দশটার পর লেক ক্লাব বন্ধ হয়ে যায়। তা ছাড়া, সুদীশকে যেতে হবে উত্তর কলকাতার সেই বিডন স্ট্রিটের দিকে। পুলিশের চাকরিতে অবশ্য রাত দশটা কোনও রাতই নয়। একেক দিন সুদীশকে ভোর রাতেও বাড়ি ফিরতে দেখেছি। খুব সৎ অফিসার। একটা জিনিস মাথায় ওর ঢুকলেই হল। সেটা সমাধান না করে ও ছাড়বেই না। তার জন্য যত খাটতে হয়, খাটবে। এই যে সুন্দরবনের রহস্যটা ওর মাথায় ঢুকেছে, ও সেই জট খোলার জন্য যতদূর করার করবে। দরকার হলে প্রচণ্ড ঝুঁকিও নেবে।

লেক ক্লাব থেকে বেরিয়ে সুদীশ উত্তর দিকে চলে যাওয়ার পর আমি একটা ট্যাক্সি ধরে গলফ গ্রিনের দিকে রওনা দিলাম। রেললাইন পেরিয়ে গেলেই লেক গার্ডেন্স। তারপর ভেতরের গলি দিয়ে অল্প রাস্তা। এ—রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করার একটাই মুশকিল। অনেক সময় ট্রেনের জন্য রেলগেট বন্ধ থাকে। তখন রবীন্দ্র সরোবরের মতো নির্জন জায়গায় অপেক্ষা করতে হয়। আগে চুরি— ছিনতাই লেগে থাকত। এখন একটা ফ্লাইওভারের কাজ চলছে। লোকজন থাকে।

রেললাইনের কাছে ট্যাক্সিটা পৌঁছতেই দেখি, গেট বন্ধ। রাত সাড়ে দশটায়—এই সময় একটা মালগাড়ি বজবজের দিকে যায়। প্রায় দিনই অফিস থেকে ফেরার সময় এই মালগাড়িটার পাল্লায় পড়ি। মিনিটপাঁচেকের ধাক্কা। কী আর করা যাবে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালাম। সারাটা দিন আজ বেকার গেল। যেদিন ভাল কোনও খবর করতে পারি না, সেদিনটা আমার মনে হয় ফালতু। মনটা ছটফট করে। দুপুরের দিকে মুম্বাইয়েই সৌরভকে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। জিম্বাবোয়েতে শচীনের সঙ্গে ওর কোনও ঝামেলা হয়েছে কিনা তা জানার জন্য। কিন্তু মোবাইলটা বোধ হয় অফ করে রেখেছিল। ওকে ধরতেই পারলাম না।

”সার, আপনি কি গলফ গ্রিন কমপ্লেক্সে যাবেন?”

প্রশ্নটা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভারের দিকে তাকালাম। আর তাকিয়েই চমকে উঠলাম। আরে, লোকটা তো একেবারে সুনীল গাওস্করের মতো দেখতে। এখনকার গাওস্করের মতো নয়। আশি—একাশি সালের গাওস্করের মতো। অদ্ভুত মিল তো দু’জনের চেহারায়। লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মুখে মিটিমিটি হাসি। আমাকে অবাক হতে দেখে নিশ্চয়ই মনে—মনে মজা পাচ্ছে। তাড়াতাড়ি ওকে বললাম, ”না, না। অতটা আপনাকে যেতে হবে না। গলফ গার্ডেনের আগেই আমি নেমে যাব।”

”তা হলে ভাল হয় সার। গড়িয়ায় গাড়িটা গ্যারাজ করেই আমি ছুটব ক্যানিংয়ের লাস্ট ট্রেন ধরতে। এগারোটা পাঁচে ট্রেন সার। আর দেখুন, এখানে কী মুসিবত। কেমন আটকে গেলাম।”

গেটের কাছে অ্যালার্ম বেল বাজছে। শব্দটা চাপা পড়ে গেল হুস করে মালগাড়িটা এসে যাওয়ায়। ট্যাক্সি ড্রাইভারের মুখটা আমার মনের মধ্যে রয়ে গেল। চণ্ডীগড়ের একটা ছেলেকে মাঝে টিভিতে দেখিয়েছিল। একেবারে শচীন তেন্ডুলকরের মতো দেখতে। আজ আমি গাওস্করকে আবিষ্কার করলাম। এরকম হয়তো সৌরভের মতো দেখতেও কেউ আছে। আমি নিজেও তো একবার প্রবলেমে পড়ে গেছিলাম। সেটা বেশ মজার ঘটনা।

দিল্লিতে সার্কিট অ্যাথলেটিকস মিট করার জন্য কার্ল লুইস যেবার এসেছিলেন, সেবারের ঘটনা। আন্দ্রেই বার্জার বলে একজন অস্ট্রিয়ানের কাছে লুইস হেরে গেলেন। মেজাজ খুব খারাপ। পরদিন সকাল দশটায় লুইস আমাকে ইন্টারভিউ দেবেন। সব ঠিক করা ছিল। ঠিক সময়ে তাজ হোটেলে গিয়ে দেখি প্রচণ্ড ভিড়। সিকিউরিটির বাধা পেরিয়ে যখন লুইসের কাছে পৌঁছলাম, তখন আমাকে দেখেই উনি বললেন, ”এ কী, এই এক্ষুনি তো আপনি আমার ইন্টারভিউ নিয়ে গেলেন। আবার এসেছেন কেন?” কিছুতেই বোঝাতে পারছি না, আমি ইন্টারভিউ নিইনি। যাই হোক, পরে উনি রাজি হলেন। পরদিনই দিল্লির এক ফটোগ্রাফার ছবি বিক্রি করতে এল। দেখি আমার মতো দেখতে এক ভদ্রলোক লুইসের ইন্টারভিউ নিচ্ছেন। পরে জেনেছিলাম ওই ভদ্রলোক মুম্বই অল ইন্ডিয়া রেডিওর রিপোর্টার। নাম অমল পালেকর।

মালগাড়ি যাওয়ার ঘটাং—ঘটাং শব্দ শুনতে পাচ্ছি। হঠাৎ ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল, ”সার, একটা কথা বলব? কিছু মনে করবেন না বলুন?”

বললাম, ”না, না, বলুন।”

”আপনাকে না অমল পালেকরের মতো দেখতে।”

প্রচণ্ড হাসি পেয়ে গেল। আমি লোকটার মধ্যে সানি গাওস্করকে দেখছি। আর ও আমার মধ্যে অন্য একজনকে দেখছে। কথা বাড়ালেই বাড়বে। তাই চুপ করে গেলাম। মিনিট সাত—আটেকের মধ্যেই আনোয়ার শাহ রোডে পৌঁছে গেলাম। রাত দশটা—সাড়ে দশটায় এই দিকটা বেশ ফাঁকা হয়ে যায়। লেক গার্ডেন্সের মোড় থেকে টিভি স্টেশনের দিকে ঢুকতেই দেখি অ্যাথলেটিকসের কোচ স্বপন রাহা হাঁটতে—হাঁটতে আসছে। তাড়াতাড়ি ট্যাক্সি থামিয়ে নেমে পড়লাম। এত রাতে স্বপন এখানে? ও অবশ্য থাকে নিউ আলিপুর আর টালিগঞ্জের মাঝামাঝি একটা জায়গায়। খুব বেশি দূরে নয়। ও এখানে কী করছে? অফিস থেকে অনেকবার ফোন করেও আজ ওকে পাইনি।

আমাকে দেখেই স্বপন বলল, ”বাঁচালে। তোমার জন্যই এতক্ষণ তোমার বাড়িতে আমি ওয়েট করছিলাম।”

”কী ব্যাপার বল তো?”

”আরে, আজ একটা মিস্টিরিয়াস ব্যাপার ঘটে গেছে। আমাদের কোচেস অ্যাসোসিয়েশনের মিটিংয়ে এতক্ষণ আটকা পড়ে গেছিলাম। মুচিশার মিটের রেজাল্ট কি তোমরা ছাপছ?”

”হ্যাঁ। ওইজন্যই তোমাকে আমি খুব খুঁজছিলাম। রুডি বলে যে মেয়েটা আজ রেকর্ড করেছে, তার পদবিটা কী? সত্যিই কি মেয়েটা সাব—ইলেভেন দৌড়েছে?”

স্বপন উত্তেজিত হয়ে বলল, ”ওই মেয়েটা আর ওর কোচকে নিয়েই তো যত মিস্ট্রি। ওর কোচ আমাদের বোকা বানিয়ে গিয়েছেন।”

”তার মানে? মেয়েটা রেকর্ড করেনি।”

”না, না, সে—কথা বলছি না। ওর কোচ আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বারই না। এই যে মিটটা আমরা করছি, তার নিয়ম হচ্ছে, আমাদের মেম্বার ছাড়া আর কারও ছাত্রছাত্রী অংশ নিতে পারবে না। আজ সকালে রুডি এবং বেশ কয়েকটা ছেলেমেয়ে নিয়ে এসে ভদ্রলোক বললেন, ওঁর নাম লোকনাথ পোদ্দার। মেদিনীপুর জেলায় কোনও একটা জায়গায়…নামটা এখন মনে নেই…ওঁর একটা কোচিং ক্যাম্প আছে। উনি মিটে অংশ নিতে চান। আমরা মেম্বার লিস্ট মিলিয়ে দেখলাম, লোকনাথ পোদ্দার বলে সত্যিই একজন আমাদের মেম্বার আছেন। তাঁর কোচিং ক্যাম্প হলদিয়ায়। তো, আমরা ওঁর ছেলেমেয়েদের পার্টিসিপেট করতেও দিলাম। কিন্তু মিট শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমরা যখন ফিরে আসছি, তখন দেখলাম, আরেক ভদ্রলোক এসে দাবি করছেন, তিনিই লোকনাথ পোদ্দার।”

এই পর্যন্ত শুনে আমি বললাম, ”তোমাদের অ্যাসোসিয়েশনের সব মেম্বারকে তোমরা সবাই চেনো না?”

”না। মুশকিলটা তো সেখানেই। আমাদের কোচেস অ্যাসোসিয়েশনটা খুব বেশিদিনের নয়। দূর জেলার অনেক কোচই আমাদের মেম্বার। এই লোকনাথ পোদ্দার মাসছয়েক আগে চিঠি দিয়ে আমাদের মেম্বার হন। তাঁকে আমরা কেউ আগে কখনও দেখিনি। সেই সুযোগটাই নিয়েছেন এই ভদ্রলোক। সবচেয়ে রহস্যময় কী জানো, দুই লোকনাথ প্রায় একই রকম দেখতে।”

”তারপর কী হল?”

”আমাদের সবার মাথায় হাত। অন্য কোচেরা চটে লাল। একটা লোক সবাইকে বোকা বানিয়ে চলে গেল, অথচ আমরা কেউ তা ধরতেও পারলাম না! মিটিং করে ঠিক হল, ওই নকল লোকনাথের ছেলেমেয়েরা যে রেকর্ড টেকর্ড করে গেছে, তা সব বাতিল করে দিতে হবে। এর পরের মিট পরের শনিবার হচ্ছে ডায়মন্ডহারবারে। নকল লোকনাথ ওখানে এলে তাঁকে হাতেনাতে ধরে ফেলতে হবে।”

স্বপনের কথা শুনে হাসি পেল। লোকটা না হয় চালাকি করে গেছে, কিন্তু ওর মেয়েটার রেকর্ডে তো কোনও ভেজাল নেই? তার কী হবে? বললাম, ”খবরটা কিন্তু কাল আমার কাগজে বড় করে বেরোচ্ছে।”

”না, না। খবরটা বের কোরো না। কথাটা বলার জন্যই তোমার কাছে এলাম। যে করেই হোক, এই কাজটা তোমাকে করতেই হবে।”

”পাগল নাকি! এখন আর সম্ভব নয়। রাত প্রায় এগারোটা। এখন আমাদের কাগজ ছাপা আরম্ভ হয়ে গেছে। একটা কথা, ওই মেয়েটা সাব—ইলেভেনে দৌড়েছে, না দৌড়য়নি?”

”হ্যাঁ দৌড়েছে।”

একটু কড়াভাবেই স্বপনকে বললাম, ”ব্যস, আর আমার কিছু জানার নেই। কে তোমাদের অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বার বা মেম্বার নন, তা আমার জানার দরকার নেই। পারলে নকল লোকনাথকে খুঁজে বের করো। ওর কাছে গিয়ে হাতে—পায়ে ধরে ওকে তোমাদের মেম্বার করে নাও।”

কথাটা বলেই আমি হাউসিং কমপ্লেক্সে ঢুকে গেলাম।

সকালের দিকে আগে রোজ সাউথ ক্লাবে ঘণ্টাখানেকের জন্য টেনিস খেলতে যেতাম। গলফ গ্রিনে চলে আসার পর ইদানীং গলফ খেলাটা ধরেছি। এই খেলাটায় আমার আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে ফিরোজ আলি। খুব নামকরা গলফার। আমাদের হাউসিং কমপ্লেক্সেই থাকে। বাড়ির কাছেই রয়াল ক্যালকাটা গলফ ক্লাব। হেঁটে তিন—চার মিনিটের পথ। ভাল লাগে রোজ সকালে ওখানে যেতে।

ফিরোজ সারা বছরই এ দেশ—সে দেশে খেলে বেড়ায়। গত সপ্তাহে ও আমেরিকা গেছে। বলে গেছে, নাকি কোন একটা টুর্নামেন্টে টাইগার উডসের সঙ্গে খেলবে। ফিরোজ দেশে থাকলে ওর সঙ্গেই গলফ ক্লাবে চলে যাই। ওর মতো তিন—চার ঘণ্টা ধরে খেলার ধৈর্য আমার নেই। সিক্স হোল খেলতেই আমার ঘণ্টাদেড়েক লেগে যায়। আজ খেলা শুরু করতেই মনে হল, কে যেন আমাকে ফলো করছে।

গলফ ক্লাবটা খুব সবুজ। সকালের দিকটায় অনেকে হাঁটাহাঁটি করতে আসেন। তাতে অনেক সময় আমাদের খেলতে অসুবিধা হয়। কিন্তু স্থানীয় লোকদের কিছু বলাও যায় না। একবার মর্নিং ওয়াকারদের ঢোকা বারণ করতে গিয়ে প্রচণ্ড ঝামেলা হয়েছিল। তারপর থেকে আমরা কিছু বলি না। ক্যাডিরাই ওদের ধমক দিয়ে সরিয়ে দেয়। ক্যাডিরা গলফ ক্লাবের আশপাশে বস্তিতে থাকে। ওদের দাপটও কম নয়।

আজ আমার পার্টনার রাজেশ ঢোলকিয়া। বিজনেসম্যান। আমারই বয়সী। কিন্তু ওর ওজন আমার প্রায় ডাবল। একশো কুড়ি কেজি। ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছেন, ‘মশাই, একটু হাঁটাহাঁটি করুন।’ তাই গলফ ক্লাবের মেম্বার হয়েছে। আমার মতোই রাজেশ সবে খেলাটা শিখেছে। ফলে একসঙ্গে খেলা শুরু করলে, একসঙ্গে শেষ করা যায়। আজ সেকেন্ড হোল থেকে থার্ড হোল—এ যাওয়ার সময় একটা স্ট্রোক নেওয়ার পর বলটা উড়ে গিয়ে যে কোথায় পড়ল, দেখতে পেলাম না। আমার বল আমি নিজেই কিনে নিয়ে যাই। ক্লাবের বল নিই না। দাম কম না। একটা বল হারিয়ে যাওয়া মানে…অনেক টাকা গচ্চা। বল হারিয়ে যেতে ক্যাডি আবদুল বলল, ”সার, আপনি দাঁড়ান। গুলিটা আমি খুঁজে আনি।” গলফ বলকে ওরা চলতি কথায় বলে, গুলি। ওদের চোখ এমন, অত গাছপালা, ঝোপঝাড়ের মাঝেও বলটা ঠিক খুঁজে আনবে। আর সেটা পেলে আমার কাছ থেকে পাঁচ টাকা বকশিশ পাবে।

কাল রাতের দিকে বেশ বৃষ্টি হয়ে গেছে। আজ সকালে চড়া রোদ উঠেছে। সকাল সাতটায় গা একেবারে চিটপিট করছে। একটা গাছের ছায়ায় এসে দাঁড়ানোমাত্রই আমি নিশ্চিত হলাম, নীল টি—শার্ট পরা একটা লোক দূর থেকে আমাকে লক্ষ করছে। গরমে হাঁসফাঁস করতে—করতে ঢোলকিয়া বলল, ”মিঃ কালকেতু, কাল থেকে একটা কথা আপনাকে বলব—বলব করছি। যদি কিছু মনে না করেন, কথাটা কি বলতে পারি?”

বললাম, ”বলুন। এত ইতস্তত করছেন কেন?”

”একটা মুশিবতে ফেঁসে গেছি মশাই। আমার ভাইয়ের জন্য।”

ভেবেছিলাম, ইডেনে ক্রিকেট ম্যাচের জন্য ঢোলকিয়া টিকিট চাইবে। না, তা তো নয়! ওর চোখ—মুখে বেশ উদ্বেগ। এতক্ষণ লক্ষ করিনি। দেখে বেশ খারাপই লাগল। তাই বললাম, ”কী ব্যাপার বলুন তো?”

”আরে মশাই,আমার এই ভাইটা একটু অন্যরকমের। বয়স কুড়ি—একুশ। পড়াশোনা নিয়েই পড়ে থাকে। রিসেন্টলি বাবা বাড়িতে একটা কম্পিউটার কিনে দিয়েছেন। তারপর থেকে বাড়ির বাইরে যাওয়াই প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। কলেজে যায়। আর ফিরে এসে কম্পিউটারের সামনে বসে খুটুর—মুটুর করে। দিনতিনেক আগে হঠাৎ কী হল, ভয়ে আর বাড়ি থেকেই বেরোচ্ছে না। ঘরের দরজা—জানালা বন্ধ করে বসে আছে। ও খাওয়াদাওয়াই ছেড়ে দিয়েছে। আর বারবার বলছে, ও লোগ মুঝে মার ডালেগা। কে লোক, কী ব্যাপার, কিছুতেই বলছে না।”

”ওর কলেজে খোঁজখবর নিয়েছেন?”

”না। তেমন বন্ধুবান্ধবও ওর কেউ নেই। রিঙ্কি বলে ওর এক ক্লাসমেট আমাদের বাড়ির কাছে থাকে। তাকে আমার মা ডেকে জিজ্ঞেস করেছে। সে কিছু বলতে পারেনি। কাল রাতে আমি ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললাম। আমার যা মনে হল, সমস্যার মূল সম্ভবত কম্পিউটার। এমন একটা কিছু করেছে, প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে।”

”ওর কি ই—মেল অ্যাড্রেস আছে?”

”হ্যাঁ। ই—মেলে নানা ধরনের লোকের সঙ্গে চ্যাট করে। একটা ব্যাপার লক্ষ করতাম, ও যখন ইন্টারনেট খুলে বসত, তখন আমরা কেউ ঘরে ঢুকলেই কানেকশনটা অফ করে দিত। মনে হত কিছু লুকোচ্ছে।”

”তা হলে আপনারা ওর ই—মেল খুলে দেখছেন না কেন। কোনও ক্লু পেলেও পেয়ে যেতে পারেন।”

”সে—কথা ভেবেছি। কিন্তু কী প্রবলেম হচ্ছে জানেন, ও ঘর থেকেই বেরোচ্ছে না। তাই ওর কম্পিউটারে হাত দেওয়া যাচ্ছে না।”

”একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে পরামর্শ করুন। আমার জানাশুনো একজন আছেন। তিনি থাকেন কর্নফিল্ড রোডে। নাম অর্ণব ব্যানার্জি। উনি দিনকয়েক কথা বললেই পেট থেকে বের করে আনবেন, প্রবলেমটা কী।”

কথাটা মনঃপূত হল না ঢোলকিয়ার। বলল, ”মিঃ কালকেতু শুনেছি আপনি একজন রহস্যভেদী। এ ধরনের কেস অনেক সলভ করে দিয়েছেন। আমাকে কথাটা বলল, সুরজমল কঙ্কারিয়া। আপনিও তাকে চেনেন। আমার একটা রিকোয়েস্ট আছে। প্লিজ, না করবেন না। আজই আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে চলুন। এই তো কাছেই। টালিগঞ্জ ফাঁড়িতে। ভাইকে দেখলে আপনি কেসটা বুঝতে পারবেন।”

সকালের দিকে এমনিতে কোনও কাজ নেই। বেলা দশটার সময় ফোন করার কথা দিল্লি থেকে জয়দীপ বাসুর। হিন্দুস্থান টাইমসের রিপোর্টার। এখন সোয়া সাতটা বাজে। অনেক সময় আছে সেই ফোন আসার। তাই বললাম, ”চলুন, খেলাটা আগে শেষ করে নিই। আটটা নাগাদ আপনার বাড়ি যাওয়া যাবে।”

কথাটা বলার ফাঁকেই হঠাৎ আমার নজর গেল, গাছের আড়ালে দাঁড়ানো নীল টি—শার্ট পরা লোকটার দিকে। পকেট থেকে ক্যামেরা বের করে আমাদের ছবি তুলছে। আমি ওদিকে কড়া চোখে তাকাতেই সে গাছের আড়ালে সরে গেল। কে এই লোকটা? সাতসকালে এখানে ছবি তুলতে এসেছে? গাছটার দিকে তাকিয়ে মেপে নিলাম। থার্ড হোল—এ যাওয়ার পথে লোকটাকে ধরে ফেলা যাবে। দু’চার থাপ্পড় মারলেই বলে দেবে কীজন্য এসেছে।

ঢোলকিয়া সেলফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। এমন সময় আবদুল বল নিয়ে এল।

”স্যার, দেখুন তো এটা আপনার গুলি কি না?”

বলটা হাতে নিয়ে চমকে উঠলাম। সাদা বলটা হঠাৎ হালকা নীল হয়ে গেছে। তাতে উড়ন্ত চাকির মতো কী একটা আঁকা। নীচে লেখা, ঈস। কী করে হল? সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি নীল রঙের টি—শার্ট পরা লোকটা মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কয়েক পা এগিয়ে হাত নেড়ে সে আমাকে বিদায় জানিয়ে গেল। স্পষ্ট দেখলাম। লোকটা দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে। দৌড়ে গিয়েও ওকে ধরা সম্ভব না। একটু হতভম্ব হয়েই আমি দাঁড়িয়ে রইলাম বলটা হাতে নিয়ে।

খেলায় আর মন লাগল না। আবদুলের হাতে স্টিক তুলে দিয়ে বললাম, ”চল, আজ যাওয়া যাক। আর খেলব না।”

আধঘণ্টা পর ঢোলকিয়ার সঙ্গে ওর বাড়িতে এসে মনে হল, কেসটা যত হালকা ভেবেছিলাম, ততটা না। বেশ গুরুতর। ঢোলকিয়ার ভাই রাকেশ কিছুতেই মুখ খুলতে চাইছে না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বাড়ির লোকজন। দেখেই মনে হয়, বেশ সম্ভ্রান্ত ঘরের। কিন্তু পরিবারের একজন মানসিক ভারসাম্য হারানোয় এঁরা সব দিশেহারা। কয়েকবার চেষ্টা করে আমি বুঝলাম, ছেলেটা অন্যদের সামনে কথা বলবে না। তাই ইশারায় ঢোলকিয়াকে বললাম, ”ঘরের দরজা বন্ধ করে তোমরা সবাই বেরিয়ে যাও। দেখি, আলাদা কথা বলে ওর পেট থেকে কিছু বের করা যায় কিনা?”

দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর রাকেশ জিজ্ঞেস করল, ”সার, আপনি কি পুলিশের লোক?”

বললাম, ”না। আমি স্পোর্টস জার্মালিস্ট। খেলার খবর লিখি।”

”আপনি সৌরভ গাঙ্গুলিকে চেনেন?”

”চিনি। কেন বল তো?”

”এমনি। একবার আমি সৌরভকে ই—মেল করেছিলাম। উত্তর দেননি।”

”সৌরভকে তোমার ভাল লাগে?”

”হ্যাঁ, সার। আমাদের বাংলার গর্ব। আমি ওঁর ফ্যান বলতে পারেন।”

”সৌরভের সঙ্গে কথা বলতে চাও?”

কথাটা শুনে রাকেশের মুখ চকচক করে উঠল। বলল, ”উনি কি আমার সঙ্গে কথা বলবেন সার? একটা ব্যাপারে ওঁকে সাবধান করে দিতে চাই।”

কথাটা শুনে একটু অবাক হলেও আমি পালটা প্রশ্ন করলাম না। বললাম, ”সৌরভের সঙ্গে তোমাকে আমি কথা বলিয়ে দিচ্ছি। এখানে ফোন আছে?”

রাকেশ উঠে দরজা খুলে একটা কর্ডলেস ফোন নিয়ে এল। তারপর বেশ আগ্রহ নিয়ে বসল সোফায়, আমার পাশে। সাড়ে আটটা বাজে। এখন সৌরভকে ওর জিমনাসিয়ামে পাওয়া যাবে। জিম্বাবোয়ে থেকে কাল সন্ধেবেলাতেই বেচারি ফিরেছে। ওকে বিরক্ত করার ইচ্ছে হচ্ছিল না। তা সত্ত্বেও সেলফোনে ওকে ধরলাম। দু’—চারটে কথা বলার পর ওকে বললাম, ”মহারাজ, তোমার একজন ফ্যান তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। একটু কথা বল তার সঙ্গে।” বলেই ফোনটা ধরিয়ে দিলাম রাকেশের হাতে।

রাকেশ ভাবতেই পারেনি সৌরভ গাঙ্গুলির সঙ্গে কথা বলতে পারবে। ও—প্রান্তে গলা শুনে একেবারে অভিভূত। হাই, হ্যালো, আয়াম ইয়োর ফ্যান। এইসব বলার পর রাকেশ হঠাৎ বলে বসল, ”সার, কয়েকদিন আগে আমি একটা ই—মেল পাঠিয়েছি আপনার অ্যাড্রেসে। প্লিজ, দেখে নেবেন। না হলে কিন্তু ওরা আপনার খুব ক্ষতি করে দেবে। বি কেয়ারফুল।”

ওপাশ থেকে সৌরভ কী বলল, বুঝতে পারলাম না। সামান্য দু—একটা কথা বলার পর কর্ডলেসের সুইচ অফ করে রাকেশ আমার দিকে ফিরে বলল, ”সার আমার যতটুকু সাবধান করার, করে দিলাম। নাউ ইট ইজ আপ টু হিম, হাউ হি ক্যান টেক কেয়ার অফ হিমসেলফ।”

একটু অবাক হয়েই বললাম, ”কী ব্যাপার বল তো?”

”বলা যাবে না। তা হলে আপনিও খুব বিপদে পড়ে যাবেন। আমার মতোই অবস্থা হবে আপনার। নো, আই কান্ট টেল ইউ সার।”

হেসে বললাম, ”সৌরভকে তুমি কি মেল পাঠিয়েছ, সেটা দেখতে পারি?”

একটু ইতস্তত করে রাকেশ বলল, ”ঠিক আছে, আপনাকে আমি দেখাতে পারি। কিন্তু বাড়ির কাউকে আপনি কিছু বলতে পারবেন না। প্রমিস?”

ঘাড় নেড়ে প্রমিস করলাম। নিশ্চিন্ত হয়ে কম্পিউটারের সামনে গিয়ে বসল রাকেশ। মিনিটদুয়েক পর আমাকে বলল, ”এই দেখুন সার। এই মেসেজটা আমি সৌরভ আর শচীন তেন্ডুলকরকে পাঠিয়েছিলাম। ওঁরা যদি আমার কথায় বিশ্বাস না করেন, তা হলে নিজেরাই কিন্তু ভুগবেন।”

কম্পিউটারের স্ক্রিনে তাকিয়ে পড়তে শুরু করলাম। প্রথমে একগাদা উচ্ছ্বাস। টিন এজার ছেলেমেয়েরা একজন ফাইভ স্টার ক্রিকেটার সম্পর্কে যা লিখতে পারে আর কী। তারপরের কয়েকটা লাইন আমার ভ্রু কুঁচকে দিল। ইংরেজিতে রাকেশ যা লিখেছে, তার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় এইরকম, ”আমাদের দেশে ঈস বলে একটা অর্গানাইজেশন আছে, যারা আপনার প্রচণ্ড ক্ষতি করে দেবে। আমি জানি, ওরা আপনার এবং শচীন তেন্ডুলকরের ক্লোন তৈরি করে ফেলেছে। কীভাবে করেছে, জানি না। এমন একটা দিন আসতে পারে, যখন দেখবেন আপনারই মতো একজন আপনার আড়ালে কুকীর্তি করে বেড়াচ্ছে। আপনাকে ধোঁকা দিচ্ছে। এ ব্যাপারে যদি বিশদ কিছু জানতে চান তা হলে আমার সঙ্গে ই—মেলে যোগাযোগ করুন। কেননা ঈস সম্পর্কে আমি অনেক তথ্য জানি।”

মেল পড়ে আমি একটু অবাক হয়েই রাকেশের দিকে তাকালাম। কাল রাতেই সুদীশের মুখে ঈস নামে এই অর্গানাইজেশনের কথা প্রথম শুনি। তারপর একটু আগে গলফ ক্লাবে খেলার সময় আমার গলফ বলে রহস্যজনকভাবে ওই ঈসের ছাপ। এখন দেখছি, এই ছেলেটাও অনেক কথা জানে ঈস সম্পর্কে। নাহ, ব্যাপারটা হালকাভাবে নিলে, চলবে না। রাকেশের কাছ থেকে যতটা সম্ভব, তথ্য নিয়ে রাখা যাক। পরে সুদীশের কাজে লেগে যেতে পারে। তাই জিজ্ঞেস করলাম, ”রাকেশভাই, তুমি কী করে জানলে সৌরভের ক্লোন ঈস নামে এই অর্গানাইজেশনটা তৈরি করে রেখেছে?”

ঘরের দরজাটা বন্ধ করে এসে রাকেশ বলল, ”সার, আমি নিজের চোখে দেখেছি। না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।”

ছেলেটা শুরু থেকেই আমাকে সার—সার করছে। শুনতে আমার ভাল লাগছে না। ওকে আরও কাছে টানার জন্য বললাম, ”রাকেশ, আমাকে সার বলার দরকার নেই। তুমি আমাকে বরং আঙ্কল বলে ডেকো। এবার বল তো, নিজের চোখে তুমি কী দেখেছ? সৌরভের মতো আরেকজনকে?”

”হ্যাঁ সার, হুবহু সৌরভ গাঙ্গুলির মতো আরেকজনকে।”

বিশ্বাস হল না। তবুও বললাম, ”কোথায় দেখলে তাঁকে?”

”ওই দ্বীপে…আমাকে নিয়ে গেল তো একদিন। বাড়িতে জানে না। দাদাকে কিন্তু বলবেন না। আপনাকে বিশ্বাস করে সব বলছি।”

”না, না। আমি কাউকে বলব না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। হ্যাঁ, এবার একটা কথার জবাব দেবে? ঈসের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ হল কীভাবে?”

”ইন্টারনেট মারফত। একদিন রাতে আমি নেট সার্ফ করছিলাম। ভূতের গল্প পড়ব বলে। এমন সময় হঠাৎই কী করে যেন ওদের ওয়েবসাইটটায় ক্লিক করে দিয়েছিলাম। দেখি, একটা ছবি পরদায় ফুটে উঠল। দু’পাশে বিরাট দুটো পাহাড়ের মাঝে একটা উপত্যকা। আকাশ জুড়ে নীলাভ আলো। হঠাৎ সেই আলো ভেদ করে একটা উড়ন্ত চাকি নেমে এল ওই উপত্যকায়। তারপর সেই চাকি থেকে একটা লোক নামল। এই দৃশ্যটা আমার খুব ভাল লেগেছিল। তাই আমি সেদিন ওই ওয়েবসাইটটা খুব ভাল করে সার্ফ করতে লাগলাম। ওদের লিটারেচার পড়ে আমার দারুণ লাগল। ঈসের যিনি চিফ, তিনি এই কলকাতারই লোক। চারের দশকে নাকি ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে আমেদ খান—দের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন। পেশায় ভেটেরেনারি সার্জেন ছিলেন। তা, উনিশশো সাতচল্লিশ সালের চোদ্দই অগস্ট, মানে আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক আগের দিন, সুন্দরবন অঞ্চলে উনি বাঘ শিকার করতে গিয়ে হঠাৎ একটা অদ্ভুত জিনিস দেখতে পান। ঝড়খালির কাটা জঙ্গলে যখন উনি মাচায় বসে রয়েছেন, সেই সময় দেখতে পান আকাশ থেকে একটা চাকির মতো কী নেমে আসছে…”

এই পর্যন্ত শুনে আমি মনে—মনে হাসলাম। ঈস বলে অর্গানাইজেশনের আসল লোকটা ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ফুটবলার ছিলেন, তদন্ত করতে গিয়ে এই তথ্যটা সুদীশ একদিন—না—একদিন জানতেই পারবে। তখন ওর মনে কী প্রতিক্রিয়া হবে? আমার তো মনে হয়, ভদ্রলোক শত অন্যায় করেও পার পেয়ে যাবেন। একটু সময়ের জন্য অন্যমনস্ক হয়েছিলাম। শুনলাম, রাকেশ জিজ্ঞেস করছে, ”আঙ্কল, আমার কথা কি আপনি শুনছেন?”

তাড়াতাড়ি বললাম, ”হ্যাঁ, হ্যাঁ শুনছি। তারপর কী হল, বলো।”

”ওই কাটা জঙ্গলেই বাঘ শিকার করতে গিয়ে ওঁর সঙ্গে ভগবান, মানে ঈশ্বরের দেখা হয়ে যায়। স্পেসশিপ থেকে নেমে ভগবান প্রায় পুরো একটা দিন ওঁর সঙ্গে কাটিয়েছিলেন। পৃথিবীর মানুষরা কোত্থেকে এল, সব বলে গিয়েছিলেন। মহাবিশ্বে দেবস্থান বলে একটা গ্রহ আছে। দেব—দেবীরা হলেন সেই গ্রহের বাসিন্দা। ওই গ্রহে বিজ্ঞানের অসম্ভব অগ্রগতি হয়েছে। ওই গ্রহ থেকেই ভগবান বহু বছর আগে একবার কিছু বিজ্ঞানীকে সঙ্গে নিয়ে এসে আমাদের এই পৃথিবীতে আসেন। কৈলাস পর্বত দেখে তিনি মনস্থ করেন, একটা উপনিবেশ বানাবেন। দেব—দেবীর ক্লোন থেকেই তিনি খুব অল্পদিনের মধ্যে এখানে আদম আর ইভকে তৈরি করে রেখে যান। আমরা তারই বংশধর। ওয়েবসাইটে এইসব পড়ে সেদিন আমার খুব কৌতূহল হয়েছিল।”

”তারপর তুমি নিজেই ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে?”

”হ্যাঁ আঙ্কল, ওয়েবসাইটে দেখলাম, ওদের সম্পর্কে আরও জানতে হলে মেম্বার হতে হবে। ইন্টারনেটেই আমি ফর্ম ভর্তি করে দিলাম। পরদিন সকালেই দেখি উত্তর এসে গেছেঃ মন্ত্রগুপ্তি নিলে তোমাকে আমাদের সদস্য করা হবে।”

”মন্ত্রগুপ্তিটা কী?”

”এক নম্বর হল, অর্গানাইজেশনের ভেতরের খবর কাউকে বলা যাবে না। দু’নম্বর, ঈস যদি কারও ক্লোন করার ব্যাপারে সদস্যদের সাহায্য চায়, তা হলে সেই সদস্যকে প্রাণ দিয়ে হলেও সাহায্য করতে হবে। তিন নম্বর, সারাজীবন যত রোজগার করব, তার তিনভাগের একভাগ টাকা আমাকে ঈসে পাঠিয়ে দিতে হবে। চার নম্বর, ঈস চায়, মানবজাতির কল্যাণ। সেই কল্যাণের জন্য ঈস যখন যেখানে যেতে বলবে, যেতে হবে। না বলা যাবে না। পাঁচ নম্বর হল, প্রত্যেক সদস্যকে প্রতি বছর একজন করে সদস্য জোগাড় করে দিতে হবে। ছয় নম্বর…”

”এইসব শর্ত মেনে নিয়ে তুমি মেম্বার হলে?”

”হ্যাঁ আঙ্কল। তখন অতশত ভাবিনি। শর্ত না মানলে কী হবে, তখন সে প্রশ্নটাও মনে জাগেনি। পরে দেখলাম, ভয়ানক ব্যাপার! চরম শাস্তি। আপনার ক্লোন বানিয়ে ওরা বাজারে ছেড়ে দেবে। তারপর আপনার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে।”

ক্লোন সম্পর্কে আমার কোনও ধারণাই নেই। কতদিনের মধ্যে একজন মানুষের ক্লোন বানানো সম্ভব, তাও জানি না। রাকেশের কথা শুনে আমি একটু ধাঁধায় পড়ে গেলাম। দেওয়াল ঘড়িতে ঢং—ঢং করে দশটা বাজল। এবার আমাকে উঠে পড়তে হবে। তাই ওকে বললাম, ”তুমি এত ভয় পেয়ে গেছ কেন রাকেশ? শুনলাম, তুমি নাকি ঘর ছেড়ে বেরোচ্ছই না।”

”আঙ্কল, কয়েকদিন আগে ওদের দু’জন আমাদের বাড়িতে এসেছিল। সঙ্গে বিরাট বড় একটা বাঘ। আমাকে খুব শাসিয়ে গেল। বলল, তুমি বিশ্বাসভঙ্গ করেছ। খুব শিগগির তোমার চারজন ক্লোন আমরা বাজারে ছাড়ছি। তখন মজা টের পাবে।”

”তুমি কী ক্ষতি করেছিলে ওদের?”

”দীক্ষা দেওয়ার জন্য ওরা এক রাত্তিরে আমাকে সুন্দরবনের দ্বীপে নিয়ে গেছিল। সেখানে সৌরভ গাঙ্গুলি আর শচীন তেন্ডুলকরের ক্লোনদের ক্রিকেট খেলতে দেখে আমি ভয় পেয়ে যাই। তার মানে, ইচ্ছে করলে আসল সৌরভকে ওরা বন্দি করে রাখতে পারে। আর নকল সৌরভদের বাজারে ছেড়ে প্রচুর টাকা অর্গানাইজেশনের জন্য রোজগার করতে পারে। মাসছয়েক নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করার পর আমি ঠিক করি, সৌরভদের সব কথা জানিয়ে দেব। ব্যস, সেটা জানতে পেরে ওরা আমার ওপর চটে যায়। আমাকেও ওরা তুলে নিয়ে যাবে। সেই কারণে ভয়ে ঘরের বাইরে বেরোতে চাইছি না।”

রাকেশের মাথাটা বিগড়েছে। ডাঃ অর্ণব ব্যানার্জিকে এখনই একবার দেখানো দরকার। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, কম্পিউটার ঘেঁটে ঘেঁটে এত পড়াশোনা করে, এখন অদ্ভুত রোগের শিকার হয়ে গেছে। হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। ওদের এই টালিগঞ্জের বাড়িতে বাঘ! হতে পারে নাকি? উঠে আসার আগে বললাম, ”রাকেশ, তোমাদের এ—বাড়িতে ঈসের লোকেরা কবে এসেছিল?”

”বললাম তো, দিনকয়েক আগে। রাতে হঠাৎ ওরা ছোট স্পেসশিপে আমাদের বাড়ির পেছনদিকের বাগানটায় নামল। প্রথমটায় আমি বিশ্বাস করিনি। ভাবলাম, হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। ওরা চলে যাওয়ার পরদিন সকালে বাগানে গিয়ে দেখলাম, লন—এর কিছুটা অংশ ডেবে গেছে। এখনও দেখলে তা বুঝতে পারবেন। আমার সঙ্গে আসুন। জানলায় দাঁড়িয়ে এখান থেকেই আপনি সেটা বুঝতে পারবেন।”

জানলার সামনে গিয়ে বাগানের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম, হ্যাঁ বেশ কিছুটা অংশে ঘাস উড়ে গেছে। বাড়িটার সামনে থেকে বোঝা যায় না, পেছনের দিকে এতবড় বাগান আছে। কী একটা চোখে পড়তেই রাকেশ ছিটকে ভেতরে চলে এল। ওর চোখমুখে প্রচণ্ড ভয়। বলল, ”আঙ্কল, ওই যে পাঁচিলের পাশে নীল শার্ট পরা একটা লোককে দেখতে পাচ্ছেন? ঈসের লোক। ঈস, জেনে গেল আপনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে।”

এবার লোকটার দিকে আমি তাকালাম। আরে, গলফ ক্লাবে দেখা সেই লোকটা না? যে আমাদের ফলো করছিল? আমাকে, না কি রাজেশ ঢোলকিয়াকে? সেই লোকটা হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। সেই লোকটার ক্লোন হতে পারে। কথাটা মনে হতেই হাসি পেল। রাকেশকে বললাম, ”তুমি ভয় পেও না। এই লোকটার সঙ্গে আগেই আমার যোগাযোগ হয়ে গেছে। এই দ্যাখো, আমাকে সিগন্যাল পাঠিয়েছে। আমার জন্য তোমাকে বিচলিত হতে হবে না।” বলেই পকেট থেকে গলফ বলটা আমি বের করে দেখালাম।

বলের ওপর উড়ন্ত চাকতিটা দেখেই রাকেশ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ঈস সম্পর্কে কৌতূহল আমার নিজেরই বেড়ে যাচ্ছে। মাঝে দু—তিনদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম ফুটবল লিগ নিয়ে। তারই মধ্যে ইন্টারনেটে ঈসের ওয়েবসাইট খুলে একবার দেখেছি, সংস্থাটা আসলে কী ধরনের। সত্যি কথা বলতে কী, মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারিনি। ঈস সংস্থাটা তৈরি করেছেন লোকনাথ পেলজার বলে এক ভদ্রলোক। তিনি বাঙালি। বেলগাছিয়ার ভেটেরেনারি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। ফার্টাইলিটি এক্সপার্ট। লোকনাথবাবু তারপর চলে যান আমেরিকায়। দীর্ঘদিন ক্যালিফোর্নিয়ায় ছিলেন।

কবে তিনি ভারতে ফিরে আসেন, সে—সম্পর্কে খোঁজ করতে গিয়ে একটু অবাকই হয়েছি। গত শতাব্দীর চল্লিশ—বিয়াল্লিশ সালে। মনে মনে হিসেব করতে লাগলাম, এখন তা হলে ভদ্রলোকের বয়স কত? নব্বইয়ের কাছাকাছি নিশ্চয়। সেদিন ঢোলকিয়াদের বাড়িতে রাকেশ লোকনাথবাবু সম্পর্কে যেসব কথা বলেছিল, ওয়েবসাইটে সেসব কথাই লেখা আছে। আরও দেখলাম, ভদ্রলোক বলেছেন, ভগবান মাঝে—মধ্যে যিশু খ্রিস্ট, গৌতম বুদ্ধ, হজরত মহম্মদের মতো কিছু লোককে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন, যাঁদের কাজই হল মানুষের ভুলত্রুটি শুধরে দেওয়া এবং তাদের ঠিক পথে চালিত করা। বিংশ শতাব্দীতে ভগবান এই দায়িত্বটা দিয়েছেন তাঁর ওপর। সেই কারণে মানব কল্যাণে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।

পাগলের প্রলাপ ভেবে ঈস সম্পর্কে মাঝে দু’দিন আর কোনও খোঁজখবর নিইনি। কিন্তু সুদীশের ফোন পাওয়ার পর থেকে ফের আগ্রহটা বাড়ল। আজ সকালে ও বলল, ”কালকেতু, জাল গুটিয়ে এনেছি। কাল বিকেলের মধ্যেই ক্লোনবাবাজিকে ধরে ফেলতে পারব মনে হচ্ছে।”

আন্দাজে বললাম, ”কাকে, লোকনাথ পেলজারকে?”

সুদীশ অবাক হয়ে বলল, ”তুই কী করে জানলি?”

”জানি। তুই কবে সুন্দরবন যাচ্ছিস?”

”সুন্দরবন ঠিক নয়। মীন দ্বীপ। বাবাজি সুন্দরবনের ডেরায় থাকেন না। উনি থাকেন ওই মীন দ্বীপে। বিরাট একটা ল্যাবরেটরি করেছেন সেখানে। আই বি—র লোকেরা খবর দিল। শনিবার রাতে আমি একাই হঠাৎ চড়াও হব ওই ল্যাবে।”

”কিন্তু লোকটাকে তুই ধরবি কেন? কী অপরাধ করেছে? লোকটা মানুষ খুন করেনি। দেশদ্রোহিতা করেনি। একটা মতবাদ প্রচার করছে মাত্র।”

”অত সোজা চোখে ব্যাপারটাকে দেখলে চলবে না রে কালকেতু। লোকটার সম্পর্কে একটা কমপ্লেন এসেছে আমাদের কাছে। ডুপ্লিকেট মানুষ তৈরি করে ব্ল্যাকমেল করার। লোকটা এখনও কোনও বেআইনি কাজ করেনি। কিন্তু করতেও পারে। ধর, কলকাতার একজন টপ বিজনেসম্যানের ডুপ্লিকেট ও তৈরি করল। তারপর তাকে দিয়ে পুরো বিজনেসটাই আত্মসাৎ করতে পারে। হিন্দি সিনেমায় যেমন হয় আর কী?”

ক্লোনিং সম্পর্কে তা হলে সুদীপ বেশি পড়াশোনা করেনি। পথিকের একটা প্রবন্ধ পড়েছিলাম সেদিন ঢোলকিয়াদের বাড়ি থেকে ফেরার পর লাইব্রেরিতে গিয়ে। ওর সেই লেখা অনুযায়ী, একটা মানুষের কোষ থেকে আরেকটা মানুষ সৃষ্টি করা সম্ভব। কীভাবে সম্ভব, সেই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সুদীশকে দেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু ও যা অনুমান করছে, তা হওয়ার নয়। ক্লোনের সঙ্গে আসল মানুষটার বয়সের অনেক তফাত হবে। ধরা যাক, একজন পঁচিশ বছর বয়সী মানুষের শরীর থেকে কোষ নিয়ে তার ক্লোন তৈরি করা হল। সেই মানুষটার সঙ্গে ক্লোনের বয়সের তফাত হবে ছাব্বিশ বছর।

এসব কথা সুদীশকে আমি কেন বলব? ও আমার সাহায্য চায়নি। ওর সঙ্গে একটু মজা করার জন্যই বললাম, ”লোকনাথ পেলজারের ওপর তুই এত রেগে আছিস কেন বল তো? লোকটা তো ভাল কাজই করছে। এই যেমন ধর, এই লোকটা যদি তোর ফরমায়েশ মতো লুই ফিগোর ক্লোন তৈরি করে দেয়, তা হলে তো তাকে অনেক কম টাকায় তোরা ইস্টবেঙ্গলে খেলাতে পারবি।”

কথাটা শুনে সুদীশ থমকে গেল। তারপর বলল, ”কথাটা তুই মন্দ বলিসনি তো। দাঁড়া, লোকটাকে একবার ধরি। তারপর ওকে দিয়ে রোনাল্ডো, ফিগো, বেকহ্যাম আর আলেজান্দ্রো দেল পিয়েরোর ক্লোন তৈরি করে নেব। কী দাঁড়াবে বল তো ইস্টবেঙ্গল টিমটা? উফ, মোহনবাগানকে দশ গোল, সালগাওকরকে পনেরো গোল। আর ভাবতে পারছি না।”

সুদীশের কথা শুনে মনে মনে হাসতে শুরু করেছি। ওর সঙ্গে আরও দু—চারটে কথা বলে ফোন ছেড়ে দিলাম। অফিসে বেরোতে হবে। আজ অনেক কাজ। সৌরভ খেলতে চলে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কায়। ওকে নিয়ে একটা রিপোর্ট করতে হবে। শচীন তেন্ডুলকর কলম্বোয় যাচ্ছে না। ভারতীয় দল পুরো শক্তি নিয়ে যেতে পারছে না। তাই সৌরভের একটা ইন্টারভিউ নেওয়া দরকার। তাই চট করে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। সকালে গলফ কোর্সে আজ ঢোলকিয়ার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। রাকেশকে নিয়ে অনেক কথা হল রাজেশের সঙ্গে। আমারই পরামর্শ অনুযায়ী ওরা রাকেশকে নিয়ে সাইকিয়াট্রিস্ট ডঃ অর্ণব ব্যানার্জির কাছে গিয়েছিল। ডাঃ ব্যানার্জি ওকে কিছুদিনের জন্য কলকাতার বাইরে পাঠিয়ে দিতে বলেছেন।

স্নান করতে করতে হঠাৎ মনে হল, সুদীশের সঙ্গে মীন দ্বীপে গেলে কেমন হয়? ও কখন যাবে, তা জিজ্ঞেস করা হয়নি। বলল, শনিবার রাতে যাবে। আজ বৃহস্পতিবার। এখনও দু’দিন আছে। আমার মুখে লোকনাথ পেলজারের কথা শুনে সুদীশ একটু চমকেই গেছিল। লোকটার নাম প্রথম শুনি আমাদের কৌশিকের মুখে। তারপর সেদিন ঈসের ওয়েবসাইট ঘাঁটার পর আমি আরও নিশ্চিত হয়ে যাই, এই সেই লোক। মীন দ্বীপটা মানুষ তৈরির কুমোরটুলি করে ফেলেছে। ক্ষমতা আছে বটে।

সুদীশকে কথাটা আমি ঠাট্টা করে বললাম বটে, কিন্তু সত্যি যদি তা সম্ভব হয়। ফিগো—রোনাল্ডোদের ক্লোন বানানো? গড়ের মাঠ তা হলে ফের ফেটে পড়বে। ধরা যাক, কার্ল লুইসের ক্লোন তৈরি করে দিল এই পেলজার। তা হলে কী হবে! ভারতীয় দল যখন ওলিম্পিকসে যাবে, তখন সেই নকল লুইসকে দিয়ে তিন—চারটে মেডেলও নিয়ে আসতে পারে। বলা কী যায়, আমাদের দেশ এভাবে ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবলেও চ্যাম্পিয়ান হয়ে যেতে পারে। আমি স্পোর্টস জার্নালিস্ট বলে এইসব কথাই আগে চিন্তা করতে লাগলাম।

স্নান শেষ করে পোশাক পরে ডাইনিং টেবলে বসামাত্রই ফুল্লরা এসে বলল, ”তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য একজন ফরেনার ভদ্রলোক অনেকক্ষণ বসে আছেন ড্রয়িংরুমে। তুমি গিয়ে আগে লোকটার সঙ্গে কথা বল। বলল, আমেরিকা থেকে এসেছে। তুমি যাও, ততক্ষণে আমি টেবল সাজাচ্ছি।”

বাইরে বেরোনোর জন্য তৈরি হয়েছে ফুল্লরা। বোধ হয় সায়েন্স কলেজের দিকে যাবে। মাঝেমধ্যে আমি অফিস যাওয়ার সময় ওকে নামিয়েও দিই রাজাবাজারে। এখন আমার বেরোনোর তাড়া। এই সময় কে এল? ড্রয়িংরুমে পা দিয়েই দেখি গ্যারি। ইলাস্ট্রেট্রেড উইকলির গ্যারি স্মিথ। ন’বছর আগে সিডনি ওলিম্পিকের সময় ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সে—বছরই গ্যারি আমেরিকার সেরা স্পোর্টস রাইটারের পুরস্কার পায়। ওকে দেখে আমি বিস্ময় চেপে রাখতে পারলাম না। বললাম, ”গ্যারি তুমি?”

উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে গ্যারি বলল, ”একটা বিশেষ কাজে আসতে হল। তুমি আমাকে চিনতে পারবে কি না, আমার সন্দেহ ছিল।”

হাসতে হাসতে বললাম, ”আমার স্মরণশক্তি এত দুর্বল নয়। সত্যি বলতে কী, তোমাকে দেখে আমি অবাকই হয়েছি। কী কারণে তোমাকে ভারতে আসতে হল, বল।”

”প্রোফেসর লুকে পেলজার নামে কাউকে তুমি চেনো?”

প্রশ্নটা শুনেই আমার ভ্রু কুঁচকে গেল। বললাম, ”ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়নি। তবে ওঁর নাম শুনেছি।”

”ওঁর সম্পর্কে তুমি কী জান?”

লোকনাথ পেলজার সম্পর্কে যা জানি, বললাম। শুনে গ্যারি বলল, ”খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। দিনসাতেক আগে ঈসের ওয়েবসাইট মারফত আমাদের একজন সায়েন্স রিপোর্টার জানতে পারে, লুকে পেলজার নামে এই লোকটা উইলমা রুডলফের ক্লোন তৈরি করেছেন। সেই ক্লোনকে দিয়ে আথেন্স ওলিম্পিকে গোল্ড মেডেল জিতবেন। এই মেয়েটার নামও দিয়েছেন রুডি। তুমি কি তার কথা কিছু শুনেছ?”

ঘাড় নেড়ে বললাম, শুনেছি। ওহ, তা হলে মুচিশায় স্বপন রাহাদের অ্যাথলেটিকস মিটে রুডি নামে যে মেয়েটা সাব ইলেভেন টাইম করেছিল, সে তা হলে উইলমা রুডলফের ক্লোন। ভাবতেই সারা শরীরে শিহরন খেলে গেল। গ্যারি না এলে জানতেই পারতাম না। নাহ, এই লোকনাথ পেলজার লোকটাকে তো আর হালকাভাবে নেওয়া যাচ্ছে না। এঁর খোঁজে একজন রিপোর্টার আমেরিকা থেকে চলে এল। আর মীন দ্বীপের পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে বসে আমরা কোনও খোঁজখবরই নিলাম না? ছি ছি।

মনে মনে যখন এসব কথা ভাবছি, তখন গ্যারি বলল, ”আমি এই লুকে পেলজারের সঙ্গে দেখা করতে চাই। সম্ভব হলে আজ এখনই। ইলাস্ট্রেটেড উইকলির পরের সংখ্যাটা প্রকাশিত হবে পরশু। আজ রাতে প্রবন্ধ লিখে পাঠিয়ে দিতে পারলে পরশুই সারা পৃথিবীর লোক এই যুগান্তকারী এক্সপেরিমেন্ট সম্পর্কে জেনে যাবে। উইলমা রুডলফ সম্পর্কে আমেরিকার লোক এখনও খুব স্পর্শকাতর। তাঁর ক্লোন সম্পর্কে খবর লোকে গোগ্রাসে গিলবে। কালকেতু, তুমি কি আমার সঙ্গে ওই দ্বীপে যেতে পারবে? এখান থেকে কতক্ষণ লাগবে যেতে?”

আমার গলফ গ্রিনের বাড়ি থেকে রায়চক গাড়িতে প্রায় সওয়া ঘণ্টা। যদি আমতলার মোড়ে জ্যাম না থাকে। রায়চক থেকে হুগলি নদী পেরোতে সব মিলিয়ে আধঘণ্টা। তার পর ওপারে কুকড়াহাটি থেকে গাড়িতে হলদিয়া। সেও প্রায় আধঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ব্যাপার। তারপর লঞ্চে করে মীন দ্বীপ। কতক্ষণ লাগবে, জানি না। সব মিলিয়ে ঘণ্টা তিনেকের ধাক্কা। এখন বেলা এগারোটা। অর্থাৎ দুটো—আড়াইটের আগে মীন দ্বীপে পৌঁছনো যাবে না। তার থেকেও বড় কথা, তা হলে আজ আর অফিসে যাওয়া যাবে না। তাতে অবশ্য ক্ষতি নেই। একটা চাঞ্চল্যকর খবর তো পাওয়া যাবে। গ্যারি যে খবরটা করবে, আমার কাগজেও সেই খবরটা বের হবে। কম কথা?

রূপায়ণকে ফোন করে বলে দিলাম, একটা বড় খবরের জন্য হলদিয়ার দিকে যাচ্ছি। আজ নাও ফিরতে পারি। ফোনটা রেখেই গ্যারিকে বললাম, ”আমার লাঞ্চ করা হয়নি। চল, একসঙ্গে লাঞ্চ করে নিই। আমাদের এখানে ইলিশ মাছ খেয়ে দেখো। একেবারে তোমাদের ওখানকার সার্ডিন মাছের মতো।”

লাঞ্চ করে দু’জনে যখন বেরোলাম, তখন প্রায় বারোটা। গ্যারি ছেলেটা বেশ মিশুকে। গাড়িতে ডায়মন্ডহারবার রোড দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম, ভারত সম্পর্কে ও বেশ পড়াশোনা করে এসেছে। বিশেষ করে ভারতীয়দের বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে মনে হল অনেক কিছু জানে। লোকনাথ পেলজার সম্পর্কে বেশ শ্রদ্ধার সঙ্গে ও কথা বলতে লাগল। বুঝলাম, ক্লোন তৈরি করা নিয়ে আমার খুব একটা বিশ্বাস না হলেও, গ্যারি কিন্তু যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। একটা সময় ও বলল, ”কালকেতু, আমাদের দেশে অনেকেই ক্লোন নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা—নিরীক্ষা করছেন। কিন্তু তোমাদের এই সায়েন্টিস্ট অন্তত তিন ধাপ এগিয়ে গেছেন।”

জিজ্ঞেস করলাম, ”কীরকম?”

”ঠিক জানি না। তবে আমেরিকান সোসাইটি অব সায়েন্টিস্টস অ্যান্ড রিসার্চার্স বলে একটা সংস্থা আছে আমাদের ওয়াশিংটনে। তাদের একজনের মতে, এই লুকে পেলজার নাকি এমন একটা ছাঁচ তৈরি করেছেন, যার ভেতর রেখে উনি একটা মানুষকে অন্য একটা মানুষের মতো করে দিতে পারেন।”

”তা সম্ভব নাকি?”

”কোনও কিছুই অসম্ভব নয় কালকেতু। ক্লোন তৈরি করতে এক বছর সময় লাগে। কিন্তু পেলজার বলছেন, এত সময় দেওয়া অর্থহীন। মানব জাতি খুব শিগগির বিরাট একটা বিপদের মধ্যে পড়বে। সেই বিপদের মোকাবিলা করার জন্য এখনই আমাদের তৈরি হওয়া দরকার। আমাদের অনেক মানুষ দরকার। স্রেফ ছাঁচে ফেলেই যমজ মানুষ তৈরি করা সম্ভব। এবং তা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। তার মানে, ভদ্রলোকের সঙ্গে যদি দেখা হয়, এবং আমি যদি ইচ্ছা প্রকাশ করি, তা হলে আমি গ্যারি স্মিথ, মীন দ্বীপ থেকে ফেরার সময় আরও তিনজন গ্যারি স্মিথ নিয়ে ফিরতে পারি।”

বলেই গ্যারি হাসতে লাগল। কথাটা শুনে চমকে উঠলাম। বললাম, ”এ তো ভয়ানক ব্যাপার। লোকনাথ পেলজার যদি সত্যিই এই ক্ষমতাটা আয়ত্ত করে থাকেন, তা হলে তো সৃষ্টি রসাতলে যাবে।”

গ্যারি বলল, ”সামান্য এই কথাটা শুনে চমকে উঠলে, পেলজারের আরও ক্ষমতা শুনলে তো সেন্সলেস হয়ে যাবে। ভদ্রলোক ইচ্ছে করলে গ্যারি স্মিথকে কালকেতু নন্দী, আর কালকেতু নন্দীকে গ্যারি স্মিথও করে দিতে পারেন, এমন ছাঁচ তিনি তৈরি করেছেন। আমাদের দেশের সোসাইটির লোকেরা বললেন, মানুষ বদলাবদল করে দেওয়াটা না কি পেলজারের কাছে এখন জলভাত।

শুনে আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। অন্য কেউ বললে বিশ্বাসই করতাম না। কিন্তু বলছে আমেরিকার অন্যতম সেরা একজন সাংবাদিক। তাচ্ছিল্য বা ব্যঙ্গ করে বলছে না। বলছে গভীর বিশ্বাস থেকে। এখানে আসার আগে নিশ্চয়ই হোম ওয়ার্ক করে এসেছে। মাত্র ষাট—সত্তর কিলোমিটার দূরে আমরা আছি, অথচ এতবড় একটা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা—নিরীক্ষার কোনও খবর রাখিনি। আর গ্যারি? আমেরিকা থেকে চলে এসেছে তা নিয়ে লেখার জন্য! ছি ছি। এইজন্যেই ওদের সঙ্গে আমাদের এত তফাত। মুখ নিচু হয়ে যাচ্ছে গ্যারির কথা শুনে।

আড়চোখে তাকিয়ে দেখি, গ্যারি সিগারেট ধরাচ্ছে। কোনও প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেই এখন লজ্জা করছে। মানুষ বদলাবদলি করে দেওয়ার ক্ষমতা সত্যিই কেউ আয়ত্ত করতে পারেন? শুনেছি আমাদের দেশে আগেকার মুনিঋষিরা নাকি কেউ কেউ এই ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু এখনকার যুগে সম্ভব? যদি সম্ভবও হয়, সেটা তো খুব ক্ষতিকারকও হবে। দুষ্টু লোকেরা নৈরাজ্য ডেকে আনবে। নিয়মশৃঙ্খলা বলে কোনও বস্তুই থাকবে না। ধরা যাক, সারা ভারতের দশজন মানুষ ওই ছাঁচে ঢুকে অটলবিহারী বাজপেয়ী হতে চাইলেন এবং মীন দ্বীপ থেকে সত্যি সত্যি প্রধানমন্ত্রীর চেহারা নিয়ে বেরিয়ে এলেন, তখন কী হবে?

পৈলানের কাছে পৌঁছতেই হঠাৎ গ্যারি বলল, ”কালকেতু, এখানে কোথাও মিনারেল ওয়াটার পাওয়া যাবে?”

বললাম, ”হ্যাঁ। আরেকটু এগিয়েই আমতলা বলে একটা জায়গা আছে। ওখানে পাওয়া যাবে।”

তারপরই গ্যারির অদ্ভূত প্রশ্ন, ”কালকেতু, ধরো প্রোফেসর পেলজার যদি আজ তোমাকে বলেন, আপনার ইচ্ছেমতো আপনাকে আমি বদলে দিতে চাই। তুমি কার মতো হতে চাইবে?”

আচমকা এই প্রশ্নে হেসে ফেললাম। আমি কার মতো হতে চাইব? কোনওদিন তো ভেবে দেখিনি। চট করে একটা নাম মনে এল। পেলে। নাহ গায়ের রং আমার সঙ্গে মিলবে না। অবশ্য আমি এখনও জানি না, প্রোফেসর পেলজার শরীর বদলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চামড়ার রংও বদলে দিতে পারেন কি না। ছেলেবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল, নামী ফুটবলার হওয়ার। না, পেলে হওয়ার স্বপ্ন নিশ্চয়ই দেখিনি। নিদেনপক্ষে প্রদীপ ব্যানার্জির মতো হলেও মনে করতাম, সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তা হলে কি মারাদোনা হতে চাইব? হ্যাঁ, হাইট প্রায় একই রকম। আমাকে মানিয়ে যাবে মারাদোনায়। হাসতে হাসতে তাই বললাম, ”ডিয়েগো মারাদোনা।”

গ্যারি বলল, ”শেষ পর্যন্ত তুমি একজন ড্রাগ অ্যাডিক্ট লোকের নাম বললে? এটা আমি আশা করিনি কালকেতু।”

কথা বলতে বলতে আমরা মিনিট দশেকের মধ্যেই আমতলায় পৌঁছে গেলাম। একটা বড় রেস্তরাঁয় গাড়ি লাগিয়েই আমরা টের পেলাম, আমরা একা নই। আমাদের পেছনে আরও অনেকে আছে। একটা টাটা সুমোয় চারজন লোক আমাদের ফলো করছে। হালকা সবুজ রঙের সুমোটাকে প্রথম দেখি ঠাকুরপুকুরের কাছে। গ্যারিকে কিছু বললাম না। পাছে ও ভয় পেয়ে যায়। দু’জনে সফট ড্রিঙ্কসের বোতল শেষ করে ফের আমাদের গাড়িতে উঠে বসলাম।

বিষ্ণুপুর থানার ও সি বিনোদ হাজরা আমার খুব চেনা। একবার ভাবলাম নেমে থানায় চলে যাই। কিন্তু থানা—পুলিশ করতে গেলে সময় নষ্ট হবে। তাই ড্রাইভারকে গাড়ি ঘোরাতে বললাম না। গ্যারি মাঝে—মাঝে এ—কথা সে—কথা জিজ্ঞেস করছে। ভারতীয়দের সম্পর্কে ওর কৌতূহল দেখে হাসছি। আমার সঙ্গে কথা বলার মাঝেই ও একবার নিউ ইয়র্কে কথা বলে জানিয়ে দিল, মীন দ্বীপের দিকে রওনা হয়েছে। কলকাতায় বেলা দেড়টা মানে নিউ ইয়র্কে গভীর রাত। এখনও ওদের কাগজে তা হলে কাজ হচ্ছে? গ্যারি জানিয়ে দিল, প্রোফেসর পেলজারের সঙ্গে যদি ওর দেখা হয়, তা হলে ছবিও পাঠাবে।

সরিষার মোড় পর্যন্ত কোনও কিছু ঘটল না। আমরা ডান দিকে টার্ন নিয়ে দু—তিন কিলোমিটার পশ্চিমে এগোতেই দেখলাম, আকাশে ঘন কালো মেঘ। যে—কোনও সময় বৃষ্টি নামতে পারে। ফাঁকা রাস্তা। দু’পাশে ধানখেত। রায়চকের দিক থেকে ক্বচিৎ এক—আধটা গাড়ি হুস করে পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ পেছন থেকে প্রচণ্ড একটা শব্দ শুনতে পেলাম। কোথাও কি বাজ পড়ল? পেছন দিকে তাকিয়ে দেখি, অনেক দূরে টাটা সুমোর গা দিয়ে ধোঁয়া উড়ছে। গাড়িটা কাত হয়ে নেমে গেছে ধানখেতে। পেছন থেকে নীল রঙের একটা মারুতি দ্রুতবেগে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।

রায়চকের লঞ্চঘাটে এসে কিন্তু কোথাও মারুতিটাকে দেখতে পেলাম না। যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। কেউ আমাদের ফলো করছে না। গ্যারির কাঁধে একটা হ্যাভারস্যাক। মনে হয়, ভিডিও ক্যামেরা, ল্যাপটপ কম্পিউটার আছে। আমরা এসব নিয়ে ঘোরার কথা ভাবতে পারি না। ও ইচ্ছে করলে এই লঞ্চঘাট থেকেই ওর কাগজের অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। আমরা পারব না। আনন্দবাজারে ফোন করতে হলে এখন আমাকে কোনও এস টি ডি বুথে যেতে হবে। আমরা কত পিছিয়ে ওদের কাছে। কথাটা ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। মোবাইল ফোনে গ্যারি কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। সেই ফাঁকে আমি দুটো ডাব কিনে ফেললাম।

লঞ্চে উঠে গ্যারি গম্ভীর মুখে বলল, ”কালকেতু, তোমার সঙ্গে কি কোনও আর্মস আছে?”

অবাক হয়ে বললাম, ”না। আর্মস কেন লাগবে?”

”দরকার হতে পারে। নিউ ইয়র্ক থেকে আমার এক কলিগ ফোন করেছিল এখন। বলল, নিউ জার্সি থেকে একজন উগ্রপন্থী বিজ্ঞানী আমার সঙ্গে একই প্লেনে এখানে এসেছেন। প্রোফেসর পেলজারের ল্যাবরেটারিটা তিনি ধ্বংস করতে চান। তিনি এত খেপে আছেন, আমাদের কাগজে ফোন করে হুমকি দিয়েছেন, প্রোফেসর পেলজার হলেন মানব সভ্যতার শত্রু। তাঁর বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই।”

বিজ্ঞানীদেরও মধ্যে উগ্রপন্থী আছেন নাকি? কোনওদিন তো শুনিনি! গ্যারিকে সে—কথা জিজ্ঞেস করতেই ও বলল, ”ওদের একটা সংস্থা আছে নিউ জার্সিতে। খুব শক্তিশালী সেই সংস্থা। কিন্তু একটা জিনিস ভেবে আমি অবাকই হচ্ছি, ওরা জানল কী করে, আমি প্রোফেসর পেলজারের সঙ্গে দেখা করতে আসছি? নিশ্চয়ই আমাদের কাগজ থেকে খবরটা জানাজানি হয়ে গেছে। জানো কালকেতু, এই উগ্রপন্থী বিজ্ঞানীরা খুব ধূর্ত। বুদ্ধিতে এঁদের সঙ্গে টক্কর দেওয়া মুশকিল। নিশ্চয়ই তোমাদের এখানে ওদের ব্রাঞ্চ আছে। এখানকার লোকজনের সাহায্যও ওরা নেবে।”

কথাটা শুনে আমি সাবধান হয়ে গেলাম। একজন বিজ্ঞানী কোনও কিছু আবিষ্কার করলে অন্য বিজ্ঞানীরা তা চট করে মানতে চান না। আকচার দেখেছি। তাঁর ক্ষতি করার জন্য অন্যরা সবাই উঠেপড়ে লাগেন। প্রোফেসর পেলজার যে আবিষ্কারটি করেছেন বলে দাবি করেছেন, তা যদি সত্যি হয়, যুগান্তকারী বললেও কম বলা হবে। লঞ্চে আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম, না স্থানীয় মানুষ ছাড়া আর কেউ নেই। তার মানে, আমাদের কেউ অনুসরণ করছে না। ওপারে কুকড়াহাটি। ওখান থেকে যেতে হবে হাতিবেড়িয়া। হুগলি নদীর পার থেকে ভটভটি করে মীন দ্বীপ। যেন নির্বিঘ্নে পৌঁছতে পারি গ্যারিকে নিয়ে।

ঠিক তখনই আমার সুদীশের কথা মনে হল। ইস, ওকে সঙ্গে নিয়ে এলে ভাল হত। অন্তত ওর আর্মস কাজে লাগত। আজ পর্যন্ত যতবার রহস্যভেদ করতে বেরিয়েছি, কোনওবার অস্ত্রের দরকার হয়নি। পাগলা বিজ্ঞানীদের পাল্লায় পড়ব, কে ভাবতে পেরেছিল? পুরো ব্যাপারটাই এমন গুলিয়ে গেল, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, মীন দ্বীপে কেন যাচ্ছি? খবর করতে? গ্যারিকে সঙ্গ দিতে? না কি কোনও রহস্যভেদ করার জন্য?

কুকড়াহাটির লঞ্চঘাটে নেমেই চমক। দেখি সুদীশ দাঁড়িয়ে। মুখ থেকে ছিটকে বেরোল প্রশ্নটা, ”তুই এখানে?”

সুদীশ নির্লিপ্ত গলায় বলল, ”প্রোফেসর পেলজার আমাকে পাঠিয়ে দিলেন তোদের রিসিভ করার জন্য।”

”তুই কী করে জানলি আমি গ্যারির সঙ্গে আসছি?”

”ভেরি সিম্পল। তোর বাড়িতে ফোন করেছিলাম। ফুল্লরা বলল, তুই আসছিস। এত অবাক হচ্ছিস কেন?” বলেই সুদীশ হাত বাড়িয়ে দিল গ্যারির দিকে। হ্যান্ডশেক করার জন্য।

মীন দ্বীপে প্রোফেসর পেলজারকে দেখে, সত্যি বলতে কী, আমি একটু অবাকই হলাম। রাজেশের মুখে শুনেছিলাম, ভদ্রলোকের বয়স আশি—একাশি বছরের কাছাকাছি হবে। কিন্তু দেখে মনে হল, পঞ্চাশ—পঞ্চান্নর বেশি না। বয়সটাকে উলটো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার বিদ্যেটাও উনি আয়ত্ত করেছেন নাকি? এসব লোক সব কিছু পারেন। যিনি ছাঁচে ফেলে নকল মানুষ তৈরি করতে পারেন, তাঁর কাছে বয়স কমিয়ে ফেলা তো কিছুই না। মনে মনে ঠিক করে রাখলাম, সুযোগ পেলেই কথাটা ওঁকে জিজ্ঞেস করব। প্রোফেসর নীল রঙের একটা পাঞ্জাবি পরে আছেন। যার ঝুল প্রায় পা অবধি। হাইট বেশি না। পাঁচ আট মতো হবে। ভদ্রলোক একসময় বেশ সুদর্শন ছিলেন।

একটা গোলমতো সিংহাসনে প্রোফেসর পেলজার বসে ধ্যান করছেন। সিংহাসনের পেছন দিকে হালকা নীল রঙের আলো। ভদ্রলোককে অবতার অবতার গোছের মনে হচ্ছে। ছোট্ট হলঘরটার দু’দিকে দুটো দরজা। আমরা যে দরজা দিয়ে ঢুকলাম, তার উলটোদিকে প্রস্থান পথ। একজন গার্ড দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বক্সিং গ্লাভসের মতো কী যেন পরা। কে জানে ওটাই কোনও অস্ত্র কি না? হাতিবেড়িয়া থেকে ভটভটি করে মীন দ্বীপে পৌঁছনোর পর, অনেক কিছুই চোখে পড়ল, আগে কখনও যা দেখিনি। নাহ গ্যারির সঙ্গে এসে ভালই করেছি। আমাদের রবিবাসরীয় পাতায় বড় করে এই অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার সম্পর্কে পরে একটা প্রবন্ধ লেখা যাবে।

ভটভটিতে সুদীশ আমাকে বলে দিয়েছিল, ”কালকেতু, প্রোফেসর পেলজার হলেন জিনিয়াস। বুঝলি! দ্বীপে নামলেই সেটা টের পাবি।”

তখন বলেছিলাম, ”কী ব্যাপার, তুই তো এখানে এসেছিলি ওঁকে অ্যারেস্ট করতে। সেদিন ঠাট্টা করে বললি ক্লোনবাবাজি। হঠাৎ তাঁর এত প্রশংসা করছিস?”

”না রে ভাই, লোকটার এলেম আছে। আমাকে কী বলেছেন জানিস? মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে আমার মতোই আরেকজনকে উনি তৈরি করে দিতে পারেন। মাত্র সাত—আট ঘণ্টা এখানে এসেছি। এরই মধ্যে যা দেখলাম, প্রোফেসরকে ভগবান বলে মনে হচ্ছে।”

”কী এমন দেখলি এখানে?”

”আরে, প্রথমে তো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ভটভটি করে দ্বীপে পা রাখার পর মনে হল জায়গাটা সুবিধার নয়। দ্বীপটা কত বড়, তারও আন্দাজ পাচ্ছিলাম না। খালি গরান আর সুন্দরী গাছের জঙ্গল। বিষাক্ত সাপ আর বড় বড় মোষের দল। জল পেরিয়ে এত মোষ এল কোত্থেকে? পারের দিকে কয়েক ঘর জেলে বাস করে। নদীতে মীন ধরে। ওদের জিজ্ঞেস করে জানলাম, দ্বীপের ভেতরের দিকে অদ্ভুত সব কাণ্ড হয়। ভয়ে মানুষজন কেউ যায় না। কী হয়, জানতে চাওয়ায় একজন বলল, রাক্ষস আছে। শুনে প্রচণ্ড হেসেছিলাম। পরেপায়ে হেঁটে ঘুরে দেখলাম, দ্বীপের সারফেসে সন্দেহজনক কিছু নেই।”

”তার মানে?”

”প্রোফেসর পেলজারের যা কিছু, সব আন্ডারগ্রাউন্ডে। পুরো ল্যাবরেটরিটাই। প্রায় দশ কিলোমিটার জুড়ে।”

”কী বাজে বকছিস? দ্বীপটা তা হলে কত বড়?”

”লম্বায় কুড়ি কিলোমিটার তো বটেই। আর চওড়ায় ধর, তিন থেকে সাড়ে তিন। সে যাক, ঘুরে ঘুরে যখন প্রোফেসরের কোনও হদিস পাচ্ছি না, তখন একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল। অরণ্যদেবের গুহার দরজাটা তোর মনে পড়ছে? মানুষের মাথার খুলির মতো। তোর মনে পড়া উচিত। এখানে প্রোফেসরের ল্যাবরেটরির দরজাটাও ঠিক তেমনই। একটা উড়ন্ত চাকির মতো। সেটা দেখেই আমি বুঝে গেলাম, দিস ইজ দ্য প্লেস। এখানেই পাওয়া যাবে লোকনাথ পোদ্দার ওরফে লুকে পেলজার ওরফে ঈশ্বরের এক নম্বর সন্তানকে।”

”কী করে ভেতরে ঢুকলি? বাই ফোর্স?”

”আরে না, না। দরজার সামনে হঠাৎ দেখি, প্রোফেসর। আমাকে আপ্যায়ন করে ডেকে নিয়ে গেলেন ভেতরে।”

”সারপ্রাইজিং। তারপর?”

”তারপরে নিজেই সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। ভাই, আমি তো জানতামই না, ভদ্রলোক ইস্টবেঙ্গলের প্লেয়ার ছিলেন। সেটা শুনেই প্রথমে আমার শ্রদ্ধা হল। চল, সব নিজের চোখেই দেখতে পাবি। এতবড় সায়েন্টিস্ট, ভদ্রলোককে তো নোবেল প্রাইজ দেওয়া উচিত।”

”কেন?”

”মানুষ তৈরি করা কি চাট্টিখানি কথা? আমাদের কত মানুষ দরকার বল তো? এই যে বর্ডারে রোজ ক্ল্যাশ হচ্ছে, আমাদের হাজার হাজার সৈন্য মারা যাচ্ছে। প্রোফেসরকে বললেই নতুন লোক চট করে বানিয়ে দেবে। যাক ভাই, আমি খুব ইম্প্রেসড। এখানে কিছুদিন থেকে যাব ভাবছি।”

ভটভটিতেই ভাবছিলাম, সুদীশের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এই ল্যাবরেটরিতে এসে আধঘণ্টার মধ্যে আমার মাথাই খারাপ হওয়ার জোগাড়। করিডরে জ্যান্ত বাঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইন্ডোর হল—এ ছোট সৌরভ আর শচীন ক্রিকেট প্র্যাকটিস করছে। আর চেয়ারে বসে খাতায় নোট নিচ্ছেন অজিত ওয়াড়েকর। তাঁর পাশে বসা একজনকে ঠিক চিনতে পারলাম না। এক ঝলক দেখে মনে হল, রমাকান্ত আচরেকর। শচীনের গুরু। কী যেন বলছেন, ওয়াড়েকরকে।

এসব দেখা করিডর দিয়ে হাঁটার সময়। গ্যারি ফিসফিস করে একবার শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, বাঘগুলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার কি না? আমি ঘাড় নাড়ার পর সেই যে চুপ করে গেছে, আর একটা কথাও বলেনি। আমি নিশ্চিত, ও কিন্তু ছবি তুলেছে। প্রোফেসর পেলজারের প্রাইভেট রুমে আমরা বসে আছি। ধ্যান সেরে নেওয়ার পর উনি আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন। গ্যারি ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য ওর বেটা ক্যামেরা নিয়ে তৈরি। কিন্তু কখন ওঁর ধ্যানভঙ্গ হবে আমরা তিনজন বুঝতে পারছি না। সুদীশ বেশিক্ষণ কোথাও বসে থাকতে পারে না। আমাকে বলল, ”কালকেতু, আমি বাইরে গিয়ে একটা সিগারেট টেনে আসছি। ঘরের মধ্যে দমবন্ধ হয়ে আসছে। আর বসে থাকতে পারছি না।”

সুদীশ বাইরে চলে যাওয়ার পরই প্রোফেসর পেলজার চোখ মেলে তাকালেন। তারপর আমাকে বললেন, ”কালকেতু, তোমার সঙ্গে আমার অনেক আগেই আলাপ হয়ে গেছে। গ্যারিকে চাক্ষুষ করিনি। ফোনে কথা হয়েছে। বল তোমরা, কী জানতে চাও।”

প্রোফেসরের কথা শুনে আমি একটু অবাকই হলাম। আমার সঙ্গে আলাপ হয়েছে মানে? কোথায় আলাপ হল? প্রশ্নটা করতেই প্রোফেসর বললেন, ”তোমার মনে আছে বেশ কয়েক বছর আগে সল্ট লেকের সাই কমপ্লেক্সে একটা সেমিনার হয়েছিল? সম্ভবত কোনও ওলিম্পিক গেমসের পরে। তুমি খুব আক্ষেপ করেছিলে, গেমস থেকে ভারতীয় দল শূন্যহাতে ফেরার জন্য। কিছু সাজেশনও তুমি দিয়েছিলে সেদিন। সেমিনারে তোমার কথাগুলো শুনে আমার খুব ভাল লেগেছিল। সেদিন সেমিনার হয়ে যাওয়ার পর আমি অনেকক্ষণ তোমার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। সত্যি কথা বলতে কী, তোমার সেই সাজেশন আমাকে অনেক ভাবিয়েছিল। বিশ্বের টপ স্পোর্টসম্যানদের ক্লোন করার আইডিয়া তখনই আমার মাথায় ঢোকে।”

প্রোফেসরের কথা শুনে আমার সেদিনকার সেই সেমিনারের কথা মনে পড়ে গেল। লস অ্যাঞ্জেলিস ওলিম্পিকের পর সাইয়ের ডিরেক্টর মুথুস্বামী প্রায় জোর করেই আমাকে নিয়ে গেছিলেন ওই সেমিনারে। সতেরো—আঠারো বছর আগেকার কথা। প্রোফেসর এখনও মনে রেখেছেন! উনি কথা বলছেন ইংরেজিতে। হঠাৎই গ্যারিকে বললেন, ”তুমি ই—মেলে কিছু প্রশ্ন পাঠিয়েছিলে। হয়তো আমি উত্তর দিতে পারতাম। কিন্তু সব কিছু তোমাকে দেখাতে চাই। সেজন্যই তোমাকে এখানে আসতে অনুরোধ করলাম। তোমরা আমেরিকানরা খুব খুঁতখুঁতে। নিজের চোখে না দেখা পর্যন্ত তোমরা কিছু বিশ্বাস করতে চাও না। আমি জানতাম না, তোমার সঙ্গে কালকেতু নন্দীর পরিচত আছে। সেটা জানতে পারলাম, তোমরা দু’জন এখানে রওনা হওয়ার পর। ভাগ্যিস, আমার কয়েকজন লোক তোমাদের ফলো করেছিল। না হলে এতক্ষণে তোমাদের লাশ পড়ে থাকত ডায়মন্ডহারবার রোডের কোনও একটা জায়গায়।”

গ্যারি বলল, ”আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না।”

প্রোফেসর মৃদু হেসে বললেন, ”কালকেতুর বাড়ি থেকে তোমরা বেরোনোর পরই একটা সুমো গাড়িতে দু’জন তোমাদের ফলো করে। তাদের একজন আমার পুরনো শত্রু। নাম উলফগ্যাং ক্রাকার। ইনিও বিজ্ঞানী এবং একটা সময় ফার্টাইলিটি এক্সপার্ট ছিলেন। আমার রিসার্চ পেপার চুরি করে ইনি আমার আগেই আমেরিকান সোসাইটি ফর সায়েন্টিস্টস অ্যান্ড রিসার্চার্সের সদস্য হয়ে যান। ক্যালিফোর্নিয়ায় এই উলফগ্যাং আমাকে নানাভাবে বিরক্ত করেছেন। সেই কারণে একটা সময় আমি দেশে ফিরে আসি। কয়েকমাস আগে ওঁকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই একটা চিঠি লিখি। তোমরা আমাকে নতুন পৃথিবী তৈরি করতে বাধা দিলেও, আমি সেই কাজে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছি। স্বয়ং ঈশ্বর আমার সহায়। তোমার মতো নগণ্য মানুষ আমার কী ক্ষতি করতে পারে? সেই চিঠি পেয়ে উলফগ্যাং প্রচণ্ড খাপ্পা হয়ে আমাকে হুমকি দেন, তুমি যাই করো না কেন, যতক্ষণ না আমরা তোমাকে স্বীকৃতি দিচ্ছি, ততক্ষণ তোমার আবিষ্কারের কথা কেউ বিশ্বাসও করবে না।”

গ্যারি জিজ্ঞেস করল, ”তারপর?”

”তারপর আমিও পালটা জবাব দিলাম, আমেরিকান সায়েন্টিস্টদের আমি পাত্তাই দিই না। তোমাদের সার্টিফিকেট আমি চাই না। ঈশ্বর চান, এবার আমি প্রচারের আলোয় আসি। তাই তোমাদের দেশের সেরা কাগজের একজন সেরা রিপোর্টারকে আমি আমার আবিষ্কৃত সব কিছু দেখাব। দেখি, তারপরও তোমরা আমায় আটকাও কী করে? তারপরই গ্যারি তোমাকে আমি যোগাযোগ করি। সম্ভবত সে—কথা উলফগ্যাং জানতে পারে এবং তোমাকে ফলো করে প্রায় আমার দ্বীপে পৌঁছে গিয়েছিল। ওঁর লক্ষ্য ছিল, তোমাকে মাঝ রাস্তায় মেরে ফেলে, তোমার পরিচয়ে এখানে ওঁর এক ভাড়াটে খুনিকে পাঠিয়ে দেওয়া। যে এখানকার সব ধ্বংস করে চলে যেত।”

গ্যারি আর আমার দু’জনের মুখ থেকেই একটা কথা ছিটকে বেরোল, ”কী বলছেন আপনি?”

”ঠিক বলছি। তোমরা হয়তো লক্ষও করোনি, এখানে আসার পথে একটা সুমো গাড়িকে আমার লোকরা আটকে দেয়। সেই গাড়িতে উলফগ্যাং আর একজন ইজরায়েলি খুনি ছিলেন। আহত অবস্থায় ওঁরা কলকাতায় ফিরে গেছেন বলে আমার কাছে খবর এসেছে। বাকি রাস্তা আমার লোকেরা তোমাদের গার্ড দিয়ে এনেছে।”

প্রোফেসরের কথা শুনে হঠাৎ আমার মনে পড়ল, সেই শব্দটার কথা। সরিষার কাছে যে গাড়িটাকে ধানখেতে নেমে যেতে দেখেছিলাম, সেই গাড়িতেই কি উলফগ্যাং ছিলেন? প্রোফেসরের কথা বিশ্বাস না করে উপায় নেই। অনেক কথা জানতে ইচ্ছে করছে ভদ্রলোকের কাছ থেকে। আগে সব দেখে নিই। তারপর না হয়, এক এক করে সব প্রশ্ন করব।

প্রোফেসর পেলজার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ”চল তোমাদের সব ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিই। গ্যারি, তুমি উইলমা রুডলফের ক্লোন সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলে। চল, আগে ক্লোন ইনস্টিটিউটে যাই।”

গ্যারি হাতঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ”তাই চলুন, আমাকে রাত বারোটার মধ্যে কলকাতায় ফিরে যেতে হবে। খবর পাঠাতে হবে। আমার অফিসের লোকেরা সবাই আমার রিপোর্টের জন্য বসে আছেন।”

লিফটে করে আমরা নীচে নেমে এলাম। প্রোফেসরের ল্যাবরেটরি যেন হলিউডের সায়েন্স ফিকশন সিনেমার সেট। সর্বত্র হালকা নীল আলো। এই আলোটা বেছে নেওয়ার কারণ কী জানতে চাওয়ায় প্রোফেসর বললেন, ”গুড কোয়েশ্চেন। নীল রংটা মহাশূন্যের প্রতীক। আমরা সবাই মহাশূন্যের এক গ্রহ থেকে এসেছি। সেটা মনে করানো আমার উদ্দেশ্য।”

লিফট থেকে নেমে চলন্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমরা এক কিলোমিটারের মতো যাওয়ার পর প্রোফেসর বললেন, ”চল, এসে গেছি।”

ক্লোন ইনস্টিটিউটের ম্যাগনেটিক গেট নিয়ে ঢুকতেই রিসেপশন। সেখানে কয়েকটা মেয়ে বসে কাজ করছে। তারা সবাই প্রোফেসরকে দেখে উঠে দাঁড়াল। প্রত্যেকের পরনে নীল শাড়ি। কাঁধের কাছে একটা ব্যাজ, উড়ন্ত চাকির। প্রোফেসর একজনকে বললেন, ”গোপা, রুডি কি প্র্যাকটিসে গেছে?”

গোপা বলে মেয়েটা বলল, ”না সার, ও ঘরেই আছে। ঘুমিয়ে রয়েছে।”

”ঘুমিয়ে রয়েছে। এখন তো ওর প্র্যাকটিসে যাওয়ার কথা।” প্রোফেসরের গলা শুনে মনে হল যেন একটু রেগে উঠলেন। বললেন, ”তোমরা এ—কথাটা আমাকে জানাওনি কেন? আর দু’দিন পর ডায়মন্ডহারবারে ওর কম্পিটিশন। আর এখনও ঘুমিয়ে রয়েছে? তোমরা তা হলে করছটা কী?”

গোপা বলল, ”সার, একটা কথা আপনাকে বলার ছিল। মুচিশায় কম্পিটিশন করে আসার পর থেকেই ওর মধ্যে অনেক পরিবর্তন আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমি ইলিয়াস বাবর সারকে সব জানিয়েছিলাম। উনি আপনাকে কিছু বলেননি?”

”না। তোমরা ভেবেছটা কী? আমার সব এক্সপেরিমেন্ট বানচাল করে দেবে? কেন মুচিশা থেকে ফিরে আসার পর রুডির মধ্যে কী কী পরিবর্তন লক্ষ করেছ, আমাকে বল তো। আমি তোমার কাছে সব শুনতে চাই।”

গোপা মেয়েটা ভয়ে ভয়ে বলল, ”সার ও এখানকার মেয়েদের মতো সব ব্যাপারে দেখছি আর্গুমেন্ট করছে। সিনেমা দেখার নেশা বেড়েছে। গান শুনছে। সাজগোজ করতে চাইছে। ফাঁকি মারতে শিখেছে। এইসব আর কি!”

”সে কী! মুচিশার কম্পিটিশনের ভিডিও ক্লিপিংস আমার কাছে পাঠিয়ে দাও তো। আমি নিজে দেখে অ্যানালিসিস করতে চাই। আর শোনো, ওকে এখুনি ডেকে তোল। বল, গ্র্যান্ডফাদার ডাকছে।”

গ্যারি আর আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। প্রোফেসর মারাত্মক চটে গেছেন। পায়চারি শুরু করে দিলেন। গোপা বলে মেয়েটা রুডিকে ডাকতে ভেতরে গেছে। ফিরে আসার নাম নেই। রিসেপশনের অন্য মেয়েরা পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। মিনিট কয়েক অপেক্ষা করে প্রোফেসর অধৈর্য হয়ে বললেন, ”এই, তোমরা আমার সঙ্গে এসো। মনে হচ্ছে, কিছু গড়বড় হয়েছে।”

প্রোফেসরের পেছন পেছন আমরা রিসেপশন ছেড়ে ভেতরে ঢুকলাম। দু’পাশে প্রচুর ঘর। সব ইস্পাতের তৈরি। একটা ঘরের সামনে পৌঁছে আমরা গোপার গলা শুনতে পেলাম, ”রুডি, সার কিন্তু তোমার ওপর প্রচণ্ড রেগে গেছেন।”

সঙ্গে—সঙ্গে একটা অল্পবয়সী মেয়ের গলা, ”না না, আমি প্র্যাকটিসে যাব না। আমার ভাল লাগছে না।”

দরজা দিয়ে প্রোফেসর ঢুকতেই মেয়েটা চুপ করে গেল। দরজার বাইরে আমরা দাঁড়িয়ে। ভাবলাম, প্রোফেসর বোধ হয় খুব বকাঝকা করবেন। আশ্চর্য, তা না করে উনি মেয়েটাকে খুব মোলায়েম গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ”রুডি, কেন প্র্যাকটিসে যেতে তোর ইচ্ছে করছে না আমায় বল তো?”

বিছানায় হাঁটু মুড়ে মেয়েটা বসে আছে। ওকে পরিষ্কার দেখে গ্যারি চমকে উঠল। ফিসফিস করে আমাকে বলল, ”একেবারে উইলমা রুডলফ! আমেরিকার লোকেরা একে দেখলে চমকে যাবে। ছাপ্পান্ন সালে উনি যখন মেলবোর্ন ওলিম্পিকে যান, তখন ঠিক এই রকম দেখতে ছিলেন।”

”কত বয়স ছিল ওঁর?”

”ঠিক এই বয়সী। ষোলো—সতেরা। প্রোফেসর পেলজার একে তৈরি করলেন কী করে?”

ঘরের ভেতরে মান—অভিমানের পালা চলছে। প্রোফেসরের সঙ্গে রুডি তর্ক করে যাচ্ছে। কেন তুমি আইসক্রিম খেতে দেবে না? কেন তুমি আমার জন্য চকোলেট কিনে আনলে না? কেন তুমি আমাকে সেদিন ওই মেয়েগুলোর বন্ধু হতে দিলে না? আমি ফাস্ট হলাম, অথচ আমার ছবি তুলতে কেন তুমি মানা করলে? রুডিকে খুব ঠান্ডা মাথায় বোঝাচ্ছেন প্রোফেসর পেলজার। কিন্তু ও শোনার মেয়েই না। একটা সময় তিনি ধৈর্য হারিয়ে বলেই ফেললেন, ”তুই যদি আমার কথা না শুনিস তা হলে তোকে এই ঘরের মধ্যে আমি আটকে রাখব।”

কথাটা শুনেই রুডি ছিটকে উঠে দাঁড়াল। তারপর আমাদের পাশ দিয়ে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। প্রোফেসরও উঠে বাইরে বেরিয়ে এলেন। ততক্ষণে রুডি রিসেপশন থেকে বাইরের করিডরে চলে গেছে। ওর যা স্পিড, ওকে কে ধরবে? প্রোফেসর হতাশ হয়ে বললেন, ”গ্যারি, সরি। মেয়েটার মাথা বিগড়েছে। একটু পরেই ও ধরা পড়ে যাবে। তখন তুমি ওর সঙ্গে কথা বোল।”

তিনজনে মিলে আমরা ভিডিও রুমে এসে বসলাম। এখানে ক্লোজ সার্কিট টিভি রয়েছে। দ্বীপের সব অংশ দেখা যাচ্ছে। কোথাও হোগলার জঙ্গল। কোথাও মোষ চরে বেড়াচ্ছে। একটা গরান গাছের নীচে কয়েকটা বাঘকে জিরিয়ে নিতে দেখলাম। টিভি ক্যামেরায় এবার রুডিকে দেখা যাচ্ছে। ওকে দৌড়তে দেখে ল্যাবরেটরির মানুষজন একটু অবাক! দৌড়তে দৌড়তে মেয়েটা গেটের বাইরে বেরিয়ে গেল। পেছন দিকে তাকিয়ে ও এবার দেখছে, কেউ অনুসরণ করছে কি না। নিশ্চিত হয়ে রুডি একটা জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। লম্বা—লম্বা পা। ওকে দেখেই আমার পি টি ঊষার কথা মনে পড়ে গেল।

প্রোফেসর টিভি সেট—এর দিকে চোখ রেখে বসে ছিলেন। হঠাৎ উনি কেমন যেন চিন্তামগ্ন। কী যেন ভাবছেন বসে বসে। আমরা দু’জন কথা বলার সাহস পেলাম না। গ্যারি আমাকে বলল, ”ঠিক যা ভেবেছিলাম, তাই ঘটছে।”

”তুমি কী ভেবেছিলে গ্যারি?”

”একজন বিজ্ঞানীর পক্ষে একজন মানুষের ক্লোন হয়তো তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু হুবহু সেই মানুষটাকে তৈরি করা সম্ভব না।”

”কী বললে, আমি ঠিক বুঝলাম না।”

”বলছি শোনো। এই রুডির কথাই ধরো। প্রোফেসর পেলজার, উইলমা রুডলফের ক্লোন তৈরি করেছেন। দেখতে মেয়েটা ঠিক উইলমার মতো বটে, কিন্তু উইলমা নন। এর কাছ থেকে উইলমার মতো পারফরম্যান্স আদায় করা সম্ভব না। কেন জানো? ঠিক যে পরিবেশের মধ্যে দিয়ে উইলমা বেড়ে উঠেছেন, সেই পরিবেশ এঁকে দিতে না পারলে এঁর কাছ থেকে কিছুই পাওয়া যাবে না।”

প্রোফেসর পেলজার আমাদের কথা শুনছিলেন কি না, তা এতক্ষণ বুঝতে পারিনি। হঠাৎ উনি বললেন, ”ইউ আর রাইট গ্যারি। তুমি ঠিক কথাই বলেছ। রুডিকে তৈরি করার আগে আমার এসব নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা উচিত ছিল। উইলমা রুডলফ সম্পর্কে কিছু তথ্য তুমি কি আমাকে দিতে পারো?”

”অবশ্যই। উইলমা আসলে টিনেসে রাজ্যের মেয়ে। ওঁর বাবা—মায়ের বাইশটি সন্তানের মধ্যে উনি ছিলেন কুড়িতম। প্রচুর ভাইবোনের মধ্যে উনি বড় হয়ে উঠেছেন। এই সাংসারিক পরিবেশটা আপনি রুডিকে দিতে পারেননি। দু’নম্বর ব্যাপার হল, ছেলেবেলায় রুডি পোলিওতে আক্রান্ত হন। তার ওপর ডাবল নিউমোনিয়া হওয়ায় ওঁর বাঁ পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছেলেবেলায় উনি ভালভাবে হাঁটতেও পারতেন না। ডাক্তার বলেন, রোজ ম্যাসাজ করে দিলে পা ভাল হয়েও যেতে পারে। সে—কথা শুনে উইলমার ভাই আর বোনেরা পালা করে ওঁর পা রোজ বারো—চোদ্দবার করে ম্যাসাজ করে দিতেন। দশ বছর বয়সে উইলমার পা অনেকটা ভাল হয়ে যায়। তখন ভাইদের সঙ্গে তিনি বাস্কেটবল খেলতে শুরু করেন। তারপর অ্যাথলেটিকসে আসেন। এইভাবেই তাঁর দৌড়জীবন শুরু। আপনার রুডির সঙ্গে কোনও মিল নেই। কী করে আপনি আশা করেন, ওঁর কাছ থেকে ওলিম্পিক মেডেল?”

প্রোফেসর পেলজার গুম হয়ে গেলেন কথাগুলো শুনে। ঘরে সূচ পড়লেও শোনা যাবে, এমন নিস্তব্ধতা। আমার খুব খারাপই লাগছে গ্যারির ব্যাখ্যা শুনে। তার মানে রুডির কোনও ভবিষ্যৎ নেই। প্রোফেসরের এত পরিশ্রম সব পণ্ডশ্রম হয়ে যাবে। এই মেয়েটা আমাদের সব প্ল্যান বানচাল করে দিল। ও পালিয়ে না গেলে প্রোফেসরের মেজাজ খারাপ হত না। আর খারাপ না হলে উনি এখন ক্লোজ সার্কিট টিভির সামনে বসতেন না।

মিনিটখানেক পর অ্যালার্ম বেলের শব্দে হঠাৎ আমরা চমকে উঠলাম। ঘরে আরও তিন—চারজন লোক ঢুকে পড়লেন। ওঁদের কথাবার্তা শুনে মনে হল, বাইরে বিপজ্জনক কিছু ঘটেছে। হঠাৎ কী হল? প্রোফেসর টিভি সেটের দিকে নজর রাখতে রাখতে বলে উঠলেন, ”তিন নম্বর জোনটায় ফোকাস করো। মনে হয়, ওখানেই কিছু ঘটেছে। হোগলার বনের মধ্যে একটা ধস্তাধস্তির মতো কিছু হচ্ছে।”

দেওয়ালের পরদায় সঙ্গে সঙ্গে ফুটে উঠল ওই অঞ্চলের অংশটা। একটা লম্বাচওড়া লোকের সঙ্গে মারপিট হচ্ছে সুদীশের। কে এই লোকটা? সিগারেট খাওয়ার নাম করে তখন বেরিয়ে গিয়েছিল সুদীশ। ও ওই হোগলার বনে গেল কী করে, আমি ভেবে পেলাম না। লম্বাচওড়া লোকটাকে দেখেই প্রোফেসর পেলজার বলে উঠলেন, ”আরে, উলফগ্যাং? ও দ্বীপে এল কী করে? সর্বনাশ! এখানে ঢুকলে ও আমার প্রচণ্ড ক্ষতি করে দেবে।” মারপিট দেখতে দেখতে খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন প্রোফেসর। ফোনের রিসিভার তুলে গর্জন করার ভঙ্গিতে কীসব নির্দেশ দিতে তাকালেন। এর পরই দেখলাম, গরান গাছের তলায় বসে থাকা বাঘগুলো দৌড়চ্ছে হোগলা বনের দিকে। প্রোফেসর কি তা হলে বাঘদের ভাষাও জানেন? না হলে হঠাৎ বাঘগুলো ওদিকে দৌড়বে কেন?

পুরো ঘটনাটা ঘটতে মিনিট তিনেকের বেশি লাগল না। দেওয়ালের পরদায় দেখলাম, বাঘগুলো ঘিরে ধরেছে উলফগ্যাংকে। সুদীশ হাঁফাতে হাঁফাতে উঠে দাঁড়িয়েছে। ওর কপাল দিয়ে রক্ত পড়ছে। কয়েকজন গার্ড সেখানে পৌঁছে গেছে। উলফগ্যাংকে বেঁধে ফেলছে লতানো শেকড় দিয়ে। মারপিট দেখে উইলমা বোধ হয় গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিল। ওকেও ধরে ফেলেছে গোপা বলে মেয়েটা। টানতে টানতে নিয়ে আসছে মেন গেটের দিকে।

ঘণ্টাপাঁচেক পর আমি, গ্যারি আর সুদীশ ফিরে আসছি কলকাতার দিকে। গ্যারি রিপোর্ট পাঠিয়ে দিয়েছে ওর কাগজের অফিসে। প্রোফেসরের ল্যাবরেটরি ঘুরে আমিও অনেক তথ্য নিয়েছি। আশ্চর্য সব অভিজ্ঞতা হল। সব কথা রবিবাসরীয় পাতায় লিখতে হবে। উলফগ্যাংকে কয়েদি করে রাখলেন প্রোফেসর পেলজার। আমাকে পরে জানিয়েও দিলেন, রুডিকে এখনই কোনও অ্যাথলেটিকস মিটে নামাবেন না। ওকে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেবেন। রুডির সব ব্যবস্থা করে দেবে গ্যারি।

ভটভটির পাটাতনে বসে আছে সুদীশ। ওর খুব ইচ্ছে ছিল, আরেকজন সুদীশকে নিয়ে আসার। বাঘ পাঠিয়ে প্রোফেসর ওকে হাতের সুখ করতে দেননি। তখন খুব আফসোস করছিল সুদীশ। তারপরই ঘণ্টাদুয়েকের জন্য কোথায় যেন চলে যায়। ফেরার সময় এখন দেখছি, খুব গম্ভীর। হঠাৎই ওর কাঁধের দিকে আমার নজর গেল। আরে, ওখানে একটা আঁচিল ছিল। সেটা কোথায়?

রাত বারোটা। আবছা আলোয় ঠিক বুঝতে পারলাম না, পাটাতনে যে বসে আছে, সে আসল সুদীশ, না প্রোফেসরের ছাঁচ থেকে বেরিয়ে আসা নকল সুদীশ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *