‘‘ক্লাইম্যাক্স’’ – বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়
আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতা থেকে গল্পটা ফেঁদেছি, উদ্দেশ্য, গল্পের ক্লাইম্যাক্স জিনিসটা কি তাই বোঝানো৷ শ্রোত্রী বা শিষ্যা আমার স্ত্রী এবং তাঁর চতুর্দশবর্ষীয়া ভগ্নী মীরা৷ প্রথমে সংজ্ঞাটা সম্বন্ধেই ধারণাটুকু পরিষ্কার করে দিলাম বললাম, ক্লাইম্যাক্স হচ্ছে কোনো রচনা বা রচনাংশের চরম পরিণতি—সে রচনা গল্প, উপন্যাস, কাব্য, মহাকাব্য যাই হোক৷ কোনো একটা বিশিষ্ট ব্যাপক অনুভূতিকে ধাপে ধাপে তুলে নিয়ে গিয়ে একেবারে চূড়ান্ত পর্যন্ত ঠেলে দেওয়া হল ক্লাইম্যাক্স৷ সেদিক দিয়ে বিচার করতে গেলে যেমন সমগ্র বইখানার শেষাংশ তার ক্লাইম্যাক্স হতে পারে, তেমনি তার একটা অধ্যায় বা আরো খণ্ডিত অংশেও একটি বিশেষ অনুভূতি বা পরিস্থিতির ক্লাইম্যাক্স সৃষ্ট হতে পারে৷ এই ক্লাইম্যাক্সটিকে ঠিকমতো ফুটিয়ে তোলাতেই রচনা বা রচনাংশের সার্থকতা৷ ক্লাইম্যাক্স জিনিসটা খুব পরিষ্কার রূপ নিয়ে ওঠে কোনো তীব্র অনুভূতি নিয়ে রচনার মধ্যেই৷ তাতে পাঠক বা শ্রোতা তীব্র উৎকণ্ঠার মধ্যে এমন আত্মবিস্মৃত হয়ে যেতে পারে যে একেবারে বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে বসতে পারে, কী বলছি, কী করছি, কোথায় আছি সে বিষয়ে কোনো সম্বিৎই থাকে না৷ এমন কি পরিণতিটা যতই খারাপ হোক, হঠাৎ উল্টে গেলে একটা আশাভঙ্গের ধাক্কাও লাগে বুকে৷ মীরার দিকে চেয়ে বললাম—‘‘এই সবের জন্যেই তোমার দিদি বই হাতে করে রান্নাঘরে ঢুকলে শুক্ত হয়ে যায় টক, অম্বল হয়ে যায় তেতো, দুধ হয়ে যায় নোন্তা, ডাল হয়ে যায়…’’
স্ত্রী বললেন, ‘‘গল্পটা বলবে তো বসি, ব্যাখ্যানা করতে হয় তো শুধু ওর কাছেই করো৷’’
‘‘বসো৷’’—বলে আরম্ভ করে দিলাম৷
‘‘একবার দিন সাতেকের জন্যে আমি আমার বন্ধু বিকাশের ওখানে বেড়াতে যাই৷ দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় দিনের কথা, বিকাশ একটা বিশেষ দরকারে সকালেই বাইরে বেরিয়ে গেল, ফিরবে খানিকটা রাত করেই৷ সমস্ত দিনটা বই পড়ে আর এদিক-ওদিক করে সন্ধ্যার একটু আগে মনে হল খানিকটা বাইরে ফাঁকা থেকে না হয় বেড়িয়ে আসি, বিকাশ এলেই তো আবার শহর দেখা, রাজবাড়ি দেখা, পার্টি, ক্লাব এই সব আরম্ভ হবে৷ ট্রেনে আসবার সময় শহর থেকে আন্দাজ মাইল দুয়েক দূরে একটি জায়গা বড় ভালো লেগেছিল একটি বেশ চওড়া নদী—তা কলকাতার গঙ্গার প্রায় আধা-আধি হবে সব নিয়ে—ওপরে একটা নেড়া পুল, তার ওপর দিয়েই গাড়িটা এল, দূরে দূরে পাহাড় কাছেও, পাহাড় না হোক এখান-ওখানে কিছু টিলা ছড়ানো, কয়েকটা বেশ খানিকটা উঠেও গেছে৷ আমাদের গাড়িটা পাস করল ঠিক সূর্যাস্তের মুখে৷ পাহাড়ে নদী, মাঝখানে শুধু কয়েকটা জলের রেখা ছড়ানো রয়েছে, বাকি সমস্তটায় ধু ধু করছে বালি৷ সেই গেরুয়া রঙের বালির ওপর প্রচণ্ড সূর্যের রাঙা রশ্মি পড়েছে ছড়িয়ে, গাংচিলের ছোটবড় ঝাঁক বাসায় ফিরছে, জলের ধারে চঞ্চল কাদাখোঁচার গায়ে সোনালী রোদটা ঝিক-ঝিক করে উঠছে—সমস্তটুকু মনে গেঁথে গিয়েছিল৷ জানতাম বিকাশকে বলতে যাওয়া বৃথা, কেননা যারা বইয়ের নেশায় ডুবে থাকে তাদের মতন, কবি বল, ঔপন্যাসিক বল, কোনো লেখককেই ও বিশেষ পছন্দ করে না—অর্থাৎ তার ঐ অংশটাকে নেকনজরে দ্যাখে না…’’
স্ত্রী একটু বক্র দৃষ্টিতে চেয়ে শুনছিলেন, ওঁকে কটাক্ষ করছি ভেবে মন্তব্য করলেন, ‘‘কেউই দ্যাখে না নেকনজরে৷’’
বললাম, ‘‘আমি অবশ্য ঠিক সে জিনিসটি দেখতে পাব না৷ কেননা বাড়ি থেকে বেরুতেই সূর্যাস্ত হয়ে যাচ্ছে, পৌঁছুব ক্রোশ-খানেক পথ হেঁটে৷ তবে শুক্ল পক্ষের মাঝামাঝি যাচ্ছে, একটা অন্যরূপে দেখতে পাব, সে বোধ হয় আরো ভালোই হবে৷
‘‘রেলের লাইন ধরে একটু পা চালিয়েই গেলাম৷ যখন পৌঁছলাম তখন সূর্য একেবারেই ডুবে গেছে, শুধু আকাশে এদিক-ওদিক ছড়ানো যে মেঘের টুকরোগুলো রয়েছে তাতে একটু একটু রঙের পোঁচ লেগে রয়েছে কোনোটাতে হাল্কা, কোনোটাতে একটু গাঢ়৷ আকাশের মাঝখানে চাঁদটা স্পষ্ট হয়ে আসছে৷ আমি পুলটা পেরিয়ে একেবারে ওপারে চলে গিয়ে লাইন থেকে নেমে পাশেই একটি ছোট্ট টিলার ওপর গিয়ে বসলাম৷ বসলাম পশ্চিমমুখো হয়ে, সামনে হাত-পাঁচেক পরেই নদীর তীরটা গেছে নেমে৷
‘‘দেখলাম, আগে বেরুবার কথা যে মনে পড়ে নি, খুব ভালোই হয়েছে৷ এমন একটি পরিপূর্ণ স্তব্ধতার মধ্যে আমি বহু দিনই পাই নি নিজেকে, এর আগে কখনো পেয়েছি বলেই মনে পড়ছে না৷ চঞ্চল জীবনের সব শব্দই গেছে থেমে, শুধু অনেক দূরে নদীটা একটা বাঁকের পর যেখানে জ্যোৎস্নার মধ্যে মিলিয়ে গেছে, খুব ক্ষীণ একটা পাখির ডাক, খুব সম্ভবত চখা-চখী, ওরা শুনেছি দূরে আলাদা আলাদা থেকে এইরকম করে ডাকতে থাকে পরস্পরকে৷ বোধহয় ভাবে এতে দাম্পত্য কলহের সম্ভাবনাটা একেবারে দূর না হোক, কমে আসে৷ একেবারে কাছে জীবন্ত কোনো শব্দই নেই, শুধু একটা টানা হাওয়া, যেটাকে আমার কেমন করে যেন মনে হচ্ছিল, এই যে মুমূর্ষু দিনটি পৃথিবীর কাছ থেকে শেষ বিদায় নিচ্ছে, তারই যেন দীর্ঘশ্বাস৷ এরকম অবস্থায় মনটা আপনিই কি করে এক হয়ে যায় এইরকম পরিস্থিতির সঙ্গে৷ আমার বয়সও তো প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি আমারও জীবনের সন্ধ্যা হয়ে আসছে, এইবার বিদায়ের পালা—এই মনে করে চোখের পাতা ভিজে-ভিজে হয়ে আসছে—একটা দীর্ঘশ্বাসও ঠেলে আসছে বুকে, এমন সময়…’’
‘‘মীরা, জিজ্ঞেস কর বাজে কথাই চলবে? তা হলে উঠি, আমার কাজ আছে ঢের৷ সাহিত্যিক নই৷’’
এবার অন্যরকম ভাব, বেশ কিছু গুরুতরই মনে হল৷ আমি স্বভাবদোষে পড়ে গিয়েছিলামই একটু ঘোরে, তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে আবার শুরু করে দিলাম, ‘দীর্ঘশ্বাসটা চেপে আসছে বুকে, এমন সময় যেন হুঁশ ফিরে এল—নিজের মনেই বললাম—বা-রে! এরকম যদি বাজে কাব্যিতে পেয়ে বসে এখানে তা হলে তো সমস্ত রাত বসেই থাকতে হবে৷ তখন বেশ কিছুক্ষণ কেটেও গেছে সেখানে, ফিরতে অনেকটা পথও, তার ওপর নতুন জায়গা, ভাবলাম এইবার উঠে পড়া যাক৷ কিন্তু ভাবুকতাটকু মন থেকে জোর করে ঠেলে সরিয়ে দিলেও, জায়গাটার নিজের একটা মোহ আছেই, মনে হল আর একটু বসে যাই, এ সুযোগ তো জীবনে বেশি আসে না৷ এইরকম ওঠবার কথা মনে হতেই আর একটু বসে যাই করে করে অনেক বারই হয়ে গেল৷ কেমন যেন অদ্ভুত মনে হল৷ কোনো আত্মীয়-কুটুমের বাড়ি গেলে—যেমন ধর, যখন তোমাদের বাড়ি যাই, একবার এর কথায় একবার ওর কথায় আটকে যেতে হয়৷ এখান জায়গাটাই যেন টেনে টেনে রাখছে৷ বেশ খানিকটা এইভাবে কাটবার পর হঠাৎ এক সময় যেন আমার চমক ভাঙল, যেন কোথায় বা কিসের মধ্যে তলিয়ে গিয়েছিলাম—হয়তো বা নিজের চেষ্টা সত্ত্বেও, এই আবার ভেসে উঠেছি৷ ভেসেও যে উঠলাম তাও একটা নতুন পরিস্থিতির মধ্যে৷ সমস্ত জায়গাটা একেবারে নিস্তব্ধ, সেই যে হাওয়ার শনশনানিটুকু ছিল তাও আর নেই৷ তোমরা আবার চটে যাবে, নইলে বলা যেত হঠাৎ যেন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে সেই দিনটার মৃত্যু ঘটে গেছে কখন৷ আমার নিজের অনুভূতিটাও গেছে বদলে একেবারে৷ সেই মুগ্ধ আনন্দের ভাবটা গিয়ে গভীর রাতে এই রকম খোলা নির্জন জায়গার নিটোল নিস্তব্ধতা আমায় সম্পূর্ণ অন্যভাবে অভিভূত করে ফেলছে আস্তে আস্তে! গা-টা ছমছম করে আসছে, একটা অহেতুক ছেলেমানুষী ভয় বুকটাকে চেপে যেন সত্যিই শ্বাসরুদ্ধ করে করে আনতে লাগল৷ শনশনানিটুকু গেলেও হাওয়া একটু রয়েছেই, এত খোলা জায়গায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয় না, আমার মন শুধু যেন বলতে লাগল—‘একটু শব্দ দাও, পৃথিবীর এতটুকু শব্দও শোনাও আমায় কেউ৷’
ঠিক এই সময় হঠাৎ একটা শব্দ উঠলও আকাশ-বাতাস চকিত করে৷ শব্দের সেরা শব্দই—রাম-নাম : কিন্তু বুকটা ছাঁৎ করে উঠল৷ পেছন ফিরে দেখি লাইনের পাশ দিয়েই, প্রায় শ’খানেক গজ দূরে কতকগুলো লোকের একটা ছোট দল চালি করে একটা শব নিয়ে আসছে৷ জানো বোধ হয়, এইরকম উপলক্ষ্যে হিন্দুস্থানীরা ‘রাম নাম সত হ্যায়’ বলে পথ চলতে থাকে৷ ওরা ঐখানেই লাইনের বাঁধ থেকে নেমে গেল৷ আমি তা হলে একটা শ্মশানের কাছেই বসে আছি৷
সেই ভয়টা যেমন বেড়ে গেল, তেমনি সঙ্গে সঙ্গে সাহসও খানিকটা এল ফিরে৷ হোক শ্মশান, কিন্তু কাছাকাছি অনেকগুলি লোকের সঙ্গ তো পাওয়া গেল৷ একটুও বসেও রইলাম, তার পর ফিরব, দাঁড়িয়েও উঠেছি, ওদের মধ্যে একটা যেন কি নিয়ে একটু চঞ্চল আলোচনা উঠল৷ শ্মশানটা খানিকটা দূরেই, কিন্তু ঐ রকম ফাঁকা জায়গায় আওয়াজটা স্পষ্ট হয়েই ভেসে আসে৷ একটু কান পেতে থাকতেই বুঝতে পারলাম, শবদেহটা তীরের কোল থেকে খানিকটা সরিয়ে নিয়ে এসে দাহ করবার কথা হচ্ছে, কারণটাও টের পেলাম— নদীতে জল নেমেছে৷
পাহাড়ি নদীতে এই রকম হয়৷ এদিকে কিছুই নেই, দূরে পাহাড়-অঞ্চলে বৃষ্টি নেমে হঠাৎ প্রবল তোড়ে দু কূল চেপে জল নেমে আসে৷ তার সঙ্গে ছোটবড় গাছপালা, জন্তু-জানোয়ার, অসাবধান থাকলে মানুষও৷ কোটালের বানের চেয়েও নাকি ভয়ানক৷ কখনো দেখি নি, ঠিক করলাম দেখে যেতে হবে৷
শোঁ-শোঁ একটা শব্দ উঠেছে দূরে৷
একটু দোমনা হয়ে গেছি, এপারে বসেই দেখে নোব, না, ওপারে গিয়ে নিশ্চিন্দি হয়ে দেখব? ঠিক করলাম, পেরিয়েই যাই, নীচে স্রোত থাকলে একটু নার্ভাস করে দিতে পারে৷ পা বাড়ালাম৷ কিন্তু এই সময় সেই শব্দই হঠাৎ বেড়ে গেল৷ আবার বসে পড়লাম আমি, ভাবলাম, তোড়টা ঠিক এসে পড়ার মুখে পুল পেরুনো আরো খারাপ হবে৷
এইখানে মস্ত বড় একটা ভুল হয়ে গেল৷ ঠিক যে জেনেশুনে ভুল তা নয়, হিসেব বা আন্দাজ করতে ভুল৷ জলের তোড়টা সেই অনেক দূরের বাঁকটা ঘুরতে শব্দটা হঠাৎ বেড়ে উঠেছিল, এসে পৌঁছুতে যে সময়টা নিল, দেখলাম তাতে আমি স্বচ্ছন্দে পুলটা পার হয়ে যেতে পারতাম৷ এ যা প্রলয়কাণ্ড দেখছি—হাজার উঁচুতেই হোক না কেন পুলটা, সম্পূর্ণ নিরাপদ, কিন্তু ঐ দশটা কামানের গর্জন কানে নিয়ে, আর ঐ তোড়ের ওপর দৃষ্টি রেখে—রাখতেই তো হবে—এখন পেরুই কি করে?…অনেক ওপরে আমি, দেখছি এপার-ওপার নিয়ে বোধ হয় পাঁচ-ছ ফুট উঁচু একটা ফণা তুলে নেমে এল স্রোতটা,—কী গর্জন, ছোট বড় গাছপালা বুকে চেপে কি আপসানি! কী সে ওলট-পালট খাওয়া! দেখতে দেখতে পুলের থামগুলোয় ধাক্কা খেয়ে যেন আরো ক্ষেপে উঠে হুঙ্কার দিতে দিতে বেরিয়ে গেল৷ তারপর দেখতে দেখতেই নদীর জল এক ফুট দু ফুট করে বাড়তে বাড়তে তীরের কাছাকাছি পর্যন্ত উঠে এল৷
‘‘দেখা হল একটা জিনিস জীবনে, পঞ্চানন রুদ্রের ভ্রূকুটি-কুটিল আননটা৷ কিছুক্ষণ পর্যন্ত যেন কোনো চিন্তা করবার ক্ষমতাই হারিয়ে চুপ করে বসে থাকতে হল৷ সেই তখনকার মতনই গেছি তলিয়ে—তখন ছিলাম সৌন্দর্যের মধ্যে, এখন যেন প্রলয়ের বিভীষিকায়৷ তখনকার মতোই এক সময় ভেসেও উঠলাম সেই অতল থেকে চিন্তা হল—পেরুই কি করে?
‘‘গোড়াতেই যেমনটা ছিল, শুকনো নদীর ওপর হঠাৎ যেন সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে পড়া, এখন ঠিক ততটা না হলেও খুবই ভীষণ তো৷ নেড়া পুলের এক ফুট অন্তর পাতা কাঠের স্লিপারের ওপর পা দিয়ে দিয়ে পেরুনো, একটু যদি মাথা ঘুরে পা টলে গেল তা হলেই আর দেখতে নয়৷ শুনেছি এসব স্রোত যেমন হঠাৎ আসে তেমনি হঠাৎ চলে যায়, কিন্তু সে-হঠাতের তো কোনো আন্দাজ নেই জলের পরিমাণ যেমন দেখছি, পাহাড়ে বৃষ্টি থেমে গিয়ে থাকলেও এ জল বেরিয়ে যেতে অন্তত সমস্ত রাত কেটে যাবে৷ বৃষ্টি হতে থাকলে তো কথাই নেই৷
‘‘কি করব ভাবতে ভাবতেই রাত অনেকটা এগিয়ে গেল৷ ঘড়িটা নিয়ে যাই নি, কিন্তু আকাশে চাঁদ যেমন ঢলে পড়েছে নীচে, প্রায় বোধ হয় দশটা হয়ে এল৷
‘‘ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ একটা কথা মনে হল একজন সঙ্গী পাওয়া গেলে বোধ হয় সুবিধে হত, যদি নেমে গিয়ে ওদের বলি, এক জন কাউকে দেয়—শুধু পুলটা পেরিয়ে দিয়ে আসতে…
‘‘আমার চিন্তাটাই যেন রূপ নিয়ে আমার পাশে এসে পৌঁছাল দেখি আমার পেছন দিয়ে কখন একটি লোক এসে রেলের বাঁধের ওপর উঠতে যাচ্ছে৷ বলতে ভুলে গেছি, আমি গিয়েছিলাম পুজোর ছুটিতে, পুজো শেষ করে, বেশ একটু ঠাণ্ডার ভাব এসে গেছে তখন৷ লোকটার গায়ে আগাগোড়া একটা সাদা চাদর জড়ানো, মাথার ওপর দিয়েও ঘুরিয়ে আনা, এদিকে বেশ সরল বলে মনে হল৷ একেবারে তালের মাথায় পেয়ে কথাটা বলতে যাচ্ছিলাম, ওই, যেন এতক্ষণ লক্ষ্য করে নি, হঠাৎই দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে আমায় জিজ্ঞেস করল, ‘বাবু, আপনি অসময়ে এখানে বসে যে!’
‘‘হিন্দিতেই করল জিজ্ঞেস৷ বললাম, ‘‘দেখো না, বেড়াতে এসেছিলাম, আচমকা নদীতে ওই বান ডেকে এসে…’’
‘‘পেরুতে ভয় হচ্ছে?’—একটু অদ্ভুতভাবে হাসল লোকটা, মনে হল তাতে যেমন ভরসা দেওয়ার চেষ্টা আছে, তেমনি একটু যেন ব্যঙ্গও রয়েছে মেশানো, বলল—‘অমন হয় পেরুতে ভয়, ভয়ঙ্কর নদীই তো৷ কিন্তু আসলে ভয়ের কিছুই নেই৷ এই তো আমিই যাচ্ছি, আসুন না, আসবেন?…আসুন তা হলে, আমার আবার সময় নেই৷’
‘‘বলতে বলতেই পা বাড়িয়েছে, আমি তাড়াতাড়ি নেমে এসে সঙ্গ নিলাম ও আগে আগে, আমি ঠিক পেছনে৷ পুলের ওপর উঠে যেতে যেতে একটু কথাও হল৷ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি ঐ ওদের দলের লোক?…যেন ওদিক থেকেই উঠে এলে মনে হল৷’
‘‘বললে, ‘হ্যাঁ৷’
‘‘ ‘কোথা থেকে আসছ তোমরা?’
‘‘কি একটা নাম বললে মনে নেই৷ একটা জিনিস লক্ষ্য করছি, লোকটার বেশ সহজ সিধা চাল দেখেই হোক, বা যেজন্যেই হোক, আমিও বেশ স্বচ্ছন্দেই স্লিপারের ওপর পা ফেলে ফেলে এগিয়ে চলেছি, ভয়ের ভাবটা একেবারেই নেই৷ সেই কথাই বললাম ওকে৷ বললাম, ‘একজন সঙ্গী পেলে সত্যিই বড় সুবিধে হয়৷ তোমার আবার দেখছি পা খুব শক্ত, একটুও ওদিক-ওদিক হচ্ছে না৷’
‘‘আমার যে অব্যেস হয়ে গেছে৷ তবে হ্যাঁ, একথা ঠিক বলেছেন যে একজন সঙ্গী পেলে ভালোই হয়৷ নৈলে এ অবস্থায় বড্ড যেন একলা আর অসহায় বোধ হয়, না?’
‘‘বললাম, ‘সত্যি তাই, খুব পেয়ে গেলাম তোমায়, কপালের জোর বলতে হবে আমার৷’
‘‘আবার ঘুরে চেয়ে সেই রকম হেসে বলল—‘কপালের জোর কি আমারই নয়? কেমন পথের মাঝেই পেয়ে গেলাম আপনাকে!…যেন আমার জন্যে বসেছিলেন নয় কি?’
‘‘আমিও হেসেই বললাম, ‘তা ভিন্ন আর কি? কিন্তু, হ্যাঁ, ঠিক কথা, ভুলেই যাচ্ছিলাম, তা তুমি সবাইকে ছেড়ে হঠাৎ এমন করে একলা যে নদী পেরুতে যাচ্ছ? যাচ্ছই বা কোথায়?
‘‘এবার আর কথায় নয়৷ এ প্রশ্নের উত্তরটা একেবারে অন্যভাবে পাওয়া গেল দেখি কেউ নেই আর আমার সামনে!’’
‘‘ঠিক পরের মুহূর্তটা আমার কি হয়েছিল মনে নেই৷ খোলা ঠাণ্ডা হাওয়া থাকার জন্যে বা যে কারণেই হোক, সম্বিৎটা ফিরে আসতে নিশ্চয় দেরি হয় নি৷ দেখি পুলের মাঝখানে একটি কাঠের স্লিপার প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে পড়ে আছি৷ বিপদা খুব উগ্র গোছের হওয়ার জন্যেই বোধ হয় জ্ঞানটা বেশ তাড়াতাড়ি আর স্পষ্ট হয়েই ফিরে এল, লোকটার… আর লোক বলিই বা কি করে—প্রত্যেকটি কথা তার আসল অর্থে ফুটে ফুটে উঠল আমার কাছে—বুঝতে বাকি রইল না কী দুকূল হারা নদী পার হয়ে ওর কাছে এ নদী যে গোষ্পদমাত্র এখন! সত্যিই কত যে অসহায় ও, কী যে একা!
‘‘এই ‘একা’ কথাটা হঠাৎ আমার কাছে যেন অতিরিক্ত বিভীষিকাময় হয়ে উঠে ভয়ের তোড়ের ওপর আর একটা তোড় এনে ফেললে—একা, তাই কি অনন্তপথের যাত্রী এই বিদেহী আত্মা আমায় তার সঙ্গী করে নিতে এসেছিল? নিজের প্রশ্নটাতেই ভয়ে মাথার চুল পর্যন্ত খাড়া হয়ে উঠেছে, সঙ্গে সঙ্গেই একটা উৎকট হুঙ্কার শুনে সামনে চাইতেই দেখি জ্বলন্ত দৃষ্টি নিয়ে সাক্ষাৎ মৃত্যু ছুটে আসছে সামনে৷ এক মুহূর্তের বিভ্রম, তার পরেই ব্যাপারটা বুঝলাম, সামনের উঁচু টিলাটা ঘুরে একটা ট্রেন মত্ত গতিতে আসছে ছুটে, তার ইঞ্জিনের সার্চলাইট এসে পড়েছে আমার ওপর, দেখেছে ড্রাইভার, প্রাণপণে হুইসিল দিতে দিতে সতর্ক করতে করতে ছুটে আসছে—কিন্তু ফল কি আর সতর্কতার? মৃত্যু আমার দু দিকেই—সামনে ঐ, নীচে এই বিক্ষুব্ধ প্রলয়-পয়োধি৷
‘‘তবু ঝাঁপিয়েই পড়ে লোকে এ-অবস্থায়, কিন্তু শরীরের সমস্ত স্নায়ু আমার তখন একেবারে শিথিল হয়ে গেছে৷ ওদিকে আর এইটুকু মনে আছে যে দুটো হাতে চোখ দুটো চেপে ধরে মাথাটা দিয়েছি নুয়ে৷
‘‘তার পরেই মনে পড়ছে একটা যেন বিকট অন্ধকার মূর্তি, ঠিক হাত দুয়েক তফাতে দাঁড়িয়ে বজ্র-কঠোর স্বরে হুঙ্কার ছাড়ছে…
‘‘ইঞ্জিনটা আর কি৷ ড্রাইভার ব্রেক…’’
‘‘যাঃ! বেঁচে গেলেন!’’
মুখ থেকে কথাটা যেন হঠাৎ ঠিকরে বেরিয়ে পড়ল মীরার, তীব্র উৎকণ্ঠায় হাত দুটো মুঠো করে বুকের ওপর চেপে ধরেছিল, আলগা হয়ে গেল৷
স্ত্রীও ঠিক ঐ ধরনেরই কিছু বলে ফেলতে যাচ্ছিলেন, সামলে নিয়ে ওর পিঠে একটা মৃদু চড় বসিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘দ্যুৎ অমন করে বলে! হুঁশ হারাস যে গল্প শুনে!…’’
‘‘উঃ ভাগ্যিস!’’ বলে আরো খানিকটা সামলে নিলেন৷