ক্রোড়পত্র-খ

ক্রোড়পত্র-খ

(“ধর্ম্মজিজ্ঞাসা” নামক প্রবন্ধ হইতে উদ্ধৃত)
গুরু। রিলিজন কি?
শিষ্য। সেটা জানা কথা।
গুরু। বড় নয়-বল দেখি কি জানা আছে?
শিষ্য। যদি বলি পারলৌকিক ব্যাপারে বিশ্বাস।
গুরু। প্রাচীন য়ীহুদীরা পরলোকে মানিত না। য়ীহুদীদের প্রাচীন ধর্ম্ম কি ধর্ম্ম নয়?
শিষ্য। যদি বলি দেবদেবীতে বিশ্বাস।
গুরু। ইস্‌লাম, খ্রীষ্টীয়, য়ীহুদ, প্রভৃতি ধর্ম্মে দেবী নাই। সে সকল ধর্ম্মেে দেবও এক-ঈশ্বর। এগুলি কি ধর্ম্ম নয়?
শিষ্য। ঈশ্বরে বিশ্বাসই ধর্ম্ম?
গুরু। এমন অনেক পরম রমণীয় ধর্ম্ম আছে, তাহাতে ঈশ্বর নাই। ঋগ্বেদসংহিতার প্রাচীনতম মন্ত্রগুলি সমালোচনা করিলে বুঝা যায় যে, তৎপ্রণয়নের সমকালিক আর্য্যদিগের ধর্ম্মে অনেক দেবদেবী ছিল বটে; কিন্তু ঈশ্বর নাই। বিশ্বকর্ম্মা, প্রজাপতি, ব্রহ্ম ইত্যাদি ঈশ্বরবাচক শব্দ, ঋগ্বেদের প্রাচীনতম মন্ত্রগুলিতে নাই-যেগুলি অপেক্ষাকৃত আধুনিক, সেইগুলিতে আছে। প্রাচীন সাংখ্যেরাও অনীশ্বরবাদী ছিলেন। অথচ তাঁহারা ধর্ম্মহীন নহেন; কেন না, তাঁহারা কর্ম্মফল মানিতেন, এবং মুক্তি বা নিঃশ্রেয়স্ কামনা করিতেন। বৌদ্ধধর্ম্মও নিরীশ্বর। অতএব ঈশ্বরবাদ ধর্ম্মের লক্ষণ কি প্রকারে বলি? দেখ, কিছুই পরিষ্কার হয় নাই।
শিষ্য। তবে বিদেশী তার্কিকদিগের ভাষা অবলম্বন করিতে হইল-লোকাতীত চৈতন্যে বিশ্বাসই ধর্ম্ম।
গুরু। অর্থাৎ Supernaturalism, কিন্তু ইহাতে তুমি কোথায় আসিয়া পড়িলে দেখ। প্রেততত্ত্ববিদ্ সম্প্রদায় ছাড়া, আধুনিক বৈজ্ঞানিকদিগের মতে লোকাতীত চৈতন্যের কোন প্রমাণ নাই। সুতরাং ধর্ম্মও নাই-ধর্ম্মের প্রয়োজনও নাই। রিলিজনকে ধর্ম্ম বলিতেছি মনে থাকে যেন।
শিষ্য। অথচ সে অর্থে ঘোর বৈজ্ঞানিকদিগের মধ্যেও ধর্ম্ম আছে। যথা Religion of Humanity.
গুরু। সুতরাং লোকাতীত চৈতন্যে বিশ্বাস ধর্ম্ম নয়।
শিষ্য। তবে আপনিই বলুন, ধর্ম্ম কাহাকে বলিব।
গুরু। প্রশ্নটা অতি প্রাচীন। “অথাতো ধর্ম্ম-জিজ্ঞাসা” মীমাংসা দর্শনের প্রথম সূত্র। এই প্রশ্নের উত্তর দানই মীমাংসা দর্শনের উদ্দেশ্য। সর্ব্বত্র গ্রাহ্য উত্তর আজ পর্য্যন্ত পাওয়া যায় না। আমি যে ইহার সদুত্তর দিতে সক্ষম হইব, এমন সম্ভাবনা নাই। তবে পূর্ব্বপণ্ডিতদিগের মত তোমাকে শুনাইতে পারি। প্রথম মীমাংসাকারের উত্তর শুন। তিনি বলেন, “নোদনালক্ষণো ধর্ম্মঃ।” নোদনা, ক্রিয়ার প্রবর্ত্তক বাক্য। শুধু এইটুকু থাকিলে বলা যাইত, কথাটা বুঝি নিতান্ত মন্দ নয়; কিন্তু উহার কথা উঠিল, “নোদনা প্রবর্ত্তকো বেদবিধিরূপঃ,” তখন আমার বড় সন্দেহ হইতেছে, তুমি উহাকে ধর্ম্ম বলিয়া স্বীকার করিবে কি না।
শিষ্য। কখনই না। তাহা হইলে যতগুলি পৃথক্ ধর্ম্মগ্রন্থ, ততগুলি পৃথক্-প্রকৃতিসম্পন্ন ধর্ম্ম মানিতে হয়। খ্রীষ্টানে বলিতে পারে, বাইবেল-বিধিই ধর্ম্ম; মুসলমানও কোরাণ সম্বন্ধে ঐরূপ বলিবে। ধর্ম্মপদ্ধতি ভিন্ন হউক, ধর্ম্ম বলিয়া একটা সাধারণ সামগ্রী নাই কি? Religions আছে বলিয়া Religion বলিয়া একটা সাধারণ সামগ্রী নাই কি?
গুরু। এই এক সম্প্রদায়ের মত। লৌগাক্ষি ভাস্কর প্রভৃতি এইরূপ কহিয়াছেন যে, “বেদপ্রতিপাদ্যপ্রয়োজনবদর্থো ধর্ম্ম।” এই সকল কথার পরিমাণফল এই দাঁড়াইয়াছে যে, যাগাদিই ধর্ম্ম এবং সদাচারই ধর্ম্ম শব্দে বাচ্য হইয়া গিয়াছে-যথা মহাভারতে,
শ্রদ্ধা কর্ম্ম তপশ্চৈব সত্যমক্রোধ এবচ।
স্বেষু দারেষু সন্তোষঃ শৌচং বিদ্যানসূয়িতা ||
আত্মজ্ঞানং তিতিক্ষা চ ধর্ম্মঃ সাধারণো নৃপ ||
কেহ বলেন, “দ্রব্যক্রিয়াগুণাদীনাং ধর্ম্মত্বং” এবং কেহ বলেন, ধর্ম্ম অদৃষ্টবিশেষ। ফলতঃ আর্য্যদিগের সাধারণ অভিপ্রায় এই যে, বেদ বা লোকাচারসম্মত কার্য্যই ধর্ম্ম, যথা বিশ্বামিত্র-
যমার্য্যাঃ ক্রিয়মাণং হি শংসন্ত্যাগমবেদিনঃ
স ধর্ম্মো যং বিগর্হন্তি তমধর্ম্মং প্রচক্ষতে ||
কিন্তু হিন্দুশাস্ত্রে যে ভিন্ন মত নাই, এমত নহে। “দ্বে বিদ্যে বেদিতব্যে ইতি হ স্ম যদ্ ব্রহ্মবিদো বদন্তি পরা চৈবাপরা চ,” ইত্যাদি শ্রুতিতে সূচিত হইয়াছে যে, বৈদিক জ্ঞান ও তদনুবর্ত্তী যাগাদি নিকৃষ্ট ধর্ম্ম, ব্রহ্মজ্ঞানই পরম ধর্ম্ম। ভগবদ্গীতার স্থূল তাৎপর্য্যই কর্ম্মাত্মক বৈদিকাদি অনুষ্ঠানের নিকৃষ্টতা এবং গীতোক্ত ধর্ম্মের উৎকর্ষ প্রতিপাদন। বিশেষতঃ হিন্দুধর্ম্মের ভিতর একটি পরম রমণীয় ধর্ম্ম পাওয়া যায়, যাহা এই মীমাংসা এবং তন্নীত হিন্দুধর্ম্মবাদের সাধারণতঃ বিরোধী। যেখানে এই ধর্ম্ম দেখি-অর্থাৎ গীতায়, কি মহাভারতের অন্যত্র, কি ভাগবতে-সর্ব্বত্রই দেখি, শ্রীকৃষ্ণই ইহার বক্তা। এই জন্য আমি হিন্দুশাস্ত্রে নিহিত এই উৎকৃষ্টতর ধর্ম্মকে শ্রীকৃষ্ণ-প্রচারিত মনে করি, এবং কৃষ্ণোক্ত ধর্ম্ম বলিতে ইচ্ছা করি। মহাভারতের কর্ণপর্ব্ব হইতে একটি বাক্য উদ্ধৃত করিয়া উহার উদাহরণ দিতেছি।
“অনেকে শ্রুতিরে ধর্ম্মের প্রমাণ বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। আমি তাহাতে দোষারোপ করি না। কিন্তু শ্রুতিতে সমুদয় ধর্ম্মতত্ত্ব নির্দ্দিষ্ট নাই। এই নিমিত্ত অনুমান দ্বারা অনেক স্থলে ধর্ম্ম নির্দ্দিষ্ট করিতে হয়। প্রাণিগণের উৎপত্তির নিমিত্তই ধর্ম্ম নির্দ্দেশ করা হইয়াছে। অহিংসাযুক্ত কার্য্য করিলেই ধর্ম্মানুষ্ঠান করা হয়। হিংস্রকদিগের হিংসা নিবারণার্থেই ধর্ম্মের সৃষ্টি হইয়াছে। উহা প্রাণিগণকে ধারণ করে বলিয়াই ধর্ম্ম নাম নির্দ্দিষ্ট হইতেছে। অতএব যদ্দ্বারা প্রাণিগণের রক্ষা হয়, তাহাই ধর্ম্ম”-ইহা কৃষ্ণোক্তি। ইহার পরে বনপর্ব্ব হইতে ধর্ম্মব্যোধোক্ত ধর্ম্মব্যাখ্যা উদ্ধৃত করিতেছি। “যাহা সাধারণের একান্ত হিতজনক, তাহাই সত্য। সত্যই শ্রেয় লাভের অদ্বিতীয় উপায়। সত্যপ্রভাবেই যথার্থ জ্ঞান ও হিতসাধন হয়।” এ স্থলে ধর্ম্ম অর্থেই সত্য শব্দ ব্যবহৃত হইতেছে।
শিষ্য। এ দেশীয়েরা ধর্ম্মের যে ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহা নীতির ব্যাখ্যা বা পুণ্যের ব্যাখ্যা। রিলিজনের ব্যাখ্যা কই?
গুরু। রিলিজন শব্দে যে বিষয় বুঝায়, সে বিষয়ের স্বাতন্ত্র্য আমাদের দেশের লোক কখন উপলব্ধি করেন নাই। এ বিষয়ের প্রজ্ঞা আমার মনে নাই, আমার পরিচিত কোন শব্দে কি প্রকারে তাহার নামকরণ হইতে পারে?
শিষ্য। কথাটা ভাল বুঝিতে পারিলাম না।
গুরু। তবে আমার কাছে একটি ইংরেজি প্রবন্ধ আছে, তাহা হইতে একটু পড়িয়া শুনাই।
ধর্ম্মতত্ত্ব
“For religion, the ancient Hindu had no name, because his conception of it was so broad as to dispense with the necessity of a name. With other peoples, religion is only a part of life; there are things religious, and there are things lay and secular. To the Hindu, his whole life was religion. To other peoples, their relations to God and to the spiritual world are things sharply distinguished from their relations to man and to the temporal world. To the Hindu, his relations to God and his relations to man, his spiritual life and his temporal life are incapable of being so distinguished. They form one compact and harmonious whole, to separate which into its component parts is to break the entire fabric. All life to him was religion, and religion never received a name from him, because it never had for him and existence apart from all that had received a name. A department of thought which the people in whom it had its existence and thus failed to differentiate, has necessarily mixed itself inextricably with every other department of thought, and this is what makes it so difficult at the present day, to erect it into a separate entity.”*
শিষ্য। তবে রিলিজন কি, তদ্বিষয়ে পাশ্চাত্ত্য আচার্য্যদিগের মতই শুনা যাউক।
গুরু। তাহাতেও বড় গোলযোগ। প্রথমতঃ রিলিজন শব্দের যৌগিক অর্থ দেওয়া যাউক। প্রচলিত মত এই যে, re-ligare হইতে শব্দ নিষ্পন্ন হইয়াছে, অতএব ইহার প্রকৃত অর্থ বন্ধন,-ইহা সমাজের বন্ধনী। কিন্তু বড় বড় পণ্ডিতগণের এ মত নহে। রোমক পণ্ডিত কিকিরো (বা সিসিরো) বলেন যে, ইহা re-ligere হইতে নিষ্পন্ন হইয়াছে। তাহার অর্থ পুনরাহরণ সংগ্রহ, চিন্তা, এইরূপ। মক্ষমূলর প্রভৃতি এই মতানুযায়ী। যেটাই প্রকৃত হউক, দেখা যাইতেছে যে, এ শব্দের আদি অর্থৃ এক্ষণে আর ব্যবহৃত নহে। যেমন লোকের ধর্ম্মবুদ্ধি স্ফূর্ত্তি প্রাপ্ত হইয়াছে, এ শব্দের অর্থও তেমনি স্ফুরিত ও পরিবর্ত্তিত হইয়াছে।
শিষ্য। প্রাচীন অর্থে আমাদিগের প্রয়োজন নাই, এক্ষণে ধর্ম্ম অর্থাৎ রিলিজন কাহাকে বলিব, তাই বলুন।
গুরু। কেবল একটি কথা বলিয়া রাখি। ধর্ম্ম শব্দের যৌগিক অর্থ অনেকটা religio শব্দের অনুরূপ। ধর্ম্ম = ধৃ+মন্ (ধ্রিয়তে লোকো অনেন, ধরতি লোকং বা) এই জন্য আমি ধর্ম্মকে religioশব্দের প্রকৃত প্রতিশব্দ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছি।
শিষ্য। তা হৌক-এক্ষণে রিলিজনের আধুনিক ব্যাখ্যা বলুন।
গুরু। আধুনিক পণ্ডিতগণের মধ্যে জার্ম্মানেরাই সর্ব্বাগ্রগণ্য। দুর্ভাগ্যবশতঃ আমি নিজে জর্ম্মান জানি না। অতএব প্রথমতঃ মক্ষমূলরের পুস্তক হইতেই জর্ম্মানদিগের মত পড়িয়া শুনাইব। আদৌ কাণ্টের মত পর্য্যালোচনা কর।

——————–
লেখক-প্রণীত কোন ইংরেজি প্রবন্ধ হইতে এইটুকু উদ্ধৃত হইল, উহা এ পর্য্য ন্ত প্রকাশিত হয় নাই। ইহার মর্ম্মার্থ বাঙ্গালায় এখানে সন্নিবেশিত করিলে করা যাইতে পারিত, কিন্তু বাঙ্গালায় এ রকমের কথা আমার অনেক পাঠকে বুঝিবেন না। যাঁহাদের জন্য লিখিতেছি, তাঁহারা না বুঝিলে, লেখা বৃথা। অতএব এই রুচিবিরুদ্ধ কার্য্যটুকু পাঠক মার্জ্জনা করিবেন। যাঁহারা ইংরেজী জানেন না, তাঁহারা এটুকু ছাড়িয়া গেলে ক্ষতি হইবে না।
——————-

“According to Kant, religion is morality. When we look upon all our moral duties as divine commands, that, he thinks, constitutes religion. And we must not forget that Kant does not consider that duties are moral duties because they rest on a divine command (that would be according to Kant merely revealed Religion); on the contrary, he tells us that because we are directly conscious of them as duties, therefore we look upon them as divine commands.”
তার পরে ফিক্তে। ফিক্তের মতে “Religion is knowledge. It gives to a man a clear insight into himself, answers the highest questions, and thus imparts to us a complete harmony with ourselves, and a thorough sanctification to our mind.” সাংখ্যাদিরও প্রায় এই মত। কেবল শব্দপ্রয়োগ ভিন্ন প্রকার। তার পর স্লিয়ের মেকর। তাঁহার মতে,-Religion consists in our consciousness of absolute dependence on something, which though it determines us, we cannot determine in our turn.” তাঁহাকে উপহাস করিয়া হীগেল বলেন,-“Religion is or ought to be perfect freedom; for it is neither more or less than the divine spirit becoming conscious of himself through the finite spirit___” এ মত কতকটা বেদান্তের অনুগামী।
শিষ্য। যাহারই অনুগামী হউক, এই চারিটির একটি ব্যাখ্যাও ত শ্রদ্ধেয় বলিয়া বোধ হইল না। আচার্য্য মক্ষমূলরের নিজের মত কি?
গুরু। বলেন, “Religion is a subjective faculty for the apprehension of the Infinite.”
শিষ্য। Faculty সর্ব্বনাশ! বরং রিলিজন বুঝিলে বুঝা যাইবে,-Faculty বুঝিব কি প্রকারে? তাহার অস্তিত্বের প্রমাণ কি?
গুরু। এখন জর্ম্মানদের ছাড়িয়া দিয়া দুই এক জন ইংরেজের ব্যাখ্যা আমি নিজে সংগ্রহ করিয়া শুনাইতেছি। টইলর সাহেব বলেন যে, যেখানে “Spiritual Beings” সম্বন্ধে বিশ্বাস আছে, সেইখানেই রিলিজন। এখানে “Spritual Beings” অর্থে কেবল ভূত প্রেত নহে-লোকাতীত চৈতন্যই অভিপ্রেত; দেবদেবী ও ঈশ্বরও তদন্তর্গত। অতএব তোমার বাক্যের সহিত ইঁহার বাক্যের ঐক্য হইল।
শিষ্য। সে জ্ঞান ত প্রমাণাধীন।
গুরু। সকল প্রমাজ্ঞানই প্রমাণাধীন, ভ্রমজ্ঞান প্রমাণাধীন নহে। সাহেব মৌসুকের বিবেচনায় রিলিজনটা ভ্রমজ্ঞান মাত্র। এক্ষণে জন্ ষ্টুয়ার্ট মিলের ব্যাখ্যা শোন।
শিষ্য। তিনি ত নীতিমাত্রবাদী, ধর্ম্মবিরোধী।
গুরু। তাঁহার শেষাবস্থার রচনা পাঠে সেরূপ বোধ হয় না। অনেক স্থানে দ্বিধাযুক্ত বটে। যাই হৌক, তাঁহার ব্যাখ্যা উচ্চশ্রেণীর ধর্ম্মসকল সম্বন্ধে বেশ খাটে।
তিনি বলেন, “The essence of Religion is the strong and earnest direction of the emotions and desires towards an ideal object recognised as of the highest excellence, and is rightfully paramount over all selfish objects of desire.”
শিষ্য। কথাটা বেশ।
গুরু। মন্দ নহে বটে। সম্প্রতি আচার্য্য সীলীর কথা শোন। আধুনিক ধর্ম্মতত্ত্বব্যাখ্যাকারদিগের মধ্যে তিনি এক জন শ্রেষ্ঠ। তাঁহার প্রণীত “Ecce Homo” এবং “Natural Relegion” অনেককেই মোহিত করিয়াছে। এ বিষয়ে তাঁহার একটি উক্তি বাঙ্গালি পাঠকদিগের নিকট সম্প্রতি পরিচিত হইয়াছে।* বাক্যটি এই-“The substance of Religion is Culture.” কিন্তু তিনি এক দল লোকের মতের সমালোচনকালে এই উক্তির দ্বারা তাঁহাদিগের মত পরিস্ফুট করিয়াছেন-এটি ঠিক তাঁহার নিজের মত নহে। তাঁহার নিজের মত বড় সর্ব্বব্যাপী। সে মতানুসারে রিলিজন “habitual and permanent admiration.” ব্যাখ্যাটি সবিস্তারে শুনাইতে হইল।
“The words Religion and Worship are commonly and conveniently appropriated to the feelings with which we regard God. But those feelings-love, awe, admiration, which together make up worship-are felt in various combinations for human beings, and even for inanimate objects. It is not exclusively but only par excellence that religion is directed towards God. When feelings of admiration are very strong and at the same time serious and permanent, they express themselves in recurring acts, and hence arises ritual, liturgy and whatever the multitude indentifies with religion. But without ritual, religion may exist in its elementary state and its elementary state of Religion is what may be described as habitual and permanent admiration.”
শিষ্য। এ ব্যাখ্যাটি অতি সুন্দর। আর আমি দেখিতেছি, মিল যে কথা বলিয়াছেন, তাহার সঙ্গে ইহার ঐক্য হইতেছে। এই “habitual and permanent admiration” যে মানসিক ভাব, তাহারই ফল, “strong and earnest direction of the emotions and desires towards and ideal object recognized as of the highest excellence.”
গুরু। এ ভাব, ধর্ম্মের একটি অঙ্গমাত্র।
যাহা হউক, তোমাকে আর পণ্ডিতের পাণ্ডিত্যে বিরক্ত না করিয়া অগুস্ত কোম্‌তের ধর্ম্মব্যাখ্যা শুনাইয়া, নিরস্ত হইব। এটিতে বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন; কেন না, কোম্‌ৎ নিজে একটি অভিনব ধর্ম্মের সৃষ্টিকর্ত্তা, এবং তাঁহার এই ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি স্থাপন করিয়াই তিনি সেই ধর্ম্ম সৃষ্টি করিয়াছেন। তিনি বলেন, “Religion, in itself expresses the state, of perfect unity which is the distinctive mark of man’s existence both as an individual and in society, when all the constituent parts of his nature, moral and physical, are made habitually to converge towards one common purpose. অর্থাৎ “Religion consists in regulating one’s individual nature, and forms the rallying-point for all the separate individuals.”
যতগুলি ব্যাখ্যা তোমাকে শুনাইলাম, সকলের মধ্যে এইটি উৎকৃষ্ট বলিয়া বোধ হয়। আর যদি এই ব্যাখ্যা প্রকৃত হয়, তবে হিন্দুধর্ম্ম সকল ধর্ম্মের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ধর্ম্ম।
শিষ্য। আগে ধর্ম্ম কি বুঝি, তার পর পারি যদি, তবে না হয় হিন্দুধর্ম্ম বুঝিব। এই সকল পণ্ডিতগণকৃত ধর্ম্মব্যাখ্যা শুনিয়া আমার সাত কাণার হাতী দেখা মনে পড়িল।
গুরু। কথা সত্য। এমন মনুষ্য কে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, যে ধর্ম্মের পূর্ণ প্রকৃতি ধ্যানে পাইয়াছে? যেমন সমগ্র বিশ্বসংসার কোন মনুষ্য চক্ষে দেখিতে পায় না, তেমনই সমগ্র ধর্ম্ম কোন মনুষ্য ধ্যানে পায় না। অন্যের কথা দূরে থাক, শাক্যসিংহ, যীশুখ্রীষ্ট, মহম্মদ, কি চৈতন্য,-তাঁহারাও ধর্ম্মের সমগ্র প্রকৃতি অবগত হইতে পারিয়াছিলেন, এমন স্বীকার করিতে পারি না। অন্যের অপেক্ষা বেশি দেখুন, তথাপি সবটা দেখিতে পান নাই। যদি কেহ মনুষ্যদেহ ধারণ করিয়া ধর্ম্মের সম্পূর্ণ অবয়ব হৃদয়ে ধ্যান, এবং মনুষ্যলোকে প্রচারিত করিতে পারিয়া থাকেন, তবে সে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাকার। ভগবদ্গীতার উক্তি, ঈশ্বরাবতার শ্রীকৃষ্ণের উক্তি কি কোন মনুষ্যপ্রণীত, তাহা জানি না। কিন্তু যদি কোথাও ধর্ম্মের সম্পূর্ণ প্রকৃতি ব্যক্ত ও পরিস্ফুট হইয়া থাকে, তবে সে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়।

————
* দেবী চৌধুরাণীতে।
————

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *