1 of 2

ক্রীড়াভূমি

ক্রীড়াভূমি

নিজের ভিতরই আছে এক অলৌকিক। কখনও-কখনও তাকে টের পাওয়া যায়। স্পষ্ট নয়–কেন না একমাত্র ধর্মের পথেই সেই অলৌকিক স্পষ্ট ও ঈশ্বরের সমতুল হয়। তুমি স্বধর্মে কখনও স্থির থাকো নাসুতরাং তুমি কখনও-কখনও একপলকের জন্য মাত্র সেই অলৌকিককে প্রত্যক্ষ করে বিপদগ্রস্ত হও।

তাই তুমি একবার স্বপ্নে এক জনহীন প্রান্তরে দাঁড়িয়ে এক নীল অতি সুন্দর বর্ণের উড়ন্ত সিংহকে তোমার নিকটবর্তীহতে দেখে ভয় পেয়েছিলে। অথচ ভয়ের কারণ ছিল না, কেন না সেই সিংহের নীল কেশর, নীল চোখ ও নীল নখ সবকিছুই হিংস্রতাশূন্য ছিল; এবং সেই নীলবর্ণ সিংহের বাসস্থান ছিল না বলে সে অতি নম্রভাবে তোমার সম্মুখের ভূমি স্পর্শ করে তোমার কাছে। একটি বাসস্থানের সন্ধান জানতে চায়, কেন না তুমি এই পৃথিবীর আইনসম্মত বসবাসকারী। তুমি নিজেও জানো না কেন তুমি তাকে উপর্যুপরি গুলি করেছিলে; কেন? সেই গুলির শব্দ শুনে এবং আহত ও ক্রুদ্ধ সেই সিংহ তার ক্ষতস্থান কামড়ে ধরে তোমার দিকেই ফিরে তাকালে তোমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু ঘুম থেকে জাগরণের ভিতরে চলে আসবার সময় যখন তুমি এক অতি সূক্ষ্ম বাধাকে অতিক্রম করছিলে তখন তোমার এক অংশ জাগ্রত ছিল, অন্য অংশকে ভয়ে আর্তনাদ করতে শুনেছিল। স্বকণ্ঠের সেই অলৌকিক স্বপ্নবিষ্ট আর্তনাদ এখনও তোমার পাপবোধকে তাড়িত করে–তুমি গুলি করেছিলে কেন? যদি স্বপ্নে আবার দেখা হয়, যদি কয়েকটি চিহ্নের দ্বারা সেই সিংহ তোমাকে আবার শনাক্ত করে? কিংবা যেন আর একবারও ভিন্ন এক স্বপ্নে তুমি তোমার বন্ধু অতীশকে খুন করেছিলে বলে জাগ্রতবস্থায়ও বহুদিন তুমি বিমর্ষ ছিলে কেন? তোমার প্রশ্ন এই যে, স্বপ্নেও কেন তুমি হত্যাকারী?

কিংবা কয়েক বছর আগে এই শীতকালে টেরিটিবাজারের কাছে তুমি যে মোটর দুর্ঘটনায় পড়েছিলে তার কথা ধরা যাক। সেদিন বিকেলের পার্টিতে তুমি সামান্য হুইস্কি খেয়েছিলে, কিন্তু মাতাল হওনি; সেদিনকার পার্টিতে তুমি অনেকক্ষণ বিদেশি নাচ নেচেছিলে, কিন্তু তুমি ক্লান্ত ছিলে না। এমনকী নাচের সময় যে মহিলা সারাক্ষণ তোমার বক্ষলগ্ন ছিল তার মুখও তোমার ঠিক মনে। পড়েনি। ঠিক কী হয়েছিল তা আজও তোমার জানা নেই। শুধু এইটুকু মনে আছে যে, তখন অনেক রাত, ফেরার পথে টেরিটিবাজারের কাছে রাস্তা ফাঁকা ছিল, গাড়িতেও তুমি ছিলে একা। তুমি জোরে চালিয়ে দিলে তোমার গাড়ি। তোমার পুরোনো আমলের পৈতৃক মোটরগাড়িতে ভয়ঙ্কর ঝঝড় শব্দ হচ্ছিল বলে তুমি মাঝে-মাঝে গালাগাল দিচ্ছিলে, মাঝে-মাঝে তুমি তোমার প্রিয় ফরাসি গান ‘ও-লা–লা ও-লা–লা’ গাইছিলে, অথচ গিয়ার স্টিয়ারিং ক্লাচ ও অ্যাক্সিলেটারের ওপর তোমার হাত পাগুলি নির্ভুল কাজ করে যাচ্ছিল। বিপদের কোনও সম্ভাবনা ছিল না-কেন। না তোমার গাড়িটির গান নেই, অন্যমনস্কতা নেই। তার ধর্ম এই যে, সে শুধু তোমার সঙ্গে যুক্ত হয়, তোমার ইন্দ্রিয়গুলির মধ্যে প্রবেশ করে এবং তার স্বধর্মে তোমাকে টেনে নিয়ে যায়। তোমার গাড়িটির আত্মা নেই, পাপ–পুণ্য নেই, তবু তুমি এই মোটরগাড়িটিকে ভালোবাসো, যেমন, মানুষ তার গৃহপালিতগুলিকে ভালোবাসে, অথচ তোমার গাড়িটি কি প্রতিদানশীল? কী হয়, যদি তুমি। গাড়ির যন্ত্র–সংলগ্ন তোমার হাত-পা তুলে নাও, চোখ বন্ধ করো? এই অলৌকিক চিন্তা হঠাৎ মনে এলে তুমি আপন মনে তোমার হাত-পা কিছুক্ষণের জন্যে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করে দেখলে ধর্মান্ধ এই মোটরগাড়ি তোমার ইন্দ্রিয়গুলিকে অধিকার করে আছে, তার কাছে তুমি তুচ্ছ ও অন্তঃসারশূন্য। কিংবা হয়তো তুমি স্বভাবত আত্মরক্ষাকারী, সেইজন্য মোটরগাড়ির সঙ্গে তোমার সম্পর্ক অমোঘ। হতাশ হয়ে তুমি আবার কিছুক্ষণ ফরাসি গান গেয়েছিলেন এবং পরমুহূর্তেই এক অন্যমনস্কতা তোমাকে পেয়ে বসেছিল। অকারণে তোমার মনোরম, ছেলেবেলায় দেখা তোমার। প্রিয় কিশোরীদের মুখগুলি তোমার মনে পড়েছিল। সেই মুখগুলি তোমার আজও প্রিয়, কেন না ফের দেখা হয়নি। তোমার ছেলেবেলায় কবে যেন তোমার একটা মার্বেল হারিয়েছিল, আজও সেই মার্বেলটার কথা মনে রয়ে গেছে, কেননা এখনও মাঝে-মাঝে স্বপ্নে সেই মার্বেলটা তুমি হঠাৎ কুড়িয়ে পাও। সেই মার্বেল তোমার মাথার ভিতরে শব্দহীন গড়িয়ে গেল। তুমি হঠাৎ লক্ষ করেছিলে কবেকার স্বপ্নে দেখা এক নীল সিংহ তোমার মাথার ভিতরে আজও বাসা বেঁধে আছে। অন্যমনস্কভাবে তোমার খেয়াল হয়েছিল যে, তুমি যে, ‘ও-লা–লা ও-লা–লা’ গানটি গাইছিলে, তোমার সেই প্রিয় ফরাসি গানটির সুর ছিল সেইসব গ্রামীণ মানুষগুলির সুরের মতো, যারা গো চারণক্ষেত্রে ও বীজক্ষেত্রে ও নৌবাহনের সময় এরকম গান গায় এবং আত্মপ্রকাশহীন নিজেকে প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত করে। এইখানে তুমি কিছুক্ষণের জন্য মোটরগাড়ির সঙ্গে, তোমার গানের বিষণ্ণ গ্রামীণ সুরে আবিষ্ট থেকে যখন এক গভীর নিরাসক্তি তোমাকে পেয়ে বসেছিল তখন ঠিক কী হয়েছিল তোমার মনে নেই। তুমি তোমার জাগ্রত অংশকে ফাঁকি দিয়ে স্বপ্নে পতনশীল মানুষের মতো হঠাৎ যন্ত্র-সংলগ্ন তোমার হাত-পা টেনে নিয়েছিল। তোমার মোটরগাড়ি টাল খেয়ে গেল; পলকের মধ্যেই বিপদ বুঝতে পেরে তুমি সোজা হয়ে বসে গিয়ার স্টিয়ারিং ক্লাচ ও অ্যাক্সিলেটার চেপে ধরতে গিয়ে দেখলে ভয়ঙ্কর স্মৃতিভ্রংশ ঘটে গেছে, তুমি কোনওটারই ব্যবহার জানো না। ইতিমধ্যে চোরাগলি, অন্ধকার, তীব্র বাঁক দেওয়ালের খাড়াই তোমার দিকেই ধাবমান দেখে তুমি চিৎকার করে উঠেছিলে। আবার ঠিক সময়ে ব্রেক চেপে ধরেছিলে তুমিই। তোমার মোটরগাড়ি ভীষণ লাফিয়ে উঠে থামল। কিন্তু স্টিয়ারিংয়ের সঙ্গে দারুণ সংঘর্ষে তোমার পাঁজরার একটা হাড় মট করে ভেঙে গেলে তুমি তীব্র যন্ত্রণায় ঢলে পড়ে অস্ফুট গাল দিলে ‘ইডিয়ট’।

কিংবা আর-একদিন, যেদিন তোমার ছিমছাম শূন্য বাড়িতে অনেকদিন পর মনোরমা এসেছিল। সন্ধে হয়ে গেলে তুমি আলো জ্বালানি, আধো অন্ধকারেই সুবিধে ছিল তোমার। মনোরমা অনেকক্ষণ গ্রামোফোন বাজাল তারপর ‘ধৎ ভালো লাগছে না’, বলে উঠে গিয়ে পিয়ানোর কাছে বসল জানালার দিকে পিঠ রেখে। যদিও সে পিয়ানো বাজাতে জানত না, তবু ওই জায়গাটা ছিল তার প্রিয়, কেন না ওখান থেকে পুরো ঘরটার দিকে না তাকিয়েও তোমাকে দেখা যায়। তুমি তোমার হেলানো চেয়ারে পড়েছিলে মনোরমার মুখোমুখি। মনোরমা সারাক্ষণ দেখছিল তোমাকে চোখ না খুলেও তুমি টের পাচ্ছিলে। তুমি কেন তাকে ডেকে পাঠিয়েছ তা জানবার কৌতূহল থাকলেও সে কোনও প্রশ্ন না করেই তা জানতে চাইছিল। তুমি কী করে তোমার সেদিনকার হৃদয়হীন কথাবার্তা শুরু করবে তা ভেবে পাচ্ছিলে না। কেন না কথাগুলো বলা হয়ে গেলে মনোরমা চলে যাবে–এই যাওয়াটা তার পক্ষে কত অপমানকর তা ভেবে মনে মনে বড় কষ্ট পাচ্ছিলে তুমি। তুমি একপলক চোখ খুলে দেখলে সে অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে আলমারিতে সাজানো খেলাধুলোয় পাওয়া তোমার ট্রফিগুলো দেখছে। পরমুহূর্তেই উঠে গেল সে, ছায়ার মতো তাকে বইয়ের র‍্যাকের কাছে, টেলিফোনের কাছে, ড্রেসিং টেবিলের কাছে পরপর। দেখা গেল, আবছা গলা শোনা গেল তার ‘তুমি কি ভীষণ চরিত্রহীন সুমন!’ তুমি ভেবে পেলে না-ও কি করছে। কিন্তু সুযোগ বুঝে তুমি বলতে শুরু করেছিলে ‘শোনো মনোরমা–।’ মনোরমার ছায়াকে আবার পিয়ানোর কাছে দেখা গেল, তুমি আবার বললে ‘শোনো মনোরমা।’ পরমুহূর্তে মাথা নীচু করল মনোরমা, তার ডানহাত কোলের ওপর থেকে শাড়ির আঁচল তুলে নিলে তুমি অতর্কিতে বুঝতে পেরেছিলে মনোরমা কাঁদছে। তুমি তাড়াতাড়ি উঠতে যাচ্ছিলে, তুমি কিছু বলবার চেষ্টা করেছিলে, কিন্তু তার আগেই কান্নার ঝোঁকে ভর রাখতে গিয়ে মনোরমা বাঁ হাত। বাড়িয়ে পিয়ানোর এলোমেলো রিডগুলো ছুঁয়ে গেলে তুমি তড়িদাহতের মতো স্থির হয়ে গেলে। ধীর গম্ভীর স্বরে সেই পিয়ানো তোমাকে চুপ করতে বলল । তুমি আর-একবার উঠবার চেষ্টা করলে। পিয়ানো গর্জন করে উঠল। যেন মনোরমার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলে ডালা–খোলা প্রকাণ্ড সেই অন্ধকার পিয়ানো তোমার ওপর লাফিয়ে পড়বে। তুমি আবার মনোরমার স্বর শুনতে পেলে ‘সুমন, তুমি চরিত্রহীন–।’ লিতকণ্ঠে তুমি আবার মনোরমার নাম ধরে ডাকলে, ঠিক সেই সময়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে মনোরমা ভারসাম্য রক্ষার জন্য আবার পিয়ানোর রিডে হাত রেখেছিল, তার অশিক্ষিত অপটু হাতে পিয়ানো তীব্রভাবে বেজে উঠলে ঘরের সবকিছু প্রাণ পেয়ে গেল। অর্থহীন শ্বেতপাথরের টেবিল, টেলিফোন, বইয়ের রং্যাক, ওয়ার্ডরোব–এ সবকিছুই তোমার ওপর লাফিয়ে পড়বে-এরকম মনে হল। তীব্র ও অলৌকিক ভয় থেকে তুমি দেখলে–এ ঘরের সবকিছুই মনোরমার; তোমার ট্রফিগুলি, হেলানো চেয়ার, গ্রামোফোন, চেস্ট অফ ড্রয়ার্স–এ সবকিছুই মনোরমার, তুমি আগন্তুক মাত্র। মুহূর্তেই হাঁটু গেড়ে এই কথা বলবার অলৌকিক ইচ্ছে হয়েছিল তোমার যে ‘ক্ষমা করো!’ তুমি নড়তে পারলে না। মনোরমা তড়িৎগতিতে তার ব্যাগ কুড়িয়ে নিল, তুমি তার আধভাঙা কথা শুনতে পেলে ‘আমি সব জানি, কিন্তু তুমি কখনও বোলো না সুমন, বোলো না’ পরমুহূর্তেই দরজার কাছে তার দ্রুত অপসৃয়মান অবয়ব একপলকের জন্য দেখা গেল কি গেল না! ইচ্ছে হয়েছিল সিঁড়ি পর্যন্ত দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরা, কিন্তু তখনও ধর্মরক্ষাকারী সেই পিয়ানোর স্বর বাঘের মতো মনোরমাকে পাহারা দিচ্ছিল, ঘরের সবকিছুই ছিল–তখনও মনোরমার, তখন সজীব ছিল তোমার ট্রফিগুলি, টেলিফোন, বইয়ের র‍্যাক ও হেলানো চেয়ার। কিছুক্ষণ ঠিক কী হয়ে গেল তুমি তা বুঝলে না। এরপর তুমি অনেকদিন পিয়ানোর কাছে বসেছ, কখনও ধীরে কখনও দ্রুতবেগে তোমার শিক্ষিত সপটু আঙুলে রিড চেপে দেখেছ–পিয়ানোর ভিতরে অলৌকিক কিছু নেই। কিন্তু কোথাও ছিল সেই ঘরে, অন্ধকারে, তোমার স্পর্শকাতরতার ভিতরে পিয়ানোর সেই অচেনা ‘নোট’–মনোরমা জেনে কয়েক মুহূর্তের জন্য সেইখানে তার হাত রেখেছিল।

ছেলেবেলায় তুমি যেসব খেলা খেলেছিলে তার মধ্যে একটা খেলা তোমার মায়ের সঙ্গে। অথচ নিতান্ত বালক বয়সেই তুমি তোমার মাকে শেষবার দেখেছিলে। খুব দীর্ঘ চুল ছিল তাঁর এটুকু ছাড়া আর কিছুই তোমার মনে নেই। তোমার মাকে যারা দেখেছিলে তারা বলত তুমি মাতৃমুখী ছেলে–ভাগ্যবান। যে দু-একটি ছবি ছিল তোমার মায়ের তা থেকে চেহারা ভালো বোঝা যায় না, শুধু বোঝা যায়–তোমার মতোই তীব্র চিবুক ছিল, একটু চাপা গাল আর একটু উঁচু কিন্তু খুব সুন্দর নাক ছিল তাঁর। কিশোর বয়সের সমস্ত লক্ষণ শরীরে ফুটে উঠলে একদিন কৌতূহলবশত তুমি শাড়ি পরেছিলে, তোমার মায়ের কিশোরী বয়সের ছবিতে যেমন ছিল তেমনি দু-চোখে কাজল এবং কপালের জ সঙ্গমে কাজলের টিপ পরেছিলে তুমি, তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তুমি তোমার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে চোরাহাসি হেসে আপন মনে প্রশ্ন করেছিলে, ‘এ রকম ছিল আমার মা?’ আয়নায় অচেনা এক কিশোরীর মুখ তোমার দিকে চেয়ে গোপন ও রহস্যময় কোনও কারণে হেসে উঠেছিল। বড় তির্যক ও বিচিত্র ছিল তার দুই চোখ। এ তো তুমি নও! তুমি ভয় পেয়েছিলে। ‘আমি কি সুমন?’ তুমি এই প্রশ্ন করেছিলে, কেন না সেই কিশোরী প্রতিবিম্বের তীব্র ও রহস্যময় টান গোপন স্রোতের মতো তোমাকে সম্ভবত বীজরূপে। আর-একবার তার গর্ভস্থ অন্ধকারের দিকে আকর্ষণ করেছিল। মনে পড়ে তুমি একবার দু-হাত বাড়িয়ে আয়নার ফ্রেমটা ধরবার চেষ্টা করেছিলে, পরমুহূর্তেই তুমি আর ছিলে না। ঠিক কী হয়েছিল তোমার তা জানা নেই, শুধু সন্দেহ হয় কিছুক্ষণের জন্য সেই ঘরে একা এক কিশোরীই ছিল তার প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে, তুমি তার কোথাও ছিলে না। অনেকক্ষণ পর যখন তুমি সচেতন হয়েছিলে তখনও তোমার মনে ‘আমি কি সুমন? এই প্রশ্ন আবছাভাবে খেলা করে গিয়েছিল। মনে পড়ে ক্রমে ভয় ভেঙে গিয়েছিল এবং তুমি তোমার কিশোর বয়সে তোমার কিশোরী মায়ের সঙ্গে আরও কয়েকবার এই খেলা খেলেছিলে। কথার মাঝখানে, খেলার মাঝখানে, ঘুমের মাঝখানে অতর্কিতে সচেতন হয়ে তুমি মাঝে-মাঝে নিজের ভিতরে এক রহস্যময় নারীত্বকে লক্ষ করে ‘আমি কি সুমন?’ এই প্রশ্ন করে মনে-মনে চমকে উঠেছ। কালক্রমে যদিও তোমার শরীর মুষ্টিযোদ্ধাদের মতো পুরুষ ও সুগঠিত হয়েছে তবু তোমার মুখে কোথাও এখনও সেই এক কিশোরীসুলভ রহস্যময় নম্রতা রয়ে গেছে, একপলক আয়নায় তাকালেই তুমি তা ধরতে পারো। এখনও যখন তুমি নানা কাজে থাকো, যখন সিঁড়ি ভেঙে ওঠো, কিংবা সিঁড়ি ভেঙে নামো, যখন দরজা খুলতে হাত বাড়াও, কিংবা কেউ ‘সুমন’ বলে ডাকলে পিছন ফিরে সাড়া দাও, বিদেশি নাচের আসরে যখন অচেনা মহিলাকে হালকা আলিঙ্গনে বদ্ধ করো তখন মাঝে-মাঝে কাকে মুহূর্তের গভীর অন্যমনস্কতা থেকে নিজের ভিতরে হঠাৎ এক। অলৌকিক ‘আমি কি সুমন?’ এই প্রশ্ন শুনে বিস্মিত হয়েছ।

তোমাদের পরিবারে ছিল চোখের অসুখ। তোমার বাবার একটু বয়েস হয়ে গেলে তাঁরও দৃষ্টিশক্তি খুব কমে এসেছিল। খুব ভারী ঘোলাটে কাঁচের চশমা ছিল তাঁর, তবু ঘড়ি দেখবার জন্য, চিঠি পড়বার জন্য সবসময় তাঁকে একটা আতস কাঁচ ব্যবহার করতে হত। যখন চোখ দিয়ে দেখবার ক্ষমতা আরও ক্ষীণ হয়ে আসছিল তখন সবকিছু দেখবার আগ্রহ ক্রমশ বেড়েছিল তাঁর। তুমি তাঁকে কখনও দেখেছ সিঁড়ির ফাটলের কাছে বসে আতস কাঁচ দিয়ে পিঁপড়ের চলাফেরা লক্ষ করছেন, কখনও আতসকাঁচের ভেতর দিয়ে পিয়ানোর ওপর জমে ওঠা ধুলোর আস্তরণের দিকে অকারণে চেয়ে আছেন। কতদিন তুমি দেখেছ তোমার বাবা বাড়ির দক্ষিণ কোণে ভিতের কাছে তাঁর আতসকাচটি নিয়ে বসে আছেন, তাঁর ধারণা ছিল দক্ষিণ কোণ থেকেই বাড়িটা ভাঙতে শুরু করবে, কেন না ওই কোণ থেকেই বাড়িটার ভিত গাঁথা শুরু হয়েছিল। তোমাকে কাছে ডেকে কখনও-কখনও তিনি বলেছেন, ‘তুমি কি খুব বেশি আয়ু চাও? খুব বেশি দৃষ্টিশক্তি চাও? সুমন, তুমি কখনও খুব বেশি চেয়ো না।’ মাঝে-মাঝে তিনি তোমাকে ঠাকুরমার গল্প বলেছেন। বাড়িতে কারও দৃষ্টিশক্তি ভালো ছিল না, দাদু অন্ধ, জ্যাঠামশাই অন্ধ হয়ে যাচ্ছেন, তখন সকলের চোখের দেখা তোমার ঠাকুমা একলা দেখতেন। এত বেশি প্রখর হয়েছিল তাঁর চোখ যে তোমাদের মস্ত বাগান থেকে একটু ফুল কেউ তুলে নিলে তিনি টের পেতেন, তোমার প্রায় অন্ধ পিসিমার খেলনার বাক্স থেকে পুঁতির মালা চুরি গেলে তিনি ধরে ফেলতেন। এইভাবে সবকিছুর ওপর তাঁর ভয়ঙ্কর মায়ার সৃষ্টি হয়েছিল বলে মরবার সময় তাঁর প্রাণ বেরোতে অনেকক্ষণ সময় লেগেছিল, আর শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার পরও দেখা গিয়েছিল তাঁর চোখ খোলা রয়েছে। এইভাবে তোমার বাবা তোমাকে প্রায়ই কাছে ডাকতেন, তোমার গলার শব্দ শুনতে চাইতেন। তুমি তোমার বাবার ভিতরে খুব আনন্দ কিংবা খুব বিষাদ কখনও দ্যাখোনি। খুব কাছের কিংবা খুব দূরের বলেও তাঁকে তোমার কখনও বোধ হয়নি। শুধু তাঁর রহস্যহীন পরিষ্কার মুখ-চোখ দেখে তোমার প্রায়ই তাঁকে বড় দূর ভ্রমণকারী বলে মনে হত। তখন তোমার যৌবন আরম্ভের সময়ে তুমি একদিন তোমার প্রথম নীতিবিগহিত যৌন স্বপ্নটি দেখেছিলে, আর-একদিন তুমি অলি নামে মেয়েটিকে প্রথম চুম্বন করেছিলে। সেই সময় তুমি প্রায়ই বড় অন্যমনস্ক ও অস্থির ছিলে। এমনই একদিন যখন তুমি তোমার বাবার ঘরের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলে তখন তিনি চোখ কুঁচকে তোমাকে দেখবার চেষ্টা করে জিগ্যেস করলেন, ‘তুমি কি সুমন?’ তুমি সাড়া দিলে তিনি বললেন, ‘একবার আমার। কাছে এসো।’ তুমি কাছে গেলে বললেন, ‘হাঁটু গেড়ে আমার সামনে বোসো।’ তুমি তোমার বাবার হাঁটুর ওপর হাত রেখে বসলে, তিনি তাঁর আতসকাচটি তুলে নিয়ে ‘দেখি সুমন তোমার মুখখানি’ এই বলে তোমার মুখের ওপর আতসকাচটি ধরলে, তুমি কাঁচের ভিতরে তাঁর মস্ত বড় গভীর চোখগুলি দেখেছিলে। তোমার মনে হয়েছিল বহু দূর বিস্তৃত রয়েছে সেই চোখ, এবং তোমার এই বোধ এসেছিল যে সেই চোখের ভিড়ে ধূসর মাঠ, পর্বতশৃঙ্গ, সমুদ্র ও আকাশ রয়েছে। –একটু ম্লান–কিন্তু এই চোখ তাঁর যিনি কাছের ও দূরের সব কিছু দেখতে পান, যিনি আলো ও অন্ধকারে সমভাবে দেখেন, যিনি ঈশ্বর, এবং তোমার স্রষ্টা। তাঁর ডান হাতখানা তোমার মাথার ওপর স্থির হয়েছিল। খানিকক্ষণ তোমার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল, কেন না তোমার বোধ। হয়েছিল তিনি তোমার ধর্মহীন ক্রিয়াকাণ্ডগুলি, তোমার সামঞ্জস্য শূন্য বোধ ও প্রবৃত্তিগুলোকে প্রত্যক্ষ করছেন। তিনি একবার বিড়বিড় করে বললেন, ‘চোখ বড় মায়ার সৃষ্টি করে।’ তারপর তিনি তাঁর হাত ও আতস কাঁচ সরিয়ে নিলেন। সেই দিনই দুপুরবেলা তোমার বাবা তাঁর আতসকাচটি নিয়ে নিঃশব্দে ছাদে উঠে গিয়েছিলেন এবং শেষবারের মতো আতস কাঁচ দিয়ে। সূর্যকে প্রত্যক্ষ করবার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর দুটো চোখই পুড়ে গিয়েছিল। তাই তারপর থেকে তুমি সবচেয়ে বেশি লক্ষ করেছ মানুষের চোখ। প্রথমে তুমি নিজের চোখ দিয়ে শুরু করেছিলে। জল খেতে গিয়ে তুমি কতদিন গ্লাসের জলে নিজের চোখের ছায়া দেখে চোখ ফেরাতে পারোনি। কতদিন তুমি ইচ্ছে করে চোখ বুজে রাস্তা দিয়ে বহু দূর পর্যন্ত হেঁটে গেছ। বড় রোমাঞ্চকর ও অস্বাভাবিক ছিল তোমার তোমাকে নিয়ে সেই খেলা। কিন্তু ক্রমে–ক্রমে তুমি অন্ধের মতো হাঁটতে শিখেছিলে, তুমি চোখ বুজে দিকনির্ণয় করবার কৌশল আয়ত্ত করেছিলে, এবং অন্ধের যেমন হয় তেমনই তোমার অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলি প্রখর ও স্বৰ্শকাতর হয়ে উঠেছিল। এইভাবে অনেকদূর অগ্রসর হয়ে তুমি ভেবেছিলে এখন তুমি তোমার অন্ধকার দিনগুলির জন্য প্রস্তুত।

তুমি অনেকদিন তোমার বন্ধুদের চোখ বুজে হেঁটে যাওয়া ও দিকনির্ণয় করার কৌশল দেখিয়ে বিস্মিত করেছ। যারা তোমার এই কৌশল দেখেছিল তাদের মধ্যে একমাত্র অতীশ তোমাকে মাঝে-মাঝে বলেছিল যে এই খেলা ভালো নয়। কারণ জিগ্যেস করলে সে সঠিক উত্তর দিতে পারত না, শুধু বলত ‘দ্যাখো তুমি–এ ভালো নয়।’ অতীশ ছিল শান্ত ও নিঃশব্দ প্রকৃতির এবং প্রথম চেনা হওয়ার পর থেকেই তুমি মাঝে-মাঝে লক্ষ করেছিলে যে তার মুদ্রদোষের মতো একটি স্বভাব রয়েছে। কম কথা বলত অতীশ এবং কখনও-কখনও কথা বলতে-বলতে হঠাৎ থেমে যেত সে। যেন কথা ভুলে গিয়ে কী বলছিলাম বলো তো? কেন বলছিলাম?’ এই প্রশ্ন করে বোকার মতো চেয়ে থাকত। তুমি অনেকদিন কথার খেই ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছ কিন্তু অতীশের ধাঁধা কাটত না, সে প্রশ্ন করতে থাকত ‘কেন বলছিলাম? কেন বলছিলাম? কেন?’ তারপর আর সে প্রশ্নও তার থাকত না এবং সে কিছুক্ষণ প্রাণপণে কোনও কথা বলবার চেষ্টা করত, পারত না। অবশেষে সে তার স্বাভাবিকতা ফিরে পেলে বহুদিন লজ্জাবশত উঠে চলে গেছে। অথচ তুমি ক্রমশ বুঝতে পেরেছিলে তোমাদের কুড়ি-একুশ বছর বয়সের সব বন্ধুদের। মধ্যে অতীশ ছিল সবচেয়ে জ্ঞানী ও অনুভূতিপ্রবণ। মাঝে-মাঝে তুমি তার এই স্বভাবটি সম্পর্কে প্রশ্ন করেছ, সে সঠিক উত্তর না দিয়ে হেসে বলত ‘ওটা আমার মনের তোতলামি।’ কিন্তু কতদিন তোমার মনে হয়েছে বহুজনের মধ্যেও অতীশ তোমাকে লক্ষ করছে অতি নিবিষ্টভাবে, যেন গোপনে সে তোমাকে কোনও কথা বলতে চায়। খেলাধুলো করত না অতীশ, কিন্তু তুমি যখন খেলতে নেমে ফুটবলের পিছনে ছুটছ তখনও টের পেয়েছে মাঠের সীমানায় বাইরে ভিড় থেকে অতীশ তোমাকে লক্ষ করছে। যখন তুমি চোখ বুজে পিয়ানোর সঙ্গে গান গাইছ, তখনও টের পেয়েছ অতীশ আর সকলের মতো গান না শুনে তোমাকে লক্ষ করছে। কিন্তু কারণ জিগ্যেস করলে হেসে এড়িয়ে যেত, বলত ‘তুমি বড্ড বেশি স্পোর্টসম্যান সুমন। বোধহয় তুমি সব কিছু নিয়ে খেলতে পারো।’ তুমি উঁচু গলায় হেসে উঠে বলেছ ‘ইয়াঃ!’ খেলা শেষ হয়ে গেলে তুমি আর অতীশ ফাঁকা খেলার মাঠে পাশাপাশি শুয়ে ছিলে, অতীশ বলছিল খেলা শেষ হয়ে গেলে খেলার মাঠ আমার ভালো লাগে।’ তুমি চোখ বুজে ছিলে, উত্তর দিলে না। অতীশ আচমকা কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে উঠে বলল  ‘সুমন, আমার একটা খেলার কথা তোমায় বলতে পারি, কারণ তোমার একটা খেলার সঙ্গে আমার খেলাটার বোধহয় মিল আছে।’ তুমি চোখ বুঝে সতর্ক গলায়। প্রশ্ন করলে কী সেটা?’ অতীশ হাসল ‘বলছি। আগে বলো তো কত ছেলেবেলার কথা তোমার মনে আছে!’ তুমি হালকা গলায় বললে, ‘এই ধরো চার-পাঁচ বছর বয়সের কথা কিছু-কিছু মনে। আছে।’ অস্থির গলা শোনা গেল অতীশের, ‘না, অত নয়। ও তো অনেকেরই মনে থাকে, আরও ছেলেবেলার কথা মনে নেই?’ উৎসুক হয়ে তুমি একটু ভেবে দেখলে ‘খুব মনে নেই, তবে আমার একটা নীল রঙের টি–পটের কথা মনে পড়ে, মার হাতে দেখেছিলাম–যখন আমার তিন–সাড়ে তিন বছর বয়স।’ অতীশের ব্যগ্র গলা শোনা গেল ‘আর কিছু আরও ছেলেবেলার?’ তুমি অবাক হয়ে আধ–বসার মতো উঠে অতীশের আবছা মুখের দিকে চেয়ে দেখলে, তোমার মনে হয়েছিল অতীশ এতকাল যা বলতে চেয়েছিল আজ তা বলতে চায়। তোমার ভয় হচ্ছিল অতীশ তার পুরোনো অভ্যাসবশে চুপ করে না যায়। তুমি শান্ত গলায় বললে, ‘বোধহয় একবার জ্বরের ঘোরে আমি একটা থার্মোমিটার ভেঙে ফেলেছিলাম, তখন আমার বয়স বোধহয় আড়াই কি তিন, আবছা মনে পড়ে, আমি থার্মোমিটার  ছুঁড়ে ফেলছি, কিন্তু এটা আমার কল্পনাও হতে পারে।’ ‘হতে পারে।’ অতীশ সঙ্গে-সঙ্গে উত্তর দিল কিন্তু এরকম মনে করবার চেষ্টা করে দ্যাখো আরও ছেলেবেলার কথা তোমার মনে পড়ে কি না।’ তুমি অনেকক্ষণ ভেবেছিলে, তুমি কিছুটা অস্বস্তিবোধ করে বলেছিলে না। কিন্তু আর কী মনে পড়বে। দু-একটা ঘটনার কথা পুরোনো ছবির মতো মনে থেকে যায়। ব্যস।’ অতীশ অস্পষ্ট গলায় বলল  ‘দু-একটা ঘটনার কথা নয়, সবকিছু একের–পর–এক স্পষ্ট মনে করার কথা বলছি যা তুমি আর কারও কাছ থেকে শোনোনি, যা কল্পনারও নয়।’ তুমি হেসে উঠেছিলে ‘পাগল! তুমি কি পারো আরও ছেলেবেলার কথা মনে করতে?’ অতীশ হাসল না, ধীর স্বাভাবিক গলায় বলল  ‘অনেক, যতদূর যাওয়া যায়।’ তুমি হাসছিলে তার মানে এক-দেড় বছর, ছ’মাস না জন্মমুহূর্ত পর্যন্ত?’ অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে উঠল। অতীশের চোখ ‘ঠিক জন্মমুহূর্তটিও মনে পড়তে পারে।’ বলেই সম্ভবত লজ্জায় সে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাতে তুলে বলে উঠল ‘সুমন, ওই দেখ ওরিয়ন।’ সে কথা ঘোরাচ্ছে বুঝতে পেরে সেদিকে তুমি কান দিলে না। ‘ঠিক আছে’ তুমি বলেছিলে ‘কীরকম ছিল তোমার জন্মমুহূর্ত?’ অতীশ মুখ লুকিয়ে খুব আস্তে-আস্তে বলল  ‘অন্যরকম, আমাদের রোজকার জীবনের মতো নয়। তুমি নিজেও জানো না কেন অতীশের স্বর শুনে তোমার রোমকূপে কাঁটা দিয়েছিল। অতীশ হাসল ‘মনে করতে-করতে ফিরে যাওয়া যায়। তুমিও চেষ্টা করে দেখতে পারো।’ তুমি বিশ্বাস করোনি, বলেছিলে, ‘কী করে সম্ভব?’ অতীশ হাসছিল ‘ঠিক জানি না, আগে আমি এটা খেলতাম কিন্তু এখন আর আমি ইচ্ছে করে খেলি না, খেলাটাই শুরু হয়ে যায়। তখনই চেনা-পরিচয় মুছে যায়, কথা ভুল হয়ে যায়, আমি ফিরে যেতে থাকি।’ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে তুমি হঠাৎ উঁচু গলায় হেসে উঠলে অতীশ বড় লজ্জা পেয়েছিল। তুমি বিশ্বাস করোনি, কিন্তু তারপর গোপনে তুমি মাঝে-মাঝে অতীশের খেলাটা খেলতে চেষ্টা করেছিলে–কিছুই তোমার মনে পড়েনি। ঠিক স্মৃতিচারণের খেলা নয়। একটু ভিন্ন ও রহস্যময়–ঠিক অতীশের মতো করে সেই খেলা তুমি খেলতে পারোনি। তুমি একা-একা আপন মনে ‘ইয়াঃ’ বলে হেসে উঠেছ। কিন্তু একদিন রোজকার মতোই তুমি খুব ভোরে উঠে খেলার মাঠে গিয়েছিলে। একা-একা আবছা অন্ধকারে তুমি আস্তে গড়িয়ে দিলে তোমার ফুটবল তারপর ছুটতে শুরু করলে। প্রথমে আস্তে আস্তে তারপর তোমার গতি বাড়ছিল। মাঠের সীমানা ধরে তুমি তোমার বলটির পিছনে ছুটছিলে মাঠকে সবসময় বাঁ-দিকে রেখে চক্রাকারে। সাধারণত তুমি চারবার মাঠটিকে ঘুরে এলে ভোর হয়ে যায়। তুমি তিনবার ঘুরে এসে চারের পাক শুরু করেছিলে, তোমার মাংসপেশিগুলি সতেজ ও রক্তস্রোত দ্রুত হয়ে উঠেছিল, ভোরের দম নিয়ে তোমার ফুসফুস পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল–এইভাবে চারের পাক শেষ হয়ে গেল। কিন্তু ভোর হল না। তোমার খেয়াল ছিল না বলটা তোমার পায়ের টোকা খেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিল–তুমি অভ্যাস মতো ছুটছিলে। কিন্তু এক সময়ে তুমি বুঝতে পেরেছিলে তোমার পায়ে বলটা আর নেই–কোথায় গড়িয়ে গেছে। থেমে তোমার খেয়াল হল তুমি অন্তত সাতবার মাঠটাকে ঘুরে এসেছ অথচ ভোর হয়নি। তুমি বলটা খুঁজবার জন্যে মাঠের দিকে তাকালে, সেখানে গাঢ় অন্ধকার জমে আছে, তুমি আকাশের দিকে তাকালে –সেখানে গাঢ় অন্ধকার জমে আছে। মাঠ না, আকাশ না, সূর্য ও নক্ষত্র কিছুই তুমি দেখতে পেলে না। তুমি পা বাড়িয়ে দেখলে, তুমি হাত চোখের সামনে এনে দেখলে–কিছুই দেখা যায় না। তোমার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। তুমি যত্নে শেখা তোমার ইন্দ্রিয়গুলির স্পর্শকাতরতার কথা ভুলে গিয়েছিলে, চোখ বুজে দিকনির্ণয় করবার কৌশলের কথাও তোমার মনে হল না। মনে আছে তুমি আস্তে-আস্তে হাঁটু গেড়ে বসেছিলে, তোমার দুটি হাত কোলের ওপর জড়ো করা, গাল বেয়ে চোখের জল পড়ছে, নিতান্ত তুচ্ছ কারণেই তুমি কাঁদছিলে–কখনও অলি নামে যে মেয়েটিকে তুমি প্রথম চুমু খেয়েছিলে তার জন্য, কখনও বাড়ি ফিরে যাওয়ার পথটির জন্য, মাঠ সূর্য ও নক্ষত্রগুলির জন্য। তুমি চোখ চেয়ে দেখেছ অনেক, তুমি চোখ বুজেও দেখেছ অনেক, আর একধরনের দেখা তোমাকে খেলাচ্ছলে শিখিয়েছিল অতীশ–তুমি অনুভব করলে সেই খেলা। তোমার ভিতরেই গোপনে ছিল একদিন। তোমার ইচ্ছা ও প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সেই খেলায় অতি দ্রুত পশ্চাৎগামী রেলগাড়ির মতো তুমি ফিরে যাচ্ছিলে। ক্রমশ আলো ও অন্ধকার লুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল–ক্রমে চেষ্টারহিত তুমি বুঝেছিলে চোখের মতোই তোমার অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলি একে একে নিভে গেল। তুমি আর কিছুই স্পর্শ করো না, কিছুই প্রত্যক্ষ করো না, কিছুই শ্রবণ করো না, তুমি খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করো না, তোমার আনন্দ ও বিষাদ কিছুই নেই–সেইখানে খুব ভোর আকাশের নীচে তোমার প্রিয় মাঠের ওপর তোমার বীজটি পড়ে আছে যার সঙ্গে ‘আমি’ এই বোধটুকু মাত্র ধর্মের মতো সংলগ্ন আছে, আর কিছুই নেই। ‘আমি’ এই বোধটুকু মায়ার মতো। তোমার ইন্দ্রিয়গুলিকে সৃষ্টি করেছিল–অলৌকিক এই শিল্প-নির্মাণ। এ তোমারই। তুমি প্রাণপণে এই বোধ ভেদ করতে চাইছিলে, চিৎকার করে উঠতে চাইছিলে, দৌড়াতে চাইছিলে–পারলে না। কয়েকটি অলীক মুহূর্তের পর কে যেন আবার খেলাচ্ছলে তোমার কোলের কাছে বলটি ঠেলে দিলে তুমি দু-হাতে তুলে নিলে তোমার বল, বুকের মধ্যে চেপে ধরে তাকিয়ে দেখলে –সবুজ বিস্তৃত মাঠ, সূর্য উঠছে। তুমি নড়লে না, তুমি তেমনই বসে রইলে–এতদিন তোমার যা দেখা হয়নি সব কিছুর জন্য অবিরল চোখের জলে তোমার বুক ভেসে যাচ্ছিল। তুমি চোখ মেলে সেই অন্ধকার আর কখনও দেখনি। এরপর দীর্ঘকাল কেটে গেলে একবার বিদেশে থাকতে তুমি জেনেছিলে অতীশ সন্ন্যাস নিয়ে ঘর ছেড়ে গেছে, এই কারণে যে, সে বিয়ে করবার পর নিতান্ত সন্দেহবশত তার বউ মল্লিকার। কৌমার্য হরণ করতে পারেনি বলে মল্লিকা তাকে ত্যাগ করে গিয়েছিল। তারপর অতীশের কথা তোমার আর মনে ছিল না। কিন্তু যখন তুমি বিদেশে প্রবাসে অচেনা রাস্তায় ও মাঠে হেঁটেছে, যখন কোনও নদীর ধারে দাঁড়িয়ে নিসর্গ প্রত্যক্ষ করেছ, যখন সমুদ্র পাড়ি দিয়েছ তখন শৈশব বাল্য ও কৈশোরের কোনও-কোনও ছবি মনে ভেসে উঠলে তোমার অতীশের সেই খেলাটার কথা মনে পড়েছে। তুমি একা-একা আপন মনে ‘ইয়াঃ’ বলে হেসে উঠেছ। এইভাবে তুমি তোমার ঊনত্রিশের জন্মদিন পার হয়ে গেলে একদিন এক পার্টিতে তোমার পরিচিতদের মধ্যে একজন তোমার হাতটা চেপে ধরেই ছেড়ে দিয়ে বলেছিল ‘সুমন, তোমার গায়ের জোর কমে যাচ্ছে।’ তুমি চমকে উঠেছিলে, কেন না তুমি বাস্তবিক অনুভব করেছিলে তোমার জোর অনেক কমে এসেছে। তুমি আগেকার মতো আর ফুটবল নিয়ে দৌড়োও না। খেলাধুলো তুমি প্রায় ছেড়ে দিয়েছ। সেই স্পর্শকাতরতাও তোমার আর নেই। তুমি অনুভব করো তুমি কখনও বির্ধমী, কখনও তুমি ধর্মদ্রোহী–তাই তোমার মধ্যস্থ অলৌকিক এখন তোমার ভিতরে মাঝে-মাঝে ত্রাসের সঞ্চার করে। আর তোমার যা আছে তোমার ধর্মহীন ক্রিয়াকাণ্ড, বোধ ও প্রবৃত্তি–এ সবই তোমার কাছে তুচ্ছ। আপাদমস্তক তুমি তোমার কাছেই গুরুত্বহীন ও সামঞ্জস্যশূন্য। সুতরাং বিপদে কে তোমাকে রক্ষা করে, একাকিত্বে কে তোমাকে সঙ্গ দেয়? আবার তোমার বিশ্বাস এই যে তুমি স্পষ্টতই এক ধারাবাহিকতার সূত্রে গ্রথিত আছ–তুমি প্রাকৃত। তুমি অনেকের দ্বারা রক্ষিত, তুমিই আবার অনেকের রক্ষাকারী। প্রয়োজনশূন্য তুমি নও-তুমি সম্পর্কযুক্ত মানুষ ধারাবাহিক–তুমিও দূরবর্তী ক্রীড়াভূমির দিকে একজন মশালবাহী–তোমার এ বিশ্বাস গথিক গম্বুজের মতো দৃঢ়মূল। সুতরাং অলৌকিক তোমার কাছে নীতিবিগর্হিত অনুপ্রবেশকারী, যেহেতু তুমি আয়নায় প্রায়ই নিজের মুখ প্রতিবিম্বিত দেখেছ, তুমি দোকানে ক্রয়কারী যুবতীদের দেখেছ, তুমি গাছে–গাছে বয়সের ফসল প্রত্যক্ষ করেছ, তুমি ফসলের ক্ষেত্রবর্ষণ, বীজবপন জলসেচন ও পক্য শস্যকে কার্যকারণ সূত্রে গ্রথিত করেছ। তোমার ইন্দ্রিয়গুলি সতেজ ও কর্মক্ষম, তুমি বাহ্যকাম ও ব্যবহারগুলিকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারো, তুমি স্বভাবে আছ, তবে কেন এই অলৌকিক?

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *