ক্রিস্টোফার কলম্বাস (আনু. ১৪৪৬-১৫০৬) – আমেরিকার আবিষ্কারক
ইতালির ছোট্ট শহর জেনোয়ার একেবারেই অজ্ঞাত অখ্যাত এক তাঁতি পরিবারের ছেলে ক্রিস্টোফার কলম্বাস (Christopher Columbus)। জন্ম তাঁর আনুমানিক ১৪৪৬ সালে।
জেনোয়া শহরেরই কারাগারে বসে যখন বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পোলো তাঁর রোমাঞ্চকর অভিযান-কাহিনী নিয়ে বই লিখছিলেন, এ ঘটনা তারও একশত বছর পরের।
পয়সার অভাবে ছোটবেলায় কলম্বাসের স্কুলে যাওয়া হয়নি। স্কুলের পড়া ছেড়ে বাবার সঙ্গে কাপড় বুনতে হতো ঘরে বসে। কিন্তু মন মানতে চাইত না। একশো বছর আগে লেখা মার্কো পোলোর অভিযান-কাহিনীগুলো তখনও জেনোয়ার লোকজনের মুখে- মুখে ফিরত। ছেলেবেলার রূপকথার অবিশ্বাস্য কাহিনীর মতো তা কলম্বাসদের মতো অজ্ঞাত পরিচয় তাঁতি পরিবারের কাছেও অজানা ছিল না। কলম্বাসের মনও যেন সেই কাহিনীতরীতে আরোহন করে হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে বেড়াত রঙিন ডানা মেলে।
জেনোয়া ছিল সমুদ্রবন্দর। এখানে এসে প্রতিদিন ভিড়ত দেশ-বিদেশের অগণিত পালতোলা বাণিজ্য-তরী। আবার তারা পাল উড়িয়ে চলে যেত কোনো অজানার পথে। কলম্বাস প্রতিদিন সমুদ্রতীরে এসে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতেন এই জাহাজগুলোর দিকে আর ভাবতেন, তিনিও যদি এমনি জাহাজে করে মার্কো পোলোর মতো পাড়ি দিতে পারতেন অজানা পথের সন্ধানে!
তারপর একদিন সত্যি সত্যি তাঁর স্বপ্ন সফল হওয়ার পথ খুঁজে পেল। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দেবার পরপরই একদিন এ-রকমেরই একটা জাহাজে সাধারণ নাবিকের চাকরি নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন সমুদ্রযাত্রায়। এভাবেই শুরু হলো তাঁর সমুদ্রাভিযান। তিনি বহু দেশ ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে এসে পৌঁছুলেন পর্তুগালে।
শুধু সমুদ্রযাত্রা নয়, তিনি এ সম্পর্কে যত বই আছে, সবগুলো একে একে পড়ে ফেলতে লাগলেন। খবর নিতে লাগলেন কোথায় কোন্ দেশ, কোন্ সাগর, কোন্ পর্বত আছে। আর এমনি করেই তিনি নিজের উদ্যোগেই একটি সমুদ্রযাত্রার পরিকল্পনা এঁটে বসেন।
তারপর সাহায্য প্রার্থনা করে সাক্ষাৎ করলেন রাজার সাথে। তিনি বললেন যে, যদি জাহাজ ও নাবিক পাওয়া যায়, তবে পশ্চিম দিকে সমুদ্রযাত্রা করে কুবলাই খাঁর দেশে গিয়ে পৌছুতে পারবেন। এমনকি তিনি মশলার দেশ বলে খ্যাত ভারতবর্ষে গিয়েও পৌঁছতে পারবেন বলে আশা করেন। কারণ পৃথিবী তো গোলাকার। তা হলে পশ্চিম দিকে যাত্রা করে অবশ্যই পূর্বদেশে গিয়ে পৌঁছানো সম্ভব।
কিন্তু কলম্বাসের এই পরিকল্পনা রাজার কাছে খুব উদ্ভট বলে মনে হলো। তাই তিনি তেমন গুরুত্ব দিলেন না।
প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় খুব মর্মাহত হলেন কলম্বাস। এই রাগে তিনি দেশই ছাড়লেন। সেখান থেকে সোজা চলে গেলেন স্পেনে। তিনি স্পেনের রাজা ফার্দিনান্দ এবং রানি ইসাবেলার কাছে সমুদ্রযাত্রার প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু তাঁরাও প্রথমটায় খুব একটা গুরুত্ব দিলেন না তাঁর প্রস্তাবের ব্যাপারে। ফরে মন খারাপ করে সেখান থেকেও ফিরে আসতে হলো কলম্বাসকে।
এর মধ্যে কেটে গেল বেশ কয়েকটি নিষ্ফল বছর। তারপর হঠাৎ করেই একদিন স্পেনের রানি ইসাবেলার কাছ থেকে কলম্বাসের ডাক এল তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। রানি ইসাবেলা তাঁকে ডেকে নিয়ে বললেন কলম্বাসের প্রস্তাবে তাঁরা রাজি। তিনি যেন শিগগিরই তাঁর সমুদ্রযাত্রার আয়োজন করেন।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার আনন্দে কলম্বাস তো মহাখুশি। ফলে কালবিলম্ব না করে কয়েক মাসের মধ্যেই আয়োজন সমাপ্ত করে তিনি জাহাজ ভাসালেন সমুদ্রের বুকে। নিনা, পিন্টা ও সেন্টামারিয়া নামে তিনটি পালতোলা জাহাজ নিয়ে তিনি ১৪৯২ সালের ৩ আগস্ট যাত্রা করলেন অজানা সমুদ্রপথে।
স্পেনের উপকূল ছাড়িয়ে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ পেছনে ফেলে তাঁর জাহাজ এগিয়ে যেতে লাগল সীমাহীন সাগরের বুক চিরে। কিন্তু তাঁর যাত্রা তো আর শেষ হয় না! কেটে গেল সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস। জাহাজ চলছে তো চলছেই। কোনো ডাঙাভূমির দেখা নেই। তা হলে এ-যাত্রার শেষ কোথায়?
অবশেষে তাঁর নাবিকেরা হতাশ হয়ে পড়ল। তারা ভাবল হয়তো সামনে আর কোনো ডাঙাভূমিই পাওয়া যাবে না। এই পাগল লোকটা তাদের মারার জন্যই এই ভয়ংকর সমুদ্রযাত্রায় নিয়ে এসেছে। তখন জাহাজে দেখা দিল নাবিক বিদ্রোহ। তারা খেপে গিয়ে কলম্বাসকে হত্যা করতে উদ্যত হলো।
কলম্বাস অনেক বুঝিয়ে তাদের শান্ত করলেন। তারপর দীর্ঘ তিন মাস পর সহসা তাঁরা সমুদ্রে একটি গাছের তাজা ডাল ভেসে যেতে দেখলেন। এই দেখে তাঁদের মনে আশার আলো দেখা দিল—হয়তো আশেপাশে কোথাও ডাঙাভূমি আছে, নইলে গাছের ডাল এল কোথা থেকে?
তাঁদের অনুমানই সত্য হলো। কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁদের উৎফুল্ল চোখের সামনে ভেসে উঠল একটি সবুজ বৃক্ষলতাশোভিত ডাঙাভূমির তটরেখা।
কলম্বাস মহানন্দে তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে এসে অবতরণ করলেন তার মাটিতে। তাঁরা স্পেনের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে ভূখণ্ডটি স্পেন সরকারের পক্ষ থেকে দখল করলেন।
কলম্বাস ভেবেছিলেন, তিনি হয়তো সত্যি সত্যি পূর্বের দেশ ভারতবর্ষে এসে পৌঁছেছেন। তিনি যেখানে গিয়ে পৌঁছেছিলেন, সেগুলো ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু দ্বীপ। তিনি মনে করলেন এগুলো হয়তো ভারতবর্ষেরই আশপাশের কিছু দ্বীপ।
এই বিজয়বার্তা নিয়ে সাত মাস পর আবার স্পেনে ফিরে এলেন কলম্বাস। এই নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কারের জন্য তাঁকে দেওয়া হল রাজকীয় সংবর্ধনা। রানি দিলেন প্রচুর উপঢৌকন।
এরপর আবার যাত্রা করলেন তিনি তাঁর নবআবিষ্কৃত দেশের উদ্দেশ্যে। এবারও তিনি আরও কিছু দেশ—জামাইকা, হাইতি ও কিউবা এইসব দ্বীপ—আবিষ্কার করলেন।
কিন্তু ইতিমধ্যে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কিছু দুষ্টু লোক রাজার কাছে তাঁর সম্পর্কে নানা কথা বলে রাজার মন বিষিয়ে তুলতে লাগল। বিশেষ করে নবআবিষ্কৃত অঞ্চলের দখল এবং এ-অঞ্চলের শাসন নিয়ে কলম্বাসের সাথে অনেক মতানৈক্যের সৃষ্টি হলো। দুষ্টু লোকেরা রানি ইসাবেলাকে বোঝাতে লাগল যে, কলম্বাস হতে পারেন একজন ভালো নাবিক, কিন্তু দেশ শাসন করার কোনো জ্ঞানগম্যি তাঁর নেই। তাই দখলকরা দেশের শাসন কলম্বাসের হাতে ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়। তাই ইসাবেলা দেশে ডেকে পাঠলেন কলম্বাসকে!
এরপরও তিনি তিনবার গিয়েছিলেন নবআবিষ্কৃত আমেরিকায়। আবিষ্কার করেছিলেন আমেরিকার মূল ভূখণ্ডের অনেকগুলো দেশ।
কিন্তু ইতিমধ্যে রানি তাঁকে আরও ভুল বুঝতে শুরু করেন। এমনকি তাঁকে কারাগারে পর্যন্ত নিক্ষেপ করা হয়।
শেষ বয়সটা কলম্বাসের খুব একটা সুখে কাটেনি। মানসিক অশান্তি, আর্থিক অনটন, বিশেষ করে রানির অবিশ্বাস ইত্যাদি কারণে তিনি খুব মানসিক অশান্তিতে দিন কাটাতে লাগলেন।
আর এই অশান্তি থেকেই দেখা দিল নানা রোগ। ক্রমেই তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়তে লাগল। তারপর নবআবিষ্কৃত আমেরিকার ভান্নাডনিক নামক স্থানে ১৫০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মে তিনি পরলোকগমন করেন।
কলম্বাস প্রথমে যে দ্বীপগুলো আবিষ্কার করেছিলেন, ভুল করে তিনি ভেবেছিলেন সেগুলো হয়তো ভারতীয় দ্বীপ। কিন্তু ওগুলো ছিল ক্যারিবিয়ান সাগরেরই কিছু দ্বীপ।
কিন্তু তাঁর সেই ভুলের প্রতি আজও সম্মান দেখানো হয়। তিনি ভুল করে যে দ্বীপের নাম দিয়েছিলেন ভারতীয় দ্বীপ, আজও তাকেই পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ বলা হয়ে থাকে।