রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন (১৮০৫–১৮৭৫) – যাঁকে বলা হয় রূপকথার জাদুকর

ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন (১৮০৫–১৮৭৫) – যাঁকে বলা হয় রূপকথার জাদুকর

সেই যে এক মজার হাঁসের গল্প—জন্মের পর কী ঢ্যাঙা আর বিচ্ছিরি হয়েছিল তার চেহারা। কেউ তাকে দেখতেই পারত না।

তাই সে মনের দুঃখে চলে গেল দুচোখ যেদিকে যায়। এমনি করে দিন যায়। তার মনের দুঃখে রাত কাটে, দিন কাটে। কিন্তু তার পরেই একদিন জলের নিচে নিজের চেহারা দেখে সে চমকে উঠল

একী অপূর্ব সুন্দর হয়েছে তার চেহারা! বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সেই কুৎসিত রূপটিও চলে গেছে। এখন তার অপূর্ব সুন্দর রূপ। ওই তো তার সুন্দর রূপে আকৃষ্ট হয়ে সবাই তাকে ভালবাসতে এগিয়ে আসছে। আজ তার কত আদর! সে আজ কত সুখী!

এই যে ভারি মজার গল্পটি, যার নাম ‘কুৎসিত রাজহাঁস’ (The Ugly Duckling), এই গল্পেরই জনকের নাম হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন (Hans Christian Anderson)। অনেকে বলেন, এটা নাকি তাঁর নিজেরই জীবনের কাহিনী।

ওই ঢ্যাঙা হাঁসের বাচ্চাটির মতোই নাকি তাঁরও বাল্যকালে চেহারা ছিল ভারি কুৎসিত। লম্বা ঢ্যাংঢ্যাঙা চেহারা। কোনো সৌন্দর্য ছিল না তাতে।

তাঁর জন্ম ১৮০৫ সালে ডেনমার্কের অডেন্স নামের এক ছোট্ট শহরে। বাবা ছিলেন এক গরিব কাঠমিস্ত্রি। ছোটবেলায় গরিব বলে ভালো স্কুলে তাঁর পড়ার সুযোগ হয়নি। বাড়িতে বাবার কাঠের কাজেও সাহায্য করতে হতো। পড়ার সময় মিলত খুবই কম।

এরই মধ্যে অ্যান্ডারসনের যখন এগারো বছর বয়স, তখনই তাঁর বাবা মারা যান। বাবা মারা যাবার পর তাঁদের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেল।

মাকেও শেষ পর্যন্ত কাজের ধান্দায় যেতে হতো বাইরে। ঘরে একা একা বসে থাকতেন অ্যান্ডারসন। ঘরে ছিল সস্তা খেলার জিনিস, আর কিছু গল্পের বই। অ্যান্ডারসনের দিন কাটত ওগুলো নিয়েই।

স্কুলেও অবশ্য পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলেন না অ্যান্ডারসন। না থাকারই কথা। পড়াশোনার সুযোগই তো তাঁর ছিল না। ভালো হবেন কেমন করে?

যখন তাঁর বয়স ১৪, তখনই তিনি ভাগ্যের অন্বেষণে নিজের শহর ছেড়ে চলে আসেন কোপেনহেগেনে। তাঁর ইচ্ছে ছিল তিনি থিয়েটারে অভিনেতা কিংবা গায়ক হবেন। কিন্তু এর কোনোটা হবারই যোগ্যতা তাঁর ছিল না। তাই ভাগ্যও সহসা সুপ্রসন্ন হল না তাঁর প্রতি।

তারপর ভাবলেন, আচ্ছা, অভিনয় যদি তাঁকে দিয়ে না হয়, তা হলে তিনি তো থিয়েটারের জন্য নাটক লিখতে পারেন। তাতেও পয়সা আসবে। কিন্তু একাজেও ভালো ফল মিলল না। তাঁর নাটক কেউ পছন্দই করল না। ঘুচল না তাঁর দারিদ্র্য।

তাঁর ছিলেন এক ধনী বন্ধু। তিনি লক্ষ্য করলেন ব্যাপারটি। তিনি দেখলেন, অ্যান্ডারসনের প্রতিভা আছে, কিন্তু অভাব শুধু সুযোগের আর সঠিক পথনির্দেশনার। তাঁর প্রতিভা কোন খাতে যে বেগবান হবে, তা-ই শুধু খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। পথ খুঁজে পেলেই তিনি সফলতা অর্জন করবেন, এটা নিশ্চিত। তাই ধনী বন্ধুটি লেখার ব্যাপারে উৎসাহ জোগাতে লাগলেন তাঁকে।

বন্ধুর উৎসাহেই নাটকে সমাদর না পেলেও একেবারে হাল ছেড়ে দিলেন না তিনি। চালিয়ে যেতে লাগলেন লেখা। কয়েকটি কবিতা, নাটক, নকশা ইত্যাদি লিখেও ফেললেন। এমনি করে তিনি ‘The improvisatore’ নামে একটি উপন্যাসও লিখে ফেললেন।

এই উপন্যাসটি কিন্তু বেশ নাম করে ফেলল, বাজারও পেল ভালো। অ্যান্ডরসনের জন্য বয়ে আনল খ্যাতি আর অর্থ—দুটোই।

এ ছাড়াও অ্যান্ডারসনের কিন্তু একটা মজার গুণ ছিল, যার কথা এখনও বলা হয়নি। তিনি মুখে-মুখে সুন্দর রূপকথার গল্প বানাতে পারতেন। আর বলতেও পারতেন খুব সুন্দর করে। পাড়ার ছেলেরা প্রতিদিন সন্ধেবেলা তাঁর কাছে এসে ভিড় করত গল্প শোনার জন্য। তিনি অপূর্ব ভঙ্গিতে এসব গল্প বলে তাদের খুশি করতেন।

শেষে একজন তাঁকে পরামর্শ দিলেন, তিনি যদি তাঁর এই মুখে বলা রূপকথার গল্পগুলো লিখে বই বের করেন, তা হলে খুবই মজার ব্যাপার হবে।

যদিও পরামর্শটা শুনে প্রথমটায় তিনি নিজেই হেসে ফেলেছিলেন, পরে নিছক মজা করার জন্যই লিখতে শুরু করলেন রূপকথার গল্প। একের পর এক।

শুধু মজা পাওয়ার জন্য লেখাই নয়, ১৮৩৫ সালে ‘রূপকথার গল্প’ (Fairy Tales) নামে প্রথম একটি বইও তিনি প্রকাশ করে ফেললেন।

আর তার পরই ঘটল অভাবনীয় কাণ্ড। তাঁর এসব মজার মজার গল্পে ভরা বই কেনার হিড়িক পড়ে গেল। এল প্রচুর অর্থ আর খ্যাতি। দেশসুদ্ধ মানুষ অ্যান্ডারসনের লেখা মজার রূপকথার গল্পের ভক্ত হয়ে গেল। সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর খ্যাতি। সেই কুৎসিত হাঁসের গল্পের মতোই ব্যাপার যেন। যে-হাঁসের বাচ্চাকে ছোটবেলায় সবাই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত, সে-ই এখন হয়ে গেল সেরা সুন্দর রাজহাঁস। সাহিত্যজগতের মধ্যমণি হয়ে উঠলেন অ্যান্ডারসন। যেখানেই যান তাঁকে সংবর্ধনা জানানো হয় রূপকথার রাজপুত্রের মতো করেই।

তাঁর উল্লেখযোগ্য রূপকথার গল্পগুলোর মধ্যে আছে ক্ষুদে জলপরি (The Little Mermaid) ও দি লিট্ল ম্যাচসেলার (The little matchseller)।

শেষ বয়সে এসে তিনি নিজের জীবনী লিখেছেন। সেও এক রূপকথার কাহিনী। তাঁর সেই আত্মকথার নাম দিয়েছেন ‘আজব গল্প’ (Wonder Stories)। তিনি শেষজীবনে এসে তাঁর জীবন সম্পর্কে বলেছিলেন, সত্যি পৃথিবীটা কত সুন্দর! আর আমি নিজেও কত সুখী!

তিনি কোপেনহেগেনেই মারা যান ১৮৭৫ সালে। এই শহরের সরকারি উদ্যানে স্থাপন করা হয়েছে তাঁর একটি মর্মর মূর্তি। আজও শত শত দর্শক, আবালবৃদ্ধবনিতা একবার এই মর্মর মূর্তির সামনে গিয়ে বিস্ময়ে দাঁড়ান। তাকিয়ে থাকেন তাদের প্রিয় রূপকথার রাজহাঁসের দিকে। আর অবনত মস্তকে তাঁকে জানান অপার শ্রদ্ধা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *