ক্রিটো

ক্রিটো

চরিত্রাবলি
সক্রেটিস
ক্রিটো

স্থান
সক্রেটিসের কারাকক্ষ

সক্রেটিস : রাত্রির এই সময়ে তুমি কেন এসেছ, ক্রিটো? এখন তো খুবই প্রত্যুষকালীন সময়–নয় কি?

ক্রিটো : হ্যাঁ, সক্রেটিস।

সক্রেটিস : কোন প্রহর এখন?

ক্রিটো : ভোর হওয়ার প্রাকমুহূর্ত

সক্রেটিস : কারা-প্রহরী তোমাকে প্রবেশের অনুমতি দিল। এটি বিস্ময়ের বিষয়।

ক্রিটো : আমি প্রায়শ যাতায়াত করি বলে প্রহরী আমাকে চিনে। তা ব্যতীত আমি প্রহরীর উপকারও করেছি।

সক্রেটিস : তুমি কি এইমাত্র এসেছ?

ক্রিটো : না, আমি কিছু পূর্বে এসে প্রবেশ করেছি।

সক্রেটিস : তা হলে আমাকে নিদ্রা থেকে না জাগিয়ে তুমি নীরব কেন বসেছিলে?

ক্রিটো : প্রিয় সক্রেটিস, তোমার পরিস্থিতিতে আমি নিজে নিক্ষিপ্ত হলে নিশ্চয় সহ্য করার ক্ষমতা আমার থাকত না। তোমার উদ্বেগ এবং বিপদের কথা আমি ভাবছিলাম এবং বিস্ময়ের দৃষ্টিতে এই উদ্বেগের মধ্যেও তোমার শান্তিপূর্ণ নিদ্রাযাপনকে দেখছিলাম। তোমাকে নিদ্রা থেকে জাগাতে আমার মন চায় নি। এই মুহূর্তে তোমার বেদনাকে হ্রাস করার ইচ্ছাই আমার মনে একান্ত হয়ে জাগছিল। তোমাকে সদানন্দ হিসাবেই আমি দেখে আসছি। কিন্তু বর্তমানের এই বিপর্যয়ের মুহূর্তে তোমার যে সৌম্য-শান্ত স্বভাব আমি দেখতে পাচ্ছি, এমনটি তোমার মধ্যে আমি পূর্বে আর কখনো দেখি নি।

সক্রেটিস : এতে বিস্ময়ের কি আছে, বন্ধু ক্রিটো? মৃত্যুর আগমন দেখে আমার মতো বৃদ্ধের দুঃখ পাওয়া কি সংগত?

ক্রিটো : কিন্তু তোমার ন্যায় অপর মানুষকেও তো এরূপ সঙ্কটে আমি দেখেছি। তাদের বার্ধক্য তো মৃত্যুর ভীতিকে হ্রাস করে নি।

সক্রেটিস : সে কথা সত্য। কিন্তু তুমি তো এখনো আমাকে বলে নি, কেন তুমি এত প্রত্যূষে কারাকক্ষে এসে প্রবেশ করেছ?

ক্রিটো : সক্রেটিস। এক মর্মান্তিক বার্তা আমি বহন করে এনেছি। আমি জানি, তোমার নিকট সে-সংবাদ বেদনাদায়ক নয়। কিন্তু আমরা যারা তোমার সুহৃদ এবং শুভাকাক্ষী তাদের নিকট এ সংবাদ অতীব হৃদয় বিদারক। বিশেষ করে আমার নিকট এ সংবাদের চেয়ে মর্মান্তিক সংবাদ অপর কিছুই আর হতে পারে না।

সক্রেটিস : কেন বন্ধু? ডেলস্ থেকে যে জাহাজ এসে পৌঁছার পর আমার মৃত্যু হওয়ার কথা, সে জাহাজ কি পৌঁছে গেছে?

ক্রিটো : না, সে জাহাজ প্রকৃতপক্ষে এখনো পোতাশ্রয়ে এসে পৌঁছে নি বটে, কিন্তু সুনিয়মে যে যাত্রীগণ জাহাজ থেকে অবতরণ করে এসেছে তারা বলেছে, সে জাহাজ অদ্যই এসে পৌঁছবে। সুতরাং প্রিয় সক্রেটিস! আগামী দিনটিই হবে তোমার জীবনের শেষ দিন।

সক্রেটিস : তাতে দুঃখের কি ক্রিটো? বিধাতার যদি সেরূপ ইচ্ছা থাকে, তা হলে আমি অবশ্যই প্রস্তুত রয়েছি। কিন্তু আমার বিশ্বাস, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে একদিন বিলম্ব ঘটবে।

ক্রিটো : তোমার এরূপ ভাববার কী কারণ, সক্রেটিস?

সক্রেটিস : বলছি। জাহাজ পৌঁছার দিনেই আমার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে-নয় কি?

ক্রিটো : হ্যাঁ, কর্তৃপক্ষ সেরূপই বলছেন।

সক্রেটিস : কিন্তু জাহাজ আগামী কালের পূর্বে এসে পৌঁছবে বলে আমি মনে করিনে। যে দৃশ্য আমি কিছু পূর্বে দেখেছি, বলতে পার, যে স্বপ্নটিকে আমার নিদ্রার বিঘ্ন না করে তুমি আমায় কিছুক্ষণ দেখার সুযোগ দিয়েছ, সে স্বপ্ন থেকেই আমি এরূপ অনুমান করছি।

ক্রিটো : কিরূপ স্বপ্ন তুমি দেখেছ–সক্রেটিস?

সক্রেটিস : আমি দেখলাম যেন উজ্জ্বল পরিচ্ছদভূষিত এক শান্ত এবং সৌম্য-কান্তি নারীমূর্তি আমার সম্মুখে উপস্থিত হয়ে আমাকে আহ্বান করে বলল : ‘আজ হতে তৃতীয় দিবসে তুমি উর্বর পিথিয়াভূমির উদ্দেশে যাত্রা করবে।’

ক্রিটো : কী অদ্ভুত স্বপ্ন, সক্রেটিস।

সক্রেটিস : ক্রিটো আমার তো মনে হয়, এ স্বপ্নের অর্থে কোনো সন্দেহ নেই।

ক্রিটো : হ্যাঁ, এ স্বপ্নের তাৎপর্য খুবই স্পষ্ট। আমার প্রিয়তম বন্ধু সক্রেটিস। আমার অনুরোধটি তুমি এখনও গ্রহণ কর। এসো, এ কারাকক্ষ থেকে তুমি পলায়ন কর। কেননা, তোমার মৃত্যুতে আমার অপূরণীয় এক সুহৃদেরই মৃত্যু ঘটবে না–অপর বিপদও দেখা দেবে। যারা তোমাকে এবং আমাকে ঘনিষ্ঠভাবে জানে না, তারা বলবে, ক্রিটো অর্থ ব্যয় করলেই সক্রেটিসকে বাঁচাতে পারত। কিন্তু ক্ৰিটো সেরূপ কোনো চেষ্টা করে নি। আমার প্রিয় বন্ধুর চেয়ে অর্থকে আমি অধিক মূল্যবান মনে করেছি–আমার বিরুদ্ধে এর চেয়ে লজ্জাজনক অভিযোগ কি আর হতে পারে? অথচ অধিকাংশ লোকই একথা জানবে না যে, আমি তোমাকে পলায়ন করবার জন্য অনুরোধ করেছি–কিন্তু তুমি আমার সে অনুবোধ প্রত্যাখ্যান করেছ।

সক্রেটিস : প্রিয় বন্ধু ক্রিটো! সাধারণ মানুষের মতামতের জন্য আমরা কেন উদ্বিগ্ন হব? যারা মহৎ তারা অবশ্যই প্রকৃত পরিস্থিতিকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন।

ক্রিটো : সক্রেটিস। সংখ্যাধিক্যের মতামতকে আমরা উপেক্ষা করব কী করে? তুমি দেখতেই পাচ্ছ, যা ঘটেছে তাতেই প্রমাণিত হচ্ছে, সংখ্যাধিক জনসাধারণ, কারো উপর রুষ্ট হলে তার চরম অনিষ্ট সাধনে তারা সক্ষম।

সক্রেটিস : ক্রিটো, সংখ্যাধিক মানুষের যদি চরম অনিষ্ট সাধনের ক্ষমতা থাকত তা হলে তো উত্তমই হতো। কেননা, তা হলে তাদের পরম ইষ্ট বা ন্যায় সাধনেরও ক্ষমতা থাকত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাধিক সাধারণ মানুষের ন্যায় কিংবা, ইষ্ট বা অনিষ্ট কোনোটিই সাধন করার ক্ষমতা নেই। কেননা, তারা কোননা মানুষকে জ্ঞানী কিংবা মূর্খ কিছুতে পরিণত করতে পারে না। তারা যা কিছু না করে সে-তা কেবল আকস্মিকতারই প্রকাশ।

ক্রিটো : আজ আমি তোমার সাথে তর্কে রত হব না, সক্রেটিস। শুধু তুমি আমায় বল, তুমি কি আমাদের বিপদের কথা চিন্তা করে আমার অনুরোধকে অগ্রাহ্য করছ? তুমি কি ভাবছ, তুমি পলায়ন করলে আমরা তোমাকে সরিয়ে দিয়েছি বলে প্রহরীগণ আমাদেরকে অভিযুক্ত করবে এবং দণ্ড হিসাবে আমাদের বিষয়-সম্পত্তি সম্পূর্ণ কিংবা বিরাট অংশ বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে? তুমি কি উদ্বিগ্ন হচ্ছে এই ভেবে যে, এর চেয়েও কঠিন কোনো দণ্ডে আমরা দণ্ডিত হতে পারি? আমাদের ভবিষ্যতের জন্য যদি তুমি উদ্বিগ্ন হয়ে থাকে, তা হলে আমার অনুরোধ, এ বিষয়ে তুমি নিশ্চিত হয়ো। তোমার জন্য এরূপ কিংবা এর চেয়েও গুরুতর বিপদের ঝুঁকি নেওয়া আমাদের কর্তব্য। আমাদের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ো না সক্রেটিস। এবার তুমি আমার অনুরোধটি রক্ষা কর এবং আমি যেরূপ বলি সেরূপ করতে সম্মত হও।

সক্রেটিস : তোমাদের জন্য আমার আশঙ্কা অবশ্যই একটা কারণ। কিন্তু একমাত্র সে কারণেই আমি অসম্মত হচ্ছিনে।

ক্রিটো : সক্রেটিস, তুমি আমাদের জন্য আশঙ্কা বোধ করো না। তোমাকে সঙ্গোপনে মুক্ত করে নেওয়ার জন্য অনেক নাগরিকই প্রস্তুত রয়েছে। সেজন্য বিপদের আশঙ্কাও তেমন নেই। প্রহরীগণের উৎকোচের দাবিও এমন অধিক কিছু নয়। সামান্য কিছু অর্থ দিলেই তারা সন্তুষ্ট হবে। অর্থ-সংগ্রহের প্রশ্নে তুমি জানো না যে, আমার সমগ্র ধন-সম্পদ তোমার সেবায় নিযুক্ত রয়েছে, সক্রেটিস। কিন্তু আমার অর্থব্যয়ে যদি তোমার সঙ্কোচ হয় তা হলে একথা জেনো যে অনেক অপরিচিত নাগরিক রয়েছেন যারা তাদের সব অর্থ দ্বারা তোমাকে সাহায্য করতে চাইবেন। এমনি একজন নাগরিক হচ্ছেন থিবের সিমিয়াস। তিনি এই উদ্দেশ্যেই প্রচুর অর্থ সঙ্গে করে এনেছেন। সিবিস এবং অন্যান্য নাগরিকও তোমার পলায়নে সাহায্য করার জন্য তাদের সমস্ত সম্পদ ব্যয় করতে প্রস্তুত রয়েছেন। সুতরাং সক্রেটিস, তুমি আমাদের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে আমাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করো না। বিচারালয়ে তুমি বলেছিলে, তুমি বুঝতে পারছ না, এথেন্স থেকে অপর কোথাও গিয়ে তুমি কী করবে। এরূপ কথাও তুমি আর বলো না। কেননা, শুধু এথেন্স নয়, তুমি যেখানেই যাবে সেখানেই তুমি সর্বসাধারণের প্রিয়পাত্র হয়ে থাকবে। থেসালীতে আমার অনেক বন্ধু রয়েছে। তুমি যদি থেসালী যেতে চাও, তা হলে থেসালীবাসীগণ তোমাকে সম্মানের সঙ্গে সমস্ত অনিষ্ট থেকে সর্বপ্রকারেই রক্ষা করবে। সক্রেটিস। আজ যখন তোমার জীবনকে আমরা রক্ষা করতে পারি, তখন তোমার পক্ষে সে জীবনকে শত্রুর নিকট সমর্পণ করে দেওয়ার তাৎপর্যটি আমরা বুঝতে পারিনে। তোমার এরূপ কার্যক্রম দ্বারা যে শত্রুগণ তোমাকে যত শীঘ্র সম্ভব ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করছে, তাদের উদ্দেশ্যই সাধিত হবে। তদুপরি আজ তুমি নিজের জীবন বাঁচাতে অস্বীকার করে আপন সন্ততিকেও পরিত্যাগ করে যাচ্ছ। তোমার জীবন রক্ষা করে তুমি তাদের শিক্ষিত করে তুলতে পার। তৎপরিবর্তে তুমি আজ তাদেরকে অনিশ্চিত ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়ে চলে যাচ্ছ। হয়তো তাদের জীবনে অনাথের স্বাভাবিক ভাগ্যই ঘটবে। যদি তা নাও ঘটে তা হলেও সেজন্য তোমার কৃতিত্ব তো কিছু থাকবে না। কিন্তু তুমি তো জানো যে পিতা তার সন্তানদের লালন-পালন এবং শিক্ষার দায়িত্ব বহনে অনিচ্ছুক তার পক্ষে এ পৃথিবীর বুকে কোনো শিশুকে জন্মদান করে নিয়ে আসাই উচিত নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় সক্রেটিস, তুমি তোমার সমগ্র জীবনে ন্যায়পরায়ণতার আদর্শ অনুসরণ করার কথা বলা সত্ত্বেও আজ তোমার পক্ষে সংগত এবং উপযুক্ত, মহত্তর এবং দৃঢ়তর যে-পথ, সে-পথ অবলম্বন না করে তুমি যেন সহজতর পথকেই গ্রহণ করছ। যখন আমি উপলব্ধি করি যে, সমগ্র বিষয়টির কারণ হিসাবে ভবিষ্যৎ বংশধরগণ আমাদের সাহসের অভাবকেই উল্লেখ করবে, তখন শুধু তোমার জন্য নয়, আমরা, যারা তোমার বন্ধু রয়েছি, তাদের জন্যও লজ্জায় ডুবে যাই। এই বিচার আদৌ সংঘটিত হতে পারত না। হলেও ব্যাপারটিকে অন্যভাবেও শেষ করা যেত। কিন্তু ভবিষ্যৎ বলবে, যে চরম মূর্খতা আজ অনুষ্ঠিত হতে চলেছে, সে শুধু আমাদের অবহেলা এবং কাপুরুষতার জন্যই সম্ভব হয়েছে। কেননা, আমরা সত্যকার মানুষ হলে, অবশ্যই তোমাকে রক্ষা করতে পারতাম এবং তুমিও কোনো প্রকার অসুবিধা ব্যতিরেকেই নিজের জীবন বাঁচাতে পারতে। প্রিয় সক্রেটিস, তুমি অনুধাবন কর, তোমার এবং আমাদের সবার জন্য এই ঘটনা কী নিন্দনীয় পরিণামকে ডেকে আনবে। তাই প্রিয়বন্ধু, তোমার মন স্থির কর, আলোচনা করার সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এখন একটিই মাত্র করণীয় আছে। সে কাজ অদ্য রাত্রিতেই সম্পন্ন করতে হবে। বিলম্বে এ কাজ সম্পন্ন করা কোনো প্রকারেই সম্ভব হবে না। যা করে বলছি, সক্রেটিস, এখনও তুমি আমার কথা শ্রবণ কর, এখনও আমি যেরূপ বলছি সেরূপ করতে সম্মত হও।

সক্রেটিস : প্রিয় ক্রিটো, তোমার উৎসাহ অপরিসীম। সে উৎসাহ যদি ন্যায্য হয় তা হলে

সে অবশ্যই অমূল্য। কিন্তু সে উৎসাহ যদি ভ্রান্ত হয়, তা হলে উৎসাহ যত অধিক হবে, বিপদের আশঙ্কাও তত বৃদ্ধি পাবে। এ কারণেই আমাদের বিশেষভাবে বিচার করা প্রয়োজন, তুমি যেরূপ বলছ, সেরূপ আমার করা কর্তব্য কি না। তুমি জানো, আমি যুক্তিবাদী মানুষ। আমার সমগ্র জীবনের আমি যুক্তি দ্বারাই পরিচালিত হয়েছি। যুক্তি যাই হোক, সে যদি আমার নিকট সঠিক বলে বোধ হয়েছে, তা হলে তাকেই আমি শিরোধার্য করেছি। আজ মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে জীবনকে রক্ষা করার সুযোগ পেয়ে আমি আমার নিজের কথাকে অস্বীকার করতে পারিনে; আমার যে নীতিকে আমি সমগ্র জীবনব্যাপী সম্মান করেছি এবং অনুসরণ করেছি, আজ তার চেয়ে উত্তম কোনো নীতির সাক্ষাৎ না পেলে, সে নীতিকে আমি বর্জন করে তোমার সঙ্গে একমত হতে পারিনে। সংখ্যাধিক জনসাধারণ তার শক্তিতে যদি আমার উপর অধিকবার কারাবাসের দণ্ড আরোপ করে, যদি আমার ধনসম্পদ সে বাজেয়াপ্ত করে, যদি সে আমার জীবনকে বহু মৃত্যুর দণ্ডেও দণ্ডিত করে, যদি সে প্রেত-উপচ্ছায়ার ভয় দেখিয়ে আমাকে শিশুর ন্যায় ভীত করেও তোলে,–না, তা হলেও আমার নীতিকে আমি পরিত্যাগ করতে পারিনে। সমস্যাটিকে আলোচনা করার সর্বোত্তম পন্থা কী? জনসাধারণের মতামত সম্পর্কে তোমার পূর্বযুক্তিতে কি আমরা ফিরে যাব? আমরা বলেছিলাম, জনসাধারণের মত বলতে আমরা যা বুঝি তার সব কিছু গ্রাহ্য নয়। কেবল কোনো বিশেষ মতকে গ্রাহ্য করা চলে। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার পূর্ব আমি এরূপ কথাই বলেছিলাম। তখন সে মতটি পোষণ করা কি আমার পক্ষে ঠিক হয়েছিল? যদি তা হয়ে থাকে তা হলে এখন কি তাকে কথার জন্য কথা মনে করে কিংবা শিশুসুলভ অর্থহীন প্রলাপ বলে পরিত্যাগ করব? বন্ধু ক্রিটো, এটিই আমার বিবেচ্য। এ বিষয়ে তুমি আমায় সাহায্য কর। তুমি বল, আমার বর্তমান অবস্থায় আমার পুরাতন যুক্তি কি তার তাৎপর্য হারিয়ে ফেলেছে কিংবা সে অপরিবর্তিত রয়েছে? সে যুক্তি কি আমি বর্তমানে অস্বীকার করব না স্বীকার করব? পুরাতন সেই যুক্তিটির কথা উল্লেখ করছি। প্রখ্যাত অনেকেই এই যুক্তিটি স্বীকার করেন। তারা বলেন, সাধারণ মানুষের সব অভিমতই গ্রাহ্য নয়। কিছু সংখ্যক মানুষের মত অনেক সময়ে গ্রহণীয় হয়, কিন্তু অপর সবার মত গ্রহণোপযোগী হয় না। ক্রিটো, এবার তোমার নিকটই আমি প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করছি। তুমি নিশ্চয়ই আমার ন্যায় আগামী কল্য মৃত্যুমুখে পতিত হবে না। আগামীকাল তোমার মৃত্যু ঘটবে, এরূপ কোনো মানবিক সম্ভাবনা আমরা কল্পনা করতে পারিনে। তা যদি না হয়, তা হলে। তুমিই হচ্ছ এ পরিস্থিতিতে নিঃস্বার্থ এবং নিরপেক্ষ ব্যক্তি। তুমিই এ প্রশ্নের জবাব দানের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। তা হলে তুমি বল, আমার একথা কি যথার্থ যে কিছু লোকের মতকে আমাদের মূল্য দেওয়া উচিত, কিন্তু অপর সবার মতকে আমাদের মূল্য দেওয়া উচিত নয়। তুমি বল, একথা আমি যখন বলেছিলাম তখন কি আমি সঠিক বলেছিলাম?

ক্রিটো : অবশ্যই।

সক্রেটিস : যা ন্যায্য তাকেই তো আমরা স্বীকার করব–অন্যায়কে তো নয়?

ক্রিটো : হ্যাঁ।

সক্রেটিস : জ্ঞানীর অভিমতই ন্যায্য এবং মঙ্গলকর; মূখের অভিমত অন্যায্য এবং অমঙ্গলকর।

ক্রিটো : অবশ্যই।

সক্রেটিস : অপর একটি বিষয়ে আমরা কি বলেছিলাম? শারীরবিদ্যার যে ছাত্র সে কি যে-কোনো ব্যক্তির নিন্দা কিংবা প্রশংসাকে গ্রহণ করবে? না, সে একটিমাত্র লোকের মতামত অর্থাৎ তার শিক্ষাদাতা যেই হোক না কেন, শুধু তারই মতামতকে সে মান্য করবে?

ক্রিটো : হ্যাঁ, একটিমাত্র লোকের অভিমতকেই সে মান্য করবে।

সক্রেটিস : সেই লোকটির নিন্দাকে তার ভয় করা উচিত; সেই লোকটির প্রশংসাকেই। তার স্বাগত জানানো উচিত, সংখ্যাধিকের নয়। তাই নয় কি?

ক্রিটো : অবশ্যই একথা সত্য।

সক্রেটিস: কিন্তু তা না করে সে যদি সেই এক ব্যক্তির মতামতকে উপেক্ষা করে এবং যে সংখ্যাধিক্যের বিষয়টি সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই তাদের মতের মূল্য দেয়, তা হলে পরিণামে সে কি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

ক্রিটো : অবশ্যই সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সক্রেটিস : বেশ! তা হলে এই ক্ষতি সেই অবাধ্য ছাত্রকে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে?

ক্রিটো : এক্ষেত্রে অবশ্য তার দেহই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সক্রেটিস : উত্তম কথা। তা হলে ক্রিটো, এই সাধারণ কথাটি কি অপরাপর বিশেষ ক্ষেত্রের জন্যও সত্য নয়? সেই বিশেষ ক্ষেত্রগুলিকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বর্ণনা করা এখানে নিষ্প্রয়োজন। আমাদের বিবেচনার বিষয় হচ্ছে : ন্যায়, অন্যায়, সৎ, অসৎ, সংগতি অসংগতির বিষয়। এসব ক্ষেত্রে আমরা কি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকেই ভয় করব, মান্য করব? অথবা যে একটিমাত্র ব্যক্তির এ সম্পর্কে জ্ঞান আছে তার মতকেই স্বীকার করব? এই জ্ঞানীর অভিমতকেই প্রয়োজনবোধে সমগ্র জগতের মতের বিরুদ্ধেও আমাদের সম্মান করা এবং ভয় করা উচিত নয় কি? তা না করে, যদি আমরা সেই জ্ঞানীকেই পরিত্যাগ করি, তা হলে কি তদ্বারা আমারা আমাদের সেই নীতিকেই আঘাত করে ধ্বংস করি না, যে নীতি ন্যায়ের সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত এবং উন্নীত হয়ে ওঠে এবং অন্যায়ের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়? এরূপ নীতি তো অবশ্যই একটি রয়েছে। নয় কি?

ক্রিটো : অবশ্যই এরূপ নীতি রয়েছে, সক্রেটিস।

সক্রেটিস : অনুরূপ অপর একটি দৃষ্টান্ত ধরা যাক : ধর দেহ সম্পর্কে যাদের জ্ঞান নেই, তাদের উপদেশকেই মান্য করে আমরা সেই বস্তুকেই বিনষ্ট করলাম, যে বস্তু বা সম্পদকে স্বাস্থ্য উন্নত করে তোলে এবং রোগ যাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে। তা হলে আমাদের জীবন কি বাঁচার উপযুক্ত থাকবে? এখানে যে সম্পদ আমাদের ধ্বংস হলো, সে নিশ্চয়ই আমাদের দেহ। তাই নয় কি?

ক্রিটো : হ্যাঁ।

সক্রেটিস : আমরা কি দুষ্টক্ষতে ক্ষত-বিক্ষত দেহ নিয়ে জীবনধারণ করতে চাইব?

ক্রিটো : অবশ্যই তা চাইব না।

সক্রেটিস : বেশ! কিন্তু মানুষের যেটি উচ্চতর দিক, অর্থাৎ যাকে উন্নত করে এবং অন্যায় যাকে বিকৃত করে, তাকে ধ্বংস করে জীবনধারণের কি যথার্থই কোনো মূল থাকে? মানুষের যে নীতির কিংবা যে চরিত্রের আমরা উল্লেখ করলাম, তাকে কি আমরা দেহের তুলনায় হীন মনে করব?

ক্রিটো : না, সেরূপ আমরা কিছুতেই মনে করতে পারিনে।

সক্রেটিস; বরঞ্চ, তাকে দেহের চেয়ে আমরা অধিকতর সম্মানীয় মনে করব?

ক্রিটো : অবশ্যই অধিকতর সম্মানীয় মনে করব।

সক্রেটিস : প্রিয় বন্ধু, তা হলে সংখ্যাধিক মানুষ আমাদের সম্পর্কে কী বলল, সেটি আমাদের নিকট মূল্যবান নয়। আমাদের নিকট মূল্যবান হচ্ছে, ন্যায় এবং অন্যায়কে যিনি জানেন তিনি কী বলেন। আমাদের নিকট মূল্যবান হচ্ছে, সত্য কী বলে। সুতরাং ক্ৰিটো, তুমি যখন বল ন্যায়-অন্যায়, সৎ-অসৎ, সম্মানীয়-অসম্মানীয় সম্পর্কে সংখ্যাধিকের মতকে আমাদের সমীহ করতে হবে, তখন তুমি শুরুতেই ভুল কর। আমার একথার জবাবে নিশ্চয়ই বলা হবে: কিন্তু সংখ্যাধিক তো শক্তির জোরে আমাদের হত্যা করতে পারে।

ক্রিটো : হ্যাঁ, সক্রেটিস, তোমার জবাব হিসাবে স্পষ্টতই সে প্রশ্ন উঠবে।

সক্রেটিস : হ্যাঁ আমিও সে কথা স্বীকার করি। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গেই আমি অনুভব করছি যে তা সত্ত্বেও আমাদের পুরাতন যুক্তির ভিত পূর্বের ন্যায়ই দৃঢ়মূল থেকে যায়। এই প্রসঙ্গে আমি আর একটি কথাও তোমার নিকটে জানতে চাই। আমাদের নিকট কি শুধুমাত্র জীবন মূল্যবান, না একটি মহৎ জীবনই প্রধানত মূল্যবান?

ক্রিটো : এখানেও পুরাতন মতটিই সঠিক। মহৎ জীবনই মূল্যবান।

সক্রেটিস : এবং মহৎ জীবনই ন্যায় এবং সম্মানের জীবন, পুরাতন একথাও তা হলে সত্য?

ক্রিটো : হ্যাঁ, একথাও সত্য।

সক্রেটিস : এ সমস্ত উদাহরণ থেকে এবার আমি আমাদের বিষয়টি আলোচনা করতে চাই–অর্থাৎ এথেন্সবাসীগণের সম্মতি ব্যতিরেকে কারাগার থেকে জীবন রক্ষার্থে আমার পলায়নের চেষ্টা করা উচিত, কিংবা উচিত নয়? আমার এ প্রশ্নের জবাব যদি এই হয় যে, পলায়ন করা আমার পক্ষে সংগত, তা হলে অবশ্যই আমি সে চেষ্টা করব। কিন্তু জবাব যদি এই যে, এ কাজ আমার পক্ষে সংগত নয়, তা হলে এরূপ চেষ্টা থেকে আমি অবশ্যই বিরত থাকব। ক্রিটো, এই বিচারের বাইরে তুমি আমার সাহসের অভাব, কিংবা আর্থিক ক্ষতি, কিংবা আমার সন্তান-সন্ততিকে পরিত্যাগ করা এবং তাদের শিক্ষিত না করার যে প্রশ্ন উত্থাপন করেছ, সেসব অবশ্যই সংখ্যাধিক সেই জনতারই মতো যারা যেমন বিনা কারণে উত্তেজিত হয়ে এক ব্যক্তির জীবন গ্রহণ করতে দ্বিধা করে না, তেমনি আবেগের মধ্যে বিন্দুমাত্র কারণ ব্যতিরেকেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তির জীবন অতি সহজে ফিরিয়ে দিতেও ইতস্তত করে না। কিন্তু আমাদের যুক্তি যেরূপ অগ্রসর হয়েছে, সেক্ষেত্রে আমাদের বিবেচ্য হচ্ছে যে, কারাগার থেকে পলায়ন করে কারো ইষ্ট বা অনিষ্ট সাধন আমার পক্ষে সংগত কিংবা অসংগত ন্যায় কিংবা অন্যায়? যদি এ কার্য অসংগত হয়, তা হলে কারাগারে আমার মৃত্যু কিংবা অপর কোনো বিপর্যয়ের কারণে আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হতে পারে না।

ক্রিটো : সক্রেটিস, তোমার যুক্তিই সঠিক বলে বোধ হচ্ছে। কিন্তু আমরা এখন কী করবো?

সক্রেটিস : এসো, আমরা উভয়ে মিলে বিষয়টি বিবেচনা করি। তুমি আমার যুক্তিকে খণ্ডন করতে সক্ষম হলে, আমি অবশ্যই তোমার যুক্তিকে মেনে নেব। নয়তো, প্রিয় বন্ধু, আমাকে তুমি আর এরূপ বল না যে, এথেন্সবাসীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারাগার থেকে আমার পলায়ন করা উচিত। আমার জীবন রক্ষার্থে তুমি যেভাবে আমাকে তোমার পরামর্শ গ্রহণ করাবার চেষ্টা করেছ তাতে সে চেষ্টাকে আমি অবশ্যই মূল্যবান মনে করি। কিন্তু আমি যে যুক্তিকে অধিকতর উত্তম মনে করি তার বিরুদ্ধাচরণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ক্রিটো, এবার তুমি আমার প্রথম প্রশ্নটির জবাব দেবার চেষ্টা কর।

ক্রিটো : হ্যাঁ, আমি সে চেষ্টাই করব।

সক্রেটিস : অপরের প্রতি অন্যায় করার ব্যাপারে আমরা কী মত পোষণ করব? আমরা কি বলব যে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে কখনোই কারো অন্যায় করা উচিত নয়? অথবা বলব, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্যায় করা সংগত, কিন্তু অপর ক্ষেত্রে অন্যায় করা অসংগত? অথবা বলব, অন্যায় সর্বদাই পাপ এবং অসম্মানজনক? একথাই আমি কিছুক্ষণ পূর্বেও বলেছি। এই মতকে আমরা গ্রহণও করেছি। এসব মতকেই কি আমরা এখন পরিত্যাগ করব? যে সত্য দুদিন পূর্বে আমি উচ্চারণ করেছি, সে কি আজ মিথ্যায় পরিণত হয়েছে? সমগ্র জীবনব্যাপী আমরা গুরুত্ব সহকারে যেসব বিষয় নিয়ে আলাপ করে এসেছি আজ এই বৃদ্ধ বয়সে তাকে কি এই বলে অস্বীকার করব যে, আমরা শিশু বই অপর কিছু নই? অথবা, সংখ্যাধিক জনতা যাই বলুক না কেন, পরিণতি আমাদের ভালো কিংবা মন্দ, যাই হোক, আমরা যে সত্যকে সেদিন উচ্চারণ করেছি, আজও তাকে ঘোষণা করব, বলব, যা অন্যায় তা সর্বদাই অন্যায়; বলব, অন্যায় কার্য অন্যায়কারীকেই অসম্মানের পাঁকে নিক্ষেপ করে। আমরা কি এ অভিমত পোষণ করব, না একে পরিত্যাগ করব?

ক্রিটো : নিশ্চয়ই আমরা এই অভিমত পোষণ করব।

সক্রেটিস : তা হলে, কোনো অন্যায় কার্য আমরা করতে পারি ন?

ক্রিটো : অবশ্যই না।

সক্রেটিস : এমনকি যে আহত, সে যদি আমাকে আঘাত করে তা হলেও আমি তাকে প্রত্যাঘাত করতে পারি না? কেননা, কাউকে আঘাত করা অন্যায়।

ক্রিটো : হ্যাঁ অন্যায়। কাউকে আমরা আঘাত করতে পারি না।

সক্রেটিস : বেশ, তা হলে আমরা কি কোনো পাপকাৰ্যও করতে পারি?

ক্রিটো : না সক্রেটিস, তাও আমরা পারি না।

সক্রেটিস : কিন্তু পাপের বিনিময়ে পাপ সম্পর্কে তুমি কী বলবে? অনেকে তো এই নীতিকেই সমর্থন করে। এ নীতি কি ন্যায় কিংবা অন্যায়?

ক্রিটো : এ নীতি ন্যায়নীতি নয়।

সক্রেটিস : কেননা, কারো প্রতি কোনো পাপাঁচরণ করা তাকে আঘাত করে আহত করারই শামিল। নয় কি?

ক্রিটো : একথা অবশ্যই ঠিক।

সক্রেটিস : তা হলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অন্যায়ের দ্বারা কখনো আমরা কারো উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারি না। তার নিকট থেকে যত অন্যায় ব্যবহারই আমি পেয়ে থাকি না কেন, তাকে প্রত্যাঘাত করা আমার পক্ষে সংগত নয়। কিন্তু ক্রিটো, তুমি যখন একথাটি স্বীকার কর, তখন তুমি গভীরভাবে বিবেচনা করে দেখ, যে কথা তুমি বলছ, তার সঠিক তাৎপর্য তুমি উপলব্ধি করছ কিনা এবং সেই অর্থই তুমি তোমার কথা দ্বারা বুঝাতে চাইছ কি না? কেননা, আমাদের এই মতটি সংখ্যাধিক্যের মধ্যে তুমি কখনো পাবে না। খুব অধিক লোক এরূপ মত কখনো পোষণ করে নি, কিংবা ভবিষ্যতেও করবে না। যারা এই মতটিকে স্বীকার করে এবং যারা একে অস্বীকার করে তাদের মধ্যে মিলনবিন্দু তুমি কোথাও পাবে না। তারা যখন পরস্পরের পার্থক্য এবং দূরত্বের গভীরতা উপলব্ধি করে, তখন উভয় উভয়কে ঘৃণার চোখেই দেখে। তা হলে তুমি চিন্তা করে বল আমার প্রথম নীতিটির সঙ্গে তুমি একমত কিনা? তুমি এ নীতি স্বীকার কর কিনা যে, পাপ কিংবা অন্যায় দ্বারা অন্যায়ের প্রতিশোধ গ্রহণ অসংগত। এমনকি আঘাত পরিহারের জন্যও অন্যায়ের আশ্রয় গ্রহণ কখনো সংগত হতে পারে না। অথবা তুমি এ মতটিকে গ্রহণ করতে সম্মত নও? আমি সমগ্র জীবনব্যাপী এরূপই চিন্তা করেছি। এখনো আমি অনুরূপভাবেই চিন্তা করি। তোমার যদি ভিন্নতর কোনো মত থাকে তা হলে সে মত আমার নিকট প্রকাশ কর। কিন্তু তুমি যদি পূর্বের মতেই স্থির থাকে, তবে তাও প্রকাশ কর। তা হলে যুক্তির পরবর্তী ধাপ নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি।

ক্রিটো : আমি আমার মত পরিবর্তন করি নি। সক্রেটিস, তুমি তোমার যুক্তিতে অগ্রসর হতে পারো।

সক্রেটিস : আমি তা হলে পরবর্তী বিষয়টিতে যেতে পারি। বিষয়টিকে একটি প্রাকারে উপস্থিত করা যায়, যেমন : ব্যক্তির পক্ষে কী করা সংগত? যাকে সে সত্য বলে জানে সে কি সেই সত্যকে রক্ষা করবে, সেই সত্যকে পালন করবে, না সে সত্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করবে?

ক্রিটো : যা সে সত্য বলে জানে তাই তার করা কর্তব্য।

সক্রেটিস : বেশ, তাই যদি হয় তা হলে এ নীতির প্রয়োগ আমার ক্ষেত্রে কীরূপে হবে? এথেন্সবাসীদের ইচ্ছায় বিরোধী হয়ে আজ যদি আমি কারাগার থেকে পলায়ন করি, তা হলে আমার সে কাৰ্যদ্বারা কি কারো প্রতি কোনো অন্যায় আচরণ করা হবে না? অথবা বল, এরূপ কার্য দ্বারা কি আমি তাদের প্রতিই সবচেয়ে বেশি অন্যায় করব না, যাদের প্রতি কোনো অন্যায় করাই আমার উচিত নয়? আমার এ কার্যের অর্থ কী, সে সমস্ত নীতিকেই পরিত্যাগ করা নয় যে সমস্ত নীতিকে এ যাবৎ আমরা ন্যায়সংগত বলে স্বীকার করে এসেছি? তুমি কি বল ক্রিটো?

ক্রিটো : এ প্রশ্নের জবাবদানে আমি অক্ষম। এর উত্তর জানিনে, সক্রেটিস।

সক্রেটিস : তা হলে বিষয়টিকে এভাবে দেখ : মনে কর, আমি স্কুলের বালকের ন্যায়ই অবাধ্য হয়ে উঠলাম। আমার বিদ্রোহ দেখে রাষ্ট্র এবং আইন আমাকে এসে জেরা করতে শুরু করল : সক্রেটিস, তোমার এরূপ কার্যের তাৎপর্য কী? তুমি কি তোমার কাৰ্যদ্বারা সমগ্র আইন এবং রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকেই উচ্ছেদ করার প্রয়াস পাচ্ছ না? বল তুমি, যে রাষ্ট্রের আইনসমূহ বাধ্যতার সঙ্গে পালিত হয় না, ব্যক্তি যে রাষ্ট্রের আইনকে উপেক্ষা করে এবং পদদলিত করে, সে রাষ্ট্র কি টিকে থাকতে পারে?’ বন্ধু ক্রিটো, এরূপ প্রশ্নের আমরা কী জবাব দেব? রাষ্ট্রের যে-কোনো বিধান যে পালিত হওয়া উচিত, যে-কোনো দণ্ড যে কার্যকর করা সংগত–এ নিয়ে যে-কোনো ব্যক্তি বিশেষ করে যে-কোনো বাগী যথেষ্ট বক্তৃতা করতে পারেন। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সে একথাই বলবে যে, রাষ্ট্রের বিধানকে ভঙ্গ করা সংগত নয়। আমরা তার জবাবে কী বলব? আমরা হয়তো বলতে পারি : বিধান মান্য করা সংগত। কিন্তু রাষ্ট্র আমাদের প্রতি ন্যায্য বিধান আরোপ করে নি; রাষ্ট্র অন্যায় দণ্ডে আমাদের দণ্ডিত করেছে। মনে কর, রাষ্ট্রকে আমি এই জবাবটিই দিলাম।

ক্রিটো : অত্যন্ত উত্তম জবাব, সক্রেটিস।

সক্রেটিস : কিন্তু রাষ্ট্র পাল্টা প্রশ্ন করবে : সক্রেটিস, তোমার সঙ্গে কি আমার এরূপ চুক্তি ছিল? অথবা তুমি রাষ্ট্রের সমগ্র বিধি-ব্যবস্থাকে মান্য করতে সম্মত হয়েছিলে এবং সম্মতির ভিত্তিতেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল? আমি যদি রাষ্ট্রের এরূপ প্রশ্নে বিস্মিত হই তা হলে সে হয়তো আরো বলবে : সক্রেটিস, বিস্মিত হয়ে আমার প্রশ্নের দিকে না তাকিয়ে আমার প্রশ্নের জবাব দাও। বল, রাষ্ট্র তোমার প্রতি কি অন্যায় করেছে যেজন্য তুমি তাকে ধ্বংস করে ফেলা সংগত মনে করছ? অথচ, রাষ্ট্রই কি এই পৃথিবীতে তোমার জন্মলাভের কারণ নয়? এই রাষ্ট্র-ব্যবস্থাতেই তোমার পিতা তোমার জননীকে একদা বিবাহ করেছিলেন এবং তোমার জন্ম সম্ভব হয়েছিল। আমরা, রাষ্ট্রের যে বিধানসমূহ বিবাহ-ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করি তার বিরুদ্ধে কি তোমার কোনো অভিযোগ রয়েছে? বল।

রাষ্ট্রের এ প্রশ্নের জবাবে অবশ্যই আমাকে বলতে হবে; না, এ বিধানের বিরুদ্ধে আমি বিদ্রোহ করতে চাইনে?’ বিধান বলবে; তুমি কি সে বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চাও যে বিধান দ্বারা আমরা রাষ্ট্রের শিশুদের লালন পালন এবং শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করি? কিন্তু তুমি তো এই বিধানের জন্যই শিক্ষিত হতে পেরেছ। যে বিধান তোমাকে সংগীত এবং শারীরবিদ্যায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য তোমার পিতাকে আদেশ করেছিল, সে বিধান কি সংগত ছিল না? এ প্রশ্নের জবাবেও আমাকে অবশ্যই বলতে হবে : হ্যাঁ, এ বিধান অবশ্যই সংগত ছিল। বিধান বলবে : যে-তোমাকে আমরা এই পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হতে সাহায্য করেছি, যে-তুমি নির্দিষ্ট বিধানসমূহের জন্যই শিক্ষিত হয়ে উঠেছ, সে-তুমি কি আজ অস্বীকার করতে পার যে, এই কারণেই তোমার পিতাও যেরূপ, তুমিও সেরূপ রাষ্ট্র এবং বিধানেরই সন্তান; রাষ্ট্র এবং বিধানেরই বাধ্য দাস। আমাদের এ তত্ত্ব যদি সত্য হয়, তা হলে একথাও তোমাকে স্বীকার করতে হবে সক্রেটিস যে, রাষ্ট্রের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক সমানের সম্পর্ক নয়। সুতরাং একথাও তুমি বলতে পারো যে, তোমার প্রতি রাষ্ট্রের যা করার অধিকার আছে রাষ্ট্রের প্রতিও সেরূপ করার তোমার অধিকার আছে। কেননা, তোমার পিতা কিংবা প্রভু যদি তোমাকে কোনো তিরস্কার করেন, যদি তারা তোমাকে কোনো আঘাত করে কিংবা তোমার বিবেচিত অপর কোনো অন্যায় করেন, তা হলে তুমি কি অনুরূপভাবেই তোমার পিতা কিংবা প্রভুকে তিরস্কার করতে পার? কিংবা পার তাদের প্রতি আঘাত কিংবা অন্যায় করতে? তুমি কি বলবে, এরূপ করার তোমার অধিকার আছে? কিংবা অধিকার থাকলেও কি তাদের সঙ্গে এরূপ ব্যবহার করবে? নিশ্চয়ই না। তেমনিভাবে আমরা যদি বলি, বিধান এবং রাষ্ট্র হিসাবে তোমার জীবন মৃত্যুর মালিক আমরা, তোমাকে ধ্বংস করার অধিকার আমাদের আছে, তা হলে তুমি কি বলবে যে, তোমারও রাষ্ট্র এবং দেশকে ধ্বংস করার অধিকার রয়েছে? সক্রেটিস, তুমি ন্যায়ধর্মের প্রবক্তা বলে নিজেকে দাবি কর। তুমি কি ব্যক্তির এরূপ কার্যকে সংগত বলবে? তোমার ন্যায় দার্শনিক কি এ সত্য উপলব্ধি না করে পারে যে, জননী কিংবা জনক, কিংবা যে-কোনো পিতৃপুরুষের চেয়েই রাষ্ট্র অধিকতর পবিত্র, অধিকতর সম্মানীয় এবং অধিকতর মূল্যবান। পিতা যখন রাগান্বিত হন, তখন তাকে যেমন আমরা সম্মানের সঙ্গে এবং তার সঙ্গে তাঁর ক্রোধকে প্রশমিত করতে চাই, তেমনি এবং তার চেয়েও অধিকতর সম্মান এবং নম্রতার সঙ্গেই আমাদের পিতৃশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রের ক্রোধকে প্রশমিত করার চেষ্টা করা কর্তব্য। পিতাকে যেমন আমরা বুঝাতে চেষ্টা করি কিন্তু তিনি শান্ত না হলেও আমরা যেমন তাঁকে মান্য করি, তেমনি কোনো ক্রুদ্ধ বিধানকেও অধিকতর সম্মান ও ধৈর্যের সঙ্গে প্রশমিত এবং পরিবর্তিত করার প্রয়াস পাব, কিন্তু সক্ষম না হলে, রাষ্ট্রের বিধানকেই আমরা মান্য করব। যদি সে আমাদের প্রতি কারাগার কিংবা বেত্রাঘাতের দণ্ড দেয় তা হলেও সে দণ্ডকে আমরা নীরবে গ্রহণ করব; যদি সে সমরক্ষেত্রে আমাদের প্রেরণ করে এবং আমাদের সম্মুখে আহত হওয়ার কিংবা মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, তা হলেও সে আদেশ আমরা পালন করব; কেউ তার নির্দিষ্ট সংগ্রামের ক্ষেত্র থেকে পলায়ন করব না। কিংবা তার স্থান পরিবর্তন করে পশ্চাদপসরণ করব না। এমনিভাবে যুদ্ধক্ষেত্র কিংবা বিচারকক্ষ–সর্বত্র ব্যক্তি তার দেশ ও রাষ্ট্রের বিধান এবং আদেশকে মেনে চলবে। যদি কোনো বিধানকে ব্যক্তি অন্যায় মনে করে, সে বিধান যে অন্যায় একথা দেশকে সে বুঝাবার চেষ্টা করবে। কিন্তু ব্যক্তি যেমন কোনো ক্ষেত্রেই তার জনক কিংবা জননীকে আঘাত করতে পারে না, তেমনিভাবে সে তার দেশ ও রাষ্ট্রের প্রতিও কেনো আঘাত হানতে পারে না। আঘাতের কথাটি জনক-জননীর ক্ষেত্রে যতদূর সত্য এবং প্রযোজ্য, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কথাটি তার চেয়েও অধিক সত্য এবং অধিকতর প্রযোজ্য। ক্রিটো, রাষ্ট্র এবং বিধানের এই যুক্তির বিরুদ্ধে আমাদের কি জবাব আছে? রাষ্ট্রের বিধানের এ যুক্তি কি সংগত, না অসংগত?

ক্রিটো : আমার মনে হয়, রাষ্ট্রের এ যুক্তি সংগত।

সক্রেটিস : বিধান আমাকে উদ্দেশ করে আরো বলতে পারে : সক্রেটিস, একথা যদি সত্য হয় যে, তোমার বর্তমান কার্য দ্বারা তুমি আমাদের উপর আঘাত হানছ, তা হলে বিবেচনা করে দেখ, তোমার এরূপ কার্যের যুক্তি কি হতে পারে? আমরাই তোমার এই জগতে জন্মলাভের কারণ হয়েছি, আমরাই তোমাকে লালন-পালন করেছি, আমরাই তোমাকে শিক্ষিত করে তুলেছি। শুধু তাই নয়। তোমাকে এবং সমস্ত এথেন্সবাসীকে ব্যক্তি-স্বাধীনতা দিয়ে আমরা বলেছি : এথেন্সের কোনো নাগরিক বয়োপ্রাপ্ত এবং আমাদের নগর-ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমাদের ব্যবস্থাকে যদি পছন্দ না করে এবং যদি সে। এথেন্স নগরী পরিত্যাগ করে অপর কোনো নগর কিংবা উপনিবেশে চলে যেতে চায়, তা হলেও সেরূপ করার তার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। এ কাজের জন্য সে কোনোরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তার সম্পত্তি তারই থাকবে। যে কোনো দ্রব্য সে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবে। এ ব্যাপারে আমাদের কোনো বিধান তাকে নিষেধ করবে না। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রীয় বিধি-ব্যবস্থার সঙ্গে যার পরিচয় ঘটেছে, যে আমাদের বিচার পদ্ধতিতে অভিজ্ঞ হয়েছে, সে যদি স্বেচ্ছায় এথেন্সে বসবাস করতে থাকে তা হলে তাকে অবশ্যই একথা বুঝতে হবে যে, তার থাকার অর্থই হচ্ছে রাষ্ট্রের বিধানকে মান্য করার চুক্তিতে সে নিজেকে আবদ্ধ করেছে। এর পরে যদি সে আমাদের অবাধ্য হয়, তা হলে তিনটি কারণে অবশ্যই সে ভ্রান্ত হবে : প্রথমত রাষ্ট্রীয় বিধান অমান্য করার অর্থ হচ্ছে তার জনক-জননীকেই অমান্য করা; দ্বিতীয়ত রাষ্ট্রই তাকে শিক্ষিত করে তুলেছে; অথচ শিক্ষিত হয়ে সে সেই রাষ্ট্রকেই অমান্য করছে। তৃতীয়ত রাষ্ট্রের সমস্ত বিধিনির্দেশের প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকারে নিজেকে আবদ্ধ করা সত্ত্বেও না সে রাষ্ট্রের বাধ্য থাকছে, না যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করতে সক্ষম হচ্ছে যে, আমাদের অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় বিধানসমূহ অন্যায়। অথচ রাষ্ট্র কখনো তার উপর এরূপ অঙ্গীকারকে কোনোরূপ জবরদস্তির মাধ্যমে চাপিয়ে দেয় নি। আমরা বিধানসমূহ তাকে বলেছি : দুটি বিকল্পই তোমার সম্মুখে রয়েছে–হয় তুমি আমাদের নিকট তোমার যুক্তির সঠিকতা প্রমাণ কর, নতুবা তুমি রাষ্ট্রকে মান্য কর। এই আমাদের বক্তব্য। কিন্তু আমাদের কোনো বিকল্পকেই সে গ্রহণ করছে না। সক্রেটিস, আজ যদি তুমি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তোমার ইচ্ছাকে কার্যে পরিণত কর, তা হলে রাষ্ট্র ন্যায্যভাবেই উপযুক্ত অভিযোগসমূহকে তোমার বিরুদ্ধে উত্থাপন করবে। অপর কোনো এথেন্সবাসীর চেয়ে তোমার বিরুদ্ধেই অধিকতর তীব্রভাবে এই অভিযোগ উত্থাপিত হবে। রাষ্ট্র এবং বিধানের এ বক্তব্যর জবাব যদি আমি জিজ্ঞাসা করি, অপর কোনো লোকের চেয়ে আমার বিরুদ্ধেই অভিযোগের এরূপ তীব্রতা কেন, তা হলে রাষ্ট্রও আমাকে সমুচিতভাবে বলতে পারে : কেননা, সক্রেটিস অপর যে-কোনো নাগরিকের চেয়ে তুমিই রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকারনামাকে অধিকতর সচেতনভাবে স্বীকার করেছ।’ রাষ্ট্রের বিধানসমূহ আরো বলতে পারে : সক্রেটিস, এরূপ স্পষ্ট প্রমাণ তো যথেষ্ট রয়েছে যে, আমরা এথেন্সনগরীর বিধানসমূহ এবং এথেন্সনগরী তোমার নিকট অপ্রিয় ছিলাম না। এথেন্সের সকল নাগরিকের মধ্যে তুমিই সবচেয়ে অধিক স্থায়ীভাবে এই নগরীতে বসবাস করে আসছ। এথেন্সকে পরিত্যাগ করে কখনো কোথাও তুমি যাও নি। যাকে মানুষ কখনো পরিত্যাগ করে না, তাকে সে অবশ্যই ভালবাসে। তুমিও তাই এথেন্সকে ভালবেসেছ,–একথা আমরা স্বাভাবিকভাবেই ভাবতে পারি। অপর সবাই যেরূপ নগর-নগরান্তরে ভ্রমণ করে বেড়ায় তুমি কখনো সেরূপ ভ্রমণ কর নি; সামরিক দায়িত্ব পালন ব্যতীত কিংবা একবার ইসথমাসের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা দর্শন ব্যতীত অপর কিছুর জন্য তুমি কখনো এথেন্সনগরী পরিত্যাগ কর নি; আমাদের প্রতি এবং এথেন্সরাষ্ট্রের প্রতি তোমরা মমতা এবং আনুগত্যকে অতিক্রম করে অপর কোনো মমতা বা আনুগত্য তোমার জীবনে প্রবেশ করে নি। অপর রাষ্ট্র এবং তার বিধানসমূহকে জানার ঔৎসুক্য তুমি কখনো প্রকাশ কর নি। আমরাই তোমার স্নেহমমতার বিশেষ পাত্র হয়ে রয়েছি। আমাদের শাসনব্যবস্থাকে তুমি স্বীকার করে এসেছ। এই শহরেই তুমি তোমার সন্তান-সন্তুতির জন্মদান করেছ। এসব তো এথেন্সের ওপর তোমার সন্তুষ্টিরই প্রমাণ। তদুপরি তোমার বর্তমান বিচার চলাকালে তুমি তোমার দণ্ড হিসাবে নির্বাসনের সুপারিশ করতে পারতে। বিধান অনুসারে তোমার সে প্রস্তাব রক্ষিত হতে পারত। তা হলে যে-এথেন্স মৃত্যুদণ্ডে-দণ্ডিত তোমাকে বর্তমানে এথেন্স। পরিত্যাগ করে অপর কোথাও চলে যাওয়ার অনুমতি দানে অসম্মত, সেই এথেন্সই তখন তোমাকে এথেন্স পরিত্যাগ করে অপর কোনো রাষ্ট্রে গিয়ে নির্বাসিতের জীবনযাপন করতে দিতে অবশ্যই সম্মত হতো। কিন্তু তুমি বলেছ, নির্বাসনের চেয়ে মৃত্যুকে তুমি উত্তম মনে কর। তুমি প্রকাশ করেছ, মৃত্যুবরণে তুমি অনিচ্ছুক নও। কিন্তু এই মুহূর্তে তুমি তোমার সব মহৎ চিন্তাকেই বিস্মৃত করেছ। এখন তুমি আমাদের প্রতি অর্থাৎ এথেন্সের বিধানসমূহের প্রতি আর আনুগত্য পোষণ করতে সম্মত নও; আর তুমি আমাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে ইচ্ছুক নও। তুমি আজ এথেন্সের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর হয়েছ। এ কি তোমার পক্ষে সংগত সক্রেটিস? হতভাগ্য দাস যেরূপ তার চুক্তিনামাকে পালন না করে পলায়ন করে, অনুরূপভাবে তুমিও আজ নাগরিক হিসাবে অঙ্গীকত তোমারই চুক্তিসমূহকে পালন না করে পলায়নের কথা চিন্তা করছ। প্রাজ্ঞ সক্রেটিস, সর্বপ্রথমে তুমি জবাব দাও একথা কি মিথ্যা যে, তুমি শুধু মুখে নয় বাস্তবভাবে এথেন্সের বিধানসমূহ দ্বারা শাসিত হতে স্বীকৃত হয়েছিলে? প্রিয় বন্ধু ক্ৰিটো, এ প্রশ্নের আমি কি জবাব দেব? বিধানের এ কথাকে আমি অস্বীকার করতে পারি? এ কথাকে কি স্বীকার করতে আমি বাধ্য নই?

ক্রিটো : হ্যাঁ, একথা স্বীকার করা ব্যতীত আমাদের গত্যন্তর নাই।

সক্রেটিস : তা না হলে রাষ্ট্র আমাকে কি বলতে পারে না? সক্রেটিস, যে অঙ্গীকার তুমি স্বেচ্ছায় একদিন করেছিলে, যে অঙ্গীকার কোনো ত্বরা কিংবা বাধ্যতা ব্যতিরেকেই একদিন তুমি করেছিলে, যে অঙ্গীকার তুমি সত্তর বৎসরের স্বাধীন জীবনযাপনের মাধ্যমে করেছিলে, আজ সেই অঙ্গীকারকেই তুমি ভঙ্গ করতে চলেছ। আমাদের সঙ্গে আবদ্ধ তোমার অঙ্গীকার যদি অন্যায় মনে হতো, যদি আমরা অর্থাৎ এথেন্সের বিধানাবলি তোমার মনঃপূত না হয়ে থাকে তা হলে এই সত্তর বৎসরের যে-কোনোদিন তুমি এথেন্স পরিত্যাগ করে চলে যেতে পারতে। ক্রিট এবং ল্যাসিডেমনকে তুমি তাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য প্রশংসা করে থাক। এই দুই রাষ্ট্রে যে-কোনো একটিতেই তুমি চলে যেতে পারতে; তুমি অপর কোনো হেলেনীয় রাষ্ট্রে কিংবা বিদেশেও গমন করতে পারতে। কিন্তু অপর যে-কোনো নাগরিকের চেয়ে তোমাকেই এথেন্সের সবচেয়ে বড় ভক্ত বলে বোধ হয়েছে। একথা সত্য যে, তুমি তার বিধানকেও ভালবেসেছ। কেননা, বিধানহীন রাষ্ট্রকে কে ভালবাসতে পারে? তুমি তাকে ভালবেসেছ বলেই তাকে পরিত্যাগ করে যাও নি; কোনো অন্ধ কিংবা খঞ্জ ও এথেন্স তোমার চেয়ে অনড় হয়ে থাকে নি। অথচ আজ তুমিই তোমার সমস্ত অঙ্গীকারকে বিস্মৃত হয়ে এথেন্স থেকে পলায়ন করতে চাচ্ছ। সক্রেটিস, আমাদের উপদেশ তুমি গ্রহণ কর; তোমার এ চেষ্টা থেকে তুমি বিরত হও, নগর থেকে পলায়ন করে নিজেকে তুমি উপহাসের পাত্র করে তুলো না। সক্রেটিস, তুমি বিবেচনা করে দেখ, তুমি যদি এভাবে আইনকে অমান্য কর এবং ভ্রান্ত পথ গ্রহণ কর তা হলে তোমার এ কার্য দ্বারা তোমার নিজের কিংবা তোমার প্রিয়জনের কি মঙ্গল তুমি সাধন করতে পারবে? একথা নিশ্চিত, তোমার এ কার্যের ফলে তোমার প্রিয় বন্ধুজন নির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত হবে, তাদের নাগরিক অধিকার হরণ করা হবে। থিবিস এবং মেগারাকে তুমি সুশাসিত রাষ্ট্র বলে প্রশংসা কর। তুমি যদি আজ এর কোনো রাষ্ট্রে পলায়ন করে আশ্রয় নাও তা হলে এ সমস্ত রাষ্ট্রও তোমার প্রিয়জনের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠবে। এ রাষ্ট্রের সরকার তোমারও বিরুদ্ধতা করবে। তোমার কার্যের জন্য সমস্ত দেশবাসী তোমাকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখবে। দেপ্রেমিক জনসাধারণ তোমাকে রাষ্ট্রীয় বিধানের ক্ষতিকারক ব্যক্তি হিসাবেই জানবে। এভাবে তোমার আপন কার্য দ্বারা তুমি বিচারকমণ্ডলীর ঘোষিত দণ্ডকেই ন্যায়সংগত বলে প্রমাণ করবে। কেননা, তখন এই সিদ্ধান্তই গ্রহণ করা হবে : যে-ব্যক্তি আইন লঙ্ঘনকারী এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা ধ্বংসকারী, তার পক্ষে তরুণ সম্প্রদায় এবং জনসমাজের সরল মানুষের মনকে বিভ্রান্ত এবং কলুষিত করে তোলা খুবই সম্ভব। সক্রেটিস, তুমি কি তা হলে সুশৃঙ্খলায় শাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে পলায়ন করতে চাও? এরূপ শর্তে জীবনধারণ করার সার্থকতা কী? যে রাষ্ট্রে তুমি পলায়ন করে আশ্রয় নিতে চাও সেখানে কি তুমি ঘৃণিত ব্যক্তি হিসাবে যেতে চাও? তেমনভাবে গিয়ে কী কথা তাদের তুমি বলবে? এথেন্সের ন্যায়, ধর্ম, বিধান, ব্যবস্থা সম্পর্কে তোমার উপদেশাবলি অবশ্যই উত্তম। কিন্তু ঘৃণ্য পলাতক তুমি কি বাণীর বাহক হয়ে তাদের নিকট উপস্থিত হবে? তোমার পক্ষে এরূপ কাজ কি কেউ সুন্দর, শালীন বলে গণ্য করবে? অবশ্যই না। তুমি পলায়ন করে যদি থেসালীতে ক্রিটোর বন্ধুদের নিকট গিয়েও উপস্থিত হও, তা হলে তারাই বা কী বলবে। থেসালীতে শাসন নেই, আছে বিশৃঙ্খলা আর অরাজকতা। তোমার পলায়নের কাহিনী তাদের অবশ্যই মোহিত করে তুলবে। পলাতকের কাহিনী হিসাবে তোমার সম্পর্কে মুখরোচক হাস্যকর গল্প সৃষ্টি হবে যে, তুমি ছাগচর্ম কিংবা অনুরূপ কোনো ছদ্মাবরণে কারাগার থেকে পলায়ন করেছ। তারা এ গল্পে মোহিত হবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু এমন কেউ কি সেখানেও থাকবে না যে তোমাকে ধিক্কার দিয়ে বলবে : এই বৃদ্ধ বয়সে রাষ্ট্রের পবিত্রতম বিধানসমূহকে অমান্য করে জীবনের আশায়, মাত্র কয়েকটি দিন বেশি বেঁচে থাকার জন্য তুমি এমনি ছদ্মাবরণে পলায়ন করতে লজ্জিত হলে না। অবশ্য তুমি যদি তাদেরকে খোশ মেজাজে রাখতে পার তা হলে হয়তো তোমাকে এ প্রশ্ন কেউ জিজ্ঞাসা করবে না। কিন্তু তারা যদি তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে তা হলে কত অপমানকর কথাই না তোমার সম্পর্কে তারা বলবে। সুতরাং পলায়ন করে তুমি হয়তো কিছুদিন জীবনধারণ করতে সক্ষম হবে। কিন্তু কী উপায়ে তুমি সেই জীবনধারণ করবে? কয়েকটি দিন বাঁচবার জন্য। থেসালীতে একটু ভালো খাদ্য এবং পানীয়ের জন্য। তখন ন্যায় কিংবা ধর্ম কিংবা কর্তব্য সম্পর্কে তোমার মহৎ ভাবগুলি কোথায় থাকবে? তুমি বলছ, তোমার সন্তান-সন্ততির জন্য তুমি বাঁচতে চাও, তাদের লালনপালন করে তুলবার জন্য তুমি পালিয়ে গিয়ে জীবনরক্ষা করতে চাও? কিন্তু তুমি কি তাদের এথেন্সের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করে থেসালীতে নিয়ে যেতে চাও? এই হবে তোমার সন্ততির প্রতি তোমার আশীর্বাদ? অথবা তুমি ভাবছ, তুমি কারাগার থেকে পলায়ন করে বিদেশে কোথাও বেঁচে থাকলেই এখানে তাদের উত্তম পরিচর্যা সম্ভব হবে? তুমি কি মনে কর যে, তুমি পালিয়ে গিয়ে থেসালীতে বাস করলেই তোমার পুত্র-পরিজনের পরিচর্যা হবে, কিন্তু তুমি মৃত্যুবরণ করে অমর জগতের অধিবাসী হলে তাদের কোনো পরিচর্যা হবে না? এরূপ চিন্তা তোমার ভ্রান্ত। যারা নিজেদেরকে তোমার সুহৃদ বলে দাবি করে, তারা সত্যকারভাবেই যদি সুহৃদ হয়, তা হলে সর্বদাই তোমার পুত্র-পরিজনের পরিচর্যা অবশ্যই তারা করবে। ‘সক্রেটিস, আমরা এথেন্সের বিধানাবলি–আমরাই তোমাকে লালনপালন করেছি। আমাদের কথা তুমি শ্রবণ কর : ন্যায়ের পূর্বে, কর্তব্য এবং ধর্মের পূর্বে তুমি তোমার প্রিয়-পরিজনের কথা ভেবো না। প্রিয়-পরিজনের পূর্বে ন্যায়, কর্তব্য এবং ধর্মের কথা চিন্তা কর। তা হলেই তুমি অমরলোকের মানব-শ্রেষ্ঠদের সম্মুখে উন্নত মস্তকে দাঁড়াতে পারবে। উপরন্তু, বন্ধু ক্ৰিটোর নির্দেশিত পথ যদি তুমি গ্রহণ কর, তা হলে তুমি কিংবা তোমার সন্তান সন্ততি কিংবা প্রিয়জন মর কিংবা অমরলোক কোথাও সম্মান ও সুখের জীবনযাপন করতে পারবে না। আজ তুমি হয়তো নিগৃহীত হয়ে জীবন বিসর্জন দিচ্ছ, কিন্তু তুমি কোনো অসৎ কর্মের কর্মী হিসাবে এ জগৎ থেকে নিষ্ক্রান্ত হচ্ছ না। তোমার এ নিগ্রহের কারণ হচ্ছে মানুষ, বিধান নয়। তুমি মানুষেরই শিকারে পরিণত হয়েছ। বিধানের শিকারে নও। কিন্তু আজ যদি তুমি অন্যায়ের বদলে অন্যায় করে, আঘাতের প্রতিদানে আঘাত করে, আমাদের সঙ্গে অঙ্গীকৃত চুক্তিকে ভঙ্গ করে এবং যাদের প্রতি তোমার সামান্যতম অন্যায় করাও উচিত নয়। অর্থাৎ তোমার নিজের সত্তা, তোমার বন্ধুবর্গ, তোমার দেশ, তোমার দেশের বিধানাবলি–তাদের প্রতি অন্যায় করে বেঁচে থাক, তা হলে তোমার জীবনকালে এ জগতে আমরা যেরূপ তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট এবং ক্রুদ্ধ হব, তেমনি অপর জগৎবাসীও তোমাকে শত্রু হিসাবেই গ্রহণ করবে, অপর জগতের বিধানসমূহও তোমাকে আইনভঙ্গকারী হিসাবেই জানবে। তাই এথেন্সের বিধান বলছে, সক্রেটিস, ক্রিটোর কথা নয়, আমাদের কথা তুমি গ্রহণ কর।

প্রিয় বন্ধু ক্রিটো, এই বাণীই রহস্যময় বাঁশির সুরের ন্যায় আমার কানে মর্মরিত হচ্ছে। মর্মরিত এই বাণী অপর সব কথার প্রতি আমাকে বধির করে তুলছে। সুতরাং বন্ধুবর, তোমার উচ্চারিত সব কথাই ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। তবু তুমি বল, বন্ধু, তোমার যদি আরো কিছু বলার থাকে।

ক্রিটো : প্রিয় সক্রেটিস, আমার আর কিছু বলবার নাই।

সক্রেটিস : সুহৃদবর! তা হলে আমাকে তুমি বিধাতার হাতেই অর্পণ করে যাও; তার ইচ্ছাই সাধিত হোক, তারই আদিষ্ট পথ আমাকে অনুসরণ করতে দাও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *