ক্রমবিকাশের ধারা : জিন-এর ভূমিকা

ক্রমবিকাশের ধারাঃ জিন-এর ভূমিকা

‘ক্রমবিকাশের ধারা’ বুঝাতে গিয়ে কোরআনের সেই প্রক্রিয়ার তথা কার্যকারণের ধারাকেই বুঝানো হয়েছে যা সময়ের ধারাবাহিকতায় কোন ব্যক্তি বা কোন প্রাণী-প্রজাতির ক্রমোন্নতি ঘটায়। প্রকৃতপক্ষে, এখন বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে ‘জিন’ বলে অভিহিত করা হয়, সেই ‘জিন’-এর ভূমিকার কথাই বলা হয়েছে কোরআনের এইসব বক্তব্যে। কেননা, এই জিন-ই প্রজননের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে পিতৃপুরুষ ও মাতৃকুলের উত্তরাধিকার নিয়ে ব্যক্তি বা প্রাণীর ক্ষেত্রে পালন করে থাকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক ভূমিকা। সুতরাং, কোরআনের এসব আয়াতে উল্লিখিত মানবজাতি বা প্রাণী-প্রজাতির ক্রমবিকাশের ‘পর্যায়’ বা উন্নয়নের ‘স্তর’ বুঝাতে যদি আমরা বিজ্ঞানের এই নব-আবিস্কৃত ‘জিন’-এর সেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের ‘স্তর’ বা ‘পর্যায়’ ধরে নিই, তাহলে কোরআনের বক্তব্য আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণালব্ধ তথ্যের সাথে সম্পূর্ণভাবেই মিলে যায়।

আলোচ্যক্ষেত্রে কোরআনের বক্তব্যের মর্মে ‘জিন’-এর সেই ভূমিকা মেনে নেয়ার পিছনে আরো একটি যুক্তি কাজ করছে। তাহল, শুধু এই সূত্রের দ্বারাই ইতিপূর্বে উল্লিখিত মানুষের দেহাবয়বগত পরিবর্তন বা রূপান্তরের যৌক্তিক একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। আর সেক্ষেত্রে পাঠক যদি এই গ্রন্থের ব্যাখ্যা অনুসারে উল্লিখিত আয়াতের বক্তব্য সূত্র নং ১৭ নাও ধরেন, তাহলেও এর দ্বারা সময়ের ধারাবাহিকতায় মানবজাতির দেহাবয়বের পরিবর্তন ও রূপান্তরের ধারণা ক্ষুণ্ণ হয় না।

কোন-এক মানবজাতির স্থলে অন্য এক মানবজাতির আবির্ভাবের বক্তব্য কোরআনের নিমোক্ত দুটি আয়াতে বিদ্যমান। যথাঃ

“নিশ্চয় আমরা তাহাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছি এবং তাহাদের সবাইকে করিয়াছি শক্তিসম্পন্ন (বা তাহাদের গঠনকে মজবুত করিয়াছি); এবং যখন আমরা ইচ্ছা করিয়াছি, তাহাদিগকে সম্পূর্ণভাবে সরাইয়া দিয়া (অথবা বদলাইয়া দিয়া) তদস্থলে অনুরূপ ধরনের মানুষকে করিয়াছি স্থলাভিষিক্ত।” –সূরা ৭৬ (দাহর), আয়াত ২৮ (সূত্র নং ১৮) :

উপরের আয়াতে মানুষের শারীরিক গঠন-কাঠামোর যে কথা বলা হয়েছিল, এখানে তাকে ক্ষমতাসম্পন্ন করার বা তার গঠন মজবুত করার কথা বলে খুব সম্ভব সময়ের ধারাবাহিকতায় মানুষের সেই দেহাবয়বগত ক্ৰম-উন্নয়নের তথ্যই তুলে ধরা হয়েছে।

“তিনি (আল্লাহ) চাহিলে তোমাদিগকে বিলুপ্ত করিতে পারেন, এবং তিনি যাহাদিগকে চাহিবেন, উত্তরাধিকারী হিসেবে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করিতে পারেন–ঠিক যেভাবে অন্য মানুষের বংশধর হইতে তোমাদের উদ্ভব ঘটাইয়াছেন।” –সূরা ৬ (আনআম), আয়াত ১৩৩ (সূত্র নং ১৯) :

এই দুই আয়াতে আল্লাহর ইচ্ছানুসারে সময়ের ধারাবাহিকতায় নির্দিষ্ট মানব-সম্প্রদায়ের অবলুপ্তি এবং তদস্থলে অন্যদের স্থলাভিষিক্তকরণের যে প্রক্রিয়া চালু ছিল–সেই বিষয়টির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

প্রাচীন তফসীরকারগণ এসব আয়াতের ব্যাখ্যায় পাপাসক্ত মানব সম্প্রদায়ের উপরে আল্লাহর গজব ও আজাব নিপতিত হওয়ার ব্যাপারটাকে বড় করে তুলে ধরেছেন। এসব আয়াতের মর্মে ধর্মীয় এই তাৎপর্য প্রথমদৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ বটে; কিন্তু বাস্তবে সুগভীর বিচার-বিশ্লেষণে এটাও স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে যে, এই দুই আয়াতের অতীতের বহু মানব-সমপ্রদায়ের (যাদের সংখ্যা এখানে উল্লেখ করা হয়নি) বিলুপ্তির কথাই বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সময় বিশেষে অন্য মানুষের বংশধরদের দ্বারা এমনকি ভিন্ন কোন মানব-সম্প্রদায়ের দ্বারাও তাদের স্থান পূরণের কথাও এখানে উল্লিখিত হয়েছে সমান গুরুত্বের সাথেই।

সুতরাং, মোদ্দাকথাটা এখানে এই দাঁড়াচ্ছে যে, বহুকাল আগে থেকেই বিভিন্ন সময় দুনিয়াতে যে সব মানবগোষ্ঠী বিদ্যমান ছিল, তাদের মধ্যে ছিল শারীরিক গঠন-কাঠামোগত ভিন্নতা। তখনকার সেইসব মানুষের দেহাবয়বগত গঠন-কাঠামোর যে ভিন্নতা, সেই ভিন্নতা আল্লাহর নির্ধারিত নিয়মে এক মহা সাংগঠনিক পরিকল্পনার অধীনেই ক্রমাগতভাবে রূপান্তরিত ও পরিবর্তিত তথা সংশোধিত হয়ে চলেছে। এই সংশোধন তথা পরিবর্তন ও রূপান্তরের ধারায় একেক সময় একেক মানব সম্প্রদায়ের বিলুপ্তি ঘটেছে; এবং সেই একইধারায় তাদের স্থান পূরণ করেছে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী।

উপরে যে-সব আয়াত তথা বাণী ও বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে–ওইসব বাণী ও বক্তব্যের দ্বারা কোরআন আলোচ্য এই বক্তব্যকে বিশদভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরছে। বলা অনাবশ্যক যে, জীবাশ্ম-বিজ্ঞানের আবিষ্কার, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও আধুনিক বিজ্ঞান-গবেষণার সিদ্ধান্তও আশ্চর্যজনকভাবে একইরকম। এক্ষেত্রে প্রমাণিত হচ্ছে যে, জীবাশ্ম-বিজ্ঞানের তথ্য-প্রমাণের সঙ্গে কোরআনের বাণী ও বক্তব্যের সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য বিদ্যমান। অন্যকথায়, মানুষের সৃষ্টি, তার গঠন সৌকর্য, মানবজাতির শারীরিক সংগঠন-কাঠামোর ক্রমবিকাশ, জাতিগতভাবে মানুষের দেহাবয়বের পরিবর্তন ও রূপান্তর ইত্যাদি সম্পর্কিত জীবাশ্ম-বিজ্ঞানের আবিস্কৃত ও গবেষণালব্ধ তথ্য-প্রমাণের সঙ্গে কোরআনের এতদসংক্রান্ত বাণী ও বক্তব্যের কোনও গরমিল নেই : গরমিল খুঁজতে গেলে বরং নিরাশই হতে হয়।