৯
কোর্ট ম্যারেজ এপ্লিকেশনের তিনমাস পর একদিন বেলা দশটার সময় সেলিনা ফোন করে বলল, আগামীকাল আমাদের কোর্ট ম্যারেজ ডেট। সকাল আটটায় মেজ মামা বাসায় যেতে বলেছেন।
কথাটা শুনে মনের মধ্যে ভয়মিশ্রিত আনন্দ অনুভব করলাম। কোনো কথা না। বলে চুপ করে রইলাম।
কি হল? চুপ করে আছ কেন?
সামলে নিয়ে বললাম, তুমি বলছ, আমি শুনছি। মহারাণীর আদেশ শিরোধার্য্য।
সেলিনা বলল, সাহেবের ও আপামনির কাছ থেকে কয়েকদিনের ছুটি নেবে।
ভাবলাম, আমাকে একান্ত করে পাওয়ার জন্য খুব অস্থির হয়ে পড়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, মহারাণীর আর কোনো আদেশ আছে?
মহারাণীর আদেশ নয়, দাসীর আর একটা অনুরোধ, আজ বেলা দুটোর সময় ফেব্রিক্স হাউসের সামনে একটু আসবে। আমি দুএকটা জিনিস কিনব।
বললাম, তথাস্তু।
সেলিনা সালাম দিয়ে ফোন ছেড়ে দিল।
নিউমার্কেটের রূপালী ব্যাংক থেকে কিছু টাকা তুললাম। দুপুরে সাহেবকে ফোন করে একসপ্তাহের ছুটি চাইতে তিন দিনের ছুটি মঞ্জুর করলেন।
বেলা দুটোর সময় ফেব্রিক্স হাউসের সামনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি, এমন সময় সেলিনাকে আসতে দেখলাম। সাদা ধবধবে সালওয়ার কামিজ পরেছে। আর ঐ একই কাপড়ের রুমাল ও ওড়না দিয়ে মাথা, বুক ও পিঠ ঢেকে দিয়েছে। মনে হল গ্রীষ্মের নির্জন দুপুরে মার্কেটের আঙ্গিনা দিয়ে একটা বেহেস্তের হুর আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি সবকিছু ভুলে তন্ময় চিত্তে তার দিকে চেয়ে রইলাম। হঠাৎ আমার মনের ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, এই নিস্পাপ হুরের মত, মেয়েটার তুমি কি উপযুক্ত? কথাটা চিন্তা করে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।
আমার কাছে এসে সেলিনা সালাম দিয়ে বলল, চল, বোরখা কিনব।
আমি চিন্তার মধ্যে এমনিই ডুবে ছিলাম যে, তার কোনো কথা আমার কানে গেল না। অপলক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়েই থাকলাম।
আমাকে চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সেলিনা আমার একটা হাত ধরে নাড়া দিয়ে বলল, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কি এত চিন্তা করছ?
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললাম, কি যেন বলছিলে?
আগে বল, তুমি এত গভীরভাবে কি চিন্তা করছিলে?
আমার প্রিয়তমার কথা।
কিন্তু আমার মন বলছে, তার সঙ্গে আরো কিছু যেন ভাবছিলে।
সবটা শুনলে তুমি যদি আবার কিছু মনে কর।
আমি কিছু মনে করব না, প্লীজ বল।
চল যেতে যেতে বলছি। তারপর যেতে যেতে বললাম, তোমাকে আসতে দেখে বেহেস্তের হুর বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ আমার ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, তুমি কি এই হুরের উপযুক্ত? কথাটার সত্যতা চিন্তা করে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।
সেলিনা দ্রুত আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পথরোধ করে বলল, কথা দাও, আর কখনও এ রকম কথা ভাববে না।
হেসে ফেলে বললাম, মন কি কারো কেনা গোলাম যে, হুকুম করলেই মেনে চলবে? তবে তোমার কথাটা রাখার জন্য মনকে কড়া শাসন করে দেব, যাতে করে ভবিষ্যতে আর এ রকম চিন্তা যেন না করে।
তারপর আমরা একটা দোকানে গিয়ে বোরখা কিনলাম। সেলিনা দোকানের একজন কর্মচারীকে আমার জন্য পাজামা পাঞ্জাবী দেখাতে বলে আমাকে কালারটা বলতে বলল।
আমি বললাম, আমার এখন কোনো কিছু কেনার দরকার নেই।
তোমার দরকার না থাকলেও আমার আছে। এই বলে তাকে ট্যাট্রনের সাঁদা পাজামা এবং ঘীয়ে রং এর নক্সা করা সূতীর পাঞ্জাবী দিতে বলল। কেনাকাটা শেষ করে সেলিনা বলল, অনেক কাজ বাকি আছে, এখন আমাকে যাওয়ার অনুমতি দাও। ইনশা আল্লাহ আগামীকাল দেখা হবে।
বললাম, চল না একটু নভেলে রেষ্ট নেবে। তোমাকে দেখে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে।
সেলিনা বলল, ঠিক বলেছ, চল একটু গলা ভিজিয়ে নিই।
আমরা নভেলে গিয়ে বসলাম।
জিজ্ঞেস করলাম, কি দিতে বলব?
সেলিনা বলল, তোমার যা মন চায়
আমি বেয়ারাকে ডেকে দুই পীস ফ্রুটকেক ও দুটো ফান্টা দিতে বললাম।
তারপর ওখান থেকে বেরিয়ে সেলিনাকে গাড়িতে তুলে দিলাম।
সেলিনা বোরখার সঙ্গে আমার জন্য কেনা পাজামা পাঞ্জাবীর প্যাকেটটাও নিয়ে চলে গেল।
রাত্রে বাসায় ফিরে স্ত্রীকে বললাম, কোম্পানীর কাজে আগামীকাল ঢাকার বাইরে যাব, ফিরতে তিন দিন দেরি হবে।
এই পর্যন্ত বলে জামান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুই হয়তো ভাবছিস, আমি একজন মিথ্যাবাদী ও প্রতারক। এটাই ভাবা স্বাভাবিক। এই কথা চিন্তা করে আমিও তখন আমার বিবেকের কাছে খুব ছোট হয়ে গেছি। কিন্তু স্ত্রীকে সত্য ঘটনা বলে তাকে অশান্তির আগুনে জ্বালাতে চাইনি। নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, সারাজীবন তার মনে অশান্তির আগুন লাগতে দেব না। সে জন্য যত স্বার্থ ত্যাগ করতে হয় করবো। যত তিতিক্ষা সহ্য করতে হয় করব। তাই পরবর্তী। জীবনে সেলিনাকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেললেও আমার প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে কোনো দিন এতটুকু খারাপ ব্যবহার করিনি।
ঐ দিনটির কথা আমার চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। সেই দিন আমার স্ত্রী নাস্তা খাইয়ে কাপড়-চোপড় ব্রীফকেসে গুছিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে কদমবুসি করল। আমার মনটা তখন ব্যাথায় টনটন করে উঠল। অনেক কষ্টে নিজেকে ঠিক রেখে তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
ঠিক আটটার সময় কোর্ট হাউস স্ট্রীটে সেলিনার মেজ মামার বাসায় গিয়ে পৌঁছালাম।
ওর মামাতো বোন জোহরা বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। আমাকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে তাড়াতাড়ি নেমে এসে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?
সালামের উত্তর দিয়ে বললাম, ভালো আছি।
জোহরা আমার হাত থেকে ব্রীফকেস ও মিষ্টির বাক্স নিয়ে বলল, আসুন। আমাকে ড্রইংরুমে বসিয়ে জোহরা চলে গেল। সেখানে তার ছোট দুই ভাইবোন। খেলা করছিল। আমি টফির বাসটা একজনের হাতে দিয়ে বললাম, তোমরা দুজনে ভাগ করে নেবে। টফির বাসটা আর খেলনাগুলো নিয়ে তারা চলে গেল। একটু পরে সেলিনার মেজ মামা এলে আমি সালাম দিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করলাম।
সালামের উত্তর দিয়ে মামা বললেন, ভালো আছি। তারপর বললেন, তোমাকে খুকী বোধ হয় সবকিছু বলেনি। ঠিক সাড়ে এগারটার সময় তোমরা ঐ জজের ঘরে যাবে, যেখানে তোমাদের এ্যাপ্লিকেশন এফিডেভিট হয়েছিল। কোর্টের কাজ শেষ হওয়ার পর কোথাও যাবে না। রাত্রে এখানে সামাজিক প্রথায় তোমাদের বিয়ে হবে।
নাস্তা খেয়ে মামা কোর্টে চলে গেলেন।
ড্রইংরুমের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি সিগারেট খাচ্ছি। মনের মধ্যে তখন নানা রকম চিন্তা এসে ভীড় করছে। সমস্ত চিন্তাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতির কথা ভাববার চেষ্টা করছি। পিঠে কারুর নরম হাতের মৃদু স্পর্শ পেয়ে ঘুরে দেখি, সেলিনা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। লজ্জায় তার ফর্সা মুখটা রাঙা হয়ে গেছে। আমি তার লজ্জা কাটাবার জন্য সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছ?
সেলিনা সালামের জওয়াব দিয়ে বলল, ভালো আছি। লজ্জা করছিল বলে এতক্ষণ আসতে পারিনি, কিছু মনে করনি তো?
লজ্জা ঈমানের অঙ্গ। যার লজ্জা নেই তার ঈমানও নেই। তারপর বললাম, বায়তুল-মোকাররম যাব, যাবে নাকি?
যাব, একটু অপেক্ষা কর, এক্ষনি আসছি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে কাপড় পাল্টে এসে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি আমার জন্য কিছু কিনবে?
বললাম, তুমি তো আমার মনের সব কথা জান।
সেলিনা আমার দুটো হাত ধরে বলল, কিন্তু পেমেন্ট আমি করব। আজকের এই অনুরোধটা তোমাকে রাখতেই হবে।
আজ তোমাকে কিছু দিতে মন চাইছে। পেমেন্ট তুমি করলে আমার তো আর তোমাকে কিছু দেওয়া হল না।
তাহলে সামান্য কিছু দিও।
সে দেখা যাবে বলে আমরা বায়তুল মোকাররমে ঐ বন্ধুর দোকানে গিয়ে অর্ডার দেওয়া গহনা দিতে বললাম।
উনি তিনটে বাক্স এনে খুলে দিয়ে সামনে রাখলেন। একজোড়া কংকন, একজোড়া কানের দুল ও একটা টায়রা।
চেকে পেমেন্ট দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, পছন্দ হয়েছে?
সেলিনা আমার হাত থেকে বা তিনটে নিয়ে বলল, আমার মনের মত হয়েছে। আমি নিজেও বোধ হয় এত ভালো ডিজাইন চয়েস করতে পারতাম না। গাড়িতে উঠে সব পরে ফেলল।
বললাম, বিয়ের সময় ওগুলো পরতে হয়।
সেলিনা বলল, এখনই তো আমাদের বিয়ে হবে।
ড্রাইভার দাদুকে বললাম, গ্যানিসে চলুন। গাড়ি ততক্ষণে গুলিস্তানে চলে এসেছিল। দাদু গাড়ি ঘুরিয়ে গ্যানিসের সামনে পার্ক করল।
সেলিনার জন্য গাঢ় লাল রং এর জাপানি সিফনের একটা শাড়ী, ওড়না, গোলাপি রং এর সার্টিন কাপড়ের একসেট সালওয়ার কামিজ, দুটো রুমাল ও একজোড়া ব্রা কিনলাম। তারপর বাটায় গিয়ে তার জন্য জুতো কিনে ফেরার পথে বললাম, এগুলোর মধ্যে তোমার ইচ্ছামতো বিয়ের সময় পরবে।
যথা সময়ে ঠিকমত সব কাজ মিটে গেল। সন্ধ্যার পর সেলিনাদের ভাড়াটিয়া দারোগা সাহেব স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন। বিয়ের পর খাওয়া দাওয়া করে চলে গেলেন। জরিনা তাদের সঙ্গে এসেছিল, সে থেকে গেল। বিয়েতে কোনো আত্মীয়-স্বজন আসেনি। সবশেষে জোহরা ও জরিনা যখন আমাকে বাসর ঘরে দিয়ে গেল তখন রাত্রি এগারটা।
দেখলাম, সেলিনা খাটের উপর বসে আছে। মাথার ওড়নাটা মুখের উপর একটু নামান। আমি ঘরের দরজা জানালা আটকে দিয়ে পর্দাগুলো টেনে ঠিক করে চেয়ারে এসে বসলাম।
সেলিনা ধীরে ধীরে খাট থেকে নেমে এসে আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল।
আমি দাঁড়িয়ে তাকে দুহাত দিয়ে তুলে বুকে জড়িয়ে প্রথমে মাথায় তারপর দুগালে শেষে অধরে অধর ঠেকিয়ে চুমো খেয়ে দোয়া করলাম-হে রাব্দুল আলামিন, তুমি আমাদের দাম্পত্য জীবনে শান্তির ধারা বর্ষণ কর। আমাদের ঈমানকে তোমার পথে দৃঢ় রেখ। আমাদের প্রেমকে কোনো দিন লাঞ্ছিত করো না।
সেলিনার সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছিল। বললাম, তোমার অযু আছে?
সেলিনা মাথা নেড়ে জানাল আছে।
তাহলে এস আল্লাহপাকের দরবারে দুরাকাত শোকরানার নামায পড়ি।
সেলিনা খুব আস্তে আস্তে বলল, আমাকে এই নামাযের নিয়েত ও নিয়ম শিখিয়ে দাও।
তাকে সবকিছু শিখিয়ে দিয়ে দুজনে শোকরানার নামায পড়লাম। তারপর তাকে পাজাকোলা করে তুলে নিয়ে আদর করে খাটে শুইয়ে দিয়ে বললাম, তুমি ঘুমাও, আমি একটু পরে ঘুমাব।
আমি চেয়ারে বসে টেবিলে রাখা জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে খেয়ে সিগারেট ধরালাম। মনের মধ্যে তখন চিন্তার ঝড় বইছে। কিছুতেই নিজেকে সম্বরণ করতে পারছিলাম না। কেবলই মনে হতে লাগল, আমি আমার প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে বেশ অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম।
সেলিনা যখন আমার পায়ে হাত দিল তখন সম্বিত ফিরে পেলাম। দেখলাম, আমার দুপা জড়িয়ে কাঁদছে। আমি সব চিন্তা দূর করে দিয়ে তাকে তুলে কোলে বসিয়ে রুমাল দিয়ে চোখ মুছিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমার ব্যবহারে কী তুমি ব্যাথা পেয়েছ?
সেলিনা আমার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, অমন কথা বল না। বরং আমিই চিন্তা করছি, আমার সঙ্গে জড়িয়ে তোমাকে অশান্তির মধ্যে ফেলে দিলাম না তো? আমার জন্য তুমি অশান্তি ভোগ করবে, সেটা যে আমি সহ্য করতে পারছি না।
দেখ, আমরা পুরুষ, আমাদেরকে অনেক কিছু বিপদ-আপদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়। অনেক চিন্তা ভাবনা করে কাজ করতে হয়। আজ ঐসব কথা বলে আনন্দের রাত্রিকে নিরানন্দ করে লাভ নাই। চল ঘুমাবে চল।
তুমি একটু বস বলে সেলিনা নিজের সুটকেস খুলে একটা অটোমেটিক ওমেন্স ঘড়ি বের করে এনে আমার হাতের ঘড়িটা খুলে নিয়ে পরিয়ে দিল। আর আমার ঘড়িটা নিজের হাতে পরে নিল। তারপর বলল, তুমি আমাকে তোমার মনের মত করে গড়ে নিও। হয়তো অনেক সময় অন্যায় করে ফেরব, সেজন্য যা মনে চায় শাস্তি দিও, কিন্তু রাগ বা অভিমান করে কখনও আমার কাছ থেকে দূরে থাকবে না বল?
সেলিনার প্রেমের গভীরতা অনুভব করে বললাম, যারা প্রকৃত প্রেমিক প্রেমিকা তারা একে অন্যের অন্যায়কে প্রেমের এমতেহান মনে করে থাকে। আর প্রত্যেক নারীর উচিৎ পানির ধর্ম অনুসরণ করা। তাহলে স্বামী-স্ত্রীর মধে কোনোদিন মনোমালিন্য হবে না।
পানির ধর্ম কি বুঝিয়ে দাও।
পানির ধর্ম তিনটি। (১) পানি সব সময় নিচের দিকে প্রবাহিত হয়।
(২) পানির নিজস্ব কোনো আকার নেই। তাকে যে পাত্রেই রাখা হোক না কেন, সেই পাত্রের আকার ধারণ করে।
(৩) পানির কোনো রং নেই। সে যে কোন রঙের সঙ্গে মিশে গিয়ে সেই রঙে রঙ্গিন হয়ে যায়।
এখন বুঝতে পারছ কেন আমি নারীকে পানির ধর্ম অনুসরণ করার কথা বললাম।
তুমি দোয়া কর, আমি যেন আমার জীবনকে তোমার জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে তোমার রঙে রঙ্গিন হয়ে যেতে পারি।
তোমাকে আল্লাহপাক আমার মনের মত করে গড়েছেন। নচেৎ আমার সবকিছু তোমার পছন্দ হবে কেন? আর আমার মনের খবরই বা জানতে পার কি করে?
যে কাপড়গুলো আমি কিনে দিয়েছিলাম সে তার থেকে সালওয়ার কামিজ পরেছিল। তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। আমি যখন তাকে কোলে তুলে নিই তখন ওড়নাটা মেঝেতে পড়ে যায়। পলকহীনভাবে আমি তার সৌন্দৰ্য্য সুধা পান করছিলাম।
আমাকে একদৃষ্টে তারদিকে চেয়ে থাকতে দেখে এতক্ষণে খেয়াল হল যে, গায়ে ওড়না নেই। লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি করে যেই ওড়নাটা তুলতে গেল আমি তখন তাকে দুহাতে তুলে নিয়ে খাটে শুইয়ে দিলাম।
সেলিনা উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ঘুমাবে না?
নিশ্চয়, তবে তুমি আগে ঘুমিয়ে পড়, তারপর।
তা কখন হয় নাকি? তুমি জেগে থাকবে আর আমি ঘুমাব?
তাহলে তুমিও আমার সঙ্গে জেগে থাক, পারবে তো জেগে থাকতে?
কেন পারব না? তুমি পারলে, আমিও পারব।
তুমি তাহলে এখানে বস, আমি ঐ চেয়ারটায় বসব। দেখি কে কতক্ষণ জেগে থাকতে পারি? এই কথা বলে খাট থেকে নেমে গিয়ে চেয়ারে বসে পরপর দুটো সিগারেট খেলাম। সেলিনা সারাক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার প্রতি খুব মায়া হল। উঠে গিয়ে তাকে শুইয়ে দিয়ে আমিও পাশে শুয়ে বললাম, আজকের আমার এই ব্যবহারের জন্য আমি খুব দুঃখিত। তবু বলছি তোমাকে ঘুমাতে দেখলৈই আমি ঘুমাব।
সেলিনা ছল ছল নয়নে বলল, তারচেয়ে আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিই তুমি ঘুমাও।
আমি আর কিছু না বলে তার দিকে মুখ করে শুলাম। সেলিনা আমার চুলে বিলি কাটতে লাগল। কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না। ভোরে মোয়াজ্জিনের আযান শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখলাম, সেলিনা আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। আমি খুব ধীরে ধীরে তার হাতটা সরিয়ে দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে উঠে তার ঠোঁটে আলতো করে চুমো খেলাম। এতেই সে জেগে গেল। ঘুম ঘুম চোখে আমার দিকে তাকাল।
বললাম, উঠে পড়, ফজরের আযান হয়ে গেছে। দুজনে একসঙ্গে নামায পড়ব। আমি বাথরুম থেকে আসার পর সেলিনা ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে বাথরুমে গেল, ফিরে এসে আমার সঙ্গে নামায পড়ল।
নামাযের পর জিজ্ঞেস করলাম, কুরআন শরীফ পড়তে জান?
না, তুমি আমাকে শিখিয়ে দেবে।
তোমাদের বাসার কাছের মসজিদের ঈমাম সাহেবকে ঠিক করে দেব। তিনি তার সময় মতো প্রতিদিন এসে তোমাকে পড়িয়ে যাবেন। এখন আমাকে কিছু খাওয়াতে পার?
সেলিনা ফ্রিজ থেকে চার পাঁচটা বড় মিষ্টি ও কয়েক পিস স্লাইস রুটি বের করে টেবিলের উপর রেখে বলল, তোমার জন্য আনিয়ে রেখেছি।
তোমার বুদ্ধির তারিফ না করে পারছি না। একটু মিষ্টি তার মুখে দিয়ে আমার সঙ্গে খেতে বললাম।
সামান্য খেয়ে বলল, আমাকে হাত ধোয়ার অনুমতি দাও। আমি ভোরে মোটেই কিছু খেতে পারি না।
বললাম, খেতে যখন পারবে না তখন পারমিশান দিলাম।
নাস্তার পাঠ শেষ করে বিছানায় শুয়ে সিগারেট ধরিয়ে বললাম, আমি এখন ঘুমাব, তুমিও ইচ্ছা করলে আমার সঙ্গে ঘুমাতে পার।
মামীমা উঠে পড়েছে, এখন ঘুমাতে লজ্জা করছে। তুমি ঘুমাও, আমি বরং হেঁসেলে মামীমাকে সাহায্য করি গিয়ে। আচ্ছা, শুয়ে চোখ বন্ধ করেই তুমি কী করে ঘুমিয়ে পড়?
ওটা আমার ছেলেবেলা থেকে অভ্যাস হয়ে গেছে। রাত্রে হোক আর দিনে হোক, যে কোনো সময়ে যদি ঘুমাবার ইচ্ছা করি তখনই ঘুমাতে পারি। ঘুমাবার সময় সব চিন্তা দূর করে দিয়ে আল্লাহপাকের জিকির করি, আর তখনই ঘুম ধরে যায়। তবে ইচ্ছা করলে আবার সমস্ত রাত্রি জেগেও থাকতে পারি, তাতে আমার কোনো অসুবিধে হয় না। তুমিও একটু চেষ্টা করলে এইভাবে ঘুমাতে পারবে। এখন আমার সঙ্গে একটু চেষ্টা করে দেখবে নাকি?
সেলিনা হেসে উঠে বলল, এখন নয়, অন্য এক সময় দেখা যাবে।
সিগারেট এ্যাসট্রেতে গুজে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বললাম, ঠিক নটার সময় জাগাবে।
সেলিনা আমার পাশে বসে বন্ধ দুচোখে চুমো খেয়ে দ্রুত খাট থেকে নেমে চলে গেল।
আমি কিছু না বলে শুধু একটু হেসে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লাম।