৬
চিঠিটা পড়ার পর পুড়িয়ে ফেললাম। চিন্তা করলাম, তাকে যদি বিয়ে না করি, তাহলে যে রকম জেদী মেয়ে, হয়তো সত্যি সতিই কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে। আর সে জন্য আমিই দায়ী হব। তাই ঠিক করলাম তাকে বিয়ে করার ব্যাপারে কতকগুলো কঠিন শর্ত আরোপ করে আর একটা পত্র দিয়ে শেষ পরীক্ষা করব। যদি সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তবে তাকে বিয়ে করতে রাজি হব। তাতে আমার তকদিরে যা হয় তোক। যদিও মনে হয়েছিল, যত কঠিন পরীক্ষা করি না কেন, পাশ সে করবেই; তবু খেয়ালের বশবর্তী হয়ে লিখলাম
সেলিনা,
দোয়া নিও। আশা করি ভালো আছ। এই পত্রে আমি তোমাকে বিয়ে করার ব্যাপারে কতকগুলো শর্ত আরোপ করছি। আমার এই শর্তগুলো ভালভাবে পড়ে স্থির মস্তিস্কে চিন্তা করে আমাকে জানাবে। তোমার উত্তর পাওয়ার পর মতামত জানাব।
১. সারাজীবন তোমাকে খোর-পোশ দিতে পারব না।
২. তোমাকে চিরকাল ঐ বাড়িতে থাকতে হবে। যদিও তোমার গার্জেনরা অত্যাচার করে তোমাকে তাড়িয়ে দেয়, তবুও বাড়ি থেকে নিয়ে আসার জন্য আমাকে অনুরোধ করবে না।
৩. কোনো বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া অন্য যে কোনো কারণে আমাকে যখন তখন ডাকা চলবে না। ৪. বিয়ের ব্যাপারটা চিরকাল গোপন রাখতে হবে। আমার বা তোমার কোনো আত্মীয়ের কাছে আমাদের সম্পর্কের কথা প্রকাশ করবে না।
৫. গার্জেনদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে যদি কোনো রকম খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হও, তবে আমাকে না জানিয়ে নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না।
৬, বাইরে যাওার সময় বোরখা ব্যবহার করতে হবে।
৭. আমার দ্বারা তোমার যৌন ক্ষুধা নাও মিটতে পারে।
৮, বিয়ের পর ব্যাংকের যে টাকার তুমি স্বত্ত্বাধিকারী হবে, সে টাকা নেওয়ার জন্য আমাকে পিড়াপিড়ী করবে না।
৯, আমার সঙ্গে সব সময় মেজাজ বুঝে চলবে। আমাকে কাছে পেয়ে নিজের ইচ্ছামত কিছু বলতে বা করতে পারবে না।
১০. আমি খুব বদমেজাজী, যদি আমার মতের বিরুদ্ধে চল, তাহলে চাবুক মেরে আমার মতে চালাব।
১১. জীবন যাত্রা যতই দুর্বিসহ হয়ে উঠুক না কেন, কোনো দিন তালাকের কথা উচ্চারণ করবে না।
১২. উপরের, এগারটি শর্তের সবগুলো অথবা যে কোনো একটা শর্ত আরোপ করে কখনও কোর্টে নালিশ করতে পারবে না।
সেলিনা তুমি যদি এই চিঠি পড়ে আমাকে কাপুরুষ ও স্বার্থপর ভেবে ঘৃণা করে দূরে সরিয়ে দাও, তাহলে এর চেয়ে জীবনে পরম পাওয়া আমার কাছে আর কিছু নেই। উপরের মালিকই জানেন, আমি তোমার ভালো চাই, না মন্দ চাই। আমি তোমাকে এখনও বলছি উপরের শর্তগুলো পড়ে তোমার মত বদলান উচিত। কারণ এর ফলে তোমার ও আমার দুজনেরই ভালো হবে। তোমার জহির ভাইয়ের সঙ্গে যাতে বিয়ে না হয় তার ব্যবস্থা করে অন্য কোনো সুন্দর স্বাস্থবান ও চরিত্রবান ছেলের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিতে ইনশাআল্লাহ পারব। এই পত্র পড়ে তোমার শুভবুদ্ধির উদয় হোক আল্লাহপাকের দরবারে সেই দোয়া করে শেষ করছি। আল্লাহ হাফিজ।
ইতি—-
কিছুদিন আগে সেলিনা আমাকে একটা ফোন নাম্বার দিয়ে বলেছিল, এটা আমাদের তৃতীয় তলার ভাড়াটিয়াদের। উনি একজন দারোগা। আব্বার এক মক্কেলের কেসের ব্যাপারে ইনকোয়ারী করেছিলেন বলে রাজ সাক্ষী হয়েছিলেন। সেই থেকে আব্বার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। আমাকে উনি ও ওঁর স্ত্রী খুব ভালোবাসেন। ওঁদের একমাত্র মেয়ে জোবেদা আমার সহপাঠী ও প্রিয় বান্ধবী। এটা তাদেরই নাম্বার। যদি কোনো কারণে আমাকে দরকার হয়, তবে এই নাম্বারে ডায়েল করে বলবেন, জোবেদার বান্ধবীকে চাই। তাহলে যেই ফোন ধরুক না কেন, আমাকে ডেকে দেবেন। কারণ আপনার ও আমার ব্যাপারটা ওঁরা জানেন। আমি ওঁদেরকে এ রকম ভাবে ফোন আসার কথা বলে রেখেছি। দারোগার ফোন নাম্বার বলে ভয়ের কোনো কারণ নেই। সেলিনা নিজেদের ফোন নাম্বার না দিয়ে অন্যের নাম্বার কেন দিল তা বুঝতে পেরেও কি উত্তর দেয় শোনার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের নাম্বার দিলে না কেন?
সেলিনা মাথা নিচু করে উত্তর দিল, আমার প্রেমিক তা জানেন।
এই পত্র লেখার পর প্রায় দশ বার দিন তার সঙ্গে যোগযোগ না হওয়ায় একদিন ঐ নাম্বারে ফোন করলাম। দুবার রিং হওয়ার পর একজন বয়স্ক মহিলা বলে মনে হল রিসিভার তুলে বললেন, হ্যাল্লো, এটা দারোগা সাহেবের বাসা, কাকে চান?
প্রথমে ওঁর গলার ভারী আওয়াজ শুনে ভড়কে যাই। পরে আমতা আমতা করে বললাম, দয়া করে জোবেদার বান্ধবীকে একটু ডেকে দিতে পারেন?
আচ্ছা ধরুন বলে উনি রিসিভারটা পাশে রেখে হেঁকে বললেন, জোবেদা, তোর বান্ধবীকে কে যেন ফোনে ডাকছে।
আমি সব কথা শুনতে পেলাম।
প্রায় দুতিন মিনিট পর একটা মেয়ে রিসিভার তুলে হ্যালো, আমি সেলিনা বলছি বলে একটু হেসে উঠল।
আমি বললাম, আপিন সেলিনা নন, জোবেদা।
আমার কথা শুনে যে ফোন ধরেছিল সে আরও একটু জোরে হেসে উঠে বলল, নে ধর, তোর হবু বর নকল ধরে ফেলেছে।
সেলিনা বলল, কি যা তা বকছিস? উনি শুনতে পেলে খুব রেগে যাবেন।
আমি যে তাদের সব কথা শুনতে পাচ্ছি সেদিকে কারুরই খেয়াল নেই। সেলিনা ফোন ধরে আস সালামু আলায়কুম বলে বলল, আজ আমার কি সৌভাগ্য হতভাগীকে এতদিন পর ফোন করেছেন।
আমি ওয়া আলায়কুম আস সালাম বলে বললাম, কাল সকাল ৯টায় দোকানে আসবে। তারপর ফোন ছেড়ে দিলাম। ভাবলাম, ফোন নাম্বার জানা থাকলে লাইন কেটে গেছে মনে করে ফোন করত।
পরের দিন সকালে সাহেবের গাড়ি আমাকে নিউমার্কেটের গেটে পৌঁছে দিয়ে গেল। আমি গেটের বাইরের দোকান থেকে সিগারেট কিনছি, এমন সময় সেলিনা আমাকে সালাম দিল। আমি সালামের জওয়াব দিয়ে তাকে দোকানে আসতে বলে চলে আসি। আকবর নামে একটা ছেলে দোকানের ফাইফরমাস খাটে। সে দোকান ঝাঁট দিয়ে কলসি নিয়ে খাবার পানি আনতে গেল। আমি আগরবাতি জ্বেলে চেয়ারে বসলাম। তখন পর্যন্ত আমার সহকর্মীরা কেউ আসেনি।
সেলিনা একটা মোটা ফর্সা মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে তাকে দেখিয়ে বলল, আমার প্রিয় বান্ধবী জোবেদা।
জোবেদা হেসে আমাকে সালাম দিল।
আমি সালামের উত্তর দিয়ে বললাম, কেমন আছেন? আপনার কথা ওর কাছে। অনেক শুনেছি।
ভালো আছি বলে জোবেদা চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
তারা দুজনেই সেদিন হলুদ রং এর সাটিন কাপড়ের সালওয়ার কামিজ পরেছিল। আজ সেলিনাকে এই পোশাকে অপূর্ব সুন্দরী বলে আমার মনে হল। চোখে চোখ পড়তে সেলিনা দৃষ্টিটা নামিয়ে নিয়ে বলল, কাল অত তাড়াতাড়ি ফোন ছেড়ে দিলেন কেন?
বললাম, এর উত্তর তো তোমার জানা থাকা উচিত।
জোবেদা বলে উঠল, জানেন, আপনি ফোন ছেড়ে দেওয়ার পর ওতো লাইন কেটে গেছে মনে করে আবার আপনার ফোনের আশায় আধ ঘন্টা বসেছিল।
কথাটা শুনে সেলিনার ফর্সা মুখটা রাঙা হয়ে উঠল। বললাম, সে জন্য দুঃখিত। তারপর লজ্জার হাত থেকে বাঁচাবার জন্য জোবেদাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলাম, ইতিহাসে জোবেদা নামে একজন নারীর কথা বর্ণনা আছে, বলুন তো সেই নারী কে ছিলেন?
জোবেদা বলল, জানি না, আপনি বলে দিন।
বাগদাদের খলিফা হারুন আর রশিদের প্রাধান ও প্রিয় বেগম ছিলেন। তিনি নিজের খরচে প্রজাদের পানির কষ্ট দূর করার জন্য একটি খাল খনন করে দিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তারপর বললাম, আপনারা বসুন, আমার সহকর্মীরা আসা পর্যন্ত আপনাদের অপেক্ষা করতে হবে।
তারা না বসে ঘুরে ঘুরে দোকানের বই দেখতে লাগল। একটু পরে জোবেদা জিজ্ঞেস করল, এত বই এর নাম আপনার মুখস্থ আছে?
মৃদু হেসে বললাম, না!
তাহলে কাষ্টোমার চাইলেই ঝটপট বের করে দেন কী করে?
আয়নার সামনে দাঁড়ালে যেমন নিজের ছবি ভেসে উঠে, কাস্টোমার যখন কোনো বই চায় তখন ঠিক তেমনি মনের আয়নায় বইটির সবকিছু মনে পড়ে যায়। তাই তাড়াতাড়ি বের করতে পারি। মুখস্থ ধরলে হয়তো দুতিনশ নাম বলতে পারব। আর লিখতে বললে আরও দুএকশ বেশি লিখতে পারব। বাকি সব মনের আয়নায় পর্দার আড়ালে ষ্টক আছে। কেউ কোনো বই চাইলেই পর্দা সরে গিয়ে ঐ বইটির কথা ভেসে উঠে।
সেলিনা একটা বই এনে আমাকে মেমো করে দিতে বলল। বইটির মেমো করছি এমন সময় আমার দুজন সহকর্মীকে আসতে দেখে বললাম, আপনারা নভেলে গিয়ে বসুন, আমি আসছি।
বই এর দাম দিয়ে তারা চলে গেল।
মিনিট পাঁচেক পর আমি নভেল ড্রিংকে গিয়ে দেখি, দুজনে মুখোমুখি বসে গল্প করছে। আমি তাদের পাশে একটা চেয়ারে বসে বেয়ারাকে প্রথমে দুটো করে বড় মিষ্টি ও পরে চানাচুর ও চা দিতে বললাম।
জোবেদা বলল, আপনি বুঝি মিষ্টি খেতে খুব ভালবাসেন?
খাওয়ার ব্যাপারে আমার কোনো বাদ বিচার নেই। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের জন্য যা কিছু হালাল করেছেন, সবই আমি খেতে ভালবাসি। তার মধ্যে মিষ্টি ও ফলের উপর লোভ একটু বেশি। খাওয়া শেষ হতে বললাম, আরও তে বলি?
তারা দুজনেই বলে উঠল, আর খেতে পরব না।
তারপর চা খেতে খেতে চিঠিটা বের করে সেলিনার হাতে দিলাম। চিঠি নেওয়ার সময় তার হাত কাপছিল। কম্পিত হস্তে চিঠিটা ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে দিল।
জোবেদাকে বললাম, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
নিশ্চিন্তে করুণ।
আচ্ছা, আপনি তো ওর প্রিয় বান্ধবী? আপনার কি উচিত না ওকে বিপদ থেকে উদ্ধার করা? ও তো গুহার মধ্যে বাঘ আছে জেনেও তাতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।
জোবেদা বলল, সেলিনা যখন আমাকে প্রথম আপনার পরিচয় জানিয়ে সব কথা বলে তখন আমি ওকে অনেক বারণ করেছি। এমন কি ঝগড়া করে কয়েকদিন মেলামেশা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছি। শেষে আবার অনেক অনুনয় বিনয় করে বন্ধুত্ব ফিরে পেয়েছি। ভাবলাম, ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া করে বন্ধুত্ব নষ্ট করব কেন? অনেক দিন থেকে আপনার সঙ্গে পরিচয় করার ইচ্ছা ছিল, সেলিনাই করায় নি। গতকাল যখন ফোন ধরলাম তখন ওকে চাপ দিতে রাজি হয়ে আজ নিয়ে এসেছে। সত্যি কথা বললে আপনার সামনে আপনার প্রশংসা হয়ে যাবে, তবু বলছি, সেলিনা অপাত্রে প্রেম নিবেদন করেনি।
আপনি ওকে খুব ভালবাসেন, তাই এ কথা বলছেন। কারণ আমার মধ্যে এমন কোনো গুণ নেই, যা দেখে আমাকে সুপাত্র বলা যেতে পারে।
গুণীরা কোনো দিন নিজের গুণ নিজেরা জাহির করে না, বরং তা আপনা থেকে সুগন্ধি ফুলের খুশবুর মত চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
কথা বেশি বেড়ে যাচ্ছে দেখে বললাম, দেরি হয়ে গেল, আর সময় দিতে পারছি না। তারপর বিল পেমেন্ট করে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দোকানে ফিরে আসার সময় ভাবলাম, সেলিনা চিঠিটা পড়ে কি করবে কি জানি?
এরপর প্রায় বিশ পঁচিশ দিন সেলিনার কোনো খবর পেলাম না। প্রতিদিন দোকানে এলে মনে হত, আজ নিশ্চয় কোনো খবর পাব। চিঠিটা দিয়ে আমিও খুব অশান্তিতে ছিলাম। একদিন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে আর্জেন্ট বই সাপ্লাই দেওয়ার জন্য সকাল আটটায় দোকান খুলে কাউন্টারের উপর টাইপ মেশিন রেখে বিল তৈরি করছিলাম। ঠিক সাড়ে আটটার সময় সেলিনাদের ড্রাইভার এসে আমাকে ছোট্ট একটা ভাজকরা কাগজ দিয়ে বলল, খুকী ভাই দিয়েছে। দাদু চলে যাওয়ার পর কাগজটা খুলে পড়লাম
ওগো আমার হৃদয়ের স্পন্দন,
প্রথমে দুখিনীর সালাম নেবেন। পরে আপনার কদম মোবারকে আজি জানাচ্ছি, আগামীকাল বেলা এগারটায় আপনাকে পার্কের সেই জায়গায় পেতে চাই। এটাই হয়তো আমার জীবনের শেষ অনুরোধ। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি–
আপনার পথের কাঁটা
অভাগিণী সেলিনা।
চিঠি পড়ে বুঝতে পারলাম কাঁদতে কাঁদতে লিখেছে। কারণ চিঠিতে কাঁদার চিহ্ন ছিল। সেদিন ছিল মঙ্গবার, বুধবার বই নিয়ে রাজশাহী যাওয়ার কথা। সাহেবকে বলে সেখানে বৃহস্পতিবার যাওয়ার ব্যবস্থা করলাম। চিন্তা করে দেখলাম, যদি তার কথামত না যাই, তাহলে হয়তো কিছু করে ফেলতে পারে।
পরের দিন ঠিক এগারটার সময় পার্কের নিদিষ্ট জায়গায় গিয়ে দেখি সেলিনা চুপচাপ লেকের পানির দিকে চেয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে আছে। তার মুখ দেখে বুঝতে পারলাম একটু আগেও কেঁদেছে। আমি ধীর পদক্ষেপে কোনো সাড়া শব্দ না করে অল্প একটু দূরে বসলাম।
প্রায় পাঁচ মিনিট সেলিনা একই ভাবে থেকে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে হাতের ঘড়ি দেখল। তারপর আমাকে দেখতে পেয়ে এক রকম ছুটে এসে পাশে বসে আমার দুটো হাত নিয়ে নিজের গলায় চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ফাইন্যাল পরীক্ষা চলছিল বলে তোমার দেওয়া সেই চিঠি এতদিন পড়িনি। গত পরশু পরীক্ষা শেষ হয়েছে। রাত্রে চিঠিটা পড়ে আজ তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি। তুমি আমাকে এভাবে চিঠি লিখতে পারলে? তোমার ঐ চিঠির শর্ত ছাড়া যদি আরও হাজার শর্ত থাকে, সেগুলোও সব আমি মেনে নেব। তবু তোমাকে হারাতে পারব না। আর এতেও যদি তুমি রাজি না হও, তবে আমার গলাটিপে এখানে মেরে রেখে যাও। এইকথা বলে সে হাত দিয়ে আমার হাত দুটো নিজের গলায় বেশ জোরে চেপে ধরল। তার কথায় ও কাজে আমি খুব অভিভূত হয়ে গেলাম। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, তুমি এখন অপ্রকৃতস্থ। আমার কোনো কথা তোমাকে ভালো লাগবে না। তুমি বাসায় চলে যাও। আর কখনও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে না। তোমার সঙ্গে যদি আরও কিছুদিন আমার যোগাযোগ থাকে, তাহলে আমি পাগল হয়ে যাব। এইকথা বলে তার গলা থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত চলে আসতে লাগলাম।
সেলিনা ছুটে আমার সামনে এসে পথরোধ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, তুমি এভাবে আমাকে অন্ধকারে ফেলে রেখে যেও না। তোমার কাছ থেকে আজ আমি স্পষ্ট কিছু শুনতে চাই।
তার কাঁন্নাভেজা মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হারিয়ে ফেললাম। তারপর সামলে নিয়ে বললাম, তোমাকে বলার মতো আমার আর কিছু নেই। যা বলার আগেই চিঠিতে সব বলেছি। এখন তুমি আমার পথ থেকে সরে দাঁড়ালে হয়তো আমি বাঁচতে পারি। নচেৎ আমার যে কি পরিণতি হবে, তা উপরের মালিকই জানেন। শেষের দিকের কথাগুলো আমার নিজের কাছে ভেজাভেজা লাগল। শেষে কি তার কাছে কেঁদে ফেলব মনে হতে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে এলাম।
গেটের বাইরে ড্রাইভারের সঙ্গে দেখা। জিজ্ঞেস করল, খুকী ভাইকে কোথায় রেখে এলেন? পরশু রাত থেকে কিছু খায়নি, কারও সঙ্গে কথাও বলেনি? কি হয়েছে কেউ কিছু বুঝতে পারছে না।
কথাগুলো শুনে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। বললাম, আপনার খুকী ভাই লেকের ধারে আছে, আপনি গিয়ে নিয়ে আসুন।
বাসায় এসে স্ত্রীকে খেতে দিতে বললাম।
আমার স্ত্রী বলল, তরকারী হতে একটু বাকি আছে। তুমি জোহরের নামায পড়ে নাও, ততক্ষণে সবকিছু হয়ে যাবে।
অযু করে মসজিদ থেকে নামায পড়ে এসে খেতে বসে মোটেই খেতে পারলাম না।
আমার স্ত্রী বলল, তুমি যে কিছুই খেলে না!
বললাম, কি জানি খিদে রয়েছে অথচ রুচী নেই।
তোমাকে বেশ কিছু দিন যাবৎ লক্ষ্য করছি, মাঝে মাঝে তুমি খুব চিন্তিত থাক, অথচ আগে এরকম ছিলে না।
মানুষের মন কি আর সব সময় এক রকম থাকে? কিছুদিন যাবৎ শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না।
তাহলে ডাক্তারের কাছে একবার চেকআপ করাও না কেন?
তুমি অত ভেব না, একদিন না হয় ডাক্তারের কাছে যাব। মন থেকে চিন্তা দূর করার জন্য এবং ওকে খুশি করার জন্য বললাম, চল। আজ চিড়িয়াখানা দেখতে যাব। তারপর হোটেলে বিরানী খেয়ে বাসায় ফিরবো।
কথাটা শুনে আমার স্ত্রী খুব খুশী হল। সেদিন সারা বিকেল চিড়িয়াখানা দেখে হাতীর পিঠে চড়ে কাটালাম। ফেরার পথে ওর জন্য গ্যানিস থেকে একসেট সালওয়ার কামিজ কিনে হোটেলে খেয়ে বাসায় ফিরলাম।