ক্রন্দসী প্রিয়া – ১০

১০

আমার যখন ঘুম ভাঙল তখন পৌঁনে নটা। বাথরুমে সাওয়ারের পানি পড়ার শব্দ পেলাম। আলনায় সেলিনার বিয়ের আগে কিনে দেওয়া লাল শাড়ী, ব্লাউজ ও ব্রা দেখে মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি জাগল। বাথরুমের দিকে মুখ করে ঘুমিয়ে থাকার ভান করে শুয়ে রইলাম।

অল্পক্ষণ পরে সেলিনা দরজা একটু ফাঁক করে আমার দিকে তাকাল। আমাকে ঘুমন্ত মনে করে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আনার কাছে গেল। তার গায়ে শুধু একটা বড় তোয়ালে জড়ান ছিল। ঐ অবস্থায় তাকে দারুন লাগছিল। কাপড় পরার সময় তার শরীরের অনেক গোপন অংশ দেখে আমি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ি। কিন্তু সে ভাবটা খুব কঠোর ভাবে দমন করে তার সৌন্দয্য সুধা পান করতে থাকি। তারপর সেলিনা ড্রেসিং টেবিলের কাছে বসে নিজেকে পরিপাটি করে সাজাল। পাশে ড্রইংরুমের ঘড়িতে নটা বাজতে সেলিনা খাটের কাছে এসে ঝুঁকে পড়ে আমার ঠোঁটে চুমো খেয়ে যেই সোজা হতে গেল, ঠিক তখনই আমি তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বুকের উপর টেনে নিয়ে বললাম

বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান,
ফাঁদে পড়ে এবার তার দিয়ে যাও দাম।

এ-মা তাহলে তুমি জেগে ছিলে?

শুধু জেগেই নয়, মহারাণীর সব কার্যকলাপ অবলোকনও করেছি।

সেলিনার মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, বিবসনা নারীকে দেখা ইসলামে কঠোর ভাবে নিষেধ।

বললাম, হাদিসটা সত্য, কিন্তু নিজের স্ত্রীর বেলায় প্রযোজ্য নয়। এটাও হাদিসের কথা।

যাও, দুষ্টু কোথাকার। ছি, ছি, আমার বুঝি লজ্জা করে না? ছেড়ে দাও কেউ এসে পড়তে পারে।

আসুক গে, আমি তো আর কোনো অন্যায় করছি না। বিনা অনুমতিতে যে আসবে, সেই, বরং অন্যায় করবে।

তোমার দুটি পায়ে পড়ি ছেড়ে দাও লক্ষীটি।

তার আগে মুক্তিপণ চাই।

সেলিনা আমার ঠোঁটে চুমো খেলে আমি আস্তে করে তার ঠোঁটে কামড়ে দিলাম। তারপর ছেড়ে দিয়ে উঠে বসলাম।

নটি বয় বলে সেলিনা কাপড় ঠিক করতে করতে বলল, বাথরুমে সবকিছু আছে, তুমি গোসল করে নাও, আমি নাস্তা নিয়ে আসি বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

 আমি গোসল করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি, নাস্তা টেবিলের উপর রেখে সেদিনকার কেনা পাজামা পাঞ্জাবী হাতে করে সেলিনা দাঁড়িয়ে আছে।

তার হাত থেকে সেগুলো নিয়ে পরতে পরতে বললাম, প্রথমে নিউমার্কেটে তারপর আম্মাকে সালাম করতে যাব।

সেলিনা বলল, আম্মা বিয়েতে মত দেয়নি। সেইজন্য এখানে আসেও নি। সেখানে গেলে আবার যদি তোমাকে অপমান করে?

উনি মা, আমাকে যত বড় অপমান করুন না কেন, আমার কর্তব্য আমি করব। ওঁর কোনো দুর্ব্যবহারই আমাকে কর্তব্য থেকে বিরত করতে পারবে না।

নাস্তা খাওয়ার পর জরিনাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা নিচে এলাম।

ড্রাইভার দাদু আমাকে সালাম দিয়ে বলল, দুলাভাই কেমন আছেন?

আমি সালামের উত্তর দিয়ে বললাম, ভালো আছি। আপনি কাল এলেন না কেন?

আম্মাকে নিয়ে কাল গুলশানে এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়েছিলাম, ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়, তাই আসতে পারি নি।

দাদুকে নিউমার্কেটে যেতে বলে গাড়িতে উঠলাম। মার্কেটে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামার সময় সেলিনাকে বললাম, তুমি আসবে না কি?

আমাকে আস্তে করে খামচি কেটে বলল, আমার মতামত জিজ্ঞেস করতে নিষেধ করেছি না।

বললাম, ভুল হয়ে গেছে। তারপর জরিনার দিকে তাকাতে ও বলল, আপনারা যান, আমি যাব না।

সেলিনাকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে ব্যাংকে গেলাম। একটা চেক কেটে একাউন্টটেন্ট সাহেবকে বললাম, দেখুন তো এই চেকের পরিমাণ টাকা আমার একাউন্টে আছে কি না?

উনি চেকটা নিয়ে এসে বললেন, আছে।

আমি ক্যাশ করে দিতে বললাম।

কিছুক্ষণ পর একজন এসে টাকাগুলো আমার সামনে রাখল।

আমি টাকাগুলো গুণে নিয়ে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে অলিম্পিয়ায় গিয়ে ফুটস কেক ও মিষ্টি কিনে গাড়িতে উঠে ড্রাইভার দাদুকে বললাম, আপনাদের বাসায় চলুন।

সেলিনা এতক্ষণ কোনো কথা না বলে চুপ করে কি যেন ভাবছিল।

বললাম, তোমাদের বাসায় যাচ্ছি বলে কি তোমার ভয় হচ্ছে? আমার কিন্তু ভয় ডর বলতে কিছু নেই। তবু যখন কিছু বলল না, তখন ভাবলাম, ব্যাংক থেকে এত টাকা তুলেছি বলে হয়তো চিন্তা করছে।

গাড়ি ওদের বাসায় পৌঁছাবার পর ড্রাইভার দাদু নেমে প্রথমে সেলিনার দিকের এবং পরে আমার দিকের দরজা খুলে দিয়ে বলল, নেমে আসুন।

জরিনা সামনে বসেছিল, সে আগেই নেমেছে। আমাদের দেখে জোবেদা ও আরও দুতিন জন মেয়ে এসে দাঁড়াল।

আমি গাড়ি থেকে নেমে সবাইকে উদ্দেশ্য করে সালাম দিলাম।

জোবেদা সালামের উত্তর দিল।

সেলিনা জরিনাকে সঙ্গে নিয়ে উপরে যাওয়ার সময় জোবেদাকে বলল, তোমরা ওকে সঙ্গে করে নিয়ে এস।

জোবেদা বলল, চলুন দুলা ভাই।

উপরের বারান্দায় গিয়ে সেলিনাকে ডাকতে বললাম। এমন সময় তাকে আসতে দেখে জোবেদাকে বললাম, তোমরা একটু অপেক্ষা কর তারপর সেলিনাকে বললাম, আম্মার কাছে চল।

সেলিনা আমাকে নিয়ে ধীর পদক্ষেপে একটা দরজার কাছে গিয়ে পর্দা ঠেলে ভিতরে ঢুকে আম্মা বলে ডাকল।

দেখলাম, উনি জানালার রড ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি সেলিনার একটা হাত ধরে কাছে গিয়ে দুজনে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম।

উনি কোনো কথা না বলে ষ্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে রইলেন।

সেলিনা আমার হাত ধরে বেরিয়ে আসার সময় বলল, আম্মা খুব রেগে আছে। আমার সঙ্গেও কথা বলেনি।

সেলিনার ঘরে এসে দেখলাম, জরিনা ও জোবেদা ছাড়া সবাই চলে গেছে।

সেলিনা তাদের দুজনকে বাইরে ডেকে নিয়ে গিয়ে পরে একা ফিরে এসে জিজ্ঞেস করল, এখানে থাকবে, না অন্য কোথাও যাবে?

আজ এখানে থাকব। কালকের কথা কাল ভাবা যাবে। তুমি দাদুকে দিয়ে হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে রাখ। আমি জুম্মার নামায পড়তে যাচ্ছি, ফিরে এসে একসঙ্গে খাব।

মসজিদে নামাযের পর ইমাম সাহেবকে ব্যারিষ্টার সাহেবের কথা বলে নিজের পরিচয় দিলাম। তারপর সেলিনাকে কুরআন শরীফ পড়াবার ব্যবস্থা করে ফিরে এসে দেখি টেবিলের উপর খাবার সাজিয়ে সেলিনা বসে কাঁদছে।

বললাম, তুমি কাঁদছ কেন? আম্মা কি কিছু বলেছেন? জানতো, তোমার চোখের পানি আমাকে কত বিচলিত করে? তোমার চোখের অশ্রুবিন্দু আমার হৃদয়ে সূঁচের মতো বিধে।

সেলিনা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতেই বলল, আজকের দিনে তোমাকে হোটেলের খাবার খাওয়াতে আমার কলজে ফেটে যাচ্ছে।

আমি, তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, হোটেলের খাবার খেতে আমার কোনো দুঃখ নেই। যাও, হাত-মুখ ধুয়ে এস। খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। সেলিনাকে চুপ করে থাকতে দেখে চেয়ারে বসিয়ে আবার বললাম, ডেল কার্নেগী তার দুশ্চিন্তাহীন নূতন জীবন বই এর মধ্যে এক জায়গায় বলেছেন, যে কোনো বিপদের সময় মানুষ যদি বিচলিত না হয়ে অতীত ও ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে বর্তমানকে মেনে নিয়ে কর্তব্য ঠিক করে, তাহলে সে একদিন না একদিন বিপদ থেকে মুক্তি পাবেই। তোমাকে আমি সেই কথা বলছি, কি ছিলে? কি হল? কি হবে? এই সব চিন্তা করলে খুব, মুষড়ে পড়বে। তারচেয়ে সব রকম চিন্তা বাদ দিয়ে এখন স্বামীর সঙ্গে মজা করে পেট পুরে খাও, দেখবে অল ক্লিয়ার। আমার কথায় কাজ হল।

সেলিনা বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে আমার পাতেই খেতে বসল। আমি কিছু বললাম না, বরং খুশী হলাম। খাওয়া শেষ করে জিজ্ঞেস করলাম, এ বেলা কোথাও যেতে হবে নাকি?

 সেলিনাকে এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললাম, ভুলে গেছি। জান, আমি খুব ভুলা। অনেক সময় অনেক দরকারি জিনিসও ভুলে যাই। তারপর তাকে হাসাবার জন্য বললাম, আজ রাত জাগতে হবে এখন ঘুমিয়ে নাও। আমিও তোমার সঙ্গে একটু কমপিটিশন দেওয়ার চেষ্টা করব। তবুও যখন হাসল তখন দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে ওকে দুহাতে তুলে খাটে এনে শুইয়ে খুব আদর করলাম। সেলিনা হাঁপাতে লাগল। বললাম, কি, মন থেকে চিন্তা দূর হয়েছে? সে আমার বুকে মুখ লুকাল। তারপর আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।

দরজায় আওয়াজ হতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সেলিনাকে জাগিয়ে বললাম, দেখ, কে যেন দরজায় নক করছে।

সেলিনা গায়ে মাথায় কাপড় দিয়ে দরজা খুলে দিল।

জরিনা ট্রেটেবিলে নানা রকম ফুল ও মিষ্টিসহ চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল, আম্মা এগুলো পাঠিয়েছে। আর হোটেলের খাবার খেতে নিষেধ করেছে।

সেলিনা ছলছল নয়নে বলল, না, তুই এগুলো নিয়ে যা। আর আমরা হোটেলের খাবারই খাব।

জরিনাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি বললাম, তুমি কার কথা শুনবে? তোমার আপার, না আমার? জরিনা কিছু বলার আগে আমি আবার বললাম, তুমি নাস্তা রেডী কর, আমি তোমার আপাকে ম্যানেজ করছি। সেলিনাকে ডেকে কাছে বসিয়ে বললাম, মুরুব্বিদের, বিশেষ করে পিতা-মাতার দোষ। কোনোদিন ধরতে নেই। ওঁদের পায়ের তলায় সন্তানদের বেহেস্ত। কুরআন পাকের মধ্যে আল্লাহ এরশাদ করেছেন। আর তোমার পরওয়ার দিগার আদেশ করিয়াছেন। যে, তোমরা তাহাকে ব্যতীত অন্য কাহারো ইবাদত করিও না, এবং তুমি মা বাপের সহিত সদ্বব্যহার করিও, যদি তোমার সম্মুখে তাহাদের একজন কিংবা উভয়। বার্ধক্যে উপনীত হন, তবে তাহদিগকে উহ পর্যন্ত বলিও না (১)। প্রত্যেক পিতা মাতা সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন। তবে অনেক সময় পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের মনের মিল হয় না। সেজন্য পিতা-মাতার উপর রাগ করে থাকা সন্তানদের মোটেই উচিত নয়। এরপর শেষ অস্ত্র ব্যবহার করলাম। বললাম, আমি যখন রাগ না করে খেতে চাচ্ছি, তখন তোমার আর অমত করা উচিত নয়। কথাটা মন্ত্রের মত কাজ করল।

সেলিনা বলল, আমার অন্যায় হয়ে গেছে।

জরিনার দিকে চেয়ে বললাম, কি ছোট গিন্নী, নাস্তা খাওয়াবে? না আপার কথায় ফিরে যাবে? বলে জীব কেটে ফেললাম।

ওরা দুজনেই তখন হাসতে আরম্ভ করেছে।

বললাম, আমারও ভুল হয়ে গেছে। তোমাকে কি বলতে কি বলে ফেলেছি। তুমি যেন আবার কিছু মাইণ্ড করে বস না। আসল কথা কি জান? তোমাকে যে কি বলে ডাকব সেটা ভেবে ঠিক করতে না পেরে হঠাৎ করে ঐ সম্বোধনটা বেরিয়ে গেছে। নাম ধরে ডাকলে যদি আবার কিছু মনে কর। তার চেয়ে কি বলে ডাকলে তুমি খুশী হবে বলে দাও। তোমাদের এ্যারিস্ট্রোকেটি সম্বন্ধে আমি অনভিজ্ঞ।

জরিনা হাসতে হাসতে বলল, আপনার যা খুশী তাই বলে ডাকবেন, কোনোটাতেই আমার আপত্তি নেই।

সেই থেকে তাকে কখনো নাম ধরে, কখনো মিস আধুনিকা, আবার কখনো ছোট গিন্নী বলে ডাকতাম।

এমন সময় দরজার বাইরে থেকে জোবেদা বলল, আসতে পারি?

আমি বললাম, নিশ্চয় আসবেন।

জোবেদা দুজন মেয়েকে সঙ্গে করে ঘরে ঢুকে সালাম দিয়ে বলল, আমাদের আত্মীয়া আসমা ও রাবেয়া, দেশ থেকে বেড়াতে এসেছে।

আমি সালামের জওয়াব দিয়ে সবাইকে বসতে বললাম।

জরিনা সকলকে নাস্তা পরিবেশন করল।

হঠাৎ জরিনা বলে উঠল, দুলাভাই, আপনি সিনেমা দেখেন?

আমি সেলিনার দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমাদের কি মনে হয়?

সেলিনা বলল, আমাকে আবার জড়াচ্ছ কেন? আমি জিজ্ঞেস করেছি না কি?

বললাম, জরিনা না পারলে তুমিই বলে দাও।

জরিনা বলল, অত কথার দরকার নেই, দেখেন কি না বলুন।

দেখিনি বললে মিথ্যা বলা হবে! আজ পর্যন্ত যে কটা ছবি দেখেছি, তা আঙ্গুলে গোনা যাবে। সিনেমা বলতে কি বোঝায় তা জানার জন্য দেখেছি।

জরিনা আবার জিজ্ঞেস করল, কি জানলেন?

সিনেমা দেখে কিছু জ্ঞান লাভ করা যায় সত্য। কিন্তু সে রকম দর্শকের সংখ্যা কম। আর বর্তমানে যে সমস্ত ছবি দেখান হয়, তাতে করে সিনেমার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে। ব্যবসায়ে সাফল্য অর্জনের জন্য পর্দায় বহু ন্যাকেট ও অশ্লীল দৃশ্য দেখান হয়। এগুলো উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। এতে করে সমাজের নৈতিক চরিত্রের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। এই কারণে ইসলামের দৃষ্টিতে সিনেমা দেখা কঠোরভাবে নিষেধ। খাওয়া পরা, কাজ-কর্ম, আচার-অনুষ্ঠান প্রভৃতি যে কোনো ব্যাপারে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ যেখানে বেশি, সে ক্ষেত্রে আল্লাহ তার বান্দাদের মঙ্গলের জন্য সেই সমস্ত জিনিস হারাম করেছেন। যেমন মদ। মদ মানুষের অল্প কিছু উপকার করে, কিন্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে মদ মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। তাই আল্লাহ মদকে হারাম করেছেন।

 আসমা নামে নূতন আগত মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, নারী স্বাধীনতা সম্বন্ধে আপনার কি মত?

 বললাম, আমার মতামতের এক পয়সাও দাম নেই। আমি সব সময় সৃষ্টিকর্তা ও তাঁর রাসূল (দঃ)-এর পথে নিজেকে এবং অপরকে চালিত করার চেষ্টা করি। আর যা কিছু বলি কুরআন হাদিস মোতাবেক। নারী স্বাধীনতার কথা আলোচনা করতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। তবু অল্প কথায় বলার চেষ্টা করছি। আমরা জানি প্রত্যেক জিনিসের একটা সীমা আছে। আর যে কেউ সেই সীমার বাইরে যাবে নিশ্চয় তার বিপদ হবে। যেমন কেউ তার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করলে সে যে ক্রমশঃ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়বে একথা সকলেই স্বীকার করবে। কেউ পাহাড়ে উঠে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যদি সে পাহাড়ের বাইরে পা বাড়ায়, তাহলে কি হবে সে কথাও আমরা জানি। তাই মুসলিম নারী হিসাবে তাদের জানা উচিত, আল্লাহ নারীদের কতটা স্বাধীনতা দিয়েছেন। বর্তমান যুগে আমাদের দেশের নারীরা সেই সব না জেনে পাশ্চাত্যের অনুকরণে স্বাধীনতার যে সমস্ত বুলি আওড়িয়ে নারী স্বাধীনতার প্রয়াস চালাচ্ছে, ইসলামে তা নিষিদ্ধ। নারী স্বাধীনতার ফলে হয়তো। কিছু সংখ্যকের উপকার হয়েছে। সেটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিছু সংখ্যকের ব্যক্তিগত সুবিধা সারা বিশ্বের সমস্ত নারীদের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। যেমন ধরুন একজন অথবা কয়েকজন ব্যক্তি খাদ্যাভাবে মারা যেতে বসেছে, সে বা তারা তখন হারাম জিনিস খেয়ে জান বাঁচাতে পারে। তার বা তাদের জন্য ইসলামে এটা জায়েজ। তাই বলে সুস্থ, সবল ও ধনী ব্যক্তিদের জন্য তা হারাম।

রাবেয়া নামে অন্য মেয়েটি বলল, আর একটু ভালো করে বুঝিয়ে দিন।

একজন খুব গরিব লোক, তার পরনে কোনো কাপড় নেই। তার উপর ইসলামের হুকুম সে যেন উলংগ অবস্থায় বসে নামায পড়ে। তবু নামাযের মাফ নেই। এখন তাকে দেখে যদি সকলে ঐভাবে নামায পড়ে, তাহলে কি দৃশ্যের সৃষ্টি হবে তা চিন্তা করে দেখুন। সারা দুনিয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে, নারী স্বাধীনতার ফলে লাভের চেয়ে ক্ষতি অনেক বেশি হয়েছে। পৃথিবীর মধ্যে যে সমস্ত দেশ এই বিষয়ে বেশি অগ্রগামী তারা অর্থনৈতিক দিকে উন্নতি করলেও দাম্পত্য জীবনের সুখ শান্তি থেকে বঞ্চিত। ইসলাম নারীকে দুনিয়ার বুকে সর্ব প্রথম সম্মান দিয়েছে। তার আগে পুরুষেরা নারীকে শুধু ভোগের সামগ্রী মনে করত, তারা উৎপিড়ীতা ও লাঞ্ছিত হত। প্রতিকারের কোনো হাতিয়ার তাদের হাতে ছিল না। কুরআন মজিদের মধ্যে আল্লাহপাক বজ্রনিনাদে ঘোষণা করিয়াছেন, তোমরা নারীকে যতেচ্ছভাবে ভোগ কর না, ইচ্ছামত উৎপীড়ন ও অত্যাচার করো না।

আল্লাহপাকের হাবিব, হযরত মুহাম্মদ (দঃ) বলিয়াছেন-তোমরা তোমাদের স্ত্রীকে ভালবাস, তাদের সহিত নম্র ব্যবহার কর, তাদের ছোট ছোট দোষগুলো ক্ষমার চোখে দেখ। তাদের প্রতি তোমাদের যেমন হক আছে, তোমাদের প্রতি তাদেরও হক আছে।

তিনি আরও বলিয়াছেন, তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম, যে তাহার স্ত্রীর। সহিত উত্তম ব্যবহার করে।

তিনি আরো বলিয়াছেন, যখন কোনো মুসলমান পূণ্য লাভের আশায় তাহার স্ত্রীর জন্য কিছু ব্যয় করে, ইহা তাহার পক্ষে একটি দানের তুল্য হয়।

আর নারীদের উদ্দেশ্যে আল্লাহপাক এরশাদ করেছেন

তোমরা ইচ্ছামত যত্রতত্র চলাফেরা কর না। যদি কোন কারণ বশতঃ বাইরে যেতে হয়, তবে অন্ধ যুগের নারীদের মত বে আবরু হয়ে না যেয়ে নিজেকে একটা চাদর দিয়ে ঢেকে নিও।

এসব কথা আলোচনা করলে অনেক কথা বলতে হয়। আজকাল অনেক ধর্মীয় কিতাব বাংলায় অনুবাদ হয়েছে এবং হচ্ছে। আপনারা ঐ সমস্ত বই পড়বেন। তাহলে নিজেদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আইন সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারবেন। এখন আমরা একটু বাইরে যাব, আপনারাও গেলে খুশী হব।

জোবেদা বলল, আমরা এখন যেতে পারব না, অন্য এক সময় যাব। তারা বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর জরিনার দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমারও কি একই মত?

না, এক্ষুনি আসছি বলে জরিনা ট্রেটেবিল নিয়ে চলে গেল।

সেলিনাকে তৈরি হতে বলে বললাম, অনেকক্ষণ লেকচার দিলাম, কিন্তু কোনো পারিশ্রমিক পেলাম না।

সেলিনা উঠে এসে একটা চুমো খেয়ে বলল, এটা এ্যাডভান্স, ফুল পেমেন্ট রাত্রে।

আসরের নামায পড়ে জরিনাকে নিয়ে আমরা বায়তুল মোকাররমে গেলাম। একটা সেফার্স পেন কিনে তাতে প্রেজেন্টেড বাই দুলাভাই লিখিয়ে জরিনাকে দিয়ে বললাম, আমাদের দেশে বিয়ের মজলিসে খাওয়ার আগে দুলাভাইয়ের হাত তার শালা ধুইয়ে দিয়ে মোটা বখশীস পায়। তুমি আমার হাত না ধোয়ালেও প্রথম খাইয়েছ, তাই খুশি হয়ে দিলাম। তারপর কিছু টুকটাক কেনাকাটা করে বাসায় ফিরলাম।

রাত্রে খাওয়ার পর্ব শেষ করে শুয়ে শুয়ে একটা গল্পের বই পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না। সেলিনার ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখলাম, স্লিপিং গাউন পরে পাশে শুয়ে আমার গালে হাত বুলাচ্ছে।

আমি উঠে খাট থেকে নেমে চেয়ারে বসে পানি খেতে চাইলাম। সেলিনা খাট থেকে নেমে পানি দিল। পানি খেয়ে সিগারেট ধরিয়ে ব্রীফকেস থেকে টাকাগুলো। বের করে টেবিলের উপর রেখে বললাম, তোমার দেনমোহর বাবদ টাকা। এগুলো নিয়ে তুমি আমাকে দেনমোহরের দাবি থেকে মুক্তি দাও। এই দাবি পরিশোধ না করে স্ত্রীকে সম্পূর্ণ ভোগ করা ইসলামের দৃষ্টিতে উচিত নয়। এগুলো নিয়ে তোমার উপর আমার সম্পূর্ণ অধিকারের পথ করে দাও।

সেলিনা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বলল, মরে গেলেও আমি এ টাকা নিতে পারব না। তুমি আমাকে মাফ কর। আমার মস্তবড় ভুল হয়ে গেছে; আগেই ভেবে রেখেছিলাম, বিয়ের রাত্রেই তোমাকে দেনমোহরের দাবি থেকে মুক্তি দিয়ে দেব। কিন্তু তোমাকে পেয়ে আনন্দের অতিশৰ্য্যে তা ভুলে গেছি। এই টাকা না নিয়েই আমি তোমাকে ঐ দাবি থেকে মুক্তি দিলাম।

বললাম, দেনমোহর আদায় করার জন্য আল্লাহপাক পুরুষকে হুকুম করেছেন। আমি তার হুকুম পালন করেছি মাত্র। এতে তোমার কাঁদবার বা টাকা না নেওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। এটা তোমার ন্যায্য পাওনা।

সেলিনা বলল, আল্লাহপাক তো আরও বলেছেন, স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় খুশীর সঙ্গে স্বামীকে এই দাবি থেকে মুক্তি দেয়, তবে সেটা উত্তম ফায়সালা! আমি প্রথম হুকুমের চেয়ে দ্বিতীয়টাকে অধিক পছন্দ করি।

আমি বললাম, তোমার কথা ঠিক, তবে আমি কথাটা প্রথম উত্থাপন করেছি। দ্বিতীয়তঃ তোমার কাছে আল্লাহপাকের ও স্বামীর হুকুম। আর তুমি পরে বলেছ। আমার কাছে আল্লাহপাকের হুকুম ও স্ত্রীর অনুরোধ। এখন তুমিই বিচার কর কে কার কথা শুনবে?

সেলিনা কয়েক সেকেণ্ড কি যেন চিন্তা করল, তারপর টাকাগুলো আমার ব্রীফকেসে তুলে রেখে বলল, আপাততঃ এগুলো এখানে থাক, আমার টাকা আমি কি করব সে কথা আগামীতে ভাবব। তারপর নিজের চামড়ার সুটকেস খুলে কিছু কাগজ পত্র এনে আমাকে দুতিন জায়গায় সিগনেচার করতে বলল।

আমি না পড়ে জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কিসের কাগজ?

সেলিনা বলল, উইল মোতাবেক গতকাল থেকে আমি ব্যাংকের টাকার স্বত্বাধিকারী হয়েছি। আমি যখন তোমার, তখন আমার সবকিছুও তোমার। এই সিগনেচার ব্যাংকে যাবে। দরকার মতো তুমিও টাকা তুলতে পারবে। আর যদি দয়া করে অনুমতি দাও, তাহলে সমস্ত টাকা তোমার একাউন্টে ট্রান্সফার করে দেব, তুমি যা বলবে তাই হবে।

তার কথাগুলো শুনে মনে হল, কেউ যেন সীসা গরম করে আমার কানে ঢেলে দিল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বালা করে উঠল। আমি ভীষণ রেগে গেলাম। রেগে গেলে সাধারণতঃ আমার কোনো হুঁশ থাকে না। কিন্তু কেন কি জানি, ঐদিন আমি হুঁশ হারাইনি। শুধু সেলিনার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম।

আমার অবস্থা দেখে সেলিনা খুব ভয় পেয়ে ছল ছল নয়নে আমার পায়ের কাছে বসে পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলল, আমাকে মাফ করে দাও। আমার কথা শুনে তুমি এত বিচলিত হয়ে পড়বে জানলে কখনও বলতাম না। উম্মুল মোমেনিন হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রাঃ) বাসর রাত্রে তাঁর বিপুল ধনরাশী স্বামী হযরত মুহাম্মদ (দঃ)-এর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেই কথা ভেবে আমি বলেছি।

সেলিনার প্রেমের ও জ্ঞানের গভীরতা বুঝতে পেরে কে যেন আমার রাগের আগুনে পানি ঢেলে দিল। আমি তাকে তুলে জড়িয়ে ধরে বললাম, তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। তোমার প্রেম সেই ভুল ভাঙ্গিয়ে দিল। আমি আমার এই দুর্ব্যবহারের জন্য মাফ চাইছি।

সেলিনা আমার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, এভাবে বল না, আমি যে গোনাহগার হব।

না, এতে মোতার গোনাহ হবে না, আমারই ভুল হয়েছে। যাক, তুমি কিন্তু জীবনে আর কখনো এই টাকা নেওয়ার জন্য বলবে না। এটা ছাড়া তুমি যা বলবে, প্রাণ দিয়ে হলেও তা রক্ষা করব। তুমি প্রেমের জোরে আমাকে বিয়ে করেছ। আমিও তোমাকে প্রেমিকার আসনে বসিয়ে বিয়ে করেছি। টাকার কথা তুলে আমাদের পবিত্র প্রেমকে কলঙ্কিত করো না। যদি আর কখনো তোল, তাহলে খুব মর্মাহত হব। মা খাদিজার (রাঃ) কথা যে বললে, তিনি সব কিছু বিলিয়ে দেওয়ার মতো উপযুক্ত স্বামী পেয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে পৃথিবীর কোনো মানুষের তুলনা করা উচিত নয়। তোমার সবকিছু গ্রহণ করার যোগ্যতা আমার নেই। মাঝে মাঝে মনে বড় ভয় হয়, তোমার এত গভীর প্রেমের ভার কতদিন আমি সহ্য করতে পারব? তার উপর যদি তোমার সবকিছু আমাকে দিয়ে দাও, তাহলে হয়তো আমি পাগল হয়ে যাব।

কান্নাভেজা কণ্ঠে সেলিনা বলল, আর কখনও এই কথা বলব না। তবে স্বাধীনভাবে এই টাকা খরচ করার অনুমতি তুমি আমাকে দাও।

বললাম, তোমার টাকা তুমি খরচ করবে, তাতে আমি কোনো দিন বাধা দেব না। কথাটা চিন্তা না করে বলেছিলাম। তাই পরবর্তী কালে যখন ও আমার পিছনে টাকাগুলো পানির মত খরচ করত তখন যদি বলতাম, শুধু শুধু আমার পিছনে এতটাকা খরচ করছ কেন? আমাকেও তোমার পিছনে কিছু খরচ করতে দাও তখন সেলিনা কুপিতভাবে লত, তুমিই তো আমাকে খরচ করার অনুমতি দিয়েছ। আর তোমার টাকা আপামনি ও ছেলেমেয়েদের জন্য খরচ করলে আমি বেশি খুশী হব। এমন সময় ড্রইংরুমের ঘড়িতে রাত বারটা ঘোষণা করল।

সেলিনা কাগজপত্রগুলো তুলে রেখে আমার কাছে এসে বলর, ঘুমাবে না?

না, আজ ঘুম নয়, শুধু আনন্দ। কি রাজি তো?

লজ্জায় সেলিনা দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল।

আমি তাকে দুহাতে তুলে নিয়ে বিছানায় গেলাম।

পরের দিন নাস্তার পর বেলা সাড়ে নটার সময় আমার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় আমাকে বলল, তুমি আমার বইয়ের কালেকসান দেখে আরও কিছু লিষ্ট তৈরি কর। আমি ততক্ষণে ফিরে আসব।

সেলিনা চলে যাওয়ার পর তাকে একটা চিঠি লিখলাম। তারপর বই এর লিষ্ট করে সিগারেট ধরিয়ে চিন্তা করলাম, সেলিনা কোথায় গেল? কেমন যেন সন্দেহ হতে আমার ব্রীফকেসটা খুলে দেখি, টাকাগুলো নেই। আমি চেয়ারে বসে মুজতবা আলির শবনম বইটি পড়তে লাগলাম।

সেলিনা ফিরে এসে চুপি চুপি আমাকে চেয়ারের পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি আমার দেনমোহরের টাকাগুলো আমার প্রেমিকের একাউন্টে জমা দিয়ে এলাম। আশা করি, উনি তার প্রেমিকার এই ধৃষ্টত্তা নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন।

মনে ব্যাথা পাবে ভেবে কিছু না বলে শুধু একটু হাসলাম। এরকম যে কিছু একটা করবে, তা আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। তাকে সামনে এনে বললাম, কাউকে কিছু দান। করলে দক্ষিণাও দিতে হয়। আমি দানের চেয়ে দক্ষিণার প্রত্যাশী বেশি।

সেলিনা আমার কোলে বসে সারামুখ চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে বলল, এর বেশি আমি দিতে পারছি না। আরো বেশি কিছু পেতে চাইলে তোমাকে নিজে সেটা নিতে হবে বলে লজ্জায় আমার বুকে মুখ লুকাল।

আমিও কিছু প্রতিদান দিয়ে বললাম, দক্ষিণা অল্প একটু হলেই চলে। তার থেকে অনেক বেশি পেলাম। আমি অল্পে সন্তুষ্ট থাকি। কারণ হাদিসে আছে, অল্পে সন্তুষ্ট ব্যক্তি বিরাট সম্পত্তির মারিক।যারা অল্পে সন্তুষ্ট হয় তারা বিপদে বা দুঃখকষ্টে সহজে মুষড়ে পড়ে না।

সেলিনা বলল, আজ আমাদের রেজাল্ট বেরিয়েছে। আল্লাহপাকের রহমতে ও  তোমার দোয়ার বরকতে আমি ফাষ্ট ডিভিসনে পাশ করেছি। এই দেখ বলে খবরের কাগজটা আমার সামনে ধরে তার রোল নাম্বার দেখাল।

আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে কংগ্রাচুলেশন দিয়ে বললাম, তাহলে তো আমার প্রিয়তমাকে কিছু উপহার দিতে হয়। বল কি পেলে তুমি খুশী হবে? এই বলে তাকে দুহাতে তুলে নিয়ে সারা মুখ আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে দোয়া করলাম-হে পরওয়ার দেগার রাহমানুর রহিম, তুমি আমার প্রিয়তমাকে দুনিয়া ও আখেরাতের সকল পরীক্ষায় এই ভাবে সম্মানের সাথে পাশ করিয়ে দিও।

সেলিনা বলল, তুমি যদি এখন আমাকে লক্ষ টাকার জিনিস উপহার দিতে, তাহলেও আমি এত বেশি আন্দিত হতাম না। আমার মন যা পেয়ে খুশী হয়, তা তুমি দিয়েছ! আমি আর কিছুই তোমার কাছে চাই না।

সুযোগ পেয়ে বললাম, একটা কথা বলব; কিন্তু কিছু মনে করতে পারবে না।

সেলিনা হাসি মুখে বলল, কি কথা বল, আমি কিছু মনে করব না।

আমাকে এবার যে ছুটি দিতে হবে? কিন্তু হাসি মুখে। বিদায় বেলায় কান্না আমি পছন্দ করি না।

ছুটির কথা শুনে সেলিনার চোখে পানি এসে গেল। ওড়না দিয়ে চোখ মুছে বলল, আজ নয় পরশু, তবে কয়েকটা সর্ত আছে।

মহারানীর সর্তগুলো শুনতে চাই।

প্রথম- আবার কবে এই দাসি তোমার দেখা পাব?

দ্বিতীয় বলার সাথে সাথে তার হাতে একটা ভঁজকরা কাগজ দিয়ে বললাম, আমি আমার প্রিয়তমার সমস্ত সর্ত জানি। তাই সে যখন বাইরে গিয়েছিল তখন তার সর্তগুলোর উত্তর লিখে রেখেছি। তুমি এই পত্র মোতাবেক কাজ করলে আমরা উভয়েই সুখী হব।

সেলিনা আমার সামনের চেয়ারে বসে কাগজটা খুলে পড়তে লাগল।

প্রিয়তমা, তোমাকে এই চিঠি লিখতে মন চায়নি। তবু কর্তব্যের খাতিরে লিখলাম। কারণ মন এক জিনিস আর কর্তব্য অন্য এক জিনিস। আমার কাছে মনের বাসনার চেয়ে কর্তব্য বড়। আমি প্রতি বৃহস্পতিবার দিনগত রাত্রে আসব। যদি কোনো কারণবশত আসতে না পরি, তবে পরের দিন সকালে আসব। বোরখা ছাড়া বাইরে কোথাও যাবে না। জীবনে কোনোদিন মিথ্যা বলবে না। শরীয়তের কারণ ছাড়া নামায রোযা ত্যাগ করবে না। ইডেন কলেজেই এ্যাডমিশন নিতে পার। আমি যে সমস্ত বইয়ের লিষ্ট করে দিয়েছি, সেগুলো পড়ে আদর্শ নারী হওয়ার চেষ্টা করবে। সব রকম বই পড়ার অনুমতি দিলাম। তবে ধর্মীয় বই পুস্তক বেশি পড়বে। আমর হুকুম ছাড়া যেখানে খুশি যাওয়া চলবে না।
তুমি যদি আমার প্রাপ্য মর্যাদা আমাকে দাও, তাহলে জীবনে কোনোদিন আমার কাছ থেকে রূঢ় ব্যবহার পাবে না। যদিও আমি জানি আমার প্রেমিকা স্ত্রী কোনোদিন আমার অমর্যদা করবে না, তবু খামখেয়ালির বশবর্তী হয়ে লিখলাম। ছেলেবেলা থেকে আমি বড় খামখেয়ালি। সেই জন্য সঙ্গিরা স্কুল লাইফে আমাকে খামখেয়ালি সম্রাট মহম্মদ বিন তুঘলুক বলে ডাকত। যৌন মিলনে আমার পূণ স্বাধীনতা থাকবে। তোমার প্রেম যখন আমাকে টানবে তখন আমার সময়ের জ্ঞান থাকবে না। গিয়ে যদি তোমাকে না পাই, তাহলে ভীষন রেগে যাব। আর রেগে গেলে আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তখন খুব খারাপ ব্যবহার করে ফেলতে পারি। এমন কি চাবুক মেরে তোমার শরীর থেকে গোস্ত তুলে নিতেও দ্বিধাবোধ করব না।
কী খুব অনুশোচনা হচ্ছে নাকি? নিশ্চয় তোমার মনে হচ্ছে, আচ্ছা পাগল লোকের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করেছি রে বাবা? বিয়ের পর দুদিন যেতে না যেতে চাবুক মারার ভয় দেখাচ্ছে?
এখন বুঝতে পারছ, আমি কি স্বভাবের লোক। বিয়ের দুদিন পর কোনো স্বামী যে তার স্ত্রীকে এইসব কথা লিখতে পারে না, তা আমি জানি। মন চাইল তাই লিখলাম। এটাকেও তুমি আমার একটা খামখেয়ালী মনে করতে পার।
আশা করি, আমার চরিত্র সম্বন্ধে তোমার মোটামুটি ধারণা হয়েছে। এখন আমি আমার প্রেমিকা সহধর্মিণীর কাছ থেকে জীবন যাত্রার সহযোগীতা কামনা করে শেষ করছি আল্লাহ হাফেজ।
ইতি
তোমার খামখেয়ালী প্রিয়তম স্বামী।

সেলিনা চিঠিটা দুবার পড়ল। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার প্রেমকে দুবছর ধরে পরীক্ষা করেও কি, তোমার সন্দেহ মিটেনি? তুমি যে চরিত্রের লোক হওনা কেন, আমার কাছে আল্লাহ ও রাসূলের (দঃ) পরে তোমার স্থান। অন্যায় করলে যত কঠিন শাস্তি তুমি দাওনা কেন, আমি তা মাথা পেতে নেব। তোমার কাছে সুখ পেয়ে যেমন শান্তি পাব, দুঃখ পেয়েও তা সইতে পারব। মনে কোনো রকম অনুশোচনা আসবে না। তুমি দুদিন পরে চলে যাবে। এসব কথা বাদ দিয়ে আমাকে তোমার সেবা করতে দাও।

বললাম, আজ পর্যন্ত তোমাকে যত রকমের পরীক্ষা করেছি, সবগুলোতেই ফুলমার্ক পেয়ে পাশ করেছ। পরীক্ষার ফলাফলে খুশি হয়ে আমার মন তোমাকে কিছু দিতে চাইছে। তুমি এখন আমার কাছে কিছু চাও। সাধ্যের মধ্যে হলে এক্ষুনি দেব। আর তার বাইরে হলে সারাজীবন ধরে তা দেওয়ার চেষ্টা করব।

কোনো চিন্তা ভাবনা না করে তৎক্ষণাৎ সেলিনা বলল, আমি শুধু তোমার প্রেম চাই। প্রেম ছাড়া তোমার কাছ থেকে আমি আর কিছুই চাই না।

তাকে খুব আদর করে বললাম, দেব, সমস্ত মন প্রাণ উজাড় করে তোমাকে প্রেম দেব। জান, মাঝে মাঝে খুব চিন্তা হয় তোমার এত গভীর প্রেম আল্লাহপাক আমার ভাগ্যে কতদিন রেখেছেন?

সেলিনা বলল, তুমি বুঝি এই সব চিন্তা কর? আর কখনও ঐ রকম চিন্তা করবে না। বরং আমারই কেবল মনে হয় তোমার প্রেমের তুলনায় আমারটা কত নগণ্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *