ক্যাশমেমোয় কিস্তিমাত
‘হ্যালো, স্যর..হ্যালো, হ্যালো…’
একটু তন্দ্রা মতো এসে গিয়েছিল শিয়ালদহ জিআরপির অফিসার—ইন চার্জের। আগের দিন ভিআইপি ডিউটি ছিল। সারা রাত জাগা। আজও সকাল থেকে বিস্তর ধকল গিয়েছে। লকআপের কয়েকজন আসামীকে কাগজপত্র দেখে কোর্টে চালান করা, তারপর বড় সাহেবের রুটিন ভিজিট, বিকেলে শিয়ালদহের রেল পুলিশ সুপারের মিটিং—সারা দিনে একটুও বসার সুযোগ হয়নি। হঠাৎ প্রথমে টেবিলের সামনে পড়ে থাকা ওয়াকিটকি, আর তারপর মোবাইলে অন—ডিউটি সাব ইন্সপেক্টরের গলা শুনে তন্দ্রা কেটে গেল।
সবে দিনের আলো ফিকে হয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। শিয়ালদহ স্টেশন চত্বর এই সময়টা যেরকম থাকার কথা, তেমনই। ঘেমে নেয়ে ক্লান্ত জনতার ভিড় এগোতে চাইছে ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে। অফিস ফেরত যাত্রীদের ভিড়, কলেজ পড়ুয়া তরুণ—তরুণীদের ভিড়, মালবাহকদের হাঁ, সাইড দিজিয়েগা, সাইড সাইড’ চিৎকারের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে প্ল্যাটফর্মে একের পর এক ট্রেনের ঘোষণা। এই সময়টা ভিড়ের সুযোগে পকেটমারদের হাত সাফাইয়ের গোল্ডেন আওয়ার। তাঁর অফিসারদের বারবার বলে দিয়েছেন জিআরপি থানার বড় বাবু, ‘সন্ধ্যা থেকে রাত অন্তত ন’টা পর্যন্ত ভালো করে প্ল্যাটফর্মে নজর রাখবে। পকেটমারি, মোবাইল চুরি কিন্তু এই সময়েই হয় সবচেয়ে বেশি। থানার ডিউটি অফিসারকেও সতর্ক থাকতে বলে রেখেছেন তিনি।
কিন্তু তরুণ সাব ইন্সপেক্টরের গলায় চাপা উত্তেজনার আঁচে অভিজ্ঞ ওসি—র বুঝতে অসুবিধা হয় না, এটা কোনও চোর—পকেটমারের কেস নয়। হ্যাঁ, বলো, কী ব্যাপার? কিছু গোলমাল হয়েছে নাকি, প্রশ্ন করেন। অফিসারটি জবাব দেন, ‘স্যর, আ ব্যাগ অ্যান্ড আ হোন্ড—অল আর লাইং আনঅ্যাটেন্ডেড।’
ভুরু কুঁচকে ওসি বলেন, ‘কোথায়? কতক্ষণ পড়ে রয়েছে?’
ও—প্রান্ত থেকে জবাব আসে, ‘স্যর, স্টেশনের সামনেই। ভিআইপি পার্কিং ইয়ার্ডে। আমি আশপাশটা নজর রাখছিলাম। কিন্তু ট্রলি ব্যাগ আর হোল্ড অলটা কে রেখে গেল, ভিড়ের মধ্যে বুঝতে পারিনি। অনেকক্ষণ ধরেই পড়ে রয়েছে। এখনও কেউ ক্লেম করতে আসেনি।’
ব্যাগ কেউ ভুল করে ফেলে যেতেই পারে।ভুলোমনা মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কিন্তু ব্যাগ বা হোল্ড—অলে সন্দেহজনক কিছু নেই তো? বিস্ফোরক বা তেমন কিছু সময় নিলেন না ওসি। অফিসারকে বললেন, ‘ইমিডিয়েটলি জিআরপি কন্ট্রোলে মেসেজ দাও। স্নিফার ডগ, বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডের লোকজনকে আগে পাঠাতে হবে। আর জায়গাটা আপাতত ঘিরে রাখার ব্যবস্থা করো। স্নিফার ডগ আসার আগে পর্যন্ত কেউ যেন ব্যাগ না ছোঁয়। অফিসারকে নির্দেশ দিয়ে নিজেই বেরিয়ে পড়েন তিনি।
তরুণ অফিসারটি চটপটে। তাঁর পিঠে হালকা চাপড় মেরে ওসি বললেন, ‘এত বড় ট্রলি ব্যাগ, হোল্ড—অল সবটাই কেউ ভুলে চলে যায় কী করে?’ দ্রুত খবর পৌঁছে গিয়েছিল জিআরপি কন্ট্রোলে। আরপিএফের কয়েকজন জওয়ানও এসে পড়েছিলেন। পুলিশের স্নিফার ডগ আর বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডের লোকজনও চলে এসেছিলেন। তাঁরা পরীক্ষা করে জানিয়ে দিলেন, ব্যাগ বা হোন্ড—অলে বিস্ফোরক জাতীয় অন্তত কিছু নেই। কিন্তু পুলিশের স্নিফার ডগ ক্রমাগত ব্যাগ আর হোল্ড—অল খুঁকেই চলেছে। কুকুরের হ্যান্ডলার বুঝতে পারলেন, বিস্ফোরক হয়তো নেই। তবে কিছু একটা নিশ্চিত আছেই ব্যাগে। জিআরপি থানার ওসি তরুণ অফিসারটিকে নির্দেশ দিলেন, ব্যাগটা খোলো তো! কী আছে? মাদক—টাদক কিছু কী!’
ট্রলি ব্যাগের চেন টানতেই আঁতকে উঠলেন অফিসার, স্যর, ডেডবডি!’
না, ঠিক দেহ বললে ভুল হবে। ট্রলি ব্যাগের মধ্যে একটা প্ল্যাস্টিকের প্যাকেটে মোড়া এক মহিলার কাটা মাথা। অন্য প্যাকেটে দু’টো কাটা হাত, দু’টো পা। ট্রলি ব্যাগে জমাট বাঁধা রক্ত। হোল্ড—অল খুলতেই সেখান থেকে বেরল কাপড় আর প্ল্যাস্টিক দিয়ে মোড়া এক মহিলার গলা থেকে ঊরু পর্যন্ত কাটা অংশ। পেটের জায়গাটা ধারালো অস্ত্র দিয়ে চিরে ফালা ফালা করে দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত অ্যাসিড ঢেলে দেওয়া হয়েছে তাঁর উপর। চামড়ায় পোড়া দাগ এমনটাই ইঙ্গিত করে। মৃতদেহ অনেক দেখেছেন অভিজ্ঞ অফিসার—ইন—চার্জ। রেললাইনে ট্রেনে কাটা পড়া দেহও দেখেছেন বহু। তা বলে এরকম? এত নৃশংসতা? এভাবে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছে একজন বছর ৩৭—৩৮ এর মহিলার দেহ? মহিলার শরীরের অংশগুলো দেখে অন্য পুলিশকর্মীদের অনেকেরই গা গুলিয়ে উঠছিল।
ব্যাগ—হোল্ড—অল পরীক্ষা করে, সুরতহালের পর দেহ চালান করে দেওয়া হল মর্গে। পাঠকের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখা ভালো, সুরতহাল বা ইনকোয়েস্ট করা যে কোনও সন্দেহজনক বা অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় বাধ্যতামূলক। অস্বাভাবিক মৃত্যু মানে খুন, আত্মহত্যা, দুর্ঘটনা, কোনও যন্ত্র বা পশুর আক্রমণে মৃত্যু বা এমন কোনও মৃত্যু যেখানে কোনও অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে বলে পুলিশের সন্দেহের উদ্রেক হয়। ভারতীয় ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী, এরকম ঘটনা ঘটলে থানার ওসি বা দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার নিকটবর্তী একজিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটকে ডাকবেন। তারপর যেখান থেকে উদ্ধার হয়েছে মৃতদেহ, সেখানে সাক্ষীদের উপস্থিতিতে খতিয়ে দেখতে হবে দেহটি। সেটা কী অবস্থায় পড়ে রয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে দেহের কোন কোন জায়গায় কী ধরনের আঘাতের চিহ্ন আছে, সেই আঘাত কী ধরনের অস্ত্র থেকে হয়ে থাকতে পারে সে সবকিছু নিয়ে প্রাথমিক রিপোর্ট তৈরি করার আইনি প্রক্রিয়া হল সুরতহাল। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে উদ্ধার হওয়া মহিলাটি যে খুনই হয়েছেন, তাতে সন্দেহ নেই।
২০ মে, ২০১৪। শিয়ালদহ জিআরপি থানার তদন্তকারী অফিসার কেস লিখলেন। এক অজ্ঞাতপরিচয় মহিলাকে খুনের পর দেহ টুকরো করে কেউ ফেলে দিয়ে গিয়েছে স্টেশনের পার্কিংয়ে। খুনের মামলাও রুজু হল অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীর বিরুদ্ধে। প্রাথমিক কাজগুলো সারতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। ওসি বলে রেখেছিলেন আগেই তাঁর অফিসারদের, রাতে সংশ্লিষ্ট সব অফিসারের সঙ্গে কথা বলবেন, কেসটার তদন্তের ব্যাপারে। পুলিশকর্মীরা পৌঁছলে অফিসার—ইন—চার্জ বললেন, “দেখো, আমাদের জিআরপি থানায় চুরি—ছিনতাই—পকেটমারির মামলা লেগেই থাকবে। এই রকম কেস বড় একটা পাবে না। এটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিতে হবে আমাদের। যত দ্রুত সম্ভব দরকার মহিলা কে, সেটা জানার। তাহলে কাজ অনেকটা সহজ হয়ে যাবে। এখন থেকে লেগে পড়ো।’
প্রবল প্রতিহিংসায় স্ত্রী, প্রণয়ী বা বন্ধুর দেহ খণ্ড খণ্ড করে ফেলে দেওয়া হয়েছে, এমন ঘটনার উদাহরণ ইন্টারনেট—হোয়াটস অ্যাপের যুগে বিরল নয়। সে সদ্য স্বাধীনোত্তর সময়ের কলকাতায় বেলারানি দত্ত হত্যা মামলাই হোক অথবা সাড়া ফেলে দেওয়া দিল্লির বিখ্যাত তন্দুর হত্যাকাণ্ড। সিনেমা সিরিয়ালে এমন ঘটনা বহুবার উঠে এসেছে। কিন্তু ঠিকই বলেছিলেন জিআরপি—র ওসি। জিআরপি থানায় এই ধরনের মামলা বড় একটা আসে না। রোজকার একঘেয়ে পকেটমারি, চুরি, ছিনতাই, বড়জোর মাদক খাইয়ে লুঠ বা ডাকাতির জন্য জড়ো হওয়ার ঘটনা ছাড়া তদন্তের মতো মামলা কোথায়? এমন কেস, যার কিনারা করার চ্যালেঞ্জে বাড়তি অ্যাড্রিনালিনের ক্ষরণ হয় শিরা—উপশিরায়, যাতে প্রচুর পরিশ্রম আর ক্লান্তি উপেক্ষা করে অবিরাম কাজ করে চলার মতো শক্তি পায় মস্তিষ্ক? একটু জটিল কেস হলেই তো তা সিআইডির হাতে তুলে দেওয়া হয়। চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন শিয়ালদহ জিআরপি থানার তদন্তকারী অফিসার। অন্য পুলিশকর্মীরাও। যে প্ল্যাস্টিকের প্যাকেটে মোড়া হয়েছিল মহিলার মৃতদেহ, ট্রলি ব্যাগ ও হোন্ড অলে মাথা আর দেহাংশ ভরে ফেলে গিয়েছিল খুনি, আবার দিনের আলোয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন তদন্তকারীরা, ছাইয়ের স্তুপ উড়িয়ে যদি বা মিলে যায় তদন্তের অমূল্য রতন!
মিলল একটা সূত্র, অমূল্য কি না—তা সময়ই বলে দেবে। ট্রলি ব্যাগের একটা পকেট হাতড়ে পাওয়া গেল একটা চিরকুট। কী এটা? তদন্তকারী অফিসারটি খুলে দেখে বললেন, “আরে, এটা তো দোকানের ক্যাশমেমো। তারিখটা…হ্যাঁ, পড়া যাচ্ছে। বছর দুয়েক আগেকার। কাস্টমারের নাম—জয়ন্তী দেব। ঠিকানা, ৮২৭এ, লেকটাউন।’
ওসিকে সবটাই জানালেন তদন্তকারী অফিসার। তাহলে এখনই চলে যাও লেকটাউন। দেখো, কাল যাঁর বডিটা পাওয়া গিয়েছে, তিনিই এই মহিলা কিনা?’ নির্দেশ দিলেন ওসি।
গন্তব্য, ৮২৭এ, লেকটাউন। সেখানে গিয়ে দেখা গেল দরজা তালা বন্ধ। ফ্ল্যাটে কেউ নেই। আশপাশের লোকজনের কাছ থেকে জানা গেল অবশ্য, ওখানেই জয়ন্তী দেব থাকেন। যে মহিলার দেহের টুকরো পাওয়া গিয়েছিল শিয়ালদহ স্টেশনে, তাঁর ছবিও দেখানো হল ওই বাড়ির অন্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের। খুনের পর চেহারা অনেকটা বিকৃত হয়ে গিয়েছিল ঠিকই, তবে চিনতে অসুবিধা হয় না, ইনিই জয়ন্তী দেব। কয়েক বছর ধরে ওই ফ্ল্যাটে একা থাকছিলেন। তাঁর স্বামী সুরজিৎ দেব আলাদা থাকতেন বছর চারেক। এক মেয়েও আছে তাঁদের। বাবার সঙ্গে থাকে মেয়ে। কেন আলাদা থাকতেন সুরজিৎ—জয়ন্তী, তা নিয়ে অবশ্য কিছু বলতে পারলেন না প্রতিবেশীরা। হয়তো পারিবারিক গোলমাল কিছু। তবে মাঝে কিছুদিন তাঁরা একসঙ্গে ছিলেন, জানা গেল পড়শিদের কাছ থেকে। সুরজিৎ কোথায় থাকেন, জানতে চান তদন্তকারী অফিসার। বাড়ি বেহালায় জানি, কোথায় বলতে পারব না। তবে ক্লাইভ রোয়ের একটা কোম্পানিতে কাজ করেন বলে শুনেছি, জবাব আসে অন্য এক পড়শির কাছ থেকে। কোনও শত্রুতা, কারও সঙ্গে গোলমাল, বাড়িতে সন্দেহজনক কারও আগমন—অন্য কিছুর হদিশ দিতে পারলেন না তাঁরা।
ক্লাইভ রোয়ের বহুজাতিক সংস্থার অফিসে গিয়ে সুরজিতের ঠিকানা পাওয়া গেল। দ্রুত তাঁর বাড়িতে পৌঁছে গেল পুলিশ।
—আপনি কি সুরজিৎ দেব? —হ্যাঁ, কেন। আপনারা হঠাৎ বাড়িতে এসেছেন কেন? কী ব্যাপার? —আপনার স্ত্রী জয়ন্তী দেবের ডেডবডি পাওয়া গিয়েছে গতকাল, শিয়ালদহ স্টেশনে, জানেন?
—ওহ মাই গড। না, না, জানতাম না। কী, কী হয়েছে? আসলে আমরা অনেক বছরই একসঙ্গে থাকতাম না। আলাদা থাকতাম।
—কেন? অস্পষ্ট জবাব দেন সুরজিৎ, অন্য কারও সঙ্গে নাকি সম্পর্ক ছিল জয়ন্তীর। তা নিয়েই ঝামেলা হয় বেশ কয়েক বছর আগে। তারপর থেকে আলাদা থাকেন দু’জন। তবে সরকারিভাবে ডিভোর্স হয়নি তখনও। —আপনারা কি তারপর আর কখনও একসঙ্গে থাকেননি? লেকটাউনের বাড়িতে কখনও যাননি আপনি?
—না, না। প্রশ্নই ওঠে না। —কিন্তু আমরা তো ওখানে গিয়ে জেনেছি, আপনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কিছুদিন ছিলেন। কদিন আগেই। অস্বীকার করতে পারেন?
—ও, হ্যাঁ, মনে আছে। ১ মে থেকে দু—তিনদিন ছিলাম ওই বাড়িতে। আমার মেয়েও ছিল সঙ্গে। তখন তো কোনও গোলমাল হয়নি। সত্যি বলছি, বিশ্বাস করুন।
পুলিশি তদন্তের প্রথম শর্তই বলে, প্রমাণ ছাড়া কিছু বিশ্বাস করবে না। বিশেষ করে যখন গোড়াতেই হোঁচট খেলেন সুরজিৎ। খুব তো পুরোনো কথা নয়। লেকটাউনের বাড়িতে তিনি যে গিয়েছিলেন, অস্বীকার করলেন কেন প্রথমে? ভুলে গিয়েছিলেন? নাকি কিছু সত্যিই লুকোচ্ছেন সুরজিৎ?
তদন্তকারী অফিসার বিস্তারিত জানালেন ওসিকে। স্যর, ওঁকে কি অ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে এসে জেরা করব? তাহলে সত্যিটা বেরিয়ে পড়বে।
ওসি বলেন, না, শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে অ্যারেস্ট করলে জামিন পেয়ে যাবে তাড়াতাড়ি। আরও একটু ভালো করে নজর রাখো ওর উপর। প্রত্যেকটা মাইনিউট ডিটেলস জোগাড় করো। তারপর।’
ইতিমধ্যে ময়না তদন্তের রিপোর্ট এসে পৌঁছল পুলিশের কাছে। শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে জয়ন্তী দেবকে। মাথা ও শরীরের অন্যান্য অংশে আরও কয়েকটি আঘাতের চিহ্ন। খুনের পর দেহ কাটা হয়েছে। একেবারে পেশাদার হাতে। উদ্ধার হওয়ার অন্তত ১৮ থেকে ২৪ ঘণ্টা আগে খুন হয়েছেন জয়ন্তী।
তাহলে কি খুনি পেশাদার? তার সঙ্গে কি আরও লোক ছিল? সাত—পাঁচ ভাবতে ভাবতে লেকটাউনের বাড়িতে আবার গেলেন তদন্তকারী অফিসার। আরও তথ্য জোগাড়ের চেষ্টা করলেন জয়ন্তী দেবের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে। কবে ওই ফ্ল্যাটে এসেছিলেন সুরজিৎ? কতদিন ছিলেন? আর কেউ কি এসেছিলেন সঙ্গে? এক পড়শির কাছ থেকে বেরোল একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। দু’—একদিন নয়, আরও বেশি দিন ওই বাড়িতে ছিলেন সুরজিৎ। এমনকি যে দিন জয়ন্তীর দেহ উদ্ধার হয় শিয়ালদহ স্টেশনে, তার আগের দিনও। অর্থাৎ ১৯ মে—ও ওই ফ্ল্যাটে দেখা গিয়েছে সুরজিৎকে। সেদিন ভোরবেলা ওই ফ্ল্যাটের বাথরুম থেকে একটানা জল পড়ার আওয়াজও পেয়েছিলেন জয়ন্তীর উপরতলার ফ্ল্যাটের এক বাসিন্দা।
‘এমনিতে হবে না। সুরজিৎকে নিয়ে লেকটাউনের ফ্ল্যাটে যাও। ওখানে নিশ্চয়ই কোনও সূত্র পাওয়া যাবে, তদন্তকারী অফিসারকে নির্দেশ দিলেন ওসি। গোড়ায় ওই ফ্ল্যাটে যাওয়ার ব্যাপারে নিমরাজি ছিলেন সুরজিৎ। তদন্তকারী অফিসার জানিয়ে দেন, ‘ভালোয় ভালোয় চলুন। তা না—হলে বুঝতে হবে আপনি তদন্তে অসহযোগিতা করছেন।’ সুরজিৎকে নিয়ে লেকটাউনের ফ্ল্যাটের দরজা খোলা হল। শোওয়ার ঘরের মেঝেয় রক্তের দাগ তখনও স্পষ্ট। জল দিয়ে ধোওয়ার চেষ্টা হয়েছে জায়গাটা, বুঝতে অসুবিধা হয় না তদন্তকারী অফিসারের।
—কী ব্যাপার? রক্তের দাগ কেন?
—জানি না। আমি তো এখানে থাকতাম না। আপনাকে অনেকবার বলেছি। যে কয়েকদিন ছিলাম তখন এসব কিছু দেখিনি।
—জানি বলেছেন। আবার জানতে চাইছি। স্ত্রীর সঙ্গে থাকলেন, অথচ আপনার স্ত্রী নিখোঁজ আর আপনি কিছুই জানতেন না?
—না, বলছি তো, আমি কিছু জানি না।
কেউ সত্যিই কিছু জানেন না, নাকি না—জানার ভান করছেন, পোড়খাওয়া পুলিশ অফিসারের ফারাকটা ধরতে সময় লাগে না। সুরজিৎবাবু আপনাকে আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে। ওখানেই যা কথা হওয়ার হবে। তা না—হলে জানেন তো। আমাদের আরও অনেক রাস্তা আছে, জানিয়ে দেন অফিসার। জিআরপি থানায় তুলে আনা হল বছর পঁয়তাল্লিশের সুরজিৎকে।
জেরা পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে বেশ কয়েক ঘণ্টা। লাগাতার জেরায় ধুকছেন সুরজিৎ, ‘ভাঙব, তবু মচকাব না’, ভাবটা বজায় রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আত্মপক্ষ সমর্থনে যা যা বলার, বলতে সুযোগ দেওয়া হল তাঁকে। তাঁর বক্তব্যের অসঙ্গতি মুহূর্তে নোট করে নিচ্ছিলেন তদন্তকারীরা। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার আত্মতুষ্টি যখন অজান্তেই ঘিরে ধরছে সুরজিৎকে, তখন পাল্টা প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিলেন গোয়েন্দারা। কেন হঠাৎ জয়ন্তী দেবীর ফ্ল্যাটে গেলেন সুরজিৎ? কবে গেলেন? কখন বের হলেন ফ্ল্যাট থেকে? কী কথা হয়েছিল আপনার স্ত্রীর সঙ্গে? কী—কেন—কবে—কখন—একের পর এক প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙে সুরজিতের, স্বীকার করে নেন একটা সময়, ‘আমি খুন করেছি ওকে। আমিই করেছি। বেশ করেছি।’
এই মুহূর্তটার অপেক্ষায় ছিলেন তদন্তকারীরা। এরপর অভিযুক্তের মনোেবল ভেঙে ফেলাটা শক্ত নয়। সামান্য বিরতির পর আবার শুরু হয় জেরা পর্ব।
—কেন খুন করলেন? আর কে কে ছিল আপনার সঙ্গে? আপনিই কি স্ত্রীর দেহ এভাবে কাটলেন?
—আমি করেছি সব। অন্য পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল ওর। বারবার বারণ করেছিলাম। রোজ ঝামেলা হত।
—কার সঙ্গে সম্পর্ক?
—জানি না।
খুনের স্বীকারোক্তির পর অভিযুক্তের কাছ থেকে সত্যিটা বের করে আনা ছিল স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। জেরায় জেরায় জর্জরিত সুরজিৎ স্বীকার করলেন, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক জয়ন্তীর নয়, ছিল তাঁরই। বান্ধবীর নাম লিপিকা পোদ্দার। দু’—একদিনের সম্পর্ক নয় সেটা। দীর্ঘদিনের। কয়েক বছর আগে তখন গুরুতর অসুস্থ সুরজিতের মা। মায়ের দেখভালের জন্য আয়া হিসাবে দেব পরিবারে আগমন লিপিকার। স্ত্রী একটু চোখের আড়াল হলেই লিপিকার সঙ্গে একটু একটু করে ঘনিষ্ঠতার শুরু সুরজিতের। তবে সে কথা জয়ন্তীদেবীর কানে পৌঁছাতে দেরি হয়নি। বাড়ির আয়ার সঙ্গে স্বামীর ঘনিষ্ঠতা মেনে নিতে পারেননি তিনি, মানিয়ে নিতেও না। বারণ করেছিলেন গোড়ায়। পরকীয়া সম্পর্কের ফাঁস থেকে স্বামীকে সরিয়ে আনার সবরকম চেষ্টাও করেছিলেন। ঝগড়া করেছেন স্বামীর সঙ্গে, প্রবল অশান্তি হয়েছে মাঝেমধ্যেই। কে কার কথা শোনে? লিপিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ বেড়েছে সুরজিতের। মানসিক যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হতে শেষ পর্যন্ত স্বামীকে ছেড়ে আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নেন জয়ন্তীদেবী। তাঁদের মেয়ে অবশ্য থাকছিলেন বাবার সঙ্গেই। মাঝেমধ্যে দেখা করতে মায়ের কাছে আসত সে।
কিন্তু আলাদা থাকলে তো লেকটাউনের ফ্ল্যাটটা মিলবে না। এই ফ্ল্যাট জয়ন্তীদেবীর নামে। তাই পথের কাঁটা সরাতে হবে। বান্ধবীর সঙ্গে পরিকল্পনা করে লেকটাউনের ফ্ল্যাটে গেলেন সুরজিৎ। ভাব দেখালেন, যেন পুরোনো বিবাদ সব মিটিয়ে ফেলতে চান। চান জয়ন্তীদেবীর সঙ্গে নতুন করে সব শুরু করতে। জয়ন্তীও ভাবলেন, স্বামীর হয়তো মতি ফিরেছে। সুরজিতের সঙ্গে তাঁর মেয়েও গিয়েছিল মায়ের ফ্ল্যাটে। ১৯ মে সন্ধ্যা থেকেই প্রবল ঝগড়া হয় স্বামী—স্ত্রীয়ের। তারপরও রাতে একঘরে শুয়েছিলেন সুরজিৎ—জয়ন্তী। পাশের ঘরে মেয়ে। বেশি রাতে আধোঘুমে থাকা স্ত্রীর মাথায় প্রদীপ রাখার পিলসুজ দিয়ে আঘাত করেন সুরজিৎ। জয়ন্তীদেবী অচৈতন্য হয়ে লুটিয়ে পড়েন। মায়ের চিৎকারে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল মেয়েরও। সুরজিৎ তাকে বোঝান, ‘মা পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। আমি দেখছি। সকাল হলেই ডাক্তার ডাকব। তুই সকালে বন্ধুর বাড়ি চলে যাস। বাবার কথা শুনে ঘুমোতে চলে যায় তাঁর মেয়ে। ২০ মে, ভোরের আলো ফুটতেই মেয়েকে বন্ধুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেন সুরজিৎ। ডেকে পাঠান লিপিকাকে। তখনও শরীরে সাড় ছিল জয়ন্তীদেবীর। সুরজিৎ—লিপিকা দু’জনে মিলে তাঁর মুখে বালিশ চেপে ধরেন। জয়ন্তীদেবীর হাতপায়ের সামান্য নিষ্ফল ছটফটানি একটা সময় থেমে যায়।
—নাহ, শ্বাস পড়ছে না। কাজ শেষ। নিশ্চিত হন সুরজিৎ—লিপিকা।
ঘটনার পুর্ননির্মাণ
কাজ অবশ্য পুরোপুরি শেষ হয়নি তখনও। ফ্ল্যাট থেকে বের করে বডিটা তাঁরা ফেলবেন কোথায়? কদিন পরই তো শুরু হবে খোঁজাখুঁজি। তখন? বান্ধবীর পরামর্শে তাঁর এক পরিচিতকে ডেকে পাঠান সুরজিৎ। নাম সঞ্জয় বিশ্বাস। পেশায় কসাই। এই কাজের বিনিময়ে সে পাবে হাজার পাঁচেক টাকা। সঞ্জয়ের উপর দায়িত্ব বতাল দেহটাকে এমনভাবে কাটতে হবে, যাতে শনাক্ত করার উপায়মাত্র না থাকে। পেশাদার কসাইয়ের দক্ষতায় নিপুণ হাতে জয়ন্তীর দেহ থেকে আলাদা করা হয় মাথা, হাত, পা। জয়ন্তীদেবীর নিজের ঘরেই। হাঁটু মুড়ে বসে যখন কাজ সারছে সঞ্জয়, অল্প দূরে বসে সুরজিৎ—লিপিকা। যেন কিছুই হয়নি। মুরগি কাটার থেকেও সহজে কেটে ফেলা হয় জয়ন্তীদেবীর দেহ। তারপরও শনাক্তকরণের সব সম্ভাবনা দুর করতে অ্যাসিড দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ারও চেষ্টা হয় দেহের টুকরোগুলো। প্ল্যাস্টিকের প্যাকেটে মুড়ে ট্রলি ব্যাগ আর হোল্ড অলে ভরে ফেলেন তিনজন। ডেকে আনা হয় ট্যাক্সি। সকালেই সুরজিৎরা দেহ ট্যাক্সিতে তুলে বেরিয়ে পড়েন। শিয়ালদহ স্টেশনে এসে দেখেন প্রচুর লোক। এতবড় ব্যাগ—হোল্ড—অল রাখতে গেলে লোকের চোখে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। তাই সেখান থেকে সুরজিৎ চলে যান বাবুঘাটে। সেখানেও বাস। স্ট্যান্ডে লোকজনের ভিড়। তাই দেহ লোপাট করতে দিনের আলো পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন তিনজন। দিনের আলো একটু নেমে আসতেই সুযোগ বুঝে তাঁরা শিয়ালদহের ভিআইপি পার্কিংয়ের সামনে চুপচাপ নামিয়ে দেন ব্যাগ—হোল্ড—অল। প্রথমে সুরজিৎরা ভেবেছিলেন, পুলিশ দেহ খুঁজে পেলেও তা শনাক্ত করা যাবে না। আর তাঁকে পুলিশ জেরা করতে এলে বলে দেওয়া যাবে, অন্য পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল জয়ন্তীদেবীর। হয়তো প্রেমিকের সঙ্গে কোথাও চলে গিয়েছেন। বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যাবে নির্বিকার। তবে দুনিয়ার সবচেয়ে বুদ্ধিমান অপরাধীও তো ভুল করে। যেমন, ক্যাশমেমো ট্রলিব্যাগেই ফেলে এসেছিলেন সুরজিৎরা।
তিনজনের স্বীকারোক্তির পাশাপাশি ফ্ল্যাটের পড়শি, ট্যাক্সিচালকের বয়ান, যে অস্ত্র দিয়ে দেহ টুকরো করা হয়েছিল, তা কেনার রসিদের মতো টুকরো টুকরো সব তথ্যপ্রমাণই আদালতে জমা দিয়েছিল পুলিশ। আদালতে বিচারকের কাছে গোপন জবানবন্দি দিয়েছিল সঞ্জয়। হাজার পাঁচেক টাকার বিনিময়ে তাকে দেহ কাটার বরাত দিয়েছিলেন সুরজিৎ—লিপিকা, তাও জানিয়েছিল আদালতে। পরিকল্পনামাফিক খুন ও সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাটের অন্যতম ষড়যন্ত্রকারীর বয়ানকে গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করে আদালত।
এখানে একটা আইনি ব্যাখ্যা জরুরি। ভারতীয় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারা অনুযায়ী বিচারকের কাছে দেওয়া গোপন জবানবন্দির গুরুত্ব অপরিসীম। যাঁর জবানবন্দি নেওয়া হচ্ছে, বিচারক তাঁর কাছ থেকে জেনে নেন কোনও চাপের মুখে তিনি এই বয়ান দিচ্ছেন কি না। এই বয়ান তাঁর বিরুদ্ধেও যেতে পারে, তাও স্মরণ করিয়ে দেয় আদালত। অন্যান্য সাক্ষ্যপ্রমাণের সঙ্গে তুল্যমূল্য যাচাই করে যদি সেই বয়ানের সমর্থন মেলে, তাহলে অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করা অনেকটা সহজ হয়ে যায়। পুলিশ হেফাজতে দেওয়া বয়ানের ক্ষেত্রে অবশ্য বিষয়টা এক নয়। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় পুলিশ অভিযুক্তের স্বীকারোক্তি রেকর্ড করে। কিন্তু পুলিশ হেফাজতে মারধর করে সেই স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে, এমন অভিযোেগ তুলতেই পারেন অভিযুক্ত। অতীতে অভিযোগ উঠেছে বিস্তর। তাই প্রমাণ হিসাবে এই স্বীকারোক্তির গুরুত্ব বা ওজন অনেকটাই কম।
দীর্ঘ সওয়াল—জবাব শেষে শিয়ালদহের প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক বলেন, “নিখুঁত পরিকল্পনা করে এই খুন। এই ঘটনা বিরলের মধ্যে বিরলতম। আদালত তিনজনেরই ফাঁসির নির্দেশ দিয়েছে। সন্তানের দোহাই দিয়ে লঘু শাস্তির আর্জি জানিয়েছিলেন সুরজিৎ—লিপিকা। ধোপে টেকেনি সেই আবেদন। নিম্ন আদালতের রায় নিশ্চিতভাবেই চ্যালেঞ্জ হবে উচ্চ আদালতে। আইনি লড়াই চলবে ঠিকই। তবে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক আর অর্থলোভ বহু নৃশংস খুনের নেপথ্য কারণ হয়েছে সেই সুলতানি বা মুঘল আমল থেকে। কিন্তু লোভ আর পরকীয়া সম্পর্ক মানুষকে যে এভাবে পশুসম করে তোলে, ভাবলে এখনও শিউরে উঠতে হয়।