ক্যালেন্ডার – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
ইংরেজি বছরের শুরুতে পাঠ্যবই বিক্রির মরসুম। শহরতলির সরু গলির মোড়ের ছোট দোকানটিও খদ্দেরে গিজগিজ করছে। আশেপাশের দু তিনটি হাইস্কুলের বইয়ের তালিকা দেখে পাতলা টেকস্ট বই আর তার মোটা মোটা নোট, ইতিহাস ভূগোল স্বাস্থ্য গণিত কিনে এনে তাক ভরে রেখেছে দোকানের মালিক মুকুন্দ বিশ্বাস। বেলা নটা বাজতে না বাজতেই পাড়া উজাড় করে নানাবয়সী ছেলে মেয়ে তার দোকানে এসে ভিড় করেছে। বইয়ের দোকান তো নয়, যেন বড় একখানা মৌচাক। মৌমাছিদের গুঞ্জনের বিরাম নেই, ক্লাসে প্রমোশন পেয়ে এক একজন দিগ্বিজয় করে এসেছে। কারও সবুর সইছে না।
‘ও মুকুন্দদা, আমার বইগুলি আগে দিন।’
‘তা হবে না। আমি কিন্তু সব চেয়ে আছে এসেছি। আমাকে শ্যামলের আগে দিতে হবে।’
মুকুন্দ কখনও বা ধমক দিচ্ছে কখনও বা হাসিমুখে বলছে, ‘দেব ভাই দেব। সবাইকেই দেব। বই তো তোমাদের জন্যেই এনেছি।’
এক হাতে সব কাজ। লিস্ট দেখে বই বাছাই করা; দাম ধরে ক্যাশমেমো লেখা, প্যাক করা— কিন্তু তাতেও কি শান্তি আছে? এরপর আবার প্রত্যেকের একখানা করে ক্যালেন্ডার চাই। যে দশ টাকা দামের বই নেবে তাকে না হয় একখানা ক্যালেন্ডার দেওয়া যায়, কিন্তু এক টাকার খদ্দেরও যদি ক্যালেন্ডার চায় তা হলে কি ধৈর্য থাকে?
মুকুন্দ তাই মাঝে মাঝে মুখ বাঁকিয়ে ভেংচি কেটে ওঠে, ‘যাঃ ভাগ। এক টাকা দেড় টাকার বই নিয়ে আবার ক্যালেন্ডার চাই। রুটিন ছেপেছি। তাই নিয়ে যা। বেশ বড় বড় খোপটানা। কোন দিন কী পড়া, সব লিখে রাখতে পারবি। ক্যালেন্ডারের চেয়ে বেশি কাজে লাগবে।’
কিন্তু কাজের জিনিসের চেয়ে অকেজো জিনিসের উপরই ক্রেতাদের আগ্রহ বেশি।
অভিযোগ আসে, ‘বাঃ রে, ক্যালেন্ডার দেবেন না, আগে বললেই পারতেন। আমরা বেলগাছিয়ার বাণীভবন থেকে বই কিনতাম।’
ছেলেদের ধমকে ফেরান যায়। কিন্তু ক্লাস নাইন-টেনের কিশোরী ছাত্রীরা যখন ক্যালেন্ডারের আবদার করে, মুকুন্দ তাদের বিমুখ করতে পারে না। তার বয়স এখনও পঁচিশের নাচে। ছেলেদের সঙ্গে আর মেয়েদের সঙ্গে ব্যবহারটা একরকম করতে তার ইচ্ছা করে না। এমনকী অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভিন্ন রকম হয়ে যায়। কাউকে বা সত্যিই একখানা ক্যালেন্ডার দেয়, কাউকে বা হাসিমুখে প্রতিশ্রুতিটুকু দিয়ে রাখে। কিন্তু শুধু অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরাই নয়, দেশসুদ্ধ বুড়ো গুড়ো যেন ক্যালেন্ডারের জন্যে কাঙাল হয়ে উঠেছে। কর্পোরেশনের কাউন্সিলার আনন্দবাবু ভাল একখানা ক্যালেন্ডার চেয়ে গেছেন, চেয়েছেন ডাঃ সোম, বাজারে মুদি বিনোদ কুণ্ডু। তার কাছ থেকে ধারে চাল ডাল কেনে মুকুন্দ। মাসকাবারে সব দেনা কাবার হয় না। সুতরাং বিনোদকেও একখানা ক্যালেন্ডার দিতে সে বাধ্য। তারপর সুরবালা বিদ্যাপীঠের দু একজন টিচারের দাবি আছে। কিন্তু এই অজস্র কাঙালি-বিদায়ের মতো অফুরন্ত ক্যালেন্ডার-ভাণ্ডার কোথায় মুকুন্দের। মাত্র বছর তিনেক হল এই দোকানখানা দিয়েছে মুকুন্দ। স্কুলের বইয়ের মরসুমে বিক্রিবাটা যা কিছু হয়। তাই খেয়েই সারা বছর কাটে, অন্য সময় নভেল-টবেল কিছু কিছু এনে রাখে। কিন্তু দু একটা বিয়ের তারিখ ছাড়া এখানে বাজে বই বড় তেমন বিক্রি হয় না। কোনও কোনও খদ্দের আছে মোটা মোটা নভেল চেয়ে চিন্তে নিয়ে যায়। ফেরত দেওয়ার সময় দু-এক আনা পয়সা গুঁজে দেয় হাতে। এই তো ব্যবসা। এতে আর কি নিজের দোকানের নামে ক্যালেন্ডার ছাপা চলে? অবশ্য ছাপবার সাধ মুকুন্দের আছে। তার দোকান ভারতী গ্রন্থালয়ের নামে আলাদা ক্যালেন্ডার হবে; বছর বছর নতুন নতুন ছবি, ভাল ভাল আর্টিস্টকে ফরমায়েস করিয়ে আঁকা। তার নীচে একটি মাত্র নাম— প্রোপ্রাইটার শ্রীমুকুন্দ বিশ্বাস। ছাপার অক্ষরে নিজের নামটি দেখতে কি ভালই না লাগে। নিজেকে সত্যিই একজন নামকরা মানুষ বলে মনে হয় তখন। কিন্তু এ সাধ মেটাবার অনেক দেরি মুকুন্দের। সংসারে বিধবা মা। ঘাড়ের উপর একটি আইবুড়ো বোন। ওদের খাওয়া পরার খরচ মিটিয়ে তবে তো দোকানের দিকে তাকাতে পারে মুকুন্দ। মরসুম তো মরসুমি ফুলের মতো। দুদিন বাদেই শুকিয়ে যায়। তারপর সারা বছর ধরে টানা হ্যাঁচড়া চলে। দোকানের মূলধনে হাত পড়ে। ধারে দেনায় ডুবু ডুবু হবার জো হয়।
দোকানের নামে ক্যালেন্ডার ছাপবারস্বপ্ন এখন বহু দূরে মুকুন্দর। আপাতত কলেজ স্ট্রিট পাড়ার বড় বড় দোকানদারদের কাছ থেকে, পাইকারদের কাছ থেকে সে চেয়ে চিন্তে ক্যালেন্ডার সংগ্রহ করে। ভাল ভাল খদ্দেরদের বিলিয়ে তাদের খুশি রাখে। সামাজিকতা বজায় রাখে পড়ার প্রতিপত্তিশালীদের সঙ্গে। কিন্তু বড় বড় পাইকাররা তো উদার হাতে ক্যালেন্ডার ছাড়ে না যে, মুকুন্দ দোকানে দানছত্র খুলতে পারে। তাই হাতের মুঠি তাকে শক্ত করে রাখতে হয়, যার তার কাছে হৃদয় খুলতে পারে না।
ছোট বড় নানা বয়সী ছেলেমেয়ে আর তাদের অভিভাবকদের কাছে বই বিক্রি করার ফাঁকে এইসব নানা কথা মনে হচ্ছিল মুকুন্দর। তার দোকানে এক বৃদ্ধ ঢুকলেন, ‘কি ভায়া, বেচাকেনা কেমন হচ্ছে?’ মুকুন্দ তার দিকে তাকিয়ে অপ্রসন্ন মুখে বলল, ‘আসুন।’ কিন্তু ‘বসুন’ কথাটি আর বলল না।
ভদ্রলোকের বয়স সত্তর পেরিয়ে গেছে। দীর্ঘ চেহারা নুয়ে পড়েছে সামনের দিকে। মাথায় একগাছি চুল নেই, মুখের মধ্যে একটিও অবশিষ্ট নেই দাঁত। পায়ে ছেঁড়া চটি, গায়ে একটি চাদর জড়ান। মালিকের মতো সে-চাদরেরও বয়স হয়েছে। আসল রংটি এখন আর ধরবার জো নেই।
মুকুন্দ তাঁর সঙ্গে আর দ্বিতীয়বার কথা না বললেও খদ্দেররা কেউ কেউ সম্ভাষণ জানাল। ছেলেমেয়েরা বলল ‘কেমন আছেন দাদু?’
তাদের সঙ্গের বাবাকাকারা বলল ‘ভালো আছেন তো মল্লিক মশাই?’
তিনি পরম বৈরাগ্যেব সুরে জবাব দিলেন, ‘আর ভাল! এখন যে দিনটি যায় সেই দিনটিই মনে করি গেল। সামনে যত এগুবো তত বেশি অন্ধকার, তত বেশি দুঃখ কষ্ট আর জ্বালা যন্ত্রণা। এখন তো ভাঙা নৌকো নিয়ে নদী পার হওয়া ভাই। এখানে ফাটা ওখানে ফুটো কোন দিক দিয়ে যে জল ওঠে টের পাইনে।’
কেউ কেউ হেসে বলল, ‘যা বলেছেন।’
পাড়ায় যারা মল্লিকমশাইকে চেনে তারা চুপ করে রইল। যাঁরা ছেলেপুলে নাতিনাতনি নিয়ে বাস করেন, মোটামুটি আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে থাকেন দেহের বার্ধক্য তাঁদের কাছে এখন দুঃসহ মনে হয় না। কিন্তু মল্লিকমশাই তেমন ভাগ্যবান নন। ছেলেমেয়েদের যৌবনেই হারিয়েছেন। নিকট আত্মীয়স্বজন আর কেউ নেই। ঘরে রুগ্ণা মুখরা স্ত্রী। বয়স বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখরতা বেড়ে চলেছে। ওঁদের ঘরখানির কাছ দিয়ে যারাই যায় তারাই শুনতে পায় দুজনের ঝগড়া। দিন নেই রাত নেই, সকাল নেই সন্ধ্যা নেই ওঁদের দাম্পত্য কলহ লেগেই আছে। বাহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়ার শ্লোক এঁদের ক্ষেত্রে অন্তত লাগসই নয়। কোন এক মহকুমা শহরে পোস্ট মাস্টার ছিলেন। তারই সামান্য পেনশনে দিন চলে। বছর পাঁচেক ধরে আছেন এ-পাড়ায়। কৃপণ, কঞ্জুস রূঢ়ভাষ বলে যে বদনাম রটেছিল তা এতদিনে বেশ পাকা হয়েছে।
মুকুন্দ এই বুড়োকে হাড়ে হাড়ে চেনে। তার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই ওঁর ওপর। কিন্তু মল্লিকমশাই আজ যেন হৃদয়ভরা ভালবাসা আর মুখভরা ভাল ভাল কথা নিয়ে তৈরি হয়ে এসেছেন। খদ্দেরদের ভিড় একটু কমলে তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফের আলাপ শুরু করলেন, ‘মুকুন্দভায়ার বেচাকেনা তা হলে ভালই চলছে?’
মুকুন্দ বলল, ‘হুঁ’।
তারপর বইয়ের প্যাকেটটা একটি ছেলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘শম্ভু, এই নাও তোমার বই। বাবাকে বলো দামটা যেন দু-একদিনের মধ্যে পাঠিয়ে দেন।’
হাফপ্যান্ট পরা বারো-তেরো বছরের ছেলেটি ভয়ে ভয়ে অস্ফুটস্বরে বলল, ‘মুকুন্দদা, আমার ক্যালেন্ডার।’
মুকুন্দ নিষ্ঠুরভাবে বলল, ‘পরে পরে। দাম চুকিয়ে দিয়ে তারপর ক্যালেন্ডার ফ্যালেন্ডার যা নিতে হয় পরে নিয়ো।’
তার ধমকের বহর দেখে বোঝা গেল, শম্ভু এ পাড়ায় কোনও প্রখ্যাত নাগরিকের ছেলে নয়।
আরও কয়েকজনকে বই বিক্রি করবার পর মুকুন্দ বুড়োর দিকে তাকিয়ে রুক্ষ স্বরে বলল, ‘আপনার কি চাই মল্লিকমশাই। বইটই কিছু নেবেন?’
মল্লিকমশাই একগাল হেসে বললেন, ‘আরে ভাই, নিতে তো খুব ইচ্ছে হয়। এই সব নতুন নতুন বই দেখে লোভ হয় মুকুন্দ, বগলে নিয়ে ফের স্কুলে গিয়ে ঢুকি। একেবারে অ আ ক খ থেকে শুরু করি আবার।’
কে একটি ছেলে মজা পেয়ে বলে উঠল, ‘চমৎকার হবে দাদু, চলুন আমাদের স্কুলে।’
আর একজন বলল, ‘না না, ওদের স্কুলের চেয়ে আমাদের স্কুলের পাশের পার্সেন্টেজ বেশি। আপনি আমাদের কুমুদবন্ধু হাইতেই আসুন। একেবারে স্কলারশিপ নিয়ে বেরোবেন। শিং ভেঙে আমাদের গোয়ালে ঢুকে পড়ুন দাদু।
আজ আর ছেলেদের ঠাট্টা পরিহাসে মল্লিকমশাই চটলেন না। হাসিমুখে মুকুন্দের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কথা শোন ভায়া। এখন কি আর ঢোকবার বয়স আছে। এখন শুধু বেরোবার পালা। স্কুল অফিন দোকান পাট সব জায়গা থেকেই গলা ধাক্কা।’
হাত দিয়ে এমন ভঙ্গিতে অর্ধচন্দ্রের আকৃতি দেখালেন মল্লিকমশাই যে, ছেলেরা সবাই হেসে উঠল।
খানিক বাদে প্রস্তাবনার পর্ব শেষ করে তিনি এবার মুকুন্দকে বললেন, ‘ইয়ে ভাল কথা, ভুলেই যাচ্ছিলাম, একখানা ক্যালেন্ডার চাই যে।’
মুকুন্দ এই আশঙ্কাই করছিল। বিস্ময়ের ভঙ্গি করে বলল, ‘ক্যালেন্ডার! ক্যালেন্ডার কোথায় পাব।’
মল্লিকমশাই হেসে বললেন, ‘কি বলে শোন। বলে কোথায় পাব। আরে তোমরা হলে দোকানদার, মহাজনের জাত। তোমাদের কি কিছুর অভাব আছে। ওই আলমারির আড়ালে কত রাজ্যের ক্যালেন্ডার মজুত রয়েছে একবার দেখাব নাকি সবাইকে?
মল্লিকমশাই সত্যিই দু পা এগিয়ে গেলেন। মুকুন্দ বাধা দিয়ে রূঢ়স্বরে বলল, ‘না আপনার দেখাতে হবে না। নিজের চোখেই তো দেখতে পেলেন, আমার খদ্দেরদেরই সবাইকে আমি ক্যালেন্ডার দিতে পারছিনে, আর আপনাকে কী করে দেব? বেশ, দশ পনেরো টাকার বই নিন, দিচ্ছি ক্যালেন্ডার।’
মল্লিকমশাই বললেন, ‘বেশ বলেছ। বই নেব কার জন্যে? আমার কি গণ্ডা কয়েক ছেলেমেয়ে নাতিনাতনি আছে?’
মুকুন্দ বলল, ‘বেশ, স্কুলের বইয়ের দরকার না থাকে ধর্মগ্রন্থ কিনুন। আমার লাইব্রেরিতে গীতা আছে, চণ্ডী আছে, রামায়ণ মহাভারত সব আছে, নিন তার দু একখানা।’
মল্লিকমশাই বললেন, ‘সব ঘরে পড়ে আছে ভাই। নিয়ে করব কি। চোখে কি ভাল করে দেখতে পাই যে পড়ব।’
মুকুন্দ বলল, ‘বইয়ের অক্ষর দেখতে পান না, কিন্তু ক্যালেন্ডারে আঁকা ভাল ভাল ছবিগুলো তো খুব দেখতে পান। বুড়ো হয়েছেন আবার ক্যালেন্ডারের শখ কেন। যান ঘরে যান। এখানে ওসব হবে না।’
এবার মল্লিকমশাই চটে উঠলেন। কুরূপ বিকৃত মুখখানা আরও বিকৃত করে চেঁচিয়ে উঠে বললেন; ‘পাজি বদমাস ছোকরা। তোমাকে দেখে নেব আমি। তুমি কী রকম দোকানদার হয়েছ আমি দেখে নেব।’
মুকুন্দ সোজা বাইরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘যান, দোকান থেকে নেবে যান আগে। বাইরে গিয়ে, তারপর দেখুন। আমার দোকানে বসে ফের যদি হামলা করেন, আমি ঠিক পুলিশ ডাকব।’
মল্লিকমশাই আর বেশি গোলমাল করলেন না। দোকান থেকে বেরিয়ে মুকুন্দকে অভিশাপ দিতে দিতে বললেন, ‘আগুন লেগে সব যেন ছারখার হয়ে যায়। সব যেন ছাই হয়ে যায় তোর।’
মুকুন্দ বুড়োর এসব অভিশাপ কানেও তুলল না। নির্বিকারভাবে দোকানের কাজ করে যেতে লাগল। খানিকক্ষণ ধরে সমালোচনার দুটি ধারা সমান্তরালভাবে বয়ে চলল। কেউ কেউ বলল, এতটা খারাপ ব্যবহার করা মুকুন্দের পক্ষে ঠিক হয়নি। হাজার হলেও বুড়ো মানুষ। একখানা ক্যালেন্ডার বই তো নয়। কি-ই বা এমন দাম দিয়ে দিলেই পারত মুকুন্দ।।
আর একদল বুড়োর বিরুদ্ধেই মন্তব্য করতে লাগল। ‘না হে, ভদ্রলোক মোটেই ভাল নন। পাড়ার কারও সঙ্গে ভাল ব্যবহার করবেন না। কারও কোনও উপকার ওঁকে দিয়ে হবে না। সবাইকে কেবল রাগ করবেন, ধমকাবেন, যেন ওঁর খাস তালুকের বাসিন্দা আমরা।’
কিছুক্ষণের জন্যে দোকানের ভিড়টা কমল। বাইরের দিকে পিছন ফিরে মুকুন্দ তাকের বইগুলি গুছিয়ে রাখছে, হঠাৎ মিষ্টি গলার আহ্বান এল, ‘মুকুন্দবাবু।’
এ গলা মুকুন্দের চেনা। না দেখেও সে বলতে পারে এ কে। বিদ্যাপীঠের নতুন টিচার সুনীতা নন্দী। বয়স বাইশ তেইশের বেশি হবে না। ছিপছিপে চেহারা। শ্যামলা রং, চোখে চশমা। শুধু গলার স্বর নয়, চেহারা স্বভাব সবই ওঁর মিষ্টি। মুকুন্দবাবু ডাকটা ভারী ভাল লাগে ওঁর মুখে।
সুনীতা বলল, ‘আমার বইগুলি এসেছে?’
তার বইগুলি মানে, তার ছাত্রী রুবির বই। পাড়ার ভুবন উকিলের বাড়িতে ট্যুইশনি করে সুনীতা। তার ছোট মেয়েকে পড়ায়। তার জন্যে খাতা পেন্সিল কিনতে সুনীতা আরও কয়েক বার এ-দোকানে এসেছে।
মুকুন্দ গুছিয়ে-রাখা খানকয়েক বই একসঙ্গে সুনীতার সামনে ধরে দিয়ে বলল, ‘এই নিন আপনার বই। ক্লাস সিকসের সব বই আমি জোগাড় করে রেখেছি। আর এই হল ক্যালেন্ডাব।’
বুদ্ধমূর্তি আঁকা দুখানা বড় ক্যালেন্ডার স্মিতমুখে মুকুন্দ সুনীতার দিকে এগিয়ে দিল।
সুনীতা বিস্মিত হয়ে বলল, ‘একি, দুখানা কেন!’
মুকুন্দ হেসে বলল, ‘একখানা ছাত্রীর, আর একখানা—।’
সুনীতা একটু আরক্ত হয়ে ওঠে। বলল, ‘না না, বরং ওখানা মল্লিকমশাইকে দেবেন। আমি আসতে আসতে সব শুনেছি। কাজটা ভাল করেননি মুকুন্দবাবু।’
মুকুন্দ লজ্জিত হয়ে বলল, ‘সেই জন্যেই নেবেন না ক্যালেন্ডার?’
সুনীতা বলল, ‘আমি পরে নেব। আগে বুড়ো ভদ্রলোককে আপনি একখানা দিয়ে আসুন।’
দাম চুকিয়ে দিয়ে সুনীতা চলে গেল। কাজ করতে করতে মুকুন্দ একটু আনমনা হয়ে উঠল। স্কুলে মাস্টারি করে ছোট-বড় সবাইকে উপদেশ দেওয়াটাই অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে মেয়েটির। ভারী তো চল্লিশ টাকা মাইনের নীচের ক্লাসের মাস্টারনী। গরবে পা পড়ে না মাটিতে। মুকুন্দের হাত থেকে একখানা ক্যালেন্ডার নিলে কি তার জাত যেত?
কিন্তু মনে মনে সুনীতা নন্দীর যত নিন্দাই করুক, ভারতবর্ষের মানচিত্র আঁকা একখানা ক্যালেন্ডার নিয়ে মুকুন্দ বেলা প্রায় দেড়টার সময় হাজির হল মল্লিকমশাইর বাসার সামনে। দোকান বন্ধ করে এসেছে। আধ ঘণ্টার মধ্যে খাওয়াদাওয়া সেরে আবার গিয়ে খুলবে। মরসুমের সময় বেশি আরাম-বিরামের উপায় নেই। কিন্তু নিজের বাসায় যাওয়ার আগে মল্লিকমশাইর একবার খোঁজ নিতে এসেছে মুকুন্দ। সুনীতা নন্দী জানুক, সংসারে তার হৃদয়ই একমাত্র উদার নয়। আরও ভালমানুষ আছে পৃথিবীতে।
সরু গলির মধ্যে পুরনো একতলা বাড়ি। বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে কড়া নাড়ল মুকুন্দ।
দোর খুলে যাওয়ার আগে ঘরের ভিতর থেকে ঝঙ্কার শোনা গেল, ‘এসেছ? এসো। কোন চুলোয় গিয়েছিলে? কোন যমের বাড়িতে? সেখানে খাওয়া জুটল না? হাড়মাস জ্বালিয়ে খেলে আমার। অসুখ নেই বিসুখ নেই, আমার গা-গতরের একবার খোঁজ নেওয়া নেই; তিরিশ দিন এই রকম। কাঁহাতক পারে মানুষ?’
বলতে বলতে সশব্দে দরজার হুড়কো খুলে মারমূর্তি হয়ে পঁয়ষট্টি বছরের এক বৃদ্ধা এসে সামনে দাঁড়ালেন। হাতে মোটা শাঁখা, পরনে লালপেড়ে আধময়লা খাটো একখানা শাড়ি, মাথায় আঁচল নেই। কাঁচাপাকা চুলের মধ্যে সিঁথিতে সিঁদুরের মোটা দাগ।
কিন্তু দোরের সামনে স্তম্ভিত মুকুন্দকে দেখে জিভ কেটে তাড়াতাড়ি মাথায় আঁচল তুলে দিলেন তিনি। তার পর ঘরের ভিতরে সরে গিয়ে লজ্জিত অস্ফুটস্বরে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না। আমি ভেবেছিলাম আমাদের বুড়োকর্তা এলেন বুঝি?’
মুকুন্দ মনে মনে ভাবল, বাড়ির কর্তার অভ্যর্থনাটি বেশ ভালই হচ্ছিল। একটু বাদে হাসিমুখে বলল, ‘ঠানদিদি, আমি আপনার নাতির বয়সী। আমার কাছে কোনও লজ্জা করবেন না। মোড়ের দোকানটা আমারই। দাদু আমার কাছে সকালবেলায় একখানা ক্যালেন্ডার চেয়েছিলেন। তখন দিতে পারিনি। এখন নিয়ে এসেছি। তিনি এলে বলবেন, মুকুন্দ দিয়ে গেছে।’
গুটানো ক্যালেন্ডারখানা বৃদ্ধা মহিলার দিকে এগিয়ে দিল মুকুন্দ।
তিনি এবার খুশি হয়ে বললেন, ‘আসুন ভিতরে বসুন এসে।’
একটু ইতস্তত করে ঘরের ভিতরে ঢুকল মুকুন্দ। ছোট ঘর। তার আধখানা জুড়ে একখানা তক্তপোষ পাতা। আপাতত বিছানাটা গুটান রয়েছে।
কিন্তু সবচেয়ে অবাক হল মুকুন্দ ঘরের দেওয়ালগুলি দেখে। পুরনো বাড়ির চুনবালি ঝরা স্যাঁৎসেতে দেওয়াল। কিন্তু চার দেওয়ালের কোনও এক জায়গায় আর ফাঁক নেই। ছোট-বড় সস্তা, দামি, হালসনের নানা আকারের নানা ধরনের ক্যালেন্ডারে দেয়ালগুলি ভরতি। নদী পাহাড় পর্বতের ছবি আছে, দুর্গা-কালী গণেশের ছবি আছে, আবার সুন্দরী তরুণী সিনেমা স্টারদের ছবিও সযত্নে ঘরে টাঙিয়ে রেখেছেন মল্লিকমশাই।
একটুকাল নির্বাক হয়ে থেকে মুকুন্দ বলল, ‘এত ক্যালেন্ডার দাদু কোত্থেকে জোগাড় করলেন বলুন তো?’
মল্লিকমশায়ের স্ত্রী বললেন, ‘কোত্থেকে আবার? কারও সঙ্গে ঝগড়া করে, কাউকে বা খোসামোদ করে, এক দিনের জায়গায় দশদিন হাঁটাহাঁটি করে সব নিয়ে এসেছে। লজ্জা নেই, ঘেন্না নেই, মান-অপমান জ্ঞান নেই। এসব দিয়ে কী যে হবে সেই জানে। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই আজ আবার বেরিয়েছে। কোথায় নাকি এক ক্যালেন্ডার পাওয়া যায়, বারো মাসের বারো রকমের ছবি। তার একখানা আনা চাই। আর বলবেন না। ছেলেমানুষের বাড়া হয়েছে।’ নিঃশব্দ কিন্তু প্রশ্রয়মুখর হাসির মধ্যে মল্লিকমশাইয়ের স্ত্রী তাঁর বাকি কথাটুকু শেষ করলেন।
২৭ জানুয়ারি ১৯৫৭