ষষ্ঠ খণ্ড (পরম পূজনীয়া পরিব্রাজিকা প্রজ্ঞা হৃদয়া করকমলে)
সপ্তম খণ্ড (স্নেহের অলোক রায়চৌধুরী ও ইন্দিরাকে)
অষ্টম খণ্ড (ডা: শ্রী বিজয়চাঁদ কুমার ও শ্রীমতী তপতী কুমার শ্রদ্ধাভাজনেষু)
5 of 6

ক্যালেন্ডারের শেষ পাতা

ক্যালেন্ডারের শেষ পাতা

আমার ছেলেবেলায় আমি এখন যে অঞ্চলে থাকি সেই অঞ্চলটি ছিল সম্পূর্ণ একটি গ্রাম। প্রাচীন এবং বর্ধিষ্ণু। শুধু প্রাচীন নয় অত্যন্ত ঐতিহ্যপূর্ণ। একপাশে গঙ্গা ওপারে বেলুড়মঠ, লালবাবার আশ্রম, দাঁয়েদের রাসবাড়ি আর এপারে পুরোনো (বেলুড়) মঠ, অতি প্রাচীন পাঠবাড়ি; সেখানে মহাপ্রভু এসেছিলেন। শ্রীচৈতন্যঘাট, যেখানে মহাপ্রভু বিশ্রাম করেছিলেন। জয় মিত্রের কালীবাড়ি, আড়াইশো বছরের প্রাচীন সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি। ওপাশে মহাশ্মশান। যেখানে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের পূত মরদেহের অগ্নিসংস্কার করেছিলেন নরেন্দ্রনাথ।

আর একটু দূরে উদ্যানবাটি। যেখানে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের অন্ত:লীলা আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্যে ভরপুর। তার বিপরীতে রানি কাত্যায়নীর বাগানবাড়ি। যেটিকে বলা হয় লালাবাবুর বাগান। সেখানে আছে ঐতিহাসিক সুবৃহৎ গোপালের মূর্তি। উদ্যানবাটিতে থাকার সময়ে নরেন্দ্রনাথ ও তাঁর ভায়েরা ওই বাগানে যেতেন ফুল তুলতে।

আমার বসবাস যেখানে তার পাশেই গঙ্গা। এই পল্লির বিভিন্ন রাস্তায় ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের পদচিহ্ন আঁকা আছে। তিনি মথুরবাবুর সঙ্গে কখনও যেমন দশমহাবিদ্যা মন্দিরে, কখনও হৃদয়রামকে নিয়ে কামার পাড়ায় আসতেন ভাগবৎ পাঠকের বাড়িতে। কখনও অদূরে গোপাললাল ঠাকুর রোড ধরে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে কলকাতায় যেতেন।

ওই পথেই বরাহনগর বাজারে ছিল বিখ্যাত ফাগুলালের তেলেভাজার দোকান। ঠাকুরের গাড়ি থামত। রামলাল দাদা কচুরি কিনতেন। এই রাস্তাতেই ঠাকুর একবার কচুরি কেনার অবসরে গাড়ি থেকে নেমে হনহন করে হেঁটে চলে গিয়েছিলেন বহুদূর ভাবস্থ অবস্থায়। এই রাস্তাতেই একবার ঠাকুরের গাড়ির চাকা খুলে গিয়েছিল।

এইরকম একটি পল্লিতে যে ভাবটি জমাট বেঁধেছিল সেটি হল ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা। মানুষ যা কিছু করত তা এই ধর্মের মধ্যে থেকে। আমার ছেলেবেলায় চৈত্র মাস এলেই প্রকৃতি জানিয়ে দিত আমি এসেছি। আমি শিব। তখনও এত বাড়িঘর ছিল না। বড় বড় মাঠ পুকুর দিঘি বাগানবাড়ি। বয়েস তখন কম। একটি কিশোর মন কল্পনায় টইটুম্বুর। আমাদের বাড়িতে শাক্ত সাধনার একটি সংস্কার ছিল। আমাদের পরিবারে কয়েকজন সাধক এসেছিলেন। তাঁদের প্রভাবেই আমার জীবন বেড়ে উঠেছে। এই চৈত্রমাসে যখন মাঠঘাট রোদে ঝলমল করছে, গাছে গাছে কচি সবুজ পাতার সাজ, যখন আকাশ তামাটে নীল, তখন আমার মাতামহ আমাকে বলতেন, ওই দ্যাখ, ধুলোর ঘূর্ণিতে জটা খুলে শিবঠাকুর নৃত্য করছেন। ওই দ্যাখ, তাঁর ত্রিশূলের ঝলক সর্বত্র।

আমাদের পল্লির নির্জন দুপুরে গাজনের সন্ন্যাসী, দল বেঁধে ঢোলক বাজিয়ে মাধুকরী করতেন। তাঁদের সমবেত ধ্বনি ছিল—বাবা তারকনাথের চরণের সেবা লাগি, মহাদেব। এই ধ্বনি কানে আসামাত্রই বুঝতে পারতুম বছর শেষ হয়ে এল। চৈত্রের শিবের সাধনা শেষ হবে নববর্ষের উদ্বোধনে। তখনই মন প্রস্তুত হত চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন বুড়ো শিবতলায় নীলের উৎসব। কাঠফাটা রোদে খালি পায়ে ভক্ত রমণীর দল বুড়ো শিবতলায় সমবেত হবেন কাতারে কাতারে। শিবলিঙ্গের দুপাশে জমবে বেলের পাহাড়। এমন একটা পবিত্রতা, এমন একটা স্পর্শ মনের চেহারাটাই পালটে যেত। আমার চেনা দিদিরা, পিসিরা সেদিন যেন দেবীর মূর্তি ধারণ করতেন। কোনও কষ্টকেই তাঁরা কষ্ট বলে মনে করতেন না। শিবতলা থেকে তাঁরা যখন ফিরে আসতেন, হাতের ঘটিতে স্নানের জল আর শালপাতার প্রসাদ নিয়ে, তখন নাকে একটা গন্ধ এসে লাগত—মন্দিরের গন্ধ। পবিত্রতার গন্ধ। আমার মাতামহ আমাকে শোনাতেন ভারতের শিবতীর্থের কথা, শৈবসাধকদের কথা।

নীলের রাত ভোর হলেই চৈত্রসংক্রান্তি। চৈত্র সংক্রান্তির দিনটি আমার কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আমার বয়েস যখন তিন কী চার, এই চৈত্র সংক্রান্তির ঊষা লগ্নে আমার মা এই পৃথিবীতে আমাকে একা ফেলে রেখে পরলোকে পাড়ি দিয়েছিলেন। সংক্রান্তি আসার আগেই আমার ভেতরে একটা প্রস্তুতি আসত—ওই বিষণ্ণ, উত্তপ্ত উজ্জ্বল দিনটিকে আমাকে আমার মতো করে উদযাপন করতে হবে। তখন চারপাশে অনেক বাগান ছিল। খুব ভোরে যে সময়টিতে আমার মা চলে যাচ্ছেন ঠিক সেই সময়ে একটি সাজি হাতে বাগানে বাগানে ফুল তুলতে বেরতাম। সে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। গঙ্গার জলে ভোরের আলো লেগেছে। ফুলের বাগানের ঘুম ভাঙছে। আধো আলো, আধো অন্ধকার। ঘুম ভাঙা পাখির প্রার্থনার কলরব। শিরশিরে শীতল বাতাস। কেউ কোথাও নেই। ফোটা ফুলের মেলায় একা একটি বালক।

ধীরে ধীরে সাজি ভরে উঠত ফুলে। ফুল তুলতে, তুলতে কেবল মনে পড়ত একদিন ওই দূরের ঘাট থেকে একটি নৌকো খুলে গিয়েছিল যার আরোহী ছিলেন আমার মা। হয়তো আমার পিতা আমার মাতামহ এসেছিলেন, হাত নেড়ে বিদায় জানাতে। এ এমন বিদায়, যে বলার উপায় থাকে না—যত তাড়াতাড়ি পারো কাজ শেষ করে ফিরে এসো। গুলঞ্চ করবী টগর এরা আমার দু:খ বুঝত। তাদের মসৃণ স্পর্শে তাদের সুগন্ধে আমাকে বলতে চাইত, খোকা মন খারাপ করিস না—ফুল ফোটে, ফুল ঝরে যায়, ফুল আবার ফোটে। আর তখনই পাশের মন্দিরে ভোরের মঙ্গল আরতির ঘণ্টা কাঁসর বেজে উঠত। একটি মালা, একটি ছবি, পৃথিবীর কোনও অচেনা প্রান্তে সাবেক কালের একটি প্রান্তে সাবেক কালের একটি বাড়ির ঘরে স্মৃতির পরদা সরিয়ে এসে হাজির হতেন মানুষের জীবনের সবচেয়ে প্রিয় সেই চরিত্র—জননী। মালাটি পরানোমাত্রই মনে পড়ত আজ সংক্রান্তি। আজ গাজন। নপাড়ার গাজনতলায় সমবেত হবেন চৈত্রের যত সন্ন্যাসী। চড়কগাছ, বানফোঁড়া, চড়কগাছে ঝোলা, চারপাশে বিপুল, বিচিত্র মেলা। মাতামহ শুধু জানিয়ে দিতেন, বেলা তিনটে।

 সেই উল্লাস সেই মেলার মানুষ ও তাদের আনন্দ এবং মিলনের স্পর্শ নিয়ে শেষ সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এসে মনে পড়ত একটা বছর আজ শেষ হয়ে গেল। আগামীকাল নতুন বছর তার খাতা খুলবে। মানুষের তৈরি এক এক অপূর্ব হিসেব, অদ্ভুত এক কালের বিভাজন। শেষের কোনও কিছুই চোখে পড়ছে না অথচ ক্যালেন্ডারের বারোটা পাতাই ঝরে গেল। ঝুলে রইল দড়ির ফাঁসে লেগে থাকা একটি টিনের দণ্ড। এমন এক রিক্ততা যা চোখে পড়ামাত্রই মনে একটা আতঙ্কের ভাব আসে—সভ্যতা বুঝি শেষ হয়ে গেল। মহাশ্মশানে বুঝি মহা চিতা লকলক করে জ্বলছে।

মাতামহ কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়ে বলছেন, কীরে, অমন করে কী দেখছিস? চমকে উঠে বলতাম, ‘সব পাতা ঝরে গেছে। মাতামহ বলতেন, ঝরাটাই দেখলি, বেরনোটা দেখলি না! প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে দ্যাখ, সর্বত্র সবুজ পাতার উৎসব। কত রকমের সবুজ! আমি বলতাম, এ তো গাছের পাতা; আমি বলছি সময়ের পাতা। ক্যালেন্ডারের ডাণ্ডাটাই পড়ে আছে। মাতামহ হাসতে হাসতে বলতেন, ব্যাটা কবি হবে। সন্ধ্যেবেলা সময়ের পাতাও এসে যাবে রে। এবার আমাদের সাত জায়গায় হালখাতার নিমন্ত্রণ।

তখন সবে আমাদের পল্লিতে পিচের রাস্তা হয়েছে। বেলা চারটে থেকে সাজো সাজো রব। নতুন রঙে পুরোনো দোকান নতুন হয়েছে। আমপাতা আর পবিত্র শোলার ফুলে নতুনের আবাহন। পবিত্র মঙ্গলঘট। প্রতিটি দোকানের সামনে রাস্তায় বালতি বালতি জল ঢালার ফলে সেই সোঁদা সোঁদা গন্ধ। সারাদিকের রোদের উত্তাপ জলপড়ায় বাষ্প হয়ে ভেপসা। দোকানের সামনে সামনে সারি সারি কাঠের চেয়ার। চটের বস্তায় বরফমুড়ে কাঠের মুগুর দিয়ে পেটানো হচ্ছে। বরফভাঙা সুরেলা কচকচ শব্দ। এক আধ টুকরো রাস্তায় ছিটকে পড়ে আপনমনে গলে যাচ্ছে।

তখন তো নিয়ন বা হ্যালোজেন আলো ছিল না। সূর্য অস্ত যেতেই হ্যাজাক লাইট ঝুলিয়ে দিলেন দোকানের মালিকরা। আলোর গরম, ঝাঁঝাঁ শব্দ, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা ঘর্মাক্ত বাঙালিবাবুদের ভিড়। গোলাপজলের পিচকিরি, পাঞ্জাবির পিঠ ঘামে ভেজা, কপালের ঘাম দুপাশের রগ বেয়ে চিবুকের দিকে ঢলছে। গেলাসে গেলাসে গোলাপি রঙের ঘোলের শরবত। তার ওপর ভাসমান মাঠা জড়ানো ফ্যাকাসে বরফের টুকরো।

খুব সাজগোজ করা দোকানের মালিক চকচকে ক্যাশ বাক্সের সামনে। মুখে অমায়িক হাসি। পাঞ্জাবির খোলা বুকে মোটা সোনার হার ঐশ্বর্যের প্রতীক। মিনিটে মিনিটে কাঠের বাক্সের ডালা খোলা ও ডালা বন্ধের শব্দ। নিমন্ত্রিত বাবুর দল হাতে মিষ্টির বাক্স। বগলে ক্যালেন্ডার। হাতের কব্জিতে জড়ানো একটি একহারা বেলফুলের মালা।

গভীর রাতে দক্ষিণের বাতাসে পাতা ওড়ার শব্দ। নতুন ক্যালেন্ডারের পাতা। দেওয়ালের শূন্যস্থানে আবার বারোটি মাসের জন্য ঝুলে গেছে। মাসে মাসে একটি করে পাতা খসবে। খসতে খসতে শেষ পাতা। অবশেষে আবার নতুন বারোটি পাতা। বাইরের আলোতে-তারাভরা আকাশের আলোতে দেখছি ক্যালেন্ডারে শ্রীকৃষ্ণের ছবি। মুখে সেই অপূর্ব হাসি। জীবন কুরুক্ষেত্রের শিরে দাঁড়িয়ে বরাভয় দিয়ে বলছেন সেই চিরন্তন কথাঃ ক্লৈব্যং মাস্ম গম: পার্থ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *