ক্যালকাটা মকটেল

ক্যালকাটা মকটেল

২০০৩-এর আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় ফোটোগ্রাফটি সর্বদেশীয় বিচারকমণ্ডলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করল তার নাম ক্যালকাটা মকটেল। চিত্রী অম্বুজ শ্রীনিবাসন। কারিগরি আছে ছবিটাতে। কোলাজ, সুপার ইমপোজিশন, নেগেটিভ ইত্যাদি অদ্ভুতভাবে ব্যবহার করে ছবিটি যেন স্টিল ফোটোর সীমা ছাড়িয়ে গেছে। কেউ বললেন স্টিল হয়েও এ চলচ্চিত্র, কেউ বললেন এ কবিতা, কেউ বললেন, এর মধ্যে খুব জটিল ছোটোগল্পের গুণাবলি দেখা যাচ্ছে। মোট কথা, ছবিটি সকলকে আশ্চর্য ও মুগ্ধ করল। বলা বাহুল্য, দেড় লাখ ইউ এস ডলারের প্রথম। পুরস্কারটি শ্রীনিবাসনই পেল। পৃথিবীতে আলোকচিত্র-প্রেমীর অভাব নেই। শ্রীনিবাসনের ফ্যান মেলটি বেশ পুরুষ্টু হতে লাগল। অনেক গুণমুগ্ধ জিজ্ঞেস করতে লাগল—এই অদ্ভুত ছবিটি সে কী ভাবে ভাবল।

দেখুন, শিল্পী মাত্রেই জানেন কত অর্থহীন এই প্রশ্ন এবং কত প্রত্যাশিতও। শিল্পী কি সব সময়ে সত্যিই জানেন কী ভাবে কী ঘটে তাঁর মাথার মধ্যে? কোথাও তিনি মানবসীমা ছাড়িয়ে যান। মিস্টিক, একটা অতীন্দ্রিয়ের হাতছানি তাঁকে নিশি ডাকে ডেকে নিয়ে যায়।

অম্বুজ জানে, অথচ জানে না। সে ফোটো-জার্নালিস্ট। পেশাদার। এর নাড়ি নক্ষত্র তার জানা। কিন্তু এ ছবির আইডিয়াটা একটা হঠাৎ ঝলক, তারপর ক্রমিক ঝলক। যখন কাজটা শেষ হয়ে গেল সে বুঝতে পারল এতক্ষণ সে একটা ঘোরের মধ্যে ছিল।

২.

পশ্চিম জার্মানির এক অটোবানে মারাত্মক গাড়ি দুর্ঘটনায় আমি মুক্তি পাই। মৃত্যু বলে মুক্তি কথাটা কেন বললাম, তার একটা বিশদ কারণ আছে। আমি মাটিল্ডার পাল্লায় পড়েছিলাম।

যা উপার্জন করতাম তাতে বেশ আরামে থেকেও মোটের ওপর চলে যেত। দু বার স্ত্রী বদলে ঘাড়মোড় ভেঙে যার প্রেমে পড়লাম সে পঁয়ত্রিশ। আমি সত্তর। যতই বয়স হয়, ততই কিছু কিছু মানুষ তরুণী-লোভে পাগল হয়। আমিও হয়েছিলাম। চিকনচাকন বাদামি চোখের ধোঁয়াটে চুলের মাটিল্ডা আমাকে চুম্বন টানে টেনে নিয়েছিল। আধা ব্রুনেট ঝলমলে এক কপর্দকহীন ডিভোর্সি। পঁয়ত্রিশ কি পঁচিশ বোঝা শক্ত। সময় কাউকে কাউকে ছোঁয় না। আমার চোখ আর বাকি সব ইন্দ্রিয়ও তো তখন সত্তর পার! তা এই আধাব্রুনেট সুন্দরীটি আমাকে কী কারণে পাত্তা দিল? আসলে মেয়েটা ছিল ডাকসাইটে বেজন্মা। কোন দেশের কোন জাতির কোন ধর্মের রক্ত যে তার ধমনিতে ছিল না, তা জানতে লাইব্রেরি-ভরতি বিজ্ঞান আর সমাজবিদ্যা লাগবে। বিজ্ঞান অবশ্য বলে থাকে এ রকম মিশ্রণে উন্নত ধরনের মগজ তৈরি হয়। কিন্তু এ মেয়েটা অদ্ভুত। নিজেকে নাস্তিক বলে গ্যাদা দেখায় আবার বিপদে পড়লেই বুকে ক্রশ আঁকে, দুষ্টু বুদ্ধির শিরোমণি অথচ কিছু শিখতে পারেনি। ফলে আকাট মুখ, মিথ্যেবাদী আর বিচ্ছিরি রকমের সুযোগসন্ধানী। ব্যালে ও বেলি-ডান্স দুটোই শিখতে গিয়ে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে অবশেষে একটা নাটকের দলে ড্রেসগুছোনির কাজ করছিল। এদিকে আমি এক তীক্ষ্মনাসা, উজ্জ্বল চোখ, গ্রানাইটের তৈরি সন্ত-সন্ত চেহারার অতি স্মার্ট মোটামুটি বিখ্যাত ইনটেলেকচুয়াল, যাকে ঠিক অতটা বৃদ্ধ বলে বোঝা যায় না। আমার মনোযোগে ও অহংকারের সপ্তম স্বর্গ তো পেলই, উপরন্তু আমাকে সমাজে ওঠার একটি সোনার সিঁড়ি ঠাওরাল।

কিছুটা সময় অবশ্যই রূপ-রস-স্পর্শঋদ্ধ এক অবিশ্বাস্য মৈথুন স্বর্গে বাস করি, তারপর মোহভঙ্গ হয়। আরে ধ্যাত্তেরি, আমার আয় অনিয়মিত, বুঝে খরচ করলে যথেষ্টর বেশি, না করলে পপাত। আজ এই ডিজাইনার ড্রেস চাই, কাল ওই মুক্তোর ছড়া চাই, পরশু চাই কমল-হিরের ব্রুচ। সীমাসংখ্যা নেই আবদারের। না রাঁধবে বাড়িতে, না যাবে সস্তার জায়গায় খেতে। তার ওপর মদ্যপ। নির্জলা। হুইস্কিতে হুশ করে পৌঁছে গেল। সন্দেহ হয় বার থেকে, লোকের বাড়ির সেলার থেকে বোতল হাতাত। বাধা দিলে তুলকালাম। গালিগালাজ, জিনিসপত্র ভাঙচুর। পার্টিতে পার্টিতে আমাকে ধরে বিশিষ্ট মানুষদের সঙ্গে পরিচয় করত। প্রথম পাঁচ মিনিটে সম্মোহন, দ্বিতীয় পাঁচ মিনিটে বিদ্যে জাহির। তৃতীয় পাঁচ মিনিটে পরিষ্কার হয়ে যেত ওর মূর্খামি। ওর এই হ্যাংলাপনা, ইতরামি ক্রমে আমার অসহ্য হয়ে উঠতে লাগল। তৃতীয় বিবাহ-বিচ্ছেদের কথা ভাবছি, এমন সময়ে বছর দুইয়ের মাথায় আমার সেরিব্রাল স্ট্রোকটি হল।

গেল মোটর নার্ভগুলো। চিকিৎসা। অজস্র ফিজিয়োথেরাপি। তার পর আস্তে আস্তে হাত-পা নাড়ি। টলে টলে উঠে দাঁড়াই। হাতে ওঠে লাঠি। প্রাণপণ মনের জোরে নিজেকে একটা মোটামুটি কর্মক্ষম অবস্থায় নিয়ে আসি। রোজগারপাতি কমে গেল। মাটিল্ডা উঁচু ডালে মই বাঁধবার চেষ্টা করল কয়েক বার, কিন্তু টিকতে পারল না। দায়ী ওর সেই আকাটমি। শরীর দেখানো, চুরিচামারি আর ঝগড়া করা ছাড়া আর কিছুরই তো চর্চা করেনি। ককেশীয় রক্তের এই একটা সুবিধে। গায়ের রং, উচ্চতা, গঠন, চোখ-মুখের সৌন্দর্য জিনগত ভাবে পেয়ে থাকে। একটু যত্নআত্তি করলে, ফ্যাশান-ট্যাশন জানলে দাসীকে দাসী বলে চেনা যায় না। মা মেরির দিব্যি বড্ডই নীচু স্তরের। মজা হল আমরা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লাম এই সময় থেকেই। পার্ট টাইম বেশ্যাগিরি আর পার্ট টাইম দাসীগিরি করে ও-ই আমার থেকে বেশি রোজগার করত। তার ওপর পেশার প্রয়োজনে একটু না ঘুরলে আমার চলে না। কে গাড়ি চালাবে মাটিল্ডা ছাড়া? ওকে ছাড়া আমার উপায়ও রইল না। হয়ে গেলাম ওর রাখনা। ওর দিক থেকে মাঝে মাঝে এক লপ্তে যখন অনেক টাকা রোজগার করতাম, তাই দিয়ে বড়োমানুষি করবার লোভ ছিল। তা ছাড়া বোধহয় একটা ভদ্রস্থ পরিচয়ের আড়াল ওর খুব দরকার ছিল। সুতরাং বিচ্ছেদটা মুলতুবি হতে হতে তামাদি হয়ে গেলই বলা চলে।

৩.

একটা পত্রিকার অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে পশ্চিম জার্মানিতে যেতে হয়। এয়ারপোর্ট থেকে একটা ঝকঝকে টয়োটা লেক্সাস ভাড়া নিলাম। বেশ কিছু ফোটো তোলা হল। তখন শেষ রাত্তির, মেয়েটা হালকা মাতাল ছিল। হাইওয়ে থেকে নেমে একটা পুরনো ধরনের গ্রামের ছবি তুলছিলাম। স্রেফ গাড়ির কাচ নামিয়ে। এমন সময়ে মাতালে-বুদ্ধিতে মেয়েটা একেবারে বিনি নোটিসে টপ গিয়ারে গাড়িটাকে হাইওয়েতে এনে ফেলল আর সঙ্গে সঙ্গে একটা বিশাল ট্রাকের সঙ্গে রাম-ধাক্কা।

মাটিল্ডার কিমাকার দেহটার দিকে চেয়ে মনে হল যাববাবা, বাঁচা গেল। পরক্ষণেই ভাবলাম, বাঁচবই বা কী করে? কে আর এই বাহাত্তুরে আধা-পঙ্গু ফোটোগ্রাফারের সহধর্মিণী হতে আসবে! আর তা না হলে কে-ই বা গাড়ি চালাবে! তারপর বোধোদয় হল। নিজের থ্যাঁতলানো মাংসপিণ্ডটাকে পরিষ্কার দেখতে পাই। এহেহে, বেচারা বুড়োটা! তবে বেঁচেই বা কী করত? তিলতিল করে মরা বই তো নয়? বড়ো চমকার মৃত্যু! বুঝতেই পারিনি কিছু! আ-হা। কিন্তু আমি তো তা হলে প্রেত! মাটিল্ডাও কি তবে প্রেতিনী! মারাত্মক ভয়ে আমি হাওয়ার সমুদ্র উথালপাতাল ফ্রিস্টাইলে সাঁতরে যাই। ব্রেস্ট স্ট্রোকে ঢু মারি আকাশ পর্দায় এবং এক সময়ে উছলে উঠি মহাকাশে।

অসাধারণ এক দৃশ্য আমার ফোটোগ্রাফার সত্তাকে টেনে বার করে। কোনো প্রেতবোধ, শূন্যতাবোধ আমার থাকে না। ফোটো তুলতে থাকি প্রাণ ভরে। যে দিকে তাকাই শুধু পিণ্ডে পিণ্ডে অগ্ন্যুৎপাত। গ্রহ তারা সৌরমণ্ডল নীহারিকা ছায়াপথ ধূমকেতু লালবামন শ্বেতবামন কৃষ্ণগহবর অ্যাস্টারয়েড। আশ্চর্য! অত্যাশ্চর্য! এই সব ফোটো যদি নেচার-এ পাঠাতে পারতাম একটা যুগান্তকারী ব্যাপার হয়ে যেত। কিন্তু এও অতি আশ্চর্য যে এই অনন্ত চলন, বিরাট গরিমা তার প্রাথমিক জাদু ক্রমশ হারিয়ে ফেলল আমার চিত্রী চোখে। বড়ো একঘেয়ে লাগতে থাকে। খুব লজ্জা পাই এই মহামহিমের সঙ্গ আর আমার টানছে না বলে। কিন্তু সত্যি কথা না বলে তো নির্ভেজাল শিল্পীর উপায়ও নেই। নামতে থাকি এবং খুঁজতে খুঁজতে টুক করে পৃথিবীর আবহমণ্ডলে একটা ওজোন-ফুটো দিয়ে গলে পড়ি।

৪.

গ্লোবটার আলো-অন্ধকার আমার চোখের সামনে ঘুরে যায়। ভালো কথা, চোখ, ক্যামেরা এ সব কথা ব্যবহার করছি বটে, কিন্তু এ সব কিছুই আর নেই আমার। শুধু অভ্যাসটা আছে। সর্বসত্তা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি তবু বলি চোখ। অনুরূপভাবে নাক, কান, মুখ হাত, পা…

আরও নীচে নামি। উত্তাল সমুদ্র, উত্তুঙ্গ পাহাড়, নিচ্ছিদ্র বনানী। নদীনালা, শহর, গ্রাম, মানুষজন। ছবি তুলে যাই কিন্তু বুঝতে পারি এগুলোর সনাতন রূপে কোনো মৌলিকত্ব আনতে পারছি না। ঢেউ উঠছে তত উঠছেই। ভাঙছে তো ভাঙছেই। সব নদী সমুদ্রের দিকে যায়। সব পাখি উড়ান শেষে নেমে পড়ে নীড়ে। মেরু অঞ্চল থেকে ক্রান্তীয় ও ক্রান্তীয় থেকে নিরক্ষীয় অঞ্চল পর্যন্ত ক্যামেরার লেন্স ঘুরে ঘুরে আসে। সোনালি বালু, মাসাই যোদ্ধা, রেন ফরেস্ট, সেকুইয়া ফরেস্ট—এ সব কত বেরিয়েছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর পাতায়। সুতরাং লেন্স ঘুরতে থাকে তৃপ্তিহীন। আর এই ভাবেই এক কৃষ্ণনীলিম রাতে ধরি আলোর ফুটকি দিয়ে আঁকা এক অসম্পূর্ণ গ্রাফিকস! বিন্দুর বিন্যাসে ঢেউ। কিন্তু নিউ ইয়র্ক নয়। গোল গম্বুজ রয়েছে। কিন্তু একাধিক। ওয়াশিংটন নয়। কতকগুলোর চারধারে মিনার, কোনোটার মাথায় পরি। কোনোটার মাথায় নিশান। দৈর্ঘ্যে বড়ো প্রস্থে ছোটো এক মুঠো এক শহর। উড়ালের ডানায় গাড়ির আলোর রেখা, নীচে গাড়ির ভিড়। আশ্চর্য হয়ে দেখি সেই সিগন্যাল সবুজ হয়, সব রকমের গাড়ির মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় কে আগে যাবে। রেস নয়, অথচ ভয়ানক প্রতিযোগিতা। কী আশ্চর্য জাদু জানে এদের চালকরা। এ ওর পাশ কাটিয়ে এতটুকু জায়গা দিয়ে দিব্যি চলে যাচ্ছে। তিন চাকার এক রকম গাড়ি তো মনে হল সার্কাসি কসরত দেখাতে দেখাতে ছুটছে। নতুন রকম বটে। ক্লিক।

পেভমেন্টে জমাট জনতা। কোনো উৎসব নাকি? মনে তো হচ্ছে না। তা ছাড়া মানুষ ছাপিয়ে জেগে থাকে গম্বুজ, মিনার মন্দির। আরও সব বিল্ডিং-এর উদ্ভাসিত বডি। হালকা কুয়াশায় মোড়া চুমকি বাহার। এই চুমকিস্তান আমার খাসা লাগে। আরও নেমে যাই সুতরাং। দেখি এক কালো গুহা থেকে ছত্রভঙ্গ মানুষ-পিঁপড়ের দল উঠে আসছে। যেন কোনো মহাভয় থেকে পালাচ্ছে। নির্ঘাৎ এখানে কোনো সন্ত্রাসবাদী হানা…ও হো, এটা পাতালরেলের সুড়ঙ্গ! লজ্জা পেয়ে দিক পরিবর্তন করি। রাস্তায় রাস্তায় সুদৃশ্য লম্বা বাড়ি, পাশে ভ্যাটে ছড়ানো পাকার জঞ্জাল। নাক নেই তবু গন্ধ বুঝি। তারপর গন্ধ চিনে চিনে পৌঁছে যাই জঞ্জালক্ষেত্রে। ঘুরে বেড়াচ্ছে অজস্র কীট। না, কীট তো নয়, ময়লা শিশু সব জঞ্জাল খুঁটে খুঁটে কী জানি কী থলিতে পুরছে। পাশ দিয়ে হুশ করে চলে গেল নীল-সাদা বাস, বাস ভরতি চকচকে ঝকঝকে বাচ্চার দল কলকলাচ্ছে। শিশু-কীটগুলি জঞ্জাল খুঁটে খায়। বাস ভরতি শিশুগুলি কলকলিয়ে যায়। বুঝে যাই এখানে আসলে দুটো শহর আছে। গরিব শিশুর শহর আর সচ্ছল শিশুর শহর। আর গরিবরা গরিব হলে কী হবে, তাদের বাচ্চা জন্মানোর কামাই নেই। জন্মানো বাচ্চাগুলোর দেখভাল কিন্তু কেউ করে না। বেশ স্পার্টান ব্যবস্থা। পারলে বাঁচো, নইলে ময়রা!

সর্বনাশ! জঞ্জালের পাহাড়টা যে ওদের ওপর ভেঙে পড়ল? ক্লিক।

৫.

আমার আশেপাশে এখন বেশ কয়েকটি প্রেতশিশু। নিরবয়ব ঠোঁটে হাসি ছড়িয়ে যাচ্ছে।

১ম জন—দমবন্ধের সময়ে এটুখানি কষ্ট হয়েছিল। তোর?

২য় জন-তুই কি ওই বদবুতে নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা বলছিস?

১ম জন—ধেৎ, বদবু আমাদের মা-বাপ, বদবু আমাদের ভাত দেয়, তুইও যেমন!

৩য় জন—না রে, ওই পাহাড়ের ভেতরে একশোটা হাজারটা আধা-খ্যাঁচড়া ব্যাঙাচি মেয়ে আছে। পেট থেকে বের করে টেনে ফেলে দেয় তো? দুর্গন্ধ বলে দুর্গন্ধ?

১ম জন—ওদের বেশ আর জন্মাতে হল না! যাক, আমরাও আর জন্মাচ্ছি না। ময়লা ঘেঁটে ঘেঁটে কাগজ, টিন, বোতলভাঙা বার করো রে, সর্দারকে দাও রে, পিটুনি খাও রে!

৪র্থ জন—এখন থেকে পেট ভরে ভাত খাব। আর মাংস। তারপরে সেই ঝলমলে দোকানটা থেকে সায়েবি জামাকাপড় কিনব, প্লেনে উড়ে চলে যাব অনেক দূরে, সায়েবদের দেশে যেখানে বড়ো বড়ো বাড়ির বড়ো বড়ো ইস্কুলের ছেলেমেয়েরা চলে যায়!

২য় জন—(হেসে) খাবি যে তোর মুখ, জিভ, দাঁত কই? পরবি যে তোর ধড় কই? দেখছিস না কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। অথচ বুঝতে পারছি তুই খন্তা, আমি পচা, ওটা মকবুল। ভুতো, রাজু, আসগর আর হরিশ উড়ে আসছে দ্যাখ।

এ বার আমার দিকে ওদের চোখ পড়ল, তুমি সায়েব-ভূত না?

ঠিক সাহেব নয়, আমি আমার গায়ের রং আর আদি জন্মস্থানের কথা ভেবে বলি।

সায়েবের মতো, তাই না? ওই যে নীচে একটা জায়গা আছে সেখানে অনেক সায়েবের মতো আছে, দেখবে?

আমি আমার ক্যামেরা রেডি করি। নীচে একটা বিরাট ইনস্টিটিউট বাড়ি থেকে দলে দলে বেরিয়ে আসছে প্রচুর, হ্যাঁ, তরুণ-তরুণীই তো মনে হল। সবাই একই রকম টাইট টপ আর টাইট জিনস পরেছে।

একজন আর একজনকে বলল, হাই ক্রিস, ডিসিশন নিলি?

দ্বিতীয় জন–নারে প্যাটস, আই নিড আ ফিউ ডেজ মোর, মুঝে টাইম দে বাবা, দিজ ওল্ডিজ আর সো বোরিং।

প্রথম জন—হোয়াটস দা গ্রেট প্রবলেম? তুই ক্রিস থাকবি গোমজির সঙ্গে, এর মধ্যে ওল্ড পিপল আসছে কী করে!

দ্বিতীয় জন—আরে বাবা, গোমজ এবার স্টক মার্কেটে কত হেরেছে জানিস? ফিফটিন ল্যাকস, বেবি। ইউ নিড ক্যাপস, বুড়োবুড়ি চট করে দেবে নাকি?

তৃতীয় জন—তো যা, কত লিটার অয়েল লাগবে হিসেব কর। ডিসগাস্টিং! ধরিয়ে দে না পাত্তি পুরিয়া, দিতে পথ পাবে না।

অনেকটা সায়েবের মতো, নয়? খন্তা বলল।

আমি ভাবতে থাকি, ভাবতে থাকি। ঠিক সাহেবদের মতো কি?

আরও দেখাচ্ছি, এসো।

হুশ করে নেমে পড়ি একটা আধা-অন্ধকার ঘরে। আলো জ্বলছে, নিবছে, প্রায় বিবসন তরুণ-তরুণী নাচছে। এঁকেবেঁকে, যেন ঘরময় সাপ কিলবিল করছে। ক্যামেরা সক্রিয় হয়ে ওঠে।

দ্যাখো, ওরা কী খাচ্ছে!

নীলিম আকাশের নীচে নীল সুইমিং পুলের পাশে কাবাব উৎসব হচ্ছে। কাবাব মোগলাই ডিশ। আমার খুব প্রিয়। এলাহি আয়োজন।

রাজু বলল, আরও খানা আছে। পিলা, সফেদ, হর রং। কী খুশবু! আচ্ছা সায়েব ভূত, ওরা সব খেতে পারে না। তবু আমাদের দেয় না কেন বলো তো?

কালু বলল, আসল কথাটা বল না, খালি পিলা-লাল। ও সায়েব-ভূত, সায়েবদের দেশের রাস্তাটা বাতলে দেবে?

অনেক দেশ তো আছে। কী রকমটা চাও?

যেখানে মা-বাবা থাকে। বাবা মাকে ঠ্যাঙায় না। মা বাবাকে খিস্তি করে না। যেখানে সর্দার আমাকে চোর-ঠ্যাঙান ঠ্যাঙায় না। আমাদের নীল-সাদা বাসে করে ইস্কুলে নিয়ে যায়। আর যে দেশে সত্যিবাদী লিটার আছে।

লিটার?

ওই যে গো মানুষের মতো। ওরা মাঝে মাঝে দাঁড়ায় আর বলে ভাত দেব, জল দেব, লাইট দেব, পাকা ঘর দেব, কিন্তু দ্যায় না।

শিশুর দল কলবল কলবল করতে করতে মিলিয়ে যায়। সাহেবদের দেশের কথা ভুলে, জীবন্মুক্তির খুশিতে ভরপুর।

৬.

নিঃসঙ্গ আমার লেন্সে ভেসে ওঠে বাজার।

পাঁচ আঙুলে পাঁচ আংটি ধবধবে পোশক এক চেকনাইঅলা কালো ব্যক্তি টাইগার প্রন-এর ঝাঁকার সামনে দাঁড়িয়ে।

৬০০ টাকা দর কিন্তু।

আরে যা যাঃ, দর দেখাসনি, পাঁচ কেজি তুলে দে। আছে তো? তোপসে দে চার কেজি। একটি রোগা, ভুড়িঅলা নিরীহ চেহারার লোক এসে দাঁড়ায়। পরনে লুঙ্গি। বলে, মিরগেল আজ কত যাচ্ছে?

মাছঅলা তোপসে ওজন করছিল। জবাব দিল না। একরাশ কুচোমাছ একদিকে জড়ো করা ছিল। সেদিকে আঙুল দেখাল।

সসঙ্কোচে কিছু কুচোমাছ কিনে লোকটি চলে যায়। কুচোমাছের খদ্দের আর পাঁচ-ছ কেজির খদ্দেরকে যার যার সওদা সুষ্ঠু ক্যামেরায় ধরে রাখি।

মাছওলা বলল, পেনশন পজ্জন্ত পায়নি, আবার মিরগেলের দর…

চেকনাই বলল, কে ওটা?

যদুগোপাল ইস্কুলের মাস্টার।

তা পেনশন পেল না কেন?

হেডমাস্টার আর পেনশন আপিসের বাবুদের খাওয়ায়নি। আবার কী? ওরা কাগজপত্তর সব গোলমাল করে রেখে দিয়েছিল। পাঁচ বছর জুতোর সুকতলা খুইয়ে এখন বলচে পেনশন হবে না।

বলিস কী রে? তা তুই এত জানলি কী করে?

আমার ছেলে দুটো তো ওই ইস্কুলের। আবার ওই মাস্টারের পাইভেট ছাত্তরও ছিল। বড়োটাকে বি কম পজ্জন্ত পাস করাল। ঢুকিয়ে দিয়েছি সরকারি আপিসে। সিডিউল কাস্টোর খাতায়। ছোটোটা ঘষটে ঘষটে একটা পাস দিয়েছে। ধরেছে প্রোমোটারি করবে।

হাঃ হাঃ বলল কী হে? আমার ভাত মারবে?

সসম্ভমে মাছঅলা বলল, আপনি প্রোমোটার নাকি? এ দিকে তো দেখিনি!

এ বার দেখবে। রূপসায়র-এর বোর্ড দেখেছ তো? জলাটা বুজোতে মেলা। ঝামেলা গেল। পাকাঁপাকি থাকব তেরো তলায়। শিগগির আসছি।

চেকনাই আর মাছঅলার সব কথা আমি ভূত হয়েও ভালো বুঝতে পারিনি। নেহাত কৌতূহলে চেকনাইয়ের পেছু নিয়েছিলাম। তা বেরিয়েই চেকনাই একটা বিরাট মিছিলে আটকে গেল। একটু পরে দেখি লোকটা বিনবিন করে ঘামছে। ইশারায় মুটেটার কাছে জল চাইল। আমার অভিজ্ঞতা আছে, বুঝলাম লোকটার স্ট্রোক হচ্ছে। ধড়াস করে পড়ল। ছুটে এল কিছু লোক।

আধমনি কৈলাশ, আরও কজন লাগবে। এই একটা ট্যাক্সি দ্যাখ তো!

মুটেটা ততক্ষণে মোট সুষ্ঠু হাওয়া হয়ে গেছে।

ট্যাক্সিটা যদি বা পেল, মিছিল পার হতে পারল না। মিছিল যদি বা পেরোল, হাসপাতালে জায়গা হল না। হাসপাতালে যখন জায়গা হল তখন চেকনাই হুশ করে আমার পাশে এসে গেছে। একটার পর একটা এসে যেতে লাগল এর পর। বাচ্চা, ধাড়ি, বউমানুষ, আধবুড়ো… গাদা একেবারে। চেকনাই টক করে হাওয়া হয়ে গেল। বলে গেল টা টা বাই বাই!আবার যেন দেখা পাই। আলাপ করার ইচ্ছে ছিল সাহেব দাদা, দেদার ফাঁকা জমি পড়ে রয়েছে আপনাদের ওদিকে। কিন্তু মিছিল, এই মিছিলকে আমি বড্ড ভয় পাই। এই প্রেতলোকের ছবিটা আমি আগাগোড়া তুলি। এখানে কথা কম। কাজ বেশি। তা ছাড়া আমার আর অসুবিধেই বা কী!

তা যদি বলেন মিছিলে আমারও বড্ড ভয় ধরে গেছে। কোনো যুক্তি নেই, তবু ভয়। পালাতে থাকি।

৭.

ঘোর অন্ধকারে উন্মত্ত কাণ্ডের সামনে পড়ে যাই। একটা মেয়ে আর তাকে ঘিরে তাকে নিয়ে সাত-আটটা লোক, তাদের পরনে ইউনিফর্ম। মেয়েটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় আর গলা দাবিয়ে খুন করে দেয় ওরা। ক্লিক। আলোয় অন্ধকারে এ রকম আরও দৃশ্য দেখি, গাড়ি থামিয়ে টেনে বার করছে। মোটর বাইকের পেছন থেকে টেনে নামাচ্ছে। গলিতে গলিতে ওত পেতে আছে। লাথি মেরে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে নায়কোচিত দর্পের সঙ্গে গালাগাল সহযোগে ধর্ষণ ও খুনের কাজটা সম্পন্ন করছে। পাঁচটা লোক একটা লোককে জ্যান্ত অবস্থায় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কাটছে দেখলাম। বুলেট, ড্যাগার, স্টিক, ক্লিক ক্লিক ক্লিক।

কারা যেন প্রচণ্ড চ্যাঁচায়। এই সমস্ত কার্যকলাপের প্রতিবাদে নিশ্চয়ই। পটকা ফাটছে, রকেট উঠে যাচ্ছে আকাশে। বড়ো বড়ো করে লেখা ব্যানার, ওয়ার্ল্ড কাপ রানার্স জিন্দাবাদ। ওয়ার্ল্ড কাপ রানার্স জিন্দাবাদ। গাঁদা ফুলের পাপড়ি ছড়ানো পথে যাই, দুধারে জনতা উন্মত্তের মতো শিস দিচ্ছে, নাচছে। বাজনা বাজছে। জিতল কে? জিতল কে লাল হলুদ আবার কে? পিলপিল করে ছেলে-বুড়ো মেয়ে-পুরুষ ছুটছে—এ পথ দিয়ে মহাতারকারা যাবেন, বলিউড! বলিউড! সমস্ত উঠে যায় আমার ভূতগ্রস্ত ক্যামেরায়।

অসীম ধৈর্যে ভিড় পার হয়ে একটি মলিন চেহারার ছেলে বাড়ি ফেরে, আজ টিইশনের টাকাটা পেয়েছি মা, রাখো।

এত কম?

ভাইরাল ফিভারে কামাই হয়ে গেল, কেটেছে।

দুটি মেয়ে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ভিড় বাসে উঠে গেল। বুটিকটা শুরু করবার টাকা জোগাড় করতে হবে বুঝলি? গোলি মারো কনট্র্যাক্টের চাকরিকে! এবং কোথা থেকে ধোঁয়ার মতো কবিতা ওঠে, গান ওঠে, ঝমঝম করে বাজনা বাজে দিগন্ত থেকে দিগন্তে। সুন্দর সুন্দর প্রেক্ষাগৃহ। গান হচ্ছে, চটুল গান, গভীর গান। কবিতা হচ্ছে, গল্প হচ্ছে, নাটক হচ্ছে। প্রেমের কবিতা, প্রতিবাদের কবিতা, গ্রামের গপ্পো, শ্রমজীবীদের গপ্পো, ষড়যন্ত্রের নাটক, কিস্তুত নাটক। মেলা দেখি, অজস্র মেলা। আর তার পরেই একটা বিশ্রী ঘটনা ঘটে। অলিগলিতে ঘুরে বেড়ানো কুকুররা আমার প্রেত দেখতে পেয়ে যায়। ছুটে আসতে থাকে লক্ষ লক্ষ ঘেয়ো কুকুরের পাল, লম্ফঝম্প, কেউ কেউ, ঘোট ঘোউ। কাকেরা গলা মেলায়। শকুন ঘুরতে থাকে হাসপাতালের আস্তাকুঁড়ে। জিঘাংসায় মৃত, ধর্ষণে হত, দুর্ঘটনায় থ্যাঁতলানো শবরাশির ওপর। ক্রমে এই সমস্ত শব শকুন হত্যা হস্তশিল্প কুকুর ও কবিতা ছাপিয়ে উঠতে থাকে কাকের আওয়াজ, আজানের সুর, গ্রন্থপাঠ, ধর্মগুরুদের স্বস্তিক সদানন্দ মুখনিঃসৃত শিবনেত্র উপদেশামৃতের গমগমে আওয়াজ। মাথা তুলে উঠতে থাকে সুপার মার্কেট, বিশাল বিশাল বিলাসবহুল সব পেয়েছির দোকান। চরম হতাশায় বুঝতে পারি দেখনসুন্দর, মাখনহাসি, গহন-পচা মাটিল্ডার প্রেত এখন বিছিয়ে আছে গোলার্ধের এই অক্ষাংশ এই দ্রাঘিমায়।

আমার সারা জীবন-মরণের সবচেয়ে অ্যাবসার্ড ছবিটি আমি পাঠাতে থাকি তরঙ্গে তরঙ্গে যতক্ষণ না কোনো লেক রোডের কোনো অম্বুজ শ্রীনিবাসন তার অ্যান্টেনায় পুরোটা নির্ভুল ধরতে পারে। কেন না প্রেত হলেও শেষ বিচারে তো আমি শিল্পীই।

প্রকাশ না করে আমার উপায় কী!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *