ক্যাপটেন রবার্ট ফ্যালকন স্কট : দক্ষিণ মেরুতে ভ্রমণকারী দ্বিতীয় ব্যক্তি
দক্ষিণ মেরুতে ভ্রমণকারী দ্বিতীয় ব্যক্তি ক্যাপটেন বার্ট ফ্যালকন স্কটের কাহিনীটি ছিল বেশ বীরত্বপূর্ণ ও অনুপ্রেরণাদায়ক কিন্তু সর্বাপেক্ষা মর্মান্তিক। রস আইস ব্যারিয়ার স্কট ও তার দু’জন সঙ্গী যে দুঃখজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন তা আজো মানুষের মনে আলোড়ন ও সহানুভূতির সৃষ্টি করে। ১৯১৩ সনের ফেব্রুয়ারি মাসের এক বিকেলে তার মৃত্যুসংবাদ লন্ডনে পৌঁছার সাথে সাথেই সমস্ত ইংল্যান্ড শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।ট্রাফালগারে নৌ সেনাপতি নেলসনের মৃত্যুর পর আর কোনো ঘটনা তাদের এত স্তব্ধ করতে পারে নি। বাইশ বছর পর একটি মেরু জাদুঘর নির্মাণ করে ইংল্যান্ডবাসী তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে, অর এটাই হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম জাদুঘর। এই জাদুঘরে তার স্মৃতির উদ্দেশে একটা ল্যাটিন বাক্য খোদিত আছে–
‘তিনি গিয়েছিলেন মেরু রহস্য উদ্ধার করতে,
পেয়ে গেলেন ঈশ্বর রহস্যের সন্ধান।‘
ক্যাপটেন স্কট ‘টেরা নোভা’ জাহাজের করে দক্ষিণ মেরুর দিকে ধাবিত হলেন এবং যে মুহূর্তে মেরু বৃত্তের বরফাচ্ছাদিত জলের ওপর দিয়ে চলা শুরু করেন তখনই তা কাঁধে সওয়ার হল অদৃষ্টের নির্মম পরিণতি।
স্কট তার গন্তব্যের দিকে এগোতে থাকলেন। সাগরের বিশাল ঢেউগুলো জাহাজের গায়ে আছড়ে পড়ছিল আর পাটাতনের উপরকার জিনিসপত্রগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। পানি জাহাজের খোলের ভিতরে প্রবেশ করতে লাগল বয়লারের আগুন নিভে গিয়েছিল এবং সমুদ্রের প্রবল নিষ্পেষণে জাহাজটা অসহায় অবস্থায় দুলতে থাকল।
কিন্তু স্কটের দুর্ভাগ্য তখন সবেমাত্র শুরু হয়েছে। স্কটের সাথে খুব কষ্ট সহিষ্ণু কয়েকটা টার্টু ঘোড়া ছিল। এগুলোকে সাইবেরিয়া অঞ্চলের প্রচণ্ড শীত সহ্য করিয়ে আনা হয়েছিল, কিন্তু তাদেরকেও তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল। মেরুর গুড়ো তুষারপাতে পড়ে তারা ইতস্তত ছুটাছুটি শুরু করে দিয়েছিল এবং তুষারের ফাঁকে ঘোড়াগুলোর পা ভেঙে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত গুলি করে মেরে ফেলতে হয়েছিল। ইউকোন থেকে অনেক ক’টা এস্কিমো কুকুর আনা হয়েছিল। কুকুরগুলো শীতের তাড়নায় বরফের ফাটলের কিনারায় এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করল।
তারপর নিরুপায় হয়ে স্কট ও তার চার সঙ্গী নিজেরাই তাদের হাজার পাউন্ড ওজনের স্নেজগাড়ি টানতে-টানতে মেরু কেন্দ্রে চূড়ান্ত অভিযান শুরু করে দিলেন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় নয় হাজার ফুট উপরোস্থিত হিম মণ্ডলের মধ্য দিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় তারা এগিয়ে চললেন। মানব ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা দুর্গম ও রহস্যাবৃত মেরু, যা সৃষ্টির প্রথম ছ’দিন থেকেই রহস্যময় থেকে গেছে–যেখানে। কিছুই বাঁচে না, শ্বাসগ্রহণ করে না, কিছুই নড়ে না, এমনকি একটা ভ্রাম্যমাণ গাংচিলও না, সেদিকেই তাদের সমস্ত শ্রম ও শক্তি ব্যয় করে তারা এগিয়ে চললেন। চতুর্দশ দিবসে তারা-স্কট ও তার দল মেরুতে পৌঁছলেন কিন্তু তাদের ভাগ্যে ছিল হতাশা আর ভীতি। তাদের অগ্রভাগে একটা লাঠির মাথায় নরওয়ের জাতীয় পতাকাটি একটুকরো ছেঁড়া কাপড়ের মতো বাতাসে দুলছিল। স্কটের আগে এই মেরুতে যিনি এসেছিলেন তার নাম নরউইজান এমুন্ডসন। তারা বুঝতে পারলেন বহু বছরের প্রস্তুতি এবং বহু বছরের যন্ত্রণা ও ভোগান্তির পর মাত্র পাঁচটি সপ্তাহের ব্যবধান তাদের হাত থেকে বিজয় ছিনিয়ে নিল।
একরাশ পুঞ্জিভূত হতাশা নিয়ে তারা বাড়ির পথে যাত্রা শুরু কররেন। সভ্যতার মাঝে তাদের প্রত্যাবর্তনের কাহিনীটি ছিল অত্যন্ত করুণ এবং দুঃখ্যাতনার আরেক মহাকাব্য। মেরুর প্রবল বায়ু প্রবাহ স্কট ও তার সঙ্গীদের সারাদেহ বরফে আচ্ছাদিত করে দিল। এমনকি তাদের চুলদাড়ি পর্যন্ত শীতে জমে গেল। তাদের সবার ধৈর্য ও শক্তি ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ হয়ে যেতে লাগল। তারা এই চরম প্রতিকূল অবস্থায় একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। অভিযাত্রীদলের সবচেয়ে শক্তিশালী অফিসার ইভান্স পা পিছলে পড়ে গেলেন এবং সবার চোখের সামনে দুঃখজনকভাবে চিরবিদায় নিলেন। দেখতে না দেখতে হিমবাহের তুষারের নিচে তার দেহটা চিরতরে ঢাকা পড়ে গেল। এবার ক্যাপটেন ওটস-এর পালা। তুষারের আঘাতে তার পা-দুটো ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেল, তিনি আর হাঁটতে পারছিলেন না। ওটস বুঝতে পারলেন তার জন্য সঙ্গীরা পিছিয়ে পড়ছে। রাতে তিনি এক কাজ করে বসলেন। মৃত্যুবরণ করার জন্য তিনি তুষারঝড়ের মধ্যে হেঁটে চলে গেলেন যাতে অন্যরা বেঁচে যান।
ক্যাপটেন ওটস শান্তভাবে বললেন, আমি বাইরে যাচ্ছি, আমি কিছুক্ষণ বাইরে থাকব।’ তিনি চিরকালের জন্য বাইরে চলে গেলেন। তার জমাটবাধা দেহটা আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় নি। যেখান থেকে তিনি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে একটা স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে যাতে লেখা আছে–এখানে আশেপাশে কোথাও প্রাণত্যাগ করেছে এক অকুতোভয় আপনজন।
দক্ষিণ মেরুতে যখন একদিন শান্তভাবে সূর্য কিরণ দিচ্ছিল তখন একদল অনুসন্ধানকারী ক্যাপটেন স্কট ও তার সঙ্গীদের জমাট দেহগুলি আবিষ্কার করল। সেখানে তাদেরকে দুটো স্কি দড়ি দিয়ে বেঁধে একটা ক্রস বানিয়ে তার নিচে তাদেরকে কবর দেয়া হল। কবরের গায়ে খোদাই করা হল লর্ড টেনিসনের কবিতার কয়েকটি চরণ যা উৎসর্গ করা হল বীরবাহুদের স্মৃতি স্মরণে।