ক্যাপটেন – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

ক্যাপটেন – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

হাতের তাস শাফল করতে-করতে ক্যাপটেন মিলিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর চার সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ব্যাস, তা হলে এই কথাই রইল। আমি ডিল করছি। সবচেয়ে কম দরের তাস যার ভাগ্যে উঠবে, তাকেই ছুটে বেরিয়ে যেতে হবে এই গুহা থেকে। সে নিজে হয়তো মারা পড়বে, কিন্তু তারই জন্যে যে বাদবাকিরা বেঁচে যাবে, এটাই হচ্ছে বড়ো কথা।’

মাত্রই ঘন্টাখানেক আগে বার্বেরিস গ্রহের এই চাঁদের পিঠে পাঁচ অভিযাত্রী এসে নেমেছিল। মিলিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, ইদি ওকাবু, পিটার জ্যাকসন, রোবের সুস্তেল আর মালাকানু বিকিলা। তারা ভেবেছিল, এখানে একটি রিলে-স্টেশন তৈরি করে তোলা যাবে। তার প্রাথমিক কাজ শুরুও করেছিল তারা। কিন্তু ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে এখন তারা এই গুহার মধ্যে বসে আছে।

গুহার বাইরে, এবড়ো-খেবড়ো পাথুরে জমির ওপরে ছড়িয়ে আছে হালকা বেগনি রঙের রোদ্দুর। সেই সূর্যের রোদ্দুর, পৃথিবীর মানুষরা যাকে ‘পরাশর’ বলে চেনে। রোদ্দুর অবশ্য গুহার ভিতরে বিশেষ ঢুকতে পারছে না, কেননা, গুহার ঠিক মুখেই দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন পৃথিবীর সেই ডাইনোসরের মতোই বিশাল একটি প্রাণী। বার্বেরিসের যে চাঁদকে তারা সম্পূর্ণ নিস্প্রাণ একটা উপগ্রহ বলে ধরে নিয়েছিল, জমি জরিপ করতে নেমে সেখানে যে একেবারে অতর্কিতে এই হিংস্র জন্তুর মুখের সামনে পড়তে হবে, তা তারা ভাবতেও পারেনি। ন্যাড়া একটা পাহাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেই জন্তুটি তাদের তাড়া করে। ঠিক তক্ষুনি যদি না এই গুহার মধ্যে তারা ঢুকে পড়ত, তা হলে আর তাদের বাঁচতে হত না।

বাঁচবার আশা অবশ্য এখনও বিশেষ নেই। কেননা, টাইটান মহাকাশযান থেকে ছোট্ট-মাপের যে শাটলে করে তারা এখানে নেমেছে, তারই মধ্যে পড়ে রয়েছে তাদের লেসার-পিস্তল। দরকার হবে না ভেবেই সেগুলি আর তারা নামায়নি। ফলে, এখন তারা পুরোপুরি নিরস্ত্র। বাইরে, বেগনি রঙের রোদ্দুরের মধ্যে, দাঁড়িয়ে আছে তাদের শাটল-যান। কিন্তু এই গুহা থেকে রেবিয়ে সেখানে পৌঁছবার কোনো উপায়ই তারা খুঁজে পাচ্ছে না।

কী কবে পাবে? গুহার মুখেই দাঁড়িয়ে আছে সেই জন্তু। রাগে গজরাচ্ছে, পাথুরে জমির ওপরে ঘন-ঘন লেজ আছড়াচ্ছে। গুহার মুখটা তার শরীরের তুলনায় এতই ছোটো যে, কিছুতেই সে ভিতরে ঢুকতে পারছে না। কিন্তু যেভাবে সে তার থাবা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছে গুহার মুখের পাথরের চাঁইটাকে, যে-কোনো মুহূর্তে সেটা আলগা হয়ে খসে পড়া কিছু বিচিত্র নয়। কী হবে তখন?

ভেবে কোনো কূলকিনারা পাচ্ছিলেন না ক্যাপটেন মিলিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি এদের নেতা। দেখে যুবক বলে ভ্রম হয়, কিন্তু তাঁর বয়স এখন পঞ্চাশ। কথা ছিল, রিলে-স্টেশনের জরিপের কাজ শেষ করেই তিনি অবসর নেবেন। হাইবারনেশন-ক্যাপসুলে পুরে তাঁকে আবার পৃথিবীতে ফেরত পাঠানো হবে, এবং সেইখানেই তিনি কাটাবেন তাঁর অবসরজীবন। কিন্তু এই শেষ মিশনেই যে তাঁর অনুসন্ধানী দলটিকে নিয়ে এমন বিপদে পড়তে হবে, তা কি তিনি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন?

সঙ্গীদের মুখের দিকে তাকালেন মিলিন্দ। তাঁরই ওপরে নির্ভর করছে এদের জীবন-মৃত্যু। আপন হাতে এদের তিনি তৈরি করে তুলেছেন। সাফল্যের মুহূর্তে যেমন মুক্তকণ্ঠে ‘শাবাশ’ দিয়েছেন, তেমনি বিপদের মুহূর্তে জুগিয়েছেন সাহস। বয়সে এরা প্রত্যেকেই তাঁর চেয়ে অনেক ছোটো। সবচেয়ে ছোটো আফ্রিকার ওই কালো মেয়ে মালাকানু, যাকে তিনি আদর করে ‘মালা’ বলে ডাকেন। মালার বয়স বাইশ বছর। মাত্রই দু’বছর আগে মালা তাঁর অনুসন্ধানী দলে এসে যোগ দিয়েছে, কিন্তু বয়স এত কম হওয়া সত্ত্বেও সাহসে, সহিষ্ণুতায়, বুদ্ধিতে আর উদভাবনী কৌশলে সে কারও থেকে কিছুমাত্র পিছিয়ে নেই। ইদি, পিটার আর রোবেরও সে-কথা খোলাখুলি স্বীকার করে। একবার তো ঘোর বিপদের মুহূর্তে এই মালার বুদ্ধিতেই বেঁচে গিয়েছিল পিটার জ্যাকসন। পিটার সে-কথা ভুলে যায়নি।

মালাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন মিলিন্দ। তাঁর মেয়ে নেই। থাকবার মধ্যে আছে একটি ছেলে। কিন্তু ছেলেটিও কাছে নেই। পৃথিবীতে সে তার কাজের মধ্যে ডুবে আছে। দিল্লিতে মাত্র পঁচিশ বছর বয়সেই সে এখন মহাকাশবিজ্ঞান-বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নামজাদা অধ্যাপক। এখন অবশ্য সেই ছেলের কথাও মিলিন্দ ভাবছিলেন না। ভাবছিলেন তাঁর সহকর্মীদের কথা। ভাবছিলেন যে, যেমন তাঁর নিজের, তেমনি তাঁর সহকর্মীদের জীবনেরও আজ শেষ দিন।

সকলেরই শেষ দিন? মিলিন্দের মাথার মধ্যে একেবারে হঠাৎই একটা চিন্তা ঝিলিক দিয়ে গেল। আছে, পাঁচজনকে না হোক, অন্তত চারজনকে বাঁচাবার একটা উপায় হয়তো আছে। দলের পাঁচজনের মধ্যে যে-কোনো একজন যদি ছুটে বেরিয়ে যায় এই গুহা থেকে, তা হলে ওই জন্তুটা নিশ্চয় তাকে তাড়া করবে, আর সেই ফাঁকে বাকি চারজন হয়তো উলটো পথে দৌড়ে গিয়ে শাটল-এ উঠে পড়তে পারবে। অর্থাৎ, একজনের প্রাণের বিনিময়ে বেঁচে যাবে বাকি চারজন।

কিন্তু কে হবে সেই একজন, দলের চারজনকে বাঁচাবার জন্যে মিলিন্দ যাকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবেন?

সহকর্মীদের মুখের দিকে তাকালেন মিলিন্দ। তিনি জানেন, নেতার নির্দেশ ওরা কেউই অমান্য করবে না। যাকে আদেশ করবেন, সে-ই ছুটে বেরিয়ে যাবে এই গুহা থেকে। বেরিয়ে গিয়ে শাটল-এর বিপরীত দিতে দৌড়তে থাকবে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ক্ষুধার্ত জন্তুটার দৃষ্টিকে সে তার দিকে আকর্ষণ করতে একটুও দ্বিধা করবে না।

কিন্তু কাকে সে-কাজ করতে বলবেন মিলিন্দ? জেনেশুনে কাকে তিনি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবেন? ইদি ওকাবুকে, যাকে তিনি আত্মহত্যার পথ থেকে একদিন ফিরিয়ে এনেছিলেন? পিটার জ্যাকসনকে? জেলখানা থেকে ছাড়িয়ে এনে যাকে তিনি মানুষের কল্যাণের কাজে লাগিয়েছেন? রোবের সুস্তেলকে? তাঁরই কথায় যে কিনা বিলাসের জীবন হাসিমুখে ছেড়ে এসেছে? নাকি মালাকে, রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া যে-মেয়েটিকে তিনি তাঁর নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন?

সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্তও দেরি হল না ক্যাপটেন মিলিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তাঁরই হাতে জীবনের দায়িত্ব তুলে দিয়ে যারা নিশ্চিন্ত, তাদের কাউকেই তিনি এইভাবে মৃত্যুবরণ করতে বলতে পারবেন না। তার চেয়ে বরং ব্যাপারটাকে তিনি ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেবেন।

হাতে যখন কাজকর্ম থাকে না, মিলিন্দ তখন ‘পেশেন্স’ খেলেন। এ-খেলার সুবিধে এই যে, একা-একাই খেলা যায়, শুধু এক প্যাকেট তাস থাকলেই হল। পকেটে তাই সবসময়েই এক প্যাকেট তাস রাখেন মিলিন্দ। ট্রাউজার্সের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সেই তাসের প্যাকেটটাকে তিনি বার করে আনলেন।

তাস শাফল করতে-করতে মিলিন্দ বললেন, ‘ব্যাপারটা তোমরা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ। আমাদেরই মধ্যে একজনকে এই গুহা থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে হবে, যাতে শাফল-এর বিপরীত দিকে জন্তুটা তাকে তাড়া করে যায়, আর সেই ফাঁকে বাকি চারজন যাতে শাটল-এ গিয়ে উঠতে পারে। কে সেই দায়িত্ব নেবে, সেটা আমি ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিচ্ছি, কেমন?’

সঙ্গীদের কেউই কোনো কথা বলল না। কারও দৃষ্টিতে লেশমাত্র ভয় নেই। সকলেই মিটিমিটি হাসছে। মিলিন্দ বললেন, ‘বাস, তা হলে ওই কথাই রইল। আমি ডিল করছি। সবচেয়ে কম দরের তাস যার ভাগ্যে উঠবে, তাকেই ছুটে বেরিয়ে যেতে হবে এই গুহা থেকে। সে নিজে হয়তো মারা পড়বে, কিন্তু তারই জন্যে যে বাদবাকিরা বেঁচে যাবে, এটাই হচ্ছে বড়ো কথা।’

পিটার জ্যাকসনই প্রথম তার তাস তুলল। রুহিতনের সাহেব। পিটার বলল, ‘মনে হচ্ছে, আমাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে না।’

ইদি ওকাবু বলল, ‘আমি পেয়েছি হরতনের দশ। মনে হচ্ছে, আমিও এ-যাত্রা বেঁচে গেলুম।’

রোবের সুস্তেল বলল, ‘আমি পেয়েছি হরতনের বিবি। ক্যাপটেন, দেখা যাচ্ছে, আমার মৃত্যুও আপাতত মুলতুবি রইল।’

মালাকানু বলল, ‘আমি পেয়েছি ইস্কাবনের পাঁচ। সঙ্গীদের বাঁচাবার দায়িত্ব দেখছি আমাকেই নিতে হবে।’

সবশেষে তাস তুললেন মিলিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর, তাসখানাকে ভালো করে দেখে নিয়ে পকেটে রেখে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘না মালা, সম্মানটা তোমার কপালে জুটল না। তোমাদের বাঁচাবার দায়িত্ব দেখছি আমাকেই নিতে হল। আমি পেয়েছি চিড়িতনের তিরি।’

কথাটা বলেই মিলিন্দ চটপট উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, ‘রোদ্দুর পড়ে আসছে। আর দেরি করা ঠিক হবে না। তোমরা উঠে পড়। আমি পাহাড়ের দিকে ছুটব। জন্তুটা নিশ্চয় তাড়া করবে আমাকে। তোমরাও তৎক্ষণাৎ উলটো দিকে দৌড় লাগিয়ে শাটল-এ উঠে পড়বে। বিদায়।’

হিংস্র জন্তুটার পেটের তলা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন মিলিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। আর জন্তুটা তাঁকে তাড়া করতেই বাদবাকি চারজনও গুহা থেকে বেরিয়ে এসে উলটো-পথে শাটল-এর দিকে ছুট লাগাল।

শাটল-এ উঠেই স্টিয়ারিং হইল হাতে নিল মালাকানু। তারপর, ছোট্ট মহাকাশযানটিকে মাটি থেকে ফুট-কুড়ি ওপরে তুলে, কমিউনিকেশন চ্যানেলে মুখ রেখে তার তিন সঙ্গীকে বলল, ‘দলের নেতাকে ফেলে রেখে এক্ষুনি আমরা টাইটান মহাকাশযানে ফিরে যাব না। ক্যাপটেন যেভাবে ওই জন্তুটার থাবা এড়িয়ে ছুটছে, তাতে হয়তো বেঁচে যেতেও পারে। যদি বেঁচে যায়, তা হলে যেমন করেই হোক, এই শাটল-এ ওকে তুলে নিতে হবে।’

ঠিক সেই মুহূর্তে মিলিন্দর পিঠের ওপরে এসে পড়ল জন্তুটার থাবা। একটা ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলেন তিনি, কিন্তু পারলেন না। মিলিন্দ বুঝতে পারলেন, জন্তুটার নখ তাঁর পিঠের চামড়ায় বসে যায়নি বটে, কিন্তু তাঁর পোশাকটা তার বাঁকানো নখে আটকে গেছে। পরক্ষণেই জন্তুটার থাবা তাঁকে মাটি থেকে অন্তত দশ ফুট ওপরে তুলে ফেলল।

পিটার বলল, ‘জন্তুটা ক্যাপটেনকে নিয়ে খাদের ধার দিয়ে ছুটছে।’

রোবের বলল, ‘ক্যাপটেন ওর থাবা থেকে যেন একটা ন্যাকড়ার পুতুলের মতো ঝুলছে।’

ইদি বলল, ‘মালাকানু, পাহাড়াটাকে চক্কর মেরে আমাদের শাটলটাকে ওই খাদের দিকে নিয়ে চল।’

পিটার বলল, ‘এখন তো আমরা নিরস্ত্র নই। শাটলটাকে ওই জন্তুর মুখোমুখি করে দিয়ে শূন্যে একেবারে স্থির করে ভাসিয়ে রাখ। আমি আমার লেসার-গান চালাব।’

মালাকানু বলল, ‘শাটলটাকে আমি ওর মুখোমুখি নিয়ে ভাসিয়ে রাখছি। কিন্তু পিটার, তুমি কিংবা রোবের লেসার-গান চালিও না। ইদির মাথা তোমাদের চেয়ে অনেক ঠান্ডা, টিপও তোমাদের চেয়ে অনেক ভালো। ওকেই লেসার-গান চালাতে দাও।’

শাটল ততক্ষণে পাহাড়াটাকে চক্কর দিয়ে খাদের ধারে জন্তুটার মুখোমুখি এসে পড়েছে। স্পিড কমাবার হাতলটাকে একেবারে জিরোর দিকে ঠেলে দিয়ে মালা সেটাকে পুরোপুরি স্থির করে শূন্যে ভাসিয়ে রাখল। এক সেকেন্ড, দু’ সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড। তারপরেই ইদি ওকাবু টিপে দিল তার লেসার-গানের বোতাম।

বিশাল সেই জন্তুর শরীর তৎক্ষণাৎ ভীষণভাবে কেঁপে উঠল একবার। তারপরেই সে আছড়ে পড়ে গেল বার্বেরিসের চাঁদের এবড়ো-খেবড়ো জমির ওপরে। আর ক্যাপটেন মিলিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ও ঠিক সেই মুহূর্তেই তার থাবার থেকে ছিটকে বেরিয়ে খাদের মধ্যে পড়ে গেলেন। পড়তে-পড়তেই দু’হাত বাড়িয়ে একটা পাথরের চাঁইকে আঁকড়ে ধরেছিলেন তিনি, তা নইলে আর মালাকানুর ঝুলিয়ে-দেওয়া দড়িটা ধরে তিনি শাটল-এ উঠে আসতে পারতেন না।

শাটল তার খানিক বাদেই টাইটান মহাকাশযানে ফিরে আসে। ভীষণভাবে আহত হয়েছিলেন ক্যাপটেন মিলিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে অর্ধচেতন-অবস্থায় টাইটানের সিক-রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। এ হল কয়েক দিন আগের কথা। ইতিমধ্যে তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। আজ তাঁকে সিক-রুম থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তার আগে টাইটান মহাকাশযানের কম্যান্ডার নোগিচো মাশাতাসি তাঁর সঙ্গে দরকারি দু-একটা কথা বলতে চান।

মাশাতাসি বললেন, ‘মিলিন্দ, কথাটা আর কিছুই নয়। তোমার বয়েস হয়েছে, তাই ঠিক হয়েছিল যে, কাজ থেকে অবসর নিয়ে তুমি এবারে পৃথিবীতে ফিরে যাবে। তুমি জান, যে-ধরনের বিপজ্জনক কাজ আমাদের অনুসন্ধানী দলগুলিকে করতে হয়, পঞ্চাশের পরে আর তার দায়িত্ব কাউকে দেওয়া চলে না। কিন্তু তোমার টিমে যে নেক্সট ইন কম্যান্ড, সেই পিটার জ্যাকসন টাইটানে ফিরে যে রিপোর্ট দিয়েছে, তাতে বুঝতে পারছি, বয়স যা-ই হোক, এক্ষূনি তোমাকে রিটায়ার করতে দেওয়া ঠিক হবে না। তোমার টিমও তোমাকে ছাড়তে আদৌ রাজি নয় তাই আমাদের ইচ্ছে, আরও অন্তত কয়েকটা বছর তুমি কাজ চালিয়ে যাও।’

কম্যান্ডার মাশাতাসি বেরিয়ে গেলেন। ক্যাপটেন মিলিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ও তার একটু পরেই বেরিয়ে এলেন সিক-রুম থেকে। লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে পার হয়ে এলেন লম্বা করিডর। তারপর 503 নম্বর ঘরে এসে ঢুকলেন। টাইটান মহাকাশযানে এটাই তাঁর নিজের ঘর।

ভেবেছিলেন, ঘরে কেউ থাকবে না। তাই মিলিন্দ একটু অবাক হয়ে গেলেন, যখন দেখলেন যে, ইদি, পিটার, রোবের আর মালা তাঁর ঘরে বসে গুলতানি করছে। তাদের সামনে, টেবিলের ওপরে, এক প্যাকেট তাস ছড়ান।

মিলিন্দকে দেখে তারা আনন্দে হইহই করে উঠল। মিলিন্দ কিন্তু একটুও হাসলেন না। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘তাস খেলছ কেন? টাইটানে যে তাস খেলা নিষিদ্ধ, তা তোমরা জানো না?’

শুনে মুচকি হাসল সবাই। পিটার কী যেন বলতে যাচ্ছিল, মালা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘ক্যাপটেন, একান্নটা তাস দিয়ে কি খেলা যায়? প্যাকেটে মোট বাহান্নটা তাস থাকবার কথা, কিন্তু এই প্যাকেটে দেখছি একান্নটা রয়েছে। বাকি তাসটা তোমার পকেট থেকে তুমি বার করে দেবে?’

মিলিন্দ বললেন, ‘তার মানে?’

‘মানে আর কিছুই নয়,’ মালা বলল, ‘যে-তাসটা এখানে পাচ্ছি না, সেটা হল ইস্কাবনের টেক্কা। সবচেয়ে বেশি দামের তাস। গুহার মধ্যে যখন তাস বাঁটা হয়, তখন এটাই তুমি পেয়েছিলে। কিন্তু এটাকে তুমি পকেটে ঢুকিয়ে রেখে অম্লালবদনে বলেছিলে যে, চিড়িতনের তিরি পেয়েছ। কেন বলেছিলে, তাও আমরা জানি। আমি পেয়েছিলুম ইস্কাবনের পাঁচ। তাই গুহা থেকে বেরিয়ে আমারই মৃত্যুবরণ করবার কথা। কিন্তু তুমি… শুধু আমাকে কেন, দলের কাউকেই তুমি মৃত্যুবরণ করতে দিতে চাওনি। আর তাই… মিথ্যে কথা বলে সবাইকে ধোঁকা দিয়ে তুমি নিজেই সেদিন মৃত্যুবরণ করবার জন্যে গুহা থেকে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল। তাই না দাও, ক্যাপটেন, পকেট থেকে এবার ইস্কাবনের টেক্কাটা বার করে দাও।’

মিলিন্দ চুপ করে রইলেন। অবসর নিয়ে পৃথিবীতে ফেরা হয়নি বলে এখন আর তাঁর সত্যিই খুব দুঃখ হচ্ছিল না। কোথায় ফিরবেন তিনি? ছেলের কাছে? ইদি, পিটার, রোবের আর মালার দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হচ্ছিল, এই এরাই তাঁর ছেলেমেয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *