ক্যাচ

ক্যাচ

হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় এবার বিল্টু দুটো বিষয়ে ক্লাসের মধ্যে সব থেকে বেশি নম্বর পেয়েছে। বাংলা এবং অঙ্ক। ইংরেজিতে ভাল করেছে। ফার্স্ট বয়ের থেকে পিছিয়ে আছে মাত্র দেড় নম্বরে। ভূগোল এবং ইতিহাসও খারাপ হয়নি। বরং ভালই হয়েছে। নম্বর আশির ঘরে। আরও মজার কথা হল, প্রত্যেকবার ড্রইং পরীক্ষায় সে পায় গ্রেড ‘বি’। এবার পেয়েছে ‘এ’ গ্রেড। ছবির বিষয় ছিল, একটি গ্রামের মেলা। বিল্টু কোনওদিন গ্রামের মেলা দেখেনি। তবু ভারী সুন্দর এঁকেছে। এতগুলো ভাল নম্বর পেয়েও বিল্টুর মন ভীষণ খারাপ। বিল্টুর বাবা তাপসবাবু এবং মা বিশাখাদেবীর মন খারাপ। এতই খারাপ যে তাপসবাবু অফিস থেকে ফিরে এক কাপ চা ছাড়া কিছু মুখে তোলেননি। বিশাখাদেবী সোফায় বসে টিভিতে একটা দম-ফাটা হাসির সিরিয়াল দেখছেন, কিন্তু একটুও হাসছেন না। ছোটকা ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে সেই যে নিজের ঘরে দরজা দিয়েছে, এখনও খোলেনি।

বিল্টুর দাদু একজন হাসিখুশি মানুষ। সবসময়ই তাঁর মুখে হাসি। আজও তাঁর হাসি মুখ। কিন্তু সেই হাসিটা শুকনো। রোজই ঠাম্মা রান্নার আগে বলে দেন, কী কী রান্না হবে। আজ তিনি রতনের মাকে ডেকে বলে দিয়েছেন, সে যেন নিজের ইচ্ছামতো রান্না করে। কোনওভাবে তাঁকে যেন বিরক্ত না করা হয়।

গোড়া বাড়ি জুড়ে একটা থমথমে ভাব।

এর কারণ হল, বিল্টু আজ ক্লাস সিক্সের ক্রিকেট টিম থেকে বাদ পড়েছে। পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর পর সিক্স এবং সেভেনের ‘সিলেকশন ম্যাচ’ ছিল। এই ম্যাচে ঠিক হয় আগামী দিনে ক্লাস টিমে কে থাকবে, কে বাদ যাবে। নতুন কেউ ঢুকবে কিনা। গেম টিচার অনিমেষ স্যার সারাক্ষণ মাঠের ধারে বসে থাকেন। ছোট্ট একটা নোটবুকে কী সব লেখেন। মনে হয় খেলোয়াড়দের নামের পাশে নম্বর দেন। খেলা শেষ হয়ে গেলে নতুন টিম ঘোষণা করেন।

আজ ক্লাস সিক্স দুর্দান্ত খেলে সেভেনকে তেইশ রানে হারিয়ে দিল। গেম টিচার মাঠে নেমে সবার পিঠ চাপড়ে দিলেন এবং বললেন, বিল্টু এবার ক্লাস সিক্সের টিম থেকে বাদ। তার বদলে জায়গা পাবে সুশান্ত। সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবার সময় অনিমেষ স্যার গলা গম্ভীর করে বললেন, কথাটা বলতে আমার খুবই খারাপ লাগছে, কিন্তু কোনও উপায় নেই। বিল্টুর রান ভাল। যে-সময় তাকে উইকেটে গিয়ে দাঁড়াতে হয়, তখন দলের ওপর যথেষ্ট চাপ ছিল। সেই চাপের মুখে দাঁড়িয়ে সে ষোলো রান করেছে। বলেও পারফরমেন্স খারাপ নয়। দুটো গুরুত্বপূর্ণ উইকেট পেয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, ফিল্ডিংয়ের একটা অংশ নিয়ে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। উলটে প্রশংসা করাই উচিত। খুব জোরে ছুটে সে তিনখানা অবধারিত বাউন্ডারি আটকে দিয়েছে। নইলে ওখানেই সেভেন বারো রান পেয়ে যেত। তবু ওকে বাদ দিতে হচ্ছে। কেন দিতে হচ্ছে? কারণ, বাদ দেওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই।’

এই পর্যন্ত বলে অনিমেষ স্যার দু’বার কাশলেন। মাঠের পাশে রাখা বোতল থেকে জল খেলেন। তারপর আবার শুরু করলেন, বিল্টু আজ মোট পাঁচখানা ক্যাচ মিস করেছে। গুনে গুনে পাঁচ। তার মধ্যে তিনটে ছিল অতি সহজ। এতই সহজ যে সেগুলোকে ক্যাচ না-বলে জল বলা যেতে পারে। একটা ক্যাচ ছিল কঠিন। বাকি একটা মাঝারি ধরনের। আমি খবর পেয়েছি, শুধু আজকের ম্যাচ নয়, এর আগের কয়েকটা খেলাতেও বিল্টু এই কাণ্ড করেছিল। ব্যাট, বল, ছোটাছুটির ফিল্ডিংয়ে সে যথেষ্ট পারদর্শিতা দেখিয়েছিল, কিন্তু ক্যাচ ধরতে পারেনি। আমি মনে করি, এই বয়স থেকে যদি ক্যাচ ধরতে এরকম গোলমাল হয়, তা হলে ভবিষ্যতে খেলতে নেমে বিল্টুরই অনেক ক্ষতি হবে। যে খেলার অন্য দিকগুলোতে এত ভাল করছে, সে ক্যাচে কেন পিছিয়ে থাকবে? ঠিক কিনা? তোমরাই বলো?’

মাঠে বসে থাকা কেউ মাথা নাড়ল। কেউ নাড়ল না। অনিমেষ স্যার বিল্টুর দিকে নরম গলায় বললেন, মন খারাপ কোরো না বিল্টু। আজ না বুঝলেও একদিন তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারবে যে আমি তোমার ভালই চেয়েছিলাম। সবদিকে ভাল পারফরমেন্স দেখিয়েও তুমি যাতে শুধু ক্যাচের জনা কখনও পিছিয়ে না যাও, সেটাই আমি চাই। তুমি ক্যাচের দিকে মন দাও। নিয়ম করে প্রাকটিস করো। আমার বিশ্বাস, ভবিষ্যতে তুমি খুব বড় প্লেয়ার হবে। ক্যাচের জন্য কত বড় বড় ম্যাচ হাতছাড়া হয়ে গেছে, সে-গল্প তোমাকে আমি একদিন বলব। সুতরাং সামনের ক’টা দিন তোমায় নিজেকে তৈরি করতে হবে। তোমার গার্জেনকে ডেকেও আমি কথাটা বলব বলে ঠিক করেছি। তুমি অবশ্যই তোমার বাবা-মাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবে।

বিল্টুর বাবা চা শেষ করে বললেন, গেম টিচার ঠিক কথাই বলেছেন। ক্রিকেট খেলায় ক্যাচ একটা ইমপর্ট্যান্ট ব্যাপার। ভেরি ভেরি ইমপর্ট্যান্ট।

বিশাখাদেবী টিভি বন্ধ করে বললেন, আমি অত খেলাটেলা বুঝি না, কিন্তু শুধু একটা জিনিসের জন্য একেবারে টিম থেকে বাদ যাবে? এটাই বা কেমন কথা?

তাপসবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, আঃ, যেটা বোঝো না, সেটা নিয়ে কথা বলো কেন?

‘বলব না! আমার ছেলে ক্লাস টিম থেকে বাদ যাবে, আর আমি চুপ করে থাকব? বিল্টু কি ব্যাট, বল কিছু খারাপ করেছে? নিজের কানেই শুনলে তো। বল না বিল্টু, কত রান করেছিস বাবাকে তার একবার বল। চুপ করে আছিস কেন? বল। ওই যে বাউন্ডারি না কী যেন, সেটাও তো ঝাঁপিয়ে পড়ে আটকেছিস। তবে?

আর ক’টা ক্যাচ মিস করেছে সেটা তো বলছ না। একটা দুটো নয়, পাঁচ-পাঁচখানা। প্রায় গোটা টিমটা আজ তোমার ছেলের হাত ফসকে মাটিতে পড়ে গেছে। সেটাও একবার বলো।

বিল্টু সোফার এক কোণে এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। এবার কথা না বলে পারল না। বলল, ‘সেভেন আজ আমাদের কাছে হেরেছে।’ তাপসবাবু চোখে বিরক্তি নিয়ে বললেন, তোমার গুণে তো হারেনি। বরং তোমার দোষে হারতে অনেক সময় লেগেছে।

এমন সময় বিল্টুর ঠাম্মা ঘরে এসে বললেন এবং আলোচনায় যোগ দিলেন। বললেন, দোষ-গুণ অত জানি না। তবে এটা বুঝতে পারছি, বিল্টুকে টিম থেকে বল দেওয়াটা মোটেই ঠিক হয়নি। আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, ওই ছেলেটার কোনও ধরাধরির ব্যাপার আছে। তাপসবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, কোন ছেলেটা? ঠাম্মা বিল্টুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আহা, বল না, ছেলেটার নাম কী যেন? আরে, তোর জায়গায় যে ছেলেটা ঢুকল। প্রশান্ত না কী যেন? বিল্টু বলল, সুশান্ত। বিশাখাদেবী বললেন, ওই হল। ওই প্রশান্ত না সুশান্ত কেন চান্স পেল? ও কি ভাল ক্যাচ ধরে? বিল্টু রাগের গলায় বলল, আমি জানি না মা। ইচ্ছে হলে তুমি গিয়ে জিজ্ঞেস করো। তাপসবাবু বিশাখাদেবীর দিকে তাকিয়ে চিন্তিত মুখে বললেন, গেম টিচারের সঙ্গে কে দেখা করতে যাবে? আমি যেতে পারি। কিন্তু অফিসে কী বলে ছুটি নেব? ছেলের ক্যাচের জন্য ছুটি চাওয়াটা কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না?

দাদু এসে বিল্টুর পাশে বসলেন। নাতির পিঠে হাত রেখে হাসিমুখে বললেন, তোমরা কি এখনই বাড়াবাড়ি করছ না? সামান্য ক্যাচ নিয়ে এত চইচই কি ঠিক হচ্ছে? বিল্টু পরীক্ষায় কী চমৎকার রেজাল্ট করেছে, সেটা একবার দেখো। তা ছাড়া যা শুনলাম তাতে তো মনে হচ্ছে, ও যথেষ্ট ভালই খেলেছে। ঠাম্মা গলা তুলে বললেন, তুমি একটু চুপ করো তো। তোমাদের যুগ আর এখনকার সময় এক নয়। আজকাল আর শুধু পড়াশোনার কোনও দাম নেই। পড়াশোনার সঙ্গে একটা কিছু চাই। শুনলে না, অণিমার মেয়ে অত বড় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু চাকরির ইন্টারভিউতে গান গাইতে বলল। বেচারি নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন গাইতে গিয়ে স্কেল ভুল করল। ব্যস, চাকরিটা হল না। এখন তো সেই মেয়ে সব ছেড়ে বাড়িতে শুধু হারমোনিয়ম নিয়ে প্যাঁ পোঁ করছে। পরেরবার ইন্টারভিউতে উতরোতে তো হবে। আরে বাবা, এখন চাকরি বাকরির বাজার অন্যরকম হয়ে গেছে। অণিমা তো সেদিন খুব আপশোস করছিল। বলছিল, ইস ছেলেবেলায় যদি মেয়েটার গানের ওপর জোর দিতাম।

দাদু অবাক হয়ে বললেন, ‘তুমি কী বলছ! বিল্টুকে বড় হয়ে একই কাণ্ড করতে হবে? চাকরির ইন্টারভিউতে গিয়ে ক্যাচ ধরতে হবে!’

তাপসবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘হতে পারে বাবা। মা ঠিকই বলেছে, এখন কোনও কিছুই অসম্ভব নয়। পড়াশোনার সঙ্গে আজকাল একটা এক্সট্রা ক্যারিকুলার না-থাকলে কিছু করা যায় না। আমার অফিসের কলিগরা কেউ মেয়েকে নাচ শেখাচ্ছে, ছেলেকে সিন্থেসাইজার কিনে দিয়েছে। এসব তো আর এমনি এমনি করছে না। বিল্টুর তো গানবাজনায় ন্যাক নেই। ক্রিকেটটা ভালবাসে। ভেবেছিলাম, এটাই পারবে। কিন্তু আজকের ঘটনাতে আমি ঘাবড়ে গেছি। লাইন চেঞ্জ করে কিছু করব কিনা ভাবছি।’

ছোটকা ঘরে এসে ঢুকল। বলল, কিচ্ছু করতে হবে না দাদা। ঘরে শুয়ে এতক্ষণ আমি ভাবলাম। ভেবে দেখলাম, যা করবার আমাকেই করতে হবে। কাল থেকেই শুরু করব। তুই একদম চিন্তা করিস না বিল্টু। ক’দিনের মধ্যে তোকে ক্যাচে ম্যাচে একেবারে মাস্টার বানিয়ে ছাড়ব। শুধু ক্যাচের জোরে তুই বড় বড় খেলায় কেমন চান্স পাস দেখবি।

সত্যি সত্যি পরদিন থেকে বিল্টুর ক্যাচ নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বেলা বাড়তে বিশাখাদেবী নিজের মতো ‘অ্যাকশনে’ নামলেন। কাল রাতে তিনি অনেক ভেবেছেন। সবকিছুর যখন প্রাইভেট টিউশন আছে, ক্যাচের থাকবে না কেন? নিশ্চয় আছে। খুঁজতে হবে। তন্নতন্ন করে খুঁজতে হবে। তিনি ছোটবোন অনুসূয়াকে টেলিফোন করলেন। খেলাধুলোর বিষয়ে অনুসূয়ার কোনও ধারণা নেই। কিন্তু টিউশন বিষয়ে তার জ্ঞান খুবই বিস্তৃত। এ ব্যাপারে তার রীতিমতো চর্চা আছে। নিজের ছেলে-মেয়েকে সে সব মিলিয়ে সতেরোরকম টিউশনে ঢুকিয়েছে। মেয়ের ভূগোলের টিউটর যেমন আছে, তেমনি আলাদা করে ম্যাপ পয়েন্টিংয়ের জন্য দিদিমণি আসেন। ছেলে বাংলায় কাঁচা। সেই কাঁচা ভাব দূর করতে ব্যাকরণ, কবিতা, প্রবন্ধর জন্য তিনজন মাস্টার রেখেছে। টেলিফোনে দিদির সমস্যা শুনে সে বলল, কোনও চিন্তা করিস না। ঠিক একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

বিশাখাদেবী উৎসাহী হয়ে বললেন, ক্যাচের জন্য প্রাইভেট টিউটর পাওয়া যাবে বলছিস?

আলবাত পাওয়া যাবে। তবে সব থেকে ভাল হত বিল্টুর স্কুলের কোনও টিচারকে রাখতে পারলে। আমি তো ছেলেমেয়ের বেলায় সায়েন্স সাবজেক্টগুলোতে হাতেনাতে ফল পেয়েছি।

ওদের গেম টিচারকে একবার বলব? উনি কি বাড়িতে এসে ক্যাচ প্র্যাকটিস করাতে রাজি হবেন? ক্যাচ আর সায়েন্স সাবজেক্ট এক নয়।

এক নয় তো কী হয়েছে? অঙ্কে কাঁচা হলে অঙ্কের স্যার, ক্যাচে কাঁচা হলে তেমনি ক্যাচের স্যার। তুই দিদি আজই একবার বিল্টুর স্কুলে যা। গেম টিচারের সঙ্গে কথা বলে আয়। জিনিসটা সিরিয়াস। ফেলে রাখা ঠিক হবে না। আগেকার দিনের মতো আর নেই।

বোনের পরামর্শ বিশাখাদেবীর মনে ধরল। শুনতে যেমনই লাগুক না কেন, পরামর্শের পেছনে যুক্তি আছে। তিনি দেরি করলেন না।

বিশাখাদেবীর কথা শুনে অনিমেষ স্যার থতমত খেয়ে গেলেন। এমন প্রস্তাব তিনি জীবনে পাননি। কেউ পেয়েছে, তাও শোনেননি। ক্যাচের জন্য প্রাইভেট টিউশনি! তিনি বললেন, না না, এসবের কোনও প্রয়োজন নেই। আপনার ছেলে খুবই ভাল খেলে। আমি আসলে চাইছি, ও ক্যাচের ওপর আরও মন দিক। আধুনিক ক্রিকেটে ফিল্ডিংটাই খুব ইমপর্ট্যান্ট হয়ে দাঁড়াচ্ছে। স্বাভাবিক কারণে ক্যাচটাও। পড়াশোনার পাশাপাশি ছেলের খেলাধুলো নিয়ে আপনারা চিন্তা করেছেন জেনে ভাল লাগছে কিন্তু আপনারা এত বেশি চিন্তা করবেন না। খেলতে খেলতে বিল্টু নিজেই ক্যাচের ওপর জোর দেবে। যত বড় হবে তত বেশি করে বুঝতে পারবে ক্যাচ কত জরুরি।

বিশাখাদেবী কাঁচুমাচু মুখে বললেন, ও-কথা শুনব না স্যার। আপনাকে রাজি হতেই হবে। সপ্তাহে একটা দিন। এই ধরুন রোববার সকালে ঘণ্টাখানেকের জন্য আপনি গেলেন। আমাদের বাড়ির কাছেই মাঠ আছে। বিল্টুকে নিয়ে সোজা ওখানে চলে গেলেন। প্লিজ, আপনি না বলবেন না স্যার।

এরপরে অনিমেষ স্যার আর কী বলতে পারেন? ভদ্রমহিলা তো নাছোড়বান্দা। রাজি না-হলে হয়তো সারাদিন স্কুলে বসে থাকবে। বাধ্য হয়ে ঘাড় নাড়তে হল।

ক্যাচের প্রাইভেট টিউটর ঠিক করতে পেরে বিশখাদেবী আনন্দে একশো টাকার সন্দেশ কিনে বাড়ি ফিরলেন।

এদিকে তাপসবাবুও হাত গুটিয়ে বসে নেই। অফিসে গিয়ে খোঁজখবর শুরু করেছেন। কলিগরা বলল, একটা ভাল ক্রিকেট কোচিংয়ে ঢুকিয়ে দিতে হবে। আজকাল গলিতে গলিতে ক্রিকেট খেলা শেখানো হয়। এটা কোনও সমস্যাই হবে না। ক্যাচ তো আলাদা কিছু নয়, ক্রিকেটেরই একটা অংশ। কয়েক মাস ওখানেই গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

অফিসে কাজ করতে করতেই তাপসবাবু কয়েকটা ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্পের নাম জোগাড় করে ফেললেন। শুধু তাই নয়, বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে, মধুসূদন পার্কের ‘ওয়ান ডে’ নামের কোচিংয়ে একেবারে টাকা দিয়ে বিল্টুর নাম লিখিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন। প্রতি শনিবার বিকেলে সাদা জামা, কেড্স পরে চলে আসতে হবে।

বাড়ি ঢোকবার আগে এক হাঁড়ি রসগোল্লা কিনে বসলেন তাপসবাবু। বিল্টুর ভাল রেজাল্ট উপলক্ষে কাল কিছুই হয়নি। আজ বাবা-মা’র জন্য একটু মিষ্টি নিয়ে যাওয়া উচিত।

বিল্টুর ছোটকাই মারাত্মক কাজটা করল। সে নিজেও ভাবতে পারেনি। ইউনিভার্সিটিতে তার এক বন্ধু খবর দিল, যাদবপুর স্টেডিয়ামের কাছে কারা যেন একটা ‘বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরিচালিত ক্রীড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ খুলেছে। যাতায়াতের পথে সে দেখেছে। সেখানে গিয়ে একবার দেখা যেতে পারে।

সত্যি বিশেষজ্ঞ কেন্দ্র। একেবারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতো। এখানে। সাধারণভাবে কোনও খেলার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। খেলার এক একটা দিক নিয়ে শেখানোর ব্যবস্থা রয়েছে। এক-একটা বিভাগের তলায় অনেকগুলো উপবিভাগ। যেমন ফুটবল শেখানো হবে না, কিন্তু কেউ যদি হেড, পেনাল্টি শট, কর্নার কিক আলাদা আলাদা করে শিখতে চায়, তা হলে ভরতি হতে পারে। ক্রিকেটেও তেমন। ফিল্ডিং বিভাগে রয়েছে বাউন্ডারি আটকানো, রান আউট করা, ক্যাচ ধরা সহ বিভিন্ন উপবিভাগ। শেখবার জন্য আলাদা আলাদা ব্যবস্থা।

ছোটকা একেবারে অভিভূত হয়ে পড়ল। কিন্তু অভিভূত হয়ে কোনও লাভ হল না। কারণ ক্যাচ সেকশনে কোনও জায়গা ফাঁকা নেই। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ম্যানেজার ভদ্রলোক বললেন, ক্যাচে ভিড় বড্ড বেশি। এই সেশনে প্রায় সাড়ে সাতশো ক্যান্ডিডেট হয়ে গেছে। আপনি বরং নেক্সট সেশনে চেষ্টা করবেন। ছোটকার তো মাথায় হাত। বলল, সাড়ে সাতশো! একটা সিটও হবে না? ম্যানেজার ভদ্রলোক হেসে বললেন, আসলে কয়েকদিন হল আমাদের এখানে নতুন দু’জন ট্রেনার জয়েন করেছেন। দু’জনেই মারাত্মক। একজন হামাগুড়ি দিয়ে ক্যাচ ধরা শেখাচ্ছেন, অন্যজন শেখাচ্ছেন উড়ে গিয়ে ধরা। এটা জানাজানির পর থেকেই ভিড় বেড়ে গেছে। এরপর ম্যানেজার ভদ্রলোক একটুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবলেন। তারপর গলা নামিয়ে বললেন, ক’টা ভি আই পি কোটা আছে। যদি কোনও ভি আই পি ধরতে পারেন, একটা কিছু হতে পারে।

ক্যাচ শিখতে ভি আই পি ধরতে হবে! এখন ভি আই পি পাওয়া যাবে কোথা থেকে? কোনও বড় লোককেই তো বিল্টুর ছোটকা চেনে না। তা হলে কী হবে? এত বড় একটা সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে?

না, হাতছাড়া হল না। ছোটকার বন্ধু টেলিফোনে তার এক মামাকে তখনই ধরে ফেলল। ভদ্রলোক একজন মস্ত বড় অফিসার। তিনি ভরতির ব্যবস্থা করে দিলেন। বিল্টুর সময় হল বৃহস্পতিবার বিকেল তিনটে থেকে সাড়ে তিনটে।

এতসব সেরে ছোটকার বাড়ি ফিরতে সন্ধে হয়ে গেল। কাল ছিল মনখারাপের সন্ধে, আজ মন খুব ভাল। বিল্টুকে আর কে আটকায়? বাড়ি ঢুকে কীভাবে খবরটা দেবে? একটা কায়দা করতে হবে। মিষ্টি কিনলে কেমন হয়? ভাল খবরের সঙ্গে মিষ্টি লাগে। এক কিলো চমচম কিনে বসল। বিল্টুটা চমচম পেলে পাগল হয়ে যায়।

সন্দেশ, রসগোল্লা, চমচমে বাড়ি একেবারে মিষ্টিময়। তবু আলোচনায় যথেষ্ট ঝাল এবং তেতো ভাব এসে গেল। সেটাই স্বাভাবিক। বিল্টুর ক্যাচ শিক্ষায় তা হলে কোন ব্যবস্থা থাকবে? মা, বাবা না ছোটকার? তিনজনেই চায়, তারটা থাকুক। বিল্টু দেখল, এ বিষয়ে কেউই তার মতামত জানতে আগ্রহী নয়। সে মন দিয়ে চমচম খেতে শুরু করল।

শেষ পর্যন্ত দাদুর রায়ই মেনে নেওয়া হল। তিনি বললেন ক্যাচ যখন এত গুরুত্বপূর্ণ তা হলে সব ক’টা ব্যবস্থা থাকুক। বেশি শেখায় তো কোনও দোষ নেই।

রবিবার থেকে চালু হয়ে গেল ক্যাচ টিউশন। অনিমেষ স্যার এসে গেলেন সকাল ন’টায়। প্রথমে বিশাখাদেবী ভেবেছিলেন মাঠে গিয়ে প্রশিক্ষণ চলবে। কিন্তু সেই পরিকল্পনা তিনি বাতিল করলেন। এতে অন্যরা দেখে ফেলতে পারে। তারপর তারাও হয়ত নিজেদের ছেলের জন্য এই ব্যবস্থা চালু করে দেবে। এটা করতে দেওয়া ঠিক হবে না। তাই মাঠের বদলে বারান্দায় প্রশিক্ষণ শুরু হল। বিশাখাদেবী প্রশিক্ষণের সময় মোড়া পেতে ঠায় বসে থাকলেন। অনসূয়া সেরকমই বলে দিয়েছে। বলেছে, শুধু প্রাইভেট টিউটরের হাতে ছেলেমেয়েরা মানুষ হয় না। নজর রাখতে হয়। তুইও রাখবি দিদি।

শনিবার ছেলেকে ‘ওয়ান ডে’ কোচিংয়ে নিয়ে যান তাপসবাবু। বৃহস্পতিবার বিশেষ ক্যাচ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বিল্টু যায় ছোটকার সঙ্গে। একমাস হয়ে গেল এই কাণ্ড চলছে। বাড়ির সকলেই খুশি। মা বলছেন, আর চিন্তা নেই। বিল্টু আবার ক্লাস টিমে চান্স পেয়ে যাবে। আমি ওর স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি। উনি বিল্টুর উন্নতিতে খুবই খুশি। বাবা বললেন, শুধু ক্লাস টিমে নয়, আমার তো মনে হয় ও এবার স্কুল টিমে ঢুকে পড়বে। ওয়ান ডে-র কোচিং ম্যানেজার সেরকমই আশা করছেন। ছোটকা ঠোঁটের ফাঁকে হেসে বলল, দূর, তোমাদের ক্লাস টিম আর স্কুল টিম। কিছুদিনের মধ্যে আমার ভাইপো একজন ক্যাচ ওস্তাদ হয়ে যাবে। কত বড় বড় চান্স যে ও তখন পাবে, তোমরা কল্পনাও করতে পারছ না। দাদু হাসিমুখে বললেন, এটা কিন্তু কন্টিনিউ করতে হবে। অনেক সময় ছোটবেলায় শেখানো জিনিস বড় হয়ে মানুষ ভুলে যায়। ঠাম্মা চোখ বড় বড় করে বললেন, বালাই ষাট, ভুলবে কেন? ইন্টারভিউতে সুর ভুলে অণিমার মেয়ের কী কেলেঙ্কারি হয়েছিল মনে নেই?

ক্যাচ শিখতে বিল্টুর ভালই লাগছে। ভাল তো লাগবেই। ক্লাস টিম, স্কুল টিমে খেলবে এটা তো কম ব্যাপার নয়। শুধু কোনও কোনও দিন রাতে ক্যাচ নিয়ে দুঃস্বপ্নে তার ঘুম ভেঙে যায়। ভয় করে। দিনেরবেলাতেও ভয়ে ভয়ে থাকে। মনে হয়, এই বুঝি তার দিকে কোনও ক্যাচ উড়ে আসছে।

ফসকে যাবে না তো?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *