কোহিনুর উদ্ধার

কোহিনুর উদ্ধার

হাটখোলার ব্লাড ব্যাঙ্কের অফিস থেকে বেরোনোর মুখে ডি আশিস বলল, ”আমাদের কথা একটু মাথায় রেখো কালকেতুদা। দেখো, যদি বাচ্চাদের জন্য ম্যাচটা করে দিতে পারো।”

মনটা এমনিতেই ভার হয়ে ছিল। তবু হাঁটতে হাঁটতে বললাম, ”তুই কোনও চিন্তা করিস না। নিশ্চয়ই করব।”

ডি আশিসকে আমি অনেক দিন থেকে চিনি। বেনেটোলার সারদাচরণ স্কুলে আমি যখন পড়তাম, তখন ওর দাদা আমার ক্লাসমেট ছিল। পুরো নাম আশিস দত্ত। কেন যে ডি আশিস লেখে, কোনওদিন তা জিজ্ঞেস করিনি। ছেলেটা খুবই ভাল। সমাজসেবা করে। যে—কোনও ভাল কাজে চোখ—কান বুজে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

গত বছর পয়লা অগস্ট ওদের ব্লাড ব্যাঙ্কের একটা অনুষ্ঠানে আমাকে প্রধান অতিথি করে নিয়ে যাওয়ার জন্য আশিস খুব ধরাধরি করেছিল। কী একটা কাজ পড়ে যাওয়ায় সেদিন আমি যেতে পারিনি। এবার হুমকি দিয়েই রেখেছিল, যদি ওদের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে না যাই, তা হলে আমার সঙ্গে আর সম্পর্কই রাখবে না। আশিসকে আমি একটু বেশিই স্নেহ করি। মাঝে মাঝে খবরের জন্যও ওকে দরকার হয়। কলকাতায় যত বেসরকারি সমাজসেবী প্রতিষ্ঠান আছে, সবার সঙ্গে ওর যোগাযোগ রয়েছে। তাই অনেক খবর ওর কাছে আগে পৌঁছে যায়। মাঝে—মধ্যে ও আমাকে চমকে দেওয়ার মতো খবর দেয়।

মাসখানেক আগে বেশ রাতে একটা খবর দিয়ে আশিস আমার ইজ্জত বাঁচিয়েছিল। মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের সাহায্য করার জন্য গোপনে কলকাতায় এসেছিলেন বিশ্বখ্যাত টেনিস প্লেয়ার ম্যাটস ভিল্যান্ডার। আমরা কেউ তা জানতাম না। সেদিন রাত দশটার সময় বাড়িতে হঠাৎ আশিসের ফোন, ”কালকেতুদা, ম্যাটস ভিল্যান্ডারকে যদি ইন্টারভিউ করতে চাও, তা হলে এখুনি লোয়ার সার্কুলার রোডে চলে এসো। কোনও কাগজের লোক এখনও জানে না, ভিল্যান্ডার কলকাতায়।”

জিজ্ঞেস করেছিলাম, ”কোথা থেকে বলছিস?”

”চাইল্ড কেয়ার থেকে। ভিল্যান্ডার এখন আমার পাশে বসে। ঝালমুড়ি খেয়ে হুসহাস করছে। তুমি চলে এসো। কাল কিন্তু আর ধরতে পারবে না। মুম্বই চলে যাবে।”

আধঘণ্টার মধ্যে চাইল্ড কেয়ারে পৌঁছে চমৎকার একটা ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম ভিল্যান্ডারের। অত বড় প্লোয়ার, কিন্তু কোনও দম্ভ নেই। দিব্যি প্রতিবন্ধী শিশুদের সঙ্গে খেলছেন, কোলে তুলে আদর করছেন। আসলে চাইল্ড কেয়ারের কর্তারা সুইডিশ সরকারের কাছে অর্থ সাহায্য চেয়েছিলেন। সুইডিশ সরকার তাই ভিল্যান্ডারকে প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে পাঠিয়েছিলেন, সত্যি সত্যিই চাইল্ড কেয়ার কলকাতায় প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করে কি না।

পরদিন আমি ‘এক্সক্লুসিভ’ করেছিলাম খবরটা। কলকাতার আর কোনও কাগজে তা বেরোয়নি। সেই কৃতজ্ঞতাবোধটা তো ছিলই। তাই এবার ব্লাড ব্যাঙ্কের অনুষ্ঠানে আশিসকে নিরাশ করতে চাইনি। অন্য কাজ ফেলেও ব্লাড ব্যাঙ্কের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে আজ হাজির ছিলাম। কিন্তু থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের দেখে মন খুব খারাপ হয়ে গেল। কারও বয়স পাঁচ, কারও সাত। অন্য শিশুদের মতো খেলছে, ঘুরছে—ফিরছে। দেখে মনে হওয়ার উপায় নেই অমন কঠিন রোগ শরীরে। কেউ বেশিদিন বাঁচবে না। ওদের বাবা—মায়েরাও তা জানেন। তাই তাঁদের অবস্থা আরও সঙ্গিন। তাঁরা চোখ—মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

থ্যালাসেমিয়া রোগ সম্পর্কে আগে আমার কোনও ধারণা ছিল না। আশিসের অনুষ্ঠানে না এলে জানতেও পারতাম না। আক্রান্তদের বাঁচাতে হলে রক্ত চাই। প্রচুর টাকা—পয়সাও। বক্তৃতা দেওয়ার সময় আশিস বলে বসল, ”প্রখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক কালকেতু নন্দী আমাদের এখানে আছেন। আমি তাঁকে রিকোয়েস্ট করব, শিশুদের জন্য কিছু করুন।” সঙ্গে—সঙ্গে ঠিক করে নিয়েছিলাম, কিছু একটা করবই। যখন আমার বলার পালা এল তখন বললাম, ”থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য আমি একটা ম্যাচ অর্গানাইজ করে দেব। মোহনবাগান—ইস্টবেঙ্গলের মধ্যে। ওই ম্যাচ থেকে যা টাকা উঠবে, সব পাবে হাটখোলা ব্লাড ব্যাঙ্ক। ম্যাচটা কবে করব, তা পরে আশিসকে জানিয়ে দেব।”

আমার দৃঢ় বিশ্বাস থ্যালাসেমিয়া শিশুদের কথা যদি বলি, তা হলে মোহনবাগান—ইস্টবেঙ্গলের কর্তারা গররাজি হবেন না। ম্যাচটা খেলতে নিশ্চয় রাজি হয়ে যাবেন। ম্যাচের আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য কয়েকজন গায়ক আর ফিল্ম আর্টিস্টকেও বলতে হবে। ইন্দ্রনীল, সৈকতরা আমার বন্ধু। বললে সেদিন মাঠে ওরা থাকবেই। ফিল্ম লাইনের লোকজনকে নিয়ে আসার জন্য ভার দেব বিপ্লব চ্যাটার্জিকে। কলকাতায় বড় কোনও খেলা থাকলে মাঝে মধ্যে ও লোক পাঠিয়ে আমার কাছ থেকে টিকিট নিয়ে যায়। এমন খেলাপাগল মানুষ। ও অবশ্যই আমাকে সাহায্য করবে। সব মিলিয়ে একটা ভাল কারণে দিনকয়েক হইচই বাধিয়ে দেওয়া যাবে।

অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমাকে তুলে দিতে বড় রাস্তা পর্যন্ত এল আশিস। গলির ভেতর গাড়ি রাখার জায়গা নেই। তাই বড় রাস্তায় গাড়িটা রাখতে হয়েছে। আশিসের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগোচ্ছি। হঠাৎ পিছন থেকে কে একজন ডাকল, ”কালকেতু, ভাই একটু দাঁড়াবি?”

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি আমারই বয়সী একজন দ্রুত হেঁটে আসছে। একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছে। পরনে ময়লা শার্ট, পাজামা। চুল উসকোখুসকো। চোখে মোটা পাওয়ারের চশমা। কোলে বছর পাঁচেকের মেয়ে। কাছে এসে লোকটা হাঁফাতে লাগল। ঠিক চিনতে পারলাম না। আমাকে অবাক হয়ে তাকাতে দেখে বলল, ”কী রে, চিনতে পারলি না। না চেনাটাই স্বাভাবিক। বছর বারো—তেরো পরে দেখা। আমাকে এখন কাছের লোকরাই চিনতে পারে না।”

মুখে মলিন হাসি। মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে লোকটা আমাকে বলল, ”আমি পরি…পরিতোষ। সারদাচরণে তোর সঙ্গেই পড়তাম। এবার নিশ্চয়ই মনে পড়ছে।”

সঙ্গে—সঙ্গে মনে পড়ে গেল। পরিতোষ শীল। একটা সময় দুর্দান্ত ফুটবল খেলত। স্কুল লাইফে ওর সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব ছিল আমার। তাড়াতাড়ি বললাম, ”চিনতে পারব না মানে? কিন্তু তোর এ কী ছিরি হয়েছে চেহারার?”

চোখ থেকে চশমাটা খুলে পরি বলল, ”আমি চলাফেরা করছি বটে। আসলে বেঁচে নেই, বুঝলি। পাঁচ বছর আগেই মরে গেছি।”

ওর কথায় এমন এক ধরনের বিষণ্ণতা, শুনে বুকটা মুচড়ে উঠল। বললাম, ”তুই কি এখনও ঢাকাপট্টিতে থাকিস?”

”না রে। পৈতৃক বাড়ির ভাগটা আর রাখতে পারলাম না। বিক্রি করে দিয়েছি।” রুমাল দিয়ে চশমার কাচ মুছে, মেয়েকে দেখিয়ে পরি বলল, ”জন্মের পরই ধরা পড়ল মেয়েটা থ্যালাসেমিয়া রোগী। ওকে বাঁচিয়ে রাখার রসদ জোগাতে গিয়েই আমি শেষ। এই আশিসবাবুরা না থাকলে হয়তো অ্যাদ্দিন মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম না। যাক, আমার কথা ছাড়, তোকে অনেকদিন পর দেখলাম। কেমন আছিস, বল। তোর ফুটবল রিপোর্টগুলো পড়ি। বেশ ভাল লাগে। তুই এখানে আসবি আগেই শুনেছিলাম। তাই মেয়েকে দেখানোর জন্য আজ এলাম। তোর জন্য আমার খুব গর্ব হয় রে কালকেতু।”

পরির কথাগুলো তিরের মতো এসে বিঁধল। স্কুল লাইফে ঠিক এই কথাটাই আমি বলতাম ওকে, ”তুই আমাদের গর্ব।” শুধু আমি নই, হেডমাস্টারমশাই থেকে শুরু করে অনেকেই তখন ওর সম্পর্কে এই কথা বলত। দিল্লিতে সুব্রত মুখার্জি কাপে দশ গোল করে পরি আমাদের স্কুলকে চ্যাম্পিয়ান করেছিল। ফিরে আসার পর ওকে নিয়ে কত হইচই। ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময়ই ও ময়দানে ফার্স্ট ডিভিশনের খিদিরপুর ক্লাবে খেলতে শুরু করল। আমরা সবাই ধরে নিয়েছিলাম, পরি একদিন না একদিন ইস্টবেঙ্গল—মোহনবাগানে খেলবে। স্কুল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর পরির সঙ্গে আর কখনও আমার দেখা হয়নি। ওকে দেখে এখন মনে হচ্ছে, ভাল নেই।

বললাম, ”তুই যাবি কোথায়? চল, তোকে নামিয়ে দিয়ে আসি।”

”আমি এখন থাকি বরানগরে। তুই তো অফিসে যাবি। তোর সঙ্গে গিয়ে আমার লাভ নেই।” কথাটা বলেই মেয়ের হাত ধরল পরি। তারপর মেয়েকে বলল, ”এই আঙ্কলটাকে চিনতে পারছিস? সেই যে, টিভিতে খেলার সময় একদিন তোকে দেখালাম। মনে আছে, বলেছিলাম, আমার সঙ্গে পড়ত। আঙ্কলকে গুড আফটারনুন বলবি না?”

মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ”গুড আফটারনুন আঙ্কল।”

ওই মুখটা আমার বুকে আঁকা হয়ে গেল। এত সুন্দর একটা মেয়ে, বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখা যাবে না? এদের জন্য চেষ্টা করতে হবে। করতেই হবে। পরিকে বললাম, ”আয় না একদিন আমাদের অফিসে।”

”যাব একদিন। তবে সময় পাই না রে। মেয়ের পিছনেই সারাটা দিন কেটে যায় আমাদের। যদ্দিন পারি আগলে রাখি। চলি রে।”

বলেই হাঁটতে শুরু করল পরি। একটু খোঁড়াতে খোঁড়াতে হাঁটছে। বোধহয় খেলোয়াড় জীবনে কোনও সময় চোট পেয়েছিল। এখন ভোগাচ্ছে। মেয়েটা ওর কোলে ওঠার জন্য আবদার ধরল। বাধ্য হয়েই পরি ওকে কোলে তুলে নিল। স্কুল লাইফে ও কারও সাহায্য নিত না। খুব জেদি টাইপের ছেলে ছিল। এখন মেয়ের অসুখের জন্য একদম ভেঙে পড়েছে। গাড়িতে উঠে স্টার্ট দেওয়ার সময় পরির একটা কথা কানে বাজতে লাগল, ‘যদ্দিন পারি, মেয়েটাকে আগলে রাখি।

অফিসে পৌঁছতেই কৌশিক বলল, ”কালকেতুদা, এক ভদ্রলোক অনেকক্ষণ ধরে আপনার জন্য রিসেপশনে বসে আছেন। একটু কথা বলে নিন।”

খেলার জগতের কোনও লোক বোধহয়। বললাম, ”কে রে?”

”নাম বললেন, শানু দত্ত। জার্মানিতে থাকেন।”

শানু দত্ত নামে কাউকে চট করে মনে পড়ল না। কে হতে পারেন? বছর কয়েক আগে হেহলবোর্ন থেকে আমার বন্ধু অরূপ ব্যানার্জি একজনকে আমার কাছে পাঠিয়েছিল। নিমপাতার গুঁড়ো কলকাতার কোথায় পাওয়া যায় তা জানার জন্য। হয়তো অরূপই ফের পাঠিয়েছে এই শানু দত্তকে কোনও কারণে। তাই কৌশিককে বললাম, ”রিসেপশন থেকে ডেকে নে তো লোকটাকে। এখানে বসেই কথা সেরে নেওয়া যাক।”

খবরের কাগজে দুপুরের দিকে এই সময়টায় কাজ কম। মানসের আজ ছুটি। সুপ্রিয় আর রূপায়ণ কলকাতার বাইরে গেছে। ওদের রিপোর্ট আসার কথা সন্ধের দিকে। কোনও দরকারে কোনও লোক অফিসে আসতে চাইলে তাই তাকে এই সময়টায় আসতে বলি। নিশ্চিন্তে কথা বলে নেওয়া যায়। বিশেষ কোনও লেখা থাকলেও কম্পিউটারের সামনে বসে যাওয়ারও এটাই সেরা সময়। খাতা খুলে চট করে দেখে নিলাম, আজ কভার করার কী কী ইভেন্ট কলকাতায় রয়েছে। সাড়ে চারটের সময় একটা প্রেস কনফারেন্স আছে বেঙ্গল ওলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের। ওখানে যাবে কৌশিক। না, আর কোনও বিশেষ কিছু নেই।

”বসতে পারি?”

ভরাট গলা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। ইনিই তা হলে শানু দত্ত। বয়স সত্তরের ওপরে। কিন্তু দেখে তা বোঝার উপায় নেই। মেদহীন সুন্দর স্বাস্থ্য। গায়ের রং বেশ ফরসা। চোখে সোনালি রিমের চশমা। পরনে পাঞ্জাবি আর পাজামা। ভদ্রলোকের চোখ—মুখে বেশ আভিজাত্যের ছাপ। তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ”বসুন।”

”আমি শানু দত্ত। আপনার কাছে একটা প্রয়োজনে এসেছি।”

”বলুন।”

”জানি আপনি ব্যস্ত মানুষ। তবুও একটা রিকোয়েস্ট করছি। আপনি কি ঘণ্টাখানেকের জন্য একবার বেরোতে পারবেন আমার সঙ্গে?”

”এখন? কোথায়?”

”বেশি দূরে নয়। এই চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউয়ের ওপরই….কফি হাউসে। এই চাঁদনি চক মেট্রো স্টেশনের কাছেই। যদি আপনার অসুবিধে না হয়…”

এই সবে বাইরে থেকে অফিসে এসে ঢুকলাম। সাধারণত আর বেরোই না। কিন্তু শানু দত্ত এমনভাবে বললেন যে, সরাসরি আমি না করতে পারলাম না। বললাম, ”যা বলতে চান এখানে বলা সম্ভব না?”

”সম্ভব। কিন্তু আমার সঙ্গে আরও দুই বন্ধু রয়েছেন। তাঁরা ওখানে বসে অপেক্ষা করছেন। তাঁরাও আমার বয়সী। চলুন না, বেশি দূরে তো নয়।”

বললাম, ”চলুন তা হলে। কিন্তু বেশিক্ষণ আটকে রাখবেন না।”

কৌশিককে বলে বেরিয়ে এলাম। আমাদের অফিস থেকে ইন্ডিয়ান কফি হাউস দু’তিন মিনিটের পথ। পাশ দিয়ে বহুবার যাতায়াত করেছি। কিন্তু কোনওদিন ভেতরে ঢুকিনি। কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসের মতো অত বড় নয়। তবু ভেতরের হলঘরটা দেখে একটু অবাকই হলাম। শানু দত্তের সঙ্গে কোণের দিকে একটা টেবিলে বসতেই অন্য টেবিল থেকে দুই ভদ্রলোক উঠে এলেন। একজন গোলগাল, টাকমাথা। অন্যজন চোখে কালো চশমা। গায়ের রং শ্যামলা।

টাকমাথা ভদ্রলোককে দেখিয়ে শানু দত্ত বললেন, ”ইনি প্রিয়ব্রত চাকলাদার। কানাডায় থাকেন। ভিক্টোরিয়ায় ব্যবসা করেন। আমাদের বিশিষ্ট বন্ধু। আর ইনি অবনীমোহন মল্লিক। গত তিরিশ বছর সুইডেনে আছেন। গোথেনবার্গে। ওখানকার এক জাহাজ কোম্পানিতে বড় চাকরি করেন।”

দু’জনেই হাত তুলে আমার সঙ্গে নমস্কার বিনিময় করলেন। প্রিয়ব্রতবাবু চেয়ারে বসে বললেন, ”শানুদা কি নিজের পরিচয়টা ঠিকভাবে দিয়েছে? না, আমাকে দিতে হবে?”

হেসে বললাম, ”না, উনি শুধু নিজের নামটি ছাড়া আর কিছু বলেননি।”

”জানতাম, বলবেন না। শানু দত্ত ইজ আ গ্রেটম্যান। আমাদের সবার দাদা। গার্জিয়ান, ফ্রেন্ড, গাইড—হোয়াট নট। সারা বিশ্বের প্রবাসী বাঙালিরা এঁকে চেনেন। ফ্রম টোকিয়ো টু টরন্টো এভরিহোয়ার।”

শানু দত্ত চুপ করিয়ে দিলেন, ”প্রিয়, মিঃ নন্দী খুব বিজি ম্যান। যা বলার সংক্ষেপে আগে বলে নেওয়া যাক।”

এই সময় পাশ থেকে অবনীমোহনবাবু বললেন, ”যা বলার আপনিই বলুন মিঃ দত্ত।”

তাঁকে সমর্থন করলেন প্রিয়ব্রতবাবু, ”হ্যাঁ, সেটাই ভাল।”

শানু দত্ত কিছু বলার আগেই সাদা পোশাক পরা একজন বেয়ারা এসে আমাকে বলল, ”সার, আপনি এখানে?”

চেনা মুখ। ময়দানে প্রায়ই দেখি ছেলেটাকে। ফুটবলপাগলদের একজন। বোধহয় প্রেসবক্সে দেখে থাকব। বললাম, ”ভাল করে চার কাপ কফি নিয়ে এসো তো এখানে।”

”আনছি সার। একটা কথা ছিল। ভাইচুং নাকি জাপানে খেলতে চলে যাচ্ছে?”

ছেলেটার চোখ—মুখে উদ্বেগ। কফি হাউসে সামান্য চাকরি করে, কিন্তু এদের ক্লাবপ্রীতির কোনও তুলনা নেই। হেসে বললাম, ”এখনও পাকা কিছু হয়নি।”

ছেলেটার মুখ থেকে উদ্বেগের ছায়া সরে গেল। প্রশ্ন করল, ”ন্যাশনাল লিগে ওকে পাওয়া যাবে তো সার?”

ওকে আশ্বস্ত করার জন্য বললাম, ”মনে হয়।”

কথাটা শুনেই ছেলেটা খুশিমনে চলে গেল। শানু দত্তরা অবাক হয়ে আমাদের কথা শুনছিলেন। বললেন, ”ভাইচুং কে?”

”এখানকার এক স্টার ফুটবলার।”

”ও।” শানু দত্ত বললেন, ”আপনিও তো মশাই দেখছি খুব পপুলার।”

”সেরকম কিছু নয়। যাই হোক, কাজের কথা বলুন।”

শানু দত্ত বাকি দু’জনের দিকে এক পলক তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন, ”আমরা এই তিনজন তিন মুলুকে থাকি। কিন্তু তিনজনেরই শেকড় ভারতবর্ষে। আমরা একটা মিশন নিয়ে এবার দেশে এসেছি। আর সেজন্যই আপনাকে আমাদের দরকার।”

”কী ব্যাপার বলুন।”

”বলছি। তার আগে একটা জিনিস আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি। যে কাজের ভার আপনাকে আমরা দিতে চাই, সেটা যদি আপনি না করতে চান, তা হলে অন্য কোথাও ডাইভালজ করবেন না। এই কথাটা আপনাকে দিতে হবে।”

”আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমরা রিপোর্টার। আমাদের ডান হাত জানতে পারে না, বাঁ হাত কী করছে।”

প্রিয়ব্রতবাবু বললেন, ”বাহ, কথাটা তো আপনি বেশ ভাল বলেছেন।”

শানু দত্ত বললেন, ”একটা কথা প্রথমেই বলে রাখছি। আমরা তিনজনেই দেশ ছাড়ার আগে ছিলাম স্বাধীনতাসংগ্রামী। আমি তিন বছর জেল খেটেও গেছি। এই যে অবনীমোহনকে দেখছেন, ইংরেজ আমলে পুলিশের অত্যাচারে এর একটা চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। এ ছিল গান্ধীজির শিষ্য। প্রিয়ব্রত আমাদের থেকে কয়েক বছরের ছোট। শহিদ ক্ষুদিরামের দেশের ছেলে। একটা সময় মেদিনীপুর শহরে ওর নাম শুনলে সাধারণ পুলিশ থেকে ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত সবাই কাঁপত। ছেচল্লিশ সালে তলপেটে গুলি খেয়ে ও মারাই যাচ্ছিল। আশ্চর্যরকমভাবে বেঁচে যায়। নিজেদের সম্পর্কে অত ডিটেলে বলার দরকার নেই। তবে জেনে রাখুন, এই দেশকে স্বাধীন করার জন্য আমাদেরও সামান্য অবদান ছিল।”

শানু দত্ত কথা বলছেন অত্যন্ত মার্জিত ভঙ্গিতে। দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার জন্যই বোধহয় অল্প কথায় অনেক কিছু বলে দেওয়ার স্টাইলটা রপ্ত করেছেন। উনি নিজে কী করেন তা কিন্তু বলেননি। নিশ্চয় বিশেষ কোনও পেশায় আছেন। সম্ভবত দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই কোনও কারণে বিদেশে চলে যান। তারপর আর ফেরেননি। সঙ্গে—সঙ্গে মনে একটা প্রশ্ন জাগল, যাঁর এত দেশপ্রীতি, তিনি দেশ ছেড়ে চলে যাবেন কেন? অন্য স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সঙ্গে তো শানু দত্তকে মেলানো যাচ্ছে না। যাই হোক, ভদ্রলোক কী বলতে চান আগে শুনি।

একটা ট্রে—তে করে সেই ফুটবলপাগল ছেলেটা বড় পটে কফি এনে টেবলের ওপর রাখল। একটু পর গরম কফিতে চুমুক দিয়ে ফের কথা শুরু করলেন শানু দত্ত, ”বিদেশে আমরা থাকি বটে, কিন্তু দেশের খোঁজখবর রাখি না, এটা কিন্তু ভাববেন না। প্রতি বছর আমরা, প্রবাসী বাঙালিরা কোনও—না— কোনও একটা শহরে জড়ো হয়ে সাংস্কৃতিক সম্মেলন করি। সেখানে দেশের কল্যাণ কামনায় নানারকম পরিকল্পনাও নিই। এবার এপ্রিল মাসে শিকাগোতে সবাই মিলে হাজির হয়েছিলাম। সেখানে আমরা একটা প্রস্তাব নিই। স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বছরে দেশকে একটা কিছু দিতে হবে। এমন একটা কিছু যা নিয়ে লোকে আলোচনা করে। সেই ব্যাপারেই আমরা আপনার দ্বারস্থ হয়েছি।”

টানা এতক্ষণ কথা বলে শানু এবার কফিতে চুমুক দিলেন। মনে মনে অঙ্ক কষতে শুরু করলাম। দেশকে ওঁরা কী দিতে চান যার জন্য আমার দ্বারস্থ হতে হবে? সানগ্লাস পরা অবনীমোহনবাবু আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে রয়েছেন। তবে বুঝতে পারছি না আমাকে দেখছেন কি না। প্রিয়ব্রতবাবু খুব গম্ভীর মুখে বসে। মোটেই এই গাম্ভীর্য ভদ্রালোককে মানাচ্ছে না।

শানু দত্ত ফের বলতে শুরু করলেন, ”আমরা তিনজন এই দিন সাতেক আগে কলকাতায় এসেছি। খোঁজ করে দেখলাম, আপনিই ফিটেস্ট। পারলে একমাত্র আপনিই পারবেন।”

জিজ্ঞেস করলাম, ”কাজটা কী?”

”সেটা বলার আগে আর একটা কথা জানিয়ে রাখি, এই কাজটার জন্য আপনাকে পারিশ্রমিক দেওয়া হবে। খুব খারাপ অঙ্কের নয় সেটা। ওয়ান মিলিয়ন রুপিজ। অর্থাৎ কি না দশ লাখ টাকা। তবে পুরো ব্যাপারটা নিছক টাকার অঙ্কে বিচার করবেন না। এর সঙ্গে মিশে আছে দেশের প্রতি কর্তব্য, ভালবাসা, এটসেটরা…এটসেটরা।”

টাকার অঙ্কটা শুনে আমার মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। শানু দত্ত বলছেন কী? দ—শ—লা—খ টা—কা, কী এমন সেই কাজ? প্রশ্নটা মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে যেতেই শানু দত্ত বললেন, ”কোহিনুর উদ্ধার।”

বুঝতে না পেরে আমি অবাক হয়ে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

গত কয়েক বছর ধরে শখের গোয়েন্দাগিরি করছি বটে, কিন্তু শানু দত্তেরা আমাকে যে কাজের ভার দিতে চাইছেন, তা পারতে পারেন জেমস বন্ড মার্কা কোনও এজেন্ট। কোহিনুর….মানে সেই বিশ্বখ্যাত হিরে…তা উদ্ধার করে আনতে হবে আমাকে। কথাটা প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি। পরে জানতে পারলাম, প্রস্তাবটা ওঁরা আমাকে সিরিয়াসলি দিচ্ছেন। কোহিনুর সম্পর্কে আমার খুব বেশি ধারণা নেই। শুধু জানি, ইংরেজরা মহামূল্যবান এই হিরেটা নিজেদের দেশে নিয়ে গিয়ে উপহার দিয়েছিল মহারানি ভিক্টোরিয়াকে। সেটা নিশ্চয়ই এমন জায়গায় রেখেছে, আমার মতো লোকের পক্ষে সেখানে পৌঁছনো অসাধ্য। উদ্ধার করে আনা তো দূরের কথা।

শানু দত্তকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলাম, ”মশাই, আমার পক্ষে এই দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়।” কিন্তু ওঁরা তিন বন্ধুই নাছোড়বান্দা। বারবারই বলতে লাগলেন, ”আপনি আগে রাজি তো হোন, তারপর অন্য সব ব্যবস্থা করা যাবে।”

শেষ পর্যন্ত কফি হাউস থেকে উঠে এসেছিলাম এই বলে, ”ঠিক আছে, ডিসিশন নেওয়ার জন্য আমাকে দু’তিনদিন ভাববার সময় দিন।”

ওই সময়ই অবনীমোহনবাবু বলে ওঠেন, ”হাতে খুব বেশি দিন সময় নেই। কালকেতুবাবু আমাদের খুব ইচ্ছে, পনেরোই অগস্ট যখন দিল্লির লালকেল্লায় মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা দেবেন, সেই সময় আমরা তিনজন গিয়ে তাঁর হাতে কোহিনুর তুলে দেব।”

কথাটা শুনে তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল, তিন প্রবাসীর মাথা সুস্থ আছে কি না, তা নিয়ে। ওঁদের সঙ্গে কথা বলার মাঝে দু’দিন কেটে গেছে। আজই ফোন করে শানু দত্ত জানতে চাইবেন, আমার সিদ্ধান্ত। সত্যি বলতে কি, মাঝের দু’দিন অফিসের কাজে এমন ব্যস্ত ছিলাম কোহিনুর নিয়ে ভাবার সময়ই পাইনি। ওঁদের না বলে দিতে মন চাইছে না। কিন্তু কাজটা এমন কঠিন, একা করাও সম্ভব না। দেশের মাটিতে বসে রামপলের অন্তর্ধান রহস্য বা মহারাজের হিরের আংটির রহস্যভেদ করা এক জিনিস। আর লন্ডনে গিয়ে চূড়ান্ত নিরাপত্তার ঘেরাটোপে রাখা কোহিনুর মণি উদ্ধার করে আনা অন্য জিনিস। এটা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম। কোহিনুর চুরি এত সহজ হলে আন্তর্জাতিক স্মাগলাররা তা অনেক দিন আগেই হাপিস করে দিত রানির কোষাগার থেকে।

”অফিসে কখন এলেন কালকেতুদা?”

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি তথাগত। মনে মনে কাল থেকে ওর কথাই ভাবছিলাম। তথাগত ছোট একটা কাগজে ক্রীড়া—সাংবাদিকতা শুরু করেছিল। কিন্তু ভাল না লাগায় এখন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ঢোকার চেষ্টা করছে। মাঝে—মাঝেই ও আমার কাছে আসে। কোনও কেস এলে তথাগতকে আমি কাজে লাগিয়ে দিই। তাই বললাম, ”এই ঘণ্টাখানেক আগে এসেছি। তোকে আমার প্রচণ্ড দরকার।”

”কী ব্যাপার, নতুন কোনও কেস পেলেন নাকি?”

”হ্যাঁ। তবে কেসটা নেব কি না ভাবছি।”

তথাগত উলটো দিকের চেয়ারে বসতেই শানু দত্তদের সম্পর্কে সবকিছু ওকে খোলাখুলি বললাম। শুনে ও বলল, ”কালকেতুদা আমার মনে হয়, এই তিনটে লোক সম্পর্কে আগে আমাদের ভালভাবে খোঁজ নেওয়া উচিত। না হলে বিশ্রী ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে পারেন। যা দিনকাল পড়েছে, কাউকে বিশ্বাস করা নেই। ভাল কথা, লোকগুলো আছে কোথায় বলতে পারেন?”

”যতদূর জানি শানু দত্ত আছেন তাজ হোটেলে। কেননা কথায়—কথায় ভদ্রলোক সেদিন বলেছিলেন, কলকাতায় ওঁর কোনও আত্মীয়স্বজন নেই। অবনীমোহনবাবু বালিগঞ্জ প্লেসে তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছেন। তৃতীয়জন—প্রিয়ব্রতবাবু আসলে মেদিনীপুরের লোক। কিন্তু নর্থ ক্যালকাটায় দু’হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট কিনে রেখেছেন। সেখানে ওঁর এক ছেলে ফ্যামিলি নিয়ে থাকে। দাঁড়া, তিনজনই ফোন নম্বর দিয়েছিলেন এখানকার, সেই সঙ্গে বিদেশের। লিখে নে।”

পকেট থেকে নোটবই বের করে সব ঠিকানা আর ফোন নম্বর টুকে নিল তথাগত। চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ”আমার এক কাকা জার্মানিতে থাকেন। স্টুটগার্টে। শানু দত্তের হেহলবোর্ন মনে হচ্ছে কাছাকাছিই হবে। ঠিক খবর পেয়ে যাব, লোকটা কেমন? প্রিয়ব্রত চাকলাদারকে ধরা যাবে না। কেননা কানাডায় আমার কোনও কন্ট্যাক্ট নেই। তবে গোথেনবার্গে থাকেন আমার বন্ধুর এক কাকা। তাঁর মাধ্যমে নিশ্চয়ই খোঁজ পাওয়া যাবে অবনীমোহনের।”

”তোর আর কী খবর বল।”

”চলছে। একটা সপ্তাহ বেকার বসে ছিলাম। আপনার জন্য তাও একটা কাজ জুটল অ্যাদ্দিনে। দাঁড়ান, এখুনি একটা ফোন করি শানু দত্তকে। যদি কোনও ইনফরমেশন পাওয়া যায়।” কথাটা বলেই তথাগত তাজ হোটেলের নম্বর ঘোরাতে লাগল। একটু পরে দু’চারটে কথা বলে আমাকে বলল, ”শানু দত্ত এখন তাজ হোটেলে নেই। কাল চেক আউট করে গেছেন। বলেছেন আগামীকাল ফিরবেন। সেজন্য উনি রুম বুক করেও রেখেছেন। হঠাৎ গেলেন কোথায় ভদ্রলোক?”

বললাম, ”হয়তো কোনও পার্সোনাল টুরে গেছেন। উনি কিন্তু বলেছিলেন, আজ আমাকে ফোন করবেন।”

তথাগত বলল, ”দাঁড়ান, অন্য দু’জন কী করছে দেখি।”

টেলিফোন নম্বর মিলিয়ে তথাগত ডায়াল করতে লাগল। বালিগঞ্জ প্লেসের নম্বরটা পাওয়া যাচ্ছে না। নর্থ ক্যালকাটায় প্রিয়ব্রত চাকলাদারের নম্বরটা পেয়ে গেল ও। তারপরই রিসিভারটা এগিয়ে দিল আমার দিকে। ও—প্রান্তে বাচ্চা একটা মেয়ে ধরেছে। বোধহয় অনেকটা দৌড়ে এসেছে। হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ”দাদু এখন ক্যারাম খেলছে আমাদের সঙ্গে। এখন আসতে পারবে না। তোমার কী দরকার বল, আমি দাদুকে বলে দেব।” দীর্ঘদিন পর বিদেশ থেকে ফিরে প্রিয়ব্রতবাবু তা হলে সময়টা বেশ ভালই কাটাচ্ছেন। বললাম, ”দাদুকে গিয়ে বল কালকেতু নন্দী ফোন করেছে।”

একটু পরে এসে ফোন ধরলেন প্রিয়ব্রত চাকলাদার, ”বলুন মিঃ নন্দী। আমাদের কাজটা কবে শুরু করছেন?”

বললাম, ”এখনও ঠিক করিনি। কয়েকটা প্রশ্ন আছে। শানু দত্তকে হোটেলে পেলাম না। তাই আপনাকে বিরক্ত করছি।”

”আরে বলুন। দ্বিধা করবেন না।”

”হঠাৎ কোহিনুর নিয়ে আপনারা কেন আগ্রহী, সেটা একটু পরিষ্কার করে জানা দরকার।”

”ওহ, এই ব্যাপার। আসলে কী জানেন, মাসছয়েক আগে শিকাগোতে বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের সময় যখন আমরা, প্রবাসী বাঙালিরা একত্রিত হয়েছিলাম, তখন দেশের জন্য কিছু করার প্রশ্নটা উঠেছিল। সেই সময় এক—একজন এক—একরকম প্রস্তাব দেন। কেউ বলেছিলেন, একটা হাসপাতাল করে দেওয়া যাক। কেউ পরামর্শ দিলেন, একটা স্মৃতিসৌধ গড়ে দিলে ভাল হয়। একজনের প্রস্তাব ছিল, দশ—বারো মিলিয়ন ডলার দিয়ে একটা ট্রাস্ট করে দেওয়া হোক। ভারত থেকে বহু প্রতিভাবান ছেলেমেয়ে পড়াশুনোর জন্য বিদেশে যেতে চায়। কিন্তু টাকাপয়সার অভাবে যেতে পারে না। আমাদের ওই ট্রাস্ট এই ধরনের ছেলেমেয়েদের বিদেশে পাঠানোর উদ্যোগ নেবে।”

”তারপর?”

”সারাদিন ধরে আলোচনা চলল। কোনও ফয়সালা হয় না। হঠাৎই কে একজন একটা ট্যাবলয়েড কাগজ নিয়ে এলেন বাইরে থেকে। সেদিন ওই কাগজে কোহিনুর নিয়ে বিরাট একটা প্রবন্ধ বেরিয়েছিল। লেখকের বক্তব্য, এটা ভারতের জিনিস। কেন ভারতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে না? লেখাটা দেখে শানুদাই তখন বললেন, ‘আমরা যদি কোহিনুর উদ্ধার করে দিই, কেমন হয়?’ কথাটা সবার মাথায় ঢুকে গেল। তখন সবাই মিলে বললেন, কী ভাবে এটা করা যায় তার দায়িত্ব শানুদাই নিন।”

”সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু আমার কথা কে ঢোকাল আপনাদের মাথায়?”

”বলতে পারব না। শানুদা ইন্টারনেটে প্রচুর তথ্য জোগাড় করার পর একদিন আমাকে বললেন, পাওয়া গেছে। এই কাজটা করতে পারে এমন লোক আছে। কলকাতারই ছেলে। তখনই আপনার নাম আমাদের কাছে করলেন। কিন্তু কালকেতুবাবু, আপনাকে তো মশাই জিরো জিরো সেভেন মার্কা লোক বলে মনে হচ্ছে না। এত কোয়ারিজ করছেন, শুনে মনে হচ্ছে, আমাদের আপনি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না। হা হা হা, কী ঠিক বলছি কি না?”

”কিছুটা ঠিক মিঃ চাকলাদার। আপনারা যে কাজটা দিয়েছেন, খুবই রিস্কি।”

”তা তো বটেই। রিস্কি তো বটেই। রিস্ক না নিলে চলবে? স্বাধীনতার আগে আমরা কম রিস্ক নিয়েছি? কালকেতুবাবু, বয়সটা আমার যদি পঞ্চাশ বছর কম হত, তা হলে এই কাজটা আমি নিজেই করতাম। কিছু মনে করবেন না, একটা কথা বলি। স্বাধীনতা আনার জন্য আপনারা তো কিছু করার সুযোগ পাননি। এই কাজটা করুন। ইতিহাসে আপনার নাম লেখা থাকবে।”

কথাটা প্রিয়ব্রতবাবু এমনভাবে বললেন, আমার একটু লজ্জাই করতে লাগল। কোনওরকমে বললাম, ”থ্যাঙ্ক ইউ। আপনার কথা মনে থাকবে।”

রিসিভারটা ক্রেডলের ওপর রাখতে—না—রাখতেই হঠাৎ আবার বেজে উঠল। ফের কানে নিয়ে বললাম, ”কালকেতু বলছি।”

”আমি শানু দত্ত।”

”বলুন মিঃ দত্ত, কোত্থেকে?”

”তাজবেঙ্গল থেকে।”

মিথ্যে কথাটা এমন স্বাভাবিকভাবে বললেন যে, আমি চমকে উঠলাম। তথাগত তা হলে ঠিক সন্দেহই করেছিল। এঁদের যাচাই না করে কোহিনুরের ব্যাপারে ঝাঁপিয়ে পড়া ঠিক হবে না। বললাম, ”আর একটা দিন সময় দিতে হবে মিঃ দত্ত। এখনও মনস্থির করতে পারিনি।”

”ঠিক আছে। আমাদের কোনও অসুবিধে নেই। আমরা চাই, কাজটা আপনি নিন। কাল এই সময়ে আপনাকে আমি ফোন করব। ছাড়ি তা হলে?”

”ও কে।”

ফোনটা ছেড়েই তথাগতকে আমি বললাম, ”যতটা সম্ভব, এই শানু দত্ত সম্পর্কে তুই খোঁজখবর নে তো। মনে হচ্ছে লোকটা গোলমেলে আছে।”

সকালবেলায় টেনিস খেলার জন্য সাউথ ক্লাবের দিকে বেরোচ্ছি, এমন সময় ফোন এল ডি আশিসের। বলল, ”কাল আর তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। একটা বাজে খবর আছে কালকেতুদা।”

”কী ব্যাপার রে?”

”তোমার সেই বন্ধু…সেই পরিতোষ শীল…তার মেয়েটা কাল রাতে মারা গেছে।”

”তাই নাকি?”

”আমার কাছে খবরটা এল রাত ন’টার সময়। মেয়েটা বাঁচবে না জানতাম। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে ভাবতেও পারিনি। অবশ্য থ্যালাসেমিয়া রোগীদের নিয়ে কোনও গ্যারান্টি দেওয়া যায় না।”

খবরটা শুনে এত মন খারাপ হয়ে গেল, কোনও কথা বলতে পারলাম না। পরির মুখটা চোখের সামনে ভাসতে লাগল। এই মাত্র তিন দিন আগে ফুটফুটে মেয়েটা আমার সঙ্গে কথা বলে গেল। এখন তার অস্তিত্বই নেই। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে আশিস বলল, ”কালকেতুদা, তোমার বন্ধুর মেয়ে মারা গেছে বলে তুমি এত আপসেট হয়ে পড়ছ। অথচ এই রোগটার জন্য কত মায়ের কোল খালি হয়ে যাচ্ছে তুমি ভাবতেও পারবে না। এদের কেউ দেখার নেই।”

কী মনে হল বললাম, ”এদের জন্য একটা নার্সিংহোম করতে কত টাকা লাগবে রে আশিস?”

”মিনিমাম লাখদশেক টাকা।”

”আমি দেব।”

আশিসের গলায় প্রচণ্ড বিস্ময়, ”তুমি দেবে? কী করে?”

”সে নিয়ে তোর ভাবার দরকার নেই। টাকাটা পাবি পনেরোই অগস্টের পর। তুই লোকজন নিয়ে কাজ শুরু করে দে।”

”আমাদের ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে একবার একটা প্রোজেক্ট তৈরি করেছিলাম। আলমারিতে সেটা এখনও রাখা আছে। সেটা তা হলে বের করতে হবে।”

দু’চারটে কথা বলে লাইন ছেড়ে দিল আশিস। ঠিক সেই মুহূর্তে আমি ঠিক করে নিলাম, কোহিনুর উদ্ধারের কাজটা আমি নেব। এবং তা জানিয়ে দেব শানু দত্তকে। কিন্তু ভদ্রলোককে তো এখন হোটেলে পাওয়া যাবে না। তার চেয়ে বরং প্রিয়ব্রতবাবুকে ফোন করা যাক। পরির মেয়েটার মুখ কিছুতেই আমি ভুলতে পারছি না। যা করার এখনই আমাকে করতে হবে। নম্বরটা খুঁজে ডায়াল করলাম। ও—প্রান্তে প্রিয়ব্রতবাবু। গলাটা আমি চিনতে পারলাম।

”আমি কালকেতু নন্দী বলছি।”

”আরে বলুন ভাই। একটু আগেই শানুদা ফোন করেছিলেন আমাকে। বোধহয় বিকেলের দিকে আপনার কাছে যাবেন। তা কী ঠিক করলেন, কাজটা করবেন?”

”সে—কথাটা জানানোর জন্যই আপনাকে ফোন করলাম। কাজটা আমি নেবো। তবে কয়েকটা শর্তে।”

”যেমন?”

”হাফ টাকা আমাকে আগে দিতে হবে। তবে আমার নামে নয়। আমি একটা সংস্থার নাম রেফার করব, তাদের হাতে পৌঁছে দিতে হবে।”

”কোনও প্রবলেম নেই। এ—কথাটা আপনি শানুদাকে বলবেন। আসলে কোহিনুরের ব্যাপারটা বিদেশি কোনও এজেন্টকে দিয়ে আমরা করাতে পারতাম। কিন্তু তা হলে সিক্রেসি মেনটেন করা যেত না। আপনাকে একটা আগাম খবর দিয়ে রাখি, কোহিনুর সম্পর্কে কিছু খবর আমাদের কাছে এসেছে। শানুদা সব নিশ্চয়ই বলবেন আপনাকে।”

”মিঃ দত্ত এখন কোথায়?”

”মনে হয় কাঠমান্ডুতে। আমি জানতে চাইনি, ফোনটা উনি করছেন কোত্থেকে। কাল একটা তথ্য জোগাড় করার জন্য ওঁর কাঠমান্ডু যাওয়ার কথা ছিল। ওঁর যাওয়ার কথা অন্য কেউ জানুক, তা উনি চাননি। আজ দুপুরের ফ্লাইটেই উনি ফিরে আসতে পারেন।”

”ও, ঠিক আছে। ছাড়ছি তা হলে।”

”ও কে।”

ফোন ছাড়ার পরও মনের ভারটা কাটল না। নীচে নেমে এলাম। গলফ গ্রিনে আমাদের হাউসিং কমপ্লেক্সের মধ্যে ছোট্ট একটা পার্ক আছে। তাতে দৌড়োদৌড়ি করছে কয়েকটা ছোট্ট মেয়ে। এদের কয়েকজনকে আমি চিনি। শচীন—সৌরভদের অটোগ্রাফ চাইতে মাঝে মধ্যে এরা আমার কাছে আসে। পরির মেয়েরও তো এরকম হেসেখেলে বেঁচে থাকার কথা। কিন্তু কালান্তক রোগ ওকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিল।

পার্কের দিকে তাকিয়ে থাকতে—থাকতে মনটা শক্ত করে নিলাম, কোহিনুর উদ্ধার করতেই হবে। যত কঠিন কাজই তা হোক। আজ পর্যন্ত বহু রহস্যের কিনারা করেছি, কিন্তু কোনওদিন কোনও পারিশ্রমিক নিইনি। এবার নেব। তবে নিজের জন্য নয়। ওই ছোট ছেলেমেয়েগুলির জন্য। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য আমি কিছু করতে চাই।

কোনও কাজ করব বলে ঠিক করলে আমি সেই কাজের জন্য হোম ওয়ার্কটা ভালভাবে করি। সেজন্য প্রথমেই মনে হল, কোহিনুর সম্পর্কে আগে খুঁটিনাটি খোঁজ নেওয়া দরকার। হঠাৎই মনে হল, দিনকয়েক আগে একটি নামী প্রতিষ্ঠান হিরে প্রদর্শনী করেছিল তাদের বালিগঞ্জের শো—রুমে। সেখানে একটা বই দিয়েছিল মণিমুক্তো সম্পর্কে। সেই বইতে কোহিনুর নিয়ে বড় একটা প্রবন্ধ ছিল। সঙ্গে—সঙ্গে ঘরের ভেতরে ঢুকে এলাম। র‌্যাক থেকে বইটা নিয়ে পড়তে শুরু করলাম।

কোহিনুর হিরে এই মুহূর্তে কোথায় রয়েছে, অফিসের লাইব্রেরিতে নিশ্চয়ই সেই তথ্য পাওয়া যাবে। লাইব্রেরিয়ান শক্তিবাবুকে একবার মুখ ফুটে বললেই হল। সঙ্গে—সঙ্গে ফাইল পাঠিয়ে দেবেন। তেমন হলে খেটেখুটে ইন্টারনেট থেকেও উনি তথ্য জোগাড় করে দেবেন। এর জন্য কয়েক ঘণ্টা সময় দিতে হবে শক্তিবাবুকে। তাই মনে মনে ভাবলাম, আপাতত সেই ব্রোশিয়োরটা থেকে কোহিনুর সম্পর্কে যা পাওয়া যায়, তাই পড়ে নেওয়া যাক।

”তুমি কখন অফিসে যাবে?”

প্রশ্নটা শুনে তাকিয়ে দেখি ফুল্লরা। আমার স্ত্রী। বেশ সাজগোজ করেছে। তার মানে কোথাও বেরোচ্ছে। বললাম ”ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বেরোব। তুমি কি কোথাও যাচ্ছ?”

”হ্যাঁ। নিউ মার্কেটের দিকে। গোটাকুড়ি জাতীয় পতাকা কিনতে হবে। নিউ মার্কেট ছাড়া আর কোথাও ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ পাওয়া যায় না।”

”হঠাৎ তোমার ন্যাশনাল ফ্ল্যাগের দরকার পড়ল?”

”ফিফটি ইয়ার্স অব ইন্ডিপেন্ডেন্স সেলিব্রেশন করা হচ্ছে আমাদের হাউসিংয়ে। সে জন্য দরকার। তোমার কাছে কোঅপারেটিভের কর্তারা পরে আসবেন।”

”কেন?”

”ওই অনুষ্ঠানে প্রিসাইড করার জন্য আমাদের একজন স্বাধীনতাসংগ্রামীকে দরকার। তাঁকে এঁরা সংবর্ধনাও জানাতে চান। তোমাকে সাজেস্ট করতে হবে কাকে আনা যায়।”

”পনেরোই অগস্ট তো এখনও অনেক দেরি আছে।”

”কোথায় আর দেরি? মাত্র দু’সপ্তাহ। আগে থেকে বলে না রাখলে নামী লোককে ওই দিন পাওয়া যাবে?”

সঙ্গে—সঙ্গে মনে পড়ল শানু দত্তদের কথা। ওঁদের কাউকে বললে নিশ্চয়ই আসবেন। তাই ঠাট্টা করে ফুল্লরাকে বললাম, ”ফ্রিডম ফাইটার আমার হাতের কাছেই আছেন। যে—সে লোক নন। স্বাধীনতাসংগ্রামী, প্লাস এন আর আই। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পালন করতেই ভদ্রলোকরা দেশে এসেছেন। বেশ মালদার লোক সব। বল তো, তোমাদের মহিলা সমিতির জন্য কোনও কিছু ডোনেট করতে বলি।”

”কোনও দরকার নেই। ফের তুমি ঝামেলা বাড়াবে।”

কথাটা বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল ফুল্লরা। হঠাৎ কী মনে হল, ওকে বললাম, ”এই শোনো। তুমি তো ইতিহাসে এম এ। কোহিনুর হিরে সম্পর্কে কোথায় ডিটেলে জানতে পারব বলো তো?”

কৌতূহলী মুখে ফিরে তাকিয়ে ও বলল, ”হঠাৎ তুমি কোহিনুর নিয়ে পড়লে?”

”দরকার আছে।”

”কোহিনুর নিয়ে একটা বই পড়েছিলাম। একজন ইরানি লেখকের লেখা। ইংরেজিতে। ভদ্রলোকের নাম যতদূর মনে পড়ছে ইরাদজ আমিনি। খুব ডিটেলে লিখেছিলেন উনি কোহিনুর সম্পর্কে।”

”বইটা কোথায় পাওয়া যাবে বল তো?”

”নিউ মার্কেটে বিদেশি বইয়ের দোকানে পাওয়া যেতে পারে। দেখব?”

”যদি পাও কিনে এনো তো।”

”ঠিক আছে।” বলে ফুল্লরা বেরিয়ে গেল। আমি ফের হাতে ধরা বইটায় মন দিলাম। কোহিনুর সম্পর্কে চমৎকার একটা ঘটনার কথা উল্লেখ রয়েছে সেই ব্রোশিয়োরটাতে। ইংরেজ আমলে জন লরেন্স নামে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক কর্মচারীর কাছে ওই হিরেটা গচ্ছিত রেখেছিলেন লর্ড ডালহৌসি। ছোট্ট একটা বাক্সে ভরে। লরেন্স জানতেন না ওটা কোহিনুর। অবহেলায় ওই অমূল্য জিনিসটা তিনি কোটের পকেটে ফেলে রেখে দেন। দিনদশেক পরে হঠাৎ একদিন লর্ড ডালহৌসি লরেন্সকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, ”তোমাকে যে বাক্সটা যত্ন করে রাখতে দিয়েছিলাম, সেটা নিয়ে এসো। রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে সেটা পাঠাতে হবে। ওর ভেতর কোহিনুর মণি আছে।”

রানি এবং কোহিনুরের নাম শুনেই পিলে চমকে যায় লরেন্সের। তাড়াতাড়ি নিজের বাড়িতে ফিরে এসে তিনি ছোট্ট বাক্সটা খুঁজতে থাকেন। কোথাও না পেয়ে যখন তিনি মুষড়ে পড়েছেন, সেই সময় বাড়ির ভারতীয় বাবুর্চি সামনে এসে জিজ্ঞেস করে, ”সাহেব, আপনি কি কিছু খুঁজছেন?”

লরেন্স বললেন, ”হ্যাঁ, ছোট্ট একটা বাক্স।”

”ওহ, ওটা তো আমার কাছে আছে। আপনার কোটের পকেটে ছিল। কোটটা কাচতে গিয়ে পেয়েছি।”

লরেন্স বললেন, ”যাও, শিগগির ওটা নিয়ে এসো।”

বাবুর্চি বাক্সটা নিয়ে আসতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন লরেন্স। সাহেবের মুখে স্বস্তির ছাপ দেখে বাবুর্চি তো অবাক। বলল, ”বাক্সের মধ্যে তো কিছু নেই সাহেব। শুধু একটুকরো একটা কাচ। এর জন্য এত উতলা হচ্ছেন কেন?”

ঘটনাটা পড়তে পড়তে মনে হল, ইস, ভারতীয় ওই বাবুর্চি যদি সেদিন কোহিনুর চিনতে পারত, তা হলে আর দরকারই হত না আজ তা উদ্ধারের কথা ভাবার।

লাইব্রেরিয়ান শক্তিবাবুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভাল। ভদ্রলোককে আমি শ্রদ্ধা করি ওঁর পেশাদারিত্বের জন্য। কোনও ব্যাপারে কোনও রেফারেন্স চাইলে দ্রুত সব তথ্য পাঠিয়ে দেন। বেলা এগারোটা নাগাদ অফিসে ফোন করে শক্তিবাবুকে জানিয়ে দিয়েছিলাম, কোহিনুর মণি সম্পর্কে আমার কিছু ইনফরমেশন দরকার। দুপুরে অফিসে ঢুকেই দেখি টেবিলে আমার নামে একটা ফাইল পড়ে রয়েছে। ভেতরে খবরের কাগজের কাটিংয়ের প্রচুর জেরক্স।

দুপুরের দিকে বিশেষ কাজ নেই বলে কাগজের কাটিংগুলোতে চোখ বোলাতে শুরু করলাম। হেডিং ‘কোহিনুর নাউ এ হট টপিক ইন ইউ কে’। ছিয়াত্তর সালের সেপ্টেম্বর মাসের কাগজ। সাংবাদিক লিখেছেন, ”কোহিনুর মণিকে নিয়ে এখন ব্রিটেনে খুব আলোচনা হচ্ছে। ভারত—পাকিস্তান ওই বিশ্বখ্যাত মণিটি ফেরত চাইছে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের প্রাক্তন কর্মচারী এবং ইতিহাসবিদরা ভারত—পাকিস্তানের এই দাবি নস্যাৎ করে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে প্রথম প্রতিক্রিয়া জানাতে এগিয়ে এসেছেন সার ওলাফ ক্যারো। উনি ব্রিটিশ—রাজের সময় ভারতে ছিলেন নর্থ—ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্সের গভর্নর হিসেবে।

”সার ওলাফ বলেন, কোহিনুরের আসল মালিক কে তা বলা মুশকিল। এর অনেক দাবিদার। এই মণিটি দীর্ঘ ২১৩ বছর দিল্লির মোগলদের দখলে ছিল। তারপর সেটা চলে যায় আফগানিস্তানের কান্দাহার এবং কাবুলে। প্রায় ৬৮ বছর সেখানে ছিল। আমরা কোহিনুর পাই লাহোরে। তখন সেটা মহারাজা দলিপ সিংহজির কাছে ছিল। আমি বুঝতে পারছি না ভারত—পাকিস্তান কেন এই মণিটি ফেরত চাইছে? ভারতকে দেওয়া হলে পাকিস্তান আপত্তি করবে। তারা বলতে পারে, আপনারা মণিটা লাহোর থেকে নিয়ে গেছেন। লাহোরেই ফেরত দিন। আমরা যদি পাকিস্তানের কথা শুনি তা হলে ভারতের রাগ হবে। তারা বলবে, লাহোর সেই সময় ভারতের অংশ ছিল। মণিটা তাই এখন ভারতেরই পাওয়া উচিত। আমার মনে হয়, কোনও দেশকেই কোহিনুর ফেরত দেওয়ার প্রশ্ন নেই। ওটা রানির সম্পত্তি। রানির কাছেই থাকা উচিত।”

শক্তিবাবুর পাঠানো পেপার কাটিংয়ে কোহিনুরের ইতিহাস পড়তে পড়তে চমকে উঠলাম। মণিটা ফেরত দেওয়া নিয়ে দাবি, পালটা দাবি চলছে গত কুড়ি বছর ধরে। অবাক লাগল ইরানও ব্রিটিশ সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে মণিটা আসলে তাদের। তেহেরানের একটা ইংরেজি কাগজ ‘কেহান’ তাদের প্রথম পাতায় লিখেছে, ”ভারত—পাকিস্তানের নয়, মণিটা আমাদের। মোগল সম্রাট মহম্মদ শাহকে যুদ্ধে হারিয়ে সম্রাট নাদির শাহ ওটা নিয়ে এসেছিলেন দিল্লি থেকে। তিনিই মণিটির নাম দেন কোহিনুর। অর্থাৎ আলোর পর্বত। ন’বছর ওই মণি তাঁর কাছেই ছিল। যদি মণিটি ভারত পাকিস্তানের হাতে তুলে দেয় তা হলে ইরান হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না।”

কোহিনুর নিয়ে এত কিছু ঘটে গিয়েছে জানতামই না। ভারত, পাকিস্তান, ইরান তো বটেই, ইচ্ছে করলে দাবি জানাতে পারত সোভিয়েত রাশিয়াও। কেননা, একটা সময় কিছুদিনের জন্য এই মণিটা সমরখন্দে ছিল। যে শহরটা ছিয়াত্তর সালে সোভিয়েত রাশিয়ার ভেতরে ছিল। শক্তিদার পাঠানো তথ্যেই জানতে পারলাম, মণিটা এখন শোভা পাচ্ছে ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথের মুকুটে। রাজপরিবার তা ফেরত দেবেন কেন? মুকুটটা রাখা আছে টাওয়ার অব লন্ডনে। রানির কোষাগারে। একটা দুর্গে চূড়ান্ত নিরাপত্তার মধ্যে। সেটা উদ্ধার করে আনা কি আমাদের মতো লোকের পক্ষে সম্ভব?

শানু দত্তরা আমাকেই এই দায়িত্ব দিতে এলেন কেন, তা নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগছে। দশ লাখ টাকাটা এমন কিছু টাকা নয়। এই মণির জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করতেও প্রস্তুত অনেকে। কোহিনুর বিশ্বের সবচেয়ে বড় হিরে নয়। সাইজে এর থেকেও বড় হিরে পাওয়া গিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার নাটালের খনি থেকে। যেমন কালিনান। আদর করে তার নাম দেওয়া হয়েছে গ্রেট স্টার অব আফ্রিকা। যেমন, দ্য রিজেন্ট। প্যারিসের লুভর মিউজিয়ামে আছে। মস্কোয় ক্রেমলিনে রাখা আছে ওরলভ হিরে। তবুও কোহিনুর হচ্ছে কোহিনুর। কেননা, মণিটাকে ঘিরে জড়িয়ে রয়েছে একটা মিথ। সেটাই দাম আর মর্যাদা অনেক অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।

কাগজের কাটিংয়ে খবরগুলো পড়তে পড়তে একেবারে দু’শো বছর পিছিয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ রিসেপশন থেকে শানু দত্তের ফোন, ”আপনি কি এখন একটু ফ্রি আছেন? তা হলে আপনার কাছে একবার আসছি।”

বললাম, ”আসুন।”

নীচ থেকে চারতলায় উঠে আসতে মিনিট চার—পাঁচেক লাগবে শানু দত্তের। তার মধ্যে চট করে হাতের কাজ সেরে রাখা দরকার। পেপার কাটিংগুলো ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখলাম। আজ শানু দত্তের সঙ্গে পরিষ্কার কথা বলে নিতে হবে। এই দায়িত্বটা নেওয়ার কথা ভাবতামই না, যদি না থ্যালাসেমিয়া রোগীদের অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসতাম। তবে শানু দত্তদের কাজটা নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং। করতে পারলে সারা বিশ্বে হইচই পড়ে যাবে।

হাতের কাজগুলো সেরে নেওয়ার আগেই শানু দত্ত এসে হাজির হলেন। একা নন, সঙ্গে পাঞ্জাবি এক যুবক। চেয়ারে বসার আগেই উনি পরিচয় করিয়ে দিলেন, ”এই ভদ্রলোকের নাম শিবসাগর সিংহ। এঁর একটা আলাদা পরিচয় আছে। ইনি পঞ্জাবের মহারাজা দলিপ সিংহের উত্তরাধিকারী। সেই সূত্রে কোহিনুরের আসল মালিক।”

প্রতি—নমস্কার করে একটু অবাক হয়েই তাকালাম। ইনি সেই দলিপ সিংহের বংশধর, যাঁকে ঠকিয়ে লর্ড ডালহৌসি কোহিনুর হাতিয়ে নিয়েছিলেন প্রায় দেড়শো বছর আগে। দলিপ সিংহের বয়স তখন মাত্র আট বছর। জিজ্ঞেস করলাম, ”আপনিই যে দলিপ সিংহজির আসল উত্তরাধিকারী তার কোনও প্রমাণ আছে?”

শিবসাগর সিংহ বললেন, ”নিশ্চয়ই আছে। আমার ঠাকুর্দারও নাম ছিল আমার নামে। রাজা শিবসাগর সিংহ। তিনি মহারাজা দলিপ সিংহের দুই ছেলের একজন। আমার বাবার নাম শিবদয়াল সিংহ। তিনি অবশ্য রাজপরিবারে মানুষ হননি। মানুষ হয়েছেন নারায়ণ সিংহ নামে এক জমিদারের বাড়িতে।”

জিজ্ঞেস করলাম, ”কেন?”

”তা হলে একটু পেছনের ঘটনা আপনাকে জানাতে হবে। মহারাজা দলিপ সিংহকে কুইন ভিক্টোরিয়া লন্ডনে নিয়ে গিয়েছিলেন। একটা সময় তিনি খুবই প্রিয়পাত্র ছিলেন রানির। কিন্তু বড় হওয়ার পর দলিপ সিংহের চোখ ফুটল। তিনি বুঝতে পারলেন, ইংরেজরা তাঁকে ঠকিয়েছেন। বদলা নেওয়ার জন্য তিনিও গোপনে আইরিশ বিপ্লবীদের সমর্থন করতে থাকেন। এ নিয়ে একটা সময় রানি খুবই অসন্তুষ্ট হন। দলিপ সিংহ রানির বিষনজরে পড়ে যান। তাঁর বংশধররা যাতে বেঁচে না থাকেন, ভবিষ্যতে যাতে কোহিনুর দাবি করতে না পারেন, তার জন্য ইংরেজরা চক্রান্ত করেন। প্রাণ বাঁচাতে আমার ঠাকুর্দা আমার বাবাকে গোপনে নয়ানসরে আমাদের অনুগত এক জমিদারের কাছে পাঠিয়ে দেন। বাবা এক সময় আর্মিতে ছিলেন। পরে অবসর নিয়ে স্কুল শিক্ষকের চাকরি করেন। আমিও বাবার কাছে থাকতে পারিনি। দিল্লিতে মানুষ হয়েছি আমার পিসিদের কাছে। সবকিছুর প্রমাণ আছে।”

”আপনি এখন কী করেন?”

”স্কুলে পড়াই।”

”আপনি কী চান?”

”দেখুন, আমার বাবা কোহিনুর এবং দলিপ সিংহের অন্য ধনসম্পত্তি ফেরত চেয়ে রানি এলিজাবেথের কাছে বেশ কয়েকবার চিঠি লিখেছেন। কিন্তু কোনও উত্তর পাননি। আমি জানি চিঠি লিখে কোনও লাভ নেই। বাবা কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন পঞ্জাব আর হরিয়ানা হাইকোর্টে। কেন আমাদের কোহিনুর ফেরত আনার উদ্যোগ তারা নিচ্ছে না, ভদ্রতার জন্য। সেই মামলা এখনও চলছে। কিন্তু আমি জানি, মামলা—টামলা করে কোনও কাজ হবে না। আমাদের জিনিস আমাদেরই ছিনিয়ে আনতে হবে।”

শিবসাগর সিংহের গলায় জঙ্গি সুর শুনে বললাম, ”ছিনিয়ে আনবেন কী করে?”

”যেমন ভাবে ইংরেজরা আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। দেখুন মিঃ নন্দী, কোহিনুর মণি আমরা ফেরত চাইছি বটে কিন্তু তা বাড়ির সিন্দুকে তুলে রাখার জন্য নয়। মিঃ শানু দত্তের সঙ্গে আমি একমত, ওই মণির মালিক আমাদের দেশ। তা হলে কেন তা দেশে থাকবে না? ইংরেজরা ছত্রপতি শিবাজির তরবারি ওদের দেশে নিয়ে গিয়েছিল। মহারাষ্ট্র সরকার চাপ দিয়ে তা ফেরত নিয়ে এল। তা হলে কোহিনুর কেন আমরা ফিরিয়ে আনতে পারব না? মিঃ দত্তের কাছে আপনার কথা শুনলাম। তখন ওঁকে বললাম, প্লিজ আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিন। লন্ডনে আমাদের কমিউনিটির প্রচুর লোক বসবাস করেন। তাঁরা এ ব্যাপারে হেল্প করার জন্য প্রচণ্ড আগ্রহী। কোহিনুর মণি উদ্ধার করার জন্য আপনি যদি লন্ডন যান, তা হলে ওখানে যা সাহায্য করার আমার কমিউনিটির লোকেরা তা করবে।”

শানু দত্ত এতক্ষণ চুপচাপ আমাদের কথা শুনছিলেন। এবার বললেন, ”কালকেতুবাবু, শিবসাগরের দাবি কিন্তু অন্যায্য নয়। ন্যাশনাল আর্কাইভ অব ইন্ডিয়ায় আমি সেই সনদটা দেখে এসেছি যাতে লর্ড ডালহৌসির সই আছে। মহারাজা দলিপ সিংহ কোহিনুর দেওয়ার সময় প্রমিস করিয়ে নিয়েছিলেন, আপাতত মণিটা রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে গচ্ছিত রাখছেন বটে, কিন্তু ঠিক একশো বছর পর তাঁর প্রপৌত্রের কাছে সেটা ফেরত দিতে হবে। একশো বছর অনেক দিন পেরিয়ে গেছে। তাই মণিটা দাবি করে শিবসাগররা কোনও অন্যায় করছেন না। কালকেতুবাবু, কোহিনুর ছিনিয়ে আনতে পারলে আপনি কোনও বেআইনি কাজ করবেন না। বরং দেশের প্রতি একটা কর্তব্য করবেন।”

শানু দত্ত লোকটাকে মিথ্যেবাদী ভেবেছিলাম। কিন্তু দেখলাম, না, সেদিন উনি আমাদের মিথ্যে কথা বলেননি। সেদিন উনি তাজ হোটেলেই ছিলেন। তবে অন্য নামে, অন্য ঘরে। নাম ভাঁড়ানোর দরকারও ছিল। না হলে উনি খুব বিপদে পড়ে যেতেন।

মহারাজা দলিপ সিংহের বংশধর শিবসাগর সিংহকে ট্যাক্সিতে তুলে দিয়ে সেদিন শানু দত্ত আমাকে বলেছিলেন, ”কালকেতুবাবু, আমরা কয়েকজন প্রবাসী যে কোহিনুর উদ্ধারে নেমেছি, সেটা বোধহয় লিক হয়ে গেছে। তিন—চারদিন আগে হোটেলে একটা ফোন পাই। একজন হুমকি দিয়ে বলেন, কোহিনুর নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। ওটা আমাদের জিনিস। আমাদের জন্য ছেড়ে দিন।”

জিজ্ঞেস করেছিলাম, ”ফোনটা কে করেছিল জানতে চাইলেন না কেন?”

”জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু লোকটা বলল না। শুধু বলল, আপনাদের ওপর আমরা লক্ষ রাখছি। আমার কী মনে হয় জানেন, যে হুমকি দিয়েছে, সে জেমস বার্চ সিংহের লোক।”

”কে এই জেমস বার্চ সিংহ?”

”কোহিনুরের আরেক দাবিদার। এই লোকটা লন্ডনেই থাকে। বলে বেড়াচ্ছে ও নাকি মহারাজার এক ভাইপোর ছেলে। রানি এলিজাবেথের কাছেও চিঠি লিখেছিল। লন্ডনের বিভিন্ন কাগজ সেই চিঠি ছেপেওছে। ওকে নিয়ে একটা সময় বিরাট লেখালেখি হয়েছিল ওয়েস্টার্ন মিডিয়ায়।”

”লোকটা জানল কী করে আপনারা দেশকে কোহিনুর উপহার দেওয়ার কথা ভাবছেন?”

”সেটাই তো আশ্চর্যের। একটু কেয়ারফুল থাকতে হবে। সে দিন ফোনটা পাওয়ার পরই হোটেলে আমি ঘর বদলে ফেলি। হোটেল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিই, অতঃপর কেউ ফোন করলে বলে দেবেন আমি দু’—চারদিনের জন্য বাইরে গেছি।”

শানু দত্তের তাগাদার জন্যই কয়েকদিন ছুটি নিয়েছি অফিস থেকে। আমাদের সঙ্গে খাটছে তথাগতও। স্টুটগার্টে ওর যে কাকা থাকেন, তাঁর সঙ্গে মাঝে একদিন কথাও বলেছে। ভদ্রলোক শানু দত্ত সম্পর্কে প্রচণ্ড উচ্ছ্বসিত। তথাগত বলছিল, ”জার্মানিতে বাঙালিরা অসম্ভব শ্রদ্ধা করেন শানু দত্তকে। কাকা বলছিলেন, লাখ লাখ মার্ক রোজগার করেছেন ভদ্রলোক। কিন্তু থাকেন খুব সাধারণভাবে। প্রতি বছর একবার করে দেশে আসেন। আর বেশ কিছু অর্গানাইজেশনকে সাহায্য করে যান। ইস্টার্ন বাইপাসের কাছে নাকি একটা হাসপাতালও করেছেন বছর তিনেক আগে সাধারণ লোকের জন্য।”

জিজ্ঞেস করলাম, ”আর কিছু পেলি ভদ্রলোক সম্পর্কে?”

”অ্যাজ স্বাধীনতাসংগ্রামী ওঁকে দেখলাম অনেকেই চেনেন। বেনেটোলার দত্তবাড়ির ছেলে। ছেচল্লিশ সালে মাত্র ষোলো বছর বয়সে উনি মারাত্মক একটা ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে মারেন কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার ক্লেমেন্সকে। ওই সময় যাবজ্জীবন জেল হয়েছিল শানুবাবুর। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য এক বছরের মধ্যেই তিনি ছাড়া পেয়ে যান। ওঁকে নিয়ে খুব চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল সে সময়। বাইরে আসার পরই শানুবাবুকে ওঁর বাবা জার্মানিতে এক আত্মীয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেন।”

তথাগত তথ্য জোগাড় করার ব্যাপারে ওস্তাদ। একটা ফাইলও তৈরি করে ফেলেছে। সেই কাগজপত্রে আমি চোখ বোলাচ্ছি। আমার এক হাত দূরে বসে তথাগত ইন্টারনেটে কাজ করছে। ওর হাতের মাউসটা খুব ব্যস্ত। আজ কিছুক্ষণ পরে আসার কথা শানু দত্তের। ফাইনাল ব্লু প্রিন্ট তৈরি হবে কোহিনুর উদ্ধারের। আগের দিন উনি বলে গেছেন আমাদের লন্ডন যাওয়ার দরকার হবে না। কেন, তা অবশ্য খোলসা করে কিছু বলেননি। মনে হয় শানু দত্ত নিজের চ্যানেলে কিছু ইনফরমেশন আশা করছেন। সেটা পেয়ে যাবেন আজকের মধ্যে। আর পেলেই লাইন অব অ্যাকশন ঠিক করব আমরা।

আমি জীবনে মাত্র দু’বার লন্ডনে গেছি। একবার সুইডেনে ইউরোপিয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়ানশিপ কভার করতে যাওয়ার সময়। আর অন্যবার আমেরিকা বিশ্বকাপ থেকে ফেরার পথে। বি বি সি বাংলা সার্ভিসে চাকরি করে আমার খুব ঘনিষ্ঠ সুপ্রকাশ ঘোষাল। একসময় আমাদেরই সহকর্মী ছিল। সে—ই ওই দু’বার আমাকে লন্ডনের দ্রষ্টব্য স্থানগুলো ঘুরিয়ে—ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। লন্ডনে তো সবকিছুই ঐতিহাসিক। এতদিনে হঠাৎ আমার মনে পড়ছে, সুপ্রকাশ দূর থেকে আমাকে টাওয়ার অব লন্ডন দেখিয়েছিল। টেমস নদীর ওপর দিয়ে আমরা যাচ্ছিলাম। পুব পারে বিরাট একটা দুর্গের মতো দেখে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ”ওটা আবার কোন ডিউকের প্রাসাদ?”

সুপ্রকাশ হাসতে হাসতে বলেছিল, ”গ্রেট ব্রিটেনের সবচেয়ে দামি বাড়ি এটা।”

”কেন?”

”রানির রাজকোষ এ প্রাসাদে।”

”কেউ কখনও হাতানোর চেষ্টা করেনি?”

”করেনি আবার? প্রচুর ডাকাতের লাশ টেমসের জলে ভেসে গেছে। এতগুলো ওয়াচ টাওয়ার, দু’দফার পাঁচিল আর চারশো গার্ড টপকে আন্ডার— গ্রাউন্ডে রাখা রানির অলঙ্কার আর ধনসম্পত্তি চুরি করা চাট্টিখানি কথা?”

সুপ্রকাশ আরও অনেক গল্প করেছিল টাওয়ার অব লন্ডন সম্পর্কে। সব কথা অবশ্য তিন বছর পরে আর মনে নেই। তথাগতর ফাইলে দেখলাম, বেশ কিছু নতুন তথ্য রয়েছে টাওয়ার অব লন্ডন নিয়ে। যা পড়ে মনে হল ওখানে গিয়ে কোহিনুর উদ্ধার করে আসা অসম্ভব।

”হুর রে….কালকেতুদা…এই দেখুন কী খবর বের করে ফেলেছি।”

তথাগতর গলা শুনে মুখ তুলে তাকালাম। ওর চোখমুখ আনন্দে ঝকমক করছে। জিজ্ঞেস করলাম, ”কী খবর রে?”

”কোহিনুর…এই একশো পঁয়ত্রিশ বছর পর প্রথম রাজকোষাগার থেকে বেরোচ্ছে।”

”তাতে তোর এত লাফানোর কি হল?”

”এর মানেটা আপনি ধরতে পারলেন না? দাঁড়ান…ইন্টারনেটের এই খবরটার প্রিন্ট আপনাকে বের করে দেখাচ্ছি।”

একটু কৌতূহল নিয়েই ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে তথাগত বলল, ”পড়ে দেখুন, বাকিংহাম প্যালেসের রয়াল নিউজে দু’তিন দিন আগে কী খবর বেরিয়েছে।”

কাগজে চোখ বুলিয়ে দেখি, মাত্র চার লাইনের একটা খবর। ”রানির মুকুটের কোহিনুর মণি হংকংয়ের রত্ন প্রদর্শনীতে যাচ্ছে। সারা বিশ্বের সেরা একশোটি হিরে এই প্রদর্শনীতে রাখা হবে। উদ্যোক্তারা রানি এলিজাবেথকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তবে তিনি যেতে পারছেন না। প্রদর্শনীটি হবে এগারোই অগস্ট থেকে আঠারোই অগস্ট। ভারত থেকে নিয়ে আসার পর ১৮৬২ সালে একবার কোহিনুর সর্বসাধারণের প্রদর্শনীর জন্য বের করা হয়েছিল। তারপর দীর্ঘদিন বাদে প্রকাশ্যে দেখা যাবে কোহিনুরকে।”

খবরটা পড়ে আমি তথাগতর দিকে তাকালাম। একটা ক্ষীণ আশার আলো দেখা যাচ্ছে। কোহিনুরের জন্য তা হলে আমাদের আর লন্ডনে যেতে হবে না। তথাগতকে বললাম, ”হংকং সাইড থেকে দ্যাখ তো এই এগজিবিশন সম্পর্কে কোনও খবর পাস কি না? একটু ডিটেল দরকার। কোহিনুর কবে ওখানে পৌঁছচ্ছে জানা গেলে ভাল হয়।”

”দাঁড়ান, সেটাও খুঁজে বের করছি।” একটা কিছু আবিষ্কারের নেশায় তথাগত ফের মাউস হাতে নিয়ে বসল। আমি উঠে বারান্দার দিকে গেলাম। একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু খাওয়া যাবে না। আমাদের অফিসে সিগারেট খাওয়া বারণ। খেলে একেবারে গেটের বাইরে গিয়ে খেতে হবে। একটা সিগারেট খাওয়ার জন্য এখন একতলায় নামতে ইচ্ছে করছে না।

সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউর দিকে তাকিয়ে রয়েছি। হঠাৎ দেখি ট্যাক্সি থেকে নামছেন অবনীমোহন মল্লিক। সঙ্গে তিরিশ—বত্রিশ বছর বয়সী একটা ছেলে। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে অবনীমোহনবাবু কী যেন নির্দেশ দিতে থাকলেন ছেলেটিকে। তারপর নিজে হনহন করে হেঁটে গেলেন কফি হাউসের দিকে। ছেলেটা আমাদের অফিস গেটের উলটো দিকে একটা বাড়ির বারান্দার নীচে গিয়ে দাঁড়াল। হঠাৎ ওপরের দিকে তাকিয়ে আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ছেলেটা স্যাট করে সরে গেল থামের আড়ালে। দেখে একটু অবাকই হলাম। কে এই ছেলেটা?

তাজ হোটেলে আমাকে আর তথাগতকে নিয়ে এসেছেন শানু দত্ত। ঘরে আছেন প্রিয়ব্রতবাবু, অবনীমোহনবাবু আর শিবসাগর সিংহ। ফাইনাল ব্লু প্রিন্ট তৈরি হচ্ছে কোহিনুর উদ্ধারের। ঘণ্টাখানেক আগে শানু দত্ত পাঁচ লাখ টাকার একটা চেক দিয়েছেন আমার হাতে। সেটা হাটখোলা ব্লাড ব্যাঙ্কের নামে। আশিসরা এই টাকা পেলে খুব খুশি হবে।

শানু দত্ত বললেন, ”কালকেতুবাবু, আপনার সুবিধের জন্য আমি আগাম কয়েকটা কাজ সেরে রেখেছি। সুইজারল্যান্ডে একটা এজেন্সি আছে, যারা গোপন খবর জোগাড় করতে এক্সপার্ট। প্রচুর টাকার বিনিময়ে ওরা সেই খবর বিক্রি করে। কোহিনুর নিয়ে ওদের কাছে কিছু খবর চেয়েছিলাম। এই তার রিপোর্ট। আপনি পড়ে নিন।”

বুঝতে পারলাম শানু দত্ত সবাইকে খবরটা জানতে দিতে চান না। রিপোর্টে চোখ বোলাতে লাগলাম। ”হংকংয়ের ওই এগজিবিশনে কোহিনুর মণি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রয়াল আর্মি ফোর্সের দুই অফিসারের হেফাজতে। অবশ্যই চূড়ান্ত গোপনীয়তার মধ্যে। কোন রুট দিয়ে যাবে এ নিয়ে ফাইনাল ডিসিশন নেওয়া হয়নি। রাজপরিবারের লোকরা চান, টোকিয়ো হয়ে হংকং। কিন্তু রয়াল সিকিউরিটির প্রধানরা বলছেন, এমন কোনও রুট দিয়ে পাঠাতে যেখানে আন্তর্জাতিক স্মাগলারদের নজর এড়ানো যাবে। সেদিক থেকে কাঠমান্ডু, দিল্লি বা কলকাতা অনেক নিরাপদ। এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।”

রিপোর্ট পড়ে আমি তাকালাম শানু দত্তের দিকে। কোত্থেকে পেলেন উনি এই রিপোর্ট? ই—মেলে বা অন্য কোনও উপায়ে হলে অন্য কারও নজরে পড়ে যাওয়ার চান্স থেকে যাবে। এই রিপোর্টের ওপরও যে নজর রাখা হচ্ছে না কে বলতে পারে? শানু দত্ত পোড় খাওয়া মানুষ। নিশ্চয়ই উনি ফোনে কোনও কোড মারফত খবরটা সংগ্রহ করে নিজে টাইপ করে আমাকে দিয়েছেন।

আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি বললেন, ”এর পরের রিপোর্টটা পাব আজ রাত দশটার পর। তেমন কোনও আর্জেন্ট মনে হলে আপনাকে তখনই জানিয়ে দেব। কিন্তু একটা কথা কোহিনুর উদ্ধার করার সময় কোনওরকম ব্লাডশেড করা চলবে না। কালকেতুবাবু, এটা কিন্তু মাথায় রাখবেন।”

বললাম, ”আপনি নিশ্চিত থাকুন।”

”আজ রাতের মধ্যেই আপনাকে জানিয়ে দিতে পারব কারা কোহিনুরটা নিয়ে আসছে। ট্রানজিটে কতক্ষণ থাকছে। কাজ হাসিল করার জন্য আপনি কিন্তু বেশি সময় পাবেন না।”

”ওঁরা যদি কাঠমান্ডুতে নামেন তা হলে অসুবিধে নেই। ত্রিভুবন এয়ারপোর্টে আমার প্রচুর জানাশোনা। কলকাতা হয়ে গেলে সব থেকে ভাল। কিন্তু ট্রানজিট যদি দিল্লিতে হয়, আমার একটু মুশকিল হবে। আমার অবশ্য মনে হচ্ছে বেটার সিকিউরিটির জন্য ওঁরা নিশ্চয়ই দিল্লি রুটটা ব্যবহার করবেন।”

”আমার তা মনে হচ্ছে না। দিল্লি এমন একটা জায়গা, কারও চোখ এড়ানো কঠিন। রয়াল ফ্যামিলির লোকজন ডেফিনিটলি চাইবেন না কোহিনুর নিয়ে হইচই হোক।”

”আজ তা হলে উঠি মিঃ দত্ত। বাড়িতে না পেলে আপনি আমাকে মোবাইলে ধরবেন।” বলেই আমি উঠে পড়লাম। মিঃ দত্ত সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ খবরটা আমাকে দিয়েছেন। এতক্ষণে আমার পুরনো আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছি। মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকলাম, ট্রানজিট যেন কলকাতা এয়ারপোর্টে হয়। একটাই সমস্যা, কারা কোহিনুর নিয়ে আসছে, তা জানব কী করে? লন্ডন থেকে কলকাতা সরাসরি ফ্লাইট অবশ্য দু’তিনটে এয়ারলাইন্সের আছে। তাও সব রাতের দিকে। তুলনায় সারা দিনে কাঠমান্ডুতে প্রচুর ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট। ফাঁকি দিকে হংকংয়ের ফ্লাইটে যে কেউ উঠে যেতে পারে। তাকে ধরা কঠিন।

তথাগতকে নিয়ে নীচে নেমে এলাম। তাজ হোটেলে বোধহয় আজ কোনও ম্যারেজ পার্টি আছে। লবিতে প্রচুর ভিড়। কাচের সুইং ডোর ঠেলে ঠিক এই সময়টায় বর ঢুকছে। এখন বাইরে বেরোনো যাবে না। তাই বাঁ পাশের কাফেটেরিয়ায় ঢুকে পড়লাম। ফুল্লরাকে নিয়ে মাঝে মধ্যেই এই কাফেটেরিয়ায় আসি। এখানে ধোসাটা খুব ভাল বানায়। তবে ধোসা অর্ডার দেওয়ার সময় আমাদের হাতে নেই। এক কাপ কফি খেয়ে চট করে বেরিয়ে পড়তে হবে। অনেক কাজ বাকি।

”এক্সকিউজ মি প্লিজ। ক্যান আই সিট হিয়ার?”

তাকিয়ে দেখি সাদা চামড়ার এক যুবক। কাঁধে হাভারস্যাক। পরনে জিনস। চোখে গোল সোনালি চশমা। কাফেটেরিয়ায় অনেক টেবিল খালি। তবুও আমাদের সঙ্গে ছেলেটা বসতে চাইছে কেন ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমি কিছু বলার আগেই তথাগত বলে বসল, ”বসুন।”

”থ্যাঙ্কস।” কাঁধ থেকে হাভারস্যাকটা নামিয়ে ছেলেটা বলল, ”আমার নাম রিক ডেইল। আমি আমেরিকান। বস্টন পোস্টের রিপোর্টার। কলকাতায় আজই এসেছি। প্লিজ, আমাকে একটু হেল্প করবেন?”

”বলুন।”

”এখানকার একটা ইংরেজি কাগজ দ্য টেলিগ্রাফের অফিসটা কোথায় বলতে পারেন?”

বিদেশে কভার করতে গেলে অনেক সময় আমাদেরও এই প্রয়োজনটা হয়। স্থানীয় খবরের কাগজের রিপোর্টারদের সঙ্গে আলাপ করে নিলে অনেক সাহায্য পাওয়া যায়। এইভাবে অনেক রিপোর্টারের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। তাদের একজন সেরজেই লেভেনস্কির কথা তো ‘মারাদোনার দোষ নেই’ গল্পে আগে দু’তিনবার বলেছি। আমি বললাম, ”তুমি খুব ভাগ্যবান রিক। ঠিক লোককেই পেয়ে গেছ। আমিও খবরের কাগজে কাজ করি। আমাদের অফিস থেকেই দ্য টেলিগ্রাফ কাগজটা বেরোয়। তুমি যদি একটু অপেক্ষা করো তা হলে আমাদের সঙ্গেই টেলিগ্রাফ অফিসে যেতে পারো।”

রিকের মুখে স্বস্তির হাসি। বলল, ”রিয়েলি আমি লাকি। কিন্তু তার আগে আমি অন্য একটা জায়গায় যেতে চাই। তুমি কি আমাকে বলতে পারবে এখানে কুইন ভিক্টোরিয়ার মেমোরিয়ালটি কোথায়?”

”এই হোটেল থেকে খুব কাছে। ইচ্ছে করলে তুমি হেঁটেও যেতে পারো। এখান থেকে কয়েকশো মিটার। তোমার ওখানে কী দরকার?”

”আসলে ওখানকার কিউরেটরের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। আমার কিছু তথ্যের দরকার। কালই আমি ব্যাঙ্ককে যাচ্ছি। আজ কিউরেটরের সঙ্গে দেখা করা যাবে?”

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কিউরেটর ডঃ অশেষ চট্টরাজ আমার খুবই পরিচিত। ইচ্ছে করলে আমি নিজে কথা বলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দিতে পারি। কিন্তু হাতে সময় কম। তাই এসব ঝামেলা নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বললাম, ”মনে হয় অসুবিধে হবে না। চল, যাওয়ার সময় ভিক্টোরিয়ায় তোমায় নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছি।”

কফির পট এসে গেল। কফিতে চুমুক দিতে দিতে রিকের সঙ্গে কথা বলছি। এমন সময় ”একটু আসছি” বলে তথাগত উঠে গেল। কাফেটেরিয়া থেকে হোটেলের লাউঞ্জটা ভাল দেখা যায়। উঁকি মেরে দেখলাম, ম্যারেজ পার্টির লোকজন পেছনে সুইমিং পুলের দিকে চলে গেছে। লাউঞ্জটা এখন প্রায় ফাঁকা। মনে মনে ঠিক করলাম কফিটা শেষ করেই আমরা বেরিয়ে পড়ব। কিন্তু তথাগত যে হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না।

রিক ছেলেটা কথা বলতে খুব ভালবাসে। বলল, এক মাসের ছুটি নিয়ে এই উপমহাদেশে বেড়াতে এসেছে। ভাল কোনও সাবজেক্ট পেলে লিখবে। কলকাতা নিয়ে ডোমিনিক লাপিয়েরের উপন্যাস পড়েছে। রিকের খুব ইচ্ছে মাদার টেরিজার মিশনারিজ অব চ্যারিটিতে কিছুদিন থেকে কলকাতাকে পটভূমি করে কোনও উপন্যাস লেখার। তা হলে আমেরিকানরা খুব আগ্রহ নিয়ে পড়বে।

রিক বকবক করে যাচ্ছে। আমার মাথায় সব তা ঢুকছেও না। মন পড়ে রয়েছে কোহিনুর আর শানু দত্তের দিকে। আজ রাত্রিতেই আশিসকে আমার বাড়িতে আসতে বলেছি। চেকটা দিয়ে দিতে চাই। চেকটা নেওয়ার পর থেকেই মনটা স্থির করে ফেলেছি। একটা দায় কাঁধে চাপল। চাপুক। থ্যালাসেমিয়া রোগী বাচ্চাদের জন্য একটা ভাল কাজে অন্তত অংশ নিই। আজ দু’তিনটে জায়গায় ঢুঁ মেরে আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে। আগামী চার—পাঁচটা দিন কিভাবে কাটবে জানি না।

রিকের সঙ্গে কথা বলতে—বলতেই তথাগত ফিরে এল। তিনজনে মিলে হোটেলের বাইরে বেরিয়ে এলাম। মারুতি করে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে পৌঁছতে মিনিট পাঁচেকও লাগল না। থ্যাঙ্কস জানিয়ে রিক নেমে যেতেই তথাগত বলল, ”কালকেতুদা, এই ছেলেটা কিন্তু বস্টন থেকে আসেনি। আমেরিকানও নয়। ও এসেছে সুইজারল্যান্ড থেকে। তেহেরান—কাঠমান্ডু হয়ে কলকাতায়।”

চমকে উঠে বললাম, ”তুই জানলি কী করে?”

”সন্দেহ হওয়ায় আমি উঠে গিয়ে হোটেলে আমার কনট্যাক্টের সঙ্গে কথা বলে চেক করে নিলাম। কাঠমান্ডু থেকে এসেছে বলেই আমাদের একটু সাবধানে থাকা দরকার কালকেতুদা।”

জগতে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়। রিক যেভাবে যেচে আমাদের সঙ্গে আলাপ করল, সেটাই সন্দেহজনক। ছেলেটা কি কোনও দেশের এজেন্ট? হঠাৎ মনে হল, হতেও পারে। ভারতের মতো ইরান, পাকিস্তান এবং আরও কয়েকজন লোকও তো কোহিনুর মণির অন্যতম দাবিদার।

শানু দত্তের ফোন এল ঠিক সাড়ে ন’টায়। গলা সামান্য উত্তেজিত, ”কালকেতুবাবু, নূরজাহানকে নিয়ে আর এ এফের দুই অফিসার আসছেন আজ রাত একটার সময়। ওঁরা নামছেন এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে। সকাল আটটায় ক্যাথে প্যাসিফিকের একটা ফ্লাইট আছে, যায় হংকং হয়ে সোল পর্যন্ত। অফিসারদের নাম দুটো লিখে নিন। ক্যাপ্টেন ডেভিড বল আর ক্যাপ্টেন নর্মান কুক। ওঁরা কোথায় থাকবেন এখনও জানা যায়নি। এর পর যা ইনফরমেশন পাব, মোবাইলে জানিয়ে দেব। ও কে, ছাড়ছি তা হলে?”

আমাকে কিছু বলারই সুযোগ দিলেন না শানু দত্ত। লাইনটা কেটে দিলেন। নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। কোহিনুরের নাম পর্যন্ত উনি উচ্চারণ করলেন না। তার বদলে বললেন, নূরজাহান। আর এ এফ মানে রয়াল আর্মি ফোর্স। অফিসার দু’জনের নাম পর্যন্ত উনি বলে দিলেন। সেইসঙ্গে প্লেনটা কখন নামছে তার সময়ও। গায়ের রক্ত টগবগ করে উঠল খবরটা শুনে। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ন’টা পঁয়ত্রিশ। আর মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় হাতে। এর মধ্যে আমাকে যা কিছু করার করতে হবে।

শানু দত্তরা যতই পুরো অপারেশনটায় জাতীয় কর্তব্যের মোড়ক দিন না কেন, আমি জানি সারা বিশ্বের চোখে তা বিরাট অপরাধ। মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য রাজনৈতিক দিক থেকে। হয়তো ভারত—ইংল্যান্ড দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কে চিড় ধরে যেতে পারে। কোহিনুর নিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও লেগে যেতে পারে। জানাজানি হলে তো ব্রিটিশরা ছেড়ে দেবেন না। রাজপরিবার নিয়ে এখনও ওঁরা ভয়ানক স্পর্শকাতর।

গলফ গ্রিন থেকে এয়ারপোর্ট যেতে আধঘণ্টাও লাগবে না। পোশাক বদলানোর ফাঁকে কী মনে হল, সুদীশ নাগকে একবার ফোন করলাম। সুদীশ কলকাতা পুলিশের পদস্থ অফিসার। আমার বিশিষ্ট বন্ধু। এর আগে বেশ কয়েকবার রহস্যভেদে আমার সঙ্গে কাজ করেছে। এবার কোহিনুর নিয়ে ওকে কিছু জানাইনি। একটু ভুল হয়ে গেছে। আগে ওর সঙ্গে কথা বলে নেওয়া উচিত ছিল। আসলে আমি ভাবিইনি এত তাড়াতাড়ি কাজে নামতে হবে।

”কী ব্যাপার কালকেতু? তোর পাত্তাই নেই আজকাল। ইস্টবেঙ্গল টিমটাকে যে সবাই মিলে শেষ করে দিল, তোরা কিছু লিখবি না?”

সুদীশ নাগ পাঁড় ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার। এ—বছর জাতীয় লিগ চ্যাম্পিয়ান হতে পারেনি লাল—হলুদ ক্লাব। সুদীশের তাই প্রচণ্ড রাগ ফুটবল কর্তাদের ওপর। দেখা হলেই অভিযোগ শুরু করে দেয়। ওকে থামিয়ে দেওয়ার জন্যই বললাম, ”রাখ তোর ইস্টবেঙ্গল। ইম্পর্ট্যন্ট কথা আছে। এখনই আসতে পারবি একবার এয়ারপোর্টে?”

একটু থমকে সুদীশ বলল, ”কী ব্যাপার রে? ফের কোনও অভিযান?”

”এত কথার বলার সময় নেই। যত তাড়াতাড়ি পারিস ওখানে চলে আয়। তা হলে সব কিছু জানতে পারবি।”

ফোনটা ছেড়ে দ্রুত পোশাক বদলে নিলাম। ফুল্লরা বাড়িতে নেই। শ্যামবাজারে গেছে ওর এক পিসির বাড়িতে। দিন দুই থাকবে। তাই ফ্ল্যাটের দরজা লক করে বেরিয়ে এলাম। বেসমেন্টের গ্যারাজ থেকে মারুতিটা রাস্তায় বের করার পর কেন জানি না মনে হল, পেছনে কালো একটা অ্যাম্বাসাডরে কেউ একজন ফলো করছে। অ্যাম্বাসাডরটা ঢাকুরিয়া ব্রিজ পর্যন্ত মারুতির পেছন পেছন এল। কিন্তু তারপর আর দেখতে পেলাম না।

এয়ারপোর্টের ইন্টারন্যাশনাল উইংয়ের কাছে গাড়ি রেখে নীচে নামতেই দেখি সুদীশ পোর্টিকোর সামনে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বলল, ”কী ব্যাপার বল তো কালকেতু। এত রাতে এয়ারপোর্টে তোর কী দরকার?”

পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ফিস ফিস করে বললাম, ”বলছি চল। আমার পিছনে লোক লেগে রয়েছে। এখানে কথা বলার উপায় নেই। তুই কাফেটেরিয়ায় চলে যা। আমি আসছি।”

এয়ারপোর্টের দোতলায় ভাল একটা রেস্তরাঁ আছে। কয়েকদিন আগেই বারাসাত থেকে ফেরার সময় আমি আর ফুল্লরা ওখানে ডিনার করতে ঢুকেছিলাম। সেই রেস্তরাঁয় ঢুকলাম। রাতের দিকে এই সময়টায় রেস্তরাঁ প্রায় ফাঁকা। কোণের দিকে একটা জায়গায় সুদীশ আগে থেকেই বসে ছিল। ওর উলটো দিকের চেয়ারে গিয়ে বসলাম। কফি খেতে খেতে প্রায় আধঘণ্টা ধরে কোহিনুর উদ্ধার নিয়ে পুরো ঘটনাটা ওকে বলতেই সুদীশ গুম হয়ে গেল। তারপর বলল, ”কালকেতু, অ্যাসাইনমেন্টটা নিয়ে তুই খুব বুদ্ধিমানের কাজ করিসনি। এ নিয়ে পরে গণ্ডগোল হতে পারে।”

বললাম, ”সে রিস্ক আছে আমি জানি। কিন্তু এতটা এগিয়ে এখন আর পিছিয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। তোর প্রচণ্ড হেলপ আমার দরকার।”

”এসেছি যখন, তখন ফিরে যাওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই। কিন্তু কাজটা করবি কী করে? কোশ্চেন নাম্বার ওয়ান, যে দুই অফিসার আসবেন তাঁদের আইডেন্টিফাই করবি কী করে? কোশ্চেন নাম্বার টু, ঠিক কোন জায়গাটা থেকে অপারেশন হবে, সে সম্পর্কে আগে থেকে পরিষ্কার একটা ধারণা থাকা প্রয়োজন। কোশ্চেন নাম্বার থ্রি, মাসল বা আর্মস পাওয়ার অ্যাপ্লাই করা চলবে কি না? কোশ্চেন নাম্বার ফোর, আফটার অপারেশন হোয়াট? কোশ্চেন নাম্বার…”

ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ”দাঁড়া, দাঁড়া, এইজন্যই তো তোর হেলপ চাই। এয়ার ইন্ডিয়ায় আমার এক বন্ধু আছে ভাস্কর রায়চৌধুরী। এখানে কাউন্টারে আজ থাকার কথা। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে ওর সঙ্গে কথা বলে এসেছি। রয়াল আর্মি ফোর্সের দুই অফিসারের নাম ওকে আমি দিয়ে রেখেছি। ফ্লাইটে কারা কারা আসছে তাদের একটা চার্ট ভাস্করদের কাছে থাকবেই তাই লোক দু’টোকে ও আলাদা করে চিনিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। আমি না, লোক দুটোকে ট্রেইল করবি তুই। কেননা কেউ তোকে চেনে না।”

”সে না হয় হল, ধর, ট্রানজিট প্যাসেঞ্জারদের যদি এয়ার ইন্ডিয়া সেন্ট্রাল ক্যালকাটার কোনও হোটেলে নিয়ে গিয়ে রাখে তা হলে?”

”সে খবরটাও ভাস্করের মারফত আগেই পেয়ে যাব। তবে ও বলল, ফ্লাইটের মাঝে তিন—চার ঘণ্টার ব্যবধান থাকলে নর্মালি প্যাসেঞ্জারদের ওরা দূরে কোথাও নিয়ে যায় না। ভি আই পি রোডে দুর্দান্ত একটা গেস্ট হাউস লিজ নিয়েছে এয়ার ইন্ডিয়া। ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার কম থাকলে ওরা ওখানে নিয়ে গিয়ে তোলে। রাতের দিকে ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টরাও কোনও কোনও সময় ডিউটি সেরে ওখানে বিশ্রাম নিতে চলে যায়। আমার মনে হচ্ছে ব্রিটেনের দুই আর্মি অফিসারকে ওরা ওই গেস্ট হাউসেই তুলবে।”

”তা যদি হয়, ভাল।” হাতঘড়িতে সময়টা দেখে সুদীশ তারপর বলল, ”এয়ার ইন্ডিয়ার কাউন্টারে গিয়ে আমি ভাস্করের সঙ্গে আলাপ করে নিচ্ছি। একটু পরে ঘুরতে ঘুরতে তুই ওখানে আয়। লোকে যেন মনে করে তুই একজন প্যাসেঞ্জার।”

”ঠিক আছে।”

সুদীশ উঠে নীচে নেমে গেল। আমিও কয়েক মিনিট পরে কফির দাম চুকিয়ে রেস্তরাঁ থেকে বেরিয়ে এলাম। নীচের লাউঞ্জে প্রচুর লোক বসে। এদের মধ্যে কে আমার পিছু নিয়েছে বোঝা মুশকিল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে লোকগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম। না কারও মাথাব্যথা নেই আমাকে নিয়ে। সিঁড়ি থেকেই দেখলাম, ইন্টারন্যাশনাল এরিয়ার গেটের সামনে এয়ারপোর্ট অথরিটির গার্ড দাঁড়িয়ে। প্রায় দশ—বারোজন। বিদেশে যাওয়ার জন্য বহুবার ওই গেট দিয়ে ভিতরে গেছি। কখনও এত গার্ড একসঙ্গে দেখিনি। দু’তিনজনের বেশি কখনওই থাকে না। আজ সিকিউরিটির এত কড়াকড়ি কেন? তা হলে কি এয়ারপোর্ট অথরিটির লোকজন জানে, এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইটে একটা মহার্ঘ জিনিস নিয়ে দু’জন আসছেন। তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।

সিঁড়ির শেষ ধাপে পা রাখতেই পকেটে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। তাড়াতাড়ি সুইচ টিপে এক কোণে সরে গেলাম। শানু দত্তের গলা, ”মিঃ নন্দী, প্রবলেম হয়ে গেছে।”

”কী প্রবলেম?”

”নূরজাহানকে নিয়ে ওরা মুম্বই এয়ারপোর্টে নেমে গেছে। শেষ মুহূর্তে ওরা এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইটে না এসে, জুরিখ থেকে ওঠে সুইস এয়ারের ফ্লাইটে। আমার এজেন্সি এইমাত্র খবর দিল, ওরা মুম্বই হয়েই হংকং যাচ্ছে। ব্যাড লাক। রিয়েলি ব্যাড লাক।”

খবরটা শুনে আমি একেবারে দমে গেলাম। কোনওরকমে বললাম, ”তা হলে তো কোনও চান্সই নেই নূরজাহানকে উদ্ধার করার। আমি এখন এয়ারপোর্টে। এখান থেকে ফিরে যাচ্ছি। ভাল কথা, আপনি এখন কোথায়?”

”তাজ বেঙ্গলে। রুম নাম্বার ওয়ান সিক্স টু নাইনে। ইন ফ্যাক্ট, আমি একা নেই। জিনিসটা পাওয়া যাবে ভেবে প্রিয়ব্রতও এখানে হাজির হয়েছিল। একটা জবর সেলিব্রেশন করা যাবে বলে। কিন্তু লাক খারাপ। এখন তো আর বাড়ি ফিরতে পারবে না। রাত্তিরটা এখানেই কাটিয়ে যাবে।”

”ঠিক আছে। কাল সকালে কথা হবে তা হলে।”

”ও কে।” বলেই ফোনটা ছেড়ে দিলেন শানু দত্ত। গলা শুনে মনে হল, ভদ্রলোক ভয়ানক আপসেট হয়ে পড়েছেন। হাতঘড়িতে দেখলাম, প্রায় পৌনে একটা বাজে। এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট নামবে আর পনেরো মিনিট পর। কিন্তু কী হবে আর অপেক্ষা করে? বেচারি সুদীশ এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে ইনটারন্যাশনাল এরিয়ায় এয়ার ইন্ডিয়ার কাউন্টারের সামনে। ওকে ফালতু এতদূর টেনে আনলাম। মনে মনে অপরাধবোধ হতে লাগল। এক সেকেন্ডের মধ্যেই ঠিক করে নিলাম, সুদীশকে বাড়ি পৌঁছে তারপর গলফ গ্রিনে যাব।

প্রেস কার্ড দেখিয়ে ইন্টারন্যাশনাল এরিয়ায় ঢুকতেই আমাকে দেখে সুদীশ হাসিমুখে এগিয়ে এল। তারপর একপাশে নিয়ে বলল, ”লোক দু’টো এই ফ্লাইটেই আছে। তোর নাম করে নিজেই তোর বন্ধু ভাস্করের সঙ্গে আলাপ করে এসেছি। চেক করে ও এইমাত্র আমাকে খবরটা দিয়ে গেল। জুরিখ থেকে ওদের কাছে ইনস্ট্রাকশন এসেছে প্যাসেঞ্জার বি ডেভিড আর সি নর্মানকে যেন ভি আই পি সিকিউরিটি দেওয়া হয়। ওরা ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের বিশেষ দূত হিসেবে হংকং যাচ্ছে।”

কী আজেবাজে কথা বলছে সুদীশ! ও কি জানে, লোক দুটো অলরেডি মুম্বাইয়ে নেমে গেছে?

রাত একটার সময় এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট টারম্যাকে নামার সঙ্গে সঙ্গে ভাস্কর আমাদের দু’জনকে অ্যারোব্রিজ পর্যন্ত নিয়ে গেল। ওর হাতে একটা প্ল্যাকার্ড, ট্রানজিট প্যাসেঞ্জারদের তিন নম্বর লাউঞ্জে যেতে বলা হচ্ছে। যাত্রীরা একে একে বেরিয়ে আসছেন। আমরা দু’জন দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি। মিনিটদশেকের মধ্যেই মোট পাঁচজন ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার তিন নম্বর লাউঞ্জে গিয়ে বসলেন। দু’জন ব্রিটিশ, একজন জাপানি, একজন মালয়েশিয়ান আর একজন আরব।

অন্য কাউকে আমাদের প্রয়োজন নেই। আমাদের দরকার কুক আর বল— কে। ওদের একবার দেখিয়ে দিয়েই ভাস্কর কাউন্টারে ফিরে গেল। আমরা দু’জনও ওর পিছু পিছু নীচে নেমে এলাম। কাউন্টারে বসে ভাস্কর আমাকে বলল, ”এঁদের আমরা মিনিট কুড়ির মধ্যে গেস্ট হাউসে নিয়ে যাচ্ছি। তোরা আগেই ওখানে চলে যা। আমার জন্য একটা রুম বুক করা আছে। টু সি। ওখানকার কেয়ারটেকারকে ফোন করে দিচ্ছি। ছেলেটা তোর লেখার খুব ফ্যান। তোকে দেখলেই খুব খাতির করবে। আমাদের ফ্লাইট এখান থেকে দিল্লি চলে গেলেই আমার ডিউটি শেষ। আমি ভোর চারটের মধ্যে গেস্ট হাউসে পৌঁছে যাচ্ছি।”

ভি আই পি রোডের ওপর দিয়ে গাড়ি চালাতে—চালাতেও আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না, যাঁদের দেখে এলাম তাঁরাই ক্যাপ্টেন বল আর কুক কি না? শানু দত্তের সোর্স খবর দিল একরকম, আর ঘটনা ঘটছে অন্যরকম—কী করে হয়? সুদীশই আমাকে তখন বলল, ”এ নিয়ে এত চিন্তা করার কী আছে? টপ সিকিউরিটির ক্ষেত্রে এরকম অদলবদল যখন—তখন হয়। আমরাও করি। দ্যাখগে, হয়তো তিনটে রুটে তিনটে ফ্লাইটে ওই দু’জনের টিকিট কেটে রাখা হয়েছিল। ঠিক কোন ফ্লাইটে ট্রাভেল করবে ক্যাপ্টেন বল আর কুক নিজেরাও সম্ভবত জানত না। লোক দুটো যে জেনুইন, তাতে আমার কোনও সন্দেহ নেই। একটাই ভয়, জিনিসটা ওঁরা ক্যারি করছেন কি না? প্রথমে হয়তো ঠিক ছিল, ওঁরা কোহিনুর নিয়ে আসবেন। পাছে খবরটা ফাঁস হয়ে ওঁদের পেছনে লোক লেগে যায়, সেজন্য সিদ্ধান্ত বদলে অন্য কারও হাত দিয়ে জিনিসটা পাঠানো হতে পারে। চল তো গেস্ট হাউসে। লাক ট্রাই করা যাক।”

গেস্ট হাউসে পৌঁছে আমরা একটু অবাক হয়ে গেলাম। যেন ছোট্ট একটা ফাইভ স্টার হোটেল। এর পাশ দিয়ে কতবার গেছি। ভাবতেও পারিনি এখানে এত সুন্দর একটা গেস্ট হাউস আছে। সুইমিং পুলের পাশ দিয়ে মেন বিল্ডিংয়ে পৌঁছতেই বেরিয়ে এল আমার সমবয়সী একটা ছেলে। খুব হ্যান্ডসাম। এয়ার ইন্ডিয়ার পোশাক পরা ছেলেটি বলল, ”আসুন কালকেতুদা। আমার নাম তীর্থঙ্কর। টিভিতে আপনাকে বহুবার দেখেছি। একটু আগেই ভাস্করদা ফোন করে আমাকে আপনার কথা জানিয়েছে। আপনারা টু সি—তে গিয়ে বসুন। আমি প্যাসেঞ্জারদের অ্যাটেন্ড করেই আসছি।”

টু সি রুমটা দোতলায়। জানলার পরদা ফাঁক করে একটু পরেই দেখলাম, লাক্সারি বাসে করে পাঁচজন যাত্রী নামলেন। ক্যাপ্টেন বল আর কুককে সঙ্গে নিয়ে তীর্থঙ্কর ভেতরে ঢুকে এল। জানি না, ওদের কোন ঘরে রাখা হবে। আমি জানালা থেকে সরে এসে সোফায় বসলাম। একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু এটা তো ঘুমোনোর সময় নয়। আমাকে যা কিছু করার আর এক—দেড় ঘণ্টার মধ্যে করতে হবে।

সুদীশ পরদা ফাঁক করে বাইরে কিছু দেখছিল। হঠাৎ বলল, ”কালকেতু, আমাদের পেছনেও কিন্তু লোক লেগে।”

সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ”কী করে বুঝলি?”

”ঘরের আলোটা নিভিয়ে দে। তারপর এখানে এসে দ্যাখ, গেস্ট হাউসের উলটো দিকের রাস্তায় একটা কালো অ্যাম্বাসাডর দাঁড়িয়ে আছে।”

পরদার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখি সেই অ্যাম্বাসাডর, যেটা আমার বাড়ি থেকে আমার পিছু নিয়েছিল। আমার মুখে উদ্বেগের ছাপ দেখে সুদীশ বলল, ”চিন্তা করিস না। আগে কোহিনুর সমস্যার সমাধান করি তারপর এই এদের শায়েস্তা করব।”

জানালার সামনে থেকে সরে এসে বিছানায় টানটান হলাম। পাশের ঘরেই লোক দুটো রয়েছে। ওদের কাছে বিশ্বের সব থেকে মহার্ঘ হিরে থাকলেও থাকতে পারে। শাহজাহান যার নাম দিয়েছিলেন জগতের বিস্ময়। এইরকম একটা জিনিস নিজের চোখে দেখতে পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার। চোখ বুজে ভাবতে লাগলাম, বিশ্বের ক’টা বিস্ময় নিজের চোখে দেখার সুযোগ পেয়েছি? তাজমহল। দেখেছি। আগ্রায় একবার ফুটবল টুর্নামেন্ট করতে গিয়েছিলাম বছর পনেরো আগে। তখন দেখেছি। তাও ভরা পূর্ণিমার রাতে। সারা জীবন মনে রাখার মতো একটা অভিজ্ঞতা। এখন অবশ্য রাতের দিকে তাজমহলের কাছাকাছি যেতে দেওয়া হয় না। বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় প্যারিসে গিয়ে প্রাণভরে রোজ ইফেল টাওয়ার দেখেছি। আমেরিকায় গিয়ে এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের চেয়েও বড় বাড়ি দেখেছি। সেই সঙ্গে স্টাচু অব লিবার্টি। প্লেনে করে যাওয়ার সময় দেখেছি গ্র্যান্ড ক্যানিয়নও।

আর কী কী দেখেছি মনে করার আগেই, ঘরে খুট করে একটা শব্দ। শিকারি বেড়ালের মতো ঘরে ঢুকল সুদীশ। চাপা গলায় বলল, ”অপারেশনের সব ব্যবস্থা করে এলাম। আর মিনিট পনেরোর মধ্যেই আমাদের অ্যাকশনে নামতে হবে।”

চোখ বন্ধ করে আমি যখন স্ট্যাচু অব লিবার্টির কথা ভাবছি তখন বোধহয় ঘর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে গিয়েছিল সুদীশ। ক্যাপ্টেন বল আর কুককে কবজা করার কোনও একটা ব্যবস্থা করে এসেছে। জিজ্ঞেস করলাম, ”কী করে এলি?”

”সাহেব দু’জন কফির অর্ডার দিয়েছে। কফি নিয়ে পাশের সুইটে ঢুকব তুই আর আমি। তারপর অ্যাকশন। লাক ফেভারে থাকলে কোহিনুর তুই পেলেও পেয়ে যেতে পারিস।”

সুদীশ বসে থাকার মানুষ নয়। পরদা সামান্য ফাঁক করে বাইরে রাস্তার দিকে উঁকি মেরে বলল, ”কালকেতু, অ্যাম্বাসাডরের লোকগুলোকে বেশ বদমাশ বলে মনে হচ্ছে। গাড়িটা দেখতে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে আমরা যে কারণে এসেছি, ওরাও সেই কারণে আমাদের পিছু নিয়েছে।”

তা হলে কোহিনুরের কথা কলকাতায় আরও কয়েকজন জানে। কী করে জানল? চিন্তা করতে লাগলাম। তথাগত ছাড়া আমি কাউকে বলিনি। ও এত বিশ্বস্ত যে, এ নিয়ে কাউকে কিছু বলবেই না। ফট করে মাথায় এল, আজ সকাল থেকে তথাগতর কিন্তু পাত্তা নেই। গেল কোথায় ছেলেটা? এরকম তো হয় না। বিকেলে ওর যোগাযোগ করার কথা ছিল আমার সঙ্গে। তা হলে কি কোনও মিসহ্যাপ হল? বিছানায় উঠে বসে মোবাইল ফোনে ওর নাম্বারটা ধরলাম। এত রাতে কারও বাড়িতে ফোন করা উচিত নয়। কিন্তু উপায় নেই।

আশ্চর্যের ব্যাপার, দু’—চারবার রিং হতেই ফোন তুললেন তথাগতর মা। আমার গলা শুনেই উনি উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, ”টুবলু তোমার সঙ্গে নেই?”

টুবলু তথাগতর ডাকনাম। বললাম, ”না। কখন বেরিয়েছে ও?”

”সেই সক্কালবেলায়। বলল, কী একটা দরকার আছে। কালকেতুদার সঙ্গে এখুনি গিয়ে দেখা করতে হবে। সারা দিনে আর কোনও পাত্তা নেই। তুমি তো আমায় চিন্তায় ফেলে দিলে বাবা।”

মনে মনে বিব্রত হলেও বললাম, ”চিন্তা করবেন না মাসিমা, আমি খোঁজখবর করে দেখছি।”

ওদিক থেকে মাসিমা বললেন, ”খবর পেলে আমাকে জানিও বাবা। ওর জন্যই আমি এত রাত্তির অবধি জেগে বসে রয়েছি।”

ফোন ছেড়ে দিতেই সুদীশ বলল, ”চল বেরিয়ে পড়া যাক। তীর্থঙ্কর দরজায় টোকা মেরে গেছে। তার মানে, কফির ট্রলি রেডি।”

তথাগতর চিন্তা মাথায় রাখার সময় নেই। মুহূর্তের মধ্যে সারাটা শরীর চনমন করে উঠল। এই সেই চূড়ান্ত সময়। ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আমাদের একটা জাতীয় সম্পত্তি ফের আমাদের হাতে ফিরে আসবে। মনটা প্রস্তুত করে আমরা দু’জন বাইরে বেরিয়ে এলাম।

১০

ইংরেজিতে একটা কথা আছে, হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ। কথাটা যে কতটা সত্যি, হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। কফির ট্রলি নিয়ে গেস্ট হাউসের টু বি ঘরের দরজায় টোকা মারতেই গম্ভীর গলা শুনতে পেলাম, ”কাম ইন।”

সুদীশের পিছু পিছু দরজা পেরোতেই ঘরের সাইজ দেখে অবাক হয়ে গেলাম। বিশাল সুইট। বোধহয় এই সুইটটা এয়ার ইন্ডিয়ার টপ লেভেলের অফিসারদের জন্য। সোফায় আধশোয়া অবস্থায় একজন বসে। এই লোকটা কুক না বল, জানা সম্ভব না। ছ’ ফুটের ওপর লম্বা, সলিড স্বাস্থ্য। বয়স চল্লিশের নীচে। এর সঙ্গে গা—জোয়ারি করতে যাওয়া মানে বোকামি। অন্যজন কোথায় গেল? একটু পরেই বুঝতে পারলাম। বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল। এই লোকটার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। কলকাতার গরম টের পাচ্ছে। দু’জনেই কোট খুলে ফেলেছে।

সুদীশ চোস্ত ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, ”আমরা কফি বানিয়ে দেব, না কি আপনারা ইচ্ছেমতো বানিয়ে নেবেন সার?”

সোফায় বসে থাকা লোকটা বলল, ”আমরা খুব টায়ার্ড। তুমি দু’কাপ বানিয়ে দাও।”

সুদীশ মন দিয়ে কফি বানাচ্ছে। আমি দ্রুত ঘরের চারপাশে চোখ বোলাচ্ছি। ঘরে ঢোকার আগে আমরা ঠিক করে নিয়েছি বলপ্রয়োগের মধ্যে যাব না। ওদের কেউ আহত হলে কেলেঙ্কারির মধ্যে জড়িয়ে পড়ব। বিদেশি নাগরিক। ইন্টারন্যাশনাল নিউজ হয়ে যাবে। তাতে বড় ঝুঁকি। শানু দত্ত যতই বলুক দেশের প্রতি কর্তব্য, গভীর রাতে গেস্ট হাউসে দুই বিদেশি নাগরিকের ঘরে জবরদস্তি ঢোকাটাই ক্রিমিনাল অফেন্সের পর্যায়ে পড়ে। তাতে আমাদের মতো লোকের নাম জড়িয়ে পড়াটা কোনওমতেই বাঞ্ছনীয় নয়।

সুদীশ দু’কাপ কফি বানিয়ে বলল, ”ইট’স রেডি সার। শ্যাল উই লিভ নাউ?”

একজন বলল, ”ও কে। বাট গিভ আস আ ওয়েকিং কল অ্যাট সিক্স ইন দ্য মর্নিং।”

”সার্টেনলি সার। ইফ ইউ নিড এনিথিং প্লিজ কল আস।” কথাটা বলেই সুদীশ দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল। আমি একটু অবাকই হয়ে গেলাম। কোনও অ্যাকশনই তো করা হল না। এমন একটা সুযোগ আমরা আর পাব? বাইরে বেরিয়ে প্রশ্নটা করতেই সুদীশ বলল, ”আধঘণ্টা পর ফের ঢুকব। তখন ওরা গভীর ঘুমে। কফির সঙ্গে এমন ঘুমের ওষুধ মিশিয়েছি, সোফা থেকে বাছাধনদের আর বিছানায় যেতে হবে না।”

এত রাতে ও কোত্থেকে ঘুমের ওষুধ জোগাড় করল, কে জানে? সম্ভব, সুদীশের পক্ষে সবই সম্ভব। তাই কোনও প্রশ্ন না করে ফের টু সি—তে এসে ঢুকলাম। রাত প্রায় আড়াইটে। গভীর ঘুমে নিদ্রিত কলকাতার মানুষ। ঠিক এই সময়টায় ভি আই পি রোডের একটা গেস্ট হাউসে কী নাটক হয়ে যাচ্ছে, কারও পক্ষে আন্দাজ করা সম্ভব না। ঘরের ঠান্ডা বাতাসে হঠাৎ ক্লান্তি লাগল। এই সময় এক কাপ কফি পেলে ভাল হত। কতক্ষণ থাকতে হবে জানি না। এও জানি না, আদৌ ওই দুই ইংরেজ কোহিনুর সঙ্গে এনেছেন কী না। যদি আনেনও এবং সেটা আমরা কুক্ষিগত করি, তারপর সেটাকে নিয়ে কী করব তাও জানি না। এত রাতে তাজবেঙ্গলে যাওয়া সম্ভব নয়। হয়তো ওই মহামূল্য মণিটা আমার ফ্ল্যাটেই নিয়ে যেতে হবে। মনে মনে ভেবে রাখলাম, বাড়িতে নিয়ে গেলে একটা ছবি তুলিয়ে রাখতে হবে সুদীশকে দিয়ে। থাকবে একটা স্মৃতিচিহ্ন। ভবিষ্যতে যদি কোনওদিন আত্মজীবনী লিখি তা হলে একটা চ্যাপ্টার নিশ্চয়ই লিখব এই কোহিনুর নিয়ে।

সুদীশ টিভি চালিয়ে দিয়েছে। অ্যাকশন চ্যানেলে একটা মারকাটারি সিনেমা চলছে। ও মন ডুবিয়ে দিয়েছে পরদায়। যত ওকে দেখি তত আশ্চর্য হয়ে যাই। এত কম সময়ের মধ্যে ও মনটাকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে কী করে? আমি জানি এখন ওর মাথায় আর কোহিনুর নেই। ফিল্মের হিরোর জায়গায় ও নিজেকে বসিয়ে নিয়েছে। আর দুষ্টের দমন করে চলেছে মনে মনে। পাশের সুইটে দুটো লোক যদি ঘুমের ওষুধে কাবু না হয়, আমি জানি, তা হলে ও গায়ের জোরে ওদের বশ করবে। এবং যতক্ষণ না কোহিনুর উদ্ধার করবে, শান্ত হবে না।

দরজায় টকটক শব্দ। তীর্থঙ্কর হাজির। সুদীশকে একটা চাবি এগিয়ে দিয়ে বলল, ”এই নিন মশাই। মাস্টার কি। এমন কিছু করবেন না, যাতে আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি হয়।”

চাবিটা দিয়েই ছেলেটা চলে গেল। সুদীশ চাবিটা লুফে নিয়ে বলল, ”চল কালকেতু, ফাইনাল অ্যাকশন করে আসা যাক।”

দু’জনে বাইরে বেরিয়ে এলাম। লম্বা করিডর ফাঁকা। সুদীশ মাস্টার কি দিয়ে খুব সাবধানে টু বি—র দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। মিনিটদশেক আগে ঘরে উজ্জ্বল আলো দেখে গিয়েছিলাম। এখন কম পাওয়ারের নীল আলো জ্বলছে। আবছা আলোয় দেখলাম, বিছানায় একজন পাশ ফিরে শুয়ে আছেন। অন্যজন সোফার ওপরই আধশোয়া। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সুদীশ আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর বলল, ”মালপত্র নিয়ে তো এরা আসেনি। অ্যাটাচি কেস হাতে করে ঢুকেছে। এগুলোই আগে ওপেন করা যাক।”

পুলিশের লোক, ওরা অনেক কিছু পারে। টেবিলের উপর অ্যাটাচি কেস দুটো রেখে সুদীশ তার একটা খোলার চেষ্টা করতে লাগল। আর আমি চোখ বোলাতে লাগলাম, অন্য কোথাও জিনিসটা পাওয়া যেতে পারে কী না। লোক দুটো যখন গেস্ট হাউসে ঢোকে তখন ওদের গায়ে কোট ছিল। কী মনে হল, ওয়ারড্রোবের দরজাটা হঠাৎ খুললাম। পাশাপাশি দুটো কোট জোলানো। ওয়ারড্রোব থেকে একটা কোট বাইরে বের করে পকেটে হাত দিতেই বুকের ভেতরটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠল। ছোট্ট একটা বাক্স। হাতির দাঁতের অসাধারণ কারুকার্য। বাক্স খুলতেই চোখটা ঝলসে গেল।

আমার হাতের মধ্যে ঝলমল করছে সেই আশ্চর্য কোহিনুর। অবিশ্বাস্য! সঙ্গে—সঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল জন লরেন্সের কথা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেই কর্মচারী, মহারানি ভিক্টোরিয়ার কাছে পাঠানোর আগে, যাঁর কাছে এই অমূল্য সম্পদ গচ্ছিত রেখেছিলেন লর্ড ডালহৌসি। দেড়শো বছর আগে সেদিনও লরেন্স তাঁর কোটের পকেটে অবহেলায় ফেলে রেখেছিলেন কোহিনুর।

হিরের দ্যুতি দেখে আমি বাকরহিত হয়ে গেলাম। এই সেই কোহিনুর, যাকে নিয়ে এত গল্পকথা। ইতিহাসের এত বিশিষ্ট চরিত্র সব জড়িয়ে! রত্ন—গবেষকদের অনেকেরই ধারণা, এটাই মহাভারতের অর্জুনের স্যমন্তক মণি। মনে পড়ে গেল, সেই ব্রোশিয়োরে পড়েছিলাম, কোহিনুর বিক্রি করে যা অর্থ পাওয়া যেতে পারে, তা দিয়ে নাকি সারা পৃথিবীর সব লোককে আড়াই দিন ভুরিভোজ করানো যেতে পারে।

আমার হাতের তালুর ওপর কোহিনুর। আশপাশ ভুলে মুগ্ধ বিস্ময়ে তার দিকে আমি তাকিয়ে রয়েছি। আলোর রোশনাই চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। গোড়ার দিকে এই হিরেটার নাম ছিল ‘বাবর’স ডায়মন্ড’। পারস্যসম্রাট নাদির শাহ—ই এর নাম দেন ‘কোহ—ই—নূর’। আড়াইশো বছর আগে তাঁর কাছে এটা পৌঁছয় অদ্ভুতভাবে। যুদ্ধে মোগল সম্রাট মহম্মদ শাহকে হারিয়ে দিলেন নাদির শাহ। দিল্লিতে অবাধ লুটপাট চালালেন। মোগল সম্রাটের কোষাগার তিনি খালি করে দিলেন।

অমাত্যদের একজন তখন বললেন, ”আপনি তো আসল জিনিসটাই পাননি।”

নাদির শাহ জিজ্ঞেস করলেন, ”সেটা কী?”

অমাত্য বললেন, ”বাবরের হিরে। পারেন তো সেটা জোগাড় করে দেশে নিয়ে যান। সেটাই আপনার ভারত—জয়ের প্রতীক হয়ে থাকবে।”

নাদির শাহ বললেন, ”কোথায় আছে সেই হিরে?”

অমাত্য জানালেন, ”সম্রাট মহম্মদ শাহ সেটা লুকিয়ে রেখেছেন তাঁর মুকুটের মধ্যে।”

নাদির শাহ তখন চালাকির আশ্রয় নিলেন। যুদ্ধের পর দুই সম্রাট মুখোমুখি হয়েছেন। নাদির শাহ বললেন, ”নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করার আগে, আসুন আমরা পরস্পরের মুকুট বদলাবদলি করি। এটা আমাদের দেশের পুরনো একটা রীতি।” মহম্মদ শাহ তখন আর কী—ই বা করবেন। নিজের মুকুট দিলেন নাদির শাহের হাতে। ভারত থেকে কোহিনুর মণি এই ভাবেই চলে যায় পারস্যে।

হঠাৎই মনে হল, নাদির শাহ—র সেই অমাত্যই ঠিক। তাজমহল নয়, ভারতের প্রতীক বলতে যদি কিছু থাকে তা হলে তা এই মণি। কোহিনুর মণি।

কোহিনুর দেখতে দেখতে আমার মুখ থেকে বোধহয় কোনও বিস্ময়সূচক শব্দ বেরিয়ে এসেছিল। সেটা শুনে সুদীশ ঘুরে তাকাল। ”ওয়াও” বলে এক লাফে ও আমার কাছে চলে এল। বাক্স থেকে কোহিনুর মণিটা সন্তপর্ণে বের করে চোখের সামনে তুলে সুদীশ বলল, ”এটার কত দাম রে?” তারপরই ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এল সেই অবধারিত প্রশ্নটি, ”এই হিরেটা বিক্রি করলে বাতিস্তুতাকে কি ইস্টবেঙ্গলে আনা যাবে?”

ওইরকম একটা পরিস্থিতিতেও আমার হাসি পেয়ে গেল। বাঙাল, সর্বত্রই বাঙাল। বললাম, ”এই হিরেটা বিক্রি করলে বাতিস্তুতাকে এক সিজনের জন্য নয়, সারা জীবনের জন্য তুই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে রেখে দিতে পারবি। চল, আর দেরি করা ঠিক হবে না।”

সুদীশ ছোট ছেলের মতো আবদার ধরল, ”একটু দাঁড়া। এটা নিয়ে একটু লোফালুফি খেলি।” বলেই ও মণিটা নিয়ে লোফালুফি খেলতে শুরু করল। তা দেখে আমি হাসতে লাগালাম।

”হু’জ দেয়ার?”

জলদগম্ভীর গলায় প্রশ্নটা ভেসে আসতেই মুখের হাসি শুকিয়ে গেল। দ্রুত জানলার ভারী পরদার পেছনে লুকিয়ে পড়লাম। পরদার সামান্য ফাঁক দিয়ে দেখলাম, বিছানায় পাশ ফিরে যিনি ঘুমোচ্ছিলেন, তিনি উঠে বসেছেন। এক সেকেন্ডের মধ্যে ঘরটা আলোর বন্যায় ভেসে গেল। সুদীশ ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। একটু আগে ও কোহিনুর নিয়ে লোফালুফি খেলছিল। সেটা এখন ওর হাতে নেই।

বিছানা থেকে লাফ মেরে লোকটা সুদীশের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে রিভলভার। খুব রুক্ষভাবে লোকটা জিজ্ঞেস করল, ”এত রাতে তুমি কী করছ?”

সুদীশ খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, ”কফি পট নিয়ে যেতে এসেছি সার।”

লোকটা বলল, ”দাঁড়াও, দাঁড়াও। তুমি ঘরে ঢুকলে কী করে?”

”দরজা দিয়ে।”

সুদীশের উত্তরটা শোনার পরই আমার চোখ গেল কফির কাপ আর পটের দিকে। এতক্ষণ লক্ষ করিনি। একটা কাপে কফি যেমন ছিল তেমনই পড়ে রয়েছে। এর মানে এই লোকটা চুমুকই দেয়নি। তাই ঘুমের ওষুধ কোনও কাজেই লাগেনি। ঘরে ঢোকার পর আমাদের খেয়াল করা উচিত ছিল। বোকামি হয়ে গেছে। চূড়ান্ত ছেলেমানুষি হয়ে গেছে। কোহিনুর হাতে পাওয়ার পর চুপচাপ আমাদের বেরিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। এখন এই লোকটা যদি হইচই বাধায় তা হলে কেলেঙ্কারির একশেষ হবে।

লোকটা সুদীশের আরও কাছে এসে বলল, ”হ্যান্ডস আপ।” তারপর এক হাতে রিভলভারটা তাক করে রেখেই অন্য হাতে সুদীশের শরীরে তল্লাশি শুরু করল। আমি নিশ্চিত, কোমরে হাত দিলেই টের পেয়ে যাবে পিস্তল আছে। লোকটা বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। বুঝতে পারছি না, পরদার আড়াল থেকে বেরিয়ে গিয়ে লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব কী না। এই সময় বলপ্রয়োগ করতে গেলেই খুনোখুনির সম্ভাবনা যথেষ্ট। সেটার ফল মোটেই ভাল হবে না।

লোকটা কোমরে হাত দেওয়ার আগেই সুদীশ ডান হাতটা হাতুড়ির মতো করে তুলল। পলকের মধ্যে তা নামিয়ে আনল লোকটার কাঁধ আর ঘাড়ের মাঝা—মাঝি। এ সব মারগুলোতে সুদীশ সম্ভবত পি এইচ ডি করেছে। কলকাতার ক্রিমিনালরা এই কারণেই ওকে এত ভয় খায়। এত দ্রুত আঘাতটা সুদীশ করল যে লোকটা ট্রিগার টেপার সময়ও পেল না। ওর গায়ে অসম্ভব জোর। এর আগে বেশ কয়েকটা ঘটনায় তার প্রমাণ পেয়েছি। লোকটা হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। মেঝেতে শরীরটা দুমড়ে গেছে। কয়েক সেকেন্ড নড়াচড়া করে লোকটা হাত—পা ছড়িয়ে দিল। সেদিকে তাকিয়ে সুদীশ বলল, ”ঘণ্টাখানেকের জন্য নিশ্চিন্দি। বাছাধনকে আর উঠতে হচ্ছে না।”

১১

টু সি—তে ঢুকেই সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলাম তাজবেঙ্গলে রুম নাম্বার ওয়ান সিক্স টু নাইনে। বেশ কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ফোন ধরলেন শানু দত্ত। শুধু বললাম, ”নূরজাহানকে পাওয়া গেছে। এটা এখন আমার কাস্টডিতে। কী করব বলুন?”

প্রায় পনেরো সেকেন্ড চুপ করে থেকে শানু দত্ত চিৎকার করে বললেন, ”কী বলছেন কী মশাই? এক্ষুনি আমার কাছে চলে আসুন। আমি লাউঞ্জে আপনার জন্য অপেক্ষা করব।”

বললাম, ”এখন এয়ারপোর্টের কাছাকাছি আছি। আলিপুর যেতে আমার পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিট লাগবে। তাহলে আসছি।”

সুদীশ বাথরুমে ঢুকেছে। চোখ—মুখে জল দেওয়ার জন্য। ঘরে ওর জন্য অপেক্ষা করছি, এমন সময় দরজায় নক করার শব্দ। বোধহয় তীর্থঙ্কর। কোহিনুরের বাক্সটা তাড়াতাড়ি পকেটে পুড়ে দরজাটা খুলতেই দেখি, অবনীমোহনবাবু। এক নজরেই চিনে ফেললাম। তাঁর পাশে শিবসাগর সিংহ, দলিপ সিংহজির উত্তরাধিকারী। এঁরা দু’জন এই রাতে? জানলেনই বা কী করে আমরা এখানে আছি? আমি কোনও কথা বলার আগেই ঘরের ভেতর ঢুকে অবনীমোহনবাবু বললেন, ”দিন, জিনিসটা দিন, আমি জানি ওটা আপনার কাছে রয়েছে।”

শিবসাগরের হাতে রিভলভার দেখে অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমি পকেটে হাত দিলাম।

অবনীমোহনবাবুর চোখে কালো চশমাটা নেই। একটা চোখ গর্তে ঢুকে রয়েছে। সারা মুখে একটা ক্রুর ভঙ্গি। দেখেই বুঝলাম এই ভদ্রলোক কোহিনুরের জন্য আমাকে খুন করেও ফেলতে পারেন। মুখে অবশ্য মনের কথা প্রকাশ করলাম না। খুব স্বাভাবিক গলায় বললাম, ”অবনীমোহনবাবু, আপনি কিন্তু আমাকে খুব অবাক করলেন।”

বলেই পিছু হটে আমি সোফায় এসে বসলাম। এই সঙ্কটময় মুহূর্তে সবচেয়ে দ্রুত আমার মস্তিষ্কটা কাজ করে। সবাইকে ঘরের মধ্যে টেনে আনলাম একটাই উদ্দেশ্যে। বাথরুম থেকে বেরিয়েই যাতে সুদীশ বিনা বাধায় পেছন থেকে অ্যাকশনে নামতে পারে। অবনীমোহনবাবু বললেন, ”চালাকি করার চেষ্টা করবেন না কালকেতুবাবু। আমার লোক এ ক’দিন ছায়ার মতো আপনার পেছনে লেগে রয়েছে।”

বললাম, ”জানি।” তারপরই চোখে চোখ রেখে আন্দাজে ঢিল মারলাম, ”তথাগতকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন?”

”তাকে এইমাত্র ছেড়ে দিয়েছি। ছেলেটা আমার সম্পর্কে বড্ড বেশি খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছিল। গোথেনবার্গেও ফোন করেছিল। আমার সম্পর্কে বোধহয় একটু বেশিই জেনে ফেলেছিল। তাই ওকে একটু ভয় দেখানোর দরকার হয়ে পড়ল।”

”হঠাৎ ওকে ছেড়ে দিলেন কেন?”

”কারণটা বলার সময় এখন নেই। যাক, জিনিসটা বের করে দিন। ভোরের ফ্লাইটেই আমাকে দিল্লি চলে যেতে হবে।”

সুদীশটা এখনও বাথরুম থেকে বেরোচ্ছে না। এই দু’জনের সঙ্গে একা আমি পেরে উঠব না। শিবসাগরের হাতে রিভলভার আছে। যে—কোনও সময় চালিয়ে দিতে পারে। সুদীশ বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত আরও সময় নষ্ট করা দরকার। তাই বললাম, ”শানু দত্ত কিন্তু আমাদের অপেক্ষায় তাজ হোটেলে বসে রয়েছেন। উনি কি জানেন, কোহিনুর আপনি ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন?”

প্রশ্নটা শুনে হা হা করে হেসে উঠলেন অবনীমোহনবাবু। তারপর বললেন, ”কালকেতুবাবু, শানু দত্ত সম্পর্কে বোধহয় খুব একটা খোঁজখবর আপনারা নেননি। লোকটা একটা আস্ত শয়তান। আপনি এখন তাজবেঙ্গলে গেলে, জানেন লোকটা কী করবে?”

”কী করবে?”

”আপনি যেই হোটেলের বাইরে বেরোবেন, অমনি লোক দিয়ে আপনাকে মার্ডার করে দেবে। রিক ডেইল বলে একজন প্রফেশনাল মার্ডারারকে ও নিয়ে এসেছে বস্টন থেকে। ছেলেটা চোখের পলকে খুন করতে পারে। একটা ইন্টারন্যাশনাল গ্যাঙের সঙ্গে যুক্ত। কোহিনুর সম্পর্কে যাবতীয় খবরাখবর ওই দিয়েছে শানু দত্তকে। আপনি একবার তাজবেঙ্গলে যান। গিয়ে দেখবেন, হিরেটা হাতিয়ে নেওয়ার পর কী অর্ভ্যথনা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। শানু দত্ত এমন লোক, অপকর্মের কোনও প্রমাণ রাখবে না।”

অবনীমোহনবাবুর কথা শুনে মনে হচ্ছে, যা বলছেন, এক বর্ণও বানিয়ে বলছেন না। রিককে প্রথম দিনই সন্দেহ করেছিল তথাগত। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছি না, শানু দত্ত যদি একজন প্রফেশনাল এজেন্টকেই ভাড়া করে থাকেন, তা হলে আমাকে আবার এই দায়িত্বটা দিতে গেলেন কেন? ফালতু দশ লাখ টাকাই বা খরচ করতে গেলেন কেন? আরও একটা জিনিস মাথায় ঢুকছে না, কোহিনুর নিয়ে শানু দত্ত করবেনটা কী?

বললাম, ”তা হলে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে দেশকে কিছু উপহার দেওয়ার কথাটা ভাঁওতা।”

অবনীমোহনবাবু বললেন, ”অ্যাবসোলুটলি ভাঁওতা। ওয়েস্ট এশিয়ার একটা দেশের…নাম জানতে চাইবেন না…এক ধনকুবের শেখ, তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় এই মণিটা রাখতে চান। শানু দত্ত তাঁর জন্য কোহিনুর সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রথম দিকে আমিও ব্যাপারটা জানতাম না। রিক কলকাতায় উদয় হওয়ার পর জানতে পারি। সত্যি বলতে কী, শানু দত্তের ইচ্ছেয় আমি প্রথম থেকেই সায় দিইনি। আমার সেন্টিমেন্ট ছিল শিবসাগর সিংহের দিকে। কোহিনুর উদ্ধার যদি করতেই হয় তা হলে যে সত্যিকারের উত্তরাধিকারী তার জন্যই আমরা করব। তাই আমাকে বিরুদ্ধাচারণ করতেই হল…”

অবনীমোহনবাবুর কথাগুলো শোনার ফাঁকেই হঠাৎ আমি লক্ষ করলাম বাথরুমের দরজার নব—টা শব্দ না করেই ঘুরতে শুরু করেছে। তার মানে সুদীশ বেরিয়ে আসছে। সঙ্গে—সঙ্গে শরীরের সমস্ত স্নায়ুগুলো সক্রিয় হয়ে উঠল। আর একটা সেকেন্ডও দেরি করা নেই। শিবসাগর হাতের নাগালে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পকেট থেকে ডান হাতটা বের করার ভঙ্গি করে চকিতে বাঁ হাতে ঘুসি চালালাম শিবসাগরের মুখ লক্ষ করে। শিবসাগরের রিফ্লেক্স আমার থেকে আরও ভাল। চট করে মুখটা সরালেও আঘাতটা পুরোপুরি সামলাতে পারল না। ওর হাত থেকে রিভলভারটা মেঝের কার্পেটের ওপর পড়ে গেল।

পা দিয়ে রিভলভারটা চেপে ধরার চেষ্টা করছি, এমন সময় অবনীমোহনবাবু আমাকে ধাক্কা দিলেন। হুমড়ি খেয়ে সোফার ওপর পড়ে গেলাম। আর বোধহয় নিস্তার নেই। আগ্নেয়াস্ত্রটা হাতে ফিরে পেলে নিশ্চয়ই শিবসাগর ট্রিগার টিপে দেবে। ও কোথায়, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার আগেই শুনতে পেলাম কে একজন উফ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। চোখ পড়ল, অবনীমোহনবাবু দেওয়ালের কোণে পেটে হাত দিয়ে বসে পড়েছেন। শিবসাগরের বুকের ওপর বসে সুদীশ ওর মুখে ঘুসি মেরে যাচ্ছে। শিবসাগরের ঠোঁটের কোণ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এসেছে। নীল পাগড়িটা ছিটকে পড়ে রয়েছে কার্পেটের ওপর। মুখটা একপাশে কাত হয়ে যেতে দেখে সুদীশ উঠে দাঁড়াল। পুরো ব্যাপারটা ঘটতে সময় লাগল সাত থেকে আট সেকেন্ড।

হাতে রক্ত লেগেছে দেখে সুদীশ ফের ঢুকে গেল বাথরুমে। হাত ধুয়ে বেরিয়ে আসার পর স্বাভাবিক গলায় বলল, ”চল, ফেরেব্বাজ দু’টোকে ঘরে রেখে আসি।”

অবাক হয়ে বললাম, ”ঘর মানে?”

”এরা দু’জন টু ডি—তে উঠেছে। মানে আমাদের পাশের ঘরে। তীর্থঙ্করের কাছে আমি আগেই খবরটা পেয়ে গিয়েছিলাম।”

দু’জনে মিলে অচেতন অবনীমোহনবাবু আর শিবসাগরকে টু ডি—তে পাচার করে দিয়ে আমরা দরজা বন্ধ করে দিলাম। তারপর সুদীশকে বললাম, ”চল, আরেকটা কাজ বাকি রয়ে গেছে। ফের টু বি—তে একবার যেতে হবে।”

সুদীশ অবাক হয়ে বলল, ”তার মানে? কোহিনুর ফেরত দিয়ে যাবি নাকি?”

”অবশ্যই। তুই কি জানিস, এটা একটা অভিশপ্ত হিরে? কোনও পুরুষের সয় না? সম্রাট হুমায়ুন আর বাবর থেকে শুরু করে সম্রাট মহম্মদ শাহ পর্যন্ত—কেউ নিজের কাছে এই মণি রেখে শান্তিতে জীবন কাটাতে পারেননি? ইংরেজরা ঠিক কাজই করেছেন। মহারানি ভিক্টোরিয়ার জিনিস রানি এলিজাবেথের মুকুটে বসিয়ে দিয়েছেন। যেখানকার জিনিস, সেখানেই না হয় ফিরে যাক।”

পুনশ্চঃ মিনিটদশেক পর ভি আই পি রোডে গাড়িতে ওঠার সময় দেখলাম, সুদীশের মুখটা বেশ গোমড়া। হওয়াটাই স্বাভাবিক। বাতিস্তুতাকে সারা জীবনের জন্য ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে নিয়ে আসার এই একটা অপূর্ব সুযোগ নষ্ট হয়ে গেল। সুদীশ সেটা ভুলবে কী করে?

আমারও মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। থ্যালাসেমিয়া রোগী শিশুদের নার্সিংহোমের জন্য ডি আশিসকে বাকি পাঁচ লাখ টাকা দিতে পারব না বলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *