কোস্টারিকার রক্তচোষা
৷৷ ১ ৷৷
সুদীপ্তদের ফকার প্লেনটা বেশ নিচ দিয়েই উড়ে চলছিল উত্তর-পূর্ব অভিমুখে। কোস্টারিকার রাজঘানী সানহোসের বিমানবন্দরকে অনেক পিছনে ফেলে এসেছে তারা। সূর্যস্নাত সকালে পাখির মতো উড়ে চলেছে সুদীপ্তদের ছোট্ট সাদা প্লেনটা। তাদের গন্তব্য ক্যারিবিয়ান উপকূলের কোস্টারিকা-নিকারগুয়া সীমান্তের একটা ছোট্ট জনপদ। সূর্যালোক ওপর থেকে সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জনপদ-শস্যক্ষেত্র-বিস্তীর্ণ তৃণভূমি অতিক্রম করে নিচে দেখা দিতে শুরু করেছে রুক্ষ পাহাড়ের সারি। উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে সে পাহাড় শ্রেণি চলে গেছে দক্ষিণ-পূর্বে। ওপর থেকে যেদিকেই তাকিয়ে ছিল সুদীপ্ত। একটা পাহড়ের মাথায় বেশ বড় একটা গহ্বর চোখে পড়ল তার। ক্রেটার! সুদীপ্ত পাশে বসা হেরম্যানকে বলল, ‘ওই দেখুন, একটা জ্বালামুখ!’
সুদীপ্তর কথাটা মনে হয় কানে গেল ‘ফোর মিস্টার ফকার প্লেনের পাইলটের পাশে বসা কো-পাইলটের। তিনি সুদীপ্তদের উদ্দেশ্যে বললেন। এই পর্বতমালাতে চারটে আগ্নেয়গিরি আছে। এর দক্ষিণভাগে ইরাজু নামে আগ্নেয় পর্বত সবচেয়ে উচ্চতম এবং তা এখনও মাঝে মাঝে তা জেগে ওঠে। ছাইয়ের চাদরে এখন চারপাশ ঢেকে যায়।’ হেরম্যান, সুদীপ্তকে বললেন, ‘এই আগ্নেয়গিরিগুলোর খনিজ পদার্থ মিশ্ৰিত ছাই-ই কিন্তু কোস্টারিকার মাটিকে উর্বরতা দান করেছে। একদিকে উন্নত কৃষিজমি, আর অন্যদিকে সমুদ্রর সান্নিধ্য, এই দুয়ে মিলে দেশটাকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। এ দেশের প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল ভাগ একটু শুষ্ক, কিন্তু আমরা যে দিকে যাচ্ছি সেই ক্যারিবিয়ান সাগর উপকূলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। যার ফলে ও অঞ্চলে জলা-জঙ্গলের আধিক্য আছে। জনসংখ্যা ওদিকে দেশের অন্য অংশর তুলনায় কম। কিছু মেস্টিজো আর নেটিভ আমেরিকানরা বাস করে ওখানে। পশুপালনই তাদের জীবিকা। আচ্ছা, তুমি ‘কোস্টারিকা” নামের অর্থ জানো তো ?’ সুদীপ্ত হেসে বলল, “হ্যাঁ, জানি। সান হোসের এয়ারপোর্টে একটা ব্রোশিওর-এ দেখলাম। ‘কোস্টারিকা’ শব্দের অর্থ ‘সমৃদ্ধ উপকূল’। স্পেনিয়ার্ডরা ওই ক্যারিবিয়ান উপকূল দিয়ে তাদের ব্যবসাবাণিজ্য চালাত। ওখানকার বন্দরগুলোর মাধ্যমে ক্যারিবিয়ান সাগরে তাদের সামরিক আধিপত্যও কায়েম রাখত। একসময় নাকি কোস্টারিকার বিস্তীর্ণ সমুদ্রতটে ক্যারিবিয়ান জলদস্যুদের ঘাঁটি ছিল। তবে আপনার বলা ওই ‘মেস্টিজো’ শব্দের মানে আমার জানা নেই । ‘
হেরম্যান বললেন, ‘স্পেনীয়রা দীর্ঘদিন এ দেশে ছিল। স্পেনীয় ও নেটিভ আমেরিকানদের রক্তর সংমিশ্রণে যাদের জন্ম তাদের বলা হয় মেস্টিজো। আমরা যে পশুখামার মালিকের আতিথেয়তা গ্রহণ করতে যাচ্ছি মিস্টার-গ্যাব্রিয়েল জাতিতে একজন মেস্টিজো। ওদের ওই গ্রামটা নাকি প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো। স্পেনীয়দের একটা প্রাচীন চার্চকে ঘিরে গ্রামের বিস্তার। দেশের ওই অংশের মানুষদের মতো ওই গ্রামের মানুষেরও প্রধান জীবিকা পশু পালন। আর বুঝতেই পারছ সেই পশুগুলোর ওপর যদি একের পর এক আক্রমণ নেমে আসে, কেউ যদি একের পর এক প্রাণীগুলোকে হত্যা করে তাদের রক্ত চুষে নেয় তবে খামার মালিকদের অবস্থা কী হতে পারে।’ হেরম্যানের কথার অর্থ বুঝতে অসুবিধা হল না সুদীপ্তর। সে বলল, ‘ব্লাড সাকার’ বা ‘রক্তচোষা’ কথাটা শুনলেই প্রথমেই মনে হয় ‘ভ্যাম্পায়ার ব্যাট’ বা ‘রক্তচোষা বাদুড়ের’ কথা।’
হেরম্যান জবাব দিলেন, “তা ঠিক। এ দেশের ট্রপিকাল রেন ‘ফরেস্টে বহু প্রজাতির বাদুড় পাওয়া যায়। এবং এ আরও ঠিক যে তাদের মধ্যে কয়েক প্রজাতির ভ্যাম্পায়ার ব্যাটও আছে। কিন্তু তারা খুব ক্ষুদ্র, আকারে হাতের তালুর চেয়েও ছোট। গবাদি পশুর গা বেয়ে উঠে ঘাড়, গলা, পাঁজর বা দুগ্ধ বাট থেকে রক্তপান করে। কিন্তু তারা প্রাণী হত্যা করতে পারে না। যে ঘটনাগুলোর কথা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে তাতে স্পষ্ট যে, কোন রক্তচোষা বড় প্রাণীর সংক্রমণেই মৃত্যু হচ্ছে গবাদি পশুদের। পুর্তারিকা, চিলি, মেক্সিকো, সেন্ট্রাল আমেরিকার বিভিন্ন দেশে চুপাকাবরার হানার যেসব ঘটনা শোনা গেছে তার সাথে হুবহু মিল পাওয়া যাচ্ছে এ ঘটনার। মৃত প্রাণীগুলোর বুকে গভীর ক্ষত। রক্তহীন দেহ!
সুদীপ্ত জানতে চাইল, ‘এই ক্রিপটিডটা দেখতে কেমন হতে পারে ? ‘
হেরম্যান বললেন, ‘এ ধরনের প্রাণীর সংবাদ মেলে ১৯৭৫ সালে পুর্তোরিকোর মোকা নামের এক শহরে। সেটাই প্রথম খবর। তারপর পুর্তোরিকোর কনভেনাস নামে আর এক ছোট শহরে হানা দিয়ে বহু প্রাণীকে হত্যা করে সেই রক্তচোষা। মাঝে কুড়ি বছর আর তার কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। সে আবার প্রচারের আলোতে আসে ১৯৯৫ সালে। পুর্তোরিকোর এক খামারে এক রাতে সাতটা পশুকে হত্যা করে সে। আর তার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে সেন্ট্রাল আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে চুপকাবরার হানার সংবাদ মিলছে। মেক্সিকো, নিকারাগুয়া, হান্ডুরাস, কোস্টারিকা…। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী প্রাণীটা আকারে পাঁচ ফুট মতো। দেহ-আবরণ রোম হীন কালো খসখসে। ঘাড় থেকে লেজ পর্যন্ত মেরুদণ্ড বরাবর করাতের দাঁতের মতো হাড়ের কাঁটা আছে। কিছু প্রজাতির ডাইনোসরদের যেমন থাকত। লাল টকটকে দুটো চোখ, ছোট নাসারন্ধ্র, ছুঁচালো চোয়াল, পাতলা ঠোঁট, চোয়ালে বসানো আছে সাপের মতো সার সার তীক্ষ্ণ বাঁকানো দাঁত। হাত পায়ের আঙুলও নখর যুক্ত। উত্তেজিত হলে পিঠের কাঁটাগুলো করাতের মতো জেগে ওঠে। বানরের মতো সে খুব জোরে ছুটতে পারে, লাফাতে পারে। নিকারাগুয়াতে একবার জাগুয়ার শিকারিদের ফাঁদে পড়ে মারা গেছিল হুবহু অমন দেখতে এক প্রাণী। জীববিজ্ঞানীরা তার দেহ পরীক্ষা করে এক অদ্ভুত তত্ত্ব দেন। তারা বলেছিলেন প্রাণীটা নাকি কোনো একক প্রাণী নয়, বহু জীবের সংমিশ্রণ ঘটেছে তার দেহে। সংকর প্রাণী। অদ্ভুত পাঁচটি জীবের মিশ্রণ আছে সে দেহে। সে দেহ এখন সংরক্ষিত থাকলেও কোন অজানা কারণে ভবিষ্যতে আর বিজ্ঞানীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়নি। এটা গল্প নয়, সত্যি ঘটনা।
হেরম্যানের কথা শুনে সুদীপ্ত একবার সেই বীভৎস প্রাণীর অবয়ব মনে মনে কল্পনা করে নিল। ইতিপূর্বে সুদীপ্ত আর হেরম্যান বহু অভিযানে সামিল হয়েছে ‘ক্রিপটিড’ অর্থাৎ রূপকথা-লোককথায় বর্ণিত, অথবা পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত প্রাণীদের খোঁজে। কখনও ইজিপ্টের প্রাচীন নগরীতে সিংহ মানুষের খোঁজে, অস্ট্রেলিয় সমুদ্রের গভীরে দানব অক্টোপাস বা বোর্নিওর আগ্নেয়গিরিকে প্রাগৈতিহাসিক উড়ুক্কু দানব ‘সাহুলের খোঁজে। কখনও বা আবার তারা পাড়ি জমিয়েছে তুষারাবৃত হিমালয়ের পর্বত কন্দরে ‘ইয়েতি’ অথবা পিগমি অধ্যুষিত আফ্রিকার বুরুন্ডিতে ‘সবুজ মানুষের সন্ধানে। কিন্তু সেসব প্রাণী যত ভয়ঙ্করই হোক না কেন তারা কেউ ‘রক্তচোষা’ ছিল না। ‘রক্তচোষা’ শব্দটার মধ্যেই কেমন যেন একটা ভয়ঙ্কর ভাব আছে! যে শব্দটা কানে এলেই শিহরণ জাগে। হিমেল রক্তের স্রোত বয়ে ধমনীতে! সুদীপ্ত জানতে চাইল, ‘ওই প্রাণীটার সম্বন্ধে আপনার ধারণা কী?’
সুদীপ্তদের প্লেনটা আগ্নেয় পর্বতের মাথা অতিক্রম করে অন্য দিকে প্রবেশ করছে। পাহাড়ের অন্যদিকে চোখে পড়ছে ঘন বনাঞ্চল। ওপর থেকে সেদিকে তাকিয়ে হেরম্যান বললেন, ‘কোস্টারিকার কুয়াশাবৃত ঘন বর্ষা বনে এখনও এমন অনেক জায়গা আছে যার সম্বন্ধে সভ্য পৃথিবী তেমন কিছু জানেনা। সেখানে প্রাগৈতিহাসিক অথবা অচেনা কোনো জীবের লুকিয়ে থাকা অসম্ভব নয়। হয়তো সেখান থেকেই রক্তর সন্ধানে লোকালয়ে এসে হানা দেয় সে প্রাণী! তবে চুপাকাবরা নিয়ে আর একটা অদ্ভুত তত্ত্ব দেন কেউ কেউ… ’ ‘কী তত্ত্ব?’ প্রশ্ন করল সুদীপ্ত।
হেরম্যান বললেন, ‘তুমি নিশ্চই জানো কিছু কিছু মানুষ আছেন যারা পৃথিবীর বুকে ভিনগ্রহর প্রাণীর আগমনের ব্যাপারে বিশ্বাসী? ব্যাপারটা বিতর্কিত হলেও সে সম্বন্ধে বেশ কিছু যুক্তিও খাড়া করেন তারা। প্রচলিত ধারণায় শিক্ষিত বিজ্ঞানীরাও কিন্তু তাদের সব যুক্তি খণ্ডন করতে পারেননা। ‘এলিয়ন’ বা ভিনগ্রহীদের নিয়ে যারা চর্চা করেন তাদের বক্তব্য ‘চুপাকাবরা’ হল কোনো ভিনগ্রহর প্রাণী ও পৃথিবীর প্রাণীর সংমিশ্রণে তৈরি প্রাণী। ভিনগ্রহী গ্রে-এলিয়ন আর পৃথিবীর কোনো হিংস্র প্রাণীর রক্তে সৃষ্ট চুপকাবরা। বিজাতীয় হিংস্রতা নিয়ে যে আক্রমণ করে তার শিকারকে। হঠাৎই আবির্ভূত হয়, আবার হঠাৎই মিলিয়ে যায় তারা। কারো কারো ধারণা চুপকাবরা অদৃশ্য হতে পারে। তবে এ ভাবনা মানুষের একটু বাড়াবাড়ি বলেই মনে হয়। প্রাণীটা খুব ক্ষিপ্রগতির বলেই সম্ভবত মানুষের মনে এ ধারণা তৈরি হয়েছে।’
এয়ার পকেটে পড়ে একবার বেশ দুলে উঠল সুদীপ্তদের ছোট্ট প্লেনটা। নিজেকে সামলে নিয়ে নিচের কুয়াশামাখা বনাঞ্চলের দিকে চোখ রেখে সুদীপ্ত বলল, ‘আজ পর্যন্ত আমরা যত ক্রিপটিডের সন্ধানে গেছি তাদের সঙ্গে কিন্তু ভিনগ্রহের প্রাণীর সম্পর্কর কথা শুনিনি । চুপকাবরা সম্বন্ধে এমন ভাবনার পিছনে কোনো বিশেষ কারণ আছে কি?”
হেরম্যান জবাব দিলেন, “তা একটা আছে। সে ব্যাপারটাও বেশ বিতর্কিত পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকদের কাছে। যেখানে যেখানে চুপাকাবরার খবর মিলেছে সেখানকার আকাশেই কিন্তু দেখা গেছে ‘আন আইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্ট’ বা ‘ইউ.এফ.ও’। চলতি কথায় যাকে ভিনগ্রহীদের মহাকাশ যান বলা হয়। তুমি তার কথা শুনেছ নিশ্চই?’
সুদীপ্ত জবাব দিল, “শুনেছি। কল্পবিজ্ঞানের গল্পে পড়েছি। বেশ কয়েকটা হলিউড সিনেমাও দেখেছি ওই ‘ইউ.এফ.ও’ বা ‘ফ্লাইং সসার নিয়ে।’ হেরম্যান বললেন, ‘কারো কারো বক্তব্য ওইসব ‘ইউ এফ ও’ থেকে পরিকল্পনামাফিক ছাড়া হচ্ছে ‘চুপাকাবরা’ বা ‘গোট সাকারদের’। প্রথমে তারা নির্জন জায়গাতে নিরীহ প্রাণীদের ওপর হত্যার তালিম নিচ্ছে। এরপর এক সময় তারা দ্রুত বংশবিস্তার করে আক্রমণ হানবে মানুষের ওপর। এইসব ছোট ছোট দেশকে প্রথমে জনশূন্য করে ভিনগ্রহীরা প্রথমে ঘাঁটি গাড়বে এ সব জায়গাতে। তারপর আক্রমণ করবে সারা পৃথিবীকে। আমি অবশ্য এ সব তত্ত্বে বিশ্বাসী নই। আমার ধারণা প্রাণীটা কোস্টারিকার জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা এই পৃথিবীরই নতুন কোনো সংকর জীব বা কোনো প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী। ভিনগ্রহর প্রাণী বা তার সংকরের ব্যাপারটা ঠিক আমার কল্পনায় আসে না।’
সুদীপ্ত বলল, ‘তবে একটা কথা বলা যেতেই পারে যে আজ পর্যন্ত যেসব ক্রিপটিডের সন্ধানে আমরা পাহাড়-জঙ্গল-সমুদ্র-মরুভূমি চষে বেড়িয়েছি তাদের মধ্যে চুপাকাবরাই নবীনতম। আর তার আচরণও হয়তো বা সবচেয়ে বেশী নৃশংস।’
হেরম্যান বললেন, ‘আর, ক্রিপটিডের সন্ধানে আমেরিকা মহাদেশে এটাই আমাদের প্রথম অভিযান।’
‘আপনারা কি তবে চুপাকাবরার খোঁজে সান মারিয়া যাচ্ছেন?’—প্রশ্নটা কানে যেতেই সুদীপ্তরা দেখল তাদের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে আছেন কো পাইলট ভদ্রলোক। তার ঠোঁটের কোণে আবছা হাসি। সম্ভবত তিনি এতক্ষণ সুদীপ্তদের কথা শুনছিলেন ও প্রশ্নটা করলেন।
ব্যাপারটা আর তার কাছে গোপন করে লাভ নেই তাই হেরম্যান বললেন, “তা বলতে পারেন। নতুন নতুন প্রাণী খোঁজা আমাদের নেশা । আপনি তো ওখানে যাওয়া আসা করেন। ওই প্রাণীর ব্যাপারে আপনার কোনো কিছু জানা আছে?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘খবরের কাগজে যেটুকু খবর বেরিয়েছে সেটুকুই জানা। আমরা এয়ারপোর্টের বাইরে যাইনা। গ্রামটা এয়ারপোর্ট থেকে বেশ খানিকটা দূর। আমার ধারণা চুপাকারবার ব্যাপারটা গ্রামবাসীদের বানানো গল্প। বেশ কয়েকটা পশুখামার আছে ওখানে। চারণ জমির দখল নিয়ে তাদের মধ্যে রেষারেষি হয় বলে শুনেছি। সম্ভবত তারাই একে অন্যের খামারে পশু হত্যা করছে। তবে চুপাকাবরার বাপারটা খবরের কাগজে প্রকাশিত হওয়ায় গ্রামটার কথা অনেকদূর ছড়িয়েছে। সাধারণ বাইরের লোক খুব একটা ওখানে আসা-যাওয়া করেনা। আমরা সরকারি লোক বা খামার মালিকদের নিয়ে আসা-যাওয়া করি তাদের প্রয়োজন মতো। আপনারা যেমন ওখানে যাচ্ছেন তেমনই দু-দিন আগে এক স্পেনীয় ভদ্রলোককে ওখানে নামিয়ে দিয়ে এলাম।’
হেরম্যান বললেন, “তিনিও কি চুপাকবরার সন্ধানেই ওখানে গেছেন ? কো-পাইলট হেসে বললেন, “তিন্নি কিছু বলেননি। তবে এখন মনে হচ্ছে তিনিও হয়তো আপনাদের মতো একই কারণে ওখানে গেছেন। যা শুনেছি ও গ্রামে দেখার মতো কিছু নেই। বাইরের লোক এত খরচা করে ওখানে হঠাৎ ছুটে যাবে কেন?”
পাইলট এবার যেন কী একটা বললেন কো-পাইলট ভদ্রলোককে। তা শুনে তিনি কথা থামিয়ে হেডফোন তুলে কানে লাগিয়ে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সাথে কথা বলতে শুরু করলেন।
হেরম্যান তাকালেন সুদীপ্তর দিকে। তার কপালে যেন কয়েকটা ভাঁজ ফুটে উঠেছে। সুদীপ্ত বলল, ‘কী ভাবছেন, ওই স্পেনিয়ার্ড ভদ্রলোক আমাদেরই মতো কেউ কিনা?” হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘না হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। দেখা যাক….
গিরিশ্রেণি অতিক্রম করে অন্যপাশে উপস্থিত হয়েছে সুদীপ্তরা। অনেক নীচে পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে আছে আদিম মহাবৃক্ষর জঙ্গল। মেঘ ভাসছে তার মাথার ওপরে। কোনো কোনো জঙ্গল আবার মেঘে আচ্ছাদিত। ওপর থেকে সেদিকে দেখিয়ে হেরম্যান বললেন, ‘ওগুলোকে বলে ক্লাউড ফরেস্ট। রেন ফরেস্টের মতো ক্লাউড ফরেস্টেও কোস্টারিকাতে আছে। যা পৃথিবীর খুব অল্প জায়গাতেই দেখা যায়।’—এ কথা বলে সে দিকে তাকিয়ে কী যেন চিন্তায় ডুবে গেলেন হেরম্যান। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর ওপর থেকে এক জায়গাতে ফাঁকা জমি দেখা গেল। তার মাথার ওপর পাক খেয়ে সেদিকে নামতে সুরু করল সুদীপ্তদের ছোট্ট ফকার প্লেনটা। কিছুক্ষণের মধ্যে মাটি ছুঁলো তারা।
পাহাড়ের ঢালের ঠিক নীচে এক ফালি লম্বাটে জমিতে কাঁটাতার ঘিরে এয়ারপোর্ট বানানো হয়েছে। দেখে বোঝাই যায় বড় প্লেন নামতে পারেনা সেখানে। প্রস্থান তোরণের গায়েই কাঠের তৈরি একটা দোতালা বাড়ির মাথায় রাজার বসানো এয়ারট্রাফিক কন্ট্রোল রুম। সামান্য কয়েকজন কর্মচারী সেখানে। এয়ারপোর্ট থেকে চেক-আউটের সময় একটা খাতায় সুদীপ্তদের নাম-ঠিকানা, আসার কারণ লিপিবদ্ধ করতে হল। হেরম্যান সেখানে আসার কারণ হিসাবে লিখলেন ‘নেচার অবজারভেশন’ অর্থাৎ ‘প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ’। তা দেখে যে বিমানবন্দর কর্মী সুদীপ্তদের সামনে খাতাটা মেলে ধরেছিলেন তিনি মন্তব্য করলেন, ‘আজকাল অনেকেই দেখছি প্রকৃতি পর্যবেক্ষণে এখানে আসছেন! বেশ ভালো ব্যাপার ।
কথাটা শুনে হেরম্যান লোকটার দিকে তাকাতেই সে খাতার এক জায়গাতে আঙুল ছোঁয়াল। সেখানে সুদীপ্তদের মতোই লেখা আছে এক স্পেনীয়র নাম—গঞ্জালো-ডি-কোস্টা। এখানে আসার কারণ হিসাবে তিনিও সুদীপ্তদের মতো একই কথা লিখেছেন—‘প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ!’ হেরম্যান সে জায়গা ছেড়ে বেরোবার সময় বললেন, ‘যাক, ভদ্রলোকের নাম জানা গেল। নিশ্চই তার সাথে সাক্ষাৎ হবে। তিনি যদি আমাদেরই মতো ক্রিপ্টোজুলজিস্ট হন, তবে তাঁর আপত্তি না থাকলে একসাথে চুপাকাবরার সন্ধান করা যেতে পারে।’
৷৷ ২ ৷৷
সুদীপ্তরা এয়ারপোর্টের বাইরে ছোট্ট একটা ফাঁকা জায়গাতে এসে দাঁড়াতেই তাদের দেখে সামনে এসে দাঁড়ালেন এক ভদ্রলোক। পরনে টি-শার্ট আর জিনস। হাইহিল বুট। মাথায় কাউবয়দের মতো বারান্দা অলা চামড়ার টুপি। ঠোটের কোণে গোঁজা আছে একটা পাইপ। মৃদু ধূম উদ্গিরণ হচ্ছে তার থেকে। গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা লালচে দাড়িঅলা সেই ভদ্রলোক বাঁ হাতে মুখ থেকে পাইপটা নামিয়ে, ডান হাতটা হেরম্যানের উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে মৃদু হেসে তার উদ্দেশ্যে বললেন, “আপনি নিশ্চই হেরম্যান? আমি পেড্রো। আমি ভাবতেই পারিনি শেষ পর্যন্ত আপনারা এখানে সত্যিই আসবেন !’
হেরম্যান পেড্রোর সাথে করমর্দন করে সুদীপ্তর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর। সুদীপ্তও করমর্দন করল তার সাথে। হেরম্যান এরপর লোকটার উদ্দেশ্যে বলল, ‘আজকাল ইন্টারনেটের যুগে পৃথিবীটা বেশ ছোট হয়ে গেছে। তাই আপনার খোঁজ পেতে, আপনার সাথে যোগাযোগ করতে খুব বেশি অসুবিধা হল না। কুড়ি বছর আগে হলেও এ ব্যাপারটা অকল্পনীয় ছিল।’
হেরম্যানের কথা শুনে ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘তা ঠিক। নইলে কোথায় জার্মানি, কোথায়-ইন্ডিয়া, আর কোথায় আমাদের এই ছোট্ট দেশ কোস্টারিকা! সান সারিয়াতে আপনাদের স্বাগত। চলুন এবার। আধ ঘণ্টা মতো পথ আপনাদের গাড়িতে যেতে হবে।’ এই বলে তিনি সুদীপ্তদের নিয়ে এগোলেন কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যান্ডরোভারের দিকে। চালকের সামনে উঠে বসলেন পেড্রো। সুদীপ্তরাও উঠে বসল গাড়িতে। চলতে শুরু করল ল্যান্ডরোভার। এয়ারপোর্টের বাইৱে একটা ছোট বাজার। ফল, ফুল বিক্রি হচ্ছে সেখানে। ফুলের টুকরি হাতে রঙচঙে পোশাক পরা মহিলা আর পানামা হ্যাট পরা লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে। শস্য বোঝাই বেশ কয়েকটা দাঁড়ে টানা গাড়িও দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। তাদের চাকাগুলো বেশ রঙচঙে। এই ‘বুল কার্ট’ হল কোস্টারিকার জাতীয় প্রতীক-এ ব্যাপারটা সুদীপ্তদের জানালেন পেড্রো বাজার ছাড়িয়ে পাহাড়ের ঢালের কোণ ঘেঁষে চলতে শুরু করল সুদীপ্তদের গাড়ি। কিছুটা পথ এগোবার পরই রাস্তার একপাশে শুরু হল ঘাসে ছাওয়া জমি। একপাশে জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ের ঢাল, অন্যদিকে সেই ফাঁকা জমি। সেই জমিগুলোর মাঝে মাঝে নামফলক পোঁতা আছে।
সুদীপ্ত জানতে চাইল, “ওগুলো কীসের নাম ফলক?”
গাড়ি চালাতে চালাতে পেড্রো বললেন, ‘এগুলোই হল ‘গেজিং-ফিল্ড’ বা চারণ ভূমি।
সরকারের থেকে এ সব জমি ইজারা নিই আমরা। জমির মালিকরা ওই নামফলক বসিয়ে তাদের জমির সীমানা নির্ধারণ করেছে।
তার কথা শেষ হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই দূর থেকে একটা বিশাল ভেড়ার পালকে চড়তে দেখল সুদীপ্তরা। তাদের তদারকিতে কয়েকজন ঘোড়ার পিঠে চাপা কাউবয় । হেরম্যান প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, আপনারা যারা খামার মালিক, আপনাদের নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক কেমন ?
পেড্রো বললেন, “ভালো-মন্দ মিলিয়ে। একটা সময় ছিল যখন পতিত চারণ ভূমি নিয়ে ঝগড়া বিবাদ লেগে থাকত। এবং তার নিষ্পত্তি যেত পিস্তল ডুয়েলের মাধ্যমে। সে অবশ্য একশো বছর আগের কথা। এখনও যে ঝগড়া-বিবাদ হয় না তা নয়, তবে সরকারি লোকরা সে বিবাদের নিষ্পত্তি করেন। গ্রামে একজন পুলিশ অফিসারও আছে। তিনিও কিছুটা সামাল দেন সমস্ত ব্যাপার।’
সুদীপ্ত বলল, ‘এমনও তো হতে পারে যে অন্য কোনো খামার মালিক আপনার ক্ষতি করার জঘন্য কাজটা করছে? পশুহত্যা করছে?’
রাস্তার দিকে চোখ রেখে হুইল ঘোরাতে ঘোরাতে পেড্রো জবাব দিলেন। চারটে খামারে এ ঘটনা ঘটেছে গত তিনমাসে। আমার প্রতিবেশী এক খামার মালিকের সাথে আমার বিবাদ আছে। তারও চারটে প্রাণী মারা পড়েছে। যদিও আমার ক্ষতির পরিমাণই সব থেকে বেশি। মোট উনিশটা প্রাণীর মৃত্যু ঘটেছে ওই রক্তচোষার আক্রমণে। এ কথা বলার পর পেড্রো প্রশ্ন করলেন, ‘আপনাদের আসল পরিচয়টা কী? জীববিদ, নাকি প্রেতচর্চা করেন অথবা কোনো কাগজের সাংবাদিক। সান মারিয়া থেকে ইতিমধ্যে কজন সাংবাদিক গ্রামে গ্রামে ঘুরে গেছেন। নইলে অতদূর থেকে এখানে ছুটে এলেন?”
এখানে আমার আগে পেড্রোকে টেলিফোনে হেরম্যান শুধু জানিয়েছিলেন তিনি চুপাকাবরার আক্রমণের ঘটনা সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী। উপযুক্ত অর্থের বিনিময় যদি পেড্রো তার খামারে তাদের দুজনের থাকার ব্যবস্থা করেন তবে উপকার হয়। হয়তো হেরম্যান চুপাকাবরা রহস্যর সমাধান করতে পারবেন এ কথাও পেড্রোকে তিনি টেলিফোন মারফত জানিয়েছিলেন। হেরম্যানের প্রস্তাবে সম্মত হয়েছেন পেড্রো। কিন্তু পেড্রো বিশেষ কিছু জানেন না সুদীপ্তদের সম্পর্কে। পেড্রোর প্রশ্ন শুনে হেরম্যান বললেন, ‘ওই প্রথমটাই ভাবতে পারেন। আমরা ক্রিস্টোজুলজিস্ট। বিভিন্ন প্রাণীর খোঁজে আমরা ঘুরে বেড়াই। তবে বিশেষ ধরণের প্রাণী। রূপকথা-লোক কথাতে যেসব প্রাণীর সন্ধান পাওয়া যায়, অথবা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়া কোনো প্রাণী, অথবা নতুন অদেখা কোনো প্রাণী,—যাদের ‘ক্রিপ্টিড’ বলে তাদের সন্ধান করি আমরা।’ ‘
হেরম্যানের জবাব শুনে পেড্রো একটু চুপ থেকে বললেন, ‘তবে হয়তো হতাশ হতে হবে আপনাদের। চার্চের পাদ্রী ডিসুজা বলেছেন, ‘এ রক্তচোষা কোনো মানুষ নয়। ও হল শয়তান। পৃথিবী পাপে ভরে গেছে, তাই শয়তানের আবির্ভাব ঘটেছে। এরপর সে মানুষদের হত্যা শুরু করবে। লোকজনও একই কথা বলছে।’
সুদীপ্ত জানতে চাইল, ‘আপনাদের গ্রামের অবস্থা এখন কেমন?
পেড্রো বললেন, “দিনের বেলা সবকিছু ঠিকঠাক চলে। কিন্তু সূর্য ডুবতে শুরু করলেই আতঙ্ক চেপে বসে সবার মনে। আর মেঘাচ্ছন্ন রাত হলে তো কথাই নেই। যে কবার ওই শয়তান হানা দিয়েছে সেই রাতগুলো ছিল মেঘাচ্ছন্ন। ক্লাউড ফরেস্টের মেঘ ঢেকে রেখেছিল চাঁদকে। ওরকম রাত হলে সূর্য ডোবার পর ঘরের বাইরে কেউ বেরোচ্ছে না। সাধারণত শিশু আর দুগ্ধবতী প্রাণীদের আমরা রাতে খোঁয়াড়ে আটকে রাখি। এই গ্রীষ্মকালে আমরা বাকি পশুদের চারণ ভূমিতেই রাতে ছেড়ে রাখি কাউবয়দের তত্ত্বাবধানে । খামারে একসাথে অত প্রাণীর স্থান সঙ্কুলান হয় না বলে। আতঙ্কে কাউবয়রা পাহারা দিতে চাচ্ছেনা। সারা রাত ভাগ্যের হাতেই পশুগুলোকে ফেলে রাখতে হচ্ছে আমাদের। দেখুন যদি আপনারা গিয়ে কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন। ’
হেরম্যান এবার জানতে চাইলেন, ‘যে সাংবাদিকরা আপনাদের গ্রামে এসেছিলেন, তারা ছাড়া আপনাদের গ্রামে নতুন কোনো অতিথির আগমন হয়েছে কি?”
একটু যেন ভেবে নিয়ে পেড্রো জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, দু-জনের আগমন ঘটেছে। তাদের মধ্যে একজন মার্কিনি, অপরজন স্পেনীয়। স্পেনীয় ভদ্রলোক এসেছেন দুদিন আগে, আর মার্কিন ভদ্রলোক এসেছেন একমাস হতে চলল।
‘তারও কী চুপাকাবরার খোঁজেই এসেছেন?’ জানতে চাইলেন হেরম্যান পেড্রো বললেন, ‘মার্কিন ভদ্রলোক একজন শিকারি। ক্লাউড ফরেস্টে নেকড়ে শিকারে এসেছেন। তার ধারণা চুপাকাবরা বলে কোনো প্রাণী নেই। নেকড়ের আক্রমণেই মৃত্যু হয়েছে পশুগুলোর। একথা ঠিকই যে জঙ্গলে খাদ্যাভাব ঘটলে অনেক সময় তারা নিচে নেমে খামারে হানা দেয়। আর স্পেনীয় ভদ্রলোককে দেখলেও তার সাথে এখনও পরিচয় গড়ে ওঠেনি। তাছাড়া সে এসে আশ্রয় নিয়েছে আমার খামারের অর্লন্ডোর খামারে। অর্লন্ডোর সাথে জমির সীমানা নিয়ে বিরোধ আছে। কাজেই তার অতিথির সাথে পরিচয় করার আগ্রহ প্রকাশ আমি করিনি।’ কথা বলতে বলতে সুদীপ্তরা একসময় পৌঁছে গেল সান-মারিয়াতে।
ছবির মতো ছোট্ট সুন্দর গ্রাম সান-মারিয়া। পাহাড়ের একদম নিচের ধাপে বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে গ্রামটা। পাহাড়ের পাদদেশকে বেষ্টন করে পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে গেছে সেই তৃণভূমি-পশুচারণ ক্ষেত্র। আর তার মাঝেই গ্রাম। গ্রাম বলতে বেশ অনেকটা করে জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা এক একটা খামার বাড়ি বা ফার্ম হাউস। তাদের সামনে দিয়ে সমান্তরাল একটা রাস্তা চলে গেছে ফার্ম হাউসগুলোকে ছুঁয়ে। আর ফার্ম হাউসগুলোর পিছন থেকেই ঘন অরণ্যে ছাওয়া পাহাড় শ্রেণি ধাপে ধাপে উঠে গেছে আকাশের দিকে। পাহাড়ের কিছুটা ওপর থেকেই শুরু হয়েছে কুয়াশার স্তর। সেই কুয়াশা গাঢ় হতে হতে মুছে ফেলেছে পাহাড়ের মায়ার দিকটাকে। ক্লাউড ফরেস্ট!’ গ্রামের প্রবেশ মুখে একটা উন্মুক্ত বৃত্তাকার জায়গা। সেখানে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সুদীপ্তদের চোখে পড়ল চার্চটা। দেখেই বোঝা যায় সেটা বেশ প্রাচীন। দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে খুব বড় না হলেও উচ্চতায় অনেক। তার ঘণ্টা ঘরটা অন্তত সত্তর ফুট উঁচুতে হবে। বৃত্তাকার জায়গাটার এক পাশে স্পেনিয়ার্ডদের চার্চ আর অন্যপাশে একটা আস্তাবল আর কয়েকটা দোকানপাট ।
আর সেই চকের ঠিক মাঝখানে উঁচু একটা বেদির ওপর রাখা আছে কোস্টারিকার জাতীয় প্রতীক রঙচঙে একটা বুল কার্ট, ষাঁড়-টানা গাড়ি। বেশ কিছু লোকজনও আছে সেখানে। গ্রামেরই লোক সব। সে জায়গা অতিক্রম করে কিছুটা এগিয়ে কাঁটা তারে ঘেরা নিজের খামারে সুদীপ্তদের নিয়ে প্রবেশ করলেন খামার মালিক পেড্রো। বেশ বড় খামার। আস্তাবল, পশুদের রাখবার জন্য লম্বা ছাদঅলা খোঁয়াড়, খামারের বাসিন্দাদের থাকবার জন্য বেশ কয়েকটা ছোট-বড় কাঠের কটেজ সব কিছুই আছে। গাড়ি থামল খামারের পিছন দিকের একটা কটেজের সামনে। মালপত্র নিয়ে নামল সুদীপ্তরা। কাঠের তৈরি কটেজের বিষয়ে সুদীপ্তদের নিয়ে প্রবেশ করলেন পেড্রো। বেশ ছিমছাম ঘর। পেড্রো বললেন, ‘এটাই আমার অতিথিশালা। আশা করি, আপনাদের কোনো অসুবিধা হবেনা থাকতে। আপনারা বিশ্রাম নিন। খাবার চলে আসবে। তবে আজ আর আপনাদের সাথে দেখা হবে না আমার। কাউবয়দের সন্ধানে বেরোব। দেখি যদি বেশি টাকার টোপ দিয়ে কাউকে রাত পাহারার জন্য রাজি করানো যায়। তাই ওদের ডেরায় যাব। বিকালবেলা আশেপাশে ঘুরে আসতে পারেন। চার্চের সামনে ওই ম্যালটায় বিকালে গ্রামের অনেকে জড়ো হয়। সেখানেও যেতে পারেন।’-এ কথা ও আরও দু-একটা কথা বলে বিদায় নিলেন পেড্রো। তিনি চলে যাবার পর ঘরের পিছনদিকের জানলাটা খুলল সুদীপ্ত। কটেজের প্রায় পিছন যেতেই অরণ্য বেষ্টিত পাহাড়শ্রেণি উঠে গেছে ওপর দিকে। জমাট বাঁধা কুয়াশা খেলা করছে পাহাড়ের মাথায় সুদীপ্তর পাশে এসে দাঁড়িয়ে সেই কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে হেরম্যান বললেন, ‘এমনও হতে পারে চুপাকাবরার বাসস্থান ওই অঞ্চল। ওপর থেকে নিচে নেমে এসে সে গ্রামে হানা দেয়? ওই মেঘাচ্ছন্ন অরণ্য, ক্লাউড ফরেস্টে কোনো প্রাণীর পক্ষে লুকিয়ে থাকা অসম্ভব নয়। দেখো কেমন রহস্যময় লাগছে জায়গাটা! একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়ব। চার্চের ও জায়গাতে যাব। দেখি স্থানীয় মানুষদের সাথে কথা বলে যদি কোনো খবর সংগ্রহ করা যায়।’
খাবার চলে এল কিছুক্ষণের মধ্যেই। মাংস আর শাক-সবজি মেশানো একটা পদ। তার সাথে রুটি। খাওয়া সেরে বেশ কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে বিকাল নাগাদ ঘর ছেড়ে বেরোল সুদীপ্তরা। তারা হাঁটতে শুরু করল চার্চের সেই চকের দিকে। কাছে-দূরের চারণ ভূমিতে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে পশুর দল। ভেড়া, ছাগল, কিছু গোরু আর শূকরও আছে। তাদের ডাক শোনা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে তারা এক সময় পৌঁছে গেল চার্চের সামনে ।
বেশ লোক সমাগম সে জায়গাতে। দিনের শেষে ফলমূল, শাক-সবজি নিয়ে বসেছে বিক্রেতার দল। গ্রাম্য মহিলারা ঘাসে বোনা টুকরি নিয়ে কেনাকাটা করছে। শস্যের বস্তা নিয়ে বেশ কয়েকটা ষাঁড়ে টানা গাড়িও উপস্থিত হয়েছে সেখানে। আস্তাবল সংলগ্ন কফিশপের সামনে আড্ডা দিচ্ছে একদল কাউবয়। পরনে জিন্স আর মোটা কাপড়ে বোনা শার্ট। মাথায় চামড়ার বারান্দা অলা টুপি, হাঁটু পর্যন্ত চামড়ার জুতো। দু-একজনের কাঁধে গাদা বন্দুক বা কোমরে পিস্তলও আছে। যেন ছবির বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা মানুষ সব। কয়েকটা রোমশ কুকুর ঘুরছে তাদের পায়ের কাছে। সম্ভবত তাদেরই কুকুর হবে। সুদীপ্তদের চেহারা দেখে তারা বিদেশি বুঝতে পেরে মাঝে মাঝে সবাই একটু বিস্মিত ভাবে তাকাচ্ছে তাদের দিকে। কিন্তু একটু চোখাচোখি হলেই তারা অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। চার্চের ঠিক সামনেই কথোপকথনরত দুজন লোককে দেখতে পেল সুদীপ্তরা। তাদের একজনের পরনে লম্বা ঝুলের সাদা পোশাক, গলায় ঝোলানো রূপোর ক্রশটা পাহাড়ের মাথা থেকে ছুঁইয়ে আসা বিকালের আলোতে ঝলমল করছে। পোশাক দেখেই চেনা যায় লোকটা। পাদ্রী। সম্ভবত সেই ডিসুজা নামের লোভ। যার কথা আসার পথে বলছিলেন পেড্রো। সাদা দাড়ি-ওলাবৃদ্ধ পাদ্রীর সঙ্গী সুঠাম চেহারার মাঝবয়সি ভদ্রলোককে দেখে ঠিক এ গ্রামের লোক বলে মনে হল না সুদীপ্তদের। ভদ্রলোকের চোখে চশমা, লালচে দাড়ি গায়ে ওয়েস্ট কোর্ট, বুশ শার্ট ও ট্রাউজার্স। তাদেরকে দেখতে পেয়ে যেদিকে এগিয়ে গেলেন হেরম্যান, তাকে অনুসরণ করল সুদীপ্ত ।
তারা দু-জন তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই কথা থামিয়ে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকালেন সেই পাদ্রী আর তার সঙ্গী ভদ্রলোক। কিন্তু তার আগেই পাদ্রীর মুখ থেকে একটা শব্দ কানে এল সুদীপ্তদের—চুপাকাবরা!’ সম্ভবত তা নিয়েই কথা হচ্ছিল তাদের দুজনের মধ্যে। পাদ্রী ভদ্রলোক সুদীপ্তদের উদ্দেশ্যে স্মিত হেসে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনারা কি বিদেশি? আজই এসেছেন এখানে? আগে দেখিনি তো!’
হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, বিদেশি। আজই এসেছি আপনাদের গ্রামে খামার মালিক পেড্রোর আতিথেয়তায়।’ এ কথা বলার পর হেরম্যান তাঁর সার সুদীপ্তর নাম পরিচয় ব্যাক্ত করলেন। সে কথা শুনে সাদা পোশাক পড়া বৃদ্ধ তার বুকের ক্রশটা তুলে ধরে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে বললেন, ‘গড ব্লেস ইউ। আমি ফাদার ডিসুজা। এই চার্চের পাদ্রী। মান মারিয়াতে আপনাদের স্বাগত জানাই ।
সুদীপ্তরা বুঝতে পারল তাদের অনুমানই ঠিক। ডিসুজা এরপর তার পাশে দাঁড়ালো ভদ্রলোককে দেখিয়ে বললেন, ‘ইনি গঞ্জালো-ডি-কোস্টা। ইনিও আপনাদের মতো বিদেশী । স্পেন থেকে এসেছেন। তবে এক সময় এ দেশটা ওনাদেরই মানে স্পেনীয়দের শাসনাধীন ছিল। এই চার্চটাও একসময় চলারাই তৈরী করেন।”
ডিসুজা একথা বলার পর সিস্টার গঞ্জালো করমর্দনের জন্য সুদীপ্তদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনারা কি টুরিস্ট? কিন্তু যতটুকু জানি টুরিস্টরা এই অখ্যাত গ্রামে আসেনা। আপনাদের পেশা কী?”
হেরম্যান, জবাব দিলেন, ‘আমরা ক্রিপ্টোজুপ্টলজিস্ট।’
এ কথা বলার পর হেরম্যান ক্রিপ্টোজুলজিস্ট শব্দের অর্থ ব্যাখ্যা করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই গঞ্জালো হেসে ফেলে বললেন, ‘ক্রিপ্টোজুলজিস্ট শব্দের অর্থ আমি জানি। বইতে পড়েছি। ওই যারা উদ্ভট প্রাণীর খোঁজ করে বেড়ান। যেমন : হিমালয়ের ইয়েতি, মাদাগাস্কারের নরখাদক গাছ, রূপকথার ফিনিক্স পাখি এসবের খোঁজে। তবে এও জানি যে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী বৃদ্ধ আপনাদের ঠিক পাত্তা দেন না। আমার অনুমান যদি ভুল না হয় তবে আপনারা চুপাকাবরার’ সন্ধানে এখানে এসেছেন ?”
গঞ্জালোর কথা বলার ঢং দেখে হেরম্যানের মনে হল যেন বিদ্রুপ লুকিয়ে আছে তার কথায়। তার কথার প্রত্যুত্তরে হেরম্যান যথাসম্ভব ভদ্রোচিত স্বরে জবাব দিলেন, “হ্যাঁ, আমাদের কাজটা ওরকমই। এ কথাও ঠিক পুঁথিপড়া পণ্ডিত বিজ্ঞানীরা আমাদের কাজের স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠা বোধ করেন, কিন্তু এ কথা আপনাকে জানিয়ে রাখি যে রূপকথার ফিনিক্স পাখি বা ডানাওলা পক্ষীরাজ ঘোড়ার সন্ধান না পেলেও কিন্তু ভিয়েতনামের ‘গোল্ডেন টার্টল’, জাপান সমুদ্রে ‘জয়েন্ট স্কুইড’, সি সার্পেন্টস, আফ্রিকান ইউনিকর্ন বা ‘ওকাপি’, ইন্দোনেশিয়ার ‘কমোডো ড্রাগন’, শ্রীলঙ্কার ‘ডেভিল বার্ড’ বা ‘জায়েন্ট আউল’ এর সন্ধান দেন ক্রিপ্টোজুলজিস্টরা। এ তালিকা আরও দীর্ঘ হতে পারে। মাত্র ক-একশো বছর আগেও তো ইউরোপীয়ানরা ক্যাঙারুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করত না। তা বলে কি অস্ট্রেলিয়ায় ক্যাঙারু ছিল না? কয়েক কোটি বছর আগের জীব সিলিকান্থ, মাছেরও তো শেষ পর্যন্ত দেখা মিলল। বিজ্ঞানীরা তার অস্তিত্ব স্বীকার করতেন না। শেষে তাঁরা ঢোক গিলে তার নাম দিলেন ‘জীবন্ত জীবাশ্ম ।”
হেরম্যান তার কথা এমন ভাবে শেষ করলেন যে তার কণ্ঠস্বর শুনে গঞ্জালো বুঝতে পারলেন তার কথা বলার ঢঙে মৃদু আহত হয়েছেন হেরম্যান। গঞ্জালো বললেন, ‘আমি কিন্তু আপনাকে আমার কথায় আঘাত করতে চাইনি। লোকে যা বলে তাই বললাম। আপনাদের কাজকে আমি সম্মান জানাই। কষ্টটাও আমি বুঝি। কারণ আমার কাজ নিয়েও অনেক ব্যঙ্গ বিদ্রুপ সহ্য করতে হয় আমাকে।’
তার ব্যথা শুনে হেরম্যান মৃদু বিস্মিত হয়ে বললেন, “এয়ারপোর্টের রেজিস্টারে তো দেখলাম যে আপনি ‘প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ’ করেন। সে কাজের জন্য আপনাকে বিদ্রুপ শুনতে হবে কেন?”
গঞ্জালো হেসে বললেন, ‘আমার আসল পরিচয় লেখায় মান-হোসের এয়ারপোর্টে লোকজন হাসাহাসি করছিল। আর সেটা এড়াতেই এখানকার এয়ারপোর্টে নিজের পরিচয় দিয়েছি প্রকৃতি পর্যবেক্ষক।’
সুদীপ্ত প্রশ্ন করল, ‘তবে আপনার আসল পরিচয় কী?’
গঞ্জালো হেসে বললেন, “আপনাদের মতো আমিও এক অদ্ভুত জিনিসের খোঁজে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়াই। আমাকেও আপনাদের মতোই অনেক বিজ্ঞানীর ঠাট্টা শুনতে হয়। ‘ইউ.এফ.ও’ কথার অর্থ নিশ্চই জানেন? আমি ‘ইউ.এফ.ও’ খুঁজে বেড়াই।”
বিস্মিত সুদীপ্ত বলে উঠল, “ইউ.এফ.ও’–‘আন আইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্ট !’ যাকে চলতি কথায় বলে ভিনগ্রহীদের মহাকাশ যান? তার সন্ধান করেন আপনি?
গঞ্জালো বললেন, ‘ঠিক তাই। আপনারা যেমন চুপাকাবরার সন্ধানে এখানে এসেছেন, তেমনই আমি এখানে এসেছি ওই ‘ইউ.এফ.ও’র খোঁজে। এখানে যেদিন প্রথম চুপাকাবরার হানা হয়। তার ঠিক আগের রাতে কয়েকজন কাউবয় চারণভূমিতে পাহারা দিচ্ছিল। তারা হঠাৎ দেখতে পায় একটা উজ্জ্বল চাকতি আকাশ থেকে ঘুরতে ঘুরতে এসে নামল ওই ক্লাউড ফরেস্টে। খুব ছোট করে হলেও একটা কাগজে খবরটা প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর চুপাকাবরা নিয়ে এত হইচই শুরু হল যে সে খবরটা হারিয়ে গেল। এমনও হতে পারে যে আপনাদের চুপাকাবরা ভিনগ্রহরই কোনো জীব?’
হেরম্যান বললেন, ‘হ্যাঁ, এমন একটা তত্ত্ব আছে বটে। কারণ যেসব জায়গাতে চুপাকাবরার হানা হয়েছে সেখানেই কেউ কেউ ‘ইউ.এফ.ও’ দেখেছেন বলে দাবি করেছেন।’ গঞ্জালো বললেন ঠিক তাই। ইউ.এফ.ও’ নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে আমি প্রথমে এক জায়গাতে চুপাকাবরার প্রসঙ্গ পাই। আর সেই সূত্র ধরে জানতে পারি ক্রিপ্টিভ বা ক্রিপ্টোজুলজির কথা।’
হেরম্যান একটু চুপ করে থেকে বললেন, “হয়তো ‘ইউ-এফ-ও’র সাথে চুপাকাবরার আবির্ভাবের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে। তবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত চুপাকাবরার এ পৃথিবীরই কোনো প্রাণী হবে।’
পাদ্রী ডিসুজা এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন গঞ্জালো আর সুদীপ্তদের কথোপকথন। তিনি এবার গঞ্জালো আর হেরম্যানের বক্তব্য খণ্ডন করে বললেন, ‘আপনাদের বক্তব্য সঠিক নয় । কোনো ভিনগ্রহর যান ওই ক্লাউড ফরেস্টে নামেনি। আর ছুপাকাবরাও পৃথিবীর কোন জীব নয়। সে সাক্ষাৎ শয়তান। পৃথিবী পাপে ভরে গেছে। তাই সে আবির্ভূত হয়েছে এ পৃথিবীতে তার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য। আর যাকে মহাকাশযান বলে ভাবা হচ্ছে সেটা তা নয়। কাউবয়রা আসলে ‘তারা’ খসে পড়তে দেখেছিল পাহাড়ে। অশুভ দৃশ্য। পৃথিবীতে যখন দুর্যোগ নেমে আসে, শয়তানের আবির্ভাব হয়, তখন আকাশ থেকে তারা খসে পড়ে । তবে ওই পাহাড়েই ঘাঁটি গেড়েছে শয়তানটা। ওখান থেকেই সে নেমে আসছে গ্রামে।
হেরম্যান বা গঞ্জালো ওরা দুজনেই হয়তো এ প্রসঙ্গে ডিসুজার সাথে বিতর্কে যেতে পারতেন, কিন্তু বৃদ্ধ পাদ্রীর ভাবনায় আঘাত না করে তারা চুপ করে রইলেন।
পাদ্রী ডিসুজা এরপর বললেন, ‘তবে ওই শয়তানকে তাড়াবার ব্যবস্থা আজ রাতেই আমি করব। যাতে ওই রক্তচোষা আর এ গ্রামে হানা না দেয়। তার জন্য প্রস্তুতিও প্রায় সারা।’
সুদীপ্ত জানতে চাইল,‘কীভাবে তাড়াবেন সেই রক্তচোষাকে ?”
ডিসুজা বললেন, “কিছু জিনিসকে শয়তানরা রক্তচোষারা ভয় পায়। যেমন, রসুনের মালা, বুনো কাঠ গোলাপ ও তার ডাল, পবিত্র ধুনো। এসব জিনিস আমি সংগ্রহ করেছি। এ জায়গাটাইতো গ্রামের প্রধান স্থান। রাস্তার ঠিক মাঝখানে, অর্থাৎ ওই যে দেখতে পাচ্ছেন যে বেদির ওপর সেখানে গোরুর গাড়িটা রাখা আছে ঠিক ওই বেদির নীচে রসুনের মালা, কাঠ গোলাপের ডাল বিছিয়ে ধুনো জ্বালাব আমি। আর রক্তচোষা আসবে না এ গ্রামে। ও সবের স্পর্শে, গন্ধে ধ্বংস হয় তারা।’
এ কথা বলার পর আকাশের দিকে তাকালেন ডিসুজা। বিকাল হয়ে গেছে। মেঘে ঢাকা জঙ্গল-পাহাড়ের মাথায় সূর্য ঢলে পড়তে শুরু করেছে। ডিসুজা সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আর কিছু সময়ের মধ্যেই সূর্য ডুববে। আকাশ দেখে মনে হচ্ছে রাতের আকাশও মেঘাচ্ছন্ন থাকবে। শয়তানের আবির্ভাবের পক্ষে উপযুক্ত রাত । তার অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে আমাকে। আবার কাল দেখা হবে আপনাদের সাথে।’ এ কথা বলে বিদায় নিয়ে বৃদ্ধ পাদ্রী ধীর পায়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন চার্চের ভিতর।
তিনি চলে যাবার পর হেরম্যান, গঞ্জালোকে বললেন, ‘আপনার অনুসন্ধিৎসু ভাবনাকেও আমি স্বাগত জানাই। এই পৃথিবীতে এই মহাবিশ্বে কত কী মানুষের অজানা থেকে গেছে! নিত্য নতুন কত কিছু তো এখনও আবিষ্কার হয়ে চলেছে। যতক্ষণ না তার দেখা মেলে ততক্ষণ পণ্ডিতদের একাংশ তাকে আমল দেয় না।’
গঞ্জালো হেসে বললেন, ‘সামনে আমি আপনি এক নৌকার যাত্রী। তবে আপনাদের তুলনায় আমাদের অবস্থা আরও একটু করুণ। আপনারা তবু বেশ কয়েকটা শ্রেণির উপস্থিতি প্রমাণ করতে পেরেছেন পৃথিবীর কাছে। ল্যাবরেটারিতে কাজ করা অথবা পুঁথি পড়া পণ্ডিত বিজ্ঞানীরা মুখে আপনাদের সম্বন্ধে যাই বলুন কিন্তু মনে আপনাদের কার্যকলাপ সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে পারেন না। আর আমাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হল যে ভিনগ্রহীদের পৃথিবীতে আগমন সম্পর্কে বেশ কিছু পরোক্ষ প্রমাণ ও যুক্তি থাকলেও আমরা যারা ‘ইউ-এফ-ও’ নিয়ে চর্চা করি তারা এখনও পর্যন্ত তেমন কিছু প্রমাণ হাজির করতে পারিনি পৃথিবীর সামনে। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে একদিন তা প্রমাণিত হবেই।’
হেরম্যান তার কথা শুনে হেসে বললেন, ‘কামনা করি যে একদিন যেন আপনারা ব্যাপারটা প্রমাণিত করতে পারেন।’
সুদীপ্ত বলল, ‘আমিও একই ব্যাপার কামনা করি। প্রচলিত ধারণার বাইরে যারা নতুন কিছু ভাবার চেষ্টা করে, প্রমাণ করার চেষ্টা করে তখন তাদের বাধার সম্মুখীন হতে হয়। আমাদের অবস্থা তো তাও ভালো, চার্চের মতের বিরুদ্ধে, প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানী ব্রুনো, বা গ্যালিলিও যখন বলেছিলেন যে সূর্য নয়, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে, তখন ব্রুনোকে পুড়ে মরতে হয়েছিল, আর গ্যালিলিওকে নতজানু হয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হয়েছিল অসহায় ভাবে। কিন্তু তাদের বক্তব্যই যে সত্যি ছিল তা ভবিষ্যতে প্রমাণিত হয়েছে।’
এ সব নানা কথা শুরু হল গঞ্জালোর সাথে সুদীপ্ত-হেরম্যানের। হঠাৎ একটা জিনিস খেয়াল করল তারা। সূর্য মেঘ অরণ্যের মাথায় যত হেলে পড়ছে তত যেন শূন্য শূন্য হতে শুরু করেছে সে জায়গা! ঘরে ফেরার জন্য একটা ব্যস্ততা লক্ষ্য করা যাচ্ছে সবার মধ্যে। আস্তাবলের সামনে জটলা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বেচা-কেনা, দোকানগুলোর ঝাঁপ। অদৃশ্য কোনো কিছুর আতঙ্ক যেন ঘর মুখী করে তুলছে স্থানীয় মানুষদের। ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারল সুদীপ্তরা । জায়গাটা জনশূন্য হয়ে যাচ্ছে দেখে তারা তিনজনও ফেরার জন্য পা বাড়াল ৷
ফেরার পথে হেরম্যান গঞ্জালোকে বললেন, ‘আমরা মিস্টার পেড্রোর খামারে আছি। আপনি শুনেছি মিস্টার অর্লান্ডোর অতিথি। তাদের দুজনের মধ্যে শুনেছি গোলযোগ, মামলা মোকদ্দমা আছে। আশা করি সে ছাপ আমাদের সম্পর্কে পড়বে না?
গঞ্জালো বললেন, “না, কখনই না। তাদের বৈরিতা বৈষয়িক ব্যাপার। আশ্রয়ের খোঁজে আমাদের ভিন্ন ভিন্ন জায়গাতে উঠতে হয়েছে। আমার আপনার মধ্যে তো আর বৈষয়িক সংঘাত নেই। বরং আমরা পরস্পরকে সহযোগিতা করব। ওই যে যেটা অরণ্য দেখছেন সেখানে পাড়ি দেব ভাবছি। এমনও হতে পারে যে ওই ওখানেই লুকিয়ে আছে আপনার চুপাকাবরা। ওখান থেকেই সে গ্রামে এসে হানা দেয়। ইচ্ছা হলে আপনারাও আমার সঙ্গী হতে পারেন। ‘
হেরম্যান সেই মোহাচ্ছন্ন পাহাড় অরণ্যর দিকে তাকিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, ওই অরণ্য সত্যি রহস্যময়। আমরা এখনও আমাদের কর্মপন্থা ঠিক করিনি। নিশ্চয়ই আপনার প্রস্তাব ভেবে দেখব। আপনার প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ।’
হাঁটতে হাঁটতে সুদীপ্তরা এক সময় পৌঁছে গেল তাদের খামারের প্রবেশ মুখে । তাদের থেকে বিদায় নিয়ে গঞ্জালো এগোলেন সামনের দিকে তার আশ্রমের দিকে। সূর্য ডুবে গেছে কুয়াশাচ্ছন্ন অরণ্যের মাথায়। দিনের শেষ আলো নিঃশেষ হয়ে আসছে। খামারের চারপাশ থেকে ভেসে আসছে দিন শেষে পশুদের ডাক। একযোগে বিভিন্ন ধ্বনিতে ডাকছে গোরু-শুয়োর-ভেড়া-ছাগলেরা। খামারে প্রবেশ করতে করতে হেরম্যান বললেন, ‘এ গ্রামের দুজন বিদেশির মধ্যে একজনের সাথে দেখা হল। গঞ্জালোকে মন্দ লাগল না। তবে সেই মার্কিন নেকড়ে শিকারির সাথে দেখা হল না। আশা করি তার সাথেও সাক্ষাৎ হবে। সুদীপ্তরা তাদের কটেজে প্রবেশ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই পশুদের কলরব থেমে গেল। সান-মারিয়ার চারণ ভূমির বুকে নেমে এল অন্ধকার। তারপর এক সময় হয়তো চাঁদ উঠল ঠিকই কিন্তু কটেজের পিছনের খোলা জানলা দিয়ে সুদীপ্ত দেখল পাথরের মাথার ওপর থেকে মেঘ ভাসতে ভাসতে ঢেকে দিল চাঁদকে। অদৃশ্য হয়ে গেল পাহাড় শ্রেণি। কুয়াশার চাদরে মুছে গেল কোস্টারিকার ছোট্ট গ্রাম সান-মারিয়া । রাত আটটা নাগাদ একজন লোক খাবার দিয়ে গেল। খাওয়া সেরে দীর্ঘ পথ পরিক্রমার ক্লান্তি দূর করতে যখন সুদীপ্তরা বিছানায় গেল তখন কুয়াশা মাখানো একে ভৌতিক পরিবেশ নেমে এসেছে এই ছোট্ট জনপদে খামারের বুকে।
৷৷ ৩ ৷৷
মোরগের ডাকে পরদিন ভোরে যখন সুদীপ্তদের ঘুম ভাঙল তখন সুর্যদেব উদয় হচ্ছেন পৃথিবীর বুকে। ঘুম থেকে একই সাথে উঠে বিছানা ছাড়ল সুদীপ্ত আর হেরম্যান। জানলা বন্ধ করে তারা শুয়েছিল। উঠে গিয়ে জানলা খুলে সুদীপ্ত বাইরে তাকাতেই দেখতে পেল এক অপূর্ব দৃশ্য। পিছনের উত্তুঙ্গ পাহাড়ের মাথায় কুয়াশা যেন অনেকটাই কেটে গেছে। পাহাড়ের মাথা থেকে সূর্যকিরণ ছড়িয়ে পড়ছে বনানীর গায়ে। নিচের পৃথিবীতে। খামারের চারপাশ থেকে পশুদের ডাক ভেসে আসছে। যেন প্রভাতী সূর্যকে সম্ভাষণ জানাচ্ছে তারা। হেরম্যান সুদীপ্তর পাশে এসে দাঁড়িয়ে প্রভাতী সূর্যালোকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘অপূর্ব! কী সুন্দর সকাল!’
সুদীপ্ত প্রশ্ন করল, “আজ আপনার পরিকল্পনা কী?”
হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘আজ গ্রাম ঘুরে চুপাকাবরা সম্পর্কে নতুন কোনো খবর সংগ্রহ করা যায় নাকি দেখি! গঞ্জালোর প্রস্তাবও ভেবে দেখব। তারপর সবকিছু ভেবে নিয়ে দুজনে আলোচনা করে আমাদের কর্মপন্থা ঠিক করব। প্রাতরাশ খেয়েই বেরিয়ে পড়ব আমরা।’
সুদীপ্তরা কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে নিল। ততক্ষণ লোক এসে প্রাতরাশও দিয়ে গেল। কফি আর বিন-চাল-পেঁয়াজ-মুরগির মাংস মিশ্রিত একটা ভারী প্রাতরাশ। যে খাবার দিয়ে গেল তাকে প্রশ্ন করে সুদীপ্ত জানতে পারল যে এ খাবারের নাম নাকি ‘গালো পিন্টো’। কোস্টারিকার গ্রামাঞ্চলে সবাই এই ভারী প্রাতরাশই খায়। কারণ, কৃষিজাত বা পশুচারণের কাজে নিয়োজিত থাকার কারণে অনেক সময় তাদের দুপুরে খাওয়া হয় না । তখন তাদের এই প্রাতরাশ কাজে লাগে। হেরম্যান তা শুনে হেসে বললেন, ‘তবে আমরাও খেয়ে নিই। আমরা কখন কোথায় যাই তার ঠিক নেই। এটা আমাদেরও কাজে লাগতে পারে।’ কফি সহযোগে সুদীপ্তরা ধীরে ধীরে উদরস্থ করল সেই গ্যালো পিন্টো’।
খাওয়া শেষ করে হেরম্যান বললেন, ‘খাবার ছেড়ে বাইরে যাবার আগে একবার মিস্টার পেড্রোর সাথে দেখা করে যাব। তিনি এখন নিশ্চই খামারে আছেন। গতকাল এ ঘরে পৌঁছে দেবার পর আর তো তার সাথে দেখাই হল না ! ‘
হেরম্যান পেড্রোর নাম নেবার সাথে সাথেই কাকতালীয় ভাবে তাদের ঘরে প্রবেশ করলেন খামার মালিক পেড্রো। চোখেমুখে তার স্পষ্ট উত্তেজনার ছাপ! হেরম্যান আর সুদীপ্ত তাকে ‘গুড মর্নিং’ জানাতেই পেড্রো কোনোরকমে তাদের প্রতি সম্ভাষণ জানিয়ে উত্তেজিত ভাবে বললেন, ‘ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে’ চুপাকাবরা আবার হানা দিয়েছে!
হেরম্যান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেছেন, ‘তাই নাকি? কোন খামারে? আপনার নাকি অন্য কারও ?’
খবরটা শুনে উত্তেজিত ভাবে উঠে দাঁড়িয়ে সুদীপ্তও বলল, ‘কটা প্রাণীকে হত্যা করল সে? কী প্রাণী?’
পেড্রো তাদের প্রশ্নর জবাবে ভীষণ উত্তেজিত ভাবে বললেন, “না, কোন গবাদি পশু নয়, তার আক্রমণের শিকার মানুষ এবার সে নরহত্যা করে তার রক্তপান করেছে! “মানুষ!’—একই সাথে শব্দটা উচ্চারণ করল সুদীপ্ত আর হেরম্যান। পেড্রোর কথায় এতটা চমক তারা আশা করেনি।
পেড্রো বললেন, ‘গতকাল রাতে মার্কেস নামে যে ছোকরা কাউবয়কে পশু পাহারার জন্য নিয়োজিত করেছিলাম সেই একটু আগে এসে খবরটি দিল। সে জানাল সে আর কোনো টাকার বিনিময়ই রাত পাহারা দেবে না। কারণ, গত রাতে ওই ভয়ঙ্কর রক্তচোষার হানায় মৃত্যু হয়েছে স্বয়ং পাদ্রী ডিসুজার! গ্রামের প্রবেশ মুখে চার্চের কাছেই রাস্তার মাঝখানে যেখানে ষাঁড়ের গাড়িটা রাখা আছে সেই বেদির নিচে পড়ে আছে ফাদার ডিসুজার রক্তশূন্য দেহ। গভীর ক্ষতচিহ্ন তার বুকে। সেই ক্ষত থেকে তাঁর রক্তপান করেছে চুপাকাবরা!”
সুদীপ্তরা স্তম্ভিত হয়ে গেল পেড্রোর কথা শুনে। একটু ধীরস্থ হবার পর হেরম্যান বললেন, ‘চলুন, আমরা সে জায়গাতে যাই।’
পেড্রোও সম্মতি প্রকাশ করলেন হেরম্যানের প্রস্তাবে। কটেজ ছেড়ে, খামার ছেড়ে তারা তিনজন রওনা হল সে জায়গার উদ্দেশ্যে।
কিছুক্ষণের মধ্যে অন্য স্থলে উপস্থিত হল তারা। বুলকাটটা যে বেদিতে রাখা আছে ঠিক তার নীচে অর্ধবৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু জনতা। মাথার টুপি খুলে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে তারা। তাদের চোখে-মুখে উত্তেজিত ভয়ার্ত দৃষ্টি। কেউ কেউ চাপা স্বরে আলোচনা করছে। সুদীপ্তরা সেই ভিড়ের মাঝখানে গিয়ে উঁকি দিল ভিতরে। তাদের চোখে পড়ল এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য। বেদির ঠিক নিচে পড়ে আছে বৃদ্ধ পাদ্রীর প্রাণহীন দেহ। তাঁর বুকে জেগে আছে এক ভয়ঙ্কর ক্ষতচিহ্ন! তার আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে রসুনের মালা, বুনো কাঠ গোলাপ আর তার ডাল। উলটো পড়ে আছে ধাতুর তৈরি ধুনোর পাত্র। তখনও তার থেকে মৃদু ধোঁয়া উঠছে।
বেশিক্ষণ সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না সুদীপ্তরা। ভিড় ছেড়ে তারা বাইরে বেরিয়ে এল।
কিছুটা তফাতে তারা এরপর দেখতে পেল তিনজনকে। তাদের একজনকে দেখেই সুদীপ্তরা বুঝতে পারল যে পুলিশকর্মী। তার পরনে সবুজ পোশাক, সবুজ টুপি, কোমরে চওড়া বেল্টে গোঁজা রিভলবার। একটা নোটবুকে সে সম্ভবত অন্য দুজনের এজাহার লিপিবদ্ধ করেছিল। সেই দুজনের একজন স্থানীয় যুবক-কাউবয়। অন্যজনের সবুজ জংলা-ছাপ পোশাক, হাই হিল জুতো, কাঁধে রাইফেল। ছিপছিপে চেহারার মাঝ বয়সি সেই লোকাটাকে দেখে কেন জানি সুদীপ্তর ঠিক স্থানীয় লোক বলে মনে হল না।
পেড্রো তাদের দেখিয়ে চাপা স্বরে বললেন, “ওই কাউবয়ের নামই হল মার্কেস, আর বন্দুকধারী হলেন সেই মার্কিন শিকারি মিস্টার বাজ সম্ভবত এজাহার নেওয়ার শেষ পর্ব চলছিল তখন। কথাবার্তা মিটে যেতেই সেই পুলিশকর্মী লোক দুজনকে ছেড়ে দিয়ে ভিড় ঠেলে প্রবেশ করল মৃতদেহর কাছে তার বাকি কাজ সম্পন্ন করার জন্য।
তিনি চলে যেতেই পেড্রো সুদীপ্তদের নিয়ে উপস্থিত হলেন সেই লোক দুজনের সামনে । তারপর কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলেন, ‘ব্যাপারটা কী? পুলিশ আপনাদের এজাহার নিল কেন?”
শিকারি বাজ জবাব দিলেন, ‘কারণ, আমরা দুজনই শুধু গতকাল রাতে ঘরের বাইরে ছিলাম। আর ফাদার ডিসুজার মৃতদেহ প্রথম আবিষ্কার করি।
‘ব্যাপারটা কী রকম’ বিস্মিতভাবে জানতে চাইলেন গঞ্জালো।
এরপর মিস্টার বাজ আর কাউবয় যুবক মার্কেসের বক্তব্যে সুদীপ্তরা যা বুঝতে পারল তা হল এই যে পেড্রোর সাথে রাত পাহারার ব্যাপারে মার্কেসের কথা হবার পর সে কাজের জন্য ঘোড়া সংগ্রহর জন্য গতকাল অন্ধকার নামার বেশ অনেক্ষণ পর এ জায়গাতে আসে মার্কেস। এ জায়গাতে তখন কোনো লোকজন নেই। সন্ধ্যা থেকেই কুয়াশার চাদরে মোড়া ছিল আকাশ। তার ওপর আবার গ্রামে ইলেকট্রিসিটি না থাকার কারণে স্ট্রিট লাইট নেই। খামারগুলোর ঘরে শুধু সৌর বিদ্যুতের আলো জ্বলে মিট মিট করে। সেই আলো বাইরে পৌঁছয় না। চার্চে আবার সৌর বিদ্যুৎও নেই। চারপাশের দোকানগুলোর ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেছিল সন্ধ্যা নামার আগেই। কাজেই জনশূন্য এ জায়গার চার্চ, আস্তাবল সবই ডুবে ছিল আধো-অন্ধকারে। আনুমানিক আটটা নাগাদ এখানে এসে আস্তাবল থেকে ঘোড়া সংগ্রহ করে সে যখন তার পিঠে চেপে এগোতে যাচ্ছে ঠিক তখনই তার চোখ পড়ে কিছুটা তফাতে রাস্তার ঠিক মাঝখানে বেদির ওপর যেখানে বুলকার্টটা রাখা আছে সেখানে। মুহূর্তর জন্য ঠিক সে সময়ই চাঁদের গা থেকে মেঘের আবরণ সরে গেছিল। মার্কেস দেখে যে একটা বড় কুকুরের মতো চতুষ্পদ প্রাণী প্রথমে যেন মানুষের মতো দু-পায়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর একলাফে অদৃশ্য হয়ে গেল ফুট-পাঁচের উঁচু বেদির ওপর রাখা গাড়িটার ছইয়ের ভিতর। মার্কেসের সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল প্রাণীটা হয়তো কোন কাউবয়ের ভুল করে ছেড়ে রেখে যাওয়া কুকুর হবে। রাতের ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্য সে আশ্রয় নিল গাড়ির ভিতর। পরদিন তার মালিক এসে নিশ্চই নিয়ে যাবে তাকে। যাই হোক তারপর সে রওনা হয় মাইল দেড়েক দূরে জঙ্গলের ঠিক নিচে পাহাড়ের ঢালে চারণ ভূমিতে যেখানে পেড্রোর পশুগুলো চরে বেড়াচ্ছে সে জায়গাতে। রাত ন-টা নাগাদ শিকারি বাজ এসে উপস্থিত হল তার কাছে। তিনি তার কাছে জানতে চান নেকড়ে জাতীয় কোন প্রাণী মার্কেস গ্রামের রাস্তায় দেখেছে নাকি? নেকড়ে শিকারের জন্য বাজ ঘাঁটি গেড়েছেন পাহাড়ের ঢালে জঙ্গলের প্রবেশ মুখের একটু ভিতরে স্থানীয় শিকারিদের পরিত্যক্ত এক কুটিরে। ওর আশেপাশের ঢাল বেয়েই নিচের চারণ ভূমি পেরিয়ে গ্রামে প্রবেশ করেছে। তা দেখে শিকারি বাজ যখন পাহাড় থেকে নিচে নেমে আসেন ততক্ষণে অন্ধকারে মুড়ে গেছে গ্রাম। পথে কোথাও লোকজন নেই, খামারগুলোর দরজাও বন্ধ হয়ে গেছে। গ্রামে ঢুকে প্রাণীটার অনুসন্ধান চালাতে থাকেন বাজ। কিন্তু নেকড়ে কেন, একটা কুকুরেরও দেখা পাননি তিনি। এভাবে ঘণ্টা তিনেক সময় কেটে যাবার পর চারণভূমিতে গিয়ে তিনি সাক্ষাৎ পান মার্কেসের এবং তাকে প্রশ্নটা করেন। আর এই প্রশ্নটা শুনে মার্কেসের মনে পড়ে যায় সেই দৃশ্যর কথা। এবং আরও এতটা জিনিস খেয়াল হয় তার। বেদিটা পাঁচ ফুট উঁচু। আর তার ওপর গাড়ির ছইটা অন্তত চার ফুটউঁচু। সব মিলিয়ে রাস্তা থেকে ছইয়ের ভিতর প্রবেশ করার জন্য অন্তত ন-দশ ফুট লাফ দিতে হবে কোনো প্রাণীকে। যা সাধারণ কুকুরের পক্ষে সম্ভব নয়, আর প্রাণীটার আকারও যেন বড় মনে হয়েছিল তার! কথাগুলো মাথায় আমার সঙ্গে সঙ্গেই বাজের প্রশ্নর জবাবে সে কথাগুলো জানায় তাকে। হ্যাঁ, কুকুর নয়, তবে নেকড়ের পক্ষে অতটা লাফ দেওয়া সম্ভব। বাজ অনুমান করেন প্রাণীটা সেই নেকড়েই। কাজেই মার্কেসের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সে রওনা হয় এ জায়গার উদ্দেশ্যে। পদব্রজে এখানে আসতে তার বেশ কিছুটা সময় লাগে। তিনি যখন এখানে এসে উপস্থিত হন তখন আস্তাবলের ভিতর থেকে একযোগে পা ঠোকার শব্দ করছিল জন্তুগুলো। যেন ভয়ঙ্কর কোনো কিছুর উপস্থিতি টের পেয়ে একযোগা পা ঠুকছিল ঘোড়াগুলো! এরপর বাজের মনে হয় বেদির ঠিক নিচে রাস্তার মধ্যে যে যেন পড়ে আছে। বাজ কাছে গিয়ে টর্চের আলো ফলতেই দেখতে পান এক বীভৎস দৃশ্য! পড়ে আছে ফাদার ডিসুজার প্রাণহীন দেহ। তার ঠিক বুকের কাছে জেগে আছে বীভৎস ক্ষতচিহ্ন! বাজের তখন ধারণা হয় প্রাণীটা হয়তো বা আস্তাবলে বা আবার ওই ছইয়ের মধ্যে আত্মগোপন করেছে। কাজেই সে কিছুটা তফাতে সরে গিয়ে বন্দুক হাতে নিয়ে লক্ষ করতে লাগে জায়গা দুটো। যাতে প্রাণীটা বাইরে বেরোলেই তাকে গুলি করা যায়। এভাবে এখানে দাঁড়িয়েই সারা রাত কেটে যায় তার। এক সময় ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে যায় ঘোড়াদের পা ঠোকার শব্দে। আলো ফুটতে শুরু করে। সে সময় তার রাত পাহারা শেষ করে ঘোড়া রাখার জন্য হাজির হয় মার্কেস। বাজ তখন তাকে মৃতদেহটা দেখায়। মার্কেসই এরপর গ্রামের সবাইকে গিয়ে ব্যাপারটা জানায়। মৃতদেহর ক্ষত দেখে তার নিশ্চিত ধারণা ব্যাপারটা চুপাকাবরার কাজ। কারণ ক্ষত থাকলেও মৃতদেহের গায়ে কোনো রক্ত নেই। তার রক্ত চুষে নিয়েছে রক্তচোষা চুপাকাবরা !
ইতিমধ্যে সুদীপ্তদের দেখে তাদের পাশে হাজির হয়েছেন গঞ্জালো। এই ভয়ঙ্কর খবর ইতিমধ্যে সব খামারেই পৌঁছে গেছে। সুদীপ্তর পাশে দাঁড়িয়ে তিনি শুনছিলেন বাজ আর মার্কেসের কথা। তাদের কথা শেষ হতে গঞ্জালোর দিকে পেড্রো কৌতূহলী ভাবে তাকাতেই সুদীপ্ত গঞ্জালোর সাথে পেড্রোর পরিচয় করিয়ে দিলেন। আর পেড্রোও বাজের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন সুদীপ্ত আর হেরম্যানের।
সুদীপ্ত এরপর মাঝবয়সি শিকারি বাজকে প্রশ্ন করল, আপনার কি ধারণা যে নেকড়ের আক্রমণের ফলেই মৃত্যু হয়েছে বৃদ্ধ পাদ্রীর ?
বাজ জবাব দিলেন, “হ্যাঁ, আমার ধারণা তাই। পাদ্রী ধুনোদানি নিয়ে গেছিলেন ও জায়গাতে। আর প্রাণীটা লুকিয়ে ছিল ওই ছেইয়ের মধ্যে। সাধারণত বন্য প্রাণীরা ধোঁয়া আগুনকে ভয় পায়। পাদ্রীর হাতে ধুনোদানি তখন নিশ্চই বেশ ধুঁয়ো ছড়াচ্ছিল। সেই ধুঁয়ো প্রবেশ করে বুল কার্টের ছইয়ের ভিতর। আর তাতেই নেকড়েটা বাইরে বেড়িয়ে আসে। আর ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বৃদ্ধর বুকের ওপর।’
তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মার্কেস বলল, ‘আপনার এই বক্তব্য আমি সমর্থন করি। হ্যাঁ, ওই ধোঁয়াতেই বাইরে বেরিয়ে এসেছিল প্রাণীটা। তারপর সে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফাদার ডিসুজার ওপর। তবে প্রাণীটা নেকড়ে নয়, চুপাকাবরা। নইলে ফাদারের দেহটা সাদা ফ্যাটফ্যাটে রক্তহীন হল কীভাবে?
হেরম্যানও মাথা নেড়ে সমর্থন জানালেন তার কথায়।
একটু ভেবে নিয়ে মার্কিন শিকারি বাজ বললেন, ‘আমি শিকারি। শ্বাপদের আক্রমণে ইতিপূর্বে আমি মানুষের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছি। সিংহ, বাঘ, নেকড়ের মতো প্রাণীরা অনেক সময় মৃত প্রাণীর উষ্ণ রক্ত পান করে। ঘটনাচক্রে প্রাণীটা যখন বৃদ্ধর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন তার দাঁতের আঘাতে বা নখরাঘাতে ছিন্ন হয়ে যায় মৃতর হৃৎপিণ্ড সংলগ্ন বুক। হৃৎপিণ্ডই তো রক্তের আধার। রক্ত বেরোতে শুরু করে আর তা চেটে খেতে থাকে নেকড়েটা।’ হেরম্যান সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তাহলে রক্ত পান করার পর নেকড়েটা শিকারের মাংস ভক্ষণ করল না কেন? সেটাই তো স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। নিশ্চই শিকারের সন্ধানেই সে পাহাড় থেকে নিচে নেমেছিল?’
বাজ বললেন, ‘হয়তো সে যখন মাংস ভক্ষণ করতে যাচ্ছে ঠিক তখনই আমাকে দূর থেকে আসতে দেখে গা ঢাকা দেয়। আমার কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাসই নেকড়েটাই ওই কাণ্ড ঘটিয়েছে। ওই সব চুপাকাবরার ঘটনা এখানকার সরল গ্রামবাসীদের অন্ধকুসংস্কার। আমেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন জঙ্গলে অন্তত কুড়ি বছর ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমি। অনেক দুর্লভ প্রাণী দেখেছি আমি। কিন্তু ও প্রাণীর অস্তিত্ব কোনো দিন টের পাইনি।’ বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই কথাগুলো বললেন তিনি।
হেরম্যান চুপ করে গেলেন তার কথা শুনে।
মার্কিন শিকারি বাজ এরপর বললেন, ‘পাদ্রী হত্যার ঘটনাটা খুব দুর্ভাগ্যজনক। সারা রাত জেগে কাটিয়েছি। বিশ্রাম নেবার জন্য আমাকে এবার ফিরতে হবে। কিন্তু যাবার আগে আমার মতো আপনাদের তিন বিদেশির এখানে আসার কারণটা জানতে পারি কি? সুদীপ্ত জবাব দিল, ‘হেরম্যান আর আমি ক্রিপ্টোজুলজিস্ট। রূপকথা-উপকথা-পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত প্রাণী বা নতুন ধরনের প্রাণী খোঁজা আমাদের নেশা। চুপাকাবরার সন্ধানেই আমরা এখানে এসেছি।’
আর তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই গঞ্জালো বললেন, ‘আর আমি ওখানে এসেছি ‘ইউ.এফ.ও’ বা ভিনগ্রহর মহাকাশ যানের সন্ধানে।’
তাদের কথা শুনে কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ করে থেকে বাজ বললেন, ‘আমাকে ক্ষমা করবেন। চুপাকাবরা বা মহাকাশ যান-এ দুটোর কোনোটার অস্তিত্বেই আমার বিশ্বাস নেই। এখন চলি। আবার আপনাদের সাথে আমার আশা করি দেখা হবে।’ এ কথা বলে লম্বা লম্বা পা ফেলে তিনি এগোলেন তাঁর ডেরায় ফেরার জন্য। তিনি চলে যাবার পর পেড্রো মাথা নেড়ে পাদ্রী ডিসুজার মৃত্যুর জন্য আক্ষেপ প্রকাশ করে বললেন, ‘আমাকেও এবার খামারে ফিরতে হবে। খামারের পশুগুলো আর গ্রামের মানুষদের ভাগ্যে ভবিষ্যতে কী লেখা আছে কে জানে ?”
পেড্রো খামারের উদ্দেশ্যে রওনা হবার পর কাউবয় মার্কেসও অন্যদিকে সরে গেল ৷ সে। আর এর কিছুক্ষণের মধ্যেই উপস্থিত সেই পুলিশ কর্মীর নেতৃত্বে পাদ্রী ডিসুজার মরদেহ উঠিয়ে সাদা কাপড়ে ঢেকে চার্চের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হল। ভিড়টা ফাঁকা হয়ে গেল। সেখানে শুধু দাঁড়িয়ে রইল সুদীপ্ত- হেরম্যান আর গঞ্জালো।
হেরম্যান গঞ্জালোকে প্রশ্ন করলেন, ‘ব্যাপারটা সম্বন্ধে আপনার ধারণা কী?’
গঞ্জালো জবাব দিলেন, মৃতদেহটা দেখে আমার ধারণা এটা সাধারণ কোনো প্রাণীর কাজ নয়। মৃত পাদ্রীর দেহে অন্য কোনো জায়গাতে আঘাতের চিহ্ন নেই নিশ্চই খেয়াল করেছেন? যেন রক্তপানের উদ্দেশ্যেই পাদ্রী ডিসুজার হৃৎপিণ্ড বিদীর্ণ করেছে প্রাণীটা। তার লভ্য বস্তু হিল ফাদার ডিসুজার বুকটাই।
হেরম্যান বলবেন ঠিক তাই। ক্ষতচিহ্নটা আমিও খেয়াল করেছি। বেশ অদ্ভুত ক্ষত চিহ্ন! তিনটে ছিদ্র! কেউ যেন তিনটে শলাকা সোজাসুজি বসিয়ে দিয়েছে তার হৃৎপিণ্ডে। নেকড়ের আক্রমণ হলে তার নখ বা দাঁতের আঘাতে ও জায়গার মাংস ফালাফালা হয়ে যাবার কথা। কিন্তু তা হয়নি। ছিদ্র করে রক্তপান করেছে রক্তচোষা।’
এ কথার বলার পর হেরম্যান তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার আগামী পরিকল্পনা কী? গঞ্জালো দূরে পাহাড়ের গায়ে মেঘ অরণ্যর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার ধারণা সব রহস্য লুকিয়ে আছে কুয়াশাচ্ছাদিত ওই অরণ্যর মধ্যে। ওখানেই তো ইউ.এফ.ও নামতে দেখা গেছে। চুপাকাবরা কোনো মহাজাগতিক প্রাণী বলেই আমার ধারণা। আর সে যদি এ পৃথিবীর কোনো প্রাণী হয় তাহলেও নিশ্চই তার আশ্রয়স্থল ওই মেঘ অরণ্য। সে নিশ্চই গ্রামে থাকবে না। রক্তর সন্ধানেই যে নিচে নেমে গ্রামে হানা দিচ্ছে।’
সুদীপ্ত বলল, ‘হ্যাঁ, যে কোনো প্রাণীর পক্ষেই ওই মেঘাচ্ছাদিত অরণ্য লুকিয়ে থাকার পক্ষে আদর্শ স্থান।’
গঞ্জালো একটু চুপ করে থেকে এরপর বললেন, “কাল ওই যে মেঘপাহাড়ের উদ্দেশ্যে রওনা হব আমি। আপনারাও যাবেন নাকি? মহাকাশে শব্দক্ষেপণের জন্য আমার কাছে একটা যন্ত্র আছে। গতকাল রাতে যখন তার হেডফোন কানে লাগিয়ে বসেছিলাম তখন এক অদ্ভুত শব্দ তরঙ্গ কানে এল। এবং সেটা যেন এল ওই পাহাড়ের দিক থেকেই ওর মাথা থেকে।
প্রস্তাব শুনে হেরম্যান বললেন, ‘হ্যাঁ, যাওয়া যেতে পারে। তবে আজকের রাতটা দেখে নেই। তেমন হলে কাল আপনার সঙ্গী হব আমরা।’ এরপর তারা তিনজনই ফেরার পথ ধরল। সুদীপ্তরা প্রবেশ করল নিজেদের খামারে। আর গঞ্জালো চলে গেলেন তার নিজের জায়গাতে। ঘরে ফিরে সুদীপ্ত হেরম্যানকে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, সত্যি যদি এমনটা হয় যে চুপাকাবরা কোনো ভিনগ্রহী তবে তা কি ক্রিপ্টিড বলে গণ্য হবে?
হেরম্যান হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই। রূপকথা, উপকথার প্রাণী, পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত প্রাণী যদি ক্রিপ্টিড হয় তাহলে মহাকাশের জীব নয় কেন? তবে আমার ধারণা চুপাকাবরা এ পৃথিবীরই কোনো প্রাণী হবে ।
দুপুরে বিশ্রাম নিয়ে বিকালের দিকে একবার বাইরে বেরোল সুদীপ্তরা। হাঁটতে হাঁটতে তারা গিয়ে উপস্থিত হল সেই চকে। বেদির ওপর দাঁড়িয়ে আছে সেই বলদের গাড়িটা। কিন্তু গতকাল বিকালেও সব মানুষের ভিড় তারা সেখানে দেখেছিল তার চারভাগের এক ভাগও মানুষ নেই সেখানে। দু-একটা দোকান খোলা ঠিকই কিন্তু লোকজনের মধ্যে কেমন যেন একটা ব্যস্ততার ভাব, চোখেমুখেও উত্তেজনার চিহ্ন স্পষ্ট। যেন, যথা সম্ভব দ্রুত কাজ সেরে ঘরে ফিরে যেতে চায় তারা। গবাদি পশুর মৃত্যুর ব্যাপারটা তো ছিলই কিন্তু পাদ্রী-ডিসুজার মৃত্যু ভয়ঙ্কর আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে স্থানীয় বাসিন্দাদের মনে। বৈকালিক পরিক্রমা শেষ করে সুদীপ্তরা যখন খামারে প্রবেশ করতে যাচ্ছে ঠিক তখনই তাদের সাথে দেখা হয়ে গেল খামার মালিক পেড্রোর সাথে। আতঙ্কের ব্যাপারটা প্রতিধ্বনিত হল তার কথাতেও। তিনি বললেন, ‘কাউবয়রা আর কোন ভাবেই কাজ করতে রাজি নয়। পাঁচজন পারিশ্রমিক পেলেও নয়। পশুদের ওপরই আমাদের জীবন জীবিকা নির্ভরশীল। খামার মালিকদের সভায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে রাত পাহারার কাজ আমরা নিজেরাই করব। প্রত্যেক খামার মালিকের কাছেই তো বন্দুক আছে। অবস্থার পরিবর্তন না হলে আগামীকাল রাত থেকে আমাকেও বেরোতে হবে নিজের পশুগুলোকে রক্ষা করার জন্য। ভাগ্যে কী লেখা আছে কে জানে ?’ হতাশ ভাবে কথাগুলো বলে মাথা নাড়তে নাড়তে পেড্রো খামারে প্রবেশ করে এগোলেন তার আস্তানার দিকে। অন্যদিন শেষ বিকালে এই সময় খামার মুখরিত হয়ে ওঠে পশুদের ডাকে। কিন্তু আজ খামারটাও কেমন যেন নিস্তব্ধ। পশুদের কোনো হাঁক-ডাক নেই। যেন কোনো অজানা আতঙ্ক সঞ্চারিত হয়েছে প্রাণীগুলোর মধ্যেও নিজেদের ঘরে ফিরে এল সুদীপ্তরাও। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকারের চাদরে মুড়ে যেতে শুরু করল গ্রাম। তারপর এক সময় পাহাড়শ্রেণির মাথায় চাঁদ উঠল বটে, কিন্তু মেঘ পাহাড়ের মেঘ মাঝে মাঝেই ঢেকে দিতে লাগল তাকে । খোলা জানলা দিয়ে সুদীপ্তদের চোখে বাইরের পৃথিবী যতটুকু দৃশ্যমান তা আরও রহস্যময় হয়ে উঠতে লাগল আলো-ছায়ার লুকোচুরিতে। সারা খামার জুড়ে, সারা গ্রাম জুড়ে বিরাজ করতে লাগল এক অপার্থিব নিস্তব্ধতা। এই নিস্তব্ধতা যেন অশুভ কোনো কিছুর অদৃশ্য আগমন বার্তা। হেরম্যান পর্যন্ত খাওয়া সেরে বিছানাতে যাবার আগে বললেন, ‘পাহাড়ে, জঙ্গলে, তাঁবুতে বা খোলা আকাশের নিচে বহু রাত কাটিয়েছি আমরা। সেখানে কোথাও শ্বাপদের হানা ছিল, মানুষের আক্রমণের ভয় ছিল, কিন্তু এমন গা-ছমছমে ভৌতিক পরিবেশ কোথাও দেখিনি !
সুদীপ্ত বিছানা নিতে নিতে মৃদু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ বুরুন্ডিতে সিংহর আক্রমণ ছিল, সুন্দাদ্বীপে কমাডো ড্রাগনের ভয় ছিল, অস্ট্রেলিয় সমুদ্রে দানব অক্টোপাসের টেনে নিয়ে যাওয়ার ভয় ছিল, কিন্তু সেসব জায়গাতে রক্তচোষার ভয় ছিল না। রক্তচোষা শব্দটার মধ্যেই কেমন যেন আতঙ্ক আর ভৌতিক ভাব আছে। আর এখানকার পরিবেশটাও ওই শব্দটার পক্ষে উপযুক্ত ।
কথা বলতে বলতে শুয়ে পড়ল তারা দুজন।
৷৷ ৪ ৷৷
শেষ রাতে হঠাৎই ঘুম ভেঙে গেল সুদীপ্তর। সে দেখতে পেল খাট থেকে নেমে হেরম্যান জানলা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছেন! খাটে উঠে বসে সে হেরম্যানকে প্রশ্ন করল, কি হল?” বাইরের আধো-অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘বাইরে বেশ কয়েকবার বন্দুকের শব্দ হল! তবে কাছ থেকে নয়, যেন একটু দূর থেকে। অন্তত তিনবার তো শব্দটা হল বটেই। পাহাড়ের গায়ে বেশ সময় নিয়ে প্রতিধ্বনিত হল শব্দটা। শেষ শব্দটা হল মাত্র কয়েক সেকেন্ড আগে ৷’
সুদীপ্ত অনুমান করল হয়তো বা সে শব্দেই ঘুম ভেঙে গেছে তার। বিছানা ছেড়ে চটপট উঠে জানলার সামনে হেরম্যানের পাশে এসে দাঁড়াল সে। সুদীপ্তর রেডিয়াম বসানো হাতঘড়িতে ভোর চারটে বাজে। জানলার বাইরে তখনও কুয়াশা মাখানো অন্ধকার বিরাজ করছে। দূরের পাহাড় শ্রেণি অস্পষ্ট একটা রেখার মতো আঁকা হয়ে আছে আকাশের বুকে। সেদিকে তাকিয়ে সুদীপ্ত বলল, ‘ঠিক বলেছেন গুলির শব্দ?’
হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ। প্রথমবারের শব্দটা সম্ভবত আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিল। তারপর পর পর দু-বার স্পষ্ট শুনলাম গুলির আওয়াজ!’
সুদীপ্ত স্বগোতক্তির স্বরে বলল, ‘এই ভোররাতে গুলি চালাল কে!’
হেরম্যান বললেন, ‘এমন হতে পারে নেকড়েকে লক্ষ করে গুলি চালিয়েছে সেই শিকারি বার্ক। অথবা অন্য কোনো কারণে অন্য কেউ। ভোরের আলো না ফুটলে ব্যাপারটা জানা যাবে না।’
সুদীপ্ত আর হেরম্যান জালনার বাইরে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্য একটা শব্দ কানে এল তাদের। কুয়াশা-মাখানো অন্ধকার ভেদ করে ঘোড়ার খুরের শব্দ। দূর থেকে শব্দটা এগিয়ে এসে খামারে প্রবেশ করল। আর তারপর একটা হাঁকডাক আর কিছু কথোপকথনের শব্দও যেন খামারের যেদিকে খামার মালিকের বাসস্থান সেদিক থেকে ভেসে এল সুদীপ্তদের কানে। এরপর আবার সেই ঘোড়ার খুরের শব্দ খামার ছেড়ে বেরিয়ে মিলিয়ে গেল অন্যদিকে হেরম্যান বললেন, “আমার অনুমান বাইরে কোনো কিছু ঘটেছে !
খোলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ভোরের প্রতীক্ষা করতে লাগল তারা । কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজায় ধাক্কা দেবার শব্দ হল ।
দরজা খুলেই সুদীপ্ত দেখতে পেল পেড্রোকে। তার সঙ্গে লণ্ঠন হাতে খামারেরই একজন লোক। পেড্রোর পরনে রাতপোশাক। বোঝাই যাচ্ছে যে বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছেন. তিনি। লণ্ঠনের আলোতে উত্তেজনার ভাব ফুটে উঠেছে তার চোখে। সুদীপ্ত আর হেরম্যানকে দেখে উত্তেজিত কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘আবারও চুপাকাবরা হানা দিয়েছে গ্রামে। আক্রমণ করেছে একটা লোককে। এই মাত্র একজন ক্রমে খবরটা দিয়ে গেল !
হেরম্যান প্রশ্ন করলেন, ‘ঘটনাটা কোথায় ঘটেছে?”
পেড্রো জবাব দিলেন, ‘গ্রামের শেষ মাথায় বুড়ো উইলসনের খামারে। উইলসন গুলিও চালিয়েছেন, কিন্তু গুলিটা সেই পিশাচের গায়ে লাগেনি। একটা লোককে মারাত্মক যখম করে রক্তচোষাটা পালিয়েছে। উইলসনেরই এক কর্মচারী এসে জানাল ব্যাপারটা। অন্য খামার মালিকদেরও সে খবরটা দিতে গেল।”
হেরম্যান প্রথমে সুদীপ্তর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আহত লোকটা তবে দেখেছে প্রাণীটাকে। কথা বলতে হবে তার সাথে।’ তারপর পেড্রোর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘ওই আহত লোকটা কি ওই খামারেই আছে? এখনই একবার সেখানে যাওয়া যেতে পারে ?”
পেড্রো পিছন ফিরে বাইরের আঁধো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে নিয়ে একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘আমি ভাবছিলাম আরও একটু আলো ফুটলে সেখানে যাব। এই অন্ধকারের প্রাণীটা যদি কোথাও ওৎ পেতে থাকে ?”
হেরম্যান বললেন, ‘বন্দুকের শব্দে প্রাণীটা নিশ্চই কিছুটা হলেও ভয় পেয়ে থাকবে। ভোরের আলোও কিছুক্ষণের মধ্যে ফুটবে। আমার কাছে রিভলবার আছে। আপনার খামারেও বন্দুক আছে। সে সব সঙ্গে নিয়ে বেরোলে খুব একটা বিপদের আশঙ্কা আছে বলে মনে হয় না।’
খামার মালিক পেড্রো একটু ভেবে নিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে আপনারা তৈরি হন। আমিও তৈরি হচ্ছি।’—এই বলে তিনি তার সঙ্গীকে নির্দেশ দিলেন আস্তাবল থেকে তিনটে ঘোড়া বার করার জন্য।
সুদীপ্তদের তৈরি হতে মিনিট পাঁচেক সময় লাগল। তারা বাইরে বেরোবার কিছুক্ষণের মধ্যেই পেড্রোর কাঁধে বন্দুক নিয়ে হাজির হলেন। ঘোড়াও এসে গেল। ঘোড়ার পিঠে চেপে খামার ছেড়ে বাইরের কুয়াশা মাখানো রাস্তায় আঁধো অন্ধকার ভেদ করে সুদীপ্তরা এগিয়ে চলল অকুস্থলের দিকে। যেতে যেতে হেরম্যান উত্তেজিত ভাবে বললেন, ‘চুপাকাবরার চেহারার আমূল বর্ণনা এবার লোকটার থেকে জানা যাবে।’
মিনিট কুড়ি চলার পর গ্রামের শেষ প্রান্তে উইলিয়ামের খামারে যখন তারা উপস্থিত হল তখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। কাঠের তৈরি একটা বাড়ি, একটা আস্তাবল, আর একটা ছোট খোঁয়াড় নিয়ে উইলিয়ামের খামার। বাড়ির পিছনের ছোট্ট চারণ ভূমিটা সোজা গিয়ে মিশেছে পাহাড়ের গায়ে জঙ্গলের পাদদেশে। এক সময় অন্য খামারগুলোর মতোই কাঠের গুড়ির বেড়াবেষ্টিত ছিল খামারটা। কিন্তু বর্তমানে তার অনেকটাই অদৃশ্য। খামারে ঢুকে বাড়িটার পিছন দিক থেকে বেশ কিছু লোকজনের গলার শব্দ শুনে সুদীপ্তরা উপস্থিত হল সে জায়গাতে। বেশ কিছু লোকজন ইতিমধ্যে জড়ো হয়েছে সেখানে। বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা। ঘোড়া থেকে নেমে সুদীপ্তরা পেড্রোর পিছু পিছু উপস্থিত হল সে জায়গাতে। ভিড়ের মধ্যে একজন অতিবৃদ্ধ লোক তার বন্দুকের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে অন্য লোকদের কী যেন বলছে। তাকে দেখিয়ে পেড্রো বললেন, ‘উনি হলেন এই খামারের মালিক উইলিয়াম। অন্য লোকগুলোর মধ্যে শিকারি বাজ আর গঞ্জালোকে দেখতে পেল সুদীপ্ত। তারাও উপস্থিত হয়েছেন ইতিমধ্যেই। সুদীপ্তরা এরপর সেই বৃত্তাকার জায়গাটার ভিতর উঁকি দিতেই তাদের চোখে পড়ল আর এক দৃশ্য। মাটিতে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে একজন লোক। প্রচণ্ড আতঙ্কে অথবা যন্ত্রণায় মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে তার শরীরটা। তার বুকের বাঁ-পাশে কাপড় চেপে ধরে বসে আছে একজন লোক। রক্তে লাল হয়ে উঠেছে কাপড়টা। বোঝাই যাচ্ছে আহত লোকটার রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছে না কিছুতেই। তাকে নিয়ে কী করা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ করছে উপস্থিত জনতা। মাটিতে পড়ে থাকা লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে পেড্রো একটু বিস্মিত ভাবে বললেন, ‘আরে ! এ যে হার্নান্দো?’
সুদীপ্ত জানতে চাইল, ‘লোকটা কে?’
পেড্রো জবাব দিলেন, ‘লোকটা চোর। খামার থেকে পশু চুরি করে। এ জন্য বার কয়েক জেলও খেটেছে লোকটা। আমার খামারেও একবার হানা দিয়েছিল হার্নান্দো।’ এ কথা বলার পর বুড়ো উইলিয়ামের সাথে চোখাচোখি হতে পেড্রো তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘ঘটনাটা কী?’
বুড়ো উইলিয়াম ইতিমধ্যে ঘটনাটা বার কয়েক বলেছেন অন্যদেরকে। একটু চুপ করে থেকে তিনি বললেন, “জানোই তো যে গতকাল রাতে কোন কাউবয়ই রাজি ছিল না পশুগুলোকে পাহারা দিতে। তার ওপর আমার খামার আবার গ্রামের শেষপ্রান্তে। গতকাল বিকালে যখন খামারে ফিরছি তখন খামারের বাইরে ঘুরঘুর করতে দেখলাম এই হার্নান্দোকে। মনের ভিতর এতটুকু—ডাকল। একে রক্তচোষার হামলা হচ্ছে তার ওপর আবার হার্নান্দো ঘুরে বেড়াচ্ছে খামারের কাছে। এদিকে আবার আমার তিনটে ছাগল সাতটা বাচ্চা দিয়েছে। আমি অনিদ্রার রোগী। রাতে ভালো ঘুম হয় না। ভাবলাম আমি তবে পাহারার কাজটা করি। তবে চুপাকাবরার জন্য ঘরের বাইরে বেরিয়ে কাজটা করার সাহস পেলাম না। ঘরের ভিতর বসে জানলা দিয়ে বন্দুক বাগিয়ে কাজটা করব ঠিক করলাম। এ জায়গাটা আমার জানলা দিয়ে দেখা যায়। মা সমেত ছাগলের বাচ্চাগুলোকে সন্ধ্যা নামার আগে আমি গ্যাব্রিয়লকে দিয়ে তাড়িয়ে এনে জড়ো করলাম এখানে। আমার ভৃত্য গ্যাব্রিয়ল। যে তোমাদের দুর্ঘটনার খবরটা দিল। আমরা দু-জন মানুষ শুধু এ খামারে থাকি। যাই হোক খাওয়া সেরে আমি একটা চেয়ার নিয়ে বন্দুক বাগিয়ে বসলাম জানলার ধারে। বাইরে তখন চাঁদ উঠলেও মেঘ পাহাড়ের মেঘ মাঝে মাঝে ঢেকে দিচ্ছে চাঁদকে। বাইরের সেই অস্পষ্ট অন্ধকারের মধ্যেই আমি ঘরের ভিতর থেকে পশুগুলোর ওপর নজর করার চেষ্টা করছিলাম। এভাবেই রাত কাটতে লাগল। শেষ রাতে একটু তন্দ্রা মতো লেগেছিল আমার। কিন্তু হঠাৎই একযোগে বেশ কয়েকটা ছাগলের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল আমার। বাইরে তখন মেঘ সরে গেছে কিছুক্ষণের জন্য। এ জায়গাটা ও পাশে পাহাড়ের ঢালের জঙ্গলে, ওই যে পাহাড়ে ওঠার সুঁড়ি পথটা সবকিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল সে সময়। হঠাৎ আমি দেখতে পেলাম একজনকে। ধীর পায়ে থমকে থমকে সে এগোচ্ছে পাহাড়ের দিকে পিছন রেখে বারবার তাকাচ্ছে পিছনে পাহাড়ের ঢালের দিকে। কিন্তু সে ওদিকে তাকাচ্ছে কেন? কয়েক মুহূর্তর মধ্যে আমি তার পোশাক আর অবয়ব দেখে অনুমান করে নিলাম যে লোকটা এই হার্নান্দো! সে এসে দাঁড়াল ওই যে গাছটা দেখছ ওর নিচে। চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে নিয়ে সে এরপর সোজা এগোতে যাচ্ছিল আমার বাড়িটার দিকেই। হয়তো বা পশুচুরি নয়, জিনিসপত্র চুরির মতলবেই সে এসেছিল। কিন্তু তার এগোনো হল না। গাছের ওপর থেকে একটা কালো ছায়া যেন এসে পড়ল তার ঘাড়ে। তাকে নিয়ে হার্নান্দো মাটিতে পড়ে গেল। আতঙ্কে যেন আর্তনাদ করে উঠল সে। একটা ঝটাপটি শুরু হল তাদের দুজনের মধ্যে। ছাগলগুলো আতঙ্কে ডাকতে শুরু করল। আমি এরপর আর চুপ থাকতে পারলাম না। গরাদের ফাঁক দিয়ে বন্দুকের মুখ আকাশের দিকে রেখে ট্রিগার টানলাম দু-দুবার কয়েক মুহূর্ত সময়ের ব্যবধানে। বন্দুকের প্রচণ্ড শব্দে ভয় পেয়ে প্রাণীটা মনে হয় ছেড়ে দিল হার্নান্দোকে। মেঘ তখন আবার ঢেকে দিচ্ছে চাঁদটাকে। সেই অস্পষ্ট আলোয় আমি মুহূর্তের জন্য দেখলাম সেই রক্তচোষাকে । আকারে সে বড় বালকের মতো হবে মনে মনে। কিন্তু চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে লম্বা লম্বা লাফে অদৃশ্য হয়ে গেল পাহাড়ের ঢালের দিকে। মেঘ ঢেকে দিল চাঁদকে। আমি আর রক্তচোষাকে ঠাহর করতে পারলাম না। ইতিমধ্যে তার কবল থেকে মুক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল হার্নান্দো। বুক চেপে ধরে টলোমলো পায়ে সে এগোতে লাগল আমার বাড়ির দিকে। কিন্তু শেষপর্যন্ত এ জায়গায় এসে সে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। বাড়ি ছেড়ে আসি আর গ্যাব্রিয়ল লণ্ঠন নিয়ে এ জায়গাতে এসে দেখলাম মাটিতে পড়ে ছটফট করছে হার্নান্দো। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বুক। আর এরপরই আমি গ্যাব্রিয়লকে পাঠালাম আপনাদের সবাইকে খবরটা দেবে।’
হেরম্যান বললেন, ‘কিন্তু এভাবে লোকটা এখানে পড়ে থাকলে মৃত্যু অনিবার্য । এখনই ওকে হাসপাতালে নেওয়া প্রয়োজন । ‘
এ কথা শুনে পেড্রো বললেন, ‘গ্রামে একটা মাত্র স্বাস্থ্যকেন্দ্র। তাতে একজন ডাক্তার, আর একজন নার্স। ডাক্তার আবার মানহোমে গেছেন ওষুধ আনতে, তার ফিরতে আরও দু-দিন সময় লাগবে।’
আর একজন বলল, ‘তাই তো ভাবছি এখন একে নিয়ে কী করা যায়? মহাসংকটে পড়া গেল!
হেরম্যান বললেন, ‘এ লোকটা কি প্রাণীটার সম্বন্ধে কিছু বলেছে আপনাদের? প্রাণীটা কি ওকে তাড়া করেছিল ?”
উইলিয়াম জবাব দিলেন, ‘না, কোনো কথা বলেনি। শুধু মাঝে মাঝে আর্তনাদ করছে।’ উইলিয়ামের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই লোকটা চোখ মেলে মাথাটা একটু ওঠাবার চেষ্টা করে বলে উঠল—‘জল, একটু জল… I’
হেরম্যান তাড়াতাড়ি তার কিট ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে তার কাছে এগিয়ে হাঁটু মুড়ে বসলেন তার সামনে। তারপর তার মাথাটা একটু তুলে ধরে ধীরে ধীরে ফোঁটা ফোঁটা জল ঢালতে লাগলেন তার ঠোঁটে।
একটু জল পান করল লোকটা। হেরম্যান তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘কে তোমাকে আক্রমণ করল? কোথা থেকে এল প্রাণীটা?’
প্রশ্ন শুনে লোকটা তার ডান হাতটা তুলে যেন পাহাড়ের ঢালটা দেখাবার চেষ্টা করল। কিন্তু তার দুর্বল হাতটা একটু ওপরে উঠেই মাটিতে পড়ে গেল। সে শুধু একটা শব্দ বলে উঠল—‘চুপাকাবরা!’ আর তারপরই প্রচণ্ড মৃত্যু যন্ত্রণায় মোচড় দিয়ে উঠে চিরদিনের জন্য স্থির হয়ে গেল। তার শূন্য দৃষ্টি শুধু স্থির হয়ে গেল পাহাড়ের মাথার দিকে তাকিয়ে । সূর্য উঠতে শুরু করলেও আদিম মেঘের আস্তরণে ঢেকে আছে সে জায়গা।
যত্ন করে লোকটার মাথাটা মাটিতে নামিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হেরম্যান বললেন, ‘চোর হোক বা ভদ্রলোক, কারও এমন মৃত্যু কাম্য নয়।”
উপস্থিত অন্যরাও মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে টুপি খুলল। যে লোকটা মৃতর বুকে কাপড় চাপা দিয়ে ধরেছিল, সে এবার সরিয়ে নিল কাপড়টা। মৃতদেহর বুকের ক্ষতচিহ্নটা ভোরের আলোতে এবার নজরে পড়ল সুদীপ্ত-হেরম্যানের। পাশাপাশি তিনটে গভীর ছিদ্র। কেউ যেন তিনটে সুতীক্ষ্ম শলাকা বিদ্ধ করেছে লোকটার বুকে। ঠিক এমনই ক্ষতচিহ্ন ছিল ফাদার ডিসুজার বুকের! হুবহু একই চিহ্ন! চুপাকাবরা !!!
হেরম্যান এরপর ভিড়ের বাইরে বেরিয়ে এগোলেন সেই গাছটার দিকে। যার মাথা থেকে প্রাণীটা ঝাঁপ দিয়েছিল মৃত হার্নান্দোর ওপর। সুদীপ্ত অনুসরণ করল তাকে।
গাছটা বেশি বড় নয়। অচেনা গাছ। মাটি থেকে আঠারো-কুড়ি ফুট ওপরে উঠে ডালপালা বিস্তার করেছে গাছটা। ঘন সন্নিবিষ্ট ডালপালা। তা দেখতে অনেকটা অর্ধবৃত্তাকার আইসক্রিমের মাথার মতো। গাছের নীচে ঘাসের ওপর এক জায়গাতে বেশ কিছু রক্ত পড়ে আছে। হতভাগ্য হার্নান্দোর রক্ত নির্ঘাত। হঠাৎ গাছের গুড়ির গায়ে একটা জিনিসের ওপর দৃষ্টি আকর্ষণ হওয়ায় হেরম্যান এগিয়ে গেলেন গুড়িটার সামনে। পকেট থেকে পেনসিল নাইফ বার করে গুঁড়ির গা থেকে একটা ছোট্ট জিনিস উপরে সেটা হাতের তালুতে রেখে মেলে ধরলেন সুদীপ্তর সামনে সুদীপ্ত জিনিসটা দেখে বলে উঠল, ‘আরে এটাতো একটা বুলেট ? ‘
হেরম্যান বললেন, “হ্যাঁ, তবে বন্দুক রাইফেলের নয় রিভলবারের। বুড়ো উইলিয়ামের বন্দুকটা দোনলা। তিনি বললেন যে দুটো গুলি ছুড়ে ছিলেন তিনি। আমি গুলি ছোড়ার তৃতীয় যে শব্দটা শুনেছিলাম সেটা যেন হালকা অস্পষ্ট ছিল। রিভলবারের শব্দ অত দূরে যাবার কথা নয়। কিন্তু সামনেই পাহাড়। উন্মুক্ত জায়গা বলে পাহাড়ে শব্দটা প্রতিধ্বনিত হয়ে আমাদের কানেও পৌঁছেছিল। অর্থাৎ বুড়ো উইলিয়াম ছাড়াও আরও কেউ সম্ভবত প্রাণীটাতে লক্ষ করে গুলি চালিয়েছিল?’
সুদীপ্ত বলল, ‘কে সে? শিকারি বাজ?’
হেরম্যান বললেন, ‘কিন্তু তার কাঁধে তো রাইফেল বেশ কিছুক্ষণ গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা ভাবার চেষ্টা করলেন হেরম্যান তারপর তারা আবার ফিরে চলল মৃতদেহটা যেখানে পড়ে আছে সেদিকে। মৃতদেহকে ঘিরে জটলাটা ততক্ষণে ভেঙে গেছে। গ্রামের সেই পুলিশকর্মীকে খবর পাঠাবার জন্য লোক পাঠানো হয়েছে। উপস্থিত জনতার কেউ কেউ ফেরার পথ ধরছে। তবে তখনও মৃতদেহের কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে আছে খামার মালিক উইলিয়ম, পেড্রো, মার্কিন শিকারি বাজ, গঞ্জালো, আরও দু-একজন লোক। সুদীপ্তকে নিয়ে হেরম্যান তাদের সামনে উপস্থিত হয়ে উইলিয়মকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি ঠিক দুটো গুলি ছুড়ছিলেন তাইতো? আর কোনো গুলির শব্দ শুনেছিলেন?
বৃদ্ধ উইলিয়াম তার বন্দুকটা উঁচিয়ে ধরে বললেন, ‘আমার এই দোনলা বন্দুকে মাত্র দুটো গুলিই ধরে। দুটো গুলিই ছুড়েছিলাম। পাহাড়ের গায়ে বেশ অনেকক্ষণ ধরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল গুলির শব্দ ? তবে যখন রক্তচোষা আর হার্নান্দোর মধ্যে ধস্তাধস্তি হচ্ছিল তখন যেন একবার তীক্ষ্ম কিচমিচ শব্দ শুনেছিলাম আসি। সেটা প্রাণীটার গলার শব্দও হতে পারে। অনেকটা তা বানরের ডাকের মতো।’
তাঁর কথা শুনে হেরম্যান জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ের ঢালের দিকে তাকিয়ে একটু চুপ করে যেতে বললেন, “আপনি তো পাহাড়ের ঢালের দিকেই পালিয়ে যেতে দেখেছিলেন প্রাণীটাকে। আপনার কথা আর মৃত লোকটার ইঙ্গিত দেখে মনে হচ্ছে এখান থেকেই নেমে এসেছিল প্রাণীটা।’
হেরম্যানের কথা শুনে পেড্রো বলল, ‘অন্যদের সাথে আলোচনা করে আমারও তাই ধারণা হল। আমরা, অর্থাৎ এখানে উপস্থিত খামার মালিকরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করলাম যে পাহাড় থেকে নীচে নামার ওই যে মুখ দেখা যাচ্ছে সেখানে আজ সন্ধ্যা থেকে আগুন জ্বালিয়ে রাখব। ওই রক্তপিশাচ চুপাকাবরা যদি পাহাড়ের জঙ্গল থেকে নেমে নীচের গ্রামে হানা দিয়ে থাকে তবে ওখানে আগুন জ্বালালে তার নীচে নামার পথ বন্ধ হবে।’
গঞ্জালো এতক্ষণ কথোপকথন শুনছিলেন, তিনি এবার বললেন, ‘আমারও কিন্তু ধারণা সব রহস্য লুকিয়ে আছে ওই ক্লাউড ফরেস্টেই। আজই আমি রওনা হব ওদিকে। আপনারা চাইলে সঙ্গী হতে পারেন এ প্রস্তাব আমি আগেই আপনাদের দিয়ে রেখেছি।’
তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে শিকারি বললেন, ‘আমি বেশ কিছুদিন ওই পাহাড়ের জঙ্গলে তাঁবু খাটিয়ে আছি। কিন্তু প্রাণীটা যদি ও জায়গাতে থাকত তবে তার সাথে কি একদিনও সাক্ষাৎ হত না আমার? তাছাড়া যে ধরনের প্রাণীরা কথা বলছে গ্রামবাসীরা, তেমন প্রাণীর অস্তিত্বে আমার ঠিক বিশ্বাস নেই।’
সুদীপ্ত প্রশ্ন করল, ‘আপনি ঠিক কোন জায়গাতে থাকেন ?”
শিকারি বাজ জবাব দিলেন, ওই সুঁড়িপথ বেয়ে কিছুটা ওপরে উঠে ডানদিকে আমার তাঁবু।’
সুদীপ্ত বলল, ‘এমনও হতে পারে যে প্রাণীরা আরও ওপরে থাকে। আপনার অলক্ষেই সে নীচে নেমে আসে?’
হেরম্যান শিকারি বাজকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার এখনও কী ধারণা যে নেকড়ের আক্রমণেই মৃত্যু হয়েছে হার্নান্দোর?
এ প্রশ্ন শুনে চুপ করে গেল শিকারি বাজ ।
হেরম্যান এরপর গঞ্জালোর উদ্দেশ্যে বললেন আপনার প্রস্তাবে আমরা রাজি। সত্যি পাহাড়টা বেশ রহস্যময় লাগে দূর থেকেই। ওর ওই মেঘের আড়ালে কী রহস্য লুকিয়ে আছে কে জানে? দেখে আসা যেতে পারে জায়গাটা।’
তার কথা শুনে গঞ্জালো বললেন, ‘আপনারা ওখানে যেতে চাচ্ছেন যান, কিন্তু পাহাড়ের মাথার দিকে কিন্তু নেকড়েদের আড্ডা। আপনারা কেউ শিকারি নন। নেকড়েরা অনেক সময় দলবদ্ধ হয়ে আক্রমণ করে। আমি নিজে শিকারি হয়েও তাই ভরসা পাইনি বেশি ওপরে ওঠার। আমার কথাটা একটু খেয়াল রাখবেন।’ এই বলে সুদীপ্তদের থেকে বিদায় নিয়ে বাজ এগোলেন পাহাড়ের দিকে।
বাজ চলে যাবার পর গঞ্জালোর সাথে মেঘ পাহাড়ে অভিযানের ব্যাপারে প্রাথমিক কথাবার্তা সারা হয়ে গেল সুদীপ্তদের। তারপর খামারে ফেরার জন্য ঘোড়ায় উঠে বসল তারা। প্রভাতী সূর্যকিরণ ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামের মাথায়। দুলকি চালে ফিরতে ফিরতে হেরম্যান পেড্রোকে বললেন, ওই মেঘে ঢাকা পাহাড়ের ভিতর কী আছে সে ব্যাপারে কোন ধারণা দিতে পারেন?”
পেড্রো জবাব দিলেন, “মাঝে মাঝে কাঠ সংগ্রহ করতে গ্রামের লোক দলবদ্ধ ভাবে পাহাড়ে যায়। তবে নেকড়ের ভয়ে তারা বেশি ওপরে ওঠেনা। ওখানে বড় বড় গাছ আর ঘন মেঘের রাজত্ব। তবে বাপ-ঠাকুর্দার মুখে শুনেছি যে মহাযুদ্ধর সময় নাকি একদল বিদ্রোহী স্পেনিয়ার্ড একটা ঘাঁটি গেড়ে ছিল ওই পাহাড়ের মাথায়। ওখানে নাকি একটা বাড়ি আছে। আরও একটা কথা জানাই, গ্রামে শয়তানটার হানা শুরু হবার কদিন আগে একদল কাঠুরে পাহাড়ে একটা হরিণের দেহ পেয়েছিল। তার বুকেও তিনটে ক্ষত ছিল। শয়তানটার ডেরা হয়তো পাহাড়টাই। নীচে নেমে যে গ্রামে হানা দিচ্ছে।
হেরম্যান বললেন, ‘আমরা তো পাহাড়টায় যাচ্ছি। নেকড়ে আর অন্য বন্য জন্তুদের উৎপাত হতে পারে। আপনার একটা বন্দুক ধার দেবেন?’
পেড্রো বললেন, ‘দেব, খামারে একটা বাড়তি বন্দুক আছে। ওটা অনেক সময় ট্রাঙ্কুলিন গান হিসাবেও ব্যবহার করা যায়। খামারে খ্যাপা ষাঁড়কে বশ মানাতে ওটা দিয়ে ঘুম পাড়ানি গুলিও ছোড়া হয়।’
কথাটা শুনে উল্লসিত হেরম্যান বলে উঠলেন, ‘চমৎকার। যদিও প্রাণীটাকে ধরার জন্য আমরা খাঁচা, ফাঁদ এনেছি। তবে ওটা আরও ভালো সাহায্য করতে পারে আমাদের ট্রাঙ্কুলিন সিরিঞ্জও কটা দয়া করে দেবেন।’
৷৷ ৫ ৷৷
পেড্রোর খামার বাড়িতে পৌছে অভিযানের জন্য জিনিসপত্র গোছগাছ করে নিল সুদীপ্তরা । একটা হালকা তাঁবু, বিশেষ ভাবে বানানো একটা হালকা অথচ মজবুত ফোল্ডিং খাঁচা, শুকনো খাবার, ওষুধপত্র ইত্যাদি নানা প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। পেড্রো এসে বন্দুক, ঘুমপাড়ানি গুলি, কার্তুজের বাক্স দিয়ে গেলেন। এসব সঙ্গে নিয়ে ঠিক বেলা দশটায় খামার ত্যাগ করল সুদীপ্তরা। কিছুটা এগোবার পরই পাশের খামারের বাইরে সুদীপ্তদের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়েছিলেন গঞ্জালো। তার কাঁধেও একটা রাইফেল। সুদীপ্তদের তিনি জানালেন তাদের মতো তিনিও তাঁর অস্ত্রটা সংগ্রহ করেছেন তাঁর খামার মালিকের কাছ থেকে। হেরম্যানের পিঠে গোটানো খাঁচাটা দেখে গঞ্জালো বললেন, ‘আপনারা দেখছি সব ব্যবস্থাই করে এগোচ্ছেন!’
সুন্দর সকাল। উজ্জ্বল আলোতে সবুজ চারণভূমিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে গবাদি পশুর দল। মাঝে মাঝের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে পাখির দল। আর তারই মাঝে সুন্দর ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছে ঢালু ছাদওলা খামার বাড়িগুলো। পশুর ডাক, মোরগের ডাক ভেসে আসছে তাদের ভিতর থেকে। সবকিছু কত সুন্দর কত স্বাভাবিক। দেখে কে বলবে যে সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গেই এ জায়গা কেমন বদলে যায়! কুয়াশা আর আতঙ্কের চাদরে মুড়ে যায় সারা গ্রামটা। একটা আধি ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয় গ্রাম জুড়ে, হানা দেয় সেই রক্তচোষা।
প্রথমে গ্রাম তারপর চারণভূমি অতিক্রম করে সুদীপ্তরা পৌঁছে গেল পাহাড়ে ওঠার সুঁড়ি পথের মুখে। সে পথ বেয়ে ওঠার মুখে একবার থমকে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের দিকে তাকাল সবাই। ঘন জঙ্গল ধাপে ধাপে উঠে গেছে ওপর দিকে। পাহাড় কিছুটা ওপরে ওঠার পর থেকেই ধীরে ধীরে শুরু হয়েছে মেঘের আনাগোনা। ধীরে ধীরে তার আড়ালে হারিয়ে গেছে অরণ্য। পাহাড় শ্রেণির মাথার ওপর দিকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না নীচ থেকে। সত্যিই সেখানে মেঘের অরণ্য—ক্লাউড ফরেস্ট। সুদীপ্তর নীচ থেকে সেদিকে তাকিয়ে মনে হল, কোন আদিম পৃথিবী যেন লুকিয়ে আছে ওই মেঘ-অরণ্যের আড়ালে। ওটাই কি চুপাকাবরার বাসস্থান?
সুঁড়ি পথ বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল তারা। ধীরে ধীরে পাকদণ্ডি উঠে গেছে ওপর দিকে। দু-পাশে ঘন গাছের জঙ্গল। ঋজু গাছের গুঁড়িগুলো সোজা উঠে গেছে ওপর দিকে। তাদের নীচে জমা হয়ে আছে পাতার রাশি। তাতে সুদীপ্তদের পা পড়াতে যতটুকু শব্দ হচ্ছে তা ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। সুদীপ্ত জানতে চাইল, ‘কী কী প্রাণী আছে এই জঙ্গলে ?’
হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘প্রায় পাঁচশো প্রজাতির প্রাণী। তবে অধিকাংশ প্রাণী ছোটখাট। নেকড়ে, দু-এক প্রজাতির হরিণ, শূকর আর টেপির ছাড়া তেমন কোনো বড় প্রাণী নেই। তবে কিন্তু প্রায় পাঁচশ ধরনের নতুন প্রজাতির প্রাণী জীব বিজ্ঞানির আবিষ্কার করেছেন এই মেঘঅরণ্য থেকে। তার মধ্যে ‘গোল্ডেন টড’ অন্যতম। যদিও আবিষ্কৃত প্রাণীগুলো ক্ষুদ্রাকৃতির, তবে কে বলতে পারে বড় কোনো নতুন প্রজাতির প্রাণী এ জঙ্গলে নেই?’ গঞ্জালো হেরম্যানের কথা সমর্থন করে বললেন, ‘নীচ থেকে মাথার ওপরের ওই মেঘ অরণ্য দেখে তো মনে হচ্ছে যে? যে-কোনকিছুই লুকিয়ে থাকতে পারে ওই মেঘের রাজ্যে। ওখানে তো মানুষের পা পড়েনা বলে মনে হয়।’
চলতে চলতে হেরম্যান গঞ্জালোকে প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, এই ‘ইউ.এফ.ও’, ভিনগ্রহর প্রাণী, এ সব ব্যাপারে আপনার আগ্রহ জন্মাল কীভাবে?
গঞ্জালো বললেন, “বলা যেতে পারে বই থেকে। ছেলেবেলায় স্কুল লাইব্রেরিতে জুলেভার্ন, এইচ. জি. ওয়েলস-এর বই পড়েছিলাম। বহির্বিশ্ব সম্পর্কে আগ্রহর পোকাটা সম্ভবত সে সময়তেই মাথায় ঢুকেছিল। সেই সময়ে প্রোগ্রামে গিলতাম মহাকাশ অভিযান, ভিনগ্রহর প্রাণী এসব ব্যাপার নিয়ে লেখা। তবে যদিও সে সময় ব্যাপারটা তার চেয়ে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলনা আমার জীবনে। আমার বাবা ছিলেন একজন বড় ব্যবসায়ী। তখন পয়সার অভাব আমাদের তেমন একটা ছিল না। পড়াশোনা শেষ করে যুবা বয়সে একবার ইজিপ্ট ঘুরতে গেলাম আমি। ঘটনাচক্রে গাইড আমাকে পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন স্থাপত্যের গায়ে এক ছবি দেখাল। এক নভশ্চরের ছবি। তার পোশাক, হেলমেট, পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার সব কিছু আধুনিক নভশ্চরের মতো! পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন দেওয়াল গাত্রে কে খোদাই করল এ ছবি? শুধু কল্পনা থেকে কি এমন ছবি আঁকা সম্ভব? আমার মাথার মধ্যে ছোটবেলার ঘুমিয়ে থাকা পোকাটা আবার নড়ে উঠল। দেশে ফিরে এসে পড়াশোনা শুরু করলাম এসব নিয়ে। পড়তে পড়তে দেখলাম পৃথিবীর নানা দেশের ইতিহাসে বা গল্পকাহিনিতে এমন সব ঘটনার কথা উল্লেখ আছে যা ইঙ্গিত দেয় গ্রহান্তরের মানুষদের পৃথিবীতে আগমনের। যেমন পৃথিবীর সব পৌরাণিক গাথাতেই আকাশ থেকে দেবতাদের মর্ত্যে নেমে আসার কথা উল্লেখ আছে। যাদের দেবতা বলা হচ্ছে তারা কি গ্রহান্তরের মানুষ? এ প্রশ্ন নিয়ে একটা চমৎকার বইও আছে দানিকেনের। তার সব প্রশ্নর উত্তর কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনও দিতে পারেননি। সভ্যতার ঊষা লগ্নে তো মানুষ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ব্যবহার তেমন জানত না বলেই মনে হয়। তবে কে তৈরি করল ‘অ্যাজটেক ক্যালেন্ডার?’ মহাকাশ সম্বন্ধে নিখুঁত জ্ঞান না থাকলে যা বানানো সম্ভব নয়। নিখুঁত জ্যামেতিক নকশায় প্রাচীন মিশরীয়দের পিরামিড বানাতে কে শেখাল? অথবা মাচুপিচুতে প্রাচীন ইনকারা কিভাবে বানাতে শিখল ভূমিকম্প নিরোধক বাড়ি? অথবা তাদের মাকমাহুনান স্থাপত্যে কিভাবে তারা গ্রানাইট পাথর গলাল? তার জন্য যে উত্তাপের প্রয়োজন তা তো আধুনিক ল্যাবরেটরি ছাড়া তৈরি সম্ভব নয়! তবে ভিনগ্রহীদের পৃথিবীতে উপস্থিতির একটা অকাট্য প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন রাশিয়ার নৃতত্ত্ববিদরা। ইউরাল পার্বত্য অঞ্চলে ১৯৯২ সালে খননের সময় তারা পেল এক অদ্ভুত জিনিস—’ন্যানো স্পাইরাল’। আণুবীক্ষণিক ধাতব স্প্রিং । অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক্স প্রযুক্তিতে যা ব্যবহার করা হয়, পরীক্ষায় দেখা গেছে তার বয়স কমসে কম এক লক্ষ বছর। টাংস্টেন বা মলিবডেনম সংকর ধাতুতে তৈরি ওই স্প্রিং মানুষ বানিয়েছে এই তো সেদিন ১৯৭০ সালে মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে। এক লক্ষ বছর আগে তখন পৃথিবীর বুকে বিরাজ করছে নিওথান্ডারাল মানুষরা। তারা ওই স্প্রিং বানাল কীভাবে? যা ভবিষ্যতের পৃথিবীর মানুষদের বানাতে এক লক্ষ বছর সময় লেগে গেল! তাহলে কি আদিম পৃথিবীতে, অথবা সভ্যতার ঊষা লগ্নে বহির্বিশ্ব থেকে এমন কেউ বা কারা এসেছিল যারা পৃথিবীর মানুষের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল? এসব প্রশ্নই আমার মনের দরজা খুলে দিল।’
গঞ্জালোর কথা শুনতে শুনতে পাকদণ্ডী বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল সুদীপ্তরা। পথের দু-পাশে ক্রমশ ঘন, আরও ঘন হয়ে উঠছে অরণ্য। টুপটাপ পাতা খসে পড়ার শব্দ ছাড়া আর কোথাও কোনো শব্দ নেই। যত তারা ওপরে উঠছে পরিবেশটা যেন তত স্যাতস্যাতে ভেজা ভেজা হয়ে উঠছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর গঞ্জালো ওপরে উঠতে উঠতে আবার চলে গেলেন ইউ.এফ.ও’র প্রসঙ্গে। তিনি বলতে লাগলেন, ‘ও সব ব্যাপারই আমাকে আকৃষ্ট করল ‘ইউ.এফ.ও’, ভিনগ্রহী ইত্যাদির প্রতি। আমি যুক্ত হয়ে গেলাম এসব নিয়ে যারা কাজ করেন তেমন কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের সাথে। আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন সংস্থা কিন্তু নিয়মিত ভাবে তদন্ত চালায়। ইউ.এফ.ও’ নিয়ে। আমেরিকার সরকারি নথিতেও ১৯৪৮ সালে ইউ.এফ.ও’ দেখার উল্লেখ আছে। এই ইউ.এফ.ও’ অনুসন্ধানের জন্য আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর অধীনে গঠিত হয় দুটি সংস্থা—প্রোজেক্ট মাইন ও প্রোজেক্ট ব্লু-বুক। দ্বিতীয় সংখ্যাটি ১৮ বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে ইউ.এফ.ও’ সংক্রান্ত ১২৬০০ জন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ সংগ্রহ করে। আর তার মধ্যে ৭০০-র বেশি ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পায়নি বিশেষজ্ঞর দল। বহু দেশের সিক্রেট সার্ভিস এজেন্সি প্রতিনিয়ত গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে ইউ.এফ.ও নিয়ে। সরকারি দপ্তরগুলোতে জমে উঠছে গোপন ফাইল। ১৯৮৯ সালে রাশিয়ার সংবাদ সংস্থা ‘টাস’-তো একবার ঘোষণাই করে দিয়েছিল যে রাশিয়ার সরকারের কাছে ‘ইউ.এফ.ও’ সংক্রান্ত অকাট্য প্রমাণ আছে! প্রাচীন ইতিহাসেও কিন্তু ইউ.এফ.ও’র প্রমাণ আছে। মিশরে এক প্রাচীন প্যাপিরাসে বলা হচ্ছে ৩৫০০ বছর আগে ফারাও তৃতীয় থুটমাস নিজে আকাশের বুকে চাক্ষুস করেছিলেন এক মহাকাশ যান। রোমের প্রাচীন ইতিহাসেও লেখা আছে আকাশ যানের কথা। অনেক নীচ থেকে দেখে তাদের মনে হত সার সার বৃহদাকৃতির ধাতব কাক যেন উড়ে চলেছে আকাশ পথে।’
ওপরে উঠতে উঠতে ‘ইউ.এফ.ও’সংক্রান্ত আলোচনায় আরও যে কথা বললেন গঞ্জালো তাতে বিস্মিত হল সুদীপ্ত আর হেরম্যান। তিনি বললেন;—’সুদীপ্ত তুমি তো ভারতীয়। তোমাদের দেশে প্রাচীন ভাষা ছিল সংস্কৃত। ও ভাষায় “বিমানিকা শাস্ত্র’ বলে এক প্রাচীন পুঁথির সন্ধান মিলেছে। কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন পুঁথি। যা একসময় পড়ানো হতো নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাইট ভ্রাতৃদ্বয় তো মাত্র ১৯০৩ সালে বিমান আবিষ্কার করেন। কিন্তু ওই পুঁথিতে চার ধরনের আকাশযানের উল্লেখ আছে। শাকুনা, রুকমা, ত্রিপুরা আর সুন্দরা। শাকুন বিমানের আকৃতি ছিল বৃত্তাকার প্রকাণ্ড বাড়ির মতো। ৫০০ লোক ধরত তাতে। বিশেষ মিশ্র ধাতু দিয়ে তৈরি সে বিমানে জ্বালানি হিসবে ব্যবহৃত হত সৌর শক্তি। অথচ সৌরশক্তির ব্যবহার তো শুরু হয় ১৯৬০ সালের পর! তবে এ বিমান, এ প্রযুক্তির ব্যবহার প্রাচীন ভারতীয়রা জানল কীভাবে? নির্ঘাত তারা এ সম্বন্ধে জেনে ছিল কোনো মহাকাশ যানকে দেখে । আর যারা তা বানিয়েছিল তারা বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে অনেক বেশি উন্নত ছিল পৃথিবীর মানুষের চেয়ে যারা মহাকাশ থেকে নেমে এসে জ্ঞানের আলোতে উদ্ভাসিত করেছিল পৃথিবীর মানুষকে…।”
চলতে চলতে গঞ্জালোর কথা শুনতে শুনতে সুদীপ্ত আর হেরম্যান বুঝতে পারলেন যে ‘ইউ.এফ.ও’র ব্যাপারটা সত্যি হোক বা না হোক এসব নিয়ে বেশ পড়াশোনা আছে ভদ্রলোকের। এরপরই হঠাৎ বেশ বড় হরিণের পাল দেখতে পেল তারা। প্রাণীগুলো তাদের সামনের রাস্তা লাফ দিয়ে পেরিয়ে গেল। গঞ্জালো একসময় হেরম্যানের কাছে পালটা জানতে চাইলেন, ‘আপনি এই ক্রিপ্টোজুলজি ব্যাপারটার সাথে যুক্ত হলেন কীভাবে?’
হেরম্যান হেসে বললেন, ‘প্রাথমিক অবস্থায় আমার এ ব্যাপারে আগ্রহ জন্মেছিল আপনারই মতো গল্পের বই পড়েই। বইয়ের চেয়ে বড় বন্ধু আর কেউ নেই। ছোটবেলায় পড়েছিলাম লেখক আর্থার কোনান ডয়েলের ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’ গল্পটা। যে গল্প খুব নাড়া দিয়েছিল আমার মনে। আমার মনে হয়েছিল এই বিপুলা পৃথিবীর এখনও তো অনেক কিছুই অজানা মানুষের কাছে ৷ তুষারাবৃত পর্বত কন্দর, গহীন অরণ্য প্রদেশ, মহা সমুদ্রর অতলে এখনও এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে পৃথিবীর মানুষ পৌছতে পারেনি। আমাদের পরিচিত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন সেই অদেখ৷ অজানা পৃথিবীতে কি ‘লস্ট ওয়ার্ল্ড’ গল্পের মতো কোনো প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী অথবা নতুন কোনো জীব লুকিয়ে থাকতে পারেনা? জীববিদ্যার ওপর আমার বরাবরই আগ্রহ ছিল। আর তা নিয়ে পড়ার জন্য ভর্তি হলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর সেখানে পড়তে গিয়ে দেখলাম এখনও পৃথিবীর বুকে নানা ধরনের নতুন প্রাণী আবিষ্কার হয়ে চলেছে। তাদের মধ্যে এক অংশের প্রাণীকে ধরা হতো পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী, যেমন লক্ষ কোটি বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে ধরে নেওয়া হওয়া ‘সিলিকাহু’ মাছ অথবা তাদের একসময় ধরা যেত রূপকথা-গল্পকথার প্রাণী হিসাবে। যেমন ইন্দোনেশিয়ার জীবন্ত ড্রাগন দানবাকৃতির কমান্ডো গিরগিটি। আর এপরই আমি বইয়ের মাধ্যমে পরিচিত হলাম বিজ্ঞানী হুডেলসম্যানের ‘ক্রিপ্টোজুলজি’ শব্দের সাথে। আমি জানলাম হিমালয়ের পর্বত কন্দরের বাসিন্দা ইয়েতির কথা, ইন্দোনেশিয়ার আগ্নেয়গিরি অধ্যুষিত জঙ্গলে প্রাগৈতিহাসিক উড়ন্ত দানব সাহুলের কথা, নিউজিল্যান্ডের নেকনেমির জলদানব, সমুদ্রতলের দানব অক্টোপাস বা মাদা গাস্বারের নরখাদক গাছের কথা বা আফ্রিকার সিংহ মানুষের কথা। আর এ সব জানার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ভেবে নিলাম আমি কী করব। অধ্যাপক বা গবেষক তো সবাই হন, কিন্তু নিশ্চিন্ত জীবন, মোটা বেতনের চাকরি ছেড়ে অজানার সন্ধানে ছোটে কজন ? আমি তাই এ পথটা বেছে নিলাম। এখনও আমি তেমন কিছু ক্রিপ্টিড সত্য পৃথিবীর কাছে উপস্থিত না করতে পারলেও উত্তুঙ্গ হিমালয় থেকে সমুদ্রতল, বুরুন্ডির পিগমি অধ্যুষিত বনভূমি থেকে বোর্নিওর আগ্নেয় পর্বত কত জায়গাতেই ক্রিপ্টটিডের খোঁজে ঘুরে বেড়ালাম আমরা দুই বন্ধু, পরিচয় হল কত মানুষের সঙ্গে। এক জীবনে এতো কিছু দেখার, জানার সৌভাগ্যই বা কজনের হয়? এই সব অভিযানের আনন্দ বা রোমাঞ্চ কি ক্লাসরুম বা ল্যাবরেটরিতে বসে পাওয়া যেত?
গঞ্জালো বললেন, ‘ঠিক তাই প্রচলিত পথে না হেঁটে অন্য পথে হাঁটার মধ্যে অন্য একটা রোমাঞ্চ আছে ৷ আমিও যেমন ছুটে বেড়াচ্ছি অজানার সন্ধানে পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্তে এমনকী ইউ. .এফ.ও-র সন্ধানে রাশিয়াতেও গিয়েছিলাম বেশ কয়েক মাস। কত অৰ্থ আমি খরচ করি এ সবের খোঁজে। এ জন্য অনেক লোক আমাকে পাগলও ভাবে।’ এরপর তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘ধরুন আপনারা যদি প্রাণীটাকে বন্দি করতে পারেন তবে তাকে নিয়ে কী করবেন? ‘
হেরম্যান বললেন, ‘তবে তাকে নিয়ে সভ্য সমাজের পণ্ডিতদের দেখাব, তাদের ব্যঙ্গবিদ্রুপের জবাব দেব। ইওরোপ-আমেরিকার যে কোনো চিড়িয়াখানা বা গবেষণাগারও কিন্তু তখন তাকে কয়েক লক্ষ ডলারে কিনতে চাইবে। তবে প্রাণীটাকে ধরার পিছনে টাকা কখনই মূল উদ্দেশ্য নয়, মূল উদ্দেশ্য হল এই আবিষ্কারের মাধ্যমে ক্রিস্টোজুলজি চর্চাকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা। যাতে ক্রিপ্টোজুলজিস্টদের কাজ নিয়ে আর হাসাহাসি না করেন পণ্ডিত বিজ্ঞানীরা।’
ক্রিপ্টোজুলজি, ইউ.এ .এফ.ও.-এ সব ব্যাপার নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে করতে সুদীপ্তরা ক্রমশ এগিয়ে চলল। সময়ও এগিয়ে চলল তাদের সঙ্গে সঙ্গে। ওপরে ওঠার ক্লান্তি . দূর করার জন্য বার কয়েক মিনিট বিশ্রামও নিল তারা। সুদীপ্তরা যত ওপরে উঠতে লাগল তত চারপাশে পরিবেশ আরও স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা ভেজা হয়ে উঠতে লাগল। গাছগুলোর গায়েও পুরু হয়ে উঠতে লাগল শ্যাওলার স্তর। এর মধ্যে আরও বেশ কবার হরিণের দেখা মিলল। বেশ বড় আকারের হরিণ। শেষ বিকালে তারা এসে উপস্থিত হল পথের মাঝখানে একটা ফাঁকা জায়গাতে। তাদের সামনের রাস্তা আরও কিছুটা ওপরে উঠে মেঘের রাজ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে। হেরম্যান সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আসল মেঘ অরণ্য ওই জায়গা থেকেই শুরু হচ্ছে বলে মনে হয়। আজ এখানেই তাঁবু ফেলা যাক । কাল আমরা প্রবেশ করব ওই মেঘ অরণ্যে। গঞ্জালোও সম্মত হলেন তার প্রস্তাবে।
গঞ্জালোও সঙ্গে একটা তাঁবু এনেছিলেন। কিছু সময়ের মধ্যেই পাশাপাশি দুটো তাঁবু খাটিয়ে ফেলা হল। স্পিরিট স্টোভ জ্বালিয়ে চা বানানো হল। চা পানের পর গঞ্জালো তার জিনিসপত্তর ভিতর থেকে একটা বেশ লম্বা দূরবিন বার করে বললেন, ‘রাতে আকাশ দেখা আমার একটা নেশা। রাতে কিছুক্ষণ আকাশ না দেখলে আমার ঘুম আসেনা।’
সুদীপ্তদের তাঁবু দুটোর এক পাশে কিছুটা তফাতে পাহাড়ের ঢাল শুরু হয়েছে। সেদিকে গাছগুলো একটা ফাঁকা ফাঁকা। সামান্য একফালি আকাশ দেখা যাচ্ছে সেখান দিয়ে। একটা ছোট স্ট্যান্ডের ওপর সেখানে লম্বা চোঙার মতো, দূরবিন বসাতে বসাতে এক সময় আকাশ টেলিস্কোপের মুখটা নীচের দিকে করে গঞ্জালো বললেন, ‘গ্রামবাসীরা দেখছি ইতিমধ্যেই তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে।’ তার কথা শুনে সুদীপ্ত গিয়ে চোখ রাখল দুরবীনের নলে। অনেক ওপরে উঠে এসেছে সুদীপ্তরা। কিন্তু টেলিস্কোপে চোখ রাখতেই পাহাড়ের পাদদেশটা যেন তার কয়েক হাতের ব্যবধানে চলে এল। সুদীপ্ত দেখল পাহাড় ওঠার সেই সুঁড়ি পথের মুখটায় আগুন জ্বালানো শুরু হয়েছে। যারা সে কাজে নিয়োজিত তাদের মুখগুলোও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। খামার মালিক পেড্রোকেও দেখা যাচ্ছে সে কাজের তদারকি করতে। ছুপাকাবরার আক্রমণ ঠেকাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরা।
সূর্য চলে পড়তে শুরু করল এক সময়। আর তার সাথে সাথেই যেন মেঘ অরণ্যর মেঘ ধীরে ধীরে ওপর থেকে নীচের দিকে নামতে শুরু করল। গঞ্জালোর টেলিস্কোপ বসানো হয়ে গেছিল। কিন্তু ক্রমশ নীচে নেমে আসা মেঘের দিকে তাকিয়ে একটু বিমর্ষ ভাবে বললেন, ‘যা অবস্থা তাতে মেঘের জন্য আকাশ দেখা হবে না । তাঁবুতে ঢুকে মহাকাশে শব্দ তরঙ্গ ক্ষেপণ যন্ত্রটার হেডফোন নিয়ে বসি। যদি কিছু সংকেত পাই।’কিছুক্ষণের মধ্যেই সুদীপ্ত আর হেরম্যান নিজেদের তাঁবুতে ঢুকে পড়ল। গঞ্জালোও গিয়ে ঢুকলেন তাঁর তাবুতে। গঞ্জালোর কথাই সত্যি প্রমাণিত হল। অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গেই রাশি রাশি মেঘ এসে ঘিরে ধরল তাদের তাঁবুদুটোকে। তাঁবুর ভিতর একটা বাতি জ্বালিয়ে গল্প করতে বসল হেরম্যান আর সুদীপ্ত। এক সময় চাঁদ উঠল। পাহাড়ের ঢালে গাছের ফাঁক দিয়ে কিছু সময়ের জন্য চাঁদের আলো এসে পড়ল। ঠিক সময় আমার ওপর মেঘঅরণ্য থেকে একদল প্রাণীর সমবেত ডাক ভেসে এল। হেরম্যান বললেন, “নেকড়ের ডাক। চাঁদের দিকে তাকিয়ে রাত্রিকে আহ্বান জানাচ্ছে আদিম প্রকৃতির সন্তানরা। তুমি নিশ্চয়ই জানো যে অনেক দেশে এই নেকড়েদেরও রক্তচোষা মনে করা হয়। ওদের বলে ‘ওয়ার উলফ’, যুদ্ধে যারা মারা যায় তারা নেকড়ের রূপ ধারণ করে মানুষের রক্ত পান করে। ইউরোপের বেশ কিছু পার্বত্য দেশে যেমন রোমানিয়া, হাঙ্গেরি ইত্যাদি জায়গাতে এ ধারণা বিশেষ ভাবে প্রচলিত ।’
নেকড়ের কথায় সুদীপ্তর মনে পড়ে গেল নেকড়ে শিকারি বাজের কথা । সুদীপ্ত বলল, “শিকারি বাজ কিন্তু বেশ দৃঢ়ভাবেই বলছিল যে পাদ্রী ডিসুজার হত্যার ব্যাপারটা চুপাকাবরা নয়, নেকড়েরই কাণ্ড।’
হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘তার কথা হয়তো বা কিছুটা বিশ্বাস করা যেত যদি না দ্বিতীয় হত্যাকাণ্ডের কোনো প্রত্যক্ষদর্শী থাকত। তবে আমার দৃঢ় ধারণা যে ওই দুর্ঘটনার সময় তৃতীয় আরও একজন ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত ছিল যে প্রাণীটাকে লক্ষ করে গুলি চালিয়েছিল। হয়তো বা সে কোনো গ্রামবাসী হবে। হয়তো বা তার ধারণা হতে পারে তারই গুলি বুকে লেগেছে চোরটার। তাই ব্যাপারটা সে চেপে গেছে।
মেঘ আবার ঢেকে দিল চাঁদকে। একসময় বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল সুদীপ্তরা। পথশ্রমের ক্লান্তিতে ঘুম নেমে এল তাদের চোখে।
তখন প্রায় রাত শেষ হতে চলেছে। হঠাৎ যেন একটা তীব্র কিছু কিচ কিচ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল সুদীপ্তর। মেঘের চাদরের ফাঁক গলে কীভাবে যেন বৃত্তাকার চাঁদের আলো এসে পড়েছে তাবুর একপাশে। ঘুম ভেঙে পাশ ফিরতেই হঠাৎ সুদীপ্তর চোখ পড়ল সে জায়গাতে। সুদীপ্ত দেখতে পেল সিনেমার পর্দার মতো সেই বৃত্তাকার আলোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছায়া। তার অবয়ব মানুষ বা দোপেয়ে কোনো প্রাণীর মতো। মুহূর্তর জন্য সে দেখতে পেল এই দৃশ্য। আর তারপরই ছায়াটা যেন লাফিয়ে সরে গেল। মাথার কাছেই রাখা ছিল হেরম্যানের রিভলবারটা। সুদীপ্ত সঙ্গে সঙ্গে সেটা নিয়ে লাফিয়ে উঠে তাবুর পর্দা ফাঁক করে বাইরের দিকে তাকাল। সামনেটা ঘন মেঘে আচ্ছন্ন। আট-দশ হাত দূরেও কিছু দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। হেরম্যানও উঠে বসলেন এবার। সুদীপ্ত ঘটনাটা জানাল তাকে। হেরম্যান বললেন, ‘আলো ফোটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।
৷৷ ৬ ৷৷
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সূর্যের আলো ফুটতে শুরু করল। তাঁবুর ফাঁক দিয়ে সুদীপ্তরা দেখতে পেল ধীরে ধীরে বাইরের মেঘ সরে যাচ্ছে। বাইরের মেঘের বলয় যখন একটু দূরে সরে গেল তখন সুদীপ্তরা তাঁবুর বাইরে বেরোল। খাদের মাথার ওপর মেঘ-অরণ্য কিন্তু একই রকম মেঘের পর্দায় ঢাকা। তারা দেখতে পেল গঞ্জালোও তার তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাকে সুপ্রভাত জানিয়ে হেরম্যান জানতে চাইছেনল, ‘কখন তাঁবুর বাইরে বেরোলেন?’
গঞ্জালো জবাব দিলেন, ‘এই তো এইমাত্র। বাইরে যা মেঘ ছিল তাতে বেরোনোর কোনো উপায় ছিল কি?’
হেরম্যান আর সুদীপ্ত এরপর একবার প্রদক্ষিণ করল তাদের তাঁবুর চারপাশটা । সুদীপ্ত যার ছায়া দেখেছিল যদি তার কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় সে জন্য। কিন্তু তেমন কোনো চিহ্ন তাদের নজরে পড়ল না। সুদীপ্ত হেরম্যানকে বলল, ‘এমনও হতে পারে যে ব্যাপারটা আমার মনের ভুল।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রাতরাশ সারা হল। তাঁবু দুটোও গুটিয়ে ফেলা হল। তারপর শুরু হল পাকদণ্ডী বেয়ে মেঘ অরণ্যের দিকে যাত্রা। চড়াই ভেঙে ক্রমশ তারা প্রবেশ করল মেঘের রাজ্যে।
ক্লাউড ফরেস্ট! মেঘ অরণ্য! সত্যিই মেঘের রাজ্য! পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে সর্বত্র। খণ্ড খণ্ড মেঘ। তাদের ছোঁয়া যায়, ধরা যায়। সেই মেঘের জলকণা এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে সুদীপ্তদেরকে। তাদের গায়ে প্যারাশুট কাপড়ের জ্যাকেট আছে ঠিকই, কিন্তু ভ্রূ, মুখমণ্ডল ভিজে যাচ্ছে জলকণায়। চারপাশে বিরাট বিরাট গাছ। শতাব্দী প্রাচীন শ্যাওলার আবরণে তারা আবৃত। তাদের ফাঁক গলে মেঘের আনাগোনা। অসম্ভব স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ চারপাশে । ভেজা মাটিতে, নুইয়ে পড়া মৃত গাছের গুঁড়ির ওপর জন্মেছে বিশাল বিশাল ছত্রাক, কোথাও কোথাও মস-ফার্নের জঙ্গল। পায়ের নীচের মাটিও ভেজা ভেজা। সেই মেঘ অরণ্যের মধ্যেই দুরবীন দিয়ে গঞ্জালো মাঝে মাঝে দেখার চেষ্টা করছিলেন যে মেঘের পর্দা ভেদ করে কোথাও কিছু দেখা যায় কিনা?
ধীরে ধীরে ওপরে, আরও ওপরে উঠতে লাগল তারা। নিঝুম চারপাশ। শুধু পাতা থেকে টুপটাপ জল খসে পড়ার শব্দ ছাড়া আর কোথাও কোনো শব্দ নেই। সেই অস্পষ্ট টুপটাপ শব্দ যেন অরণ্যর নিস্তব্ধতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
চলতে চলতে গঞ্জালো হঠাৎ তার দুরবীনে চোখ রেখে বললেন, ‘ওপর দিকে একটা বাড়ি মত কী যেন দেখা যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ‘
সুদীপ্ত আর হেরম্যান তার দূরবিনে চোখ রেখে দেখল সত্যিই যেন তেমন কিছুর একটা অবয়ব দৃষ্টিগোচর হচ্ছে বেশ কিছুটা ওপরে মেঘ জঙ্গলের আড়ালে। তা দেখে হেরম্যান বললেন খামার মালিক পেড্রো বলেছিলেন যে পাহাড়ের ওপর স্পেনিয়ার্ডদের একটা আস্তানা ছিল। হতে পারে ওটা সেটাই। চলো দেখা যাক।’ হেরম্যানের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই একপাল হরিণ সুদীপ্তদের চমকে দিকে বনের এক পাশ থেকে অন্য পাশে চলে গেল ! তারপর জঙ্গলের চড়াই ভেঙে ওপরে এগোতে শুরু করল সুদীপ্তরা। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের সামনে আত্মপ্রকাশ করতে লাগল বাড়িটা। এক সময় সত্যি তারা পৌঁছে গেল বাড়িটার কাছাকাছি। মেঘ জঙ্গলের মধ্যে কিছুটা সমতল ফাঁকা জায়গাতে দাঁড়িয়ে আছে পাথর আর কাঠের তৈরি বেশ বড় বাড়িটা। তার গঠনশৈলী দেখেই অনুমান করা যায় সেটা বয়সে খুব প্রাচীন। তিন চারশো বছর বয়সও হতে পারে। বাড়িটার চালের একটা অংশ, দরজা জানলা ইত্যাদি খসে পড়লেও কাঠামোটা মোটামুটি অক্ষুণ্ণ আছে। চারপাশের গাছগুলো থেকে খসে পড়া পাতার রাশি মনে হয় বাতাসে উড়ে এসে জমা হয়েছে বাড়িটার সামনে, তার অর্ধভগ্ন চালের মাথায়। মাঝে মাঝে মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে তার ঢালু ছাদটাকে। কেমন যেন অদ্ভুত থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে চারপাশে।
হেরম্যান বললেন, ‘বাড়িটার ভিতরটা একবার ঘুরে দেখে আসা যাক। যদিও বাড়ির ভিতরে কেউ আছে বলে মনে হয় না।’
পঁচা পাতার রাশি মাড়িয়ে সুদীপ্তরা প্রবেশ করল বাড়িটার ভিতর।
বাড়িটা অধিকাংশ ঘরগুলোই ফাঁকা ফাঁকা। কপাটহীন জানলা-জা, মাথার ওপরের ভাঙা ছাদের ফাঁক দিয়ে ধুলো আর পাতার রাশি জড়ো হয়েছে ঘরগুলোর ভিতরে। এ ঘর ও ঘর অতিক্রম করে বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল সুদীপ্তরা। হঠাৎ একটা ঘরের সামনে এসে অবাক হয়ে গেল সুদীপ্তরা। বনের থেকে কাঠ কেটে এনে পাল্লা বানানো হয়েছে সে ঘরের দরজার। হয়তো বা দরজাটা বসানো হয়েছিল কয়েক মাস আগে। লোহার কবজাতে এখনও মরচে পড়েনি। কিছু বাড়তি কাঠ, করাত ইত্যাদিও পড়ে আছে দরজার বাইরে।
হেরম্যান সে সব দেখে বললেন, ‘সম্ভবত এ জায়গাতে আস্তানা গেড়ে ছিল কেউ!’ সুদীপ্ত বলল, ‘কারা হতে পারে ?’
হেরম্যান বললেন, ‘গ্রামবাসীদের কেউও হতে পারে। হয়তো বা হরিণ শিকার বা কাষ্ঠ সংগ্রহর জন্য তারা এখানে এসেছিল। অন্য কোন কারণও হতে পারে।’ দরজার পাল্লাটা ফাঁক করাই ছিল। সুদীপ্তরা প্রবেশ করল সেই ঘরের ভিতর। আধো-অন্ধকার ঘর। একটা জানলা আছে তবে সেটা বন্ধ ৷ সেটাও মনে হয় নতুন বসানো হয়েছিল। সুদীপ্ত জানলার কাছে গিয়ে সেটা খুলে দিতেই আলো প্রবেশ করল ঘরে। বেশ বড় ঘর। সুদীপ্ত ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল যে কাঠের পাটাতন দিয়ে সেটার মেরামত করা হয়েছিল। হেরম্যান হঠাৎ চাপ দিলেন সুদীপ্তর কাঁধে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সুদীপ্ত দেখতে পেল ঘরের কোণে মেঝেতে একটা নর কঙ্কাল পড়ে আছে। বিস্মিত সুদীপ্তরা গিয়ে দাঁড়াল তার সামনে। মাটিতে চিৎ হয়ে পড়ে আছে কঙ্কালটা। দেহের মাংস পচে গলে গেছে। কিন্তু তার পোশাক এখনও লেপ্টে আছে দেহের সাথে। কিছুটা বিবর্ণ হয়ে যাওয়া সাদা পোশাক। কোমড়ের বেল্ট আর পায়ের বুট জুতোও আটকে আছে দেহের সাথে। এ নরকঙ্কাল কোথা থেকে এল? সুদীপ্তরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল কঙ্কালটা। হেরম্যান বললেন, ‘লোকটার পোশাক দেখে মনে হচ্ছে লোকটা বৈমানিক হবে। পোশাকটা সাদা ছিল। তাছাড়া ওর কাঁধের ব্যাজ আর বেল্টের মাঝখানে দেখো পাখির দুটো ডানার এমব্লেম আঁকা আছে। আরও একটা জিনিস খেয়াল করো, কঙ্কালের জামার বুকের বাঁ পাশটা কেমন যেন ছিন্নভিন্ন!’
হেরম্যানের কথার ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেই সম্ভবত গঞ্জালো বলে উঠলেন, ‘বুকের বাঁ দিকে ক্ষত! তবে কী চুপাকাবরার আক্রমণেই প্রাণ হারিয়েছিল এ লোকটা? এ বৈমানিক এখানে কোথা থেকে এল ?”
হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘হতে পারে লোকটা চুপাকাবরার আক্রমণেই প্রাণ হারিয়েছিল। লোকটা এখানে কোথা থেকে এল জানা নেই। তবে কঙ্কালটা দেখে একটা কথা বলাই যায় যে লোকটা ভিন গ্রহর কোনো প্রাণী ছিল না, এটা মানুষেরই কঙ্কাল । ‘
গঞ্জালো হেরম্যানের কথার জবাবে কোনো কথা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ তার চোখ পড়ল মাটিতে পড়ে থাকা একটা জিনিসের ওপর। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে মাটি থেকে তিনি কুড়িয়ে নিলেন সেটা। চ্যাপ্টা বাক্সর মতো একটা জিনিস, ছোট একটা অ্যান্টেনা, একটা ছোট স্ক্রিন আর কয়েকটা নব আছে তার গায়ে। সুদীপ্ত আর হেরম্যান ঝুঁকে পড়ল গঞ্জালোর হাতে ধরা যন্ত্রটার ওপর । গঞ্জালো তার হাতের যন্ত্রর নব বা চাবিগুলো ঘোরাতেই একবার বিপবিপ শব্দ করল যন্ত্রটা। তার পর্দায় আবছা একটা আলোও যেন মুহূর্তর জন্য ফুটে উঠল। তারপর আলোও নিভে গেল, শব্দও থেমে গেল।’
সুদীপ্ত জানতে চাইল, ‘এ যন্ত্রটা কী?’
গঞ্জালো জবাব দিলেন, ‘সম্ভবত এটা একটা ট্রান্সমিটার ৷ তবে কী কাজের জন্য ব্যবহৃত হত জানা নেই।’ কথাগুলো বলে গঞ্জালো নব ঘুরিয়ে আবার চেষ্টা করতে লাগলেন যন্ত্রটা চালু করার। কিন্তু সেটা আর চলল না। জিনিসটা তার ব্যাগে ভরতে ভরতে গঞ্জালো বললেন, ‘জিনিসটা রেখে দেই, দেখি পরে চেষ্টা করে চালু করা যায় কিনা? এই মেঘ পাহাড়ে ‘ইউ.এফ.ও’নামতে দেখা গেছিল। এমনও তো হতে পারে যে কঙ্কাল হয়ে যে লোকটা শুয়ে আছে সে এখানে ঘাঁটি গেড়ে এই যন্ত্রর মাধ্যমেই ভিনগ্রহীদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিল? তারপর কোন কারণে মৃত্যু হয় লোকটার? হয়তো বা তাদের সঙ্গে আসা কোনো শ্রণীর আক্রমণেই। আমার কিন্তু ধারণা যে আপনাদের চুপাকাবরা ভিন গ্রহর কোনো প্রাণী হবে।’
হেরম্যান কোনো মন্তব্য করলেন না তার কথায়। সেই ঘর সংলগ্ন আরও একটা ঘর আছে । সুদীপ্তরা প্রবেশ করল সে ঘরটাতে। কয়েকটা ছোট প্যাকিং বাক্স রাখা আছে সে ঘরে। সুদীপ্তরা ঢাকনা খুলে দেখল বাক্সগুলো। শুকনো খাবারের প্যাকেট, খাবারের প্লেট, কম্বল ইত্যাদি আরও কিছু নিত্য ব্যবহার্য্য জিনিস রাখা আছে বাক্সগুলোর মধ্যে। সেসব ব্যবহার করা হয়নি। সম্ভবত এ বাড়িতে বেশ কিছুদিন থাকার জন্যই জিনিসগুলো আনা হয়েছিল এখানে।
বাড়ির অন্য ঘরগুলোতেও এরপর কিছু দেখতে পাওয়া যায় কিনা সে জন্য খোঁজাখুঁজি করল সুদীপ্তরা। কিন্তু অনেক খোঁজার পরও অন্য কোথাও কিছু মিলল না । যে বা যারা এখানে এসেছিল তারা সম্ভবত ও ঘরদুটোই তাদের বাসস্থান হিসাবে নির্বাচিত করেছিল। বাড়ির ভিতর তল্লাশি চালিয়ে এক সময় বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়াল তারা। হেরম্যান বললেন, ‘এবার এ জায়গায় আশপাশটা একটু ঘুরে দেখা প্রয়োজন। যদি কিছুর খোঁজ মেলে?’
বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে আবার অরণ্যে প্রবেশ করল তারা। পাহাড়ের মাথার কাছাকাছি গিরিশিরার এ অরণ্য যেন আরও অনেক বেশি থমথমে, নিস্তব্ধ। সুদীপ্তরা অনেক সময় নিজেদের পায়ের শব্দেই চমকে উঠছিল। চলতে চলতে একসময় ভেজা মাটিতে বেশ কিছু হরিণের পায়ের ছাপ দেখতে পেল। হেরম্যান বললেন হরিণ দেখছি প্রচুর আছে ও জঙ্গলে। তাই নেকড়েও আছে। পরস্পরের মধ্যে খাদ্য খাদকের সম্পর্ক আছে তো । হেরম্যানের বক্তব্য যেন কিছুক্ষণের মধ্যে মিলে গেল। দূরবিনটা মাঝে মাঝে চোখে লাগিয়ে সামনের যাত্রাপথটা দেখে নিচ্ছিলেন গঞ্জালো। তিনি দূরবিনটা সুদীপ্তদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘দেখুন শিকারি শিকার ধরেছে!’
সুদীপ্তরা দুরবিনে চোখ রেখে দেখল সামনের যাত্রাপথে একটা গাছের নীচে একটা হরিণের দেহ ছিঁড়ে খাচ্ছে দুটো বড় কুকুর জাতীয় প্রাণী। নেকড়ে! সুদীপ্তরা বন্দুক নামিয়ে সামনে এগোতেই তাদের পদশব্দ পেয়ে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল প্রাণী দুটো। সুদীপ্তরা গিয়ে দাঁড়াল হরিণটার মরদেহর সামনে। নেকড়ে দুটো মনে হয় মেরে খাওয়া শুরু করেছিল দেহটা। পায়ের ওপরের অংশের কিছুটা তারা ছিঁড়ে খেয়েছে মাত্র। কিছুক্ষণ ছোট আকারের হরিণটার মৃতদেহর দিকে তাকিয়ে থাকার পর হেরম্যান হঠাৎই নীচু হয়ে উল্টে দিলেন প্রাণীটাকে। একটা অদ্ভুত দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হল সুদীপ্তর। হরিণটার বুকের কাছে তিনটে গভীর ছিদ্র। ঠিক যেন সেখানে শলাকা বিধিয়ে দিয়েছে কেউ!
হেরম্যান এরপর বললেন, ‘নেকড়ে কি এভাবে ছিদ্র করতে পারে ? হুবহু ওই একই চিহ্ন ! দেখো বুকের কাছে ছিদ্রর গায়ে ছাড়া নেকড়ে যেখানে কামড় বসিয়েছে সেখানেও কোনো রক্ত নেই। কেউ যেন শুষে নিয়েছে তার রক্ত। নেকড়ে প্রাণীটাকে মারেনি। তারা মৃত হরিণের মাংস খাচ্ছিল। প্রাণীটার সম্ভবত মৃত্যু হয়েছে চুপাকাবরার হানায় ৷
সুদীপ্ত বলল, ‘হরিণটার দেহে এখনও পচন শুরু হয়নি দেখছি।’
হেরম্যান বললেন, ‘খুব বেশি আগে হলে ভোর রাতেই প্রাণ হারিয়েছে হরিণটা। নইলে দেহে পচন ধরত।’
হেরম্যানের কথা শুনে গঞ্জালো উত্তেজিত ভাবে বললেন, ‘তাহলে কি সেই ভিনগ্রহর জীবটা এখানেই আছে? এটাই কি তার ডেরা?’
সুদীপ্ত বুঝতে পারল ভিনগ্রহর ব্যাপারটা সবসময় কাজ করে গঞ্জালোর মাথায় ।
হেরম্যান বললেন, ‘বাড়ির মধ্যে পড়ে থাকা কঙ্কালটা, এই হরিণটা তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। ফাদার ডিসুজা বলেছিলেন শয়।নটা পাহাড় থেকেই নেমে আসে। পেড্রো বলছিলেন এমনই একটা হরিণের মৃতদেহ নাকি এ পাহাড়ে খুঁজে পেয়েছিল গ্রামবাসীরা। খামার মালিক উইলিয়াম তো প্রাণীটাকে এই পাহাড়ের দিকেই পালিয়ে আসতে দেখেছিলেন। গতকাল বিকালে পাহাড় থেকে নীচে নামার পথে আগুন জ্বালানো হয়েছিল। তাই হয়তো শয়তান রক্তচোষা নীচের দিকে না নেমে এই ওপর দিকে উঠে এসেছে।
গঞ্জালো বললেন, ‘আপনার যুক্তি ঠিক। কিন্তু রক্তচোষাটা যদি কাছাকাছি থেকে থাকে তবে তাকে ধরা বা মারার জন্য কী ব্যবস্থা করবেন?’
হেরম্যান বললেন, ‘প্রাণীটাকে জ্যান্ত ধরতে পারলেই ভালো। তাকে ধরার জন্য খাঁচার ফাঁদ আছে, ট্রাঙ্কুলিন ইঞ্জেকশন অর্থাৎ ঘুমপাড়ানি গুলিও আছে। ভাবছি কাল একটা হরিণ ধরব। যেটাকে চুপাকাবরার টোপ হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।’
গঞ্জালো বললেন, ‘হরিণ তো প্রচুরই আছে ওখানে। মাঝে মাঝেই তাদের দেখা মিলছে। কিন্তু কীভাবে ধরবেন ওদের ?”
হেরম্যান সুদীপ্তর কাঁধের বন্দুকটা দেখিয়ে বললেন, ‘এটা ট্রাঙ্কুলিন গান’অর্থাৎ ঘুম পাড়ানি গুলি ছোড়ার জন্যও ব্যবহার করা যায়। আমাদের কাছে ঘুমপাড়ানি ওষুধের সিরিঞ্জও আছে। কম মাত্রার ওষুধ প্রয়োগ করে কোনো হরিণকে সজ্ঞান করতে পারব আমরা। তারপর সেটাকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করব। ভাবছি আজকের রাত বাদ দিয়ে আগামী দুটো রাত এখানেই কাটাব। যদি প্রাণীটার সন্ধান মেলে, যদি সে এসে ধরা দেয় ফাঁদে।’
গঞ্জালো বললেন, ‘আপনার পরিকল্পনাটা মন্দ নয়। দেখা যাক সেই ভিনগ্রহর প্রাণীটা আপনার ফাঁদে আটক হয় কিনা ?”
বেশ সতর্কভাবে সুদীপ্তরা এরপর আশেপাশের জায়গাগুলোতে তল্লাশি চালাতে চালাতে এগিয়ে চলল। মাঝে মাঝে মেঘের আনাগোনায় অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে চারপাশ। দৃষ্টি চলছে না কোনোদিকে। কয়েক হাত তফাত থেকেও কোনো প্রাণী যদি বেরিয়ে আসে সুদীপ্তদের আক্রমণ করে কিছু করার থাকবে না তাদের। যদিও সামনে মেঘের বলয় সৃষ্টি হলেই কাঁধ থেকে বন্দুক খুলে নিচ্ছিল সুদীপ্ত আর গঞ্জালো। হেরম্যানের হাত চলে যাচ্ছিল তার কোমরে গোঁজা রিভলবারের দিকে। একবার তো একটা হরিণকে সামনে মেঘের আড়াল দিয়ে যেতে দেখে অন্য কিছু ভেবে গুলিই চালিয়ে দিচ্ছিল সুদীপ্ত! বিকাল নাগাদ সামান্য একটু ফাঁকা জমিতে উপস্থিত হল সুদীপ্তরা। গঞ্জালো বুঝলেন, ‘আজ অনেকটা পথ ঘোরা হয়েছে। এখানেই তাঁবু ফেলা যাক । কাল সকালে উঠে আপনাদের ফাঁদের জন্য হরিণ ধরা যাবে বা আগামি পরিকল্পনা করা যাবে।’
হেরম্যানও সম্মত হলেন তার প্রস্তাবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গা ঘেঁষে পর পর দুটো তাঁবু খাটিয়ে ফেলা হল। গতকাল সুদীপ্তরা যেখানে ছিল এদিন তারা তার থেকেও বেশি ওপরে উঠে প্রবেশ করেছে মেঘ অরণ্যে। সূর্যদেব পশ্চিমে হেলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই চারপাশ থেকে মেঘরাশি ধেয়ে আসত তাঁবুর দিকে। অগত্যা তাঁবুর ভিতরে ঢুকে যেতে হল সুদীপ্তদের, গঞ্জালোও নিজের তাঁবুতে গিয়ে ঢুকলেন। নিজেদের তাঁবুতে ঢোকার পর হেরম্যান বললেন, ‘আজকের যা অভিজ্ঞতা, ওই লোকটার মৃতদেহ, আর তারপর ওই হরিণটাকে দেখে আমার কিন্তু সত্যিই কেমন যেন মনে হচ্ছে এ জায়গাটাই রক্তচোষার ডেরা। এই মেঘ জঙ্গলের মতো লুকিয়ে থাকার ভালো জায়গা আর হয় না। দেখা যাক কালকের দিনটাতে নতুন কিছুর খোঁজ পাওয়া যায় কিনা? তবে হরিণ ধরে ফাঁদ পাতার ব্যবস্থাটা কালকেই করব। আজকের রাতটাও সতর্ক থাকতে হবে। প্রাণীটা মানুষের রক্তের স্বাদ পেয়েছে। রক্তপেয়ী প্রাণীদের কাছে মানুষের রক্তই নাকি সবচেয়ে সুস্বাদু। যে কারণে বাঘ-সিংহ একবার মানুষ মারলে অন্য প্রাণীকে ছেড়ে দিয়ে শুধু মানুষই মারার চেষ্টা করে। বলা যায় না রক্তচোষাটা হয়তো আমাদের অলক্ষে অনুসরণ করেছে আমাদের। হয়তো সে তাঁবুতেই হানা দিল। কাজেই প্রথম রাতটা তাঁবুর ভিতর তুমি জেগে কাটাবে, আর শেষ রাতে আমি।’
তাঁবুর ভিতরই খাওয়া সেরে নিল সুদীপ্তরা। তারপর কিছুক্ষণ গল্প করার পর হেরম্যান ঘুমাবার প্রস্তুতি শুরু করলেন। বাইরে তখন অন্ধকার নেমেছে। ঠিক এই সময় তাদের তাঁবুতে প্রবেশ করলেন গঞ্জালো। একটু ইতস্তত করে তিনি জানতে চাইলেন, ‘একটু আগে কি আপনারা কেউ বাইরে গেছিলেন ?”
সুদীপ্ত জবাব দিল, ‘নাতো। আমরা বাইরে যাইনি। কেন বলুন তো?’
গঞ্জালো একটু চুপ থেকে বললেন, ‘একটু আগে তাঁবুর ফাঁক দিয়ে দেখলাম একটা মানুষ যেন মেঘের মধ্যে দিয়ে তাঁবুর সামনে দিয়ে হেঁটে গেল। তাঁবুর বাইরে বেরোলাম। ‘কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। অবশ্য ব্যাপারটা আমার দৃষ্টি বিভ্রমও হতে পারে। অবশ্য স্নায়ুতন্ত্রের ওপর চাপ পড়লে অনেক সময় এমন হয়।’ এই বলে তাঁবু ছেড়ে বেড়িয়ে গেলেন গঞ্জালো।
তিনি চলে যাবার পর হেরম্যান বললেন, ‘এখানে লোক আসবে কিভাবে? হয়তো সত্যি এটা ওর দৃষ্টি বিভ্রম। যাই হোক আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’
শুয়ে পড়লেন হেরম্যান। কিছুক্ষণ পরই সুদীপ্ত বুঝতে পারল বাইরের ঘন মেঘাচ্ছন্ন অন্ধকার যেন একটু হালকা হয়ে গেল। চাঁদ উঠতে সুরু করেছে। আর এরপরই খুব কাছ থেকে কোথায় যেন নেকড়ের পাল ডেকে উঠল। হ্যাঁ, চাঁদ উঠেছে। সেই চাঁদকে স্বাগত জানাচ্ছে তারা। নেকড়ের ডাক একসময় থেমে গেল। এগিয়ে চলল রাত। হেরম্যান ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাঁর মৃদু নাসিকা গর্জন শোনা যাচ্ছে। বন্দুকটা কোলে নিয়ে তাঁবুতে বসে রইল সুদীপ্ত। হঠাৎ সে খেয়াল করল কোথা থেকে যেন মৃদু বিপবিপ শব্দ আসছে! নিশ্চই পাশের তাঁবু থেকে। তবে কী গঞ্জালো কি এখনও ঘুমান নি?’ গঞ্জালো কি তবে মহাকাশে শব্দ নিক্ষেপক যন্ত্রটা নিয়ে কাজ করছেন? নাকি তিনি সেই বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা যন্ত্রটা চালু করতে পেরেছেন। যন্ত্রটা কী? ভোরবেলা জিজ্ঞেস করতে হবে তাঁকে। নানা কথা ভাবতে লাগল সুদীপ্ত। প্রহরের পর প্রহর এগিয়ে চলল। কাছে দূরে আবারও বার কয়েক নেকড়ের ডাক শোনা গেল। একবার যেন একটা হরিণেরও আর্তনাদ শোনা গেল । হয়তো বা নেকড়ের শিকার হল সে। মাঝরাতে হেরম্যানকে ডেকে উঠিয়ে সুদীপ্ত তার হাতে বন্দুকটা তুলে দিয়ে শুয়ে পড়ল।
হেরম্যানকে পাহারায় রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল সুদীপ্ত। শেষ রাতে হঠাৎ কিসের একটা শব্দে ঘুম ভেঙে উঠে বসল সে। হেরম্যান তার উদ্দেশ্যে বললেন—
‘গুলির শব্দ হল একটা। আর তার সাথে নেকড়ের ডাক! অর্থাৎ আরও কেউ আছে এ পাহাড়ে !
তাঁবুর ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সুদীপ্তদের কিছু দৃষ্টিগোচর ল না। মেঘ আর অন্ধকারে মোড়া আছে তাঁবুর বাইরেটা।
৷৷ ৭ ৷৷
ভোর হল একসময়। সুদীপ্তরা আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়াল। সুদীপ্তরা গঞ্জালোর তাঁবুর ভিতর উঁকি দিয়ে তাকে দেখতে পেল না। তাবুর ভিতর অন্য জিনিসের সাথে একটা রেডিও বাক্সর মতো যন্ত্র আর হেডফোন পড়ে আছে। হেরম্যান সেই যন্ত্রর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওটা সম্ভবত টর শব্দ। প্রক্ষেপণ যন্ত্র। যারা ইউ.এফ.ও নিয়ে চর্চা করেন তারা শুনেছি এ যন্ত্র কানে লাগিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকেন। যদি তাদের প্রেরিত শব্দ তরঙ্গর কোনো প্রত্যুত্তর মহাকাশ থেকে ভেসে আসে সে আশায়।’ হেরম্যানের কথা শেষ হতে না হতেই মেঘের পর্দা ঠেলে তাঁবুর পিছন দিক থেকে গঞ্জালো এসে দাঁড়ালেন। তার কাঁধে বন্দুক, এক হাতে ধরা গতকালের সেই যন্ত্রটা।
তিনি বললেন, ‘শেষ রাতে গুলির শব্দ নিশ্চয়ই শুনেছেন? তাই আলো ফুটতে না ফুটতেই চারদিকটা একবার দেখে এলাম।’
সুদীপ্ত জানতে চাইল, ‘কিছু নজরে পড়ল?’
গঞ্জালো জবাব দিলেন, ‘না। খুব বেশি দূরে তো যাইনি। তাছাড়া মেঘও ভালো করে কাটেনি।’
হেরম্যান একটু চিন্তিতভাবে বললেন, ‘কিন্তু গুলিটা চালাল কে?’
গঞ্জালো বললেন, ‘হতে পারে সেই নেকড়ে শিকারি আমাদের দেখাদেখি পাহাড়ে উঠে এসেছেন।’
হেরম্যান বললেন, ‘তা হতে পারে। তবে হয়তো দেখা হয়ে যাবে তার সাথে।’
সুদীপ্ত এরপর গঞ্জালোর হাতের যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওই যন্ত্রটা কি চালু করতে পেরেছেন? মাঝে মাঝে বিপ বিপ শব্দ আসছিল আপনার তাঁবু থেকে। ওটা কি যন্ত্র বুঝতে পারলেন ?”
গঞ্জালো বললেন, ‘চালু করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু মাঝে মাঝে চালু হয়েই আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি যে যন্ত্রটা কী? বেখেয়ালে হাতে যন্ত্রটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলাম।’ এ কথা বলার পর তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘আজকের পরিকল্পনা কী ?
হেরম্যান বললেন, ‘তাঁবু তুলব না ভাবছি। আর দুটো রাত এখানেই কাটাব। প্রাথমিক ভাবে চেষ্টা করি ফাঁদ পেতে একটা হরিণ ধরা যায় কিনা? যেটাকে রাতে রক্তচোষার টোপ হিসাবে ব্যবহার করব ।’
গঞ্জালে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীভাবে হরিণ ধরবেন?”
হেরম্যান বললেন, “বনের এক জায়গাতে আমি গাছের আড়ালে একটা সুঁড়িপথ দেখেছি। সেখানে হরিণের অনেক পায়ের ছাপ দেখেছি। সম্ভবত ওটা হরিণ চলাচলের পথ। ওখানে দড়ির ফাঁদজাল পাতব। লবণ ছড়াব ওখানে। হরিণ জাতীয় প্রাণীদের লবণের প্রতি আগ্রহ প্রবল ৷ কিন্তু পাহারি অঞ্চলে লবণ পাওয়া যায়না বলে প্রাণীরা পাহাড়ের ঢালে কোথাও খনিজ লবণ পেলে তা চেটে চেটে খায়। দেখি লবণের ফাঁদ পেতে হরিণ ধরা যায় কিনা ? ” গঞ্জালো জানতে চাইলেন, ‘সে জায়গা কোথায় ?”
হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘যেখানে হরিণের মৃতদেহটা পাওয়া গেছিল তার খুব কাছেই। বেশ কিছুটা আবার যেতে হবে সে জায়গাতে পৌঁছবার জন্য। গঞ্জালো একটু চুপ করে থেকে বললেন, তাহলে তাই করুন। আমার তাঁবুটাও তাহলে এখানেই থাক। তবে আজ আমি আপনাদের সঙ্গ দিতে পারব না। এর পিছনে বিশেষ একটা কারণ আছে। গতকাল রাতে আমার শব্দ প্রক্ষেপণ যন্ত্রর প্রত্যুত্তরে একটা অদ্ভুত তরঙ্গ বার্তা এসেছে। যদিও তার পাঠোদ্ধার আমি করতে পারিনি, তবু বলি সেই শব্দ তরঙ্গ যেন খুব কাছ থেকেই এসেছে, মহাকাশ থেকে নয়। হরিণের মৃতদেহটা তো পূর্ব দিকে পাওয়া গেছিল, তরঙ্গ বার্তাটা সম্ভবত এসেছে পশ্চিমের পাহাড়ের শাখা থেকে। এমনও হতে পারে যে, ‘ইউ.এফ.ও’কে পাহাড়ের মাথায় নামতে দেখা গেছিল তার ভিনগ্রহী নভশ্চরটা আসার প্রেরিত শব্দ তরঙ্গর জবাব দিচ্ছে। কাজেই ওদিকে যাব আমি। এতে একটা সুবিধাও হবে। আপনারা যাবেন পূর্বে। আর আমি যাব পশ্চিমে। দু-দিকটাই দেখা হবে আমাদের। বিকালবেলা তাঁবুর কাছে এসে আবার আমরা মিলিত হয়ে নিজেদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময় করে পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করা যাবে।’
সুদীপ্ত বলল, ‘আপনার তাঁবুতে আপনার খোঁজে উঁকি দিয়ে আপনার মহাকাশে শব্দ প্রেরণকারী যন্ত্রটা সম্ভবত দেখলাম। সত্যিই কি ওই যন্ত্রর মাধ্যমে মহাকাশ থেকে আসা শব্দতরঙ্গ ধরা পড়ে? অবিশ্বাস করছি না। ব্যাপারটা সম্বন্ধে জানতে চাচ্ছি মাত্ৰ ৷
সুদীপ্তর কথা শুনে গঞ্জালো বললেন “অবশ্যই। আমরা যারা মহাজাগতিক বিষয় নিয়ে চর্চা করি তাদের কাছে এটা একটা সত্যি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র। বহু মহাকাশ গবেষক মহাকাশ থেকে নানা অদ্ভুত বার্তা পেয়েছেন এ ধরনের যন্ত্রর মাধ্যমে। একটা প্রামাণ্য ঘটনার কথা বলি এ ব্যাপারে। যা সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। হার্ভাড স্টেট ইনস্টিটিউটের মহাকাশ গবেষক ডক্টর ডোরির কাজ ছিল রেডিও টেলিস্কোপের মাধ্যমে মহাকাশের বার্তা শোনা। ১৫ আগস্ট ১৯৭৭। অন্যদিনের মতোই তার ইনস্টিটিউটের কাজে এসেছিলেন তিনি। এবং একই কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এ কাজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে মনিটরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে হয়। এ কাজ করতে করতে একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন তিনি।
হঠাৎ তার কানে আসে এক সংকেত ! দূর মহাকাশ থেকে ভেসে আসছে সেই সংকেত। টানা প্রায় আট মিনিট ধরে আসে সেই বার্তা। কম্পিউটার প্রিন্ট বার করে তার সমার্থ বার করলেন ডেরি। ফুটে উঠল এক অদ্ভুত বিস্ময়কর শব্দ— ‘Wow’ বা ‘ওয়াও’। মহাকাশ থেকে কারা পাঠিয়েছিল এই বার্তা?’ বিজ্ঞানীরা অনেক চেষ্টা করেও এ সংকেতের যথার্থ কারণ খুঁজে পাননি। মহাকাশ বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই রহস্যময় ঘটনা ‘ওয়াও সিগনাল’ নামে খ্যাত।’ তার কথা শোনার পর হেরম্যান বললেন, ‘আপনার বলা এ ঘটনাটা আমি যেন কোন একটা বইতে পড়েছিলাম। যাই হোক আপনার প্রস্তাবটা মন্দ নয়, আমরা দু-ভাগে দু-দিকে যাই। তাতে দু-পাশটা সম্বন্ধে আমাদের জানা হবে। তবে আপনি একলা যাচ্ছেন, কাজেই একটু সাবধানে থাকবেন।’ গঞ্জালো হেসে বললেন, ‘সতর্ক করার জন্য ধন্যবাদ। তবে আপনারা না এলে আমাকে তো একাই এই মেঘ জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে যেত। সেই রক্তচোষা ভিনগ্রহর প্রাণীটা সম্ভবত ভোরের আলো ফোটার আগেই হানা দেয়। সূর্যোদয়ের পর তার ভয় আছে বলে মনে হয় না। বাকি রইল নেকড়ের ব্যাপার। সঙ্গে বন্দুক তো রইলই। আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না।’—এই বলে তিনি ঢুকে গেলেন তাঁবুর ভিতর।
প্রাতরাশ সেরে কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে সুদীপ্তরা বাইরে বেরিয়ে এল। একই সময় বাইরে বেরিয়ে এলেন গঞ্জালো। তার পিঠে বন্দুক। হাতে ধরা আছে গতকাল উদ্ধার করা সেই যন্ত্রটা।
হেরম্যান সেটা দেখে বললেন, ‘আবারও খেয়ালবশে যন্ত্রটা সঙ্গে নিচ্ছেন নাকি?”
গঞ্জালো হেসে বললেন, ‘এবার সচেতন ভাবেই সঙ্গে নিচ্ছি এটা। দেখি যদি যন্ত্রটা চলার পথে কোনোভাবে চালু করা যায়। এ যন্ত্রের মাধ্যমে ভিনগ্রহীদের সাথে যোগাযোগের সম্ভাবনা কিন্তু আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না। হয়তো যার কঙ্কাল দেখলাম তিনিও এখানে সত্যিই এসেছিলেন আমারই মতো কোনো মহাকাশযানের খোঁজ পেয়ে ?”
হেরম্যান এ প্রসঙ্গে আর কোনো মন্তব্য করলেন না। তাঁবু ছেড়ে কিছুটা পথ গঞ্জালোকে নিয়েই হাটল সুদীপ্তরা। তারপর একটা সময় তারা রওনা হল পরস্পরের বিপরীতে।
তিনি চলে যাবার পর হেরম্যান বললেন, ‘ভিনগ্রহীদের অস্তিত্ব থাক বা না থাক গঞ্জালো কিন্তু এ ব্যাপারে অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে একাগ্রতা আছে।’ মেঘ অরণ্যর মেঘ আর প্রাচীন গাছের জঙ্গল ধরে এগিয়ে চলল তারা। চলতে চলতে সুদীপ্ত বলল, ‘চুপাকাবরা প্রাণীটার যে বিবরণ তার প্রত্যক্ষদর্শী খামার মালিক উইলিয়ামের মুখে শুনলাম তাতে প্রাণীটা সম্বন্ধে আপনার ধারণা কী? ‘
হেরম্যান প্রথমে হেসে বললেন, ‘সম্ভবত ভিনগ্রহী নয়। রক্তপান তো পৃথিবীর শ্বাপদ শ্রেণির প্রাণীরা করে। মহাকাশের ভিনগ্রহর জীবের দেহেও রক্ত প্রবাহিত হয় ? সেখানেও কি বাতাসে অক্সিজেন আছে?’
এরপর তিনি বললেন, ‘আমার ধারণা প্রাণীটা নতুন প্রজাতির কোনো প্রাণী। আবার শঙ্কর প্রাণীও হতে পারে। তুমি কি হগজিলার ব্যাপারটা জানো ?’ আমেরিকার জর্জিয়ার এক জঙ্গলে আবির্ভাব হয়েছিল সেই মহাকায় চতুষ্পদের। কারো কোনো ক্ষতি না করলেও তার দানবীয় আকার ত্রাস সঞ্চার করেছিল স্থানীয় গ্রামবাসীদের মনে। আমাদের মতো ক্রিস্টিভ অনুসন্ধানকারীরাও নেমে পড়ে তার খোঁজে। শেষপর্যন্ত প্রাণীটাকে গুলি করে মারা হয়। ঘটনাটা ২০০৪ সালের! প্রাণীটা বারো ফিট লম্বা, ওজন এক হাজার পাউন্ড। তার বাঁকানো দাঁতের দৈর্ঘ্য দু-ফুটের ও বেশি। জীব বিজ্ঞানীরা তার জিনের পরীক্ষা করে দেখেন যে সেটা আসলে ছিল গৃহপালিত শুকরও বন্য বরার সঙ্কর প্রাণী। কোনো কারণে সেই হগজিলা অমন দানবীয় আকার ধারণ করেছিল।’
কথা বলতে বলতে সুদীপ্তরা একসময় পৌঁছে গেল নির্দিষ্ট জায়গাতে। হরিণটাকে ধূসর নেকড়ে বা কোয়াটের দল প্রায় সাবাড় করে ফেলেছে। শুধু তার শিংসমেত শাখা আর কিছু হাড়গোড় পড়ে আছে সেখানে। যে গাছের নীচে হরিণের দেহাবশেষ পড়ে তার পিছনে লেই হরিণ চলাচলের সুঁড়িপথ। প্রাণীগুলোর অসংখ্য পায়ের ছাপ সেখানে আঁকা। ঘাস নেই মাটিতে। দেখেই বোঝা যায় হরিণের দল নিয়মিত চলাচল করে। হেরম্যান সেখানে খুব সরু অথচ ভীষণ শক্ত নাইলনের দড়িতে ফাঁদ বিছালেন। নুনও ফেলা হল সেখানে। এসব কাজ সাঙ্গ হতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। কাজ শেষ হবার পর হেরম্যান বললেন, ‘এবার এখান থেকে সরে পড়তে হবে। ওদের ঘ্ৰাণ তীক্ষ্ম। শ্রবণশক্তি খুব, আমরা কাছাকাছি থাকলে ওরা এ রাস্তা মাড়াবে না।’
সুদীপ্ত বলল, তবে এখন কী করবেন?”
হেরম্যান রিস্ট ওয়াচের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এখন সকাল দশটাও বাজেনি। এই মুহূর্তে তো তেমন কিছু করার নেই। চলো তাঁবুর কাছে করে যাই। ওদিকে কোথাও খাঁচাটা বসাবার জন্য স্থান নির্বাচন করে খাঁচা বসানোর কাজটা সেরে ফেলি। কাজ এগিয়ে থাকবে। তারপর বিকাল নাগাদ এখানে ফিরে এসে যদি ফাঁদে হরিণ ধরা পড়ে তবে সেটাকে নিয়ে খাঁচার ফাঁদে পুরব।’
হেরম্যানের কথা মতো তাঁবুর দিকে ফেরা শুরু করল সুদীপ্তরা। তাঁবুর কাছাকাছি পাহাড়ের ঢালে খাঁচা বসাবার জন্য একটা জায়গা পছন্দ হল তাদের। বড় বড় বৃক্ষরাজির মধ্যে একটা ফাঁকা জমি। তাঁবুতে ফিরে গোটানো খাঁচাটা নিয়ে সে জায়গাতে রওনা হল তারা। সেখানে পৌঁছে খাঁচাটা বসানো হল। এসব কাজ সমাধা করে বেলা একটা নাগাদ তারা তাঁবুতে ফিরে এল। হেরম্যান বললেন, ‘এবার তবে ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নেওয়া যাক। যে কোনো অভিযানের পক্ষে ঘুমটা বেশ জরুরি। স্নায়ু ও শরীর চাঙ্গা হয়। কখন রাত জাগতে হয় বলা যায় না। তাছাড়া আমরা দুজনেই গতকাল অর্ধরাত ঘুমিয়েছি। তিনটে নাগাদ আমরা রওনা হব দড়ির ফাঁদে হরিণ পড়েছে কিনা দেখতে ।’
তাঁর প্রস্তাব মতোই তাঁবুর ভিতর গিয়ে ম্যাটে শুয়ে পড়ল তারা দুজন। কিছুক্ষণের মধ্যেই হেরম্যানের নাসিকা গর্জনের মৃদু শব্দ হলেও সুদীপ্তর কিন্তু ঘুম হল না। প্রায় এক ঘণ্টা শুয়ে এপাশ ওপাশ করার পর সুদীপ্ত উঠে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে একটা পাথরের ওপর বসল । বনের ভিতর মেঘের খেলা চলছে। মাঝে মাঝেই চারপাশের গাছগুলো মেঘের আড়ালে ঢেকে যাচ্ছে। সুদীপ্ত দেখতে লাগল সেই মেঘের খেলা। কিন্তু হঠাৎই একটা যান্ত্রিক রিনিরিনি শব্দ কানে আসতে লাগল তার। শব্দটা আসছে গঞ্জালোর তাঁবু থেকে। প্রাথমিক অবস্থায় সুদীপ্তর তেমন আগ্রহ জন্মায়নি শব্দটার প্রতি। কিন্তু শব্দটা এতো নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বাজতে লাগল যে একসময় তা সুদীপ্তর মনোযোগ আকর্ষণ করল। সুদীপ্ত উঠে গিয়ে উপস্থিত হল গঞ্জালোর তাঁবুর সামনে। পর্দা ফাঁক করে সে বুঝতে পারল ওই যান্ত্রিক শব্দটা হচ্ছে সেই মহাকাশে শব্দ প্রেক্ষণকারী রেডিওটর মতো যন্ত্রটার থেকে। ব্যাপারটা দেখে বেশ কৌতূহল জন্মাল সুদীপ্তর মনে। কিন্তু গঞ্জালোর অনুপস্থিতিতে তাঁর তাঁবুতে পা রাখা ঠিক নয়। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হল যে গঞ্জালোর বক্তব্য মতো মহাকাশ থেকে কোনো বার্তা আসছে না তো । সে যদি কোনভাবে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে গঞ্জালোকে জানিয়ে দিতে পারে তবে তিনি উপকৃত হতে পারেন। এ কথা ভেবে সে একটু ইতস্তত করে গঞ্জালোর তাঁবুর ভিতর ঢুকল। তারপর সেই যন্ত্রর সাথে সংযোগকারী ইয়ারফোনটা তুলে নিয়ে কানে দিল। সেই ইয়ারফোনের সাথে মুখের কাছে নেমে আসা একটা সরু মাইক্রোফোনও আছে। ইয়ারফোনটা কানে দেয়ার পর সে বলল, ‘হ্যালো?’
ওপাশ থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘হ্যালো? টু-সেভেন-ফাইভ-টু, অস্ত্রোভোস্কি কলিং।’
এটুকুই সে বুঝতে পারল। তারপর দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন বলতে শুরু করল ও পাশে থাকা ব্যক্তি। বেশ কিছুক্ষণ ধরে সে কথা বলে চলল। একসময় সুদীপ্ত বলল, ‘আই অ্যাম সুদীপ্ত। হু আর ইউ?’
সঙ্গে সঙ্গেই যেন সেই অদ্ভুত ভাষাটা থেমে গেল। নিস্তব্ধ হয়ে গেল ওপাশের লোকটা । রেডিওর মতো যন্তর সেই রিনিরিনি শব্দটাও আচমকা থেকে গেল। বেশ কিছুক্ষণ ইয়ারফোন কানে দিয়ে থাকার পরও আর কোনো শব্দ ভেসে এল না। এরপর এক সময় ইয়ারফোনটা কান থেকে নামিয়ে তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়াল। বিস্মিত সুদীপ্ত তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল, ‘কার কণ্ঠস্বর শুনল সে? ভিনগ্রহীরা কি ইংরেজি জানে? সেই অদ্ভুত কণ্ঠস্বর প্রথম বাক্যটা ইংরেজিতে বলল কেন?’ অদ্ভুত ব্যাপার !
সুদীপ্তর ঘড়িতে আড়াইটে বাজে। হেরম্যানের ঘুম ভাঙাতে হবে। সে নিজেদের তাঁবুতে ঢুকতে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই গঞ্জালো ফিরে এলেন। তিনি সুদীপ্তকে প্রশ্ন করলেন, ‘হেরম্যান কই ?”
সুদীপ্ত বলল, ‘তাঁবুর ভিতর ঘুমচ্ছেন। হরিণ ধরার ফাঁদ পাতা হয়েছে। আর একটু পরই আমরা রওনা হব ফাঁদে হরিণ ধরা পড়েছে কিনা দেখার জন্য।’
এ কথা বলার পর সুদীপ্ত তাকে বলল, ‘আপনার তাঁবুতে মহাকাশ শব্দ প্রক্ষেপণকারী যন্ত্র থেকে দীর্ঘক্ষণ ধরে একটা শব্দ হচ্ছিল। মাফ করবেন, আপনার অনুমতি না নিয়েই আপনার অনুপস্থিতিতে আপনার তাঁবুতে ঢুকেছিলাম। ইয়ারফোন কানে দিয়ে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে কে যেন বলল ‘অস্ত্রোভোস্কি কলিং। তারপর সে কী বলল আমি বুঝতে পারলাম না। এরপর আমি আমার পরিচয় দিতেই লোকটা লাইন কেটে দিল। ভিনগ্রহীরা এক পৃথিবীর ভাষা জানতে পারে? কেমন যেন অদ্ভুত ব্যাপারটা !
সুদীপ্তর কথা শুনে মুহূর্তর জন্য যেন গম্ভীর হয়ে গেল গঞ্জালোর মুখ। পরক্ষণেই তিনি হেসে ফেলে বললেন, “না, ওটা মহাকাশ বার্তা নয়। অনেক সময় এই পৃথিবীর নানা বার্তা ধরা পড়ে যন্ত্রে। তেমনই কোনো বার্তা হয়তো আপনি শুনেছেন। যে কথা বলছিল সে তার ভুল বুঝতে পেরে লাইনটা কেটেছে।’
সুদীপ্ত বলল, ‘ও, ব্যাপারটা এবার বুঝতে পারলাম না। তা আজ আপনার অনুসন্ধানে কি কিছু মিলল ?”
গঞ্জালো জবাব দিলেন, ‘না, তেমন কিছু পেলাম। তবে কাছেই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম । ওই কিছুটা এগিয়ে ওই গাছগুলোর আড়ালে পাহাড়ের ঢালে।’
সুদীপ্ত প্রশ্ন করল, ‘কী দৃশ্য ?’
গঞ্জালো হেসে বললেন, ‘চলুন নিজের চোখেই দেখবেন। মাত্র কয়েক-পা তো মাত্র ব্যাপার।’ এই বলে সুদীপ্তকে ইশারায় তার সাথে আসতে বলে গঞ্জালো এগোলেন সেদিকে।
কাছেই জায়গাটা। মিনিট দুই সময় লাগবে সে জায়গাতে যেতে। সুদীপ্ত অনুসরণ করল গঞ্জালোকে। তার সাথে জায়গাটা পৌঁছল সুদীপ্ত। পাহাড়ের মাথায় এক সারি গাছ। তারপরই অতল খাদ। গাছের আড়ালে খাদের সামনে তারা দুজন এসে দাঁড়াল। গঞ্জালো নীচে খাদের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “কিছু দেখতে পাচ্ছেন?’
মেঘের রাশি ভেসে বেড়াচ্ছে খাদের উপর। নীচে দৃষ্টি চলছে না। সুদীপ্ত সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিছু বুঝতে পারছি না।’
গঞ্জালো পাশ থেকে বললেন, ‘আর একটু ঝুঁকে ভালো করে দেখুন। ঠিক দেখতে পাবেন। ওই তো আমি দেখতে পাচ্ছি!’
গঞ্জালোর কথামতো সুদীপ্ত খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আরও একটু ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করল খাদের নিচটা। আর এর পরক্ষণেই সুদীপ্তর মনে হল হঠাৎই যেন সে দু-হাত পাখির ডানার মতো মেলে নেমে যাচ্ছে মেঘে ঢাকা খাদের ভিতর। একটা অস্পষ্ট শব্দ শুধু বেরোল তার গলা দিয়ে। সুদীপ্ত তলিয়ে যেতে লাগল মেঘের ভিতর !
৷৷ ৮ ৷৷
যেন মেঘের মধ্যে দোল খাচ্ছে সুদীপ্ত। ওপরে মেঘ, নিচে মেঘ, চারপাশে শুধু রাশি রাশি মেঘ। তারই ফাঁক দিয়ে মুহূর্তর জন্য কখনও হয়তো চোখ মেলে সে দেখেছে মাথার ওপরের গোল চাঁদকে, কখনও বা তার মুখে এসে পড়েছে সূর্যকিরণ। তার পরক্ষণেই আবার মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেছে সবকিছু। চোখের পাতা আবার মুদে এসেছে সুদীপ্তর। এক প্রগাঢ় ঘুমের দেশে যেন চলে যাচ্ছে সে। স্বপ্নর মধ্যেই যেন মেঘের রাজ্যে ভেসে চলেছে সুদীপ্ত। শুধু মেঘ, শুধু মেঘ…
কিন্তু শেষপর্যন্ত এক সময় আচ্ছন্ন ভাবটা তার কাটল। চোখ মেলল সে। কিছু সময়ের জন্য মাথার ওপর থেকে মেঘ সরে গেছে। সূর্যকিরণ সোজাসুজি এসে পড়েছে তার মুখে, সেটাই হয়তো তার আচ্ছন্ন ভাবটা কাটিয়ে দিয়েছে। চোখে খুলে সূর্যের দিকে তাকিয়ে প্রথমে চোখে ধাঁধা লেগে গেল তার। সুদীপ্ত প্রথমে চোখ বন্ধ করে ফেলল, তারপর আবার ধীরে ধীরে চোখ মেলল। সুদীপ্ত এরপর উঠে বসার চেষ্টা করতেই দুলে উঠল। ভালো করে চারপাশে তাকিয়ে সে বুঝতে পারল সে শুয়ে আছে পাহাড়ের গা থেকে হাত কুড়ি তফাতে একটা ঝুলন্ত গাছের মাথার ওপর। পাহাড়ের গায়ের একটা গর্তর ভিতর থেকে মানুষের হাতের মতো শূন্যে ঝুলছে গাছের গুড়িটা। সুদীপ্তর নীচে অতলস্পর্শী খাদ, আর মাথার ওপরে পাহাড়ের কিনারাটা অন্তত তিরিশ ফুট উঁচুতে। বাতাসে মাঝে মাঝে দুলে উঠছে শূন্য ঝুলন্ত গাছটা। এ জন্যই সুদীপ্তর তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় মনে হচ্ছিল সে মেঘের ভিতর দোল খাচ্ছে। কিন্তু সে এই ঝুলন্ত গাছের মাথায় কি করে এলো? কিছুক্ষণের মধ্যে তার মনে পড়ে গেল সব কথা। সে খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছিল গঞ্জালোর সাথে। আর তারপর… নিচে তাকিয়ে কি হঠাৎ সুদীপ্তর মাথা ঘুরে গেছিল? ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না সে। সূর্য এখন ঠিক মাথার ওপর। অর্থাৎ একটা রাত কেটে গিয়েছে। প্রায় কুড়ি ঘণ্টা অতিক্রান্ত। সুদীপ্ত ভাবার চেষ্টা করতে লাগল হেরম্যান আর গঞ্জালো কি করছেন। তারা কি খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাকে? যেখান থেকে সুদীপ্ত নিচে পড়েছিল পাহাড়ের মাথার সে জায়গাটা ঝুলন্ত তাকের মতো বাইরে বেরিয়ে আছে। তাই হয়তো সেখানে দাঁড়িয়ে নিচে ঝুলন্ত গাছের ডালপালার আড়ালে আটকে থাকা সুদীপ্তকে তারা দেখতে পাচ্ছেন না। একটু ধাতস্থ হবার পর সাবধানে ডাল আঁকড়ে উঠে বসল সুদীপ্ত। মাথাটা বেশ ভার ভার লাগছে। একটা হাত মাথার পিছনে দিতেই হাতটা চটচট করে উঠল কোন আঠালো তরলে। রক্ত! ওপর থেকে পড়ে গাছের ডালে বাড়ি খেয়ে সে আহত হয়েছে, নাকি অন্য কিছু ঘটেছিল ? সুদীপ্তর যেন অস্পষ্ট ভাবে মনে পড়ল যে তাকে খাদের নিচটা দেখাবার ঠিক আগের মুহূর্তে নিজের বন্দুকটা কাঁধ থেকে খুলে নিয়েছিলেন গঞ্জালো । যাই হোক এসব ভাবার সময় এখন নয়। বাতাসে যেভাবে ডালটা মাঝে মাঝে দুলছে থাকে সুদীপ্তর নিচে পড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। সুদীপ্তকে মুক্তি পেতে হবে এই ঝুলন্ত অবস্থার থেকে। তাই আগে কি ঘটেছিল তা আর না ভেবে সে দেখতে লাগল পাহাড়ের গাটা। হাত কুড়ি দীর্ঘ গাছের গুঁড়িটা যদি সে অতিক্রম করতে পারে তবে সে পৌঁছে যাবে পাহাড়ের খাঁজে। তখন আর নিচে পড়ার ভয় থাকবে না। কিন্তু সমস্যা হল ঝুলন্ত গুঁড়ির গায়ে আঁকড়ে ধরার মতো কোনো শাখাপ্রশাখা নেই। আর গুঁড়িটাও সমূল ও মেঘের আনাগোনার জন্য পিছল স্যাঁতস্যাঁতে। হেঁটে কোনোভাবেই পেরোনো যাবেনা ওই জায়গাটা কিন্তু এভবে গাছের ডালে ঝুলন্ত অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। কাজেই কর্তব্য স্থির করে নিল সুদীপ্ত। ডালপালা আঁকড়ে অতি সাবধানে সে প্রথমে পৌঁছে গেল গুঁড়ির কাছে তারপর গুঁড়িটা দু-হাতে জড়িয়ে ধরল। গিরগিটি যেভাবে গাছের ডাল ধরে এগোয় ঠিক তেমনভাবেই সুদীপ্ত হাত আর পায়ে গুঁড়ি আঁকড়ে বুকে হেঁটে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোতে শুরু করল। নিচে হাঁ করে আছে অতল খাঁদ। সুদীপ্তর হাত-পা পিছলোলেই মৃত্যু অবধারিত। মাত্র কুড়ি হাত শুঁড়িটা, কিন্তু সেটুকু ওভাবে পেরোতেই সুদীপ্তর মনে হল সে যেন আদি-অনন্তকাল ধরে ওভাবে বুকে হেঁটেই চলেছে ! অবশেষে একসময় সে পৌঁছে গেল পাহাড়ের খাঁজে নিরাপদ জায়গাতে। আর তার পরমুহূর্তে একটা ঘটনা ঘটল। গুঁড়িটা হঠাৎ দুলে উঠল তারপর পাহাড়ের গা থেকে শিকড় সমেত উপরে উল্কার বেগে ধাবিত হল নিচে অতল খাদের দিকে। দীর্ঘক্ষণ সুদীপ্তর ভার বইতে বইতে পাহাড়ের গা থেকে শিকড়ের বাঁধন তার খসে আসছিল। সুদীপ্ত তার থেকে নেমে গেলেও গাছটা শেষ পর্যন্ত আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না।
এ ঘটনা যদি আর একটু আগে ঘটত তবে কী ঘটত তা ভেবে সুদীপ্ত শিউরে উঠল। বেশ কিছুক্ষণ একই জায়গায় বসে রইল সুদীপ্ত। ধীরে ধীরে তার শরীর আর মনে বল ফিরে এল। মেঘের আনাগোনা আবার শুরু হয়েছে। সুদীপ্তকে পাহাড়ের মাথায় উঠতে হবে, খুঁজে বার করতে হবে হেরম্যানকে। তাই সে এরপর পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে একটু তেরছাভাবে পাহাড়ের মাথার দিকে ওঠার চেষ্টা করতে লাগল। ঘুরপথে বেশ কিছুটা পথ অতিক্রম করতে হলেও পাহাড়ের শাখার জঙ্গলে উঠতে খুব বেশি বেগ পেতে হল না সুদীপ্তকে। এক সময় সে এসে দাঁড়াল পাহাড়ের মাথার জঙ্গলে। তারপর সে তাঁবুর অবস্থান কোথায় হতে পারে তা অনুমান করে এগোল সেদিকে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সে পৌঁছে গেল তাঁবুর কাছে।
কিন্তু দুটো তাঁবুই শূন্য। হেরম্যান বা গঞ্জালো কেউ নেই। তবে বন্দুক আর গঞ্জালোর সেই শব্দ প্রক্ষেপন যন্ত্র ছাড়া অন্য সব জিনিসই পড়ে আছে তাঁবুতে। তবে কি তারা খুঁজে বেড়াচ্ছেন সুদীপ্তকে? তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকিয়ে সুদীপ্ত চিৎকার করে উঠল—‘হেরম্যান আপনি কোথায়?’
কিন্তু বার কয়েক হাঁক দেবার পরও হেরম্যানের কোনো সাড়া মিলল না। সুদীপ্তর চিৎকার মেঘ পাহাড়ের জঙ্গলে প্রতিফলিত হয়ে আবার তার কাছেই ফিরে আসতে লাগল। গলা শুকিয়ে গেছে সুদীপ্তর। তাঁবুতে ঢুকে বোতল থেকে জল খেয়ে আবার সে বাইরে এসে দাঁড়াল। হঠাৎই হাত দশেক তফাতে একটা জিনিস মাটিতে পড়ে থাকতে দেখল সে। গাছের ফাঁক গলে মৃদু সূর্যকিরণ তার পর এসে পড়ায় জিনিসটা মৃদু চিকচিক করছে। সুদীপ্ত এগিয়ে গিয়ে জিনিসটা হাতে নিয়েই চিনতে পারল সেটা। হেরম্যানের রিস্ট ওয়াচ। কীভাবে সেটা খসে পড়ল তার হাত থেকে? মাটির দিকে তাকিয়ে এরপর সুদীপ্তর আরও কটা ব্যাপার চোখে পড়ল। কোন একটা ভারি জিনিস যেন ঘসটে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সে জায়গা দিয়ে ! কি জিনিস হতে পারে? হেরম্যানও কি তবে বিপদগ্রস্ত ?
ঘড়িতে বেলা দুটো বাজে। সুদীপ্ত হিসাব করে দেখল মেঘ পাহাড় অন্ধকার নামতে আরও ঘণ্টা তিনেক সময় লাগবে। এ সময়ের মধ্যে হেরম্যানকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করা যেতে পারে। হয়তো তিনি জঙ্গলের মধ্যে কাছাকাছিই কোথাও আছেন। এ কথা ভেবে নিয়ে সে দাগটাকে অনুসরণ করে এগোল সামনের দিকে। কিন্তু বনের ভিতর ঢুকে পাথুরে জমিতে হারিয়ে গেছে সে দাগটা। হেরম্যানের খোঁজে সুদীপ্ত ঘুরে বেড়াতে লাগল মেঘ অরণ্যে। সময় এগিয়ে চলল, বিকাল হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই মেঘ অরণ্যর মধ্যে অন্ধকার বাড়তে শুরু করল। একসময় সুদীপ্তর মনে হল যে তাঁবুতে ফেরাই ভালো। হয়তো বা হেরম্যান তাঁবুতে ফিরে এসেছেন? সে এরপর তাঁবুতে ফেরার জন্য পা বাড়াল। কিন্তু কিছুটা এগোবার পরই সুদীপ্ত বুঝতে পারল, সে মেঘ অরণ্যে পথ হারিয়েছে।
মেঘের দেশে খুব দ্রুত যেন আলো কমে আসছে। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে রাত্রিবাসের জন্য নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে হবে সুদীপ্তকে। সেই প্রচেষ্টাই করতে লাগল সে। অরণ্যের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে একদিকে পাহাড়ের খাদের কিনারে অচেনা এক মহাবৃক্ষ দেখতে পেল সে। গগনচুম্বি গাছটার গুঁড়িতে এক বড় মতো ফোকর। একজন মানুষ গুটিদুটি মেরে তার মধ্যে বসে থাকতে পারে। রাতটা কোনোভাবে সেখানে কাটাবার জন্য সে জায়গাটা মনে ধরল সুদীপ্তর। সে গিয়ে দাঁড়াল গাছটার নিচে। সে সেখানে দাঁড়িয়ে মনে মনে ভাবতে লাগল রাতটা কোনোরকমে গাছের ফোকরে কাটিয়ে ভোরের আলো ফুটলে তাঁবু খোঁজার চেষ্টা করবে। সেখানে হেরম্যানকে না পেলে অথবা তাঁবু খুঁজে না পেলে ঢাল বেয়ে পাহাড়ের নিচে নেমে গ্রামবাসীদের সাহায্যে হেরম্যানকে খোঁজার চেষ্টা করবে।
তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ভাবছিল সুদীপ্ত। পাহাড়ের ঢালটা মেঘে ঢাকা। হঠাৎ সে দিক থেকে একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনল পাতা মাড়াবার। সে তাকাল সেদিকে। মেঘের আড়াল থেকে একটা অস্পষ্ট অবয়ব যেন উঠে আসছে তার দিকে। কে ?’
কয়েক মুহূর্তর মধ্যেই ওপরে উঠে এল সেই মূর্তি। তাকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল সুদীপ্ত। আর সুদীপ্তকে দেখেও যেন বেশ অবাক হয়ে গেল লোকটা। সে মার্কিন নেকড়ে শিকারি বাজ। তবে এখন আর তার কাঁধে রাইফেল নেই, একটা রুকম্যাক আছে।
সুদীপ্ত একটু বিস্মিত ভাবে বলল, ‘আপনি এখানে ?”
বাজ জবাব দিলেন, ‘আপনাদের ওপরে উঠতে দেখে আপনাদের পিছু পিছু আমিও ওপরে উঠে এসেছিলাম। কিন্তু সন্ধ্যা নামতে চলেছে, আপনি এখানে ? ”
তাঁর প্রশ্ন শুনে সুদীপ্ত সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করল পুরো ঘটনাটা। তার কথা শুনে একটা অদ্ভুত হাসি যেন ফুটে উঠল শিকারি বাজের ঠোঁটের কোণে।
কথা শেষ করার পর হঠাৎই সুদীপ্তর চোখে পড়ল লোকটার বুকের বাঁ দিকটা। শুকনো রক্ত লেগে আছে তার জামার বুকে। আর একটা ছিদ্রও যেন দেখা যাচ্ছে তার মাঝে। বিস্মিত সুদীপ্ত প্রশ্ন করল, ‘আপনার বুকে রক্ত কেন? চুপাকাবরা আক্রমণ করেছিল নাকি?’ বাজ মৃদু হেসে বললেন, ‘না, চুপাকাবরা নয়। বুকে বন্দুকের গুলি লেগেছিল গতকাল ভোররাতে।’
সুদীপ্ত আরও বিস্মিত ভাবে জানতে চাইল, ‘বুকে গুলি খেয়ে আপনি বেঁচে গেলেন কি ভাবে?’
মৃদু চুপ থেকে বাজ তার জামার বোতাম খুলে উন্মুক্ত করলেন তার বুক। সুদীপ্ত দেখল তার জামার নিচে বুকের মধ্যে একটা ধাতব পাত বাঁধা আছে। আর তার মাঝখানে একটা ছোট গোলাকার ছিদ্র। সেটা দেখিয়ে বাজ বললেন, ‘নেহাত গুলিটা বেশ দূর থেকে ছোঁড়া হয়েছিল। গুলির শক্তি কিছুটা কমে এসেছিল। তাই গুলিটা পাত ভেদ করে ভেতরে পুরোপুরি প্রবেশ করতে পারেনি। এই ধাতব পাতে গুলিটা আটকে যায়। শুধু তার ‘নোজ’ অর্থাৎ মাথার দিকের অংশটা চামড়া ছিঁড়ে বুকের ভিতর সামান্য একটু প্রবেশ করে। তাতেই এই রক্তপাত । তবে ওই বুলেটের ধাক্কার অভিঘাতেই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ছিটকে পড়লাম আমি। রাইফেলটা খোয়া গেল । আশ্চর্য নিশানা বটে লোকটার। মেঘে ঢাকা আধো অন্ধকারে একেবারে আমার হৃৎপিণ্ড লক্ষ করে গুলি চালিয়েছিল। অব্যর্থ লক্ষভেদ! তবে গুলি আটকাবার জন্য আমি এই ধাতব বর্ম পরিনি। পড়েছিলাম চুপাকাবরার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। সেটাই আমাকে বাঁচিয়ে দিল।’
সুদীপ্ত তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল, ‘আপনি যে বলেছিলেন, ‘চুপাকাবরা বলে কিছু নেই? তার মানে সে আছে!’
মৃদু চুপ থেকে বাজ জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, সে আছে। আপনারা, আমি, গঞ্জালো আমরা আসলে সবাই তার সন্ধানে এসেছি। তবে ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে। এ পাহাড়ই প্রাণীটার প্রধান আস্তানা। প্রাথমিক অবস্থায় আমার ধারণা হয়েছিল যে আপনারা গঞ্জালোরই সঙ্গী। লোকে যাতে বুঝতে না পারে তাই আপনারা আলাদা আলাদা ভাবে এসেছেন। তাই ওই রক্তচোষা বনে কোনো প্রাণী নেই, পাট্রার মৃত্যুর ঘটনা নেকড়ের আক্রমণ বলে চুপাকাবরা রক্তচোষার খোঁজ থেকে নিবৃত্ত করতে চাইছিলাম আপনাদের। পরে আমার অভিজ্ঞতা ও আপনার কথা শুনে বুঝলাম আপনারা সত্যিই ক্রিপ্টোজুলজিস্ট। আপনাদের সাথে গঞ্জালোর বিশেষ সম্পর্ক নেই ৷ ‘
সুদীপ্ত বলল, ‘কিন্তু কে গুলি চালাল আপনাকে ?
বাজ বললেন, ‘ওই গঞ্জালোই, আমার ধারণা সেই আপনাকে আঘাত করে খাদে ফেলে দিয়েছিল। আপনার সঙ্গীকেও অপহরণ করেছে সে।’
সুদীপ্ত বলল, ‘কিন্তু কেন ?”
বাজ জবাব দিলেন, “সে আসল ‘ইউ.এফ.ও’ সন্ধানী নয় । ঠিক আমি যেমন পাকা শিকারি নই। তবে সে সব কথা পরে হবে। অন্ধকার নেমে আসছে, আমার ধারণা আপনার সঙ্গী মিস্টার হেরম্যান ভীষণ বিপদের মধ্যে আছেন। তাকে আগে বিপদমুক্ত করা প্রয়োজন।’ সুদীপ্ত বলল, ‘হ্যাঁ, ঠিক তাই। আগে তার খোঁজ প্রয়োজন। কিন্তু এত বড় মেঘাচ্ছন্ন জঙ্গলে কিভাবে তাকে খুঁজব? অন্ধকারও নেমে আসছে।’
বাজ বললেন, ‘হ্যাঁ অন্ধকার নেমে আসাটাই ভয়ের ব্যাপার। রক্তচোষাটা অন্ধকারেই হানা দেয় ৷ দেখি আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি কিনা?”
৷৷ ৯ ৷৷
অন্ধকার হয়ে আসছে। পিঠের ককস্যাকটা খুলে বাজ তার ভিতর থেকে একটা যন্ত্র বার করে বললেন, ‘ব্যাগে থাকায় এ যন্ত্রটা ঢাল বেয়ে পড়ার সময় বেঁচে গেছে। আমার রাইফেলের মতো এ যন্ত্রটা হারালে খুব মুশকিলে পড়তে হতো।’
যন্ত্রটা দেখেই সুদীপ্ত বলে উঠল, ‘আরে, এ যন্ত্র আপনি কোথায় পেলেন? এটাতো গঞ্জালো কুড়িয়ে পেয়েছিলেন এ জঙ্গলে স্পেনীয়ার্ডদের পুরনো একটা বাড়ি আছে সেখান থেকে ‘ওই বাড়িতে একটা কঙ্কালও ছিল!”
যন্ত্রটার নব টিপে সেটা চালু করে বাজ বললেন, ‘এটা একই যন্ত্র। তবে এটা গঞ্জালোর কুড়িয়ে পাওয়া সেই যন্ত্র নয় ৷ সেটা তার কাছেই আছে। এটা আমি সঙ্গে করে এনেছিলাম । ‘ সুদীপ্ত জানতে চাইল, ‘এটা কী যন্ত্র?’
প্রশ্নর উত্তরটা সরাসরি না দিয়ে বাজ জবাব দিবেন, ‘আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তবে এ যন্ত্রই আমাদের হেরম্যান আর গঞ্জালোর কাছে পৌছে দেবে।’
বিপ বিপ শব্দ করতে শুরু করেছে যন্ত্রটা। তার গায়ের ছোট এল.সি.ডি পর্দায় ফুটে উঠেছে একটা সাংকেতিক নির্দেশ। যদিও সেটা বোধগম্য হচ্ছে না সুদীপ্তর। পর্দাটায় চোখ রেখে বাজ হাঁটতে শুরু করলেন মেঘ আর অন্ধকার নেমে আসা অরণ্যর দিকে। সুদীপ্ত তাকে অনুসরণ করল। সূর্য ডুবে গেল। দিনের শেষ আলোটুকুও মুছে গিয়ে অন্ধকার নেমে এল কোস্টারিকার মেঘ অরণ্যে।
অন্ধকারের মধ্যে হেঁটে চলেছে সুদীপ্তরা। মাঝে মাঝে কেউ ঠোক্কর খাচ্ছে পায়ের নিচে পাথরে বা গাছের ডালে। মৃদু আলো ছড়াচ্ছে বাজের হাতের যন্ত্রটা। তার পর্দায় চোখ রেখে এগোচ্ছেন বাজ। মেঘ আর অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে এগোতে লাগল তারা। কোন দিকে সুদীপ্ত এগোচ্ছে তা বুঝতে পারছে না। সে শুধু অনুসরণ করছে বাজকে। এক সময় চাঁদ উঠতে শুরু করল আকাশে তার অস্পষ্ট আলো ছড়িয়ে পড়ল মেঘ অরণ্যে। অন্ধকার কিছুটা কেটে গেল । এরপর কিছুটা দ্রুত এগোতে শুরু করল সুদীপ্তরা। একটা জিনিস সুদীপ্ত বুঝতে পারল যে তারা এর আগে অরণ্যের এ অংশে আসেনি। এদিকের গাছগুলো আরও প্রাচীন। তাদের মাথাগুলোও অনেক বেশি ঝাঁকড়া। তবে অরণ্যের অন্য অংশর মতো এদিকের গাছগুলো অতো ঘনসন্নিবিষ্ট ভাবে ঠেসাঠেসি করে দাঁড়িয়ে নেই। কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে তারা দাঁড়িয়ে আছে। গাছগুলোর মধ্যে দিয়ে মাঝে মাঝে মেঘের আবরণ সরে গেলে বেশ কিছুটা দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। তা দেখে সুদীপ্তর মনে হল তারা ধীরে ধীরে চড়াই ভেঙে পাহাড়ের মাথায় উঠে এসেছে।
চলতে চলতে এক সময় থমকে দাঁড়ালেন বাজ। এক সারি বড় বড় গাছ সেখান থেকে কিছুটা ভাতে তফাতে এগিয়েছে সামনের দিকে। শাখাপ্রশাখা ছড়ানো সেই গাছগুলোর মাথায় জমাট বাঁধা অন্ধকার। বাজের হাতের যন্ত্রটা ভীব্র বিপ বিপ শব্দ করে চলেছে। একবার তার পর্দার দিকে তাকিয়ে আর একবার অন্ধকারাচ্ছন্ন গাছগুলোর মাথার দিকে তাকিয়ে বাজ বললেন, ‘এবার সাবধানে চলবেন। গাছগুলোর নিচ দিয়ে যাবার সময় ওপর দিকে খেয়াল রাখবেন।’
সুদীপ্ত প্রশ্ন করল, ‘কেন ?
শিকারি বাজ জবাব দিলেন, রক্তচোষাটা খুব কাছেই আছে। সম্ভবত কোনো গাছের মাথায়।’ কথাটা বলে রাজ তার হাতের মুটো বন্ধ করে ইশারাং আর কোনো কথা বলতে বারণ করলেন সুদীপ্তকে। অতি সাবধানে এরপর গাছগুলোর নিচ দিয়ে এগোতে থাকেন তারা। নিচ দিয়ে যাবার সময় মাথার ওপর তাকালেও বড় বড় গাছগুলোর মাথার ভিতর ডালপালার আড়ালে কোনো কিছু ঠাহর করা যাচ্ছেনা। ঘন অন্ধকার বিরাজ করছে সেখানে। তার ওপর আবার মেঘ নেমে ঢেকে দিচ্ছে গাছের মাথাগুলো। তাদের নিচ দিয়ে যাবার সময় সুদীপ্তর মনে হতে লাগল মেঘে ঢাকা অন্ধকার গাছগুলোর মাথা থেকে এই বুঝি তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কেউ!
একটার পর একটা গাছ টপকে এগিয়ে চলল তারা। এক সময় তারা দেখতে পেল তাদের সামনে একটা উন্মুক্ত জমি। তার একদিকে খাদ, আর অন্যপাশে জমিটাকে অর্ধবৃত্তাকারে বেড় দিয়ে রেখে সার সার বড় বড় গাছ। ফাঁকা জমিটার মধ্যে খাদের দিক থেকে উড়ে আসা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। তবে ফাঁকা জমিটার মাথাটা গাছপালাতে ঢাকা না থাকায় সরাসরি চাঁদের আলো এসে পড়ছে জমিটাতে। একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে জমিটার দিকে তাকাল সুদীপ্তরা। প্রথমে তেমন কিছু তাদের নজরে পড়ল না। কিন্তু খাদের দিকের মেঘ সরে যেতেই তাদের চোখে পড়ল এক অদ্ভুত দৃশ্য। খাদের দিক ঘেসে মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ফুট আটেক লম্বা নেড়া গাছের গুঁড়ি। হয়তো তার মাথাটা ঝড়ে ভেঙে গেছিল বা কেটে কেটে ফেলেছিল। সেই গাছের গুঁড়ির গায়ে বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন হেরম্যান! মাঝে মাঝে মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে তাকে, আবার মেঘ সরে গেলেই দৃশ্যমান হচ্ছে তার অবয়ব।
শিকারি বাজ চাপা স্বরে সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার সঙ্গীকে চুপাকাবরার টোপ বানিয়েছে শয়তানটা। সে নিশ্চই কাছাকাছিই আছে!’ তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই পিছন থেকে একটা কর্কশ গলা শোনা গেল, ‘হ্যাঁ, শয়তানকে স্মরণ করলেই সে আবির্ভূত হয়।’ সুদীপ্তরা ঘুরে দেখল তাদের হাত দশেক দূরে একটা গাছের আড়াল থেকে চাঁদের আলোতে এসে দাঁড়িয়েছেন গঞ্জালো। তার ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি। শিকারকে ফাঁদে ফেললে শিকারি ঠোঁটে যেমন হাসি দেখা যায় ঠিক তেমনই এক নিষ্ঠুর হাসি। তার রাইফেলের নল সোজা তাগ করা সুদীপ্তদের দিকে।
সুদীপ্ত বলে উঠল, এ সব আপনি কি করছেন ?
গঞ্জালো ধমকের সুরে বলে উঠলেন, ‘মাথার ওপর হাত ওঠাও দু-জনে। নইলে এখনই গুলি চালাব। দুজনেই এখনও বেঁচে আছেন দেখছি! আপনাদের আর বেঁচে থাকার সামান্য আশা যদি এখনও থেকে থাকে কথন শুনলে আমি তখনই সেটুকুই শেষ করে দেব। আপনারা নিশ্চই বুঝতে পেরেছেন যে মানুষ খুন করতে আমার হাত কাঁপবে না?”
তার কথা শুনে সুদীপ্ত আর বাজ ধীরে ধীরে মাথার ওপর হাত তুলল। গঞ্জালো বললেন, ‘এবার পিছন ফিরে ঘুরে দাঁড়াও।’
এবার তার নির্দেশ পালনে একটু ইতস্তত করতে লাগল সুদীপ্তরা।
গঞ্জালো বলে উঠলেন, ‘যা বলছি তাই করো। যে প্রাণীটা কাছাকাছিই আছে। তাকে ধরে অথবা মেরে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। আমার হাতে বেশি সময় নেই।’ তার কথা শুনে বাজ বলে উঠলেন, ‘কিন্তু প্রাণীটাকে নিয়ে নিচে নেমে লোকজনের চোখ এড়িয়ে এ দেশ থেকে কি ভাবে পালাবে? ঠিক ধরা পড়ে যাবে।’
গঞ্জালো প্রথমে জবাব দিলেন, ‘নিচে নামতে হবে না। প্রাণীটা যেভাবে এখানে এসেছিল ঠিক তেমনভাবেই তাকে আমি নিয়ে যাব। আমি ওটা দেখেছি। গ্রামবাসী বা সাধারণ মানুষ ধোঁকা খেলেও আমি খাইনি।’
গঞ্জালো কথাগুলো কী বললেন তা সুদীপ্ত ঠিক বুঝতে না পারলেও সুদীপ্ত খেয়াল করল যে তার কথা শুনে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল বাগের মুখ। গঞ্জালো এরপর তার রাইফেলটা তুলে ধরে বাজের বুক তাক করে বললেন, ‘ঠিক আছে আমার কথা যখন শুনতে চাচ্ছ না তখন খেলাটা এখনই শেষ করি।’
গুলি চালিয়ে দিতে পারে লোকটা। অগত্যা মাথার ওপর হাত উঁচু করে ঘুরে দাঁড়াল দুজন।
গঞ্জালো নির্দেশ দিলেন, ‘সোজা মাঠের দিকে হাঁটুন৷ আসলে গুলিতে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাবেন।’
লোকটার নির্দেশ পালন করে মাঠের মধ্যে ঢুকল তারা দুজন। আর তাদের পিছনে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে তাদের দিকে রাইফেল তাক করে গঞ্জালো। সুদীপ্ত আর বাজ মাঠের ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়াল। গঞ্জালো পরবর্তী নির্দেশ দিলেন, ‘এবার খাদের দিকে এগোন ।
সেদিকেই গাছের গুড়িতে বাঁধা আছেন হেরম্যান। গঞ্জালোর কথা মেনে সোজা খাদের দিকে হাঁটতে শুরু করল তারা। হেরম্যানের দিকে তাকাতে তাকাতে এগোল সুদীপ্ত। এক সময় তার কাছাকাছি পৌঁছে গেল সে। একপাশে মাত্র হাত দশেক ব্যবধান তার সাথে। হেরম্যান নড়ছেন না। দড়িবাঁধা অবস্থায় তিনি দাঁড়িয়ে আছেন গাছের গুড়িটার সাথে। তার মাথাটা এক পাশে হেলানো, চোখের পাতা বন্ধ। মনে হয় তিনি অজ্ঞান হয়ে আছেন। দড়ির বাঁধন কেটে দিলেই যেন তিনি মাটিতে পড়ে থাকেন। আরও একটা জিনিস খেয়াল করল সুদীপ্ত। তার জামাটা যেন ভেজা ভেজা মনে হচ্ছে! রক্ত! হেরম্যান কি তবে আহত? সুদীপ্ত সে দিকে এক পা বাড়াতে যাচ্ছিল। কিন্তু সেটা খেয়াল করে গঞ্জালো ধমকে উঠলেন, ‘ও পাশে নয় ৷ সোজা খাদের দিকে চলুন। নইলে এখনই গুলি চালাব।’অগত্যা হেরম্যানকে একপাশে ফেলে সুদীপ্তরা এগোল খাদের দিকে।
হেরম্যানকে অতিক্রম করে হাত পনেরো তফাতেই খাদটা। চলতে চলতে খাদের কিনারে এসে থেকে গেল সুদীপ্ত আর বাজ। সুদীপ্তদের পিছনে গঞ্জালোর পায়ের শব্দও থামল। মুহূর্ত খানেকের নিস্তব্ধতা। তারপর গঞ্জালোর কণ্ঠস্বর শোনা গেল পিছন থেকে—‘এবার খাদে ঝাঁপ দিন।’
খাদের মধ্যে থেকে মেঘ উঠে আসছে মাঠের ভিতর। তার গভীরতা কত বোঝা যাচ্ছে না। সুদীপ্তরা তাকাল সেদিকে। এরপর সুদীপ্ত বলে উঠল, ‘আপনি কি বলতে চাইছেন?”
গঞ্জালো অট্টহাস্য করে বলে উঠলেন, ‘সহজ কথা বলছি। খাদে ঝাঁপ দিন । তাহলে হয়তো আপনাদের মধ্যে কেউ বেঁচে গেলেও বেঁচে যেতে পারেন। ঠিক যেভাবে এর আগে আপনারা একবার মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়েছেন। কিন্তু গুলি খেয়ে খাদে ছিটকে পড়লে আপনারা কেউ বাঁচবেন না ।
তার কথা শুনে খাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সুদীপ্ত আর বাজ।
গঞ্জালো এরপর বললেন, ‘আমি দশ গুনব। আর তার মধ্যে লাফ না দিলেস গুলি চালাব ।’
তার কথা শুনে চাপা স্বরে বাজ সুদীপ্তকে বললেন, ‘ও ঠিক সাত গুনলে আমরা পিছন ফিরে এক সাথে ঝাঁপাব ওর দিকে। ও একটা গুলি ছোঁড়ার সুযোগ পাবে। একজন মারা গেলেও অন্য একজন বেঁচে যাবে।’
সুদীপ্ত জবাব দিল, ‘আচ্ছা ৷’
তাদের দুজনকে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে গঞ্জালো এবার গুনতে শুরু করলেন—‘এক…দুই…
ধীরে ধীরে সংখ্যাগুলো বলছেন গঞ্জালো। এক একটা মুহূর্ত যেন একটা দীর্ঘসময় মনে হচ্ছে! গঞ্জালো গুনে চলেছেন—তিন…চার…পাঁচ… পিছনে ফেরার জন্য প্রস্তুত হল সুদীপ্ত।
‘ছয়…।’—দীর্ঘ সময় নিয়ে শব্দটা উচ্চারণ করলেন গঞ্জালো।
এবার তিনি সাত গুনবেন। মুহূর্তর নিস্তব্ধতা। কিন্তু তারপরই পিছনে একটা শব্দ শুনে বিদ্যুৎ বেগে গঞ্জালোর দিকে ঘুরে দাঁড়াল সুদীপ্ত আর বাজ। তারা দেখল পিছন থেকে এসে গঞ্জালোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন হেরম্যান। সাত গোনা আর হল না গঞ্জালোর। হেরম্যান আর গঞ্জালো দুজনেই মাটিতে পড়ে গেলেন। অবাক হয়ে গেল সুদীপ্তরা । কিভাবে মুক্ত হলেন হেরম্যান ?
কিন্তু ধস্তাধস্তির মধ্যেই হঠাৎ মাটি থেকে স্প্রিং-এর মতো লাফিয়ে উঠলেন গঞ্জালো। হেরম্যানও উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই গঞ্জালো এক লাথিতে তাকে ছিটকে ফেলে তিরবেগে দৌড়ালেন মাঠের গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর দিকে।
সুদীপ্ত আর বাজ সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেল হেরম্যানের দিকে। তারা মাটির ওপর তুলে দাঁড় করালো হেরম্যান। সুদীপ্ত হেরম্যানকে বলল, ‘আপনার দেহে রক্ত কেন ?”
হেরম্যান হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, “ও কিছু নয়। আমার না। গায়ে হরিণের রক্ত ঢেলেছিল গঞ্জালো চুপাকাবরাকে আমার দিকে আকৃষ্ট করার জন্য।’—এ কথা বলার পরই হেরম্যান বললেন, ‘ওই যে ও পালাচ্ছে! ওকে ধরতে হবে।’
মাঠের মেঘ কুয়াশা ভেদ করে তির গতিতে গাছগুলোর দিকে ছুটছেন গঞ্জালো। বাজের হঠাৎ চোখে পড়ল কিছুটা তফাতে গঞ্জালোর হাতে থেকে খসে পড়া রাইফেলটার দিকে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাইফেলটা কুড়িয়ে নিয়ে নিচু হয়ে বসে ট্রিগারে চাপ দিলেন গঞ্জালোর পা লক্ষ করে গুলি চালাবার জন্য। পরপর দুটো গুলি। তার শব্দে কেঁপে উঠল মেঘ পাহাড়ের বনাঞ্চল ৷ বার বার সেই শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে লাগল পাহাড়ে। কিন্তু মেঘে ঢাকা মাঠে লক্ষভ্রষ্ট হল বাজের নিশানা। গঞ্জালো হারিয়ে গেলেন গাছগুলোর আড়ালে। কিন্তু এরপরই অদ্ভুত এক ঘটনার সাক্ষী হল সুদীপ্ত আর হেরম্যান। মাঠের অন্য পাশে একটা গাছের মাথা হঠাৎ প্রবল ভাবে আন্দোলিত হল। সুদীপ্তরা মেঘে ডাকা অস্পষ্ট চাঁদের আলোতে দেখতে পেল সে গাছের মাথা থেকে অন্য গাছের মাথায় ঝাঁপ দিল একটা মিশমিশে কালো বানরের মতো প্রাণী! তারপর সে গাছ থেকে একটা অন্য গাছে। তারপর তার থেকে আরেকটা গাছের মাথায়। গাছগুলোর মধ্যে ব্যবধান কমপক্ষে কুড়ি-পঁচিশ ফুট হবে। কিন্তু সে দূরত্ব অবলীলায় লাফিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে প্রাণীটা। হেরম্যান বিস্মিত ভাবে বলে উঠলেন, ‘চুপাকাবরা ! ”
কয়েক মুহূর্তর মধ্যেই লম্বা লম্বা লাফে প্রাণীটা অদৃশ্য হয়ে গেল চোখের আড়ালে। বাজ বলল, ‘গুলির শব্দে ভয় পেয়েছে প্রাণীটা। গঞ্জালো সত্যিই এখানে তার উপস্থিতি টের পেয়েছিল। পাছে প্রাণীটা গুলির শব্দে টোপ ছেড়ে পালিয়ে না যায়, তাই গুলি না করে আমাদের খাদে ফেলে মারতে চাচ্ছিল।’
হেরম্যান বললেন, ‘প্রাণীটা কোথায় পালাল সেখানে আমাদের যেতে হবে।
বাজ মুহূর্তখানেক ভেবে নিয়ে বললেন, ‘আমার ধারণা এক জায়গাতে হয়তো প্রাণীটাকে অথবা গঞ্জালোকে পাওয়া যেতে পারে অথবা তাদের দুজনকেই। এই বলে তিনি ব্যাগ থেকে তার সেই যন্ত্রটা বার করে চালু করলেন। বিপ বিপ শব্দ করে যন্ত্রটা চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার মনিটরে কী সব যেন রেখা ফুটে উঠতে লাগল। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে বাজ বললেন ‘আমার ধারণা সঠিক। প্রাণীটা অন্তত সেদিকেই যাচ্ছে।’
হেরম্যান প্রশ্ন করলেন, ‘কোথায়? এটা কি যন্ত্র?’
বাজ জবাব দিলেন, “পরে বুঝবেন সব। এখনই সে জায়গায় পৌছতে হবে। গঞ্জালোও যদি ওদিকে গিয়ে থাকে আর আমাদের আগে সে জায়গাতে পৌছে যায় তবে হয়তো আর তাকে ধরা যাবে না। আসুন আমার সাথে।’ এই বলে তিনি দ্রুত এগোলেন মাঠটা পেরোবার জন্য। সুদীপ্তরা অনুসরণ করল তাকে। মাঠ থেকে বেরিয়ে যে গাছের আড়াল থেকে গঞ্জালো তাদের দেখা দিয়েছিলেন তার গুঁড়িটার পেছনে গঞ্জালোর ছেড়ে রেখে যাওয়া বেশ কিছু জিনিস হঠাৎ নজরে পড়ল সুদীপ্তদের। হেরম্যানের বন্দুক, কার্তুজ আর সিরিঞ্জের বাক্স, স্পেনীয়ার্ডদের বাড়ি থেকে কুড়িয়ে পাওয়া সেই যন্ত্র, সেই রেডিওর মতো মহাকাশে শব্দ প্রেক্ষণকারী যন্ত্র আর একটা রিভলবার। তা দেখে থমকে দাঁড়িয়ে বাজ বললেন, ‘প্রাণীটাকে ধরা অথবা মারার জন্য বেশ সেজেগুজেই এখানে বসেছিল লোকটা! রিভলবারটা দিয়েই উইলিয়ামের খামারে শ্রণীটাকে গুলি চালিয়ে ছিল সে। বাজ যন্ত্রদুটো শুধু তুলে তার ব্যাগে পুরলেন। হেরম্যান আর সুদীপ্ত নিয়ে নিল বন্দুক আর কার্তুজ। হেরম্যান বললেন বন্দুকে ট্রাঙ্কুলিন সিরিঞ্জ ভরা। অর্থাৎ প্রাণীটাকে মারা নয় ধরার চেষ্টা করতো সে। গঞ্জালোও কি তবে ক্রিপ্টোলজিস্ট ?
তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে অস্পষ্ট চাঁদের আলোতে মেঘ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগোলেন বাজ। আর তার পিছনে সুদীপ্ত আর হেরম্যান। মেঘ ভাসছে জঙ্গলের মধ্যে। আশেপাশের গাছগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে তারা যেন এক একজন মানুষ। চাঁদের আলোতে তারা ভৌতিক অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে যেন তারা তাকিয়ে আছে সুদীপ্তদের দিকে। তাদের ফাঁক গলে সুদীপ্তরা যথাসম্ভব দ্রুত এগিয়ে চলল বাজের পেছনে। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর সুদীপ্ত হেরম্যানকে প্রশ্ন করল, ‘আপনাকে গঞ্জালো বন্দি করল কিভাবে? আর মুক্তও হলেন কীভাবে?’
হেরম্যান বললেন, ‘তিনটের একটু আগে ঘুম থেকে উঠে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে দেখলাম তুমি নেই, গঞ্জালো দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন তুমি বনের আড়ালে গেছ; একটু পরই ফিরবে। আমি বললাম আমরা হরিণের খোঁজে যাব। তিনি বললেন তিনিও সঙ্গে যাবেন। তাবে যাবার আগে একটু কফি খাওয়া যাক। নিজের তাঁবু থেকে কফি বানিয়ে আনলেন তিনি। ওতে মাদক মেশানো ছিল। হুঁশ ফিরল আজ বিকালে গাছের গুঁড়ির সাথে বাঁধা অবস্থায়। আমার ট্রাউজারের পকেটে একটা ছোট পেনসিল কাটার ছুরি ছিল। অন্ধকার নামার পর অনেক কষ্টে সেটা বার করে বাঁধন কেটে ফেলেছিলাম। আমার যে জ্ঞান ফিরেছে তা আমি বুঝতে দেইনি লোকটাকে। অন্ধকার আর মেঘ ব্যাপারগুলোতে আমাকে সাহায্য করেছিল। কিন্তু তোমার কি হয়েছিল ?
হেরম্যানের প্রশ্নর জবাবে সুদীপ্ত সংক্ষেপে সমস্ত ঘটনা জানাল তাকে।
একসময় বাজ তাদের কথোপকথন থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আর কথা বলবেন না। আমরা জায়গাটার কাছে পৌঁছে গেছি।’
সুদীপ্তরা দেখল তাদের সামনে কিছুটা দূরে এক সার গাছ স্থান সন্নিবিষ্টভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বাজ এগোলেন সেদিকেই।
গাছগুলোর কাছাকাছি এক জায়গায় একটা পচাগলা কঙ্কাল পড়ে আছে। তার পরনের পোশাকও সেই বাড়িটাতে পড়ে থাকা কঙ্কালের মতোই। তার পাশ দিয়ে যাবার সময় বাজ একবার মুহূর্তর জন্য সেদিকে তাকিয়ে আফশোসের সুরে খুব আস্তে বললেন, “ঈশ্বর তোমাদের আত্মাকে শান্তি দিন।’ তারপর পকেট থেকে কার্তুজ বার করে বন্দুকে ভরে নিয়ে এগোলেন সমনের গাছের প্রাচীরের দিকে।
৷৷ ১০ ৷৷
সার সার বড় বড় গাছ গা ঘেঁসাঘেঁসি করে দাঁড়িয়ে আছে। খুব বেশি হলে দুটো গাছের মধ্যে হাত তিনেকের ব্যবধান। তবে মাথার ওপরের ডালপালাগুলো মিলেমিশে যাওয়ায় গাছের গুঁড়িগুলোর নিচে জমাট বেঁধে আছে অন্ধকার। তেমনই এক গাছের নিচে বাজের সঙ্গে এসে হেরম্যান আর সুদীপ্ত তাকাল গাছের প্রাচীরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা জায়গাটার দিকে। সাপের মাঠটার মতো এখানেও একটা উন্মুক্ত জমি তবে আকারে একটু বড়। জমিটার তিন দিকে বৃক্ষপ্রাচীর আর একদিকে খাদ। বাইরে দূর থেকে এই জমিটার অস্তিত্ব বোঝার কোনো উপায় নেই। খাদের দিক থেকে মাথার ওপরের পূর্ণ চাঁদের আলো এসে পড়েছে জমিটাতে। মেঘ তেমন একটা নেই এখানে। তাই সব কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলোতে মাঠের ঠিক মাঝখানে একটা জিনিসকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হেরম্যান আর সুদীপ্ত দুজনেই চমকে উঠল। চুপাকাবরার সাথে সামনাসামনি সাক্ষাৎ হলেও এতটা বিস্মিত হত না তারা। সেখানে রয়েছে বর্তুলাকার একটা যান। পিরিচের ওপর ওল্টানো পেয়ালার মতো দেখতে যানটা মাটি থেকে ফুট আটেক ওপরে দাঁড়িয়ে আছে তিনটে পায়ের সাহায্যে। যানটার ধাতব সঙ্গ বেয়ে চাঁদের আলো পিছলে পড়ছে। এ যানের বহু ছবি হেরম্যান আর সুদীপ্ত দেখেছে বইয়ের পাতায় অথবা সিনেমার পর্দায়। মহাকাশ যান! ইউ-এফ-ও! ফ্লাইং সসার!!
হতবাক সুদীপ্তরা বিস্মিত ভাবে চেয়ে রইল সেই অদ্ভুত যানটার দিকে। মহাকাশ যানের দরজা খোলা। তার থেকে একটা সিঁড়ি নেমে এসেছে মাটিতে। সুদীপ্তর মনে পড়ে গেল গঞ্জালোর কথা। লোকটা তাদের সাথে যে ব্যবহারই করে থাকুক তবে তার বক্তব্যই কি সত্যি ? মহাকাশ যান সত্যিই আছে!
চুপাকাবরা কি তবে সত্যিই ভিনগ্রহর জীব? একই প্রশ্ন মুহূর্তর জন্য হলেও নাড়া দিল হেরম্যানের মনকেও। শুধু বাজের সেই মহাকাশ যানটা দেখে কোনো ভাবান্তর হল না। ইশারায় তিনি সুদীপ্তদের চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে জমিটা আর অন্যদিকের গাছের মাথার দিকে তাকিয়ে কিসের যেন পরীক্ষা করতে থাকলেন!
কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা অস্ফুট শব্দ কানে যেতেই সতর্ক হয়ে গেল সুদীপ্তরা। কেউ যেন মাঠের অন্যপাশের গাছের আড়লে জঙ্গল ভেঙে ছুটে আসছে মাঠের দিকে। কয়েক মুহূর্তর মধ্যেই গাছের আড়াল থেকে ছুটতে ছুটতে মাঠের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করল একজন লোক। গঞ্জালো !
মাঠের ঠিক মাঝখানে মহাকাশ যানটার কাছাকাছি পৌঁছে দাঁড়িয়ে পড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে সে চারপাশে তাকাতে লাগল । সুদীপ্তরা অন্ধকারে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে বলে গঞ্জালোর চোখে তারা ধরা পড়ছে না। তবে মহাকাশ যানটা দেখে সে বিস্মিত হয়েছে বলে মনে হল না। সে যেন জানতই যে যানটা এখানে আছে। বরং চারপাশে কাউকে না দেখতে পেয়ে যেন একটা স্বস্তির হাসি ফুটে উঠল তার মুখে।
বাজ তার দিকে তাক করে বন্দুক উঁচিয়ে রাখলেও চাপা স্বরে বললেন, ‘ও মনে হয় সিঁড়ি বেয়ে ওর ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করবে। ওর কাছে কোনো অস্ত্র নেই। ও সিঁড়ি বেয়ে ওর ভিতরে ঢুকলেই সঙ্গে সঙ্গে আমরা ছুটে যাব। যানটার ভিতরই ওকে আটকে ফেলব আমরা।’ বাজের অনুমানই সত্যি হল। চারপাশে কাউকে না দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে মহাকাশ যানের সিঁড়ির দিকে এগোল সে। আট দশটা মাত্র ধাপ আছে সিঁড়িটার। গঞ্জালো উঠতে শুরু করলেন সিঁড়ি বেয়ে। সুদীপ্তরাও প্রস্তুত হল সেদিকে ছোটার জন্য।
গঞ্জালো তখন প্রায় মহাকাশ যানটার দরজার কাছে উঠে গেছেন। ঠিক সেই মুহূর্তে সুদীপ্তদের চমকে দিয়ে মহাকাশ যানের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল অনেকটা বানরের মতো দেখতে তবে তার চেয়ে আকারে বড় মিশমিশে কালো একটা প্রাণী। তার গোলাকার চোখ দুটো যেন জান্তব হিংস্রতায় জ্বলছে। তবে তার মুখমণ্ডল নেকড়ের মতো ছুঁচালো না হলেও বর্তুলাকার মুখমণ্ডলে চোয়ালের এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত তীক্ষ্ম দাঁতের সারি চাঁদের আলোতে ঝিলিক দিচ্ছে। ঠিক যেন প্রাণীটা শয়তানের প্রতিমূর্তি !
তাকে সামনে দেখতে পেয়েই থমকে গেলেন গঞ্জালো। আর তারপরই তিনি পিছু হটে সিঁড়ি থেকে নামতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু প্রাণীটা পরমুহূর্তে ঝাঁপ দিল গঞ্জালোর ওপর। সিঁড়ি থেকে জড়াজড়ি করে তারা গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। সঙ্গে সঙ্গে সুদীপ্তরা গাছের আড়াল থেকে বেড়িয়ে ছুটতে শুরু করল মাঠের দিকে। মাটিতে গঞ্জালো আর প্রাণীটা কাটাকাটি করছে। গঞ্জালোর আতঙ্কিত চিৎকার আর প্রাণীটার বিজাতীয় তীক্ষ্ম কিচমিচ শব্দে খান খান হয়ে যাচ্ছে রাত্রির নিস্তব্ধতা। তাদের বেশি কাছে গেলে শয়তানটা সুদীপ্তদেরও আক্রমণ করতে পারে তাই যুযুধান দুপক্ষের কিছুটা তফাতে সুদীপ্তরা দাঁড়িয়ে পড়ল। গঞ্জালোকে প্রাণীটার কবল থেকে মুক্ত করার জন্য বাজ শূনে দু-দুবার গুলি চালালেন । প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল চারপাশ । এতে কাজ হল। রক্তচোষাটা গঞ্জালোকে ছেড়ে দু পায়ে ভর করে উঠে দাঁড়াল । তারপর সুদীপ্তদের দেখতে পেয়ে প্রচণ্ড আক্রোশে চিৎকার করে উঠল—‘কিঁ-ই-চ, কিঁ-ই-চ। তারপর একটা লম্বা লাফ দিল সুদীপ্তদের উদ্দেশ্যে। বাঁচবার জন্য প্রাণীটাকে লক্ষ করে সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালিয়ে দিল সুদীপ্ত। ভাগ্য ভালো তার গুলি লক্ষভ্রষ্ট হল না। শুন্যে পাক খেয়ে সুদীপ্তদের মাথার ওপর দিয়ে গিয়ে প্রাণীটা আছড়ে পড়ল মাটিতে। সে অবস্থাতে বাজের পরবর্তী গুলি চিরদিনের জন্য শান্ত করে দিল প্রাণীটাকে।
সুদীপ্তরা তিনজনেই ছুটে গেল গঞ্জালোর কাছে। তার অবস্থা দেখে চমকে উঠল সুদীপ্তরা । যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছেন গঞ্জালো। তাকে ছেড়ে ওঠার আগেই শয়তানটা গঞ্জালোকে মারণাঘাত হেনেছে। তিনটে গভীর ছিদ্র তার বুকে। গল গল করে রক্ত বেরোচ্ছে সেখান থেকে। অস্পষ্ট স্বরে একবার তিনি বললেন, ‘জল দাও, জল।’ বাজ তাড়াতাড়ি জলের বোতল বার করে জল ঢেলে দিল তার মুখে। শেষবারের জন্য একবার চোখ মেললেন গঞ্জালো। তার ওপর ঝুঁকে পড়া মুখগুলো দেখে একটা দুর্বোধ্য হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। তিনি বললেন, “আমি তো মরলামই, কিন্তু এ প্রাণীগুলোর হাতে আপনারাও একদিন মরবেন। সে দিন আর খুব বেশি দূরে নেই…। এ কথা বলে অজানা কোনো ভাষায় বিড়বিড় করে কী যেন বলতে লাগলেন তিনি। হয়তো বা সেটা তাঁর মাতৃভাষা হবে। তার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারল না সুদীপ্তরা। কিছুক্ষণের মধ্যে কেঁপে উঠে স্থির হয়ে গেল গঞ্জালোর দেহ। কোনো মানুষের মৃত্যুই সুদীপ্তদের কাছে কাম্য নয়। তার বিস্ফোরিত চোখের পাতা দুটো হাত দিয়ে বুজিয়ে দিলেন হেরম্যান।
সেদিক থেকে সুদীপ্তরা এরপর এগিয়ে গেল মৃত প্রাণীটার দিকে। মাটিতে পড়ে আছে বাঁদর আর শিম্পাঞ্জির মাঝামাঝি আকৃতির মৃত প্রাণীটা। ছড়কুটে বেরিয়ে আছে তার করাতের মতো সারসার বিভৎস দাঁতগুলো। কুঁচকুচে কালো প্রায় রোমহীন দেহ। সুদীপ্তদের দৃষ্টি পড়ল তার হাতের পাতায়। প্রাণীটার দুই হাতেই তিনটে করে দীর্ঘ শলাকার মতো নখ। আকারে অন্তত পাঁচ ইঞ্চি হবে। যা সে বিঁধিয়ে দিত শিকারের বুকে। তবে গল্পে শোনা চুপাকাবরার বর্ণনার মতো শিরদাঁড়াতে কুমিরের মতো কোনো কাটা নেই। তার হাতের ওই বীভৎস নখ আর হিংস্র দাঁতগুলো বাদ দিলে বাঁদর জাতীয় প্রাণীর সাথেই রক্তচোষাটার মিল বেশি। এরপর প্রাণীটাকে আরও ভালো করে লক্ষ্য করে একটা জিনিস চোখে পড়ল সুদীপ্তদের। প্রাণীটার গলায় বকলেসের মতো একটা কলার আছে।
সুদীপ্ত বাজকে প্রশ্ন করল, ‘এটা কি ভিনগ্রহর জীব? ওই মহাকাশ যান থেকে নেমে এসেছিল?’
একটু চুপ করে থেকে কী যেন ভেবে নিয়ে বাজ বললেন ওটা কোনো মহাকাশ যান নয় ৷ একটা অত্যাধুনিক আকাশ যান। আর এ প্রাণীটাও কোনো মহাকাশের প্রাণী নয় । ঠিক যেমন গঞ্জালো আর আমার পরিচয়টাও আসল নয়।
বিস্মিত হেরম্যান বললেন, তবে আপনাদের পরিচয় কি? ব্যাপারটা খুলে বলুন আমাদের । বাজ পিছন ফিরে একবার আকাশ যানটার দিকে তাকালেন। তারপর রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আমাকে কিছু সময়ের মধ্যেই রওনা হতে হবে। তবে যাবার আগে আপনাদের কৌতুহল নিরসনের জন্য আমার পক্ষে যতটা সম্ভব বলে যাই আপনাদের। আমার নাম বা আমার দেশের নাম আসলে কী তা আমার পক্ষে জানানো সম্ভব নয়। গঞ্জালোর নিজের নাম বা দেশের নামটাও ভুয়ো । তবে আমরা দুজনেই পৃথিবীর দুটো বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে উন্নত শক্তিধর দেশের সামরিক বাহিনীর সিক্রেট এজেন্সির লোক। এ প্রাণীটার খোঁজেই আমরা দু-জনেই এখানে এসেছিলাম। আমি প্রাণীটাকে ধরে বা মেরে নিজের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে যাতে প্রাণীটার হত্যালীলা বন্ধ হয় ও প্রাণীটা অন্য কোনো দেশের বিজ্ঞানীদের হাতে না পড়ে। আর গঞ্জালো পরিচয়ের লোকটা চেয়েছিল প্রাণীটাকে ধরে বা মেরে নিজের দেশের সামরিক বিভাগের জীব বিজ্ঞানীদের হাতে তুলে দিতে।’
হেরম্যান বলে উঠলেন, ‘প্রাণীটার গলায় কলারটা দেখেই বুঝতে পেরেছি এটা কোনো পোষা প্রাণী ছিল। কিন্তু এটা কী প্রাণী?’
বাজ পরিচয়ের লোকটা জবাব দিল, ‘আপনারা যখন জীববিজ্ঞানের চর্চা করেন তখন আপনারা নিশ্চই ‘রেসাস বানরের নাম শুনেছেন। এদের নিয়ে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। অবশ্য সবটাই করা হয় অত্যন্ত গোপনীয়তার ঘেরাটোপে, অনেক সময় সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে। আপনাদের সামনে যেটা পড়ে আছে সেটা একটা বড় প্রজাতির রেসাস বানর। নানা জেনিটিক মিউটেশান ঘটিয়ে ওর চেহারা, দাঁত ও নখের অমন বৃদ্ধি ঘটানো হয়েছে। চরিত্রেরও বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে ওকে রক্তপানে অভ্যস্ত করে তোলা হয়েছিল। কিন্তু ওকে নিয়ে গবেষণা করার সময় কোনো ত্রুটির কারণে প্রত্যাশার তুলনায় আরও অনেক বেশি হিংস্র হয়ে উঠেছিল প্রাণীটা…
‘কিন্তু এমন গবেষণার কারণ কি? ওকে হিংস্র করে তোলার কারণ কি?
এ প্রশ্নর জবাবে লোকটা যা বললেন তাতে চমকে উঠলেন হেরম্যান আর সুদীপ্ত। তিনি বললেন, ‘যুদ্ধর জন্য। পৃথিবীর উন্নত শক্তিধর দেশগুলো তাদের সামরিক গবেষণাগারে শুধু উন্নত ধরনের বোমা বন্দুক তৈরির জন্যই গবেষণা করে না, যুদ্ধর অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার জন্য বিভিন্ন ভয়ঙ্কর জীবাণু আর প্রাণীদের নিয়েও গবেষণা করে… হেরম্যান বললেন, ‘এ ব্যাপারটা আমি শুনেছি।’
লোকটা বলল, “আপনাদের সামনে পড়ে থাকা প্রাণীটার ব্যাপারও একই। রেসাস বানরদের বেশ কয়েকটা প্রজাতি স্বভাবগত ভাবে খুনে প্রকৃতির হয়। খেলার ছলে নিজেদের সঙ্গীদেরও খুন করতে ওস্তাদ তারা। রক্তপানেও আসক্ত তারা। তাই এই রেসাস বানরকেই জেনিটিক মিউটেশানের মাধ্যমে আরও হিংস্র করে তোলা হচ্ছিল, করে তোলা হচ্ছিল রক্তপেয়ী। ধরুন শত্রুদেশের এমন কোনো জায়গা যেখানে বোমা ফেলা বা সেনা পাঠানো অসুবিধাজনক তখন সেখানে গিয়ে ছেড়ে আসা হল একদল এই বানরকে। ব্যাপারটা কি বলতে চাচ্ছি তা নিশ্চই বুঝতে পারছেন? ‘
ব্যাপারটা কল্পনা করে শিউরে উঠল সুদীপ্ত। সত্যিই পৃথিবীতে মানুষ মানুষকে হত্যা করার জন্য কী নির্মম খেলা শুরু করেছে!
হেরম্যান গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘কিন্তু এ দেশে প্রাণী এলো কেন? এটা কি আপনাদের শত্রু দেশ?’
সিক্রেট সার্ভিসের লোকটা জবাব দিলেন, “শত্রু দেশ নয়, বরং বন্ধু দেশ। সে জন্যই এ দেশের মেঘপাহাড়ে প্রাণীটাকে আমাদের দেশ থেকে উড়িয়ে আনা হয়েছিল তাকে নিয়ে আরও গবেষণা করার জন্য ওই আকাশ যানে। ওর আকৃতি ইউ.এফ.ও-র মতো করা হয়েছিল এ কারণে যে, যদি কোনো কারণে কেউ প্রাণীটাকে দেখে তাহলে সে যেন ভাবে প্রাণীটা মহাকাশের জীব। কারণ মহাকাশ যান নামতে দেখা গেছে এখানে। যাই হোক এখানে প্রাণীটাকে আনার পর কোনো অসতর্কতাবশক মুক্ত হয়ে গেছিল প্রাণীটা। সে প্রথমেই খুন করল যারা তাকে এখানে এনেছিল তাদের দুজনকে। ওদের কঙ্কাল পড়ে থাকতে দেখেছেন আপনারা। লোকদুটো খুন হয়ে যাবার ফলে দেশে বসে আমরা তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না, কী হয়েছে তাদের বুঝতেও পারছিলাম না। তারপর একদিন সংবাদ মাধ্যমে খবর বেরোল এ গ্রামে রক্তচোষা চুপাকাবরার হানা দেবার সংবাদ, কোস্টারিকার রক্তচোষার সংবাদ। তার হত্যার ধরন দেখে আমরা বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা কী ঘটেছে। আমাকে এ দেশে পাঠানো হল প্রাণীটাকে মেরে অথবা ধরে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। গঞ্জালোও সম্ভবত খবরের কাগজের সংবাদটা পেয়েই এখানে এসেছিল। এক দেশ অন্য দেশের ওপর নজর রাখে। সম্ভবত তার দেশের বৈজ্ঞানিকরাও প্রাণীটার ব্যাপারে অনুমান করতে পেরেছিলেন। প্রাণীটাকে তাদের দেশের সামরিক গবেষণাগারে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করার ইচ্ছা ছিল….
এরপর একটু থেমে তিনি বললেন, “প্রাণীটার গলায় যেটা পরানো আছে সেটা রেডিওকলার। আমার কাছে ছোট যে যন্ত্রটা দেখেছিল ওটা একটা ট্রান্সমিটার। ওর মাধ্যমেই এ প্রাণীটার অবস্থান মোটামুটি বোঝা যায়। এর সাহায্যেই প্রাণীটাকে অনুসরণ করে মারার চেষ্টা করছিলাম। ঘটনাচক্রে গঞ্জালো একইরকম একটা যন্ত্র কুড়িয়ে পায় ও প্রাণীটার গতিবিধি জেনে যায়। তবে আমি কিন্তু গঞ্জালোকে প্রথমে সন্দেহ করিনি, তাকে ইউ.এফ.ও- -ম্যানিয়াকই ভেবে ছিলাম । ও রকম খ্যাপাটে লোক আমাদের দেশেও আছে। বরং আমার সন্দেহটা কিছুটা হলেও আপনাদের ওপর হয়েছিল। কারণ আপনারা সরাসরি খোঁজ চালাচ্ছিলেন প্রাণীটার । যে কারণে পাদ্রীর হত্যাকাণ্ডটা নেকড়ের আক্রমণ বলে প্রাণীটাকে খোঁজার ব্যাপারে নিরস্ত করতে চাচ্ছিলাম আপনাদের। কিন্তু উইলিয়ামের বাহারের ঘটনার পর সেটা আর নেকড়ের ব্যাপার বলে চালানো গেল না। আপনারা পাহাড়ে উঠে এলেন।
উইলিয়ামের খামারে গাছের গায়ে রিভলবারের বুলেটটা আমি দেখেছিলাম। তার সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম আমি। খুব দ্রুত স্থান পরিবর্তন করছিল প্রাণীটা। দ্রুত লাফিয়ে চলে যাচ্ছিল গ্রামের এদিক ওদিক। তার পিছু পিছু ঘুরতে ঘুরতে আড়াল থেকে আমি গঞ্জালোকেও সে রাতে ঘুরতে দেখি। গাছের রিভলবারের বুলেটটা দেখে প্রথমে একটা মৃদু সন্দেহ তৈরি হয় তার ওপর। তবে আমার সব ধারণা স্পষ্ট হয়ে যায় পরশু সন্ধ্যায়। আপনার! তাবুতে ফিরে আসার পর চারপাশের মেঘ আর অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে আমি আড়ি পেতেছিলাম গঞ্জালোর তাঁবুতে। তার তাঁবুতে থাকা যন্ত্রটা আসলে একটা রেডিও সিস্টেম যার মাধ্যমে সে নিজের দেশে যারা তাকে পাঠিয়েছিল তাদের সাথে যোগাযোগ করছিল। গঞ্জালোর বিজাতীয় ভাষায় বলা সব কথা বুঝতে না পারলেও তারই মাঝে ইংরাজিতে বলা কিছু কথায় তার পরিচয় আর উদ্দেশ্য বুঝতে পারি। তবে প্রাণীটাকে ধরার জন্য ও যে আপনাদেরও খুন করতে চাইবে এতটা আমার ধারণা ছিল না। সিক্রেট সার্ভিসের লোকদের নানা ধরনের ট্রেনিং থাকে। শেষ পর্যন্ত এই আকাশ যানেই পালিয়ে যেতে চেয়েছিল লোকটা। তবে আমাদের মতো তারও ধারণা ছিল না যে মৃত্যুদূত পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিল তার নিজের পরিচিত এই এরোপ্লেনে । এটা করেই তো প্রাণীটা এখানে এসে নেমেছিল। ভয় পেয়ে পোষা প্রাণীরা নিজের খাঁচাতেই সবচেয়ে নিরাপদ মনে করে।’—দীর্ঘক্ষণ কথা বলে আসলেন বাজ ।
হেরম্যান আর সুদীপ্ত নিশ্চুপ ভাবে তাকিয়ে রইল মৃত প্রাণীটার দিকে ।
লোকটা আবার তার হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আর কোনো দিন আপনাদের সাথে দেখা হবে না আমার। হাতে আমার আর সময় নেই। এবার আমাকে মৃত প্রাণীটাকে নিয়ে ফিরে যেতে হবে। গুডবাই ।
সুদীপ্ত আর হেরম্যান লোকটার দিকে তাকিয়ে অতি কষ্টে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘গুডবাই ।’
লোকটা এবার প্রাণীটাকে মাটি থেকে তুলে নিয়ে এগোল তার যানটার দিকে। আর সুদীপ্তরাও রওনা হল ফেরার জন্য। অস্পষ্ট চাঁদের আলোতে মেঘ অরণ্যে হাঁটতে লাগল তারা । কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা শব্দ শুনতে পেল তারা। আলোকিত হয়ে উঠল পাহাড়ের একটা নির্দিষ্ট জায়গা। আর সেখান থেকে বিদ্যুৎ গতিতে আকাশের দিকে উড়ে গেল সেই আকাশ যান। কোস্টারিকার রক্তচোষাকে নিয়ে সে হারিয়ে গেল কোন অজানা দেশের উদ্দেশ্যে। চলতে চলতে সুদীপ্ত এক সময় বলল, ‘মানুষই তো মানুষ খুন করতে শেখাচ্ছে প্রাণীদের! এই বীভৎস খেলার শেষ কোথায় ?”
হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘মানুষ যদি এসব করা বন্ধ করে তবে গঞ্জালোর কথাই হয়তো একদিন সত্যি হবে। ওদের হাতেই মৃত্যু লেখা আছে আমাদের। বিষণ্ণ ভাবে পথ চলতে লাগল তারা দুজন ।
সূর্যোদয় যখন হল তখন অনেকটা নিচে পৌঁছে গেছে তারা। ধীরে ধীরে প্রভাতী সূর্যকিরণ ছড়িয়ে পড়ছে ছবির মতো সুন্দর গ্রামটার মাথায়। সেদিকে তাকিয়ে সব বিষণ্ণতা ধীরে কেটে যেতে লাগল। সেই বাজের মুখ থেকে তারা যা শুনেছে সবই যেন গল্পকথা। এক সময় সুদীপ্ত বলে উঠল, ‘দেখছেন কী সুন্দর ভোর হচ্ছে !
হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘হঠাৎ খুব সুন্দর সকাল। ওই প্রাণীটার মতো কোনো প্রাণী নয়, এমন সুন্দর সকাল যেন চিরদিন জেগে থাকে পৃথিবীর বুকে। মানুষের মনে সেই আশা নিয়েই পথ চলব আমরা ।