সিপাহী বিদ্রোহের পরবর্তীকালের ভয়াবহ অবস্থা
এ সম্পর্কে সাংবাদিক ও সাহিত্যিক মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ লিখেছেন, “….ভারতবর্ষের প্রথম মুক্তি-সংগ্রাম এইরূপে শোচনীয় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইল বটে, কিন্তু উহার জের চলিল একটানাভাবে আরও প্রায় এক যুগ। বিদ্রোহ সম্পূর্ণভাবে প্রশমিত হওয়ার পূর্বেই ১৮৫৮ সালের ১লা নভেম্বর ইংল্যাণ্ডের মহারাণী ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন। বড়লাট ক্যানিং উক্ত দিবস এলাহবাদে এক দরবারের অনুষ্ঠান করিয়া মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ঘোষণা পাঠ এবং ভারতবর্ষের প্রথম ভাইসরয় হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। …..মহারাণী ভিক্টোরিয়ার প্রতিশ্রুতির উপর নির্ভর করিয়া যেই অর্ধ লক্ষাধিক নর-নারী মধ্য ভারত ও নেপালের জঙ্গল হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া বৃটিশের নিকট আত্মসমর্পণ করে বিদ্রোহোত্তরকালে প্রথম আঘাত পড়িয়াছিল তাহাদেরই উপর। বিদ্রোহ, ইংরেজ হত্যা, ট্রেজারি ও অস্ত্রাগার লুণ্ঠন প্রভৃতি অভিযোগে ইহারা অভিযুক্ত হয়। কত জনের যে ফাঁসি হইল কত হাজার হাজার লোকের প্রতি যে স্বল্পমেয়াদী কারাবাসের আদেশ হইল তাহার হিসেব এক্ষণে পাওয়া দুষ্কর। যাবজ্জীবন দীপান্তরবাসে যাঁহারা দণ্ডিত হইয়াছিল, শুধু তাঁহাদেরই সংখ্যা ছিল দশ হাজারের ঊর্ধ্বে। ……বিদ্রোহে উস্কানি, ইংরেজ নর-নারী হত্যায় প্ররোচনা, পলাতকদের আশ্রয় এবং আর্থিক সাহায্য দান, বিদ্রোহীদের গতিবিধি সংক্রান্ত তথ্যাদি ও সংবাদ গোপন প্রভৃতি নানা কাল্পনিক অভিযোগে হাজার হাজার মুসলমান তাহাদের জোত-জমি, তালুকদারী, জমিদারী, নগদ টাকা-পয়সা বৃটিশের হাতে তুলিয়া দিতে বাধ্য হয়। সদাশয় সরকার ইহার সমস্ত নিজেরা হজম না করিয়া কিছু কিছু হিন্দুরে মধ্যেও বিলি-বন্টন করিয়া দিয়া নুতন আর একটি রাজভক্তের দল সৃষ্টির প্রয়াস পান।” (আমাদের মুক্তি সংগ্রামঃ পূঃ ১২৪-১২৭ : বাংলা একাডেমী ঢাকা ১৯৭৮)
এ সম্পর্কে পশিচম বঙ্গের প্রখ্যাত গবেষক কাজী আবদুল ওদুদ-এর বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে যে, “ওহাবীদের দমন করতে ইংরেজ গভর্ণমেন্টের লোকবল ও অর্থবল দুইয়েরই অপচয় হয়েছিল। পরিশেষে ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে বহু ওহাবীকে নির্বাসনে পাঠিয়ে শাসকবর্গ কিঞ্চিৎ স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। সিপাহী বিদ্রোহ দমন ও ওহাবী বিদ্রোহ দমন এই দুইয়ের প্রভাবে মুসলমান সম্প্রদায় অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়লো, অথবা তাদের দুর্বলতা অত্যন্ত প্রকট হলো এবং শাসকবর্গের কৃপাভিক্ষা ভিন্ন তাদের গত্যন্তর রইল না। বিফল বিদ্রোহের এমন বিনতি স্বাভাবিক সন্দেহ নেই, কিন্তু বড় করুণ। এই দুর্দিনে তাদের চললো ধর্ম সম্বন্ধে নূতন চিন্তা। ভারতবর্ষ প্রকৃত প্রস্তাবে অমুসলমান রাজ্য “দারুল হরব” নয়, কেননা মুসলমানের দৈনন্দিন ধর্মকর্মে এদেশের শাসকবর্গ বাধা দেয় না— এই মতের প্রসার লাভের দিন এলো” (শাশ্বত বঙ্গ (২য় সং) ব্র্যাক প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮৩)।
এরকম এক বিরাজমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রখ্যাত গবেষক ও অধ্যাপক ডক্টর আনিসুজ্জামানের মন্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর পরিচ্ছন্ন বক্তব্য হচ্ছে, “সিপাহী অভ্যুত্থানের সমস্ত দায়িত্বটাই কিন্তু ভারতীয় মুসলমানদের ঘাড়ে এসে পড়েছিল। দেশে ও বিলেতে শাসক মহলে এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যে, মুঘল শাসনের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে মুসলমানেরা এই বিদ্রোহ ঘটিয়েছিলেন। শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মোটা অংশটাই তাদের ভাগ্যে জুটেছিল।” (মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্যঃ ১৯৬৪: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।
এ ধরনের এক প্রেক্ষিতে স্যার সৈয়দ আহমদের কর্মময় জীবনের বিশ্লেষণ করা বাঞ্ছনীয় বলে মনে হয়। ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে উর্দু ভাষায় রচিত “রাজভক্ত ভারতীয় মুসলমান” শীর্ষক পুস্তকে সৈয়দ আহমদ সরাসরিভাবে লিখলেন যে, “বিদ্রোহের সময়ে মুসলমানেরাই সব চাইতে রাজভক্তির পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু পত্র-পত্রিকায় যেভাবে গোটা মুসলমান জাতটাকেই এই ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণকারী বলে চিত্রিত করা হচ্ছে, সেটা খুবই শোচনীয়।”
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ইংরেজদের সমর্থনে মুসলিম মধ্যবিত্ত এবং শিক্ষিত সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে স্যার সৈয়দের সার্বিক প্রচেষ্টা ছিলো মুসলমানদের প্রতি ইংরেজ সরকারের গৃহীত নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন করানো। এজন্যই তাঁকে উপমহাদেশে সংঘটিত দুই-দুটো সুদূরপ্রসারী ঘটনা যথাক্রমে সিপাহী বিপ্লব এবং ওহাবী আন্দোলন-এর প্রতিক্রিয়ার হাত থেকে রক্ষা করা।
ডঃ আনিসুজ্জামান এ সম্পর্কে আরও মন্তব্য করেছেন যে, “ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি ইংরেজ শাসকদের ক্রোধ প্রশমিত করার পর স্যার সৈয়দ আহমদ এবারে স্ব-সম্প্রদায়ের মধ্যে সংস্কার আন্দোলনের সূচনা করলেন। তাই আন্দোলনের মূল কথা হচ্ছে শাসকশ্রেণীর সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতার মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোক লাভ করা এবং দেশের শাসন ব্যবস্থার অধিকার লাভ করা। “
অতঃপর সংক্ষেপেস্যার সৈয়দ আহমদ-এর কর্মজীবন নিম্নরূপ :
১৮৬২: ‘বাইবেল সম্পর্কিত টীকা’ প্রকাশ।
১৮৬৪: গাজীপুরে অনুবাদ সমিতি গঠন
১৮৬৯: বিলেত গমন।
১৮৬৯-৭১ : লণ্ডনে অবস্থানকালে হজরত মুহম্মদ (দঃ)-এর জীবনী এবং এতদসম্পর্কিত ২টি পুস্তক রচনা।
১৮৭৩ : আলীগড়ে মুসলিম অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজের সূচনা।
১৮৭৬: সরকারী চাকরি থেকে অবসর। ১৮৭৮-৮২: ভাইসরয় কাউন্সিল-এর সদস্য। ১৮৯৮: ইন্তেকাল।
রামমোহন এবং সৈয়দ আহমদের তুলনামূলক বিচার
স্যার সৈয়দ আহমদ সম্পর্কে আলোচনার সমাপ্তিতে ডঃ আনিসুজ্জামানের মন্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে নিঃসন্দেহে তা সমর্থনযোগ্য বলা যায়। ডঃ আনিস লিখেছেন, “রামমোহনও তাঁর (সৈয়দ) মতোই ভারতীয় জনসাধারণকে রাজভক্ত বলে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি যেমন সিপাহী বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিলেন, রামমোহন তেমনি নীলকরদের স্বপক্ষে দাঁড়িয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রশমন করতে চেয়েছিলেন। রামমোহনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সৈয়দও বিলেতে গিয়েছিলেন (১৮৬৯) এবং ফিরে এসে ‘মহামেডান সোশ্যাল রিফরমার’ নামে একটি পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ‘দি ব্রাহ্মণিক্যাল ম্যাগাজিন’-এর সম্পাদক দেশীয়দের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের যে চেষ্টা করেন, তার ফলে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় (১৮১৬)। আর স্যার সৈয়দের চেষ্টায় ১৮৭৩-এ আলীগড়ে মুসলিম অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজের সূচনা হয়।”
এখানে একটা কথা উল্লেখ করতে হয় যে, স্যার সৈয়দ আহমদ সুদীর্ঘ ৯ বছর ধরে তাঁর প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার মাধ্যমে ভারতীয় মুসলমানদের ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। ফলে রক্ষণশীল মুসলিম ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ সৈয়দের কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করেন। এমনকি তাঁকে ধর্মত্যাগী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু সৈয়দ আহমদ এতে বিচলিত না হয়ে স্বীয় আদর্শের প্রচার অব্যাহত রাখেন।
আগেই উল্লেখ করেছি যে, এই একই সময়ে বংগীয় এলাকায় বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক ও নয়া চিন্তাধারার সূত্রপাত হয় এবং ১৮৭০ সালে কোলকাতায় ‘মহামেডান লিটারেরী সোসাইটির’ প্রকাশ্য অধিবেশনে এর বহিঃপ্রকাশ হয়। এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন যথাক্রমে নবাব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী ও জৌনপুরের মওলানা কেরামত আলী প্রমুখ।
এজন্য একতরফাভাবে তৎকালীন বাঙালি মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক বলে কোনক্রমেই চিহ্নিত করা সমীচীন হবে না। এর সমর্থনে পশ্চিম বাংলার প্রখ্যাত সাংবাদিক ও গবষেক বিনয় ঘোষের মন্তব্যের উদ্ধৃতি দেয়া বুদ্ধিমত্তার পরিচয় হবে। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি শিক্ষিত সমাজ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, “প্রথম ও প্রধান ট্র্যাজেডি হল, বাংলার এই বিদ্বৎসমাজ (কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী) প্রায় সম্পূর্ণ ‘মুসলমানবর্জিত’ রূপ ধারণ করল এবং সেই জন্য একে সাধারণভাবে ‘বাঙালি বিদ্বৎসমাজ’ না বলে বিশেষ অর্থে ‘বাঙালি হিন্দু বিদ্বৎসমাজ’ বলাই যুক্তিসঙ্গত। আমরা যখন নব্যবঙ্গের বা নবযুগের বাংলার ইতিহাস আলোচনা করি তখন কতকটা সচেতনভাবেই বাঙালি মুসলমান সমাজের এই প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যাই।’ (বাংলার বিদ্বৎসমাজ (২য় সং) প্রকাশ ভবন কলিকাতাঃ ১৯৭৮)।
এক্ষণে তুলনামূলক আলোচনার সুবিধার জন্য ‘কোলকাতা কেন্দ্রিক সুবর্ণ শ্রেণী এবং সম্ভ্রান্ত মহাশয়দের কিঞ্চিৎ পূর্ব ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হবে তা সত্ত্বেও অত্যন্ত সংক্ষিপ্তাকারে উপস্থাপনা বাঞ্ছনীয় মনে করছি। পুরানো দলিলদস্তাবেজ থেকে একথা বলা যায় যে, সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে প্রথমে পর্তুগীজ এবং এরপর ওলন্দাজ ও আর্মেনিয়ানদের বসতি স্থাপিত হয়েছিলো। এই কোলকাতা (সুতানুটি) অঞ্চলে। সবশেষে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর জব চার্ণকের
নেতৃত্বে ইংরেজদের কোলকাতা আগমনের বছর হচ্ছে ১৬৯০ খ্রীষ্টাব্দ। এখানেই পারস্পরিক স্বার্থে ইংরেজদের সংগে অর্থবহ কারণে বাঙালি শেঠ, বসাক, শীল, সিংহ, ঘোষ, দত্ত, মিত্ৰ, সেন, বন্দোপাধ্যায় ও ঠাকুর প্রভৃতি পরিবারের যোগসূত্র স্থাপিত হয় এবং অচিরেই সঞ্চিত অর্থের দাপটে এসব পরিবার সম্ভ্রান্তের মর্যাদা লাভ করে। ঢাকা ও মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে বনেদী হিন্দুরা নবাবদের অধীনে প্রভাবশালী অবস্থায় লালিত-পালিত হওয়া সত্ত্বেও প্রায় একই সময়ে কোলকাতার আলোচ্য পরিবারগুলো কার্যতঃ শ্বেত বণিকদের ‘বিকল্প প্রভু’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান এবং তাদের প্রতি সক্রিয়ভাবে সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারণ করে। ফলে ইংরেজদের এজেন্ট, বেনিয়ান ও মুৎসুদ্দি হিসেবে নানা ধরনের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের মাঝ দিয়ে কোলকাতার এসব বাঙালি হিন্দু পরিবার থেকেই সুবর্ণ শ্রেণীর অভ্যুদয় ঘটে।
বঙ্কিমের দৃষ্টিতে মুর্শিদ কুলী খাঁ ‘মহাপাপিষ্ঠ’
প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক বংকিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-৯৪ খ্রীঃ) তাঁর রচিত সর্বশেষ সীতারাম (১৮৮৭ খ্রীঃ) উপন্যাসে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বাংলার নবাব মুর্শিদ কুলী খার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দুদের ‘নবাগত’ বিকল্প ‘প্রভু’ ইংরেজদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের সামগ্রিক বিষয়টি যুক্তিযুক্ত ও যথার্থ বলে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে পরোক্ষভাবে প্রচেষ্টা করেছেন। বাস্তবে এসব কর্মকাণ্ড ছিলো বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর মাত্র। বঙ্কিম বাবুর ‘সীতারাম’ উপন্যাসের কাহিনীকাল হচ্ছে নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁর (১৭১০-১৭১৭ খ্রীঃ পর্যন্ত দেওয়ানী এবং ১৭১৭-১৭২৭ খ্রীঃ পর্যন্ত নবাবী) আমল। উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম পরিচ্ছেদেই বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের পরিষ্কার ভাষায় মন্তব্য হচ্ছে, “আবার এই সময়ে, মহাপাপিষ্ট, মনুষ্যধাম মুর্শিদ কুলী খাঁ মুর্শিদাবাদের মসনদে আরূঢ়. থাকায়, সুবে বাংলার আর সকল প্রদেশে হিন্দুর উপর অতিশয় অত্যাচার হইতে লাগিল— বোধ হয়, ইতিহাসে তেমন অত্যাচার আর কোথাও লিখে না।”
অথচ বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ কালীপ্রসন্ন বন্দোপাধ্যায় মহাশয় তাঁর রচিত ‘বাংলার ইতিহাস (নবাবী আমল)’ গ্রন্থে মুর্শিদ কুলী খাঁ সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছেন তা সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এবং বিশেষভাবে লক্ষণীয়। “মুর্শিদ কুলী খাঁ কর্মনিষ্ঠ ও আলস্য বিরহিত ছিলেন। রজনীতে অল্পকাল মাত্র নিদ্রায় অতিবাহিত করিতেন।…… সুরা বা অন্য কোন প্রকার মাদকদ্রব্য তিনি কোনকালেই ব্যবহার করেন নাই। নর্তকীর নৃত্যগীত শ্রবণ করিতেন না। স্বীয় একমাত্র পত্নীতে চিরদিন অনুরক্ত ছিলেন।….. তাঁহার হস্তাক্ষর অতি সুন্দর ও লিখন ক্ষমতাও যথেষ্ট ছিল। অঙ্কশাস্ত্রে সম্পূর্ণ দক্ষতা থাকায় সর্বপ্রকার হিসাব-নিকাশ শীঘ্র প্রণিধান করিতেন। হিসাবে তাঁহাকে প্রতারিত করে, কাহারও এরূপ সাধ্য ছিল না। সমস্ত নিকাশী কাগজ ও হুকুম স্বয়ং লাল কালিতে করিতেন। মাসের শেষ দিবসে সকল সেরেস্তার মাসকাবারের কাগজপত্র স্বয়ং পর্যবেক্ষণ করিতেন।……… মুর্শিদ কুলী খাঁ যুদ্ধে বীর, পরোপকারে মুক্তহস্ত, দানে হাতেম ও বিচারে নসেরুয়ার সাদৃশ্য ছিলেন।” (বাংলার ইতিহাস— নবাবী আমলঃ কালী প্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়)।
তাহলে একথা বলাটা নেহায়েৎ অন্যায় হবে না যে, কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দুদের সুবর্ণ শ্রেণীর অভ্যুদয় হয়েছিলো মুর্শিদাবাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা এবং শ্রেণীস্বার্থে ইংরেজদের লেজুড় হিসেবে পরবর্তীকালে নানা আদর্শের কথা উচ্চারণ করে, কিংবা বাঙালিত্ব ও জাতীয়তাবাদ এবং প্রগতি ও আধুনিকতার বুলি কচলিয়ে যত কথাই বলা হোক না কেনো, প্রকৃত ইতিহাস এখন আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
এদিকে কোলকাতায় বাঙালি হিন্দু সমাজে সুবর্ণ শ্রেণী গঠন পূর্ণতা লাভের পরবর্তীকালে এদেরই অনেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ নিলামে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারী ক্রয়ের মাধ্যমে ‘কর্ণওয়ালিশ-মার্কা’ নব্য জমিদার শ্রেণীতে পরিণত হয়। এখানেই শেষ নয়। অনেকের মতে এই উপমহাদেশে ইংরেজদের এদেশীয় দালাল ও সমর্থক হিসেবে যথাযথ ভূমিকা পালন এবং স্বীয় শ্রেণীর বুনিয়াদ সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে এঁরাই আবার এই ভূখণ্ডে সর্বপ্রথম ইংরেজী ভাষা শেখা ছাড়াও রেনেসাঁর শ্লোগানের আড়ালে ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে রপ্ত করে। ঐতিহাসিকরা কোলকাতার এই সমাজকেই “বাবুসমাজ” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আসলে এঁরাই হচ্ছেন কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী। বিশিষ্ট মার্কসিষ্ট গবেষক বিনয় ঘোষের ভাষায় বলতে হলে, “বিত্তের সঙ্গে বিদ্যারও মণিকাঞ্চন যোগ হল।…… কলকাতা শহরের নতুন মধ্যবিত্ত সমাজের উচ্চ শ্রেণীর লোকেরা— দেওয়ান- মুন্সী- বেনিয়ান- মুৎসুদ্দি – ব্যবসায়ীদের পরিবার নিয়ে গঠিত নুতন শহুরে উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এই সমাজই তখন কলকাতা শহরে ‘বাবু সমাজ’ বলে পরিচিত ছিলেন।….. মুৎসুদ্দিগিরি বেনিয়ানি করে প্রচুর বিত্তসঞ্চয় করেছিলেন কারা? কারা সঞ্চিত অর্থ নিয়োগ করে জমিদারী কিনে নতুন জমিদার হয়েছিলেন? গ্রাম ও শহরের নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণী কাদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল? কারা নতুন পাশ্চাত্যবিদ্যা শিক্ষা করে আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণী হয়ে সেকালের ভাষায়, ‘রুলার্স এ্যাণ্ড রুল্ড’-এর (শাসক এবং শাসিতের) মধ্যে ইন্টারপ্রিটার্স (মাধ্যম) হয়েছিলেন? অধিকাংশই হিন্দু এবং হিন্দুদের মধ্যে অধিকাংশই ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ প্রভৃতি উচ্চ বর্ণভুক্ত যারা তাঁদের নিয়েই প্রধানতঃ এই তিনটি শ্রেণী গঠিত হয়েছিল। মুসলমান এবং অনুচ্চবর্ণ বলে হিন্দু সমাজে যারা উপক্ষেণীয়, তাঁদের সংখ্যা এই তিনটি শ্রেণীর মধ্যে খুবই সামান্য। কেন সামান্য? কেন অনুচ্চ বর্ণের লোকেরা অর্থনীতি রাজনীতি শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে নতুন যুগে স্বাধীনভাবে বিচরণের সুযোগ গ্রহণ করেননি? এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে বাংলার, তথা ভারতের, ভুয়ো রেনেসাঁসের মূল কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে এবং বোঝা যাবে কেন বাংলার নবজাগৃতি (রেনেসাঁ) একটি অতিকথা ছাড়া কিছু নয়।” (বাংলার নবজাগৃতিঃ ২য় সং ১৯৭৯: ওরিয়েন্ট লংম্যান, কলিকাতা)।
আগেই উল্লেখ করেছি যে, বংগীয় এলাকায় এ ধরনের এক সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে পলাশীর যুদ্ধের প্রায় ১১৩ বছর পরে ওহাবী আন্দোলনের পরিসমাপ্তিতে ১৮৭০-৭১ সাল নাগাদ বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে নতুন চিন্তাধারার সূত্রপাত হয়। আর পরাশক্তির বিরোধিতা নয়। এক্ষণে মুসলিম মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী গঠনের লক্ষ্যে রাজশক্তির সঙ্গে সহযোগিতা ভিন্ন আর গত্যন্তর নেই। ১১৩ বছর যাবৎ মুসলমানরা প্রায়শঃই একাকি ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, আন্দোলন, অসহযোগিতা, বিদ্রোহ, ধর্মীয় ফতোয়া, যুদ্ধ এমনকি হত্যাকাণ্ড ও বিপ্লব পর্যন্ত সংঘটিত করার পর স্তিমিত হয়ে বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হলো। আগেই উল্লেখ করেছি যে, দিল্লীতে স্যার সৈয়দ আহমদ এবং কোলকাতায় নবাব আবদুল লতিফ ও সৈয়দ আমির আলী প্রমুখ এই নতুন চিন্তাধারার পথ প্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। ১৮৬৮ সালের ৩০শে জানুয়ারী ফরিদপুরের নবাব আবদুল লতিফ কোলকাতায় ‘বেঙ্গল সোশ্যাল সাইন্স এসোসিয়েশনের’ দ্বিতীয় অধিবেশনে ‘বাংলায় মুসলিম শিক্ষা সংক্রান্ত মতামত শীর্ষক নিবন্ধে আক্ষেপের সুরে এ মর্মে মন্তব্য করলেন যে, “বাংলার মুসলমানরা যদি ইংরেজী শিক্ষিত হতেন তাহলে ভারতীয় রাজনীতির ধারা বদলে যেত এবং ভারতে শাসন পদ্ধতি সম্বন্ধেও জনমত সজাগ হত।”
কোলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি জে বি ফেয়ার এই একই অধিবেশনে আবদুল লতিফের (১৮২৮-৯৩ খ্রীঃ) পঠিত নিবন্ধের আলোচনা কালে পরিচ্ছন্ন ভাষায় হুঁশিয়ারি দিয়ে বললেন, “ওয়ারেন হেষ্টিংসের সময় থেকে এদেশে মুসলমান ভদ্র শ্রেণী লোকচক্ষে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছেন! শিক্ষায় ও সামাজিক সম্মানলাভে তাঁরা শিক্ষিত হিন্দু ভদ্র শ্রেণীর অনেক পিছিয়ে পড়ে রয়েছেন। মুসলমান সম্প্রদায়ের এই পশ্চাদগতির রাজনৈতিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। এর ফলে মুসলমানদের মধ্যে বিক্ষোভ দেখা দিতে বাধ্য।”
মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলো নিশ্চিহ্নের পথে
এই প্রেক্ষিতে ১৮৭০-৭১ সাল নাগাদ বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে যখন ইংরেজ রাজশক্তির সংগে সহযোগিতার চিন্তাধারার সূত্রপাত হলো, তখনকার বিরাজমান অবস্থাটা কিঞ্চিৎ পর্যালোচনা করা অপরিহার্য মনে হয়। ১৮৭০-৭১ সালে কোলকাতার প্রখ্যাত ইংরেজ গবেষক হান্টার সাহেব লিখেছেন, “গেলো পঁচাত্তর বছরের মধ্যে বাংলার মুসলমান পরিবারগুলো (সম্ভ্রান্ত) হয় এই ভূখণ্ড থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, না হয় আমাদের শাসনে সৃষ্ট নতুন সমাজ ব্যবস্থার চাপে অতল গহবরে নিমজ্জিত হয়েছে।” (ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার— দি ইণ্ডিয়ান মুসলমান্স : কলিকাতায় পুনর্মুদ্রণ ১৯৪৫: পরিচ্ছেদ ৪, পৃষ্ঠা ১৫৭)
গবেষক বিনয় ঘোষ এই সময়কালের চমৎকার বর্ণনা প্রদান করেছেন। তিনি লিখেছেন, “….অর্থাৎ শোভাবাজার, জোড়াসাঁকো, পাথুরিয়াঘাটা, বাগবাজার, শ্যামবাজার, কলুটোলা প্রভৃতি অঞ্চলে নতুন রাজধানী কলকাতায় যখন ইংরেজ আমলের সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবার প্রতিষ্ঠাতারা ধন-সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখন মুর্শিদাবাদ, হুগলি প্রভৃতি পুরাতন মুসলমান শাসনকেন্দ্রে সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের ক্রমবিলুপ্তি ঘটছিল। বাঙালি দেওয়ান বেনিয়ান মুৎসুদ্দিদের মধ্যে মুসলমানদের নাম একরকম পাওয়াই যায় না বলা চলে। তার প্রধান কারণ বাঙালি মুসলমানদের ইংরেজ বিদ্বেষ সেই সময় অনেক বেশী তীব্র ছিল।…… মুসলমান সমাজ এইসব ক্ষেত্রে, রাজ্যচ্যুতি ও মর্যাদাহানির বিক্ষোভ থেকে, ইংরেজদের সঙ্গে অসহযোগিতা করছেন। শিক্ষা, রাজসম্মান ইত্যাদি কোন ক্ষেত্রেই তাঁরা কোনো সুযোগ গ্রহণ করতে চাননি, বরং তাঁদের অসহযোগ নীতির পূর্ণ সুযোগ ইংরেজরা তাঁদের শাসনস্বার্থে গ্রহণ করেছিলেন। ইংরেজরা সেই সুযোগে, শিক্ষা ও অর্থ উভয় ক্ষেত্রে, সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভে হিন্দু সমাজকে সাহায্য করেছেন এবং সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির বীজ বপন করে ভবিষ্যতের জন্য তাঁদের সিংহাসনটিকে অটল করবার চেষ্টা করেছেন। (বিনয় ঘোষ : বাংলার বিদ্বৎসমাজ ২য় সং ১৯৭৮: প্রকাশ ভবন কলিকাতা)।
১৮৭১ সালটি নানা দিক দিয়ে বাঙালি মুসলমানদের জন্য এক উল্লেখযোগ্য বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকা বাঞ্ছনীয়। এই বছরের ১১ই মার্চ আন্দামান দ্বীপে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগকারী পাঠান ওহাবী কর্মী শের আলী খান কর্তৃক বড়লাট লর্ড মেয়োকে হত্যা এবং ২০শে সেপ্টেম্বর আবদুল্লাহ নামে পাঞ্জাবের অপর এক ওহাবী কর্মীর হাতে কোলকাতায় টাউন হলের সম্মুখে প্রকাশ্য দিবালোকে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জাষ্টিস নর্মাণ নিহত হন। বিচারে উভয়েরই ফাঁসি হয় এবং ঐতিহাসিকদের মতে এই দু’টিই হচ্ছে গোড়া শরীয়তপন্থী ওহাবী আন্দোলনের সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা এবং এখানেই নেতৃত্ববিহীন অবস্থায় এই আন্দোলনের যবনিকাপাত ঘটে। আবার এই ১৮৭১ সালেই মুসলিম সংস্কারপন্থী নেতৃবৃন্দ ইংরেজ শাসনের প্রতি বিরোধিতার পথ পরিহারের আহবান জানান এবং জৌনপুরের মওলানা কেরামত আলী ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষকে ‘দারুল ইসলাম’ হিসেবে যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, এই ১৮৭১ সালেই তা ফতোয়া আকারে ব্যাপকভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়।
অন্যদিকে ১৮৭১ সালের ৭ই আগষ্ট তারিখে জারিকৃত এক নির্দেশনামায় লর্ড মেয়ো সবগুলো প্রাদেশিক সরকারকে শিক্ষা ক্ষেত্রে ভারতীয় মুসলমানদের অবস্থা সম্পর্কে তদন্তের নির্দেশ দেন। এরই ফলে বাংলার তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্ণর ১৮৭২ সালের ১৭ই আগষ্ট পত্র নং-২৯১৮ মারফত এক চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট দাখিল করেন। রিপোর্টে বলা হয় যে, “আমার ভয় হয়, আমরা মুসলমানদের প্রতি শিক্ষার দিক দিয়ে সুবিচার করিনি। আমি বার্ণার্ডের ‘নোট থেকে যেটুকু তথ্য গ্রহণ করতে পেরেছি, তাতে দেখেছি, শিক্ষা বিভাগের ইন্সপেকটিং এজেন্সীতে একজনও মুসলমান কর্মচারী নেই। গভর্ণমেন্ট স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে একজনও মুসলমান আছেন কিনা সন্দেহ। বাংলার সরকারী শিক্ষা বিভাগ হিন্দুদের বিভাগ বললেও ভুল হয় না। উপরের স্তর থেকে নিম্নের স্তর পর্যন্ত সমস্ত চাকরি হিন্দুদের একচেটিয়া দখলে।” (এম আজিজুল হকঃ হিষ্ট্রি এ্যাণ্ড প্রেবালেমস অফ মোসলেম এ্যাডুকেশন ইন বেঙ্গল : কলিকাতা ১৯১০)।
আগেই উল্লেখ করেছি যে, এ ধরনের এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে ১৮৭০-৭১ সাল নাগাদ কোলকাতায় মুসলিম সংস্কারপন্থী নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত দ্রুত বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী গঠনের উদগ্র বাসনায় ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর নিকট আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে দাবী আদায়ের লক্ষ্যে সোচ্চার হলো। এঁরা এই উদ্দেশ্যে সম্ভাব্য সমস্ত পন্থা গ্রহণে কুণ্ঠা বোধ করেননি। সবচেয়ে লক্ষণীয় এই যে, দিল্লী এলাকায় সমসাময়িককালে স্যার সৈয়দ আহমদ-এর নেতৃত্বে প্রায় একই আদর্শের সংস্কারপন্থী ও ইংরেজী শেখার আন্দোলনে স্বীয় সম্প্রদায়ের নিকট থেকে বাধাগ্রস্ত হলেও বংগীয় এলাকায় লতিফ-আমীরের নেতৃত্বের আন্দোলন কিন্তু সে ধরনের বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। অনেকের মতে খ্রীষ্টীয় একাদশ শতাব্দী থেকে বঙ্গীয় এলাকায় যে উদারমনা সুফী দর্শনের ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের সর্বাত্মক বিকাশ ঘটেছিল এবং প্রায় ছ’শ’ বছর ধরে যে সুফী মতবাদ বাঙালি মুসলমানদের হৃদয়ের বিশালতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলো, ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তর দশকে বিরাজমান পরিস্থিতির মোকাবেলায় অত্যন্ত সন্তর্পণে এবং সবার অলক্ষ্যেই সেই মন-মানসিকতার পুনর্জাগরণ ঘটে। এর মোদ্দা কথাটাই হচ্ছে, আর গোড়ামি নয়— পরিস্থিতির মোকাবেলায় সংস্কারপন্থী হওয়াটাই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। এতে ভবিষ্যৎ হবে মঙ্গলদায়ক।
এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার প্রাক্কালে শুধু একটা কথাই বলবো যে, ১৮৭১ থেকে ১৯৭১-এর সময়ের দূরত্ব ঠিক একশ’ বছরের। ১৮৭১-এ যেখানে বংগীয় এলাকায় মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিশ্চিহ্ন প্রায় এবং সমগ্র বাঙালি মুসলমান সমাজ অন্ধকারে নিমজ্জিত, সেখানে পরিস্থিতির মোকাবেলায় সেদিনের সংস্কারপন্থী আন্দোলনের মাধ্যমে নিজের অস্তিত্ব রক্ষাটাই ছিলো সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। এরপর ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে যে, বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে মাত্র ১০০ বছরের ব্যবধানে গাংগেয় বদ্বীপ এলাকায় এরাই অকৃত্তিম বাঙালিত্বের দাবীদার হিসেবে ১৯৭১-এ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র নির্মাণ করেন এবং ‘এদের মাতৃভূমির নাম বাংলাদেশ। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি, লোকাচার— সবকিছুর গার্জিয়ান এঁরাই। জাতি হিসেবে এঁরা বাঙালি এবং এঁদের অধিকাংশই হচ্ছে ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান। আর এজন্যই বাংলাদেশের বাঙালিত্বে স্বাভাবিকভাবেই সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আচার-আচরণের কিছুটা প্রভাব পড়লে আপত্তিটা কোথায়?
ঐতিহাসিক তত্ত্ব ও তথ্যের ভিত্তিতে আগেই উল্লেখ করেছি যে, বিদেশী শাসকগোষ্ঠীর ভয়াবহ দমননীতির ফলে ১৮৭০-৭১ সাল নাগাদ ওহাবী আন্দোলন (চরিত্রগতভাবে প্ৰথমে শিখ-বিরোধী ও পরবর্তীকালে ইংরেজ-বিরোধী) স্তিমিত হয়ে পড়লে বাংলার মুসলমানদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ইতিহাসের এই যুগ সন্ধিক্ষণে বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়কে এক ভয়াবহ দুর্যোগের মাঝ থেকে উদ্ধারকল্পে কোলকাতায় নবাব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী, জৌনপুরের মওলানা কেরামত আলী প্রমুখ নেতার আবির্ভাবে সংস্কারপন্থী কর্মকান্ডের সূচনা হয়। পুনরাবৃত্তি হওয়া সত্ত্বেও আলোচনার সুবিধার জন্য আবারও বলতে হচ্ছে যে সেদিন এঁদের ঘোষিত নীতি ছিলো আর পরাশক্তি ইংরেজদের বিরোধিতা নয়— এক্ষণে বিশেষ করে ইংরেজী শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত বুদিধজীবী শ্রেণী গঠনের লক্ষ্যে রাজশক্তির সংগে সহযোগিতা ভিন্ন আর গত্যন্তর নেই
এধরনের এক প্রেক্ষাপটে কোলকাতার কেন্দ্রিক এই মুসলিম সংস্কারপন্থীদের কর্মকান্ড সম্পর্কে আলোচনার আগে প্রাসংগিক বিধায় আরও কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়।
পলাশী যুদ্ধের পর প্রথম ৫৬ বছর এদেশে খ্রীষ্টধর্ম প্রচার বেআইনী ছিলো
প্রথমেই বলতে হয় যে, উপমহাদেশে ইংরেজ রাজশক্তির ধর্মীয় বিশ্বাস খ্রীষ্টধর্ম এবং খ্রীষ্টান মিশনারীদের প্রচেষ্টায় ইংরেজী শিক্ষার প্রসার ও প্রচারটা কবে থেকে আর কিভাবে শুরু হয়েছিলো। একথা চিন্তা করলে আজকের দিনে বিস্ময়কর মনে হয় যে, উদারমনা মোগল সম্রাট ও মুসলিম নবাবদের শাসনাধীন উপমহাদেশীয় অঞ্চলে খ্রীষ্টান ধর্ম প্রচারের অনুমতি থাকলেও ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে লর্ড ক্লাইভ-এর বিজয়ের পর থেকে প্রথম ৫৬ বছর অর্থাৎ ১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এদেশে ইংরেজ শাসিত এলাকায় খ্রীষ্টধর্ম প্রচার কার্যতঃ বেআইনী ছিলো। এর চাঞ্চল্যকর পূর্ব ইতিহাস থেকে এটুক অনুধাবন করা সম্ভব হবে যে সে আমলে কোলকাতায় কর্মরত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর উচ্চ পদস্থ কর্মচারী এবং ডিরেক্টরবৃন্দের চিন্তাধারা নিজেদের স্বার্থে কতদূর পরিপক্ক ছিলো। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এবং শিক্ষাবিদ অধ্যাপক পারসিভ্যাল স্পীয়ার-এর রচিত এ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া-২ (পেংগুইন বুকস লিঃ লন্ডন : পুনর্মুদ্রণ ১৯৮২: পৃষ্ঠা ১২২-১২৩) গ্রন্থে বর্ণিত তথ্য থেকে দেখা যায় যে, ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দে বৃটেনের কমন্সসভায় ভারতে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাণিজ্যিক সনদ পরবর্তী ২০ বছরের জন্য নবায়ন করার সময় তুমুল বাকবিতন্ডার সৃষ্টি হয়। তখন বৃটেনের ক্ষমতাসীন দল হচ্ছে রক্ষণশীল টোরী পার্টি। মূলতঃ দু’টি প্রশ্নে এই বিতর্ক দেখা দেয়। প্রথমতঃ ভারতের পূর্বাঞ্চলের ইংরেজ শাসিত এলাকায় শুধুমাত্র ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তার একচেটিয়া বাণিজ্য করার অর্থাৎ মনোপলী অব্যাহত রাখার আইনসঙ্গত অধিকার লাভ করবে কি-না। লন্ডন নগরীতে এর মধ্যেই এমন অনেক ক’টা বড় বড় বাণিজ্যিক কোম্পানীর সৃষ্টি হয়েছে, যাদের মূলধন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর চেয়েও অনেক বেশী এবং যাদের সমগ্র বিশ্বব্যাপী শাখা অফিস রয়েছে। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বৃটেনের টোরী দলীয় সদস্যদের উপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ডিরেক্টরদের অকল্পনীয় প্রভাব এবং এই কোম্পানীর সঙ্গে পারস্পরিক সমঝোতার ফল হিসেবে ভারত উপমহাদেশে ইংরেজ রাজত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি হওয়ার প্রেক্ষিতে কমন্সসভার রায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পক্ষে প্রদত্ত হলো। ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী পরবর্তী বিশ বছর পর্যন্ত অর্থাৎ ১৮১৩ সাল পর্যন্ত ভারতে একচেটিয়া বাণিজ্যের আইনসংগত অধিকার লাভ করলো। এজন্যই এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, পুরানো ‘ক্যালকাটা এ্যালমানাক’-এ কোলকাতা ভিত্তিক যে সব ইংরেজ কোম্পানীর নাম পাওয়া যায়, তার সবগুলোই হচ্ছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কমিশন ও অন্যান্য শর্ত ভিত্তিক এজেন্সী হাউস। আসলে এসব প্রতিষ্ঠানের কোন স্বতন্ত্র আন্তর্জাতিক মর্যাদা ছিলো না এবং বিদেশ বাণিজ্যের অধিকারও ছিলো না। ১৭৯৭ সাল নাগাদ কোলকাতায় এ ধরনের প্রায় ১৯টি এবং ১৮১০ সালে ২৭টি এজেন্সী হাউসের নাম পাওয়া যায়।
এসব এজেন্সী হাউস-এর গুটিকয়েক নামের পুনরুল্লেখ করলেই প্রতিষ্ঠানগুলোর চরিত্র অনুধাবন করা যায়। যেমনঃ টড এ্যান্ড মিলার, ক্যাম্বেল এ্যাণ্ড ক্লার্ক, বারবার পামার এ্যাণ্ড কোং, ল্যামবাট রস এ্যান্ড কোং, ফেয়ারলি গিলমোর এ্যান্ড কোং প্রভৃতি। এ সম্পর্কে ইংরেজ গবেষক ক্রোকর্ড-এর মন্তব্য হচ্ছে, “এজেন্সী হাউসগুলোর সাধারণতঃ তিন-চার জন করে অংশীদার থাকতো এবং সকলেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারী। হাউসগুলোর প্রতিষ্ঠার সময় অংশীদারদের নিজেদের কোন মূলধন ছিলো না, কোম্পানীর কর্মচারীদের আমানত থেকে মূলধন সংগ্রহ করা হতো। কোম্পানীর কর্মচারীদের বাৎসরিক সঞ্চয় থেকে আমানত যথেষ্ট পরিমাণ বৃদ্ধি পেত। এ দেশীয় ধনিক বণিকরাও এইসব হাউসে (অর্থ) গচ্চিত রাখতেন। (স্কেস অব কমার্শিয়াল রিসোরসেসঃ লন্ডন ১৮৩৭)।
তাহলে দেখা যায় যে, এই এজেন্সী হাউসগুলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর এজেন্ট হিসেবে মধ্যস্বত্বের বাণিজ্যিক মুনাফা অর্জন করতো। কেননা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পণ্য সংগ্ৰহ করে সরবরাহ করার আসল কাজটি কিন্তু অর্পিত ছিলো এদেশীয় কোম্পানীর উপর। “ এই কোম্পানীগুলোকেই বলা হতো বেনিয়ান। মোদ্দা কথায় বলতে গেলে সে আমলে একচেটিয়া রফতানী ও আমদানীকারক প্রতিষ্ঠান ছিলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। এরপর মধ্যস্বত্ব মুনাফা লাভ করতো কোম্পানীর কর্মচারীদের বেনামিতে সৃষ্ট ইংরেজ এজেন্সী হাউসগুলো। আর সবশেষে হচ্ছে এজেন্সী হাউসগুলোকে অর্ডারের ভিত্তিতে পণ্য সরবরাহক এদেশীয় প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ বেনিয়ান। আশ্চর্যজনকভাবে কোলকাতা কেন্দ্রিক এ সবগুলো বেনিয়ান প্রতিষ্ঠানই ছিলো বাঙালী বর্ণ হিন্দু মালিকানায়। এঁরাই হচ্ছেন কোলকাতার সুবর্ণ শ্রেণী এবং এদেরকেই কেন্দর করে কোলকাতা কেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী যৌবনপ্রাপ্ত হয়। এই প্রেক্ষিতে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দে লন্ডনের কমন্সসভায় রক্ষণশীল টোরী সরকারের উদ্যোগ গ্রহণের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতে তার একচেটিয়া বাণিজ্যিক সনদের নবায়ন লাভ করতে সক্ষম হয় এবং এর মেয়াদ ১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বর্ধিত হয়। ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এবং কোলকাতাস্থ ইংরেজ এজেন্সী হাউসগুলো ছাড়াও কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু বিত্তশালী বেনিয়ানদের বাণিজ্যিক স্বার্থ চমৎকারভাবে রক্ষিত হয়।
কমন্সসভায় আইন পাস করে বঙ্গীয় এলাকায় খ্রীষ্টধর্ম প্রচার বন্ধ হলো
১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকারে সনদ পরবর্তী ২০ বছরের জন্য নবায়নের সময় কমন্স সভায় এর একটি বিশেষ শর্ত নিয়ে সদস্যদের মধ্যে মারাত্মক মতবিরোধের সৃষ্টি হয়। এই বিষয়টি হচ্ছে পূর্ব ভারতে ইংরেজ শাসিত এলাকায় খ্রীষ্টান মিশনারীদের খৃষ্টধর্ম প্রচার করতে দেয়া হবে কি-না। আগেই উল্লেখ করেছি যে, আলোচ্য সনদটি নবায়নের সময় অর্থাৎ ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দ থেকে পরবর্তী আরও ২০ বছরের জন্য খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের অনুমতি দেয়া হয়নি। এক্ষণে কোন প্রেক্ষাপটে এবং কিভাবে কমন্সসভায় এ ধরনের একটা বিস্ময়কর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিলো তা কৌতূহলী পাঠকদের সমীপে উপস্থাপিত করবো। ইংরেজ জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, কয়েক শত বছর ধরে সমগ্র বিশ্বের পাঁচটি মহাদেশের বিশাল ভূখন্ড এবং অগণিত রাজ্য ইংরেজদের করতলগত হলে সর্বত্রই দলে দলে ইংরেজ খ্রীষ্টান পাদ্রীরা খ্রীষ্টধর্ম প্রচারে লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু ১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ইংরেজ শাসিত বংগীয় তথা পূর্ব ভারতীয় এলাকার জন্য কেন এই ব্যতিক্রমধর্মী ব্যবস্থা? কমন্স সভার সমস্ত সদস্য খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও আইন পাসের মাধ্যমে কেন এ ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিলো?
সঠিকভাবে এ প্রশ্নের জবাব দানকালে সত্যভাষণ করতে হলে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বৰ্ণ হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রসংগটা আবারও উত্থাপন করতে হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়া থেকে শুরু করে এঁরা নিজেদের শ্রেণী স্বার্থে এতো নিষ্ঠার সংগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ইংরেজদের প্রতি সক্রিয় সমর্থন অব্যাহত রেখেছিলো তা তুলনাহীন বলা চলে এবং যুগের পর যুগ ধরে কোলকাতা কেন্দ্রিক এই বাঙালি বর্ণ হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণী এদেশে প্রকৃত অর্থেই ইংরেজদের সম্পূরক শক্তিতে পরিণত হয়। সে আমলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ইংরেজদের সংগে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণ হিন্দুদের বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপিত হওয়া ছাড়াও সামাজিকভাবে দহরম মহরম ও মাখামাখিটাও মাত্রাতিরিক্তভাবে অব্যাহত ছিলো। এ সম্পর্কে আলোচনাকালে পশ্চিম বাংলার বিশিষ্ট গবেষক ডক্টর অতুল সুর-এর বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি লিখেছেন, হিন্দুর পালা পার্বণে যেখানে ব্রাহ্মণ, আত্মীয় ও স্বজনবর্গ নিমন্ত্রিত হত, মহারাজ নবকৃষ্ণ দেব সাহেবদের অনুগ্রহ লাভের জন্য তাদের সংগে যোগ করে দিলেন সাহেব-মেমদের। পুজা বাড়ীতে তখন প্রবেশ করল বিদেশী সুরা ও নিষিদ্ধ খানা। সংগে সংগে আরও প্রবেশ করল যবনী নর্তকীর দল। সাহেবদের অনুগ্রহলাভের জন্য আরও পাঁচজন বড়লোক নবকৃষ্ণকে অনুসরণ করল। শহরে এক নতুন অভিজাত সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হল। যে সকল সুযোগ সন্ধানী ও স্বার্থান্ধ বংগসন্তান অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধের বাঙলার ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে গেছেন (ওয়ারেন হেষ্টিংস-এর ব্যক্তিগত ব্যবসায়ের মুৎসুদ্দি কৃষ্ণকান্ত নন্দী) তাঁদের অন্যতম। ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বেঁচে ছিলেন।
বস্তুতঃ কোলকাতায় বসতি স্থাপনের পর সাহেব-মেমরা দু’টো জিনিস রপ্ত করে নিয়েছিল। একটা পালকি চাপা ও আর একটা হুঁকোয় তামাক খাওয়া। আবার কোন কোন সাহেব এদেশে থেকে হিন্দুভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে হিন্দু স্টুয়ার্ড (মেজর জেনারেল চার্লস স্টুয়ার্ড) প্রসিদ্ধ। তিনি প্রত্যহ পদব্রজে গংগাস্নান করতে যেতেন ও ব্রাহ্মন পুরোহিত দিয়ে শালগ্রাম শিলার পুজা করাতেন। তাঁর বাড়ীতে বহু হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি ছিল। (আঠারো শতকের বাঙলা ও বাঙালি : সাহিত্যলোক কোলকাতা-৬ এপ্রিল (১৯৮৫ পৃ-১২৭)।
অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি। বৰ্ণহিন্দু সমাজের সংগে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ইংরেজ সাহেবদের পারস্পরিক স্বার্থে সৃষ্ট হৃদ্যতার আরও চিত্র উপসথাপনার প্রাক্কালে সে আমলের পারিপার্শ্বিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক বিদ্যমান পরিস্থিতিটাও মনে রাখা প্রয়োজন। এটা এমন একটা সময় ছিলো, যখন ইউরোপ থেকে আগত ফরাসী, পর্তুগীজ, দিনেমার, গ্রীক, আর্মেনীয় প্রভৃতি উপনিবেশ ও বাণিজ্যিক শক্তিগুলোও উপমহাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চলের বিভিন্ন শহর ও বন্দরে ঘাঁটি স্থাপন করে বসে রয়েছে। ইংরেজদের সংগে বৈরী ভাবাপন্ন এদেশীয় যে কোন এক বা একাধিক শক্তির সংগে এসব ইউরোপীয় উপনিবেশ ও বাণিজ্যিক শক্তির যোগসাজশ-এর বিষয়টা ইংরেজদের জন্য কিছুতেই শুভ হবে না। দ্বিতীয়তঃ দিল্লীতে মোগল এবং বেরার, অযোধ্যা ও মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি অঞ্চলের ক্ষয়িষ্ণু শাসক শ্রেণী ও নবাবদের ইংরেজদের পক্ষে সম্পূর্ণ বিশ্বাসী মিত্র হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব ছিলো না। বাংলা ও বিহার অঞ্চলের মুসলিম এবং নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুদের সঠিক মনোভাব আঁচ করা তখন খুবই দুরূহ ছিলো। অন্যদিকে ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ গোয়ালিয়ের সিন্ধিয়া, ইন্দোরে হোলকার, নাগপুরে ভোসালা, বরোদাতে গায়কোয়ার এবং খোদ পুনাতে পেশোয়ার নেতৃত্বে মারাঠারা এক বিরাট শক্তিতে পরিণত হতে চলেছে। উপরন্তু দক্ষিণ ভারতের মুসলিম রাজ্যগুলোও তখন পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করতে শুরু করেছে।
এধরনের এক প্রেক্ষাপটে সত্যিকারভাবে বলতে গেলে প্রথমে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু সুবর্ণ শ্রেণী এবং পরবর্তীতে এঁদেরই উত্তরসুরী বাঙালি হিন্দু বিদ্বোৎসমাজ ছিলো ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ইংরেজদের জন্য সবচেয়ে নির্ভরশীল সম্পূরক শক্তি। কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায় যেমন শ্রেণী স্বার্থে এই অবস্থার পূর্ণ ব্যবহার করেছে, ইংরেজরাও তেমনি এই বশংবদ সম্প্রদায়ের কাছ থেকে নিজেদের স্বার্থে মাত্রাতিরিক্ত ফায়দা উঠিয়েছে।
বর্ণ হিন্দু বুর্জোয়াদের সন্তুষ্ট করতে ৫৩ দিন সরকারী ছুটি
এ সময় ইংরেজরা কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণ হিন্দুদের উপর কতদূর সন্তুষ্ট ছিলো, তা একটা মাত্র দৃষ্টান্ত থেকে অনুধাবন করা যাবে। ১৭৮৭ খ্রীষ্টাব্দে (১১৯৪ বংগাব্দ) কোলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ থেকে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর জারিকৃত ৫৩ দিনের সরকারী ছুটির তালিকা ছিলো নিম্নরূপঃ
অক্ষয় তৃতীয়া (১ দিন), নৃসিংহ চতুর্দশী (২ দিন), জ্যৈষ্ঠের একাদশী (২ দিন), স্নান যাত্রা (১ দিন), রথযাত্রা (১ দিন), পূর্ণ যাত্রা (১ দিন), জন্মাষষ্ঠী (২ দিন), শয়ন একাদশী (১ দিন), রাখী পূর্ণিমা (১ দিন), উত্থান একাদশী (২ দিন), অরন্ধন (১ দিন), দুর্গাপূজা (৮ দিন), তিলওয়া সংক্রান্তি (১ দিন), বসন্ত পঞ্চমী (১ দিন), গণেশ পূজা (১ দিন), অনন্ত ব্রত (১ দিন), বুধ নবমী (১ দিন), নবরাত্রি (১ দিন), লক্ষ্মীপূজা (১ দিন), অন্নকুট (১ দিন), কার্তিক পূজা (১ দিন), জগদদ্ধাত্রী পূজা (১ দিন), রাস যাত্রা (১ দিন), অগ্রহায়ণ নবমী (১ দিন), রটন্তী অমাবশ্যা (২ দিন) মৌনী সপ্তমী (১ দিন), ভীমষ্টমী (১ দিন), বাসন্তী পূজা (৪ দিন), শিবরাত্রি (২ দিন), দোলযাত্রা (৫ দিন), বারুনী (১ দিন), চড়ক পূজা (১ দিন) এবং রামনবমী (১ দিন)। এই ৫৩ দিন সরকারী ছুটির তালিকায় বাঙলি মুসলমানদের জন্য কোন ধর্মীয় ছুটির উল্লেখ নেই।
এখানে উল্লেখ্য যে, ১৭৮৬ খ্রীষ্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিশ এদেশে গভর্নর জেনারেল হিসেবে আগমণের পর তাঁরই নির্দেশে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু সুবর্ণ শ্রেণীকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী থেকে এ ধরনের একটা সরকারী ছুটির তালিকা ঘোষণা করা হয়েছিলো। লর্ড কর্নওয়ালিশ ছিলেন আদিতে ইংরেজ ভূস্বামী এবং ইংল্যাণ্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট-এর (১৭৫৯-১৮০৬) নিজস্ব গ্রুপের অন্যতম নেতা। ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে আগমনের পর লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রথমেই রাজস্ব বোর্ড পুনর্গঠিত করেন এবং বেশ কিছুসংখ্যক দুর্নীতিপরায়ণ ইংরেজ অফিসারকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেন। সত্যিকারভাবে বলতে গেলে কর্নওয়ালিশই হচ্ছেন উপমহাদেশে পদ্ধতিগত ভিত্তিতে সিভিল সার্ভিস-এর স্রষ্টা। তিনিই সর্বপ্রথম কোলকাতায় ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ইংরেজ কর্মচারীদের দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করেন। এদের প্রমথ শ্রেণীর চাকরিজীবীদের বাৎসরিক ৫০০ পাউণ্ড রেতনে শুধুমাত্র রাজস্ব আদায় ও প্রশাসন পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট করা হলো। দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মচারীরা (বেনামীতে ব্যবসা করার কারণে) তুলনামূলকভাবে কম বেতনে কোম্পানীর বাণিজ্যিক কার্যাদি সম্পন্নের জন্য নিয়োগ করা হলো। তিনিই ফৌজদারী বিচারের দায়িত্ব গ্রহণ করে ইংরেজ শাসিত এলাকায় ২৩টি জেলা কোর্ট এবং ৪টি আপীল কোর্ট স্থাপন করলেন। উপরন্তু কর্নওয়ালিশ সৈন্য বাহিনীকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে পুনর্গঠিত করলেন।
ইংরেজ স্বার্থে কর্নওয়ালিশ-এর সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে ভূমি রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে একসালা, পাঁচসালা, দশ সালা এবং সবশেষে ১৭৯৩ সাল নাগাদ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন করা। আগেই উল্লেখ করেছি যে, এরই ফলশ্রুতিতে কিভাবে একান্ত অনুগত কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণহিন্দু সুবর্ণ শ্রেণীর নব্য জমিদার শ্রেণীতে গোত্রান্তর হলো এবং ইংরেজরা বিশেষ করে পূর্ব ভারতে শিল্প স্থাপন ও কোলিয়ারী এবং চা শিল্পে কোলকাতার সুবর্ণ শ্রেণীর প্রতিদ্বন্দ্বিতার হাত থেকে রক্ষা পেলো।
এমনি এক অবস্থায় যখন লণ্ডনের কমন্স সভায় ভারতে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর সনদ পরবর্তী ২০ বছরের জন্য নবায়নের প্রশ্নটি তুমুলভাবে বিতর্কিত হচ্ছিলো, তখন লর্ড কর্নওয়ালিশের কাছ থেকে বন্ধু প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট-এর কাছে এ মর্মে অনুরোধ যেয়ে পৌঁছালো যে, ভারতে বিরাজমান নাজুক পরিস্থিতিতে ইংরেজদের পক্ষে এমন কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত হবে না যাতে ইংরেজদের জন্য পরীক্ষিত এবং একান্ত অনুগত কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণ হিন্দুদের স্বার্থহানি ঘটে। এই অনুরোধের কিঞ্চিৎ ব্যাখ্যাদান করে বলা হয় যে, ভারতে ইংরেজ শাসিত এলাকায় খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের অনুমতি দান করলে তা কোলকাতা কেন্দ্রিক ধর্মভীরু বাঙালি বর্ণ হিন্দুদের জন্য নিশ্চিতভাবে মনোকষ্টের কারণ হবে এবং সেমতাবস্থায় আনুগত্যের ক্ষেত্রে শিথিলতার উদ্রেক হবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। এই অবস্থাটা বৃহত্তর স্বার্থে ইংরেজ সাম্রাজ্যের কর্ণধারদের জন্য কাম্য হবে না।
ইংল্যাণ্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলীয় সদস্যরা নিজেদের ধর্মীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে সাম্রাজ্যের স্বার্থকে স্থান দিলেন। কমন্স সভায় ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দে এ মর্মে আইন পাস হলো যে, আপাততঃ ১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে ইংরেজ শাসিত এলাকায় খ্রীষ্টান মিশনারীরা খ্রীষ্টধর্ম প্রচার করতে পারবে না। এটাই হচ্ছে ইতিহাসভিত্তিক বাস্তব তথ্য।
এ জন্যই ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দে খ্রীষ্টান মিশনারী উইলিয়াম কেরী এবং ডাঃ টমাস খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এদেশে আগমণ করলে কোলকাতায় কিংবা ইংরেজ শাসিত এলাকায় তাঁকে বসবাস করতে দেয়া হয়নি। গবেষক ডঃ অসিত বন্দোপাধ্যায়ের মতে, “প্রথমে এঁরা কলকাতাকে প্রচার কেন্দ্ররূপে বেছে নেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীদের প্রতিকূলতার জন্য এঁরা বাধ্য হয়ে কলকাতার অদূরে দিনেমার কেন্দ্র শ্রীরামপুরে মিশন প্রতিষ্ঠিত করেন (১৮০০)। এঁদের সংগে এর পূর্বেই যোগ দিয়েছিলেন অন্যান্য মিশনারী। যথা— ওয়ার্ড, বার্ণডন, মার্শম্যান প্রভৃতি” (বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত (৪র্থ সংঃ) কলিকাতা ১৯৭৮।
ডঃ বন্দোপাধ্যায়-এর এই ভাষ্য আরও ইতিহাসভিত্তিক করতে হলে বলতে হয় যে, ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দেই কমন্সসভায় ২০ বছর মেয়াদী আইন পাসের দরুণই সেদিন ইংরেজ শাসিত এলাকায় খ্রীষ্টধর্ম প্রচারকদের প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। এজন্যই বংগীয় এলাকা সম্পূর্ণভাবে ইংরেজ শাসনাধীন থাকা সত্ত্বেও অবিভক্ত বাংলায় ইংরেজ মিশনারীদের উদ্যোগে সর্বপ্রথম প্রোটেষ্টান্ট মিশন ও গির্জা (১৮০০ খ্রীঃ) স্থাপিত হয়েছিলো দিনেমার কলোনী শ্রীরামপুরে। সেদিন দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে উইলিয়াম কেরী, ডাঃ টমাস, মার্শম্যান, বার্নডন প্রমুখ উদ্যোগী ইংরেজ প্রতিভাবান ব্যক্তিদের দিনেমার শাসিত শ্রীরামপুরে আস্তানা স্থাপন করতে হয়েছিলো। তাঁরা মিশ্চিতভাবে জানতেন যে, ইংরেজ শাসিত এলাকায় খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের জন্য তাঁদের ১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অবশ্য এঁরা শ্রীরামপুরে অবস্থানকালে এতগুলো বছরের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছিলেন। মিশন ও গির্জা স্থাপন ছাড়াও এঁরা এখানে বসেই বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা, বিশেষ করে বাংলা ভাষাকে সম্পূর্ণভাবে রপ্ত করা ছাড়াও বাংলা ভাষায় বাইবেল অনুবাদের কাজ সম্পন্ন করেন।
এরই ফলে উপমহাদেশে নবাগত ইংরেজ কর্মচারীদের বাংলাভাষা শিক্ষা এবং স্থানীয় সংস্কৃতি ও লোকাচার সম্বন্ধে জ্ঞানদানের লক্ষ্যে ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে কোলকাতার লালবাজারের কাছে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপিত করা হলে খ্রীষ্টান মিশনারী উইলিয়াম কেরীকেই এই কলেজ বাংলা, মারাঠি ও সংস্কৃতি ভাষার অধ্যক্ষ নিযুক্ত করা হয়। তবে মূল শর্ত একটাই— ১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ইংরেজ শাসিত এলাকায় খ্রীষ্টধর্ম প্রচার করা যাবে না।
সে আমলের বিরাজমান পরিস্থিতি অনুধাবনের লক্ষ্যে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারের গোড়ার দিকের এই চাঞ্চল্যকর বিষয় দু’টোর উল্লেখ করতে হলো। ১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত উপমহাদেশে সংঘটিত ঘটনাবলীর বিস্তারিত ব্যাখ্যা ইতিপূর্বেই উপস্থাপিত করেছি।
এক্ষণে পরবর্তী পরিচ্ছেদে ১৮৭০-৭১ খ্রীষ্টাব্দ থেকে বংগীয় মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী গঠনের লক্ষ্যে কোলকাতায় অবস্থানকারী আবদুল লতিফ আমীর আলী প্রমুখ আপোষমুখী ও সংস্কারপন্থী মুসলিম নেতৃবৃন্দের কর্মতৎপরতা এবং ইংরেজ রাজশক্তির সঙ্গে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণীর ধাপে ধাপে প্রথমে মান-অভিমান, আবেদন-নিবেদন, দর-কষাকষি ও আন্দোলন এবং শেষ পর্যন্ত, মাত্র ৩৫ বছরের ব্যবধানে সংঘটিত সন্ত্রাসবাদীমূলক কর্মকাণ্ডের বর্ণনা প্রদান যথার্থ হবে বলে মনে হয়।
১৮৭০-৭১ খ্রীষটাব্দের পর থেকে গুটিকয়েক হাতে-গোনা মুসলিম সমাজ সংস্কারকের প্রচেষ্টায় একটা নয়া চৌহদ্দিতে ইংরেজী শিক্ষার মাধ্যমে বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী গঠনের ক্রমবিকাশের সময় একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, প্রতিবেশী কোলকাতা-কেন্দ্ৰিক বাঙালি হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণীর মতো এঁদের ভিত্তি কিন্তু ততটা মজবুত ছিলো না। কারণ হিসেবে শুধু এটুকু বললেই যথেষ্ট যে, ইংরেজ আমলের শুরুতে আমরা যে বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অবস্থান দেখতে পাই, ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, সেটাও কিন্তু নবাবী আমলে যথেষ্ট পরিমাণে রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা লাভে সক্ষম ছিলো। পরবর্তীতে ১৭৫৭ খ্রীষটাব্দ থেকে শুরু করে ১৮৭০-৭১ পর্যন্ত ১১৩ বছরে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণী ইংরেজদের সহযোগিতায় ধাপে ধাপে সুবর্ণ শ্রেণী ও নব্য জমিদার শ্রেণীর সমস্ত সুযোগ-সুবিধা আদায়ের মাঝ দিয়ে তথাকথিত রেনেসাঁ আর ‘বাঙালিত্বের’ ধ্বজা উড়িয়ে নিজেদের উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্বৎসমাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
এরই পাশাপাশি ১৮৭০-৭১ খ্রীষ্টাব্দের পর বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী গঠনের প্রচেষ্টার প্রাক্কালে কিন্তু দু’টো স্তরের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
বাঙালি মুসলমানরা প্রথম থেকেই ইংরেজবিরোধী কর্ম পদ্ধতিতে লিপ্ত থাকায় সুবর্ণ শ্রেণী এবং নব্য জমিদার গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হতে সক্ষম হয়নি। এজন্যই বলা যায় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর আট দশকে যখন ইংরেজী শিক্ষার মাধ্যমে বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হলো, তখন এর ভিত্তিটা পরিপক্ক ছিলো না। এরই ফল হিসেবে মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজ গঠনের গতি ছিলো মন্থর।
এসম্পর্কে মার্ক্সীয় গবেষক বিনয় ঘোষের মন্তব্য বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। তিনি লিখেছেন, “প্রধানত হিন্দু সমাজের উচ্চস্তর থেকে, অর্থাৎ উচ্চ বর্ণে ধনিক ও সচ্ছল মধ্যবিত্তের স্তর থেকে আধুনিক বাঙালি এলিটদের উদ্ভব হয়েছে। এক কথায় ঊনিশ শতকের বাঙালি এলিটকে উচ্চ বর্ণে সঙ্গতিপন্ন হিন্দু মধ্যবিত্ত ‘এলিট’ বলা যায়। তার ফলে এই এলিটগোষ্ঠী অনুপ্রাণিত ধর্ম সংস্কার ও সমাজ সংস্কার আন্দোলন হিন্দু সমাজ কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে।”
রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক ট্রাজেডি
এই প্রেক্ষাপটে বিনয় বাবু বাঙালি মুসলমানদের অবস্থা সম্পর্কে যথার্থই সত্য ভাষণ করেছেন। তাঁর মন্তব্য হচ্ছে, “প্রায় ঊনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে শিক্ষিত মুসলমান এলিট গোষ্ঠীর বিকাশ হয়নি বলা চলে। ব্রিটিশের ক্রমবর্ধমান প্রশাসন যন্ত্রের নিম্ন শ্রেণীর চালক ও কর্মচারী সরবরাহের জন্য যে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধির প্রবর্তন করা হয়েছিল, তা হিন্দুরাই বেশী আয়ত্ত করেছিলেন বলে এই স্তরের চাকরিজীবীদের মধ্যে শিক্ষিত বাঙালি হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল। ধনিক ও মধ্যবিত্তের স্তরে বাঙালি হিন্দুদের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানদের বিচ্ছেদ তো হয়েছিলোই, শিক্ষিত এলিটের স্তরেও হয়েছিল। এই কারণে বাংলাদেশে যে সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক ট্রাজেডি ঘটেছে, তাও ঐতিহাসিক সত্যের খাতিরে অস্বীকার করা যায় না। যদি ঐতিহাসিক সত্য বিকৃত না করে বাংলাদেশ থেকে আধুনিক জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ও ক্রমবিকাশের ইতিবৃত্ত রচনা করতে হয় তাহলে তা মূলত হিন্দু জাতীয়তাবোধের বিকাশ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।” (বাংলার নবজাগৃতি : পৃঃ ১৫৮: ওরিয়েন্ট লংম্যানঃ কলিকাতা ১৯৭৯)।
১৮৭০-৭১ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী গঠনের লক্ষ্যে সত্যিকার অর্থে ইংরেজী ভাষা শিক্ষা ও ইউরোপীয় কালচারকে রপ্ত করার যখন প্রক্রিয়া শুরু হলো, তখনকার বিরাজমান পারিপার্শ্বিক আর্থসামাজিক পরিবেশ অনুধাবন করা অপরিহার্য বলে মনে হয়। এসময় মুসলিম সমাজ সংস্কারক ও সংস্কারপন্থী নেতৃবৃন্দের দায়িত্ব পালন কতদূর দুরূহ ছিলো তা নিম্নের চিত্র থেকে সহজে বোধগম্য হবে।
ইতিপূর্বে বারংবার একটা কথা উল্লেখ করেছি যে, এদেশে ইংরেজদের ১৯০ বছর শাসনামলের ১৫৫ বছরই বৃটিশ ভারতের রাজধানী ছিলো কোলকাতা মহানগরীতে। এই নগরীই ছিলো শক্তির কেন্দ্রবিন্দু এবং এখানেই উপমহাদেশের তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে অগ্রসরমান বাঙালি হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণীর শক্তিশালী দুর্গ। ঊনবিংশ শতাব্দীর সময়কালটা এমন ছিলো, যখন কোলকাতা-কেন্দ্রিক এই বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী রাজশক্তির সম্পূরক হিসেবে যে কেবলমাত্র বঙ্গীয় প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অপর সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করে রেখেছিলো তা-ই নয়, উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর এলাকার অন্যান্য প্রদেশের সকল ধর্ম, বর্ণ ও ভাষাভাষীর জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।
শিক্ষাক্ষেত্রে ভয়াবহ দুরবস্থার চিত্র
১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দে যখন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম স্থাপিত হলো তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী ছিলো মাত্র ২৪৪ জন। ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ এর সংখ্যা প্রায় ২৫ গুণ বেড়ে দাঁড়ালো ৩০00 জন এবং এর প্রায় সবাই হচ্ছেন বাঙালি উচ্চবর্ণের হিন্দু। ১৮৫৮ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বিএ পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো মাত্র ১৩ জন। ২৩ বছরের ব্যবধানে ১৮৮১ সালে গ্রাজুয়েটের সংখ্যা হচ্ছে ১৭১২। এর মধ্যে ১৪৮০ জনের মতো বাঙালি বর্ণহিন্দু। বাকীদের মধ্যে বিহারী, আসামী, ওড়িয়া এবং বাঙালি মুসলমান। ১৮৮১ সাল নাগাদ উপমহাদেশের সমস্ত প্রদেশের একত্রিত হিসাবে এম এ পাস মোট শিক্ষিত লোক ছিলো ৪২৩ জন। এর মধ্যে ৩৪০ জনের মতো বাঙালি হিন্দু।
প্রাসঙ্গিক বিধায় ইংরেজ পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট কোলকাতা-কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণহিন্দুদের শিক্ষার দাপটের পাশাপাশি বিহার, উড়িষ্যার ও আসামের সমসাময়িককালীন বিরাজমান পরিস্থিতি উপস্থাপনা সমীচীন হবে মনে হয়। যেখানে ১৮৯৮ সালে শুধুমাত্র কোলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজের ছাত্রসংখ্যা ছিলো ৫৬১ জন; সেখানে সমগ্র বিহার এলাকার সবগুলো কলেজের মোট ছাত্রসংখ্যা ছিলো মাত্র ২০৫ জন।
উড়িষ্যার অবস্থা আরও শোচনীয়। এক খতিয়ানে দেখা যায় যে, ১৯০৫ সালে কটকের বিখ্যাত রাভেনশ কলেজ থেকে বি এ পরীক্ষার্থী ছিলো মাত্র ২ জন।
উড়িষ্যার বালেশ্বর গভর্ণমেন্ট ইংরেজি স্কুল থেকে যে একজন মাত্র ছাত্রকে এনট্রান্স পরীক্ষা দেয়ার জন্য কোলকাতায় পাঠানো হয়েছিলো, আশ্চর্যজনক হলেও উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, তিনি ছিলেন একজন বাঙালি হিন্দু। নাম রাধানাথ রায়। পরবর্তীকালে ইনিই হচ্ছেন রায় রাধানাথ রায় বাহাদুর। উড়িষ্যাবাসীদের সন্তুষ্টির জন্য এঁর পরিচয় হচ্ছে উৎকল নিবাসী বঙ্গীয় কায়স্থ। প্রথমে বাংলায় এবং পরবর্তীতে ওড়িয়া ভাষায় কবিতা রচনা করে রাধানাথ বাবু বিখ্যাত হয়ে রয়েছেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আসামের অবস্থা কিন্তু সবকিছুকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। এ সময় অসমীয়া ভাষা বাংলা ভাষারই একটা উপভাষা হিসেবে গণ্য হতো, এ কথা আজ রূপকথার মতো মনে হলেও এখানে উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, ১৮৭৩ সালের পূর্বে আসামের সমস্ত স্কুলে বাংলা ছাড়া আর কোন ভাষাই শেখানো হতো না। ১৮৯৯-১৯০০ সাল নাগাদ সমগ্র আসামে একটিমাত্র আর্টস কলেজ ছিলো। ছাত্র সংখ্যা মাত্র ৩০ জন। অথচ কোলকাতায় ইংরেজি শিক্ষার জন্য হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয়েছিলো এর ৮২ বছর আগে ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দে এবং কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণহিন্দুরা এর পূর্ণ সুবিধা আদায় করে নেয়। এক কথায় বলতে গেলে এরা বঙ্গীয় এলাকার মুসলিম সম্প্রদায়কে বঞ্চিত করা ছাড়াও বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের সর্বত্র ইংরেজ ছত্রচ্ছায়ায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।
কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিজেদের শ্রেণীস্বার্থের পরিপন্থী কোন কিছুই মুক্তবুদ্ধির দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যন্ত বিচার করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো এতো বড় একজন শিক্ষাবিদ এবং সমাজ সংস্কারকও শিক্ষা ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠীর চিন্তাধারার প্রতিধ্বনি করেছেন। প্রাপ্ত নথিপত্রে দেখা যায় যে, ১৮৫৯ সালে বাংলা সরকারের কাছে বিদ্যাসাগরের চিঠি হচ্ছে, “আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে মনে হয় বাংলাদেশে শিক্ষাবিস্তারের সর্বোত্তম এবং হয়ত একমাত্র উপায় হিসেবে সরকারের উচিত উচ্চতর শ্রেণীগুলির মধ্যে ব্যাপক শিক্ষা প্রসার করেই ক্ষান্ত থাকা।” (বাংলার বিদ্বৎসমাজ : প্রকাশ ভবন, কলিকাতা ১৯৭৮)।
সামগ্রিক বিষয়টি অনুধাবনের লক্ষ্যে ইংরেজ রাজশক্তির বশংবদ ও নিতান্ত অনুগত হিসেবে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বাঙালিরা কিভাবে ‘সর্বভুখ’ হিসেবে সরকারী চাকরি দখল করেছিলো, নীচে ১৮৫৬-৫৭ সালের চিত্র প্রদত্ত হলোঃ
বিভাগ | বাঙালি | অন্যান্য ভারতীয় | মোট |
ভারত সরকারের অর্থ | |||
স্বরাষ্ট্র শিক্ষা ইত্যাদি | ১১৭ | ১২ | ১২৯ |
বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েট | ৬৫ | ৩ | ৬৮ |
আদালত সমূহ | ৩৪ | ৩ | ৩৭ |
রাজস্ব অফিস | ৫৮ | ১১ | ৬৯ |
একাউন্স অফিস | ৬৯ | ৪ | ১১৫ |
অবশ্য এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে, বাঙালি বলতে সে সময় শতকরা ৯৮ জনই হচ্ছেন বাঙালি বর্ণহিন্দু এবং বাঙালি মুসলমান প্রায় অনুপস্থিত বলা চলে।
কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবীদের মনমানসিকতার আরও সুস্পষ্ট পরিচয় দেয়ার লক্ষ্যে মাত্র ২৯ বছরের ব্যবধানে ১৮৮৬ সালে অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনের সভাপতি ডব্লিউ সি ব্যানার্জী প্রদত্ত ভাষণের অংশবিশেষ উল্লেখ যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে।
শ্রী ব্যানার্জী উদাত্ত কণ্ঠে বললেন, …….ইংল্যাণ্ডের মহারাণী এবং জনগণের শাসনে সুসভ্য হইয়া অদ্য আমরা এই স্থানে সম্মিলিত হইয়াছি এবং কোনো প্রকার বাধা ব্যতিরেকেই আপনাপন চিন্তার অর্গল উন্মুক্ত করিতে সক্ষম হইয়াছি। ব্রিটিশ শাসন, একমাত্র ব্রিটিশ শাসনেই ইত্যাকার ঘটনা সম্ভব (উচ্চরোল হর্ষধ্বনি)। এই কংগ্রেস কি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ অথবা বিদ্রোহ লালনের প্রতিষ্ঠান (চিৎকার-না না); নাকি উক্ত সরকারের স্থিতিশীলতার ভিত্তিভূমিতে আরো একটি প্রস্তরখণ্ড যোজন? (“চিৎকার হ্যাঁ, হ্যাঁ)”?
এই যখন অবস্থা, তখন কোলকাতার পাইওনিয়ার পত্রিকার ১৭ই নভেম্বর (১৮৮০) সংখ্যায় এ মর্মে মন্তব্য প্রকাশ হলো যে, “ব্যক্তিগত জীবনেও মুসলমানরা হিন্দুদের পিছনে পড়ে আছেন। জমিদারী সম্পত্তি মুসলমানদের হাতছাড়া হতে যাচ্ছে, অভিজাত মুসলমান পরিবারগুলি প্রায় সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এবং শহরে বহু সম্ভ্রান্ত মুসলমান অত্যন্ত দুরবস্থার মধ্যে পড়ে দিন কাটাচ্ছেন। গভর্ণমেন্ট অফিসার এবং শিক্ষা বিভাগের কর্মচারীদের মধ্যে শিক্ষিত মুসলমানদের সংখ্যা নগণ্য।”
বাঙালি মুসলমানদের দুঃসময়
সংস্কারপন্থী মুসলিম নেতা সৈয়দ আমীর হোসেন এমতাবস্থায় ‘মহামেডান এডুকেশন ইন বেঙ্গল’ নিবন্ধে সরাসরি বললেন, “ক্রমবর্ধমান মুসলমান ছাত্রদের শিক্ষার সুবিধার জন্য কলিকাতার মুসলমান মহল্লায় একটি কলেজ (বি,এ, ডিগ্রী পর্যন্ত) স্থাপন করা অবিলম্বে প্রয়োজন। প্রেসিডেন্সী কলেজ গভর্ণমেন্ট কলেজ হলেও হিন্দু মহল্লায় স্থাপিত এবং মুসলমান মহল্লা থেকে এত দূরে যে ছাত্রদের যাতায়াতের খরচই প্রায় ২০ টাকা পড়ে যায়।”
ইংরেজদের বিভেদ নীতি বলে আখ্যায়িত করলেও বলতে হয় যে, এই সর্বপ্রথম (১৪ই আগস্ট ১৮৮০) ক্যালকাটা স্টেটসম্যান পত্রিকা এধরনের একটা দাবী সমর্থন করে এ মর্মে মন্তব্য প্রকাশ করলো যে, “মুসলমানদের মধ্যে এক সময় যে গোঁড়ামি দেখা গিয়েছিল, এখন আর তা নেই। এখন বাংলার মুসলমানরা উচ্চ শিক্ষার জন্য উদগ্রীব এবং সর্বক্ষেত্রে শিক্ষিত হিন্দু শ্রেণীর সমকক্ষ হতে তাঁরা চান। লর্ড মেয়ো ও স্যার জর্জ ক্যাম্পবেলের সময় মুসলমানদের উচ্চ শিক্ষার জন্য যে আন্দোলন শুরু হয়েছিলো তা বিশেষ ফলপ্রদ হয়নি। কলিকাতা, হুগলি, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর মাদ্রাসাগুলিতে যে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয়। সুতরাং আমীর হোসেন মুসলমানদের পৃথক কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য যে আবেদন করেছেন তা বিশেষভাবে বিবেচ্য বলে মনে হয়।”
১৭৫৭ খ্রীষটাব্দ থেকে ১৮৭০-৭১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়ের দূরত্ব হচ্ছে ১১৩ বছরের মতো। ইংরেজ কর্তৃক এদেশের শাসন ক্ষমতা লাভের ১১৩ বছর পর্যন্ত বিশেষ করে বঙ্গীয় অঞ্চলের মুসলিমরা বৈরী মনোভাব পোষণ করে। রেভারেন্ট জেমস লং-এর ভাষায় বলতে গেলে, “জীর্ণ প্রাসাদের ভগ্নস্তূপ এবং শোচনীয় সামাজিক দুরবস্থার দিকে চেয়ে দেখতেই বোঝা যায় যে, এদেশের মুসলমানরা নিশ্চিত ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছেন।…..” তখন অর্থাৎ বঙ্গীয় মুসলমানদের সেই ভয়াবহ দুঃসময়ে সৈয়দ আমীর আলী, আবদুল লতিফ খাঁ, সৈয়দ হাসান ইমাম, মীর মোশাররফ হোসেন, সৈয়দ আমীর হোসেন, মওলানা কেরামত আলী প্রমুখের কর্মকাণ্ডকে কিভাবে মুল্যায়ন করা যায়?
কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণ হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীদের তুলনায় প্রায় ১১৩ বছর পর বংগীয় এলাকার বিধ্বস্ত প্রায় মুসলিম সম্প্রদায় যখন ইংরেজ রাজশক্তির সঙ্গে একটা অলিখিত সমঝোতার ভিত্তিতে ১৮৭০-৭১ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ (ওহাবী আন্দোলনের পরিসমাপ্তিতে) সংস্কারপন্থী মনোভাব গ্রহণ করলো, তখনকার বিরাজমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও কিছুটা আলোকপাত করা অপরিহার্য বলে মনে হয়। কেননা কেবলমাত্র সেক্ষেত্রেই মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তর দশকে বংগীয় মুসলমানদের এই পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং কর্মপদ্ধতিকে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের দালালী হিসেবে চিহ্নিত করা যায় কিনা।
১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দের পলাশীর যুদ্ধ থেকে শুরু করে ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দের ওহাবী আন্দোলনের পরিসমাপ্তি অর্থাৎ ১১৩ বছর পর্যন্ত ইংরেজ-বিরোধী অসংখ্য যুদ্ধ, কৃষক বিদ্রোহ, অসহযোগিতামূলক কার্যকলাপ, সংঘর্ষ এবং সংগঠিত প্রতিটি বিপ্লবাত্মক ঘটনার মূল চালিকা শক্তি হিসেবে ভূমিকা পালনের পর ১৮৭০ সাল থেকে পরবর্তী ৭৭ বছর অর্থাৎ ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগ পর্যন্ত বংগীয় মুসলমানরা কোন্ প্রেক্ষাপটে রাজশক্তির সংগে সংঘর্ষ তো দূরের কথা, রাজপথের সামান্য আন্দোলনে পর্যন্ত যোগদানে বিরত থাকলো তা বিস্ময়কর মনে হলেও, এর গূঢ়. কারণ অনুসন্ধান ও মূল্যায়ন করার সময় এসেছে।
বিংশ শতাব্দীর তিরিশ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করে চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি সময়কাল পর্যন্ত ইংরেজ আমলে যখন স্কুল কলেজে বিদ্যার্জন করতাম, তখন বর্ণহিন্দু সহপাঠীদের কাছ থেকে বারংবার একটা কথাই শুনতাম যে, “আমরা বংগীয় মুসলমানরা হচ্ছি সাম্রাজ্যবাদ ইংরেজদের খয়ের খাঁ এবং দালাল।” সে আমলের পত্র-পত্রিকা এবং বই-পুস্তক সর্বত্রই এই একই কথার প্রতিধ্বনি দেখতে পেয়েছি। আমাদের গুরুজন ও শ্রদ্ধাভাজনদের কাছ থেকেও সে আমলে এ ব্যাপারে কোন সুষ্ঠু ব্যাখ্যা পাইনি। যেটুকু পেয়েছি তা হচ্ছে, কোনরকম যুক্তিতর্ক ছাড়াই সরাসরি কিছু হিন্দু-বিদ্বেষী কথাবার্তা আর হচ্ছে ভালোভাবে লেখাপড়া শিখে বিভিন্ন ক্ষেত্রে হিন্দুদের মোকাবেলা করার উপদেশ।
কিন্তু আজ? বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে এসে ঢাকার বিদ্বৎ সমাজ নিশ্চুপ (জনাকয়েক ব্যতিক্রম) থাকলেও কোলকাতা থেকে প্রকাশিত কিছুসংখ্যক বাস্তবধর্মী ও সাহসী লেখকের গবেষণামূলক পুস্তকে এর ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি। শ্রেণী, গোষ্ঠী এবং সম্প্রদায়ের বৃহত্তর স্বার্থে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দুরা ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে বংগভংগের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সময়কাল অর্থাৎ ১৪৮ বছর (ইংরেজদের পুরো রাজত্বকাল ১৯০ বছর) ধরে ইংরেজ রাজশক্তির সম্পূরক হিসেবে যেমন ‘সাফল্যজনকভাবে’ ভূমিকা পালন করেছে, ঠিক সেরকম দক্ষভাবে না হলেও ১৮৭০ সাল থেকে পরবর্তী ৭৭ বছর পর্যন্ত বংগীয় মুসলমান সম্প্রদায় শ্রেণীস্বার্থে অত্যন্ত সন্তর্পণে ইংরেজদের বৈরী কোন কর্মকাণ্ডে নিজেদের আর জড়িত করেনি। এটাই হচ্ছে ঐতিহাসিক তথ্য।
এর প্রকৃত মূল্যায়ন করতে হলে, কোন কোন ক্ষেত্রে কিঞ্চিৎ পুনরাবৃত্তি সত্ত্বেও আলোচনার সুবিধার্থে সার্বিকভাবে সামগ্রিক বিষয়টি উপস্থাপনা করা অপরিহার্য বলে মনে করছি।
প্রথমেই একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, মোগল সম্রাট আকবরের রাজত্বকাল থেকেই (১৫৪২-১৬০৫ খ্রীঃ) বংগীয় এলাকাকে রাজনৈতিকভাবে উত্তর ভারতীয় এলকার একটা বর্ধিত অঞ্চল হিসেবে পরিগণিত করা হয়েছে। ঐতিহাসিক তথ্য থেকে দেখা যায় যে, ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দের বংগভংগ পর্যন্ত কয়েক শতাব্দী যাবৎ সমগ্র বাংলাদেশ, বিহার, উড়িষ্যা ও ছোট নাগপুর নিয়ে গঠিত এলাকাকেই প্রধানতঃ বংগীয় এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। তাই মুসলিম সম্রাট ও নবাবদের আমলে ঢাকা ও মুর্শিদাবাদে সৃষ্টি হয়েছিলো বংগীয় মুসলিমদের নেতৃত্বদানকারী মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর।
‘আশরাফ ও আতরাফ’ শ্রেণী গঠনের পূর্ব ইতিহাস
সৈয়দ গোলাম হোসেন রচিত “সিয়ারুল মোতা আখেরিন” গ্রন্থের ইংরেজী অনুবাদ থেকে এঁদের সম্পর্কে কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। এঁরা ছিলেন “আশরাফ” বা খান্দানীর দাবীদার। এঁদের অধিকাংশই উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় এলাকা থেকে ভাগ্যের অন্বেষণে আগত অবাঙালি মুসলমান। মোগল সম্রাটদের প্রদত্ত সনদ মোতাবেক লাখেরাজ সম্পত্তির অধিকারী এবং ঢাকা ও মুর্শিদাবাদের নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক পদ দখলকারী এসব মুসলমান কালক্রমে নিজেদের বাঙালি মুসলমান হিসেবে পরিচয়দান করলেও এঁদের মাতৃভাষা ছিলো ফার্সী এবং নিম্নশ্রেণী ও বিধর্মীদের সংগে কথাবার্তার সময় এঁরা ‘সেনাছাউনী ভাষা’ উর্দু ব্যবহার করতেন। একথা চিন্তা করলে আশ্চর্য মনে হয় যে, যেখানে খ্রীষ্টীয় দশম শতাব্দী থেকে কয়েকশত বছর ধরে বংগীয় এলাকার পাঠান আমলে শত-সহস্ৰ পীর, দরবেশ, আউলিয়া ও ফকির উদারমনা সুফী দর্শনের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম প্রচারকালে “আশরাফ” ও “আতরাফ”-এর মধ্যে কোন তফাৎ করতে দেয়া হয়নি এবং বহিরাগত মুসলমান ও ধর্মান্তরিত মুসলমানদের মধ্যে কোন শ্রেণী বিভাগ বিদ্যমান ছিলো না, সেখানে বাংলাদেশ মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর হিন্দু সমাজের শ্রেণী বিভাগের অনুকরণে সৃষ্টি হলো এই ‘আশরাফ’ আর ‘আতরাফ’-এর শ্রেণী বিভাগ।
গ্রাম বাংলার সোঁদা মাটির সঙ্গে এবং বাংলার ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি, লোকাচার আর হাসি-কান্নার সংগে এই অবাঙালি মুসলিম “আশরাফ”-দের বিশেষ কোন সম্পর্ক না থাকায় রাজদণ্ড ইংরেজদের হাতে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের ভিত্তিটা শিথিল হয়ে গেলো এবং এদের মনে আস্থার বিরাট অভাব দেখা দিলো। আগেই উল্লেখ করেছি যে, পলাশীর যুদ্ধের পর ১৭৫৯-৬০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ নবাব মীরজাফরের ৮০ হাজার সৈন্যের অধিকাংশ ও ১৭৬৩ খ্রীষ্টাব্দে নবাব মীর কাসেমের ৪০ হাজার সৈন্যবিশিষ্ট সমগ্র সৈন্যবাহিনী বরখাস্ত, ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারী প্রথা প্রবর্তন, ১৮২৮ খ্রীষ্টাব্দের লাখেরাজ ও ওয়াকফ সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ, এবং ১৮৩৭ সাল নাগাদ রাষ্ট্রভাষা ফারসীর পরিবর্তে ইংরেজী প্রবর্তিত হওয়ায় বংগীয় এলাকায় মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী একরকমভাবে বলতে গেলে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। এঁদের অনেকেই বংগীয় এলাকা থেকে পুত্র-পরিজনসহ উত্তর ভারতীয় অঞ্চলে দেশান্তরিত হলো। বাকীরা নিঃস্ব অবস্থায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গমন করে কৃষিজীবীর পেশা গ্রহণে বাধ্য হলো।
বংগীয় এলাকায় মুসলমানদের মধ্যে বিরাজমান মনমানসিকতা সম্পর্কে ইংল্যাণ্ডের কমনস্ সভার সিলেক্ট কমিটিতে ১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দে বক্তব্য পেশকালে স্যার জন ম্যাকম সত্য ভাষণ করেছেন বলা যায়। তিনি বলেছেন,–
“আমার বিশ্বাস এই যে, মুসলিম জনসংখ্যার (বংগীয় এলাকায়) একটা বিরাট অংশ তেমন সন্তুষ্ট নয়। কারণ এঁদের স্মৃতিতে ক্ষমতা হারাবার ভয়ংকর দহন বিদ্যমান রয়েছে। অথচ হিন্দুদের স্মৃতিতে এ ধরনের কোন জ্বালা নেই। তাই হিন্দুরা যদি সন্তুষ্ট থাকে, তাহলে কেউই বৃটিশ শক্তির বিশেষ ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম হবে না। এজন্যই ভারতবর্ষে আমাদের (বৃটিশদের) নিরাপত্তার প্রধান অবলম্বনই হচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায়ের সংগে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন।
প্রাসংগিক বিধায় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, লণ্ডনের কমন্সসভার সিলেক্ট কমিটিতে সে আমলে প্রদত্ত এ ধরনের সাক্ষ্য, বিবৃতি ইত্যাদির ভিত্তিতেই ইংরেজ শাসক গোষ্ঠী বৃটিশ ভারত সম্পর্কিত তাদের নীতি প্রণয়ন ও নির্ধারণ করতো। অবশ্য ভারতে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী এবং ইংল্যাণ্ডের রাণী ভিক্টোরিয়ার কর্মচারী হিসেবে যারা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন, কেবলমাত্র তাদের কাছ থেকেই এ ধরনের সাক্ষ্য, বিবৃতি ইত্যাদি গ্রহণ করা হতো।
তাই বাঙালি মুসলমানদের সম্পর্কে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ইংরেজ কর্মচারীরা এবং পরবর্তীকালে ইংরেজ রাজপুরুষেরা কি ধরনের মনোভাব পোষণ করতো ও কথাবার্তা বলতো, তা’ অনুধাবনের লক্ষ্যেই স্যার জন ম্যাকম-এর আলোচ্য মন্তব্যের উদ্ধৃতি দিলাম। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের গবেষক ডক্টর আজিজুর রহমান মল্লিকের মন্তব্য হচ্ছে; “মুসলমান উচ্চবিত্ত শ্রেণীভুক্ত ব্যক্তিবর্গ সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে গ্রামাঞ্চলের দিকে পা বাড়ালো। সেখানে তাদের উন্নতির আশা ছিল সুদূরপরাহত। বর্তমান সরকারের (ইংরেজ) অধীনে রাষ্ট্রীয় ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব হারিয়ে পূর্ববাংলার শহরাঞ্চলগুলো যেভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিলো, তা’ ইতিহাসের এক মর্মান্তিক ঘটনা। যেসব মুসলমান এসব শহরে বসবাস করছিলো, তাঁরা উন্নতির কোনো সুযোগই পেলো না। অন্যদিকে কোলকাতার হিন্দুরা (রাজশক্তির নিকট থেকে) অভাবনীয় ধরনের সাহায্য ও সহানুভূতি লাভে সক্ষম হলো। (বৃটিশনীতি ও বাংলার মুসলমান : বাংলা একাডেমী, ঢাকা ১৯৮২)।
পশ্চিমবঙ্গের এককালীন মার্কসবাদী সাংবাদিক এবং পরবর্তীকালে বিশিষ্ট গবেষক বিনয় ঘোষ বঙ্গীয় এলাকায় ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বিরাজমান সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কে চমৎকার মূল্যায়ন করেছেন। তিনি লিখেছেন……কিন্তু নব্যবঙ্গের ইন্টেলিজেনশিয়ার এই বিকাশের ধারাটা সুখের নয়। তার মধ্যে ট্রাজেডির উপকরণও ছিল যথেষ্ট। কিন্তু কিসের ট্রাজেডি? প্রথম ও প্রধান ট্রাজেডি হল, বাংলার এই নতুন বিদ্বৎসমাজ প্রায় সম্পূর্ণ ‘মুসলমানবর্জিত’ রূপ ধারণ করল এবং সেইজন্য একে সাধারণভাবে ‘বাঙালি বিদ্বৎসমাজ’ না বলে, বিশেষ অর্থে ‘বাঙালি হিন্দু বিদ্বৎসমাজ’ বলাই যুক্তিসঙ্গত। আমরা যখন নব্যবঙ্গের বা নবযুগের বাংলার ইতিহাস আলোচনা করি তখন কতকটা সচেতনভাবেই বাঙালি মুসলমান সমাজের এই প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যাই। কিন্তু কোন সমস্যাকে এড়িয়ে গিয়ে ইতিহাস লেখা যায় না, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস তো নয়-ই। বাংলার বিদ্বৎ সমাজের বিকাশের ইতিহাস আলোচনা প্রসঙ্গে তাই বাঙালি মুসলমান সমাজের কথা না বললে আলোচনা সম্পূর্ণ হয় না।
“ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন বাংলার পুরাতন সমাজবিন্যাসের ভাঙ্গাগড়া চলেছে এবং ইংরেজ আমলের নতুন সম্ভ্রান্ত ধনিক সমাজ গড়ে উঠেছে, তখন মুসলমান সমাজের অবস্থা কি? বাঙালি সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবার সেই সময়ের মধ্যে ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে গিয়েছেন। ইংরেজ নয়, তাঁদের ঐশ্বর্য ও আভিজাত্য ছিল মুসলমান আমলের। সেই ঐশ্বর্য ও আভিজাত্য দুই-ই যখন তাঁদের লুপ্ত হয়ে গেল, তখন ইংরেজ আমলের নতুন সম্ভ্রান্ত হিন্দু সমাজ গড়ে উঠল। …..অর্থাৎ শোভা বাজার, জোড়াসাঁকো, পাথুরিয়াঘাটা, বাগবাজার, শ্যামবাজার, কলুটোলা প্রভৃতি অঞ্চলে, নতুন রাজধানী কোলকাতায় যখন ইংরেজ আমলের সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবার-প্রতিষ্ঠাতারা ধনসমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখন মুর্শিদাবাদ, হুগলি প্রভৃতি পুরাতন মুসলমান শাসন কেন্দ্রে সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের ক্রমবিলুপ্তি ঘটছিল। বাঙালি দেওয়ান বেনিয়ান মুছুদ্দিদের মধ্যে মুসলমানদের নাম একরকম পাওয়াই যায় না বলা চলে। তার প্রধান কারণ বাঙালি মুসলমানদের ইংরেজবিদেবষ সেই সময় অনেক বেশী তীব্র ছিল।……. মুসলমান সমাজ তাই সর্বক্ষেত্রে, রাজ্যচ্যুতি ও মর্যাদাহানির বিক্ষোভ থেকে ইংরেজদের সঙ্গে অসহযোগিতা করেছেন। শিক্ষা, রাজসম্মান ইত্যাদির কোন ক্ষেত্রেই তাঁরা কোনো সুযোগ গ্রহণ করতে চাননি, বরং তাঁদের অসহযোগ নীতির পূর্ণ সুযোগ ইংরেজরা তাদের শাসনস্বার্থে গ্রহণ করেছিলেন। ইংরেজরা সেই সুযোগে শিক্ষা ও অর্থ উভয় ক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিষ্ঠালাভে হিন্দু সমাজকে সাহায্য করেছেন এবং সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির বীজ বপন করে ভবিষ্যতের জন্য তাদের সিংহাসনটিকে অটল রাখবার চেষ্টা করেছেন।
“…….হিন্দু সমাজে ক্রমবর্ধমান একটি শিক্ষিত ও চাকরিজীবী মধ্য শ্রেণীর বিকাশ হয়েছে। তার মধ্যে মুসলমান সমাজে নতুন মধ্য শ্রেণীর বিকাশ তো একেবারেই হয়নি, পুরাতন অভিজাত সমাজ ধীরে ধীরে লোপ পেয়েছে এবং দরিদ্র ও নিঃস্ব শ্রেণীর সংখ্যা বেড়েছে। নতুন কোন বিদ্বৎসমাজেরও বিকাশ হয়নি।” (বাংলার বিদ্বৎ সমাজ ২য় সংঃ প্রকাশ ভবন, কলিকাতা ১৯৭৮)।
১৮৭০ সালে মুসলিম মধ্যবিত্ত সবেমাত্র হামাগুড়ি দিতে শুরু করেছে
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দের পলাশীর যুদ্ধের ১১৩ বছর পর ১৮৭০-৭১ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গীয় এলাকার মুসলিম সম্প্রদায়ের উচ্চ শ্রেণী কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে, মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণী হয় দেশান্তর হয়েছে না হয় নিশ্চিহ্নপ্রায়। আর কৃষক ও নিম্ন শ্রেণী অত্যাচারের জগদ্দল পাথরের নীচে নিষ্পেষিত। অনাহার, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যই তাঁদের নিত্য সঙ্গী।
এ প্রসংগে বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সাংবাদিক মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহর মন্তব্য বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। তিনি লিখেছেন, “……বিদ্রোহের (১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব ) শেষের দিকে বিশেষ করিয়া বিপর্যয়ের সূচনায় বিদ্রোহের সমস্ত দায়িত্ব মুসলমানদের স্কন্ধে চাপাইয়া দিয়া সংগ্রাম হইতে সরিয়া পড়ার পর হইতে হিন্দুরা ক্রমশঃ মুসলমানদের সহিত সকল প্রকার সম্পর্কচ্ছেদ করিতে থাকে। ইহার উত্তরে মুসলমানেরাও তাহাদিগকে আরও বেশী করিয়া পর ভাবিতে এবং সন্দেহের চক্ষে দেখিতে আরম্ভ করে। এজন্য কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাকে তাঁহারা সেদিন সুনজরে দেখিতে পারে নাই।” (আমাদের মুক্তি সংগ্রাম : বাংলা একাডেমী, ঢাকা : ১৯৭৮)
এমনকি যে বৃটিশ ইণ্ডিয়া এসোসিয়েশনের (স্থাপিত : ১৮৬৬ খ্রীঃ) উত্তরসূরী হিসেবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম হলো (ডিসেম্বর ১৮৮৫ খ্রীঃ), সংস্কারপন্থী স্যার সৈয়দ আহম্মদ-এর মতো নেতাও সেই বৃটিশ ইণ্ডিয়া এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তীকালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেয়া তো দূরের কথা, সাংবাদিক ওয়ালিউল্লাহর ভাষায় বলতে গেলে “মুসলমানদিগকেও ইহার ছায়া পর্যন্ত না মাড়াইতে সতর্ক করিয়া দেন। এমনকি প্রগতিশীল মুসলমানদের নেতা জনাব বদরুদ্দীন তায়েবজী এবং জনাব রহমতুল্লাহ সায়ানীর যোগদানেও মুসলমান শিক্ষিত সম্প্রদায় মোটামুটিভাবে কংগ্রেসের প্রতি অনাকৃষ্ট থাকিয়া যায়।”
এই প্রেক্ষাপটে একথা বলা যথার্থই হবে যে, ১৮৭০-৭১ খ্রীষ্টাব্দে যখন কোলকাতায় মহামেডান লিটারারী সোসাইটির উদ্যোগে একটা সংস্কারপন্থী মনোভাবের মাধ্যমে বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়কে পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে এর চালিকাশক্তি ইংরেজী শিক্ষিত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী গঠনের প্রচেষ্টা সবেমাত্র শুরু হলো, তখন কোলকাতা কেন্দ্ৰিক বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত। সত্যি কথা বলতে কি, এদের পুনর্জন্মের সময়টা তো ১১৩ বছর আগে পলাশীর যুদ্ধের প্রাক্কালেই হয়েছে।
এজন্যই ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তর দশকে অগ্রগতির মানদণ্ডে এই দুটো সম্প্রদায় বিরাট তফাতে দাঁড়িয়ে। বহু ঘাত-প্রতিঘাত আর দুর্যোগের মাঝ দিয়ে বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী এসময় ইংরেজী শিক্ষার মাধ্যমে কেবলমাত্র হামাগুড়ি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ইংরেজদের দালাল হিসেবে আখ্যায়িত হচ্ছে; আর তখন এরই পাশাপাশি শতাধিক বছর ধরে ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীদের সম্পূরক শ্রেণী পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত অবস্থায় নানা প্রগতিশীল দর্শনের বুলি কপচিয়ে বাহবা কুড়াচ্ছে। আসলে সবার অজান্তে এঁরা তখন সর্বভুক ও সর্বগ্রাসী এবং ভবিষ্যতের অলীক স্বপ্নের সৌধ রচনা করে বসে রয়েছে।
সঠিকভাবে পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে, ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় পুরো সময়কালটাই হচ্ছে সবচেয়ে ঘটনাবহুল। এ সম্পর্কে গবেষকরা নানাভাবে ব্যাখ্যাদান করে বিভিন্ন বিষয়ের উপস্থাপনা করেছেন। কিন্তু সত্যিকারভাবে বলতে গেলে এসব প্রতিবেদনের অধিকাংশই অসম্পূর্ণ। কেননা উপ-মহাদেশে সংঘটিত প্রতিটি ঐতিহাসিক ঘটনার সংগে যেখানে তৎকালীন রাজশক্তির কেন্দ্রবিন্দু ইংল্যান্ডের স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেখানে সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর ওধারে ইংরেজদের আদি নিবাসভূমিতে বিরাজমান রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা নিতান্ত অপরিহার্য বলে মনে হয়। এ সম্পর্কে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট গবেষক পারসিভাল স্পেয়ার তাঁর রচিত ‘এ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া-২’ (১১সং ১৯৮২) গ্রন্থে নানা ঐতিহাসিক তথ্য উপস্থাপনা করেছেন। এসব তথ্য থেকে দেখা যায় যে, ১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ কমন্স সভায় আইন পাসের মাধ্যমে ভারত উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার রহিত এবং সর্বপ্রথম খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের অনুমতি প্রদান করা হলে বিশেষ করে ইংল্যান্ডের উচ্চ মহলে দারুণ আলোড়নের সৃষ্টি হয়। এ সময় সর্বত্রই যে আলোচনা সর্বাধিক গুরুত্ব লাভ করে তা হচ্ছে এই যে, অবস্থার প্রেক্ষিতে এবং ইংরেজ স্বার্থে ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের লক্ষ্যে কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা সমীচীন বিবেচিত হবে।
এখানে একটা কথা স্মরণ রাখা দরকার যে, ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দে যখন কমনস সভায় ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার সংক্রান্ত সনদ পরবর্তী ২০ বছর অর্থাৎ ১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত নবায়ন করা হয়, তখন ইংল্যান্ডের প্রভাবশালী মহলের সমর্থনে উইলিয়াম উইলবারফোর্স কর্তৃক উত্থাপিত খ্রীস্টধর্মের প্রচারের অনুমতিদান সম্বলিত সংশোধিত প্রস্তাবটি নাকচ হয়ে যায়। উপরন্তু সমাজ সংস্কারক ও ভারতের এককালীন গভর্ণর জেনারেল লর্ড রিচার্ড ওয়েলেসলী (১৭৬০-১৮৪২ খ্রীঃ) কর্তৃক উত্থাপিত সতীদাহ (সদ্য বিধবা মহিলা পোড়ানো) বন্ধকরণ আইন প্রণয়নের প্রস্তাব বারংবার স্থগিত রাখা হয়।
আলোচ্য সময়ে দু’টো বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। প্রথমতঃ ইংল্যান্ডে তখন রক্ষণশীল টোরী দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এবং দ্বিতীয়তঃ সমগ্র ইউরোপে তখন ফরাসী ব্যক্তিত্ব নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এবং জ্যাকোবিন্সদের প্রচন্ড প্রভাব বিরাজমান। ইংরেজরা এই প্রভাবের দরুন সবচেয়ে ভীত ও সন্ত্রস্ত ছিলো।
ভারত সম্পর্কে বৃটেনের তিন ধরনের চিন্তাধারা
এ ধরনের এক পটভূমিতে মোটামুটিভাবে ইংল্যান্ডে তখন ভারত উপমহাদেশ সংক্রান্ত তিন ধরনের মনোভাব বিদ্যমান ছিল। প্রথমেই “ইভাজেলিক্যাল” মতবাদের কথা বলতে হয়। এঁরা যদিও ধর্মনিরপেক্ষ রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন ছিলেন, তবু এঁদের সুস্পষ্ট দাবী হচ্ছে, ভারতের সতীদাহ, ক্রীতদাস প্রথা এবং ধর্মের নামে ঠগীদের হত্যাকান্ড ইত্যাদি কঠোর হস্তে বন্ধ করা ইংরেজ রাজশক্তির জন্য অবশ্য করণীয়। তাই এদের শ্লোগান, ‘পাশ্চাত্যের খ্রীষ্ট ধর্মকে পূর্বে নিয়ে যাওয়া হোক। কেবলমাত্র সেক্ষেত্রেই এমন এক সংস্কারমুক্ত ভারত সৃষ্টি করা সম্ভব হবে, যেখানে স্বচ্ছন্দে দাবী করা যাবে যে, প্রস্ফুটিত ফুল সূর্যমুখী হয়েছে। এ ধরনের মতাবলম্বীদের নেতৃত্বে ছিলেন উইলিয়াম উইলবারফোর্স, উইলিয়াম পিট এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অন্যতম ডিরেক্টর চার্লস গ্রান্ট প্রমুখ।
এ সময় রক্ষণশীল টোরী দলের মধ্যে অবস্থানকারী আর একটি প্রভাবশালী গ্রুপ বিদ্যমান ছিলো। ভারতবর্ষ সম্পর্কে এদের বক্তব্য ছিলো বেশ একরোখা। `এরা শুধু যে ভারতে ব্যাপকভাবে খ্রীষ্টধর্ম প্রচার এবং অবাধ অর্থনীতির সমর্থক ছিলেন তাই-ই নয়, এঁদের পরিষ্কার কথা হচ্ছে যে, পাশ্চাত্যের খ্রীষ্টধর্ম ছাড়াও পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি ও সভ্যতার সবকিছুই মহান ও উন্নত। অন্যান্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি যেখানে স্থবির হয়ে রয়েছে সেখানে একমাত্র পাশ্চাত্যের সভ্যতা সচলভাবে সম্মুখপানে ধাবমান এবং সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ অর্জনে সক্ষম। তাই ভারতীয় সমাজে পাশ্চাত্যের সভ্যতাকে গলধঃকরণ করাতে হবে। এই মতাদর্শের নেতা ছিলেন বিখ্যাত গ্রন্থ “হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া” (১৮১৭ খ্রীঃ) লেখক জেমস মিল।
আলোচ্য সময়ে ইংল্যান্ডের উচ্চ সমাজে তৃতীয় একটি মতাদর্শ বিদ্যমান ছিলো। এঁরা ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীতে চাকরিরত যুবক কর্মচারীদের কথাবার্তা ও চিঠিপত্রে প্রকাশিত মতামত থেকে দারুণভাবে প্রভাবান্বিত ছিলেন। মাত্র দেড় যুগের ব্যবধানে এসব চাকরিজীবীই ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দখল করে বসলো। এঁদের মতাদর্শ বেশ কিছুটা উদারপন্থী। সোজা কথায় এঁদের বক্তব্য হচ্ছে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় দ্রুত এবং আকস্মিকভাবে ব্যাপক পরিবর্তনের প্রচেষ্টা খুব একটা সুখকর হবে না। ভারতের জীবনাদর্শের মধ্যে যেমনভাবে যুগের পর যুগ ধরে এক সময় ইসলামী আদর্শের সমন্বয় হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে পাশ্চাত্যের দর্শন, সংস্কৃতি ও সভ্যতার অনুপ্রবেশ ঘটাতে হবে এবং তার গতি হবে ‘মন্থর অথচ স্থিতিশীল।’ এই ধরনের মতাদর্শের প্রবক্তাদের মধ্যে মাউন্ট স্টুয়ার্ড এ্যালফিনস্টোন (১৭৭৯-১৮৫৯ খ্রীঃ) স্যার চার্লস মেটকাফ (১৭৮৫-১৮৪৬ খ্রীঃ) এবং স্যার জন ম্যালকম (১৭৬৯-১৮৩৩ খ্রীঃ) অন্যতম ছিলেন। এ্যালফিনস্টোনের প্রচেষ্টায় বোম্বাই এলাকায় মারাঠি ও গুজরাটিদের মধ্যে ইংরেজী শিক্ষার প্রসার সম্ভব হয়েছিলো। চার্লস মেটকাফ যখন দিল্লী এলাকার শাসনের দায়িত্বে ছিলেন, তখন সেখানে অত্যন্ত সন্তর্পণে পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষার প্রবর্তন হয়েছিলো। আর জন ম্যালকম বোম্বের গভর্ণর থাকাকালীন ভারতীয়দের সম্পর্কে অর্জিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটি নতুন শ্লোগান উচ্চারণ করলেন। শ্লোগানটি হচ্ছে ‘অতএব আমরা ঠান্ডা মাথায় ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়ার নীতি বাস্তবায়িত করবো।”
এক কথায় বলতে গেলে উপরে বর্ণিত প্রথম ও দ্বিতীয় মতবাদের সমর্থকরা ছিলেন ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল টোরী দলীয় আর তৃতীয় মতাবলম্বীরা ছিলেন উদারপন্থী। শেষ পর্যন্ত বৃটেনের তৎকালীন ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দলীয় সরকার এই তৃতীয় উদারপন্থী মতামতকে গ্রহণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলো।
একথা চিন্তা করলে আজ বিস্মিত হতে হয় যে, সে আমলে পদানত ভারতবর্ষ সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ করতে ইংল্যান্ডের ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে ১৭৯৩ খ্রীঃষ্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৮৩০ খ্রীঃষ্টাব্দ পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৩৭ বছরকাল অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। আর এই নীতি হচ্ছে ‘পাশ্চাত্যের শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে প্রাচ্যের (ভারতের) দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে হবে—কিন্তু সে রকম কোন বাধ্যবাধকতা থাকবে না। এর পাশাপাশি ১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ভারতের ইংরেজ এলাকায় সর্বপ্রথম খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের অনুমতি দেয়া হলেও পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো যে, খ্রীষ্টধর্ম প্রচারে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোন পৃষ্ঠপোষকতা থাকবে না।
এ ধরনের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ভারতে গভর্নর জেনারেল হিসেবে পরবর্তীতে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক-এর (১৭৭৪-১৮৩৯ খ্রীঃ) গৃহীত পদক্ষেপগুলো ইংরেজ-এর স্বার্থে খুবই সময়োপযোগী হয়েছিলো।
এক্ষণে আমাদের বিচার করা দরকার যে, তৎকালীন বৃটিশ ভারতের রাজধানী কোলকাতায় এর কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো। ইতিপূর্বে কয়েকবার একথাটা উল্লেখ করেছি যে, উপমহাদেশে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সে আমলে এ দেশে ইংরেজদের প্রধান সম্পূরক শক্তির ভূমিকা পালন করেছিলো। আলোচ্য সময়ে কোলকাতা তথা সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিরাজমান সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিতে উদীয়মান বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্যশ্রেণীর অভিন্ন লক্ষ্য থাকা সত্ত্বেও ৩টি চিন্তাধারার স্রোত বিদ্যমান ছিল। সুষ্ঠু আলোচনার লক্ষ্যে পুনরাবৃত্তি হওয়া সত্ত্বেও এই তিনটি মতবাদের কথা পুনরায় অত্যন্ত সংক্ষিপ্তাকারে হলেও উল্লেখ করতে হচ্ছে।
প্রথমেই এ্যাংলো ইণ্ডিয়ান হেনরী লুইস ডিরোজিওর (১৮০৯-১৮৩১ খ্রীঃ) কথা বলতে হয়। এঁরই প্রবর্তিত মতাদর্শের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছিল ইয়ং বেংগল গ্রুপ।’ এঁদের বক্তব্য হচ্ছে, অবাধ অর্থনীতি থেকে শুরু করে পাশ্চাত্যের ইংরেজী শিক্ষা এবং ইউরোপীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির সবটুকুই গ্রহণ করতে হবে। ডিরোজিওর সমর্থকদের মধ্যে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী রাম গোপাল ঘোষ, কৃষ্ণমোহন, প্যারীচাঁদ মিত্র বা টেকচাঁদ ঠাকুর (১৮১৪-১৮৮৩ খ্রীঃ), রামতুন লাহিড়ী প্রমুখ অন্যতম ছিলেন। বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের ইতিহাসে এঁদের অবদান অনস্বীকার্য হলেও ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এঁদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়।
দ্বিতীয় চিন্তাধারাকে রাধাকান্ত-ভুদেব-রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের চিন্তাধারা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এঁদের কথা হচ্ছে যে, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোড়ামির বেড়াজাল ভেদ করে কিঞ্চিত সংশোধনের মাধ্যমে এবং সুষ্ঠু ব্যাখ্যাদানের ভিত্তিতে হিন্দু ধর্মের আদর্শকে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য করে তোলা সম্ভব। অতএব, পাশ্চাত্য দর্শন এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে গলধঃকরণের সমস্ত প্রচেষ্টা বর্জনীয়। এ সময় তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতাদর্শ হচ্ছে রামমোহন রায়ের (১৭৭২-১৮৩৩ খ্রীঃ) প্রবর্তিত সমন্বয়ের চিন্তাধারার মাধ্যমে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর সম্পূরক হিসেবে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও মধ্য শ্রেণীকে একটা সুদৃঢ় ভিত্তিতে গড়ে তোলা। তিনি প্রথমেই হিন্দু যুবকদের দলে দলে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পথ রুদ্ধ করার লক্ষ্যে ১৮২৮ খ্রীষ্টাব্দে ব্রাহ্ম সমাজ গঠন করেন। অথচ রামমোহন রায় ছিলেন পাশ্চাত্য সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ইংরেজী শিক্ষার গোড়া সমর্থক। তিনি প্রাত্যহিক জীবনে সমস্ত দিন ধরে ইউরোপীয় পোশাক পরিধান করে ইউরোপীয় আদব-কায়দায় ইংরেজদের সংগে উঠা-বসা করলেও সন্ধ্যার পর ভারতীয় দর্শন এমনকি ইসলামী ভাবধারা সম্পর্কিত বিষয়ে পড়াশুনা করতেন।
ভারত সম্পর্কে ইংরেজদের ‘ধীরে চলো নীতি’
এটা খুবই আশ্চর্যজনক যে, ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দে বৃটেনের ক্ষমতাসীন টোরী দল ইংরেজ শাসিত ভারত সম্পর্কে সর্বক্ষেত্রে “ধীরে চলো”-র ভিত্তিতে যে নীতি গ্রহণ করেছিলো, রামমোহন রায় কর্তৃক প্রবর্তিত ‘সমন্বয়ের চিন্তাধারার সংগে তার অপূর্ব সাদৃশ্য বিদ্যমান। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত সমন্বয়ের চিন্তাধারা ছিল ইংরেজদের একমাত্র ভরসার স্থল। কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্যশ্রেণী নিজেদের গোষ্ঠী ও শ্রেণীস্বার্থে চরম আগ্রহে গ্রহণ করেছিলো বলেই কমন্স সভায় গৃহীত আলোচ্য নীতি খুবই নির্বিঘ্নে এদেশে বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়েছিলো। তবে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, উপরে বর্ণিত তিনটি মতাদর্শের সকলেই ইংরেজদের সমর্থক ছিলো। অথচ এসময় বাঙালি মুসলমানদের চিন্তাধারা ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্নমুখী।
আগেই উল্লেখ করেছি যে, একটা সংস্কারপন্থী চিন্তাধারার ভিত্তিতে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে ইংরেজী শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী ও মধ্যশ্রেণী ১৮৭০-৭১ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ যখন সবেমাত্র হামাগুড়ি দিতে শুরু করেছে, তখন কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী শ্রেণী পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত। সামগ্রিকভাবে পুরো ব্যাপারটা অনুধাবনের লক্ষ্যে অত্র পরিচ্ছদে কমন্স সভায় ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দের গৃহীত নীতি এবং অভিন্ন লক্ষ্যে বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত সমাজের বিরাজমান তিনটি চিন্তাধারা সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের উল্লেখ করতে হয়েছে। এক্ষণে আমার বিশ্বাস এই যে, ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ৪০ বছর সময়কালের মধ্যে এই যৌবনপ্রাপ্ত বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণী কত ধরনের সমিতি গঠন করেছিলো, তার বিচিত্র ইতিহাস উপস্থাপনা না করলে এতদসম্পর্কিত প্রতিবেদন অসমাপ্ত থেকে যাবে।
তাহলে মোদ্দা কথাটা দাঁড়াচ্ছে এই যে, ইতিহাসের বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মাঝ দিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তর দশকে বংগীয় এলাকার সমাজ জীবনে আমরা যে সুস্পষ্ট চিত্রটা দেখতে পাই তা’ হচ্ছে, ইংরেজ পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট কোলকাতা কেন্দ্রিক একটি পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্য শ্রেণী এবং এরই পাশাপাশি সংস্কারপন্থী মনোভাবের ভিত্তিতে সদ্য হামাগুড়ি দিতে শুরু করেছে এমন এক বাঙালি মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। এরপর জীবনযুদ্ধে শুরু হলো এই দুই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা। তবে এখানে আরও একটা বিষয় বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার। যেখানে অষ্টাদশ শতাব্দীর কোলকাতা কেন্দ্রিক এদেশীয় সুবর্ণ শ্রেণী এবং ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দের কর্ণওয়ালিশ মার্কা জমিদার শ্রেণীর মাঝ থেকে বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্যশ্রেণীর জন্ম হয়েছে, সেখানে কিন্তু বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী গঠনের পূর্ণ জন্মলগ্নে এ ধরনের দু’টি স্তর প্রায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত বলা যায়। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের গবেষক ডঃ আজিজুর রহমান মল্লিকের মন্তব্য আবারও উল্লেখ করতে হচ্ছে, “মুসলমানদের সবচাইতে বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শ্লথ অভ্যুত্থান। অথচ আধুনিককালে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীই একটি জাতির সকল প্রকার উন্নতির সোপান। ক্ষমতা হারিয়ে মুসলমানরা ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করেনি।” (বৃটিশ নীতি ও বাংলার মুসলমান : বাংলা একাডেমী ঢাকা ১৯৮২)।
কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্তের এই শ্রেণীর ভিত্তিটা যে সুদৃঢ় ছিলো তা’ নিঃসন্দেহে বলা যায়। তৎকালীন ভারত উপ-মহাদেশে ইউরোপীয় শিক্ষা-দীক্ষায় এঁরাই ছিলেন সবচেয়ে উন্নত। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শুরু করে প্রথম মহাযুদ্ধ পর্যন্ত সময়কালে এঁদের মাঝে অসংখ্য প্রতিভাবান ও মেধাবী ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হয়েছে। তৎকালীন সমাজ জীবনের প্রতিটি পেশায় এঁরা অগ্রণীর ভূমিকা পালন করে গেছেন। এঁদের কর্মকাণ্ড সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হলে, অন্যান্য ক্ষেত্রের কথা বাদ দিয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে শুরু করে ইংরেজ ও বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন সমিতি, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার নাম ও পরিচিতি উল্লেখ করলেই যথেষ্ট হবে বলে মনে হয়।
এশিয়াটিক সোসাইটি : স্যার উইলিয়াম জোনস কর্তৃক ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ই জানুয়ারী কলিকাতায় স্থাপিত। প্রথম সভায় ৩০ জনের মতো ইংরেজ উপস্থিত ছিলো। জোনস সাহেব তাঁর প্রদত্ত ভাষণে বলেন, “…..আপনারা শিক্ষিত নেটিভদের এই সমিতির সদস্য হিসেবে গ্রহণ করবেন কি-না, তা নির্ধারণ করবেন।” প্রাপ্ত রেকর্ড থেকে দেখা যায় যে, এই সোসাইটি প্রতিষ্ঠার প্রায় ৪৫ বছর পরে ১৮২৯ সালের ৭ই জানুয়ারীর সভায় এদেশীয় লোকদের সর্বপ্রথম সদস্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
আত্মীয় সভা : রাম মোহন রায় কর্তৃক ১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতায় স্থাপিত। এই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সাপ্তাহিক বৈঠকে বাল্যবিবাহ সমস্যা, জাতিভেদ সমস্যা, নিষিদ্ধ খাদ্য সমস্যা, সতীদাহ সমস্যা, বহু বিবাহ সমস্যা নিয়ে খোলাখুলিভাবে আলাপ হতো। বৈঠকের সমাপ্তিতে ব্ৰহ্মসংগীত পরিবেশিত হতো। বিশিষ্ট সদস্যদের মধ্যে ছিলেন দর্পনারায়ণ ঠাকুরের পুত্র গোপী মোহন ঠাকুর, তদীয় পুত্র প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, তেলেনীপাড়ার জমিদার অন্নদাপ্রসাদ বন্দোপাধ্যায়, টাকীর জমিদার কালীনাথ রায়, রাজনারায়ণ বসুর পিতা নন্দকিশোর বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাজা কালীশঙ্কর ঘোষাল, রাজা বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় এবং রাজা কাশীনাথ প্রমুখ।
হিন্দু কলেজ : ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দের ২০শে জানুয়ারী কলিকাতায় স্থাপিত। পরবর্তীকালে এই কলেজেরই পরিবর্তিত নাম প্রেসিডেন্সী কলেজ। প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়। ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি : রাম মোহন রায়ের উদ্যোগে ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই মাসে ‘কলিকাতায় স্থাপিত। নতুন ইংরেজী শিক্ষার উপযোগী পাঠ্যপুস্তক রচনার লক্ষ্যে এই সোসাইটি স্থাপিত হয়।
ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি : রাম মোহন রায়ের প্রচেষ্টায় ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে কলিকাতায় এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়। ইংরেজী শিক্ষার দ্রুত প্রসারের জন্য নতুন স্কুল স্থাপন এবং পুরাতন স্কুলগুলোকে ইংরেজী শিক্ষাদানের লক্ষ্যে উপযোগী করে গড়ে তোলাই এই প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ছিলো।
ইংরেজদের উদ্যোগে গঠিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানঃ মূলতঃ কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণ হিন্দুদের পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দ থেকে মধ্যবর্তী সময়ে কোলকাতায় এ ধরনের বেশ কয়েকটি ইংরেজী নামের প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা গড়ে উঠে। এগুলো হচ্ছে:
(১) লিটারেরি সোসাইটি, (২) ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরী সোসাইটি, (৩) এগ্রিকালচার এ্যাণ্ড হর্টিকালচার সোসাইটি, (৪) কমার্শিয়াল এ্যাণ্ড প্যাট্রিয়টিক এসোসিয়েশন (স্থাপিত ১৮২৮ খ্রীঃ) কোষাধ্যক্ষ ছিলেন রাম মোহন রায়, (৫) লেডিস সোসাইটি (স্থাপিত ১৮২৮ খ্রীঃ)। এই লেডিস সোসাইটি স্থাপনে ইংরেজদের সংগে যৌথভাবে ছিলেন রাজা বৈদ্যনাথ রায় এবং কাশীনাথ মল্লিক। (৬) ক্যালকাটা মেডিক্যাল এ্যাণ্ড ফিজিক্যাল সোসাইটি।
গৌড়ীয় সমাজ : সম্পূর্ণভাবে বাঙালি বর্ণ হিন্দুদের উদ্যোগে ১৮২৩ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে কোলকাতায় এই সমাজ স্থাপিত হয়। কোলকাতা হিন্দু কলেজের মতো এই প্রতিষ্ঠানের বৈঠকগুলোতে প্রগতিশীল ও রক্ষণশীল উভয় মতাদর্শের নেতৃবৃন্দ যোগদান করেছেন। একদিকে যেমন রাম মোহন রায়ের দলভুক্ত দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, কাশীনাথ মল্লিক, রাজা বৈদ্যনাথ, তাঁরাচাঁদ চক্রবর্তী প্রমুখ গৌড়ীয় সমাজের বৈঠকগুলোতে যোগ দিতেন, অন্যদিকে তেমনি হিন্দু রক্ষণশীল দলীয় রাধাকান্ত দেব, ভবানীচরণ বন্দোপাধ্যায়, রামদুলাল দে, কাশীনাথ, তর্ক পঞ্চানন প্রমুখ ব্যক্তিত্বের নিয়মিত আগমন হয়েছে। এঁরা সবাই বাঙালি সমাজ বিশেষ করে নিজেদের গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় সম্পর্কে অতিরিক্ত মাত্রায় সচেতন ছিলেন। গৌড়ীয় সমাজ ঠিক কতদিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিলো তা’ বলা সম্ভব নয়। এরমূল উদ্দেশ্য ছিলো “এদেশীয় লোকদের বিদ্যানুশীলন ও জ্ঞানোপার্জনার্থে।”
এ্যাকাডেমিক এসোসিয়েশন : ‘ইয়ং বেংগল’ গ্রুপের প্রবর্তক ও নেতা মুক্তবুদ্ধির হেনরী লুইস ডিরোজিও কোলকাতায় ১৮২৭-২৮ খ্রীষ্টাব্দে এই সমিতি স্থাপন করেন। ডিরোজিও-র বসতবাটীর বৈঠকখানায় স্থাপিত এই সমিতির বৈঠকগুলোতে মূলতঃ বিভিন্ন বিষয়ে তুমুল বিতর্ক ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হতো। ‘ইয়ং বেংগল’-এর ঘোষিত নীতি প্রতিধ্বনিত করে এঁরা ইউরোপীয় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা সামগ্রিকভাবে গ্রহণের জন্য সোচ্চার হয়। ইংরেজদের বশংবদ হিসেবে এই তরুণ গোষ্ঠীর কণ্ঠে সেদিন উচ্চারিত শ্লোগান হচ্ছে, “হিন্দুইজম নিপাত যাক”, “রক্ষণশীলতা বর্জন করো।” অন্যদের মধ্যে কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিড়ী, রাধানাথ সিকদার, প্যারীচাঁদ মিত্র, দক্ষিণারঞ্জন মজুমদার প্রমুখ এসব বিতর্কে যোগদান করতেন। এই একাডেমীর পক্ষ থেকে ‘পার্থিনন’ নামে যে মুখপত্র প্রকাশ করা হয়েছিলো, হিন্দু কলেজ কর্তৃপক্ষের হুমকিতে তা’ বন্ধ হয়ে যায়। প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় যে, এসব বিতর্ক ও আলোচনা সভায় প্রায়ই সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি এডোয়ার্ড রায়ান, ডেপুটি গভর্ণর বার্ড এবং ডেভিড হেয়ার প্রমুখ প্রায়ই যোগদান করতেন। ডিরোজিও হিন্দু কলেজের শিক্ষকতার পদ থেকে চাকরিচ্যুত হয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সে ১৮৩১ সালের ২৬শে ডিসেম্বর আত্মহত্যা করেন।
ধর্মসভা : বড়লাট লর্ড বেন্টিংক ১৮২৯ খ্রীষ্টাব্দের ৪ঠা ডিসেম্বর সতীদাহ প্রথা আইন বিরুদ্ধ ঘোষণা করলে কোলকাতায় সনাতনপন্থীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং মাত্র মাসাধিককালের মধ্যে বিধর্মী কর্তৃক এ ধরনের আনীত বিধান বানচালের লক্ষ্যে ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ই জানুয়ারী তারিখে “ধর্মসভা” নামীয় এই প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়।
ইয়ং বেংগল গ্রুপের পত্র-পত্রিকা : ডিরোজিও-র জীবদ্দশায় ‘পার্থিনন’ নামক পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলেও ‘ইয়ং বেংগল’-এর সমর্থকরা ঊনবিংশ শতাব্দীর তিরিশ দশকে অনেক পত্র-পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে হিন্দু সনাতনপন্থীদের মোকাবেলা করে। এসব পত্রিকার মধ্যে ‘হেসপারাস’, ‘ইস্ট ইণ্ডিয়ান,’ ‘রিফর্মার’, ‘এনকোয়ারার’, ‘জ্ঞানান্বেষণ’ প্রভৃতি অন্যতম। এই গ্রুপের প্রধান হাতিয়ার ছিলো পত্র-পত্রিকা আর এরই পাশাপাশি গড়ে উঠেছিলো অসংখ্য সমিতি ও প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এ সময় বাঙালি মুসলমানদের পরিচালিত কোন পত্র-পত্রিকা কিংবা সমিতি গঠনের তথ্য পাওয়া যায় না। বাঙালি মুসলমানরা এ সময় প্রথমে শিখ বিরোধী ও পরে ইংরেজ বিরোধী ওহাবী আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে জীবন উৎসর্গ করেছে।
১৮২৪ থেকে ১৮৪০ খ্রীঃ পর্যন্ত অন্যান্য সমিতি : বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য থেকে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এই ১৬ বছরে কোলকাতায় অসংখ্য সমিতি গড়ে ওঠে। এরূপ সমিতি স্থাপন এ সময় বাঙালি বর্ণ হিন্দুদের মধ্যে এক ধরনের ‘ম্যানিয়া’-তে পরিণত হয়েছিলো। নিম্নে নমুনা হিসেবে কয়েকটি নাম দেয়া হলোঃ
১। বংগহিত সভা
২। এ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান হিন্দু এসোসিয়েশন (১৮৩০ খ্রীঃ)
৩। জ্ঞানসন্দীপণ সভা (১৮৩০ খ্রীঃ)
৪। ডিবেটিং ক্লাব (১৮৩০ খ্রীঃ)
৫। বংগরঞ্জিনী সভা
৬। বিজ্ঞানদায়িনী সভা
৭। সর্বতত্ত্বদীপিকা সভা (১৮৩২ খ্রীঃ)
৮। জ্ঞানচন্দ্রোদয় সভা (১৮৩২ খ্রীঃ)
৯। সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা (১৮৩৮ খ্রীঃ)
১০। তত্ত্ব বোধিনী সভা
১১। মেকানিক্স ইনস্টিটিটিউট
১২। টিচার্স সোসাইটি (সূত্রঃ সংবাদপত্রে সেকালের কথা : ২য় খণ্ডঃ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় : কলিকাতা)
সর্বতত্ত্বদীপিকা সভা : সমসাময়িককালে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন সমিতিগুলোর মধ্যে এই একটিমাত্র সমিতির প্রধান উদ্দেশ্যই ছিলো বাংলাভাষার বিশেষ অনুশীলন করা। এই সমিতির সভাপতি ছিলেন রাম মোহন রায়ের পুত্র রমাপ্রসাদ রায় এবং সম্পাদক ছিলেন তাঁরই অকৃত্রিম বন্ধু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা : ঊনবিংশ শতাব্দীর তিরিশ দশকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সমিতি হচ্ছে এই সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা। এর পাঁচজন উদ্যোক্তা ছিলেন যথাক্রমে তারিণীচরণ বন্দোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিড়ী, তারাচাঁদ চক্রবর্তী এবং রাজকৃষ্ণ দে। তবে এঁদের প্রচারিত ম্যানিফেস্টো থেকে এটুকু অনুধাবন করা যায় যে, এ সময় ডিরোজিও-র এ্যাকাডেমিক এ্যাসোসিয়েশনের জৌলুস অনেক হ্রাস পেয়েছে। অথচ ‘জ্ঞানোপার্জিকা সভার’ প্রভাব তখন ক্রমবর্ধমান এবং ১৮৪৩ খ্রীস্টাব্দে এই সভার সদস্য সংখ্যা প্রায় ২০০ জন ছিলো। উপরন্তু এই প্রতিষ্ঠানের কার্যবিবরণীও সংকলিত হতো। এর সভাপতি ছিলেন তারাচাঁদ চক্রবর্তী এবং সম্পাদক ছিলেন রামতনু লাহিড়ী ও প্যারীচাঁদ মিত্র। বংগভাষা প্রকাশিত সভাঃ সম্ভবতঃ ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষার সরকারী নীতি ঘোষিত হবার পর ১৮৩৫ খ্রীস্টাব্দ নাগাদ এই সভা স্থাপিত হয়েছিলো। এর সভাপতি ছিলেন পণ্ডিত গৌরীশংকর তর্কবাগীশ (পরবর্তীকালে পণ্ডিত গৌরীশংকর ‘সংবাদ ভাস্কর’ পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হয়েছিলেন) এবং সম্পাদক ছিলেন পণ্ডিত দূর্গাপ্রসাদ তর্কপঞ্চানন। ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার সম্পাদক কবি ঈশ্বর গুপ্ত এবং ‘সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয়’ পত্রিকার সম্পাদক হরচন্দ্র বন্দোপধ্যায় এই সভার সদস্য ছিলেন।
তত্ত্ববোধিনী সভাঃ ১৮৩৯ সালের ৬ই অক্টোবর দ্বারকানাথ ঠাকুরের জোড়াসাঁকোর বাড়ীতে এই সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে এর নাম ছিলো ‘তত্ত্বরঞ্জিনী সভা’। পরে পণ্ডিত রামচন্দ্র বিদ্যাভাগীশের প্রস্তাবক্রমে ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ নামকরণ করা হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এর মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহর্ষির ভাষায় বলতে গেলে, “আমাদিগের উদ্দেশ্য সমুদয় শাস্ত্রের নিগূঢ় তত্ত্ব ও বেদান্ত প্রতিপাদ্য ব্রহ্মবিদ্যার প্রচার।” প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় যে, এই সভার কর্তৃপক্ষ একাধারে যেমন ইংরেজী ভাষা শিক্ষা থেকে শুরু করে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে গ্রহণ করতে আগ্রহী ছিলেন, ঠিক তেমনি দৃঢ়-তার সঙ্গে বাঙালি হিন্দু যুবকদের খ্রীস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টিরও বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু কোথাও রাজশক্তির বিরোধিতার প্রশ্ন উত্থাপিত করা হয়নি। বছর কয়েকের মধ্যে এই প্রতিষ্ঠানের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৮০০-তে দাঁড়ায়। কোলকাতায় বসবাসকারী ইংরেজী শিক্ষিত বাঙালি বিশিষ্ট হিন্দু ব্যক্তিত্ব মাত্রই এই সভার সদস্য হন। এ সময় ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশিত হলে দারুণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সাহিত্য ক্ষেত্র অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রমুখের অভ্যুদয় সর্বপ্রথম এই পত্রিকার মাধ্যমেই হয়েছিলো। কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর ভিত্তি সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে তত্ত্ববোধিনী সভার অবদান সর্বাধিক।
বিদ্যোৎসাহিনী সভা (১৮৫৩ খ্রীঃ)
ঊনবিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকে কোলকাতায় প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে গঠিত উল্লেখযোগ্য সমিতিগুলোর মধ্যে ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’ অন্যতম। বেথুন সোসাইটির পদাংক অনুসরণ করে ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কোলকাতার অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি কালীপ্রসন্ন সিংহ মহাশয়ের বসতবাটির দ্বিতলে এই সমিতি স্থাপিত হয়। ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার ১৪ই জুন তারিখের সংখ্যায় এতদসম্পর্কিত প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয় যে, “নন্দলাল সিংহ মহাশয়ের পুত্র শ্রীমান বাবু কালী প্রসন্ন সিংহ বঙ্গভাষার অনুশীলনের জন্য এক সভা করিয়াছেন।” প্রাপ্ত রেকর্ডপত্রে দেখা যায়, যেখানে সে আমলের কোলকাতার সবচেয়ে প্রভাবশালী ‘বেথুন সোসাইটির’ ব্যয়ভার সদস্যদের চাঁদায় পরিচালিত হতো, সেখানে নব্য প্রতিষ্ঠিত ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভার’ সমস্ত খরচই এই সমিতির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক কালীপ্রসন্ন সিংহ নিজেই বহন করতেন। এমনকি স্বীয় বাসগৃহে ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভার আলোচনা বৈঠকের পর উপস্থিত সদস্যদের নৈশভোজের ব্যবস্থাদিও করতেন। অবশ্য বিরুদ্ধবাদীরা এই প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেছিলেন ‘মদ্যোৎসাহিনী সভা’। তথাপি একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে— ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভার কার্যক্রম সে আমলে বেশ আলোড়নের সৃষ্টি করেছিলো। তাহলে একটা প্রশ্ন মনে জাগা স্বাভাবিক যে, যখন কোলকাতায় ‘বেথুন সোসাইটি’ বুদ্ধিজীবীর সব রকম চাহিদা মেটাতে সক্ষম সেখানে একই ধাঁচের আর একটি ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’ নামক সংস্থা স্থাপনের যৌক্তিকতা কতদূর ছিলো। এ সম্পর্কে সম্প্রতি জনৈক গবেষক-এর প্রকাশিত মতামত যথার্থ বলে মনে হয়। তিনি লিখেছেন “. তখনকার তরুণ বিদ্যোৎসাহীরা কালীপ্রসন্ন সিংহের সভায় গিয়ে যতটা স্বচ্ছন্দে আলাপ-আলোচনায় যোগদান করতে পারতেন, বেথুন সোসাইটিতে তা পারতেন না। তার প্রধান কারণ বেথুন সোসাইটিতে ইংরেজদের সংখ্যাধিক্য না থাকলেও তাঁদের প্রভাব-প্রতিপত্তি যথেষ্ট ছিল। সভার কাজকর্ম পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে পরিচালিত হত। তার শৃঙ্খলা ও সংযত পরিবেশ বাঙালিদের কাছে খুব আকর্ষণের বিষয় ছিল না। তাই বেথুন সোসাইটির খাঁটি বাঙালি সংস্করণ হয়েছিল বিদ্যোৎসাহিনী সভা। একটু ঢিলেঢালা ঘরোয়া মজলিসি পরিবেশ না হলে বাঙালিদের বিদ্বৎসভা বা সাহিত্যসভা জমতে চায় না। সেই পরিবেশটি সিংহ মহাশয় তাঁর সভায় সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর আর্থিক সামর্থ্যও ছিল এবং প্রধানতঃ তাঁর পোষকতাতেই সভা চলত। পরিবেশটা পুরো সামন্ততান্ত্রিক। সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি নানা বিষয়ে সভায় আলোচনা হত। ইংরেজী ও বাংলা, দুই ভাষাতেই আলোচনা হত, কিন্তু বাংলা ভাষায় আলোচনার দিকেই ঝোঁক বেশী।”
প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় যে, ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভার’ উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হচ্ছে নিম্নরূপ :
ক) তরুণ লেখকদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সুলিখিত প্রবন্ধ পাঠের জন্য দু’তিনশো নগদ টাকা পুরস্কার।
খ) মাঝে মাঝে কৃতী সাহিত্যিকদের সম্বর্ধনা জ্ঞাপন। এসবের মধ্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও রেভারেণ্ড ফাদার জেমস লং-এর প্রতি প্রদত্ত সম্বর্ধনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
গ) ‘বিদ্যোৎসাহিনী’ নামক পত্রিকা প্রকাশ।
ঘ) ১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দে ‘বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ’ প্রতিষ্ঠা।
ঙ) বিধবা-বিবাহ আন্দোলনকে সফল করার লক্ষ্যে কাউন্সিল-এ দরখাস্ত পাঠানো ছাড়াও এই সংস্থা থেকে প্রকাশ্যে সংবাদপত্রে এ মর্মে ঘোষণা দেয়া হয় যে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে হিন্দু বিধবা-বিবাহ করতে ইচ্ছুক যুবকদের প্রত্যেককে সংস্থার পক্ষ থেকে কালীপ্রসন্ন সিংহ মহাশয় নগদ এক হাজার টাকা করে পুরস্কার প্রদান করবেন।
পশ্চিম বাংলার প্রখ্যাত গবেষক এবং কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ডক্টর অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায় তাঁর রচিত বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত’ (৪র্থ সং) গ্রন্থে কালীপ্রসন্ন সিংহ ওরফে ‘হুতোম প্যাচা’ সম্পর্কে চমৎকার মন্তব্য করেছেন। তিনি লিখেছেন, “কালীপ্রসন্ন সিংহ (১৮৪০-১৮৭০) বাংলাদেশের এক অদ্ভুত মানুষ, অদ্ভুততর তাঁর সাহিত্য প্রতিভা। ধনী বংশে ঐশ্বর্যের ক্রোড়ে জন্মগ্রহণ করেও তিনি ধনী সমাজের কদাচারকে শাণিত ভাষায় ব্যঙ্গ করেছেন, উচ্ছৃঙ্খল আবহাওয়ার মধ্যে থেকেও সর্বদা একটি মার্জিত পরিশীলিত ভব্য মনের অধিকারী ছিলেন। অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সে তাঁর মৃত্যু না হলে কালে তিনি বঙ্কিম-বিদ্যাসাগর-মাইকেলের মতোই এক দিক্পাল ব্যক্তি হতে পারতেন।……. নিতান্ত অল্প বয়সে কালীপ্রসন্ন কোলকাতার নানা জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন, তরুণ বয়সেই প্রবীণের বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন।….. দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ নাটকের ইংরেজী অনুবাদের প্রকাশক রেভাঃ লঙগ সাহেব অভিযুক্ত হয়ে কারারুদ্ধ হন, তাঁর অর্থদণ্ডও হয়। কালীপ্রসন্ন নিজে টাকা নিয়ে আদালতে (বিলাতে) উপস্থিত ছিলেন।….. অনেক বই লিখলেও ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শার জন্যই তিনি বাংলা গদ্য সাহিত্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।”
সুহৃদ সমিতি (১৮৫৪ খ্রীঃ)
এই সমিতির কার্যক্রম থেকে একথা প্রতীয়মান হয় যে, এ সময় কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণহিন্দুদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষার প্রচলনের পর হিন্দু ধর্মকে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষিত হিন্দুদের মধ্যে গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে হিন্দু ধর্মের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও সমাজ সংস্কারক এবং বিদ্বৎসমাজ বিশেষ আগ্রহী হয়। এই প্রেক্ষাপটে সুহৃদ সমিতিকে প্রকৃত অর্থে ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত না করে অনায়াসে একটি হিন্দুসমাজ সংস্কারক প্রতিষ্ঠান বলা যায়। ১৮৫৪ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ই ডিসেম্বর তারিখে কাশীপুরের দমদম রোডস্থ কিশোরী চাঁদ মিত্রের বাসভবনে সুহৃদ সমিতি স্থাপিত হয়। এতে বক্তৃতা প্রসঙ্গে কিশোরী চাঁদ মিত্র বলেন যে, “কেবল প্রবন্ধ রচনা এবং বক্তৃতা দিয়ে কাজ হবে না। প্রাচীন ও নবীন বাঙালি সকলে মিলেমিশে একযোগে সমাজের উন্নতি বিধানের চেষ্টা করতে হবে।” এই প্রথম বৈঠকেই কিশোরী চাঁদ মিত্র এমর্মে প্রস্তাব করেন যে, (ক) স্ত্রী শিক্ষা প্রবর্তন, (খ) বিধবা-পুনর্বিবাহ, (গ) বাল্যবিবাহ বর্জন এবং (ঘ) বহুবিবাহ নিরোধের লক্ষ্যে সমিতির সদস্যদের সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে।
সম্প্রতি কোলকাতা থেকে প্রকাশিত মন্মথনাথ ঘোষ রচিত ‘কর্মবীর কিশোরী চাঁদ’ গ্রন্থের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে সুহৃদ সমিতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপিত করা হয়েছে। এতে দেখা যায় যে, এ সময় সুহৃদ সমিতি মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুরের প্রস্তাবক্রমে কোলকাতার উপকণ্ঠে স্ত্রীশিক্ষার প্রসারের জন্য একটি বালিকা বিদ্যালয় পর্যন্ত স্থাপন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলো। ফলে একথা স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা যায় যে, পরাশক্তি ইংরেজদের সম্পুরক শক্তি হিসেবে কোলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্য শ্রেণীর পুরুষরা যেভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষা এবং সভ্যতা ও কৃষ্টির অনুকরণ ও অনুসরণ করে এগিয়ে এসেছিলো, তুলনামূলকভাবে এঁদের নারী সমাজের অগ্রগতির গতি ছিলো অত্যন্ত শ্লথ। অথচ কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণ হিন্দুদের পক্ষে সর্বভারতীয় নেতৃত্ব গ্রহণের লক্ষ্যে হিন্দু নারীমুক্তি অপরিহার্য হয়ে পড়েছিলো। এজন্যই ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ হিন্দুধর্ম ও সমাজের ব্যাপক সংস্কার অপরিহার্য হয়ে পড়েছিলো। এর প্রেক্ষিতেই দেখা যায় যে, সমসাময়িককালে বাংলা ভাষার দিক্পালদের প্রায় সবাই সামগ্রিকভাবে সমাজ সংস্কারক-এর ভূমিকায় এবং বিশেষ করে বাঙালি হিন্দু নারী সমাজের মুক্তির প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। এ সব হিন্দু মনীষীদের মধ্যে অক্ষয় কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) ভূদেব মুখোপাধ্যায় (১৮২৭-১৮৯৪), প্যারী চাঁদ মিত্র ওরফে টেক চাঁদ ঠাকুর (১৮১৪-১৮৮৩), কালী প্রসন্ন সিংহ (১৮৪০-১৮৭০), দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫), রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় (১৮২৭-১৮৮৭), বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) প্রমুখ অন্যতম।
সুহৃদ সমিতি সম্পর্কে গবেষক বিনয় ঘোষের মন্তব্যের বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। তিনি লিখেছেন, “….. সুহৃদ সমিতি প্রধানত সামাজিক সভারূপেই স্থাপিত হয়েছিল, বিদ্বৎসভা রূপে নয়। কোনো বিষয় নিয়ে বিদ্বৎসভার মতো আলোচনা বা প্রবন্ধ পাঠ করা যে সুহৃদ সমিতিতে হত না তা নয়, কিন্তু সামাজিক সুনীতি ও সত্যাচরণের আদর্শ প্রচার করাই ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য। এক কথায় বলা যায়, বিদ্যাসাগর যুগের বিদ্বৎসভার সঙ্গে সামাজিক সভার খুব বেশী পার্থক্য ছিল না। নতুন জ্ঞান বিদ্যার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামাজিক উন্নতি ও কল্যাণের অনুভূতি তখন প্রায় এক হয়ে মিশে গিয়েছিল। অবশ্য সেটা মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের সমাজের উন্নতি ও কল্যাণ।“
ফ্যামিলি লিটারারী ক্লাব (১৮৫৭) খ্রীঃ
সমগ্র উত্তর ও পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলব্যাপী সিপাহী বিপ্লবের ভয়াবহ রণদামামা শুরু হয়ে গেছে ঠিক সেই সময়ে ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসে খ্রীষ্টান ধর্মে দীক্ষিত রেভারেণ্ড কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়ের উদ্যোগে ‘ফ্যামিলী লিটারারী ক্লাব’ গঠিত হয়। সে আমলে কোলকাতার প্রখ্যাত ব্যক্তিদের বসতবাটিতে চক্রাকারে এই ক্লাবের বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো। এসব বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য ও সামাজিক বিষয়ে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে আলোচনা করা হতো এবং প্রায়ঃশই সদস্যদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হতো। যেকোন বুদ্ধিজীবীর পক্ষে এই ক্লাবের সদস্যপদ লাভে বিশেষ অসুবিধা ছিলো না। ব্যারিস্টার উড, স্যার রিচার্ড টেম্পল, রেভারেণ্ড ডল, রেভারেণ্ড মুলেন্স প্রমুখ ইংরেজরা প্রায়ই এই ফ্যামিলী লিটারারী ক্লাবের বৈঠকে যোগদান করে আলোচনায় অংশগ্রহণ করতেন।
১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের রক্তাক্ত সিপাহী বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে ইংরেজ পৃষ্ঠপোষকতায় কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্যশ্রেণীর জন্য এটা এমন একটা সময় যখন নিজেদের গোষ্ঠী ও শ্রেণীকে প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি একটা সর্বভারতীয় নেতৃত্ব গ্রহণের উদগ্র বাসনায় এঁদের নেতৃবৃন্দ মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে। হিন্দু-মুসলমানদের মিলিত উদ্যোগে সংগঠিত হওয়া সত্ত্বেও সিপাহী বিপ্লবের সমস্ত রকম উত্তাপ পর্যন্ত এঁরা সযত্নে পরিহার করেছিল। এজন্যই অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায় যে, সুহৃদ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা কিশোরী চাঁদ মিত্র, সম্ভুনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বাঙালি মনীষীদের বক্তব্য হচ্ছে, “সিপাহী বিদ্রোহ হচ্ছে সিপাহীদের ব্যাপার এবং এর সঙ্গে জনসাধারণের কোন সংশ্রবই নেই।”
এখানেই শেষ নয়। কবি ঈশ্বর গুপ্ত সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’ এবং পণ্ডিত গৌরী শংকর ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘সম্বাদ ভাস্কর’ প্রভৃতি বিশিষ্ট সংবাদপত্রগুলো এ সময় তীব্র ভাষায় সিপাহী বিপ্লবের নিন্দা জ্ঞাপন (বিস্তারিত সম্পাদকীয় মন্তব্য ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে) করেন। উপরন্তু ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের ২৬শে মে তারিখে হিন্দু মেট্রোপলিটান কলেজ প্রাঙ্গণে আয়োজিত প্রকাশ্য সভায় সিপাহীদের কর্মকাণ্ডের জন্য তীব্র নিন্দা করা ছাড়াও ইংরেজদের সমর্থনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বক্তৃতাদানের পর প্রস্তাব পাস করা হয়। রাজা রাধাকান্ত দেব-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভার’ প্রতিষ্ঠাতা কালী প্রসন্ন সিংহ এবং কোলকাতার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হরেন্দ্র চন্দ্র প্রমুখ ইংরেজদের পক্ষে জ্বালাময়ী বক্তৃতাদান করেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কোলকাতায় রাজশক্তি ইংরেজদের সক্রিয় সহযোগিতায় বুদ্ধিজীবীদের আরও যেসব সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, সে সবের মধ্যে ‘বড় বাজার গার্হস্থ্য সমাজ’ এবং ‘বঙ্গীয় সমাজ বিজ্ঞান’ সভার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বড়বাজার গার্হস্থ সাহিত্য সমাজ (১৮৫৭ খ্রীঃ)
বাংলা ১২৬৪ সালে অর্থাৎ ১৮৫৭ খ্রীস্টাব্দে যখন সমগ্র উত্তর ও পূর্ব ভারতে সিপাই বিপ্লবের বহ্নিশিখা প্রজ্বলিত হয়েছিলো এবং যখন হাজার হাজার দেশপ্রেমিক এই বিপ্লবের বহ্নিশিখায় আত্মাহুতি দিচ্ছিলো, ঠিক তখনই বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী প্রসাদ দাস মল্লিকের উদ্যোগে কোলকাতার জোড়াসাঁকোতে ‘বড়বাজার গার্হস্থ্য সাহিত্য সমাজ’ স্থাপিত হয়। এর প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান করেছিলেন বড়বাজারের রতন সরকার গার্ডেন স্ট্রিট-এর উঠতি ব্যবসায়ী গোষ্ঠবিহারী মল্লিক। প্রাপ্ত নথিপত্রে দেখা যায় যে, ‘গার্হস্থ্য সাহিত্য সমাজ’-এর প্রতিষ্ঠাকালে সম্পাদক ছিলেন স্বয়ং প্রসাদ দাস মল্লিক এবং ১৮৫৯ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৮৬৭ খ্রীষ্টাবদ পর্যন্ত পাক্কা ন’বছর ইংরেজ পাদ্রী রেভারেণ্ড জেমস লংএর সভাপতির পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই সাহিত্য সমাজের উদ্যোগে প্রতিমাসেই নিয়মিতভাবে ইংরেজী ও বাংলায় প্রবন্ধ পাঠ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো। এমনকি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে প্রবন্ধ রচনার জন্য পুরস্কার প্রদান ছাড়াও প্রবন্ধগুলো পুস্তকাকারে ছাপিয়ে বিতরণ করার ব্যবস্থা পর্যন্ত করা হয়েছিল। সম্ভবতঃ অর্থপ্রাপ্তির সুবিধার লক্ষ্যে সুবর্ণ বণিক গোষ্ঠবিহারী মল্লিক মহাশয়কে প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদক পদে রাখা হয়েছিল। এই ‘সাহিত্য সমাজ’-এর পক্ষ থেকে কোলকাতায় মাঝে-মধ্যে বিশিষ্ট গুণী ব্যক্তিদের সম্বর্ধনা প্রদানের রেওয়াজ চালু করা হয়েছিল। এছাড়া ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠানের এককালীন সভাপতি ইংরেজ মিশনারী পাদ্রী জেমস লং-এর বিলাত প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে আয়োজিত বিদায় সম্বর্ধনায় ইংরেজীতে লেখা যে অভিনন্দনপত্র দেয়া হয় এবং ফাদার লং লিখিতভাবে তার যে জবাব পাঠ করেছিলেন তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অভিনন্দনপত্রে বলা হয় যে,
আমাদের বাংলা সাহিত্যের উন্নতিকল্পে নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে আপনি যেভাবে এই দেশের সামগ্রিক শ্রীবৃদ্ধির লক্ষ্যে অবদান রেখেছেন, তার মূল্যায়ন করা আমাদের পক্ষে সম্ভবপর নয়। আপনার প্রায় সমগ্র জীবনের সাধনা দিয়ে আপনি বাঙলার রায়ত শ্রেণী ও নারী জাতির দৈনন্দিন কথাবার্তায় ব্যবহৃত বহু প্রবাদ বাক্য ও কৌতুক সংগ্রহপূর্বক আমাদের পারিবারিক জীবনযাত্রার চিত্র পাশ্চাত্য সভ্য জগতের সম্মুখে যেভাবে উপস্থাপিত করেছেন, তা বহু ভারতীয় গবেষকের পক্ষে সম্ভব নয়।… …।”
প্রদত্ত অভিনন্দনপত্রের জবাবদানকালে জেমস লং বলেন, “… … বাঙলায় একটা পরিবর্তন আসন্ন হয়ে উঠেছে। সুখের বিষয় এই যে, বাঙলা ভাষা তার পুরানো সংস্কৃত স্টাইল পরিহার করতে শুরু করেছে এবং নতুন রূপ গ্রহণ করছে। আমার বিশ্বাস বাঙালি বন্ধুরা এই শিক্ষা গ্রহণ করেছে যে, শুধু ‘কথার’ মানুষ না হয়ে ‘কর্মের’ মানুষ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আজ সবচেয়ে বেশী।… …।”
বঙ্গীয় সমাজবিজ্ঞান সভা ১৮৬৭ খ্রীঃ
১৮৬৭ খ্রীষ্টাব্দের ২২শে জানুয়ারী কোলকাতায় ‘বঙ্গীয় সমাজবিজ্ঞান সভা’ প্রতিষ্ঠিত হলেও এর পূর্ব ইতিহাস রয়েছে। ইংরেজ মিশনারী রেভারেণ্ড জেমস লং সাহেব এ সময় বেশ কিছুদিন ধরেই কোলকাতায় সমাজবিজ্ঞান চর্চা সম্পর্কে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের উৎসাহিত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু এতে বিশেষ সাড়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত ইংল্যাণ্ড থেকে সদ্য আগত কুমারী কার্পেন্টার নামীয় জনৈকা ইংরেজ মহিলা এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁরই উদ্যোগে ১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ই ডিসেম্বর কোলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে এক সভার আয়োজন করা হয়। সভায় কোলকাতায় বসবাসকারী বিশিষ্ট ইংরেজ ও এদেশীয় বুদ্ধিজীবীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো। কুমারী কার্পেন্টার উল্লেখিত সভায় ‘গ্রেট বৃটেনস্থ সমাজবিজ্ঞান উন্নয়নের জাতীয় সমিতির” শাখা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাঙলাদেশে একটি সমাজবিজ্ঞান সভা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। ফলে উপস্থিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবটি বিবেচনা এবং প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানের খসড়া পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য ১৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। এঁরা হচ্ছেন রেভারেণ্ড লং, জাস্টিস নর্মান, জাস্টিস ফিয়ার, সীডান কার, ই সি বেইলী, আর্থার গ্রোট, এ্যাটকিনসন, ফার্কুয়ার, ম্যাকেনজি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্যারীচাঁদ মিত্র, ক্ষেত্রমোহন চ্যাটার্জী, রামচন্দ্র মিত্র, কেশবচন্দ্র সেন, মনোমোহন ঘোষ এবং রাজেন্দ্রলাল মিত্র। কমিটি বৃটেনের সমাজবিজ্ঞান সমিতির এ দেশীয় শাখা সংস্থাপনের প্রস্তাবের ঘোর বিরোধিতা করে কোলকাতায় একটি স্বতন্ত্র সামাজবিজ্ঞান সমিতি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উপস্থাপিত করে। ফলে ১৮৬৭ খ্রীষ্টাব্দের ২২শে জানুয়ারী মেটকাফ হলে আহূত সাধারণ সভায় ‘বঙ্গীয় সমাজবিজ্ঞান সভা’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
সাধারণ সভায় গৃহীত প্রস্তাবে আরও বলা হয় যে, প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানের ৪টি বিভাগ থাকবে। এগুলো হচ্ছে, যথাক্রমে আইন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অর্থনীতি ও বাণিজ্য। প্রতিটি বিভাগ কি কি বিষয়ে অনুসন্ধান করবে, সে সম্পর্কে পৃথক পৃথক সার্কুলার তৈরী করে বিতরণ করা হয়েছিলো।
এ সময় কোলকাতায় বাঙালি বর্ণহিন্দু বুদ্বিজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে নানা ধরনের সমিতি ও প্রতিষ্ঠান স্থাপনের হিড়িক পড়ে গিয়েছিলো। এ সম্পর্কে ঔপন্যাসিক বঙ্কিম চন্দ্র চটেটাপাধ্যায় তাঁর গুরু ও পথপ্রদর্শক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের উল্লেখ করে লিখেছিলেন, “সৌভাগ্যক্রমে তিনি আজিকার দিনে বাঁচিয়া নাই; তাহা হইলে সভার জ্বালায় ব্যতিব্যস্ত হইতেন। রামবঙ্গিনী, শ্যামতরঙ্গিনী, নববাহিনী, ভবদাহিনী প্রভৃতি সভার জ্বালায়, তিনি কলিকাতা ছাড়িতেন সন্দেহ নাই। কলিকাতা ছাড়িলেও নিষ্কৃতি পাইতেন, এমন নহে। গ্রামে গেলে দেখিতেন, সভাসকল সভ্য সংগ্রহের জন্য আকুল হইয়া বেড়াইতেছে।” (বঙ্কিম রচনাবলী, বিবিধ খণ্ড ১২৯২ বঙ্গাব্দ, ১৮৮৫ খ্রীঃ)
কোলকাতায় পাঠাগার স্থাপনের হিড়িক
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী সমাজ পরিপক্বতা লাভের লক্ষ্যে ইংরেজদের সক্রিয় সহযোতিার ভিত্তিতে যখন একটার পর একটা সমিতি ও প্রতিষ্ঠান গঠন করেছিলো তখন ঠিক তারই পাশাপাশি গড়ে উঠেছিলো বাংলা নাট্য আন্দোলন এবং পাঠাগার প্রতিষ্ঠার জোয়ার। বাংলা নাটকের মুক্তি সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোচনা করায় এক্ষণে সে আমলে কোলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় স্থাপিত কিছু সংখ্যক গ্রন্থাগার বা পাঠাগারের নাম ও পরিচিতির উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছি। এসবের মধ্যে রয়েছে জাতীয় গ্রন্থাগার (১৮৩৬ খ্রীঃ), মেদেনীপুরের রাজনারায়ণ পাঠাগার (১৮৫২ খ্রীঃ), কোন্ননগর পাবলিক লাইব্রেরী (১৮৫৮ খ্রীঃ), উত্তরপাড়া পাবলিক লাইব্রেরী (১৮৫৯ খ্রীঃ), শ্রীরামপুর পাবলিক লাইব্রেরী (১৮৭১ খ্রীঃ), ইউনাইটেড রিডিং রুমস (১৮৭২ খ্রীঃ), চন্দননগর পুস্তকাগার (১৯৭৩ খ্রীঃ), শিবপুর পাবলিক লাইব্রেরী (১৮৭৪ খ্রীঃ), তালতলা পাবলিক লাইব্রেরী (১৮৮২ খ্রীঃ), বাগবাজার রিডিংলাইব্রেরী (১৮৮৩ খ্রীঃ), কুমারটুলি ইনস্টিটিউট (১৮৮৪ খ্রীঃ), বালি সাধারণ পাঠাগার (১৮৮৫ খ্রীঃ), চৈতন্য লাইব্রেরী (১৮৮৯ খ্রীঃ), আশুতোষ মেমোরিয়াল লাইব্রেরী (১৮৯১ খ্রীঃ), ভারতী পরিষদ (১৮৯০ খ্রীঃ) এবং বাঁশবেড়িয়া পাবলিক লাইব্রেরী (১৮৯১ খ্রীঃ)।
কিন্তু সভা, সমিতি এবং পাঠাগার স্থাপনের যে ইতিহাসই রচনা করি না কেনো, কোলকাতায় সবচেয়ে প্রথমে এ ধরনের যে প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হয়েছিল, তার নাম হচ্ছে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ (১৭৮৪ খ্রীঃ)। এই প্রতিষ্ঠান স্থাপনের সমস্ত উদ্যোগটাই হচ্ছে, কোলকাতানিবাসী ইংরেজদের। এঁদের নেতৃস্থানীয় ছিলেন সুপণ্ডিত স্যার উইলিয়াম জোনস। ১৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ই জানুয়ারী তারিখে স্যার উইলিয়াম-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রথম সভায় ৩০ জন ইংরেজ যোগদান করেছিলেন। বক্তৃতা প্রসংগে তিনি বলেন যে, “এর (সোসাইটির) সদস্য হিসেবে নেটিভ শিক্ষিতদের গ্রহণ করা হবে কিনা, সে সিদ্ধান্ত আপনারাই গ্রহণ করবেন।”
এশিয়াটিক সোসাইটিতে নেটিভদের সদস্য হিসাবে গ্রহণের জন্য প্রায় ৪৫ বছরের প্রয়োজন হয়েছিলো। ১৮২৯ সালের ৭ই জানুয়ারীর বৈঠকে এদেশীয় শিক্ষিত ব্যক্তিদের সদস্য পদ প্রদানের প্রস্তাব গৃহীত হয়।