ভারতীয় জাতীয়তাবোধে হিন্দু প্রবণতা
পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ১৮৫৭ সালের ‘সিপাহী বিদ্রোহের’ বছর থেকে শুরু করে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত এই ৪৮ বছরকাল সময়ে ইংরেজ রাজত্বে, বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস খুবই চাঞ্চল্যকর। ১৮৫৭ সালে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের ‘দালালী করেছে এবং ১৮৮৫ সাল নাগাদ শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারের সমীপে ‘বিনীতভাবে দাবী-দাওয়া উত্থাপন এবং ‘আত্মনির্ভর’ হওয়ার লক্ষ্যে বোম্বাই-এর নব্যসৃষ্ট গুজরাটি ও মারাঠি শিল্পপতিদের সঙ্গে মিলিত হয়ে “ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস” গঠন করেছে, তাঁরাই আবার ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন-এর বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নের দরুন স্বীয় শ্রেণী ও গোষ্ঠীস্বার্থে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বাঙালি হিন্দু যুবসমাজকে ইংরেজ-বিরোধী সন্ত্রাসবাদ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ইন্ধন যুগিয়েছে।
এখানে আবার উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দ থেকে শুরু করে পরবর্তী বছরগুলোতে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের সম্পূরক শক্তি হিসেবে ভূমিকা পালনের মাধ্যমে নিজেদের শ্রেণী ও গোষ্ঠীকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে এবং বাল্য ও কৈশোর উত্তীর্ণের পর যৌবনে পদার্পণ করেছে। কিন্তু এঁরা বাঙালি তথা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে ‘ইচ্ছাকৃত’ অথবা ‘অনিচ্ছাকৃত’ যেভাবেই হোক না কেন, জলাঞ্জলি দিয়েছে। এজন্যই তো শ্রী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় ১৯০৫ সালে এসেও ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের’ একটা পরিচ্ছন্ন সংজ্ঞা খুঁজে না পেয়ে উদ্ভ্রান্ত হয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত গবেষক শ্রী বিনয় ঘোষ তাঁর ‘বাংলার নবজাগৃতি’ গ্রন্থে (ওরিয়েন্ট লং ম্যানঃ কলিকাতা) (১৯৪৯:২ সং) এই অবস্থাটার বর্ণনা দিয়েছেন। “সেই জন্যই ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগৃতি আন্দোলনের পুরোগামী শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং বাংলার উদীয়মান হিন্দুপ্রধান বুর্জোয়া শ্রেণী। একটা হিন্দু প্রধান ভাবধারা সেই কারণেই কখনও ক্ষীণ, কখনও প্রবল বেগে, বাংলার নবজাগৃতি আন্দোলনের ভিতরে দিয়ে অন্তঃসলিলার মতন প্রবাহিত হয়ে গেছে। • বাঙালির নবজাগৃতি তাই সমগ্র ভারতের নবজাগৃতির উদ্দেশ্য সার্থক হয়নি” (পৃঃ ৭৬) এ সম্পর্কে তিনি আরও বলেছেন যে, “বাংলার নবজাগৃতি আন্দোলনের পুরোটা হিন্দুপ্রধান উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণী, নব্যশিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্ৰেণী।”
১১৮ বছর পর ইংরেজদের সংগে প্রথম মনোমালিন্য
তথাপিও শেষ পর্যন্ত পলাশী যুদ্ধের প্রায় ১১৮ বছর পর ১৮৭৬ সাল (মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ভারত সম্রাজ্ঞী উপাধি গ্রহণ) নাগাদ সর্বপ্রথম কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর একাংশের সংগে রাজশক্তি ইংরেজদের প্রকাশ্যে মনোমালিন্য দেখা দেয়। রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন বড়লাট লর্ড লিটন এই ১৮৭৬ সালেই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অথচ নিন্দনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এগুলো হচ্ছে ১. নাটক নিয়ন্ত্রণ আইন ২. ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট এবং ৩. অস্ত্র আইন।
অতএব এই প্রেক্ষাপটে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ১৮৭৬ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী ৩০ বছর পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯০৫ সাল পর্যন্ত এতদঞ্চলের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সম্পর্কে শ্রী বিনয় ঘোষ যথার্থই বলেছেন, “তাহলে দেখা যাচ্ছে, প্রধানতঃ বৃটিশ কূটকৌশলের জন্য এবং আংশিকভাবে মুসলমান সমাজের আত্মাভিমান, অসহযোগিতা ও গোঁড়ামির ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণী ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে হিন্দুদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলার বুর্জোয়া শ্রেণী, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী আজও তাই হিন্দুপ্রধান (পশ্চিম বাংলার)। তাই হিন্দুপ্রধান বাঙালি বুর্জোয়া শ্রেণী ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীই বাংলার নবজাগৃতি আন্দোলন এবং জাতীয় আন্দোলনের (?) অগ্রদূত এবং তা প্রধান হিন্দু সমাজের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত”। (বাংলার নবজাগৃতি (১৯৪৮): বিনয় ঘোষঃ ওরিয়েন্ট লংম্যানঃ কলিকাতা)
এই প্রেক্ষাপটে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ২৫/৩০ বছরে উপমহাদেশে সংগঠিত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলী বিশেষভাবে ব্যাখার দাবী রাখে। কেননা, এই বছরগুলোই হচ্ছে ইংরেজ পরাশক্তির সংগে হিন্দু বাঙালি মধ্যশ্রেণী তথা হিন্দু ভারতীয় উচ্চ বর্ণের ‘দর কষাকষি’ এবং ‘মনোমালিন্যের’ যুগ। এ সম্পর্কে আগেই কিঞ্চিৎ আলোকপাত করেছি।
এখানে একটা ব্যাপার বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি মধ্য শ্রেণী ও বুদ্ধিজীবী মহল যখন ‘ইলবার্ট বিল’ (১৮৮২), জমিদারদের দাবী-দাওয়া, আইসিএস পরীক্ষা দেয়ার জন্য বয়ঃসীমা বৃদ্ধি, সরকারী চাকরিতে আরোও অধিকসংখ্যক ভারতীয়দের গ্রহণ, মনোনয়ন প্রথার মাধ্যমে স্থানীয় সরকার গঠনের অধিকার দান, ইংরেজী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার এবং ভাইসরয় কাউন্সিলে ভারতীয় প্রতিনিধি গ্রহণের দাবীতে সোচ্চার, তখন বোম্বাই কেন্দ্রিক উঠতি গুজরাটি এবং মারাঠি শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী দল বৃটেনের ল্যাংকাশায়ারের কাপড়ের কলগুলোর সংগে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। ১৮৭৯ সালে ল্যাংকাশায়ার-এর কাপড়ের কলগুলোকে পরোক্ষভাবে সহায়তার উদ্দেশ্যে ভারত সরকার কর্তৃক সমস্ত ট্যারিফ ডিউটি প্রত্যাহার এবং ১৮৯৫ সাল নাগাদ ভারতে তৈরী সকল ধরনের কাপড়ের উপর শতকরা পাঁচভাগ কর ধার্য করলে বিশেষ করে বোম্বের উঠতি শিল্পপতিরা প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। আগেই বলা হয়েছে যে, ইংরেজ পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম হলেও সর্বভারতীয়ভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক বছরগুলোতে একদিকে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও বাঙালি জমিদার শ্রেণী এবং অন্যদিকে বোম্বাই এলাকার উঠতি শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের অপরূপ মিলন সাধিত হয়েছিলো।
এটা এমন একটা সময় ছিলো, যখন প্রাক্তন আইসিএস সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী বাঙালি হিন্দু মধ্যশ্রেণী ও বুদ্ধিজীবী মহলের শ্রেণীস্বার্থে বিভিন্ন দাবী আদায়ের জন্য কোলকাতায় একটার পর একটা আন্দোলন পরিচালনা করেছেন এবং এরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে অল্প সময়ের ব্যবধানে বোম্বাই নগরীতেও গোপাল কৃষ্ণ গোখলে এবং বাল গংগাধর তিলক-এর প্রতিবাদী কন্ঠস্বরও উত্থাপিত হচ্ছে। ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী নানা সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ড করেও এঁদের সন্তুষ্ট রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।
এখানে একটা প্রশ্নের অবতারণা প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। বিশ্বের ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, যে কোন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে জাতীয় চেতনাবোধ তথা জাতীয়তাবাদে জাগ্রত করার লক্ষ্যে একটি বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য, এই বিষয়টি হচ্ছে সেই জাতির অতীত কিংবা বর্তমান ইতিহাস থেকে এক বা একাধিক সর্বজনস্বীকৃত ব্যক্তিত্বের বীরগাঁথার বহুল প্রচার। আলোচ্য জাতির সাহিত্য-সংস্কৃতি, নাটক-উপন্যাস এবং কাব্য সর্বত্রই এসব ব্যক্তিত্বের বিভিন্নমুখী প্রতিভার জয়গানে মুখরিত করে উপস্থাপনা করাটাই, স্বভাবসিদ্ধ ব্যাপার। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বলতে হয় যে, অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে (ইংরেজ আমলে) যখন পরাশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় কোলকাতাকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশের সর্বপ্রথম বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্যশ্রেণীর ক্রমবিকাশ হয়, তখন এঁরা বাঙালি হিন্দুর ইতিহাস থেকে সর্বজনস্বীকৃত এ ধরনের একটা ব্যক্তিত্ব খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বাঙালিত্বের (?) শ্লোগান উচ্চারণ করে এঁরা যে বাঙালি হিন্দু জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি করেছিলেন, তার স্থায়িত্ব বৃদ্ধি এবং সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে এঁদের সুদূর রাজপুতনা থেকে একাধিক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে খুঁজে আনতে হয়েছিলো। ইতিহাস এর সাক্ষ্য দেয়।
এ ব্যাপারে লেঃ কর্ণেল জেমস টড (১৭৫২-১৮৩৫) নামক জনৈক ইংরেজ সামরিক কর্মচারী রাজপুত শৌর্য-বীর্য কাহিনী সম্বলিত ‘এ্যানালস এ্যাণ্ড এ্যান্টিক্স অব রাজস্থান’ নামীয় পুস্তক রচনা করায় কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ‘আলোকবর্তিকার সন্ধান লাভ করে। এক কথায় বলতে গেলে এই পুস্তক সর্বপ্রথম ইংরেজী ভাষায় প্রকাশিত হবার পর থেকেই তৎকালীন কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, কবি, সঙ্গীত-রচয়িতা এবং সাহিত্যিকদের মধ্যে ‘আনন্দের হিল্লোল’ বয়ে যায়। কারণ ছিলো একটাই এবং তা হচ্ছে ‘হিন্দু’ জাতীয়তাবাদ-এর ভিত্তি সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে রানা প্রতাপ সিংহের মতো ব্যক্তিত্বের সন্ধান লাভ। এজন্যেই সে আমলের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে প্রায় শতবর্ষ পর্যন্ত প্রতাপ সিংহ এবং মেবার কাহিনী এতো বেশী প্রাধান্য লাভ করেছে। বাংলা নাটক ও উপন্যাসে বাঙালি হিন্দু লেখকসমাজ রাজপুত চরিত্রের গুণকীর্তন এবং শৌর্য-বীর্যের বীরগাথা উপস্থাপনা কিংবা বর্ণনা করতে যেয়ে এতো বেশী ‘উত্তেজিত’ ছিলেন যে, তাঁরা ইতিহাসকে নিজেদের লেখার প্রয়োজনে যথেচ্ছভাবে বিকৃত করেছেন এবং প্রায়শঃই তার স্বীকৃতি পর্যন্ত দিতে দ্বিধাবোধ করেননি।
আশ্চর্যের বিষয় এই যে, প্রায় ১৩৩ বছরে জেমস টড-এর এই বইটি ইংরেজী ভাষায় মাত্র তিনটি সংস্করণ (পারসিভাল স্পীয়ারঃ এ হিস্টরী অব ইণ্ডিয়া (২): পেংগুইন বুকস লণ্ডন ১৯৮২ পৃঃ ১৬৭) প্রকাশিত হলেও ভারতীয়, বিশেষ করে বাংলা ভাষায় এর অসংখ্য অননুমোদিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতে এবং বাংলায় এটাই ছিলো সর্বাধিক প্রচারিত পুস্তক।
জেমস টড-এর আলোচ্য বইটি প্রকাশিত হবার স্বল্পদিনের মধ্যেই কোলকাতার বুদ্ধিজীবী মহলে দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি হলে ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকেই (?) শ্রী বরদাকান্ত মিত্ৰ সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় এর অনুবাদ করেন এবং ‘রাজস্থানের ইতিবৃত্ত’ নামে বইটি প্রকাশিত হয়। এরপরেই ‘রাজস্থান’ এই একই নামে বাংলায় আরো দু’টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। রচয়িতা ছিলেন যথাক্রমে শ্রী অঘোরনাথ বরাট এবং শ্রী উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। এর পর পরই রাজপুত শৌর্য-বীর্যের জয়গান করে বাংলা ভাষায় উপন্যাস ও নাটক ইত্যাদি পুস্তক প্রকাশের হিড়িক পড়ে যায়। কবি রঙ্গলালের ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৬১), হরলাল রায়ের ‘হেমলতা’ (১৮৭৩), জ্যোতিবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সরোজিনী’ (১৮৭৫) এবং ‘অশ্রুমতি’ (১৮৭৯), গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘আনন্দে রহো’ (১৮৮১), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘রাজসিংহ’ (১৮৮২), গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘রানা প্রতাপ’ (অসম্পূর্ণ :১৯০৪), ডি, এল রায়-এর ‘রানা প্রতাপ’ সিহং’ (১৯০৫), ‘দুর্গাদাস’ (১৯০৬) এবং ‘মেবার পতন’ (১৯০৮), ক্ষীরোদ প্রসাদ-এর পদ্মিনী ১৯০৬ এবং নিশিকান্ত বসুর ‘বাপ্পারাও’ (১৯১৪) প্রভৃতি নাটক ও উপন্যাস-এর সবগুলোই জেমস টডের আলোচ্য রাজস্থান বইটির কাহিনী ও উপাখ্যানকে ভিত্তি করেই রচিত হয়েছে।
একমাত্র মাইকেল মধুসূদন-এর ‘কৃষ্ণকুমারী’ (যদিও কোলকাতার বেলগাছিয়া নাট্যশালার কর্মকর্তাদের নির্দেশে মুসলিম চরিত্র-ভিত্তিক ‘রিজিয়া’ নাটককে বাদ দিয়ে এটি রচিত) ব্যতিক্রমধর্মী নাটকটি ছাড়া উপরে বর্ণিত সমস্ত সাহিত্যকর্মের একমাত্র লক্ষ্যই ছিলো রাজপুত ব্যক্তিত্বগুলোকে মহান ও শক্তিধর হিসেবে চিত্রিত করে ‘হিন্দু জাতীয়তাবোধকে জাগ্রত করা।
অথচ ন্যায়তই একথা উল্লেখ করতে হয় যে, রাজপুতনার পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্যগুলোর জন্য ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী কৃতক নিযুক্ত তৎকালীন পলিটিক্যাল এজেন্ট লেঃ কর্ণেল জেমস টড-এর লিখিত আলোচ্য গ্রন্থটি ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীর সহায়ক হিসেবে অত্যন্ত সাফল্যজনকভাবে ভূমিকা পালন করেছে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ১৮১৭ সাল থেকে ১৮২৩ সালের মধ্যবর্তী সময়কালে রাজস্থানের ছোট-বড় রাজপুত রাজ্যগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে ইংরেজের ‘আশ্রিত রাজ্যে’ পরিণত হয় এবং ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের আশ্রয় লাভ করে। এটাই হচ্ছে ঐতিহাসিক সত্য।
“লর্ড হেস্টিংস-এর মন্তব্য অনুযায়ী যেসব রাজপুত রাজ্যগুলো কোম্পানীর ‘স্বাভাবাবিক মিত্র’ ছিলো, সে সব রাজপুত রাজ্যগুলো আশ্রিতদের জন্য এভাবেই তাঁদের স্বাধীনতা বিসর্জন দিলো এবং বৃটিশ কর্তৃত্বকে গ্রহণ করলো।”
(এ্যান এ্যাডভান্স হিস্ট্রি অব ইণ্ডিয়া : মজুমদার, রায় চৌধুরী এবং দত্ত : নিউইয়র্ক (১৯৬৫) পূং ৭২৭ )
এ ধরনের একটা প্রেক্ষাপটে জেমস টড রচিত সুবৃহৎ ‘এ্যানালস এ্যাণ্ড এ্যান্টিক্স অব রাজস্থান’ বইটির মূল বক্তব্য ও উপস্থাপনা সম্পর্কে আরও কিঞ্চিৎ আলোচনা করা বাঞ্ছনীয় মনে করছি। কেননা, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে শুরু করে প্রায় শতবর্ষ পর্যন্ত যে বইটির উপাদান বাংলা সাহিত্যের দিকপালদের মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিলো, তা নিশ্চিতভাবে দীর্ঘ আলোচনার দাবীদার। প্রথমেই বলতে হয় যে, জেমস টড জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে প্রবেশ করেননি। গবেষক, লেখক কিংবা ইতিহাসবিদ হিসেবেও তার কোনও পরিচয় পাওয়া যায়নি। একজন সামরিক কর্মচারী হিসেবে কর্মজীবনের অনেকগুলো বছর তিনি রণক্ষেত্রে অতিবাহিত করার পর কূটনীতিক হিসেবে রাজস্থানে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নিজে কোথাও ঐতিহাসিকের কৃতিত্ব কিংবা মর্যাদাও দাবী করেননি।
রাজপুতনা অঞ্চলে প্রচলিত চারণগীতি এবং মধ্যযুগে রাজস্থানী ভাষায় রচিত কয়েকটি কাব্য-গাঁথাকে ভিত্তি করে জেমস টড তাঁর এই বিতর্কিত বিরাট গ্রন্থ রচনা করেছেন। এতে রাজপুত জাতির সমগ্র ইতিহাস অনুপস্থিত। প্রকৃতপক্ষে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে যেসব রাজপুত রাজ্যের অস্তিত্ব বজায় ছিলো, টড শুধু তাদেরই কাহিনী বর্ণনা করেছেন। এ সব রাজ্যের মধ্যে মেবারের গল্প কাহিনী এই গ্রন্থে প্রাধান্য লাভ করেছে। মোগলদের আক্রমণের বিরুদ্ধে মেবারের রাজন্যবর্গের দীর্ঘকালব্যাপী লড়াই-এর ঘটনাবলী ইংরেজ লেখক টড তাঁর গন্থে অনন্যসাধারণ দৃষ্টিভংগীতে উচ্চ মর্যাদার আসনে অভিষিক্ত করেছেন। অথচ জেমস টড মারাঠাদের আক্রমণে বিপর্যস্ত মেবারের ঘটনাবলী অত্যন্ত সুচতুরভাবে এড়িয়ে গেছেন।
এ সম্পর্কে কলিকাতাস্থ বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় কলেজের বংগভাষা ও সাহিত্যের বিভাগীয় প্রধান ডঃ প্রভাত কুমারের মন্তব্যগুলো বিশেষভাবে লক্ষণীয়। “যে চারণগীতিকে ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার আফিমখোরের গালগল্প বলে অবহেলা করেছেন, টডের তাই-ই ছিল উপজীব্য। … যদিও টড যে যুগে মেবারের কাহিনী লিখেছেন সে যুগের মেবার মারাঠা আক্রমণে বিপর্যস্ত, কুশাসনে দুর্বল এবং আফিম-এর প্রতি আসক্তিতে মেরুদণ্ডহীন।… – কিন্তু আমার বিশ্বাস কবির দৃষ্টিভংগি নয়, রীতিমত সাম্রাজ্যবাদী বুদ্ধির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই টড ইচ্ছাকৃতভাবেই এটা করেছেন। অর্থাৎ বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির জয়লাভে রাজপুত জাতি একটি উচ্ছৃংখল অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তিলাভ করেছে। শুধু টড নন, বৃটিশ ঐতিহাসিকেরা সবাই এইটাই দেখাবার চেষ্টা করেছেন যে, বৃটিশ শক্তি স্বাধীনতা হারানো রাজপুত জাতি এবং বাঙালি জতি, দুই জাতিকেই চরম অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করেছে। অথচ ১৮১৭ সালে রাজপুত রাজ্যগুলোকে এবং তার আগে ১৭৫৭ সালে বংগদেশকে কিভাবে বৃটিশ রাজশক্তি কুক্ষিগত করেছে, তা কারও অজানা নেই। … টডের গ্রন্থের ভূমিকায় পাতার পর পাতা একদিকে আট শতাব্দীর মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে বিষোদগার, অন্যদিকে ‘হিন্দু’ অতীত মহত্ত্বের কথা আছে। সেটা কিন্তু হিন্দু বা রাজপুত প্রীতিবশতঃ নয়। কারণ ওই দু’টি পাশাপাশি ধরে তারই মধ্য দিয়ে তিনি প্রচার করতে চেয়েছেন যে, বৃটিশ শাসন হিন্দুদের মুক্তি দিয়েছে। আমাদের দেশের ঐতিহাসিক নাট্যকারদের তাই এ ব্যাপারে যতটা সতর্ক হওয়া উচিত ছিল তা তাঁরা হতে পারেননি।“
(দেশাত্মবোধক ও ঐতিহাসিক বাংলা নাটকঃ সাহিত্য প্রকাশঃ কলিকাতা ১৩৮৫)।
পশ্চিমবাংলার বিশিষ্ট গবেষক শ্রী অনিলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি এ সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করেছেন। “…রাজপুতদের রাজনৈতিক দৃষ্টি অতি সঙ্কীর্ণ ছিল। সমগ্র ভারতবর্ষ দূরে থাকুক সমগ্র রাজস্থান এমনকি কোনও রাজপুত রাজার কর্মক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত হয় নাই। …এমন কি, ‘খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত’ রাজস্থানকে এক রাজছত্রতলে আনয়নের স্বপ্নও কোনও রাজপুত রাজার নিদ্রাভংগ করে নাই।… প্রধানতঃ এই কারণেই রাজপুতের শৌর্য কখনও ভারতকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিতে পারে নাই।”
(বেতার জগৎঃ শারদীয় সংখ্যাঃ ৪৮ বর্ষ ১৮ সংখ্যাঃ পৃষ্ঠা ৪৪)।
এহেন এক পরিস্থিতিতে ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষ নাগাদ কোলকাতায় সুবর্ণ শ্রেণী ও বিত্তশালী মহল এবং বোম্বাই-এর উঠতি শিল্পপতি গোষ্ঠীর সমর্থনে যে বুদ্ধিজীবী আর রাজনীতিবিদরা রাজপুত বীর প্রতাপ সিংহ প্রমুখের ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে সর্বভারতীয় ভিত্তিতে ‘হিন্দু রিভাইভালিজম’-এর স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁদের মোহমুক্তি ঘটলো। তাঁরা প্রায় সতেরো বছর পর উপলব্ধি করলেন, যেহেতু রাজপুত জাতির ইতিহাস হচ্ছে মোগলদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক’ লড়াই ও প্রায়শঃই মোগলদের সঙ্গে সমঝোতার ইতিহাস, সর্বভারতীয় ভিত্তিতে রাজপুতদের কোনও ভূমিকা নেই সেহেতু এক্ষণে মারাঠা বীর ছত্রপতি শিবাজীর ব্যক্তিত্ব এবং মারাঠা শক্তির শৌর্যবীর্যের কাহিনী ও বীর-গাঁথাগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। বোম্বাই নগরীতে ১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস গঠনের প্রায় আট বছর পর এই মৌলিক বিষয়টিকে চিহ্নিত করে সর্বসমক্ষে একটা রূপরেখা উপস্থাপিত করা হলো।
এর নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন কংগ্রেসের চরম দক্ষিণপন্থী নেতা মারাঠ ব্রাহ্মণ বাল গংগাধর তিলক। ১৮৯৩ সালে গংগাধর তিলক ‘গণপতি উৎসব’-এর প্রবর্তন করলেন। এঁরই উদ্যোগে মহারাষ্ট্রের রায়গড়ে ১৮৯৬ সালের ১৫ই এপ্রিল ‘শিবাজী উৎসবের আয়োজন করা হয়। এর পরের বছর পুনা শহরে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে তিন দিনব্যাপী ‘শিবাজী উৎসব’ পালিত হয়। এমনকি গংগাধর তিলক জাতীয় বীর হিসেবে ছত্রপতি শিবাজীর রাজ্যাভিষেক উৎসব-এরও প্রচলন করেন। শিবাজী ছিলেন ভবানী দেবীর ভক্ত। তাই ভবানী পূজা শিবাজী উৎসব-এর মূল অংগস্বরূপ প্রতিষ্ঠিত হলো। মারাঠাদের অনুসরণে ১৯০২ সাল নাগাদ কোলকাতায় শিবাজী উৎসব-এর সূচনা হলো। এর পরেই বাংলা সাহিত্য, নাটক, কবিতা ও গানগুলো ছত্রপতি শিবাজীর জয়গানে মুখরিত হয়ে উঠলো। সবার (রবীন্দ্রনাথসহ জনাকয়েক ব্যতিক্রম) উদ্দেশ্য হচ্ছে একটাই। বাঙালিত্বের নামে হিন্দু বাঙালিত্ব প্রতিষ্ঠা (?) করার পর ‘হিন্দু রিভাইভালিজম’-এর মাধ্যমে সর্বভারতীয় ভিত্তিতে, হিন্দু জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করা।
এদিকে ক্লাইভের পর ওয়ারেন হেষ্টিংস বাংলার নয়া গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। হেস্টিংস-এর ১৩ বছরব্যাপী গভর্নর-এর সময়কাল নানা ঐতিহাসিক ঘটনায় ভরপুর কোম্পানী কর্তৃক বাংলার রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভের পূর্বে ইংরেজদের এরকম বিশ্বাস ছিলো যে, আদায়কৃত রাজস্বের উদ্বৃত্ত থেকে কোম্পানীর বার্ষিক মূলধন বিনিয়োগের অর্থ পরিশোধ সম্ভব হবে। কিন্তু ক্লাইভ কর্তৃক নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা সত্ত্বেও রাজস্ব আদায়ে লিপ্ত এদেশীয় ব্যক্তিদের যোগসাজশে কোম্পানীর কর্মচারীরা এতদূর দুর্নীতিপরায়ণ ছিলো যে, বাস্তবে আদায়কৃত অর্থের বিরাট অংশই আর কোম্পানীর তহবিলে জমা হতো না। ফলে হেস্টিংস নয়া গভর্নর জেনারেল হয়েই রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির জন্য মনোনিবেশ করলেন। রাতারাতি বঙ্গীয় এলাকার ভূমিকর দ্বিগুণ হয়ে গেলো। এক হিসাবে দেখা যায় যে, ১৭৫৬ থেকে ১৭৬৬ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে যেখানে মোট আদায়কৃত রাজস্বের পরিমাণ ছিলো ১৫ লাখ ৮১ হাজার পাউণ্ড, ১৭৬৬-৬৭ সালে সেই রাজস্বের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৫ লাখ ২৭ হাজার পাউণ্ড। ভূমি রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ওয়ারেন হেস্টিংস যে কঠোরতা অবলম্বন করেন এবং নৃশংসতার পরিচয় প্রদান করেন তা ইতিহাসে বিরল।
গবেষক বিনয় ঘোষ তার ‘বাংলার নবজাগৃতি’ (ওরিয়েন্ট লংম্যান : কলিকাতা : পূঃ ২২) গ্রন্থে এ সম্পর্কে বর্ণনাদানকালে লিখেছেন, “এইভাবে ইংরেজ বণিকদের নির্লজ্জ শোষণ ও লুটতরাজ চলতে লাগলো। কারুশিল্প ও কুটিরশিল্প ধ্বংস তো হলই, ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার পরিবর্তনের ফলে বাংলার কৃষক ও কৃষির চরম অবনতি ঘটল।”
প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় যে, একদিকে কোম্পানীর দেওয়ানী লাভের পর আকস্মিকভাবে ভূমি রাজস্বের ব্যাপক বৃদ্ধি এবং তা আদায়ের জন্য কৃষকের উপর ভয়াবহ অত্যাচার ও অন্যদিকে অনাবৃষ্টির দরুন ১৭৭১-৭২ (বাংলা ১১৭৬ সন) সালে বাংলা ও বিহারে দেখা দিলো মানব ইতিহাসের এক হৃদয়বিদারক দুর্ভিক্ষ। এটাই হচ্ছে কুখ্যাত ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। ইংরেজদের স্বীকৃতি অনুযায়ী এই দুর্ভিক্ষে বাংলার মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী এই ধরাধাম থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এরকম অবস্থাতেও ১৭৭২ সালে বাংলার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস লণ্ডনস্থ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর বোর্ড অব ডিরেক্টসদের কাছে দম্ভোক্তি করে চিঠি লিখলেন, যদিও ওই প্রদেশের তিন ভাগের একভাগ লোক মরে গেছে এবং চাষাবাদের চরম অবনতি হয়েছে তবুও ১৭৭১ সালে নীট আদায় ১৭৬৮ সালেরও বেশী।
গবেষক ও ইতিহাসবিদ ডঃ আজিজুর রহমান মল্লিক সে আমলের এই পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, · বাংলা এবং বিহারে প্রকট দুর্ভিক্ষের প্রথম ছয় মাসে কর আদায় পূর্ববর্তী বছরের চাইতে ছয় লাখ টাকা বেশী হয়েছিলো এবং পরবর্তী বছরে হয়েছিলো চৌদ্দ লাখ টাকা।” (বৃটিশ নীতি ও বাংলার মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবস্থা : ১৯৮২: বাংলা একাডেমী ঢাকা)
সমসাময়িককালে নব্য শাসকগোষঠ আরও যে সব কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তার সবগুলোই বাংলার মুসলমানদের স্বার্থ-বিরোধী বলে প্রমাণিত হয়েছে। এর ফলে মুসলমানদের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ একেবারে ভেংগে পড়ে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, তৎকালীন বাঙালি হিন্দু বিত্তশালী ও সুবর্ণ শ্রেণী এসময় ইংরেজ পরাশক্তির সহযোগীর ভূমিকা পালনে এগিয়ে এসেছিলো।
ইংরেজ গবেষক ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার তাঁর রচিত বিখ্যাত অথচ অধুনা প্রায় দুষ্প্রাপ্য ‘আওয়ার ইণ্ডিয়ান মুসলমান্স (লণ্ডনঃ ১৮৭১) গ্রন্থে বঙ্গীয় এলাকার মুসলমানদের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে এক অপূর্ব মন্তব্য করেছেন। মন্তব্যটি নিম্নরূপঃ
“১৭০ বৎসর (১৭০০ খ্রীঃ) পূর্বে বাংলাদেশে একজন সম্ভ্রান্ত মুসলমানের পক্ষে দরিদ্র হওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল; আজ ধনী থাকাই তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব।” (অনুবাদ: কাজী আবদুল ওদুদ)
এই প্রেক্ষিতে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ও যথাক্রমে সেনা, রাজস্ব, বিচার ও শিক্ষা বিভাগের কর্তৃপক্ষের উপর নির্ভর করে কয়েক শ’ বছর ধরে বাংলার যে মুসলিম অভিজাত শ্রেণী গড়ে উঠেছিলো, সেই চারটি বিভাগ থেকে অত্যন্ত দ্রুত এঁদের অপসারণ করায় বাংলার সব শ্রেণীর মুসলমানরা সেদিন নেতৃত্ববিহীন অবস্থায় ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পতিত হলো।
প্রথমতঃ সৈন্য বিভাগ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্তৃপক্ষ ১৭৬১-৬৩ সালে যখন তাদের শিখণ্ডী মীরজাফর আলীকে দ্বিতীয়বারের মতো নবাবের গদিতে অধিষ্ঠিত করে, তখন এই মীরজাফরকে দিয়ে দিন কয়েকের মধ্যে ৮০ হাজার নবাবী সৈন্য বরখাস্ত করানো হয়েছিলো। এছাড়া অযোধ্যার নবাবকেও সীমিত সংখ্যক সৈন্য রেখে বাকী সব সৈন্যকে বরখাস্ত করার জন্য ইংরেজরা বাধ্য করলো। এদিকে গিরিয়া, উদয়নালা ও বক্সার যুদ্ধে পরাজিত হবার পর নবাব মীর কাসেম মধ্য ভারতের দুর্গম এলাকায় পলায়ন করলে, তখন তাঁর অধীনস্থ প্রায় ৪০ সহস্রাধিক সৈন্যও ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লো। এদের প্রায় সবাই ছিলো মুসলমান। এরা সবাই হঠাৎ করেই বেকার হয়ে পড়লো। উপরন্তু কোম্পানীর বাহিনীতেও বাংলার মুসলমানদের নিয়োগ তখন প্রায় নিষিদ্ধ। এর ফলে বাংলার মুসলিম শাসকগোষ্ঠীর মনে স্বাভাবিকভাবেই নিরাপত্তাহীনতার মনোভাব দেখা দিলো। সবচেয়ে লক্ষণীয় যে, এ সময় সাধারণ সৈন্যদের সংগে নবাব বাহিনীর বিভিন্ন স্তরের সমস্ত মুসলিম অফিসারও চাকরিচ্যুত হয়ে বেকার অবস্থায় বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে কৃষিজীবীকেই উপজীবিকা হিসেবে বেছে নিলো। এছাড়া এদের জন্য অন্য সব পথই তখন রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
দ্বিতীয়তঃ রাজস্ব বিভাগ। বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস নিজের কৃতিত্ব প্রদর্শনের লক্ষ্যে বাংলার ভূমি রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য এতদূর ক্ষিপ্ত হলেন যে, তিনি রাজস্ব আদায়ের পুরো দায়িত্বটাই রাতারাতি ইংরেজ কর্মচারীদের হাতে ন্যস্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এজন্যই ১৭৭২ সালে গঠিত হলো কেন্দ্রীয় বোর্ড অব রেভেন্যু। হেস্টিংস রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রতিটি জেলায় ইংরেজ কালেক্টর নিয়োগ করলেন। এর পরেই চালু হলো পাঁচসালা (৫ বছর মেয়াদী) বন্দোবস্ত। ফলে রাজস্ব আদায়ে লিপ্ত সমস্ত মুসলমান কর্মচারী অপসারিত হলো। ইংরেজ কালেক্টররা জেলায় জেলায় গিয়ে দায়িত্বভার গ্রহণ করেই নিলাম ডাকের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের জন্য পাঁচসালাভিত্তিক পত্তনি দিলো। স্বাভাবিকভাবেই কোলকাতার বাঙালি হিন্দু বিত্তশালী এবং সুবর্ণ শ্রেণী এই সুযোগ গ্রহণ করলো আর রাজস্ব আদায়ে লিপ্ত হাজার হাজার মুসলমান কর্মচারী বেকার হয়ে পড়লো। এখানেই শেষ নয়। বছর কয়েক পরে অর্থাৎ বড়লাট লর্ড কর্নওয়ালিশ-এর আমলে ১৭৮৯ সালে স্যার জন শোর ভূমি ‘রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত তাঁর বিখ্যাত প্রতিবেদন দাখিল করলেন। স্যার জনের সুপারিশ ছিলো তিনটি।
১. ভূমি রাজস্ব আদায়ের বন্দোবস্ত জমিদারদের সংগে করতে হবে, ২. আদায়কৃত রাজস্বের দশ ভাগের নয় ভাগ পাবে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী ও এক ভাগ হচ্ছে জমিদারদের প্রাপ্য এবং ৩. জমিদারদের সংগে এই বন্দোবস্ত হবে দশ বছর ভিত্তিক। ১৭৯১ সালে দশসালা বন্দোবস্তের আইন পাস হলে রাজস্ব বিভাগ থেকে বাংলার মুসলমানদের অবস্থান প্রায় সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এদিকে বিভিন্ন দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করায় ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক ১৭৬৫ সালে দেওয়ানী লাভের প্রথম বছরে আদায়কৃত রাজস্বের চেয়ে ১৭৯০-৯১ সালে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় এর পরিমাণ তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২ কোটি ৬৮ লাখ টাকায় দাড়ায়-
এর পরের ইতিহাস তো আরও চাঞ্চল্যকর। লর্ড কর্নওয়ালিশ দশসালা বন্দোবস্তে পুরোপুরি সন্তুষ্ট না হয়ে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী ভিত্তিতে জমিদারী প্রথা সংক্রান্ত আইন চালু করলেন। সূর্যাস্ত আইনের অছিলায় মাত্র দু’বছরের মধ্যে লর্ড কর্নওয়ালিশের আমলে বাংলার প্রায় অর্ধেক জমিদারী নিলাম হয়ে গেলো। নিলামে এসব জমিদারী ক্রয় করলো কোলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু বিত্তশালী ও সুবর্ণ শ্রেণীর ‘মহাশয়েরা। শুরু হলো নতুন উদ্যোগে অত্যাচার। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের এই সম্পূরক শক্তির পূর্বাপর ইতিহাস আগেই উল্লেখ করেছি।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বিরাজমান অবস্থার কথা আজ প্রায় দু’শ বছর পরে লিখতে বসে শিহরিত হতে হয়। ছিয়াত্তরের (১৭৭১ খ্রীঃ) মহামন্বন্তরের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা নিশ্চিহ্ন হওয়া সত্ত্বেও সেদিন ইংরেজ বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস ভূমি রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিলেন। এরপর পাঁচসালা, দশসালা এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে গ্রামবাংলার নব্য জমিদার শ্রেণী ভাড়াটিয়া লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে রায়তদের উপর যে অমানুষিক অত্যাচার হয়েছিলো তা ইতিহাসে বিরল। বাংলার অধিকাংশ কৃষক মুসলমান বলে এর পুরো ধাক্কাটাই মুসলিম কৃষকদের সহ্য করতে হয়েছে। প্রায় একই সময়ে এদের জন্য নতুন বিপদ দেখা দেয়। জমিদারদের (অধিকাংশই বর্ণ হিন্দু) যোগসাজশে গ্রামবাংলায় শুরু হয় নীলকর সাহেবদের অত্যাচার। চাষীরা নীলচাষে অস্বীকার করলে নীলকরদের পাইক, বরকন্দাজ, লাঠিয়াল সেই চাষীদের বাড়ীঘর লুট করতো, ঘর জ্বালিয়ে দিতো আর স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের পথের ভিখারী করে ছাড়তো। এসব নীলকর সাহেবের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আদালতে বিচার প্রার্থনা করেও কোন ফায়দা হতো না। বিচার তখন প্রহসনে পরিণত হয়েছিলো।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক হারানচন্দ্র চাকলাদার-এর একটিমাত্র মন্তব্যের মাঝ দিয়ে এসময়ের নজীরবিহীন অত্যাচারের একটা চিত্র পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন,” … ইউরোপীয়রা এদেশে এসেছিলো দাস-মালিকের মনোবৃত্তি নিয়ে। নিরংকুশ শ্রেষ্ঠত্বের প্রচণ্ড লোভের সংগে উদ্ভাবনী কল্পনাশক্তি মিলিত হয়ে যত প্রকার উপায় আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিল, তার প্রত্যেকটিকেই নীলকর সাহেবরা এদেশে প্রয়োগ করেছিল। যে সমস্ত পন্থায় রায়তদের নীল চাষে বাধ্য করা হতো তার মধ্যে ছিল হত্যাকাণ্ড, বিচ্ছিন্নভাবে খুন, ব্যাপকভাবে খুন, দাংগা, লুটতরাজ, গৃহদাহ, লোক অপহরণ।”
(‘ফিফটি ইয়ার্স এগো’ : ডন ম্যাগাজিন জুলাই ১৯০৫)
এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত শতাধিক বছরের মধ্যে এই বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৪০টির মতো কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। (এসবের মধ্যে ফকির বিদ্রোহ ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ১৭৬৩-৭৮), মেদিনীপুরের বিদ্রোহ (১৭৬৩-৮৩), ত্রিপুরার সমশের গাজীর বিদ্রোহ (১৭৬৭-৬৮), সন্দ্বীপের বিদ্রোহ (১৭৬৯), কৃষক তন্তুবায়ের সংগ্রাম (১৭৭০-৮০), পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকলা বিদ্রোহ (১৭৭৬৮৭), তিতুমীরের লড়াই (১৮২৭-৩১), ফারাইজী আন্দোলন (১৮৩১-৫৭) এবং সিরাজগঞ্জের কৃষক বিদ্রোহ (১৮৭২-৭৩) অন্যতম ছিলো। কিন্তু সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এবং সাফল্যজনক হিসেবে নীলচাষীদের বিদ্রোহকে (১৭৭৮-১৮৬০) আখ্যায়িত করতে হয়।
১৮৪৮ সালে ক্যালকাটা রিভিউ পত্রিকায় সে আমলে বাংলার কৃষকদের প্রতিরোধ সম্পর্কে প্রকাশিত এক নিবন্ধে জনৈক ইংরেজ সমালোচকের মন্তব্য হচ্ছে, বহু ক্ষেত্রে নীলকর সাহেব কৃষক লাঠিয়ালদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তাদের তেজস্বী ঘোড়ার পিঠে চেপে অতি দক্ষতার সংগে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কৃষকেরা সশস্ত্র আক্রমণের দ্বারা নীলকুঠি ধুলিসাৎ করে দিয়েছে, অনেক জায়গায় এক পক্ষ বাজার লুট করেছে, তার পরক্ষণেই অপর পক্ষ এসে তার প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে।” এরই ফলে ১৮৬০ সালে আইন পাসের মাধ্যমে নীল চাষ কৃষকদের ইচ্ছাধীন ব্যাপারে পরিণত হয়।
তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, যারা এই বংগীয় এলাকায় কয়েকশ’ বছর ধরে শাসক ছিলো কিংবা শাসকদের একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে বিরাজমান ছিলো, বাংলার সেই মুসলিম জনগোষ্ঠীর সমস্ত শ্রেণীর লোক মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে বুভুক্ষু কৃষিজীবী সম্প্রদায়ে পরিণত হলো। এসময় প্রায়শঃই কৃষক বিদ্রোহের মাধ্যমে মুসলিম প্রজাসাধারণের স্বাধীনচেতা মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে একটা কথা স্পষ্টভাবে বলতে হয় যে, বংগীয় এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসকারী মুসলিম জনগোষ্ঠী এই দেশ, এই মাটি, এই ভাষা আর এই লোকাচারকে এর আগ্নেই নিষ্ঠার সংগে গ্রহণ করে বাঙালি হিসেবে গর্বের পরিচয় দেয়ার যে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলো, সেটাই ছিলো তাঁদের জন্য সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ।
এ সম্পর্কে গবেষক বিনয় ঘোষের বস্তুনিষ্ঠ মন্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি লিখেছেন, “প্রথম যুগে বৃটিশ গভর্নমেন্টের নীতি মুসলমান-বিদ্বেষ এবং হিন্দু পক্ষপাতিত্বের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। তাই হিন্দুরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ ও উৎসাহ পেয়েছেন, সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন এবং ইংরেজদের অধীনে কিছু কিছু মোটা বেতনের সরকারী চাকরিও পেয়েছেন।” শ্রী ঘোষ আরও লিখেছেন, “মুসলমানদের প্রতি বৃটিশ শাসকদের অবিচার ও বিদ্বেষভাব প্রথম যুগে বেশ প্রবল হয়ে উঠেছিল। ইংরেজদের নতুন জমিদারী ব্যবস্থার ফলে শুধু যে মুসলমান জমিদার-জায়গীরদারেরা ধ্বংস হয়ে গেলেন তা নয়, বাংলার যে কৃষক প্রজারা ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হল তাদের মধ্যে অধিকাংশই মুসলমান। বাংলার প্রায় প্রত্যেক জেলায় এই উৎখাত নিঃস্ব প্রজাদের ধূমায়িত বিক্ষোভ দস্যুবৃত্তি (?) ও কৃষক বিদ্রোহের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করল। সেই সময় এলো ওয়াহাবী আন্দোলনের ঢেউ। ধর্মান্দোলনের ঢেউ, কৃষক বিদ্রোহ, মুসলমান অভিজাত শ্রেণীর প্রতিহিংসা প্রবৃত্তি ও ইংরেজ বিদ্বেষের এই সম্মিলিত প্রকাশকে বৃটিশ শাসকরা বৃটিশ-বিরোধী ‘জ্বিহাদ’ (জ্বেহাদ) বলে প্রচার করলেন।”
(বাংলার নবজাগৃতিঃ ওরিয়েন্ট লংম্যান কলিকাতা (১৯৭৯) পৃষ্ঠা ৭৪)
বাংলার রাজস্ব বিভাগ থেকে মুসলমানদের কৌশলে বিতাড়ন সম্পর্কে ইংরেজ গবেষক ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার সত্য ভাষণ করে গেছেন। তিনি ‘আওয়ার ইণ্ডিয়ান মুসলমানস’ গ্রন্থে লিখেছেন, “ইংরেজরা বাংলাদেশ লাভ করেছিলেন দিল্লীর বাদশাহের প্রধান তহশিলদাররূপে মাত্র। মোটা ঘুষ না দিয়ে তলোয়ারের জোরে আমরা (ইংরেজরা) এই পদ পেয়েছিলাম। কিন্তু
আইনত আমরা (ইংরেজরা) লাভ করেছিলাম মাত্র দেওয়ানের পদ অথবা প্রধান রাজস্ব আদায়কারীর পদ (১৭৬৫ সালের ১২ই আগস্টের ফরমান)।… সেই আঘাত হচ্ছে লর্ড কর্নওয়ালিশ ও স্যার জন শোর প্রবর্তিত সংস্কার পরস্পর যার পরিণতি হলো ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এই সংস্কারের ফলে আমরা (ইংরেজরা) অধিকার করলাম সেইসব উচ্চ মুসলমান রাজপুরুষদের আসন যাঁরা রাজশক্তি ও প্রজার নিকট থেকে সাক্ষাৎ সম্বন্ধে রাজস্ব সংগ্রহকারী এই দুয়ের মধ্যবর্তী ছিলেন, আর যাদের নিযুক্ত কর্মচারীদের হাতেই ছিল ভূমিকর আদায় সম্বন্ধে বিধি-ব্যবস্থাভার। ‘ঢালী-ঘোড়সওয়ার সমন্বিত মুসলমান তহশিলদারদের পরিবর্তে আমরা জেলায় জেলায় স্থাপন করলাম এক একজন ইংরেজ কালেক্টর। এঁদের আদালতের সঙ্গে সংযুক্ত হলো ধর-পাকড়, নিলাম ইত্যাদির ক্ষমতাযুক্ত আমলাদের মতো অস্ত্রহীন বরকন্দাজ। আর একভাবে বড় বড় মুসলমান ঘরের পক্ষে এটি বিষম ক্ষতির কারণ হলো এই বন্দোবস্তের প্রবণতা হলো যেসব হিন্দু কর্মচারী সাক্ষাৎভাবে প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায়-আদি করতেন তাঁদের জমিদার বলে স্বীকার করার দিকে। … এর ফলে যে সমস্ত হিন্দু ভূমিকর আদায়কারী এতদিন নগণ্য পদের অধিকারী ছিলেন তাঁরা হলেন জমিদার, জমিদার মালিকানা স্বত্ব তাঁদের হলো, আর মুসলমান আমলে যেসব টাকা মুসলমানদের ঘরে যেত তা গেল তাঁদের (হিন্দুদের ঘরে)।”
পরিশেষে শিক্ষা ও বিচার বিভাগের কথা বলতে হয়। বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যা এলাকায় যেখানে একসময় শিক্ষা ও বিচার বিভাগের উচ্চ পদগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলমানদের একচেটিয়া ছিলো, ইংরেজরা কোলকাতায় রাজধানী স্থাপন করে এদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করলে স্বল্প দিনের ব্যবধানে অত্যন্ত দ্রুত তার আমূল পরিবর্তন ঘটে। এই পরিস্থিতি সম্পর্কে লর্ড এলেনবারো সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, “ইংরেজদের প্রতি মুসলমানদের এক জন্মগত, বিদ্বেষ ও শত্রুতা আছে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
“প্রবলেমস অব ইণ্ডিয়া : সেলভেনকারঃ (পৃষ্ঠা ২২)
লর্ড এলেনবারোর এই মন্তব্যের ব্যাখাদান করলে বলতে হয় যে, পরাশক্তি ইংরেজের বশ্যতা যত সহজে এবং আগ্রহের সাথে বাঙালি হিন্দুরা মেনে নিয়েছিলো, এদেশের সন্তান হিসাবে বাঙালি মুসলমানরা তা মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলো এবং প্রায়শঃই বিদ্রোহের রক্তাক্ত পথ অনুসরণ করেছিলো। এরই ফল হিসাবে ইংরেজ শাসনের আমলে বাঙালি মুসলমানদের বিরাট ‘কাফফারা দিতে হলো। কয়েক দশকের ব্যবধানে বঙ্গীয় এলাকার সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের আমূল পরিবর্তন হয়ে গেলো। বাঙালি মুসলমানরা প্রশাসনের উচ্চ পদগুলো থেকে বিতাড়িত হলো এবং বিশেষ করে কোলকাতা কেন্দ্রিক নব্য সৃষ্ট মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী ইংরেজদের সম্পূরক শক্তি হিসেবে ইংরেজী শিক্ষায় ‘বলীয়ান’ হয়ে সেসব পদ দখল করলো।
মুসলমানদের অদৃষ্টে জুটেছে দফতরী বেয়ারা পিওন ও ড্রাইভারের চাকরি
এ সম্পর্কে গবেষক বিনয় ঘোষ বলেছেন, “বাংলার নতুন হিন্দু জমিদার শ্রেণী ও উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে আপোষ করে, শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে সরকারী চাকরির মধ্য-নিম্নস্তরের উচ্ছিষ্ট দিয়ে সন্তুষ্ট করে। তাই শিক্ষিত হিন্দুরা সিভিলিয়ান বিচারপতি, গেজেটেড পুলিশ অফিসার, গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার বা কাস্টমস অফিসার না হলেও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, ডেপুটি কালেক্টর, ছোট আদালতের জজ, মুন্সেফ ইত্যাদি হয়েছেন, হিন্দু উকিল মোক্তার কেরানীর সংখ্যাও যথেষ্ট বেড়েছে, কিন্তু মুসলমানদের অদৃষ্টে জুটেছে দফতরী, বেয়ারা, পিওন, ড্রাইভার, কোচোয়ান আর লশকরের কাজই বেশী। ইংরেজী শিক্ষার সুযোগ হিন্দুরা যেভাবে সাগ্রহে গ্রহণ করেছিলেন, মুসলমানরা সেভাবে করেনি।’
১৮৬৮ সালের ৩০শে জানুয়ারী কোলকাতায় অনুষ্ঠিত ‘বেঙ্গল সোশ্যাল সাইন্স এসোসিয়েশন’-এর দ্বিতীয় অধিবেশনে স্যার আবদুল লতিফের পঠিত মুসলিম শিক্ষা সংক্রান্ত প্রবন্ধ আলোচনাকালে বিচারপতি জেবি ফিয়ার সত্য ভাষণ করে গেছেন। তাঁর মন্তব্য হচ্ছে, “ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় থেকে এদেশের মুসলমান ভদ্রশ্রেণী লোকচক্ষে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছেন। শিক্ষায় ও সামাজিক সম্মান লাভে তাঁরা শিক্ষিত হিন্দু ভদ্রশ্রেণীর অনেক পিছনে পড়ে রয়েছেন। মুসলমান সম্প্রদায়ের এই পশ্চাদগতির রাজনৈতিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। এর ফলে মুসলমানদের মধ্যে বিক্ষোভ দেখা দিতে বাধ্য।“
পরের বছর উল্লেখিত সোশ্যাল সাইন্স এসোসিয়েশন-এর বার্ষিক অধিবেশন ১৮৬৯ সালের ২১শে জানুয়ারী বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক রেভারেন্ড জে লং সাহেবের মন্তব্যে করুণ বাস্তব সামাজিক চিত্র পরিস্ফুট হয়েছে। তিনি বললেন, এক সময় যারা এত বড় একটা রাজ্য শাসন করেছেন, আজ তাঁহার বংশধররা কায়ক্লেশে জীবনধারণ করছেন। …. বাংলাদেশের কোনও গভর্নমেন্ট অফিসে উচ্চপদস্থ মুসলমান কর্মচারী বিশেষ দেখা যায় না; কিন্তু মুসলমান দফতরী আর পিওনে সব অফিস ভরে গেছে।…”
এদিকে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীরা তখন যেসব প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ব্যস্ত সেগুলো হচ্ছে ১. জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে ‘হিন্দুমেলা’ (১৮৬৭ খৃঃ) ২. বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শণ পত্রিকা (১৮৮২ খৃঃ) এবং ৩. ইংরেজ ভাইসরয় লর্ড ডাফরিন-এর পৃষ্ঠপোষকতায় অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজ রাজ কর্মচারী এ ও হিউম এবং বাঙালি হিন্দুর বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ডব্লু সি ব্যানার্জীর (প্রকৃত বাংলা নাম উমেশচন্দ্র ব্যানার্জী হলেও ইংরেজীতে উমেশ-এর বানান ইউ-এর পরিবর্তে ডব্লুউ দিয়ে লিখতেন) নেতৃত্বে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা (১৮৮৬ খৃঃ)। ইতিপূর্বে এসব ব্যাপারে উল্লেখ করা সত্ত্বেও আলোচনার সুবিধার জন্য আবারও বলতে হয় যে, কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু উচ্চ মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে স্থাপিত এসব প্রতিষ্ঠানের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো :
ক. আরও সুশৃংখলভাবে সাম্রাজ্যবাদ শাসকগোষ্ঠীর মদদ যুগিয়ে আস্থাভাজন হওয়া ও বিশ্বস্ত থাকা; খ. তৎকালীন ভারতের রাজধানী কোলকাতা এবং অন্যান্য এলাকার বাঙালি হিন্দুদের নব্য সৃষ্ট উচ্চ মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী মহলের অর্থাৎ বাঙালি হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণীর বুনিয়াদকে সুদৃঢ় করা; গ. ইংরোপীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে একটা সংস্কারপন্থী মনোভাব থেকে অনুকরণ ও অনুসরণ করে বাংলার রেনেসাঁ বলে সোচ্চার হওয়া এবং ঘ. পরাশক্তি ভারতেশ্বর ও জগদীশ্বর ইংরেজ শাসকদের বিশেষ কোনরকম বিরক্ত না করে’ আবেদন-নিবেদন, আলোচনা, কথাবার্তা, বক্তৃতা, বিবৃতি এবং সম্পাদকীয় মন্তব্য ইত্যাদির মাধ্যমে শুধুমাত্র নিজেদের শ্রেণী ও গোষ্ঠীস্বার্থে “বিবেক সম্পন্ন দাবী-দাওয়া এবং সুবিধার ব্যবস্থা করা।
বাঙালি মুসলিম অবস্থাপন্নরা তখন প্রায় নিশ্চিহ্নের পথে
বংগীয় এলাকায় যখন কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণী ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বশ্যতা পুরোপুরিভাবে মেনে নিয়ে নানাভাবে ‘ফায়দা’ গ্রহণে লিপ্ত তখন বাঙালি মুসলিম অবস্থাপন্ন শ্রেণীর উপর একের পর এক আঘাত এলো।
এসবের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৮৩৭ খ্রীষ্টাব্দে অফিস-আদালতে ফারসীর পরিবর্তে ইংরেজী ভাষার প্রবর্তন। অফিস-আদালতে ইংরেজী ভাষা প্রবর্তনের কাজ যখন চলছিলো, তখনই অর্থাৎ ১৮৩২ খ্রীষ্টাব্দে ক্যাপ্টেন টি মেকান সিলেক্ট কমিটির কাছে অত্যন্ত জোরের সংগে সুপারিশ করেছিলেন যে, অফিসের ভাষার পরিবর্তনটা যেনো খুবই মন্থর গতিতে করা হয়। অন্যথায় বিশেষ করে বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হলট ম্যাকেঞ্জী এ মর্মে সিলেক্ট কমিটির কাছে প্রস্তাব করেছিলেন যে, অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে ইংরেজী ভাষার প্রবর্তনটা জেলাওয়ারী হিসেবে করা সমীচীন হবে।
কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এসবের কিছুই হলো না। ১৮৩৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে মাত্র ৫/৬ বছর সময়কালের মধ্যে ইংরেজ ভারতের সর্বত্র অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে ইংরেজী ভাষা চালু হয়ে গেলো। শিক্ষা, বিচার এবং প্রশাসনের অন্যান্য বিভাগ থেকে দলে দলে বাঙালি মুসলমানরা চাকরিচ্যুত হয়ে বিতাড়িত হলো।
বাংলাদেশের জীবিত ইতিহাসবিদদের মধ্যে প্রবীণতম এবং এককালের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডক্টর আজিজুর রহমান মল্লিক এ সম্পর্কে যে মন্তব্য লিপিবদ্ধ করেছেন, তা থেকেই উদ্ধৃতি দেয়া যুক্তিযুক্ত হবে।
“এ পরিবর্তন অপর সম্প্রদায়ের (বাঙালি হিন্দু) জন্য খুব সুখকর হয়ে উঠলো। কারণ তারা ইতিমধ্যেই ইংরেজী শিক্ষায় অনেক দূর অগ্রসর হতে পেরেছিলো। মুসলমানদের জন্য এ সময়ে ইংরেজী শিক্ষার কোন প্রতিষ্ঠান ছিলো না। সুতরাং হিন্দু কলেজের (পরবর্তীকালে কোলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজ) ছাত্ররা এই পরিবর্তনের পূর্ণ উপকার ভোগ করেছে। অপরপক্ষে মুসলিম আপার ক্লাস নতুন ব্যবস্থার সংগে খাপ না খাওয়াতে পারায় সর্বস্তরের অফিস-আদালত থেকে বহিস্কৃত হয়েছে। (বৃটিশ নীতি ও বাংলার মুসলমানঃ বাংলা একাডেমী, ঢাকা)
এ ধরনের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় যে, বংগীয় এলাকার প্রশাসন ও সৈন্যবাহিনী ছাড়াও রাজস্ব, বিচার এবং শিক্ষা বিভাগ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর চল্লিশ দশক নাগাদ বাঙালি মুসলমানদের প্রভাব বিলুপ্ত হয়ে যায়। ১৮৩৭ সালে অফিস-আদালতে এবং ১৮৪৪ সালে সরকারী সমস্ত বিভাগে ফার্সীর পরিবর্তে ইংরেজীকে অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে চালু করায় এই প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হলো। এ বছরের ১৪ই অক্টোবর সরকারীভাবে এ মর্মে নির্দেশ জারি করা হলো যে, ‘অতঃপর সরকারের সমস্ত দফতরে কেবলমাত্র ইংরেজী শিক্ষিত লোকদের চাকরিতে নিয়োগ করতে হবে।’
১৮৩৭-এ ফার্সীর বদলে ইংরেজী চালু হওয়ায় মুসলিমরা বিপাকে পড়লো
ইংরেজ সরকারের এই নির্দেশে বাঙলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো বলা চলে। কেননা তখনও পর্যন্ত সরকারী কিংবা বেসরকারী প্রচেষ্টায় বাঙালি মুসলমানদের ইংরেজী শিক্ষার কোন ব্যবস্থাই হয়নি। উপরন্তু এক শ্রেণীর ধর্মীয় নেতা ইংরেজী শিক্ষার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার অভিযান চালিয়ে সরলমনা মুসলমানদের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলো এবং সীমিতসংখ্যক মুসলিম সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ ‘পরাভব চেতনার দরুন সবকিছুতেই নির্লিপ্ত হয়ে রইলো। এর পাশাপাশি ডঃ এ আর মল্লিকের মতে “বাঙালি মুসলমানদের জন্য বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণী হিসেবে তাদের মন্থর ও বিলম্বিত অভ্যুত্থান।”
কিন্তু অন্যদিকে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের সম্পূরক হিসেবে কোলকাতা কেন্দ্ৰিক সুবর্ণ শ্রেণী, কর্নওয়ালিশ-মার্কা নব্য জমিদার শ্রেণী এবং মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর সমন্বয়ে গঠিত বাঙালি হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণী তখন কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। এর মধ্যেই পরাশক্তি ইংরেজের সংগে কোলকাতা কেন্দ্রিক এই বাঙালি হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণীর একটা চমৎকার বোঝাপড়া হয়ে গেছে এবং ১৮১৬ খ্রীষ্টাব্দেই ইংরেজী শিক্ষার জন্য কোলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর প্রথম সম্পাদক ছিলেন বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়। বৈদ্যনাথ বাবুকেই এদেশে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে ইংরেজী শিক্ষার পথিকৃৎ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ইংরেজ মহলে তাঁর অসাধারণ প্রভাব বিদ্যমান ছিলো। এছাড়া, বিশেষ করে কোলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ইংরেজী শিক্ষার প্রসারের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ‘স্কুল বুক সোসাইটি’ এবং এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন রাধাকান্ত দেব মহাশয়। এই প্রেক্ষিতে ১৮৪৪ সালের নির্দেশের ফলে নব্য ইংরেজী শিক্ষিত হিন্দু যুবকরা দলে দলে চাকরিতে যোগদানের সুবর্ণ সুযোগ লাভ করলো। বাঙালি শিক্ষিত হিন্দুদের জন্য নব্য যুগের সূচনা হলেও বাঙালি মুসলমানরা এক ভয়াবহ দুর্যোগের মধ্যে পতিত হলো।
এখানে উল্লেখ্য যে, অফিস-আদালত থেকে শুরু করে সরকারের সমস্ত বিভাগে ইংরেজী ভাষা চালু করার জন্য ইংরেজ শাসক-গোষ্ঠী উদ্যোগ গ্রহণ করার আগেই ১৮৩৫ সালে কোলকাতার বর্ণ হিন্দু বুর্জোয়াশ্রেণীর নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে শ্রী রাধাকান্ত বন্দোপাধ্যায়, শ্রী প্রশান্ত কুমার ঠাকুর এবং আরও ৬,৯৪৭ জন এক যুক্ত দরখাস্তে অবিলম্বে ইংরেজী ভাষা চালু করার দাবী জানান। (ইণ্ডিয়া পাবলিক কনসালটেশন্স : ১০ই ফেব্রুয়ারী, ১৮৩৫, নং ২৮)। এই দরখাস্তে দাবীর স্বপক্ষে বলা হয় যে, “এরকম অনেক বাঙালি আছে, যারা ইংরেজী সাহিত্য ও বিজ্ঞানকে তাদের শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চার আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং তারা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ প্রস্তুত।”
গবেষক বিনয় ঘোষ এ সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন যেঃ “…..যেমন কোলকাতা শহরে, ব্রিটিশ শাসকরা তাঁদের বিশ্বাসভাজন আরও দু’টি শ্রেণী তৈরী করেছিলেন—একটি নতুন নাগরিক ধনিক শ্রেণী, আর একটি নতুন নাগরিক মধ্য শ্রেণী।….. নাগরিক মধ্যশ্রেণীর একটি বিশেষ স্তর হিসেবে গড়ে উঠেছিল বাঙালি ইংরেজী শিক্ষিত এলিটশ্রেণী।…প্রধানতঃ হিন্দু সমাজের উচ্চস্তর থেকে, অর্থাৎ উচ্চবর্ণের ধনিক ও সচ্ছল মধ্যবিত্তের স্তর থেকে আধুনিক বাঙালি এলিটের উদ্ভব হয়েছে। এককথায় ঊনিশ শতকের বাঙালি এলিটকে উচ্চবর্ণের সংগতিপন্ন হিন্দু মধ্যবিত্ত ‘এলিট’ বলা যায়। তার ফলে এই এলিটগোষ্ঠী অনুপ্রাণিত ধর্মসংস্কার ও সমাজসংস্কার আন্দোলন হিন্দু সমাজ কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। প্রায় ঊনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে শিক্ষিত মুসলমান এলিটগোষ্ঠীর বিকাশ হয়নি বলা চলে।”
রেনেসাঁসের কারণ সম্পর্কে মার্কসিস্ট বিনয় ঘোষের নানা প্রশ্ন
পশ্চিম বাংলার প্রখ্যাত গবষেক এবং মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী বিনয় ঘোষ এতদবিষয়ে আরও প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। “মুছুদ্দিগিরি বেনিয়ানি করে প্রচুর বিত্ত সঞ্চয় করেছিলেন কারা? কারা সঞ্চিত অর্থ নিয়োগ করে জমিদারী কিনে নতুন জমিদার হয়েছিলেন? গ্রাম ও শহরের নতুন মধ্যবিত্তশ্রেণী কাদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল? কারা নতুন পাশ্চাত্যবিদ্যা শিক্ষা করে আধুনিক শিক্ষিতশ্রেণী হয়ে সেকালের ভাষায় ‘রুলার্স এ্যাণ্ড রুলড’-এর মধ্যে ‘ইন্টারপ্রিটার্স’ হয়েছিলেন? অধিকাংশই হিন্দু এবং হিন্দুদের মধ্যে অধিকাংশই ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ প্রভৃতি উচ্চবর্ণভুক্ত যারা তাঁদের নিয়েই প্রধানতঃ এই তিনটি শ্রেণী (নাগরিক কমপ্রাডর শ্রেণী, জমিদার শ্রেণী ও নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণী) গঠিত হয়েছিল। মুসলমান ও অনুচ্চবর্ণ বলে হিন্দু সমাজে যারা উপেক্ষণীয়, তাঁদের সংখ্যা এই তিনটি শ্রেণীর মধ্যে খুবই সামান্য। কেন সামান্য? কেন অনুচ্চবর্ণের লোকেরা অর্থনীতি-রাজনীতি শিক্ষা প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন যুগে স্বাধীনভাবে বিচরণের সুযোগ গ্রহণ করেননি? এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে বাংলার তথা ভারতের, ভুয়ো রেনেসাঁসের মূল কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে এবং বোঝা যাবে কেন বাংলার নবজাগৃতি একটি অতিকথা ছাড়া কিছু নয়।…..বাংলার তথা ভারতের নবজাগৃতি যে একটি অতিকথা, এ সত্য বাস্তব ইতিহাসের মধ্য দিয়ে প্রকট হয়ে ওঠে।” (বাংলার নবজাগৃতিঃ ওরিয়েন্ট লংম্যানঃ কলিকাতা, ১৯৭৯)।
বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও গবেষক ডক্টর আনিসুজ্জামান এ প্রশ্নে কিছুটা ভিন্ন মত পোষণ করলেও আলোচনাকালে এ মর্মে মন্তব্য করেছেন যে, “কিন্তু যেহেতু এই উদীয়মান উচ্চবিত্ত শ্রেণী (কোলাকাতা-কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু) ছিল ইংরেজ বণিক ও শিল্পপতিদের পার্শ্বচর, তাই ইংরেজ শাসকদের শুভেচ্ছায় এঁদের আস্থা ছিল যথেষ্ট।”
(মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য ১৭৫৭-১৯১৮: ঢাকা ১৯৬৪)
এ প্রশ্নে কোলকাতার গবেষক কাজী আবদুল ওদুদ-এর বক্তব্য হচ্ছে, “হিন্দু সমাজের পদস্থ ব্যক্তিদের আনুকূল্যে বাংলায় ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।”
(শাশ্বত বংগঃ ব্রাক প্রকাশনী, ঢাকা)
আগেই উল্লেখ করেছি যে, ১৮৪৪ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজ সরকারের জারিকৃত আলোচ্য নির্দেশে বাঙালি মুসলমানদের জন্য সরকারী চাকরি লাভের সমস্ত সম্ভাবনা বিলীন হয়ে গেলো। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভার এককালীন অর্থমন্ত্রী ডক্টর এ আর মল্লিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে পরিচ্ছন্ন মত প্ৰকাশ করেছেন।
তিনি লিখেছেন, ….এতে মুসলিম সম্প্রদায়ের ভাগ্য চিরতরে মুদ্রিত হয়ে গেলো। ১৮৪৫-৫২ খ্রীষ্টাব্দে যোগ্য প্রার্থীদের তালিকাতেও কোন মুসলমান লোকের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয় নাই। আসল কথা হচ্ছে, এসব পরীক্ষার মান এতো উচ্চ ছিলো যে, মক্তব-মাদ্রাসার ইংরেজী শিক্ষার প্রাথমিক জ্ঞান নিয়ে মুসলমানরা সেসব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। সরকারী দফতরের একজন পুরাতন ছাত্রের বিবৃতি ঢাকা কলেজের কর্তৃপক্ষ মুসাবিদা করেছিলেন। তাতেও ১৯৫০-৫১ সালের তালিকায় মুসলমানদের মান হতাশাব্যঞ্জকভাবে অনুপস্থিত। ১৮৫১-৫২-এর তালিকায় ৭৭টি নামের মধ্যে মুসলমানদের নাম ছিলো মাত্র একজনের। সে বছর হুগলী কলেজের তালিকাতে কোন মুসলমানের নাম দৃষ্ট হয় না। মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনের চাকরিতে অথবা তারও উপরে আইন আদালত এবং রাজস্ব বিভাগের চাকরিতে ১৮৫৬-৫৭ সালে ৩৩৬ জন লোককে নিযুক্ত করা হয়েছিলো। তার মধ্যে মুসলমান ছিলো মাত্র ৫৪ জন, ৯ জন খ্রীষ্টান, বাকী সব হিন্দু। অন্যান্য বিভাগেও মুসলমানদের অবস্থা খুব ভালো ছিলো না। ১৮৫৩ খ্রীঃ পর্যন্ত গভর্ণমেন্ট নিয়োজিত মেডিকেল কলেজের ৪৯ জন সহকারী সার্জনের মধ্যে মাত্র ৫ জন ছিলো মুসলমান। শিক্ষা বিভাগের দ্বারও রুদ্ধ ছিলো মুসলমানদের জন্যে। কেবলমাত্র মাদ্রাসায় আরবী ও ফার্সী শিক্ষার জন্যে কিছুসংখ্যক মুসলিম নিয়োজিত ছিলো।
বাঙালি মুসলমানদের এই চরম দুর্দিনে পরাশক্তি ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী যে ক’টা নীতি গ্রহণ, করলো, তার সব ক’টিই বাঙালি মুসলমানদের জন্য ভয়াবহ কারণ হয়ে দাঁড়ালো। এই নির্দেশগুলো নিম্নরূপ :
(১) ১৮৩৭ সালে অফিস-আদালতে ফার্সীর পরিবর্তে ইংরেজী ভাষা চালুর নির্দেশ।
(২) ১৮৪৪ সালের ১৪ই অক্টোবরে সরকারের সমস্ত বিভাগে শুধুমাত্র ইংরেজী শিক্ষিত লোকদের নিয়োগের আদেশ।
(৩) ১৮৪৬ সালের ৪ঠা মার্চের জারিকৃত নির্দেশে লাখেরাজ সম্পত্তির মালিকানা নির্ধারণের লক্ষ্যে রেজিস্ট্রিকরণ পদ্ধতি বন্ধ ঘোষণা।
প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যায় যে, মাত্র ৭০/৮০ বছর সময়ের মধ্যে বংগীয় এলাকার মুসলমান সম্ভ্রান্ত শ্রেণী প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়া ছাড়া বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোও ইতিপূর্বে বর্ণিত কারণগুলোর প্রেক্ষিতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ১৮৩৭ সালে অফিস-আদালতে ফার্সীর পরিবর্তে ইংরেজী ভাষা চালু এবং ১৮৪৪ সালে সরকারের সমস্ত বিভাগে শুধুমাত্র ইংরেজী শিক্ষিত লোকদের নিয়োগের নির্দেশ জারির দরুন এ সময় বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী ‘একেবারে হতভম্ব হয়ে যায়। প্রায় একই সময়ে নিত্যনতুন আইন জারি ও সরকারী নির্দেশের জের হিসেবে অসংখ্য লাখেরাজ অর্থাৎ ওয়াকফ সম্পত্তির মালিকানা হাতছাড়া হলে এই মুসলিম মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সবার অলক্ষ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এরকম অবস্থায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মধ্যবিত্ত পরিবার বংগীয় এলাকা থেকে উপমহাদেশের অন্যত্র বাস্তুত্যাগ করেছে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।
এরকম এক নেতৃত্ববিহীন অবস্থায় বংগীয় এলাকায় শিক্ষার ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানেরা অত্যন্ত দ্রুত পিছিয়ে পড়তে শুরু করে। এখানে বিষয়টা সঠিকভাবে অনুধাবনের লক্ষ্যে সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ১৮৪৬ সাল থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছর সময়কালে বিরাজমান অবস্থায় একটা চিত্র উপস্থাপন করা বাঞ্ছনীয় হবে বলে মনে হয়।
১৮৪৬ সালের ছাত্র সংখ্যা
হিন্দু ৩৮৪৬
মুসলিম ৬০৮
অন্যান্য ৮৭
মোট ৪৫৪১
১৮৫২ সালের ছাত্র সংখ্যা
হিন্দু ৬৩৩৮
মুসলিম ৭৩১
অন্যান্য ১৪৭
মোট ৭২১৬
এখানে উল্লেখ্য যে, ১৮৪৬ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যবর্তী সময়ে কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ-এ (পূর্বের হিন্দুর কলেজ) একজন মুসলমান ছাত্রও ভর্তি হতে পারেনি।
আরও উল্লেখ্য যে, সিপাহী বিদ্রোহের (বিপ্লব) বছরে অর্থাৎ ১৮৫৬-৫৭ সালে অবিভক্ত বাংলার সরকার পরিচালিত যে ৭০টি বিদ্যালয়ে শুধুমাত্র ইংরেজী ও বাংলাভাষা শিক্ষা দেয়া হতো সেসব প্রতিষ্ঠানে মোট ৮,১৭৫ জন ছাত্রের মাত্র ৩৪৯ জন ছিলো মুসলমান এবং কোলকাতার আশেপাশে অবস্থিত সরকারের মঞ্জুরীপ্রাপ্ত স্কুলে অধ্যয়নরত ২০,৬৪৭ জন ছাত্রের মধ্যে মুসলমান ছাত্রের সংখ্যা ছিলো মাত্র ১,৫৮৬ জন।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডঃ এ আর মল্লিক এ সময়ের অবস্থা বিশ্লেষণ করে এ মর্মে মন্তব্য করেছেন যে, “হিন্দুরা সরকারের অতিরিক্ত সুবিধা ভোগ করতো। বিভিন্ন সরকারী কাজকর্ম দেখে একথা প্রমাণ করা যায়। যেমন সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান হিন্দুপ্রধান অঞ্চলেই ছিলো। বাংলার পূর্ব এবং উত্তরাঞ্চলে মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় স্কুল স্থাপন করা হয়েছে অনেক পরে। পশ্চিম বাংলার হিন্দু প্রধান অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে অনেক আগে।……মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় স্কুল কলেজের শ্লথ প্রসারের ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানরা এতো পিছিয়ে পড়ে।”
তৎকালীন নথিপত্র পরীক্ষা করে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। ১৮৪৭-৪৮ সালে অবিভক্ত বাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বছরে যে ৬১ দিন ছুটির জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছিলো তার মধ্যে মুসলমানদের উৎসবের জন্য একদিনও নির্দিষ্ট ছিলো না। এমনকি বছরে দুইটি ঈদের দিনেও ছুটি ছিলো না। এ সময় সরকারের শিক্ষানীতি নির্ধারণের জন্য যে শিক্ষা কাউন্সিল গঠিত হয়েছিলো তাতে ইউরোপীয়রা ছাড়া বাকী সমস্ত সদস্যই নিযুক্ত হয়েছিলো কোলকাতার হিন্দু বুর্জোয়াদের মাঝ থেকে। এই হিন্দু সদস্যরাই সেদিন ছুটির তালিকা প্রণয়ন করে সরকারকে দিয়ে অনুমোদন করিয়ে নিয়েছিলেন।
বংগীয় এলাকায় মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে ইংরেজ শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক ‘নিষ্কর জমির বাজেয়াপ্তকরণ। এর ফলে শুধু যে বাঙালি সম্ভ্রান্ত মুসলমানেরা আর্থিক দিক দিয়ে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো, তাই-ই নয়; এইসব জমির আয় থেকে পরিচালিত মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও হয় আর্থিক দুর্গতির সম্মুখীন হলো, না হয় একের পর এক বন্ধ হয়ে গেলো। যুগের পর যুগ ধরে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেসব মুসলমান ছাত্র বিনা মাহিনা ছাড়াও বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থার মাধ্যমে পড়াশোনা করছিলো, তার দ্বার চিরতরে রুদ্ধ হয়ে গেলো।
সাংবাদিক ও গবেষক মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহর মতে, “মুসলমানদের নিকট হইতে নানা ভুয়া অজুহাতে জমিদারী, তালুকদারী, লাখেরাজ সম্পত্তি ইত্যাদি কাড়িয়া লওয়ার ফলে দেশের অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আয়ের প্রধান উৎসটি বন্ধ হইয়া যায়। বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে সকল ওয়াকফ্ সম্পত্তির আয়ের টাকায় পরিচালিত হইত সে সকল সম্পত্তির বেশীরভাগ বাজেয়াপ্ত হওয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির অপমৃত্যু ঘটে।” (আমাদের মুক্তি সংগ্রাম : বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৭৮)
গবেষক কাজী আবদুল ওদুদ-এর এ সম্পর্কে বক্তব্য হচ্ছে, “মুসলমানদের অবস্থার পরিবর্তন আরম্ভ হলো দশসালা বন্দোবস্ত থেকে, আর তাদের সম্ভ্রান্তদের আর্থিক দুর্গতি চরমে পৌঁছালো সনদ দেখাতে না পেরে যখন তাঁদের বহু নিষ্কর জমিজমা বাজেয়াপ্ত হয়ে গেলো।” (শাশ্বত বংগ :ব্রাক প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮৩)।
এখানে উল্লেখ্য যে, মুসলিম শাসন আমলে গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব আদায়ের পদগুলো ছিলো মুসলমানদের হাতে এবং তাঁদের অধীনে কর্মরত হিন্দু কর্মচারীরা কৃষকদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষভাবে রাজস্ব আদায় করতো। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর আমলের প্রথম দিকেও এই ব্যবস্থা চালু ছিলো। কিন্তু ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ-এর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে নতুন বর্ণহিন্দু জমিদার শ্রেণীর অভ্যুদয় এবং স্যার জন শোর-এর সুপারিশ মোতাবেক বাংলাদেশের জেলায় জেলায় ইংরেজ কালেক্টার নিয়োগের ফলে রাজস্ব বিভাগের উচ্চ পদগুলো থেকে মুসলমানদের অপসারণের ফলে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে। অথচ রাজস্ব বিভাগের মধ্য ও নিম্নপদগুলোতে বাঙালি হিন্দু কর্মচারীদের অবস্থানের কোনই হেরফের হলো না। এঁরা কেবলমাত্র মুসলমান কর্তৃপক্ষের পরিবর্তে ইংরেজ ‘বস’ লাভ করলো এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগে নিজেরাই সম্পদশালী হয়ে উঠলো।
লাখেরাজ সম্পত্তি হস্তান্তরের চাঞ্চল্যকর ইতিহাস
সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে এদেশে লাখেরাজ বা নিষ্কর জমির ব্যাপারে এক বিরাট পূর্ব ইতিহাস রয়েছে। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ডঃ আজিজুর রহমান মল্লিক চমৎকারভাবে এর বর্ণনা প্রদান করেছেন। তিনি লিখেছেন, “বহুদিন থেকে ভারতবর্ষের শাসনকর্তাগণ সাধারণ মানুষের বিদ্যাশিক্ষার জন্য লাখেরাজ জমি মঞ্জুর করতেন। দেবদেবীর পূজার্চনা করার জন্যও তাঁরা ভূমির ব্যবস্থা করতেন। শাসনকর্তাগণ অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী থাকতেন। মুসলমান শাসনের দায়িত্বপূর্ণ অফিসারদেরকে তাদের চাকরির ভাতা ছাড়াও প্রত্যেকের জ্ঞানবুদ্ধি, সততা, অন্যান্য গুণের ভিত্তিতে জায়গীর, আলতামা, আইমা এবং মদদ-ই-মাশ দেয়া হতো। (জায়গীর এবং আলতামা সাধারণতঃ সিভিল এবং সামরিক অফিসারকে দেয়া হতো, আর আইমা এবং মদদ-ই-মাশ দেয়া হতো জ্ঞানী-গুণীগণকে। জায়গীর সাধারণভাবে দিলেও রাষ্ট্রীয় নিযুক্তির সময় উত্তরাধীকারীকেই দেয়া হতো।…আর মসজিদ, মাজার ও অন্যান্য পবিত্র স্থানের জন্য ভূমি মঞ্জুর করা হতো)। এছাড়াও তারা নানা প্রকার বৃত্তি ভোগ করতো। শুধু মুসলমানদের জন্যই এসময় পনের প্রকারের আয়কর মওকুফের মঞ্জুরী ছিলো, তিন প্রকারের ছিলো হিন্দুদের……” (বৃটিশ নীতি ও বাংলার মুসলমানঃ বাংলা একাডেমী, ঢাকা)।
পলাশী যুদ্ধের প্রায় ১৫ বছর পর ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী তরবারির জোরে বঙ্গীয় এলাকায় তহশিলদারী আদায়ের দায়িত্ব নেয়ার পর ভেবেছিলো যে, জমির খাজনা আদায়ের উদ্বৃত্ত অর্থ থেকে কোম্পানীর প্রশাসনিক ব্যয়ভার বহন করা ছাড়াও কিছু লভ্যাংশ লণ্ডনস্থ কোম্পানীর হেড অফিসে পাঠানো সম্ভব হবে। কিন্তু বাস্তবে তা না হওয়ার ফলে ১৭৭২ খ্রীষ্টাব্দে ওয়ারেন হেষিটংস সর্বপ্রথম হিসেব করে বের করলেন যে, বাংলাদেশের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ জমি একেবারে নিষ্কর অর্থাৎ লাখেরাজ হয়ে রয়েছে। এরপর থেকেই ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী নানা বাহানায় এইসব জমি খাজনাযুক্ত করার জন্য এক “অঘোষিত যুদ্ধ” অব্যাহত রাখে। জমির প্রকৃত মালিকানা স্থিরকরণ-এর অছিলা এসব বাহানার অন্যতম। এসবের মধ্যে ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দের ১৯ নং এবং ৩৭ নং আইন; ১৮১১ খ্রীষ্টাব্দের ৮ নং আইন; ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দের ১১ নং এবং ১৩ নং আইন; ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দের ২ নং আইন; ১৮২৮ খ্রীষ্টাব্দের ৩ নং আইন; ১৮৩৪ খ্রীষ্টাব্দের কোর্টের নির্দেশ প্রভৃতি অন্যতম। ১৮৪৬ সালের ৪ঠা মার্চ তারিখে জারিকৃত এক সরকারী নির্দেশে বলা হয় যে, লাখেরাজ ভূমির মালিকানা নির্ধারণ এবং রেজিষ্ট্রীকরণ করার পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা হলো। বোর্ডস কালেকশন নং ৭৪০৭৩ সূত্র মোতাবেক দেখা যায় যে, ইংরেজ সরকারের কাছে পেশ করা ২০ হাজার লোকের যুক্ত দরখাস্তের এ সময় আর ন্যায় বিচার পাওয়া যায়নি।
কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেলো যে, মাঝে মাঝে দেশের দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ও রোগ মহামারী, চোর, ডাকাত, গৃহবিবাদ, মারাঠা আক্রমণ এবং আভিজাত্যের বড়াই-এর দরুন মুসলমানেরা এসব দলিল-দস্তাবেজ সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ করতে পারেনি। কিন্তু হিন্দুদের ক্ষেত্রে বিষয়টা ছিলো স্বতন্ত্র ধরনের। কেননা অতীতে মুসলিম কিংবা বর্তমানে ইংরেজ এই দুই-ই ছিলো তাঁদের দৃষ্টিতে শাসক গোষ্ঠী। তাই অনুগত প্রজা হিসেবে হিন্দুদের দলিলপত্র মোটামুটিভাবে সঠিকভাবে রক্ষিত ছিলো।
অন্যদিকে এ সময় আরও দু’টি সমস্যা প্রকটভাবে দেখা দিলো। প্রথমতঃ দলিল রেজিষ্ট্রি করতে কালেক্টারদের শৈথিল্য। প্রাপ্ত হিসেবে দেখা যায় যে, একমাত্র বর্ধমান জেলাতেই এসময় ৭২ হাজার নিষ্কর জমি রেজিষ্ট্রির আবেদনের প্রায় ৬৭ হাজারই কেবলমাত্র নকল করে কোর্টে ফেলে রাখা হয়েছিলো। আর দ্বিতীয়তঃ ত্রুটিপূর্ণ বিচার পদ্ধতি। এ সম্পর্কে ডঃ এ আর মল্লিক লিখেছেন, “সনদ রেজিষ্ট্রি না করার অজুহাতে অধিকাংশ মোকদ্দমা সরকারের পক্ষেই রায় হতো। কষ্ট, হয়রানি ও ব্যয় নির্বাহের ভয়ে এ সমস্ত মামলায় আপীলও করা হতো না। আর যদি কোন ব্যক্তি আপীল করতো, তবে কালেক্টাররা শুধু রেজিষ্ট্রি না করার কারণই দর্শাতো এবং বিশেষ কমিশনার কোন প্রকার বাদ-বিচার না করেই তা মেনে নিতো।……
……মুসলিম লাখেরাজদের মধ্যে যারা পল্লী এলাকায় বাস করতো, তারা এ সমস্ত আইন সম্পর্কে অনেক সময় কিছুই জানতো না।……লাখেরাজ সম্পত্তি পূর্ব আইনানুসারে রেজিষ্ট্রি করিয়ে না নিলে, তা বৈধ বলে গৃহীত হতো না এবং তাদের প্রতি নির্মম ব্যবহার করা হতো। ষাট-সত্তর বছরের পূর্বের পূর্বপুরুষের ত্রুটির প্রত্যক্ষ শিকার হতো তারাই (লাখেরাজদার)। মূলতঃ দোষ ছিলো কালেক্টারদেরই। তারা বিভিন্ন বিজ্ঞপ্তি বহুল প্রচার করতে পারতো না এবং কর্মচারীর অভাবে সমস্ত রেজিষ্ট্রেশনও শেষ করতে পারতো না।” (বৃটিশনীতি ও বাংলার মুসলমান : বাংলা একাডেমী, ঢাকা)।
তৎকালীন ভারত সরকারেরই একজন ইংরেজ সদস্য স্যার চার্লস মেটকাফ রাজস্ব নীতি সম্পর্কে ১৮২০ সালে মন্তব্য করেছেন যে, “……এ নীতি হচ্ছে অন্যায়-অবিচারের চূড়ান্ত; কোন দেশেই এরকম নীতির নজির নেই যেখানে সমস্ত জমিজমা যাদের প্রাপ্য তাদেরকে না দিয়ে অন্য এক গোষ্ঠী বাবুর হাতে তুলে দেয়া হলো যারা নানা দুর্নীতি ও উৎকোচের আশ্রয় নিয়ে দেশের ধনসম্পত্তি চুষে খেতে চায়।”
“এটা এখন স্পষ্ট হলো যে, ১৮৫৬ খ্রীঃ-এর দিকে সরকারী সমস্ত বিভাগেই মুসলমানদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হলো। তাছাড়া অফিস-আদালতের ভাষার পরিবর্তন এবং চাকরি নিযুক্তি নীতি মুসলমানদের চরম অসুবিধের সৃষ্টি করলো এবং সরকারী চাকরিতে এভাবে দু’টি সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পূর্ণ বিপরীত বৈষম্য গড়ে উঠলো। বস্তুতঃ, ম্যাজিস্ট্রেট অথবা জুরি পর্যায়ের উচ্চ চাকরি থেকে সামান্য কেরানী অথবা ব্যবসা কেন্দ্রে নগণ্য ম্যানেজারের চাকরি পর্যন্ত হিন্দুরাই পড়ালেখার দিক থেকে প্রবলভাবে সাড়া জাগালো। সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় যেকোন অবস্থায় থাকাই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য, চাকরিতে অতি সামান্য বেতন পাওয়া কখনো তাদের দুঃখের কারণ ছিলো না। অবশ্য এরও একটি পরোক্ষ সুবিধে মনে করতো তারা। কারণ, মোটামুটি একটি ভালো অবস্থায় থাকতে পারলে সমস্ত পরিবারের জন্যেই তা আশীর্বাদ স্বরূপ ছিলো, একজন হিন্দু এভাবে তার শক্তি অনুসারে পরিবারের সমস্ত লোককেই চাকরিতে প্রবেশ করাতে সক্ষম হতো।
এই অবস্থায় মুসলিম উচ্চবিত্তদের আয় কমে গেলো। নবোদ্ভূত হিন্দু মধ্যবিত্তরা সরকারী সকল প্রকার চাকরি-বারি থেকে মুসলমানদের বহিষ্কার করে দিলো। রাজনৈতিক এই পরিবর্তনের ফলে নেতৃস্থানীয় মুসলিম পরিবারগুলো বিনষ্ট হয়ে গেলো।” (বৃটিশ নীতি ও বাংলার মুসলমান : বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮২)।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে, ‘অনুগত’ বাঙালি বর্ণহিন্দুদের পৃষ্ঠপোষকতা করা ছাড়াও বাঙালি মুসলমানদের স্বাধীনতার মনোভাব এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে বাঙালি মুসলমান কৃষকদের অনেকক’টা ব্যর্থ বিদ্রোহ-এর জের হিসেবে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীও একটার পর একটা বাঙালি হিন্দু-ঘেঁষা নীতি গ্রহণ করেছিলো। তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এদেশে ইংরেজদের আগমনের প্রথম দেড়শ’ বছর পর্যন্ত এঁদের নীতি মুসলিম বিদ্বেষ এবং হিন্দুপক্ষপাতিত্বের মধ্যে উলঙ্গভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ইংল্যান্ডে ও তৎকালীন ভারতে নেতৃস্থানীয় ইংরেজদের বক্তব্য-বিবৃতি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই এসব সুদূরপ্রসারী নীতি গ্রহণ করা হয়েছিলো বলে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
মুসলমানরা এসময়ে সন্তুষ্ট ছিলো কিনা সে বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে ১৮৯৩ সালে লন্ডনে সিলেক্ট কমিটির নিকট স্যার জন ম্যাকন সুস্পষ্টভাবে বলেছেন— “আমি মনে করি, মুসলিম জনসংখ্যার এক বৃহৎ অংশ ঠিক সে রকম সন্তুষ্ট নয়। কারণ তাদের স্মৃতিতে কেবল বিলুপ্ত ক্ষমতার দহন আছে, যা হিন্দুদের স্মৃতিতে নেই …… আমাদের সঙ্গে এখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনই ভারতবর্ষে আমাদের প্রধান নিরাপত্তার অবলম্বন।”
কর্ণেল থমাস মনরু নামক আর এক ইংরেজ একই সিলেক্ট কমিটিতে বলেছেন, “হিন্দুরা কোম্পানীর শাসনব্যবস্থায় সন্তুষ্ট থাকলে অসন্তুষ্ট মুসলমানরা বহুল পরিমাণে শক্তিশালী হয়েও কোন ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম হবে না।”
ক্যাপ্টেন টি, মেকান সিলেক্ট কমিটির কাছে যে মন্তব্য করেছেন তা আরও চমকপ্ৰদ। “মুসলমানরাও কৃতকার্যতার বিন্দুমাত্র আশা পেলেই ইউরোপীয় যে কোন শক্তির সংগে যুক্ত হতে পারে। কারণ তাদের বর্তমান পরাধীনতা থেকে মুক্তিলাভ করার ক্ষীণ আশা পোষণ করাও ভবিষ্যতের জন্যে সুখকর। হিন্দুরা সবসময় মুসলমানদের তুলনায় বৃটিশ রাজশক্তির প্রতি অধিক আস্থাবান।”
.
ইতিপূর্বে বর্ণিত পরিস্থিতির সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে একথা সুস্পষ্টভাবে বললে যথার্থই হবে যে, অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে পরাশক্তি ইংরেজদের গৃহীত প্রতিটি নীতিই যেমন মুসলিম স্বার্থবিরোধী বলে প্রমাণিত হয়েছে, কোলকাতা কেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীদের কর্মকাণ্ডও তেমনি নিজেদের গোষ্ঠী ও শ্রেণী স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সম্পূরক হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তা অন্ততঃপক্ষে বাংলার মুসলমানদের জন্য খুব একটা সুখকর হয়নি। তাহলে বিষয়টা আরও পরিষ্কারভাবে অনুধাবনের লক্ষ্যে সে আমলে বাংলা তথা ভারতের মুসলিম নেতৃত্ব কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন এবং তা সঠিক, সুষ্ঠু ও সময়োপযোগী ছিলো কিনা, সেটাও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা অবশ্য বাঞ্ছনীয় বলে মনে হয়।
আলোচ্য সময়কালে বহুসংখ্যক কৃষক বিদ্রোহ ও সিপাহী বিপ্লব ছাড়াও শুধুমাত্র মুসলমানদের দ্বারা মূলতঃ ধর্মীয় শ্লোগান দিয়ে পরিচালিত বংগীয় এলাকায় হাজী শরিয়তউল্লাহ ও পীর দুদু মিয়ার নেতৃত্বে ফারায়েজী আন্দোলন, পশ্চিম বাংলার বারাসতে তিতুমীর-এর বিদ্রোহ এবং সৈয়দ আহম্মদ ব্রেলভীর ওহাবী আন্দোলন সম্পর্কে বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সাংবাদিক মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ মন্তব্য করেছেন, “ইহাদেরই (ইংরেজদের) হাতে নির্যাতনের ভয়ে মুজাহিদগণ (ওহাবী) অতঃপর কখনও সাধু-ফকিরের বেশে এবং কখনও ব্যবসায়ীর বেশে প্রচারকার্য চালাতে থাকেন। তবু এদেশে বৃটিশ শাসন তাহারা সহজভাবে গ্রহণ করে নাই। গবেষক ও ইতিহাসবিদ ডঃ এ আর মল্লিক এসব ধর্মীয় আন্দোলনকে “ভারতীয় ইসলামে প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কার আন্দোলন” নামে আখ্যায়িত করেছেন এবং বৃটিশ আমলে মুসলমানদের পিছিয়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কিত স্বীয় বক্তব্যের সমর্থনে বহু তত্ত্ব ও তথ্য উপস্থাপনা ছাড়াও প্রসংগতভাবে নানা মূল্যবান পুস্তকাদি থেকে উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন।
বিশিষ্ট গবেষক কাজী আবদুল ওদুদ বলেছেন, “মুসলমানেরা যে দুটি কারণে ইংরেজী শিখতে এগুলো না, তার প্রথমটি ধর্মনাশভয় –এ সময়ে দেশে খ্রীষ্টান করবার ও হবার হিড়িক পড়ে যায়— কিন্তু দ্বিতীয় কারণটি প্রথম কারণের চাইতে অনেক বড়, সেটি— নব রাজশক্তির প্রতি মুসলমানদের বিরূপতা দীর্ঘ ওহাবী বিদ্রোহের ভিতরে রয়েছে যার সুস্পষ্ট পরচিয়। এর সংগে মুসলমান জগতে মুস্তফা কামালের (তুরস্কের) আবির্ভাবের কথাও স্মরণীয়। ওহাবীদের আদিম ইসলামে প্রত্যাবর্তনবাদ আজো যত প্রবলই হোক কামালের বিজ্ঞানবাদ ও জাতীয়বাদের অপূর্ব সাফল্য যে তার যোগ্য প্রভাব বিস্তারে অপারগ হবে না, এ আশা করা যায়। (১৩৪৪ বংগাব্দ)।”
অবশ্য এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত গবেষণার পূর্বে কোন রকম সুস্পষ্ট মতামত দেয়া সম্ভব না হলেও এটুকু বলা যায় যে, বংগীয় এলাকায় কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণ হিন্দুরা অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই ইংরেজের বশ্যতা স্বীকার করে নিজেদের শ্রেণী ও গোষ্ঠীকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সচেষট হয় এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে স্বাধীনতাবিহীন অবস্থায় ধর্মনিরপেক্ষতাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে পরাশক্তির সহযোগী হিসেবে পাশ্চাত্য সভ্যতার ভাষা, কৃষ্টি ও রীতিনীতিকে অনুকরণ এবং অনুসরণ করে ‘বাঙলার রেনেসাঁ’ নামীয় শ্লোগানে সোচ্চার হয়েছিলো। পক্ষান্তরে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে, ১৮৭০ সাল নাগাদ ওহাবী আন্দোলনের ব্যর্থতার পরে স্যার সৈয়দ আহমদ, নওয়াব আবদুল লতিফ, বিচারপতি আমীর আলী, মীর মোশাররফ হোসেন, রেভারেন্ড জেমস লং প্রমুখের প্রচেষ্টায় বাঙলার মুসলমানরা শেষ পর্যন্ত ইংরেজ রাজত্বের বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেয়। ডক্টর এ আর মল্লিক-এর মন্তব্য আবারো প্রণিধানযোগ্য যে, “মুসলমানদের সবচাইতে বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শ্লথ অভ্যুত্থান। অথচ আধুনিককালে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীই একটি জাতির সকল প্রকার উন্নতির সোপান। ক্ষমতা হারিয়ে মুসলমানরা ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করেনি। ফলে তারা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্ম দিতে সক্ষম হয়নি। সুতরাং তাদের দাবী-দাওয়ার প্রতি সমর্থন জানাবার আর কেউ রইলো না। ফলে নতুন সরকারের (ইংরেজের) কাছে থেকে তারা কোন উপকারও আদায় করে নিতে পারলো না।”