কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী – ৩

সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ায় ‘আনন্দ’ ও ‘উল্লাস

ইতিহাসের এই চাঞ্চল্যকর প্রেক্ষাপট স্পষ্টভাবে অনুধাবন করার জন্য এসব ঘটনাবলীর আরও কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা অপরিহার্য বলে মনে হয়। আগেই উল্লেখ করেছি যে, কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী মহল কোন্ প্রেক্ষিতে নিজেদের শ্রেণী ও গোষ্ঠী স্বার্থে ‘সিপাহী বিদ্রোহের’ (বিপ্লব) বিরোধিতা করেছিলো এবং এই ‘বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর এঁরা কিভাবে ‘আনন্দ’ ও ‘উল্লাস’ প্রকাশ করেছিল। এর পরবর্তী বছরগুলোতে আমরা দেখতে পাই যে, বাঙালি তথা ভারতীয় ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’-কে জাগ্রত করার লক্ষ্যে ইংরেজ পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণী বাংলা কবিতা, গান, উপন্যাস, নাটক ও যাত্রাগানে’ কিরকম নগ্নভাবে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। অবশ্য এর আগেই প্রায় এক শতাব্দীকাল ধরে কোলকাতা কেন্দ্রিক এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণী পাশ্চাত্যের ইংরেজ সভ্যতা ও সংস্কৃতির অনুকরণ, অনুসরণ ও গলাধঃকরণ করে সাম্রাজ্যবাদী সম্পূরক হিসেবে নিজেদের অবস্থানকে সুদৃঢ়. করেছে। উভয়ের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এক অশুভ আঁতাত।

এরকম এক পটভূমিতে ঊনবিংশ শতাব্দীর ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম দশকের ঘটনাবলী বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ১৮৪৭ সাল থেকে শুরু করে ১৮৬৯ সাল নাগাদ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে বাংলা গদ্য প্রকৃত সাহিত্য রূপ লাভ করেছে। ১৮৬০ সালে মধুসূদনের ‘পদ্মাবতী’ নাটকে সকলের গ্রহণযোগ্য সংলাপের ব্যবহার শুরু হয়েছে। ১৮৭২ সালে কোলকাতায় বঙ্কিমচন্দ্রের বংগ দর্শন পত্রিকায় আত্মপ্রকাশ হয়েছে। একই বছরে ‘শ্যামবাজার নাট্যসমাজ’ সাধারণ রংগালয়ে রূপান্তরিত হয়ে ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ নামকরণে চিহ্নিত হয়েছে। ১৮৬৭ সালে ‘হিন্দুমেলা’ এবং ১৮৭৬ সালে ‘ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের’ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। রোমাঞ্চধর্মী ঔপন্যাসিক বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৬৫ সালে ‘দুর্গেশ নন্দিনী’ উপন্যাস দিয়ে শুরু করে ১৮৮১ সালে ‘রাজসিংহ’ পর্যন্ত বেশ কিছুসংখ্যক উপন্যাস লেখা সমাপ্ত করেছেন এবং বাঙালিত্বের নামে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘বন্দেমাতরম’ শ্লোগান উচ্চারণ করেছেন। তাঁর শক্তিশালী লেখনী তখন সাম্প্রদায়িকতা ও শ্রেণী বিদ্বেষে ভরপুর। এসময়ের বাংলা নাটকগুলোতে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদের আদর্শ অত্যন্ত নগ্নভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। হাতে-গোণা গুটিকয়েক বাদ দিয়ে এসব নাটকগুলোর মধ্যে হরলাল রায়-এর ‘হেমলতা’ (১৮৭৩) ও ‘বংগের সুখাবসান’ (১৮৭৪,) কিরণচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়-এর ‘ভারতে যবন’ (১৮৭৪), হারাণচন্দ্র ঘোষ-এর ‘ভারত দুঃখিনী’ (১৮৭৫), নটেন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর ‘এই কি সেই ভারত’ (১৮৭৫), কুঞ্জবিহারী বসুর ‘ভারত অধীন’ (১৮৭৬), জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পুরুবিক্রম’ (১৮৭৪), ‘সরোজিনী’ (১৮৭৫), ‘অশ্রুমতী’ (১৮৭৯) ও ‘স্বপ্নময়ী’ (১৮৮২) এবং গিরিশ ঘোষ-এর ‘আনন্দ রহো’ ১৮৮১ প্রভৃতি অন্যতম।

এখানে পুনরায় উল্লেখ করতে হয় যে, এসব নাটক রচিত হওয়ার আগে উদার মনোভাবাপন্ন কবি ও নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘কৃষ্ণ কুমারী’ (১৮৬১) রচনার পরে স্বার্থান্বেষী মহলের বিরোধিতার দরুন ‘সুভদ্রা’ নাটক সমাপ্ত করতে পারেননি এবং ‘রিজিয়া’ নাটক লেখার প্রচেষ্টা বাধ্য হয়ে বাদ দিয়েছেন। উপরন্তু তাঁর দু’টি প্রহসন নাটক ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ বেলগাছিয়া নাট্যশালার মালিকরা মঞ্চস্থ হতে দেয়নি। আলোচ্য সময়ে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ (১৮৬০), মীর মোশাররফ হোসেন-এর “জমিদার দর্পণ’ (১৮৭৩) এবং দক্ষিণারঞ্জন চট্টোপাধ্যায়-এর ‘চা-কর দর্পণ’ (১৮৭৫) নাটক তিনটি বেশ কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী বলে এই তিনজন লেখককে প্রচন্ড রকমের সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। অবশ্য ১৮৮৩ সাল নাগাদ রবীন্দ্রাথ ঠাকুর তাঁর প্রথম নাটক ‘বৌঠাকুরানীর হাট’ রচনা করেছেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের সামাজিক ইতিহাস পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে, ১৮৭২ সাল থেকে ১৮৭৬ সাল পর্যন্ত সময়ের ইতিহাস বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৭২ সালের জুলাই মাসে (ভাদ্র ১২৮০) বংকিমচন্দ্রের বংগ দর্শণ পত্রিকায় মীর মোশাররফ হোসেন কৃত ‘জমিদার দর্পণ নাটকটি বেআইনী ঘোষণার দাবী জানানো হয়েছে এবং দীনবন্ধু মিত্রের রচিত ‘নীল দর্পণ’ নাটকের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয়েছে।

এরই পাশাপাশি ১৮৭২ সালের ২১শে ডিসেম্বর কোলকাতার ‘দি ইংলিশম্যান’ (ক্যালকাটা স্টেটসম্যান) পত্রিকায় ‘নীল দর্পণ”-এর প্রথম রজনীর অভিনয়ের পরেই ইংরেজদের ‘মানহানির’ অভিযোগ উত্থাপন করে নাটকটির অভিনয় বন্ধের দাবী জানানো হয়। কর্তৃপক্ষ ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে দ্বিতীয় রজনীর অভিনয়ের পূর্বে কথিত সম্মানহানিকর’ অংশ বাদ দেয়ায় নাটকটি সে যাত্রায় রক্ষা পায়।

নাট্যকার গিরিশ ঘোষ-এর হিন্দু ভক্তি-দর্শন প্রীতি

এই প্রেক্ষিতে আলোচ্য সময়ে প্রখ্যাত নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষের কর্মময় জীবন সম্পর্কে আরও কিছুটা আলোকপাত করা অপরিহার্য বলে মনে হয়। গিরিশচন্দ্র ঘোষের আবির্ভাব এমন একটা যুগে হয়েছে যখন হিন্দুমেলার (১৮৬৩) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সরোজিনী’ (১৮৭৫), ‘অশ্রুমতী’ (১৮৭৯) এবং ‘স্বপ্নময়ী’ (১৮৭৯) নাটকগুলোর মাধ্যমে মুসলিম বিদ্বেষ-এর প্রচারণা তুংগে রয়েছে এবং সমসাময়িককালে বংকিমের ‘আনন্দমঠ (১৮৮২) উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ১৮৮৩ সালে নাট্যকার কেদার চৌধুরী ‘আনন্দমঠ’-এর নাট্যরূপ দান করেন এবং এবছরেই কোলকাতার ন্যাশনাল থিয়েটারে আনন্দমঠ মঞ্চস্থ হয়।

বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ মূলতঃ হিন্দু পৌরাণিক নাট্যকার। তিনি সর্বমোট ৭৭টি নাটক ও প্রহসনাদি রচনা করে গেছেন। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর প্রথম চার বছর অর্থাৎ ১৯০৪ সাল পর্যন্ত তাঁর অধিকাংশ নাটক হিন্দু ধর্মীয় দর্শনভিত্তিক এবং তিনি ভক্তির প্লাববে কোলকাতার রংগমঞ্চ প্লাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এক কথায় এসব নাটককে গীতিনাট্য, রোমান্টিক নাটক এবং পৌরাণিক নাটকের শ্রেণীভুক্ত করা যায়। কিন্তু এসব নাটকের সর্বত্রই হিন্দু ভক্তি দর্শনের জন্য তাঁর সোচ্চার কন্ঠস্বর। অবশ্য এই সময়কালে তিনি বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক নাটকও রচনা করেছেন। এসবের মধ্যে ‘আনন্দে রহো’ (১৮৮১), ‘মহাপূজা’ (১৮৯১), ‘চন্ডু’, (১৮৯১), ‘কালাপাহাড়’ (১৮৯৬), ‘সৎনাম বা বৈষ্ণবী’ (১৯০৪) এবং ‘রাণা প্রতাপ’ (১৯০৪) অন্যতম। শেষোক্ত নাটকখানি তাঁর অসম্পূর্ণ রচনা।

কিন্তু সুষ্ঠুভাবে বিচার করলে এগুলোকে ঐতিহাসিক নাটক বলা যায় না। তাঁর পূর্বসুরী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুসরণে তিনি এসব নাটকে অবাধ কল্পনার আশ্রয় গ্রহণ করেছেন এবং এ সবগুলোতে যাত্রার প্রভাব বিদ্যমান। সবচেয়ে উল্লেখ্য বিষয় হচ্ছে এই যে, এসব নাটক রচনার সময় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মত তিনিও জেমস টড-এর ‘এ্যানালস এ্যাণ্ড এ্যানটিকস অব রাজস্থান’ পুস্তকের বক্তব্যের দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবান্বিত ছিলেন। তাঁর রচিত ঐতিহাসিক (?) নাটকগুলো রাজপুত চরিত্র-ভিত্তিক। উপরন্তু তিনি হিন্দু ধর্মবোধ ও দেশাত্মবোধের সংমিশ্রণে ‘মুক্তির সন্ধান’ দেখতে পেয়েছিলেন বলে নিজেই দাবী করে গেছেন। এটাকেই তিনি জাতীয়তাবোধ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এক কথায় বলতে গেলে তিনি হিন্দু রিভাইভালিজম-এর স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর সুস্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে, ….যদি নাটকের সার্বজনীন হওয়া প্রয়োজন হয়, তবে কৃষ্ণ নামেই হইবে।….. হিন্দুস্হানের মর্মে মর্মে ধর্ম। মর্মাশ্রয় করিয়া নাটক লিখিতে হইলে ধর্মাশ্রয় করিতে হইবে। এই মর্মাশ্রিত ধর্ম বিদেশীর ভীষণ তরবারি ধারে উচ্ছেদ হয়নি”। (গিরিশচন্দ্র ঘোষঃ পৌরাণিক নাটক প্রবন্ধ)।

তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ধর্মবোধ এবং হিন্দু পুরানের প্রতি আন্তরিক নিষ্ঠার দরুন গিরিশচন্দ্র ১৯০৪ সাল পর্যন্ত যেসব ঐতিহাসিক নাটক রচনা করেছেন, তার সবগুলোতেই নৈতিক ও আধ্যাত্মিক আদর্শের বাহন হওয়া ছাড়াও স্বাভাবিকভাবেই পরধর্ম বিদ্বেষী হয়েছে। বংগভংগের অব্যবহিত পূর্বে গিরিশচন্দ্রের রচিত ‘সৎনাম’ বা ‘বৈষ্ণবী’ (১৯০৪) নাটকে অন্যতম চরিত্র বৈষ্ণবীর সংলাপ হচ্ছে, “……এই তো, এ বাড়ীতে মুসলমানেরা আমোদ কচ্ছে, ঐ শোনো যন্ত্রের ধ্বনি শোনো, আকাশব্যাপী সুর লহরী শোনো- তলোয়ার হাতে আছে, যাও গিয়ে বধ করো”।

এই ‘সৎনাম’ বা বৈষ্ণবী’ নাটকটি এতো বেশী মুসলিম বিদ্বেষী ছিল যে, কোলকাতার তৎকালীন সংখ্যালঘু মুসলমানরা এর বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ উত্থাপন করে। এ সম্পর্কে ১৯০৪ সালের ২৭শে মে তারিখে ‘মিহির ও সুধাকর’ পত্রিকায় নিম্নোক্ত সংবাদটি প্রকাশিত হয়ঃ

“গিরিশবাবুর সৎনাম মহানাটক লইয়া গত শনিবারে ভীষণ কাণ্ড সংঘটিত হইয়াছিল। মুসলমানদের কুৎসাপূর্ণ নাটক অভিনয় করিতে দিব না বলিয়া কলিকাতা শহরের প্রায় ২/৩ সহস্র মুসলমান ক্লাসিক থিয়েটারের সম্মুখে সমবেত হইয়াছিলেন, শহরে হুলস্থুল পড়িয়া গিয়াছিল, নাটক অভিনয় বন্ধও হইয়াছিল”।

‘সৎনাম’ নাটক রচনা পর্যন্ত তাঁর অন্ধ বিশ্বাস ছিল যে, “তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বপক্ষে সোচ্চার হয়েছেন এবং নাটকে স্বদেশপ্রেমের প্রবল তরংগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন”। অথচ বাস্তবে ‘সৎনাম’ নাটকটি হচ্ছে বাঙালি হিন্দু জাতীয়তাবাদের মোড়কে পরিবেশিত এবং সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে জর্জরিত।

এজন্যই দেখা যায় যে, ‘হিন্দুমেলার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং বাঙালি হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা জ্যোতিরিন্দ্রথান ঠাকুর ‘সরোজিনী’ নাটকের পর আর নাটক রচনা না করে রাজনৈতিক অংগনে প্রবেশ করার কারণ হিসেবে সত্য ভাষণ করে গেছেন। অমৃতলাল বসু একদিন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঐতিহাসিক নাটক রচনা বন্ধের কারণ জিজ্ঞেস করলে, শ্রীঠাকুরের জবাব হচ্ছে, “নাট্য জগতে গিরিশচন্দ্র প্রবেশ করিয়াছেন, আমার নাটক রচনার আর প্রয়োজন নাই”। (মন্মথনাথ ঘোষ : ‘জ্যোতিরিন্দ্রনাথ’ পূঃ ১০৯)।

অবশ্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ সম্পর্কে একটা মন্তব্য এখানে বিশেষভাবে প্রাসংগিক হবে বলে মনে হয়। ১৯০৫ সাল নাগাদ বড়লাট লর্ড কার্জনের আমলে বংগভংগ করে পূর্ববাংলা ও আসামকে নিয়ে একটা পৃথক প্রদেশ সৃষ্টি করা হলে, বাঙালি হিন্দু বিত্তশালী ও বুদ্ধিজীবী মহল শ্রেণীস্বার্থে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে এসময় গিরিশচন্দ্রের ভেতর মানসিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় এবং তাঁর কিঞ্চিৎ ‘মোহমুক্তি’ ঘটে। যে গিরিশচন্দ্র ১৯০৪ সালে মুসলিম বিদ্বেষপূর্ণ ‘সৎনাম’ বা ‘বৈষ্ণবী’ নাটক রচনা করে চরম সাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিচয় দিয়েছিলেন সেই গিরিশচন্দ্রই মাত্র দু’বছরের ব্যবধানে রচনা করলেন ‘সিরাজদৌল্লা’ (১৯০৬) ও ‘মির কাশিম’ (১৯০৬) জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি সর্বপ্রথম মূল শত্রু ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদকে চিহ্নিত করতে উদ্যোগী হলেন। তথাপিও সিরাজদৌল্লা নাটকের গানগুলোতে আশ্চর্যজনকভাবে দেশাত্মবোধ সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। এই নাটকের সংলাপ এবং গানের মর্মকথা প্রকটভাবে বিপরীতমুখী। যেখানে সিরাজদৌল্লা নাটকের সংলাপগুলো স্বদেশ প্রেমের উদ্রেক করে, সেখানে নাটকের গানগুলো পরাশক্তি ইংরেজদের জয়গানে সোচ্চার। এই নাটকে সিরাজ হত্যার পর গানের নমুনা হচ্ছে :

“উড়েছে কোম্পানীর নিশান
বাহাদুর কলির ঠাকুর, ভূবন কাঁপায় যার কামান,
… … …
থাকবে না ডাকাতি, কুকি, আঁধাররেতে চোরের উঁকি,
থাকবে না আর কুলনারীর মানের দায়ে লুকোলুকি”,

তবুও তৎকালীন ইংরেজ সরকার ‘সিরাজদৌল্লা ও ‘মির কাশিম’ নাটক দু’টির অভিনয় ও মুদ্রণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

তাই সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর কয়েকটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট হয়েছে। ১. ইংরেজ শাসন সুদৃঢ়. মেনে নিয়ে চাতুর্যের সংগে সম্পূরক শক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করতে হবে এবং ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করতে হবে। ২. ইংরেজদের রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহার, ভাষা সাহিত্য ইত্যাদি সবকিছুই আধুনিক সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে অনুকরণ করতে হবে। ৩. ইংরেজ শাসক গোষ্ঠীর নিকট আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে হবে। ৪. বাংলা সাহিত্য উপন্যাস নাটকে ইংরেজ রাজশক্তির বদলে অতীতের মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে নির্বিবাদে লিখতে হবে। ৫. বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপর শ্লোগান উচ্চারণ করে ‘বাঙালি হিন্দুয়ানী জাতীয়তাবাদ’ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং ৬. সর্বশেষ সাম্প্রদায়িকতার বীজ এমনভাবে সমাজ জীবনে বপন করতে হবে যার ফলশ্রুতিতে নীল চাষীদের বিদ্রোহ’ কিংবা ‘সিপাহী বিদ্রোহ’-এর মতো অসাম্প্রদায়িক কোন আন্দোলন ও অভ্যুত্থান কিছুই আর সংগঠিত না হয়।

রোম নগরী যখন পুড়িতেছিল সম্রাট নীরো তখন-

আলোচ্য বিষয়ের প্রেক্ষাপটে তৎকালীন বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী মহলের মনমানসিকতা লক্ষ্য করলে বিস্মিত হতে হয়। দীর্ঘস্থায়ী নীল চাষীদের সাফল্যজনক বিদ্রোহ, পাবনায় কৃষকদের রক্তাক্ত অভ্যুত্থান, এমনকি ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ প্রভৃতি কোনও কিছুরই উত্তাপ এদের স্পর্শ করেনি এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীস্বার্থে এসবের সমর্থনে কোনও সার্থক রচনা পর্যন্ত এঁরা করেননি। এটা অনেকটা “রোম নগরী যখন পুড়িতেছিল, সম্রাট নীরো তখন বাঁশি বাজাইতেছিলেন”-এর মতো। এজন্যই ১৮৫৭ এবং ১৮৫৮ এই দুই বছর ধরে যখন সমগ্র উপমহাদেশব্যাপী ‘সিপাহী বিদ্রোহ” দাবাগ্নির মতো ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন কোলকাতা কেন্দ্ৰিক বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী রচিত নাটকগুলো হচ্ছেঃ কালী প্রসন্ন সিংহের ‘বিক্রমোর্বশী’ (১৮৫৭) ও ‘সাবিত্রী সত্যবান’ (১৮৫৮) এবং রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘রত্নাবলী’ (১৮৫৮) প্রভৃতি।

এখানে প্রাসংগিক বিধায় পুনরায় উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, সে যুগের বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’ এবং পণ্ডিত গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘সম্বাদ ভাস্কর’ প্রভৃতি বিশিষ্ট পত্রিকাগুলো ‘সিপাহী বিদ্রোহের’ বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নিন্দা জ্ঞাপনের ক্ষেত্রে অগ্রণীর ভূমিকা পালন করে। এমনকি পরাশক্তি ইংরেজদের পক্ষে জ্বালাময়ী ভাষায় সম্পাদকীয় নিবন্ধ পর্যন্ত প্রকাশ করে। ইংরেজদের বিজয় সংবাদ কোলকাতায় পৌঁছলে ১৮৫৭ সালের ২০শে জুন ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার সম্পাদকীয় হচ্ছে, “যাহারা গোপনে গোপনে অথবা প্রকাশ্যরূপে এই বিষমতর অনিষ্ট ঘটনার ঘটক হইয়া উল্লেখিত জ্ঞানান্ধ সেনাগণকে কুচক্রের দ্বারা কুপরামর্শ প্রদান করিয়াছে ও করিতেছেন তাহাদিগকে দণ্ডদান কর। তাহারা অবিলম্বেই আপনাপন অপরাধ বৃক্ষের ফল ভোগ করুক”।

একই দিনে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সম্বাদ ভাস্কর’ পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্য হচ্ছে, “আমাদিগের সৈন্যরা (ইংরেজ) দিল্লীর প্রাচীরে -উঠিয়া নৃত্য করিতেছে। —- বৃটিশাধিকৃত ভারতবর্ষবাসী প্রজাসকল নির্ভয় হও…“

এর প্রায় মাসাধিককাল পূর্বে অর্থাৎ ১৮৫৭ সালের ২৬শে মে তারিখে ইংরেজদের সমর্থনে কোলকাতার হিন্দু মেট্রোপলিটন কলেজে বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের এক সমাবেশের আয়োজন করা হয়। রাজা রাধাকান্ত দেব-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় কোলকাতার “সম্ভ্রান্ত মহাশয়েরা” যোগদান করেন এবং ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর সরকারকে পূর্ণ সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দানের প্রস্তাব পাশ করেন।

গবেষক ও মনীষীরা প্রায় বলে থাকেন যে, “নাটক হচ্ছে জাতীয় জীবনের প্রতিচ্ছবি এবং নাটকের সংগে জাতীয় জীবনের অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিরাজমান”। কিন্তু আলোচ্য সময়ের নাটকগুলোতে জাতীয় জীবনের প্রতিচ্ছবিতো সম্পূর্ণ অনুপস্থিত? এমনকি মাইকেল মধুসূদন দত্ত যখন ১৮৫৮ সালের শেষ ভাগে ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক রচনা করেন, তবুও বিদ্রোহী সিপাহীদের বিরুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীর বীভৎস অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক প্রকাশিত হবার সময় সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক বেরেলীর খানকে গুলী করে হত্যার পর হাজার হাজার সিপাহীকে কামানের তোপের মুখে নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে, বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধগুলোকে অত্যন্ত নৃশংসতার মাঝ দিয়ে অপসারণ করে এতদিন পর্যন্ত যে বিশাল উপ-মহাদেশ কেবলমাত্র ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর একচেটিয়া গোষ্ঠীগত লুণ্ঠনের ক্ষেত্র ছিল, তা ১৮৫৮ সালের শেষ নাগাদ ইংরেজ রাজশক্তির করায়ত্ত হওয়ায়, বৃটিশ শোষক শ্রেণীর লুণ্ঠনের ক্ষেত্রে পরিণত হল। তাই এ কথা নিঃসন্দেহে বল যায় যে, সেদিন কোলকাতা কেন্দ্রিক নবসৃষ্ট এবং পূর্ণতার পথে অগ্রসরমান বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করা তো দূরের কথা, নীরবে সমর্থন পর্যন্ত করেনি। এঁরা সেদিন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছেদও কামনা করেনি। এ সম্পর্কে ডঃ প্রভাত কুমার গোস্বামী মন্তব্য করেছেন, “ নাট্যকারেরা ঐতিহাসিক ঘটনাকে যথাযথভাবে আঁকড়ে থাকেননি। ইংরেজকে সোজাসুজি আক্রমণ করার সুবিধা থাকার জন্যও কেউ কেউ রাজপুত মোগল বা রাজপুত-মারাঠা সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদ জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন। সেখানেও হিন্দু মানসিকতা এড়ানো যায়নি। এর ফল জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে সুখকর হয়নি এবং এগুলোকে অবলম্বন করে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প উদগীরিত হয়েছে”। (দেশাত্মবোধক ও ঐতিহাসিক বাংলা নাটক : সাহিত্য প্ৰকাশ : কলিকাতা)

একথা স্পষ্ট বলা যায় যে, ‘সিপাহী বিদ্রোহের’ পরবর্তী বছরগুলোতে বাংলা তথা উত্তর ভারতীয় অঞ্চলগুলোতে এক ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে আসে। বিজয়ী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর লেলিয়ে দেয়া সৈন্যেরা পলায়মান দেশীয় সৈন্যদের এবং এঁদের সহযোগীদের নিশ্চিহ্ন করার অভিযানে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যে বীভৎস অত্যাচার করেছিল তার একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কোলকাতা কেন্দ্রিক তৎকালীন সংবাদপত্রগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই এসবের বিশেষ উল্লেখ নেই। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, হিন্দু-মুসলমান মিলিতভাবে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে সক্রিয়ভাবে যোগ দিলেও কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু ।বুদ্ধিজীবী মহল নিজেদের শ্রেণী ও গোষ্ঠী স্বার্থে ইংরেজ শাসক সম্প্রদায়ের নিকট একথা প্রমাণিত করতে সক্ষম হয়েছিলে যে, আবার ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে মূলত মুসলমানদের কর্মকাণ্ডের ফসলই হচ্ছে এই ‘সিপাহী বিদ্রোহ’।

মঞ্চে মহিলাদের অভিনয় বন্ধের জন্য সংবাদপত্রের চড়া সুর ও আব্দার

সিপাহী বিদ্রোহের প্রায় ১৫ বছর পরে বিভিন্ন বিষয়ে কোলকাতার সংবাদপত্রগুলোর বক্তব্য উপস্থাপনা এবং ইরেজ সরকার কর্তৃক অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবীর সুর বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এ সময়কে বাংলা নাটকের যুগ-সন্ধিক্ষণের সময় বলে অভিহিত করা যায়। এই সর্বপ্রথম কোলকাতার নাট্যমঞ্চে ভদ্রঘরের মেয়েরা অভিনয়ের জন্য এগিয়ে এলে কোলকাতা কেন্দ্রিক রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন সংবাদপত্রগুলো এর তীব্র বিরোধিতা করলো।

কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়া নিউজ’ পত্রিকায় ১৮৭৩ সালের ১৭ই মার্চ সংখ্যায় এ সম্পর্কে প্রকাশিত উগ্র মন্তব্য হচ্ছে : ‘এই কলংকিত কোম্পানীর প্যাভেলিয়ানের দেওয়ালগুলি পোড়াইয়া মাটির সহিত মিশাইয়া না দেওয়া অবধি এবং ইহার আসবাবপত্রসমূহ বাজেয়াপ্ত করিয়া রাষ্ট্রের হাতুড়ির আঘাতের মাধ্যমে নিলাম বিক্রয় না করা পর্যন্ত আমাদিগের পরিপূর্ণ সন্তোষ লাভ হইবে না। এই কথা কেহই অস্বীকার করিতে পারিবেন না যে, নাট্যমঞ্চে বেশ্যাগিরির প্রবর্তন করা হইয়াছে এবং ইহাতে নাট্যমঞ্চসমূহ দুর্নীতি ও নৈতিকতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের আখড়ায় পরিণত হইয়াছে।

১৮৭৬ সালের ১৬ই আগস্ট তারিখে ‘ভারত সংস্কারক’ পত্রিকায় মঞ্চনাটকে মহিলাদের অভিনয় সম্পর্কে তীব্র কটাক্ষ করা হল। পত্রিকাটিতে এ মর্মে মন্তব্য প্রকাশিত হল যে, নাটকে “কুরুচি স্থান পাচ্ছে এবং অসম্মানিত স্ত্রীলোকেরা অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেছে”। ভারত সংস্কারক পত্রিকায় বলা হল যে, “এ পর্যন্ত আমরা যাত্রা, নাচ, কীর্তন, ঝুমুরেই কেবল বেশ্যাদিগকে দেখিতে পাইতাম, কিন্তু বিশিষ্ট বংশীয় ভদ্রলোকদিগের সহিত প্রকাশ্যভাবে বেশ্যাদিগের অভিনয় এই প্রথম দেখিলাম। ভদ্র সন্তানেরা আপনাদিগের মর্যাদা আপনারা রক্ষা করেন, ইহাই বাঞ্ছনীয়।

যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি সংবাদপত্রের আহবান

তাই লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, সে আমলের নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা ছাড়াও সংবাদপত্রগুলোও অযাচিতভাবে নানা ঘটনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে। ১৮৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ইংল্যাণ্ডের যুবরাজ এডোয়ার্ড-এর (পরে সম্রাট সপ্তম এডোয়ার্ড) অবিভক্ত ভারতের তৎকালীন রাজধানী কোলকাতা আগমন উপলক্ষে সর্বপ্রথম হিন্দু বুদ্ধিজীবী মহল দ্বিধাবিভক্ত হল। ইংরেজঘেঁষা মহলের অন্যতম নেতা ভবানীপুরের প্রখ্যাত উকিল ও ব্যবস্থাপকসভার মনোনীত সদস্য শ্রী জগদানন্দ মুখোপাধ্যায় যুবরাজ এডোয়ার্ডকে নিজ বাটিতে আমন্ত্রণ করে কুল মহিলাদের দিয়ে বরণ করলেন। উপরন্তু ইংরেজ যুবরাজকে বিরাট অভ্যর্থনা দেয়ার ব্যয় নির্বাহের জন্য জোরজবরদস্তি করে চাঁদা আদায় করা হয়েছিল। ফলে বুদ্ধিজীবীদের অন্য মহলে এ সময় এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এঁদের উদ্যোগে ১৮৭৬ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারী গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে জগদানন্দ ও যুবরাজ নামে এক প্রহসনমূলক নাটক মঞ্চস্থ হয়। সরকার তৎক্ষণাৎ এক অর্ডিন্যান্স জারি করে এই নাটকের অভিনয় বন্ধ করলে, ২৬শে ফেব্রুয়ারী ‘হনুমান চরিত্র’ এই ভিন্ন নামে আবার প্রহসন নাটকটি অভিনীত হয়। এবারও পুলিশ নাটকটির অভিনয় বন্ধ করল। পলাশী যুদ্ধের ১১৮ বছর পরে কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী মহলের একাংশের সংগে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর এই সর্বপ্রথম মনোমালিন্যের সৃষ্টি হলো।

১৮৭৫ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারী বড়লাট নর্থব্রুক নাটক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে যে অর্ডিন্যান্স জারি করেন, তাতে অনতিবিলমেব অশ্লীলতার (?) অভিযোগে উপেন্দ্রনাথ দাস রচিত ‘সুরেন্দ্র বিনোদিনী’ নাটকের সংগে জড়িত ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। নিম্ন আদালতে মূল দু’জন আসামীর শাস্তি হলেও হাইকোর্টে এঁরা মুক্তি লাভ করেন। ফলে বড়লাট নর্থব্রুক এতদসম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট আইন প্রণয়নে উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। ইতিপূর্বে কোলকাতার সংবাদপত্রগুলো শাসকগোষ্ঠীর প্রতিটি কর্মকাণ্ডকে যেভাবে সমর্থন দিয়েছে তাতে করে কর্তৃপক্ষের বিশ্বাস ছিল যে, এ ধরনের আইন প্রণয়ন করলে খুব একটা বিরোধিতা হবে না।

১৮৭৬ সালের ১৬ই ডিসেম্বর “ডরামাটিক পারফরমেন্স কন্ট্রোল বিল” আইন হিসেবে পাস হয়। গবেষক ডঃ প্রভাত কুমার গোস্বামীর মতে, “নাট্য-নিয়ন্ত্রণ আইনটি পড়লেই দেখা যাবে যে বিদেশী সরকার নাটকের বিরুদ্ধে ঐ ধরনের (কোলকাতা কেন্দ্রিক সংবাদপত্রের) সমালোচনাকে লুফে নিয়েছিলেন এবং আইনে রাজদ্রোহ, মানহানিকর প্রভৃতি বিষয়ের সঙ্গে কুৎসা, অশ্লীলতা প্রভৃতিও যোগ করে দিয়ে আইনটি জারি করেছিলেন”।

১৮৭৬ সাল বছরটি আরও কয়েকটি ঘটনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এবছর বৃটিশ পার্লামেন্টে একটি আইন পাস করে মহারাণী ভিক্টোরিয়াকে ‘ভারত সম্রাজ্ঞী উপাধি দেয়া হয়। এসময় গোড়া রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন নতুন বড়লাট লর্ড লিটন দারুণ জাঁকজমকের সঙ্গে দিল্লীতে দরবার বসিয়ে মহারাণী ভিক্টোরিয়াকে ভারতের সম্রাজ্ঞী হিসেবে ঘোষণা করেন। অথচ এ বছরেই পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ ও দক্ষিণ ভারতে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে প্রায় ৫০ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

মহারাণী ভিক্টোরিয়াকে ‘ভারত সম্রাজ্ঞী’ হিসেবে ঘোষণা সম্পর্কিত বিরূপ মন্তব্য এবং দুর্ভিক্ষে ৫০ লাখ লোকের মৃত্যু সংক্রান্ত কোনও খবরাদি যাতে করে সংবাদপত্রে প্রকাশিত না হয়, এজন্যই বড়লাট লর্ড লিটন দেশীয় ভাষায় প্রচারিত সংবাদপত্রগুলোর স্বাধীনতা খর্ব করলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় জারি হলো, ‘ভার্নাকুলার প্রেন্স এ্যাক্ট’। উপমহাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের এটাই হচ্ছে প্রথম সূচনা। অবশ্য সে আমলের ইংরেজী পত্র-পত্রিকাগুলো ইংরেজ মালিকানাধীনে ইংরেজদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো বলে উল্লিখিত আইনটি ইংরেজী ভাষার পত্র-পত্রিকাগুলোর প্রতি প্রযোজ্য ছিলো না।

আগেই উল্লেখ করেছি যে, পলাশীর যুদ্ধের ১১৮ বছর পর যুবরাজ এডোয়ার্ড-এর কোলকাতা সফর উপলক্ষে বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের একাংশের সংগে শাসকগোষ্ঠীর প্রথম মনোমালিন্য দেখা দেয়। রক্ষণশীল বড়লাট লর্ড লিটন একদিকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এবং অন্যদিকে এ ধরনের মনোমালিন্যের প্রেক্ষিতে আরও একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এই পদক্ষেপই হচ্ছে ‘অস্ত্র আইন’ প্রবর্তন। এই আইনের ফলে সরকারের লিখিত অনুমতি ছাড়া ভারতবাসীদের পক্ষে অস্ত্র রাখা নিষিদ্ধ ঘোষিত হল।

হিন্দু মধ্যশ্রেণীর শৈশব ও কৈশোর কাল অতিক্রম

লর্ড লিটন-এর আমলে অত্যন্ত স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ‘নাটক নিয়ন্ত্রণ আইন’, দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার স্বাধীনতা হরণ সম্বলিত “ভার্নাকুলার প্রেস এ্যাক্ট’ এবং ‘অস্ত্র আইন প্রবর্তনের ফলে স্বাভাবিকভাবেই কোলকাতা কেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী মহলের ক্ষোভের সঞ্চার হল। রক্ষণশীল ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী বুঝতেই পারেননি যে, অবিভক্ত ভারতে একমাত্র বৃহত্তর বাংলায় তাঁদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় একটা সুদৃঢ়. ভিত্তিতে অত্যন্ত দ্রুত বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছে। এই নব্য সৃষ্ট শ্রেণী নিজেদের গোষ্ঠী ও শ্রেণীস্বার্থে খুবই সচেতন; উপরন্তু এঁরা ‘বন্দেমাতরম’ শ্লোগান এবং ‘ভারত মাতার’ ‘হিন্দুয়ানীর আদর্শকে’ আঁকড়ে ধরে পরিতৃপ্ত হওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছে। ইংরেজ শাসকরা অনুধাবন করতে পারেননি যে, কোলকাতা কেন্দ্রিক নেতৃত্বে সৃষ্ট এই মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সবার অলক্ষ্যে তার শৈশব ও কৈশোরের কাল অতিক্রম করেছে।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক পারসিভাল স্পয়ার-এর (এ হিস্ট্রি অব ইণ্ডিয়া : দ্বিতীয় খণ্ডঃ ১৯৬৫ লণ্ডন) মতে, “উভয়পক্ষের (ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী ও বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী শ্রেণী) মনোভাবের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতির ঘটনাপ্রবাহ মোটেই আশা করা যায়নি। আলোচ্য মধ্যশ্রেণীর গঠন এতো দ্রুত সংগঠিত হয়েছিল এবং এর ব্যাপ্তি এতো ত্বরিতগতিতে হয়েছিল, যা সাধারণ পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে ধরাই পড়েনি”।

পরবর্তীতে লর্ড ডাফরিন এ মর্মে মত প্রকাশ করেছেন যে, “–কিন্তু তখন এই সংখ্যালঘুরা (বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী) একটা ভাষা ও ধ্যান-ধারণার অধিকারী হয়েছে। এঁদের দৃষ্টিভংগী, মন-মানসিকতা ও বক্তব্য অভিন্ন ধরনের। ভারতের আর কোথাও এবং কখনও ইতিপূর্বে এ ধরনের মধ্যশ্রেণীর সৃষ্টি হয়নি। এই ব্যাপারটা অচিরেই সর্বভারতীয় রূপ পরিগ্রহ করতে পারে”।

আলোচ্য সময়কালের সামাজিক পরিস্থিতি অত্যন্ত সন্তর্পণে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে দেখা যায় যে, ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর প্রশ্রয় ও আনুকূল্য এর অন্যতম কারণ। উপরন্তু মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ঘোষণাপত্র, পৌরসভাগুলোতে স্বায়ত্তশাসন-এর প্রবর্তন এবং আইসিএস পরীক্ষায় ভারতীয়দের প্রবেশাধিকার দেয়ায় ইংরেজী শিক্ষায় অগ্রসরমান বাঙালি মুলসমানদের তখনও ‘অন্ধকার যুগ’ চলছে এবং তাঁরা নিদারুণভাবে পশ্চাদপদ (বাঙালি) হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী ব্যাপক উৎসাহ লাভ করে এবং অধিকার আদায়ে সচেতন হয়। রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন লর্ড লিটন-এর পর বড়লাট হিসেবে ১৮৮০ সালে উদারপন্থী লর্ড রিপনের আগমনে এ ধরনের একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়।

এই প্রেক্ষিতে ‘ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশন’-এর উদ্যোগে ১৮৮২ সালে কোলকাতায় ইলবার্ট বিল নিয়ে আন্দোলন গড়ে উঠে। এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন পদচ্যুত আইসিএস সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী। ১৮৮৩ সালে সুরেন্দ্রনাথ কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলে এই আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। আন্দোলনকারীদের অন্যতম দাবী ছিলো ভারতীয় বিচারকদের অবিলম্বে ইংরেজ বিচারকের সমপর্যায়ভুক্ত করতে হবে। লর্ড রিপন ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশনের এই দাবী মেনে নেন।

এখানে প্রাসংগিক বিধায় সমসাময়িককালের রাজনৈতিক পরিবেশ-এর কিঞ্চিৎ বর্ণনা বাঞ্ছনীয় মনে হয়। বৃটিশ পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলার হিন্দু ভূস্বামী এবং পশ্চিম ভারতীয় অঞ্চলের উঠতি শিল্পপতিদের সহযোগিতার ফলে ১৮৮৫ সালে বোম্বাই নগরীতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস স্থাপিত হলে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে দু’টি স্রোত পরিলক্ষিত হয়। একটির নেতৃত্বে গোপাল কৃষ্ণ গোখলে এবং অপরটির নেতা বাল গংগাধর তিলক। গোখলে ছিলেন মূলত রাজা রামমোহন রায়ের পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতার সমর্থক এবং তিনি কোলকাতা কেন্দ্ৰিক বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশের সমর্থনলাভ করেন। এই প্রেক্ষিতেই গোপাল কৃষ্ণ গোখলে তাঁর ঐতিহাসিক উক্তি করেছিলেন যে, “বাঙালিরা আজ যা চিন্তা করে, সমস্ত ভারত আগামীকাল তা করে”। এক কথায় বলতে গেলে ‘চিৎপভন’ গোত্রীয় ব্রাহ্মণ গোখলে ছিলেন পুরোপুরি সংস্কারপন্থী।

এরই পাশাপাশি একই ‘চিৎপভন’ গোত্রীয় অপর মারাঠা কংগ্রেসী নেতা বাল গংগাধর তিলক ছিলেন চরম উদারপন্থী এবং হিন্দু ‘রিভাইভালিজম’-এ বিশ্বাসী। তিনি পর্যালোচনা করে দেখলেন যে, কেবলমাত্র মোগলদের বিরুদ্ধে রাজপুতদের শৌর্য-বীর্যের কাহিনীর মাধ্যমে ভারতের সমগ্র হিন্দু জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভবপর নয়। কেননা রাজপুত ইতিহাস হচ্ছে প্রায়শঃই মোগল রাজশক্তির সংগে সমঝোতা এবং সময়বিশেষে আত্মরক্ষামূলক লড়াই-এর ইতিহাস। রাজপুতরা কখনই রাজস্থান পাঞ্জাব এলাকা থেকে শক্তির দাপটে বেরিয়ে আসতে পারেনি।

শিবাজী উৎসব এবং হিন্দু ভারতীয় জাতীয়তাবাদ

অথচ অন্যদিকে তুলনামূলকভাবে ছত্রপতি শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠাদের ইতিহাস ‘হিন্দু রিভাইভালিজম’-এর জন্য অনেক বেশী কার্যকর হবে। মারাঠারা শক্তির দাপটে সাময়িকভাবে হলেও উপমহাদেশের দক্ষিণাঞ্চল ছাড়াও উত্তরে দিল্লীর উপকন্ঠ থেকে শুরু করে পূর্বে বংগাল এলাকা (বর্গী হামলা) পর্যন্ত আগ্রাসন করতে সক্ষম হয়েছিল। তাই মারাঠাদের দেশপ্রেম এবং শৌর্য-বীর্যের ভিত্তিতেই গড়ে তুলতে হবে নতুন ‘হিন্দু ভারতীয় জাতীয়তাবাদ’।

এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বাল গংগাধর তিলক ১৮৯৩ খৃষ্টাব্দে মারাঠাদের প্রিয় দেবতা গণপতিকে (গণেশ) নিয়ে ‘গণপতি উৎসব’-এর প্রবর্তন করেন। এটাই হচ্ছে ‘শিবাজী উৎসব’। ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে (১৩-১৫ই জুন) গংগাধর মহারাষ্ট্রের পুনা নগরীতে তিনদিন ব্যাপী ‘শিবাজী উৎসব’ পালন করেন। অত্যন্ত দ্রুত শিবাজীভিত্তিক মনোভাব ভারতের হিন্দু জনগোষ্ঠীর মন-মানসিকতাকে আচ্ছন্ন করে তোলে।

ঐতিহাসিক তত্ত্ব ও তথ্যের উপর ভিত্তি করে একথা সপষ্টভাবে বললে যথার্থ হবে যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়কালটা এমন ছিল যখন পরাশক্তি ইংরেজদের সৃষ্ট রাজধানী কোলকাতা নগরীতে রাজ ছত্রচ্ছায়ায় বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর ভিত্তি সুদৃঢ়. হতে চলেছে। বাহ্যতঃ মানবতাবোধ, রেনেসাঁ ও দেশপ্রেম-এর আদর্শের জন্য সুচতুরভাবে সোচ্চার (?) হলেও বাস্তবে এঁরা সব সময়েই ধর্ম, শ্রেণী ও গোষ্ঠীস্বার্থে সচেতন ছিলেন।

তাই এ সময় ইংরেজ রাজ-প্রভুদের বিরুদ্ধে এই মধ্য শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী সমাজ কোনও উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদ পর্যন্ত করেনি। বরং ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের সম্পূরক শক্তি হিসেবে তাঁদের ভূমিকা পালন করেছে। এই প্রেক্ষাপটে উল্লেখিত সময়কালে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সন্তান প্রখ্যাত নাট্যকার ও সমাজ সংস্কারক এবং হিন্দুমেলার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্মকাণ্ড ও মন-মানসিকতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ঠাকুর মহাশয় তাঁর রচিত ঐতিহাসিক নাটকগুলোতে তথ্য বিকৃত করে উপস্থাপনা করেছেন এবং সুস্পষ্টভাবে তাঁর ভূমিকার সমর্থনে সাফাই গেয়েছেন। পরবর্তীকালে তিনি কোলকাতার বড়বাজার লাইব্রেরীর অবৈতনিক সম্পাদক কেশব প্রসাদ মিত্রকে লিখিত এক পত্রে এসব ঐতিহাসিক নাটক সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “ইহা বুঝা উচিত, নাটক ও ইতিহাস এক জিনিস নহে। কোনও দেশের কোনও নাটকেই ইতিহাস সম্পূর্ণভাবে রচিত হয় না”। অর্থাৎ এ কথা বললে অন্যায় হবে না যে, ঠাকুর মহাশয় সজ্ঞানে ইতিহাসভিত্তিক তথ্য বিকৃত করেছেন। স্বীয় নাটকের প্রয়োজনে তিনি যথেচ্ছভাবে ঐতিহাসিক চরিত্রগুলো ব্যবহার করেছেন এবং প্রায়ই কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। তাঁর লিখিত নাটকগুলোর মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ই হচ্ছে হিন্দু রাজ রাজাদের বীর্যবত্তা। আর এই বীর্যবত্তা প্রতিষ্ঠা করতে যেয়ে তিনি যে শুধু ইতিহাস বিকৃত করেছেন তাই-ই নয়, তাঁর লেখনী অবলীলাক্রমে মুসলিম বিদ্বেষে ভরপুর হয়েছে। তাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের রচিত নাটকগুলোতে যে জাতীয়তাবোধ (?) রয়েছে তার মধ্যে প্রকটভাবে হিন্দু-প্রবণতা বিদ্যমান।

তবুও একটা কথা বলতে হয় যে, জাতীয়তাবাদ-এর প্রশ্নে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের মন দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। কেননা, এই উপমহাদেশের অর্থাৎ ভারতবাসীর অখণ্ড জাতীয়তাবোধ সম্পর্কে তিনি শেষ পর্যন্ত সংশয় প্রকাশ করে গেছেন। পরবর্তীকালে ১৯০৫ সালে ‘প্রবন্ধ মঞ্জরী’ পুস্তকে ‘ভারতবর্ষীয়দিগের রাজনৈতিক স্বাধীনতা’ নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, “প্রশ্ন উঠিতে পারে, ভারতবর্ষীয়দিগকে একটি সমগ্র জাতি বলা যায় কি না? ভারতবর্ষীয় বলিলে ভারতবাসী মুসলমান ও খৃষ্টান তাহার অন্তর্ভুক্ত হয় কি না? যদি তাহাদিগকে ছাড়িয়া শুদ্ধ হিন্দু জাতিকেই ধরা যায় তাহা হইলেও এক্ষণে হিন্দুদিগের যেরূপ অবস্থা, তাহাদিগকে কি এক জাতি বলিয়া মনে হয়?”

একটু লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, সে আমলে যারা বাঙালি হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ছিলেন, তাঁরা পরোক্ষভাবে রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতার জন্য আগ্রহান্বিত ছিলেন। কেননা, এই পৃষ্ঠপোষকতার দরুনই বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী সমাজ পূর্ণতা লাভ করেছে। অথচ প্রকাশ্যে এই সত্য স্বীকার করার সৎসাহস পর্যন্ত অনেকেরই ছিল না এবং এখনও পর্যন্ত নাই। তাই অত্যন্ত সন্তর্পণে সে আমলে বাংলা সাহিত্যের নাটক উপন্যাসে নব রাজশক্তি ইংরেজদের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখার চেয়ে অতীতের মোগল-পাঠান রাজন্যবর্গের চরিত্র হনন সম্পর্কিত ঘটনাবলী বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *