অত্র পুস্তকের সমাপ্তি পর্ব
অত্র পুস্তকের সমাপ্তি পর্বের বক্তব্যগুলো উপস্থাপনকালে প্রথমেই পাঠকদের দেয়ালে টানানো উপমহাদেশের ম্যাপের দিকে দৃষ্টিপাত করার বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। এতে দেখা যায় যে, উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম এলাকা এবং পূর্বাঞ্চলীয় গাংগেয় বদ্বীপ কেবলমাত্ৰ — এই দু’টি এলাকায় মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। প্রথমটির ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক কারণ খুবই সুস্পষ্ট। মধ্যযুগে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে খাইবার গিরিপথ দিয়ে বিজয়ীর বেশে মুসলামানরা এ দেশে আগমন করেছে বলে স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান পাকিস্তানের ভৌগোলিক সীমারেখার অন্তর্ভুক্ত এলাকায় মুসলমানদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা হয়েছে। কিন্তু রাজধানী দিল্লী এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাতে মুসলমানরা প্রায় ৬/৭শ’ বছর পর্যন্ত রাজত্ব করলেও এসব এলাকাগুলোতে ধর্মভিত্তিক জনবসতির চিত্রটি ভিন্নতর কেনো? অর্থাৎ এই অঞ্চলগুলোতে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা সব সময়েই সংখ্যালঘু কেনো? তাহলে এক শ্রেণীর ঐতিহাসিকরা যখন এ মর্মে দিব্যি মন্তব্য করে থাকেন যে, ‘শুধুমাত্র তরবারির জোরেই এদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারিত হয়েছে’— তখন এসব বক্তব্যকে সহজেই সত্যের অপলাপ বলে আখ্যায়িত করা যায়। আসলে এ ক্ষেত্রে সম্ভবতঃ রাজ্য শাসনের বৃহত্তর স্বার্থে দিল্লীর মুসলিম রাজা-বাদশাহদের (সম্রাট আওরংগজেব ব্যতিক্রমধর্মী) সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা খুব একটা উল্লেখযোগ্য ছিলো না বললেই চলে। এই উপমহাদেশে পবিত্র ইসলাম ধর্ম প্রচারের মূল কৃতিত্ব হচ্ছে সুফী পীর, ফকির, আউলিয়া আর দরবেশদের।
এক্ষণে দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রের কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায় যে, সুফীদের নিরলস প্রচেষ্টায় মধ্যযুগে দুর্গম এলাকা বলে পরিচিত নদী বিধৌত পূর্ব বাংলায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়া সম্ভবপর হয়েছিল। একদিকে মোগলদের সংগে যুদ্ধে পরাজিত পাঠান সৈন্যদের বংগীয় এলাকায় আগমন এবং অন্যদিকে সুফীদের বদৌলতে ধর্মান্তরিত বিশাল জনগোষ্ঠী। কালের আবর্তে উভয়ের মিলনে সৃষ্টি হলো বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়। অচিরেই এঁরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলেন যে, এই দেশ— এই মাটি আমার, এই ভাষা— এই সাহিত্য আমার, এখানকার সংস্কৃতি ও লোকাচার সব কিছুই আমার। আমি এ দেশের বাঙালি সন্তান।
পরবর্তীকালে ঘটনাপ্রবাহে আমরা এসবের অপরূপ প্রতিফলন অবলোকন করতে সক্ষম হয়েছি। বাস্তবকে স্বীকার করতে না পেরে সাত চল্লিশের দেশ বিভাগের সময় আর্যদের উত্তরসুরীর দাবীদার বর্ণ হিন্দুরাই এ দেশ ত্যাগ করেছেন এবং মাত্র ২৪ বছরের ব্যবধানে একাত্তরের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের ভার “শরাফত” ও “খানদানী” মুসলমানিত্বের দাবীদার অবাঙালি মুসলমানরাই এ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। কেননা ইতিহাসের গতিধারাকে কোন শক্তিই রুদ্ধ করে রাখতে পারে না।
প্রসাংগিক বিধায় এখানে গাংগেয় বদ্বীপ এলাকার জনগোষ্ঠীর জাতিগত পূর্ব ইতিহাস সংক্ষেপে হলেও উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় মনে হয়। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে যাযাবরের অনিশ্চিত জীবন যাত্রার সমাপ্তিতে কৃষি-ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাই হচ্ছে প্রকৃত মানব সভ্যতার প্রথম সূচনা এবং কৃষিই হচ্ছে মানব জাতির ইতিহাসে এক বৈপ্লবিক ঘটনা। এজন্যই পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বিশ্বের বড় বড় নদ-নদীর তীরবর্তী এলাকায় মানবগোষ্ঠী সর্বপ্রথম বসতি স্থাপন করেছে এবং কৃষিভিত্তিক সভ্যতার প্রথম উন্মেষ হয়েছে। এসব অঞ্চলের মধ্যে মিশরের নীল নদ, মধ্যপ্রাচ্যের ইউফ্রেটিস ও তাইগ্রিস নদী, পাকিস্তানের সিন্ধু নদ এবং মহাচীনের হোয়াংহো ও ইয়াংসিকিয়াং-এর নদী-বিধৌত উর্বর মাটিতে মানুষের প্রথম বসতি ও গৃহস্থালী শুরু বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সমসাময়িককালে না হলেও স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বিশ্বের এই সর্ববৃহৎ গাংগেয় বদ্বীপ এলাকায় যে কৃষিভিত্তিক মানব সভ্যতার সূচনা হয়েছিলো, তা নিঃসন্দেহে বলা যায় এই জনগোষ্ঠীই হচ্ছে বাংলাদেশের আদি বাসিন্দা এবং এঁরা অষ্ট্রিক দ্রাবিড় সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সম্প্রতি ভারতের দাক্ষিণ্যাত্যে বিশেষ করে তামিলনাড়ু অঞ্চলে আবিষ্কৃত প্রত্ন-প্রস্তর যুগের অস্ত্র ও প্রস্তর নির্মিত কৃষি যন্ত্রপাতির সঙ্গে বঙ্গীয় এলাকার কৃষি যন্ত্রপাতির আকৃতিগত সাদৃশ্য থেকেই বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের মত প্রকাশ করেছেন। মহাকবি কালিদাসের ‘রঘুবংশম’-এ উল্লেখ রয়েছে যে, বঙ্গীয় এলাকার বাসিন্দারা নৌকায় বসবাস করতো এবং ধানের চাষাবাদে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। গবেষকদের মতে আস্ত গাছ খুদে যে কোন্দা নৌকা এই বাঙালিরা তৈরী করতো, তা নিশ্চিতভাবে প্রস্তর যুগের নিদর্শন বহন করছে।
বংগীয় এলাকার আদি বাসিন্দারা দ্রাবিড়ীয় এবং কৃষি ঐতিহ্য, নবান্নের উৎসব ও নৌকার ব্যবহারের সূত্র ধরে বলা যায়, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা বিধৌত অঞ্চলের সভ্যতা প্রায় হাজার বছরের পুরাতন নব্য প্রস্তর যুগের। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডক্টর অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায়ের মতে, “এ দেশে আর্যাভিযানের পূর্বে অষ্ট্রিক গোষ্ঠীভুক্ত নিষাদ জাতি বাস করত”। এই প্রেক্ষাপটে বলা চলে যে, দ্রাবিড়ীয় সভ্যতার আলোকে বংগীয় এলাকায় নদীর তীরবর্তী এলাকায় প্রথম স্থায়ীভাবে বসবাসকারী মানব গোষ্ঠীই হচ্ছে বাঙালি জাতির আদি সূত্র। গবেষকদের মতে যে ভৌগোলিক সীমারেখা নিয়ে আমাদের আবাসস্থল, সেই বংগ দেশের (বাংলাদেশের) ‘বংগ’ শব্দটি প্রাচীনতার সাক্ষ্য বহন করছে। ‘বং’ শব্দ থেকেই ‘বংগ’ শব্দের উৎপত্তি নির্ণয় করা যায়। এটি একটি সুপ্রাচীন চৈনিক শব্দ। এ শব্দের প্রাচীনত্ব প্রায় পাঁচ হাজার বছরের। চীনা ভাষায় বঙ্গ শব্দটির অর্থ হচ্ছে জলাশয়— অর্থাৎ নদীমাতৃক এলাকা। এরপর বহু সংঘাতপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার মাঝ দিয়ে ‘বংগ’ শব্দটি ‘বংগদেশ’, ‘বংগীয় এলাকা’, ‘সুবে বঙ্গাল’, ‘বংগ-প্ৰদেশ’, ‘পূর্ব বংগ’, ‘পূর্ব বাংলা’ (পূর্ব পাকিস্তান) এবং শেষ পর্যন্ত একটা রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ— এই নামে রূপান্তরিত হয়েছে।
ইতিহাসের ঘাত-প্রতিঘাতের মাঝ দিয়ে এই মানবগোষ্ঠীর ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি, ধর্মীয় বোধ এবং চিন্তাধারায় আগ্রাসন, সংমিশ্রণ, সংযোজন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং সমন্বয় সাধন হয়েছে। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায় বাঙালি মানবগোষ্ঠীর বসবাস শুরু হওয়ার এক-দেড় হাজার বছর পরে উপমহাদেশে আর্যদের আবির্ভাব ঘটে এবং এদের দৃষ্টিতে দাক্ষিণাত্যে ও বংগীয় এলাকায় তাম্রবর্ণ গাত্রের জনগোষ্ঠী মাত্রই অনার্য। ডক্টর অসিত বন্দোপাধ্যায় তাঁর প্রণীত ‘বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত’ (সংশোধিত ৪র্থ সংস্করণ) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, “পশ্চিমী পণ্ডিতেরা বলেন, খ্রীস্টের জন্মের হাজার দেড়েক বছর আগে ইউরোপীয় ভাষাভাষী প্রাচীন আর্যজাতি ইরান ছেড়ে পশ্চিম পাঞ্জাবে উপনিবিষ্ট হয়। এদের ভাষা ভাষাতত্তের আদি ভারতীয় আর্যভাষা নামে পরিচিত। বৈদিক ও সংস্কৃত ভাষা এর অন্তর্ভুক্ত। এর ব্যাপ্তিকাল খ্রীঃ পূঃ ১৫০০ অব্দ থেকে খ্রীঃ পূঃ অব্দ পর্যন্ত।”
তাহলে এ কথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, আর্যরা এদেশে আগমনের পর সুজলা-সুফলা এই উপমহাদেশের পুরো এলাকা পদানত করার উদগ্র বাসনায় কয়েক শতাব্দী যাবত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখো। এই প্রেক্ষাপটে দাক্ষিণাত্য ও সিংহল বিজয়ের জন্য আর্য যুবকদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে আর্যদের নানা গ্রন্থে এ মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দক্ষিণী এলাকার অসভ্য ও বর্বর রাক্ষসতুল্য দ্রাবিড় নামীয় অচ্ছুৎ মানবগোষ্ঠীর আবাসস্থল। দক্ষিণদিকের এ ধরনের আগ্রাসন হচ্ছে ধর্মযুদ্ধ এবং দেবকূল এ সময় আর্যদের সক্রিয় সমর্থন প্রদান করবে। এ প্রসঙ্গে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলি নেওয়াজ তাঁর খনার বচন ও কৃষি পুস্তকে যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, “রাবনের যুদ্ধ আর্য-অনার্যের যুদ্ধ ছাড়া আর কিছু নয়। রামায়নের রচনাকাল শ্রীকৃষ্ণের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ অবলম্বনে লিখিত মহাভারতেরও পূর্বেকার। কুরুক্ষেত্রর যুদ্ধও আর্য-অনার্যেরই অপর একটি মহাযুদ্ধ যাতে অগণিত লোক ক্ষয় হয়েছিলো।”
এদিকে উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে গৌড় বংগ সুন্ম সমতট অর্থাৎ বংগীয় এলাকায় বসবাসকারী মানবগোষ্ঠীর প্রতি আর্য ভূদেবদের বৈরীভাব ও ঘৃণাপোষণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এদের দৃষ্টিতে বংগীয় এলাকার নরগোষ্ঠী হচ্ছে”, দেশোহনার্য নিবাস :” এজন্যই গাংগেয় বদ্বীপ এলাকায় এলে আর্যদের জাত বিনষ্ট হতো। দুঃসাহসিক আর্য যুবকরা এদেশে যাতায়াত করলে অনার্যের প্রভাব মুক্তির জন্য তাদের কপালে ‘ব্রাত্য’ এঁকে দেয়া হতো। এই ‘ব্রাত্য’ই হচ্ছে কলংকতিলক। আর্য যুবকদের কপালে কলংকতিলক থেকে অনুধাবন করা সম্ভব হতো যে, এসব যুবকরা অস্পৃশ্য বংগীয় এলাকায় গমন করেছিলো। তাই প্রত্যাবর্তনের পর কপালে কলংকতিলক অংকন ছাড়াও প্রায়শ্চিত্তমূলক যাগযজ্ঞাদি ‘ব্রাত্যস্তোম’ করার পর এঁদের পুনরায় আর্য মন্ডলে স্থান দেয়া হতো। আর্যরা বাংলাদেশের অধিবাসীদের ভাষাকে ‘পৈশাচী ভাষা’ হিসেবে আখ্যায়িত করতো। এ সময় ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা এ মর্মে নির্দেশ জারি করেছিলেন যে, পৈশাচী ভাষায় বিদ্যা চর্চা করলে ভয়াবহ রৌরব নরকে ঠাঁই হবে। অথচ পৈশাচী ভাষাই হচ্ছে বাংলা ভাষার আদি জননী।
এখানে উল্লেখ্য যে, বংগীয় এলাকায় আর্য যুবকের আবির্ভাব ঘটলে, স্থানীয় অধিবাসীরা কুকুর লেলিয়ে হত্যা করতো বলে পণ্ডিতরা বর্ণনা করেছেন। এসব অধিবাসীদের চরিত্র সামগ্রিকভাবে নৃশংস ছিলো বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
ঐতিহাসিকদের মতে খ্রীষ্টের জন্মের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে আর্যদের এই উপমহাদেশে আগমন হলেও খ্রীষ্টের জন্মের কয়েক শতাব্দী পরে বংগীয় এলাকায় আর্যরা অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিলো। এবং এটাই ছিলো আর্যদের জন্য সর্বশেষ এলাকা। কিন্তু এই এলাকায় আর্য ও অনার্যদের মধ্যে রাজনৈতিক ছাড়াও ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির সংঘাত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অব্যাহত ছিলো। পরবর্তীকালের ঘটনা প্রবাহের জের হিসেবে এ কথা বলতে হয় যে, বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে বৌদ্ধ, হিন্দু এবং সুফী মনীষীদের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম প্রচারের পরেও অনার্যদের প্রাচীন আমলের কৃষি-ভিত্তিক সংস্কৃতি, আচার, অনুষ্ঠান, ব্রত ও প্রথার বিলুপ্তি সম্ভব হয়নি। এখানে উল্লেখ্য যে, আর্য হিন্দুরা এসব অনার্য সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিরোধিতা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে বাধ্য হন। ফলে অনার্যদের কৃষি-ভিত্তিক বহু আচার-অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্ম হিন্দু ধর্মে প্রবিষ্ট হয়ে অস্তিত্ব বজায় রাখে। পাকিস্তানী আমলে এসব সাংস্কৃতিক ও কৃষি-ভিত্তিক আচার-অনুষ্ঠানকে ‘হিন্দুয়ানী” বলে আখ্যায়িত করার প্রচেষ্টা হয়েছিল। এবং জের আজও পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে।
অবশ্য বৌদ্ধ ধর্মের প্রচরকরা এবং এদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারকালে সুফী দরবেশরা স্থানীয় ভাষা, সংস্কৃতি ও আচার-অনুষ্ঠানের তেমন একটা বিরোধিতা না করে ধর্মের মূল আদর্শ প্রচারে বিশেষ আগ্রহী হয়েছিলেন বলেই বিরাট সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁরা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, এ দেশের সভ্যতা-সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান, শিল্প-সাহিত্য সবকিছুই কৃষি-ভিত্তিক এবং এসবের প্রতি মানুষের অটল শ্রদ্ধা রয়েছে। এরই ফল হিসেবে ধান-দুর্বা-হলুদ দিয়ে নববধূকে বরণ করা এবং নববধূর আগমনে উঠানে ঘড়া থেকে পানি ঢালা, বিবাহ অনুষ্ঠানে কলাগাছ লাগানো, লাংগল-জোয়াল ও জমিকে সালাম করে চাষাবাদ শুরু করা, সংগৃহীত নতুন ফসলকে আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বরণ করা, ক্ষেতে বীজ ছিটানোর আগে কিছু অনুষ্ঠান পালন করা, সন্তানের মুখে ভাত ও হাতে খড়ির অনুষ্ঠান করা, নবান্ন ও হালখাতার উৎসব উদযাপন করা প্রভৃতি আদি ও অকৃত্রিম অনার্য অথচ বংগীয় সংস্কৃতি হাজার হাজার বছরের ঘাত-প্রতিঘাতের মাঝ দিয়ে আজও পর্যন্ত স্বীয় বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখে অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, সুফী আউলিয়া, পীর ফকির ও দরবেশরা বংগীয় এলাকায় ইসলাম ধর্ম প্রচারের সময় স্থানীয় ভাষা ও সাহিত্য ছাড়াও বহুল পরিমাণে এদেশী সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি মেনে নিয়ে শুধুমাত্র পবিত্র ইসলাম ধর্মের নিরাকার একেশ্বরবাদের মূল আদর্শকে প্রচারে ব্রতী হয়েছিলেন বলেই এরকম অবিস্মরণীয় সাফল্য লাভ করেছিলেন। এজন্যই উপমহাদেশের পশ্চিম অঞ্চলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার পর প্রায় ১২ শত মাইল ব্যবধানে বংগীয় এলাকায় মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জিত হয়েছে। গাংগেয় বদ্বীপ এলাকায় সুফী মনীষীদের এ ধরনের ইসলাম প্রচারকে প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী মরহুম ডঃ এনামুল হক ‘পপুলার ইসলাম’ বলে আখ্যায়িত করে গেছেন।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বহিরাগত সেন বংশের আদিপুরুষ অবাঙালি সামন্ত সেন কর্ণাটক ত্যাগ করে পূর্ব থেকেই আর্য পণ্ডিতদের তত্ত্বাবধানে নবদ্বীপ এলাকায় বসবাস করছিলেন। তাঁর পৌত্র বিজয় সেন গৌর রাজ্যের রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়েই দক্ষিণ ও পূর্ববংগে প্রভাব বিস্তার করেন। সবচেয়ে লক্ষণীয় যে, সেন বংশের আমলে বংগীয় এলাকার রাজধানী নবদ্বীপে স্থানান্তিরত হয়। এতে বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে যে, বহিরাগত সেন রাজারা গৌড় নগরীকে নিরাপদ মনে করতেন না এবং সব সময়েই স্থানীয় অধিবাসীদের বিদ্রোহের সম্ভাবনা অব্যাহত ছিলো।
১১৫৮ খ্রীঃ বিজয় সেনের পুত্র বল্লাল সেন এবং আরও ২০ বছর পরে ১১৭৮ খ্রীঃ তদীয় পুত্র লক্ষণ সেন বাংলাদেশে বিদেশী সেন বংশের অধিকার সুপ্রতিষ্টি করেন। কিন্তু স্থানীয় জনগোষ্ঠী এদের কোনও সময়েই গ্রহণ করতে পারেনি। নবদ্বীপ রাজধানী স্থানান্তরকরণ ছাড়াও ক্ষাত্র বৃত্তিতে বিশ্বাসী এই সেন বংশের রাজত্বে কঠোর হস্তে ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রচার করা হয় এবং এই আমলেই পশ্চিম ভারতীয় অঞ্চল থেকে সর্বাধিকসংখ্যক উগ্র চিন্তাধারার ব্রাহ্মণদের আনা হয়। এঁদের বংশধররা আজও পর্যন্ত পশ্চিম বাংলায় ‘বিশুদ্ধ রক্তের’ বড়াই করছেন। এক কথায় বলতে গেলে বদ্বীপ এলাকায় আর্য বংশোদ্ভূত ব্রাহ্মণদের দ্বারা সেন বংশের রাজত্ব পরিচালিত হয়। ব্রাহ্মণ্যমতে ঘোরতর আস্থাযুক্ত বিদেশী সেন বংশের রাজ সভাতে উচ্চ সমাজের বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের আনাগোনা বৃদ্ধি পেলেও, গণমানুষের সংগে এই শাসনের বিশেষ যোগাযোগ ছিলো না বললেই চলে। ফলে সেন বংশের রাজত্ব স্বাভাবিকভাবে শাসনদন্ডের অত্যাচারে ভয়াবহ বহিঃপ্রকাশ হয়েছিলো। পশ্চিম বাংলার প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ডক্টর অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায়ের মতে ‘সেন রাজগণ বিদেশী ছিলেন বলে বাংলা ভাষা সম্বন্ধে বিশেষ কৌতূহলী ছিলেন না। উপরন্তু তারা ঘোরতর ব্রাহ্মণ্য মতাবলম্বী ও স্মার্ট সংস্কারপন্থী ছিলেন। সুতরাং তাদের সভায় সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের একটু বেশী প্রাধান্য হওয়াই স্বাভাবিক।
ইতিহাসের এই প্রেক্ষাপটে ১১৯৯ খ্রীঃ তুর্কী সেনাপতি ইফতেখার উদ্দিন বিন বখতিয়ার খিলজী মাত্র সতেরোজন অনুচর নিয়ে অতর্কিতে তৎকালীন বাংলার রাজধানী নবদ্বীপে আক্রমণ করলে কোনরকম লড়াই কিংবা প্রতিরোধ ছাড়াই অবাঙালি বৃদ্ধ রাজা লক্ষণসেন পরিবারসহ দুর্গম পূর্ব বঙ্গীয় এলাকায় পলায়ন করেন। ইতিহাসের পাতায় এ ধরনের ভীরুতার ঘটনা বিরল। পরবর্তীকালে এই ঘটনাকে বিতর্কমূলক করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ কথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, ব্রাহ্মণদের দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং ক্ষাত্র মতে বিশ্বাসী বহিরাগত ও অবাঙালি সেন রাজারা যুগের পর যুগ ধরে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপর এমন অত্যাচার অব্যাহত রেখেছিলো যে, ইফতেখারউদ্দিন বিন বখতিয়ার খিলজীর আক্রমণের সময় স্থানীয় অধিবাসীদের কেউই রাজা লক্ষণ সেনের পক্ষে অস্ত্র তুলে নেয়নি। সম্ভবতঃ সর্বশেষ সেন রাজা লক্ষণ সেন এ ব্যাপারে অবহিত ছিলেন বলেই কোনরকম লড়াই ছাড়াই রাজধানী নবদ্বীপ ছেড়ে তিনি সপরিবারে পলায়ন করেছিলেন। একটা বহিরাগত শাসকগোষ্ঠী যখন নিজেদের কৃতকর্মের জন্য স্থানীয় গণমানুষের সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয় এবং জনসাধারণের সংগে সম্পর্কহীন হয়ে পড়ে, তখন এ ধরনের ঘটনা হতে বাধ্য। ঐতিহাস এর সাক্ষ্য বহন করছে। ১১৯৯ খ্রীঃ নবদ্বীপে রাজা লক্ষণ সেনের পলায়ন কোনও ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা নয়।
অবশ্য এর আগে বংগীয় এলাকায় ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে সুফী পীর, ফকির, আউলিয়া ও দরবেশদের আগমন শুরু হয়ে গেছে। আগেই উল্লেখ করেছি যে, মাত্র কয়েক শতাব্দীকালের মধ্যে বংগীয় এলাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী পবিত্র ইসলামকে সাদরে গ্রহণ করে এবং এর জন্য কোনরূপ শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন হয়নি বলা যায়। সমাসাময়িককালে এ দেশে বিরাজমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক দাসত্ব এবং হিন্দু ধর্মের কঠোর অনুশাসন এর অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
তাহলে বংগীয় এলাকার হাজার পাঁচেক বছরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নিন্মরূপ হিসেবে বর্ণিত করা সমীচীন হবে :
১. অষ্ট্রিক ও দ্রাবিড় সভ্যতার উন্মেষ ও বিস্তার
২. বহিরাগত আর্যদের প্রতিহত করার সময়কাল
৩. ৬০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তারকাল
৪. পঞ্চম শতাব্দীর শেষভাগে ব্রাহ্মণ্যবাদের ছত্র-ছায়ায় আর্য গুপ্ত সাম্রাজ্যের আমলে ব্রাহ্মণ্য স্মৃতি সংহতির প্রভাবকাল
৫. ষষ্ঠ শতাব্দীতে হুণদের আক্রমণে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পরিসমাপ্তি
৬. সপ্তম শতাব্দীতে আর্য রাজা শশাংক নরেন্দ্র গুপ্ত কর্তৃক মুর্শিদাবাদ এলাকায় সিংহাসন আরোহণ এবং বংগীয় এলাকায় আর্যসংস্কার চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা। তাম্র গাত্রবর্ণের স্থানীয় বাঙালি জনগোষ্ঠীর রক্তাক্ত বিদ্রোহ।
৭. আর্য পণ্ডিত সমাজের বর্ণিত “মাৎস্য ন্যায়”-এর (জোর যার মুলুক তার)-এ সময়কাল। ইংরেজ ঐতিহাসিকদের আখ্যায়িত ৭ম এবং ৮ম শতাব্দীর এই বিশৃংখলা ও আজকতার সময়কালই হচ্ছে আসলে বহিরাগত আর্যদের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বিদ্রোহের শতাব্দী।
৮. আর্যরা পরাজিত হলে স্থানীয় বাঙালি জনগোষ্ঠী কর্তৃক ৮ম শতাব্দীতে নির্বাচনের মাধ্যমে মহাযানী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সেনাপতি গোপাল দেবকে রাজা ঘোষণা এবং বাঙালি পাল বংশের রাজত্বের সূত্রপাত ও গৌড়ে রাজধানী স্থাপন।
৯. প্রায় ৩০০ বছরকাল পাল বংশের রাজত্বের অবসানে কর্নাটক থেকে আগত অবাঙালি ব্রাহ্মণ বিজয় সেন কর্তৃক বাঙলার ক্ষমতা দখল ও নবদ্বীপে রাজধানী স্থাপন।
১০. কয়েক দশকের ব্যবধানে ১১৯৯ খ্রীষ্টাব্দে তুর্কী সেনাপতি ইফতেখার উদ্দিন বিন বখতিয়ার খিলজী মাত্র ১৭ জন অনুচর নিয়ে অতর্কিতে রাজধানী নবদ্বীপ আক্রমণ করলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সমর্থনের অভাবে অবাঙালি এবং বহিরাগত বৃদ্ধ রাজা লক্ষণ সেনের পলায়ন।
১১. ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত (পলাশীর যুদ্ধে) ৫৫৮ বছর যাবত বংগীয় এলাকায় পর্যায়ক্রমে পাঠান ও মোগলদের রাজত্বকাল।
১২. ১৭৫৭ খ্রীঃ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ১৯০ বছর ধরে ইংরেজের শাসনামল।
১৩. ১৯৪৭-৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানী উপনিবেশ শাসনের ২৪ বছরকাল।
১৪. ১৯৭১ সালে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে গাংগেয় বদ্বীপ এলাকায় স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং প্রকৃত জাতির বাঙালি জাতির সম্পূর্ণতা লাভ।
বাংলাদেশে বিশেষ করে গাংগেয় বদ্বীপ এলাকায় ইতিহাসের সংঘাতবহুল ক্রমবিকাশের ধারায় কিভাবে প্রকৃত অর্থে বাঙালি জাতির (মধ্যযুগের শেষ পাদ থেকে ধর্ম বিশ্বাসে অধিকাংশ মুসলমান) দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটলো, তার বর্ণনা সংক্ষিপ্ত আকারে উপস্থাপিত করা হলো। এক্ষণে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবীদের প্রভাবিত এলাকাবাসী এবং গাংগেয় বদ্বীপ এলাকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতিগতভাবে শেষাবদি কারা লাভবান হলো সেই সত্য উদ্ঘাটনের প্রাক্কালে আলোচনার সুবিধার্থে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার রেনেসাঁর প্রতি পুনরায় কিছুটা আলোকপাত করা অপরিহার্য মনে হয়।
পশ্চিম বাংলার বিশিষ্ট মার্কসিস্ট লেখক ও সাংবাদিক বিনয় ঘোষ তাঁর রচিত ‘বাংলার বিদ্বৎ সমাজ’ গ্রন্থে অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে সৃষ্ট কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্যশ্রেণীর বিকাশ ও বিস্তার সম্পর্কে যে বস্তুনিষ্ঠ বক্তব্য উপস্থাপিত করেছেন, তা নিশ্চিতভাবে সমর্থনযোগ্য। তিনি লিখেছেন, “ইংরেজ যুগের প্রথম পর্বে নতুন বাঙালি সম্ভ্রান্ত সমাজ গড়ে ওঠে প্রধানতঃ এই দেউলিয়া-বেনিয়ানি মুছুদ্দিগিরি ও চলনসই ইংরেজী বিদ্যার উপর ভিত্তি করে। ……কিন্তু অধিকাংশ বাঙালি পরিবার ‘সম্ভ্রান্ত’ বলে গণ্য হয়েছেন, দেওয়ানী-বেনিয়ানির অর্থলাভে। ……….অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিক থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের মধ্যে নতুন কলিকাতা মহানগরীতে এইসব হিন্দু বাঙালি পরিবার বিত্ত ও বিদ্যা, উভয় ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। … –বাংলার এই নতুন বিদ্বৎ সমাজ প্রায় সম্পূর্ণ ‘মুসলমানবর্জিত’ রূপ ধারণ করল এবং সেই জন্য একে সাধারণভাবে বাঙালি বিদ্বৎ সমাজ’ না বলে, বিশেষ অর্থে ‘বাঙালি হিন্দু বিদ্বৎসমাজ’ বলাই যুক্তিসংগত। ……হিন্দু মধ্যশ্রেণী ও হিন্দু বিদ্বৎসমাজের বিকাশের ফলেই রিনেসান্স (সংকীর্ণ অর্থে) ও রিফর্মেশন আন্দোলন হিন্দুসমাজের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত ছিল। …. সংস্কার আন্দোলন ধীরে ধীরে হিন্দু ধর্মের পুনরুভ্যুত্থান আন্দোলনে পরিণত হল। ‘হিন্দু’-প্রীতি ক্রমে ‘হিন্দুত্ব’-প্রীতির ভিতর দিয়ে ‘সাম্প্রদায়িকতায়’ পর্যবসিত হল। ..একেশ্বরবাদী ব্রাহ্মধর্মের গতি হলো ঊষরবুদ্ধি অহমিকায় এবং হিন্দুধর্মকে সংস্কার করে নিতে ব্যর্থ হওয়ায় তা শেষ পর্যন্ত হিন্দু ধর্মেরই আবেষ্টনের মধ্যে একটি উপ-সম্প্রদায়ের মর্যাদা গেল— আর পাঁচটা উপ-সম্প্রদায়েরই মতো। …… যতো দিন গেল মধ্যযুগীয় প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা— কাঠামোর প্রতিটি বৈশিষ্ট্য আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল ঊনবিংশ শতাব্দীতে— যে যুগকে আমরা নাম দিয়েছে ‘রিনেসান্সের যুগ’ জাতিভেদ সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় বিভেদ প্রবণতা, মুর্তিপূজা, বহু-ঈশ্বরবাদ, গোঁড়ামি— এইসব মধ্যযুগীয় ব্যাপারগুলোর একটি অথবা অপরটির কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছিলেন ‘আধুনিক’ বুদ্ধিজীবীরা, যাদের ইংরেজী শিক্ষার ওজন বেশ ভারী।”
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজ আমলে বংলার কথিত রেনেসাঁ বা নবজাগৃতির সাফাই গেয়ে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবীরা এ পর্যন্ত যেসব গ্রন্থ রচনা করেছেন, তার মধ্যে নিম্নেবর্ণিত বইগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১. সে কাল আর এ কাল : রাজনারায়ণ বুস
২. রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বংগসমাজ : শিবনাথ শাস্ত্রী
৩. বেংগলী লিটারেচার ইন দি নাইনটিনথ সেঞ্চুরী : ডঃ সুশীল কুমার দে
৪. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (১ম খন্ড) : সজনীকান্ত দাস
৫. বাঙলা সাহিত্যে গদ্য : সুকুমার সেন
৬. বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস : সুকুমার সেন
৭. জাতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্য : সুনীতিকুমার চ্যাটার্জি
৮. বাংলার নবযুগ : মোহিতলাল মজুমদার
৯. সংবাদপত্রে সেকাল : ব্রজেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী
১০. সিলেকশন ফ্রম রাইটিংস অব হরিশ চন্দ্র মুখার্জি : ডঃ নরেন্দ্র চন্দ্র সেনগুপ্ত
১১. ভারতবর্ষের স্বাধীনতা : যোগেশচন্দ্র বাগল
এসব গবেষণামূলক বই সম্পর্কে পশ্চিম “বাঙলার গবেষক বিনয় ঘোষের মন্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলার নবজাগৃতির ইতিহাস পূর্বে যাঁরা লিখেছেন তাঁদের অধিকাংশ লেখাই আংশিক অথবা প্ৰাসংগিক। এই ধরনের আরও অনেক গ্রন্থে প্রবন্ধে ও জীবনচরিতে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙলার ইতিহাসের নানাদিক ও নানা বিষয় নিয়ে আংশিক আলোচনা করা হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানর দৃষ্টি নিয়ে এর মধ্যে অনেকেই করেননি। শ্রী গোপাল হালদারের দু’একটি প্রবন্ধ এবং অমিত সেনের খসড়া ‘নোটস অন বেংগলী রেনেসান্স এ বিষয়ে প্রথম দিগদর্শন বলা যায়; কিন্তু তাঁরা কেউ নবজাগৃতির সম্পূর্ণ ইতিহাস রচনা করেননি।” (ভূমিকা বাংলার নবজাগৃতিঃ ওরিয়েন্ট লংম্যান কলিকাতা)
কিন্তু কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যক্ষ এবং বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ডক্টর অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায়-এর বক্তব্য সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। কিছুটা পুনরুল্লেখ হওয়া সত্ত্বেও এক্ষণে তাঁর উদ্ধৃতির প্রয়োজন রয়েছে। তিনি ‘বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে লিখেছেন, “ঊনবিংশ শতাব্দীর বড়ো কথা পুঁথির যুগের অবসান এবং মুদ্রণের যুগের সূচনা। মুদ্রাযন্ত্র ইউরোপীয় রেনেসাকে ত্বরান্বিত করেছিল, বাংলাদেশেও মুদ্রণ শিল্পের ক্রম সম্প্রসারনের ফলে চিন্তাশ্রয়ী মানবজ্ঞান যুগপৎ গভীর ও ব্যাপক হল। শুধু তাই নয়, সাহিত্যের সংগে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সংস্কৃতির অন্যান্য বিভাগের গভীরতর সম্পর্ক স্থাপিত হল। বিশুদ্ধ সারশ্বত আনন্দ যেমন লেখক ও পাঠককে প্রণোদিত করল, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রের যাবতীয় ব্যাপার সাহিত্যের মারফত, নানা আলাপ-আলোচনার দ্বারা বিশেষতঃ সাময়িক পত্রিকার সাহায্যে বাঙালির জীবনধারাকে উচ্চকিত করে তুলল। ইউরোপের রেনেসাঁস, রিফর্মেশন, রেস্টোরেশন এবং আধুনিকতার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো ঊনবিংশ শতকের বাঙালি-জীবনে ও বাংলা সাহিত্যে বিকশিত হতে আরম্ভ করল। একে আমরা সাধারণতঃ বাঙালি জীবনের ‘ঊনবিংশ শতকী রেনেসাঁস’ বলি। ঐতিহাসিকের ভাষায় “সাচ এ রেনেসান্স হ্যাজনট বিন সিন এনিহোয়ের এলস ইন দি ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি” (বিশ্বের ইতিহাসে এ ধরনের রেনেসান্স আর কোথাও দেখা যায়নি।)
পশ্চিম বাংলার অপর এক বিশিষ্ট মার্কসিস্ট গবেষক সুপ্রকাশ রায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজদের ছত্রছায়ায় সৃষ্ট কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী তথা মধ্যশ্রেণীর ভূমিকা সম্পর্কে সুচিন্তিত অভিমত জ্ঞাপন করেছেন। ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ (১৯৮০ কলিকাতা) গ্রন্থের ভূমিকায় কমরেড রায় লিখেছেন, “ঊনবিংশ শতাব্দীর কৃষক বিদ্রোহের পাশাপাশি” ‘রিনাসান্স’ নামে ইংরেজী শিক্ষাপ্রাপ্ত জমিদার শ্রেণী ও মধ্যশ্রেণীর যে আন্দোলনটি চলিয়াছিল তাহাও কৃষক বিদ্রোহগুলোর মতই তাৎপর্যপূর্ণ। ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর দেওয়া ভূমিস্তরের অধিকারবলে জমিদার শ্রেণী ও মধ্যশ্রেণী একদিকে কৃষক-শোষণের ব্যবস্থা দৃঢ়তর করিবার জন্য এবং অপরদিকে ইংরেজ সৃষ্ট নূতন সমাজের নেতৃত্ব লাভের জন্যই তাহাদের তথাকথিত ‘রিনাসান্স’ আন্দোলন আরম্ভ করিয়াছিল।
এই “রিনাসান্স” আন্দোলন হইতেই শিক্ষিত ‘ভদ্রশ্রেণী’ হিসেবে মধ্যশ্রেণী নূতনভাবে গড়িয়া উঠিয়াছে। কেরানী সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী ভারতবর্ষে যে ব্যয়বহুল ইংরেজী শিক্ষার প্রবর্তন করিয়াছিল, জমিদারশ্রেণীর সহিত মধ্যশ্রেণীর প্রাণপণে তাহার সুযোগ গ্রহণ করিয়া ইংরেজী-শিক্ষিত মধ্যশ্রেণীতে পরিণত হয়। শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ হইতে এই ইংরেজী শিক্ষার প্রসারের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন টমাস ব্যাবিংটন মেকলে। তাঁহার লক্ষ্য ছিল, এ দেশে এরূপ একটি ইংরেজী-শিক্ষিত শ্রেণী সৃষ্টি করা যে শ্রেণীটি উহার উন্নত ইংরেজী শিক্ষার গুণে ভারতবর্ষকে নহে, ইংলন্ডকে ‘স্বদেশ’ ও ইংরেজদের পরমাত্মীয় বলিয়া মনে করিবে এবং কোনকালেই ইংরেজ শাসনের বিরোধী হইবে না।………..
“ঊনবিংশ শতাব্দীতেই যখন বিহার ও বংগদেশের উপর দিয়া কৃষক-বিদ্রোহের ঝড় বহিতেছিল, তখন এই শিক্ষিত মধ্যশ্রেণী গণ-সংগ্রামের দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া বিদেশী ইংরেজ প্রভুদের শাসনকে ‘ভগবানের আশীর্বাদরূপে বরণ করিয়া ইংরেজী শিক্ষার দানের ভিত্তিতে নিজেদের নূতনভাবে গড়িয়া তুলিতে ব্যস্ত হইয়াছিলেন। সভ্যশ্রেণীরূপে নিজেদের গড়িয়া তুলিবার জন্য সর্বপ্রথম সাহিত্যের প্রয়োজন। সুতরাং নূতন সাহিত্য সৃষ্টি আরম্ভ হইল। বঙ্কিমচন্দ্র হইলেন এই সাহিত্য সৃষ্টিকার্যের প্রধান নায়ক এবং তাঁহার সৃষ্ট সাহিত্যের মধ্য দিয়াই মধ্যশ্রেণীর এই ‘রিনাসান্স’ পূর্ণ বিকশিত রূপ গ্রহ করিল।………
“এমনকি বঙ্কিমচন্দ্র কৃষকের দুর্দশার এবং এদেশে ইংরেজ প্রভুদের শোষণ-উৎপীড়নের চিত্র উদঘাটন করিয়া রচিত কোন সাহিত্যও সহ্য করিতে প্রস্তুত ছিলেন না। দীনবন্ধু মিত্র তাঁহার ‘নীল দর্পণ’ নাটকে কৃষকদের কোন সংগ্রামের চিত্র অঙ্কিত করেন নাই, কেবল ইংরেজ প্রভুদের শোষণ-উৎপীড়ন এবং কৃষকদের চরম দুর্দশার চিত্রই অঙ্কিত করিয়াছেন। অথচ বঙ্কিমচন্দ্র ‘আর্ট’-এর নাম করিয়া ইহার উপরও আক্রমণ করিতে ইতস্ততঃ করেন নাই। মোশাররফ হোসেনের ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকের বিষয়বস্তু সিরাজগঞ্জের ঐতিহাসিক কৃষক বিদ্রোহ। বঙ্কিমচন্দ্র ইহার প্রচার বন্ধ করিবার জন্য কোন চেষ্টারই ত্রুটি করেন নাই। কিন্তু নাট্যকারের দৃঢ়তায় তাঁহার (বঙ্কিমের) সকল চেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছিল।……..
“বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহিত সহযোগিতা ও’আপোষের নীতি বংগদেশ তথা ভারতবর্ষের ‘রিনাসান্স’ আন্দোলনেরই অন্যতম অবদান। “
গবেষক সুপ্রকাশ রায় আলোচ্য পুস্তকের অন্যত্র (পৃঃ ১৯৬-৯৭) কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের মনমানসিকতা ও কর্মকান্ড সম্পর্কে আরও সুচিন্তিত ও বস্তুনিষ্ঠ মন্তব্য করেছেন। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, “এইভাবে বঙ্কিমচন্দ্রের নেতৃত্বে বংগীয় ‘রিনাসান্স’ হিন্দু ‘রিনাসান্সে’ পর্যবসিত হয়। প্রকৃতপক্ষে এই হিন্দু ‘রিনাসাল’ হিন্দু অভিজাত ও হিন্দু মধ্যশ্রেণীরই নবজাগরণ। বঙ্কিমের পর রামকৃষ্ণ পরমহংস ও তাঁহার শিষ্য বিবেকানন্দ বঙ্কিমচন্দ্র কর্তৃক আরদ্ধ এই হিন্দু ‘রিনাসাঙ্গ’কে আরও গভীর ও ব্যাপকভাবে ধর্মীয় ও সামাজিক রূপ দান করেন।
অথচ ১৯৮৩ সালে এসেও পশ্চিম বাংলার বিশিষ্ট অধ্যাপক ও নয়াদিল্লীর ‘জহরলাল নেহেরু স্মৃতি তহবিল’ সংস্থার রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন গবেষক শ্রী প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় বঙ্কিম আদর্শের সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে সমর্থনসূচক মন্তব্য করে লিখেছেন যে, “মহান বিপ্লবী শ্রী অরবিন্দ বঙ্কিমের আদর্শ দ্বারা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন এবং তিনি বঙ্কিচন্দ্রকে ‘স্বাদেশিকতার ধর্মগুরু’ বলে অভিহিত করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর রচনার মধ্যে হিন্দুধর্ম ও জাতীয়তাবাদ এই দুই-এর মধ্যে এক আশ্চর্য সমন্বয় সাধন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। হিন্দু দর্শন সম্পর্কে তাঁর গভীর অনুরাগ থাকায় অনেকে তাঁর চিন্তাধারাকে ধর্মকেন্দ্রিক ও রক্ষণশীল বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু এই ধারণা গ্রহণযোগ্য নয়— কারণ তিনি হিন্দুধর্ম ও ঐতিহ্য অনুসরণ করে দেশবাসীর মনে স্বদেশপ্রেম সষ্ণার ব্রতী হয়েছিলেন।…..
স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর ১৮২৫-১৮৮৩ খ্রীঃ) ধর্মীয় মতবাদ (হিন্দু) সংগ্রামী জাতীয়তাবাদ প্রসারে সহায়ক হয়েছিল। বৈদিক সভ্যতার আদর্শের ভিত্তিতে তিনি হিন্দুধর্ম ও হিন্দু সমাজের সংস্কারকার্যে আত্মনিয়োগ করেন। এই সংস্কারকার্য পরিচালনার জন্য তিনি আর্য-সমাজ নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। … সংগ্রামী জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রসারে স্বামী বিবেকানন্দের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।……… যদিও হিন্দুধর্ম ও ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে সংগ্রামী (হিন্দু) জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল; কিন্তু তিলক, বিবেকান্দ, বঙ্কিমচন্দ্ৰ প্রমুখ মনীষীদের সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক দোষে দুষ্ট বলা যায় না। (কেন্দ্রীয় ভারত সরকারের অর্থানুকূল্যে বাংলায় প্রকাশিত গ্রন্থ ‘আধুনিক ভারত’ : পূঃ বংগ রাজ্য পুস্তক পর্যদ : কলিকাতা ১৯৮৩)।
এ সম্পর্কে পশ্চিম বাংলার বিশিষ্ট লেখক অশোক মিত্রের বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি লিখেছেন, “ভারতের বুদ্ধিজীবীরা যে নবযুগের অভ্যুদয়কে ‘রেনেসাঁস’ বলিয়া অভিনন্দন জানাইলেন, গ্রামের ওপর তাহার পরিণাম হইল দুঃখজনক। গ্রামে নতুন মধ্যশ্রেণী গজাইয়াছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রে জমির ওপর কায়েমী স্বত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়া, গ্রাম্য মহাজনবৃত্তি হইতে উচ্চহারে খাজনা এবং ক্রমবদ্ধমানভাবে ভাগচাষী ও কৃষি-শ্রমিক নিযুক্ত করিয়া। ….. প্রকৃত চাষী এবং ভূমি-স্বত্বাধিকারীর মধ্যে ব্যবধান বাড়িয়া গেল, তাহাদের মধ্যে সৃষ্টি হইল শোষক ও শোষিতের সম্বন্ধ— চুক্তি ও সহযোগিতা নয়।”
সাম্প্রতিককালে পশ্চিম বাংলায় চাঞ্চল্যসৃষ্টিকারী চরম বামপন্থী লেখক প্রয়াত প্রমোদ সেনগুপ্ত মহাশয় ‘বাংলার রেনেসাঁ’ সম্পর্কে সরাসরি বক্তব্য রেখেছেন। তিনি লিখেছেন যে, “তারা (রেনেসাঁর দাবীদার) সমাজের সংস্কার চেয়েছিল, সমাজের আমূল পরিবর্তন চায়নি। উপরন্তু, তাদের আন্দোলন ছিল মুষ্টিমেয় শিক্ষিত হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং জনসাধারণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। তাই তাদের চিন্তার ক্ষেত্রও ছিল খুব সংকীর্ণ এবং তার সাহসও ছিল খুব দুর্বল। কোনো কোনো বিষয়ে কিছু ভাসা-ভাসা মিল ছিল, থাকলেও, ইউরোপের রেনেসাঁসের সংগে বাংলার রেনেসাঁসের কোনো তুলনা করা চলে না, দুটোর মধ্যে রয়েছে একটা মৌলিক প্রভেদ। ইয়োরোপের রেনেসাঁস ছিল সামন্ততন্ত্র বিরোধী ও বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অগ্রদূত, আর বাংলার রেনেসাঁস বিকাশ লাভ করেছিল ইংরেজ শাসক শ্রেণী কর্তৃক পুনরুজ্জীবিত বাংলার সামন্ততন্ত্রের ছত্রছায়ায়। ইয়োরোপের রেনেসাঁসের স্বাভাবিক পরিণতি ঘটেছিল যুক্তিবাদের যুগে। যুক্তিবাদী যুগের বিপ্লবী মতাদর্শ, বস্তুবাদ ধর্মবিরোধী গির্জাবিরোধী চিন্তাই বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্বে ঘটিয়েছিল মহান ফরাসী বিপ্লব, আপোষহীনভাবে ধ্বংস করেছিল ফরাসী সামন্ততন্ত্র গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মুক্তির বাণী ছড়িয়ে দিয়েছিল সারা বিশ্বে।… এটাই ছিল বর্তমান ইয়োরোপীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভিত্তি। বেংগল রেনেসাঁসের চরিত্র ছিল বিপরীত। তার নেতারা [কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী] সমাজ ও ধর্ম সংস্কারের সংকীর্ণ সীমা অতিক্রম করতে পারেননি। তাঁরা দেশকে বিদেশী শাসন থেকে মুক্ত করা বা সমাজের মৌলিক পরিবর্তন ঘটানোর কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেননি। … কৃষক শোষণে তাঁরা ছিলেন ইংরেজ সরকারের অংশীদার, তাই তাঁরা ছিলেন কৃষকদের শত্রু এবং ইংরেজ শাসকদের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল্প। তাঁরা অনেকেই ভারতে ইংরেজ শাসনকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলেই মেনে নিয়েছিলেন।… …..মোট কথা, এঁরা এঁদের কোনো ঐতিহাসিক কর্তব্যই পালন করতে পারেননি, কোনো মূল সমস্যাও সমাধান করতে পারেননি। তাই এঁদের কোনো মহান কীর্তি নাই, আছে শুধু দম্ভ— জাতিদন্ত, শিক্ষার দত্ত, রেনেসাঁসের দম্ভ, নিজেদের শ্রেষ্ঠতার দম্ভ।” (ভারতীয় মহাবিদ্রোহ, দ্বিতীয় খণ্ডঃ সুবর্ণ রেখা কলিকাতাঃ ১৯৮৪)।
এ ধরনের এক ভয়াবহ প্রতিক্রিয়াশীল প্রেক্ষাপটে একটা পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিভংগী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর ‘কোলকাতা কেন্দ্রিক বাংলার রেনেসাঁর’ মূল্যায়ন করলে যে চিত্রটি আমাদের সম্মুখে উদ্ঘাটিত হয়, তা নিশ্চিতভাবে দুঃখজনক ও লজ্জাস্কর বলা যায়। আলোচ্য রেনেসাঁর প্রারম্ভিককালে রাজা রামমোহন রায় কর্তৃক সর্বোচ্চ আদালতে দাখিলকৃত স্মারকলিপির অংশবিশেষ ছিলো নিম্নরূপ :
“ভারতবাসিগণের পরম সৌভাগ্য যে, তাহারা ভগবৎ করুণায় সমগ্র ইংরেজ জাতির রক্ষণাবেক্ষণে রহিয়াছে এবং ইংলণ্ডের রাজা, ইংলন্ডের লর্ডগণ ও ইংলণ্ডের পার্লামেন্ট ভারতবাসিগণের জন্য আইন প্রণয়নের কর্তা।” (মেমোরিয়াল টু দি সুপ্রীম কোর্ট, ওয়ার্কস পৃঃ ৪৪২)।
উপরন্তু রামমোহন যুগের পরবর্তীতে কয়েক দশক পর্যন্ত উদারপন্থী চিন্তাধারার রোজরিও, দেবেন্দ্রনাথ, অক্ষয়কুমার, রামতনু, রাজেন্দ্রলাল, কৃষ্ণমোহন, বিদ্যাসাগর, প্যারীচাঁদ, মধুসূদন প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গের কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি রাধাকান্ত ভূদেব, রামকৃষ্ণ প্রমুখদের হিন্দুয়ানীর যে ক্ষীণ ধারা প্রবাহিত হচ্ছিলো, তারই উত্তরসূরী হিসেবে আর সবাইকে আড়াল করে যখন ধূমকেতুর মতো বাংলা সাহিত্যের সম্রাট এবং চরম প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দু জাতীয়তাবাদের একনিষ্ঠ সেবক ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের আবির্ভাব হলো, তখন ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী ছাড়াও কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণী অচিরেই বঙ্কিমের কর্মকাণ্ডকেই বাংলার রেনেসাঁর পূর্ণ বিকাশের যুগ হিসেবে আখ্যায়িত করলো।
অথচ প্রকৃত সত্য ও স্বরূপ উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে পুনরাবৃত্তি হওয়া সত্ত্বেও বঙ্কিম সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে মহল বিশেষ কর্তৃক চিহ্নিত ‘আনন্দমঠ’-এর মূল্যায়ন এক্ষেত্রে অপরিহার্য মনে হয়। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্রের মনমানসিকতা ও বঙ্কিম-দর্শনের প্রতিফলন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বঙ্কিমের বক্তব্য হচ্ছেঃ
ক. “ইংরেজ বহির্বিষয়ক জ্ঞানে অতি সুপণ্ডিত, লোকশিক্ষায় বড় সুপটু। সুতরাং ইংরেজকে রাজা করিব।” (আনন্দমঠ)
খ. “ইংরেজরা এক্ষণে বণিক— অর্থ সংগ্রহেই মন দিয়াছে, রাজশাসনভার লইতে বাধ্য হইবে,……. ইংরেজ রাজ্যে অভিষিক্ত হইবে বলিয়াই সন্তানবিদ্রোহ উপস্থিত হইয়াছে।” (আনন্দমঠ)
গ. “সত্যানন্দের চক্ষু হইতে অগ্নিস্ফুলিংগ নির্গত হইল। তিনি বলিলেন, “শত্রুশোণিত সিক্ত করিয়া মাতাকে শঙ্খশালিনী করিব।
মহাপুরুষ শত্রু কে? শত্রু আর নাই। ইংরেজ মিত্র রাজা।” (আনন্দমঠ)
ঘ. “কে কাহার হাত ধরিয়াছে? জ্ঞান আসিয়া ভক্তিকে ধরিয়াছে, ধর্ম আসিয়া কর্মকে ধরিয়াছে।” (আনন্দমঠ
ঙ. “ইংরেজ বাংলাদেশকে অরাজকতার হস্ত হইতে উদ্ধার করিয়াছে।” (আনন্দমঠ)
চ. “অতএব তোমরা দেশ উদ্ধার করিতে পারিবে না। আর ফল যাহা হইবে ভালই হইবে, ইংরেজ না হইলে সনাতন ধর্মের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নাই।” (আনন্দমঠ)
কোন রকম লুকোচুরি না করে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর রচিত ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে, এদেশ সম্পূর্ণভাবে ইংরেজদের পদানত হওয়ার ফল শুভ হতে বাধ্য। কারণ একটাই এবং তা হচ্ছে এই যে, ইংরেজরা এদেশে না আসলে সনাতন ধর্মের (হিন্দু ধর্ম) বিজয় কেতন উড্ডীন সম্ভব হতো না। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে এমর্মে বিশেষ করে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও মধ্যশ্রেণী সম্প্রদায়কে বুঝাতে চেয়েছেন `যে, মুসলমানদের শাসনে হিন্দু ধর্ম হয়েছিলো, কিন্তু ইংরেজ শাসনে তা পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে।
তাহলে বঙ্কিম-প্রতিভার প্রকৃত মূল্যায়নের পর এ ধরনের মন্তব্য করলে অন্যায় হবে না যে, ‘বাংলার রেনেসাঁর পূর্ণ বিকাশের হোতা হিসেবে বর্ণিত বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর নির্ভেজাল সমর্থক। অবশ্য তিনি ইংরেজের ছত্রচ্ছায়ায় প্রতিক্রিয়াশীল সনাতন হিন্দু ধর্ম ও হিন্দু শৌর্য-বীর্যের পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে ইংরেজদের দালালীর পথকে সহজতর হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এ জন্যই বঙ্কিমের মন-মানসিকতা কৃষক বিদ্বেষ, নিম্নশ্রেণী বিদ্বেষ এবং যবন বিদ্বেষ-এ ভরপুর। অভূতপূর্ব প্রতিভার অধিকারী বঙ্কিমচন্দ্রের মত শ্রেণী এবং সম্প্রদায়-সচেতন ব্যক্তিত্ব ইতিহাসে বিরল বলা যায়। কিন্তু আশ্চর্যজনক মনে হলেও একথা সত্য যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে এসে কোলকাতা কেন্দ্রিক ইংরেজী শিক্ষিত বাঙালি বর্ণহিন্দুরা রামমোহন-ইয়ংবেংগল-প্যারীচাঁদ-বিদ্যাসাগর-মাইকেলের প্রবর্তিত উদার ও সংস্কারপন্থী পথ পরিত্যাগ করে শ্রেণী ও গোষ্ঠীস্বার্থে ‘অত্যন্ত সুবোধ বালকের ন্যায়’ বঙ্কিম-বিবেকান্দ প্রদর্শিত আদর্শকে সাদরে গ্রহণ করে মাতোয়ারা হয়ে উঠলেন। এরই ফলশ্রুতিতে ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষপাদে এসে আমরা কোলকাতার বর্ণহিন্দু বাঙালি বুর্জোয়া সমাজে অদ্ভুত জীবযাত্রা অবলোকন করতে সক্ষম হই। যেসব ইংরেজী শিক্ষিত বর্ণহিন্দু সরকারী কর্মচারী, ডাক্তার, আইনজীবী, অধ্যাপক, বিচারক প্রমুখ স্যুট-টাই পরিহিত অবস্থায় পাশ্চাত্য সভ্যতার পরিবেশে ইংরেজীতে দিনভর কথাবার্তা বলা-কওয়া করছেন এবং স্ব স্ব পেশায় অর্থ উপার্জন করছেন, তারাই আবার আস্তাচলে গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর স্নানান্তে ধূতি-ফতুয়া পরিধান করে তুলসী তলায় কিংবা গৃহ-দেবতার পদতলে পূজা-আহ্নিক করছেন আর সশব্দে সংস্কৃত ভাষায় বেদের শ্লোক উচ্চারণ করছেন। তখন এঁরা ভিন্ন জগতের অধিকারী।
এই প্রেক্ষিতে গবষেক বিনয় ঘোষ এসব মধ্যশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, “ব্যর্থ হল মেকলের ভবিষ্যদ্বাণী। আধুনিক ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরা দোভাষী হয়ে উঠলেন ঠিকই কিন্তু তাঁদের রুচি অভিমত নীতিবোধ এবং বুদ্ধিশীলতা ঠিক ইংরেজের মতো হলো না। তাঁরা হয়ে পড়লেন ‘দোঁ-আশলা’ শ্রেণী…….. মধ্যযুগ আর আধুনিক যুগের এক বিচিত্র মিশ্রণ।” (বাংলার বিদ্বৎসমাজ : প্রকাশ ভবন কলিকাতা ১৯৭৮)
পশ্চিম বাংলার গবেষক সুপ্রকাশ রায়-এর এক্ষেত্রে সুষ্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে, “ভারতের দুর্ভাগ্য যে, ইংরেজ-সৃষ্ট ভূম্যধিকারি গোষ্ঠীর হস্তে জাতীয় সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী ন্যস্ত হইয়াছিল। তাই তাহারা জাতীয়তাবাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করিয়া ইহার বিকৃতি ঘটাইবার এবং জাতীয় আন্দোলনকে ভ্রান্ত পথে অর্থাৎ আপষের পথে পরিচালিত করিবার সুযোগ লাভ করিয়াছিল। …. ইহাদের পক্ষে ইংরেজ শাসনকেই ভারতের জাতীয় মুক্তির একমাত্র পথ বলিয়া গ্রহণ করাই ছিল স্বাভাবিক। ইহারাই বিংশ শতাব্দীতে ভারতের জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করিয়াছিল বলিয়া সেই জাতীয় আন্দোলন কখনও বৈপ্লবিক চরিত্র গ্রহণ করে নাই, তাহা প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত আপষপন্থী রাজনৈতিক সংস্কার-আন্দোলনরূপে পরিচালিত হইয়াছিল।… বিংশ শতাব্দীর জাতীয় আন্দোলনের মূল ঊনবিংশ শতাব্দীর “রিনাসান্স” আন্দোলনের মধ্যেই নিহিত। ঊনবিংশ শতাব্দীতে রামমোহন, দারকানাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, স্বামী বিবেকানন্দ প্রভৃতি বংগীয় “রিনাসাঁন্সের” নায়কবৃন্দ জাতীয়তাবাদের যে আদর্শ স্থাপন করিয়াছিলেন, তাহাই পরবর্তীকালে বিকাশ লাভ করায়া বিংশ শতাব্দীর জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হইয়াছে।” (ভারতের কৃষক বিদ্রোহঃ কলিকাতাঃ এপ্রিল, ১৯৮০)
কমরেড রায় প্রসংগত আরও লিখেছেন যে, “বৃটিশ প্রভুত্বকে ভারত ভূমিতে অক্ষত রাখিয়া শাসকগণের নিকট হইতে কিছু সুবিধা-সুযোগ আদায়ের জন্য যে আন্দোলন ‘রিনাসাঁন্সের নায়কগণ আরম্ভ করিয়াছিলেন, তাহা ছিল রাজনৈতিক সংস্কারের আন্দোলন, স্বাধীনতার সংগ্রাম নহে”।
সুপ্রকাশ রায়ের এই বক্তব্যের সংগে আরও একটা বিষয়ের সংযোজন এক্ষণে অপরিহার্য মনে হয় এবং কেবলমাত্র সেক্ষেত্রেই প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন সম্ভব হবে। “বংগীয় রেনেসাঁর কর্মকাণ্ডের বিশ্লেষণ এবং এর ধারক ও বাহক কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বৰ্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর চরিত্রের মূল্যায়নকালে ইতিহাসের এক বিস্ময়কর প্রেক্ষিতে দেখা যায় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাপ্তির পর বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আলোচ্য ইংরেজী শিক্ষিত সম্প্রদায়ের হৃদয় থেকে সংস্কারপন্থী ও উদার ভাবাদর্শের সব কিছুই কর্পূরের মতো উড়ে গেছে। আর এঁদের সেই শূন্য হৃদয়ের প্রায় সবটুকুই আপ্লুত হয়ে রয়েছে রাধাকান্ত-ভূদেব-রামকৃষ্ণ বঙ্কিম বিবেকানন্দ প্রমুখের প্রচারিত প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক সনাতন ধর্মীয় ভাবাদর্শে। কোলকাতায় তখন নতুনভাবে ‘ভবানী পূজা’ শুরু হয়ে গেছে আর এই বর্ণহিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণীর মুখে উচ্চারিত শ্লোগান হচ্ছে, “জয়তু শিবাজী”। এঁরা সম্ভবতঃ ভুলেই গিয়েছিলন যে, এই বংগভূমিতেই বুভুক্ষ দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত নিম্নবর্ণের হিন্দু ছাড়াও বিপুলসংখ্যক বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায় দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে সব কিছুই অবলোকন করছে।
তা’হলে গাংগেয় বদ্বীপ এলাকার প্রকৃত অর্থে বাঙালি জাতির (অধিকাংশই ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান) সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর “বংগীয় রেনেসাঁর” প্রেক্ষাপটে সাম্প্রদায়িকতার পথ ধরে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের পরিবর্তিত মন-মানসিকতার বর্ণনার পর উত্তর ভারতীয় অবাঙালি মুসলিম নেতৃবৃন্দের কার্যকলাপের কিঞ্চিৎ উল্লেখ সমীচীন মনে হয়। যদিও বংগভংগকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে ইতিপূর্বে বলা হয়েছে, তথাপিও আলোচনার সুবিধার লক্ষ্যে এ বিষয়ে কিছুটা পুনরুল্লেখ করতে হচ্ছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে কোলকাতা বর্ণহিন্দু বাঙালি বুর্জোয়া শ্রেণীর অন্যতম পুরোধা সুরেন্দ্রনাথ ব্যাণার্জীকে (ইলবার্ট বিল বিরোধী নেতা) আই সি এস-র চাকরি থেকে যে বছর বরখাস্ত করা হয়, ঠিক সে বছর অর্থাৎ ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দে একজন চীফ কমিশনারের অধীনে সিলেট জেলাসহ পৃথক আসাম প্রদেশ গঠন করা হয়। এ সময় কোর্ট উইলিয়াম প্রেসিডেন্সীর আয়তন ছিল প্রায় ২,৩০,৭৯৮ বর্গমাইল। এরমধ্যে নতুন আসাম প্রদেশের জন্য দেয়া হলো ৪১,৭৯৮ বর্গমাইল। আসামের লোকসংখ্যা তখন ৪১ লক্ষ ৩২ হাজার ১৯ জন। তবুও বাংলার আয়তন এক লক্ষ ৮৯ হাজার বর্গমাইল এবং চট্টগ্রাম থেকে ছোট নাগপুর পর্যন্ত এই ভূখণ্ডের লোকসংখ্যা সাত কোটি ৮০ লাখ-এর মতো।
মাত্র ৩১ বছরের ব্যবধানে প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর যখন পুনরায় অবিভক্ত বংগীয় এলাকা থেকে পূর্ববংগকে (চট্টগ্রাম, ঢাকা ও দার্জিলিং বাদে রাজশাহী বিভাগ এবং পার্বত্য ত্রিপুরা ও মালদহ জেলা) আলাদা করে আসামের সংগে যুক্ত করে নতুন প্রদেশের নামকরণ হলো “পূর্ববংগ ও আসাম প্রদেশ” তখনও বেংগল প্রেসিডেন্সীর আয়তন (পশ্চিম সীমানায় ৫টি হিন্দী ভাষাভাষি অঞ্চলকে মধ্য প্রদেশে প্রদান এবং সম্বলপুর ও ৫টি উড়িয়া ভাষাভাষি এলাকা লাভ) এক লক্ষ ৪১ হাজার ৫৮০ বর্গমাইল। অন্যদিকে নতুন এলাকা যুক্ত হওয়ায় (ইতিপূর্বেই লুসাই পাহাড় আসামের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে) পূর্ববংগ ও আসাম প্রদেশের এলাকা হচ্ছে এক লক্ষ ৬ হাজার ৫৪০ বর্গমাইল। নতুন প্রদেশের লোকসংখ্যা তিন কোটি ১০ লাখ-এর মতো। সমগ্র ইংরেজ শাসিত এলাকার মধ্যে এই একটি মাত্র প্রদেশে শতাধিক বছর ধরে নির্যাতিত বাঙালি মুসলমানরা সবার অলক্ষ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো। নিম্নে একনজরে এর পরিসংখ্যান দেয়া হলোঃ
পূর্ববংগ ও আসাম প্রদেশ
আয়তন : ১০৬৫৪০ বর্গমাইল
জনসংখ্যা : ৩ কোটি ১০ লাখ
বাঙালি মুসলমান : ১ কোটি ৮০ লাখ
হিন্দু ধর্মাবলম্বী : ১ কোটি ২০ লাখ
উপজাতি : ১০ লাখ
পূর্বে উল্লেখ করেছি যে, নানাবিধ গোষ্ঠীগত ও শ্রেণীস্বার্থে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী মহল এবং কোলকাতায় বসবাসকারী হিন্দু জমিদার শ্রেণী ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দের আসাম পৃথককরণ-এর বিরোধিতা না করলেও ৩১ বছরের ব্যবধানে ১৯০৫ সালের বংগভংগের ভয়াবহ রকমের বিরোধিতা করলো। এরই জের হিসেবে ১৯০৭ সালের সুরাট কংগ্রেস অধিবেশনে অশ্বিনীকুমার দত্ত (১৮৫৬-১৯২৩), বিপনীচন্দ্র পাল (১৮৫৮-১৯৩২), অরবিন্দু ঘোষ (১৮৭২-১৯৫০) এবং বাল গংগাধর তিলক (১৮৫৬-১৯২০) প্রমুখ চরমপন্থী হিন্দু নেতৃবৃন্দ পরাজিত হলে বংগীয় এলাকায় ‘কালীমাতার সম্মুখে শপথ গ্রহণান্তে ‘বন্দেমাতরম’ শ্লোগান উচ্চারণ-এর মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায় এবং হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাংগার সূত্রপাত হয়।
ঠিক এমনি এক সময় স্যার সৈয়দ প্রবর্তিত ‘আলিগড় চিন্তাধারায়’ (আলিগড়স্থ এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ : ১৮৭৭) উদ্বুদ্ধ হয়ে উত্তর ভারতীয় অঞ্চলের কিছুসংখ্যক অবাঙালি মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের নামে অবাঙালি মুসলিম বুর্জোয়া শ্রেণীর রক্ষাকবজের ব্যবস্থার জন্য প্রচেষ্ট হন। এ ব্যাপারে অগ্রণীর ভূমিকা গ্রহণ করেন আলিগড় কলেজের সেক্রেটারী নবাব মহসিন-উল-মূল্ক। এ সময় সিরাগঞ্জের ভিক্টোরিয়া ও বানোয়ারীলাল বিদ্যালয় দু’টির শিক্ষকরাও বংগভংগ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত হলে পূর্ববংগ ও আসাম প্রদেশের প্রথম গভর্ণর ব্যামফিল্ড ফুলার স্বয়ং বিদ্যালয় দু’টির সরকারী অনুমোদন প্রত্যাহারের সুপারিশ সম্বলিত যে পত্র প্রেরণ করেন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিণ্ডিকেট তা প্রত্যাখ্যান করলে অনতিবিলম্বে গভর্ণর ফুলার পদত্যাগ (৩রা আগষ্ট ১৯০৬) করায় উত্তপ্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ঠিক এমনি এক সময়ে আলিগড় কলেজের তৎকালীন সেক্রেটারী মহসিন-উল-মুল্ক ১৯০৬ সালের ৪ঠা আগস্ট কলেজের ইংরেজ অধ্যক্ষ আর্কিবল্ড-এর নিকট প্রেরিত এক পত্রে সংখ্যালঘু মুসলমানদের স্বার্থ-সংরক্ষণ সংক্রান্ত প্রশ্নে সহযোগিতা কামনা করেন।
এ সম্পর্কে বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের প্রদত্ত আক্ষেপপূর্ণ বর্ণনা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। তিনি লিখেছেন, “আর্কিবল্ড বড়লাট-এর (লর্ড মিন্টো) ব্যক্তিগত সচিব ডানলপ স্মিথের সংগে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করেন। ডানলপ স্মিথ ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ কর্মচারীগণ মুসলমান প্রতিনিধি দলের সংগে সাক্ষাতের প্রস্তাব সমর্থন করেন। বড়লাট-এর কার্যনির্বাহক পরিষদের সদস্য ডি. ইবেটসন লর্ড মিন্টোকে মুসলমান প্রতিনিধি দলের সংগে সাক্ষাতের পরামর্শ দেন এবং তাদের দাবি-দাওয়া সহানুভূতির সংগে বিচার করতে অনুরোধ জানান।… একই সময়ে পূর্ববংগের গভর্ণর ল্যান্সলট হেয়ার বড়লাট মিন্টোকে প্রতিনিধি দলের সংগে সাক্ষাতের পরামর্শ দিলেন এবং তিনি এই প্রতিনিধি দলকে ভারতীয় মুসলমান সমাজের প্রকৃত প্রতিফলন বলে মন্তব্য প্রকাশ করেন।
“১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দের ১লা অক্টোবর আগা খাঁর নেতৃত্বে ৩৫ সদস্যবিশিষ্ট এক প্রতিনিধি দল সিমলায় বড়লাট মিন্টোর সংগে সাক্ষাত করে এবং এক দাবিপত্র পেশ করেন। প্রতিনিধি দলের সদস্যদের অধিকাংশই ছিলেন ভূস্বামী ও অভিজাত সম্প্রদায়ভুক্ত। উত্তর প্রদেশ থেকে সবচেয়ে বেশী সদস্য যোগদান করেন। সিমলায় প্রেরিত প্রতিনিধি দলের সংগঠন ও উদ্দেশ্য থেকে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, আলিগড় গোষ্ঠীর দ্বারা মুসলিম প্রতিনিধি দল প্রভাবিত হয়েছিল।” (আধুনিক ভারত প্রথম খণ্ড ১৮৮৫-১৯২০: পঃ বংগ রাজ্য পুস্তক পর্ষদঃ কলিকাতাঃ ১৯৮৩)।
১৯০৬ সালের ১লা অক্টোবর সিমলায় অনুষ্ঠিত হবে এই মর্মে জানিয়ে দেন, তখন মহসিন-উল-মুল্ক প্রতিনিধি দলের সদস্যদের তালিকা এবং দাবী-দাওয়াসম্বলিত খসড়া প্রতিবেদন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এখানে প্রাসংগিক বিধায় মহসিন-উল-মুলকের পরিচয় প্রদান সমীচীন মনে হয়। উত্তর প্রদেশের এটোয়ার উর্দুভাষী জনাব মহসিন-এর পুরো নাম নাবব সৈয়দ মেহেদী আলী মহসিন-উল-মুল্ক। ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের সময় ইনি ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীনে এটোয়াতে কেরানির চাকরি করতেন। বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ও সাংবাদিক মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ এঁর সম্পর্কে লিখেছেন, “বিদ্রোহীদের হাতে এটোয়ার পতনের পর তিনি কোম্পানীর অধীনে সামান্য বেতনের কেরানীর পদতি হারাইয়া ফেলিয়াছিলেন। বিদ্রোহ অবসানের পর তিনি চাকরিতে পুনর্বহাল হইয়া দ্রুত প্রমোশন পাইতে থাকেন। তাঁহার সর্বশেষ চাকরি ছিল হায়দরাবাদে। মোটা পেনশন এবং লম্বা উপাধিসহ তিনি স্যার সৈয়দের জীবদ্দশায় তথা হইতে এটোয়ায় প্রত্যাবর্তন করেন। কংগ্রেস সম্পর্কে তিনিও স্যার সৈয়দের অনুরূপ মত পোষণ করিতেন। তিনিও মুসলমান শিক্ষিত শ্রেণীকে কংগ্রেস হইতে দূরে রাখার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করিয়াছেন। মহসিন-উল-মুল্ক বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী লোক ছিলেন। (আমাদের মুক্তি সংগ্রামঃ বাংলা একাডেমী ঢাকা ১৯৭৮)
এহেনো নবাব মহসিন বড়লাট মিন্টোর সংগে সাক্ষাৎকারের জন্য মহামান্য আগা খানের পরামর্শে যে ৩৫ সদস্যের প্রতিনিধি দলের তালিকা প্রণয়ন করলেন, তাতে আশ্চর্যজনকভবে পাঞ্জাবের কবি আল্লামা ইকবাল, সিন্ধুর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (পরবর্তীতে পাকিস্তানের শ্রষ্টা) এবং বোম্বের বদরুদ্দীন তায়েবজীর (নবাব মহসিনের প্রচেষ্টায় ১৯০৩ সালে মোহামেডান এ্যাডুকেশনাল কনফারেন্সের সভাপতি) মতো ব্যক্তিবর্গের নাম অনুপস্থিত। যেসব মুসলিম নেতৃবৃন্দের নাম আলোচ্য সিমলা প্রতিনিধি দলের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলো, তাদের মধ্যে মহামান্য আগা খান, নবাব ইমদাদুর-মুল্ক, নবাব ভিকার-উল-মুল্ক মোস্তাক হোসেন, হেকিম আজমল খান, স্যার আলি ইমাম, স্যার মোজাম্মেল উল্লাহ খান, স্যার রফিকউদ্দিন আহমদ, স্যার সলিমুল্লাহ, স্যার মোহাম্মদ শফি, স্যার আবদুর রহিম, বিচারপতি শাহেদীন এবং নবাব মহসিন-উল-মুল্ক প্রমুখ অন্যতম অবশ্য প্রয়োজনমতো এঁদের পরামর্শ দেয়ার জন্য আরও বহুসংখ্যক নেতৃস্থানীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দকে ১৯০৬ সালের ১লা অক্টোবর সিমলায় উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিলো।
প্রাপ্ত নথিপত্রে দেখা যায় যে, বিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকে জাতীয় কংগ্রেসের সংস্কারপন্থী নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে গোপাল কৃষ্ণ গোখলে এবং রমেশ দত্ত প্রমুখরা ভারতীয় আইন সভায় অতঃপর মনোনয়নের পরিবর্তে সরাসরি নির্বাচনের দাবী জোরের সংগে উত্থাপন করলে উত্তর প্রদেশের সংখ্যালঘু মুসলিম অভিজাত সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কেননা সরাসরি যুক্ত নির্বাচনের ভিত্তিতে (পাঞ্জাব ও বংগীয় এলাকা ছাড়া) অন্ততঃ তাঁদের পক্ষে আইন সভায় আসন গ্রহণ সম্ভবপর হবে না। উপরন্তু তাঁদের মনে এ মর্মে আশংকা ছিলো যে, গোখলের সংগে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর মাত্রাতিরিক্ত দহরম-মহরম থাকায় এবং ইংল্যান্ডে ১৯০৬ সালের নির্বাচনে উদারনৈতিক দলের বিরাট সাফল্যের জের হিসেবে ইংরেজদের পক্ষে কংগ্রেসের সরাসরি নির্বাচনের দাবি মেনে নেয়া মোটেই বিচিত্র নয়। এজন্যই উত্তর প্রদেশের মুসলিম অভিজাত নেতৃবৃন্দ নিজেদের সম্প্রদায়গত স্বার্থ-সংরক্ষণের লক্ষ্যে একটি নতুন পথের সন্ধান করছিলো।
এ ধরনের এক প্রেক্ষিতে বড়লাট মিন্টোর সংগে সাক্ষাৎকারের আমন্ত্রণলিপি পাওয়ার পর মহামান্য আগা খানকে সম্মুখে রেখে উত্তর প্রদেশের অভিজাত মুসলমানদের নেতৃবৃন্দরা প্রতিটি সিদ্ধান্তের সময় অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করেন বলা যায়। উত্তর প্রদেশের নবাব ভিকার-উল-মুল্ক মোস্তাক হোসেন, নবাব ইমাদাদুল মুল্ক এবং নবাব মহসিন-উল-মুল্ক এই তিনজন মিলিতভাবে মুসলামানদের দাবী-দাওয়া সংক্রান্ত স্মারকলিপির খসড়া প্রণয়ন করেন। গবেষক প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে সিমলা প্রতিনিধি দলের মূল দাবিগুলো ছিলো নিম্নরূপ :
(ক) সরকারের সামরিক ও বেসামরিক ক্ষেত্রে মুসলমানদের অধিক সংখ্যায় নিয়োগ।
(খ) বিনা পরীক্ষায় উচ্চ পদগুলোতে মুসলমানদের নিয়োগ।
(গ) পৌরসভা ও জেলা পরিষদগুলোতে মুসলমানদের নিয়োগ সম্পর্কে প্রতিশ্রুতি।
(ঘ) প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় আইনসভাগুলোতে মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা।
(ঙ) একটি পৃথক মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি।
এতোসব কর্মকান্ডের প্রেক্ষিতে গবেষকদের মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন জাগরুক হওয়া স্বাভাবিক। প্রথমতঃ সিমলা প্রতিনিধি দলের অধিকাংশ সদস্যই শুধুমাত্র উত্তর ভারতীয় উর্দুভাষী এলাকা থেকে গ্রহণ করে পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতীয় অঞ্চলের আল্লামা ইকবাল, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং বদরুদ্দীন তায়েবজীর মতো ব্যক্তিত্বকে বাদ দেয়া হলো কেনো? দ্বিতীয়তঃ কেনো এই প্রতিনিধি দলে কোন শিক্ষিত ধর্মীয় নেতা ও ব্যবসায়ীকে অন্তর্ভুক্ত করা হলো না? তৃতীয়তঃ কেনোই বা বংগীয় এলাকার মুসলিম প্রতিনিধিকে দলভুক্ত করা হলো?
প্রখ্যাত গবেষক ডঃ তারাচাঁদ তাঁর রচিত ‘হিস্ট্রি অব দি ফ্রিডম মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া (৩য় খন্ড)’ গ্রন্থে এ মর্মে মন্তব্য করেছেন যে, সিমলা প্রতিনিধি দল ছিল উচ্চবিত্ত অভিজাতগোষ্ঠী ও বৃটিশ আমলাতন্ত্রের যৌথ প্রচেষ্টার ফলশ্রুতি। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে বলা যায় যে, ডঃ চাঁদের এই মন্তব্য অসুম্পূর্ণ। কেননা এই প্রতিনিধি দল শুধুমাত্র যে, ‘আলিগড় মতাদর্শের অনুসারী উত্তর ভারতীয় ভূস্বামী ও বিত্তশালী ‘খান্দানী’ সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলো তাই-ই নয়, এঁরা ছিলেন অতিমাত্রায় শ্রেণী-সচেতন ও গোষ্ঠীস্বার্থে নিবেদিত প্রাণ। এঁদের মনে তখন একটাই মাত্র প্রশ্ন যে, কিভাবে প্রস্তাবিত সিমলা বৈঠকের মারফত উত্তর ভারতীয় সংখ্যালঘু উর্দু ভাষাভাষী অভিজাত শ্রেণীর স্বার্থ-সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে। অবহেলিত মুসলিম জনগোষ্ঠী তো দূরের কথা, এঁরা মুসলিম ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের কথা পর্যন্ত চিন্তা করেননি। এজন্যই মূল উদ্দেশ্য (পূর্বে বর্ণিত ৫টি দাবী লক্ষ্যণীয়) ব্যাহত হতে পারে আশংকায় আলোচ্য প্রতিনিধি দলে যোগদানের জন্য পাঞ্জাবের আল্লামা ইকবাল, সিন্ধুর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং বোম্বের বদরুদ্দীন তায়েবজীর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতৃবৃন্দকে সেদিন আমন্ত্রণ পর্যন্ত জানানো হয়নি। এঁদের মনে ভয় ছিলো যে, ইকবাল-জিন্নাহ-তায়েবজীর মতো রাজনৈতিকসচেতন ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতৃবৃন্দকে আহবান জানালে বড়লাটের জন্য প্রণীত খসড়া প্রতিবেদনের চরিত্রগত পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়ে যেতে পারে।
অবশ্য এখানে যে কেউ-ই এ মর্মে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন যে, এই-ই যখন অবস্থা তখন বংগীয় এলাকার ক’জনা নেতা আলোচ্য প্রতিনিধি দলে অন্তর্ভুক্ত হলো কিভাবে? জবাবে শুধু এটুকু বললেই যথেষ্ট যে, সিমলা প্রতিনিধি দলের গুরুত্ব বৃদ্ধির জন্য এ সময় বাংলার মুসলমানদের সমর্থনের প্রয়োজন ছিলো সবচেয়ে বেশী। এখানে উল্লেখ্য যে, ভারত উপমহাদেশের বিগত প্রায় দুশ’ বছরের জনসংখ্যার আনুপাতিক হার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সব সময়েই উপমহাদেশের মোট মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশের আবাস এই বাংলায়। ১৯০৬ সালে উপমহাদেশের মোট ৬২ মিলিয়ন (প্রণব চট্টোপাধ্যায়কৃত আধুনিক ভারত’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য) মুসলমান জনসংখ্যার ১৮ মিলিয়নের বসবাস ছিলো নবগঠিত ‘পূর্ববংগ ও আসাম প্রদেশে। এজন্যই সেদিন সিমলা প্রতিনিধি দলে গুটি কয়েক বাঙালি মুসলমান নেতা অন্তর্ভুক্ত করে ১৮ মিলিয়ন বাঙালি মুসলমানের সমর্থনের প্রয়োজন ছিলো সবচেয়ে বেশী। বড়লাট মিন্টোর সংগে প্রস্তাবিত আলোচনাকালে প্ৰশ্ন উত্থাপিত হলে যাতে প্রতিনিধি দলের পক্ষে বলা সহজ হয় যে, বাঙালি মুসলমানরাও আমাদের সংগে রয়েছেন।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক ও মর্মান্তিক হলেও এখানে বলতে হচ্ছে যে, সেদিন উত্তর প্রদেশের মুসলিম অভিজাত সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ শ্রেণীগত স্বার্থে এতোই নিমগ্ন ছিলেন যে, তাঁরা বাঙালি মুসলমানদের স্বার্থের প্রতি মোটেই আমল পর্যন্ত দেননি। এক্ষণে সত্যের খাতিরে ইতিহাসের সেই চাঞ্চল্যকর ঘটনাবলীর অবতারণা করতে হচ্ছে।
এটা এমন একটা সময় যখন নবগঠিত ‘পূর্ববংগ ও আসাম প্রদেশ’ গঠনের প্রায় বছর খানেক সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, এটা এমন একটা সময় যখন কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী এবং পূর্ববাংলার হিন্দু জমিদার সম্প্রদায় বংগভংগ রদের লক্ষ্যে এক ‘মরণপণ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে; এটা এমন একটা সময় যখন বাঙালি বর্ণহিন্দু যুব সম্প্রদায় ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি উচ্চারণ করে কালীমাতার সম্মুখে শপথ গ্রহণের পর সন্ত্রাসবাদের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হচ্ছে এবং এটা এমন একটা সময় যখন বংগভংগের পক্ষে বাঙালি মুসলমানরা ছাড়াও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সমর্থনের ব্যাপারগুলো (গবেষক সতেন্ত্র নারায়ণ মজুমদারকৃত ‘ইন সার্চ অব এ রেভল্যুশনারী ইডলজী’ গ্রন্থের বক্তব্য “কিন্তু শুধু মুসলমান সম্প্রদায়ই স্বদেশী আন্দোলন থেকে দূরে ছিলেন তা নয়, পূর্ব বাংলার অধিকাংশ তফসিলী হিন্দুরাও বিশেষতঃ নমঃশূদ্র জাতি বংগভংগ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি বিরূপ ছিলেন, কারণ তাঁরা উচ্চবর্ণে হিন্দুদের শোষণে জর্জরিত ছিলেন এবং এই উচ্চবর্ণের উন্দুরাই স্বদেশী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।) পত্র-পত্রিকাগুলোতে পর্যন্ত প্রকাশিত হচ্ছিল না। ঠিক এমনি এক সময়ে বাঙালি মুসলমানদের নেতা নবাব সলিমুল্লাহ এবং নবাব আলী চৌধুরী গেলেন উত্তর প্রদেশের মুসলিম অভিজাত সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের সংগে আলাপ-আলোচনার জন্য।
নবাব সলিমুল্লাহ আর সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী বক্তব্য অত্যন্ত সহজ ও সরল। তাঁরা এ মর্মে বললেন যে, প্রস্তাবিত সিমলা বৈঠকের জন্য প্রণীত প্রতিবেদনে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের স্বার্থ-সংরক্ষণের লক্ষ্যে আইনসভাগুলোতে রিজার্ভ আসন তথা পৃথক নির্বাচন এবং সরকারী চাকরিতে মুসলমানদের কোটার প্রবর্তন ইত্যাকার ব্যাপারগুলো সমর্থনযোগ্য কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের সমস্যাগুলো কিছুটা ভিন্নতর। ভারতের অন্যান্য প্রদেশগুলোতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হলেও নবগঠিত “পূর্ববংগ ও আসাম প্রদেশে” বাঙালি মুসলমানরা সংখ্যালঘু নয়……. সংখ্যাগুরু (১২ মিলিয়ন হিন্দুঃ এক মিলিয়ন উপজাতিঃ ১৮ মিলিয়ন মুসলমান)। তাই নবগঠিত “পূর্ববংগ ও আসাম প্রদেশের” অধিকাংশ জনগোষ্ঠী অর্থাৎ বাঙালি মুসলমানদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হচ্ছে, কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণহিন্দু ও পূর্ব বাংলার বর্ণহিন্দু জমিদারদের মোকাবেলায় এই নবগঠিত প্রদেশের “স্থায়িত্বকরণ”। বড়লাট মিন্টোর সংগে প্রস্তাবিত বৈঠকের জন্য প্রণীত স্মারকলিপিতে ১৮ মিলিয়ন বাঙালি মুসলমানদের এই প্রাণের দাবীকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সলিমুল্লাহ ও নবাব আলী চৌধুরী বহু প্রচেষ্টা করেও সফল হতে পারলেন না।
অবস্থাদৃষ্টে একথা বলা যায় যে, এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির ক্ষেত্রে আরও গবেষণা হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সে আমলের প্রকৃত ঘটনা প্রবাহের মূল্যায়নের লক্ষ্যে আমাদের জানা দরকার যে, শুধুমাত্র উত্তর প্রদেশ তথা উত্তর ভারতীয় উর্দু ভাষাভাষী সংখ্যালঘু অবাঙ্গালী মুসলমানদের সম্প্রদায়গত ও গোষ্ঠীস্বার্থে বংগীয় এলাকার বিশেষ করে নবগঠিত পূর্ববংগ ও আসাম প্রদেশ—’এর বিশাল বাঙ্গালী মুসলমান জনগোষ্ঠীর সমর্থন আদায় করে কেমন করে তা ব্যবহার করা হয়েছিলো। কথাটা আরও সোজাসুজিভাবে বললে বলতে হয় যে, উপমহাদেশের ইতিহাসে যখন এক সংকটপূর্ণ অবস্থা বিরাজমান ছিলো, ঠিক তখন আলোচ্য অবাঙ্গালী মুসলিম নেতৃবৃন্দ গার্জিয়ান-এর ভূমিকা গ্রহণ করেও কিভাবে পূর্ববংগ ও আসাম প্রদেশের সংখ্যাগুরু বাঙ্গালী মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অর্থাৎ নবগঠিত প্রদেশের স্থায়িত্বকরণ-এর প্রশ্নটি জলাঞ্জলী দিয়েছিলো, তার বিস্তারিত তথ্য অবশ্যই জানতে হবে। এ বিষয়ে পশ্চিম বাংলার গবেষক প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় যে মন্তব্য করেছেন তার উল্লেখ সমীচীন হবে। তিনি লিখেছেন, “এই প্রসংগে উল্লেখযোগ্য বাঙ্গালী মুসলমান নেতৃবৃন্দ বিশেষত ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ ও সৈয়দ নবাব আলি চৌধুরী এই দাবিপত্রে (বড়লাটের জন্য প্রণীত স্মারকলিপি) বংগভংগের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আগা খাঁর বিরোধিতায় তা সম্ভব হয়নি” (আধুনকি ভারতঃ ১ম খণ্ডঃ পঃ বংগ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ : কলিকাতা ১৯৮৩)
তাই একটি কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, মহামান্য আগা খার নেতৃত্বে ৩৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল ১৯০৬ সালের ১লা অক্টোবর ভারতের ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর সংগে সিমলায় সাক্ষাৎ করে সংখ্যালঘু মুসলমানদের দাবী-দাওয়া সম্পর্কিত যে স্মারকলিপি পেশ করেছিলো, তাতে বংগীয় এলাকার সংখ্যাগুরু বাঙ্গালী মুসলমানদের মূল দাবী ‘পূর্ববংগ ও আসাম’ প্রদেশের স্থায়িত্বকরণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিলো না এবং এটাই হচ্ছে ঐতিহাসিক সত্য। তবে এই বৈঠকে লর্ড মিন্টো কর্তৃক প্রতিনিধি দলের উত্থাপিত প্রস্তাবগুলো সহানুভূতির সংগে বিবেচনার আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি প্রদানের ফলে ভারতীয় মুসলমানদের জন্য অন্ততঃ দু’টি বিষয়ে সাফল্য অর্জিত হয়। প্রথমতঃ বৃটিশ সরকার এই প্রতিনিধি দলকেই ভারতীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতিভু বলে স্বীকৃতিদান করলেন। দ্বিতীয়তঃ মুসলমানদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদানের আশ্বাস ও সম্প্রদায়গত নির্বাচনের নীতি গ্রহণ করার ফলে স্বভাবতই মুসলামানদেরকে ভারতে একটি স্বতন্ত্র জাতির মর্যাদা দেয়া হলো। সবার অলক্ষ্যেই এর ফল হলো সুদূরপ্রসারী।
পরবর্তীকালে অর্থাৎ প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকে এ ব্যাপারে কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙ্গালী বর্ণহিন্দু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবী মহল তীব্র ভাষায় বহু বাদানুবাদ করলেও সমসাময়িককালে এঁদের মধ্যে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো, তা’ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রথমতঃ অধিকাংশ নেতা বংগভংগ রদ সম্পর্কিত আন্দোলনে ব্যস্ত থাকায় বিষয়টিকে বিশেষ আমলই দেয়নি। সে আমলে বাঙ্গালী বর্ণহিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত দু’টি বিশিষ্ট দৈনিক পত্রিকা যথাক্রমে ‘এ্যাডভোকেট’, ও ‘হিন্দুস্থান রিভিউ’-এ সিমলা বৈঠকের ফলাফলে আনন্দ প্রকাশ করা হয়। আগা খা’র নেতৃত্বে মুসলিম প্রতিনিধি দল বড়লাটের কাছে যে স্মারকলিপি প্রদান করেছিলো, তার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হলে যখন দেখা গেলো যে এসব দাবী-দাওয়ার মধ্যে নবগঠিত ‘পূর্ববংগ ও আসাম প্রদেশ-এর “স্থায়িত্বকরণ”-এর প্রশ্নটি অনুপস্থিত, তখনই কোলকাতার প্রভাবশালী বাঙ্গালী বর্ণহিন্দু মহলে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। এঁদের মনে এ মর্মে আশার আলো দেখা দিল যে, তা’হলে আন্দোলন চালিয়ে গেলে বংগভংগ রদ সম্ভব হবে এবং সেক্ষেত্রে অন্যান্য সুবিধা ছাড়াও পূর্ব বাংলার জমিদারীগুলোতে আবার সরাসরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। তৎকালীন কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দের মধ্যে রমেশচন্দ্র দত্ত— এমনকি মারাঠী চীৎ ভবন ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ভুক্ত গোপাল কৃষ্ণ গোখলেও সিমলা বৈঠকের ফলাফলকে অভিনন্দিত করে। অন্যদিকে স্বভাবিকভাবেই ‘লণ্ডন টাইমস্’ পত্রিকা তার সম্পদাকীয় নিবন্ধে (১লা অক্টোবর ১৯০৬) সিমলা বৈঠকের সাফল্য কামনা করে। কেবলমাত্র বৃহত্তর রাজনীতি সম্পকের্র সচেতন কোলকাতার “অমৃতবাজার পত্রিকা” ১৯০৬ সালের ৪ঠা অক্টোবরে প্রকাশিত এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে তীব্র ভাষায় সিমলা বৈঠকের সমালোচনা করে। এখানে আরও লক্ষণীয় যে, কংগ্রেসের মধ্যপন্থী নেতৃবৃন্দ এসময় নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বমূলক আইনসভা গঠনের দাবীর প্রশেখএতোই নিমগ্ন ছিলেন যে তাঁরা তখন সিমলা বৈঠকের সুদূরপ্রসারী ফলাফল সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন বলে মনে হয় না। এ জন্যই ১৯০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে কোলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন (সভাপতি দাদাভাই নওরোজী) অনুষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও এই অধিবেশনে আশ্চর্যজকভাবে সিমলা বৈঠকের কোন উল্লেখ ছিলো না।
অন্যদিকে বিশেষ করে উত্তর ভারতীয় উর্দু ভাষাভাষী মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যে আলীগড় বৈঠকের শুভ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলো। তাঁরা একটা বিষয় নিশ্চিতভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হলেন যে, অতঃপর উত্তর ভারতীয় সংখ্যালঘু মুসলিম অভিজাত সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষা সম্ভব হবে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে অধিকারগুলোকে সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে এখন সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন একটি সর্বভারত ভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। কেবলমাত্র এ ধরনের একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই আলোচ্য স্বার্থ রক্ষার জন্য অতন্দ্রপ্রহরীর মতো দায়িত্ব পালন করতে পারবে।
আগা খাঁন ডেপুটেশনের অন্যতম সদস্য নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নবগঠিত ‘পূর্ববংগ ও আসাম প্রদেশ’-এর রাজধানী ঢাকা নগরীতে ১৯০৬ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ‘মোহামেডান এ্যাডুকেশন্যাল কনফারেন্স’-এর বার্ষিক সম্মেলন আহবান করলে পরিস্থিতি ‘আলীগড় চিন্তাধারার অনুসারিদের পক্ষে প্রবাহিত হয় বলা যায়। গবেষক মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ বর্ণিত উত্তর প্রদেশের “বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী” ব্যক্তিত্ব নবাব মহসিন-উল-মুলক্ এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করলেন না। মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনের শেষদিন অর্থাৎ ১৯০৬ সালের ৩০শে ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকার শাহবাগের নবাবদের বাগান বাড়ীতে বিকেলের চা-নাস্তার সময় ভারতীয় মুসলিম লীগের জন্ম হয়। গবেষক ও সাংবাদিক মরহুম মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ এ সম্পর্কে লিখেছেন, “অধিবেশনের শেষে একটি ঘরোয়া বৈঠকে মহসিন-উল-মুকের প্রসাবক্রমে (সমর্থক-হেকিম আজমল খাঁ) বহু প্রতিক্ষীত মুসলিম লীগ জন্ম লাভ করে। এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন নওয়ার ভিকার-উল-মুল্ক। ইহার গঠনতন্ত্র রচনার ভার অর্পিত হয় তাঁহার (মহসিন-উল-মুল্ক) ও নওয়াব ভিকার-উল-মুল্ক-এর উপর। (আমাদের মুক্তি সংগ্রামঃ পৃষ্ঠা ১৭৪: বাংলা একাডেমী ঢাকা, ১৯৭৮)।
এখানে দু’টি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রথমতঃ শুরু থেকেই ‘মুসলিমু লীগ’ নামের এই প্রতিষ্ঠানের একটি সর্বভারতীয় চরিত্র দেয়ার লক্ষ্যে ১৮ মিলিয়ন বাঙ্গালী মুসলমান অধ্যুষিত ‘পূর্ববংগ ও আসাম’ প্রদেশ-এর রাজধানী ঢাকায় এর জন্ম হওয়ার প্রয়োজীয়তা (ঢাকা সম্মেলনেও ইকবাল-জিন্নাহ-তায়েবজীকে আমন্ত্রণ করা হয়নি) ছিলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য যে, এর পরবর্তী ৪১ বছর অর্থাৎ ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ঢাকায় নিখিল ভারত মুসলিম লীগের আর কোন অধিবেশন আহবান করা হয়নি। দ্বিতীয়তঃ ঢাকায় এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম হলেও শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘মুসলিম লীগ’-এর নাম ও চারটি উদ্দেশ্য ঘোষণা এবং পরবর্তী বৎসরে অধিবেশন করাচীতে অনুষ্ঠিত হবে— এই সিদ্ধান্তটুকু ছাড়া ঢাকায় আর কিছুই হয়নি।
এ প্রসংগে মুসলিম লীগের ঘোষিত চারটি মূল লক্ষ্যের উল্লেখ করা হলো :–
(ক) বৃটিশ সরকারের প্রতি ভারতের মুসলমানদের আনুগত্য সুনিশ্চত করা এবং সরকারী বিধি ব্যবস্থা সম্পর্কে মুসলমানদের মনে কোনরূপ সন্দেহ সৃষ্টি না হতে দেয়া।
(খ) মুসলমানদের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা এবং মুসলমানদের মনে কোনরূপ সন্দেহ সৃষ্টি না হতে দেয়া।
(গ) জাতীয় কংগ্রেসের প্রভাব-প্রতিপত্তি খর্ব করা।
(ঘ) উপরোক্ত উদ্দেশ্যগুলো কোন অবস্থাতেই ক্ষুণ্ণ না করে ভারতের অন্যান্য সম্প্রদায়ের সংগে মৈত্রী বজায় রাখা। ভারতের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক মিত্রতা সম্ভব— কিন্তু রাজনৈতিক মিত্রতা স্থাপন সম্ভব নয়।
১৯০৬ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের জন্ম হওয়ার পর থেকে এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম ছয় বছরের কর্মকাণ্ডের সমীক্ষা করলে বিস্মিত হতে হয় বৈকী। ১৯০৭ সালে নবাব মহসিন-উল-মুল্কের মৃত্যু হলে নবাব ভিকার-উল-মুল্ক একাকীই মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানের গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। স্যার পীর ভাই-এর সভাপতিত্বে করাচীতে ১৯০৭ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ সম্মেলনে এ মর্মে এক “অদ্ভুত” সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, পরবর্তী ছয় বছর অর্থাৎ ১৯১২ সাল পর্যন্ত মহামান্য আগা খান এই প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। অবশ্য আগা খান দেশের বাইরে থাকলে কিংবা অনুপস্থিত থাকলে অন্য কেউ বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব কররেন।
তাহলে একথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, উত্তর প্রদেশ তথা উত্তর ভারতীয় সংখ্যালঘু অভিজাত অবাঙ্গালী মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সিমলা বৈঠকে ভাইসরয় লর্ড মিন্টো যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেসব আইনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকতা লাভ না করা পর্যন্ত ‘আলীগড় আন্দোলনের’ অনুসারীরা মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানের দ্বার সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করতে রাজী ছিলেন না এবং এ জন্যই অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করে এঁরা এঁদের গার্জিয়ান মহামান্য আগা খানকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত ছয় বছরের জন্য স্থায়ী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছিলেন। এ সময় মুসলিম লীগের প্রধান কার্যালয় প্রথমদিকে আলীগড়ে ও পরে লক্ষ্ণৌতে অবস্থিত ছিলো।
বাংলাদেশের গবেষক মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ্র মতে, “দীর্ঘ ছয় বছর এরূপে লীগ অল্প কয়েক ব্যকিখপকেট প্রতিষ্ঠান হিসাবেই বিরাজ করে। মওলানা মোহাম্মদ আলীই ইহাকে কোটারীমুক্ত করিয়া ১৯১২ সালে ইহার দ্বার জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করিয়া দেন।”
পশ্চিম বাংলার কংগ্রেসী মনোভাবাপন্ন গবেষক প্রণব কুমার চ্যাটার্জীর এতদসম্পর্কিত কটাক্ষপূর্ণ বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি লিখেছেন, “মুসলিম লীগের প্রতি অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান সংবাদপত্রগুলিতে সমর্থন জানানো হয়। ইংলিশম্যান (স্টেটসম্যান) ও টাইমস অফ ইণ্ডিয়া পত্রিকায় ব্রিটিশ শাসনের প্রতি মুসলিম লীগের আনুগত্য ও নির্ভরশীলতায় আনন্দ প্রকাশ করা হয়। নতুন দলটি ভারতে শান্তি রক্ষা করতে পারবে কিনা, এই বিষয়ে লণ্ডনের টাইমস্ পত্রিকা সংশয় প্রকাশ করে। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী এই সঙ্ঘের সঠিক তাৎপর্য বুঝতে পারেননি। ব্রিটিশ বিরোধী মুসলমান উলেমা সম্প্রদায়ও এই সংগঠনের গুরুত্ব বোঝেননি। মুসলিগ লীগ মুসলমান সমাজের স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্রিটিশ সরকারের প্রতি যে আনুগত্যের নীতি গ্রহণ করেন এবং ব্রিটিশ সরকার নিজ স্বার্থ রক্ষার জন্য যে সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির সূচনা করলেন তার ফলে কংগ্রেস পরিচালিত ঐক্যবদ্ধ? ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের পথে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হল। কংগ্রেসের চরমপন্থী দলের প্রভাব ক্ষুণ্ণ করার উদ্দেশ্যে, নরমপন্থী দলের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্যও মুসলমান সম্প্রদায়ের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য ১৯০৯ খৃষ্টাব্দে মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন প্রবর্তিত হয়। এই সংস্কার আইনে মুসলমান সম্প্রদায়কে আইন সভায় পৃথকভাবে সদস্য নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়। সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের নীতি গ্রহণ করে ইংরেজ সরকার হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যবধান ও বিদ্বেষ গড়ে তুলতে সহায়তা করলেন। …….এইভাবে ১৯০৯ খৃষ্টাব্দের মর্লে-মিন্টো আইনে যে “দুই জাতি তত্ত্বের” বীজ বপন করা হল, তারই অনিবার্য ফলশ্রুতি হল ভারত বিভাগ (১৯৪৭)।”
সামগ্রিকভাবে সমসাময়িককালের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, গবেষক প্রণব চ্যাটার্জী তাঁর বক্তব্যে বহুলাংশে সত্যের অপলাপ করেছেন। আলোচ্য সময়ে কিছুদিন পর্যন্ত উত্তপ্ত স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার পর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বীয় অভিজ্ঞতার আলোকে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন তাতে সম্পূর্ণ ভিন্ন সুর সোচ্চার হয়েছে। গভীর লজ্জা ও বেদনাপীড়িত হৃদয়ে বিশ্ব কবি লিখেছেন, “মুসলমানকে যে হিন্দুর বিরুদ্ধে লাগানো যাইতে পারে এই তথ্যটাই ভাবিয়া দেখিবার বিষয়, কে লাগাইল সেটা তত গুরুতর বিষয় নয়। শনি তো ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না। অতএব, শনির ছিদ্র সম্বন্ধেই সাবধান হইতে হইবে। …….কেননা, আমি এই বলি, দেশকে সাদাভাবে, সত্যভাবে দেশ বলেই জেনে, মানুষকে মানুষ বলেই শ্রদ্ধা করে, যারা তার সেবা করতে উৎসাহ পায় না— চীৎকার করে মা ব’লে, দেবী বলে মন্ত্র পড়ে যাদের কেবলই সম্মোহনের দরকার হয়— তাদের সেই ভালোবাসা দেশের প্রতি তেমন নয় যেমন নেশার প্রতি। সত্যেরও উপরে কোনো একটা মোহকে প্রবল করে রাখবার চেষ্টা, এ আমাদের মজ্জাগত দাসত্বের লক্ষণ।” (রবীন্দ্রনাথ/রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বঃ ডঃ অরবিন্দ পোদ্দারঃ কলিকাতা ১৯৮২)
ইংরেজ ভারতে যখন এ ধরনের এক উত্তপ্ত পরিবেশ বিদ্যমান এবং যখন ‘আব্দার-অভিমান-আবেদনের’ শতাব্দী অতিক্রম করে বাঙ্গালী বর্ণহিন্দু আর মারাঠী, ব্রাহ্মণ যুবকরা সন্ত্রাসের পথ অবলম্বন করেছে; ঠিক তখনই অর্থাৎ ১৯০৯ সালে মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন প্রবর্তিত হলো। ১৯০৬ সালে মহামান্য আগা খা-এর নেতৃত্বে উত্তর ভারতীয় অবাঙ্গালী মুসলিম অভিজাত সম্প্রদায়ের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে যে প্রতিনিধি দল ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর সঙ্গে সাক্ষাত করে ৫ দফা দাবী করেছিলেন, অবশেষে ১৯০৯ সালে তা’ আইন সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতা লাভ করলো। পূর্ববঙ্গীয় মুসলিম জনগোষ্ঠীর এ সময়কার রাজনৈতিক চিন্তাধারা দুর্বল থাকা সত্ত্বেও এরা কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে মর্লে-মিন্টোর সংস্কার আইন গ্রহণ করে নিলো। কিন্তু এঁদের মনে তখন বিরাট প্রশ্ন— নবগঠিত ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ’-এর স্থায়িত্বকরণের বিষয়টি সিমলা ডেপুটেশনের স্মারকলিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি কেনো? উপরন্তু ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশে’ বাঙ্গালী মুসলমানরা তো সংখ্যালঘু নয়— সংখ্যাগুরু। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, ১৯০৯ সালে মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের মাধ্যমে ‘আলীগড় চিন্তাধারা’র বিজয় সূচিত হওয়ার পর থেকে বেশ কিছুদিনের জন্য উত্তর ভারতীয় মুসলিম অভিজাত সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারণের লক্ষ্যে উদ্যম হারিয়ে ফেলে। কেননা এতোদিন পর্যন্ত গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধারের জন্য উত্তর প্রদেশের অভিজাত মুসলিম নেতৃবৃন্দের জন্য ‘মুসলিম লীগ’ নামের প্রতিষ্ঠানটির গুরুত্ব ছিলো সর্বাধিক। এক্ষণে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মুসলিম নেতৃবৃন্দ এই প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব গ্রহণে অগ্রসর হলে তা নিশ্চিতভাবে গ্রহণযোগ্য হতে আর বাধা থাকার কথা নয়।
এ সম্পর্কে গবেষক ডঃ শীলা সেন-এর মূল্যায়ন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি লিখেছেন, “পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ এক জটিল সমস্যার সম্মুখীন হলেন। সৈয়দ আহমদ প্রবর্তিত হিন্দু বিরোধী ও ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আনুগত্যের নীতি বহাল রাখা সম্ভব হল না। ঢাকার নবাব, আগা খা প্রমুখ নেতৃবৃন্দ মুসলিম লীগ থেকে সরে এলেন এবং জাতীয়তাবাদী মনোভাবাপন্ন তরুণ মুসলমান নেতারা মুসলিম লীগে যোগদান করলেন। শীঘ্রই মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, মহম্মদ আলী প্রমুখ নেতারা মুসলিম লীগ রাজনীতিতে অবতীর্ণ হলেন; এছাড়া ব্রিটিশ বিরোধী উলেমা সম্প্রদায় মুসলমান রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারে সমর্থ হলেন। এইভাবে ক্রমশঃ মুসলিম লীগে নেতৃত্ব ও সংগঠনের চরিত্রে পরিবর্তন দেখা গেল, মুসলিম লীগে উচ্চ অভিজাত সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের অবসান হল এবং সাংগঠনিক ভিত্তি আরও সম্প্রসারিত হল। (মুসলিম পলিটিক্স ইন বেংগল : দিল্লী ১৯৭৬)
তাহলে ডঃ শীলা সেন বর্ণিত কোন্ প্রেক্ষিতে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ এবং মহামান্য আগা খা’র মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আগ্রহ বিলুপ্ত হয়, সে সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা সমীচীন মনে হয়
আগেই উল্লেখ করেছি যে, সিমলা প্রতিনিধি দলের প্রণীত স্মারকলিপিতে নবগঠিত ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ’-এর স্থায়িত্বকরণের বিষয়টির অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হওয়ায় নবাব সলিমুল্লাহ অত্যন্ত মনক্ষুণ্ণ এবং নিগৃহীত বাঙ্গালী মুসলমানদের ভবিষ্যত সম্পর্কে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। এমনকি এ কথাও বলা অন্যায় হবে না যে, তিনি নবগঠিত ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ’-এর ভবিষ্যত সম্পর্কে খুব একটা নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। তিনি ভেবেছিলেন যে, ঢাকায় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হওয়ায় অন্ততঃ এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নবগঠিত প্রদেশের স্থায়িত্বকরণের প্রশ্নে ব্যাপক সাড়া জাগানো সম্ভব হবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেলো যে, ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী যখন সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে আইন সভায় সদস্য নির্বাচনের চিন্তা-ভাবনা করছে, ঠিক তখনই উত্তর ভারতীয় অভিজাত শ্রেণীর মুসলিম নেতৃবৃন্দ প্রতিষ্ঠানটি কুক্ষিগত করে নিজেদের সম্প্রদায়গত স্বার্থে ‘প্লাটফর্ম’ হিসেবে ব্যবহার করছে।
এ ধরনের এক চাঞ্চল্যকর প্রেক্ষাপটে ১৯০৯ সাল নাগাদ মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ’-এর স্থায়িত্বকরণ সম্পর্কিত বিষয় অনুপস্থিত থাকায় বর্ণহিন্দু বাঙ্গালীদের নেতৃত্বে দ্বিতীয় দফায় দারুণ উৎসাহ বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলন শুরু হয়। আশ্চর্যজনক হলেও বলতে হয় যে, এ সময় ইংরেজ ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মুসলিম সম্প্রদায় তেমন উল্লেখযোগ্যভাবে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ’-এর সংখ্যাগুরু বাঙ্গালী মুসলমানদের সমর্থনে এগিয়ে আসেননি বা সক্রিয় সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারিত করেননি।
এই পরিস্থিতিতে ভারতে নয়া ভাইসরয়ের আগমন হলো। লর্ড মিন্টোর স্থলে ১৯১০ সালে বড়লাটের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন লর্ড চার্লস হার্ডিঞ্জ ১৮৫৮-১৯৪৪। ইনি পেশায় ছিলেন একজন কূটনীতিবিদ এবং উদারনৈতিক দলের সমর্থক। হার্ডিঞ্জের সংগে অচিরেই মধ্যপন্থী কংগ্রেসী মারাঠা নেতা গোখলের প্রকাশ্য-বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়। এমনকি লর্ড হার্ডিঞ্জ এ সময় স্বীয় ব্যক্তিগত প্রতিনিধি হিসেবে গোখলেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠিয়েছিলেন। এ সময় দক্ষিণ আফ্রিকায় তরুণ ভারতীয় নেতা গান্ধীর নেতৃত্বে যে আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছিলো, ইংরেজদের সঙ্গে তার একটা সমঝোতা করার লক্ষ্যেই সেদিন “ইসলিংটন” মিশনের অন্যতম সদস্য হিসেবে গোখলে মনোনীত হয়েছিলেন। প্রখ্যাত ইংরেজ গবেষক পারসিভিয়াল স্পিয়ার-এর মতে, কংগ্রেস-ভারত সরকারের এই ‘মধু-চন্দ্রিমা’ পরবর্তী প্রায় ৫ বছর অর্থাৎ প্রথম মহাযুদ্ধের শুরু পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো।
অন্যদিকে জাতীয় কংগ্রেস সমর্থক বড়লাট হার্ডিঞ্জ ১৯১০ সালের ১০ই নভেম্বর বঙ্গভঙ্গ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার সুপারিশ করে লণ্ডনে একটি গোপনীয় চিঠি লিখলেন তৎকালীন ভারত সচিবকে। এরপর সবকিছু গোপনে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯১১ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গভঙ্গ রদের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হলেও দিল্লীতে রাজধানী স্থানান্তরের কথা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কেউ জানতেই পারেনি।
কারণ একটাই এবং তা হচ্ছে এই যে, ভারত সরকার তখন দিল্লীতে আকস্মিকভাবে রাজধানী স্থানান্তরের প্রশ্নে কোলকাতায় বসবাসকারী ইংরেজ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের সাম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার জন্য আতংকিত ছিলো।
এদিকে উপমহাদেশে দ্রুত রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহ ‘হতভম্ব’ হয়ে পড়েন এবং মুসলিম লীগ সম্পর্কে তাঁর সমস্ত আস্থা বিনষ্ট হয় ও ‘নিজ হাতে গড়া’ এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি আগ্রহের বিলুপ্তি ঘটে। এমনকি নবাব সলিমুল্লাহ ক্ষোভে ও দুঃখে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর ‘দিল্লী দরবার’ চলাকালীন সময়ে তা পরিত্যাগ করেছিলেন। এজন্য একথা বলা যায় যে, সেদিন সর্বক্ষেত্রে পশ্চাদপদ বাঙ্গালী মুসলমানদের জন্য মুসলিম লীগ কোনরকম অর্থবহ পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হওয়ায় যেখানে মুসলিম লীগের প্রতি নবাব সলিমুল্লাহর আগ্রহের সমাপ্তি ঘটেছিলো; সেখানে মুসলিম লীগ থেকে মহামান্য আগা খা’র সরে পড়ার কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। উত্তর প্রদেশের অবাঙ্গালী মুসলিম অভিজাত শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থার লক্ষ্যে যে আগা খা একদিন সিমলা ডেপুটেশনের নেতৃত্বদান করেছিলেন, ১৯০৯ সালে মর্লে-মিন্টো সংক্রার আইনে সেই উদ্দেশ্য সফল হওয়ায় আগা খা মুসলিম লীগের সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন। আবারও বলতে হচ্ছে যে, ‘আলীগড় ডেপুটেশনে’র কাছে পূর্বে বর্ণিত ৫ দফা দাবীই ছিলো মুখ্য এবং তাঁদের মানস-হৃদয়ে বাঙ্গালী মুসলমানদের প্রাণের দাবী ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ”-এর “স্থায়িত্বকরণের” দাবীর কোন স্থান ছিলো না। এটাই হচ্ছে ঐতিহাসিক সত্য।
পাঠকবৃন্দ, এক্ষণে অত্র পুস্তকে বর্ণিত চাঞ্চল্যকর ঘটনাবলী ও নানাবিধ কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষিতে বিংশ শতাব্দীর শেষপাদে এসে এ মর্মে একটা সমীক্ষার প্রয়োজন যে, নিম্নে বর্ণিত সম্প্রদায়ের হিসেবে কারা বেশী লাভবান হলো?
ক. উত্তর ভারতীয় অবাঙ্গালী মুসলিম সম্প্রদায়।
খ. পূর্ব বঙ্গীয় এলাকার অবহেলিত মুসলমান জনগোষ্ঠী এবং
গ. কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবী ও বিত্তশালীদের নেতৃত্বের মানব-গোষ্ঠী।
উত্তর ভারতীয় অবাঙ্গালী মুসলিম সম্প্রদায়
বঙ্গীয় এলাকার সংখ্যাগুরু ও সর্বক্ষেত্রে পশ্চাদপদ বাঙ্গালী মুসলমানদের দাবীর প্রতি সামান্যতম সহযোগিতা না করে ১৯০৯ সালে মর্লে-মিন্টোর সংস্কার আইনের মাধ্যমে এরা যে সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিয়েছিলো, মাত্র ৩৮ বছরের মাথায় ১৯৪৭ সালের আগস্টে তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। স্বাধীন ভারতে এঁদের কোন ‘রক্ষাকবচ’ নেই। গণতন্ত্রের মৌলিক আদর্শের বাস্তবায়নের মোকাবিলায় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এঁদের জীবন এখন অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকদের মতোই সংগ্রামবহুল।
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান অর্জিত হবার প্রাক্কালে উত্তর ভারতীয় এলাকা থেকে যেসব মুসলমানরা তৎকালীন পাকিস্তানে ‘হিজরত’ করে ‘শরাফত’ ও ‘খান্দানী’র দাপট প্রদর্শন করেছিলো, ১৯৫১ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান আততায়ীর হাতে নিহত হলে এদের প্রভাব দ্রুত হ্রাস পেতে শুরু করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে তৎকালীন পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর গণ-হত্যার মোকাবিলায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এদের অধিকাংশই সেই হানাদার বাহিনীর মদদ জুগিয়েছিলো। ফলে একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর এঁরা বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে। বাংলাদেশে আজ ‘শরাফত’ আর ‘খান্দানীর মিথ্যা গর্ব ও অহমিকার স্থান পর্যন্ত অবশিষ্ট নেই।
অন্যদিকে পাকিস্তানে (প্রাক-একাত্তরের পশ্চিম পাকিস্তান) এঁরা এক নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করছে। একমাত্র করাচী শহর ছাড়া আর কোথাও এঁদের জন্য কোন স্থান নেই। এমনকি সেই করাচীতেও অহরহ দাংগা সংগঠিত হচ্ছে। সবই নিয়তির বিধান হিসেবে মেনে নেয়া ছাড়া এঁদের কোন গত্যন্তর নেই।
পূর্ব বঙ্গীয় এলাকার অবহেলিত মুসলমান জনগোষ্ঠী
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা পরাজিত হবার পর থেকে ১৭৬৩ সালে গিরিয়ার যুদ্ধে নবাব মীর কাসিমের পরাজয় পর্যন্ত মাত্র ৬ বছর সময়কালের মধ্যে নবাবদের বিশাল সেনাবাহিনী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে সেনাবাহিনীর জীবিত পদস্থ সামরিক কর্মচারী ছাড়াও বহু মুসলমান বেসামরিক কর্মচারীরা বঙ্গীয় এলাকা পরিত্যাগ করে। অতঃপর একদিকে কোলকাতা নগরীর সমৃদ্ধি এবং অন্যদিকে মুর্শিদাবাদ ও ঢাকা নগরীর গুরুত্ব দ্রুত হ্রাস পাওয়ায় বহু বিত্তশালী মুসলিম পরিবার স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে উত্তর ভারতীয় এলাকায় গমন করে। ১৭৯৩ সালে চীরস্থায়ী জমিদারী বন্দোবস্ত ও ১৮৪২ সাল নাগাদ ফার্সীর পরিবর্তে অফিস-আদালতে ইংরেজী ভাষা চালু এবং পরবর্তীতে লাখেরাজ সম্পত্তির দলিল প্রদর্শন সম্পর্কিত নির্দেশ জারি হওয়ার প্রেক্ষিতে বঙ্গীয় এলাকার মুসলিম মধ্যবিত্ত ও বিত্তশালী সম্প্রদায় হয় দেশত্যাগ, নাহয় নিঃস্ব হয়ে পড়ে। ফলে বিশাল বাঙ্গালী মুসলিম জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বদানকারী মধ্যবিত্ত শ্রেণী প্রায় সম্পূর্ণভাবে “অদৃশ্য” হয়ে যায়। এটাই ছিলো বাঙ্গালী মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে “দুঃসময়।” এসময় বাঙ্গালী মুসলিম সম্প্রদায়ের বুক থেকে নেতৃত্বদানকারী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অবলুপ্তি হওয়ার নানা ধরনের কুসংস্কার এই জনগোষ্ঠীকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
অবশেষে ওয়াহাবী আন্দোলনের পরিসমাপ্তিতে ১৮৭১ খৃষ্টাব্দে মওলানা কেরামত আলী জৌনপুরী ইংরেজ শাসিত এলাকাকে দারুল ইসলাম বলে ঘোষণা করলে সত্যিকার অর্থে বাঙ্গালী মুসলমানরা ইংরেজী শিখতে শুরু করে এবং এখান থেকেই নতুনভাবে বাঙ্গালী মুসলিম মধ্যবিত্তের যাত্রা শুরু। এরপর ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ৭৬ বছরের মধ্যে বাঙ্গালী মুসলমানরা আর কোন গোপন, সন্ত্রাস কিংবা রাজপথের আন্দোলন করেনি। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, আদিতে বাঙ্গালী এবং ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান— এই বিশাল মানবগোষ্ঠীকে ইংরেজরা শাসন ও শোষণ করেছে; কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী ও হিন্দু জমিদাররা ঘৃণা-অবহেলা-শোষণ করেছে এবং উত্তর ভারতী অবাঙ্গালী মুসলিম অভিজাত শ্রেণী এঁদের ‘প্রতারিত’ ও ‘ধোকা দিয়েছে।
কিন্তু সময়ের দুরত্বে ১৮৭১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ঘটনাবহুল একশত বছর অতিক্রান্ত হবার পর আমরা দেখতে পাই যে, পৃথিবীর বৃহত্তম বঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকার বঞ্চিত ও অবহেলিত বিশাল বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী স্বাধীন ও সার্বভৌম হয়েছে। একটা নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় এঁরা শুধু স্বাধীন ও সার্বভৌম তাই-ই নয়, এঁদের রক্তবলয় খচিত নিজস্ব জাতীয় পতাকা ছাড়াও এঁদের রাষ্ট্র ভাষা হচ্ছে হাজার বছরের ঐতিহ্য বহনকারী বাংলা ভাষা। সমগ্র বিশ্বে একমাত্র বাংলাদেশের রাষ্ট্র ভাষা হচ্ছে বাংলা। তবে আজ সগর্বে বলতে চাই যে, বাংলা ভাষা, বাংলা লোকাচার আর বাংলা সংস্কৃতি-সভ্যতা সবকিছুর গার্জিয়ান আমরাই। আমরাই হচ্ছি বাংলাদেশের প্রায় ১০ কোটি আদি ও অকৃত্রিম সন্তান— বাংলাদেশের বাঙ্গালী এবং আমাদের অধিকাংশ ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান। নদী-বিধৌত এই বাংলায় বাঙ্গালীত্ব সুফী-দর্শনের অপরূপ মিশ্রণ হয়েছে। বিশ্বের ইতিহাসে এ ধরনের বিবর্তন বিরল।
এ জন্যই আমরা ইতিহাসের ঘটনা প্রবাহে অত্র এলাকায় চাঞ্চল্যকর বিষয় অবলোকন করেছি। ভয়াবহ আন্দোলনের মাধ্যমে যে বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী ও জমিদার শ্রেণী ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গকে রদ করেছিলো, তারাই আবার ১৯৪৭-এ এসে বাংলাকে খণ্ডিত করেছে। ফলে ১৯৪৭ সালে আর্যদের উত্তরসূরীর দাবিদাররা এ দেশ ত্যাগ করেছে এবং ১৯৭১ সালে ‘শরাফত’ ও ‘খান্দানী’ মুসলমানিত্বের শ্লোগান উচ্চারণকারী অবাঙ্গালীরা এদেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে। এখন প্রায় ৫৬ হাজার বর্গমাইল এলাকা নিয়ে গঠিত বাংলাদেশের বাঙ্গালীদের দায়িত্ব একটাই এবং তা হচ্ছে নিজেদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিজেদের গড়ে তোলা।
কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্বের মানবগোষ্ঠী
সবশেষে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবী ও বিত্তশালীদের নেতৃত্বের মানবগোষ্ঠী সম্পর্কের মূল্যায়ন। এদেশে ইংরেজ আগমনের পর উপমহাদেশে সর্বপ্রথম একমাত্র এঁরাই একটা সম্পূরক শক্তি হিসেবে অর্থবহ ভূমিকা পালন করেছে। যেখানে মুর্শিদাবাদ ও ঢাকা কেন্দ্রিক মুসলিমদের শাসনামলে এই বর্ণহিন্দুরাই ছিলো সম্পূরক শক্তি, সে ক্ষেত্রে ইংরেজ শাসনের শুরুতে এঁরা সহজেই নতুন ‘মুনিবকে’ মেনে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। অত্র পুস্তকে এতদসম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করেছি। এরই জের হিসেবে এঁরাই সর্বপ্রথম পরিগণিত হয়েছিলেন এই উপমহাদেশের ইংরেজী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী হিসেবে। কিভাবে এসব সম্ভব হয়েছিলো, তারও বিস্তারিত তথ্যাদি ইতিপূর্বে বর্ণিত করেছি। এই বর্ণহিন্দু বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবীরা কোন্ প্রেক্ষিতে ইউরোপীয় রেনেসাঁর মূল শর্ত ‘স্বাধীনতা” ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ ভিত্তি না থাকা সত্ত্বেও বাংলার রেনেসাঁর দাবীদার হিসেবে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলো তারও কথাবার্তা পূববর্তী অধ্যায়গুলোতে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখন হচ্ছে লাভ-ক্ষতির খতিয়ান।
অন্যান্য সবকিছুর কথা ছেড়ে দিলেও বর্তমান শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বঙ্গভঙ্গ রদের ফলাফলগুলো একটা পরিচ্ছন্ন ও উদার হৃদয়ে মূল্যায়ন করা অপরিহার্য মনে হয়। কারণ ১৯১১ সালের ডিসেম্বর মাসে বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণার পর দেশ-বিদেশে এ মর্মে বিশ্বাস জন্মেছিলো যে, এর ফলে কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী ও বিত্তশালী জমিদার শ্রেণীর বিজয় সূচিত হয়েছিলো। এমনকি বহু পণ্ডিত ব্যক্তির রচিত গ্রন্থেও এই বিজয়গাঁথা লিপিবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু এতোগুলো বছর পরে প্রকৃত ইতিহাস বিশ্লেষণ ও সমীক্ষা আন্ত ফলাফলগুলো তো ভিন্ন রকম মনে হচ্ছে। নিম্নে সংক্ষেপে সে কথাগুলোই উপস্থাপিত করলাম :—
ক. ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী করে বাংলা প্রেসিডেন্সীতে এলাকা দেয়া হয়েছিলো যশোর-কুষ্টিয়া থেকে ছোট নাগপুর পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৪১ হাজার ৫৮০ বর্গমাইল এবং লোকসংখ্যা ৫৪ মিলিয়ন। কিন্তু ১৯১১ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে বাংলা প্রেসিডেন্সীর আয়তন দাঁড়ালো চট্টগ্রাম থেকে মেদিনীপুর পর্যন্ত ৮৫ হাজার বর্গমাইল এলাকার মতো। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণাকালে উড়িষ্যা ও বিহার অঞ্চল কেটে নিয়ে নতুন প্রদেশ গঠন করা হয়। এর রাজধানী স্থাপিত হলো পাটনায়।
খ. ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী হলে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙ্গালী বর্ণহিন্দু নেতৃবৃন্দ এ মর্মে অভিযোগ উত্থাপন করলেন যে, পুনর্গঠিত বাংলা প্রেসিডেন্সীতে অবাঙ্গালীরা সংখ্যাগুরু হয়ে গেছে। কিন্তু এঁরা বুঝতেই পারলেন না যে, ১৯১১ সালে যেভাবে বাংলাকে যুক্ত করে অবিভক্ত বাংলা সৃষ্টি করা হলো, তাতে বাঙ্গালী মুসলমানদের জনসংখ্যাই সংখ্যাগুরু হয়ে দাঁড়ালো।
গ. ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় ইংরেজ ভারতের রাজধানী কোলকাতাতেই নির্দিষ্ট ছিলো; কিন্তু ১৯১১ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে কোলকাতা থেকে দিল্লীতে রাজধানী স্থানান্তরিত হয়ে গেলো। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধকে ইংরেজ আমলের শুরু হিসেবে চিহ্নিত হলে ইংরেজদের মোট রাজত্বকাল হলো ১৯০ বছরের মতো। এর মধ্যে ১৫৪ বছর পর ১৯১১ সালে রাজধানী দিল্লীতে স্থানান্তরিত হলো। তাহলে বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে বাঙ্গালী বর্ণহিন্দু বুদিধজীবী ও বিত্তশালীদের হাত থেকে বিশাল ইংরেজ ভারতের রাজধানীটা চলে গেলো সুদূর দিল্লীতে।
ঘ. বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার সময় পর্যন্ত ইংরেজ ভারতের সমস্ত রকমের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো কোলকাতায় এবং রাজনীতির নেতৃত্বে ছিলো বাঙ্গালী বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী ও বিত্তশালীদের প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ রদের স্বদেশী আন্দোলন চলাকালে সবার অলক্ষেই অবাঙ্গালী নওরোজী-তায়েবজী-গোখলে-তিলক-মেহতা-রানাডে-লাজপত-সাভারকার প্রমুখের অভ্যুদয় হলো। সত্যিকারভাবে বলতে গেলে নিখিল ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেই যে ১৯১১ সাল নাগাদ বর্ণহিন্দু বাঙ্গালীদের হস্তচ্যুত হলো, তা আজও পর্যন্ত পুনরুদ্ধার হয়নি।
ঙ. ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময়কালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কোলকাতা কেন্দ্ৰিক বর্ণহিন্দু বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবীদের অবিচ্ছেদ্য অংশবিশেষ। কিন্তু মাত্র একানব্বুই দিনের মাথায় রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়িয়ে ১৯০৬ সাল থেকে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। প্রায় বছর খানেক পরে কবিগুরু রবীন্দ্র যখন আবার লেখনী ধরলেন, তখন তিনি সম্পূর্ণ এক ভিন্নাদর্শের অনুসারী। রবীন্দ্রনাথ তখন মানবপ্রেম ও বিশ্বপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। স্বদেশী আন্দোলনের নামে বিরাজমান সাম্প্রদায়িকতা রবীন্দ্রনাথের হৃদয়কে বিক্ষুব্ধ করে তুললো। অচিরেই রবীন্দ্রনাথের গোত্রান্তর হলো। তিনি ‘গীতাঞ্জলী’ কাব্যগ্রন্থ রচনা করে নোবেল প্রাইজ পুরস্কার পেয়ে বিশ্ব কবি হিসেবে পরিণত হলেন।
চ. সবচেয়ে লক্ষণীয় ঘটনা হচ্ছে, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী হওয়ার সময়েও শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনাকালে টেবিলের একদিকে শেতাঙ্গ রাজপুরুষ এবং অন্যদিকে বাঙ্গালী বর্ণহিন্দুদের প্রতিনিধিবৃন্দের দেখা যেতো। কিন্তু(১৯০৬ সালেই মুসলিম লীগের জন্ম)বাংলার রাজনীতিতে নতুন করে তৃতীয় পক্ষের অভ্যুদয় হয়েছে। এঁরা বাঙ্গালী মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের দাবীদার।
ছ. ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে আলোচ্য তৃতীয় পক্ষ শুরু করলো ‘কোটার রাজনীতি’। ১৯১১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সময়ের দুরত্ব মাত্র ৩৬ বছরের মতো। এই ৩৬ বছরের মাথায় আলোচ্য তৃতীয় পক্ষ অবিভক্ত বাংলাসহ পাকিস্তানের দাবী সমর্থন করে বসলো। এর জবাবে বাংলা কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার নেতৃত্বে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙ্গালী বর্ণহিন্দু আর বিত্তশালীরা অবিভক্ত বাংলা প্রেসিডেন্সীকে ভাগ করার দাবী উত্থাপন করলো। শেষ পর্যন্ত বিভক্ত বাংলার শতকরা সাড়ে বাষট্টি ভাগ নিয়ে গঠিত হলো পূর্ব বাংলা আর বাকীটুকু হচ্ছে আজকের পশ্চিম বাংলা (ম্যাপ দ্রষ্টব্য)। কোথায় ১৯০৫ সালে পূর্ব বঙ্গ ও আসাম প্রদেশ গঠনের পর ১ লাখ ৪১ হাজার ৫৮০ বর্গমাইল সম্বলিত বাংলা ফোর্ট উইলিয়াম প্রেসিডেন্সী আর কোথায় ১৯৪৭ সালে হাজার তিরিশেক বর্গমাইল-এর পশ্চিম বাংলা।
সমাপ্তিতে শুধু এ কথাটাই বলতে চাই যে, নদীমাতৃক বাংলাদেশের সেই অবহেলিত বাঙ্গালীরা কিন্তু এখন স্বাধীন। এঁদের নিজস্ব পতাকা রয়েছে; এঁদের জাতীয় সঙ্গীত বাংলায় পরিবেশিত হচ্ছে আর এঁদের রাষ্ট্র ভাষাও বাংলা। এই বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী এখন এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। তাহলে অন্যদিকে পশ্চিম বাংলার সেই বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী নেতৃত্বের পরিণতিটা কোথায় যেয়ে দাঁড়িয়েছে সেটাই লক্ষণীয়। ভারতে কিন্তু সেই ‘বন্ধে মাতারম’ সঙ্গীত জাতীয় সঙ্গীত হয়নি। এঁদের রাষ্ট্র ভাষা হচ্ছে হিন্দী আর এই এঁরা হচ্ছেন ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র শতকরা ৮/৯ ভাগের মতো। এঁরা এখন নিজস্ব স্বকীয়তা পর্যন্ত হারাতে বসেছে। তাহলে ইতিহাসের বিচারে লাভবান কারা হলো?