কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী – ১২

বাঙালি মুসলিম মনমানসিকতা

বঙ্গভঙ্গের প্রাক্কালে বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠী এবং ‘সবেমাত্র ইংরেজি শিক্ষিত’ মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মন-মানসিকতা ও কর্মকাণ্ডের উল্লেখ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। অন্যথায় পুরো আলোচনাটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এটা এমন একটা সময় যখন ‘মেঘে মেঘে বেশ কিছু বেলা’ হয়ে গেছে। বিষয়টা একটু গুছিয়ে বললে বলতে হয় যে, ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দে ওয়াহাবী আন্দোলনের পরিসমাপ্তিতে সেই যে মওলানা কেরামত আলী জোনপুরী ইংরেজী শেখার জন্য ‘ফতোয়া’ জারি করেছিলেন; তখন থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত মাত্র ৩৪ বছরকাল সময়ের দূরত্বে শিক্ষিত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী কৈশোরে উপনীত হয়েছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর বাস্তবতা এই যে, এসময় কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী ও বিত্তশালী সম্প্রদায় বিগত প্রায় এক শতাব্দীকালের মধ্যে বিশাল বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠীর মন-মানসিকতা সম্পর্কে কোনরকম চিন্তা করারও অবকাশ পাননি। এঁদের ধ্যান-ধারণায় তখনও পর্যন্ত বাঙালি মুসলমান বলতে কোলকাতার দিলখুশা, কলুটোলা, নারিকেলডাঙ্গা, মেটিয়াবুরুজ, খিদিরপুর এলাকা বসবাসকারী কিছু সংখ্যক আদম সন্তান আর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বদৌলতে প্রাপ্ত পূর্ব বঙ্গের জমিদারী এলাকার শোষিত বিপুল সংখ্যক কৃষক, মাঝি আর গাড়োয়ানের দল।

মানবজাতির সামাজিক ইতিহাসে আজও পর্যন্ত এমন ঘটনা বিরল; যেখানে পাশাপাশি দু’টো সম্প্রদায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বসবাস করে যাচ্ছে, অথচ শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রণীরা নিগৃহীত সামাজিক অনুষ্ঠানাদি থেকে শুরু করে এঁদের মনমানসিকতা ও চিন্তাধারা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। অন্যান্য দিকের কথা ছেড়ে দিলেও ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রায় এক শতাব্দীকালে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু লেখকদের রচিত নাটক, উপন্যাস আর ছোট গল্পগুলো এর জ্বলন্ত সাক্ষ্য বহন করছে। অবশ্য অবিস্মরণীয় প্রতিভার অধিকারী,ঋষি বঙ্কিমচন্দ্ৰ বিপ্লবী অরবিন্দ বর্ণিত (“স্বাদেশিকতার ধর্মগুরু”) তাঁর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এদের চোখে এক সময় যে প্রতিক্রিয়াশীল ঠুলি পরিয়ে দিয়েছিলেন, একমাত্র রবীন্দ্র প্রতিভা ছাড়া আরও গুটিকয়েক ব্যতিক্রম রয়েছে। সাতচল্লিশ পর্যন্ত এদের আর কারো পক্ষে সেই ঠুলি ছিঁড়ে ফেলা সম্ভব হয়নি। তাই পশ্চিম বঙ্গের মার্কসীয় গবেষক সুপ্রকাশ রায় যথার্থই লিখেছেন, “ সামন্ত প্রথার সমস্ত রক্ষণশীল কুসংস্কারের এমন ঘোরতর সমর্থক বলিয়াই বঙ্কিম-সাহিত্য এত আদরণীয় হইয়া উঠিয়াছিল এদেশের সমাজের গোঁড়া হিন্দু ও উচ্চশ্রেণীর নিকটে। বঙ্কিম সাহিত্য হইল প্রগতিবিরোধী অভিজাতগোষ্ঠী ও মধ্যশ্রেণী সমাজের মুখপত্র। “ সেই হিন্দু সমাজের রক্ষণশীলতা ও গোঁড়ামির মধ্যেই নতুন প্রাণ সঞ্চারের চেষ্টা দ্বারা বঙ্কিম সামন্ততন্ত্রের বুনিয়াদ দৃঢ়. করিয়া তুলিবার প্রয়াস পাইয়াছিলেন। এইভাবে বঙ্কিমচন্দ্রের নেতৃত্বে বঙ্গীয় “রিনাসান্স” হিন্দু “রিনাসান্সে” পর্যবসিত হয়। প্রকৃতপক্ষে এই হিন্দু “রিনাসান্স” হিন্দু অভিজাত ও হিন্দু মধ্যশ্রেণীরই নবজাগরণ। বঙ্কিমের পর রামকৃষ্ণ পরমহংস ও তাহার শিষ্য বিবেকানন্দ বঙ্কিমচন্দ্র কর্তৃক আরদ্ধ এই হিন্দু “রিনাসান্স”কে আরও গভীর ও ব্যাপকভাবে ধর্মীয় ও সামাজিক রূপদান করেন।” (ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামঃ পূঃ ১৯৬–১৯৭ কলিকাতা ১৯৮০)

সত্যিকারভাবে বলতে গেলে বিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকে সমগ্র উপমহাদেশে ইংরেজী শিক্ষা-দীক্ষার সবচেয়ে অগ্রসরমান এই উন্নাসিক কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের পক্ষে বাঙালি মুসলিম মানস সম্পর্কে চিন্তার অবকাশ পর্যন্ত ছিলো না। এ সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের আর এক বিশিষ্ট মার্কসীয় গবেষক ও সাংবাদিক কমরেড বিনয় ঘোষের মন্তব্য পুনরুল্লেখ করতে হয়। তিনি যথার্থই লিখেছেন, “…..হিন্দু-প্রীতি ক্রমে ‘হিন্দুত্ব’ প্রীতির ভিতর দিয়ে ‘সাম্প্রদায়িকতায়’ পর্যবসিত হল।…… যুক্তির বদলে এল সেই সনাতন ভক্তি, সংস্কারের বদলে এল কুসংস্কার, উদারতার বদলে সঙ্কীর্ণতা, মানবতার বদলে সাম্প্রদায়িকতা। ……মুসলমান বর্জিত তথাকথিত রিনেস্যান্স ও রিফর্মেশন আন্দোলনের প্রায়শ্চিত্ত করা হল চরম প্রতিক্রিয়াশীল রিভাইভ্যাল আন্দোলনের সূত্রপাত করে, বিদ্যা-বুদ্ধি-যুক্তি সব বিসর্জন ও বন্ধক দিয়ে।”

বাংলার সামাজিক ইতিহাসের এ ধরনের এক বিকৃত উত্তরণ লক্ষ্য করে কমরেড বিনয় ঘোষের লেখনীতে মারাত্মক আক্ষেপের সুর পরিলক্ষিত হয়। তিনি পুরো ঘটনা প্রবাহকে ‘ট্র্যাজেডি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বিনয় বাবু সুস্পষ্ট ভাষায় আরও লিখেছেন যে, “প্ৰথম ও প্রধান ট্র্যাজেডি হল, বাংলার এই নতুন বিদ্বৎসমাজ প্রায় সম্পূর্ণ ‘মুসলমান বর্জিত’ রূপ ধারণ করল এবং এই জন্য একে সাধারণভাবে ‘বাঙালি বিৎসমাজ’ না বলে বিশেষ অর্থে ‘বাঙালি হিন্দু বিদ্বৎসমাজ’ বলাই যুক্তিসংগত। আমরা যখন নব্যবংগের বা নব যুগের বাংলার ইতিহাস আলোচনা করি তখন কতকটা সচেতনভাবেই বাঙালি মুসলমান সমাজের এই প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যাই।” (বাংলার বিদ্বৎসমাজ : প্রকাশ ভবন কলিকাতা ১৯৭৮)।

ইতিহাসের এ ধরনের এক চাঞ্চল্যকর প্রেক্ষাপটে বংগভংগের প্রাক্কালে বাঙালি মুসলমানদের মনমানসিকতা ও কর্মকাণ্ডের উল্লেখ নিতান্ত অপরিহার্য মনে হয়। প্রাপ্ত নথিপত্রের ভিত্তিতে প্রথমেই বলে রাখতে হয় যে, বহু ঘাত-প্রাতিঘাতের মাঝ দিয়ে বংগভংগ কার্যকরী হওয়ায় সামগ্রিকভাবে বাঙালি মুসলমানরা সন্তুষ্ট হয়েছিলো। কেননা এর ফলে মুসলমানদের অর্থনৈতিক দুর্গতির কিছুটা লাঘব হওয়া ছাড়াও বাঙালি মুসলিম মধ্যশ্রেণীর ক্রমবিকাশের ধারা দ্রুততর হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিলো। এ জন্যই ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর ঢাকায় “মহামেডান প্রভিন্সিয়াল ইউনিয়ন” নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয় (সূত্রঃ দি মুসলিম ক্রনিক্যাল, ২১শে অক্টোবর ১৯০৫)। নয়া প্রদেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তাধারার বিকাশই ছিলো এই সংস্থার মুখ্য উদ্দেশ্য। এ সময় উপমহাদেশের অন্যান্য এলাকার মুসলমানরাও নয়া প্রদেশ গঠনের প্রতি সমর্থন দান করে।

কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু নেতৃবৃন্দের সর্বাত্মক বিরোধিতার মোকাবেলায় বাঙালি মুসলমান শিক্ষিত সমাজ ১৯০৬ সালের ২৫শে নভেম্বর কোলকাতার ৫১, ওয়েলেসলী স্ট্রীট-এ “মহামেডান ভিজিলেন্স এসোসিয়েশন” (মুসলিম সতর্ক প্রহরা সমিতি) গঠন করে। নবাব সৈয়দ আমীর হোসেন এবং বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের প্রাক্তন সদস্য খান বাহাদুর সিরাজুল ইসলাম যথাক্রমে এই সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই সমিতির মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে, “সামগ্রিকভাবে মুসলিম জণগোষ্ঠীর ওপর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের “দুঃখজনক প্রভাবকে” সম্ভাব্য সমস্ত রকমের আইন সঙ্গত উপায়ে প্রতিরোধ করা।”

মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে ভাড়া করা বক্তা

অবশ্য একথা স্বীকার করতেই হয় যে, এ সময় কতিপয় বাঙালি মুসলিম নেতৃবৃন্দ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে সমর্থন দিয়েছিলো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডঃ এম. কে ইউ মোল্লার মতে, এদের মধ্যে নবাব সলিমুল্লাহর সৎভ্রাতা খাজা আতিকুল্লাহ, ফরিদপুরের আলিমুজ্জামান চৌধুরী, সিরাজগঞ্জের ইসমাইল সিরাজী, ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ রসুল এবং নোয়াখালীর লিয়াকত হোসেন অন্যতম। ডঃ মোল্লা তাঁর রচিত ‘দি নিউ প্রভিন্স অব ইস্টার্ণ বেঙ্গল এ্যাণ্ড আসাম’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে আরও তথ্য উপস্থাপন করেছেন। তিনি ইতিহাসবিদ ডঃ মফিজুল্লাহ কবীরের বরাত দিয়ে এ মর্মে মন্তব্য করেছেন যে, খাজা আতিকুল্লাহ আসলে খাজা সলিমুল্লাহর সংগে বৈষয়িক বিষয়ের বিবাদের জের হিসেবে আলোচ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে দুই ভাইয়ের বিরোধের নিষ্পত্তি হলে খাজা আতিকুল্লাহ বঙ্গভঙ্গের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। আলিমুজ্জামান চৌধুরী ভারত সরকারকে বঙ্গভঙ্গ রদের লক্ষ্যে যে প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন তা বেশ বিতর্কিত বলা যায়। ডঃ মোল্লা এ মর্মে মন্তব্য করেছেন যে, এই প্রতিবেদন কোনো জনসভায় গৃহীত হয়নি। উপরন্তু আলোচ্য প্রতিবেদনটি কারা উপস্থাপনা করেছিলেন এবং কারাইবা তা’ দস্তখতের জন্য বিতরণ করেছিলেন তারও সুস্পষ্ট প্রমাণাদির অভাব রয়েছে। তবে এটুকু দেখা যায় যে, প্রতিবেদনটি কোলকাতাতেই প্রণীত হয়েছিলো এবং এর প্রথম চারজন দস্তখতকারী দু’জনই এ সময় হিন্দু আইনজীবীদের ব্যবস্থপনায় পরিচালিত ‘ফরিদপুর লোন অফিসে’ দারুণভাবে ঋণগ্রস্ত। তৃতীয় দস্তখতকারী ছিলেন জনৈক অমিতচারী মুসলিম যুবক।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নোয়াখালীর মুসলিম নেতা লিয়াকত হোসেন সম্পর্কে ডঃ মোল্লা চাঞ্চল্যকর তথ্য উপস্থাপনা করেছেন। তিনি ১৯০৭ সালের ২৪শে জানুয়ারী পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের চীফ সেক্রেটারী পিসি লিওন কর্তৃক ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিবের নিকট প্রেরিত নোট-এর বরাতে উল্লেখ করেছেন যে, বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াবার জন্য আন্দোলনকারীরা লিয়াকত হোসেনকে মাসিক ৪০ টাকা হিসেবে ভাতা প্রদান করতো।

এ ধরনের গুটিকয়েক ব্যতিক্রধর্মী বাঙালি মুসলিম ব্যক্তিত্বের কর্মকাণ্ডের চেয়ে যেটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে বঙ্গভঙ্গের প্রাক্কালে সামগ্রিকভাবে বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠীর চিন্তাধারার মূল্যায়ন। ১৯৮৩ সালের আগস্ট মাসে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ‘পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ’ কর্তৃক বাংলায় প্রকাশিত ‘আধুনিক ভারতঃ প্রথম খণ্ড’ (প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায় কৃত) গ্রন্থে এ সম্পর্কে কিছু তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে। শ্রী চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘এছাড়া কলকাতার ‘মোহামেডান সাহিত্য সভা’ বঙ্গবিভাগের সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানালেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, স্বদেশী আন্দোলনে হিন্দু ধর্ম ও আদর্শের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় মুসলমান জনগণের মনেরও এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হল। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় যেমন “ইসলাম প্রচার”, “মিহির ও সুধাকর” ও ‘হাফেজ’-এ মুসলমান লেখকেরা প্রচার করতে লাগলেন যে, তিলক, অরবিন্দ, বিপিনচন্দ্র পাল, ব্রহ্মবান্ধব প্রভৃতি নেতৃবৃন্দ হিন্দু ধর্মকে কেন্দ্র করে যে হিন্দু জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যা করেছেন তা উগ্রভাবে ইসলাম বিরোধী।…… কিন্তু সাধারণ মুসলমান কৃষিজীবী সম্প্রদায় কেন স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি বিমুখ হলেন তা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যায় যে, পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ জমিদার ও ভূ-স্বামীগণ ছিলেন হিন্দু এবং তাঁরাই স্বদেশী আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন। বংগভংগের ফলে মুসলমান প্ৰজা অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গে তাদের ভূ-সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় হিন্দু জমিদারগণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন ও বংগভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেন।……. অনিবার্য ফলশ্রুতিরূপে পূর্ববঙ্গের বিভিঅঞ্চলে হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা দেখা দেয়। ১৯০৬-০৭ খ্রীষ্টাব্দে জামালপুরে মুসলমান প্রজাগণ হিন্দু জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দাঙ্গায় সংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন। ডঃ সুমিত সরকারের [দি স্বদেশী মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল : পৃঃ ৪৫৫-৪৫৬] মতে, ময়মনসিংহের দাঙ্গায় ভূমি সংক্রান্ত চরিত্রটি পরিস্ফুট হয়েছিল।’

এ সময় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিক্ষুব্ধ চিত্তে লিখলেন, ‘মানুষকে ঘৃণা করা যে দেশের ধর্মের নিয়ম, প্রতিবেশীর হাতে জল খাইলে যাহাদের পরকাল নষ্ট হয়, পরকে অপমান করিয়া যাহাদিগকে জাতিরক্ষা করিতে হইবে, পরের হাতে নিয়মিত অপমানিত না হইয়া তাহাদের গতি নাই। তাহারা যাহাদিগকে ম্লেচ্ছ বলিয়া অবজ্ঞা করিতেছে, ম্লেচ্ছর অবজ্ঞা তাহাদিগকে সহ্য করিতে হইবেই” (রচনাবলী ১২ পৃঃ ৯০৫-৯১৫)।

তাহলে একথা সহজেই অনুমিত হয় যে, পূর্ববঙ্গে বর্ণহিন্দু জমিদারদের বল্গাহীন শোষণের মোকাবেলায় বিপুল সংখ্যক মুসলিম কৃষক সমাজ বংগভঙ্গের মাঝেই কিছুটা মুক্তির আলো দেখতে পেয়েছিল। এর পাশাপাশি সদ্য ইংরেজী শিক্ষিত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী কোন প্রেক্ষাপটে বংগভঙ্গের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলো তা পর্যালোচনা করা সমীচীন মনে হয়। পূর্ববংগ ও আসামের শিল্প, বাণিজ্য এবং যাতায়াতের ভয়াবহ দূরবস্থার বিস্তারিত আলোচনা না করে শুধুমাত্র সংক্ষেপে শিক্ষা ব্যবস্থার উল্লেখই এখানে যথেষ্ট মনে হয়। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ১৯০৬ সালের পরিসংখ্যান নিম্নে প্রদত্ত হলো :

কলেজের সংখ্যা

পূর্ববংগ ও আসাম : ১১টি

অবশিষ্ট বংগ : ২৬টি

এ পর্যন্ত পড়ার কলেজ

পূর্ববংগ ও আসাম : শূন্য

অবশিষ্ট বংগ : ৩টি

মেয়েদের হাই স্কুল

পূর্ববংগে : ৩টি

আসামে : শূন্য

চাকরির ক্ষেত্রে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া না গেলেও ১৯০৫ সালের ১২ই ডিসেম্বর তারিখে নবগঠিত পূর্ববংগ ও আসাম সরকারের নিকট থেকে কোলকাতায় পুলিশের আইজি’র নিকট প্রেরিত এক পত্রে দেখা যায় যে, এই প্রদেশের সমগ্র পুলিশ বিভাগের ইন্সপেক্টরের পদে হিন্দুদের সংখ্যা যেখানে শতকরা ৯২.৬% ভাগ, সেখানে মুসলমানদের সংখ্যা মাত্র শতকরা ৭.৪% ভাগ। অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, নয়া প্রদেশের সর্ববৃহৎ ময়মনসিংহ জেলায় যেখানে জনসংখ্যার শতকরা ৭১.৩৬% ভাগ মুসলমান, সেখানে মাত্র শতকরা ৯.৪% ভাগ পদে মুসলিম কর্মচারী রয়েছে। বাকী সবাই অমুসলিম। (ইস্ট বেঙ্গল এ্যাণ্ড আসাম জুডিশিয়াল প্রসিডিংস, ১৯০৬)।

এ ধরনের এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সদ্য ইংরেজী শিক্ষিত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী যে স্বাভাবিকভাবেই বঙ্গভঙ্গের প্রতি সমর্থনের হস্ত সম্প্রসারিত করেছিলো তা বলাই বাহুল্য। আর ঠিক এমনি সময়ে মাত্র ৯০ দিনের ব্যবধানে পর পর দু’টো ঘটনা সংঘটিত হলো। প্রথমটি হচ্ছে ১৯০৬ সালের ১লা অক্টোবর সিমলায় বড়লাট লর্ড মিন্টোর সংগে আগা খানের নেতৃত্বে ৩৫ জন সদস্যবিশিষ্ট এক মুসলিম প্রতিনিধি দলের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক। দ্বিতীয়টি হচ্ছে একই বছরের ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় মোহামেডান এডুকেশন্যাল কনফারেন্সের বার্ষিক অধিবেশনের সময় এক ঘরোয়া বৈঠকে আলিগড় কলেজের মহসিন-উল-মুলকের প্রস্তাবক্রমে সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান মুসলিম লীগের জন্ম হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেছিলেন নবাব ভিকার-উল-মুলক। উল্লেখ্য যে, আগা খানের প্রতিনিধি দলে এবং ঢাকায় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠালগ্নে বদরুদ্দিন তায়েবজী, মহাকবি ইকবাল এবং ব্যারিস্টার মুহম্মদ আলী জিন্নাহর কোন স্থান ছিলো না। সেদিন এঁদের কাউকে আমন্ত্রণ পর্যন্ত করা হয়নি।

এক্ষণে গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটি প্রশ্নের অবতারণা প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। বিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকে ভাষাভিত্তিক এবং ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠী-স্বার্থে পর্দার অন্তরালে যেসব অর্থবহ ঘটনা এই উপমহাদেশে সংঘটিত হয়েছে সে সবের প্রতি অন্ততঃ কিছুটা আলোকপাত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯০৬ সালের ১লা অক্টোবর আগা খানের নেতৃত্বে যখন ৩৫ সদস্যের উত্তর ভারতীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দের একটি প্রতিনিধি দল সিমলায় বড়লাট লর্ড মিন্টোর (১৯০৫-১৯১০) সমীপে মুসলমানদের ‘দাবী-দাওয়া’ পেশ করতে যায়, তখন “বঙ্গভঙ্গ স্থায়ী করার” বিষয়টি আলোচ্য দাবী দাওয়ার’ অন্তর্ভুক্ত হলো না কেনো? এবং কেনোইবা বড় লাটের সঙ্গে আলোচনাকালে বাঙালি মুসলমানদের মূল দাবী বঙ্গভঙ্গের প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হলো না?

প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় যে, এ সময় কোলকাতা-কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দুদের উদ্যোগে ‘বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন মারাত্মক আকার ধারণ করলে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ এবং ময়মনসিংহের নবাব আলী চৌধুরী আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় আগাখানের “দাবী-পত্রে” বঙ্গভঙ্গ স্থায়ী করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা করেছিলেন। বিশিষ্ট গবেষক প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “এ সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য বাঙালি মুসলমান নেতৃবৃন্দ বিশেষতঃ ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ ও সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী এই দাবী-পত্রে বঙ্গভঙ্গের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আগাখার বিরোধিতায় তা সম্ভব হয়নি।” (আধুনিক ভারতঃ প্রথম খণ্ড, পৃঃ ১৩৮ কলিকাতা ১৯৮৩)।

গোষ্ঠীস্বার্থে বাঙালি মুসলমানদের সেদিন ব্যবহার করা হলো

আগাখান এবং যুক্ত প্রদেশের অন্যান্য মুসলিম নেতৃবৃন্দ কর্তৃক এর ঘোর বিরোধিতা করার কারণ একটাই। তা হচ্ছে ইংরেজ ভারতের যে সব প্রদেশে জনসংখ্যার দিক দিয়ে মুসলমানরা সংখ্যালঘু রয়েছে, সেই সংখ্যালঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যেই যুক্ত প্রদেশের নবাব ইমদাদুল মুলক এবং নবাব মোস্তাক হোসেন ভিকার-উল-মুলক-এর খসড়া অনুসারে আলোচ্য ‘দাবী-পত্র’ প্রণীত হয়েছিলো। এই ‘দাবী-পত্র’কে একটা সর্বভারতীয় চরিত্রে দাঁড় করাবার জন্যই সেদিন পূর্ববংগ ও আসাম প্রদেশের ১৮ মিলিয়ন মুসলমানের সমর্থনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিলো। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, হিন্দী ভাষার মোকাবেলায় যুক্ত প্রদেশ ও বিহার অঞ্চলের সংখ্যালঘু মুসলমানদের মাতৃভাষা উর্দুকে রক্ষার লক্ষ্যে আলোচ্য নেতৃবৃন্দ সেদিন এ মর্মে ধূলিঝড়ের সৃষ্টি করেছিলো যে, বংগীয় এলাকার মুসলমানদের ভাষাও হচ্ছে উর্দু। (এরই জের হিসেবে পাকিস্তান আমলে ১৯৫২ সালে পূর্ব বাংলায় রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়)। সে ক্ষেত্রে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর সংগে দর কষাকষির সময় বলতে সুবিধা হলো যে, ইংরেজ শাসিত ভারতের ৬২ মিলিয়ন মুসলমানের উর্দু ভাষার জন্য রক্ষাকবচ চাই। মোদ্দা কথায় বলতে গেলে সেদিন এসব উর্দুভাষী নেতৃবৃন্দের কাছে উততর ভারতীয় অঞ্চলের সংখ্যালঘু মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রশ্ন ছিলো মুখ্য। নবগঠিত পূর্ববংগ ও আসাম প্রদেশের সংখ্যাগুরু বাঙালি মুসলমানদের (৩১ মিলিয়ন জনসংখ্যার ১৮ মিলিয়ন মুসলমান) স্বার্থে বংগভংগ স্থায়ীকরণের বিষয়টি এঁরা সেদিন অর্থবহ কারণে আমলই দিলেন না। বাঙালি মুসলমানদের দুর্ভাগ্য যে, সেদিন ঢাকার নবাব সলিমুল্লার আর ময়মনসিংহের সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী ছাড়া গোষ্ঠীস্বার্থে দাবী উত্থাপনের লক্ষ্যে আর কোন বিশিষ্ট নেতা ছিলেন না। সিরাজগঞ্জের আসাদুল্লাহ সিরাজী, কোলকাতার আবদুল্লা রসুল আর চট্টগ্রামের মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর মতো মহৎপ্রাণ ব্যক্তিরাও তখন ছিলেন দুঃখজনকভাবে ভিন্নদর্শী। বাঙালি মুসলমানদের পক্ষ থেকে একথা সেদিন কেউই সুস্পষ্ট ভাষায় বলতে পারলেন না যে, আগাখানের ‘দাবি-পত্রের প্রতি সমর্থন থাকলেও কেন্দ্রের কোটাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব এবং ‘পূর্ববংগ ও আসাম’ প্রদেশকে স্থায়ীকরণই হচ্ছে ইংরেজ ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বাঙালি মুসলমানদের মূল দাবী এবং এ ব্যাপারে আর কোন আপোষ নেই। নবগঠিত ‘পূর্ববংগ ও আসাম’ প্রদেশ স্থায়ী হলে প্রাদেশিক পর্যায়ে তো আর বাঙালি মুসলমানদের ‘কোটার’ প্রয়োজন হয় না। সেক্ষেত্রে উপ-মহাদেশের রাজনীতি সেদিন একটা সুষ্ঠু অথচ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতো বলা যায়।

অথচ ইতিহাসের চাঞ্চল্যকর প্রেক্ষাপটে আমরা দেখতে পাই যে, ১৯০৬ সালের ১লা অক্টোবর আগা খানের নেতৃত্বে ‘সিমলা ডেপুটেশনের’ মাত্র ৯০ দিনের মাথায় ডিসেম্বর মাসের শেষ নাগাদ ঢাকায় মুসলিম লীগের জন্য হলেও এই প্রতিষ্ঠানের দাবী-দাওয়ার মধ্যে নবগঠিত বাঙালি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববংগ ও আসাম প্রদেশ স্থায়ীকরণের প্রশ্নটি সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। শুধু তাই-ই নয়, সদ্য স্থাপিত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানটি যাতে হাতছাড়া না হয়ে যায়, এজন্য আগাখানকেই এর স্থায়ী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯০৯ সালে ‘মলেমিন্টো সংস্কার আইনের প্রবর্তনে ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের’ সোপান রচিত হওয়ায় যেসব প্রদেশে মুসলিমরা সংখ্যালঘু মূলতঃ তাঁদের অধিকার সংরক্ষণ এবং কেন্দ্রে মুসলিম প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা হলেও কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণ-হিন্দুদের ক্রমাগত বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের মোকাবেলায় বাঙালি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ প্রদেশের অখণ্ডতা রক্ষার গ্যারান্টির কোন ব্যবস্থাই হলো না। এরই জের হিসেবে লর্ড মিন্টোর পরবর্তী গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ (১৯১০-১৯১৬) যখন ১৯১০ সালের নভেম্বর বভঙ্গের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য ভারত সচিব লর্ড ত্রিউকে সুপারিশ করলেন, তখন উপ-মহাদেশের অবাঙালি মুসলিম নেতৃবৃন্দ গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধার হওয়ায় আর বিশেষ উচ্চবাচ্য করলেন না বলা যায়। আগাখানের নেতৃত্বে মুসলিম লীগও মোটামুটিভাবে নীরব রইলো। একথা আজ চিন্তা করলে বিস্ময়কর মনে হয় যে, বঙ্গভঙ্গ রদ-এর আলোচ্য সুপারিশকালে নবাব সলিমুল্লাহর সঙ্গে কোন আলাপ-আলোচনা পর্যন্ত করা হয়নি। কারণ, ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর স্থির বিশ্বাস ছিলো যে, ১৯০৯ সালে মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনে প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বত্র ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের কোটার ব্যবস্থা করায় বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর তেমন কোন আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে না। “১৯১১ খৃষ্টাব্দের ডিসেম্বরে নতুন সরকারী সিদ্ধান্ত (পুনরায় যুক্ত বাংলা) ঘোষিত হয়। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার সিদ্ধান্তে বাংলার মুসলমান সমাজের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বঙ্গভঙ্গের ফলে মুসলমান উচ্চবিত্তে শ্রেণীর বৃটিশ শাসনের সমর্থকে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ সিদ্ধান্ত বাতিল হওয়ায় তাঁদের মনে হতাশা দেখা দিল।” (আধুনিক ভারত প্রথম খন্ডঃ পূঃ-১৪৩, কলিকাতা ১৯৮৩)।

এরই পাশাপাশি ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার পর থেকে কোলকাতা কেন্দ্ৰিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বে এর বিরুদ্ধে আন্দোলনের ক্রমবিকাশ কিভাবে ঘটলো তা’ পর্যালোচনা করা দরকার। আগেই উল্লেখ করেছি যে, বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার দিনটিতে অর্থাৎ ১৬ই অক্টোবর এদের কর্মসূচীর মধ্যে ছিলো ধর্মঘট, গঙ্গাস্নান এবং রাখিবন্ধন। বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতে উল্লেখ করতে হয় যে, এদিন কোলকাতায় যে শোভাযাত্রা হয়েছিলো, অন্যদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথও তার পুরোভাগে ছিলেন এবং তিনি অসংখ্য পথচারীর হাতে রাখি বেঁধে দিয়েছিলেন। অপরাহ্নে রোগর্জর আনন্দমোহন বসু ‘মিলন মন্দিরের’ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠানের জন্য ইংরেজীতে যে ভাষণ লিখে এনেছিলেন তা’ পড়ে শোনালেন আশুতোষ চৌধুরী এবং বাংলায় অনুবাদ করে পাঠ করেছিলেন ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার সেই আমলের সম্পাদক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিকেলের জনসভায় ঘোষিত শপথ বাক্যের বাংলায় তর্জমা করেও পাঠ করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ।

কংগ্রেসে নরম ও চরমপন্থীদের সংঘাত চরমে উঠলো

কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিত্ব মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে কেনো এই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ালেন তা’ বলার প্রাক্কালে এর প্রেক্ষাপট বর্ণনা করা সবচেয়ে বেশী প্রয়োজনীয় মনে হয়। প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় যে, শুধু বিক্ষোভ প্রতিবাদের মাধ্যমে সরকারের টনক নড়ানো যাবে না— এই সত্য উপলব্ধি করে বাঙালি হিন্দু নেতৃবৃন্দ প্রত্যক্ষ আন্দোলনের পথ অনুসরণের গুরুত্ব অনুভব করলেন। ফলে প্রতিবাদ রূপান্তরিত হলো সক্রিয় বিক্ষোভে। ‘বয়কট’ নীতির ভয়াবহ বহিঃপ্রকাশে প্রথমে বিলেতী পণ্য বর্জন ও স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহারের প্রস্তাব গৃহীত এবং দোকানে দোকানে পিকেটিং শুরু হলো। শীঘ্র আন্দোলন আরও একধাপ এগিয়ে বিলেতী পণ্যের বহ্ন্যুৎসব চলতে লাগলো। বিপিনচন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ চরমপন্থী নেতা এ সময় ‘বয়কট’-এর ব্যাখ্যাদান করে ঘোষণা করলেন যে, ‘বয়কট এর অর্থ বিলেতী পণ্য বর্জন ছাড়াও বিলেতী চিন্তাধারা এবং আদব-কায়দা সব কিছুকেই পরিত্যাগ করা। ফলে অচিরেই এই আন্দোলন বাংলার সর্বত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে পরিব্যাপ্তি লাভ করলো। এ মর্মে শ্লোগান উচ্চারিত হলো যে, বিদেশী প্রশাসন এবং বিদেশী শিক্ষাকেও বর্জন করতে হবে। এরই মোকাবেলায় ইংরেজ সরকারের তৎকালীন মুখ্যসচিব আর ডাবলিউ কার্লাইল এ মর্মে এক সার্কুলার জারি করলেন যে, আন্দোলনের সংগে সংশ্লিষ্ট ছাত্রদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। ফলে বেশ কিছুসংখ্যক হিন্দু ছাত্র কোলকাতার কলেজগুলো থেকে বহিষ্কৃত হয়। প্রায় একই সময়ে পূর্ববংগ ও আসাম সরকারের মুখ্যসচিব মিঃ লায়ন তাঁর জারিকৃত নির্দেশে উল্লেখ করলেন যে, বংগভংগ বিরোধী আন্দোলনের সংগে জড়িত ছাত্রদের ভবিষ্যতে সরকারী চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হবে। এরই জের হিসেবে সরকারী আওতার বাইরে ‘ন্যাশনাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’ স্থাপনের প্রচেষ্টা শুরু হয়। রংপুরে (বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত) কালী প্রসন্ন দাস গুপ্ত এবং ব্রজসুন্দর রায়ের উদ্যোগে প্রথম ন্যাশনাল স্কুল স্থাপিত হয়। ঢাকার নবাবপুর রোডে মুকুল সিনেমা হলের পাশে ‘ন্যাশনাল মেডিক্যাল’ নামক প্রতিনষ্ঠানটি আজও পর্যন্ত সেই সাক্ষ্য বহন করছে। এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাজা সুবোধ চন্দ্ৰ মল্লিক এক লাখ টাকা এবং ময়মনসিংহের বর্ণহিন্দু জমিদাররা প্রচুর অর্থ চাঁদা দিয়ে কোলকাতায় প্রতিষ্ঠিত “জাতীয় শিক্ষা পরিষদকে” সাহায্য করলেও এসব প্রতিষ্ঠান সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। কারণ এসব প্রতিষ্ঠান থেকে উত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদের সরকারী চাকরি লাভের পথ সম্পূর্ণ বন্ধ।

অন্যদিকে বিশিষ্ট গবেষক ডঃ সুমিত সরকার তাঁর রচিত ‘দি স্বদেশী মুভমেন্ট ইন বেংগল গ্রন্থে সরকারী নথিপত্রের ভিত্তিতে এ মর্মে মত প্রকাশ করেছেন যে, বাংলার বয়কট আন্দোলন চীনের বয়কট আন্দোলনের মত সাফল্য লাভ করেনি। কারণ স্বদেশী জিনিস পত্রের মূল্য তুলনামূলকভাবে বেশী হওয়ায় স্বদেশী দ্রব্যের জনপ্রিয়তা আশাব্যাঞ্জক ছিল না। ডঃ সরকার আরও উল্লেখ করেছেন যে এ সময় ‘স্বদেশী আন্দোলনের’ অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সম্পর্কে নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতবিরোধের সৃষ্টি হয়। একদিকে অরবিন্দ ঘোষ, বিপিন পাল, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় প্রমুখ ‘স্বদেশী কর্মসূচীকে’ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারে সচেষ্ট হন এবং অন্যদিকে প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সতীশ মুখোপাধ্যায়, নীলরতন সরকার প্রমুখ স্বদেশী শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসারকে রাজনৈতিক আওতার বাইরে রাখার উদ্যোগী হয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, এ সময়েই প্রফুল্ল রায়ের ‘ক্যালকাটা’ কেমিক্যাল, ডাঃ নীলরতনের সাবানের কারখানা, বংগলক্ষ্মী কটন মিলস্, বেঙ্গল ন্যাশনাল ব্যাংক, ন্যাশনাল ইনসুরেন্স কোম্পানী প্রভৃতি স্থাপিত হয়েছিলো। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এসবের সংখ্যা ছিলো খুবই নগণ্য।

এদিকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু হওয়ার মাত্র ১০ মাসের মাথায় ইংরেজভক্ত বর্ণহিন্দু জমিদারের দল এই আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ালো। বৃটিশ ইণ্ডিয়া এসোসিয়েশন-এর মাধ্যমে এঁরা সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে এক স্মারকলিপি দাখিল করলেন। এতে মোট ১০৭ জন বর্ণহিন্দু জমিদারের স্বাক্ষর ছিলো। এর মধ্যে প্রথম নামটিই হচ্ছে ময়মনসিংহের মহারাজা সূর্যকান্ত এবং দ্বিতীয়টি বর্ধমানের মহারাজার

তবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন অত্যন্ত দ্রুত চরমপন্থী বর্ণহিন্দু নেতৃবৃন্দের কব্জায় চলে যায়। এ সময় গোপনে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের বিস্তার লাভ ছাড়াও পত্র-পত্রিকাগুলোও উগ্র নীতি গ্রহণ করে। বিশিষ্ট লেখক যোগেশচন্দ্র বাগল-এর মতে, প্রেস আইনের দাপটে ৩৫০টি ছাপাখানা এবং ৩০০টি সংবাদপত্র বাজেয়াপ্ত হয়। (‘মুক্তির সন্ধানে ভারত :’ কলিকাতা ১৯৪০ পৃঃ ৩১১)। এছাড়া অর্ডিন্যান্স জারি করে বরিশালের স্বদেশ বান্ধব সমিতি, ঢাকায় অনুশীলন সমিতি, ময়মনসিংহের সুহৃৎ সমিতি ও সাধনা সমিতি, ফরিদপুরের ব্রতী সমিতি এবং কোলকাতার অনুশীলন সমিতি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়। উপরন্তু অশ্বিনীকুমার দত্ত, কৃষ্ণকুমার মিত্র, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী, সুবোধ চন্দ্র, বসুমল্লিক, মনোরঞ্জন গুহ ঠাকুরতা, সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, পুলিনবিহারী দাস, ভূপেশচন্দ্র নাগ এবং শচীন্দ্র প্রসাদ বসু এই ৯ জন চরমপন্থী বর্ণহিন্দু নেতাকে গ্রেফতার করে বাংলার বাইরে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে জাতীয় কংগ্রেসের ভূমিকার একটা সমীক্ষা বিশেষ সমীচীন মনে হয়। আলোচনার সুবিধার জন্য সমসাময়িককালে কংগ্রেসের সভাপতির পদে যাঁরা অধিষ্ঠিত ছিলেন, তাঁদের নামের উল্লেখ বাঞ্ছনীয় হবে। এঁরা হচ্ছেনঃ

(১) স্যার হেনরী কটন (বোম্বাই ১৯০৪ )

(২) গোপালকৃষ্ণ গোখলে (বারানসী ১৯০৫)

(৩) দাদাভাই নওরোজী (কলিকাতা ১৯০৬)

(৪) রাসবিহারী ঘোষ (সুরাট ১৯০৭)

(৫) রাসবিহারী ঘোষ (মাদ্রাজ ১৯০৮)

(৬) মদনমোহন মালব্য (লাহোর ১৯০৯)

(৭) স্যার ডব্লিউ (ওয়েডারবার্ণ এলাহাবাদ ১৯১০)।

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং নথিপত্রে দেখা যায় যে, ১৯০৬ সালে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে ‘বংগভংগ’ প্রশ্নটি নিয়ে নরম ও চরমপন্থীদের মধ্যে উত্তপ্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। নরমপন্থীরা কিছুতেই ‘একটা আঞ্চলিক প্রশ্নে’ ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে চূড়ান্ত বোঝাপড়া করতে রাজী নয় এবং নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী। অন্যদিকে চরমপন্থীরা ‘স্বদেশী’ ও ‘বয়কট’ আন্দোলনকে আরও সর্বাত্মক করে গড়ে তুলতে আগ্রহী। শেষ পর্যন্ত দাদাভাই নওরোজী কংগ্রেসের কোলকাতা অধিবেশনে উভয় পক্ষকে সন্তুষ্ট করার জন্য এ মর্মে ঘোষণা করলেন যে, কংগ্রেসের মূল লক্ষ্য হলো ‘স্বরাজ’ অর্জন করা। কিন্তু ১৯০৭ সালে সুরাট কংগ্রেসে উভয়পক্ষের শক্তি পরীক্ষা হলো। চরমপন্থীরা “হিন্দু ধর্মরাজ্যে বিশ্বাসী” মারাঠা ব্রাহ্মণ বাল গংগাধর তিলককে সভাপতির প্রার্থী মনোনয়ন করলে কংগ্রেসের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো হাতাহাতি এবং পরে মারপিট সংঘটিত হয়। এরই জের হিসেবে চরমপন্থীরা কংগ্রেস ত্যাগ করলে রাসবিহারী ঘোষ ১৯০৭ সালে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। কৌতূহলী পাঠকদের কাছে এখানে একটা তথ্য উল্লেখ করতে চাই যে, ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্মলগ্ন থেকে যে ব্যক্তি এক নাগাড়ে ২৭ বছর অর্থাৎ ১৯১২ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু এই প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজ আইসিএস রাজপুরুষ— নাম এ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম (১৮১৯-১৯১২)।

এজন্যই সেদিন সর্ব ভারতীয় ভিত্তিতে অবাঙালি বর্ণহিন্দু ও পার্শী সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ ইংরেজ সহযোগিতায় নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করার বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে বাধ্য হলেন এবং বাঙালী বর্ণহিন্দুদের বংগভংগ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রকারান্তরে অপারগতা প্রকাশ করলেন। ইতিহাসে মোটামুটিভাবে এদেরই নরমপন্থী কংগ্রেসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১৯০৭ সালে সুরাট কংগ্রেসে চরমপন্থীদের মোকাবিলায় এঁরা বিজয়ী হয়েও বাইরে কংগ্রেসের ভাবমূর্তিকে অক্ষুণ্ণ রাখার কৌশল হিসেবে নরমপন্থী বাঙালি বর্ণহিন্দু নেতা রাসবিহারী ঘোষকে উপর্যুপরি দু’বছর পার্টির সভাপতি নির্বাচিত করেছিলো।

তৃতীয়তঃ নবগঠিত ‘পূর্ববংগ ও আসাম’ প্রদেশ-এর কাজকর্ম শুরু হওয়ার স্বল্প দিনের ব্যবধানে ভারতের বড়লাট বংগভংগের প্রবক্তা লর্ড জর্জ ন্যাথানিয়াল কার্জন এবং এই নতুন প্রদেশের প্রথম লেঃ গভর্নর স্যার জোসেফ বি ফুলারের বিদায় গ্রহণ প্রসংগ। লর্ড কার্জন ১৯০৪ সালে দ্বিতীয় দফায় গভর্নর জেনারেল হিসেবে ভারতে আগমনের অব্যবহিত পরেই প্রধান সেনাপতি লর্ড কিচেনারের সংগে মতবিরোধের প্রেক্ষিতে ১৯০৫ সালে পদত্যাগ-পূর্বক দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এদিকে বংগভংগ বিরোধী আন্দোলনের সংগে সিরাজগঞ্জের ভিক্টোরিয়া এবং বানোয়ারীলাল নামক বিদ্যালয় দু’টির শিক্ষকরা সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকায় নবগঠিত প্রদেশের লেঃ গভর্নর ফুলার অবিলম্বে আলোচ্য বিদ্যালয় দু’টির সরকারী অনুদান বন্ধ করে দেয়ার জন্য কোলকাতায় (তখনও পর্যন্ত ‘পূর্ববংগ ও আসাম প্রদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কোলকাতা থেকেই নিয়ন্ত্রিত হতো) চিঠি লিখেন। নতুন বড়লাট লর্ড মিন্টো এই সুপারিশ অগ্রাহ্য করলে নবগঠিত পূর্ববংগ ও আসাম প্রদেশের প্রতিষ্ঠাতা লেঃ গভর্নর স্যার জোসেফ বি, ফুলার (১৮৫৪-১৯৩৫) ১৯০৬ সালের ৩রা আগস্ট পদত্যাগ করেন। পরবর্তীতে ফুলারের অবদানকে স্মরণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে ‘ফুলার রোড’।

এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯০৬ সালে বৃটেনের পার্লামেন্ট নির্বাচনে উদাননৈতিক দলের ঐতিহাসিক বিজয়ের ফলশ্রুতিতে ভারত সাম্রাজ্যের প্রতি ইংরেজ সরকারের নীতির আমূল পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তিত নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উদারনৈতিক নেতা গ্ল্যাডস্টোনের জীবনীকার জন মর্লেকে ভারত সচিব এবং ক্যানাডায় কর্মরত প্রতিভাবান ইংরেজ ব্যক্তিত্ব লর্ড মিন্টোকে ভারতের গভর্নর জেনারেল নিয়োগ করা হয়। এই জুটি ১৯০৫ সালের শেষার্ধ থেকে শুরু করে ১৯১০ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। তবে বঙ্গভঙ্গ রদের দায়িত্ব পালনে এঁদের প্রায় পাঁচ বছরের সময়ের প্রয়োজন হয়। এরমধ্যে সিমলা সম্মেলনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৯০৯ সাল নাগাদ মিন্টো-মর্লে সংস্কার আইনের মাধ্যমে উত্তর ভারতীয় অবাঙালি মুসলিম অভিজাত নেতৃবৃন্দকে নিরপেক্ষ করা এবং নওরোজী-গোখলে চিন্তাধারার অবাঙালি নরমপন্থী কংগ্রেসী নেতাদের সংগে সমঝোতা সৃষ্টি করতে হয়।

চতুর্থতঃ বংগীয় এলাকার বর্ণহিন্দু জমিদার, ইংরেজী শিক্ষিত বর্ণহিন্দু নেতৃবৃন্দ ও শিক্ষিত বেকার হিন্দু যুব সম্প্রদায় মূলতঃ ৫টি কারণে বংগভংগের তীব্র বিরোধিতা করে। এগুলো হচ্ছে:

১। কোলকাতার ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এ মর্মে আশংকা প্রকাশ করলো যে, পূর্ববংগ আসাম প্রদেশের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে অনেক সস্তা হবে বলে অনেক ব্যবসা-বাণিজ্যই শীঘ্র চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হবে। (সূত্রঃ বেংগল চেম্বার অব কমার্স-এর সেক্রেটারী শ্রীনাথ রায় কর্তৃক বাংলা সরকারের নিকট ১৯০৪ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারীর চিঠি)।

২। কোলকাতার আইনজীবীরা এজন্য ভীত হলেন যে, ঢাকায় একটি নতুন হাইকোর্ট স্থাপিত হতে যাচ্ছে এবং এতে করে বহু মক্কেল হাতছাড়া হয়ে যাবে। (সুত্রঃ ভারতের বড়লাট (১৯০৫-১৯১০) লর্ড মিন্টো কর্তৃক লণ্ডনস্থ উদারনৈতিক ভারত সচিব (১৯০৫-১৯১০) লর্ড জন মর্লের নিকট ১৯০৬ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী লিখিত পত্র)।

৩। কোলকাতাস্থ সংবাদপত্রের মালিকগণ এজন্য চিন্তিত হলেন যে, অচিরেই ঢাকা থেকে পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু করবে এবং সেক্ষেত্রে কোলকাতার খবরের কাগজের প্রচার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পাবে (দি বেংগলী, কলিকাতা, ১৯০৫ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর সংখ্যা)।

৪। কোলকাতায় আরাম-আয়েশের মধ্যে বসবাসকারী যেসব বর্ণহিন্দু জমিদারের জমিদারী এলাকা পূর্ব ও পশ্চিম বংগে রয়েছে, তাঁরা এ মর্মে আতংকগ্রস্ত হলেন যে, তাঁদের নিয়মিত খাজনা আদায়ের জন্য ঢাকায় পৃথক অফিস বসাতে হবে এবং তা ব্যয়বহুল হতে বাধ্য। উপরন্তু পূর্ব বঙ্গের মুসলিম কৃষকদের পক্ষে কালক্রমে খাজনা বন্ধ আন্দোলন শুরু করারও সম্ভাবনা বিদ্যমান (বৃটিশ ইণ্ডিয়া এসোসিয়েশনের সেক্রেটারী প্রদ্যুত কুমার ঠাকুর কর্তৃক ১৯০৪ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারী বাংলা সরকারের নিকট লিখিত চিঠি)।

৫। কোলকাতা-কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু রাজনীতিবিদদের মনে এ মর্মে ধারণা বদ্ধমূল হলো যে, নয়া প্রদেশে বিপুলসংখ্যক বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর ভাগ্য স্থানান্তরিত হওয়ার প্রেক্ষিতে তাঁদের ক্ষমতা ও প্রভাব সংকুচিত হতে চলেছে (১৯০৬ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারী বড়লাট লর্ড মিন্টো কর্তৃক লণ্ডনে ভারত সচিব লর্ড মর্লের নিকট প্রেরিত চিঠি)।

প্রায় ৮০ বছর পর আগা খানের এই ডেপুটেশন সম্পর্কে একটা পরিচ্ছন্ন মূল্যায়ন করা অপরিহার্য মনে হয় এবং সেক্ষেত্রে নিম্নোক্ত ৪টি সম্প্রদায়ের চিন্তাধারার উল্লেখ বিশেষ বাঞ্ছনীয় :

ক) যে সব প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘুঃ সিমলা সম্মেলনে প্রস্তাবিত পৃথক নির্বাচনের মাধ্যমে কেন্দ্র ছাড়াও প্রদেশগুলোতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের রক্ষাকবজের ব্যবস্থা করায় এঁরা সেদিন সন্তোষ প্রকাশ করেন।

খ) নবগঠিত পূর্ববংগ ও আসাম প্রদেশের সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায় : প্রস্তাবিত কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে মুসলমানদের আসন সংরক্ষণের বিষয়টি লাভজনক হলেও প্রাদেশিত পরিষদে এই প্রদেশের সংখ্যাগুরু মুসলমানদের আসন সংরক্ষণ ইত্যাদি রক্ষাকরজের প্রশ্নই ওঠে না। এজন্য পাকিস্তান আমলেও বাঙালি মুসলমানরা যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে সোচ্চার ছিলো। ১৯০৫-০৬ সালে বাঙালি মুসলমানদের দ্রুত সমৃদ্ধির লক্ষ্যে যেটা ছিলো জীবন-মরণের প্রশ্ন তা হচ্ছে নবগঠিত ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ প্রদেশের স্থায়িত্বকরণ। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে ১৮ মিলিয়ন বাঙালি মুসলমানের বিরাট সংখ্যাকে ব্যবহার করেও সেদিন আগা খান ডেপুটেশনে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ প্রদেশের স্থায়িত্বকরণের প্রশ্নটি ছিলো অনুপস্থিত

গ) বাংলার বাইরে সর্বভারতীয় ভিত্তিতে এদেশীয় উঠতি পুঁজিপতিদের স্বার্থে অবাঙালি হিন্দু ও পার্শী সম্প্রদায় : জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে এই নরমপন্থী নেতৃবৃন্দ এ সময় গোষ্ঠী স্বার্থে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে একটা বোঝাপড়ার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে এতো বেশী আগ্রহান্বিত ছিলেন যে, সেদিন এঁরা ‘সিমলা বৈঠক’কে ততটা গুরুত্ব প্রদান করেননি বলা যায়।

ঘ) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে লিপ্ত ইংরেজী শিক্ষিত বাঙালি বর্ণহিন্দু ও জমিদার শ্রেণী : নবগঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের জমিদারী হাতছাড়া হয়ে যাবে এবং অন্যান্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রশ্নে এসব নেতা সেদিন এতো বেশী উগ্র হয়ে উঠেছিলেন যে, ১৯০৭ সালে সুরাট কংগ্রেসে পরাজিত হবার পরও এঁরা বঙ্গীয় এলাকায় বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনকে শুধু তীব্রতর করে তুলেছিলেন তাই-ই নয়, বাংলার বুকে সৃষ্টি হলো হিন্দু সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন। এঁরা সেদিন আগা খানের ডেপুটেশন এমনকি সর্বভারতীয় ভিত্তিতে নেতৃত্ব হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার প্রশ্নটি অগ্রাধিকার দেয়ার কথা পর্যন্ত বিবেচনা করেননি।

এ সম্পর্কে পশ্চিম বাংলার বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্যের উল্লেখ সমীচীন মনে হয়। তিনি লিখেছেন, “কিন্তু আশ্চর্যের কথা, সমকালীন জাতীয়তাবাদী নেতাদের কেউই সিমলায় মুসলমান প্রতিনিধি দলের প্রকৃত গুরুত্ব বুঝতে পারেননি। একদিকে চরমপন্থী গোষ্ঠীর নেতারা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে এতটা নিমগ্ন ছিলেন যে, এই প্রতিনিধি দল প্রেরণের ঘটনা তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। অন্যদিকে নরমপন্থী নেতৃবৃন্দের প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্কার সাধনের ব্যাপারে বেশী আকৃষ্ট হওয়ার ফলে সিমলা সম্মেলনের (মিন্টো-আগা খাঁ বৈঠক) তাৎপর্য সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর-এ আহূত জাতীয় কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশনে সিমলা সম্মেলনের কোন উল্লেখ ছিল না। …..তবে অমৃতবাজার পত্রিকায় (৪ অক্টোবর ১৯০৬) সিমলা সম্মেলন সম্পর্কে কটূক্তি দেখা যায়” (আধুনিক ভারত প্রথম খণ্ডঃ পৃষ্ঠা ১৩৯-১৪০, কলিকাতা)।

এক্ষণে উপমহাদেশের সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা অপরিহার্য মনে হয়। ইতিহাসে বর্ণিত তথ্য থেকে দেখা যায় যে, উপমহাদেশে দ্বিতীয় দফায় কট্টরপন্থী ওয়াহাবী আন্দোলনের একেবারে অন্তিম সময়ে দু’টো উল্লেখযোগ্য হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিলো। এর প্রথমটি হয় ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দের ২০শে সেপ্টেম্বর তৎকালীন ইংরেজ ভারতের রাজধানী খোদ কোলকাতা মহানগরীতে। ৪৫ বৎসর বয়স্ক ওয়াহাবী বিপ্লবী মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দে পাঞ্জাব থেকে বিহারের পাটনায় আগমন করেন। এসময় পাটনার দায়রা জজ জাস্টিস প্রিন্সেপ এক মামলায় ওয়াহাবী বিপ্লবী কাজী দীন মুহাম্মদ, মোবারক আলী, আমীর উদ্দিন ও তবারক আলী প্রমুখকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করলে আবদুল্লাহ খুবই মর্মাহত হন। দণ্ডিত ব্যক্তিগণ কোলকাতা হাইকোর্টে আপীল করলে আবদুল্লাহ এই আপীল শ্রবণের জন্য কোলকাতায় আগমন করেন। হাইকোর্টের অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি জাস্টিস মিঃ নর্মান আপীল মামলার রায় প্রদানকালে পূর্বের দণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। ফলে ওয়াহাবী স্বেচ্ছাসেবক আবদুল্লাহ প্রধান বিচারপতি মিঃ নর্মানকে হত্যার মাধ্যমে প্রতিশোধ গ্রহণের সংকল্প গ্রহণ করেন। ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দের ২০শে সেপ্টেম্বর দুপুর ১১টার কোলকাতা টাউন হলের সোপানে মুহাম্মদ আবদুল্লাহ সুতীক্ষ্ণ ছোরার আঘাতে বিচারপতি নর্মানকে হত্যা করেন। পরে আবদুল্লাহর ফাঁসি হয়।

মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দের ৮ই ফেব্রুয়ারী কালাপানির দেশ আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের হেপ টাউন-এ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগকারী এক পাঠান ওয়াহাবী বিপ্লবী শের আলী খান ভারতের বড়লাট লর্ড মেয়োকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। কট্টরপন্থী ওয়াহাবীদের দ্বিতীয় দফা আন্দোলনের এটাই হচ্ছে সর্বশেষ হত্যাকাণ্ড। আন্দামানের ভাইপার দ্বীপের কারাগারে ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ই এপ্রিল ওয়াহাবী বিপ্লবী শের আলীর ফাঁসি হয়। অবশ্য এর মধ্যেই ইংরেজী শিক্ষা এবং ইংরেজ সরকারের সংগে সহযোগিতা প্রদান সংক্রান্ত মওলানা কেরামত আলী জৌনপুরীর ঐতিহাসিক ‘ফতোয়া’ জারি হওয়ায় উপমহাদেশের মুসলিম রাজনীতি নতুন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে।

মহারাষ্ট্রে প্রথম সন্ত্রাস আন্দোলন

আগেই উল্লেখ করেছি যে, ভারত উপমহাদেশে হিন্দুদের মধ্যে সীমিত আকারে প্রথম বৈপ্লবিক আন্দোলনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। মহারাষ্ট্রে, কোন কোন গবেষকের মতে বাসুদেব বলবন্ত ফাদকে (১৮৪৫-১৮৮৩) নামক মারাঠা ব্যক্তিত্বই হচ্ছেন হিন্দু সন্ত্রাসবাদী এবং বিপ্লবীদের জনক। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, মহারাষ্ট্রের কোলাবা জেলায় জন্মগ্রহণকারী বলবন্ত ফাদকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে রামো জি কোল প্রভৃতি উপজাতিকে সংগঠিত করে বেশ কিছু সন্ত্রাসবাদমূলক কার্যকলাপের প্রস্তুতি গ্রহণ করলেও ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ দরুন তা সফল হয়নি। সশস্ত্র বিপ্লব সংক্রান্ত তাঁর স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় এবং তিনি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন।

এরপরেই মারাঠা ব্রাহ্মণ চরমপন্থী বাল গংগাধর তিলকের (১৮৫৬-১৯২০) কথা বলতে হয়। এঁরই প্রচেষ্টায় পুনায় ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে ফার্গুসন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। গংগাধর তিলক ছিলেন ‘হিন্দু বাহুবল’ ও ‘হিন্দু শৌর্যবীর্যের’ প্রবক্তা। ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষভাগে মূলতঃ এঁরই প্রচেষ্টায় মারাঠা ও বাঙালি বর্ণ হিন্দুদের মধ্যে ‘গণপতি পূজা’ এবং ‘শিবাজী উৎসব’ প্রবর্তিত হয়। ইংরেজদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করে ‘হিন্দু রাজত্ব’ প্রতিষ্ঠা করাই ছিলো চরমপন্থী তিলকের আদর্শ। শিক্ষিত মারাঠা যুবকদের মধ্যে এসব আদর্শ প্রচারের লক্ষ্যে শ্রী তিলক “মারাঠা” ও “কেশরী” নামের দু’টো পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। বঙ্গভঙ্গের প্রাক্কালে ইনি কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের চরমপন্থী উপদলীয় অংশের খুবই শ্রদ্ধাভাজন নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ১৯০৭ সালের সুরাট কংগ্রেসে গঙ্গাধর তিলক ছিলেন সভাপতি পদে চরমপন্থীদের প্রার্থী। এরপর ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী সর্বভারতীয় রাজনীতিতে অপর মারাঠা ব্রাহ্মণ এবং নরমপন্থীদের কংগ্রেসী নেতা গোপালকৃষ্ণ গোখলের (১৮৬৬-১৯১৫) পূর্ণ সহযোগিতা লাভ করলে, এর প্রতিদ্বন্দ্বী গংগাধর তিলককে কথিত সন্ত্রাসবাদী কাজের অভিযোগে সুদীর্ঘ ৬ বছরকাল বার্মার মান্দালয় কারাগারে আটক রাখা হয়। কারারুদ্ধ অবস্থায় গংগাধর তিলকের অবিস্মরণীয় গবেষণামূলক কাজ হচ্ছে হিন্দু ধর্মীয় পুস্তক গীতার টিকা-টিপ্পনী সংক্রান্ত বিরাটাকার গ্রন্থ রচনা

এরই পরবর্তীতে মহারাষ্ট্রে ‘বাল সমাজ’ নামে একটি গোপন সমিতি গঠিত হয়। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠান বিশেষ প্রসার লাভ করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত প্রয়াত মারাঠা নেতা বাসুদেব বলবন্ত ফাদকের আদর্শে স্থাপিত হয় হিন্দু বিপ্লবী সংস্থা “আর্যবান্ধব সমাজ।” ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ পাঞ্জাবের চরমপন্থী কংগ্রেসী নেতা লালা লাজপ রায় (১৮৬৫-১৯২৮) এবং ভাই পরমানন্দ এই আর্যবান্ধব সমাজের সঙ্গে যুক্ত হলে এর কর্মকাণ্ড উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় এলাকায় বিস্তৃতি লাভ করে। ১৯০১ সালে বংগীয় এলাকার হিন্দু বিপ্লবীদের সংগে আর্যবান্ধব সমাজের সর্বপ্রথম যোগাযোগ হয়।

এদিকে বিনায়ক দামোদর সাভারকার (১৮৮৩-১৯৬৬) নামক অপর এক মারাঠা ব্রাহ্মণ নেতা ১৯০৪ সালে মহারাষ্ট্রের নাসিক শহরে “অভিনব ভারত সংঘ” নামে একটি বিপ্লবী প্রতিষ্ঠান গঠন করে বিশেষ করে বর্ণ হিন্দু যুবকদের গোপনে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা ছাড়াও বৃটেন থেকে অস্ত্র সংগ্রহে লিপ্ত হন। এদিকে বছর কয়েকের মধ্যে বিনায়ক সাভারকার ইংল্যাণ্ডে গমন করলে তদীয় ভ্রাতা গণেশ সাভারকারও বিপ্লবী রাজনীতিতে যোগদান করেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক পুস্তক রচনার অভিযোগে নাসিকের ইংরেজ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জ্যাকসন এক সংক্ষিপ্ত বিচারে গণেশ সাভারকারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। ফলে ‘অভিনব ভারত সংঘের সদস্যরা ১৯০৯ সালের ২১শে ডিসেম্বর জ্যাকশনকে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের দায়ে তিন জনের ফাঁসি হয়। অবশ্য পুলিশ এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করার সময় একটি আন্তঃপ্রাদেশিক ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করে। এটাই ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে “নাসিক ষড়যন্ত্র মামলা” নামে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। এই মামলায় মোট ২৭ ব্যক্তিকে বিভিন্ন মেয়াদে কঠোর শাস্তি দেয়া হয়েছিলো।

এ সময় খোদ লণ্ডন নগরীতে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা সংঘটিত হয়। বিনায়ক সাভারকারের কর্মকাণ্ডে দারুণভাবে প্রভাবান্বিত ২২ বছরের প্রবাসী ভারতীয় যুবক মদনলাল ধিংড়া (১৮৮৭-১৯০৯) নাসিকের ঘটনাবলীতে উত্তেজিত অবস্থায় তৎকালীন ভারত সচিব লর্ড মর্লের এডিকং স্যার ইউলিয়াম কার্জন উইলীকে লণ্ডনের ইম্পিরিয়াল ইন্সটিটিউটে এক সভায় গুলী করে হত্যা করেন। মদনলাল গ্রেফতার হলে লণ্ডনেই বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়। এরই জের হিসেবে ইংরেজদের হাতে নির্যাতনের আশংকায় ইংল্যাণ্ডের প্রবাসী ভারতীয়রা মদনলালের কর্মকাণ্ডের নিন্দাসূচক প্রস্তাব গ্রহণের লক্ষ্যে লণ্ডনের ক্যাকসটন হলে এক সভার আয়োজন করেন। কিন্তু আলোচ্য সভায় বিনায়ক সাভারকার এ ধরনের প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। বৃটিশ সরকার এই অপরাধে সাভারকারকে গ্রেফতার করে জাহাজযোগে ভারতে প্রেরণের ব্যবস্থা করে। কিন্তু উল্লেখিত জাহাজটি বোম্বাই-এর পথে ফ্রান্সের মার্সাই বন্দরের নিকটবর্তী হলে বিনায়ক সাভারকার সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সাঁতার কেটে উপকূলে পৌঁছার সংগে সংগে ফরাসী পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে ইংরেজ পুলিশের নিকট হস্তান্তর করে। এরপর বন্দী অবস্থায় সাভারকারকে ভারতে আনা হয় এবং বোম্বাই-এর আদালত রাজদ্রোহের অভিযোগে বিনায়ক সাভারকারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। সাভারকার আন্দামানে বন্দী অবস্থায় ১৪ বছর অতিবাহিত করেন।

বিনায়ক সাভারকার সম্পর্কে বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাহিত্যিক মরহুম মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহর মূল্যায়ন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি লিখেছেন, “……তিনিই (সাভারকার) প্রথম ভারতীয় যিনি সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে বিলাতী কাপড় দগ্ধ করিয়াছিলেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় ব্যারিস্টার যাঁহাকে মামলা পরিচালনার জন্য আদালতে প্রবেশ করিতে দেওয়া হয় নাই। তিনিই ভারতের প্রথম বিপ্লবী যাহার জীবনী সম্বলিত বই সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হইয়াছিল। তিনিই ভারতের একমাত্র কবি যিনি কাগজ-কলমের অভাবে কারাগারের দেওয়ালে অঙ্গার দ্বারা কয়েক হাজার লাইন কবিতা রচনা করিয়াছিলেন এবং সম্ভবতঃ তিনিই প্রথম ভারতীয় লেখক যাঁহার পুস্তক মুদ্রিত ও প্রকাশিত হইবার পূর্বেই নিষিদ্ধ ঘোষিত হইয়াছিল। দ্বীপান্তর অবস্থানকালে তাঁহার বৃটিশ বিরোধী মনোভাব মুসলিম বিদ্বেষে রূপান্তরিত হয়।” (আমাদের মুক্ত-সংগ্রাম বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৭৮)

বিনায়ক সাভারকার সম্পর্কে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, আন্দামান থেকে মুক্তিলাভের পর ইনি “হিন্দু রাজ রাজত্ব’ প্রতিষ্ঠা করার আদর্শ সম্বলিত নিখিল ভারত হিন্দু মহাসভার সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। প্রসঙ্গতঃ আরও উল্লেখ করতে হয় যে, প্ৰথম বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে ভারতীয় পুঁজিতে স্থাপিত বোম্বাই এলাকার বিপুলসংখ্যক বস্তু কলগুলির ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটলে মহারাষ্ট্র এলাকায় ইংরেজ বিরোধী সন্ত্রাসবাদীমূলক কার্যকলাপ স্তিমিত হয়ে পড়ে এবং এই এলাকার রাজনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়।

বাংলায় সন্ত্রাস আন্দোলনের গোড়াপত্তন :

মহারাষ্ট্রের পর বংগীয় এলাকায় হিন্দু সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত হলেও এর জন্মকাল সম্পর্কে বেশ কিছুটা বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি পশ্চিম বাংলার বিশিষ্ট গবষেক এ সম্পর্কে লিখেছেন, “অবশেষে বিংশ শতাব্দীর সূচনায় বাংলায় রাজনৈতিক গুপ্ত সমিতি গঠনের প্রকৃত সূচনা। ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতায় তিনটি ও মেদিনীপুরে একটি গুপ্ত সমিতি গঠিত হয়। এই সকল সমিতির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ছিল অনুশীলন সমিতি। অনুশীলন সমিতির ইতিহাসের সঙ্গে প্রমথ মিত্রের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি ছিলেন একজন ব্যারিস্টার এবং ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে তিনি চারবার বিপ্লবী সংস্থা গঠন করার চেষ্টা করেন। অবশ্য অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন সতীশচন্দ্র বসু (২৪শে মার্চ ১৯০২) এবং এই সমিতি শরীর শিক্ষা সংস্থারূপে আত্মপ্রকাশ করে। বঙ্কিম চন্দ্রের “আনন্দ মঠ” গ্রন্থ থেকে এই নাম নেওয়া হয়। সতীশচন্দ্র বসু ও অন্যদের অনুরোধে ব্যারিস্টার প্রমথ মিত্র অনুশীলন সমিতির সভাপতি ও সর্বাধিনায়ক হন।……

“কিন্তু ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দের বংগভংগ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলনের সূত্রপাত হয় এবং এরপর বাংলার বৈপ্লবিক আন্দোলনের নতুন রূপ পরিগ্রহ করে। ডঃ সুমিত সরকার (দি স্বদেশী মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল ১৯০৩-১৯০৮) এই মত পোষণ করেন যে, ১৯০৫ সালে স্বদেশী আন্দোলনের সূচনা না হলে বাংলার বিভিন্ন সমিতি ঊনবিংশ শতাব্দীর সঞ্জীবনী সভার মত স্তিমিত হয়ে পড়তো। কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ারে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বৈপ্লবিক সমিতি গড়ে ওঠে এবং মেদিনীপুর ও ঢাকা জেলায় স্বদেশী আন্দোলন এই সকল বৈপ্লবিক সমিতি দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। এই সময় ঢাকার পুলিনবিহারী দাশের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত অনুশীলন সমিতির যে শাখা গড়ে ওঠে, তা নিয়মানুবর্তিতা ও সাংগঠনিক শক্তির দিক দিয়ে খুব শক্তিশালী ছিল।……..

“কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনের পর বৃটিশ শাসনযন্ত্র বিকল করার উদ্দেশ্যে গুপ্ত হত্যার মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। হিংসাত্মক আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, ভূপেন্দ্র নাথ দত্ত, অবিনাশ ভট্টাচার্য, দেবব্রত বসু ও উপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেন। এই দলের সংগে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন সুবোধচন্দ্র মল্লিক, চারুচন্দ্র দত্ত ও সর্বোপরি অরবিন্দ ঘোষ।…. জনগণের মধ্যে (হিন্দু) বিপ্লবী আদর্শ প্রচারের উদ্দেশ্যে ‘ভবানী মন্দির’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করা হয় (১৯০৫ খ্রীঃ) ধর্মের ভিত্তির উপর বিপ্লবী আন্দোলন সংঘটিত করার উদ্দেশ্যে প্রচারিত হয়।” (আধুনিক ভারত পূঃ ১১০-১১২ কলিকাতা ১৯৮৩)।

মোদ্দা কথায় বলতে গেলে, সে আমলে শেষ পর্যন্ত ঢাকার সন্ত্রাসবাদীরা ‘অনুশীলন’ এবং কোলকাতার সন্ত্রাসবাদীরা ‘যুগান্তর’ এই দু’টি নামের সমিতির মাধ্যমে তাঁদের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে। এক্ষণে বংগভংগের পর কি ধরনের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো সংক্ষেপে তার উল্লেখ করা অপরিহার্য মনে হয়।

১৯০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে নবগঠিত পূর্ব বংগ ও আসাম প্রদেশের লেঃ গভর্ণর বাম ফিল্ড ফুলার এবং পশ্চিম বংগের গভর্ণর স্যার ফ্রেজারকে বোমার আঘাতে হত্যার দু’টি প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়। এরপরেই কোলকাতার চীফ প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার প্রচেষ্টাও সফল হয়নি। ইংরেজ সরকার অনতিবিলম্বে কিংসফোর্ডকে নিরাপত্তার জন্য বিহারের মোজাফফরপুরে বদলী করলে বিপ্লবীরা তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বগুড়া জেলার বিহার গ্রামের রাজনারায়ণ চাকীর পুত্র প্রফুল্ল চন্দ্র চাকী (জন্ম ১৮৮৮) এবং মেদিনীপুর জেলার হবিপুরের ত্রৈলোক্যনাথ বসুর পুত্র ক্ষুদিরাম বসুকে (জন্ম ১৮৮৯) এই হত্যাকাণ্ড সমাধা করার নির্দেশ দেয়া হয়। ১৯০৮ সালের ৩১শে এপ্লির রাতে ৮টার সময় এই দুই বিপ্লবী যুবক মোজাফফরপুরে ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডের বাংলোর সম্মুখে একটি চলন্ত ঘোড়ার গাড়ীর উপর বোমা নিক্ষেপ করলে দু’জন আরোহিনী ইংরেজ ব্যারিস্টার কেনেডির স্ত্রী এবং কন্যা নিহত হন। গ্রেফতার এড়াবার জন্য প্রফুল্ল চাকী নিজের পিস্তলে আত্মহত্যা করেন এবং ১৯০৮ সালে ১২ই আগষ্ট মোজাফফরপুর জেলে ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়। অবশ্য প্রফুল্ল চাকীকে যে গুপ্ত পুলিশ গ্রেফতারের প্রচেষ্টা করেছিলো, বিপ্লবীরা সেই সাব-ইন্সপেক্টর নন্দলাল ব্যানার্জীকে ১৯০৮ সালের ৯ই নভেম্বর কোলকাতায় হত্যা করে। বিপ্লবীদের হাতে অন্য দু’জন নিহত পুলিশ কর্মচারী হচ্ছে বসন্ত চ্যাটার্জী (১৯০৬) এবং শামসুল আলম (১৯১০)।

এদিকে মোজাফফরপুরের হত্যাকাণ্ডের তদন্তকালে পুলিশ কোলকাতার মুরারীপুকুর এলাকায় প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়াও বোমা তৈরীর কারখানা এবং চিঠিপত্র উদ্ধার করে। এসবের সংগে জড়িত হিসেবে অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্র ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত প্রমুখ ৩৪ জনকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। এটাই হচ্ছে বিখ্যাত আলীপুর বোমার মামলা। এই মামলা চলাকালীন সময়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও কানাইলাল দত্ত অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে জেলের মধ্যে রাজসাক্ষী নরেন্দ্রনাথ গোস্বামীকে হত্যা করলে এঁদের দু’জনেরই ফাঁসি হয়। অবশ্য ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জনদাশের প্রচেষ্টায় অরবিন্দ ঘোষ খালাস পেলেও অন্যরা বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত হন। এই মামলায় সরকার পক্ষের আইনজীবী মিঃ নর্টনকে সাহায্য করেছিলেন কোলকাতার ভবানীপুর নিবাসী সরকারী উকিল আশুতোষ বিশ্বাস। ১৯০৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে জনৈক বিপ্লবীর গুলীতে আশুতোষ বিশ্বাস নিহত হন। ভারত স্বাধীন হবার পর এঁরই পুত্র বিচারপতি চারুচন্দ্র বিশ্বাস নেহেরু মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছিলেন।

বাংলার ইতিহাসের এই চাঞ্চল্যকর প্রেক্ষাপটে ১৯০৯ সালে যুগান্তর ও অনুশীলন পার্টি বেআইনী ঘোষণা ও প্রচণ্ড দমননীতির মুখে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়লে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন হতে থাকে। এগুলো হচ্ছে নিম্নরূপ :

(১) ১৯০৭ সালে সুরাট কংগ্রেসে বিপর্যয়ের পর সর্বভারতীয় কংগ্রেসী রাজনীতিতে বাঙালি বর্ণ হিন্দুদের আধিপত্য হ্রাস।

(২) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের ভয়াবহ ব্যাপকতা প্রদর্শন করে বর্ণ হিন্দু জমিদারদের আন্দোলনের সংস্পর্শ ত্যাগ।

(৩) আলিপুর বোমার মামলায় খালাসপ্রাপ্ত বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ কর্তৃক আধ্যাত্ম সাধনা গ্রহণ ও পণ্ডিচেরিতে আশ্রম স্থাপন।

৪) বিপিন চন্দ্র পাল কর্তৃক ইংল্যাণ্ডে পাড়ি জমাবার ছাড়পত্র গ্রহণ।

(৫) অসংখ্য পত্র-পত্রিকা নিষিদ্ধ এবং শতশত বাঙালি হিন্দু বিপ্লবী কারারুদ্ধ এবং অন্যান্যের মধ্যে বিভ্রান্তি ও হতাশা।

(৬) ১৯০৯ সালে মিন্টোমলে সংস্থার আইনে সাম্প্রদায়িক কোটার রাজনীতির প্রবর্তন এবং উত্তর ভারতীয় সংখ্যালঘু মুসলিম অভিজাত শ্রেণীর রক্ষাকবজের ব্যবস্থা।

গবষেক ডঃ সুমিত সরকার সমসাময়িককালে বংগীয় এলাকার রাজনৈতিক পরিবেশের উল্লেখ করে এ মর্মে লিখেছেন যে, ১৯১০ সালে বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেস অধিবেশনে অম্বিকাচরণ মজুমদার তাঁর পঠিত প্রতিবেদনে কাউন্সিলরদের জানান যে, বিগত বছরে অর্থাৎ ১৯০৯ সনে পুরাতন বা নতুন কোন প্রদেশে একটাও জনসভা অনুষ্ঠিত হয়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *