1 of 2

কোর্ট কাছারি ও আইনবিদ

কোর্ট কাছারি ও আইনবিদ 

সমসাময়িক নথীপত্র থেকে আমরা জানতে পারি যে ১৭০৪ খ্রীষ্টাব্দের আগস্ট মাসে কোম্পানি কলকাতায় একটা আদালত স্থাপন করেছিলেন। প্রতি শনিবার সকাল ন’টা থেকে বেলা বারটা পর্যন্ত ওই আদালত বসত। ওই আদালতের শাস্তিবিধান পদ্ধতি ছিল অদ্ভুত। কেননা ১৭০৬ খ্রীষ্টাব্দের আগস্ট মাসে আমরা দেখতে পাই যে কতগুলো চোর ও খুনী আসামী সম্বন্ধে আদালত রায় দিচ্ছে যে তাদের গালে ছেঁকা দিয়ে চিহ্নিত করে নদীর অপর পারে ছেড়ে দিয়ে আসা হউক। বোধ হয় মেয়রস্ কোর্ট স্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত এই আদালত কার্যকর ছিল। 

ইংলণ্ডের রাজা প্রথম জর্জের আমলে এক রাজকীয় সনদানুসারে কলকাতায় ১৭২৬ খ্রীষ্টাব্দে মেয়রস্ কোর্ট স্থাপিত হয়। এই আদালতে বিচারকার্য নির্বাহের জন্য একজন মেয়র ও নয়জন সহকারী বিচারক বা অ্যালডারম্যান নিযুক্ত হত। মেয়রস কোর্টের জন্য কোন নির্দিষ্ট বাড়ী ছিল না। মাসিক ত্রিশ টাকা ভাড়ায় একটা চ্যারিটি স্কুল’ ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। এই স্কুল বাড়ীটার জমির ওপরই বর্তমান সেণ্ট এ .জ চার্চ অবস্থিত। মেয়রস্ কোর্টে প্রধানত ইংরেজদের বিষয়সম্পত্তিঘটিত দাওয়ানী মোকদমারই শুনানী হত এবং এর এলাকা কলকাতার সীমানার মধ্যেই নিবদ্ধ ছিল। এই আদালতের রায় চূড়ান্ত ছিল না। এর ওপরে কোর্ট অভ্ আপীল নামে আর একটা আদালত ছিল। এ ছাড়া, সেকালে কোর্ট অভ্ কোয়াটার সেসনস্ নামে একটা ফৌজদারী আদালতও ছিল। 

১৭৫৩ খ্রীষ্টাব্দের ৮ জানুয়ারী তারিখের এক রাজকীয় সনদ বলে ‘কোর্ট অভ্ রিকুয়েষ্টস্’ নামে এক আদালত স্থাপিত হয়। এখানে প্রথম ২০ টাকার অনধিক দাবীর মুফরাক্কা মামলাসমূহের বিচার হত। এরই বংশধর হচ্ছে বর্তমান ছোট আদালত বা স্মল কজেস কোর্ট। 

দেওয়ানী পাবার পর ইংরেজরা দাওয়ানী ও ফৌজদারী মামলাসমূহ বিচারের ভার নিজেদের হাতে নেন। এজন্য মফস্বলে কোর্ট স্থাপিত হয়। ওই সব কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করবার জন্য কোম্পানি কলকাতায় সদর নিজামত ও সদর দাওয়ানী আদালত স্থাপন করেন। এই আদালতদ্বয় ‘সদর আদালত’ নামে পরিচিত ছিল, এবং এর অবস্থান ছিল বর্তমান সদর স্ট্রীটে, ও পরে রেকোর্সের দক্ষিণে। তারপর ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ২৬ মার্চ তারিখে কলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হয়। পুরানো মেয়রস্ কোর্ট ভবনেই সুপ্রিম কোর্ট প্রথম অবস্থিত হয়। সুপ্রিম কোর্টের একজন প্রধান বিচারপতি ও তিনজন সহকারী বিচারক ছিল। পরে সহকারী বিচারকদের সংখ্যা কার্যত দুই করা হয়। পরে (১৭৮০ থেকে ১৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে) সুপ্রিম কোর্টের জন্য বর্তমান হাইকোর্টের পশ্চিমাংশের ভূমিতে সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব ভবন নির্মিত হয়। এই নূতন ভবনের নীচের তলায় অন্যান্য কোর্টের অধিবেশন হত, আর দোতলায় দায়রা কোর্ট বসত। সুপ্রিম কোর্টের একতিয়ার (Jurisdiction) ছিল মারহাট্টা ডিচের অন্তর্ভুক্ত শহর কলকাতা’। ১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ মে তারিখে হাইকোর্ট গঠিত হবার পর সদর নিজামত আদালত ও সদর দাওয়ানী আদালত সমেত সুপ্রিম কোর্ট তুলে দেওয়া হয়। নবগঠিত হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন স্যার বারনস্ পিকক্। তাঁর অধীনে আরও বারো জন জজ (puisne judges) নিযুক্ত হন। পরের বছর (১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দে) একজন ভারতীয় জজ ও নিয়োগ করা হয়। (পরে দেখুন)। 

বর্তমান হাইকোর্ট ভবনের নির্মাণ কার্য শুরু হয় ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে, আর এর নির্মাণ কার্য শেষ হয় ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসে। এর স্থপতি ছিলেন সরকারী আর্কিটেক্ট মিষ্টার ওয়ালটার গ্র্যানভিল। যে জমিটার ওপর হাইকোর্ট বাড়ীটা তৈরী হয়, তার পশ্চিম ভাগে অবস্থিত ছিল সেকালের সুপ্রিম কোর্টের বাড়ী। পুরানো সুপ্রিম কোর্টের সামনে (পূর্বদিকে) ছিল একটা খুব সরু গলি। ওই গলির পূর্বদিকে (বর্তমান হাইকোর্ট ভবনের পূর্বাংশ) চিল তিনখানা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির বাসভবন। এ তিনটা বসতবাটী ছিল লঙভিল ক্লার্ক, উইলিয়াম ম্যাকফারসন ও জেমস্ উইলিয়াম কলভিল-দের। এঁদের মধ্যে লঙভিল ক্লার্কই ১৮২৫ খ্রীষ্টাব্দে বার লাইব্রেরী স্থাপন করেছিলেন। উইলিয়াম ম্যাকফারসন ছিলেন ১৮৬৪ থেকে ১৮৭৭ পর্যন্ত হাইকোর্টের জজ স্যার আরথার জর্জ ম্যাকফারসনের ভাই। আর জেমস উইলিয়াম কলভিল ছিলেন ১৮৪৬ খ্রীষ্টাব্দে অ্যাডভোকেট জেনারেল ও ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৫ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের জজ। ওই তিনখানা বাড়ী, সরু গলিটা ও সুপ্রিম কোর্টের পুরানো বাড়ী, এ সবই বর্তমান হাইকোর্টের গর্ভে চলে গিয়েছে। 

হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হবার পর এর ওপর অর্পিত হয় সুপ্রিম কোর্টের ‘জুরি- সডিকশন’—তার মানে মারহাট্টা ডিচ বেষ্টিত শহর কলকাতার এলাকা। এটাই হাইকোর্টের ‘অরিজিনাল সাইড’-এর এলাকা। ‘আপীলেট সাইড’-এর ‘জুরিসডিকশন’ রাখা হয় সমগ্র বাঙলা, বিহার, ওড়িষা, ছোটনাগপুর ও আসাম (প্রায় দুই লক্ষ বর্গ মাইল )। পরে স্বতন্ত্র প্রদেশসমূহ গঠিত হবার পর এই ‘জুরিসডিকশন’ সঙ্কুচিত করা হয়। ‘অরিজিনাল সাইড’-এ কোন মামলার মাত্র প্রাথমিক আর্জি পেশ করা হয়। আর ‘আপীলেট সাইড’-এ ভিন্ন ভিন্ন স্থানের নিম্নতর কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল পেশ করা চলে। ফৌজদারী মামলার শুনানী দায়রা অধিবেশনে হয়। 

প্রথমে হাইকোর্টের মাত্র ১২ জন জজ ছিলেন। তারপর এই সংখ্যা বাড়ানো হয়। সূচনায় হাইকোর্টের সব জজই ইংরেজ জজ ছিলেন। ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দে রাজা রামমোহন রায়ের পুত্র রামপ্রসাদ রায়কে প্রথম দেশীয় জজ নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু পদাসীন হবার পূর্বেই তাঁর মৃত্যু ঘটায় শম্ভুনাথ পণ্ডিত নামে একজন কাশ্মীরি ব্রাহ্মণই হাইকোর্টের প্রথম দেশীয় জজ হন। ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে রমেশচন্দ্র মিত্র কিছুদিনের জন্য হাইকোর্টের অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। মুসলমানদের মধ্যে আমীর আলি ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দে হাইকোর্টের প্রথম মুসলমান জজ নিযুক্ত হন। বর্তমান শতাব্দীর সত্তরের দশকে শ্রীমতী জ্যোতির্ময়ী নাগ ও মতী পদ্ম। খাস্তগীর হাইকোর্টের প্রথম মহিলা জজ নিযুক্ত হন। পরে আরও দুজন মহিলা জজ নিযুক্ত হযেছেন। 

হাইকোর্টের উকিলদের আগে ‘ভকিল’ বলা হত। এ ছাড়া ছিল ইংলণ্ডের ‘ব্যারিষ্টার’ ও আয়ারল্যাণ্ডের ‘অ্যাডভোকেট’ (ব্যারিষ্টারের সমগোত্রীয় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এই অর্থে ‘অ্যাডভোকেট’ ছিলেন)। আনুমানিক ষাট বৎসর পূর্বে (২০ নভেম্বর, ১৯২৪ খ্রীষ্টাব্দ থেকে) ‘ভকিল’দের আখ্যা পরিবর্তন করে ‘অ্যাডভোকেট’ রাখা হয়। 

হাইকোর্টের (তার পূর্বগামী সুপ্রিম কোর্ট সমেত) ইংরেজ জজদের মধ্যে স্বানামধন্য হয়ে আছেন উইলিয়াম জোনস্, এলিজা ইমপে, রবার্ট চ্যাম্বারস্, হেনরী রাসেল, বার্নস্ পীকক, আরথার জর্জ ম্যাকফারসন, চালর্স জ্যাকসন,জন প্যাকসটন নরম্যান, ওয়ালটার মরগান, ফ্রানসিস্ উইলিয়াম ম্যাকলীন, উইলিয়াম ডাককিন, এডওয়ার্ড হাইড, জন উডরফ, জন অ্যানষ্ট্রা টার, বাকল্যাণ্ড ও প্যানক্রিজ। আরও অনেক ইংরেজ জজ যাদের নাম এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, তাঁরা হচ্ছেন ফ্রানসিস ম্যাগনাটেন, উইলিয়াম বরোজ, হেনরী ব্লসেট, ক্রিষ্টোফার পুলার, এণ্টনী বুলার, রিচার্ড গার্থ, উইলিয়াম কোমার পেথেরাম, চালর্স বিনি ট্রেভর, জন রাসেল কলভিন, হেনরী উইলমট সেটন, লরেন, পীল, জন হারবার্ট হ্যারিংটন, এডওয়ার্ড রায়ন, চার্লস এডওয়ার্ড গ্রে, গ্রেগরী চার্লস পল প্রমুখ। একজন জজের মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা এখানে উল্লেখ করতে হয়। ঘটনাটা ঘটেছিল ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দে। হাইকোর্টের ‘অরিজিনাল সাইড’-এর ভবনটি তখন তৈরী হচ্ছে। হাইকোর্টের অধিবেশন বসছে টাউন হলে। চীফ জাষ্টিস নরম্যান টাউন হলের সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন। এমন সময় একজন উন্মত্ত মুসলমান তাঁকে হত্যা করে। 

হাইকোর্টের এদেশীয় বিচারপতিদের মধ্যে যাঁরা স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁরা হচ্ছেন শম্ভুনাথ পণ্ডিত, রমেশচন্দ্র মিত্র, আমীর আলি, দ্বারকানাথ মিত্র, চন্দ্রমাধব ঘোষ, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, আশুতোষ চৌধুরী, চারুচন্দ্র বিশ্বাস, মন্মথনাথ মুখোপাধ্যায়, রাধাবিনোদ পাল, ফণিভূষণ বক্রবর্তী, বিনোদচন্দ্র মিত্র, সব্যসাচী মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। বিনোদচন্দ্র মিত্র ইংলণ্ডের প্রিভি কাউনসিলেরও বিচারপতি হয়েছিলেন। 

হাইকোর্টের বিখ্যাত আইনবিদদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রমাপ্রসাদ রায়, শম্ভুনাথ পণ্ডিত, রমেশচন্দ্র মিত্র, আমীর আলি, দ্বারকানাথ মিত্র, কালীমোহন দাশ, হেমচন্দ্ৰ বন্দ্যোপাধ্যায়, ত্রৈলোক্যনাথ মিত্র, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, আশুতোষ চৌধুরী, মন্মথনাথ মুখোপাধ্যায়, রাধাবিনোদ পাল, সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ, চিত্তরঞ্জন দাশ, ব্যেমকেশ চক্রবর্তী, উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ফণিভূষণ চক্রবর্তী, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, কিরণশঙ্কর রায়, শরৎচন্দ্র বসু, তুলসীচরণ গোস্বামী, কুমুদনাথ চৌধুরী, গোপালচন্দ্র সরকার, জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর, তারকনাথ পালিত, রাসবিহারী ঘোষ, দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মলচন্দ্র চন্দ্র, 

নাথ দাস, নৃপেন্দ্রনাথ সরকার, ভূপেন্দ্রনাথ বসু, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, মতী পদ্মা চ্যাটার্জি প্রভৃতি। দুজন স্বনামধন্য ইংরেজ ব্যারিষ্টার যাঁদের সঙ্গে বর্তমান লেখকের আলাপ ছিল, তাঁরা হচ্ছেন ল্যাংফোর্ড জেমস্ ও ডবলিউ কে. পেজ। 

১৭৫৩ খ্রীষ্টাব্দের ৮ জানুয়ারী তারিখের রাজকীয় সনদ দ্বারা কলকাতায় যে কোর্ট অভ্ রিকুয়েষ্ট স্থাপিত হয়েছিল, তারই উত্তরাধিকারী হচ্ছে কলকাতার স্মল কজেস্ কোর্ট বা ছোট আদালত। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ২৬ মার্চ তারিখে যখন সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হয়, তখন প্রেসিডেন্সী টাউনসমূহে (কলিকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ) অবস্থিত কোর্ট অভ্ রিকুয়েষ্টগুলি সুপ্রিম কোর্টের অধীনে ন্যস্ত হয়। রিকুয়েষ্ট-এর মাত্রা ২০ টাকা ও পরে ১০০ টাকার অনধিক দাবীযুক্ত মামলার বিচার করবার অধিকার ছিল। পরে ইহা ৪০০ টাকায় বৃদ্ধি করা হয়। কোর্ট অভ্ রিকুষ্টেস্-এ মামলা করবার অনেক অসুবিধা ছিল, এবং ১৮৩৮ খ্রীষ্টাব্দে ‘ক্যালকাটা ট্রেডারস্ এসোসিয়েশন’ সেগুলির প্রতি কোম্পানির কাউনসিলের প্রেসিডেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তারপর অনেক জল ঘোলা হবার পর সরকার ১৮৫০ খ্রীষ্টাব্দের নয় অম্বর আইন বলে কোর্ট অভ্ রিকুয়েষ্টসকে ‘স্মল কজেস্ কোর্ট, বা ছোট আদালতে পরিণত করে। মামলার দাবীর সীমা ৪০০ টাকায় রাখা হয়। পরে ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে ১০০০ টাকায় ও ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে ২০০০ টাকায় বর্ধিত করা হয়। আগে ছোট আদালত প্রতিদিনই বসত, কিন্তু গ্রীষ্মকালে ১ থেকে ১৫ মে ও শীতকালে ১৫ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আদালত বন্ধ থাকত। বন্ধের সময় জরুরী মামলা সমূহ দায়ের করবার জন্য ১৮৫৪ খ্রীষ্টাব্দে একটি ‘ভেকেশন বেঞ্চ’ সৃষ্টি হয়। 

কোর্ট অভ্ রিকুয়েষ্ট-এর ঋণের টাকা অনাদায়ে জেল দেবার ক্ষমতা ছিল। ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দের ২৯ অকটোবর তারিখের এক সরকারী ঘোষণা থেকে আমরা জানতে পারি যে জেলের পরিমাণ নিম্নলিখিত রূপ ছিল— দশ টাকার ঋণের জন্য এক মাস জেল, পঞ্চাশ টাকা ঋণের জন্য পাঁচ মাস জেল, ২০০ টাকার অধিক ঋণের জন্য এক মাস জেল। ১৮২৭ খ্রীষ্টাব্দে ছোট আদালতের জেলখানায় ৩৪ জন বন্দী ছিল, তার মধ্যে ৬ জন ইরেজ, ৭ জুন মুসলমান ও ২১ জন হিন্দু। এদের ঋণের পরিমাণ ছিল তিন টাকা থেকে ৩৭০ টাকা। বন্দীদের ভরণপোষণের জন্য পাওনাদারদের প্রত্যহ দেড় আনা করে দিতে হত। যদি এই খরচ একদিন দেওয়া না হত, তা হলে বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হত। 

১৮২৮ খ্রীষ্টাব্দে কোর্ট অভ্ রিকুরেষ্ট-এ শপথ গ্রহণ করাবার জন্য একজন গঙ্গাজলী ব্রাহ্মণ ও একজন কোরানী মোল্লা নিযুক্ত হয়। ১৮৪০ খ্রীষ্টাব্দের এক বিবরণী থেকে জানতে পারা যায় যে কোর্ট অভ্ রিকুয়েষ্ট-এর শতকরা ২৫ ভাগ মামলা ওড়িয়া কাপড় ব্যবসায়রা করত। 

আগেই বলা হয়েছে যে কোর্ট অভ্ রিকুয়েষ্ট-এর স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে স্মল কজেস্ কোর্ট বা ছোট আদালত। ছোট আদালত বলবার উদ্দেশ্য এই যে, যে সব মামলা দাবীর পরিমাণ অতিরিক্ত হওয়ার দরুণ স্মল কজেস্ কোর্টে করা যেত না, সেগুলি বড় আদালত বা হাইকোর্টে করতে হত। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর মূল্য স্ফীতির ফলে পাওনাদারদের দাবীর পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায়, হাইকোর্টে এরূপ মামলার বোঝা ক্রমশ বেড়ে যেতে থাকে। হাইকোর্টের ‘অরিজিনাল সাইড’-এ মামলার বোঝা লাঘব করবার জন্য জুডিসিয়াল রিফরম কমিটির সুপারিশক্রমে ও W.B.Acts XX ও XXI of 1953 অনুসারে ১৯৫৭ খ্রীষ্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারী তারিখে কলকাতার টাউন হলে সিটি সিভিল অ্যাণ্ড সেসনস্ কোর্টের উদ্বোধন হয়। উদ্বোধন করেন হাইকোর্টের তদানীন্তন প্ৰধান বিচারপতি পি. বি. চক্রবর্তী। পরে ২ ও ৩ নং হেষ্টিংস স্ট্রীটের (বর্তমানে কে. এস. রায় রোড) বর্তমান ভবনে স্থানান্তরিত হয়। সিটি কোর্টের স্বানামধন্য আইনবিদদের মধ্যে উল্লেখনীয় পূর্ণেন্দুশেখর বসু, এ. কে. মিত্র., এন. বি. ব্যানার্জী, চন্দ্রনারায়ণ লায়েক (পরে হাইকোর্টের জজ), চাঁদমোহন চক্রবর্তী, অশোককুমার চক্রবর্তী, প্রভাতকুমার বোস, ডঃ হেমেন্দ্ৰনাথ দাশগুপ্ত, অশোকলাল বোস, স্নেহেশকুমার সুর, জে. এল. চ্যাটার্জি, বি. বি. মিত্র, এস. এন. দাশগুপ্ত, কে. কে. মিত্র, বি. সি. ঘোষ (সিটি কোর্টের প্রথম প্রধান জজ) বিভুতোষ ব্যানার্জি, বিজয়কৃষ্ণ বসু, কে. সি. মুখার্জি, তিনকড়ি সরকার, উমাপদ মৈত্র, সুনীলকুমার ঘোষ, বৈদ্যনাথ সরকার, নরেশচন্দ্র ব্যানার্জি, শ্যামলেন্দুমোহন রায়, অজিতকুমার বোস, দেবীপ্রসাদ মুখার্জি, সুকুমার গুহ ঠাকুরতা, মনোরঞ্জন দাস, নারায়ণচন্দ্র দাশ শর্মা, বদ্রীনারায়ণ সুর, বৈদ্যনাথ সরকার, প্রশান্তকুমার সিংহ, সৌধেন্দুকুমার বসু, দেবীপ্রসাদ কর, বীরেন্দ্রকুমার গুপ্ত, শচীকান্ত হাজারি (পরে হাইকোর্টের জজ) প্রমুখ। 

আগেই বলা হয়েছে যে হাইকোর্টের জুরিসডিকশন-এর পূর্বসীমা হচ্ছে মারহাট্টা ডিচ বা পরবর্তীকালে তার ওপর নির্মিত সারকুলার রোড (এখন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড ও আচার্য জগদীশচন্দ্র রোড)। সারকুলার রোডের পূর্বদিক যে সকল থানার অন্তর্ভুক্ত, সে সকল অঞ্চল শিয়ালদহ কোর্টের অধীনস্থ। ঠিক কবে শিয়ালদহ কোর্ট স্থাপিত হয়েছিল, তা আমাদের সঠিক জানা নেই। তবে নানারকম অনুমানের ভিত্তিতে নারায়ণচন্দ্র রায় বলেন যে ১৮১৪ খ্রীষ্টাব্দে ১৪নং রেগুলেশন বলে কলকাতার শহরতলীর জন্য যে সকল জেলা আদালত (ডিস্ট্রিক্ট কোর্টস) স্থাপিত হয়েছিল, শিয়ালদহের বর্তমান মুন্সেফ কোর্ট তারই বংশধর। শিয়ালদহের মুন্সেফ কোর্ট ২৪ পরগণার অন্তর্ভুক্ত। উল্লেখনীয় যে ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দের দুই, তিন ও নয় নম্বর রেগুলেশনস্ অনুযায়ী ২৪ পরগণায় দাওয়ানী, ফৌজদারী ও রাজস্ব আদালতসমূহ স্থাপিত হয়েছিল। এই সকল আদালতের একতিয়ার কলকাতা (মারহাট্টা ডিচ বেষ্টিত) শহরের বাহিরে ছিল। ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে ২৪ পরগণার দাওয়ানী আদলত সমূহের এলাকাধীন অধিকার (Jurisdiction) নদীয়া ও হুগলী জেলার ওপর ন্যস্ত হয়। ১৮০৬ খ্রীষ্টাব্দে ২৪ পরগণার দাওয়ানী আদালতসমূহ আবার পুনর্গঠিত হয়। ১৮০৮ খ্রীষ্টাব্দের দশ আইন অনুযায়ী ২৪ পরগণার ম্যাজিষ্ট্রেটকে সুপারিনটেণ্ডেণ্ট অভ্ পুলিশ নিযুক্ত করা হয় ও ১৮১১ খ্রীষ্টাব্দে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ও জেলা জজের পদদ্বয় একত্রিত করা হয়। ১৮১৪ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ নং রেগুলেশন অনুযায়ী ২৪ পরগণাকে দুইভাগে বিভক্ত করা হয়—(১) কলকাতা শহরতলীর অন্তর্ভুক্ত চিৎপুর, মানিকতলা, তেজেরহাট, নৌহাজরি ও সালকিয়া (বর্তমান হাওড়া জেলায় অবস্থিত) ও (২) ২৪ পরগণার অবশিষ্টাংশ। ১৮৩২ খ্রীষ্টাব্দের ৮নং রেগুলেশন অনুযায়ী এই দুই ভাগকে আবার পুনর্মিলিত করা হয়। ১৮৩৪ খ্রীষ্টাব্দে নদীয়া ও যশোহরের কিয়দংশ ২৪ পরগণার সহিত সংযুক্ত করা হয়, এবং ২৪ পরগণাকে দুটি ভিন্ন মেজেষ্টিরিয়াল ভাগে বিভক্ত করা হয়—(১) আলিপুর ও (২) বারাসাত। ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে এই দুই বিভাগকে আবার পুনর্মিলিত করা হয় ও আটটি মহকুমায় বিভক্ত করা হয়। যথা,(১) আলিপুর, (২) বারাসাত, (৩) বারাকপুর, (৪) বারুইপুর, (৫) বসিরহাট, (৬) ডায়মণ্ডহারবার, (৭) দমদম ও (৮) সাতক্ষীরা। ১৯০৪ খ্রীষ্টাব্দে বারাকপুর ও বারাসাতের কিছু অংশকে আলিপুর সদরের অধীনস্থ করা হয়। 

বর্তমানে শিয়ালদহের দাওয়ানী আদালত দুই অংশে বিভক্ত—(১) একজন সাবজজের অধীনে স্মল কজেস্ কোর্ট ও (২) ৫ জন মুন্সেফের কোর্ট। বোধ হয় ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দের নয় নম্বর আইন অনুযায়ী শিয়ালদহের বর্তমান স্মল কজেস কোর্ট গঠিত হয়েছিল, যদিও এর পূর্ব থেকেই যে এর অস্তিত্ব ছিল, তা আইনের নজীর থেকে অবগত হওয়া যায়। অবশ্য ১৮৪০ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে এর নাম ছিল শিয়ালদহ ও হাওড়া দাওয়ানী আদলত। ১৮৪৩ খ্রীষ্টাব্দে হাওড়ায় একটি মুন্সেফ কোর্ট স্থাপিত হয়, এবং তাকে হুগলী জেলা জজের অধীনস্থ করা হয়। 

শিয়ালদহ স্মল কজেস্ কোর্টের বর্তমান এলাকা (jurisdiction) কাশীপুর, চিৎপুর, মানিকতলা, বেলিয়াঘাটা, এণ্টালী, বেনিয়াপুকুর, বালীগঞ্জ, ভবানীপুর, টালিগঞ্জ, আলিপুর, ওয়াটগঞ্জ, গার্ডেনরীচ, করেয়া, একবালপুর, সাউথ পয়েন্ট ও নিউ আলিপুর প্রভৃতি থানাসমূহ। 

শিয়ালদহ কোর্টের স্বনামধন্য আইনজীবিদের মধ্যে উল্লেখনীয় যতীন্দ্রনাথ রায়, তারাপদ ঘোষ, খগেন্দ্রনাথ দে, দেবব্রত মৈত্র, সুধাংশু হোর, শশধর চক্রবর্তী, শরৎচন্দ্র মুখার্জি, মনমোহন মৈত্র, রমেশচন্দ্র গাঙ্গুলী, গিরিজা প্রসন্ন ব্যানার্জি, প্রমোদকুমার ব্যানার্জি, ধীরেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি, দুলালচন্দ্র মুখার্জি, বীরেশচন্দ্র চক্রবর্তী, নারায়ণ চন্দ্র রায়, উপেন্দ্রনাথ রায় প্রমুখ। 

শিয়ালদহে একটি পুলিশ কোর্টও আছে, কিন্তু তা সন্নিহিত স্বতন্ত্র ভবনে অবস্থিত। এখানে মাত্র ফৌজদারী মামলার বিচার হয়। 

কলকাতা শহরের ফৌজদারী মামলার বিচার হয় প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে। ১৯১৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত লালবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টারের পূর্বাংশে প্রেসিডেন্সী ম্যাজিষ্ট্রেটের কোর্ট ও মিউনিসিপ্যাল কোর্ট—এই দুই আদালত অবস্থিত ছিল। ১৯১৪ খ্রীষ্টাব্দের পর কলকাতায় তিনটি প্রেসিডেন্সী ম্যাজিষ্ট্রেটের কোর্ট স্থাপিত হয়। প্রথমটি ব্যাঙ্কশাল ষ্ট্রীটে, দ্বিতীয়টি কিড ষ্ট্রীটে ও তৃতীয়টি জোড়াবাগানে ডাফ্ কলেজের প্রাক্তন ভবনে। ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দে কিড ষ্ট্রীটের আদালত তুলে দেওয়া হয় এবং ওই আদালতের তদানীন্তন ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ B. Keys-কে জোড়াবাগান আদালতে স্থানান্তরিত করা হয়। প্রথমে, তাঁর পদের নাম দেওয়া হয় সেকেণ্ড প্রেসিডেন্সী ম্যাজিষ্টেট, কিন্তু পরে পরিবর্তন করে বলা হয় অ্যাডিশন্যাল চীফ প্রেসিডেন্সী ম্যাজিষ্ট্রেট। ১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দে জোড়াবাগান আদালত তুলে, ওই আদালতকে ব্যাঙ্কশাল ষ্ট্রীটের আদালতের সঙ্গে মিলিত করা হয়। তখন থেকে কলকাতায় একটাই প্রেসিডেন্সী ম্যাজিষ্ট্রেটের কোর্ট আছে। বর্তমানে প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেটের নাম মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট করা হয়েছে। অতীতকালে যে সকল লব্ধপ্রতিষ্ঠ উকিল প্রেসিডেন্সী ম্যাজিষ্ট্রেটের কোর্টে প্র্যাকটিস করে গেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখনীয় মিঃ ম্যানুয়েল, মিঃ ক্র্যাসেনবরো, মিঃ এফ. একস্ ডি. সিলভা, কালী পালিত, তারকনাথ সাধু, যতীন মোহন ঘোষ, সুরেশচন্দ্র মিত্র, কৃষ্ণলাল দত্ত, জ্ঞানচন্দ্র গুহ, পশুপতি ভট্টাচার্য, কেশবচন্দ্র গুপ্ত, দেবেন্দ্রনাথ দাস, মনোজমোহন বোস, সুরেন্দ্রনাথ দত্ত, ললিত মোহন দে, মহেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, সুরেশচন্দ্র পালিত, যোগেন্দ্রনাথ মিত্র প্রমুখ। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *