কোরআনে বর্ণিত মানব-সৃষ্টির বর্ণনা

কোরআনে বর্ণিত মানব-সৃষ্টির বর্ণনা

মানুষের আদি উৎস এবং সময়ের ধারায় মানুষের রূপান্তরের ব্যাপারে কোরআনে যে-সব আয়াত রয়েছে তার মধ্যে বেশকিছুসংখ্যক আয়াতের রয়েছে সুগভীর আধ্যাত্মিক অর্থ ও তাৎপর্য। পক্ষান্তরে, এরমধ্যেও বেশকিছু আয়াতে রয়েছে মানুষের শারীরবিজ্ঞান-সংক্রান্ত দেহ-কাঠামোগত পরিবর্তনের কথা। ড. মরিস বুকাইলি বলেন, আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেচনায় এই পরিবর্তনের বক্তব্যের মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানুষের ক্রমরূপান্তরের তথ্য। এসব আয়াতে একান্ত জাগতিক ভাষা ও ভাবধারার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে যে, মানুষের দেহাবয়বের এই পরিবর্তন তথা রূপান্তর সাধিত হয়েছে পর্যায়ক্রমে। শুধু তাই নয়, কোরআনের বক্তব্য অনুসারে, প্রতিটি পর্যায়ের সেই রূপান্তর বা পরিবর্তনের কাজটি সম্পাদিত হয়েছে–এক যথাযথ প্রক্রিয়ায়, সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে। আর প্রতিবারেই এই ঘটনাটি ঘটেছে মহান স্রষ্টার মহতী ইচ্ছায়। এসব আয়াতে এই কথাটা বেশ কয়েকবারই উচ্চারিত হয়েছে।

উপরের আলোচনায়, একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যখন কোন কিছুর মধ্যে রূপান্তর সাধিত হয়, তখন তা ব্যক্ত করার জন্য বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘ইভ্যুলিউশন’ বা ‘বিবর্তন’ শব্দ বা টার্মটা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ড. মরিস বুকাইলি তাঁর এই গবেষণা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এই ‘বিবর্তন’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন। তবে, এক্ষেত্রে তিনি যে অর্থে ‘বিবর্তন টার্মটা ব্যবহার করেছেন, তা ডারউইনের তথাকথিত ‘বিবর্তনবাদের’ বিবর্তন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

বস্তুত, একের পর এক সংশোধন ও পরিবর্তনের মাধ্যমে একটা চূড়ান্ত গঠন-কাঠামো নির্মাণের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করার জন্যই ড. মরিস বুকাইলি এক্ষেত্রে ‘বিবর্তন’ শব্দ বা টার্মটা ব্যবহার করেছেন। তাঁর ব্যবহৃত এই “বিবর্তনের মূলে রয়েছে সর্বশক্তিমান বিধাতার সেই বক্তব্য যেখানে তিনি ঘোষণা করেছেন যে, নতুন মানব-প্রজাতির আগমনের পথ সুগম করার জন্য তিনি পুরাতন মানব প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটিয়ে থাকেন। এই অধ্যায়ের আলোচনায় কোরআনের যে-সব আয়াত উদ্ধৃত করা হয়েছে, কোরআনের সে-সব আয়াতের বক্তব্য-বিশ্লেষণের দ্বারা এই মূল বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হতে পারে।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মানুষের দৈহিক গঠন-কাঠামোর মধ্যে কোন রূপান্তর যে সাধিত হতে পারে প্রাচীন তাফসীরকারগণ তেমন কোন ধারণা মেনে নিতে পারেননি। তারা অবশ্য পরিবর্তনের কথা যে একেবারে অস্বীকার করছেন, তাও নয়। তারা স্বীকার করেছেন যে, পরিবর্তন ঘটে, তবে সেই পরিবর্তন বা রূপান্তর-ক্রিয়াটা সাধিত হয় শুধু মাতৃগর্ভে মানব-ভ্রূণের ক্ষেত্রে। মানব-ইতিহাসের প্রায় সকলপর্যায়ে মানব-ভ্রূণের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন বা রূপান্তর স্বীকৃত। তবে, কোরআনে মানব-ভ্রূণের রূপান্তর বা পরিবর্তন বলতে সত্যিকারার্থে কি বলা হয়েছে ও কি বুঝানো হয়েছে, একমাত্র আধুনিকযুগে এসে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের দরুন আমরা স্পষ্টভাবে তা বুঝতে সক্ষম হচ্ছি। এই অবস্থায় এখন আমাদের মনে এই প্রশ্ন দেখা না দিয়ে পারছে না যে, পর্যায়ক্রমে মানুষের উৎকর্ষ-বিধানের যে কথা কোরআনে বলা হয়েছে, তা কি শুধু গর্ভাশয়ে মানব-ভ্রূণের ক্রম-পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী, নাকি সেই বক্তব্যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দেহাবয়বের পরিবর্তন ও রূপান্তরের তথ্যও নিহিত রয়েছে?

উল্লেখ্য যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানবজাতির দেহাবয়বগত পরিবর্তন ও রূপান্তরের বিষয়টা আধুনিক জীবাশ্ম-বিজ্ঞান কর্তৃক সমর্থিত এবং এ সম্পর্কে জীবাশ্ম-বিজ্ঞানের প্রমাণ এতবেশি স্পষ্ট যে, তা নিয়ে এখন আর প্রশ্ন উত্থাপনের কোনও অবকাশ নাই। সেই প্রাচীনযুগে বসে যারা কোরআনের তাফসীর রচনা করেছেন, তাদের পক্ষে জীবাশ্ম-বিজ্ঞান-সমর্থিত মানবজাতির দেহগত বৈশিষ্ট্যের এই পরিবর্তনের বিষয়টা ধারণা করা ছিল সম্পূর্ণ অসম্ভব। কেননা, জীবাশ্ম বিজ্ঞানের গোটা ব্যাপারটাই আধুনিক যুগের অবদান। সুতরাং, সে যুগে বসে কোরআনের আয়াতে বর্ণিত মানুষের এই পরিবর্তন বা রূপান্তরের বক্তব্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রাচীন তাফসীরকারদের পক্ষে মাতৃগর্ভে মানব-ভ্রূণের রূপান্তরের বেশিকিছু ধারণা করা কিংবা তার বিকল্প কিছু চিন্তা করার তেমন কোন অবকাশ ছিল না।

এরপর, আধুনিক যুগের সূচনায় এল ডারউইনবাদের সেই বম-শেল’! অবস্থা শেষপর্যন্ত এমন দাঁড়াল যে, অনুসারী-অনুরাগীরা ধরে-বেঁধে ডারউইনের মতবাদকে এমন একটা-কিছু বলে দাঁড় করালেন, যা ডারউইন নিজেও বলেননি; এমনকি ধারণাও করেননি! তবুও, এই ডারউইন-থিওরির উপর আরোপ করা হল সেই তথাকথিত ‘বিবর্তনবাদ’, যে বিবর্তনবাদ’ এ যাবতকালের মধ্যে প্রাণিজগতের ক্ষেত্রে কখনই কার্যকরভাবে প্রমাণিত হয়নি! তথাপি, সেই বিবর্তনবাদকে অনেক টানা-হ্যাঁচড়া করে নিয়েই যুক্ত করা হল মানবজাতির উদ্ভাবন ও ক্রমবিকাশের ইতিহাসের সঙ্গে।

মূলত, ‘মানুষ বানরের বংশধর’ –এই বক্তব্যটা তত্ত্ব হিসেবে বিজ্ঞানের ধারায় আদৌ স্বীকৃত কোন তত্ত্ব নয়; সুতরাং, সত্যনিষ্ঠ বিজ্ঞানীদের দ্বারা সমর্থনের প্রশ্নও অবান্তর। পক্ষান্তরে, সময়ের ধারাবাহিকতায় মানবজাতির দেহাবয়ব বা শারীরিক গঠন-কাঠামোর পরিবর্তন ও রূপান্তরের ধারণাটি শুধু ধারণা হিসেবেই থাকেনি; বরং আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণায় তা সুপ্রমাণিত হয়ে ইতিমধ্যেই সুস্পষ্ট এক মতবাদের রূপ পরিগ্রহ করেছে। এখানেই দুটি সম্পূর্ণ আলাদা ধারণা বা মতবাদ পাওয়া যাচ্ছে।

এক. ডারউইনের থিওরি, যেখানে বলা হয়েছে, মানুষের আদি উৎস হচ্ছে, বানর অর্থাৎ বানরই রূপান্তরের মধ্যদিয়ে মানুষে পরিণত হয়েছে এবং

দুই. দুনিয়াতে মানুষ আবির্ভূত হয়েছে মানুষ হিসেবেই এবং আবির্ভাবের কাল থেকেই নানাপরিবর্তন ও রূপান্তরের মধ্যদিয়ে মানুষ তার বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে। তাছাড়াও, মানুষের সেই রূপান্তর শুধু তার জ্ঞান-বুদ্ধিগত নয় এবং তার শারীরিক গঠন-কাঠামোর দিক থেকেও হয়েছে কার্যকর।

উল্লেখ্য যে, কোরআনের বহুসংখ্যক বাণী ও বক্তব্য মানুষের দৈহিক রূপান্তরের বিষয়টা সমর্থন করে বটে; কিন্তু এসব বাণী ও বক্তব্যে কোথাও বলা হয়নি যে, মানুষ বানরের বংশধর। বলাই বাহুল্য যে, ‘মানুষ বানরের বংশধর’–এই ধারণাটা সঙ্গত কারণেই মুসলিম, ইহুদী ও খ্রিস্টানদের ধর্মীয়বোধ ও ভাবাবেগকে আহত করে। কোরআনের মত একটি সুপ্রতিষ্ঠিত আসমানী কিতাবে এই ধরনের কোন ভিত্তিহীন বিষয় এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অপ্রমাণিত কোন তথ্যের স্থানলাভের ধারণা একান্তই অবান্তর।