কোরআনের মতে মানুষ, মৃত্তিকা ও পানি

কোরআনের মতে মানুষ, মৃত্তিকা ও পানি

নিচে কোরআনের যে দুটি আত উদ্ধৃত করা হচ্ছে, তাতে দেখা যাবে মানবজীবন মাটির সঙ্গে একান্তভাবে সম্পৃক্ত। যথা :

“বরং আল্লাহ তোমাদিগকে উদ্ভূত করিয়াছেন ভূমি হইতে উদ্ভিদের ন্যায়। অতঃপর তিনি ইহাতে তোমাদিগকে ফিরাইয়া লইবেন, এবং তিনি তোমাদিগকে সেখান হইতে বাহির করিবেন–এক (নতুন)। জাত হিসেবে।”–সূরা ৭১ (নূহ), আয়াত ১৭ ও ১৮ (সূত্র নং ১) :

 “এই (জমিন) হইতেই আমরা তোমাদিগকে পরিগঠিত করিয়াছি, এবং ইহাতেই তোমাদিগকে ফিরাইয়া লইব এবং ইহা হইতেই তোমাদিগকে বাইর করিব অন্য সময়ে।”-সূরা ২০ (ত্বাহা), আয়াত ৫৫ (সূত্র নং ২) :

এই আয়াতে মাটি থেকে মানুষের বিকাশের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় যে, মানুষ পুনরায় এই মাটিতেই ফিরে যাবে এবং সেইসাথে এখানে এই ধারণাও দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ্ শেষবিচারের দিনে এই মাটি থেকেই পুনরুত্থান ঘটাবেন। বাইবেলেও একই আধ্যাত্মিক অর্থে ও তাৎপর্যে অনুরূপ বক্তব্যই রয়েছে।

পাশ্চাত্যে (এবং অন্য দেশেও) আরবী ‘খালাকা’ শব্দের তরজমা করা হয় সাধারণত ‘টু ক্রিয়েট’ বা সৃষ্টি করা–এই ক্রিয়াবাচক শব্দ দিয়ে। লক্ষণীয়, কাজিমিরিস্কির সুবিখ্যাত অভিধানে এই ‘খালাকা’ শব্দের আদি বা মূল অর্থ নিম্নমরূপঃ

‘কোন জিনিসকে সমানুপাত বা সৌষ্ঠব দান করা অথবা কোন কিছুকে সমানুপাতে বা সমমাত্রায় নির্মাণ করা।’

সুতরাং, এখানে ‘খালাকা’ শব্দের অর্থ যদি শুধু সৃষ্টি করা বলে উল্লেখ করা হয়, তাহলে এই অর্থের একান্ত সরলীকরণ করা হয় মাত্র। আর এভাবে ‘খালাকা’ শব্দের অর্থ যখন শুধু সৃষ্টি করা লেখা হয় বা বলা হয়, তখন তাতে শুধু সৃষ্টির কাজটাকেই বুঝায় ও নির্মাণকর্মে অনুপাত ও মাত্রা প্রদান এবং সৌষ্ঠবদানের কথাগুলো উহ্যই থেকে যায়। এ কারণেই ‘খালাকা’ শব্দের দ্বারা যা-কিছু বলা হয়েছে–সেই অর্থই শুধু তাকে তার মূল অর্থের কাছাকাছি নিতে পারে। এ কারণে এই শব্দটির প্রাচীন আরবী ব্যবহারের দিকে দৃষ্টি রেখেই প্রায় সব অনুবাদে খালাকা’ শব্দের অনুবাদ করা হয়েছে ‘টু ফ্যাসন’ বা ‘সৌষ্ঠব দান’, ‘পরিগঠন’ কিংবা শুধু ‘গঠন’ শব্দের দ্বারা।

মানুষ মৃত্তিকা থেকে পরিগঠিত–কোরআনের এই বক্তব্যের সকল আধ্যাত্মিক তাৎপর্য অটুট রেখেও বলা চলে, এই তাৎপর্যের দ্বারা আধুনিক যুগে মানুষের দেহ-গঠনের যেসব রাসায়নিক উপাদানের কথা বলা হয়, সেই অর্থও একেবারে খারিজ হয়ে যায় না। (মানবদেহ পরিগঠনের প্রয়োজনীয় রাসায়নিক এই উপাদান বা উপকরণ যাই বলা হোক, তা কিন্তু মাটির সারনির্যাস থেকেই পাওয়া সম্ভব। তাছাড়া, এসব উপাদান বা উপকরণ কখনো নিমূল হয় না বা হারিয়ে যায় না। যেমন, অ্যাটমিক উপাদান যেগুলো মলিকুল তৈরি করে থাকে। অন্যকথায়, যেসব উপাদান ও উকপরণে মানবদেহ পরিগঠিত সে-সব কমবেশি মৃত্তিকায় বিদ্যমান।)

যে-কালে কোরআন নাজিল হয়েছিল, তখনকার মানব-সমাজকে বুঝাবার জন্য তাদের মেধা ও জ্ঞানের উপযোগী করে মানুষ মৃত্তিকা দ্বারা পরিগঠিত’ বলে যে কথাটা বলা হয়েছিল, সে কথাটাই এখন এভাবে আধুনিক বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক গবেষণায় সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অর্থাৎ, মানবদেহ পরিগঠিত হয়েছে মৃত্তিকার সারনির্যাস বা মধ্যস্থিত উপাদান সহযোগে। কোরআনের বেশ কয়েকটি আয়াতে এ কথাটা আরো স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে এবং সেখানে মানবদেহ পরিগঠনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান ও উপকরণকে আখ্যায়িত করা হয়েছে নানাভাবে। যথা :

“তিনিই (আল্লাহ) তোমাদের উদ্ভব ঘটাইয়াছেন জমিন হইতে।”–সূরা ১১ (হুদ), আয়াত ৬১ (সূত্র নং ৩) :

(জমিন—মৃত্তিকা–আরবী আরদ, ইংরেজি আরথ) এই আরদ্ বা আরথ তথা মৃত্তিকার কথাটাই পুনরায় উল্লিখিত হয়েছে ৫৩নং সূরার (নজম) ৩২নং আয়াতে।

“আমরা তোমাদিগকে গঠন করিয়াছি (বা সৌষ্ঠবদান করিয়াছি) মাটি হইতে।”–সূরা ২২ (হজ্ব), আয়াত ৫ (সূত্র নং ৪) :

মানুষ যে মৃত্তিকা দ্বারা পরিগঠিত, সেই কথাটা এখানে আবারও উল্লিখিত হয়েছে ১৮ নং সূরার (কাহাফ) ৩৭নং আয়াতে; ৩০নং সূরার (রুম) ২০নং আয়াতে; ৩৫ নং সূরা (ফাতের) ১১নং আয়াতে এবং ৪০ নং সূরার (মুমেন) ৬৭ নং আয়াতে।

“(আল্লাহ) সেই একক সত্তা যিনি তোমাদিগকে গঠন করিয়াছেন কর্দম হইতে।”-সূরা ৬ (আনআম, আয়াত ২ (সূত্র নং ৫) :

মানব পরিগঠন প্রসঙ্গে কর্দম (আরবী–তীন) শব্দটি কোরআনের বেশ কয়েকটি আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে। এর দ্বারা মানুষ যেসব উপাদানে পরিগঠিত তা সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। যেমন :

“(আল্লাহ) মানবসৃষ্টির সূচনা করিয়াছেন কর্দম হইতে।”–সূরা ৩২ (সাজদা), আয়াত ৭ (সূত্র নং ৬) :

এখানে যা গুরুত্বপূর্ণ ও লক্ষণীয় তাহল, কোরআন ‘তীন’ বা কর্দম’ থেকে মানবসৃষ্টির সুচনার কথা বলছে। এ থেকে এটা পরিষ্কার যে, সূচনা থেকে ‘শেষ পর্যন্ত এই সৃষ্টির আরো পরবর্তী-পর্যায় বিদ্যমান।

“আমরা তাহাদিগকে গঠন করিয়াছি আঠালো কর্দম হইতে।”–সূরা ৩৭ (সাফফাত), আয়ত ১১ (সূত্র নং ৭) :

এই আয়াতে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় নতুন কোন তথ্য তেমন না থাকলেও, আলোচনার সম্পূর্ণতার জন্য এটি উদ্ধৃত করা হচ্ছে। বলা অনাবশ্যক যে, এখানে মানবসৃষ্টির কথাই বলা হয়েছে।

“(আল্লাহ্) গঠন করিয়াছেন মানুষকে কর্দম হইতে মৃৎশিল্পের মত করিয়া।”–সূরা ৫৫ (রহমান), আয়াত ১৪ (সূত্র নং ৮) :

এই বক্তব্যে আভাস পাওয়া যায় যে, মানুষকে মডেল বা নমুনা অনুযায়ী নির্মাণ করা হয়েছে। পরের আয়াতেও এর উল্লেখ দেখতে পাওয়া যাবে।

“আমরা মানুষকে গঠন করিয়াছি কর্দম হইতে নকশাকাটা নরম মাটি হইতে।”–সূরা ১৫ (হিজর), আয়াত ২৬ (সূত্র নং ৯) :

(হামায়েম মাসনুন-এর আরেক অর্থ ও পচা-গলা কাদামাটি–সুদীর্ঘ সময়কালের যার চেহারা-সুরত পরিবর্তিত ও রূপান্তরিত হয়েছে।)

এই একই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে একই সূরার (হিজর) ২৮-৩৩ আয়াতেও।

“আমরা গঠন করিয়াছি মানুষকে কাদামাটির বিশুদ্ধ সারভাগ হইতে।”–সূরা ২৩ (মুমেনুন), আয়াত ১২ (সূত্র নং ১০) :

আরবী ‘সুলালাত’ শব্দের অর্থ ‘বিশুদ্ধ সারভাগ’–যার দ্বারা কোন কিছু থেকে তার সার-নির্যাস নির্গত করা বুঝায়। এই ‘সুলালাত’ শব্দটি কোরআনের অন্যত্রও ব্যবহৃত হয়েছে এবং সেখানে মানুষের বংশধারা সৃষ্টিতে মানব-বীর্যের সারভাগ বা নির্যাসের কথা বুঝানো হয়েছে। আর এ কথা সর্বজনবিদিত যে, মানুষের তরল বীর্যের একটিমাত্র জীবকোষ, যা সাধারণত শুক্রকীট নামে পরিচিত–সেই একটিমাত্র জীবকোষই মানুষের বংশধারা বিস্তারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে (‘কর্দমের সারভাগ’ বলতে সেইসব রাসায়নিক উপাদানকে বুঝানো হয়েছে যেসব উপাদান আসে পানির সারনির্যাস থেকে এবং যেসব উপাদান কাদার মূল উপকরণ হিসেবে কাজ করে)।

কোরআন পানিকে সকল জীবনের ‘আদি উৎস’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। সেই পানি যে মানবসৃষ্টিতেও অত্যাবশ্যক উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল–সে কথাটাই বর্ণিত হয়েছে নিম্নলিখিত বাণীতে। যথাঃ

“(আল্লাহ) সেই একক সত্তা যিনি মানুষকে পানি হইতে গঠন করিয়াছেন এবং প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন বংশধারা (পুরুষের মাধ্যমে) এবং আত্মীয়তার ধারা নারীদের মাধ্যমে।”-সূরা ২৫ (ফোরকান), আয়াত ৫৪ (সূত্র নং ১১)

কোরআনে অন্যত্র যেমন, এখানেও তেমনি পুরুষ বলতে অনেকে আদমকে বুঝে থাকেন। পক্ষান্তরে, কোরআনের অনেক আয়াতে নারীর সৃষ্টি সম্পর্কেও বর্ণনা রয়েছে। যেমন :

“(আল্লাহ) সেই একক সত্তা যিনি গঠন করিয়াছেন তোমাদিগকে এক ব্যক্তি হইতে এবং তাহা হইতে সৃষ্টি করিয়াছেন তাহার স্ত্রী।”–সূরা ৪ (নিসা), আয়াত ১ (সূত্র নং ১২) :

একই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে ৭নং সূরার (আরাফ) ১৮৯ নং আয়াত এবং ৩৯ নং সূরার (জুমার) ৬নং আয়াতে। এ ছাড়াও ৩০নং সূরার (রুম) ২১ নং আয়াতে এবং ৪২নং সূরার (শূরা) ১১ নং আয়াতে একইবিষয়ের সূত্র টানা হয়েছে একইভাবে।

[এই স্থানে দুটি বিষয় পরিষ্কার করে নেয়া দরকার। (১) সাধারণভাবে বলা হয়, পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে নারীদের সৃষ্টি করা হয়েছে। অনেকসময় কোরআন-হাদিসের বক্তব্য হিসেবেও এই ধারণাটাকে চালিয়ে দেয়া হয়। মূলত, এ বক্তব্য বাইবেলের (দেখুন, পুরাতন নিয়ম, ২ অধ্যায়, বাণী এবং ২২)। সেখানে বলা আছে : “সদাপ্রভু ঈশ্বর আদম হইতে গৃহীত সেই পঞ্জরে এক স্ত্রী নির্মাণ করিলেন” ইত্যাদি। অথচ, বোখারী শরীফের ‘বিবাহ’ অধ্যায়ে, বলা আছে, শেষনবী (দঃ) বলেছেনঃ

“স্ত্রীলোকেরা পাঁজরার (হাড়ের) মত; যদি তোমরা তাকে সোজা করতে যাও তাহলে ভেঙে যাবে–সুতরাং, বাঁকা অবস্থায় তা থেকে ফায়দা গ্রহণ কর।” {আরবীসহ হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বর্ণিত এই হাদিসটির জন্য দেখুন, সহী আল-বোখারী ৫ম খণ্ড, প্রকাশনা–মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, আধুনিক প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৭০।} এখানে কোথাও পুরুষের পাঁজরা থেকে নারী সৃষ্টির কথা বলা নেই; এমনকি হযরত আদম (আঃ) কিংবা বিবি হাওয়ার কথাও নেই। বরং সাধারণভাবে সকল কালের স্ত্রী-জাতির বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে।

(২) কোরআনে যে ‘নাফসেন ওয়াহেদাতেন’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, ডঃ মরিস বুকাইলি তার অর্থ করেছেন–সিঙ্গল পার্সন বা এক ব্যক্তি বলে। মোহাম্মদ মারমাডিউক পিকথল তাঁর জগদ্বিখ্যাত “দি মিনিংস অব দি গ্লোরিয়াস কোরআন’ এ এর অর্থ করেছেন ‘সিঙ্গল সোল’ বা ‘একক আত্মা’। আল্লামা ইউসুফ আলীও তার ‘দি হোলি কোরআনে’ সূরা নিসার ১নং আয়াতের টীকায় এই অর্থ সমর্থন করেছেন। এই নাফসেন ওয়াহেদাতেন-এর আরেক অর্থ ‘অভিন্ন সত্তা” বা ‘একটি প্রাণ’ অথবা একটি ‘জীবকোষ’ও হতে পারে। সেক্ষেত্রে, উপরে উদ্ধৃত আয়াতের অর্থ দাঁড়াবে:

“সেই তিনি যিনি তোমাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন একটি অভিন্ন প্রাণ’ কিংবা একক জীবকোষ হইতে এবং উহা হইতেই সৃষ্টি করিয়াছেন তাহার জোড়া (জাওজ)।”

কোরআনের এই বক্তব্য থেকে, এই অর্থে, মানুষের আদি-পিতা ও আদি মাতার সৃষ্টি-প্রক্রিয়া যে অভিন্ন ছিল, সেই তথ্যই বেরিয়ে আসে।

পূর্বোক্ত কোরআনের আয়াতগুলোর সূত্রে মানুষের আদি উৎস-সংক্রান্ত সুস্পষ্ট বক্তব্য উচ্চারিত হয়েছে–কোরআনের সুবিস্তৃত স্থান জুড়ে। একইসঙ্গে বলা হয়েছে, মৃত্যুর পর মানুষের কি হবে। তাছাড়াও, সেখানে এ কথাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, শেষবিচারের দিনে মানুষকে আবারও দুনিয়ায় ফিরিয়ে আনা হবে। অন্যদিকে, মানবদেহের পরিগঠনে যে-সব উপাদান উপকরণের প্রয়োজন–সে সবের কথাও এসব আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে স্পষ্টভাষায়।