কোম্পানির দুই বিশিষ্ট সায়েব আধিকারিক

কোম্পানির দুই বিশিষ্ট সায়েব আধিকারিক

অনেক লড়াই করে কোম্পানি যেমন কলকাতায় বাণিজ্যকুঠি গড়ে তুলেছিল, তেমনি তার কর্মচারীদের লড়াই করতে হয়েছিল কলকাতাকে বাসযোগ্য করে তুলতে। ঔপনিবেশিক শাসনের অতি বড় সমালোচকও একথা স্বীকার করতে বাধ্য যে, শহর-কলকাতা গড়ে তুলেছিল সায়েবরা। তবে এই প্রচেষ্টা এবং উদ্যোগে বিলেতের কর্তৃপক্ষ বা এদেশে কোম্পানির কর্মকর্তাদের চেয়ে অনেক বেশি অবদান ছিল কোম্পানির ইংরেজ আধিকারিকদের, রবীন্দ্রনাথ যাদের বলেছেন ‘ছোট ইংরেজ।’ এই ছোট ইংরেজ সায়েবদের বেশ কয়েকজন কলকাতার উন্নয়নের জন্য ব্যক্তিগতভাবেই উদ্যোগী হয়েছিলেন, ওপরতলার নির্দেশের অপেক্ষা করেননি। বরং অনেকক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ সংকীর্ণ ঔপনিবেশিক মনোভাবের পরিচয় দিয়ে তাঁদের উদ্যোগে বাধা দিলে তাঁরা কর্তৃপক্ষের কড়া সমালোচনা করতে পিছিয়ে যাননি। ভয় পাননি সরকারি অনুশাসনের রক্তচক্ষুকে। এমনই দু’জন সায়েব আধিকারিকের কথা আলোচনা না করলে কলকাতার সায়েব সমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ অদেখা ছবি আ়ড়ালে থেকে যাবে আমাদের কাছে।

উনিশ শতকে কলকাতার প্রায় সব সায়েবের মধ্যে শাসকজাতির দম্ভ ফুটে উঠলেও, কয়েকজনের মধ্যে উচ্চমন্যতা কিংবা জাতিবিদ্বেষ তেমন নজরে পড়ত না। তাঁরা মনে করতেন, শাসক ও শাসিতের পরস্পরের প্রতি সমীহ ভাব প্রদর্শন এবং মেলামেশা উভয়েরই স্বার্থের অনুকূল। তাঁরা ছিলেন কলকাতার সায়েব সমাজে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। অথচ তাঁরা কখনও ইতিহাসের পাদপ্রদীপে আসতে পারেননি, চাপা পড়ে গেছেন ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সমালোচনার ভারে।

কলকাতায় সায়েবদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং সামগ্রিকভাবে জনস্বাস্থ্যের পথে প্রবল বাধা ছিল এই শহরের উষ্ণ-আর্দ্র জলবায়ু এবং ঘন ঘন মহামারী। মহামারী ভৌগোলিক সীমা মানে না। উত্তর কলকাতার ‘ব্ল্যাক টাউনে’ কোনও রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে, তা ছড়িয়ে পড়ত গোটা শহরে। রেহাই পেত না ‘হোয়াইট টাউনে’র সায়েবরা। উনিশ শতকের প্রথম দিকে সায়েব ডাক্তাররা দাবি করেছিলেন, ক্রান্তীয় অসুখ-বিসুখ নেটিভ এলাকা থেকে ছড়িয়ে পড়ে সায়েব পাড়ায়। কথাটা হয়তো সত্যি ছিল। কিন্তু অসুখ-বিসুখের সূচনা কেন নেটিভ এলাকায় হয়, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয়নি কখনও। যিনি এই কাজের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, তিনি হলেন কলকাতার নেটিভ হাসপাতালের প্রেসিডেন্ট সার্জেন জেমস রেনাল্ড মার্টিন।

ডা. মার্টিন (১৭৯৩-১৮৭৪) ১৮১৭ সালে বেঙ্গল মেডিক্যাল সার্ভিসে যোগ দেন চব্বিশ বছর বয়সে। সম্ভবত ১৮৩৪ কি ১৮৩৫-এ হেমন্তের এক ভোরবেলা, তখনও সূর্যোদয় হয়নি। কলকাতার ঘুম ভাঙেনি তখনও। ডা. মার্টিন কিন্তু অভ্যেসমতো বিছানা ছেড়েছিলেন আঁধার থাকতেই। প্রাতঃভ্রমণে পায়ে পায়ে এগিয়ে চললেন। তাঁর অনুসন্ধিৎসা তাঁকে টেনে নিয়ে গেল বড়বাজারের এক গলিতে। গলিতে ঢুকতেই নাকে-মুখে রুমাল চাপা দিতে হল। ঘ্রাণ-বৈরী আবদ্ধ নোংরা জল দেখে গুলিয়ে উঠল শরীরটা। এরপর শুধু বড়বাজার নয়, ডা. মার্টিন ঘুরে বেড়ালেন কলকাতার বিস্তীর্ণ এলাকায়। বাদ গেল না তখনকার শহরতলি ইন্টালি এবং বালিগঞ্জ। বেছে বেছে গরিব মানুষের কুঁড়ে ঘরে ঢুঁ মারলেন কলকাতার জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য। তথ্যের সন্ধানে চষে ফেললেন চিৎপুর, বাহির সিমলা, কুমোর পাড়া এবং শেয়ালদা।

নানারকম তথ্য সংগ্রহের পর তাঁর মনে হয়েছিল, কলকাতার নেটিভ এলাকায় অসুখ-বিসুখের জন্য প্রধানত দায়ী তাদের সামাজিক অবস্থা। তিনি জানতে চেষ্টা করেন এই স্বাস্থ্যহীনতা ও রোগ-পীড়ার কারণের মধ্যে কলকাতার মানুষের জীবনচর্যা অন্যতম কিনা। বেশ কিছুদিন ধরে তথ্য সংগ্রহ করার পর ১৮৩৭-এ প্রকাশ পেল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Notes on the Medical Topography of Calcutta। গ্রন্থটি উনিশ শতকের কলকাতার জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে অফুরন্ত ও মূল্যবান তথ্যের ভাণ্ডার, যদিও তাঁর দু’-একটি মন্তব্য বিতর্কিত। কিন্তু আজ থেকে একশো আশি বছর, প্রায় দুশো বছর আগে তিনি বিশ্বের মানুষকে সচেতন করতে যে আপ্তবাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেন তার মর্মার্থ আজ এই একবিংশ শতকের বিশ্ববাসী উপলব্ধি করছে প্রতি মুহূর্তে। জে. পি গ্রান্টের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি মন্তব্য করেন, ‘In all countries it is man himself that makes his climate’.

খেয়াল রাখতে হবে, মার্টিন ছিলেন হিতবাদে প্রভাবিত লর্ড বেন্টিঙ্কের বিশেষ অনুরাগী। তিনি মনে করতেন, ইউরোপীয় জ্ঞান ও স্বাস্থ্যবিধি প্রয়োগ করে কলকাতার জনস্বাস্থ্যের হাল ফেরানো যাবে না, যদি নেটিভদের জীবনশৈলীর মজ্জাগত ত্রুটিগুলো থেকে যায়। তিনি ‘ব্ল্যাক টাউন’ বা নেটিভ এলাকার প্রতি কোম্পানি সরকারের চরম উদাসীনতা ও অবহেলা লক্ষ করে ভীষণ অবাক হয়েছিলেন। তবে সেই সঙ্গে কলকাতার মানুষের জীবনচর্যাকে কড়া সমালোচনা করতে ছাড়েননি। এদেশের মানুষের জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে অতীব অনাগ্রহ ও উদাসীনতা লক্ষ করে তিনি বলেন, ‘The natives have yet to learn, in a public and private sense, that the sweet sensatious connected with cleanly habits and pure air are some of the most precious gifts of civilization.’

কলকাতার নেটিভদের বিরুদ্ধে মার্টিনের অভিযোগগুলো একেবারে মিথ্যে ছিল না। নিমাইচাঁদ মল্লিকের নাতি রামরতনের বিয়ের সময় চিৎপুরের দু’মাইল রাস্তায় গোলাপ জলের ছড়া দেওয়া হয়েছিল, নইলে ধুলো উড়বে, দুর্গন্ধ ছড়াবে যে! অথচ রাস্তার ধারে পগারের গায়ে সারি সারি খাটা-পায়খানা। কলকাতার ধনীরা সামাজিক অনুষ্ঠানে অঢেল অর্থ ব্যয় করত, অথচ তাদের প্রাসাদতুল্য বাসভবনের সামনের গলি দিয়ে হাঁটা-চলা দায়, এমন নোংরা আর দুর্গন্ধ। কলকাতার মানুষের স্বাস্থ্যহীনতার জন্য দায়ী এমন একুশটা ত্রুটির কথা মার্টিন তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেন। সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল, ঘিঞ্জি পরিবেশ, নিকাশি ব্যবস্থার অভাব, বিশুদ্ধ পানীয় জলের দুষ্প্রাপ্যতা, অনুপযুক্ত পোশাক, নিরামিষ খাদ্যাভ্যাস, হাসপাতালের অভাব এবং বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ।

মার্টিনের সংগৃহীত তথ্য এবং সুপারিশ নিশ্চিতভাবে প্রভাবিত করেছিল উনিশ শতকে মিউনিসিপ্যালিটির নীতিকে। তাঁর মনে হয়েছিল, নেটিভ এলাকার পুকুরগুলোর জল ব্যবহারে কিছু নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার। যে-সব পুকুরে কাপড় কাচা বা স্নান করা হয়, সেসব পুকুরের জল পান করা নিষিদ্ধ করা উচিত। তাঁর বক্তব্য ছিল, কোনও সম্পত্তি জনস্বাস্থ্যবিরোধী হলে তাতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার বর্তায় না। কলকাতার মানুষের স্বাস্থ্যহীনতা ও পীড়ার জন্য তিনি শহরের পরিবেশকে দায়ী করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, কলকাতার দশ মাইল দক্ষিণে ঘন জঙ্গল পিত্ত জ্বরের উৎস। লক্ষ করেছিলেন, কলকাতার উত্তর-পূর্বে অগভীর লবণ হ্রদ, যার জল সূর্যতাপে শুকিয়ে গেলে মরে পচে যাওয়া মাছের দুর্গন্ধ ভেসে আসে শীতকালে। উপযুক্ত ঢাল ও নিকাশি ব্যবস্থার অভাবে জল আবদ্ধ হয়ে থাকে শহরের মধ্যে। শহরে দিঘি ও পুকুরগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। অনেকগুলো মজে গিয়ে আগাছায় ঢাকা।

মার্টিন খুব খুঁটিয়ে দেখেছিলেন নেটিভ এলাকা এবং সেখানকার মানুষজনকে। তিনি লিখেছেন, সারা বাংলা থেকে মানুষ কলকাতায় আসে রুজি-রোজগারের খোঁজে। খুব সামান্য আয় তাদের। মাসে দু’আনা থেকে দু’টাকা দিয়ে ঘর ভাড়া করে থাকে। অভাবের শিকার হয়ে অর্ধ-উলঙ্গ মানুষগুলো শোওয়ার বিছানা পায় না। স্যাঁত স্যাঁতে মাটির মেঝের ওপর মাদুর পেতে শোয়। কলেরার মতো প্রাণঘাতী অসুখ হলে সঙ্গীরা ওষুধ আনে না। মরণ অবধারিত জেনে ফেলে রেখে আসে নদীর পাড়ে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু হলে চলে যায় শেয়াল-কুকুরের পেটে।

১৭০৭ সালে কোম্পানি কলকাতায় প্রথম হাসপাতাল গড়ে তোলে। সেখানে চিকিৎসা হত সেনা, নৌ-বিভাগের কর্মচারী ও গরিব সায়েবদের। পরে গড়ে ওঠে পুলিশ হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল ও নেটিভ হাসপাতাল। নেটিভ হাসপাতাল ছিল কলকাতার নেটিভদের জন্য। স্থাপিত হয়েছিল ১৭৯৪ সালে। তবে তোড়জোড় শুরু হয় ১৭৯২ থেকে। খেয়াল রাখা দরকার, কোম্পানির কর্তৃপক্ষ জনস্বার্থে তাদের খাজাঞ্চিখানা থেকে একটা পয়সাও খরচ করতে রাজি ছিল না। ১৮০৩-এর ৩০ সেপ্টেম্বর পরিচালক সমিতি কলকাতার কর্মকর্তাদের সাফ জানিয়ে দিয়েছিল, শহরের উন্নয়নের জন্য যা করার জনগণের পয়সায় করবে। প্রয়োজনে কর বসাতে নির্দেশ দেয়। সতর্ক করে দেওয়া হয়, ‘… your expenditure on these accounts must be confined within the limit. ১৮০৫-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি বিলেত থেকে আবার একটা চিঠি আসে। তারা সে চিঠিতে লেখে ‘আমরা বুঝি না জনকল্যাণের জন্য সরকারকে কেন সমস্ত খরচের বোঝা বইতে হবে।’

খোদ বিলেতের কর্তৃপক্ষের এই অনীহা ও অনাগ্রহের কারণে নেটিভ হাসপাতাল গড়ে তুলতে হয়েছিল জনগণের অর্থে। কিন্তু জনগণ কারা? ১৭৯২ থেকে ১৮৩৭ এই পঁয়তাল্লিশ বছরের মধ্যে নেটিভ হাসপাতালের জন্য চাঁদা উঠেছিল ১,৫৮,৬৭০-১-৪ টাকা। চাঁদা দিয়েছিলেন ৪৪১ জন। তাদের মধ্যে মাত্র ১৪ জন ভারতীয়, বাকি সকলে কলকাতার সায়েব। খেয়াল রাখা দরকার, হাসপাতালটা স্থাপিত হয়েছিল নেটিভদের জন্যই। কলকাতার ধনীদের মধ্যে যারা চাঁদা দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর ও রূপলাল মল্লিক। তাঁরা চাঁদা দেন ১০০ টাকা করে।১০

বিভিন্ন কারণে নেটিভ হাসপাতাল কলকাতার বাসিন্দাদের চিকিৎসার পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। ডা. মার্টিন সেজন্য নেটিভ হাসপাতালের সচিবের কাছে তাঁর গ্রন্থটি পাঠিয়ে দিয়ে কলকাতায় একটা ফিভার হাসপাতাল স্থাপনের প্রস্তাব পেশ করেন।১১ মার্টিনের প্রস্তাব নেটিভ হাসপাতালের গভর্নররা প্রথমে আমল দেননি। তাঁরা মনে করেছিলেন, নেটিভরা ইউরোপীয় চিকিৎসা পদ্ধতি এবং হাসপাতালে আস্থা রাখে না। মার্টিন অস্বীকার করেন এই ধারণাকে। তিনি প্রমাণ করেন, শুধুমাত্র কলিঙ্গা ডিসপেনসারিতে ১৮৩৩ সালে ১৯,৫৩৯ এবং ১৮৩৪-এ ২০,৯৮২ জন আবেদনপত্র জমা দিয়েছে চিকিৎসার জন্য। শেষ পর্যন্ত নেটিভ হাসপাতালের গভর্নররা ১৮৩৫-এর ২০ মে টাউন হলে সি. ডবলিউ স্মিথের সভাপতিত্বে মিলিত হন এক সভায়। উদ্দেশ্য, ফিভার হাসপাতাল স্থাপন।১২

মার্টিন অবশ্য শুধুমাত্র জ্বর নয়, সবরকম অসুখের জন্য ফিভার হাসপাতাল চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রথমেই বিতর্ক বাধে ফিভার হাসপাতাল কাদের জন্য তৈরি হবে সেই প্রশ্নকে ঘিরে। পুলিশ হাসপাতালের সার্জেন প্রস্তাব দেন, এই হাসপাতাল তৈরি হোক অবস্থাপন্ন বাবু এবং সায়েবদের ভৃত্যদের জন্য। এ প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। ফিভার হাসপাতালের জন্য যে কমিটি তৈরি হয়েছিল, তাদের বক্তব্য ছিল, বিশাল সংখ্যক মানুষ যখন জ্বর বা অন্য অসুখে পড়ে, নেটিভ হাসপাতাল সামাল দিতে পারে না। তা ছাড়া, ধর্মীয় সংস্কার নেটিভদের বাধা দেয় এই হাসপাতালে আসতে। সেখানে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকলের চিকিৎসা হয়। জাতি-ধর্ম অনুসারে পৃথক চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই।

তোড়জোড় শুরু হল ফিভার হাসপাতাল গড়ে তোলার জন্য। একটা উপসমিতি গঠিত হল। সেখানে কলকাতার গণ্যমান্যদের মধ্য থেকে সদস্য করা হল রামকমল সেন, রাধাকান্ত দেব ও রাজচন্দ্র দাসকে। পরে এই কমিটিতে আনা হয় রাধামাধব বন্দ্যোপাধ্যায়, রসময় দত্ত, মথুরনাথ মল্লিক, মতিলাল শীল, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাত্র তিনজন সভায় উপস্থিত থাকতেন, তা-ও অনিয়মিত। বাকিরা দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। রামকমল সেন তো সদস্যপদে ইস্তফা দেন। রাধাকান্ত দেবও গুটিয়ে নেন সহযোগিতার হাত। শহরের সম্ভ্রান্ত এবং ধনীদের এই উদাসীনতায় আঘাত পেয়েছিলেন ডা. জ্যাকসন। তিনি বলতে বাধ্য হন, ‘I have been at considerable pains to ascertain the feeling of a large portion of the wealthier Natives.’১৩ সায়েব সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, ডা. মার্টিন, ডা. জে. আর ভস, ডা. এ. আর জ্যাকসন, ডা. নিকলসন, স্যার এডওয়ার্ড রেয়ন, স্যার চার্লস গ্রান্ট, লর্ড বিশপ ও আর. ডি. ম্যাঙ্গেলস্।

ডা. মার্টিন আশা করেছিলেন, ফিভার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় সরকারি সাহায্য পাওয়া যাবে। গভর্নর জেনারেল লর্ড অকল্যান্ড মার্টিনের Topographical Notes-এর দ্বারা সম্ভবত প্রভাবিত হয়েছিলেন। অন্তত পরিচালক সমিতিকে লেখা তাঁর চিঠি পড়লে তা বোঝা যায়। কিন্তু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবে ঘাড় কাত করলেও সরকারি সাহায্য অস্বীকারে অনমনীয় হয়ে রইলেন। সরকারি টাকায় হাসপাতাল হওয়াটা তিনি পছন্দ করলেন না। বিলেতে চিঠি লিখে জানালেন, ‘এই শহরের বরাবরের বদ অভ্যেস, সব ব্যাপারে সরকারের ওপর নির্ভর করা। এই ধরনের দাতব্য প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে মুক্ত হস্তে দান-ধ্যানের মাধ্যমে হয়ে থাকে।’১৪ ডা. মার্টিন ওপরওয়ালার এই অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নিতে পারেননি। তিনি কোনওরকম রাখঢাক না করে বলেন, ‘আমি জানি না, জনগণ সরকারকে যে রাজস্ব দিচ্ছে, সেই রাজস্ব তাদের জীবন রক্ষার কাজে ছাড়া অন্য কোনওভাবে তার সদ্ব্যবহার করা যায় কিনা।’১৫ এখানে স্পষ্ট হয়ে যায় কোম্পানির আধিকারিকদের স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি, যার সঙ্গে কলকাতা এবং বিলেতের কর্মকর্তাদের ফারাক ছিল দুস্তর।

গভর্নর জেনারেল একটু নরম হলেন ফিভার কমিটির বিভিন্ন সদস্যের যুক্তির মোকাবিলা করতে না পারায়। কিন্তু বিতর্ক শুরু হল এক অন্য প্রশ্ন ঘিরে। কলকাতার পক্ষে কোনটা উপযোগী, হাসপাতাল না ডিসপেনসারি? সরকারের পছন্দ ছিল ডিসপেনসারি। এই পছন্দের পেছনে ছিল অর্থ-চিন্তা। তবে সেটা গোপন রাখার চেষ্টা করেছিল। বৃহত্তর স্বার্থের অজুহাত দেখিয়েছিল ডিসপেনসারি স্থাপনের ভাবনাকে সমর্থন করার জন্য। তাদের যুক্তি ছিল, নেটিভ হাসপাতালে ৭৬০০ রুগির জন্য বছরে খরচ হয় ২১৮৩৬ টাকা। আর মাত্র ১৭,১৩৫ টাকায় ডিসপেনসারিতে ১,৬১,০০০ রুগির চিকিৎসা হতে পারে। সরকারের অনুমান ছিল, যে টাকা ফিভার হাসপাতালের জন্য খরচ হবে, সেই অর্থ দিয়ে অন্তত সাত-আটটা ডিসপেনসারি চালালে উপকৃত হবে বেশি সংখ্যক গরিব মানুষ। ডা. মার্টিন হাসপাতাল ও ডিসপেনসারির উপযোগিতার মধ্যে পার্থক্যটা দেখিয়ে দিয়ে বলেন, কলকাতার মতো শহরে হাসপাতাল ছাড়া জ্বর এবং আমাশয়ের চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। হাসপাতালে দ্রুত আরোগ্য লাভের ব্যবস্থা থাকে। আলো-বাতাসযুক্ত পরিচ্ছন্ন ওয়ার্ডে উঁচু বিছানা, উপযুক্ত পথ্য সবই হাসপাতালে সুলভ। ডিসপেনসারিতে রুগিকে ওষুধ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করা সম্ভব হয় না। ওষুধ নিয়ে সে ফিরে যায় সেখানেই, যেখানে সে রোগে আক্রান্ত হয়েছিল, যেখানে স্যাঁত-সেঁতে মেঝের ওপর শোয়, সঙ্গীরা যে খাবার আনে তাই খায়, যেখানে পরিচ্ছন্নতা বা খোলা আলো-বাতাসের বালাই নেই।১৬

ডা. মার্টিনকে সমর্থন করেন অন্যান্য চিকিৎসকরাও। ডা. স্টিওয়ার্থ সরকারকে ডিসপেনসারি আঁকড়ে ধরে হাসপাতালের প্রস্তাব এড়িয়ে যেতে দেখে বেশ ক্ষুণ্ণ হলেন। ক্ষোভ চেপে রাখতে না পেরে সোজা-সাপটা বলেই ফেলেন, ‘ডিসপেনসরি নিয়ে আলোচনাটাই দুঃখের ব্যাপার। এই আলোচনার উদ্দেশ্য হল, একটা গুরুত্বপূর্ণ এবং চমৎকার পরিকল্পনা থেকে নগণ্য বিষয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা মাত্র।’১৭ ডা. নিকলসন বলেন, একমাত্র হাসপাতালের পক্ষেই সম্ভব আসন্ন মহামারীর পূর্বাভাস পাওয়া, রোগ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করা এবং মহামারীর সময় কার্যকর ভূমিকা নেওয়া। সবচেয়ে বড় কথা, মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের হাতে-কলমে চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রত্যক্ষ জ্ঞানলাভের সুযোগ করে দিতে পারে একমাত্র হাসপাতালই। চিকিৎসার ক্ষেত্রে সেটা খুব জরুরি।১৮

অবশেষে লর্ড অকল্যান্ডের প্রস্তাব মতো চাঁদা ও দানের রসিদ বই ছড়িয়ে দেওয়া হল চারিদিকে। ফিভার হাসপাতাল কমিটি আশা করেছিল, যেহেতু এদেশের মানুষের জন্য এই হাসপাতালের পরিকল্পনা, তাই তারা সাগ্রহে এগিয়ে আসবে আর্থিক সাহায্য নিয়ে। ডা. মার্টিন ভেবেছিলেন, ১৮৩৩ সালে মহামারীতে কলকাতায় যে বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, সেই ভয়ংকর স্মৃতি মনে রেখে উদ্যোগী হবে কলকাতার নেটিভ-সায়েব সকলেই। স্বেচ্ছায় দান করবে মুক্ত হস্তে। হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য ডা. মার্টিন বাংলার বাইরে মানুষের কাছে, কটক থেকে লুধিয়ানা পর্যন্ত ধনীদের কাছে সাহায্যের আবেদন করতে প্রস্তুত হন। কিন্তু ফিভার কমিটির সভাপতি কলকাতার চিফ ম্যাজিস্ট্রেট ডেভিড ম্যাকফারলান তৃতীয় উপসমিতির প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে মন্তব্য করেন, ‘From the Natives generally we regret to state that our expectations have been greatly disappointed.’১৯ এদেশের ধনীরা দান করেছিলেন, ২৮,৭০০ টাকা, আর সায়েবরা ১৯,০২৩ টাকা, মোট ৪৭,৭২৩ টাকা।১০ কলকাতার বাঙালিরা হাসপাতাল তৈরিতে খুব একটা উৎসাহ দেখায়নি শুধুমাত্র সন্দেহের বশে। মাধব দত্ত এক হাজার টাকা দান করেছিলেন এই শর্তে যে, এক বছরের মধ্যে হাসপাতালের কাজ শুরু না হলে তার টাকা ফেরত দিতে হবে।২১

প্রস্তুতি শেষ। এবার প্রশ্ন উঠল, হাসপাতাল কোথায় হবে। অনেকগুলো প্রস্তাব এল। সেগুলোর মধ্যে ড. ডবলিউ. গ্রাহামের প্রস্তাবটাই মনে ধরল কমিটির। তাঁর প্রস্তাব ছিল, মেডিক্যাল কলেজের আশেপাশে কোথাও হাসপাতাল হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাঁকে সমর্থন করলেন মেডিক্যাল কলেজের সচিব ডেভিড হেয়ার। কলেজ সংলগ্ন জমির মালিক ছিলেন মতিলাল শীল। তিনি দান করলেন জমিটা। ১৮৪৭ সালে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করা হল সরকারের কাছে। লর্ড ডালহৌসি হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। তবে ‘ফিভার’ নামটা পেডিমেন্টের নীচে স্থান পেল না। তাতে লেখা হল, ‘Medical College Hospital’. ১৮৫২ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে রুগি ভর্তি শুরু হল।২২ কলকাতাবাসী পেল শহরের প্রথম আধুনিক হাসপাতাল।

এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, ডা. মার্টিনের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং অন্যান্য শ্বেতাঙ্গ চিকিৎসকদের সম্মিলিত আগ্রহ ও দাবি নিরন্তর চাপ সৃষ্টি করেছিল অনাগ্রহী সরকারের ওপর। সরকার ও ফিভার কমিটির মধ্যে লড়াইয়ের স্বরূপ আন্দাজ করা যায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লেখ্যাগারে সংরক্ষিত General Committee of Fever Hospital and Municipal Improverment শীর্ষক সাত খণ্ডের বিপুল পরিমাণ চিঠিপত্র প্রত্যক্ষ করলে। হাসপাতাল তৈরির সব কৃতিত্বই ডা. মার্টিন ও তাঁর সহযোগী চিকিৎসকদের। কলকাতার মানুষের উচিত ইতিহাসের আলোয় অপ্রকাশিত এই সায়েবদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা।

ডেভিড ম্যাকফারলান (David McFarlan):

অধ্যায়ের শুরুতে কলকাতায় কোম্পানির দুই বিশিষ্ট ইংরেজ আধিকারিকের কথা বলা হয়েছে। ডা. জেমস রেনাল্ড মার্টিনের সমসাময়িক আর একজন হলেন কলকাতার চিফ ম্যাজিস্ট্রেট ডেভিড ম্যাকফারলান। তাঁর কথা আলোচনা না করলে কোম্পানির আমলে কলকাতার এক বিশিষ্ট উন্নতমনা সায়েবের পরিচয় অজ্ঞাত থেকে যাবে চিরকাল।

ম্যাকফারলান ছিলেন একজন স্কটিশ। তাঁর বাবা ছিলেন আইনজীবী। তবে তাঁর পরিবার ছিল একান্তভাবেই কৃষিজীবী। দু’বছর হেইলিবেরিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজে কাটিয়ে ১৮১৬ সালে কলকাতায় আসেন মাত্র উনিশ বছর বয়সে।২৩ ১৮৩০ সালের নভেম্বরে তিনি কলকাতার চিফ ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিযুক্ত হন মাসিক তিন হাজার টাকা বেতনে।২৪ প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাঁকে মাঝে মাঝে কঠোর হতে হয়েছিল। তথাপি তাঁর হয়তো মনে হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘কাছে থাকিব অথচ মিলিব না, এ অবস্থা অনিষ্টকর।’ আর দশজন ইংরেজ প্রশাসক থেকে তিনি স্বতন্ত্র ছিলেন কলকাতার নগরবাসীদের প্রতি তাঁর অ-ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়ে। উন্নত নগর শাসনের প্রকরণ উদ্ভাবন ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। আর তা করতে গিয়ে ওপরওয়ালার অন্যায্য ও পক্ষপাতপূর্ণ আচরণের প্রতিবাদে পিছিয়ে যাননি সরকারি অনুশাসনের ভয়ে।

এটা ঘটনা যে, কলকাতার কর্মকর্তারা সায়েবপাড়া বা হোয়াইট টাউনের স্বাচ্ছন্দ্য নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। নেটিভ বা ব্ল্যাক টাউন ছিল দুয়োরানি। এই বৈষম্যটা ডা. মার্টিনের মতো ম্যাকফারলানও মেনে নিতে পারেননি। ১৮১৭ সালে সরকার ৯৮ জন ভিস্তি নিয়োগের ব্যবস্থা অনুমোদন করেছিল রাস্তা ধোয়ার জন্য। ১৮২০ সালে সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী চৌরঙ্গির ধর্মতলা রোড থেকে পার্ক স্ট্রিট পর্যন্ত রাস্তা ধোয়ার জন্য একদল ভিস্তি নিয়োগ করা হয়। তবে বলা হয় ১৯৬ টাকার বেশি খরচ করা যাবে না। খবরটা জানতে পেরে বিলেতের কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ হন। তারা জানালেন, এটা সরকারি অর্থ অপব্যয় ছাড়া আর কিছুই নয়।২৫ উন্নয়ন কমিটি রাস্তা ধোয়ার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে বোঝালে গভর্নর জেনারেল অবশেষে ওই ১৯৬ টাকায় চৌরঙ্গি এলাকার রাস্তা ধোয়ার অনুমতি দেন।

সরকারি নির্দেশের কথা জানতে পেরে প্রশ্ন তুললেন ম্যাকফারলান। ১৮৩৫-এর ৫ ফেব্রুয়ারি এক চিঠিতে বঙ্গীয় সরকারের সচিবকে স্পষ্ট ভাষায় জানালেন, ‘নেটিভদের অবজ্ঞা করে ইউরোপীয় এলাকায় রাস্তা ধোয়ার ব্যবস্থা করলে সরকার নিশ্চয়ই পক্ষপাতিত্বের অপরাধে অভিযুক্ত হবে। এটা গরিবদের ঠেলে রেখে ধনী ও প্রভাবশালীদের জন্য সাধারণ তহবিল থেকে অর্থব্যয় ছাড়া আর কিছু নয়।’২৬

সমস্যা সমাধানের জন্য ম্যাকফারলান দুটো প্রস্তাব দেন। প্রথম, এ ব্যাপারে সরকার আইন পাশ করে অর্থের ব্যবস্থা করতে পারে। দ্বিতীয়, প্রত্যেক বাড়ির মালিককে বাড়ির সামনের রাস্তা জল দিয়ে ধুতে যাতে বাধ্য হয়, সেই ব্যবস্থা করা। যদি ট্যাক্স বসাতে হয়, তা আট মাসের শুখা মরসুমের জন্য। আর গরিব মানুষ, যাদের বাড়ি ভাড়া মাসে ১০ টাকার কম, তাদের রেহাই দিতে হবে।২৭

কলকাতার মানুষ, বিশেষ করে গরিবদের ওপর কর চাপানোর প্রত্যেকটা প্রচেষ্টায় বাধা দিয়েছিলেন ম্যাকফারলান। ১৮৩৭ সালে টালির নালা এবং সার্কুলার ক্যানালে টোল ট্যাক্স বসানোর প্রস্তাব উঠলে তিনি প্রবল আপত্তি তোলেন। কারণ টোলের টাকা দিয়ে সায়েব পাড়ার নর্দমা পরিষ্কার করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তাঁর বক্তব্য ছিল, ধনীদের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য টোলের টাকা ব্যয় করা অন্যায় চিন্তা। টালির নালা দিয়ে প্রধানত চাল আর কাঠ পরিবহণ করা হত। তাতে মাশুল চাপালে গরিবের একান্ত প্রয়োজনীয় এই ভোগ্যবস্তুর মূল্য ঊর্ধ্বমুখী হবে। সংকটে পড়বে তারা, ধনীরা নয়।২৮

তবে সাধারণভাবে ম্যাকফারলান কর বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ছিলেন না। তিনি মনে করতেন, শহরবাসীর ওপর কর না চাপালে তারা পৌর প্রশাসনে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহী হবে না। কর বৃদ্ধির পক্ষে সওয়াল করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সরকারি ব্যয় হ্রাস করার প্রস্তাবও দেন। তিনি বলেন, ‘যে শহরে গৃহকর হিসেবে পৌরসংস্থার আয় যেখানে বছরে মাত্র দু’লক্ষ টাকা, সেখানে ম্যাজিস্ট্রেটদের বেতনের জন্য বছরে ৯৬০০০ হাজার টাকা খরচ করা অযৌক্তিক।২৯ পৌর প্রশাসনের উন্নতির জন্য তিনি দু’জন কমিশনার নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যাদের বেতন চিফ ম্যাজিস্ট্রেটের বেতন থেকে দেওয়া যেতে পারে।৩০ খেয়াল রাখা দরকার, ম্যাকফারলান স্বয়ং ছিলেন চিফ ম্যাজিস্ট্রেট, একজন খাঁটি সায়েব।

কলকাতা শহরে প্রায়ই বিভিন্ন এলাকায় অগ্নিকাণ্ড ঘটত। এর অন্যতম কারণ, খড়, হোগলা প্রভৃতি দাহ্য বস্তু দিয়ে তৈরি হত গরিবের কুটির। এজন্য ওই দুটি বস্তু দিয়ে কুটির তৈরি নিষিদ্ধ করে আইন পাশ করা হয়। সরকারের এই পদক্ষেপে ভীষণ ক্ষুব্ধ হন চিফ ম্যাজিস্ট্রেট। গভীর আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘Almost all have been against the very poorest and most unfriended of the people. Poor widows and infirm old men have, for putting up a wretched Hooghla or Palm-leaf covering to shelter themselves from the rains, been called up before the magistrate…’৩১ তিনি পুলিশকে সতর্ক করে বলেন, তাদের কোনওরকম অভিযোগ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি এই আইনে। কোনো প্রতিবেশী এই অভিযোগ আনতে পারে। তাঁর আশঙ্কা ছিল, পুলিশকে এই ক্ষমতা দিলে, তার অপব্যবহার হবে। থানাগুলোকে নির্দেশ দেন, পুলিশ যেন আগ বাড়িয়ে কোনও গরিবের বিরুদ্ধে খড়ের বাড়ির জন্য অভিযোগ দায়ের না করে।৩২

হাসপাতাল স্থাপনের প্রশ্নে গভর্নর জেনারেল অকল্যান্ড যখন সরকারের দায়বদ্ধতা এড়িয়ে কলকাতাবাসীর ওপর তার দায় চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, ম্যাকফারলান সরকারকে কাবু করেন তাঁর অভ্রান্ত যুক্তি দিয়ে। তাঁর যুক্তি ছিল, সরকার তো অনেক আগেই এই শহরের নেটিভদের জন্য সম্পূর্ণ সরকারি অর্থে মাদ্রাসা ও সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করেছে। এই দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গৃহ নির্মাণ থেকে শুরু করে বার্ষিক অনুদান হিসেবে লক্ষ টাকার বোঝা বহন করে আসছে। তা হলে হাসপাতাল স্থাপনের ক্ষেত্রে সরকার কেন অর্থ মঞ্জুর করবে না? সে সময় ইংল্যান্ডের অধীন আয়ারল্যান্ডের হাসপাতাল ও ডিসপেনসরিগুলো যে সরকারি সাহায্য পেত, তিনি তার নজিরও তুলে ধরেন।৩৩

কলকাতা শহর ক্রমশ যতই মহানগরী হয়ে উঠছিল, ততই গুরুত্ব পাচ্ছিল নাগরিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রশ্নটা। সেজন্য ম্যাকফারলান পৌরশাসনে কলকাতাবাসীর প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজন উপলব্ধি করেন। তিনি জানতেন, কলকাতার দিশি সমাজ এমন যোগ্য হয়ে ওঠেনি যে, তাদের হাতে পৌর প্রশাসনের গুরুদায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। তথাপি তিনি চাইতেন, প্রশাসনে তারা কিছু অংশগ্রহণ করুক। এ ব্যাপারে কেন উদ্যোগ নেওয়া হবে না, সে প্রশ্নও তিনি তোলেন।৩৪ তাঁর বক্তব্য ছিল, নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের কিছু দায়িত্ব শহরবাসী গ্রহণ করুক, এটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। তারা কমিশনার নির্বাচন করুক যাতে তারা নিজেরাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারে পৌরসংস্থার হিসেবপত্র। যে বিষয়টির সঙ্গে তাদের স্বার্থ এমন প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে, সেটাকে তারা কেন অবজ্ঞা করবে। কলকাতাবাসীকে নাগরিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি তাদের উদ্দেশে ‘নেটিভ’ শব্দটা ব্যবহার না করে তাদের ‘সিটিজেন’ বলে সম্বোধন করেন।৩৫ ইতিপূর্বে কোনও ইংরেজ প্রশাসক এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিতে পারেনি।

তাঁর লেখা অনেক চিঠিপত্রে তাঁর ভাবনাগুলো প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর বক্তব্য ছিল, উন্নয়ন বা পরিবর্তন যা-ই হোক না কেন, তাতে যেন জনসাধারণের সম্মতি থাকে। তিনি মনে করতেন, পৌরশাসন সম্পর্কে শহরবাসীর কেবল অবহিত হওয়াই যথেষ্ট নয়, তারা নিজেদের ইচ্ছে-অনিচ্ছে প্রকাশের সুযোগ লাভ করুক, নিজেরাই পেশ করুক শহরের স্বাচ্ছন্দ্য ও পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে নিজেদের ভাবনা-চিন্তা। ঔপনিবেশিক শাসনে কোনও শ্বেতাঙ্গ প্রশাসকের এই মানসিকতা শুধু অভূতপূর্ব এবং অভিনব নয়, ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্রের সঙ্গে একেবারে বেমানান। শহরের উন্নয়নে ভারতীয়দের অনাগ্রহ ও উদাসীনতা তাঁকে হতাশ করেছিল। সেজন্য তিনি তাদের ওপর আস্থা হারাননি। ১৮৩৮ সালে রাজা রাধাকান্ত দেব ও দ্বারকানাথ ঠাকুর কলকাতার ‘জাস্টিসেস্ অব পিস্’ হলে তিনি হর্ষ প্রকাশ করেন। তাঁর মনে হয়েছিল, ‘The greatest ends have often small beginning.’৩৬

সূত্রনির্দেশ

১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গদ্য গ্রন্থাবলী, ১৩শ ভাগ, সমাজ, কলকাতা (তারিখ নেই)

২. Sarmistha De, Marginal Europeans in Colonial India, প্রাগুক্ত, p. 17.

৩. Partha Dutta, Ranald Martin’s Medical Topography (1837), (Biswanath Pati and Mark Harrison (ed), The Social History of Health and Medicine in Colonial India, Delhi, 2011, pp. 15-26)

৪. General Committee of Fever Hospital and Municipal Improvement, 1839. Appendix, F, p. 378. (এরপর থেকে Fever Commtt. Report.)

৫. James Ranald Martin, Notes on the Medical Topography of Calcutta, Cajcutta (1837) p. 45

৬. তদেব, p. 28

৭. Report of the Committee for the establishment of a fever Hospital, 1839, vol. 5, Appendix-A, p. 18

৮. Letters from the Court of Directors (Judicial), September 30, 1803

৯. তদেব, February 28, 1805

১০. Fever Commtt. Report, Appendix-F pp. 418-419

১১. তদেব, 1839, vol. 5, p. 1

১২. তদেব, 1840, p. 45

১৩. তদেব, vol. 5, Appendix-A, p. 15

১৪. Letters to the Court of Directors (Judicial), July 19, 1836

১৫. Judicial (criminal) Proceedings, June 16, 1835

১৬. Fever Commit. Report, Appendix D-E, p. 284

১৭. তদেব

১৮. তদেব, p. 293

১৯. তদেব, Appendix-D, p. 283

২০. তদেব

২১. Judicial (criminal) Proceedings, November 22, 1836

২২. Centenary of the Medical College, Bengal 1835-1934 (Souvenir 1936) pp. 37-38

২৩. E. M. Collingham, প্রাগুক্ত, pp. 20-21

২৪. Judicial (criminal) Proceedings, 30 November, 1830

২৫. তদেব, January 25, 1822

২৬. Fever Commtt. Report, (1839), appendix-F, p. 368

২৭. Judicial (criminal) Proceedings, May 23, 1835

২৮. Report of the Committee for the Establishment of a Fever Hospital, 1839, Appendix C, p. Clxxix

২৯. তদেব, Appendix-B, p. 288

৩০. Judicial (criminal) Proceedings, April 27, 1841

৩১. General Committee of Fever Hospital, Vol. 5, p. 671

৩২. Judicial (criminal) Proceedings, March 10, 1840

৩৩. Fever commtt. Report, Appendix D-E, p. 283

৩৪. তদেব, Appendix-F, p. 355

৩৫. তদেব, Appendix-F, p. 364

৩৬. তদেব, p. 358

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *