কোন বাণিজ্যে
প্রকৃত ব্যবসায়ী যিনি, তিনি সর্বদাই ব্যবসা করেন। শয়নে-স্বপনে, পথে-ঘাটে সর্বদা, সব সময়ে তাঁর ব্যবসার চিন্তা। এমনকী মৃত্যুর মুহূর্তেও সে চিন্তা তাঁর মাথা থেকে যায় না।।
মৃত্যুপথযাত্রী ব্যবসায়ীকে নিয়ে গল্পের অন্ত নেই। একটি পুরনো গল্প স্মরণ করা যেতে পারে। একজন বড় দোকানদার মৃত্যুশয্যায় শায়িত, তাঁর শেষ নিশ্বাসের মুহূর্ত খুব দূরে নয়। তিনি ক্ষীণ কণ্ঠে সকলের খোঁজ নিতে লাগলেন।
প্রথমে বড় ছেলের খোঁজ পড়ল, ‘অমল কোথায়?’ অমল মাথার কাছে দাঁড়িয়েছিল, সে বলল, ‘এই যে বাবা, আমি এখানে।’ অতঃপর বিমল, কমল ইত্যাদি অন্যান্য পুত্রের অনুসন্ধান করলেন, দেখা গেল সকলেই সমান পিতৃভক্ত, শেষ শয্যার পাশে সকলেই দণ্ডায়মান। ছেলেদের রোলকল শেষ হয়ে যাওয়ার পর নাতিদের অনুসন্ধান করলেন বৃদ্ধ। দেখা গেল তারাও সকলেই ওই ঘরের মধ্যে দাদুর কাছেই রয়েছে। মৃত্যুপথযাত্রী এবার ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে পড়লেন, একজন মুমূর্ষুর পক্ষে যতটা কণ্ঠস্বর বাড়ানো সম্ভব তার থেকে বেশি বাড়িয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘তা হলে? তা হলে দোকানে কে রয়েছে? তোমরা সবাই দোকান খালি করে এখানে চলে এসেছ? আমার মরার পরে ব্যবসা তো লাটে উঠবে দেখছি।’
আরেক মৃত্যুপথযাত্রীর কাহিনী জানি, সেটি কিঞ্চিৎ বীভৎস রসের। এক ব্যবসায়ী তাঁর অংশীদারকে খুন করেছিলেন। আদালতের বিচারে তাঁর ফাঁসির হুকুম হয়। ফাঁসির আগের দিন জেলখানার এক কর্মচারী কথায় কথায় তাঁকে বলে যে, কাল তার ফাঁসি দিতে সরকারের প্রায় পাঁচশো টাকা খরচ হবে। শুনে সেই মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত ব্যবসায়ী জানতে চাইলেন, ‘এত কেন?’ তখন সেই কারাকর্মী হিসেব দিয়ে বললেন, ‘জল্লাদ আর তার সহকারীরা পাবে তিনশো টাকা, দড়ি. ও অন্যান্য ফাসির সরঞ্জাম, ফাঁসিকাঠে তেল লাগানো ইত্যাদি বাবদ একশো টাকা, আপনার ফাঁসির পোশাক, মুখ ঢাকা কালো কাপড় এসব বাবদ আরও একশো।’
খরচের বর্ণনা শুনে ব্যবসায়ী রীতিমতো স্তম্ভিত। তিনি বহুক্ষণ ধরে গম্ভীরভাবে কী ভাবলেন, তারপর বললেন, ‘জেল কর্তৃপক্ষ যদি একটা দড়ি আমাকে দু’টাকা দিয়ে কিনে দেয় আর আমাকে একশো টাকা দেয়, তাহলে আমি নিজেই গলায় দড়ি দিতে পারি, আমারও কিছু লাভ হয়, সরকারেরও কিছু সাশ্রয় হয়।’
ব্যবসার বিষয়ে বলতে আরম্ভ করে চলে গেলাম একেবারে জেলখানার ভিতরে ফাঁসির কাঠগড়ায়। এসব বীভৎস ব্যাপার পরিত্যাগ করে এবার আসল ব্যবসার প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
ধর্মতলার মোড়ে দু’জন ফলওয়ালা পাশাপাশি বসে৷ যে সময়ের যে ফল, বর্ষায় পেয়ারা, গরমে আম, শীতে কমলালেবু দু’জনে একই রকম ফল বেচে। শুধু একই রকম ফল নয়; দু’জনের ফলের বর্ণ, গন্ধ, আকার, আয়তন সর্বদাই একরকম, দেখে মনে হয় যেন একই ঝুড়ির ফল দু’জনে ভাগ করে বেচছে। কিন্তু গোলমাল রয়েছে এক জায়গায়, দু’জনের দাম দু’রকম। একজন মোটা, কালো তার নাম মোটা মিঞা তার ফলের দাম সর্বদাই চড়া, এক কাঠি ওপরে। দ্বিতীয় জন রোগা, ফর্সা, তার নাম পাতলা খাঁ। তার দাম কম। একই রকম দেখতে একই সাইজের ল্যাংড়া আম মিঞাসাহেব দশ টাকার এক পয়সা কম দামে দেবেন না। ওপাশে খাঁ সাহেব সেই একই আম আট টাকা, সাড়ে সাত টাকায় বেচছেন। সুতরাং খাঁ সাহেব যখন রমরমা ব্যবসা করছেন, তখন মিঞা সাহেবের ভাঁড়ে মা ভবানী অর্থাৎ বিক্রিবাটা শূন্য। দু’-এক ঘণ্টার মধ্যে আম হোক, পেয়ারা হোক বা কমলালেবু হোক, খাঁ সাহেবের সমস্ত ফল উড়ে যাচ্ছে আর মিঞা সাহেব তখনও চড়াদাম হেঁকে খদ্দের তাড়াচ্ছেন।
মিঞা সাহেব কেন এমন করছেন, তাঁর এতে লাভ কী? আসলে মিঞা সাহেব বোকা লোক নন। তাঁর আর খাঁ সাহেবের একই ব্যবসা, দু’জনেই সমান অংশীদার। মিঞা সাহেবের দাম বেশি বলেই খদ্দেররা চটপট শস্তায় একই ফল খাঁ সাহেবের কাছ থেকে কম দামে কিনে নেয়। খাঁ সাহেবের ফল ফুরিয়ে গেলে তখন মিঞা সাহেব তার ঝুড়ি থেকে আবার অর্ধেক ফল তাকে দিয়ে দেন, ব্যবসা জোর জমে ওঠে, মিঞা সাহেব হাঁকতে থাকেন, ‘দশ রূপেয়া, দশ রূপেয়া…’ পাশেই খাঁ সাহেব আরও জোর গলায় হাঁকেন, ‘আট রূপেয়া, আট রূপেয়া…।’
আবার এমন খদ্দেরও জুটে যায় যে দাম বেশি দিয়ে মিঞা সাহেবের ফলটাই কেনে, কারণ তার ধারণা, যা কিছুর দাম বেশি তাই ভাল। এ রকম খদ্দের জুটলে তো কারবারে একেবারে ষোলো আনা লাভ।
একই জিনিস বেশি দামে কেনার ব্যাপারটা কিন্তু ঠিক গল্প নয়। এটা ক্রেতা মনস্তত্ত্বের একটা বড় দিক। মার্কিন দেশে কিছুদিন আগে একটা সমীক্ষা হয়েছিল। একটা পাঁচ ডলার দামের মাখনের প্যাকেট ঠিক সমান দু’ভাগে ভাগ করে এক ভাগের দাম রাখা হল তিন ডলার আর অন্য ভাগের দাম দু’ডলার। দোকানের তাকে দু’ভাগে অর্ধেক অর্ধেক করে দু’ডলার দাম লেখা এবং তিন ডলার দাম লেখা মাখনের প্যাকেটের অর্ধাংশগুলো সাজিয়ে রাখা হল। দেখা গেল ক্রেতারা অধিকাংশই ওই বর্ধিত মূল্যের তিন ডলারের টুকরোগুলো নিয়েছেন; দু’ডলার দামের ওই একই মাখন তাঁরা নিকৃষ্ট ভেবে এড়িয়ে গেছেন।
আসলে ব্যবসা বাণিজ্য খুব সোজা ব্যাপার নয়। যার হয়, তার এমনিতেই হয়, যার হয় না কিছুতেই হয় না। আবার যার আজ হয় তার হয়তো কাল হয় না। ব্যবসায় সফল হওয়ার যেমন অনেক অঙ্ক অনেক হিসেব আছে তেমনই আবার কখনও কোনও অঙ্ক কোনও হিসেবই মেলে না। উনিশশো পঁচাশির হিসেব উনিশশো ছিয়াশিতে মেলে না, রামবাবুর অঙ্ক আর শ্যামবাবুর অঙ্ক মিলতে চায় না। দুইয়ে আর দুইয়ে মাঝে মধ্যে চার অবশ্যই হয় আবার কখনও শূন্য হয়, অন্য দিকে কারও সৌভাগ্যে বাইশ পর্যন্ত হতে পারে।
কবি বলেছিলেন, ‘যাবই আমি/…বাণিজ্যেতে যাবই, তোমায় যদি না পাই তো তবু আর কারে তো পাবই।’ কবির পাওনা আর বণিকের পাওনা এক নয়। কবি হয়তো সব অবস্থাতেই কিছু না কিছু পেয়ে যান, কিন্তু বহু পরিশ্রম, বহু ক্লান্তির পরে বালু মরুর তীরে শূন্য হাতে ফিরে আসা মহাজনের সংখ্যা কম নয়।
এই রকম এক একদা-সচ্ছল, এখন সর্বস্বান্ত মহাজনকে এক সন্ধ্যাবেলা দু’জন ছিনতাইকারী রাস্তার মধ্যে ধরেছিল। প্রায় পনেরো মিনিট ধরে সেই ব্যবসায়ী লড়ে গেলেন গুণ্ডা দু’জনের সঙ্গে। কিন্তু অবশেষে কাবু হয়ে আত্মসমর্পণ করলেন। তাঁর শার্টের পকেট থেকে অনেক খুঁজে একটি মাত্র আধুলি পাওয়া গেল, তখন এক নম্বর ছিনতাইকারী দু’ নম্বর ছিনতাইকারীকে বলল, সর্বনাশ! এর কাছে যদি পুরো একটা টাকাও থাকত, তাহলে আর আমাদের প্রাণে বাঁচতে হত না।’