কোনও একদিনে
রাত এখন অনেক। এখনও আলো জ্বলছে ডক্টর মহলানবীশের ল্যাবরটরিতে। বন্ধ কাচের জানালা দিয়ে উঁকি মারতেই চোখে পড়বে চারপাশে অনেক রকমের কাচের জার। অ্যামনিওটিক ফ্লুইডে ভরতি। আর ওর মধ্যে রয়েছে নানান আকারের মানব জ্বণ। খুব মন্থরভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে জারের মধ্যে।
ডক্টর সমরজিৎ মহলানবীশের নাম আজ আর কারুর অজানা নয়। বায়োকেমিস্ট ডক্টর মহলানবীশ এক নতুন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন মানব সভ্যতাকে। তার ফলেই শক্তি বুদ্ধি সৌন্দর্যে এক নন্দনকানন হয়ে উঠবে আমাদের এই পৃথিবী।
ঘরের এক পাশে চাকা লাগানো একটা টেবিলের ওপরে অনেক রকম ডাক্তারি যন্ত্রপাতি। মাঝখানে একটা ছোট টেবিল আর চেয়ার। টেবিলের উপর একটা মোটা ডায়েরি খোলা। জন্মমুহূর্তের অতিসূক্ষ্ম এক বিন্দু রক্তের ফোঁটা থেকে শুরু করে মরিউলা, ব্লাস্টোসিক হয়ে পূর্ণতা প্রাপ্ত ছয়-সাত পাউন্ডের মানব শিশুরা ছড়িয়ে রয়েছে ঘরের চারদিকে। দুধের উপর থিরথিরে কাঁপা পাতলা সরের মতো সবেমাত্র চামড়া গজিয়েছে। কোনও কোনও জ্বণের। কারুর বা আবার পায়ের নখ থেকে শুরু করে নিখুঁতভাবে তৈরি হয়ে উঠেছে চোখ মুখ নাক… আর সেই ক্ষুদে মুখগুলো থেকে থেকে হাঁ করে উঠছে একই ছন্দে।
কতকগুলো পূর্ণতাপ্রাপ্ত জারের সামনে থমকে দাঁড়ালেন ডক্টর মহলানবীশ। কী সুন্দর দেখাচ্ছে ওদের। ছোট মুখগুলো মিষ্টি মিষ্টি হাঁ করছে। পদ্মকলির মতো কচি আঙুলগুলো মুঠো হচ্ছে আর খুলছে। প্রতিটি জারের থার্মোমিটার আর কৃত্রিম গর্ভ-ফুলগুলোকে খুব ভালোভাবে লক্ষ করলেন ডক্টর। জ্বণগুলোকে মাঝে মাঝে নাড়িয়ে দিলেন স্পাটুলা দিয়ে। আর বহুদিনের অভিজ্ঞতায় সহজেই বুঝতে পারলেন যে কোনও লাভ নেই এদের মধ্যে কয়েকটি জ্বণকে বাঁচিয়ে রেখে। সঙ্গে সঙ্গে বিষাদে ভরে উঠল মন। কিন্তু কর্তব্য বড় নিষ্ঠুর। তাই একটা লাল পেন্সিল দিয়ে X চিহ্ন মেরে দিলেন কয়েকটা জারে।
এই বিশেষ প্রজনন বিদ্যার গবেষণা চলেছে পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্রে। ভারতবর্ষও পিছিয়ে নেই। তার প্রমাণ এই ল্যাবরেটরি, ডক্টর স্বয়ং আর ওঁর যোগ্য সহকর্মীরা। বিশেষভাবে নির্বাচিত সুস্থ সবল নর-নারীর স্পার্মসেল (পুং বীজ) ও ওভা (স্ত্রী বীজ)-গুলোকে পৃথক পৃথকভাবে নিয়ে আসা হয় এখানে। তারপর খুব জটিল প্রক্রিয়ায় জারের মধ্যে কৃত্রিমভাবে এদের মিলন ঘটিয়ে সৃষ্টি করা হয় জ্বণের। মাতৃ জীবের প্রায় সমস্ত পরিবেশ রয়েছে জারগুলোতে। এমনকী আহার্য গ্রহণ করে প্লাস্টিকের নকল গর্ভ-ফুলের মাধ্যমে। গত বিশ বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন ডক্টর মহলানবীশ। আর সেই সঙ্গে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে মানব বংশধারার সবদিক থেকে ক্রমাবনতির মূল কারণ হচ্ছে স্ত্রী পুরুষের ইচ্ছামতো মিলন। অথচ শক্তি বুদ্ধি সৌন্দর্যে এক বিস্ময়কর মিলন ঘটেছে ল্যাবরেটরিতে সৃষ্ট প্রতিটি জীবনের মধ্যে। শুধু তাই নয়, অচিরেই সন্তান বহনের অস্বস্তিকর পরিবেশ থেকে মুক্তি পাবে মাতৃ জাতি৷ এক সুদূরপ্রসারী বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে মানব সভ্যতা।
x চিহ্ন মারা জারগুলোকে একে একে একপাশে জড় করলেন ভক্টর। গভীর মমতা মাখানো চোখে প্রতিটি জ্বণকে লক্ষ করলেন। অ্যামনিওটিক ফ্লুইডের মধ্যে ধীরে ধীরে ঘুরছে জণগুলো। কচি কচি আঙুলগুলো যেন কোনও এক সংকল্পে মুঠো হয়ে উঠেছে। বড় বড় চোখগুলো বোবা ভাষায় যেন বাত্ময়। না, বেশিক্ষণ এভাবে থাকলে দুর্বল হয়ে উঠবে মন। নিরুপায় স্নেহময় পিতার মতো করুণ হয়ে উঠল চোখ-মুখ। তাড়াতাড়ি x চিহ্ন দেওয়া একটা জার থেকে এক টানে খুলে ফেললেন গর্ভফুলের নলটাকে। আকস্মিক আঘাতে চমকে উঠল ভ্রণটি। লক্ষ লক্ষ শিশুকণ্ঠ যেন কাতর আর্তনাদ করে উঠল ডক্টরের মাথার মধ্যে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে অবশ হয়ে পড়ল সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। নরম হাত দুটো তুলে যেন বারণ করল একবার। মৃত্যু যন্ত্রণায় কেঁপে কেঁপে উঠল ওর ছোট্ট দেহটা। শেষবারের মতো মিনতি জানাল নির্বাক চোখদুটো। নিজেকে সামলে নিলেন ডক্টর মহলানবীশ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কি দুর্বল হয়ে পড়ছেন–ভাবলেন একবার। তারপর অকম্পিত হাতে জলে ভরতি করে দিলেন জারটাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে দশটা জল ভরতি জার ল্যাবরেটরির বাইরের টেবিলের উপরে সাজিয়ে রাখলেন ডক্টর। জল মেশানো অ্যামনিওটিক ফ্লুইডের মধ্যে ডুবে রইল দশটি মানব শিশু। জীবন পেয়েও যাদের ফুটে ওঠা সম্ভব হল না।
দড়াম করে ল্যাবরেটরির দরজা খুলে ঘরে ঢুকল একটি মেয়ে। উত্তেজনায় কাঁপছে সমস্ত শরীর।
স্যার…
কে? অনিতা? তুমি?
থাকতে পারলাম না স্যার। ঘুমের মধ্যে কেমন যেন চমকে উঠলাম।
কেন অনিতা কোনও দুঃস্বপ্ন দেখেছ?
কী যে হল তা ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না। কচিকচি গলায় কারা যেন মা-মা বলে ডাকল। ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল আমার ছেলের কথা। সে কোথায় স্যার? শুধু একবার দেখব।
বোস, বোস অনীতা। তুমি জানো…
না না, স্যার, শুধু একবার…
অনীতা তুমি না আমার ছাত্রী। তোমার কিছু তো অজানা নয়। বাঁচার অধিকার সকলের…
কী, কী বললেন স্যার…
শাড়িটা লুটোতে লুটোতে চক্ষের পলকে বেরিয়ে গেল অনীতা। প্রথম জারটার দিকে নজর পড়তেই মাথাটা ঘুরে উঠল। জারের গায়ে বড় বড় করে লেখা শ্রীমতি অনীতা সোম ও পার্থনীল ঘোষ। জারটাকে বুকে জড়িয়ে ফিরে এল অনীতা। দু-চোখে নেবেছে তখন শ্রাবণের ধারা।
স্যার আমার যে…
অনীতা শান্ত হও।
না, না, স্যার… গলা বুজে এল কান্নায়।
শেষ বারের মতো ভ্রূণটি হঠাৎ চোখ মেলে দেখল অনীতাকে, মা-কে।
এই তো, এই তো স্যার তাকাল, শুধু একবার বাঁচিয়ে দিন..
না অনীতা, ওর বাঁচার অধিকার নেই।
স্যার, আমি মা-মায়ের অধিকার… না না, আপনি বুঝবেন না কত কী ভেবেছি মনে মনে… কান্নায় ভেঙে পড়ল অনীতা।
কোনও সান্ত্বনাবাক্য বেরুল না ডক্টরের মুখ দিয়ে। অব্যক্ত যন্ত্রণায় ভরে উঠল সমস্ত মন।
অরুদ্ধ কণ্ঠে অনীতা আবার বলে উঠল, স্যার, না-ই বা হত ওকে দিয়ে আপনাদের কোনও মহৎ কাজ। আমার ছেলে হয়েই না হয় থাকত আমার কাছে। মা বলে ডাকত আমায়… উঃ, না না, এ কী করলেন…
ফুলে ফুলে কাঁদছে অনীতা। নিশ্চল ড্যাবডেবে চোখে জ্বণটি তাকিয়ে রইল ওর মায়ের দিকে।
ঘরের চারপাশে জারের মধ্যে অনেকগুলো কচি কচি নর-বানরাকৃতি মানব ভ্রূণগুলো কেবল ঘুরছে আর ঘুরছে।
[প্রথম প্রকাশ: বিস্ময় সায়েন্স ফিকশন, জুলাই-আগস্ট ১৯৭১]